Bangla - প্রেমের গল্প

তোমার নামের মতো সন্ধ্যা

Spread the love

অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত


পর্ব ১

মৌনতারও একটা শব্দ আছে। আর সেই শব্দ যখন কারও চোখে জ্বলে ওঠে, তখন তাকে বলা যায় প্রেম।
আসলে এই গল্পটা একটা ট্রেন স্টেশনে শুরু হয়নি, বা কোনও প্রজাপতি আঁকা ডায়রির পাতায়ও নয়। এটা শুরু হয়েছিল এক সন্ধ্যায়, হাওয়ার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক মেয়ের চুলের গন্ধে।

সন্ধ্যা ছট ছট করছিল সেদিন। আমি তখন কলেজের শেষে চাকরির খোঁজে একেবারে নাকাল। নিউ আলিপুরের এক নামী কোচিং সেন্টারে নতুন জয়েন করেছি, একরকম ফ্রিল্যান্স টিচার হিসেবে। প্রথম দিন, প্রথম ক্লাস—তাই হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলাম, পাছে কোনও ভুল না হয়। ক্লাসে ঢুকতেই দেখি প্রায় আট-ন’জন স্টুডেন্ট, চুপচাপ বসে। এদের মধ্যেই ছিল সেই চোখটা, যেটার কথা বলছিলাম।

সে প্রথম তাকিয়েছিল আমার দিকে। এক মুহূর্ত। তারপর নিচু চোখে ফের খাতা খুলে ফেলেছিল। আমি নিজেকে বোঝাতে চেয়েছিলাম—”এ কিছু না, ও হয়তো সব স্যারের দিকেই এমন করে তাকায়।” কিন্তু তবুও আমার ভিতরে কোথাও একটা কাঁপুনি টের পেয়েছিলাম।

তার নাম ছিল—অনিন্দিতা। ডাকনাম টুকটুকে সুন্দর—নন্দু। সে কেমিস্ট্রির ছাত্রী, কিন্তু তার চোখে যেন সাহিত্যের পাতারা গুঁড়িয়ে আছে। ক্লাসের পরে যখন আমি ওয়াটার বোতল খুঁজছি, ও হঠাৎ উঠে এসে বলল, “স্যার, আপনার বোতলটা এটা না?”

আমি তাকিয়ে দেখলাম, আমার নীল বোতল ওর হাতে। ধরা পড়ার মতো একটা হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।

“হ্যাঁ, ধন্যবাদ… নন্দু, তাই তো?”

সে একটু অবাক, বলল, “স্যার, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?”

আমি হেসে বললাম, “তোমার খাতার ওপর লেখা ছিল। নীল কালিতে। আর নিচে একটা ছোট্ট হৃদয়ের চিহ্ন।”

নন্দু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তারপর বলল, “ওটা আমি অভ্যেসে এঁকে ফেলি…মানে, যেকোনো কিছুর পাশে একটা হার্ট দিয়ে দিই।”

সেদিনের পর থেকে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগটা শুধুই শিক্ষক-ছাত্রীর গণ্ডিতে ছিল, কিন্তু একটা নিরব ছন্দ বেজে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। যেমন ধরো, ক্লাসে আমি যখন কোনও উদাহরণ দিতাম ‘অণু আর পরমাণুর বন্ধনের মতো সম্পর্ক’, নন্দু তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে।

একদিন ক্লাস শেষে ও বলল, “স্যার, আপনি এত সুন্দর করে পড়ান! কখনও ক্লাস যেন শেষ না হয়।”

আমি জবাবে শুধু বলেছিলাম, “সুন্দর শুনলে সাহস আসে।”

তারপর থেকে আমি লক্ষ্য করতাম—নন্দুর খাতায় আমার বলার ভঙ্গিটা, ছোট ছোট কথা, এমনকি বোর্ডে লেখা চকের রেখাগুলো পর্যন্ত হুবহু টুকে রাখত। একটা অদ্ভুত আন্তরিকতা ছিল ওর মধ্যে, যে আন্তরিকতা আমাকে টানত।

একদিন ক্লাসের পরে বৃষ্টি নামল। সবাই দৌড়ে বেরিয়ে গেল, শুধু নন্দু দাঁড়িয়ে ছিল জানালার ধারে। আমি বললাম, “ছাতা আনোনি?”

ও মাথা নাড়ল। “ভিজে ভিজে বাড়ি যেতে ভালো লাগে। এই তো, জল জমে গেছে রাস্তায়, অদ্ভুত নয়?”

আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই অদ্ভুত। আলো আর জলে ভিজে পথ যেন জলরঙে আঁকা।

“চলো, আমি তোমায় এগিয়ে দিই। আমার ব্যাগে একটা অতিরিক্ত ছাতা আছে,” আমি বললাম।

নন্দু একটু ইতস্তত করেছিল। তারপর হাসল। সেই হাসিটা আমি আজও ভুলি না।

রাস্তার ধারে ছাতা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কথাবার্তা শুরু হল। নন্দু বলল, “স্যার, আপনি কোনওদিন প্রেমে পড়েছেন?”

আমি থমকে গিয়েছিলাম। একটা ছাত্রীর মুখে এমন সরাসরি প্রশ্ন… আমি সামলে নিয়ে বললাম, “হয়তো, বা না-ও। জীবনে তো এমন কিছু অনুভব হতেই পারে, যেটা প্রেম না হয়েও প্রেমের মতো।”

নন্দু তখন হালকা গলায় বলেছিল, “যেমন আপনার চোখে বৃষ্টি ভালো লাগা, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, বইয়ের পাতার গন্ধ… এগুলো প্রেমের মতো না?”

আমি একটু হেসেছিলাম। তারপর শুধু বলেছিলাম, “তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো নন্দু।”

ও বলেছিল, “বড় হইনি স্যার, শুধু একটু বেশিই অনুভব করি।”

আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বড় রাস্তায়। ও বলল, “স্যার, আপনি কী জানেন? আমার জীবনের প্রথম ছাতাটা এই।”

আমি ওর দিকে তাকালাম। “এই মানে?”

“মানে, আমি কখনও কারও সঙ্গে ছাতা ভাগ করে চলিনি। এটা একটা নতুন অনুভব। আপনি বুঝছেন না!”

হঠাৎ করে আমার বুকের ভিতর কেমন যেন একটা চাপা দোলা বয়ে গেল। সেই সন্ধ্যায় আমি নিজের ছায়াকেও কিছুটা অপরিচিত মনে করছিলাম।

পরদিন ক্লাসে ও ছিল না। তারপর দিনও না। এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। অজান্তেই প্রতিদিন ওর চেয়ারে চোখ চলে যেত। কোচিং-এ জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কিছু জানে না।

দু’সপ্তাহ পরে একদিন হঠাৎ অফিসের বাইরে ও দাঁড়িয়ে। চোখে চশমা, ক্লান্ত মুখ, কিন্তু একটা আশার রেখা ফুটে ছিল।

“স্যার, একটু সময় হবে?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “এসো।”

ও বলল, “মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হসপিটাল, ওষুধপত্র, ঘর সামলাতে গিয়ে… ফোন করতেও পারিনি।”

আমি কিছু বলিনি। শুধু বললাম, “আজকে ফিরবে কি আবার ক্লাসে?”

ও বলল, “ফিরব। আপনি যদি থাকেন।”

আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “আমি তো আছিই।”

সেইদিন থেকেই গল্পটা আর শিক্ষক-ছাত্রীর পরিসরে থাকেনি। সন্ধ্যার মতো ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এসেছিল আমাদের মধ্যে এক অমোঘ আড়ালহীনতা। আমি জানতাম, এটা ‘ঠিক’ নয় হয়তো। কিন্তু কে ঠিক আর কে ভুল, সেই হিসেব যে হাওয়ার মতো উড়ে যায় অনুভবে।

পর্ব ২

জীবনে কিছু সম্পর্কের নাম হয় না, কিছু অনুভবের ব্যাকরণ থাকে না—তবু তারাই সবচেয়ে বেশি সত্যি হয়ে ওঠে। নন্দুর ফেরার পর সেই কোচিং ক্লাসটা যেন বদলে গেল। এখন আর ও শুধু একজন ভালো ছাত্রী নয়, সে আমার চোখের কথা বোঝে, নীরবতার মানে বোঝে, এমনকি আমার বিষণ্ণতা পর্যন্ত ধরতে পারে। আমি বুঝতে পারতাম—এই সম্পর্কটা ক্লাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু একটা আমার ভিতরে আমাকে আটকে রাখত। আমি নিজেকে বলতাম—”তুমি শিক্ষক, ও ছাত্রী। এই টান যেন ভুল পথে না যায়।” কিন্তু সত্যি বলতে কী, যতই ভাবি এটাকে ‘ভুল’ বলে, ততই যেন হৃদয়ের মধ্যে অজানা এক সত্যের দোলা জেগে ওঠে। ক্লাস শেষে একদিন নন্দু হঠাৎ বলল, “স্যার, আপনি কি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসেন?” আমি একটু হেসে বললাম, “আমি বাঙালি, নন্দু। সেটা উত্তর?” সে হেসে বলল, “ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার একটাই প্রিয় কবিতা আছে—‘তুমি সন্ধ্যার মতো’। আপনি পড়েছেন?” আমি বললাম, “অনেকবার। এমনকি একবার কাউকে উপহারও দিয়েছিলাম কবিতাটা, চুপচাপ, বইয়ের পাতার ফাঁকে রেখে।” নন্দু বলল, “সে কি পেয়েছিল?” আমি একটু চুপ করে বললাম, “হয়তো পেয়েছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি না জানি না।” সে চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি পেলে বুঝে নিতাম। সন্ধ্যার মতো জড়িয়ে থাকতাম পাশে।” আমি সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। সেদিন ক্লাস শেষে আমি আর ও হাঁটছিলাম কলেজ স্কোয়ারের দিকে। শীতকাল, সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে, চারপাশে হালকা কুয়াশা। আমি বললাম, “তুমি কি জানো, ভালোবাসা অনেক সময় মুখে আসে না। সেটা হাঁটার শব্দেও হতে পারে, কিংবা কারও ছায়ার পাশে ছায়া হয়ে থাকার ইচ্ছেতে।” সে বলল, “আপনার কথা সবসময় মনে রাখি। আপনি অনেক আলাদা, জানেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন আলাদা?” নন্দু বলল, “কারণ আপনি কাউকে মুগ্ধ করতে চান না, শুধু অনুভব করাতে চান। আজকাল এমন মানুষ কম হয়।” আমরা বসেছিলাম এক বেঞ্চে, কলেজ স্কোয়ারের মোড়ের কাছে। চারপাশে আলো জ্বলেছে, দূরে রিকশার টুং টাং শব্দ, কিছু সান্ধ্য প্রেমিক-প্রেমিকা, আর সেই নিঃশব্দে জমা হয়ে ওঠা সন্ধ্যা। হঠাৎ নন্দু বলল, “আপনি জানেন স্যার, আমার মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। দমদমের এক ছেলেকে—সে এখন চাকরি করে দুবাইয়ে।” আমার হৃদয় যেন আচমকা থমকে গেল। “বিয়ে? তুমি কি রাজি?” আমি চেষ্টা করলাম স্বাভাবিক থাকতে। সে বলল, “আমি কিছু বলিনি এখনও। কিন্তু আমার মা চায় আমি যেন চাকরি না করি, সংসার করি। তারা ভাবে, প্রেম একটা বিলাসিতা, আর ভালোলাগা—সেটা সময় নষ্ট।” আমি বললাম, “তোমার নিজের ইচ্ছেটা কী বলো তো?” সে জানাল, “আমি তো শুধু পড়তে চেয়েছিলাম। নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু কে শোনে আমার কথা? আমার মন বলে, কারও পাশে দাঁড়াতে গেলে আগে নিজের ভেতরটাকে বুঝতে হয়।” আমি কিছু বললাম না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখে একটা ভয়, একটা চাপা প্রতিবাদ—যেটা শব্দে আসে না, কিন্তু হৃদয় বুঝে যায়। আমি বললাম, “তুমি চাইলে লড়তে পারো। তোমার মতো সাহসী মেয়েরা একটা নতুন পথ তৈরি করতে পারে।” সে বলল, “আপনি থাকবেন আমার পাশে?” এই প্রশ্নে আমি চুপ করলাম। আমি কি থাকতে পারি? আমি কি পারব সমাজের চোখ এড়িয়ে, শিক্ষকের গণ্ডি পেরিয়ে, ওর জীবনের সঙ্গে নিজের নাম জুড়তে? আমি বললাম, “আমি পাশে থাকব যতদূর পারি, যতক্ষণ পারি।” সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে আজ একটা কথা বলুন, যা আমি মনে রাখব সবসময়।” আমি চোখ বন্ধ করে একটুখানি ভেবে বললাম, “তুমি সন্ধ্যার মতো। তুমি আসলে আলো কমাও না, বরং অন্ধকারকেও নরম করে দাও।” ও হাসল, একরাশ নরমতা নিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি কিন্তু সত্যি সন্ধ্যাকে ভালোবাসি। কারণ ওর মধ্যে দিন আর রাতের মাঝের একটা দ্বিধা আছে। ঠিক যেমন আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এখন আছে।” আমি নীরব হয়ে পড়লাম। কারণ সত্যি, আমরা তখন দুজনেই একটা দ্বিধার ভিতর দিয়ে হাঁটছিলাম—না প্রেম, না দূরত্ব। সেদিন রাতে আমি ঘরে ফিরেও চুপচাপ ছিলাম। এক কাপ চায়ের কাপের গায়ে স্পর্শ ছিল নন্দুর হাতে ধরা ছাতার মতো উষ্ণতা। ফোনে কোনও মেসেজ ছিল না, কোনও কলও না। তবুও বুকের ভিতর কোথাও একটা শব্দ বাজছিল—সন্ধ্যা। ভালোবাসা। আর একটা অসমাপ্ত কবিতা। রাত গভীর হতেই আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখলাম—
“যদি কোনওদিন এই শহরের বাইরে চলে যাই, তবে সন্ধ্যাকে মনে রেখো। সে আমায় মনে করাবে।”
পরদিন ক্লাসে আমি চিরকুটটা রেখে দিলাম নন্দুর খাতার পাতায়। সে হয়তো বুঝবে, হয়তো না। কিন্তু এই মুহূর্তে, আমি শুধু চাই, সে নিজের সিদ্ধান্ত নিক। প্রেম যদি সত্যি হয়, সে ফিরে আসবে। আর যদি না আসে, তবুও সে রয়ে যাবে আমার কবিতার মতোই—তোমার নামের মতো সন্ধ্যা।

পর্ব ৩

সন্ধ্যার সেই বেঞ্চটা এখনো আছে, কিন্তু সেখানে বসে আর কেউ আমার দিকে তাকিয়ে বলেনা—“আপনি বুঝিয়ে দেন, কথার চেয়েও গভীর কিছু থাকে।” নন্দু এখন আর প্রতিদিন আসে না। ক্লাসে আসে না, ফোনও করে না। আমি বুঝতে পারি, দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে বোঝাই, আমি শুধু একজন শিক্ষক নই—আমি ওর নীরব কথার শ্রোতা হতে চেয়েছিলাম। সেদিন যখন চিরকুটটা ওর খাতায় রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম হয়তো ও আমাকে কিছু বলবে। হয়তো একটা সংকেত দেবে। কিন্তু ও কিছু বলেনি। শুধু মাথা নিচু করে ক্লাস শেষে চলে গিয়েছিল। সেই যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত শীতলতা ছিল। তারপরের দুদিন, তিনদিন, চারদিন—ও এল না। কোচিং-এর রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম, “নন্দু ক্লাসে আসছে না কেন?” কেউ কিছু বলতে পারল না। একটা স্টাফ বলল, “মেয়েটা কি আপনার একটু পরিচিত ছিল না স্যার? কিছু সমস্যা হয়েছিল কি?” আমি মাথা নাড়লাম—না, কিছু বলিনি। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা বাড়তে লাগল। মানুষ যখন কাউকে ভালোবেসে ফেলে, তখন তার প্রত্যেকটা অনুপস্থিতিই যেন শরীরে গর্জে ওঠে। আমি প্রায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। বারবার ভাবতাম—ও কি চলে গেল? ও কি বুঝতে পারল না আমার অনুভব? নাকি ও নিজেই নিজেকে সরিয়ে নিল এই টান থেকে? পঞ্চম দিনে ও এল। একেবারে ভোরবেলা, ঠিক যখন ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু আজ ও খাতায় কলম রাখল না। শুধু দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে। আমি ক্লাস নেওয়ার ভান করছিলাম, কিন্তু চোখ বারবার ওর দিকে চলে যাচ্ছিল। সবাই চলে যাওয়ার পরে ও এগিয়ে এসে বলল, “স্যার, আপনি কি জানেন, আমি অনেকটা হেঁটেই এসেছি আজ। বাসে উঠতে ইচ্ছে করল না। আমার মনে হচ্ছিল হাঁটতে হাঁটতে যদি সব ভুলে যেতে পারি, যদি কোনওভাবে নিজেকে বোঝাতে পারি, যে আপনার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত শুধু কল্পনা ছিল।” আমি চুপ করে ছিলাম। ওর কণ্ঠে অভিমান ছিল না, ছিল ক্লান্তি। আমি বললাম, “তুমি তো সবটা জানো না নন্দু। আমি তো… প্রতিদিন সন্ধ্যায় তোমার জন্য অপেক্ষা করি। আমার টেবিলের পাশে তোমার ওই ছাতাটা পড়ে থাকে—তুমি যেদিন ভিজে চলে গেলে রেখে গেলে। আমি ফেলে দিইনি। ছুঁয়ে থাকি প্রতিদিন।” ওর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। বলল, “আমি বুঝেছিলাম। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম স্যার। জানেন তো, সমাজ আমাদের মতো সম্পর্ককে বোঝে না। কেউ একজন যখন বলেন ‘তুমি সন্ধ্যার মতো’, তখন সমাজ বলে ‘এটা শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক নয়।’ আমি ভেবেছিলাম সরে গেলেই ভালো।” আমি বললাম, “তুমি কি জানো নন্দু, অনেক সময় সরে যাওয়া মানেই সবকিছু ফেলে দেওয়া নয়। মাঝে মাঝে সেটা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু বাঁচার মধ্যে যদি একাকীত্ব থাকে, তবে সেই বাঁচা তো মরারই নামান্তর।” ও ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসে পড়ল। বলল, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্যার। আমি বিয়ে করব না। অন্তত এখনই না। মা-বাবাকে বলেছি, আরও এক বছর সময় চাই। নিজেকে তৈরি করতে চাই। নিজেকে চিনতে চাই। আপনাকে সময় দিতে চাই।” আমি ওর হাতটা ধরলাম। কত সহজ, কত সোজাসাপ্টা এই মেয়েটা। অথচ এমন সরলতা হয়তো সবাই বোঝে না। আমি বললাম, “তোমার মা-বাবা মানল?” ও মাথা নেড়ে বলল, “না। এখনও নয়। কিন্তু আমি জানি, একদিন মানবে। আমি চুপ করে থাকলে ওরা ভাবে আমি রাজি। কিন্তু এবার আমি কথা বলেছি, স্পষ্টভাবে। ওরা ভাবছে, আমি বদলে গেছি।” আমি হেসে বললাম, “তুমি বদলে যাওনি। তুমি শুধু নিজের ভেতরের মেয়েটাকে চিনতে শুরু করেছো। এটা বড় পাওয়া।” আমরা সেদিন আর ক্লাসে বসে থাকিনি। বেরিয়ে পড়েছিলাম কলেজ স্কোয়ারের দিকেই। আগের সন্ধ্যার মতোই হালকা কুয়াশা, কিন্তু এবার আলোটা বেশি ছিল—হয়তো ভেতরের আলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী হতে চাও নন্দু?” ও বলল, “আমি শিক্ষক হতে চাই। আপনার মতো।” আমি বললাম, “তোমার মতো হও। আমি শুধু অনুভব করাতে চাই, তুমি বোঝাতে শিখো। তফাত আছে।” ও হেসে ফেলল, বলল, “আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে জীবনটা একটু বুঝতে পারি। আগে এতটা সাহস ছিল না। আপনি যেন একটা আয়নার মতো, যেখানে আমি নিজেকে দেখতে পাই, ছাপানো নয়—আসল রূপে।” আমি বললাম, “কিন্তু আয়না তো নিজেকে দেখতে পারে না।” ও বলল, “তাই তো আমি চাই, আমি হয়ে উঠি আপনার জন্য একটা জানালা—যেখান দিয়ে আপনি নিজের আলো দেখতে পাবেন। হয়তো একদিন।” সেই সন্ধ্যায় প্রথমবার, আমি ওর হাতটা ধরেছিলাম, কোনও দ্বিধা ছাড়াই। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, অটো আসছে যাচ্ছে, দূর থেকে ঘণ্টা বাজছে কোথাও—তবু আমাদের চারপাশে যেন এক নিঃশব্দ আবরণ। ও বলল, “এই সন্ধ্যাকে মনে থাকবে আপনার?” আমি বললাম, “তুমি তো আমার প্রতিটি সন্ধ্যাকে নিজের নামে করে নিয়েছো। এখন আর আলোর অভাব নেই।” কিছু সম্পর্ক না বলে বোঝানো যায়। কিছু সম্পর্ক চুপ করে থাকলেও পল্লবিত হয়। সেদিন আমি আর নন্দু কোনও ছবি তুলি না, কোনও কবিতা লিখি না, শুধু অনুভব করি—আমরা আছি, দুজনে, এই শহরের কোনও এক অলিন্দে, কিছু না বলেই সবটা বলে ফেলেছি।

পর্ব ৪

প্রেম যখন জন্ম নেয়, তখন তার বয়স হয় না, ঠিক-ভুল হয় না—হয় শুধু একটি নামহীন সাহস, যা গোপনে হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। নন্দু আর আমি এখন আর কোচিং ক্লাসের নিয়মে মেলে না। এখন আমরা দেখা করি রবিবার দুপুরে, রবীন্দ্রসদনের সামনে, দু’কাপ কফি আর কিছু অকারণ কথা নিয়ে। আগের দিনের মতো ওর চোখ এখনো বলে, “তুমি কি জানো, তুমি আমার জগৎটা একটু একটু করে গড়ছো?” আর আমার মুখে যেটা আসতে চায় কিন্তু আসে না—“তুমি আমার সমস্ত একাকীত্বে সন্ধ্যার আলো লাগিয়ে দিলে।”

একদিন ও বলল, “স্যার, আমি আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।”
আমি বললাম, “আজও তুমি আমায় ‘স্যার’ ডাকো কেন?”
ও মাথা নিচু করে বলল, “ভেতরে ভেতরে আপনি এখনও আমার শিক্ষক। আমি অনেক কিছু শিখি আপনার কাছ থেকে।”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে আজ আমিই শিখব তোমার দেখানো পথে। চল।”

ও আমাকে নিয়ে গেল চিৎপুরের এক পুরনো গলিতে, একটা সাদামাটা দোতলা বাড়ির সামনে। বলল, “এখানে আমার এক ঠাকুমা থাকতেন। এখন ঘরটা খালি পড়ে আছে। আমি মাঝে মাঝে এখানে এসে বসি, ভাবি।”
আমি ভেতরে ঢুকতেই একটা পুরনো কাঠের গন্ধে ভরে উঠল বুক। যেন শারদ সন্ধ্যার গন্ধ। দেয়ালে কিছু বিবর্ণ ছবি, টেবিলে কিছু ধুলো মাখা বই। একপাশে ছোট্ট জানালা, সেখান দিয়ে আলো এসে পড়ছে একটা আয়নার গায়ে।

নন্দু বলল, “আমি এই আয়নাটার সামনে বসে নিজেকে চিনেছি। যখন চারপাশ চুপ হয়ে যেত, তখন এখানে এসে আমি কেঁদে ফেলতাম, আবার নিজের চুল বেঁধে বেরিয়ে যেতাম নতুন করে। আপনি বলেছিলেন না, আয়নাও নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায় না? আমি তাই আয়নাকে নিজের মতো করেছিলাম। ও ছিল আমার সাহস।”

আমি কিছু বলিনি, শুধু ওর কাঁধে হাত রেখেছিলাম। বলেছিলাম, “আমায় এই জায়গাটা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি যেন তোমার ভেতরের একটা চাবিকাঠি পেলাম।”
ও বলল, “আপনি জানেন, আমি আপনাকে ছাড়া কারও সঙ্গে এতখানি ভাগ করে উঠতে পারি না। আমি জানি না এটা প্রেম কিনা, আমি শুধু জানি আপনি থাকলে আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখি।”

আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। কিন্তু জানি, কিছু অনুভব স্পর্শের বাইরে থাকে। আমরা শুধু বসেছিলাম পাশাপাশি, একটা টিনের ট্রে-তে রাখা দুটি পুরনো কাপে লাল চা নিয়ে। চারপাশে কেমন যেন স্তব্ধতা, তবুও মনে হচ্ছিল কত শব্দ কানে বাজছে—হৃদয়ের কথা, অলিখিত স্বপ্ন, হয়তো ভবিষ্যতের আভাস।

নন্দু হঠাৎ বলল, “স্যার, আপনি কি জানেন, আমি আপনাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি?”
আমি একটু চমকে গিয়ে বললাম, “আচ্ছা? কী লিখেছো?”
ও ব্যাগ থেকে একটা ছেঁড়া খাতা বার করল। পাতাগুলো ভাঁজ হয়ে গেছে, একপাশে কফির দাগ। ও পড়তে শুরু করল—

“একটা সন্ধ্যে, নীরব ছায়া হয়ে পাশে হেঁটে যায়,
একটা মানুষ, যার চোখে শব্দ নেই—তবু তার ভাষা বাজে বুকের ভিতর।
আমি তাকে ডাকিনি, তিনি নিজে এসে দাঁড়িয়েছেন,
আমার নির্জন বারান্দায়, আমার সব অনিচ্ছের পাশে।
তিনি জানেন, আমি ভয় পাই প্রেমকে,
তবু তিনি আমায় ভালোবেসে ফেলেছেন—
ঠিক যেমন সন্ধ্যে ভালোবাসে আলোকে ছুঁয়ে থাকা অন্ধকারকে।”

আমার গলা শুকিয়ে এলো। বললাম, “তুমি তো… আমার থেকেও ভালো করে লিখো।”
ও বলল, “কারণ আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সত্যি বলছি স্যার, আজকে না বললে আর পারতাম না। আমি চাই না এই অনুভব অর্ধেক থেকে যায়।”

আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এই মেয়েটি যে এতখানি নির্ভীক হয়ে বলতে পারে, সেটাই তো আমার প্রথম ভালোবাসার পর অনুভব করা দ্বিতীয় সত্যি। আমি ওর হাত ধরলাম, এবার আর চুপ করে নয়—স্পষ্ট করে বললাম, “নন্দু, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেই প্রথম দিন, যেদিন তুমি আমার বোতল ফিরিয়ে দিয়েছিলে, সেই মুহূর্তেই তুমি আমার শ্বাসের ছন্দ হয়ে গেছো। আমি চেয়েছি না তুমি জানো, কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম—আমার বয়স, আমার ভূমিকা, সমাজের চোখ, তোমার ভবিষ্যৎ। কিন্তু আজ বুঝলাম, ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে তা সময়, নিয়ম, গণ্ডি—সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমি চাই, তুমি পাশে থাকো। কিন্তু যদি না থাকতে পারো, তাও তোমার সেই কবিতাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কবিতা হয়ে থাকবে।”

ও চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে আমার কাঁধে মাথা রাখল। বলল, “আমি পাশে থাকব। যতদিন সন্ধ্যে নামে, যতদিন অন্ধকার আলোকে খোঁজে, ততদিন আমি থাকব। আপনি আমায় শুধু ভয় না পেতে শেখান।”

সেদিন বিকেলে আমরা চুপচাপ হেঁটেছিলাম সেই পুরনো বাড়ি থেকে বেরিয়ে, যেন দুজনেই একটু বদলে গেছি। আর যা বদলায়, তা ফিরে আসে না আগের রূপে।

প্রেম তার গতি পায় কখনও কবিতায়, কখনও নীরবতায়। আর আমাদের প্রেম—তা এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যায় পৌঁছনোর মাঝখানে এক অস্পষ্ট আলো, যাকে নাম না দিলেও চিনে ফেলা যায় হৃদয়ের আলোয়।

পর্ব ৫

মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে, তখন সে সময়ের হিসেব রাখে না, দিন-মাস-তারিখের কথা ভাবে না। শুধু সেই মুহূর্তগুলোর কথা মনে রাখে—যেখানে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিল, কেউ একজন কাঁধে হাত রেখেছিল, কিংবা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে একসাথে নীরবতা ভাগ করেছিল। আমাদের সম্পর্কটা ঠিক তেমনই হয়ে উঠেছিল—নন্দু আর আমি, আলাদা জগতের মানুষ, কিন্তু অনুভবের একটানা সেতু বেয়ে একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এখন নন্দু আমাকে ‘স্যার’ ডাকে না। ‘রুদ্র’ নামে ডাকে। প্রথম যেদিন বলেছিল, হঠাৎ করে আমি নিজের নামটাই চিনে উঠতে পারিনি। কতদিন পর কেউ আমায় রুদ্র বলে ডাকল, তা মনে করতে পারিনি। অথচ ওই ডাকেই এতখানি আলতো অনুভব গোপন ছিল, যেটা কানে নয়—বুকের গভীরে গিয়ে লাগে।

আমরা এখন মাঝে মাঝে বইয়ের দোকানে যাই, পুরনো বইয়ের গন্ধ নিই। নন্দু প্রতিবারই কোনও না কোনও কবিতার বই কেনে—হয় জীবনানন্দ, নয়তো শঙ্খ ঘোষ। আমি বলি, “তুমি শুধু কবিতা পড়ো কেন?” ও হেসে বলে, “কারণ গল্পে সময় লাগে, কবিতায় অনুভব লাগে। আর আমি তো সময়ে নয়, অনুভবে বাঁচতে চাই।” একদিন প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে বসে ও বলল, “তুমি কি জানো, আমি চাই, একদিন আমাদের দুজনের একটা কবিতার বই বের হোক। তুমি কবিতা লেখো না কেন রুদ্র?” আমি বললাম, “তুমি থাকলে তো কবিতা লেখার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিটি মুহূর্তই তো তোমার সঙ্গে কবিতা হয়ে যায়।” ও চোখে মুখে চুল সরিয়ে বলল, “ভালোবাসার কথা এমন করে কেউ বলে না।” আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভালোবাসা তো বলার নয়, বোঝার। তুমি বোঝো, সেটাই যথেষ্ট।”

এইভাবে এক মাস কেটে গেল। দিনগুলো যেন গলে গলে মেঘ হয়ে উঠল। আমরা দেখা করতাম নির্দিষ্ট কোনও দিনে নয়, যেখানে সময় মিলত, সেখানেই। কখনও কলেজ স্কোয়ার, কখনও সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি, কখনও শুধু একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে, গরম নুন-লেবু চা খেতে খেতে। একদিন সন্ধ্যা নামছিল। আমি আর নন্দু বালিগঞ্জ স্টেশনের পাশে একটা ছোট প্ল্যাটফর্ম বেঞ্চে বসেছিলাম। দূরে ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে, মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছে। হঠাৎ ও বলল, “রুদ্র, যদি কোনওদিন আমি আর না থাকি, যদি হঠাৎ কোথাও হারিয়ে যাই, তুমি কি খুঁজবে আমাকে?” আমি হেসে বললাম, “তুমি কি সত্যিই মনে করো, তোমাকে খুঁজতে হবে? তুমি তো প্রতিটি শব্দের ভেতরে ঢুকে গেছো আমার। তোমাকে হারানো মানে নিজেকে হারানো।” নন্দু চোখ নামিয়ে বলল, “তবু অনেক সময় আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে ধরে রাখতে পারি না। পারিপার্শ্বিকতা, পরিবার, সমাজ, হাজার কিছু এসে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। তখন মনে হয়, এই ভালোবাসার কি কোনও ঠিকানা নেই?” আমি বললাম, “ভালোবাসা ঠিকানার জন্য নয়। এটা পথের মতো, পাশে থাকার মতো। তুমি যদি সত্যিই ভালোবাসো, তবে একদিন না একদিন সেই ঠিকানাও খুঁজে নেবে।” ও চোখ মুছল, আমি জানি সেটা ঘাম নয়—চোখের জল।

সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারিনি। নন্দু ক্লাসে ফিরে গিয়েছিল, আমি কোচিং শেষে একা হেঁটেছিলাম ধর্মতলার দিকে। হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ এল—“আজ একটা কথা না বললেই নয়। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। মা আবার পাত্র দেখছে। বলছে আর সময় নেই, এবার পাকা কথা হবে। আমি কিছুতেই থামাতে পারছি না। কিছু একটা করো, রুদ্র।” আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতদিন ধরে আমরা যেটা ভেবেছিলাম ‘সময়ের বাইরে’র সম্পর্ক, সেটা এখন সময়ের আঘাতে কেঁপে উঠছে। আমি কী করব? আমি তো কোনও বড় চাকরি করি না, আমি ওর বাড়ির যোগ্য হব না—এসব আমি জানি। তবুও, হৃদয়ের গলায় যে প্রতিবাদ জমে উঠছিল, সেটা চেপে রাখতে পারছিলাম না।

আমি ওকে ফোন করলাম। বললাম, “নন্দু, আমরা একবার তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করি। আমি বলব সবটা। তোমার বাবা না মানলে না মানুক, কিন্তু তোমার মা—তিনি তো তোমার মনের কথা বোঝেন?” ও বলল, “না রুদ্র, তুমি জানো না, মা বাইরে যতটা নরম, ভিতরে ততটাই ভয় পায় সমাজকে। আমি জানি, তিনি রেগে যাবেন। হয়তো আমাকেই আড়াল করে রাখবেন। আমি ভয় পাচ্ছি।” আমি চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, আমার প্রেম আর সাহসের মধ্যে ফারাক আছে। সাহসটা ওর, আমি তো শুধু অনুভব করতাম। তখনই ও বলল, “আমরা কোথাও চলে যেতে পারি না রুদ্র? হয়তো কোথাও একসাথে একটা ঘর, একটা ছোট চাকরি—তুমি টিউশন দেবে, আমি কোচিং পড়াবো। নতুন করে বাঁচব।” আমি জানি ওর কথায় রোম্যান্টিকতা আছে, কিন্তু বাস্তব কোথাও যেন ছায়া ফেলে দিচ্ছে। তবু আমি বললাম, “চলো, না হয় সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে একটা জীবন শুরু করি।” ও বলল, “তুমি কি পারবে?” আমি বললাম, “তোমার জন্য আমি পারব না এমন কিছু নেই। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো, সন্ধ্যার মতো নরম থেকে যাও।” ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে একটা চিঠি রাখি আমি, মায়ের জন্য। আর একটা রাখো তুমি, তোমার বাড়িতে। কেউ খুঁজতে এলে জানবে, আমরা পালিয়ে যাইনি, আমরা ভালোবাসতে শিখেছি।”

সেদিনই রাতে আমি একটা ব্যাগ গোছালাম—কিছু জামাকাপড়, কিছু টিউশন খাতার কপি, আর একটা বই—তুমি সন্ধ্যার মতো। এর পৃষ্ঠার ভেতরে রেখে দিলাম ওর দেওয়া সেই কবিতাটা। আগামীকাল সকাল সাতটায় আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে একটি লোকাল ধরে বেরিয়ে যাব অজানা শহরের পথে। আমি জানি না, আমাদের ভবিষ্যৎ কী। হয়তো কোথাও থেমে যাব, কোথাও ধাক্কা খাব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি জানি—আমার পাশে যে আছে, সে নামের মতোই সন্ধ্যা, ধীরে ধীরে বিস্তার করে আমাকে নিজের আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে।

পর্ব ৬

সকালের হাওড়া স্টেশন, লাল-সবুজ-হলুদ মানুষের ভিড়ে হাঁটছিলাম আমরা দু’জন—নন্দু আর আমি। কেউ কিছু জানে না, কেউ চিনেও না। অথচ আমাদের দু’জনের মধ্যে যে স্পর্শ ছিল, তার চেয়ে গভীর আর কিছু হতে পারে না। আমি ওর হাত ধরে ছিলাম, শক্ত করে, যেন একটা ট্রেন না এসে আমাদের আলাদা করে দেয়। ট্রেনটা এসেছিল—বর্ধমান লোকাল, ৬:৫৫। আমরা উঠে পড়েছিলাম পেছনের কামরায়। জানলার ধারে বসে ছিল নন্দু, আর আমি ওর পাশে।
আমি বলেছিলাম, “তুমি ঠিক তো? ভয় করছে?”
নন্দু আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ভয় লাগছে না বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু এখন ভয়টাকেও ভালোবাসার মতো আপন মনে হচ্ছে। জানো কেন?”
আমি মাথা নাড়লাম।
“কারণ ভয়টা তোমার পাশে বসে আছে।”

ট্রেন চলছিল। জানলার বাইরে জানালার মতোই দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল দৃশ্য। মানুষের মুখ, কাকের উড়ে যাওয়া, পিচঢালা পথ, বাঁধানো ঘাট, কিছু অজানা স্টেশন। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা যেন একটা কবিতার লাইনের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছি—যার শেষ নেই, শুধু ছন্দ আছে।

আমি নন্দুকে বললাম, “তুমি ঠিক করেছো কোথায় নামব?”
ও বলল, “শ্রীরামপুরে নামব। ওখানে এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল, এখন খালি পড়ে আছে। আগে গিয়ে দেখি জায়গাটা কেমন, তারপর ঠিক করব।”

শ্রীরামপুর পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। আমরা নামলাম, একটা ব্যাগ আর দুটো মানুষ নিয়ে। স্টেশনের বাইরেটা যেন একটা ছোট্ট শহরের মতো—নোংরা নয়, ভিড় নেই, কিন্তু কোথাও একটা ক্লান্তি ছড়িয়ে আছে। হয়তো সেই ক্লান্তিটা আমাদের মধ্যে থেকেও ছিল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম একটা সরু গলির ভেতর দিয়ে একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটা ছিল সাদা, কিন্তু রঙ চটে গেছে। খোলা জানালায় ঝুলছিল একটা নীল পর্দা, যেটা হাওয়ায় দুলছিল।

নন্দু বলল, “এই বাড়িটায় আগে কাকিমা থাকতেন। এখন তিনি পুণেতে। চাবিটা মাসখানেক আগে আমি রেখে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম একদিন আসব।”

বাড়ির ভেতরে ঢুকেই মনে হল, একটা শান্ত গ্রন্থাগারে এসেছি। এত চুপচাপ, যেন শব্দ ঢুকলে দোষ হয়ে যাবে। ঘরটা ছিল ছোট, কিন্তু জানালাও ছিল, আলোও। আর ছিল একটা তক্তপোশ, দুটো চেয়ার, একটা কাঠের তাক, আর এক কোণে টিনের আলমারি। আমি বললাম, “এটা যেন আমাদের ছোট্ট সংসার।”
নন্দু বলল, “সংসার তো জিনিস দিয়ে নয়, মানুষ দিয়ে হয়।”

সেই দুপুরে আমরা একটা হালকা লেপ পেতে বসে পড়েছিলাম। নন্দু ব্যাগ থেকে বার করেছিল বিস্কুট আর একটা জলের বোতল। আমি পাশে বসে ওর চুলের গন্ধ নিচ্ছিলাম। বলেছিলাম, “এই চুলের গন্ধটা আমার সারা জীবনের ভেতরে ঢুকে গেছে।”

নন্দু মাথা ঘুরিয়ে বলেছিল, “তুমি কি জানো, আমি কখনও কাউকে এতখানি বিশ্বাস করিনি। আমি জানি না তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো, কিন্তু আমি জানি, আমি তোমার কাছে নিজের সমস্তটুকু খুলে রেখেছি।”

আমি বলেছিলাম, “ভালোবাসা কখনও পরিমাপ করা যায় না। এটা শুধু বোঝা যায়, যেমন তুমি বোঝো—আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”

সন্ধ্যা নামতে নামতে আমরা ঘর পরিষ্কার করলাম, একটা বাল্ব লাগালাম, মোমবাতি কিনলাম, আর একটা হেঁশেল গুছিয়ে নিলাম। প্রথম রাত আমরা ছিলাম একে অপরের কাছাকাছি, কিন্তু স্পর্শ করিনি। শুধু পাশাপাশি শুয়ে শুনেছিলাম ঘড়ির শব্দ, আর একে অপরের নিঃশ্বাস। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, “তুমি এখনো কি সন্ধ্যার মতো মনে হও?”

নন্দু হেসে বলেছিল, “তোমার চোখে তো আমি সকালও, দুপুরও, অন্ধকার রাতও। তুমি কি জানো, ভালোবাসা যখন একা দু’জন মানুষের মধ্যে জমে ওঠে, তখন তা একটা আলাদা দিন হয়ে ওঠে—যার কোনও নাম হয় না, তার শুধু সময় থাকে।”

রাতের অন্ধকারে, শ্রীরামপুরের পুরনো ঘরে, আমি বুঝতে পারছিলাম—আমাদের জীবন এখন সত্যিই শুরু হয়েছে। এটা কোনও পালিয়ে আসা নয়, এটা পাল্টে ফেলার শুরু।

পরদিন আমি স্থানীয় একটা কোচিং সেন্টারে খোঁজ নিয়েছিলাম। ইংরেজি পড়ানোর সুযোগ মিলল—অবশ্য খুব কম বেতন, কিন্তু শুরু তো এটা থেকেই হতে হয়। নন্দু বলল, “তুমি শুরু করো, আমি অন্যখানে খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের দু’জনের রোজগার মিললেই চলবে।”

দিনগুলো শুরু হল এক নতুন নিয়মে। সকালে নন্দু রান্না করত, আমি ক্লাসে যেতাম। দুপুরে আমরা একসাথে খেতাম, তারপর বিকেলে হাঁটতে বেরোতাম গঙ্গার ধারে।

একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে আমি বললাম, “তুমি কি বুঝতে পারছো, আমরা যা করলাম, সেটা কেমন একটা বিপরীত স্রোতের মতো?”
নন্দু বলল, “বিপরীত স্রোতের ভেতর দিয়েই তো নদী নিজের পথ খোঁজে। আমি জানি না ভবিষ্যৎ কী, কিন্তু আমি জানি—এই পথটা আমার নিজের। আর তাতে তুমি আছো।”

আমি ওর দিকে তাকালাম। বললাম, “তুমি কি কখনও ফিরে যেতে চাইবে?”
ও বলল, “যদি কখনও মনে হয়, যেতে হবে, আমি একাই যাব। কিন্তু আমি চাই না, সেই দিনটা আসুক। আমি চাই, এই সন্ধ্যাগুলোর মতোই তোমার সঙ্গে থাকি—অভ্যাস হয়ে, বাতাসের মতো।”

আমরা তখন জানি না, কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু একটা আসছে—যা আমাদের এই শান্ত সংসারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে।
একটা অজানা ছায়া ধীরে ধীরে জমছিল—নিরব, কিন্তু নিশ্চিত।

পর্ব ৭

আমরা যতটা ভাবি জীবন শান্ত থাকবে, জীবন ততটাই একদিন এসে দরজায় কড়া নাড়ে এক অপ্রত্যাশিত ঝড়ে। শ্রীরামপুরের আমাদের ছোট সংসারটায় আমরা প্রেমের মতো করে দিন সাজিয়ে তুলছিলাম। কিন্তু সেই সাজানো ঘরে কোনও এক অজানা হাওয়া এসে ধাক্কা দিল হঠাৎ এক সকালে।

সেদিন সকালটা ঠিক আগের দিনের মতোই ছিল। আমি কোচিং-এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, নন্দু রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্য ঢুকছিল ওর ঘাড়ে, আর আমি ওকে দেখে মনে মনে ভাবছিলাম—এই মেয়েটা সত্যিই সন্ধ্যার মতো, যাকে কোনও কিছু দিয়ে বাঁধা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নেড়ে উঠল এক ঘন আওয়াজ। আমি ভাবলাম, হয়তো বাড়িওয়ালা এসেছে, ভাড়া বাড়ানোর কথা বলতে। দরজা খুলতেই তিনজন দাঁড়িয়ে—একজন মাঝবয়সী মহিলা, মুখে স্পষ্ট রাগ; আর দুই পুরুষ, একজন পুলিশ পোশাকে, আরেকজন সাদা জামায়, হাতে কিছু কাগজ। মহিলাটি চিৎকার করে উঠলেন, “নন্দিনী! এভাবেই তুমি আমাদের মুখে চুনকালি মাখাতে চেয়েছিলে? পালিয়ে গিয়ে এই লোকটার সঙ্গে থাকতে এসেছো?” আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ও যে নন্দুর মা। পিছন থেকে নন্দু ছুটে এসে দাঁড়াল, মুখ থমথমে, চোখ বিস্ময়ে ভরা।

“মা… তুমি এখানে?”

“তোর বাবার হৃদরোগে কী হয়েছিল জানিস তুই? তোর জন্য লোক জানাজানি হয়ে গেছে পুরো পরিবারে! পুলিশে অভিযোগ করেছিলাম অপহরণের, জানিস তুই?”
পুলিশের লোকটা তখন বলল, “দেখুন, মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং স্বেচ্ছায় কারও সঙ্গে থাকেন, তাহলে আইনত কিছু বলা যায় না। কিন্তু যেহেতু নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছে, আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতেই এসেছি।”

নন্দু তখন হাতজোড় করে বলল, “আমি পালাইনি মা। আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে থাকার। এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসি। তোমরা যদি একবার শান্তভাবে কথা বলতে, তাহলে আমি সব বলতাম।”

ওর মা যেন থমকে গেলেন। কিন্তু চোখে তীব্র অপমানের ছাপ। “ভালোবাসা? এটা ভালোবাসা? তুমি তোমার থেকে বয়সে বড় একটা লোকের সঙ্গে থাকতে এসেছো, যে কিছুই করতে পারে না, যার ভবিষ্যৎ নেই?”

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু নন্দু আমার হাত চেপে ধরল। বলল, “মা, আমি বুঝি তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু তুমি কী জানো, আমি এখানে কষ্টে থেকেও শান্তিতে ছিলাম? আমি এখানে কাউকে ভয় পাইনি, কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য মুখোশ পরিনি। আমি নিজে হতে পেরেছিলাম। তুমি যদি আমায় ভালোবাসো, তাহলে শুধু একবার চোখে চোখ রাখো আমার—দেখো আমি খারাপ আছি কিনা।”

ওর মা তখন কাঁপছিলেন। তিনি বললেন, “আমি জানি না কে ঠিক আর কে ভুল। আমি শুধু জানি, তুই আমার মেয়ে। আর তুই যদি আজ তোর মায়ের দিকে ফিরে তাকাতে না পারিস, তাহলে একদিন এই ভালোবাসাও তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।”

পুলিশ তখন চলে যেতে বলল। ওরা চলে গেল, কিন্তু ঘরে রেখে গেলো এক অদ্ভুত ভার। নন্দু চুপ করে বসে ছিল, আর আমি বোঝাতে পারছিলাম না—আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক যেমন আগে ছিলাম।

সন্ধ্যা নামার একটু আগে ও বলল, “রুদ্র, আমি আজ যাব।”
আমি চমকে উঠলাম, “কোথায়?”
ও বলল, “মায়ের সঙ্গে। আমি চাই না তুমি এই ঝড়ের মধ্যে থাকো। আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো, কিন্তু আমি যদি আজ মায়ের হাত না ধরতে পারি, তাহলে আমি কোনওদিন নিজের মুখ দেখতে পারব না আয়নায়।”

আমি বললাম, “তুমি কি আমায় ছেড়ে যাচ্ছো?”
নন্দু মাথা নাড়ল, “আমি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি না রুদ্র, আমি আমার জীবনের দায় মেটাতে যাচ্ছি। যদি তোমার প্রতি ভালোবাসা সত্যি হয়, আমি ফিরে আসব। যদি না আসি, তবে জেনো—আমি সবটা রেখেছি তোমার কবিতায়।”

আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু ওর হাতে একটা পুরনো খাতা তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “তুমি আমার জীবনের একমাত্র কবিতা। যদি কোনওদিন এই খাতাটা খোলো, দেখবে প্রতিটি পাতায় আমি তোমাকেই খুঁজেছি।”

ও চলে গিয়েছিল। নীরব, ধীর পায়ে, একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে, চোখে জল নয়—অভিমানও নয়—শুধু একধরনের আত্মবিশ্বাস। আমি জানি না ওর মা তখন কী ভেবেছিলেন, বা বাড়িতে ফিরে কী হয়েছিল, কিন্তু আমি জানি, আমার সেই সন্ধ্যা ফিরে গেল দূরের জানালায়, যেমন একদিন এসেছিল।

পরদিন ঘরে আলো ছিল না, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারিনি। নন্দুর স্পর্শ, ওর চায়ের কাপ, খাটের পাশে পড়ে থাকা ওর বই—সব যেন চুপচাপ বসে ছিল আমার সঙ্গে। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর ভাবছিলাম—ভালোবাসা কী এতটাই দুর্বল যে সমাজের একটুখানি রোষে হারিয়ে যায়?

নাহ, আমি বিশ্বাস করি না।

আমি জানি, সে ফিরে আসবে। ঠিক এক সন্ধ্যায়, হালকা হাওয়া নিয়ে, যেমন করে সে প্রথম আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

পর্ব ৮

ভালোবাসা সবসময় ফিরে আসে, তবে কখনও তার রূপ বদলে যায়, কখনও সময় বদলে দেয় তার উচ্চারণ। নন্দু চলে যাওয়ার পরের দিনগুলো আমি কাটিয়েছিলাম একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষায়, যার কোনও প্রমিজ ছিল না, কোনও ঠিকানাও না। আমি আবার পড়াতে শুরু করেছিলাম, শ্রীরামপুরেই, যেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন এসে ক্লাসের ফাঁকে জিজ্ঞেস করত—“স্যার, আজও আপনার সঙ্গী এল না?” আমি হাসতাম, বলতাম, “ও সন্ধ্যা নামে, আর এখনো দিন শেষ হয়নি।” সেই সব সন্ধ্যাগুলোতে আমি একা হাঁটতাম গঙ্গার ঘাটে, যেখানে আগে আমরা বসে কবিতা পড়তাম, চুপ করে থাকতাম, হাত ধরতাম। জানি না কেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম—ও ফিরবে। ঠিক ফিরবে।

একদিন, প্রায় একমাস পরে, সেই সন্ধ্যার মুখে, আমি স্টেশনের দিক থেকে হাঁটছিলাম যখন হঠাৎ দেখি, রঙচটা একটা শাল পরে, একটা মেয়ের ছায়া ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে গলির মোড় থেকে। আমি থেমে গেলাম। বুকের ভেতরটা দৌড়াতে শুরু করল, কিন্তু পা আটকে রইল মাটিতে। মেয়েটা কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে আলো নেই, ক্লান্তি রয়েছে, কিন্তু চোখ—সেই একই আলো, যা একদিন বলেছিল, “আমি তোমার মতো মানুষের পাশে থাকতে চাই।”

নন্দু ধীরে ধীরে বলল, “আমি জানতাম, তুমি এখানে থাকবে। ঠিক এই সময়, এই রাস্তায়, এই আলোয়।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “তুমি জানতেও পারলে না, আমি প্রতিদিন এসেছি ঠিক এইখানে, তোমার প্রতিধ্বনি খুঁজতে।”
ও বলল, “আমার মা বলেছিল, ‘তুই যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তাহলে তোকে ফিরে আসতেই হবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘মা, আমি যাইনি, আমি শুধু নিজেকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।’ মা অবাক হয়েছিল, কিন্তু এখন বুঝেছে। ও বলেছে, ‘তুই যদি এভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারিস, তাহলে তুই ঠিক পথেই আছিস।’”

আমি হাসলাম, বললাম, “তাহলে কি এখন আর সমাজের চোখে আমরা ‘ভুল’ নই?”
ও বলল, “সমাজ কিছুদিন চুপ করে থাকে, তারপর ভুলে যায়। কিন্তু হৃদয় যেটা মনে রাখে, সেটা কখনো বদলায় না।”

আমি ওর হাত ধরলাম, এবার আর কোনও ভয় ছাড়াই। রাস্তায় কিছু লোক তাকাল, কেউ মাথা নাড়ল, কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু আমাদের আর কিছু যায় আসে না। কারণ আমরা জানি, আমাদের মধ্যে কোনও অপরাধ নেই, আছে শুধু একসাথে থাকার সাহস।

সেদিন রাতের খাবারটা ছিল খিচুড়ি আর ভাজা বেগুন। আমরা মোমবাতির আলোয় খেতে খেতে নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেলাম। ও বলল, “তুমি জানো রুদ্র, আমি এবার একটা স্কুলে পড়াবো। ওরা নিয়েছে আমাকে জুনিয়র কেমিস্ট্রি টিচার হিসেবে।”
আমি হাত ধরে বললাম, “তুমি শুধু কেমিস্ট্রি পড়াবে না, তুমি শিখিয়ে দেবে ভালোবাসার মৌলিক গঠন কেমন হয়।”

ও হেসে ফেলল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি জানো, আমি একটা নতুন কবিতা লিখেছি?”
আমি বললাম, “শোনাও।”
ও বলল—

তোমার নামের মতো সন্ধ্যা,
নরম আলোয় ঢেকে রাখো ব্যস্ত দিনের ক্লান্তি।
তোমার পাশে দাঁড়ালে, আমি নিজের ছায়াকেও আপন মনে হয়।
তুমি বলো না, তবু শুনিয়ে যাও—‘থেকে যাও’,
এই থেকেই তো সব প্রেমের শুরু, এই থেকেই তো সব কবিতা…

আমার চোখে জল চলে এসেছিল। বললাম, “তুমি কি জানো, আজ এই মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারছি, জীবনে কোনও কিছুই আসলে শেষ হয় না। প্রতিটি শেষ এক একটা নতুন শুরুর মুখোমুখি দাঁড়ায়।”

ও বলল, “তবে এই শুরুটাকে আমরা কী নাম দেব?”
আমি বললাম, “সন্ধ্যার মতো তুমি, আর আমি সেই অন্ধকার, যে তোমার আলো পেলে আলো হয়। এইটুকু যথেষ্ট। নাম না থাকলেই প্রেম আরও গভীর হয়।”

আমরা সেই রাতটা জানালার পাশে বসে কাটালাম। বাইরে পুজোর বাজি ফুটছে দূরে কোথাও, কুয়াশা জমছে ধীরে ধীরে। আমি ওর কাঁধে মাথা রেখেছি, আর ও আমার গলায় আঙুল রেখে বলছে, “একদিন বই বের করব আমরা। দু’জনের কবিতা দিয়ে, দু’জনের গল্প দিয়ে। জানো, বইয়ের নাম কী হবে?”
আমি বললাম, “কী?”
ও বলল, “তোমার নামের মতো সন্ধ্যা।”

আমরা হেসে উঠেছিলাম—একসঙ্গে, একসুরে, যেন এই পৃথিবীর সমস্ত বিরুদ্ধ হাওয়া আমাদের আর স্পর্শ করতে পারবে না।

সন্ধ্যা তখন জানালার কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে বলছিল, “এই প্রেম, এই গল্প, সত্যি… সবটাই সত্যি।”

[সমাপ্ত]

1000025108.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *