Bangla - প্রেমের গল্প

তোমার চোখে বসন্ত

Spread the love

অনিরুদ্ধ মিত্র


অধ্যায় ১: বৃষ্টিভেজা ছাদে প্রথম দেখা

বর্ষার সেই বিকেলটা ঠিক যেন সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা কোনো দৃশ্য। নীল ছাতার নিচে শহরের ধূসর রাস্তায় হাঁটছিল অয়ন। হুট করে অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় খানিকটা সময় তার নিজের ছিল—এমন সময় যা সে সাধারণত পায় না। কলকাতার বাইপাসের ধারে এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে সপ্তাহখানেক আগে। এখনো বাড়ির মানুষজন কিংবা আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে ওঠা হয়ে ওঠেনি।

ছাদে উঠেছিল শুধুই এক কাপ চা আর এক টুকরো নিঃশব্দতার খোঁজে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে সে হারিয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব ভাবনার জগতে। তখনই একটা আওয়াজ ভেসে এলো পাশের ছাদের দিক থেকে—মেয়েলি হাসি, ঝলমলে আর পরিস্কার। এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেল।

পাশের ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল এক মেয়ে। তার চোখে ঝুলে থাকা চুলগুলো ভিজে গিয়ে লম্বা দড়ির মতো পড়ে আছে। সে হয়তো অয়নের উপস্থিতি লক্ষ্য করেনি। অথবা করেও চুপ করে আছে। হঠাৎই মেয়েটি অয়নের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “বৃষ্টি ভালোবাসেন?”

অয়ন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। “হ্যাঁ… মানে, বেশ লাগে। তবে মাঝে মাঝে খুব একা মনে হয়।”

মেয়েটি হেসে বলল, “বৃষ্টি একা করে না। বরং চারপাশের সবকিছু ধুয়ে-মুছে নতুন করে দেয়। ঠিক যেন একটা রিসেট বাটন।”

“আপনি কি কবিতা লেখেন নাকি?” অয়ন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটির ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। “আমি নীলাঞ্জনা। আর আপনি?”

অয়ন মুগ্ধ হয়ে বলল, “অয়ন। আমি এই নতুন বাড়ির বাসিন্দা। সপ্তাহখানেক হলো এসেছি।”

“ও। আমি এখানে বড় হয়েছি। এই ছাদ, এই বৃষ্টি—সব আমার চেনা। আপনি কোথা থেকে?”

“শান্তিনিকেতন থেকে। এখানে চাকরির কারণে আসা।”

বৃষ্টির ধারাগুলো তখন একটু ধীর হয়েছে। ছাদের রেলিং-এর ওপর নীলাঞ্জনার হাত, আর অয়নের চোখ ধীরে ধীরে তাতে স্থির হয়ে এলো। এক অদ্ভুত শান্তি যেন ঘিরে ধরল তাকে—যেন এই ছাদ, এই শহর, এই বৃষ্টি—সব একসাথে মিলে তাকে এই মেয়েটার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

“আপনি যদি রোজ এই ছাদে আসেন, তাহলে হয়তো আমার দিনটা ভালো কাটবে,” হঠাৎই বলে ফেলল অয়ন।

নীলাঞ্জনা একটু চমকে গিয়ে আবার হেসে ফেলল। “এত সহজে মানুষকে জানলে চলে না, মশাই। আমার ভেতরের রংগুলো অনেক বেশি জটিল।”

অয়ন মুচকি হেসে বলল, “জানি না আপনার রং কতটা জটিল, কিন্তু এই বৃষ্টিতে আপনার হাসিটা বড় সহজ লাগে।”

একটু নীরবতা নেমে এলো। হয়তো বৃষ্টির পর ছাদের পেছনের আলোতে তারা দুজনই নিজেদের ছায়া খুঁজে ফিরছিল।

“কাল দেখা হবে?” অয়ন জিজ্ঞেস করল এক নিঃশ্বাসে।

“হয়তো… যদি আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন বৃষ্টি একা করে না,” বলে নীলাঞ্জনা চলে গেল।

অয়ন ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার কপালের চুল ভিজে গিয়েছে, চোখের পাতা ভারী। কিন্তু সে হেসে ফেলল।

বহুদিন পর সে অনুভব করল—তার জীবনে আবার কোনো বসন্ত আসতে পারে। শুধু জানতে হবে, নীলাঞ্জনার চোখে কোন রঙে ফুটে ওঠে সেই বসন্ত।

অধ্যায় ২: পুরনো ডায়েরির পাতায় তোমার নাম

পরদিন ছাদের দিকে যাওয়ার আগে অয়ন আয়নায় নিজেকে খানিকটা খুঁটিয়ে দেখেছিল। একরকম অস্থিরতা আর উদ্দীপনার মিশেলে চোখের ভেতর এক ধরনের আলো জন্ম নিচ্ছিল। যেন তার এই জীবনে যা কিছু ব্যস্ত, ক্লান্ত, মলিন—সবের বাইরে কোথাও একটা নীলাঞ্জনা নামক ছায়া খেলা করছে।

ছাদে পৌঁছে দেখে ছাদ খালি। বৃষ্টির বদলে আজ রোদ। শুকনো পোড়ামাটির গন্ধ, আর হালকা বাতাস। সে ছাদের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে রইল, অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট দশেক পরে সে ভেবেই নিয়েছিল, আজ নীলাঞ্জনা আর আসবে না। হয়তো আগেরদিনের কথাগুলো শুধুই বাতাসে ভেসে যাওয়া কিছু শব্দ ছিল। ঠিক তখনই পাশের ছাদে দরজা খোলার শব্দ।

নীলাঞ্জনা এল, হাতে একটা ছোট নীল খাতা। চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল। আজ তার মুখে ছিল একরকম স্থিরতা, যেন কিছুর সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে।

“আজ বৃষ্টি নেই,” বলল অয়ন।

“তবু আপনি এলেন?” হাসল সে।

“হ্যাঁ। আপনার কথার ওপর আমার এখন কিছুটা বিশ্বাস জন্মেছে।”

নীলাঞ্জনা চুপ করে গিয়ে রেলিংয়ে বসে পড়ল। তারপর বলল, “এইখানে বসতে আমার ভালো লাগে। এই রেলিং, এই খোলা আকাশ, আর এই নোটবুক।”

অয়ন চোখ সরাল না। “লিখেন? ডায়েরি?”

“হ্যাঁ। ক্লাস সেভেন থেকে লিখছি। প্রথম ভালোবাসা, প্রথম ঠকানো, প্রথম গান, প্রথম ঝগড়া—সব কিছু এইখানে। একটা পাতাও বাদ দিইনি।”

“কেউ পড়েছে কখনো?”

“না। এটা আমার একান্ত নিজস্ব জগৎ। আজ… আপনাকে একটা কিছু শোনাতে ইচ্ছে করছে।”

অয়ন একটু থমকে গেল। নীলাঞ্জনা ডায়েরির একটা পাতায় চোখ রাখল। তারপর পড়ে শোনাতে শুরু করল—

“‘সে’ যেদিন প্রথম ছাদে উঠেছিল, আমি জানতাম না আমার দিনটা পাল্টে যাবে। সে জানত না, আমি সেই ছাদে প্রতিদিন অপেক্ষা করি এমন কাউকে, যে বৃষ্টির মতো নেমে আসবে আমার নিঃশব্দে ভিজে থাকা দিনগুলোর ভেতরে। আমি জানতাম না, এমনও হতে পারে কোনো অপরিচিত মুখে এতটা চেনা অনুভব হতে পারে।”

নীলাঞ্জনার গলা কেঁপে গেল একটু। অয়ন বুঝল, এ লেখা আজকের নয়। অনেকদিন আগেকার।

“এটা আমি ক্লাস টেন-এ থাকতে লিখেছিলাম। তখন ছাদে বসে আমি এমন একজনের কথা ভাবতাম, যে হয়তো কল্পনায় ছিল। আপনি… অনেকটা তার মতো।”

অয়নের বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। সে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি কখনো ভাবিনি, আমার মতো এক সাধারণ লোক এতটা গভীরে যেতে পারবে কারও মনে।”

নীলাঞ্জনা চোখে চোখ রাখল। “আপনার চোখে একটা অদ্ভুত নির্ভরতা আছে। আমি বুঝি না, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।”

হঠাৎ বাতাসে একটা পুরনো গান ভেসে এল—কেউ পাশের ফ্ল্যাটে বাজাচ্ছে হয়তো, “তুমি যে আমার…”

সেই গানের মাঝে দুজনের চোখ আটকে রইল কিছুক্ষণ। সময় থেমে গেল যেন।

“আপনি যদি চান, আমি কাল আবার আসব,” বলল নীলাঞ্জনা।

“আমি রোজ আসব,” মুচকি হেসে বলল অয়ন।

সেদিন রাতে অয়ন নিজের পুরনো ডায়েরি খুলে বসল। অনেকদিন পর। সে যে ভাবত না কবিতা লিখতে পারে, আজ নিজেরই একটা পুরনো লেখায় চোখ পড়ল—

“যদি কোনোদিন কারও চোখে বসন্ত দেখি, আমি তাকে ছুঁয়ে থাকব এক বিন্দু জল হয়ে।”

সে লিখেছিল—কবে, মনে নেই। কিন্তু আজ, তার মনে হলো, সেই বসন্ত তাকে ডাকছে।

অধ্যায় ৩: লালজামার সন্ধ্যা

শহরের বাতাসে তখন হালকা শীতের আভাস। শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে ফুটপাতে। অয়ন আজ দুপুর থেকেই অস্থির। অফিসের কাজ গুটিয়ে ফেলে বারবার ফোনটা দেখছিল, যদিও নীলাঞ্জনার ফোন নম্বর সে চায়নি, আর সে দেয়ওনি। এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা আর অজানা আকর্ষণের মাঝে ঘুরছিল তার দিনগুলো।

সন্ধ্যেবেলা ছাদে উঠতেই চোখে পড়ল, আজ নীলাঞ্জনা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে। গায়ে লাল রঙের জামা, হালকা মেরুন শাল, ঠোঁটে রঙহীন একটা হাসি। দেখে অয়ন থমকে দাঁড়াল। যেন কারও আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে—কিছু বলার ভাষা নেই, শুধু চাওয়া।

“আজ লাল জামা পরেছেন?” অয়ন একটু হেসে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। দোলের দিন পরে ছিলাম শেষবার। আপনি আজ একটু দেরি করলেন।”

“হ্যাঁ, অফিসে একটা ফাইল আটকে গিয়েছিল… কিন্তু মনে হচ্ছিল আপনি থাকবেন। তাই ছুটে এলাম।”

নীলাঞ্জনা চুপ করে গেল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আপনি জানেন? লাল আমার খুব প্রিয় রঙ নয়। কিন্তু এটা কেউ দিয়েছিল, যাকে একসময় ভেবেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ হবে।”

অয়ন থমকে গেল। “ব্রেকআপ?”

“না। বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ বছর আগে। ও মারা গেছে। অ্যাক্সিডেন্ট।”

নিরবতা কেটে ছাদে একটা হালকা সোঁদা গন্ধ ভেসে এলো। অয়ন বুঝল, এই সম্পর্ক কোনো সরলরেখায় হাঁটবে না। এই মেয়ের ভেতরে বয়ে চলেছে একটা অদৃশ্য নদী, যার গভীরতা অনুমান করা যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়।

“আমি দুঃখিত। জানতাম না…” অয়ন শান্ত গলায় বলল।

“জানার কিছু নেই। মানুষ চলে যায়। থেকে যায় কিছু জামা, কিছু গান, কিছু ছাদ।”

“আর কিছু লেখা। আপনার ডায়েরিতে।”

নীলাঞ্জনা তাকিয়ে রইল। “আপনি বিশ্বাস করেন নতুন করে ভালোবাসা হতে পারে?”

অয়ন মৃদু হেসে বলল, “বিশ্বাস না করলে রোজ এই ছাদে আসতাম না।”

নীলাঞ্জনা হালকা মাথা নিচু করল, বাতাসে চুল উড়ে এল মুখে। সে সামলে নিয়ে বলল, “আজ আমি অনেক কিছু ভেবেছি। বুঝেছি, আমি আপনাকে ভয় পাই না। আপনার কাছে কিছু হারানোর ভয় নেই আমার। অথচ আপনি নতুন কিছু দিতে পারেন।”

“আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না,” অয়ন কাঁপা কণ্ঠে বলল, “কিন্তু একটা সময় দিতে পারি—যেটা আপনি চাইলে আমার সঙ্গে কাটাতে পারেন। শুধুই আপনাদের মতো করে।”

নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল। “আজ আমি এক কাপ কফি বানিয়েছি নিজের হাতে। আপনি খাবেন?”

“আপনার কফি হলে আমি জাস্ট কফির জন্যই বাঁচব,” বলে হেসে ফেলল অয়ন।

“তাহলে আসুন। ছাদ থেকে একদিন নেমে যাই। বাস্তবের সিঁড়িতে।”

সেদিন অয়ন প্রথম নেমে গেল সেই অচেনা পথ ধরে, যেটা হয়তো ভালোবাসার দিকে নয়, কিন্তু এক ঘন সান্ধ্য বৃষ্টির মতো অনুভবের দিকে যাচ্ছিল।

একটা লাল জামা, এক কাপ কফি, আর দুটো মানুষ—যারা খুব ধীরে ধীরে বুঝছে, বসন্ত শুধু ফুল ফোটায় না, পুরনো পাতাও ঝরিয়ে দেয়।

অধ্যায় ৪: দূরত্বের রং

তারপর থেকে প্রতিদিন না হলেও, প্রায় প্রতিদিন দেখা হতে লাগল তাদের। কখনো ছাদে, কখনো পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে, আবার কখনো হঠাৎ করে অয়ন এসে দাঁড়াত নীলাঞ্জনার বারান্দার সামনে, ফোন না করেই। যেন এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে চলেছে—অভিমানহীন, প্রতিশ্রুতিবিহীন, অথচ গভীর।

কিন্তু সময়ের ভেতরে থাকা ভালোবাসা সবসময় সরল হয় না। একদিন দুপুরে অয়ন অফিস থেকে বেরিয়ে ফিরছিল, হঠাৎ দেখতে পেল নীলাঞ্জনা এক ছেলের সঙ্গে বসে আছে ক্যাফেটের এক কোণায়। ছেলেটির মুখে হাসি, আর তার সামনে কাঁচের গ্লাসে জলের মতো স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে নীলাঞ্জনা।

অয়ন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে চায়নি সন্দেহ করতে। তবুও ভেতরে একটা হিমেল বাতাস বয়ে গেল। সে পা টেনে ফিরল।

সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে গিয়ে সে অপেক্ষা করল। কিন্তু নীলাঞ্জনা এল না।

পরদিনও না।

তৃতীয় দিনে সে নিজেই দাঁড়িয়ে গিয়ে ডাকল, “নীলাঞ্জনা?”

বারান্দা থেকে মাথা বের করে মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ?”

