১
ঋভু সেনগুপ্ত ভোরবেলা কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেই বুঝে গিয়েছিল—এই যাত্রা তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত আর অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে। সাংবাদিক জীবনে সে বহু ঘটনা দেখেছে, বহু মানুষ, কিন্তু এমন এক গুহার অস্তিত্ব—যেখানে আজও ‘দক্ষিণাগ্নি’ নামে তান্ত্রিক যজ্ঞ হয়, তা শুনে প্রথমে অবিশ্বাসই করেছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেই তার হাতে এসে পড়েছিল এক পুরনো চিঠি, যা লিখেছিলেন একজন মৃত প্রত্নতত্ত্ববিদ—ড. বিভাস মুখোপাধ্যায়। চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত এক অরণ্যঘেরা গুহার, যেখানে “দেহান্তরণ” নামক এক প্রাচীন তন্ত্রচর্চা আজও গোপনে চলে। চিঠিতে লেখা ছিল একটি মাত্র লাইন: “যদি সত্য জানতে চাও, তবে আগুনকে ভয় পেও না। দক্ষিণাগ্নি সব জানে।” সেই লাইন আজও ঋভুর মাথায় বাজে, যেন প্রতিটি অক্ষর তার বুকের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেয়। স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন সে ট্রেন ধরার অপেক্ষায়, তখনও তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভিতরে ক্যামেরা, নোটবুক আর সেই চিঠির প্রতিলিপি—সবকিছুই যেন নিঃশব্দে প্রস্তুত হচ্ছিলো অজানার দ্বারে পা রাখার জন্য।
রাঁচি পৌঁছে ঋভু প্রথমে দেখা করে তিস্তা সরকারের সঙ্গে। একসময় তারা এক কলেজে পড়ত, কিন্তু তিস্তা পরে প্রত্নতত্ত্বে গবেষণা করতে রাঁচি চলে আসে। এই যাত্রায় সে ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারত না। তিস্তা প্রথমে অবিশ্বাস করলেও যখন চিঠিটা পড়ে, তার চোখেও ভয় আর উত্তেজনার ঝিলিক দেখা যায়। সে জানায়—ঝাড়খণ্ডের গরুডি ব্লকের গভীরে সত্যিই এক পুরনো গুহা আছে, যার নাম স্থানীয় লোকেরা মুখে আনতে ভয় পায়। বলা হয়, রাতে সেখানে আগুন জ্বলে, অথচ কেউ দেখেনি কে জ্বালায়। গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করে, সেই আগুন সাধারণ নয়—তা আত্মা পোড়ায় না, বরং আত্মা স্থানান্তরিত করে। তিস্তার গাইড হিসাবে ঠিক হয় অভিজিৎ সিংহ, একজন স্থানীয় ট্রেকার, যার পরিবার ওই অঞ্চলের বহু পুরনো বাসিন্দা। অভিজিৎ শুরুতে গাইডিংয়ের টাকা নিলেও, যখন শুনল গন্তব্য ‘চাঁদের গুহা’—তার মুখ শুকিয়ে গেল। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তাকে রাজি করানো হয়, কিন্তু সে শর্ত রাখে—গোটা সফরে এক ফোঁটাও ভুল করা যাবে না। তারা তিনজনে শুরু করল যাত্রা—ঘন অরণ্যের ভিতর দিয়ে, অচেনা পথের দিকে। দিনের আলো যতই কমতে লাগল, পথ যেন ততই গা-ছমছমে হয়ে উঠছিল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শুকনো পাতার ওপর পায়ের শব্দ, দূরের কোন অজানা পাখির হঠাৎ চিৎকার—সব মিলিয়ে যেন সময়ও থমকে ছিল।
