Bangla - প্রেমের গল্প

তোমার জন্য আকাশ

Spread the love

নবনীতা সেনগুপ্ত


নীলাঞ্জনার শৈশব কেটেছিল নদীর ধারের ছোট্ট এক গ্রামে। দিনগুলো ছিল সাদামাটা, কিন্তু সেই সরলতায় এমন এক আবেশ ছিল যা তাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। সকালের শুরু হতো পাখির ডাক দিয়ে, দুপুরের গরমে ধানের গন্ধ ছড়িয়ে যেত বাতাসে, আর সন্ধ্যা নামলেই আকাশটা ভরে উঠত অসংখ্য তারায়। তখনই নীলা অনুভব করত, এই আকাশের ভেতর যেন লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক ডাক, এক রহস্য, যা তাকে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন।

এই শৈশবের দিনগুলোতে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিল ঈশান। বয়সে তিন বছরের বড় হলেও তাদের মধ্যে কোনো ভেদরেখা ছিল না। ঈশান দূর সম্পর্কের দাদা, শহরে পড়াশোনা করে ছুটিতে গ্রামে ফিরত। নীলার কাছে সে ছিল একইসঙ্গে বন্ধু, অভিভাবক আর গোপন বিশ্বাসভাজন। গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলার সময় নীলা যতটা হাসিখুশি থাকত, ঈশানের পাশে এসে সে হয়ে উঠত অন্য মানুষ—আরও কৌতূহলী, আরও স্বপ্নময়।

তাদের বিকেলগুলো কেটে যেত নদীর ঘাটে। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় তারা বসত দু’জনে, নদীর জলে ভেসে যাওয়া কাগজের নৌকা দেখত। কখনো প্রতিযোগিতা করত—কার নৌকা দূর পর্যন্ত যাবে। কিন্তু সেই খেলার মাঝেও নীলার মনে এক অদ্ভুত টান ছিল, যেন এই মুহূর্তগুলো কোনো এক গভীর সত্যির সঙ্গে বাঁধা।

রাত হলে তারা উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকাত। ঈশান নক্ষত্র চিনিয়ে দিত—“ওটা সপ্তর্ষিমণ্ডল, ওইদিকে ধ্রুবতারা।” নীলা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত, আর মনে হতো, আকাশটা তাদের দু’জনের গোপন বই, যেখানে প্রতিটি তারা একেকটা গল্প।

এক বর্ষার রাতে, যখন বিদ্যুৎ নেই, চারপাশে শুধু বৃষ্টির শব্দ আর অন্ধকার, তারা দু’জনে বসেছিল উঠোনে। হাতে মোমবাতি, বাতাসে কাঁপছে তার আলো। তখনই ঈশান হঠাৎ বলল—
“জানো নীলা, একদিন আমরা একসাথে আকাশে তারা গুনব। যতগুলো তারা আছে, সব গুনে ফেলব।”

কথাটা ছিল এক শিশুসুলভ খেয়াল, তবু নীলার মনে যেন প্রতিশ্রুতির মতো গেঁথে গেল। তার মনে হলো, এই প্রতিশ্রুতি একদিন পূর্ণ হবেই।

কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক সবসময় সহজ নয়। ঈশান কিছুদিন পরই শহরে ফিরে গেল পড়াশোনার জন্য। প্রথম প্রথম চিঠি লিখত, ডাকঘরের পোস্টমাস্টারের হাত দিয়ে আসা সেই খামে অক্ষরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত নীলার কাছে। কখনো শিউলির শুকনো ফুল, কখনো ছোট্ট আঁকিবুঁকি থাকত চিঠির ভাঁজে। নীলা সেগুলো যত্ন করে রাখত।

ধীরে ধীরে চিঠি কমতে লাগল। শহরের ব্যস্ততা, নতুন জীবন—সব মিলিয়ে ঈশান আর তেমন যোগাযোগ রাখল না। নীলা প্রতিদিন সন্ধ্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন তারাদের ভেতর দিয়ে ঈশানের খবর পাবে। কিন্তু আকাশ তখন নিস্তব্ধ, শুধু ঝিকমিক করা আলো, কোনো উত্তর নেই।

এভাবেই কেটে গেল কয়েক বছর। নীলা পড়াশোনায় ভালো, স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। পড়াশোনার ফাঁকে সে মনে মনে শুধু একটাই জিনিস আঁকড়ে ধরল—ঈশানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি। শৈশবের সেই রাতে শোনা কথাগুলো যেন তার জীবনের মন্ত্র হয়ে দাঁড়াল।

রাতের বেলা পড়তে বসে জানালার বাইরে তাকাতেই আকাশ ভরে থাকত তারায়। নীলা মনে মনে ফিসফিস করে বলত, “ঈশান, তুমি কি মনে রেখেছো?”

সে জানত না ঈশান কোথায়, কেমন আছে, তার জীবন কোন দিকে এগোচ্ছে। তবু বিশ্বাস করত, তারা দু’জন একদিন আবার সেই প্রতিশ্রুতির আকাশের নিচে মিলিত হবে।

সেই বিশ্বাসই তাকে জীবনের কঠিন সময়েও বাঁচিয়ে রাখত।

সময়ের চাকা যেমন নিরবচ্ছিন্ন ঘুরে চলে, তেমনি নীলার জীবনেও বদল এল ধীরে ধীরে। ঈশান চলে গেল কলকাতায় পড়াশোনার জন্য। প্রথমদিকে মনে হতো সে যেন এখনও কাছেই আছে। প্রতি মাসে এক-দু’টি চিঠি আসত, পোস্টমাস্টারের হাতে নীলার নাম লেখা খাম তুলে ধরলেই বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কেঁপে উঠত। চিঠির ভাঁজে শুকনো শিউলি ফুল কিংবা ঈশানের হাতের আঁকা ছোট্ট তারা নীলাকে মনে করিয়ে দিত, সে একা নয়।

কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস বেশিদিন টিকল না। একসময় চিঠি আসা কমে গেল, তারপর মাসের পর মাস কোনো খবরই এল না। ফোনের সুবিধে তখনও সহজলভ্য নয়, তাই যোগাযোগের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। নীলা সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত। গ্রামভরা অন্ধকার আকাশে ঝিকমিক করত হাজার তারা। সে ফিসফিস করে বলত—“ঈশান, তুমি কি প্রতিশ্রুতিটা মনে রেখেছ?” কিন্তু আকাশের ঝিকিমিকি ছাড়া কোনো উত্তর আসত না।

মাঝেমধ্যে কাকিমা বলতেন, “ঈশান খুব ব্যস্ত এখন, পড়াশোনায় ডুবে আছে।” কথাটা শোনার পর নীলা বুঝত, শহরের কোলাহলে হয়তো সে আর শৈশবের প্রতিশ্রুতি মনে রাখেনি। তবু তার মনের ভেতর এক টুকরো আলো থেকে যেত—হয়তো একদিন আবার দেখা হবে।

দিনগুলো একঘেয়ে ছন্দে কেটে যাচ্ছিল। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে নীলা ভর্তি হলো স্থানীয় কলেজে। গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ সীমিত, কিন্তু সে দমল না। পড়াশোনার পাশাপাশি সে লেখালিখি শুরু করল—ডায়রির পাতায় ভরে উঠল নিজের অনুভূতি, অজস্র কবিতা। প্রায় প্রতিটি কবিতাই আকাশ আর তারার কথা দিয়ে শুরু হতো, শেষ হতো এক অদৃশ্য বন্ধুর উদ্দেশে লেখা চিঠিতে।

সন্ধ্যার সময় নদীর ঘাটে বসে একা একা কাগজের নৌকা ভাসাতো সে। শৈশবের খেলাটা একা করতে গিয়ে বুকের ভেতর শূন্যতা আরও স্পষ্ট হতো। মাঝে মাঝে গ্রামের লোকজন খোঁচা দিয়ে বলত, “নীলা এখনো ঈশানের খোঁজ করে?” সে হেসে এড়িয়ে যেত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আহত হতো।

এদিকে ঈশানের খবর কমে আসতে আসতে প্রায় শূন্য হয়ে গেল। মাঝে মধ্যে শহর থেকে আসা কারও মুখে শোনা যেত, সে নাকি খুব ভালো করছে, পড়াশোনায় নাম করেছে। এসব শুনে নীলার গর্ব হতো বটে, কিন্তু বুকের ভেতর কোথাও একটা হাহাকারও জন্ম নিত।

কয়েক বছর এভাবেই কেটে গেল। নীলা মাস্টার্স পড়তে শহরে গেল। প্রথমবার কলকাতায় গিয়ে মানুষের ভিড়, আকাশছোঁয়া বিল্ডিং আর ব্যস্ততার ভেতর সে নিজেকে অচেনা মনে করল। ভিড়ের মধ্যেও সে একা হয়ে পড়ল। শহরের আকাশে তারা কম—অথচ তার জীবনের প্রতিশ্রুতি ছিল সেই তারাদের সঙ্গেই।

ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পড়তে জানালার বাইরে তাকাত সে। দূরের আলোর ভিড়ে এক টুকরো তারা দেখা দিলে বুকের ভেতর ভেসে উঠত শৈশবের সেই রাত। মনে হতো, ঈশানও হয়তো কোথাও একই তারা দেখছে।

তবে একবারও তাদের দেখা হলো না। এত কাছে থেকেও তারা অচেনা দুই মানুষ হয়ে রইল।

কিন্তু নীলা ভরসা হারাল না। মনে মনে সে জানত, সময়ের ব্যবধান যতই হোক, একদিন প্রতিশ্রুতির আলো আবার জ্বলে উঠবেই।

দুর্গাপূজার ছুটি এলেই নীলার মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই গ্রাম—পান্নারঙা ধানক্ষেত, নদীর ঘাটে কাশফুলের ঢেউ, আর সন্ধ্যা নামলেই আকাশভরা তারা। কলেজের চাকরি শুরু করার পর শহরের ব্যস্ততায় ডুবে গেলেও এবার তার ভেতরে অদ্ভুত এক টান কাজ করছিল। তাই এই ছুটিতে সে সিদ্ধান্ত নিল বহু বছর পর আবার গ্রামে ফিরবে।

ট্রেনের কামরার জানালার বাইরে চোখ রেখে দেখছিল সে—সবুজ ধানক্ষেত দৌড়ে পালাচ্ছে, মাঝে মাঝে ছোট্ট স্টেশন, লালচে টালির ছাউনি, মাঠে খেলতে থাকা বাচ্চারা। মনে হচ্ছিল, সময় যেন পেছনে ফিরে যাচ্ছে। প্রতিটি দৃশ্য তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেই শৈশবের দিনে, যখন ঈশানের সঙ্গে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা গুনবে একসাথে।

স্টেশনে নেমে নামতেই তার মনে হলো, কোনো কিছুই পাল্টায়নি। বাতাসে শিউলির গন্ধ, কাশফুলের সাদা সমুদ্র, পুকুরঘাটে মেয়েদের হাসি—সবই আগের মতো আছে। কেবল তার নিজের ভেতরটাই বদলে গেছে, শহরের জীবন তাকে অন্য মানুষ করে তুলেছে।

গ্রামের উঠোনে পা রেখেই কাকিমা হেসে বললেন, “শোন নীলা, ঈশানও এসেছে এ বছর। ও-ও ছুটি কাটাতে ফিরেছে।” কথাটা শুনেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। এতদিন পর? সে কি একই মানুষ রয়ে গেছে, নাকি শহর তাকে পুরো বদলে দিয়েছে?

সন্ধ্যায় নদীর ধারে হাঁটতে বেরোল নীলা। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আলো পড়েছে জলে, বাতাসে ভেসে আসছে কাশফুলের গন্ধ। হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল এক পরিচিত অবয়ব—সাদা পাঞ্জাবি, হাতে বই, চোখে চশমা। তার বুক কেঁপে উঠল। ঈশান।

প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। এত বছর পরেও সেই চেনা হাসি, চোখের ভেতরে সেই আগের উজ্জ্বলতা। শুধু চুলের কোণে হালকা পাক আর চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা যোগ হয়েছে।

“নীলা!”—ডেকে উঠল ঈশান।
তার গলা আগের মতোই উষ্ণ।
নীলা থমকে দাঁড়াল। ঠোঁটে অপ্রস্তুত হাসি খেলে গেল। “ঈশান দাদা… তুমি?”

মুহূর্তের মধ্যে সময় যেন থেমে গেল। এত বছরের দূরত্ব, না বলা প্রশ্নগুলো সব ভেসে উঠল নিঃশব্দে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর ঈশান এগিয়ে এল। “তুমি বদলাওনি, নীলা। শুধু চোখগুলো… আরও গভীর হয়ে গেছে।”

নীলা হেসে ফেলল। “তুমি বদলেছো। পুরো শহুরে ভদ্রলোক।”
ঈশান মৃদু হেসে বলল, “শহর মানুষকে বদলায়, কিন্তু ভেতরের মানুষ কি বদলায়?”

তারা দু’জনে নদীর ধারে বসে পড়ল। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হাওয়া বইছে কাশফুলের গন্ধ নিয়ে। ঈশান জানাল, সে এখন কলেজে অধ্যাপনা করে। শহরের জীবন তাকে ব্যস্ত রেখেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবসময়ই মনে পড়ে গ্রাম, নদী, আর তারাভরা আকাশ।

নীলার বুক কেঁপে উঠল। এতদিন পরও সে সেই প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখেছে? নাকি কেবল কাকতালীয়ভাবে বলছে এসব?

কিছুক্ষণ পর ঈশান বলল, “মনে আছে নীলা, আমরা একদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম—আকাশে তারা গুনব একসাথে?”
নীলার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। ধীরে বলল, “মনে আছে… আমি ভেবেছিলাম তুমি ভুলে গেছ।”
“ভুলিনি। শুধু সময় আমাকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল।”

নীলার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ল। এতদিনের প্রতীক্ষার পর এই দেখা যেন জীবনের নতুন অধ্যায় খুলে দিল।

সেদিন রাত নামার সময় আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে উঠল। উঠোনে দাঁড়িয়ে নীলা উপরের দিকে তাকাল, আর মনে মনে বলল—“ঈশান, এবার কি সেই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে?”

গ্রামের পুজো মানেই উৎসবের এক অন্যরকম আবহ—মাঠে বাঁশ দিয়ে তৈরি মণ্ডপ, রঙিন কাপড়ের আলপনা, ঢাকের বাদ্যিতে দুলে ওঠা সকালের হাওয়া। নীলা অনেক বছর পর এইসব দেখতে দেখতে যেন শৈশবের দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছিল। এবার তার কাছে সবকিছু আরও নতুন, কারণ ভিড়ের মাঝেই কোথাও ঈশান আছে।

সপ্তমীর সকালে নীলা সাজগোজ করে মণ্ডপে গেল। শাড়ির আঁচলে শিউলির গন্ধ মিশে আছে, মুখে হালকা চন্দনের ছোঁয়া। ভিড়ের ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল—ঈশান দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, হাতে ক্যামেরা। ভিড়ের কোলাহল পেরিয়ে তাদের চোখ এক মুহূর্তে মিলল, আর সেই দৃষ্টি বিনিময়ে যেন সময়ের সব ব্যবধান গলে গেল।

ঈশান এগিয়ে এসে হাসল। “তুমি প্রতিদিনই আসছ?”
নীলা হেসে উত্তর দিল, “এখন তো ছুটি। পুজোর সময় মণ্ডপ না এলে কি আর হয়?”
“হয়তো হয়, কিন্তু তোমার উপস্থিতিতে সবকিছু আরও অন্যরকম লাগে।”

নীলার গাল লাল হয়ে উঠল। সে উত্তর না দিয়ে শুধু পাশ ফিরে দাঁড়াল। কিন্তু বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত স্পন্দন বাজতে লাগল, যেন ঢাকের তালের সঙ্গে তার হৃদস্পন্দন মিলেমিশে যাচ্ছে।

আরতির সময় ভিড় আরও বেড়ে গেল। ঠেলাঠেলির মধ্যে হঠাৎ ঈশান তার হাত ধরে টেনে পাশে নিল। নীলার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু হাত ছাড়িয়ে নিল না। সেই এক মুহূর্তের স্পর্শে শৈশব থেকে জমে থাকা প্রতিশ্রুতি যেন আবার আলো পেতে শুরু করল।

আরতি শেষে দু’জনে মণ্ডপের পাশের নির্জন জায়গায় দাঁড়াল। চারপাশে আলো, ধূপের গন্ধ, বাতাসে শিউলির সুবাস। ঈশান আস্তে বলল, “তুমি কি জানো নীলা, এতদিনেও আমি ভুলি নি। আকাশের তারাগুলো আমাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিয়েছে তোমার কথা।”

নীলার চোখে জল এসে গেল। সে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। অসংখ্য তারা যেন সাক্ষী হয়ে ঝিকমিক করছে। তার মনে হলো, অনেকদিনের জমে থাকা নিঃশব্দ আবেগ একসাথে কথা বলতে চাইছে।

সন্ধ্যার পর আবার দেখা হলো। গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চে গান, নাটক, আবৃত্তি। ঈশানকে উঠে যেতে হলো কবিতা পড়তে। মাইকে ভেসে এল তার কণ্ঠস্বর—সেই চেনা আবেগে ভরা, গভীর টান। নীলা দর্শকসারিতে বসে শুনছিল, আর মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দ যেন সরাসরি তার দিকে ছুটে আসছে।

অনুষ্ঠান শেষে ভিড় কমে এলে ঈশান নীলাকে বাইরে ডাকল। চাঁদের আলোয় আলোকিত মাঠ, দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ঈশান ধীরে বলল, “তুমি কি কখনও ভেবেছ, আমরা যদি শুধু বন্ধু না হয়ে আরও কিছু হতাম?”

নীলা চমকে উঠল। এতদিনের না বলা অনুভূতি যেন একসাথে মাথা তুলল। সে গলা শুকিয়ে আসা সত্ত্বেও বলল, “ভেবেছি… তবে ভয় পেয়েছি।”
ঈশান কাছে এগিয়ে এল। “কিসের ভয়?”
“হয়তো সমাজের, হয়তো সময়ের, হয়তো তোমাকে হারানোর।”

ঈশান একদৃষ্টে তার দিকে তাকাল। “আমি হারাইনি, নীলা। আমি এখনও আছি—তোমার দেওয়া প্রতিশ্রুতির মতোই।”

চাঁদের আলোয় ঝলমল করা সেই মুহূর্তে নীলার মনে হলো, আকাশটা আজ আরও কাছে নেমে এসেছে।

অষ্টমীর সকাল থেকেই গ্রাম ভরে উঠল আনন্দের ঢেউয়ে। মণ্ডপের সামনে ঢাক বাজছে অবিরাম, নারীরা শাড়ি পরে জড়ো হয়েছে কুমারী পুজোর প্রস্তুতিতে, আর চারপাশে ধূপ-ধুনোর গন্ধে যেন আকাশও ভরে গেছে। নীলা এতদিন শহরে থেকে ব্যস্ততার জীবন দেখেছে, কিন্তু গ্রামের পুজোর এই আবহ তার কাছে অন্য এক জগতের মতো।

সে সকালবেলায় শাড়ি পরে মণ্ডপে পৌঁছাল। ভিড়ের ভেতরেই চোখ খুঁজে নিল ঈশানকে। দেখল, সে কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে ব্যস্ত, তবে চোখে চোখ পড়তেই থেমে গিয়ে হাসল। নীলার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। মনে হলো, যেন হাজারো মানুষের ভিড়েও তারা দু’জন আলাদা এক বৃত্তে আটকে আছে।

অষ্টমীর সন্ধ্যায় ছিল সিঁদুরখেলা। ঢাকের তালে তালে দেবী বিসর্জনের আগে একে অপরের গালে সিঁদুর মাখিয়ে দিচ্ছিল গ্রামের মহিলারা। নীলা প্রথমে একটু সংকোচে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ ঈশান তার দিকে এগিয়ে এল। হাতে সিঁদুর নিয়ে তার গালে হালকা ছোঁয়া দিল। সেই মুহূর্তে চারপাশের হাসি, রঙ, আওয়াজ সব স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু নীলার বুকের ভেতরে জোয়ারের মতো ঢেউ উঠল।

নীলা থেমে গিয়ে তার দিকে তাকাল। ঈশানের চোখে কোনো খেলা নেই, কোনো চপলতা নেই—শুধুই গভীর এক স্নিগ্ধতা। নীলা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সেও ঈশানের কপালে আলতো করে সিঁদুর মাখিয়ে দিল। ভিড়ের মধ্যে এই এক বিন্দু মুহূর্ত যেন তাদের গোপন প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে রইল।

রাতের দিকে গ্রামের পুকুরপাড়ে মেলা বসেছিল। আলো ঝলমলে দোকান, পাটিসাপটা, ঝালমুড়ি, আর খেলনার ভিড়ে মেতে উঠেছিল সবাই। ঈশান নীলাকে নিয়ে ভিড় এড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল নির্জন দিকটায়। পুকুরের জলে চাঁদের আলো ঝিলমিল করছিল।

“নীলা,” ঈশান ধীরে বলল, “আমার মনে হয় আমরা দু’জনেই জানি, এ সম্পর্ক আর শুধু বন্ধুত্বে থেমে নেই। আমি বহু বছর ধরে একটা কথাই মনে রেখেছি—আমরা একদিন তারা গুনব একসাথে। কিন্তু আমি চাই, সেই তারাগুলো গুনতে গুনতে আমাদের জীবনও একসাথে কাটুক।”

নীলার চোখ ভিজে উঠল। এতদিন ধরে যে অনুভূতি বুকের ভেতরে জমিয়ে রেখেছিল, তা আর আটকে রাখতে পারল না। ধীরে ধীরে বলল, “আমিও চাই, ঈশান। তবে ভয় পাই, এতদিনের দূরত্ব, সমাজের বাঁধন—সব মিলে যদি আবার আমাদের আলাদা করে দেয়?”

ঈশান তার হাত ধরে বলল, “সমাজের বাঁধন যদি থাকে, তবে ভাঙতে সময় লাগে। কিন্তু আমাদের প্রতিশ্রুতি তো অনেক আগেই বোনা হয়ে গেছে। আমি চাই তুমি আমার জীবনের প্রতিদিনের আকাশ হও।”

নীলা কোনো উত্তর দিল না, শুধু তার হাত শক্ত করে ধরল। আকাশের তারা তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তারাও এই মুহূর্তের সাক্ষী।

নবমীর সন্ধ্যায় গ্রামের মাঠ আলোয় ঝলমল করছিল। বাঁশের মঞ্চে রঙিন কাপড় ঝুলছে, চারপাশে সাজানো চেয়ার, আর সামনে গ্রামজোড়া মানুষ ভিড় জমিয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেন গ্রামের পুজোর প্রাণ—গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি সবকিছু মিলিয়ে উৎসবের আবহ। নীলা ভিড়ের মাঝখান থেকে তাকিয়ে ছিল মঞ্চের দিকে, কিন্তু তার চোখ বারবার খুঁজে নিচ্ছিল ঈশানকে।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের নাচ, তারপর গান। মাঝপথে ঘোষক ঘোষণা করল—“এবার আবৃত্তি করবেন আমাদের গ্রামেরই সন্তান, বর্তমানে কলকাতার এক কলেজের অধ্যাপক, ঈশান চট্টোপাধ্যায়।”

হাততালির মধ্যে ঈশান মঞ্চে উঠল। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, হাতে মাইক্রোফোন। নীলার বুক কেঁপে উঠল। শৈশবের সেই চেনা ঈশান আজ যেন আরও পরিণত, আরও গভীর।

সে কবিতা শুরু করল—কণ্ঠে সেই অদ্ভুত টান, যা নীলার ভেতর ঝড় তুলল। কবিতার লাইনগুলো ছিল আকাশ, তারা আর প্রতিশ্রুতির কথা নিয়ে। নীলা শুনতে শুনতে বুঝল, প্রতিটি শব্দ যেন তার জন্যই লেখা। ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে অনুভব করল, তারা দু’জন যেন আলাদা এক গোপন পরিসরে দাঁড়িয়ে আছে।

আবৃত্তি শেষে হাততালি পড়ল চারদিক থেকে। কিন্তু ঈশানের চোখ শুধু নীলাকে খুঁজে নিল। ভিড় ভেদ করে তাদের দৃষ্টি মিলল, আর সেই মুহূর্তে নীলা বুঝল—এই আবেগ আর গোপন রাখা যাবে না।

অনুষ্ঠান শেষে লোকজন ভিড় করে বেরোতে লাগল। ঈশান ইশারায় নীলাকে বাইরে ডাকল। তারা দু’জনে চলে গেল মাঠের এক প্রান্তে, যেখানে আলো কম, চাঁদের আলোয় সবকিছু রূপালি হয়ে উঠেছে।

“কেমন লাগল?” ঈশান জিজ্ঞেস করল।
নীলা একটু হেসে বলল, “শুধু কবিতা নয়, তোমার কণ্ঠও যেন কবিতা হয়ে উঠেছিল।”
ঈশান মৃদু হাসল। “তুমি জানো নীলা, আমি যখনই আকাশ দেখি, তোমাকেই মনে পড়ে। আজকের কবিতাও তোমার জন্যই।”

নীলার চোখে জল এসে গেল। সে ধীরে বলল, “আমিও প্রতিদিন আকাশের দিকে তাকিয়েছি, তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু ভেবেছি তুমি হয়তো আমাকে ভুলে গেছ।”

ঈশান এগিয়ে এসে বলল, “আমি ভুলিনি। শুধু সময় আর দূরত্ব আমাদের আলাদা করে রেখেছিল। কিন্তু আমার ভেতরে প্রতিশ্রুতি কখনো ম্লান হয়নি।”

নীলা থেমে গিয়ে তার দিকে তাকাল। “তাহলে আজ এতদিন পর আমরা কি আবার সেই প্রতিশ্রুতিকে নতুন করে শুরু করতে পারি?”
ঈশানের চোখ ঝলমল করে উঠল। “আমরা তো শুরু করেই দিয়েছি, নীলা।”

সে আস্তে করে নীলার হাত ধরল। চারপাশে তখন গ্রামের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, শুধু রাতের আকাশ ভরে উঠছে অসংখ্য তারায়।

সে মুহূর্তে নীলা অনুভব করল, শৈশবের সেই প্রতিশ্রুতির বীজ থেকে জন্ম নিয়েছে পূর্ণতা পেতে চলা এক প্রেম।

দশমীর সকাল থেকেই গ্রামের আঙিনা অন্য এক আবহে ভরে উঠেছিল। দেবীকে বিদায় জানানোর সময় এসে গেছে, চারদিকে কোলাহল, ঢাকের তালে তালে সিঁদুরখেলা, নারীদের হাসি-কান্না মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবেগের ঢেউ তুলছে। কিন্তু নীলার ভেতরে আজ যেন অন্যরকম এক অস্থিরতা।

সারা রাত সে ঘুমোতে পারেনি। ঈশানের কথা, তার স্বীকারোক্তি, সেই আবৃত্তির পর নির্জন মাঠে বলা বাক্যগুলো বারবার ফিরে আসছিল মনে। বুকের ভেতর হাওয়ার মতো উঠছিল অনুভূতির ঢেউ। সে জানে, ঈশান তাকে ভুলে যায়নি, তার ভেতরে আজও সেই প্রতিশ্রুতির আলো জ্বলছে। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়—গ্রাম, সমাজ, পরিবার—সবকিছু কি মেনে নেবে এই নতুন শুরুটা?

কাকিমা বারবার বলছিলেন, “ঈশান এখন অনেক বড় হয়েছে। ওর জন্য শহর থেকে অনেক প্রস্তাব আসে। হয়তো বিয়ের কথাও হবে খুব শিগগির।” কথাটা শুনেই নীলার বুকের ভেতর কেমন চাপা ব্যথা জমে উঠল। যদি ঈশানকে আবার হারাতে হয়? যদি সমাজের বাঁধন তাদের আলাদা করে দেয়?

সেই দিন বিকেলে, দেবী বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ভিড় জমল গ্রামজোড়া মানুষ। নদীর ঘাটে নামল প্রতিমা, ঢাকের বাজনা, মানুষের স্লোগান, চোখের জলে ভরা বিদায়ের মুহূর্ত। নীলা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখল ঈশান তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের মাঝেও তাদের চোখে চোখ পড়তেই বুক কেঁপে উঠল।

“তুমি ঠিক আছ তো?” ঈশান ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
নীলা উত্তর দিল না, শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল। তার গলা শুকিয়ে আসছিল।

প্রতিমা নদীর জলে ভেসে যেতে লাগল। চারদিকে তখন সিঁদুরে রাঙানো মুখ আর কান্নাভেজা হাসি। ঈশান আস্তে বলল, “দেখলে, দেবী প্রতিবছর আসেন, আবার ফিরে যান। কিন্তু প্রতিশ্রুতি কখনো ভাঙে না। আমাদের প্রতিশ্রুতিও তেমনই। তুমি কি বিশ্বাস করো না?”

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বিশ্বাস করি, ঈশান। কিন্তু ভয় পাই… সমাজ কি আমাদের মেনে নেবে? তোমার পরিবার, আমার পরিবার—সবাই কি সহজে বুঝবে?”

ঈশান তার দিকে দৃঢ় চোখে তাকাল। “ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে সমাজকেও একদিন নতি স্বীকার করতে হয়। নীলা, আমি এতদিন তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি শুধু এই বিশ্বাস নিয়ে। তুমি যদি আমার পাশে থাকো, বাকিটা আমিই সামলাব।”

নীলার চোখ ভিজে উঠল। সে কিছু বলতে পারল না, শুধু আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যার আকাশে তখন অসংখ্য তারা ফুটে উঠছে। মনে হচ্ছিল, তারা-ই যেন বলছে—ভয় পেও না, প্রতিশ্রুতির পথ কখনো অন্ধকারে হারায় না।

রাতের দিকে নিজের ঘরে বসে ডায়রির পাতায় লিখল নীলা—
“ভয় আছে, কিন্তু ভয়ের চেয়ে বড় কিছু আছে আমার ভেতরে—সেটা ঈশানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি। জানি না সামনে কী আছে, তবে আজ মনে হচ্ছে আকাশটাও আমাদের হয়ে গেছে।”

সন্ধ্যার পর গ্রাম শান্ত হয়ে আসে। পুজোর কোলাহল মিইয়ে গিয়ে চারপাশে নেমে আসে এক গভীর নীরবতা। দূরে শোনা যায় কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ, আর বাঁশঝাড়ে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। এমন এক রাতেই ঈশান নীলাকে ডাকল—“চলো, আজ আকাশে তারা গুনব।”

নীলা অবাক হলো। এতদিন পর সেই শৈশবের প্রতিশ্রুতি সত্যিই কি পূর্ণ হতে চলেছে? বুকের ভেতর অদ্ভুত এক স্পন্দন বাজতে লাগল। নিঃশব্দে তার সঙ্গে হাঁটল বাড়ির উঠোনে।

উঠোনের মাটিতে চাটাই বিছানো। দু’জন পাশাপাশি বসে পড়ল। উপরে আকাশ ভরা তারা, মনে হচ্ছিল অসংখ্য প্রদীপ ঝুলছে। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে সেই তারাগুলো যেন একেকটা গল্প বলছে।

ঈশান আস্তে বলল, “দেখেছ নীলা, এত তারা। ছোটবেলায় আমরা ভেবেছিলাম সব গুনব। তখন বুঝিনি, তারা গোনার মতো সহজ কিছু নয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতিটা তখনও সত্যি ছিল, আজও তাই।”

নীলা মৃদু হাসল। “আমি এতদিন ধরে প্রতিদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, শুধু ভেবেছি তুমি কোথায় আছ। মনে হতো, হয়তো তুমিও তাকাচ্ছো। কিন্তু কখনও সাহস পাইনি ভাবতে যে এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হতে পারে।”

ঈশান তার দিকে ঘুরে তাকাল। চোখে সেই চেনা উজ্জ্বলতা। “আমিও প্রতিদিন আকাশ দেখেছি। শহরের আলোয় তারা কম দেখা যায়, তবু যতটুকু দেখা যেত, ততটুকুই মনে করিয়ে দিত তুমি আছ। নীলা, আমাদের গল্পটা অসম্পূর্ণ থাকার জন্য নয়।”

কথাগুলো শুনে নীলার চোখ ভিজে উঠল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে গুনতে শুরু করল—“এক… দুই… তিন…” ঈশানও তার সঙ্গে গুনতে লাগল। সংখ্যাগুলো যেন তাদের মধ্যে অদৃশ্য সেতু তৈরি করছিল। তারা বুঝতে পারছিল, গোনার মধ্যে কোনো শেষ নেই, তবু প্রতিটি সংখ্যা তাদের আরও কাছে নিয়ে আসছে।

কিছুক্ষণ পর ঈশান বলল, “তারাগুলো অসীম, নীলা। কিন্তু স্বপ্নগুলোও কি তেমনই অসীম হতে পারে?”
নীলা অবাক হয়ে তাকাল। “স্বপ্ন?”
“হ্যাঁ,” ঈশান বলল, “আমি স্বপ্ন দেখি তোমার সঙ্গে একটা জীবন কাটানোর। প্রতিদিন এই আকাশ দেখব, কিন্তু একা নয়। তুমি থাকবে পাশে।”

নীলার গলা শুকিয়ে গেল। এতদিন ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা অনুভূতি যেন উথলে উঠল। সে আস্তে বলল, “আমিও চাই। তবে ভয় পাই, যদি আবার তোমাকে হারাই?”
ঈশান তার হাত আলতো করে চেপে ধরল। “এইবার আর হারাব না। প্রতিশ্রুতি দিলাম।”

চারপাশ নিস্তব্ধ। আকাশে তারারা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হাওয়ায় শিউলির গন্ধ ভেসে আসছে। নীলা অনুভব করল, এই মুহূর্তটাই যেন তাদের প্রতিশ্রুতির পুনর্জন্ম।

চাঁদের আলোয় ভরা উঠোনে দু’জন পাশাপাশি বসে তারাগুলো গুনছিল। আর প্রতিটি সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাদের স্বপ্নগুলোও আকাশে ঝলমল করে উঠছিল।

গ্রামের উৎসব শেষের দিকে এগোচ্ছে। প্রতিমা বিসর্জনের পরও কয়েকদিন ধরে লোকজনের আড্ডা, আত্মীয়-স্বজনের আসা-যাওয়া চলতে থাকে। নীলার ভেতরটা তখনও আলোয় ভরে আছে—ঈশানের সঙ্গে তারাভরা রাতের প্রতিশ্রুতি তাকে যেন নতুন জীবন দিয়েছে। মনে হচ্ছিল, সবকিছু এখন আগের থেকে আলাদা, আরও স্পষ্ট, আরও বাস্তব।

কিন্তু জীবনের পথে সুখের মতোই হঠাৎ করেই আসে অনিশ্চয়তা। এক বিকেলে কাকিমা এসে নীলাকে বললেন,
“শোন নীলা, পাশের গ্রামের শ্রীকান্তবাবুর ছেলে খুব ভালো চাকরি করে, শহরে থাকে। ওর পরিবার তোমার কথাই ভাবছে।”

নীলা চমকে গেল। প্রথমে কিছু বলতে পারল না। বুকের ভেতর যেন হিম শীতল একটা বাতাস ঢুকে পড়ল। শ্রীকান্তবাবুর ছেলের নাম সে শুনেছে—ভদ্র, শিক্ষিত, সচ্ছল। গ্রামের চোখে তার মতো ছেলে আদর্শ পাত্র। কাকিমার কথায় বোঝা গেল, তার পরিবারও চায় নীলার মতো শিক্ষিতা, নম্র মেয়ে ঘর সামলাক।

“কিন্তু কাকিমা, আমি তো…”—নীলা বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভেতরে ভেতরে বুক কাঁপছিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ঈশানের মুখ, তার বলা প্রতিশ্রুতির কথা।

সেই রাতে নীলা ঘুমোতে পারল না। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি পরিবার জোর করে? যদি ঈশান কিছু বলার আগেই সব শেষ হয়ে যায়? তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল ভয়ে।

পরদিন দুপুরে নদীর ধারে হাঁটতে গিয়ে ঈশানের সঙ্গে দেখা হলো। ঈশান লক্ষ্য করল নীলা অস্বাভাবিক চুপচাপ।
“কি হলো, নীলা? তুমি এমন গুমরে আছ কেন?”

নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কাকিমা বলেছে… আমার জন্য প্রস্তাব এসেছে। তারা চায় আমি হ্যাঁ বলি।”

ঈশানের মুখ শক্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে বলল, “তাহলে?”
“আমি কিছু বলিনি।”
“কেন বলোনি?” ঈশানের কণ্ঠে ব্যথা।
নীলার চোখে জল চলে এল। “কারণ ভয় পাই, যদি তোমার কথা বলি—তুমি কি সত্যিই আমার হয়ে দাঁড়াবে? নাকি এটাও কেবল আকাশে ভেসে থাকা প্রতিশ্রুতি?”

ঈশান তার দিকে দৃঢ় চোখে তাকাল। “নীলা, আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আর এবার সেটাকে পূর্ণ করব। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করবে না?”

নীলার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। তবু দ্বিধা কাটল না। সমাজের বাঁধন, পরিবার—সব একসঙ্গে তাকে ঘিরে ধরছিল।

ঈশান তার হাত ধরল শক্ত করে। “শোনো নীলা, আকাশের তারারা যদি অসংখ্য হয়, তবে আমাদের সাহসও তেমনই অসীম হতে হবে। আমি পিছিয়ে যাব না।”

নীলা কিছু বলল না। শুধু আকাশের দিকে তাকাল। তারারা তখনও ঝলমল করছে, কিন্তু মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত অনিশ্চয়তার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

গ্রামের আকাশে সেদিন ছিল পূর্ণিমার আলো। সাদা আলোয় আলোকিত কাশবন, নদীর ধারে নরম বাতাস, আর দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক—সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতিও এক অদৃশ্য অপেক্ষায় আছে। নীলা সারাদিন অস্থির ছিল। কাকিমার বলা কথাগুলো তার বুকের ভেতর ভারী হয়ে বসে আছে। পরিবার যদি জোর করে বিয়ে দিতে চায়? যদি ঈশান কিছু না বলে?

সন্ধ্যায় ঈশান এসে হাজির হলো নীলাদের উঠোনে। চোখে তার দৃঢ়তা, মুখে স্পষ্ট অঙ্গীকার। সে বলল,
“কাকিমা আমাকে সব বলেছেন। আমি আজ চুপ থাকব না। নীলা, তোমার সঙ্গে আমার প্রতিশ্রুতি শুধু আকাশে তারা গোনার নয়, একসাথে জীবন কাটানোরও।”

কাকিমা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালেন। গ্রামের মানুষজনও জেনে গেল দ্রুত। কেউ বলল, “গ্রামের মেয়ে শহরের অধ্যাপককে বিয়ে করলে দোষ কি!” আবার কেউ কপাল কুঁচকে বলল, “এমন তো আগে ভাবা হয়নি।”

কিন্তু ঈশান সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি নীলাকে ছোটবেলা থেকে চিনি। আমি আজও বিশ্বাস করি, ও-ই আমার জীবনের সঠিক সঙ্গী। সমাজ যা-ই বলুক, আমি আর পিছিয়ে যাব না।”

নীলার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত এক সাহসে। সে সামনে এসে দাঁড়াল ঈশানের পাশে। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, তবু স্পষ্ট শোনা গেল, “আমিও ভয় পাইনি, ঈশান। শুধু অপেক্ষা করেছি। আজ আমি জানি, আমাদের প্রতিশ্রুতি সত্যি।”

গ্রামের অনেকেই চুপ করে গেল। কেউ কেউ মৃদু হাসল। আর যাদের চোখে প্রশ্ন ছিল, তারা দেখল দু’জন মানুষের চোখের ভেতর অটল বিশ্বাস। সমাজের বাঁধন যতই শক্ত হোক, সত্যিকারের প্রতিশ্রুতির কাছে তা ম্লান হয়ে যায়।

রাত গভীর হলো। আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলছে। ঈশান আর নীলা উঠোনে পাশাপাশি বসে গুনতে শুরু করল—“এক… দুই… তিন…”। সংখ্যা যেন থামছেই না। তারা দু’জনেই হেসে ফেলল।

ঈশান বলল, “তারাগুলো গোনা যায় না, নীলা। কিন্তু আমাদের প্রতিশ্রুতি গোনা যায়। আর আমি আজ গুনে গুনে জানলাম, আমরা আর কখনও আলাদা হব না।”

নীলা মাথা রাখল তার কাঁধে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সেই জল আজ আনন্দের। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তারারাও যেন তাদের জন্য আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

দূরে নদীর ঘাট থেকে শিউলির গন্ধ ভেসে আসছিল, বাতাসে বাজছিল অদৃশ্য এক ঢাকের তালে প্রেমের জয়ধ্বনি।

সেই রাতেই পূর্ণ হলো বহু বছরের প্রতিশ্রুতি। শৈশবের সেই স্বপ্ন আকাশের তারার মতো চিরকালীন হয়ে গেল।

এবার আকাশ সত্যিই তাদের জন্য।

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-12.04.12-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *