আত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যায় ১: হারানো মুখ
হাসপাতালের করিডোরটা ঠান্ডা আর ধূসর, যেন কাঁচের খাঁচায় আবদ্ধ কোনো অদৃশ্য বিষাদ। অর্ঘ্য সান্যাল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল—তার হাতের মুঠোয় একটুকরো পুরনো ছবি, যেখানে ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে হাসছে; পরনে হলুদ ফ্রক, গলায় একটি লাল হৃদয় আকৃতির লকেট। পাশেই এক কিশোর ছেলেকে দেখা যাচ্ছে—চোখেমুখে দায়িত্ব, একরাশ ভালোবাসা। ছবিটার নিচে কালি দিয়ে লেখা—“দাদা আর রাত্রি, পুরুলিয়া ভ্রমণ, ২০০৩।” অর্ঘ্য ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে, গভীর শ্বাস নেয়। তারপর চোখ মেলে চুপিচুপি ফিসফিসিয়ে বলে, “আমি এবারও তোর কাছে পৌঁছাব, রাত্রি।” বিগত বিশ বছর ধরে তার এই কথাটুকু বদলায়নি, শুধু মানুষটা বদলে গেছে—বিজ্ঞানমনস্ক থেকে সে এখন বিশ্বাস করে স্বপ্ন, ছায়া, অদৃশ্য ইশারা—আর একটা শব্দ যা বারবার তার চিন্তার মধ্যখানে ফিরে আসে—“ত্রিনয়নী।”
কয়েক সপ্তাহ আগে এক অচেনা নাম্বার থেকে অর্ঘ্যের ইমেইলে একটি ভয়েস রেকর্ড আসে। অর্ধেকটা শোনা যায় না, বাকি অংশে এক নারীকণ্ঠ উচ্চারণ করে—“ত্রিনয়নী দেবী তোমাকে ডেকেছেন, রাত্রির পথ খুলছে…” সেই কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত অনুরণন, যেন জলের তলায় গলা ভেসে আসছে। অর্ঘ্য প্রথমে এটাকে কোনও প্র্যাঙ্ক বা হ্যালুসিনেশন ভাবলেও, দ্বিতীয়বার শুনে তার কাঁধ জমে আসে। সে চিৎকার করে ওঠে—“এই কণ্ঠটা তো… রাত্রি?” এরপর থেকেই তার নিশি রাতগুলো বদলে যেতে থাকে—ঘুমে দেখা দেয় এক লাল শাড়ি পরিহিতা নারী, যার কপালে একটি চোখ—উজ্জ্বল, তীব্র, অপ্রাকৃত। স্বপ্নে সে বলে, “তোমার সময় এসেছে।” এই ইঙ্গিত থেকেই অর্ঘ্য সিদ্ধান্ত নেয়—যেখানে রাত্রি হারিয়ে গিয়েছিল, সেই মেদিনীপুরে ফিরে যাবে। সে জানে না কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু অনুভব করে—এই সফর শুধু বাস্তব নয়, এটা আত্মার পথ।
মেদিনীপুর শহরটা আগের চেয়ে অনেক পাল্টেছে, কিন্তু তার বাইরের একটি নির্জন গ্রাম এখনো সময়ের বাইরে আটকে আছে। সে পৌঁছায় এক পুরনো ডাকবাংলোয়, ঝড়ের মুখে দাঁড়ানো এক ক্লান্ত দুপুরে। গ্রামবাসীরা যেন কিছু বলতে চায় না; কেউ কেউ চোখ নামিয়ে নেয়, কেউ কেউ কানের পাশ দিয়ে ফিসফিস করে ওঠে—“ত্রিনয়নী আশ্রম?” কেউ বলে, “ওদিকটা মশাই এড়িয়ে চলুন, সন্ধ্যার পর ওই পথে কুকুরও হাঁটে না।” অর্ঘ্য এক বৃদ্ধার কাছে পৌঁছে তার বোনের ছবি দেখায়। বৃদ্ধা দীর্ঘসময় ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর চোখ সরিয়ে বলেন—“এই মেয়েটা তো অনেক দিন আগে আশ্রমে গিয়েছিল। সেই তো আর ফিরে এল না।” অর্ঘ্যের হাত কেঁপে ওঠে। সে প্রশ্ন করে, “আশ্রম মানে কোথায়?” বৃদ্ধা শুধু বলে, “বাঁশবনের ওপারে একটা সাদা ঘর—ওর নামই ‘ত্রিনয়নী’ এখন।”
রাতে ডাকবাংলোর জানালা দিয়ে দেখা যায় বনের গায়ে এক অপার্থিব আলো। বাতাসে মাটি আর ধূপের গন্ধ—মনে হয় কেউ গভীর রাতে কোনো পুরনো দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞ করছে। হঠাৎই অর্ঘ্য দেখে—বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে একটি শাড়ি পরা নারী হেঁটে যাচ্ছে। সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়, পেছন ফিরে তাকায়—আর অর্ঘ্য স্পষ্টভাবে দেখে তার কপালে কিছু জ্বলছে, যেন চোখ। সে দরজা খুলে পেছনে দৌড়োয়, কিন্তু বাইরে গিয়ে কেবল বাতাসের হাহাকার আর বাঁশপাতার মর্মরধ্বনি। কোথাও কেউ নেই। অর্ঘ্য জানে না, তার সামনে কী অপেক্ষা করছে—কিন্তু সে ঠিক করে, পরদিন ভোরেই সে আশ্রমের দিকে পা বাড়াবে। কারণ এবার সে কেবল রাত্রিকে খুঁজছে না—সে খুঁজছে সেই নারীকে, যাকে ঘিরে কুয়াশা, আলো, নিষেধ আর রহস্য—ত্রিনয়নী দেবী।
অধ্যায় ২: অশরীরীর নিশ্বাস
ভোরের আলো যেন এই গ্রামে ঠিকমতো ঢোকে না। গাছের ফাঁকে ফাঁকে শুধু কুয়াশা, বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ, আর সবুজে মিশে থাকা ধূসর রঙ। অর্ঘ্য সকালে উঠে হাঁটতে বেরোয় বাঁশবনের দিকে, যেদিকে আগের রাতে সে সেই শাড়ি পরা নারীর ছায়ামূর্তি দেখেছিল। রাস্তা নেই, শুধু মাটির পথ আর বুনো গাছগাছালি। কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য—মাটির ওপর লাল আলপনার মতো আঁকা কিছু চিহ্ন, যেগুলোর আকৃতি যেন চোখ, ত্রিভুজ আর গোল প্যাঁচের। কেউ যেন রাতের বেলা কিছুর আহ্বান করেছে। অর্ঘ্য কিছুটা ভয় পেলেও থামে না। সামনে এগিয়ে এক জায়গায় পৌঁছায় যেখানে হঠাৎ চারদিক ঠান্ডা হয়ে আসে, পাখির ডাক থেমে যায়, বাতাস নিঃশব্দ। বাঁশপাতার মধ্যে দিয়ে ফিসফিস শব্দ ভেসে আসে—একটি কণ্ঠ, নারীর, যা বলে—“তোমার সময় ঘনিয়ে এসেছে… ফিরে যাও…”
সে মুহূর্তে অর্ঘ্যর শরীর শীতল হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, কেউ বা কিছু তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। কিন্তু ভয়কে দমিয়ে সে আরও এগোয় এবং একসময় চোখে পড়ে একটি সাদা ভবন—বনের মাঝে যেন জেগে থাকা কোন মন্দির বা আশ্রম। এই ভবনের সামনে দুটি ধূপধুনো, ফুল আর ঘিয়ের আলো জ্বলছে। কিছুমাত্র কোলাহল নেই, কিন্তু তীব্রভাবে বোঝা যায়, এটি পরিত্যক্ত নয়। হঠাৎ আশ্রমের পেছন দিক থেকে এক যুবতী বেরিয়ে আসে, মাথা নিচু করে হাঁটছে, পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি, চুল বাঁধা নেই। অর্ঘ্য তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়, তারপর চোখ তুলে সরাসরি অর্ঘ্যের দিকে তাকায়। তার চোখ দুটি গভীর, শূন্য, আর অভিব্যক্তিহীন। সে ফিসফিস করে বলে—“ত্রিনয়নী দেবীর চোখে তাকিও না… ভুলেও না…” বলেই মেয়েটি পেছন ফিরে হেঁটে চলে যায়, গাছেদের আড়ালে মিলিয়ে যায় যেন জলছবি।
অর্ঘ্য আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে তার মনে পড়ে ছোটবেলার রাত্রি—যখন সে অন্ধকারে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল, আর রাত্রি ভয়ে তার হাত ধরে বলেছিল, “দাদা, তুমি থাকো তো না?” সেই ভয়, সেই নির্ভরতা আজও তার বুকের মধ্যে। সে মনে মনে ভাবে—যদি ত্রিনয়নী তার বোনকে নিয়ে গিয়ে থাকে, তবে তাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া তার আর কোনো গন্তব্য নেই। কিন্তু ঠিক তখন, হঠাৎ আশ্রমের ছাদ থেকে এক ছায়ামূর্তি নেমে আসে। একটি উজ্জ্বল কপাল—যেখানে স্পষ্ট একটি “তৃতীয় চোখ” আঁকা। অর্ঘ্যর পা যেন জমে যায়। সেই নারীর গলায় শোনা যায়—“তুমি এসেছো… চোখে চোখ রাখোনি… এখনো সময় আছে।” তারপর মুহূর্তেই ছায়াটি মিলিয়ে যায়। আশ্রমের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যায়—ভেতরে অন্ধকার।
সেই রাতে অর্ঘ্য ফিরে আসে ডাকবাংলোয়, কিন্তু সে ঘুমাতে পারে না। মাথায় ঘুরতে থাকে সেই অচেনা নারীকণ্ঠ, সেই চোখের কথা, সেই অন্ধকার ঘরের স্মৃতি। জানালার ওপারে বাঁশবনের মধ্য থেকে আবার সেই ধূপের গন্ধ ভেসে আসে, যেন তাকে ডাকছে কেউ। আর তার বুকের ভিতরে একটা স্পষ্ট অনুভূতি—সে যেটার মধ্যে ঢুকছে, সেটা কোনো ধর্মস্থল নয়, কোনো মানবিক আশ্রম নয়—এটা এক আলাদা জগৎ, যেখানকার নিয়ম, সময় আর সতর্কতা সব আলাদা। আর সেই জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে যে নারী, তার নাম ত্রিনয়নী, যার চোখে তাকালে মানুষ শুধু আলো নয়, তার নিজের ছায়াও দেখতে পায়।
অধ্যায় ৩: আলোচরণ সংঘ
রাত গভীর হলেও অর্ঘ্যর চোখে ঘুম নেই। ডাকবাংলোর টেবিলে ছড়িয়ে রয়েছে ছবি, কাগজ, রেকর্ড করা সেই ভয়েস ক্লিপ, আর পাশেই খোলা সেই পুরনো লকেট—যেটা একমাত্র রাত্রিকে চিনিয়ে দিতে পারে। বাইরের ঝিঁঝিঁর ডাক আর অজানা রাতচরার কণ্ঠ তার মনে অনবরত কাঁপন জাগাচ্ছে। সে বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইছে—সবটা কাকতালীয়, সবটা হয়তো তার মানসিক ক্লান্তি, কিন্তু ঠিক তখনই দরজায় ধাক্কা পড়ে—একটি থাপ! অর্ঘ্য চমকে ওঠে। আরেকটি থাপ। সে ধীরে দরজা খুলতেই এক অচেনা পুরুষ দাঁড়িয়ে—মাথায় টুপি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে চামড়ার ফোল্ডার। লোকটি বলে, “আমার নাম বলতে পারব না, কিন্তু আমরা আলোচরণ সংঘের পক্ষ থেকে এসেছি।”
অর্ঘ্য হতভম্ব হয়ে যায়। “আলোচরণ সংঘ”? সে এই নাম কখনো শোনেনি। লোকটি ভেতরে ঢুকে আসন নেয়। তার কথাবার্তায় অদ্ভুত এক নির্লিপ্তি—কোনো ভয় নেই, কোনো তাড়া নেই, যেন বহু বছর ধরে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ব্যাগ থেকে বের করে একটি ছেঁড়া নোটবুক, যার পাতায় লাল কালি দিয়ে আঁকা হয়েছে ত্রিভুজ, চোখ, আর কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক। সেই পাতাগুলোর ভাঁজে ছোট ছোট ছবির মতন ফুটে উঠেছে এক কিশোরীর মুখ—একই মুখ, যা অর্ঘ্যর কাছে রাত্রির মতো লাগে। লোকটি বলে, “এই নোটবুকটি আমরা পেয়েছি চার বছর আগে, এক ঝর্ণার ধারে… সেখানে যে মেয়েটি থাকত, তার নাম রাত্রি।” অর্ঘ্য চিৎকার করে ওঠে—“তুমি রাত্রিকে চেনো?” কিন্তু লোকটি হাত তুলে থামায়, “আমরা জানি কে রাত্রি ছিল, কিন্তু এখন সে কে হয়ে উঠেছে, তা তুমি জানো না।”
লোকটি বলে চলতে থাকে—“ত্রিনয়নী হলো একটি চেতনার নাম। একজন নারীকে এই চেতনার বাহক করে গড়ে তোলা হয় বহু তান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে। প্রথমে তার পরিচয়, আবেগ, স্মৃতি সব কিছু ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তারপর সেই খালি মনকে ‘তৃতীয় চক্ষু’ দিয়ে পূর্ণ করা হয়—যেটি দেখে, জানে, এবং শাসন করে। কিন্তু এটাই সব নয়। একটি সময় আসে যখন সেই বাহক—ত্রিনয়নী—তার নিজের শিকড় খুঁজতে শুরু করে। সেই সময় সে হয়ে ওঠে সর্বনাশা। সে খুঁজে বেড়ায় তার পুরোনো আত্মীয়, পরিচিত মুখ—কখনো ভালোবাসার নামে, কখনো প্রতিহিংসায়।” অর্ঘ্য চুপ করে শোনে, কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। সে জানতে চায়, “তুমি কি বলতে চাও… রাত্রি এখন… ও কি ত্রিনয়নী?” লোকটি বলে—“আমরা নিশ্চিত না। তবে তুমি যে ঘনিয়ে এসেছো তার কাছে, এটা নিশ্চিত।”
আলোচরণ সংঘের সেই সদস্য অর্ঘ্যকে একটি মানচিত্র দেয়—বাঁশবনের ভেতর, সাদা আশ্রমের পেছনে একটি ধ্বংসপ্রায় শিবমন্দির রয়েছে, যেখানে তাদের একজন গুপ্ত অনুসন্ধানকারী শেষবার রাত্রিকে দেখেছিলেন। মন্দিরের এক গোপন কুঠুরিতে পাওয়া যায় একটি শব্দরেকর্ড—যেখানে কোনো মেয়ে গুনগুন করে গাইছে, “ও দাদা, কোথায় গেলে… আমি একা…” অর্ঘ্যর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। লোকটি উঠে দাঁড়ায়, দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে—“তুমি যা খুঁজছো, সেটা পেতে গেলে চোখে চোখ রাখতে হবে… কিন্তু মনে রেখো, তিনবার নয়। একবার অনুভবের জন্য, দ্বিতীয়বার সত্যের জন্য, আর তৃতীয়বার? সেটা মৃত্যু।” দরজা বন্ধ হওয়ার পর অর্ঘ্য বুঝতে পারে—এই যাত্রা আর ফেরার নয়, কারণ এবার সত্য তার খুব কাছেই, ঠিক তার চোখের সামনে—তবে তার জন্য সে হয়তো নিজেকেই হারাতে চলেছে।
অধ্যায় ৪: শ্বেত আশ্রম
আলোচরণ সংঘের লোকটির বিদায়ের পর অর্ঘ্যের মধ্যে এক আশ্চর্য শান্ত অস্থিরতা ঘিরে ধরে। সে জানে, সময় এসেছে মুখোমুখি হওয়ার—নতুন কোনো তত্ত্ব নয়, নতুন কোনো ক্লু নয়—এইবার প্রত্যক্ষের পালা। সকালবেলা সে খুব অল্প খেয়ে বেড়িয়ে পড়ে, সেই বাঁশবনের পথ ধরে যেটা স্থানীয়রা “দেবতার পথ” বলে এড়িয়ে চলে। পথ যতই গভীরে যায়, ততই আলোর পরিমাণ কমে আসে, কিন্তু গাছের পাতায় আশ্চর্য রকমের নিস্তব্ধতা—যেন প্রকৃতিও নিঃশব্দ শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে আছে। একসময় সে দেখে তার সামনে সেই সাদা আশ্রম—যেটা দেখতে যেন গড়া হয়েছে নীলচে পাথর আর হাড়ের গুঁড়োর মিশ্রণে, নিঃসন্দেহে মানব নির্মিত নয়। ঘরের গায়ে আঁকা অদ্ভুত ত্রিভুজ ও চক্রাকার চিহ্ন, যেগুলো দেখামাত্র মাথা ভার হয়ে আসে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য থেমে যায়। তার কাঁধে তখনও সেই লকেটটা গলায় ঝোলানো, যেন একটা আত্মিক তাবিজ। সে ধীরে দরজায় হাত রাখতেই সেটা অদৃশ্য শক্তিতে নিজে থেকে খুলে যায়। সে ভেতরে ঢোকে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশ অদ্ভুতভাবে হালকা হতে থাকে। আশ্রমের ভেতরে কোনো জানালা নেই, কিন্তু ছাদ থেকে নেমে আসা রুপালি আলোর রেখা দেয়ালের ওপর ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে—মানব শরীরের ছায়া, নারীর অবয়ব, আর সবশেষে চোখ—এক জোড়া নয়, তিনটি চোখ। হঠাৎই অর্ঘ্য বুঝতে পারে, সে একা নেই। ঘরের এক কোণ থেকে বেরিয়ে আসে এক নারী—উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে, কপালে জ্বলজ্বল করছে তৃতীয় নেত্রের প্রতীক। তার পরনে রক্তরঙা শাড়ি, চুল খোলা, চোখে তীব্র নিষ্পৃহতা। সে এগিয়ে এসে বলে, “তুমি এসেছো… তোমার গলায় ওটা আমার খুব চেনা লাগছে।”
অর্ঘ্য মুখ খোলার আগেই নারীর কণ্ঠ আবার বলে ওঠে, “আমার নাম এখন ত্রিনয়নী। তোমার সত্য জানার আগ্রহ আছে?” অর্ঘ্য কাঁপা গলায় বলে, “আমি আমার বোন রাত্রিকে খুঁজছি। তার নাম শুনলে… কিছু মনে পড়ে?” ত্রিনয়নী হাসে—একটা অদ্ভুত হাসি, যেন কোনো পুরোনো গান মনে পড়ে গেছে। “রাত্রি… সে তো অনেক আগের কথা… তুমি কি জানো, তুমি যা খুঁজছো তা পেতে গেলে তোমাকে ত্যাগ করতে হবে নিজেকে? আমি তোমাকে সাহায্য করব, কিন্তু তোমাকে আমার নিয়ম মানতে হবে।” সে ঘরের এক পাশে রাখা তাম্রের আয়নার দিকে ইশারা করে। “তোমার চোখ শুধু আয়নায় থাকবে। আমার চোখে যদি তিনবার তাকাও—তোমার শরীর থাকবে, কিন্তু আত্মা ভেসে যাবে… আমার মতো।” অর্ঘ্য মাথা হেঁট করে সম্মতি জানায়, কিন্তু তার মনে তখন রক্তের মতো ছাপ ফেলে গেছে সেই নাম—রাত্রি।
ত্রিনয়নী ধীরে ধীরে এক তান্ত্রিক মুদ্রায় বসে পড়ে, অর্ঘ্যকে বলেও বসতে। আশ্রমে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ—ধূপ, চন্দন আর হাড়ের গুঁড়োর। চারদিকে হঠাৎ যেন বাতাস ভারী হয়ে আসে, এবং ত্রিনয়নী শুরু করে এক উচ্চারণ—যার ভাষা অর্ঘ্য বুঝতে পারে না, কিন্তু হৃদয়ের গভীরতম স্তরে সেই ধ্বনি কাঁপন তুলতে থাকে। চোখ বন্ধ করতেই অর্ঘ্য দেখতে পায়—এক ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের এক কোণে, তার গলায় সেই লকেট, হাতে কাঁচের পুতুল। মেয়ে ঘুরে তাকায়—চোখে জল, মুখে শুধু একটাই শব্দ—“দাদা…” মুহূর্তেই দৃষ্টি ছিন্ন হয়, এবং অর্ঘ্য নিজের শরীরে ফিরে আসে। ঘাম ভেজা গায়ে সে বুঝতে পারে, সে সত্যের কাছাকাছি এসেছে—কিন্তু এই আশ্রম আর এই নারী ঠিক কতটা সত্য বলছে, আর কতটা তাকে ভুল জালে টানছে, সেটা সে তখনও জানে না। শুধু অনুভব করে, তার আত্মার দরজা একবার খুলে গেছে—এবার আর তা বন্ধ করার উপায় নেই।
অধ্যায় ৫: অতীতের ঘূর্ণি
আশ্রমের ভেতরে সময় যেন অন্যভাবে চলে। বাইরে সূর্য অস্ত যায়, আলো ফুরায়, কিন্তু ভিতরের ঘরে আলো জ্বলে থাকে ছায়ার মতো। ত্রিনয়নী একটি মাটির প্রদীপ অর্ঘ্যের সামনে রেখে বসে থাকে, তার সামনে তিনটি বস্তু—একটি কাঁচের পুতুল, একটি ছেঁড়া লাল ফ্রক, আর একটি ছোট কাঁসার থালা যার মাঝে পড়ে থাকে এক বিন্দু রক্তের মতো লাল তরল। অর্ঘ্য বসে থাকলেও তার ভেতরে চলতে থাকে এক অব্যক্ত দ্বন্দ্ব—এটি কি বাস্তব, না সে কোনও স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছে? ত্রিনয়নী নিঃশব্দে বলে ওঠে, “আজ তুমি তোমার অতীতের ঘূর্ণিতে প্রবেশ করবে। চোখ বন্ধ করো, মনের সব শব্দ থামাও, আর সেই মুহূর্তে ফিরে যাও… যেদিন তুমি রাত্রিকে শেষবার দেখেছিলে।” অর্ঘ্য চোখ বন্ধ করে, আর যেন এক আকর্ষণে, এক স্মৃতি-নদীতে তলিয়ে যায়।
সে দেখতে পায় সেই পুরোনো রেলস্টেশন—পুরুলিয়ার, ২০০৩ সালের এক শীতে। রাত্রি তখন ছয় বছর বয়সী, আর সে বারো। তারা মায়ের হাত ছাড়িয়ে পিয়নদের পেছনে দৌড়োচ্ছিল। হঠাৎ এক ঝাঁক লোক আসে—গাড়ি, লাঠি, হট্টগোল, আর সেই ভিড়ে কোথাও মিলিয়ে যায় রাত্রি। ছোট্ট একটা কান্না, একটা “দাদা!” ডাক আর তার পর—শূন্যতা। অর্ঘ্য আবার চোখ খুলে ফেলতে চায়, কিন্তু পারে না। সে দেখে রাত্রিকে—বসে আছে একটি অচেনা ঘরে, ঘরের দেয়ালে আঁকা চোখ, আর এক নারী বসে তার সামনে—ত্রিনয়নী। কিন্তু তখনও সে রাত্রি—ভীত, অসহায়, এবং প্রশ্নে ভরা। এক কণ্ঠ বলছে, “তোমার ভাই তোমায় ফেলে রেখে গেছে… এখন থেকে তুমিই আমাদের আলো…”
স্মৃতির দৃশ্যগুলি দ্রুত রূপ নেয় বিকৃত স্বপ্নে। সেই নারী—ত্রিনয়নী—রাত্রিকে শেখাচ্ছে কীভাবে “চোখ দিয়ে” দেখতে হয়, কিভাবে নিজেকে ভুলতে হয়। অর্ঘ্য নিজের ভেতর চিৎকার করে ওঠে—“না! এটা সত্য নয়! আমি রাত্রিকে ফেলে যাইনি!” কিন্তু ত্রিনয়নী এক আশ্চর্যভাবে ফিসফিস করে বলে, “কিন্তু সে তো তা-ই বিশ্বাস করেছে।” অর্ঘ্য দেখছে—রাত্রির চোখ ধীরে ধীরে নিঃসঙ্কোচ, নিরাবেগ, আর ঠান্ডা হয়ে উঠছে। তার হাসি কমে যাচ্ছে, চাহনি শীতল হয়ে উঠছে—সে এখন রাত্রি নয়, হয়ে উঠছে “ত্রিনয়নী।” এটাই সেই ঘূর্ণি—যেখানে সময় নিজের ব্যাখ্যা পাল্টায়, আর স্মৃতি হয়ে ওঠে অস্ত্র।
অর্ঘ্য হঠাৎ জেগে ওঠে। সে ঘর্মাক্ত, কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে। ত্রিনয়নী তার সামনে বসে আছে—চোখে আগুনের রেখা। সে বলে, “তুমি বুঝেছো এখন, কেন আমি ‘আমি’ নই? আমাকে বানানো হয়েছে—তোমার স্মৃতি দিয়ে, আমার ভাঙা অস্তিত্ব দিয়ে, আর সেই দুঃখ দিয়ে যে বিশ্বাস করে, কেউ কখনো ফিরে আসবে না।” অর্ঘ্য আরেকবার তার গলায় ঝোলানো লকেটের দিকে তাকায়—সেই একই লকেট, যেটা তার বোনের ছিল। সে ফিসফিস করে বলে, “তুমি… তুমি রাত্রি… তাই না?” ত্রিনয়নী মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য কাঁপুনি দেখা যায়। অর্ঘ্য জানে, সে এখন এমন এক সত্যে পৌঁছেছে, যা তাকে হয় উদ্ধার করবে—নয়তো চিরকালের জন্য গিলে ফেলবে। আর ঠিক তখন, আশ্রমের বাইরে বাজতে থাকে এক অদ্ভুত ঢাকের শব্দ—নতুন কোনও শক্তি প্রবেশ করতে চলেছে… আর ত্রিনয়নী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি এবার দ্বিতীয় দৃষ্টির কাছে পৌঁছেছো… তৃতীয়টি এলে, আর ফিরতে পারবে না।”
অধ্যায় ৬: নিষিদ্ধ দৃষ্টি
আশ্রমের চারপাশে ঢাকের শব্দ থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসের ভার যেন একটুও কমেনি। অর্ঘ্য ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, ত্রিনয়নী তখন জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার ছায়া মাটিতে পড়ে আছে, কিন্তু তার সঙ্গে কোনো কণ্ঠ নেই—শুধু নিঃশ্বাসের মতো একটা অনুভূতি, যেন তার উপস্থিতি হালকা হয়ে যাচ্ছে বা বহুবার বিভক্ত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ঘ্য ভেবে পায় না, সে কেন এতটা টান অনুভব করছে—ভয় নয়, বরং একধরনের দুঃখ আর চেনা অনুভূতির সম্মিলন। সেই নারীটি, যে নিজেকে ত্রিনয়নী বলে পরিচয় দিয়েছে, তার শরীরের ভঙ্গিমা, তার চোখের কোণের রেখা, এমনকি হাঁটার ধরন—সবকিছুই যেন কোথাও একবার দেখা, একবার ছোঁয়া—রাত্রির মতো।
অর্ঘ্য প্রথমবার চোখ তোলে—একেবারে সামনাসামনি। সেই চোখ জ্বলছিল না, বরং ক্লান্ত ছিল। সে চমকে ওঠে, কারণ চোখের সেই তৃতীয় কেন্দ্রবিন্দুটি তখন নিস্তব্ধ—যেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সে জানে, এটিই প্রথম দৃষ্টি—অনুভবের। সে নিজের ভিতরের কণ্ঠ শুনতে পায়—“এত বছর পর আমি তোমায় দেখছি…” এই মুহূর্তে ত্রিনয়নী কোনও কিছু বলে না, শুধু তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত কাঁপুনি খেলে যায়। এরপর, কিছু সময় পর আশ্রমের এক কোণে রাখা আয়নায় ত্রিনয়নী নিজেকে দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। অর্ঘ্য তখন তার দ্বিতীয়বার চোখের দিকে তাকায়—এবার বিস্ময়ে। কারণ আয়নার প্রতিবিম্বে সে দেখে, ত্রিনয়নীর গলায় থাকা লকেটটি খোলে, আর ভেতর থেকে পড়ে যায় সেই পুরোনো ছবি—যেখানে রাত্রি ও অর্ঘ্য একসাথে।
অর্ঘ্য সামনে এগিয়ে আসে। ত্রিনয়নী তখনো আয়নার দিকে চেয়ে, একরাশ দ্বিধায়। এই সময়ে, অর্ঘ্য ভুলে যায় নিয়ম, ভুলে যায় সতর্কতা। তার চোখ তৃতীয়বারে জন্য সরাসরি ত্রিনয়নীর চোখে থামে—এইবার আর কৌতূহল নয়, ভালোবাসায়। মুহূর্তেই বাতাস জমাট বাঁধে, আশ্রমের মাটি দুলে ওঠে, একধরনের কর্কশ গর্জন ঘরের ভেতরে ফিরে ফিরে আসে। অর্ঘ্যর চারপাশ ঘোলা হয়ে যায়, শব্দ বদলে যায় গুঞ্জনে, গুঞ্জন বদলে যায় চিৎকারে। সে পড়ে যেতে যেতে দেখতে পায়, ত্রিনয়নীর চোখ তিনটি আলাদা হয়ে চারদিকে ঘুরছে, ছড়িয়ে পড়ছে দেয়ালে, ছাদে, তার মনের ভিতরে।
তারপর যা ঘটে, তা সময় বা বাস্তবের নিয়মে চলে না। সে নিজেকে দেখতে পায়—একটি অন্ধকার ঘরে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেই। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রি—ছোটবেলার রাত্রি, পরনে সেই হলুদ ফ্রক। সে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “তুমি দেরি করেছো দাদা।” তখন তার পেছনে এক নারীর ছায়া—ত্রিনয়নী, কিন্তু মুখ তার অর্ধেক পুড়ে গেছে, তৃতীয় চোখ বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। অর্ঘ্য নিজের শরীরের দিকে তাকায়—তার হাত আগুনে পুড়ছে, মুখ গলে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে ওঠে, “এটা স্বপ্ন না! এটা সত্য না!” কিন্তু সেই মুহূর্তে এক বিকট কণ্ঠ তার মাথার ভেতরে বলে—“তৃতীয় দৃষ্টি সত্য নয়, এটা আত্মার প্রতিশোধ।” অর্ঘ্য বুঝতে পারে, সে শুধু ত্রিনয়নীর নিয়ম ভাঙেনি—সে নিজেকেই ঠকিয়েছে।
ঘুম ভাঙে না, জেগে ওঠাও নয়—অর্ঘ্য আশ্রমের মেঝেতে পড়ে থাকে নিঃশব্দে, দেহ শীতল, চোখ স্থির। বাইরে সূর্য উঠছে, কিন্তু তার চোখে আলো নেই। ত্রিনয়নী চুপচাপ পাশে বসে থাকে। তার চোখ দুটি নিস্তব্ধ, মাঝখানের তৃতীয়টি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে মাথা নিচু করে বলে, “তুমি নিয়ম ভেঙেছো, তাই তুমি এখন সত্য দেখতে পেয়েছো। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সত্য তুমি নিয়ে যেতে পারবে তো?” আশ্রম তখন নিস্তব্ধ, এবং অর্ঘ্যর হৃদয় সেই মুহূর্তে একবার ধুকপুক করে ওঠে—শেষবারের মতো।
অধ্যায় ৭: স্মৃতির অনল
আশ্রমের মেঝেতে পড়ে থাকা অর্ঘ্যর শরীর নিথর, কিন্তু তার চেতনা দুলছিল এক অদৃশ্য আগুনের তরঙ্গে। বাইরে তখন ঝড়ের মতো বাতাস, চারপাশের গাছপালা যেন ছটফট করে উঠেছে। ঠিক এমন সময় আশ্রমের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে পড়ে, আর ঢোকে তিনটি কালো পোশাক পরা লোক—তাদের কপালে ত্রিভুজ আঁকা, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। তাদের পেছনে প্রবেশ করে একজন বৃদ্ধ—গাঢ় গেরুয়া বসনে, সাদা দাড়িতে মুখ ঢাকা, চোখদুটি গভীর—তিনি মুনি কৃপারাম, আলোচরণ সংঘের শেষ জীবিত তান্ত্রিক-সংরক্ষক। তিনি ত্রিনয়নী-কে দেখে থেমে যান। দীর্ঘসময় তারা চোখাচোখি করে থাকেন। মুনি বলেন, “অনেক বছর পর দেখা হলো, কন্যা। আজও তোমার স্মৃতির আগুন নিভেনি।” ত্রিনয়নী চুপ।
মুনি কৃপারাম এক হাঁটু গেড়ে অর্ঘ্যর পাশে বসে পড়েন। তিনি তার কপালে ছুঁয়ে দেন ভস্মমাখা হাত। সঙ্গে সঙ্গে অর্ঘ্যের চোখ কেঁপে ওঠে, সে হঠাৎ হাঁচড়ে কাঁপড়ে উঠে বসে পড়ে—গলা শুকনো, চোখে বিভ্রান্তি। মুনি বলেন, “তুমি এখনো বেঁচে আছো, কারণ তোমার হৃদয়ের কোথাও রাত্রির শেষ ডাক আজও গাঁথা আছে।” অর্ঘ্য উঠে বসে, ধীরে ধীরে চারপাশ চিনতে পারে। সে বলে, “আমি ভুল করে তাকিয়েছিলাম… আমি…” মুনি থামিয়ে বলেন, “তুমি চোখে তাকাওনি, তুমি হৃদয়ে স্পর্শ করেছো। আর তাতে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, সেটা নিছক কোনো দৃষ্টির নয়—ওটা স্মৃতির অনল।” ত্রিনয়নী তখনো চুপ, তার চোখে একধরনের যুদ্ধ—ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের সংঘর্ষ।
মুনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন ত্রিনয়নীর অতীত—তিনি বলেন, “তোমার বোন রাত্রিকে সেই অপহরণের রাতেই একটি নিষিদ্ধ তান্ত্রিক গোষ্ঠী নিয়ে যায়—তারা বিশ্বাস করত, একটি শিশুমনের বিশুদ্ধতা দিয়ে গড়ে তোলা যায় শ্রেষ্ঠ বাহক। তারা রাত্রিকে ধীরে ধীরে স্মৃতি হারাতে বাধ্য করে, ত্রিনয়নী নাম দেয়। তবে একটি স্মৃতি তারা মুছতে পারেনি—তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার অভ্যেস। রাত্রির ভেতর সেই ডাকে ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল বলেই সে পুরোপুরি ত্রিনয়নী হয়ে ওঠেনি। সেই দ্বন্দ্বই তাকে অর্ধেক দেবী, অর্ধেক মানুষ করে রেখেছে।” অর্ঘ্য ধীরে ধীরে ত্রিনয়নীর দিকে তাকায়। এবার তার চোখে ভয় নয়—সমবেদনা। সে এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে দেয়, বলে, “তুই ফিরতে পারিস… আমি জানি।”
ত্রিনয়নী মাথা নিচু করে বলে, “আমি যে ছিলাম, সে আর নেই। তবুও মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি—একটা ফ্রক পরা মেয়ে হাত ধরে দৌড়চ্ছে, আর কেউ ডাকছে, ‘রাত্রি!’” তারপর সে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে। মুনি বলেন, “এই আশ্রম, এই দৃষ্টি, সব ধ্বংস করতে হবে। তবে সাবধান—ত্রিনয়নী যদি পুরোপুরি জেগে ওঠে, তাহলে সে শুধু নিজেকে নয়, তোমাকেও গ্রাস করবে। সেই আগুন যা তার ভেতরে, সেটা নেভানো যাবে না—তাকে শুধু রূপান্তর করতে হবে।” অর্ঘ্য মাটিতে বসে, লকেটটা খুলে রাত্রির ছোটবেলার ছবি ত্রিনয়নীকে দেখায়। সেই ছবি দেখে ত্রিনয়নী থেমে যায়, হাত কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে। সে ফিসফিস করে বলে, “এই ছবি আমি স্বপ্নে দেখি…” অর্ঘ্য ধীরে বলে, “তুই শুধু স্বপ্ন দেখিস না রাত্রি, তুই এখনো বেঁচে আছিস।” ঘরের বাতাস ভারি হয়, ত্রিনয়নী ধীরে মাথা তোলে, আর প্রথমবার তার চোখে দেখা যায়—অশ্রু।
অধ্যায় ৮: তৃতীয় চোখের যজ্ঞ
রাত নামতেই আশ্রমের চারপাশে পাতা হয় যজ্ঞমণ্ডল। বনের মধ্যে স্থির বাতাস, যেন গাছের পাতাগুলিও নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। মুনি কৃপারাম তামার ছক কেটে মাঝখানে বসেন। তার চারপাশে আটজন আলোচরণ সংঘের সাধক, প্রত্যেকের কপালে ত্রিভুজ চিহ্ন, এবং সবার সামনে একটি করে প্রদীপ—ঘি ও ধূপের তীব্র গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। অর্ঘ্য একটু দূরে, ত্রিনয়নীকে নিয়ে বসে। সে তখন নিস্তব্ধ, চোখ বন্ধ, মুখে কোনো ভাব প্রকাশ নেই—যেন শূন্যের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। মুনি বলেন, “এই যজ্ঞে আমরা ডাকি তৃতীয় চক্ষুর আগুনকে, যাতে সে বিভ্রম সরিয়ে সত্য প্রকাশ করে। যদি তার শক্তি কুপ্রভাবে ব্যবহার হয়, তাহলে ত্রিনয়নী রূপে রাত্রি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে।”
যজ্ঞ শুরু হতেই চারপাশে গর্জনের মতো শব্দ ওঠে। আগুনের শিখা নড়ে ওঠে অলৌকিকভাবে—একবার সবুজ, একবার রক্তরঙ। মুনি স্লোক উচ্চারণ করতে থাকেন, যা মনে হয় আদি কোনো ভাষা—যা শব্দ নয়, কেবল কম্পন। ত্রিনয়নী হঠাৎ কেঁপে ওঠে। সে চিৎকার করে বলে, “থামো! আমি আর কিছু মনে রাখতে চাই না!” তার চোখ খুলে যায়—তিনটি চোখই জ্বলে ওঠে উজ্জ্বল নীল শিখায়। অর্ঘ্য উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, “তুই চাইলে আবার রাত্রি হতে পারিস! আমি তোকে ফেলিনি! আমি তো খুঁজে গেছি বছর বছর ধরে!” তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা সেই মুহূর্তে ত্রিনয়নীকে স্তব্ধ করে দেয়।
যজ্ঞশক্তি তীব্রতর হয়। আগুনের মধ্যে ভেসে ওঠে ছায়া—রাত্রির, সেই ছোটবেলার মেয়েটি ফ্রক পরে, তার পাশে দাঁড়িয়ে এক যুবক—অর্ঘ্য। দৃশ্য একবার ঝাপসা হয়, আবার স্পষ্ট। মুনি বলেন, “তোমার চোখে তাকাও না, ত্রিনয়নী—তুমি যা ছিলে, তাকে চোখে দেখো না, মনে দেখো!” কিন্তু ত্রিনয়নী এবার নিজেই সামনে এগিয়ে আসে, যজ্ঞের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে ফিসফিস করে, “আমি যদি আর কখনো রাত্রি না হই, তাহলে আমি কে?” এবং সে চোখ বন্ধ করে, নিজের কপালের তৃতীয় চোখে নিজের হাত রাখে—আঙুলে আগুন জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে এক তীব্র বিস্ফোরণ, মাটিতে চিড় ধরছে, বাতাস ছিঁড়ে যাচ্ছে।
অর্ঘ্য ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে—প্রদীপ উলটে যায়, আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তারপর—হঠাৎ স্তব্ধতা। ধোঁয়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী মেয়ে—পরনে পুরোনো হলুদ ফ্রক, গলায় লাল হৃদয় লকেট, চোখে জল। সে ধীরে ধীরে বলে, “দাদা?” অর্ঘ্য চিৎকার করে ওঠে, “রাত্রি!”—এবং ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। চারপাশের সাধকরা মাথা নিচু করে বসে পড়েন, মুনি কৃপারাম ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করেন। যজ্ঞ সফল, কিন্তু তার মূল্য একটিই—ত্রিনয়নী আর নেই। রাত্রি ফিরে এসেছে—এক অন্য দেহে, এক নতুন চেতনায়, কিন্তু হৃদয়ে তার সেই পুরোনো ডাক—”দাদা”—এখনও অটুট।
অধ্যায় ৯: ছায়াদের শপথ
যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর বনের মধ্যে ফিরে আসে নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেটি আর স্বাভাবিক নয়—সে নিস্তব্ধতা যেন জমাট, ঠান্ডা, চাপা কিছু লুকিয়ে থাকা স্রোতের মতো। অর্ঘ্য রাত্রিকে নিয়ে মুনির আশ্রয়ে আসে। রাত্রি এখনো কাঁপছে, মাঝে মাঝে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়—আর চোখ খোলার পর মনে হয় যেন সে কিছু দেখতে পায় যা অন্যরা দেখছে না। মুনি কৃপারাম তাকে দেখে বলেন, “ত্রিনয়নী এখন আর নেই, তবে তার চেতনার ছায়া চিরতরে বিলীন হয় না। আগুন শুধু বহন করে, ধ্বংস নয়।” এরপর তিনি অর্ঘ্যর দিকে ঘুরে বলেন, “তুমি কি শুনছো না? বাতাসে সেই গুঞ্জন? যারা যুগে যুগে এই আগুনে পুড়েছে, তারা এখন জেগে উঠছে। ত্রিনয়নী যজ্ঞ যতো পবিত্র, ততই বিপজ্জনক।”
তাদের কথার সত্যতা বোঝা যায় সেদিন রাতেই। আশ্রমের পেছনে ছোট্ট কুয়োর ধারে এক সাধক ধূপ জ্বালাতে গিয়েই পড়ে যায়—তার চোখ দুটি পাথরের মতো কঠিন, মুখ ফ্যাকাশে। সে বলতে পারে না কী দেখেছে, শুধু কাঁপতে থাকে। পরদিন সকাল হতেই দেখা যায়, আশ্রমের দেয়ালে আঁকা ত্রিভুজ চিহ্নগুলো কালো হয়ে গেছে, আর তার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালচে তরল। রাত্রি উঠে এসে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, অনেকক্ষণ চুপচাপ, তারপর বলে, “ওরা চলে যায় না। ওরা ফিরে আসে।” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করে, “কারা?” রাত্রি ধীরে বলে, “যারা আমাকে তৈরি করেছিল… যারা তাদের আত্মা দিয়েছিল সেই চক্ষুর জন্য… তারা এখন ছায়া হয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনো শপথবদ্ধ।”
মুনি তখন ব্যাখ্যা করেন—তন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ কখনো পুরোপুরি বিলীন হয় না। ত্রিনয়নী প্রকল্পের পেছনে ছিল আরও তিন জন নারী, যারা বিভিন্ন সময় ‘ত্রিনয়নী বাহক’ হিসেবে প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত স্তরে ব্যর্থ হয়ে আত্মাহীন হয়ে পড়ে। তাদের চেতনা—‘ছায়া’ হিসেবে আটকে ছিল এই আশ্রমের তলদেশে, সেই পুরনো কুয়োতে। কিন্তু এবার যজ্ঞের আগুনে রাত্রির স্মৃতি ফিরেছে ঠিকই, সেইসঙ্গে জেগে উঠেছে তাদের চেতনাও। রাত্রি জানায়, তার স্বপ্নে এখন তিনটি নারীর মুখ ভেসে আসে—তারা কাঁদে না, চায় না কিছু, শুধু বলে, “আমাদের অসমাপ্ত শপথ শেষ করো।” অর্ঘ্য উদ্বিগ্ন হয়—রাত্রি কি আবার সেই অন্ধকারের দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে? নাকি সে-ই এখন সেই নতুন বাহক?
সন্ধ্যার সময়, আশ্রমের সামনে একটি ছায়া দেখা যায়—মহিলার মতো অবয়ব, কপালে তিনটি চোখের ক্ষতচিহ্ন, হাঁটার শব্দ নেই, কিন্তু ছায়া পড়ে থাকে মাটিতে। রাত্রি জানায়, এদের একজনের নাম ছিল ‘মৃণালিনী’—সে প্রথম বাহক ছিল, যাকে ১৯৭৯ সালে জীবন্ত গঙ্গাজলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। সে বলে, “ওরা চায় আমি তাদের কাজ শেষ করি—তিনজনের মধ্যে আমি একমাত্র জীবিত… আমি না গেলে ওরা ছাড়বে না।” অর্ঘ্য বলে, “তুই যাবি না, কোথাও না! তুই এখন আমার সঙ্গে, রক্ত-মাংসের, স্মৃতির…” কিন্তু রাত্রি চুপ করে থাকে। মুনি কৃপা ধীরে বলেন, “তোমরা প্রস্তুত হও—আগামী পূর্ণিমায় কুয়োর নিচে ঢুকতে হবে। যদি ছায়াদের যজ্ঞ রোধ করা না যায়, তবে এই দুনিয়ায় আর কেউ চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে পারবে না।”
অধ্যায় ১০: কুয়োর নিচে আগুন
পূর্ণিমার রাত। আকাশ ঝকঝকে, কিন্তু তার নিচে জমে আছে অজস্র আঁধার। আশ্রমের পেছনের সেই প্রাচীন কুয়ো—যার চারপাশে শতাব্দীপ্রাচীন তুলসী গাছ, যার গভীর থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসে শ্বাসরুদ্ধ করা গন্ধ—সেই কুয়োর মুখে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য, রাত্রি, এবং আলোচরণ সংঘের চারজন বেছে নেওয়া সাধক। কুয়োর চারপাশে ঘিরে রেখেছে চারটি মাটির মূর্তি—ত্রিনয়নী বাহকাদের প্রতিরূপ। তারা সকলেই চোখে আঁকা তিনটি রেখা, পায়ের নিচে রক্তের দাগের মতো কাপড়ে বাঁধা কাপালিক চিহ্ন। মুনি কৃপারাম বলেন, “এই কুয়ো আসলে সময়ের কূপ—এখানে ঢুকে পড়লে কেবল শরীর নয়, স্মৃতি, বিশ্বাস, এমনকি সত্যের ধারণাও বদলে যায়। কিন্তু তাতেই লুকিয়ে আছে তাদের যজ্ঞের শেষ ছায়া।”
রাত্রি মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে, তার পেছনে অর্ঘ্য। কুয়োর ভেতরে নামা মানে যেন বাস্তবতা থেকে সরে যাওয়া—ঘন নীরবতা, শুধু পায়ের নিচে জলপড়া কিংবা কালের গুঞ্জন শোনা যায়। কিছুদূর নামতেই এক অদ্ভুত সুর ভেসে আসে—কান্নার মতো, আবার যেন পুরনো লোরির মতো। রাত্রি ফিসফিস করে বলে, “ওরা এখানে… ওরা জেগে আছে।” নিচে পৌঁছে দেখা যায়, এক বিশাল গোলাকৃতি কক্ষে জ্বলছে কালো আগুন—পাশে রাখা তিনটি নিথর দেহ, যেন তিনটি জীবন্ত শরীরেই ছায়ারা আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ তাদের চোখ খুলে যায়—তারা একসঙ্গে বলে, “আমরা শেষ করতে এসেছি আমাদের যজ্ঞ, আমাদের জীবন দিয়ে শুরু হয়েছিল, তোমার আত্মা দিয়ে শেষ হবে।” রাত্রি ভয় পায় না, সে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে, “তোমাদের আমি মনে রাখব, তবে তোমাদের দুঃখ আমি আর বহন করব না।”
ত্রিমূর্তি ছায়ারা তখন তাণ্ডব শুরু করে—একজন আগুনে মিশে যায়, একজন ধোঁয়ায়, আর আরেকজন রক্তে। পুরো ঘরটা ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকে, সময় থেমে যেতে যেতে জেগে ওঠে ত্রিনয়নী-র এক নিগূঢ় প্রতিচ্ছবি—এক আধাআলো আধাঅন্ধকার মুখ, যেটা রাত্রিরও নয়, অর্ঘ্যেরও নয়, বরং তাদের মিশ্রণে তৈরি এক নতুন সত্ত্বা। এই বিভ্রমে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য বুঝে যায়—এখানে শক্তির সঙ্গে লড়াই নয়, এখানে ‘চোখ মেলে’ বিশ্বাস করতে হবে। সে নিজের কপালে আঙুল রাখে, চোখ বন্ধ করে উচ্চারণ করে সেই নাম—“রাত্রি!” ঠিক তখনই রাত্রি হেঁটে যায় সেই কালো আগুনের মাঝে, হাত বাড়িয়ে দেয়—তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু চোখে আগুন নেই—আছে জল। সে বলে, “আমি যদি ত্রিনয়নী হয়ে যাই, আমাকে থামিও। কিন্তু আজ আমি রাত্রি হয়ে শেষ করতে চাই এই যজ্ঞ।”
ঘরের মাঝখানে আগুন হঠাৎ নীল হয়ে ওঠে। ছায়ারা চিৎকার করে, “তুমি আমাদের ফেলে দিচ্ছো না তো?” রাত্রি ধীরে বলে, “তোমাদের মুক্তি দিচ্ছি।” তারপর সে কপালে হাত রাখে, চোখ বন্ধ করে থাকে দীর্ঘ সময়। চারপাশে একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে আগুন নিভে যায়, ছায়ারা মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার মতো। ঘরটা স্থির হয়ে পড়ে, কুয়োর মাথার ওপরে দেখা যায় পূর্ণিমার আলো। অর্ঘ্য ছুটে গিয়ে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে—তার চোখ বন্ধ, ঠোঁটে শান্ত হাসি। সে নিঃশব্দে বলে, “আমি ফিরে এসেছি।”
সমাপ্ত