চার ঘণ্টা ট্রেক করার পর, ঠিক যখন অরণ্য নিঃশব্দ আর বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, অভিজিৎ এক চওড়া শালগাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। “এইখানেই শুরু হয় ছায়ার রাস্তা,” ফিসফিস করে বলল সে। আর তার ঠিক পেছনে, ঘন লতাগুল্মের আড়ালে, একটা পাথরের দরজা দেখা গেল—যা দেখে মনে হয় যেন প্রাকৃতিক, অথচ চোখে পড়ার মতো নিখুঁত গোলাকৃতি। দরজার পাশে খোদাই করা এক অদ্ভুত প্রতীক—যা তিস্তা সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারে: “এটা প্রাচীন তান্ত্রিক মুদ্রা… দক্ষিণাগ্নির চিহ্ন,” সে বলে ওঠে। গুহার ভিতরে ঢোকার আগে তারা তিনজনে একবার মুখ চেয়ে নেয়। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, কাষ্ঠ আর… কিছু একটা পোড়ার মতো। ভিতরে পা দিতেই ঋভু বুঝতে পারে—এখানে সময় আর আলো আলাদা নিয়মে চলে। গুহার দেয়ালে মশাল টাঙানো, যেগুলোর আগুন যেন বাতাসে নড়ে না, স্থির। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ যেন কানে আওয়াজ তোলে না, অথচ মনে হয় কেউ পেছন পেছন হাঁটছে। আচমকা এক বাঁক পেরিয়ে তারা দেখে এক বিশাল গর্ভগৃহ—কেন্দ্রে কালো পাথরের বেদি, যার চারদিকে আগুন জ্বলছে, আগুনের রঙ লাল নয়, নীলচে। সেই আগুনের পেছনে দাঁড়িয়ে এক নারী—কালো বসনে, সিঁদুররাঙা কপালে, চোখদুটি যেন শতাব্দীর অভিশাপ নিয়ে উঁকি মারছে ভবিষ্যতের দিকে। সে বলল না কিছুই, শুধু আঙুল তুলে ঋভুর দিকে দেখাল—আর তখনই ঋভু বুঝতে পারল, এই যাত্রা সে নিজেই নয়, বরং তার দেহটাই আসল টার্গেট।
২
ঋভুর মনে হচ্ছিল যেন সে কোনও প্রাচীন নিদ্রাভঙ্গ করা শবমঞ্চে এসে পড়েছে, যেখানে চারদিকে আগুন জ্বলছে অথচ কোনও উষ্ণতা নেই, বরং চারপাশে জমাটবাঁধা এক নিঃশব্দ ঠান্ডা। মাঝখানের বেদির পাথরটি কালো এবং চকচকে, যেন হাজার বছর ধরে কেউ বারবার ছুঁয়ে গেছে। বেদির চারদিকে কিছু নিখুঁত বৃত্ত আঁকা, যেগুলো পাথরে খোদাই করা নয়—জীবন্ত, যেন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে আবার ফিরে আসে। আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই নারী—বহ্নিশিখা—যার চোখ যেন সরাসরি ঋভুর স্নায়ুতন্ত্রে গেঁথে গেল। মুহূর্তে তার ভেতরে এক গা ছমছমে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল, একটা স্বপ্ন ও জাগরণময় দ্বৈতবাস্তবতায় সে আটকে গেল। বহ্নিশিখা কোনও শব্দ না করেও যেন তার চিন্তা পড়তে পারছিল। হঠাৎ সে এক হাতে আকাশের দিকে তুলে নিল ধূপে ভরা পাত্র, আর অন্য হাতে মাটিতে আঁকতে থাকল কিছু জটিল প্রতীক। সেই অক্ষরগুলো তিস্তার চোখে পড়তেই সে চমকে উঠল—এগুলো আয়ুর্বেদের নয়, বরং প্রাচীন ভৈরবী-তন্ত্র থেকে নেওয়া, যেগুলো দেহান্তর প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হত।