“কিছু বলব ভাবছিলাম।”

“আপনি আজকাল অনেক কথা ভাবেন। কিন্তু মনে হয় কিছু কিছু কথা না বলাই ভালো।”

“মানে?” অয়ন থেমে গেল।

নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে বলল, “আপনি কি দেখেছেন আমাকে কারও সঙ্গে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমি কিছু বলিনি।”

“তাই তো বললাম, কিছু কিছু কথা না বলাই ভালো। ও আমার এক্স-হাসবেন্ডের ছোট ভাই। ওর সঙ্গে বছরে একবার দেখা হয়। কিছু কথাবার্তা, কিছু স্মৃতি। তাতে আমি খারাপ হয়ে গেলাম?”

“আমি তো কিছু বলিনি…”

“আপনি না বললেও, আপনার চোখ বলে। আপনার চোখে সেই পুরনো সন্দেহ, সেই পুরুষের অধিকারবোধ। আপনি কি জানেন, আমি কেন এই ছাদে এসে কথা বলতাম আপনার সঙ্গে? কারণ আপনি কখনও আমাকে পিঞ্জরের পাখি বানাতে চাননি।”

অয়ন নিশ্চুপ।

“আপনি যদি আমাকে ভালোবাসেন, তাহলে সেই বিশ্বাসটাও দিতে হবে—আমি আমার অতীত নিয়ে নিজেই সৎ। কেউ এসে আমার পাশে বসলেই আমি পাল্টে যাই না। আপনিও যদি সেটুকু না পারেন… তাহলে ছাদের এই রেলিংটা আমাদের আলাদা করে রাখাই ভালো।”

সেদিন অয়ন বাড়ি ফিরল খুব চুপ করে। সে জানে, এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই, কোনো দাবি নেই, কিন্তু অনুভব আছে। অনুভব যার রঙ হয় না—হয় আলো, নয় ছায়া।

রাতের বেলায় সে তার ডায়েরিতে লিখল—

“ভালোবাসা যদি বিশ্বাসহীন হয়, তবে তা ঠিক ভালোবাসা নয়—একধরনের আবেগ মাত্র। কিন্তু আমি তোমাকে আবেগ নয়, মানুষের মতো ভালোবাসতে চাই।”

সেই রাতে বারান্দার বাতাসে ভেসে এল এক টুকরো কণ্ঠ—“অয়ন… কাল আসবেন তো?”

অয়ন জানে, বসন্ত আসতে পারে, কিন্তু তার আগেও একটা ঋতু থাকে—যার নাম ‘অপেক্ষা’।

অধ্যায় ৫: ভালোবাসার অসম্ভব সমীকরণ

পরদিন ছাদে পৌঁছে অয়ন দেখল, নীলাঞ্জনা আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় খোলা চুল, চোখে ক্লান্তির ছায়া, ঠোঁটে অভিমান নয়—কিন্তু নিরুত্তাপতা। এমন মুখের অভিব্যক্তি, যেটা হয়তো কিছু বলছে না, অথচ অনেক কিছু বোঝায়।

অয়ন কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু বলার আগেই নীলাঞ্জনা বলে উঠল, “আমরা কি করব, অয়ন?”

“মানে?” অয়ন থমকাল।

“এই যেটা চলছে… ছাদে দেখা, কথাবার্তা, অনুভব… কোনো পরিণতি নেই তো এতে?”

অয়ন চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “সবকিছুর পরিণতি হয় না। কিছু সম্পর্ক শুধুই বেঁচে থাকে নিজের মতো করে। হিসেব ছাড়াও।”

“কিন্তু মানুষ তো সংখ্যা চায়। একটুখানি নিশ্চয়তা, একটুখানি স্থায়িত্ব। আপনি কি আমাকে নিয়ে কোনোদিন ভেবেছেন কিছু? বিয়ে? ভবিষ্যৎ?”

অয়ন মাথা নিচু করে ফেলল। অনেক কথা তার মুখে এসে গলায় আটকে গেল।

“আমি জানি, আপনি একা। আপনার পরিবার শান্তিনিকেতনে। এই শহরে আপনার কেউ নেই। আমি এখানে নিজের ভাঙা অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুজন দুজনের জন্য হয়তো প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট?”

“আমি ভয় পাই,” বলল অয়ন অবশেষে। “ভয় পাই আবার হারানোর। আবার কাছের কেউ দূরে চলে যাওয়ার। আপনি যদি আমার জীবনের অংশ হয়ে যান, আর একদিন… আবার হারিয়ে যান…?”

নীলাঞ্জনা হালকা হেসে ফেলল। “তাহলে আপনি ভাবেন, দূরে থাকলেই হারানো কম হয়?”

“না, সেটা বলছি না। কিন্তু আপনাকে চাই বলেই তো আমি নিজেকে ধরে রাখছি। যেন ভেঙে না পড়ি। যেন সেই বিশ্বাসটা ভেঙে না যায়।”

“অয়ন, ভালোবাসা কখনো সমীকরণের মতো মেলানো যায় না। সেখানে x-এর মান মেলে না, শুধু অনুভবের জ্যামিতি হয়। যে গাণিতিক নয়, হৃদয়ের রেখায় আঁকা।”

অয়ন প্রথমবার নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে চলুন, সমীকরণ না মেলানোর শর্তে ভালোবাসা করি। কোনো শর্ত ছাড়াই।”

নীলাঞ্জনা তাকিয়ে রইল। বাতাসে তখন সন্ধ্যার প্রথম হাওয়া। একটা পাখি ডেকে উঠল দূরের গাছে। সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপনি মুখ ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু আপনি আমায় ফিরিয়ে আনলেন আবার এই রেলিঙে। এটাও একধরনের সাহস।”

“ভালোবাসা মানেই সাহস, নীলাঞ্জনা। শুধু একসাথে থাকার সাহস নয়, একে অপরকে বুঝে ওঠার, একে অপরের অতীত মেনে নেওয়ার সাহস।”

এক মুহূর্ত থেমে নীলাঞ্জনা বলল, “তাহলে কাল একটু বাইরে যাই?”

“যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন, আমি যাব।”

“ঠিক আছে,” সে বলল, “কাল আপনাকে আমার শৈশবের একটা জায়গায় নিয়ে যাব। যেখানে আমি একদিন বসন্ত খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাইনি।”

অয়ন বুঝল, সে হয়তো সেই বসন্ত নয়, কিন্তু তার আগমনী সুর—যেটা এক ভাঙা মেয়ের হৃদয়ে ধীরে ধীরে আবার বাজছে।

অধ্যায় ৬: শহর বদলায়, মন বদলায় না

পরদিন সকালে তারা ট্রেনে চড়ল। গন্তব্য—একটা ছোট্ট শহর, শহরতলির প্রান্তে অবস্থিত, যেখানে একসময় নীলাঞ্জনার মামাবাড়ি ছিল। সেই শহরের নাম শুনে অয়ন কিছুটা বিস্মিত হয়েছিল—উলুবেড়িয়া। কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়, অথচ অয়ন কখনো যায়নি।

নীলাঞ্জনা জানাল, “এখানে আমি ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে আসতাম। মামা-মামী, পুকুর, জাম গাছ, মেলা—সব ছিল এখানে। আমি ক্লাস সেভেনে থাকতে, এক ছেলেকে খুব পছন্দ করতাম। নাম ছিল অনিক। একদম চুপচাপ, গাছের নিচে বসে আঁকত। একদিন তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি আমার প্রিয় মানুষ’। সে শুধু হেসেছিল। তারপর আমি চলে যাই কলকাতায়, আর কোনোদিন দেখা হয়নি।”

অয়ন চুপ করে শুনছিল। “তাহলে আজ আসলে সেই অতীতকে দেখতে এসেছেন?”

“হয়তো। অথবা আপনাকে সেই অতীতটা দেখাতে, যাতে আপনি বুঝতে পারেন, আমি কীভাবে এমন হলাম।”

ট্রেন থেকে নেমে তারা হাঁটতে লাগল শহরের ভেতরে। পুরনো সব বাড়ি, দালান, লাল মাটির পথ। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোট্ট লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জনা বলল, “এইখানে আমি প্রথম প্রেমের উপন্যাস পড়ি। তখনও জানতাম না, বাস্তবের প্রেম এতোটা কঠিন হয়।”

অয়ন একটু হেসে বলল, “তখন কি আপনি জানতেন, বড় হলে একজন এক্স-কবি অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে আপনাকে ভালোবাসবে?”

“তখন ভাবতাম, কেউ যদি সত্যিই ভালোবাসে, তবে সে গল্পের মতো বলবে না। সে চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

“আমি চুপ করে না, আজকাল বেশ কথা বলি,” বলে অয়ন নরম করে তার দিকে তাকাল।

নীলাঞ্জনা একটুও না তাকিয়ে বলল, “আপনি এখনো ভয় পান?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এখন ভয়টা হারের নয়, হারিয়ে যাওয়ার। কারণ আপনি অনেকটা হয়ে উঠেছেন আমার ভেতরের শব্দ। আর শব্দ হারালে কবিতা লেখা যায় না।”

তারা একটা পুরনো পুকুরের ধারে গিয়ে বসল। বিকেলের আলো পড়েছে জলে, আর তার প্রতিফলনে নীলাঞ্জনার মুখে এক আশ্চর্য আলো।

“এই শহর বদলে গেছে,” সে বলল, “কিন্তু আমার ভেতরের অনুভবগুলো ঠিক তেমনি রয়ে গেছে।”

“আমিও বদলাইনি। কেবল একটা কথা বলার সাহস পেয়ে গেছি। বলব?”

“বলুন,” নীলাঞ্জনার কণ্ঠে কাঁপা কৌতূহল।

“আপনাকে না দেখে আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। আপনি আমার একধরনের প্রয়োজন হয়ে গেছেন—জলের মতো, আলোর মতো, শ্বাসের মতো।”

নীলাঞ্জনা তাকিয়ে রইল, চোখে জল জমে উঠল। “আমি ভয় পাই, অয়ন। আবার কাউকে আপন করে হারানোর ভয় পাই।”

“তাহলে সেই ভয়টা আমি নিয়ে নেব। আপনি শুধু পাশে থাকুন।”

পুকুরের ধারে হাওয়া বয়ে চলল। কোথাও একটা জামরুল গাছের পাতা ঝরল। আর তাদের মাঝে জন্ম নিল এক নতুন বিশ্বাস—যেটা শহর বদলালেও বদলায় না।

অধ্যায় ৭: দোলের দিন, চোখে রঙ

দোল পূর্ণিমার সকাল। শহরের অলিগলিতে রঙ, আবির, পিচকারি আর হাসির রোল। বারান্দা থেকে ছুড়ে দেওয়া জলরঙে ভিজছে রাস্তাঘাট। সেই সকালেই অয়ন দাঁড়িয়ে আছে এক গুচ্ছ রঙ হাতে নিয়ে নীলাঞ্জনার দরজার সামনে। খুব সাধারণ একটা পলাশ রঙের কুর্তা পরা, চোখে একটু শঙ্কা, আর হাতে কাঁচের কৌটোতে রাখা গুলাল।

নীলাঞ্জনা দরজা খুলল, চোখে ক্লান্তি নেই—বরং এমন এক ধরণের জ্যোতি, যা জন্মায় মনে উত্তাপ থাকলে। সে পরেছে সাদা সালোয়ার কামিজ, চুল খোলা, কপালে ছোট্ট একটা টিপ। এক মুহূর্তে অয়ন যেন ভুলে গেল পৃথিবীর বাকি সব রঙ।

“দোল মানে তো রঙের দিন,” বলল অয়ন, “কিন্তু আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, দোল মানে আলো।”

নীলাঞ্জনা হেসে বলল, “তুমি কিন্তু কবিতা লেখা ছেড়েছিলে বলেছিলে। এখন তো প্রায় লাইন লিখেই ফেলছ।”

“তুমি না বললে, কবিতা এসে পড়ে না। এখন তোমার চোখে রঙ দেখে মনে হচ্ছে, লিখে ফেলি একটা… শুধু তোমাকে ঘিরে।”

নীলাঞ্জনা নিচু গলায় বলল, “তবে দিও না আবির আগে। শোনো, আমি তো কখনো কোনো প্রেমিকের হাতে প্রথম রঙ পাইনি। এবার তোমার কাছে থাকুক সেই অধিকার।”

অয়ন এক চিমটি হলুদ তুলে আলতো করে ছোঁয়াল নীলাঞ্জনার গালে। বলল, “তোমার গায়ে রঙ মানেই যেন বসন্ত নিজে এসে তোমায় ছুঁয়ে গেল।”

নীলাঞ্জনা কিছু না বলে পিচকারিতে জলভরা আবির ছুড়ে দিল অয়নের বুকের দিকে। “এইবার কিন্তু আমি পালটা নিলাম,” বলে সে হেসে উঠল।

একসাথে ছুটতে ছুটতে তারা ছাদে উঠে গেল। ছাদে আজ আর চুপচাপ রেলিং নেই, বরং চারদিক রঙে রঙিন, কিছু আবছা চিহ্ন, কিছু জল মাখা ধ্বনি, আর হাসির প্রতিধ্বনি।

অয়ন হঠাৎ বলল, “তুমি কি জানো, আমি অনেক দিন পর মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি… আমাদের একটা ঠিকানা হতে পারে?”

নীলাঞ্জনা একটুখানি থেমে বলল, “ঠিকানাগুলো কাগজে লেখা যায় ঠিকই, কিন্তু মন যদি না মানে, তবে সে ঠিকানাও বাড়ি হয় না। তবে আজ… আজ তোমার চোখে যে রঙ দেখছি, মনে হচ্ছে, সে ঠিকানা আমি চিনি।”

“কোথায়?”

“তোমার বুকের বাঁ দিকে। সেখানেই বসন্ত আসে—দোলের সকাল হোক বা কোনো এক মেঘলা বিকেল।”

অয়ন এগিয়ে এসে চুপচাপ তার কপালে এক বিন্দু লাল রঙ ছুঁইয়ে দিল। বলল, “তুমি আমার প্রেমের প্রথম নাম নয়, কিন্তু হতে পারো শেষ শব্দ।”

নীলাঞ্জনা চোখ বন্ধ করল। একটানা বাতাস এল, পলাশ গাছের ছায়া নড়ল, আর অয়ন মনে মনে জানল—এই প্রেম কোনো উৎসবের নয়, এটি ছুঁয়ে থাকা প্রতিটি মুহূর্তের মতোই সত্য, প্রতিদিনের মতোই আবশ্যক।

অধ্যায় ৮: স্বীকারোক্তির আগে-পরে

দোলের পরদিন সকালটা যেন অন্যরকম। রঙ ধুয়ে গেলেও শরীরে লেগে থাকে এক ধরনের অনুভব—যেটা শুধু বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে বদলে দেয় মানুষকে।

অয়ন সেই সকালে নিজের ঘরে বসে ডায়েরি খুলেছিল। অনেকদিন পর একটানা লিখছিল—কোনো ব্যাকরণ না মেনে, কোনো ছন্দের তোয়াক্কা না করে। কেবল অনুভূতির মতো বয়ে যাওয়া কিছু শব্দ—

“তুমি যখন আমার গালে প্রথম হলুদ ছুঁয়েছিলে, তখন বুঝেছিলাম, পৃথিবীর সব রং একসাথে এসে তোমার চোখে জমেছে।”

ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। নীলাঞ্জনার মেসেজ—”আজ সন্ধ্যায় সময় হবে? একটা জায়গা দেখাতে চাই।”

অয়ন সন্ধ্যায় এল পার্ক সার্কাসের এক পুরনো বাড়ির সামনে। তিনতলা একটা লাল রঙের বিল্ডিং, নিচে ছোট্ট বারান্দা, কড়া ধাতব দরজা। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল নীলাঞ্জনা। পরনে একটা খয়েরি সিল্কের শাড়ি, হালকা গন্ধে ভেসে আসছে চন্দনের মতো কিছু।

“এই বাড়িটা আমার মাসির,” সে বলল। “এখানে আমি ক্লাস টুয়েলভে থাকতে এক বছর থেকেছিলাম। এই বারান্দায় বসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজের সঙ্গে কথা বলতাম। আজ হঠাৎ মনে হলো, এই মানুষটিকে এখানে আনতে চাই—যার সামনে আমি আবার নিজেকে দেখতে শিখছি।”

অয়ন চুপ করে তাকিয়ে রইল। শব্দ আসছিল না। তার বুকের ভেতর কিছু জমে উঠছিল—একধরনের প্রস্তুতি, স্বীকার করার জন্য।

“তুমি কি জানো, আমার ভয়টা কোথায়?” বলল নীলাঞ্জনা।

“ভয় তোমার চলে যাওয়ার নয়?”

“তা তো আছেই। কিন্তু আরও বড় ভয়—তুমি একদিন আমায় ভালোবেসে ফেলবে, কিন্তু বলবে না। তুমি হয়তো ভেবে নেবে আমি বুঝে যাব। কিন্তু আমি চাই, তুমি একদিন জোর করে আমাকে বলো—যেমন গল্পের নায়কেরা বলে, বুক ফুলিয়ে, ভয়ের তোয়াক্কা না করে।”

অয়ন নরম গলায় বলল, “তুমি কি চাও আমি আজ বলি?”

নীলাঞ্জনা একটুও না তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। আজ বলো। আর যদি না পারো, তাহলে আজকের পরে আমরা আর ছাদে দেখা করব না। আমি জানি, এটা অন্যায় শর্ত, কিন্তু আজকের মতো এমন এক সন্ধ্যা দরকার—যেখানে উত্তর দিতে হয়।”

অয়ন বুকের ভেতর পাথরের মতো একটা চেপে থাকা শব্দ বের করে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, নীলাঞ্জনা। ঠিক সেই দিন থেকেই, যেদিন প্রথম ছাদে দাঁড়িয়ে তুমি বলেছিলে—বৃষ্টি একা করে না।”

“এখনো বৃষ্টি ভালোবাসো?”

“না। এখন আমি বৃষ্টিকে তোমার কণ্ঠে খুঁজি। আর ভালোবাসাকে খুঁজি তোমার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে।”

নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল। তারপর কপালে একটা চুল সরিয়ে বলল, “তাহলে এসো। এই বারান্দায় বসে আজ সেই প্রথম গল্পটা আবার বলি—যেখানে ভালোবাসা চুপ করে পাশে বসে থাকে, কোনো উত্তর চায় না। শুধু হাতে হাত রাখে।”

অয়ন তার হাত ধরে ফেলল।

সেদিন বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে তারা দুজনে কোনো প্রেমের ঘোষণা করল না। তারা শুধু চুপচাপ বুঝে গেল—স্বীকারোক্তি উচ্চারণে নয়, সাহসে হয়। আর সাহস তখনই জন্মায়, যখন ভালোবাসা নিজে এসে পাশে বসে।

অধ্যায় ৯: শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়

কলকাতা শহরে রাত নামে একটু ধীরে, একটু মোহময়ভাবে। স্ট্রিটলাইটের নিচে ছায়া পড়ে লম্বা, যেন কেউ অপেক্ষা করছে কাকে যেন বিদায় জানাবে বলে। এমন এক রাতে, অফিস থেকে ফিরে অয়ন জানতে পারল—তার বদলি হয়েছে।

চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে বসে পড়ল সে। চোখে ধরা পড়ার মতো জল নেই, কিন্তু ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। শহরটা যাকে ধীরে ধীরে নিজের করে তুলেছিল, সেই শহরই এখন তাকে বিদায় বলছে।

বদলির জায়গা—বর্ধমান। হয়তো খুব দূর নয়, কিন্তু তবুও সেই ছাদ, সেই রেলিং, সেই নীলাঞ্জনা থাকবে না।

সে ভাবল কিছু বলবে না। হয়তো আজ ছাদে যাবে, নীলাঞ্জনাকে দেখবে, একটু হাসবে, একটা চা খাবে, তারপর চুপচাপ চলে যাবে।

কিন্তু ছাদে পৌঁছে দেখে নীলাঞ্জনা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে। চোখে যেন কিছু একটা আগেই বুঝে ফেলার ভাব।

“কিছু বলবে না?” সে জিজ্ঞেস করল।

অয়ন মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ। বদলি হলাম। বর্ধমান। আগামী সপ্তাহেই যেতে হবে।”

“তোমার মুখে এটা খুব অচেনা লাগছে। আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলবে, ‘আমি ফিরে আসব’।”

“আমি জানি না ফিরতে পারব কি না। কিন্তু তুমি জানো, আমি এই শহরটা ভালোবাসি না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। শহরটা শুধু তোমার মাধ্যমে জীবন্ত হয়েছিল।”

নীলাঞ্জনা ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি জানো, আমি একসময় এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলাম, যেটা সে কোনোদিন পায়নি। সেখানে লিখেছিলাম—‘যদি কখনো চলে যেতে হয়, তাহলে শেষ ট্রেনটা ধরার আগে আমার সামনে এসে দাঁড়িও।’”

“তুমি কি চাও আমি আসি?”

“তুমি কি চাও না?”

অয়ন চুপ করে রইল। তারপর হালকা করে বলল, “আমি তোমার সেই বন্ধুর মতো হতে চাই না, যে চিঠির উত্তর দেয় না। আমি আসব। শেষ ট্রেন ধরার আগে, তোমার সামনে দাঁড়াব। যদি তুমি ততদিনেও কাউকে খুঁজে না পাও—যে তোমার গল্পের শেষ পৃষ্ঠা লিখবে।”

নীলাঞ্জনার চোখ ভিজে উঠেছিল। সে কিছু বলল না। শুধু ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে একবার তাকাল।

সপ্তাহ পেরোল। অয়ন ট্রেনে উঠল। জানলার পাশে বসে দূরের শহরটাকে পেছনে রেখে এগোতে লাগল। কিন্তু তার বুক পকেটে ছিল একটা ছোট্ট খাম—ভেতরে লেখা, “তোমার চোখে বসন্ত, আমি সেই পাতায় অপেক্ষা করছি।”

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা এখনো ফুরোয়নি।

অধ্যায় ১০: তোমার চোখে বসন্ত

বর্ধমানের সকালে হালকা কুয়াশা পড়ে। অয়ন এখন নতুন জায়গায়, নতুন অফিসে, নতুন চায়ের দোকানে—কিন্তু কাগজের কাপের ধোঁয়ার ভেতরেও খুঁজে ফেরে এক চেনা মুখ। রেলিং নেই, ছাদ নেই, কিন্তু মন বলিরেখায় আঁকা এক অনুপস্থিতির ছবি আঁকছে প্রতিদিন।

প্রথম কিছুদিন সে নিয়মিত ফোনে খোঁজ নিয়েছে নীলাঞ্জনার। মেসেজে লিখেছে—“আজ সকালটা কেমন?” কিংবা “চায়ে তোমার মতো আদার ঘ্রাণ নেই।” কিন্তু ধীরে ধীরে কথাগুলো কমে এসেছে। নয়ত অনুভব গভীর হতে হতে শব্দ ফুরিয়েছে।

একদিন সকালে, ছুটির দিন, অয়ন শান্তিনিকেতনে যায়। মা-বাবার কাছে বসে এক কাপ লাল চায়ের সঙ্গে পুরনো চেনা গল্প শুনছিল। হঠাৎ মনে পড়ল—আজ ঠিক একমাস, যেদিন সে কলকাতা ছেড়েছিল।

সে ভাবল, আজ যদি ফিরে যাই একবার? অন্তত একটা বারান্দা তো থাকবে, যেখানে বসে কেউ হয়তো চুপচাপ তাকিয়ে থাকে শেষ ট্রেনের দিকে।

কলকাতা ফিরল বিকেলে। সেই পুরনো ছাদ, সেই লাল বিল্ডিং—সব এখনো একই। শুধু একা লাগছে।

রাত দশটায় সে হাজির হল পার্ক সার্কাসের সেই বাড়ির সামনে। দরজায় শব্দ করতেই ভেতর থেকে আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ল।

দরজা খুলে দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জনা। চুল খোলা, চোখে বিস্ময় আর শান্তি। গলায় কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু একটুকরো প্রশান্তি—যা অপেক্ষার চূড়ান্তে জন্ম নেয়।

“তুমি এসেছ?” তার স্বরটা যেন ধূপের মতো মৃদু।

অয়ন মৃদু হেসে বলল, “তোমার চোখে বসন্ত আছে। আমি তো জানিই… আর সেই বসন্ত দেখতে এলে বারবার আসতে হয় না। একবার দেখলেই জীবন বদলে যায়।”

নীলাঞ্জনা এগিয়ে এসে তার কপালে হাত রাখল। “আমি ভেবেছিলাম, তুমি আসবে না। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এটা শুধুই একটা ঋতু ছিল তোমার জীবনে। কিন্তু এখন বুঝি, তুমি ছিলে আমার সমস্ত ঋতুর মধ্যে বসন্ত।”

অয়ন তার ডায়েরির পাতাগুলোর মতো বলল, “তুমি কি জানো, আমি ভালোবাসাকে আজকাল মরশুমের মতো দেখি না। আমি তাকে দেখি আলোর মতো। তুমি আমার ভেতরের আলো।”

তারা দুজনই জানত, আজ কোনো প্রথাগত ঘোষণা হবে না, কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নয়। কিন্তু আজ তারা দুজন ঠিক করল, একসাথে চুপ করে থাকা যাবে।

ছাদের নিচে বসে, হাতে এক কাপ চা, আর একে অপরের চোখে বসন্ত নিয়ে তারা বসে রইল।

বসন্ত কখনো কারও নামে আসে না, কিন্তু কেউ কেউ এমন হয়—যার চোখেই চিরকাল বসন্ত থেকে যায়।

শেষ

Lipighor_1751125462839.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *