অরিত্রী চক্রবর্তী
পর্ব ১: সকালটা তোমার মতো নরম ছিল
সকালটা নরম ছিল। ঠিক যেমন নরম হয় ভিজে তুলোর মতো আবেশ—যা গায়ের ওপর পড়ে না, কিন্তু ঢুকে যায় চামড়ার নিচে। পল্লবী জানালার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখন, পেছনে এলার্মের শব্দ থেমে গেছে অনেক আগেই। মা চিৎকার করছেন—“পল্লু, দেরি হয়ে যাবে ব্যাচে যাওয়ার! আবার না খেয়ে বেরোবি?”
কিন্তু পল্লবীর চোখ তখন জানালার ওপারে একটা দৃশ্য খুঁজছে—যেটা প্রতিদিন দেখে সে, অথচ কাউকে কখনও বলে না।
রাস্তাটা ফাঁকা। সাইকেলের ঘণ্টি একটা বাজে পাশের গলিতে, তারপর আবার নীরবতা। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই দোকানের সামনের স্টিলের শাটারটা উঠে যায়। একটা ঝাঁপ খুলছে, আর তাতেই তার বুকের মধ্যে কিছু খুলে বসে।
রাজা এসে দাঁড়ায় মিষ্টির দোকানের কাউন্টারে। গায়ে ধূসর রঙের সস্তা হুডি, চুলগুলো এলোমেলো, আর চোখে সেই নরম ঘুমের দাগ। সে প্রথমে একটা ভাজা ফ্যান চালায়, তারপর একটা স্টিলের ট্রেতে প্যাঁড়া সাজাতে শুরু করে।
পল্লবী জানে, সে তার জন্যই দুটো প্যাঁড়া আলাদা করে রাখবে—একটু নরম, একটু বেশি ছানা দেওয়া, যেগুলোর ওপর রোজ সকালে হালকা রোদ পড়ে থাকে।
জলের মতো হাঁটতে হাঁটতে পল্লবী সেই দোকানে পৌঁছায়। ব্যাগটা একদিকে ঝুলে আছে, চুলগুলো খোঁপা হয়নি ঠিকঠাক, তবু চোখে কাঁচা মুগ্ধতা।
রাজা কিছু বলে না। সে মাথা নিচু করে একটাই প্রশ্ন করে রোজ, একেবারে একই টোনে—“একটা প্যাঁড়া?”
পল্লবী একটু হাসে, বলে—“আজ দুটো।” তারপর হাতে বাড়ানো প্যাঁড়ার বাক্সটা নিতে গিয়ে তাদের আঙুল ছুঁয়ে যায়। খুবই সামান্য, হয়তো একটা অক্ষর লেখার মতো। কিন্তু সেই স্পর্শটা নরম, ধীরে গলে যায় পল্লবীর তালুতে। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
রাজা তখন চোখ তোলে, জিজ্ঞেস করে না কিছু, কিন্তু বুঝে ফেলে যেন। তার মুখে হালকা হাসি, যেমন হাসলে মানুষ অচেনাকে চিনে ফেলে।
পল্লবী মিষ্টির কাগজটা নিয়ে এগিয়ে যায়। পেছনে আর তাকায় না, অথচ গালে একটা অদ্ভুত উত্তাপ টের পায়। একটা মিষ্টির কাগজে গন্ধ লেগে থাকে কারো আঙুলের, সেটা হয়তো সে বুঝে গেছে। হেঁটে হেঁটে ব্যাচে পৌঁছায় সে। প্রথম বেঞ্চে বসে, ক্লাস শুরু হয়। পাশের জন গালাগালি করে বলে—“রোজ দেরি করিস তুই! ওই দোকানেই না?”
পল্লবী হেসে না, মাথা নাড়ে না। কেবল চোখ বন্ধ করে ভাবে—আজকের স্পর্শটা কি আগে কখনও হয়েছে?
সেদিন ব্যাচের ক্লাসটা অদ্ভুত ঠেকে। অঙ্ক, অঙ্ক আর অঙ্ক—কিন্তু পল্লবী যেন অঙ্কের ভেতর থেকে কিছু ছুঁতে চাইছে বারবার। রাজা যখন প্যাঁড়া দেয়, তার আঙুলের পাশে একটা দাগ থাকে কি না, মনে পড়ে না। কিন্তু আজ মনে হলো সেই স্পর্শ যেন একরকম গরম ছিল।
ব্যাচ শেষ হয়। পল্লবী বেরিয়ে আসে। বিকেলের আলো তখন একটু লালচে, ধুলো উড়ছে। সে দোকানের সামনে দিয়ে যাবে না ঠিক করেছিল, তবু পা আপনিই সেই দিকে যায়।
রাজা তখন দোকান গুছিয়ে নিচ্ছে। পল্লবী হঠাৎ থেমে বলে—“আজ কাগজে একটু বেশি ছানা ছিল, না?”
রাজা তাকিয়ে বলে—“তুমি দেখলে?”
পল্লবী হেসে বলে—“তুমি কি জানো, আমি শুধু খেতে আসি না?”
রাজা মাথা নিচু করে, বলে না কিছু।
একটা নীরবতা নামে, খুব দীর্ঘ। তারপর রাজা আস্তে করে বলে—“তুমি আসলে সকালটা একটু সুন্দর করে দাও।”
পল্লবী প্রথমবার মুখ তুলে তাকায়। সে কিছু বলে না, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণ থেকে একটা নরম প্যাঁড়ার হাসি গড়িয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে পল্লবী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, আঙুলে একটা অদ্ভুত আলো আছে। সেটা হয়তো রোদের নয়, হয়তো মিষ্টির নয়, হয়তো কারো ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্তের।
সে ভাবে—সকালটা সত্যিই তোমার মতো নরম ছিল।
পর্ব ২: তোমার আঙুলের ঠিক পাশে
ব্যাচের ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও পল্লবীর মাথায় রয়ে গেল কেবল একটা জিনিস—আঙুলের পাশে থাকা সেই কাঁপুনি। স্পর্শ হয়নি ঠিক, কিন্তু এমন এক অনুভব হয় যেন কারো নিঃশ্বাস গাল ছুঁয়ে চলে গেছে। নরম, নিঃশব্দ, তবু প্রবল।
সন্ধ্যেটা একটু ছাইরঙা। বাইরের আলো ম্লান, রাস্তাগুলো নীরব। সে ফিরছে, মাথায় হেডফোন, তবু কোনো গান চলছে না। দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে একটু থামে। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। শাটার অর্ধেক নামানো, রাজা ভিতরে ট্রে মুছছে।
পল্লবী হঠাৎ বলেই ফেলে,
“তুমি কি প্রতিদিন সকালে প্যাঁড়া বেছে রাখো?”
রাজা চমকে তাকায়। একটু পরে হাসে—“তুমি তো প্রতিদিনই আসো, না?”
পল্লবী বলে—“তাতে কী হয়? প্রতিদিন কেউ কাউকে একইরকম দেখায় না তো।”
রাজা একটু থেমে বলে—“তুমি প্রতিদিন একইরকম ভালো লাগো।”
এই কথাটা শুনে পল্লবীর বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে। না, গলা শুকিয়ে আসে না, হাত কাঁপে না, কেবল মনে হয়—এইটুকু শুনতেই তো এত দিন অপেক্ষা ছিল?
পল্লবী হাসে না, কিছু বলে না। শুধু একটা ছোট্ট পা-ঘোরানো নীরবতায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বলে,
“তুমি জানো, প্যাঁড়ার ওপর ছানা যত বেশি থাকে, আমার তত পছন্দ হয়? একদম নরম ছানা, যেটা আঙুলে লেগে যায়।”
রাজা বলে—“আমি জানতাম না, কিন্তু এখন থেকে খেয়াল রাখব।”
তারপর পল্লবী হেঁটে চলে যায়, রাস্তার আলো পেরিয়ে। তার হুডির ভিতরে শরীর গরম হয়ে আছে। কারো একটা দৃষ্টি যেন তার ঘাড় বরাবর লেপ্টে আছে। না, ভয় নয়—মিষ্টি আর অদ্ভুত একটা টান। যে ছুঁয়েছে, সে বুঝি কিছু ছোঁয়নি—তবু শরীর বলছে, কিছু একটা হয়েছে।
রাতের ঘরে চুপ করে বসে পল্লবী তার ডান হাতটা তাকিয়ে থাকে। ওই হাত দিয়েই সে আজ বাক্সটা নিয়েছে। ওই আঙুলের পাশে রাজার আঙুল ছুঁয়ে গিয়েছিল কি না, সে জানে না। কিন্তু ওই পাশটায় একটা ঘোর লেগে আছে। কেউ যেন আঙুলের নিচে কিছু লিখে রেখে গেছে।
পল্লবীর খাটের নিচে রাখা পুরনো ডায়েরি খুলে ফেলে। পেন নেয়, লিখে—
“তোমার আঙুলের পাশে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।”
পরের দিন সকাল।
আজ একটু কুয়াশা ছিল, শীত পড়েছে। মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। দোকানের কাছে পৌঁছে দেখে, রাজা দাঁড়িয়ে আছে কাচের দরজার পাশে। তার মুখে চা-রঙা হালকা হাসি, হাতে রাখা ট্রেতে দুটো প্যাঁড়া, একটাতে উপরে একটু ছানা বেশি।
পল্লবী কাছে গিয়ে বলে—“আজ একটু বেশি ছানা দিয়েছো, তাই না?”
রাজা হেসে বলে—“আজ একটু বেশি ভাবতে হয়েছিল তোমায়…”
পল্লবীর চোখে জল আসার মতো হয়। হাসি লুকিয়ে প্যাঁড়া নেয়। বাক্সটা নিতে গিয়ে আবার আঙুল ছোঁয়ে যায়—এবার আর ইচ্ছাকৃত নয়, তবু একটুখানি বেশিক্ষণ ধরে থাকে যেন। রাজার ঠোঁট নড়ে না, চোখও না, তবু আঙুলগুলো বলে—”আমার আঙুলের পাশে তুমি থাকো।”
ব্যাচে গিয়ে আজ কিছুতেই মন বসে না। অঙ্কের সূত্রগুলো সবকিছু গুলিয়ে যায়। মাথা নিচু করে বইয়ের পাতায় সে প্যাঁড়ার গন্ধ খোঁজে। কিছু না পেয়েও মনে হয়, রাজা বসে আছে তার পাশের বেঞ্চে।
বিকেলে ফেরার সময় রাস্তার ধারে হালকা হাওয়া। সে ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে ট্র্যামে বসে একটা লাইন লেখে—
“তোমার আঙুল ছুঁয়ে আমি আর ছুঁতে চাই না কিছু।”
শহর জানে না, দুইজন মানুষ কিভাবে একে অপরকে ছুঁয়ে যায় শুধু নীরবতায়। শুধু প্যাঁড়ার বাক্সে একফোঁটা ছানা গলে যায়, আর কোথাও একটা হৃদয় ঠান্ডা হয়ে আসে।
পর্ব ৩: চোখের নিচে লুকোনো কথা
পল্লবীর চোখের নিচে একটা কথা লুকিয়ে থাকে, প্রতিদিন। ওটা বললে সবকিছু বদলে যাবে—তাই সে চুপ করে থাকে।
সকালগুলো তার এখন নির্দিষ্ট একটা রুটিনে বাঁধা। উঠেই জানালার পাশে দাঁড়ায়, দেখতে পায় রাজা দোকানের শাটার তুলছে, তারপর একে একে প্যাঁড়ার ট্রে সাজাচ্ছে। সে জানে কোন ট্রেটা তার জন্য, কোনটায় ছানা একটু বেশি থাকবে, কোনটায় রাজার আঙুল ছুঁয়ে থাকবে গতকালের কথা।
পল্লবী নিজের ভেতরে একটা কথাকে রোজ চেপে রাখে—”তুমি আমায় ছুঁয়ে গেলে কি না জানি না, কিন্তু আমি কেন জানি ছুঁয়ে ফেলেছি তোমায়।”
সেদিন সকালটা একটু অন্যরকম ছিল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই সে দেখে, রাজা মাথা নিচু করে কিছু লিখছে একটা ছোট্ট ছেঁড়া কাগজে। তারপর সেটা এক প্যাঁড়ার কাগজের নিচে রেখে দেয়। তার চোখে পড়ে যায়, হঠাৎ করে।
সে এগিয়ে যায়, কিছু না বলে কাগজে মোড়া সেই প্যাঁড়াটা নেয়। রাজা তাকিয়ে থাকে, বলে না কিছু। শুধু একবার পল্লবীর আঙুলের গায়ে তার আঙুলটা একটু বেশি সময় রাখে। এবার আর কেউ তাড়ায় না, না শব্দ, না রোদ। শুধু দু’জন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে একটা প্যাঁড়ার মোড়া নিয়ে, যেন কাগজের ভাঁজে পৃথিবীর সমস্ত অপেক্ষা।
পল্লবী হাঁটতে হাঁটতে ডান হাতে প্যাঁড়ার মোড়া খুলে। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সেই কাগজ—খুব ছোট, টিফিনের পাতলা কাগজে লেখা একটা অক্ষরে ভরা লাইন:
“তোমার মুখের পাশে থাকা মৌনতা আমার সবচেয়ে প্রিয় শব্দ।”
সে থমকে দাঁড়ায়। পেছনে তাকায় না, কেউ ডাকে না। কিন্তু তার মুখের দুই পাশে কেমন যেন আলো জমে থাকে। প্যাঁড়া আজ খায় না, পকেটে রেখে দেয়। আজ শরীর চায় না কিছু, মন শুধু বলে—এই লাইনটা চিরকাল রেখে দে।
ব্যাচে সেদিন কিছু শোনে না। সে শুধু জানে তার চোখের নিচে কিছু একটা আছে, একটা কথা, যা কেউ পড়তে পারলে সে নিজেকে খুলে দেবে।
রাতের দিকে ডায়েরির ভেতরে সেই কাগজটা আটকে রাখে সে। নিচে নিজে লেখে—
“তুমি আমার মুখ না দেখে আমার চুপ করে থাকা পড়ো। এটাই ভালোবাসা।”
পরের দিন সকালে দোকানে গিয়ে বলে—
“তুমি কি রোজ লিখো?”
রাজা একটু হেসে বলে—“না, শুধু মাঝে মাঝে, যখন মনে হয় তুমি পড়বে…”
পল্লবী বলে না কিছু, শুধু প্যাঁড়া নিয়ে যায়। কিন্তু সে জানে, আজ যদি বাক্সটা খুলে, আরেকটা কাগজ থাকবে সেখানে।
বাড়ি ফিরে খোলে, এবং হ্যাঁ, এবারও কাগজে লেখা—
“তোমার চোখের নিচে একটা কথা পড়ে থাকতে দেখি, আমি রোজ সেটা কুড়িয়ে নিই।”
পল্লবীর মনে হয়, কেউ যদি তার চোখে তাকিয়ে এমন কথা পড়ে ফেলতে পারে, তবে তাকে ভালো না বেসে উপায় নেই।
তবে এখনও তারা কেউ কাউকে বলেনি “ভালোবাসি”। এখনও তারা কারো নাম মুখে আনে না। তবু শহরের দু’জন মানুষ জানে, কথার আগে যারা চোখে চোখ রাখে, তারাই সবচেয়ে বেশি সত্যি।
এভাবেই চোখের নিচে জমে থাকা কথারা প্রতিদিন একটু করে বেরিয়ে আসে… মিষ্টির মোড়কে, স্পর্শের হাওয়ায়, আর নরম না বলা অনুভবে।
পর্ব ৪: জলেভেজা কপালের গল্প
সকালের আকাশটা আজ ধূসর। মেঘ জমে আছে, বাতাস ভারী। পল্লবী জানে, আজ হয়তো বৃষ্টি নামবে। তবে মেঘের থেকেও বেশি ভার তার বুকের ভেতরে। কারণ আজ তিনদিন হলো রাজা কিছু লেখেনি।
প্যাঁড়ার কাগজের নিচে থাকে শুধু নীরবতা। কোনো লাইন নেই, কোনো ছেঁড়া পাতার অভিসার নেই।
তবু পল্লবী যায়।
প্রতিদিনের মতো—চুপচাপ।
আজ সে খেয়াল করে, রাজা চোখের নিচে ক্লান্ত। পল্লবী বলে, “তুমি ঠিক আছো?”
রাজা হেসে বলে, “ঠিকই তো। একটু কম ঘুম হয় এই ক’দিন।”
পল্লবী কিছু বলে না। প্যাঁড়া নেয়। কোনো ছোঁয়া চায় না আজ। কিন্তু ঠিক তখনই মেঘ ফেটে বৃষ্টি নামে, হঠাৎ করে।
দোকানের সামনে দু’জনে দাঁড়িয়ে, কাগজে মোড়া মিষ্টি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। রাজা দ্রুত ছাউনি টেনে দেয় দোকানের, আর পল্লবীকে ভেতরে ডাকায়—“ভিজবে না, এসো ভিতরে।”
এতদিনে এই প্রথমবার সে দোকানের ভিতরে যায়।
আসলে মিষ্টির ঘ্রাণে রাজা নিজে মিশে আছে। কাঠের তাক, কাঁচের শোকেস, আর হালকা রঙ করা দেয়ালে রাজার নিঃশ্বাস জমে আছে।
পল্লবী দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশেই। মুখ ভেজা, কপাল থেকে জল টপকে গালে গড়িয়ে পড়ে।
রাজা একটা শুকনো কাপড় এগিয়ে দেয়। বলে, “মাথায় ঠান্ডা লাগবে।”
পল্লবী নেয় না। কেবল বলে, “আমার কপালের জল দেখে তুমি কী ভাবো?”
রাজা একটু চমকে যায়। তারপর ধীরে বলে,
“তোমার কপালের জল… তোমার না বলা কথার মতো। ওগুলো আমি পড়তে পারি না, কিন্তু বুঝি, গায়ে পড়লে তুমি কি ভাবো।”
পল্লবীর গায়ে হালকা কাঁপুনি আসে। হয়তো বৃষ্টির ঠান্ডা, হয়তো কথার তাপ।
রাজা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে একটা হাত তোলে—পল্লবীর দিকে না, বরং তার কপালের ঠিক পাশের জলের ফোঁটার দিকে। বলেই ফেলে,
“এইটুকু জায়গা… এখানে জল পড়লে আমার দৃষ্টি আটকে যায়।”
পল্লবী এবার মুখ ঘোরায়। চোখের কোণে জমে থাকা জল কারো চোখে পড়ে গেলে যেভাবে লজ্জা লাগে, সেভাবে সে বলে,
“তুমি কি সত্যি জানো, আমি আসি শুধু প্যাঁড়ার জন্য না?”
রাজা বলে,
“আমি জানি। তুমি আসো, কারণ কেউ তোমার চোখের নিচে লেখা কথাগুলো পড়ে। আর আমি তো প্রতিদিন প্যাঁড়ার নিচে কাগজ রাখি না, কারণ তুমি নিজেই তো এখন একটা কাগজ।”
বৃষ্টির শব্দ বাড়ে। বাইরে ভিজে যাচ্ছে শহর। কিন্তু ভিতরে একটা স্পর্শহীন তাপ জমে থাকে।
পল্লবী এবার ধীরে বলে,
“আমার কপালের জল তুমি মুছে দিলে কি আমি তোমার হয়ে যাই?”
রাজা চুপ করে। তারপর নিচু গলায় বলে,
“আমি তো চাই না তোমায় মুছে ফেলতে… আমি চাই তুমি ওইরকমই থাকো—ভেজা, নরম, একটু দূরে।”
এই কথায় পল্লবী চোখ বন্ধ করে।
প্রথমবার কেউ তাকে এমন করে কিছু বলেনি, যেন ছুঁয়েও ছোঁয়নি, ভালোবেসেও দাবি করেনি।
বৃষ্টি কমে আসে।
পল্লবী দরজার বাইরে পা রাখে। এবার আর কোনো বাক্স নেয় না, কোনো প্যাঁড়া না, কেবল একটা পকেটভরা জল নিয়ে ফিরে যায়।
তার ডায়েরির পাতায় সেদিন রাতে সে লেখে—
“তুমি আমার জলেভেজা কপালের গল্প। যেটা আমি কাউকে বলি না, শুধু বৃষ্টি হলে মনে পড়ে।”
পর্ব ৫: নরম হাসির ভেতর আমি
পল্লবী এখন রাজার মুখের দিকটা আলাদা করে চেনে না—সে শুধু জানে, রাজা হাসলে একটা নিঃশব্দ ঢেউ ওঠে তার বুকের মধ্যে। কেমন যেন ঝিলের মতো কাঁপে, দুলে ওঠে, আবার থেমেও যায়। সেই হাসির শব্দ নেই, কোনো চওড়া দাঁতের প্রদর্শন নেই, কেবল ঠোঁটের কোণে এক নরম ভাঁজ, যেটা কেউ ছুঁতে চায় না—দেখেই চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
সকালের হাওয়া এখন একটু শীতল। নভেম্বরের হাওয়া, পল্লবীর হাতে ধরা শাল, কিন্তু মনের ভিতর গরম কিছু কাজ করে। আজ সে খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে। মা অবাক হয়ে বলে, “এত সকাল সকাল? পরীক্ষা তো দূরে!”
সে হেসে বলে, “আজ নরম হাসির দিন।”
দোকানের সামনে পৌঁছে দেখে রাজা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আজ একটু অন্যরকম লাগছে তাকে। হয়তো নতুন জামা পরেছে, বা হয়তো চোখে ঘুম নেই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলাদা হচ্ছে তার মুখের হাসিটা। আজ একটু বেশি নরম, একটু বেশি সত্যি।
রাজা প্রথমে কিছু বলে না, শুধু একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। প্যাঁড়ার মোড়কে নয়, একেবারে হাতে।
সাদা কাগজে শুধু একটা লাইন:
“তুমি যখন হাসো না, তখন আমার দিনটা কাঁপে।”
পল্লবী এবার একটু থমকে যায়। সে কাগজটা পকেটে ভরে ফেলে, কিছু না বলে। কিন্তু তার চোখের কোণ চকচক করে ওঠে, এমনভাবে, যেন ওই এক লাইনে কেউ তার ভিতরটা খুঁড়ে পড়ে ফেলেছে।
রাজা এবার হাল্কা হাসে। বলে, “আজ একটু ভালো লাগছিল, তাই কাগজে না রেখে মুখেই বললাম।”
পল্লবী অবাক হয়ে বলে, “তোমার মুখ তো আর কাগজ না, রাজা!”
রাজা উত্তর দেয়, “তোমার সামনে আমার মুখটাই নরম কাগজ হয়ে যায়।”
এমন কথা কেউ কখনও বলেনি পল্লবীকে।
সে একটানা তাকিয়ে থাকে রাজার মুখের দিকে, সেই হাসির বাঁকে। মনে হয়, এই হাসিটার ভিতরেই সে লুকিয়ে যেতে পারে।
আজ সে প্যাঁড়া নেয় না। শুধু বলে, “আজ কি তোমার ওই নরম হাসির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?”
রাজা কিছু বলে না। শুধু মাথা নাড়ে।
পল্লবী জানে, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে প্রেম নেই—কিন্তু তার থেকেও কিছু বেশি আছে। প্রেম তো বললেই হয় না, প্রেম তো ছোঁয়ার আগের প্রস্তুতির মতো—যেখানে শরীর দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু এগোয় না। যেখানে চোখ চায়, কিন্তু দাবি করে না। যেখানে হাসি নেমে আসে, কিন্তু শব্দে ফোটে না।
সেদিন বিকেলে পল্লবী তার পুরনো একটা ছবি খোঁজে। ক্লাস সেভেনের, মেলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। সেই ছবির মুখে হাসি নেই। সে ছবি ছিঁড়ে ফেলে।
রাতের ডায়েরিতে সে লেখে—
“তুমি আমার মুখে একটা হাসি রাখো, যেটা আমি কখনও আয়নায় দেখিনি। যদি এই হাসিটা চিরকাল আমার হয়, তবে আমিও হয়তো তোমার হয়ে যাই একদিন।”
পরদিন সকালে রাজাকে দেখে সে বলে,
“আমি আজকাল আয়নায় আমার মুখ খুঁজি, কারণ তোমার জন্য সেটার রং বদলেছে।”
রাজা উত্তর দেয় না, শুধু সেই একই নরম হাসিটা আবার ফুটে ওঠে।
তারা কেউ কাউকে ছোঁয় না, কেউ প্রেমে পড়েছি বলেনি, তবু প্রতিদিন পল্লবী রাজার হাসির পাশে একটু একটু করে নিজেকে চিনে নেয়।
পর্ব ৬: স্পর্শহীন অভ্যর্থনা
দুজন মানুষ প্রতিদিন দেখা করে, কথা বলে, একে অপরকে খুঁজে নেয়। অথচ কেউ কাউকে ছোঁয় না।
এই গল্পে প্রেম আছে, কিন্তু শরীর এখনো দাঁড়িয়ে আছে নিজের সীমানার ঠিক ধারে।
এটাকে কেউ বলে না ‘ভালোবাসা’, এটাকে বলা যায়—স্পর্শহীন অভ্যর্থনা।
সকালে আজ পল্লবী একটু দেরি করে পৌঁছায়। মনে হচ্ছিল, রাজা হয়তো থাকবে না। দোকান বন্ধ দেখলে একরকম হাল্কা দুঃখ জেগে উঠেছিল বুকের নিচে।
কিন্তু না—শাটার অর্ধেক খোলা, রাজা বসে আছে কৌটো গোছাচ্ছে। তাকিয়ে দেখে, পল্লবী এসেছে।
কিন্তু আজ সে কিছু বলে না। শুধু এক কাপ চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়।
পল্লবী চমকে যায়। প্রথমবার রাজা তার জন্য চা এনেছে।
সে কাপটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে। দোকানের বাঁদিকে একটা ছোট কাঠের বেঞ্চ, রাজা কখনই কাউকে বসতে দেয় না, কিন্তু আজ সে নিজেই মাথা ঘুরিয়ে বলল—“এখানে বসো।”
কাপটা ঠোঁটে তুলতেই পল্লবীর শরীরের ভিতর দিয়ে একটা তরঙ্গ বয়ে যায়। গরম নয়, কিন্তু আরামদায়ক। যেন কোনোদিন না-ছোঁয়া কিছু গায়ে এসে আলতোভাবে লেগেছে।
রাজা তাকিয়ে থাকে। চোখে কোনও কথা নেই, কিন্তু একটা ইশারা আছে—যেখানে কেউ কাউকে বলছে, “তুমি চুপ করে থেকো, আমি বুঝে নেবো।”
হাওয়াটা আজ একটু বেশি ঠান্ডা। জানলার পাশের গাছের ডাল ভিজে আছে গতরাতের শিশিরে। পল্লবীর মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তটা যেন ঠোঁটে জমে থাকে চিরকাল।
তারা বসে থাকে পাশাপাশি। রাজা মাঝে মাঝে দোকানের দিকে তাকায়, মাঝে মাঝে তার দিকে। পল্লবী চোখ নামিয়ে রাখে, কিন্তু সে টের পায়, রাজার শরীর তার পাশে উপস্থিত—ভীষণভাবে। অথচ কেউ একবারও কোনো শরীরী বাক্য উচ্চারণ করে না।
এই তো অভ্যর্থনা—যেখানে কেউ কাউকে ছোঁয় না, অথচ কেউ কারো ভিতরে ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে।
পল্লবী হঠাৎ করে বলে ফেলে—
“তুমি কি কখনও আমায় ছুঁতে চাওনি?”
রাজা চমকে তাকায়, তারপর ধীরে বলে—
“তুমি প্রতিদিন এত কাছে আসো, যে ছোঁয়ার দরকার পড়ে না।”
পল্লবী হেসে ফেলে। বলে, “তুমি দারুণ কথা বলো।”
রাজা চোখ নিচু করে বলে, “তুমি যখন চুপ করে থাকো, আমার ভাষা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়।”
এই কথার ভিতরেই একটা নরম, গা-ঘেঁষা বাতাস বইছিল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা নেই—আছে একটা গভীর সম্মান। এমন স্পর্শ যা গায়ের নয়, মনের।
চা শেষ করে পল্লবী উঠে পড়ে। রাজা একটা কাগজ এগিয়ে দেয় আবার—ছোট্ট, বাক্স ছাড়া।
তাতে লেখা—
“তোমায় ছুঁতে না পেরেও আমি প্রতিদিন ছুঁয়ে ফেলি—তোমার অভ্যর্থনায়।”
পল্লবীর চোখ ভিজে আসে। সে মাথা নিচু করে চলে যায়, কোনো শব্দ না করে।
রাতে ডায়েরিতে লেখে—
“তুমি আমার ভেতরের নীরবতা ছুঁয়ে যাও। তোমার অভ্যর্থনায় আমি প্রতিদিন ঢুকে পড়ি, আর নিজেকে নতুন করে চিনে নিই।”
পর্ব ৭: যতবার পাশ কাটিয়ে গেলে
কিছু ভালোবাসা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হয় না। তারা বরং পাশাপাশি হাঁটে—দুজন দুজনকে ছুঁয়ে না গিয়ে পাশ কেটে যায়, বারবার। অথচ প্রতিবারই শরীরের ভেতরে কিছু লেগে থাকে।
ঠিক যেমন পল্লবী অনুভব করে রোজ, রাজা যখন তাকে অতিক্রম করে যায়—সামান্য দূরত্ব রেখে, নিঃশব্দে।
এই পাশ কাটানোটা হয়তো তাদের ভাষা। এইটুকু দূরত্বই হয়তো তাদের প্রেম।
সকালগুলো এখন যেন নির্দিষ্ট ছন্দে বাঁধা। কেউ কিছু বলে না, তবু প্রতিটি নড়াচড়ার মধ্যে একটা অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে—যেন তার প্রতিটি পা, প্রতিটি শ্বাস জানে কোন মুহূর্তে রাজাকে দেখতে পাবে।
সেদিন সকালে দোকানে পল্লবী পৌঁছায় একটু তাড়াতাড়ি। দোকান এখনও খোলেনি। সে জানে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজা চলে আসবে—স্টিলের ঝাঁপ টেনে ওপরে তুলবে, তারপর প্যাঁড়ার ট্রে সাজাবে।
কিন্তু সেদিন অন্যরকম। রাজা আসার সময় পল্লবী তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে কিছু বলে না, তাকায়ও না। শুধু ধীর পায়ে পাশ কাটিয়ে যায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা অদ্ভুত ঢেউ ওঠে পল্লবীর ভিতরে—কেউ তাকে ছোঁয়নি, তবু তার গায়ের চারদিকে যেন জোয়ার লেগে গেছে।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে চায়, রাজা হাঁটছে, দোকানের দিকে যাচ্ছে, মাথা নিচু, চোখ তার নিজের পায়ের দিকে।
এই পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা আজ হঠাৎ নতুন লাগে। যেন শরীরের প্রতিটি কোষ তাকিয়ে থাকে রাজার দিকেই—সে কি ফিরে তাকাবে? সে কি জানে, তার পাশ দিয়ে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে পল্লবীর বুক থেমে থাকে?
দোকান খোলে। রাজা দাঁড়িয়ে থাকে নিজের মতো। আজ সে কোনো কাগজ দেয় না, কোনো কথা বলে না।
পল্লবীও চুপচাপ প্যাঁড়া নেয়। একবার চোখ তোলে—রাজার চোখে আজ কোনো হাসি নেই, শুধু অপেক্ষা।
পল্লবী হেঁটে চলে যায়। আবার পাশ কাটায়। কিন্তু এবার সে থেমে যায় ঠিক দশ কদম পরে। বুকের ভেতর থেকে একটা কথা নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে—
“তুমি জানো, যতবার পাশ কাটিয়ে যাও, আমার শরীর তখন তোমায় ছুঁয়ে ফেলে… মনে মনে।”
রাজা কিছু বলে না। কিন্তু সে এসে পাশে দাঁড়ায়, একেবারে কাছে নয়, কেবল এমন দূরত্বে যেখানে নি:শ্বাস মিশে যায়।
পল্লবী বলে, “তুমি কি ইচ্ছে করে এমন পাশ কাটিয়ে যাও?”
রাজা ধীরে মাথা নাড়ে। “না… ইচ্ছে করে না। কিন্তু ভয় হয়। হয়তো ছুঁয়ে ফেললে তুমি দূরে সরে যাবে। এখন যতটা পাশে আছো, তাও থাকবে না।”
এই ভয়টা হয়তো প্রেমের প্রথম ভাষা। সেই ভাষা যেখানে কেউ প্রেম স্বীকার করে না, তবু প্রতিটি হাওয়া প্রেমে ভিজে থাকে।
সেদিন রাতে পল্লবী নিজের শরীরটাকে দেখছিল আয়নায়। শুধু নিজের জন্য নয়, রাজার দৃষ্টিতে সে কেমন হয়ে উঠেছে—তা দেখার চেষ্টা করছিল। নিজের কাঁধ, কপাল, আঙুল—সবকিছু যেন তার নয়, বরং কারো উপহার।
সে ডায়েরিতে লেখে—
“তুমি পাশ কাটাও, আর আমি তোমার ছায়া হয়ে যাই। কেউ কাউকে ছুঁই না, তবু এই দূরত্বের মাঝেই প্রতিদিন প্রেমে পড়ি।”
পর্ব ৮: ছুঁয়ে না ছুঁয়ে থেকো
সেই সকালটা ছিল একধরনের শেষ সকাল। না, কেউ কিছু বলেনি, তবু পল্লবীর মনে হচ্ছিল—আজ হয়তো কিছু বদলে যাবে। অথবা আজ হয়তো কিছুই আর বলার মতো থাকবে না।
শীতের কুয়াশা নেমে এসেছে পুরো শহরের গায়ে। পল্লবী ধীরে হাঁটে, চুপ করে। তার মনে হয়, আজ যদি রাজা প্যাঁড়া না দেয়, আজ যদি কোনো কাগজ না থাকে, তাও সে যাবে। শুধু তাকিয়ে থাকবে। কারণ কিছু মানুষকে স্পর্শ না করেও ভালোবেসে ফেলা যায়।
দোকানের সামনে পৌঁছে দেখে, রাজা দাঁড়িয়ে আছে গা ঢেকে রাখা হালকা কম্বল গায়ে, চোখে ক্লান্তি। কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
আজ সে কোনো প্যাঁড়া এগিয়ে দেয় না। শুধু বলে, “আজ তোমার জন্য কিছু নেই। কিন্তু চাইলে একটা কথা দিতে পারি।”
পল্লবী অবাক হয়। চুপ করে থাকে। তারপর ফিসফিস করে বলে, “কি কথা?”
রাজা বলে—
“তুমি যদি আমায় কখনও না ছোঁয়, আমি তবুও প্রতিদিন তোমার পাশে থাকব।”
এই বাক্যটা পল্লবীকে স্তব্ধ করে দেয়।
সে ভাবে—মানুষ তো প্রেমে পড়ে, চায় একে অপরকে ছুঁতে, রাখতে, স্পর্শ করতে। কিন্তু কেউ যদি বলে, “ছুঁয়ে না ছুঁয়েও থেকো”— তবে তা হয়ত প্রেমের চূড়ান্ত রূপ।
পল্লবীর চোখ ভিজে আসে। সে বলে, “তুমি কি জানো, আমি কতবার চাইছি তোমাকে ছুঁতে?”
রাজা মৃদু হেসে বলে, “জানি। ঠিক যেমন আমি চেয়েছি। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছে—তোমাকে ছুঁয়ে দিলে হয়তো সেই কোমলতাটুকু ভেঙে যাবে।”
তারা দুজন পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, একে অপরের অদৃশ্য শরীর ঘেঁষে।
রাজা আস্তে করে বলে,
“তুমি আমার সমস্ত ইচ্ছে, কিন্তু আমি শুধু তোমার অস্তিত্বে থেকেছি। যেন এক কাঁপা বাতাস, যেটা জানালার পর্দা নাড়ায়, কিন্তু জানালায় ঢোকে না।”
পল্লবী আজ আর হাসে না। সে শুধু বলে,
“তুমি কি চাও না, একদিন আমি তোমার আঙুল ছুঁয়ে বলি—এই আমি, তোমার?”
রাজা উত্তর দেয় না, কেবল তার হাতদুটো পকেটেই রাখে।
তবে সেই মুহূর্তেই, একটা নিঃশব্দ আলো জ্বলে ওঠে তাদের মাঝখানে।
পল্লবী বলে,
“তাহলে থেকো, ছুঁয়ে না ছুঁয়েই। হয়তো সেটাই আমাদের প্রেমের সবচেয়ে নিরাপদ রূপ।”
রাজা মাথা নাড়ে। এবার তার চোখে জল।
সে বলে,
“তুমি আমার প্রথম স্পর্শ, যেটা আমি কোনোদিন ছুঁইনি। শুধু বুকের মধ্যে রেখেছি—নরম আর চিরকালীন।”
পল্লবী হেঁটে চলে যায়। পেছনে তাকায় না।
তবে সে জানে, কেউ তাকিয়ে আছে। কেউ তার ছায়াকে ছুঁয়ে বলছে—“তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা এখন আমার চিরকাল।”
রাতে ডায়েরির শেষ পাতায় পল্লবী লেখে—
“আমরা একে অপরকে ছুঁইনি, কিন্তু প্রতিটি প্রহরে আমরা ছিলাম শরীরের সবটুকু পাশে। এই না-ছোঁয়ার প্রেমই আমার সবচেয়ে বেশি ছোঁয়া।”
সমাপ্ত