তিস্তা এক ধাক্কায় ঋভুর হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “ঋভু, আমরা ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। এটা কোনও সাধারণ তন্ত্রকক্ষ নয়। এরা তোমার শরীরটাই চাইছে, আত্মার জন্য।” অভিজিৎ তখন ইতস্তত করে পেছন দিকে সরে যেতে চাইছিল, কিন্তু ঠিক তখনই এক অন্ধকার করিডোর থেকে উঠে এল আরও চারজন—তাঁদের মুখে মুখোশ, হাতে ত্রিশূল আর গলায় অদ্ভুত মণির মালা। তাদের চোখদুটোও ছিল স্থির, ঠান্ডা, অথচ তীব্রভাবে জাগ্রত। তারা তিনজনকে ঘিরে ফেলল নিঃশব্দে, যেন নিঃশ্বাস ফেলার শব্দটুকুও পাপ। বহ্নিশিখা এবার এগিয়ে এসে প্রথমবার কথা বলল, তার গলা ছিল ধ্বনি আর ধ্বংসের মিশেলে গড়া, যেন ধুপোর আগুনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে: “ঋভু সেনগুপ্ত, তুমি নিজেই আমাদের কাছে এসেছ। এখন তোমাকে নিয়েই আমাদের যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। তুমি ভাগ্যবান—দক্ষিণাগ্নির আগুনে পোড়া মানে অনন্তে স্থানান্তর।” তিস্তা কিছু বলতে যাবে এমন সময় এক মুখোশধারী তার দিকে এগিয়ে আসে, কিন্তু হঠাৎ করেই মাটিতে কেঁপে ওঠে পুরো কক্ষ। যেন কোনও শক্তি এখানকার ভারসাম্য নষ্ট করছে।
আচমকা গুহার ভেতরেই ছাদ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ে ঋভুর কাঁধে—সেই জল অস্বাভাবিক ঠান্ডা, আর সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য—এক বৃদ্ধ, এক গুহার মুখে দাঁড়িয়ে বলছেন, “শরীর ক্ষয় হয়, কিন্তু আত্মা যদি আবদ্ধ হয়, তবে সে চিৎকার করে মুক্তি চায়।” দৃশ্যটা এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, কিন্তু ঋভু বুঝতে পারল—এটা ছিল এক সতর্কবার্তা, কে জানে কার আত্মা থেকে উৎসারিত। সে এবার চোখ তুলে সরাসরি বহ্নিশিখার দিকে তাকাল। “তোমরা যা করছ, তা তো আত্মার হত্যা। শরীর বদল নয়—এটা আত্মা বন্দী করে রাখার যজ্ঞ।” বহ্নিশিখা হেসে উঠল, “কী জানো তুমি আত্মা সম্বন্ধে? আত্মা কি স্বাধীন? না কি শুধু একটা জ্বালানি?” গুহা এবার আবার কেঁপে উঠতে লাগল। দূর থেকে শুনতে পাওয়া গেল মন্ত্রোচ্চারণের তীব্র শব্দ, আর সেই সঙ্গে কক্ষের চারপাশে আগুনের রং বদলে গেল—নীল থেকে সাদা, আর সেখান থেকে ধূসর। তিস্তা এক ঝটকায় একটি মশাল ছুঁড়ে মারল মুখোশধারীদের দিকে, আর সেই সুযোগে ঋভু তার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দিল বারবার। হঠাৎ করে আলো আর শব্দের তীব্রতা গুহার ভারসাম্য নষ্ট করে দিল—আর তখনই শুরু হল পালানোর এক পাগলপ্রায় দৌড়, যা শুধু দেহ বাঁচানোর জন্য নয়, আত্মাকে মুক্ত রাখারও চেষ্টায়।
৩
তারা দৌড়োতে শুরু করল বুনো জন্তুর মতো, অথচ পায়ের নিচের জমি যেন ক্রমশ সরতে লাগল। গুহার করিডোর এত জটিল আর গোলকধাঁধার মতো ছিল যে, একবার পেছনে ফিরলে আর বোঝা যেত না তারা আগের পথে আছে কিনা। মাটির গভীর থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত আওয়াজ—কখনও কারো কান্না, কখনও দমবন্ধ করা চাপা চিৎকার, আবার কখনও মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি। তিস্তার মুখ ঘামজলায় ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত সংকল্প। ঋভুর হাত টেনে ধরে সে বলল, “এই গুহা শুধু একটা স্থান নয়, এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ। যারা একবার ঢোকে, তারা আর আগের মতো থাকে না।” অভিজিৎ তখন সামনের পথ ধরে একটা গোপন ফাটল দিয়ে তাদের নিয়ে গেল—যেটা সে বহুদিন আগে আবিষ্কার করেছিল কিন্তু কখনও ব্যবহার করেনি। গুহার সেই অংশে ঢুকে মনে হল সময় থেমে গেছে। দেয়াল জুড়ে অজস্র প্রতিচ্ছবি—মাথাহীন শরীর, কংকালধারী পুরোহিত, আর আগুনের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা মুখ—যেন তারা সবাই চায় তাদের কথা কেউ শুনুক।
ঋভুর পায়ে কিছু একটা ঠেকে। সে নিচু হয়ে দেখে একটি পুরনো খয়েরি কাগজে মোড়া ডায়রি। খুলে দেখে—এটা সেই ড. বিভাস মুখোপাধ্যায়ের লেখা, যিনি সেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পাতাগুলো ঝুরঝুরে, কিন্তু কিছু শব্দ স্পষ্ট: “এই যজ্ঞ নিছক আত্মা স্থানান্তর নয়—এ হল আত্মাকে নিজের দেহ ভুলিয়ে, নতুন দেহে বন্দি রাখার পদ্ধতি। দক্ষিণাগ্নি আসলে এক ভয়ঙ্কর জীবনচক্র, যেখানে কারও মৃত্যু মানে অন্য কারও জন্ম। যে একবার বেদির কেন্দ্রে পড়ে, সে আর নিজের নয়।” ডায়রির শেষ পাতায় একটা আঁকা—এক খোলা চোখ, যার মণি-চোখের বদলে আগুন। ঋভু বুঝে গেল—এই বেদি শুধু আত্মার নয়, এটি এক ধ্বংস ও পুনর্জন্মের কেন্দ্র। সে তিস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তারা শুধু আমাকে চায় না। তারা এমন দেহ খোঁজে যার আত্মা যথেষ্ট শক্তিশালী—যে আত্মা প্রতিরোধ করতে জানে। তাদের পুরনো আত্মাগুলো হয়তো নিজের শরীর ভুলে গেছে, কিন্তু আমি পারব না।” তিস্তা ধীরে মাথা নাড়ল। “তুমি পারবে, কারণ তুমি এখনও ভয় পাও। আর ভয় থাকা মানেই তুমি পুরোপুরি দখলযোগ্য নও।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই গুহার ভেতরে ঘন কালো ধোঁয়া জমতে শুরু করল। চারপাশ ঝাঁপসা হয়ে এল, আর সেই সঙ্গে শোনা গেল বহ্নিশিখার গলা—এইবার অনেক দূর থেকে, অথচ যেন মাথার ভিতরে। “তুমি পালাতে পারবে না ঋভু। তুমি আমাদের পছন্দ। তোমার আত্মা এখনও জ্বলছে, আর আমরা চাই সেই আগুন।” গুহার দেয়াল হঠাৎ কেঁপে উঠল, আর একপাশ থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল এক ছায়ামূর্তি—একদম মানবদেহের মতো, কিন্তু মাথাহীন। ছায়াটি সরাসরি ঋভুর দিকে এগিয়ে এল, তার বুকে হাত রাখতেই ঋভু হঠাৎ অতীতের কোনো এক সন্ধ্যায় ফিরে গেল—সে দেখল ছোটবেলা, বাবার মুখ, সেই মৃত্যুদিন, হাসপাতালের করিডোর, বাবার মৃতদেহের গা ছুঁয়ে উঠেছিল আগুনের ছোঁয়া। সেই স্মৃতিতে লুকিয়ে ছিল তন্ত্রের ছায়া, যাকে সে এতদিন অস্বীকার করেছিল। ফিরে এসে সে বুঝল—এই গুহার সঙ্গে তার নিজের রক্তের সম্পর্ক আছে। হয়তো তার বাবা কোনওদিন দক্ষিণাগ্নির প্রান্তেই ছিল। আর এবার—ঋভুকে তাদেরই উত্তরসূরি বানাতে চায় এই অন্ধকার।
৪
গুহার ধোঁয়ার মধ্য থেকে ছায়ামূর্তিটি মিলিয়ে যেতেই, এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত শব্দ থেমে গেল। যেন কেউ গুহার নিঃশ্বাস থামিয়ে দিয়েছে। ঋভু পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাটা আবার খুলে দেখে, যেখানে আগুনচোখ আঁকা ছিল। এবার সে লক্ষ্য করে চোখটির নিচে আরও কিছু লেখা ছিল, যা আগেই চোখে পড়েনি—“সংযোগ রক্তে, উত্তরাধিকার আত্মায়; যে আগুন একবার শরীরে জাগে, সে আর নিভে না।” পাঠ্যাংশটুকু দেখে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা ঘাম নামতে থাকে। তিস্তা ডায়রির পৃষ্ঠার উপর আঙুল রেখে বলল, “ঋভু, তোমার বাবার নাম কী ছিল?”—প্রশ্নটা হঠাৎ করে হলেও ভয়ানক সরল মনে হল। “অভিনাশ সেনগুপ্ত,” উত্তরে বলল ঋভু। তিস্তা থমকে গেল। সে ধীরে পেছনের পৃষ্ঠা উল্টে দেখাল—সেখানে একটি নাম লেখা: অভিনাশ সেনগুপ্ত, আয়ুর্বেদ গবেষক, দক্ষিণাগ্নি যজ্ঞ পর্যবেক্ষণ, ১৯৯৭। মুহূর্তে যেন সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। ঋভু এতদিন যাকে নিছক একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ভেবে এসেছে, সেই মৃত্যু ছিল না—তা ছিল বিসর্জন, উৎসর্গ। তার বাবা দক্ষিণাগ্নির গুহায় এসেছিলেন সেই প্রথম দলভুক্ত আধুনিক গবেষকদের একজন হিসেবে। কিন্তু তিনি ফিরে যাননি—তাকে আর ফেরা হতে দেওয়া হয়নি।
তিস্তা এবার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল, “ঋভু, তুমি দক্ষিণাগ্নির জন্য তৈরি হয়ে জন্মেছ। হয়তো তোমার বাবাও চাইতেন তুমি এখানে আসো, সত্য জানো। কিন্তু তুমি শুধু উত্তরাধিকারী নও, তুমি ব্যতিক্রম। তুমি সেই দেহ—যার আত্মা তাদের আয়ত্তে আনতে পারছে না।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখতে পেল, করিডোরের দেয়ালে টাঙানো ছায়াছবির মতো কয়েকটি দৃশ্য চলতে শুরু করেছে—একটি দৃশ্যে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, ঠিক ঋভুর মুখের মতোই, একটি মশালের আলোয় কিছু লিখছে। তার চারপাশে আগুনের বৃত্ত, মুখে করুণ অথচ অদ্ভুত শান্তির ছাপ। “ওই আমার বাবা,” ফিসফিস করে বলল ঋভু। মুহূর্তে সেই দৃশ্য আরেকটা চিত্রে রূপান্তরিত হল—বহ্নিশিখা যুবতী বয়সে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনেতার মতোই স্বাভাবিক অভিব্যক্তির এক অভিনাশ, যার পাঁজরের ওপর আঁকা দক্ষিণাগ্নির চিহ্ন। “তুমি যদি আমার উত্তরসূরি হও, তাহলে তোমার শরীরেও সেই চিহ্ন আছে,” বলল তিস্তা। ঋভু মনের ভয় সরিয়ে জামার ভিতর হাত দিয়ে স্পর্শ করল বাম বুকের পাশে—আর তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল, সেখানে একটা বস্তু আছে, যা এতদিন সে আঁচ করতে পারেনি। খুলে দেখে—তার বুকের চামড়ার নিচে, হালকা লালচে গাত্রচিহ্ন—এক আগুনের শিখার মতো—যা শুধুই আলোতে নয়, গুহার আগুনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আবার গুহা গর্জে উঠল, যেন কেউ তার শিকড় কেটে ফেলেছে। বহ্নিশিখা গর্জে উঠল দূরের অন্ধকার থেকে—“তুমি তাকে ফিরিয়ে এনেছ। আগুন তাকে মেনে নেয়নি, সে তখন ফিরে গিয়েছিল মাটির কাছে। কিন্তু এবার আমরা সফল হব। এবার আত্মা আর পথ খুঁজবে না, এবার শরীরই তাকে ডাকবে।” গুহার মধ্য থেকে অদ্ভুত শব্দে যেন কেউ জন্ম নিচ্ছে, একটা নতুন শরীর তৈরি হচ্ছে আত্মার পুরনো স্মৃতি থেকে। তিস্তা বলল, “এখনও সময় আছে। আমরা যদি গুহার মূল ‘সংযোগ বেদি’ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি, তাহলে চক্রভঙ্গ করা সম্ভব। সেই আগুন নিভিয়ে দিতে হবে, না হলে তোমাকে আর কোনওদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না।” অভিজিৎ, যিনি এতক্ষণ চুপ ছিলেন, হঠাৎ মুখ খুললেন, “আমার ঠাকুর্দা বলত, এই আগুনকে জলে নিভানো যায় না। একমাত্র সেই শরীর পারে এই আগুন নেভাতে—যার আত্মা আগুনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তুমি পারবে ঋভু। কারণ আগুন তোমার ভিতরে আছে, কিন্তু তুমি আগুন নও। তুমি তার ব্যতিক্রম।”
৫
গুহার মধ্যবর্তী করিডোর ধরে তারা এগিয়ে চলল—তিনজন, তিনটি আলাদা ইচ্ছা ও ভয় নিয়ে। তিস্তার হাতে ছিল এক ছেঁড়া তামার পাত, যাতে খোদাই করা ছিল ‘সংযোগ বেদি’ পৌঁছানোর পথচিহ্ন। অভিজিৎ সামনে থেকে মশাল হাতে পথ দেখাচ্ছিল, আর ঋভু পেছনে থেকে চুপচাপ তার বুকের ওপর আঁকা দক্ষিণাগ্নির চিহ্ন স্পর্শ করে চলছিল, যেন নিজের ভিতরের আগুনকে বোঝার চেষ্টা করছিল। চারদিকে পাথরের দেয়াল আর ছাদের ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছিল গেরুয়া রঙের ঝুলন্ত পাতাকাগুলি—যাদের ওপরে আঁকা ছিল অদ্ভুত প্রতীক ও চোখ। যত এগোচ্ছিল, করিডোর ক্রমেই সরু আর ঠান্ডা হয়ে উঠছিল, বাতাস যেন ভারী, অদৃশ্য কিছু তাদের পেছনে পেছনে আসছিল। “আর মাত্র এক বাঁক,” ফিসফিস করে বলল তিস্তা, “তারপর আমরা পৌঁছে যাব কেন্দ্রে, যেখানে যজ্ঞ শুরু হয় আর আত্মা-চক্র সম্পন্ন হয়।” ঠিক সেই মুহূর্তে তারা পৌঁছল এক বিশাল গোলাকৃতি কক্ষে—যার ছাদ ছিল গম্বুজাকৃতি, এবং কেন্দ্রে রাখা ছিল বিশাল এক পাথরের আসন। সেই বেদির চারপাশে ঘুরছিল আগুনের রেখা—জীবন্ত আগুন, যা স্থির থেকেও ছায়া ফেলছিল না। আর সেই আগুনের মাঝেই একটি বস্তুর আকৃতি—ধোঁয়ায় ঢাকা, ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
ঋভু কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কক্ষের তিনটি দরজা হঠাৎ নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। বেদির সামনের ধোঁয়ার মধ্য থেকে উঠে এল এক শরীর—মাথা নিচু, চুল এলোমেলো, পরনে কোনও জামাকাপড় নেই, শরীরের গায়ে লাল কালির আঁচড় আর শিকল। সেই শরীর ধীরে ধীরে মাথা তোলে—এবং ঋভু মুহূর্তেই বুঝে যায়—এটি তার বাবার শরীর। কিন্তু সেই শরীরের চোখে নেই কোনও পরিচিত আলোর রেখা, বরং রয়েছে অন্ধ, শূন্য দৃষ্টি—যেন ভেতরে আত্মা নেই, শুধু এক পুরোনো যন্ত্রণার ছায়া। তিস্তা বলল, “ওই হচ্ছে পূর্ব-আত্মা-ধারক দেহ। দক্ষিণাগ্নি যজ্ঞে যাদের আত্মা দেহ ত্যাগ করে, তাদের পুরোনো দেহকে বেদির পাহারাদার হিসেবে বন্দি করে রাখা হয়।” ঠিক তখনই বহ্নিশিখা প্রবেশ করল—দেয়ালের ফাটল দিয়ে ভেসে এলো যেন। তার মুখে হালকা হাসি, হাতে আগুনের পাত্র। “এই বেদির আগুন এবার তোমার রক্ত দিয়ে পূর্ণ হবে ঋভু,” সে বলল। “তোমার বাবার আত্মা এতকাল ধরে অপেক্ষা করেছে, এখন সে তোমার দেহ পাবে। দক্ষিণাগ্নি তার পথ শেষ করবে তোমার ভিতর দিয়ে।”
ঋভু সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল বেদির সামনে। “আমি এসেছি আগুন নেভাতে, জ্বালাতে নয়,” সে বলল। বহ্নিশিখা হাসল, “তুমি আগুন নেভাতে চাও? তাহলে এই বেদিতে দাঁড়াও, আগুন তোমাকে গ্রহণ করলে—তবেই নিভবে। কিন্তু যদি তোমার আত্মা কমজোরি হয়, তুমি চিরকাল এ গুহার বন্দী হয়ে থাকবে। তোমার শরীর যাবে আমাদের চক্রে।” তিস্তা বলল, “ঋভু, এটাই সেই মুহূর্ত। তোমাকে আত্মার ভারে দাঁড়াতে হবে। ভয় পেও না, আগুন তোমাকে পরীক্ষা করবে, কিন্তু তুমিই হবে সেই ব্যতিক্রম—যে আগুন থেকে জন্ম নিয়েও তা নিভিয়ে দিতে পারে।” অভিজিৎ মাটিতে রাখা শিকল টেনে একদিকে টানল—আর ধ্বংসের মতো শব্দে কক্ষের এক প্রাচীন জলাধার ভেঙে পড়ল বেদির দিকে। কিন্তু আগুন নিভল না। বরং বেদির আগুন আরও তীব্র হল, আর ঋভুর বুকের চিহ্ন আগুনের মতো জ্বলে উঠল। চারপাশের বাতাস কেঁপে উঠল, আর তখন ঋভু চোখ বন্ধ করল। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো সেই স্মৃতি—বাবার মুখ, সেই ছেলেবেলার ভয়, কিন্তু এবার সেই ভয় আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল না। সে এগিয়ে এল বেদির মাঝে, দাঁড়িয়ে রইল আগুনের কেন্দ্রে। বহ্নিশিখা চিৎকার করল, “তোমাকে গ্রহণ কর হে দক্ষিণাগ্নি!”—আর ঠিক তখনই, আগুনের রঙ বদলে গেল। তা লাল বা নীল নয়—তা হয়ে উঠল সাদা, ধীরে ধীরে ধূসর, তারপর এক ঝলকে নিভে গেল।
৬
যে মুহূর্তে আগুন নিভল, পুরো কক্ষ নিঃশব্দে ডুবে গেল, যেন শতাব্দীপ্রাচীন এক শ্বাস দীর্ঘদিন পর থেমে গেল। বাতাস ভারমুক্ত হলো, অথচ সেই হালকা অনুভূতির মাঝেই ঋভু অনুভব করল বুকের ভেতর কিছু একটার গতি—ধীরে ধীরে, কিন্তু তীব্রভাবে তার শিরা-উপশিরায় কিছু একটার ছড়িয়ে পড়া। সে মাটিতে বসে পড়ল, ঘাম ঝরছিল, হৃদস্পন্দন ছন্দ হারাচ্ছিল, আর সেই মুহূর্তে তার সামনে এসে দাঁড়াল ‘দেহ’টা—যেটা একসময় তার বাবার ছিল। কিন্তু এবার সে হাঁটছে না, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে—মাটিতে ধসে পড়ে কণায় কণায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেন সেই দেহের মধ্যে বন্দি আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। তিস্তা দৌড়ে এসে ঋভুর কাঁধে হাত রাখে—তার মুখে ছিল ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্র প্রতিচ্ছবি। “তুমি এটা কীভাবে করলে ঋভু?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। “আমি ভয় পেতে পেতে… ভয়টাই জিতেছি,” ঋভু জবাব দিল, নিঃশ্বাস টেনে।
কিন্তু তখনই, বহ্নিশিখার গলা আবার শুনতে পাওয়া গেল—এইবার আর মাটির নিচ থেকে নয়, ঋভুর ঠিক পিছন থেকে। “ভেবেছিলে এত সহজে শেষ হবে?” সে বলে উঠল। তার গলা ক্ষীণ, কাঁপা, তবু জেদি। “এই আগুন নিভিয়ে দিলে কি আত্মা শান্ত হবে? না, আগুন তো ছড়িয়ে গেছে… তোমার রক্তে, তোমার হৃদয়ে।” পিছনে ফিরতেই দেখা গেল, বহ্নিশিখা আগুনের ধারে বসে আছে, তার চারপাশে শূন্য। আগুন নিভলেও বেদির নিচে থেকে ধোঁয়ার মধ্যে ঘুরছে ছায়ার মতো কিছুরা—ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি? পুরোনো আত্মার প্রতিধ্বনি? জানা নেই। “তুমি আমাদের চক্র ভেঙেছ, কিন্তু তুমি নিজেই এখন সংযোগ পয়েন্ট। দক্ষিণাগ্নি তোমার ভিতর দিয়ে নতুন পথ খুঁজবে—কালের ভিতর দিয়ে, হয়তো নতুন নামে, নতুন সময়ে। তুমি তো শুধু বাঁচোনি, তুমি ধারক হয়ে উঠেছ।” এই বলে বহ্নিশিখা ধীরে ধীরে পাথরের দেয়ালের ভিতরে ঢুকে যায়—যেন কখনও ছিলই না।
তিনজন বাইরে বেরিয়ে এল গুহা থেকে—রাতের অন্ধকারে আকাশে পূর্ণিমার আলো, বনের নিঃশব্দতা, পাখিদের কোনও আওয়াজ নেই। মনে হচ্ছিল পৃথিবী থেমে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু ঋভু জানত, থামা মানেই শেষ নয়। তার বুকের নিচে আগুনের সেই চিহ্নটা এখনও জ্বলজ্বল করছে—এবার আর ধাতব আলোকছটা নয়, বরং গভীর লাল, স্থির, নিঃশব্দ। তিস্তা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তুমি কি করবে?” ঋভু বলল, “লিখব। লিখে যাব এই আগুনের কথা। যাতে কেউ আবার ভুল করে এখানে না আসে, বা যদি আসে, সে যেন জানে আগুন নিভলেও ছায়া পড়ে থাকে।” সে হাঁটতে শুরু করল, ধীরে, পেছনে রেখে সেই গুহা—যেখানে দক্ষিণাগ্নি নিভেছে, কিন্তু যার অঙ্গার এখনও তার ভেতর ঘুমিয়ে আছে।
তিন মাস পর।
কলকাতা। শ্যামবাজারের একটি পুরনো বাড়ি।
আলো ঝাপসা। জানলার কাঁচে ধুলো জমে আছে। ঘরের কোণে একটি ডেস্ক, তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোটবই, খবরের কাগজের কাটা অংশ, আর মাঝখানে ল্যাপটপ—যেখানে টাইপ করা চলছে একটি দীর্ঘ রচনা: “The Fire That Breathed — দক্ষিণাগ্নি: এক অন্তঃশক্তির আখ্যান”।
ঋভু এখন একজন লেখক—কিন্তু তার ভিতরে জেগে উঠেছে এক নতুন সত্তা। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যায়, বুক ধড়ফড় করে, তার মনে হয় কেউ তাকে ডাকছে—গভীর মাটির নিচ থেকে, আগুনের ভেতর থেকে। চিকিৎসকেরা বলেন এটা PTSD, কিন্তু ঋভু জানে, দক্ষিণাগ্নির আগুন নিভে গেলেও সেই আগুনের ছায়া এখনও তার রক্তে বয়ে চলে। একদিন বিকেলে সে তার লেখার মাঝখানে হঠাৎ থেমে যায়। একখানা পুরনো খামে মোড়া চিঠি তার চেয়ারের নিচে পড়ে থাকতে দেখে। খুলে দেখে লেখা একটিই লাইন—“অগ্নিসূত্র ভাঙলেও ছায়াসূত্র থাকে। গুহা শুধু স্থান নয়, স্মৃতি।”
চিঠির নিচে স্বাক্ষর নেই।
ঋভু জানে না কে পাঠিয়েছে, জানেও না কী উদ্দেশ্যে, কিন্তু জানালা খুলে যখন সে বাইরে তাকায়, দেখে—আকাশে ঘন কালো মেঘ। তার ঠিক মাঝখানে সূর্য, রক্তিম আলোয় জ্বলছে, যেন আবার এক নতুন আগুনের জন্ম হতে চলেছে।
সে মুচকি হাসে। লিখতে থাকে।
আবারও আগুনের কথা, আবারও সেই ছায়ার কথা।
কারণ যারা একবার আগুন ছুঁয়েছে, তারা জানে—
আগুন নিভে গেলেও, ধোঁয়ার রেখা থেকে যায়।
—
শেষ



