Bangla - তন্ত্র

ত্রিনয়নী

Spread the love

উৎসব মুখার্জী


মেদিনীপুর শহরের প্রান্তে যখন অর্ণবের ট্রেন এসে দাঁড়াল, তখন সকালের কুয়াশা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে নেমে চারদিকে তাকাল—পরিচিত অথচ অচেনা লাগছিল জায়গাটিকে। ছোটবেলায় সে এখানে বহুবার এসেছে, মামার বাড়ি ছিল এই শহরে, কিন্তু তারপর থেকে কলকাতার ব্যস্ততা, পড়াশোনা, চাকরি আর শহুরে জীবনের দৌড়ঝাঁপ তাকে এই মাটির গন্ধ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার ফিরে আসার একটাই কারণ—তার বোন অনন্যা। বহু বছর আগে, অদ্ভুতভাবে অনন্যা হারিয়ে যায়। পরিবারে সেই ক্ষত আজও শুকোয়নি। বাবা-মা বোনের নাম শুনলেই কেঁদে ফেলেন, আর আত্মীয়রা চুপ করে যায়। অর্ণব একসময় চেষ্টা করেছিল খোঁজার, কিন্তু অল্প বয়সে তার কিছুই করার ছিল না। এখন যখন সে স্বাধীন, তখন তার মধ্যে এক তীব্র দায়বদ্ধতা জন্ম নিয়েছে—সে জানবে, বোনের কী হয়েছিল, কোথায় মিলিয়ে গেল সে। এ জায়গার বাতাসেই যেন লুকিয়ে আছে সেই উত্তর।

অর্ণব যখন গ্রামের ভেতর ঢুকল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। লাল মাটির পথ, ছায়াঘেরা আমগাছের নিচে কয়েকজন বৃদ্ধ বসে পান খাচ্ছে, আর দূরে একদল বাচ্চা খেলছে কাঁঠালতলার পাশে। গ্রামের মানুষ তাকে দেখে প্রথমে কৌতূহলী হয়ে উঠল। শহুরে জামাকাপড়, হাতে আধুনিক ব্যাগ—এমন আগন্তুক প্রতিদিন আসে না এখানে। সে কারও কাছে পথ জিজ্ঞাসা করার আগেই এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন, “কার বাড়ি খুঁজছো বাবা?” অর্ণব একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি আমার বোনকে খুঁজছি… নাম অনন্যা।” এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল। হাসি-আড্ডা থেমে গেল, শিশুরাও হঠাৎ খেলায় মন হারিয়ে নিরুত্তাপ হয়ে গেল। বৃদ্ধরা একে অপরের দিকে তাকালেন, যেন এমন নাম উচ্চারণ করাই অশুভ। এক মহিলা, যিনি কুয়ো থেকে জল তুলছিলেন, থেমে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “ও নাম এখানে উচ্চারণ করো না, ছেলে। অনেক কথা আছে, অনেক ভয় আছে।” অর্ণব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেন? সে কি এখানে ছিল?” কিন্তু কেউ সরাসরি উত্তর দিল না।

পরে বিকেলের আলো যখন বনের দিকে হেলে পড়ছে, তখন গ্রামের একজন মধ্যবয়সী লোক, নাম হরিপদ, অর্ণবকে আলাদা ডেকে নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলল। সে বলল, “বাবা, তুই যদি সত্যিই তোর বোনের খোঁজ করতে এসেছিস, তবে একটাই পথ আছে। বনপথের শেষে, যেখান থেকে বাঁশঝাড় শুরু হয়েছে, সেখানে এক সাধিকা থাকেন। লোকে তাঁকে ‘ত্রিনয়নী দেবী’ বলে। বলে, মৃতদের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন তিনি, ভবিষ্যৎ দেখতে পান তিনি। কিন্তু তাঁর কাছে যাওয়াটা সহজ নয়, আর নিরাপদও নয়। গ্রামের লোকেরা ভয় পায়, কারণ যেই তাঁর ছায়ায় গেছে, সে আর ফিরে আসেনি আগের মতো। তবু যদি মন শক্ত করে গেছিস, তবে ওই পথেই যেতে হবে।” অর্ণবের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল এক অদ্ভুত ভয় আর টান। সে জানে না সামনে কী আছে, কিন্তু বোনের নাম যেহেতু কারও মুখ থেকে আসছে না, আর সকলেই যাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, হয়তো সেই রহস্যময় সাধিকার কাছেই লুকিয়ে আছে সত্যিটা। রাত নামার আগে সে একবার দূর থেকে বনের দিকে তাকাল—অন্ধকার গাছেদের ফাঁক দিয়ে যেন গভীর এক ছায়া তাকে ডাকছে। অনন্যার খোঁজে অর্ণব বুঝল, তার যাত্রা শুরু হলো আজ, আর তার পথ তাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক গহ্বরে, যেখান থেকে ফেরাটা হয়তো আর সম্ভব হবে না।

বিকেলের আকাশ যখন রক্তকমল রঙে রাঙাতে শুরু করেছে, অর্ণব তখন বনের ভেতর পা রাখল। গ্রামের লোকেরা যে বাঁশঝাড়ের কথা বলেছিল, তার আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে অনুভব করছিল, চারপাশ যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভরে উঠছে। প্রথমে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, তারপর ধীরে ধীরে সেটিও মিলিয়ে গেল। বাতাস থেমে গিয়ে যেন শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ তৈরি হলো। বাঁশগুলোর ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে না, অন্ধকারে গাঢ় ছায়ারা লেপ্টে আছে। হঠাৎ করেই সামনে এক পুরোনো পাথরের সিঁড়ি চোখে পড়ল, যা নীচে নামতে নামতে এক গুহার মতো জায়গায় গিয়ে মিশেছে। গুহার প্রবেশপথে মাটির প্রদীপ জ্বলছে, শিখাগুলো কেঁপে কেঁপে এক অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছে দেয়ালে। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করছে, তবু সে এগোল। গুহার ভেতরে ঢুকতেই যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করল সে—চারদিকে ধূপের গন্ধ, মাটির দেওয়ালে অদ্ভুত চিত্রলিপি, আর মাঝখানে আসনে বসে আছেন এক রহস্যময়ী নারী। গাঢ় লাল শাড়ি, জটাজুটে ভরা চুল, আর কপালে আঁকা একটি চোখের চিহ্ন—যা অল্প অল্প করে জ্বলজ্বল করছে। অর্ণব প্রথমে ভেবেছিল, এ কেবল এক আঁকা অলঙ্করণ, কিন্তু পরে দেখল, সে চোখ আসল চোখের মতো নড়ছে, তাকাচ্ছে।

“তুই এসেছিস,” গুহার ভেতর যেন প্রতিধ্বনির মতো শোনা গেল মহিলার গলা। অর্ণব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলাটি ধীরে ধীরে চোখ তুললেন, আর অর্ণব অনুভব করল, তার সমস্ত শরীর যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন, “আমি ত্রিনয়নী দেবী। তুই যাকে খুঁজছিস, সে আমার জগতের মধ্যে আটকে আছে।” অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “আমার বোন… অনন্যা… আপনি জানেন সে কোথায়?” দেবীর ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি খেলে গেল। তিনি হাত নেড়ে বললেন, “সব জানি। কিন্তু তোর পক্ষে তাকে উদ্ধার করা সহজ নয়। আমার নিয়ম মানতে হবে। নিয়ম ভাঙলেই সর্বনাশ।” অর্ণব অসহায় কণ্ঠে বলল, “যত নিয়মই হোক, আমি মানব। শুধু আমাকে আমার বোনের কাছে নিয়ে চলুন।” তখন দেবী গম্ভীর হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “তুই যদি সত্যিই তোর বোনকে দেখতে চাইস, তবে শোন—আমার চোখের দিকে কখনও তিনবার তাকাস না। একবার হলে সতর্ক করব, দুইবার হলে পথ অন্ধকার হয়ে যাবে, আর তিনবার তাকালে তুই অভিশপ্ত হয়ে যাবি। তোর আত্মা আমার সঙ্গে মিশে যাবে। তখন আর তোর বোন তোকে চিনবে না।” কথাগুলো বলতে বলতে তার কপালের তৃতীয় চোখ অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠল, গুহার দেয়াল পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠল। অর্ণব ভয়ে গিলে ফেলল লালা, কিন্তু চোখ নামাতে পারল না। তারপর তড়িঘড়ি মাথা নীচু করে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

ত্রিনয়নী দেবী উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর পদক্ষেপে মাটির প্রদীপের আলো কেঁপে উঠল। তিনি বললেন, “আজ রাতে তুই স্বপ্নে তোর বোনের ছায়া দেখবি। কাল ভোরে আবার এই গুহায় আসবি, আমি তোর পথ খুলে দেব। তবে মনে রাখিস, আমার চোখকে অবহেলা করিস না।” অর্ণব গুহা থেকে বেরিয়ে এল, কিন্তু বুকের ভেতর একটা ভয়ানক আতঙ্ক জমে রইল। গাছপালার অন্ধকারের ফাঁক দিয়ে যখন আকাশের দিকে তাকাল, তখন মনে হলো, তিন জোড়া চোখ তাকে অনুসরণ করছে—দুটি দেবীর, আর একটি অদৃশ্য কারও। সে বুঝতে পারল, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। যে খোঁজে বেরিয়েছে, সেটাই হয়তো তার সর্বনাশ ডেকে আনবে। তবু বোনের মুখ মনে পড়তেই বুক শক্ত হলো। সে জানে, শর্ত যত ভয়ঙ্করই হোক, তাকে মানতে হবে। কিন্তু অজান্তেই মনে হলো, এই গহ্বর থেকে হয়তো সে আর আলোয় ফিরে আসতে পারবে না।

রাত নামার পর অর্ণব অস্থির হয়ে পড়ল। গাঁয়ের ভাড়া করা কুঁড়ে ঘরে সে শুয়ে থাকলেও, চোখে এক ফোঁটা ঘুম এল না। ধূপের গন্ধ, ত্রিনয়নী দেবীর গুহার ভেতরের আঁধার, কপালের জ্বলজ্বলে চোখের চিহ্ন—সব মিলিয়ে মাথার ভেতর এক অদ্ভুত ঘোর কাজ করছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে, নিস্তব্ধতা যখন গাঢ় হয়ে এল, তখন হঠাৎ অর্ণব অনুভব করল, কেউ যেন তাকে ডাকছে। সে ডাক ছিল না সাধারণ মানুষের, বরং যেন বাতাসে ভেসে আসা সুরের মতো। “দাদা…”—এই একটাই শব্দ যেন কানে বাজল। অর্ণব চমকে উঠে বসে পড়ল। অনেক বছর হয়ে গেছে, কিন্তু সে কণ্ঠস্বর ভুলবার নয়। অনন্যার কণ্ঠ, যেভাবে ছোটবেলায় তাকে ডাকত। অর্ণব বুঝতে পারল, ত্রিনয়নী দেবীর দেওয়া শক্তি কাজ করছে। সে চোখ বন্ধ করে কান পাতল, শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। অনন্যা যেন তাকে ডাকছে, পথ দেখাচ্ছে। কণ্ঠ বলছে, “পুকুরঘাটে আয়… আমি এখানে আছি।” অর্ণব আর দেরি করল না, অন্ধকার গলিপথ ধরে ছুটে চলল গ্রামের সেই পুরোনো পুকুরের দিকে, যেটি নিয়ে শৈশবে নানা গল্প শোনা ছিল—একসময়ে এখানে পূর্ণিমার রাতে নাকি ছায়ারা খেলা করত।

পুকুরঘাটের ধারে পৌঁছেই অর্ণব দেখল, কুয়াশার পর্দার মতো জল ঢেকে রেখেছে, আর চাঁদের আলোয় সেই কুয়াশা অদ্ভুতভাবে ঝিকমিক করছে। জলের ওপর ছায়া ভেসে উঠল—প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর ধীরে ধীরে একটি মেয়ের অবয়ব। অর্ণব শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, এ তার বোন অনন্যা। পরনে সাদা ফ্রক, লম্বা খোলা চুল, চোখেমুখে যেন অপরূপ প্রশান্তি। কিন্তু কণ্ঠস্বরে ছিল একরাশ আকুতি—“দাদা, আমাকে বাঁচাও…” অর্ণব হাত বাড়াল, কিন্তু মুহূর্তেই সেই অবয়ব ভেঙে পড়ল জলে, যেন কখনো ছিলই না। হতভম্ব অর্ণব এক পা এগোতেই হঠাৎ অনুভব করল, কেউ তার কাঁধে হাত রাখল। পেছনে তাকাতেই দেখল ত্রিনয়নী দেবী, গাঢ় লাল আভায় জ্বলজ্বল করছে তাঁর দেহ, আর কপালের তৃতীয় চোখ অগ্নিশিখার মতো দপদপ করছে। অর্ণব চোখ ফেরাতে পারল না, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেই চোখের গভীরে। মুহূর্তে তার চারপাশ ভেঙে পড়ল, সে দেখল জলের ওপর আগুনের রেখা ভেসে উঠছে, আকাশে কাকের মতো ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের ভেতর তীব্র কষ্ট, শরীর জমে আসছে—এই অনুভূতিতে যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে।

ঠিক তখনই দেবীর কণ্ঠ বজ্রের মতো গর্জে উঠল—“এটি ছিল প্রথমবার। তুই সতর্ক থাকিস। আর দু’বার হলে তুই হারিয়ে যাবি, তোর আত্মা আমার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকবে।” অর্ণব হাপাচ্ছিল, ঘাম তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। সে কোনোমতে চোখ নামিয়ে নিল, আর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চারপাশে কুয়াশা ঘন হয়ে এল, দেবীর অবয়ব ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কেবল কণ্ঠ প্রতিধ্বনির মতো বাজতে লাগল—“মনে রাখিস, নিয়ম ভাঙিস না।” অর্ণব ক্লান্ত দেহে পুকুরের সিঁড়িতে বসে রইল, বুক ধড়ফড় করছে, মাথার ভেতর শূন্য গর্জন। কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠছিল অনন্যার মুখ, সেই বোন যাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে জানে, ভয় যতই থাকুক, আর অভিশাপ যতই প্রবল হোক, সে থামতে পারবে না। অনন্যা এখনও তাকে ডাকছে, আর অর্ণবের একমাত্র লক্ষ্য তাকে মুক্ত করা। তবে এও সত্যি—ত্রিনয়নী দেবীর চোখের প্রথম ঝলকই তাকে বুঝিয়ে দিল, সামনে যে পথ, তা অমানবিক শক্তি আর অভিশাপের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। আর সে পথ থেকে ফিরে আসা হয়তো আর কখনোই সম্ভব নয়।

ভোরের আলো ফুটতেই অর্ণব আবার পথে বেরোল। গত রাতের অভিজ্ঞতা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে, কিন্তু তার মনে এখন একটাই লক্ষ্য—অনন্যার খোঁজ। গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এক পুরোনো বটগাছের নিচে বসে থাকা বৃদ্ধ সাধুকে দেখল। সাদা ধুতি, কাঁধে ছেঁড়া গামছা, কপালে চন্দনের ফোঁটা—চোখে গভীর শান্তি, অথচ মুখে যেন গোপন ভার। অর্ণব সামনে গিয়ে প্রণাম করতেই বৃদ্ধ বললেন, “তুই নতুন এসেছিস গ্রামে। তোর চোখে অস্থিরতা, তোর ভেতরে আগুন। কাকে খুঁজছিস বল।” অর্ণব আর লুকাল না, সরাসরি বলল, “আমার বোন, অনন্যা। অনেক বছর আগে এখানে হারিয়ে গেছিল। কেউ কিছু বলতে চায় না, শুধু ভয় পায়।” বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “হ্যাঁ, আমি জানি,” তিনি ধীরে ধীরে বললেন। “সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল। গ্রামে গোপনে এক আচার-অনুষ্ঠান চলছিল। লোকে বলে, সেই সাধিকা—ত্রিনয়নী দেবী—শক্তি আহরণের জন্য তরুণীদের ডাকে, আর তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। তোর বোনও সেই রাতে গেছিল ওই বনে। আর ফিরল না।” অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে কেঁপে কেঁপে বলল, “তাহলে অনন্যা বেঁচে আছে?” বৃদ্ধ বললেন, “তার আত্মা হয়তো আছে, কিংবা শরীরও থাকতে পারে, কিন্তু সে আর আগের মতো মানুষ নেই। তুই যদি তাকে উদ্ধার করতেই চাইস, তবে সাহসী হতে হবে। তবে মনে রাখিস, সেই দেবীর চোখে বারবার তাকিও না।” অর্ণব বৃদ্ধের চোখে তাকিয়ে বুঝল, তিনি শুধু সতর্ক করছেন না, বরং নিজের ভয়ের কথাই বলছেন—কারণ তার মুখে আতঙ্কের রেখা তখনও আঁকা।

দেবীর দেওয়া শক্তির কথা মনে পড়ে অর্ণব বুঝল, এখন সময় এসেছে সেটি ব্যবহার করার। বনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে গভীর মনোযোগে চোখ বন্ধ করল। হঠাৎ করেই তার কানে ভেসে এল অদ্ভুত এক সুর, যেন কারও কান্না আর হাহাকার মিশে আছে। সুর তাকে টেনে নিয়ে গেল বনের গহীনে। সে অচেনা পথ ধরে এগোতে লাগল, যেখানে গাছপালা ঘন হয়ে সূর্যের আলো ঢুকতে পারছে না। মাটিতে লালচে রঙের ফুল ঝরে আছে, যা দেখে মনে হয় রক্তের ফোঁটা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। ফুলের গন্ধ ছিল মিষ্টি, অথচ অর্ণবের শরীর শিউরে উঠছিল, যেন ওগুলো জীবন্ত। সে আরও ভেতরে যেতে থাকল, আর হঠাৎই মাটিতে চকচক করে উঠল কিছু একটা—একটি রূপোর গলার হার। অর্ণব হাঁটু গেড়ে তুলে নিল হারটি। হারটির পেন্ডেন্টে ছিল অনন্যার প্রিয় শঙ্খচিহ্ন, যেটি সে ছোটবেলায় সবসময় পরত। অর্ণবের চোখ ভিজে উঠল। এ নিদর্শনই প্রমাণ যে অনন্যা সত্যিই এই পথে এসেছে। তার বুকের ভেতর শক্তি এসে জমল, সে জানল বোন কোথাও কাছে আছে। কিন্তু তখনই হঠাৎ বাতাসে কেঁপে উঠল চারপাশ। শীতল হাওয়া হাড় পর্যন্ত বিদ্ধ করল তাকে, আর গাছের ডালপালা যেন নিজেরাই নড়তে শুরু করল।

অর্ণব আতঙ্কিত হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল, আর সেই মুহূর্তে হঠাৎ সামনেই দাঁড়িয়ে উঠলেন ত্রিনয়নী দেবী। তাঁর চোখের লাল আভা অন্ধকার ছেদ করে জ্বলে উঠল। অর্ণব প্রথমে নিজেকে সামলাতে চাইল, কিন্তু ভুল করে তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল দেবীর কপালের তৃতীয় চোখে। মুহূর্তেই বজ্রপাতের মতো আলো বেরোল, আর মাটি কেঁপে উঠল। অর্ণব অনুভব করল যেন তার দেহ মাটিতে শেকড় গেঁড়ে বসে যাচ্ছে, চারপাশে অদ্ভুত ছায়ারা ঘুরপাক খাচ্ছে। কানে ভেসে এল চিৎকার, কান্না, আর ফিসফিসানি—যেন অগণিত আত্মা মুক্তির আকুতি জানাচ্ছে। অর্ণব মরিয়া হয়ে চোখ সরিয়ে নিল, বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তখনই দেবীর কণ্ঠ গর্জে উঠল, “এবার দ্বিতীয়বার হল। মনে রাখিস, আর একবার হলে তুই আমারই হবে।” অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে গলার হার শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, যেন অনন্যার স্পর্শ এখনও লেগে আছে তাতে। কিন্তু তার মাথার ভেতর তখনও গর্জন বাজছিল, মাটির কাঁপন থামছিল না। সে জানল, তার পথ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবুও, বোনের হার হাতে নিয়ে তার মনে হলো, ভয় পেলে চলবে না—শেষ সত্য জানার আগেই তার থামার উপায় নেই। আর এভাবেই সে ত্রিনয়নী দেবীর দ্বিতীয় সতর্কতার ছায়ায় এক ধাপ আরও গভীরে ঢুকে পড়ল অভিশপ্ত অরণ্যের অন্ধকারে।

রাতের অন্ধকারে বনের গভীরে অর্ণব যখন ত্রিনয়নী দেবীর আশ্রমে পৌঁছালো, তখন তার চোখে পড়ল—চারদিক যেন কোনো অজানা ছায়ায় ঘেরা। দেবীর আশ্রম ছিল একটি গুহার মতো জায়গা, যার চারপাশে শিকড় আর লতা-পাতা ঝুলে নেমে এসেছে। ভিতরে পা দিতেই গা শিউরে ওঠার মতো এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগল—না রক্তের, না পোড়া ধূপের, বরং দুটো মিশ্রণে তৈরি কোনো অস্বস্তিকর আবেশ। দেবী এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সামনে বসে আছেন, চোখ বুজে মন্ত্র জপ করছেন। তার কপালের আঁকা তৃতীয় নয়নটি আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল, যেন শিখার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জ্বলছে। অর্ণবকে দেখে তিনি ধীরে ধীরে চোখ মেলে বললেন, “তোর বোন এই আশ্রমেই বন্দি, কিন্তু তাকে উদ্ধার করতে হলে তোকে নিষিদ্ধ আচার সম্পূর্ণ করতে হবে।” অর্ণব হতভম্ব হয়ে গেল। দেবী তাকে বুঝিয়ে দিলেন, এটি এমন এক যজ্ঞ, যেখানে জীবিত আর মৃত—দু’জগতের শক্তি একত্র হয়। তিনি হাত উঁচিয়ে একটি শিখা ডেকে আনলেন, আর মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচ থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এল কিছু ছায়ামূর্তি। তাদের দেহে কোনো রক্তমাংস নেই, কেবল কালো কুয়াশার মতো আভা। অর্ণব ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু দেবী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “এরা মৃতদের ছায়া, আমার ডাকে সাড়া দেয়। এই আগুন এদেরই হাতে জ্বলছে।” সত্যিই, অর্ণব দেখল—ছায়ামূর্তিরা গাছের শুকনো ডাল ভেঙে এনে আগুনে ফেলে দিচ্ছে, আর আগুন আরও উঁচু হয়ে উঠছে।

যজ্ঞচক্রের আলোতে হঠাৎ অর্ণব যেন এক পরিচিত মুখ দেখতে পেল। ধোঁয়ার ফাঁকে, ছায়াদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তার বোন অনন্যা। তার চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা, ঠোঁটে অচেনা হাসি। অর্ণব ছুটে গিয়ে তাকে ধরতে চাইল, কিন্তু ছোঁয়ার আগেই অনন্যার শরীর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল, “অনন্যা!” কিন্তু উত্তর এলো না। দেবী মৃদু হাসলেন এবং বললেন, “তাকে দেখতে পাস, মানে তোর আত্মার সঙ্গে তার বন্ধন এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু তাকে ছুঁতে চাইলে আচার ভঙ্গ হবে। তুই যদি সত্যিই তাকে মুক্ত করতে চাই, তবে মনের সমস্ত ভয় দূরে সরিয়ে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে হবে।” অর্ণব তখনই বুঝল—তার যাত্রা শুধু বোনকে খুঁজে পাওয়ার নয়, বরং নিজের আত্মার সঙ্গেও এক যুদ্ধ। সে আগুনের সামনে বসে পড়ল, আর দেবীর নির্দেশে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। গুহার দেয়ালগুলো যেন কেঁপে উঠছিল প্রতিটি শব্দে, আর বাইরে বাতাসের হাহাকার আরও তীব্র হচ্ছিল। হঠাৎ অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা এক ছায়া অর্ণবের গা ঘেঁষে চলে গেল, যেন তাকে পরীক্ষা করছে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে স্থির থাকল, ভেতরে ভেতরে অনন্যার মুখ মনে করে মন্ত্র পড়তে লাগল। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শক্তির ঢেউ খেলে গেল, যা সে আগে কখনও অনুভব করেনি।

কিন্তু ঠিক তখনই ত্রিনয়নী দেবী তার তৃতীয় নয়ন খুললেন, আর অর্ণবের মনে হল যেন এক প্রচণ্ড ঝড় তাকে ঘিরে ধরল। অজান্তেই তার দৃষ্টি চলে গেল দেবীর কপালের ওই অগ্নিশিখার মতো জ্বলতে থাকা চোখের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল, আর ভেতরে কানে বাজতে লাগল এক বিকট ধ্বনি, যেন শত শত মৃত আত্মার আর্তনাদ। অর্ণব ভয় পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেও ক্ষতি হয়ে গেছে—সে দ্বিতীয়বার নয়নটির দিকে তাকিয়েছে। দেবী বজ্রকণ্ঠে বললেন, “আর মাত্র একবার, অর্ণব! এর পর যদি আমার চোখের দিকে তাকাস, তবে তুই অভিশপ্ত হয়ে এই মৃতদেরই দলে মিলিয়ে যাবি।” অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে পড়ে গেল, তার বুক ধকধক করছে। কিন্তু তার মনের ভেতরে তখনও অনন্যার অস্পষ্ট মুখ ভেসে উঠছিল—সেই মুখ যাকে স্পর্শ করতে না পারার যন্ত্রণায় তার অন্তর ছিন্নভিন্ন। অগ্নিশিখার আলোয় যখন আবার ছায়ামূর্তিরা নাচতে শুরু করল, অর্ণব মনে মনে শপথ নিল—যত বড় বিপদই আসুক, সে বোনকে উদ্ধার করবেই। দেবীর চোখের অভিশাপ, মৃতদের আর্তনাদ, নিষিদ্ধ যজ্ঞ—সবকিছুর মধ্যেও তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল এক অদম্য শক্তি, যা তাকে আরও বড় ঝড়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।

রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, ততই অর্ণবের বুকের ভেতর চাপা অস্থিরতা বাড়ছিল। দেবীর দেওয়া শক্তির ছোঁয়া যেমন তাকে ভেতরে ভেতরে জাগিয়ে তুলছিল, তেমনই বোনের অস্পষ্ট মুখ দেখতে পাওয়ার পর তার মনে হচ্ছিল—সত্যটা তার নাগালের একেবারে কাছেই। কিন্তু সেই সত্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা জানলে হয়তো তার জগৎটাই ভেঙে যাবে। পরদিন ভোরে সে গ্রামের পুরোনো মন্দির চত্বরে বসা এক বৃদ্ধার কাছে গেল, যিনি চুপচাপ ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছিলেন। অর্ণব তার সামনে বসে অনন্যার কথা তুলতেই বৃদ্ধা একবার চারপাশে তাকালেন, যেন কেউ শুনছে কি না। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “তুই যা খুঁজছিস, সেটা সহজে পাবে না। ত্রিনয়নী দেবী আসলে দেবী নন, এক শক্তিশালী তান্ত্রিকী। অনেক বছর আগে সে এখানে এসে আশ্রম গড়েছিল। মানুষ ভেবেছিল তিনি পূজারিণী, মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, কিন্তু আসল সত্য হল—তিনি মানব বলি দিয়ে নিজের শক্তি বাড়ান। গ্রাম থেকে অনেক মেয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছে, কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলে না।” অর্ণবের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। তার মনে পড়ল, অনন্যা হারিয়ে যাওয়ার দিনগুলো, আর কীভাবে পুরো গ্রাম এ বিষয়ে চুপ করে গিয়েছিল। সে বুঝল, অনন্যা জীবিত, কিন্তু তান্ত্রিকীর যাদুবলে বন্দি। বৃদ্ধার কণ্ঠে কাঁপুনি ছিল, “আমরা সবাই জানি, কিন্তু মুখ খুললে মৃত্যু আসবে। অনন্যার ভাগ্যও তাই হয়েছে।” অর্ণবের চোখে রক্ত চড়ে উঠল—এবার সে সিদ্ধান্ত নিল, যে কোনো মূল্যে দেবীর মুখোমুখি হতে হবে।

সেই রাতে অর্ণব আরেকবার বনের গভীরে পা রাখল। বনের বাতাস যেন তাকে চেপে ধরছিল, পেঁচার ডাক আর শুকনো পাতার খসখস শব্দ আরও ভয়ের আবহ তৈরি করছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল এক ক্ষীণ ডাক—“ভাই…”। গলা তার চেনা, যেন অনেকদিন ধরে খুঁজে ফেরা অনন্যার কণ্ঠ। শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছাল এক লুকোনো বেদির কাছে, যেখানে কয়েকটা মশাল জ্বলছিল। আলোয় দেখা গেল—অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখ শূন্য, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তার গলায় অদ্ভুত তাবিজ ঝুলছে, আর হাতে বাঁধা আছে লাল সুতো। অর্ণব ছুটে গিয়ে তাকে ধরতে চাইল, কিন্তু ঠিক তখনই ত্রিনয়নী দেবী ছায়ার মতো আবির্ভূত হলেন। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, কপালের আঁকা তৃতীয় নয়নটি আগুনের মতো দীপ্ত। তিনি মৃদু হাসলেন, “দেখলি? তোর বোন এখনও জীবিত। কিন্তু সে আমার আশ্রয়ে, আমার নিয়ন্ত্রণে। এই শক্তি ছাড়া তাকে তুই কখনোই পেতি না।” অর্ণব দাঁত চেপে বলল, “তুই মিথ্যা দেবী। তুই কেবল শয়তান, যে মানুষ বলি দিয়ে নিজের শক্তি বাড়াচ্ছিস।” দেবী বজ্রকণ্ঠে হেসে উঠলেন, চারদিক কেঁপে উঠল। “তুই বুঝতে পারছিস না, আমি অমরত্বের দ্বারে পৌঁছে গেছি। এই বোন তোর নয়, এখন সে আমার।” অর্ণবের বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল, কিন্তু তার শরীর ভয় আর যাদুর চাপে কেঁপে যাচ্ছিল।

অর্ণব গভীর শ্বাস নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল, হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরল, যেন ভেতর থেকে শক্তি টেনে আনছে। দেবী কাছে এসে দাঁড়ালেন, কপালের চোখ জ্বলতে লাগল আরও উজ্জ্বল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুই ইতিমধ্যেই দু’বার আমার নয়নের দিকে তাকিয়ে ফেলেছিস। আর একবার তাকালেই তুই অভিশপ্ত হবে। তবুও সাহস করে এসেছিস, সেটা আমি মানি। কিন্তু মনে রাখিস, শক্তি ছাড়া কেউ মুক্তি পায় না।” হঠাৎ অর্ণবের চোখে পড়ল, অনন্যার গলায় ঝোলানো তাবিজ থেকে এক ক্ষীণ আলো বেরোচ্ছে। মনে হল, সেই আলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে মুক্তির চাবিকাঠি। দেবী মন্ত্র জপতে শুরু করলেন, আর মশালগুলো একে একে নেভে গেল। চারপাশে কেবল অন্ধকার আর দেবীর চোখের আগুন। কিন্তু সেই অন্ধকারের ভেতরেই অর্ণব শপথ নিল—সে কোনোভাবেই তৃতীয়বার দেবীর চোখের দিকে তাকাবে না। তার লক্ষ্য একটাই, বোনকে মুক্ত করা। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, “তুই যেভাবেই থামাতে চাই, আমি থামব না। আমার বোনকে ছাড়।” তার কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা ছিল, যা দেবীও এক মুহূর্তের জন্য অনুভব করলেন। চারদিকের বাতাস হঠাৎ থেমে গেল, যেন বন নিজেই শ্বাস আটকে রাখল—অর্ণব ও দেবীর আসন্ন মুখোমুখি লড়াইয়ের অপেক্ষায়।

অর্ণবের ধড়ধড়ানো হৃদয় আর ত্রিনয়নী দেবীর রহস্যময় উপস্থিতি যেন এক অদ্ভুত তানাপোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গ্রামের পুরোনো মন্দিরের ভাঙাচোরা প্রাচীরের মাঝে, যেখানে ধূলোমাখা বাতাস শুধু কিসের ভেসে আসা ফিসফিসানি বহন করত, সেখানে অর্ণব দাঁড়িয়ে ছিলেন এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে। অনন্যার মুক্তির জন্য সে এতদূর এসেছিল, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেবীর অদ্ভুত শান্তি আর একইসাথে ভয়ানক সৌন্দর্য তার মনের সব রৈখিক ধারণা ভেঙে দিয়েছিল। ত্রিনয়নী দেবী, যিনি তার সব শক্তি ও তান্ত্রিক ক্ষমতা দিয়ে মানুষের ভীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, এবার অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার চোখ দু’টি যেন আগুনের লুকানো স্রোত বহন করছে। “আমার চোখের দিকে তাকাস না,” তিনি বললেন, কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী অর্ণবের কানে যেন এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে ধরা দিল। অর্ণব বুঝতে পারছিল, যদি সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, তবে অনন্যার মুক্তি সম্ভব হবে না, কিন্তু যদি সে তাকায়, তাহলে তার নিজের অস্তিত্বও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। মনের গভীরে একটি লড়াই চলছে—ভয় বনাম দায়িত্ব, নিজের জীবন বনাম প্রিয়জনের মুক্তি।

যুদ্ধের মুহূর্তটা আসলে অতি দ্রুত, কিন্তু মনে হয় সময় থমকে গেছে। দেবী নিজের হাতে তান্ত্রিক শক্তি উদ্দীপ্ত করে অর্ণবকে ঘিরে রেখেছিলেন; বাতাসে যেন অদৃশ্য আগুনের গন্ধ ভেসে আসছে। অর্ণবের চোখ অচেতনভাবে তৃতীয়বার দেবীর চোখে পড়ল, এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার দেহ যেন জলে ভিজে থাকা পাথরের মতো জমে গেল। আগুনের ঝলক, যা তার দৃষ্টির সঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছিল, এখন প্রতিটি নার্ভের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সে নিজের কণ্ঠ শুনতে পায় না, শুধু মনে হচ্ছে হৃদয় ও রক্ত প্রবাহ সব থেমে গেছে। দেবীর হাসি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে একটি অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করল—ভয়ানক, মোহময়, এবং একপ্রকার শিকারীর আনন্দ। অর্ণব বুঝতে পারল যে এই দৃষ্টি শুধু তার নয়, বরং তার আত্মার ওপরও প্রভাব ফেলছে। ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন, এই চোখের মায়াজালে ফেলতে দেবী আসলে প্রস্তুত ছিলেন বহুদিন ধরেই, এবং অর্ণবের জন্য কোনো পিছু হটার পথ নেই।

দেবী একভাবে যেন বিজয়ী, একভাবে যেন শত্রু—অর্ণবকে নিজের শক্তির মধ্যে টেনে আনতে চাচ্ছেন। হাসিমুখে তিনি বললেন, “এবার তুই আমারই অংশ।” এই কথার সাথে সাথে অর্ণবের মনের মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি হলো। সে বুঝতে পারল যে, অনন্যাকে মুক্ত করার সাথে সাথে নিজের স্বাধীনতাও সে হারাচ্ছে; তার মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ দেবীর হাতে চলে যাচ্ছে। মনে মনে অর্ণব চেষ্টা করল—কীভাবে এই বন্ধনের থেকে নিজেকে মুক্ত করবে, তবে শক্তি এতটাই প্রখর যে প্রতিটি পরিকল্পনা ভেসে যায় বাতাসে। অরণ্য, ধূলোমাখা মন্দির, ফিসফিসানি বাতাস—সব কিছু যেন তার চারপাশে রক্তের নীরব তানচিত্র আঁকতে শুরু করল। অনন্যার মুক্তি, দেবীর অদ্ভুত আনন্দ, এবং নিজের উপর দখল—এই তিনটির মধ্যে অর্ণবের মন একদম বিভক্ত। এক অদ্ভুত অনুভূতি, যা কেবল ভয় নয় বরং মোহও, তাকে গ্রাস করে ফেলল। সে বুঝতে পারল, শেষবার চোখে চোখের এই মুহূর্ত তার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং একসাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন আগুনের শিখায় রূপান্তরিত হচ্ছে, আর অর্ণব জানল, এই যুদ্ধে কোনোমাত্র অনুপস্থিতি তার প্রিয়জনের মুক্তি এবং নিজের আত্মার অস্তিত্বের জন্য একমাত্র চাবিকাঠি।

যুদ্ধের আগুন নিভে যাওয়ার পর, গ্রাম যেন অচেতন অবস্থায় আটকা পড়ে। মন্দিরের ভাঙাচোরা প্রাচীরের মধ্যে, ধূলোর স্তর জড়িয়ে থাকা স্থানগুলোতে অদ্ভুত শান্তি এবং ভীতিকর নীরবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু অর্ণবের জন্য এই শান্তি ছিল একপ্রকার মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের সংমিশ্রণ। ত্রিনয়নী দেবীর চোখের সঙ্গে তার দৃষ্টির সংঘাত শুধু তার দেহ নয়, তার আত্মার কাঠামোকেও বদলে দিল। অর্ণব নিজেকে আর স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে চেনতে পারছিল না। তার রক্ত, তার শ্বাস, তার অনুভূতি—সবকিছু দেবীর অর্ধদেবীয় শক্তির সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এখন সে শুধু ভাই নয়, বরং দেবীর ছায়ার এক অর্ধেক অংশ। তার চোখের মধ্যে আগুনের ঝলক, হাতের অদ্ভুত শক্তি, এবং তার মানসিক অবস্থার গভীর অস্থিরতা—সব কিছুই প্রকাশ করছিল যে অর্ণব আর আগে যেমন ছিল, তেমন নেই।

অন্যদিকে, অনন্যা অবশেষে মুক্তি পেল। তার দমবন্ধ করা জীবনের বদ্ধ দরজা খুলে গেল, আর সে গ্রামবাসীর সঙ্গে আবার যোগাযোগ করতে শুরু করল। কিন্তু সেই খুশির মাঝেও তার চোখে অচেনা দুঃখের ছাপ। সে অর্ণবকে চিনতে পারছিল না—তার ভাই, যিনি তার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন, এখন এক অদ্ভুত সত্তায় রূপান্তরিত। অর্ণবের মুখ, তার কণ্ঠ, এমনকি তার ছোট ছোট অভিব্যক্তি সবই অচেনা হয়ে গেছে। অনন্যা শুধু অনুভব করতে পারল যে তার মুক্তির জন্য কেউ এমন এক আত্মা আত্মনিবেদন করেছে, যাকে সে আর ঠিকভাবে চেনতে পারছে না। এই অনুভূতিটি ছিল একপ্রকার ব্যথা আর মুক্তির সমন্বয়, যা গ্রামবাসীর মনে অদ্ভুত কল্পনার জন্ম দিল। তারা দেখল, সেই যুবক, যে এখন দেবীর ছায়া হয়ে উঠেছে, গ্রামে অদ্ভুত শক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন সে মানুষ নয় বরং কোনো রহস্যময় শক্তির এক অর্ধাংশ।

গ্রামে গল্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বলত, ত্রিনয়নী দেবী এখন দ্বিগুণ শক্তিশালী; তার শক্তির সঙ্গে অর্ণবের ছায়া মিলে তৈরি হলো এক নতুন রূপ। যারা রাতের বেলা বনপথে হাঁটতেন, তারা তিন জোড়া চোখের ঝলকানি দেখতে পেত। দেবীর চোখ দুটি আগের মতোই জ্বলজ্বল করত, আর অর্ণবের অর্ধদেবীয় ছায়ার চোখ দুটি এক অদ্ভুত লালচে আলো ছড়াত। এই দৃশ্য গ্রামবাসীর মনে একরকম ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণ সৃষ্টি করল। কেউ কেউ বলত, এটি আশীর্বাদ, কেউ বলত অভিশাপ; কারণ যে যুবকটি তাদের কাছে পরিচিত ছিল, তার পরিবর্তন মানবসমাজের সীমার বাইরে চলে গেছে। গ্রাম যেন দেখল, মুক্তি কখনও সহজ নয়, কখনও তা অভিশাপে রূপ নিতে পারে, এবং প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা শুধু শারীরিক নয়, আত্মিকও হতে পারে। রাতের বেলা বনপথে হঠাৎ তিন জোড়া চোখের জ্বলজ্বলানি দেখা মানে এখন শুধুই একটি গল্প নয়—এটি বাস্তবের ভয়ংকর, মায়াময়, এবং এক অমোঘ সত্য।

___

 

1000069366.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *