Bangla - সামাজিক গল্প

তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই

Spread the love

অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী


মফস্বলের স্টেশনের নামটা যতই নিস্প্রভ হোক, বিকেলের শেষ আলোয় যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে মেয়েটার, তখন যেন চারপাশের সব শব্দ থেমে যায়। নাম তার অরিত্র। পুজোর পর শহরের বাইরে প্রথমবার এসে দাঁড়িয়েছে চাঁদপুর স্টেশনে। একটা চাকরির সাক্ষাৎকার, একটা নতুন জীবনের আশ্বাস। আর তাতেই যাত্রীদের হঠাৎ ভিড় ঠেলে আলতা-লাল সালোয়ারে একটা মেয়ে চলে এলো ঠিক তার সামনে। মেয়েটার নাম—মালবিকা।

“এই যে, আপনি কি হোস্টেলটা খুঁজছেন?”
প্রথম কথা।
অরিত্র একটু হকচকিয়ে গিয়ে হ্যাঁ বলল।
“চলুন, আমিও সেদিকেই যাচ্ছি।”

এইভাবেই শুরু। হেঁটে যেতে যেতে ওরা অনেক কথা বলল—ছোটখাটো। অরিত্র জানাল, সে কলকাতা থেকে এসেছে, সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। মালবিকা হাসল, “আমার তো ইঞ্জিনিয়ারিং ভালো লাগে না একটুও। আমি ফিল্মস্টাডিজে পড়ছি।”
“তুমি সিনেমা বানাতে চাও?”
“না, শুধু সিনেমায় হারিয়ে যেতে চাই।”

মেয়েটার চোখে একরকম অন্ধকার ছিল। নরম আলোয় ঢাকা বিষণ্ণতা। হোস্টেলের সামনে এসে মালবিকা বলল, “এই তো, পৌঁছে গেলেন। আজ অনেক কথাই বলা হলো। ভালোলাগলো আপনার সঙ্গে। কাল আপনার ইন্টারভিউ, না?”
অরিত্র মাথা নেড়ে বলল, “তুমি থাকবে না?”
মালবিকা হেসে বলল, “থাকব না মানে? আমি তো এখানেই থাকি। দেখা হবে। সময় হলে সব বলব।”

পরদিন ইন্টারভিউয়ের দিন মালবিকা এল না। অরিত্রের চোখ খুঁজে ফিরল মেয়েটাকে, কিন্তু সে গায়েব। অফিসটা তাকে পছন্দ করেছে, বলেছে এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতে হবে। অরিত্র এই শহরেই থেকে গেল—আলগা অচেনা ভালোবাসার এক অদ্ভুত টানে।

সপ্তাহ কেটে গেল। অরিত্র প্রতিদিন সন্ধেয় সেই রাস্তায় দাঁড়ায় যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল মালবিকার সঙ্গে। তবু কোথাও দেখা নেই। একদিন হঠাৎ করেই তাকে ডাকল কেউ—“এই যে! এত খুঁজে চলেছেন কেন?”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে—মালবিকা।
সে হেসে বলল, “তোমাকে খুঁজছিলাম। অনেকদিন দেখা নেই।”

মালবিকা বলল, “চলো, আজ তোমায় আমার একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
রিকশায় উঠল ওরা। শহরের এক প্রান্তে পুরনো এক সিনেমা হল—‘রূপসী’। ফাঁকা, ধুলোয় ঢাকা, কিন্তু একটা কক্ষে প্রোজেক্টর চলছে।
“এই হলে আমার দাদু সিনেমা চালাতেন,” মালবিকা বলল।
“তুমি এখানে আসো?”
“আসি। যখন ভীষণ কষ্ট হয়, তখন পুরনো ফিল্ম রিল চালিয়ে বসে থাকি। আর ভাবি, মানুষগুলো যদি বাঁচত, তাহলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতো।”

অরিত্র বলল, “তোমার পরিবার?”
মালবিকা চোখ নামিয়ে বলল, “নেই কেউ। মা মারা গেছেন। বাবা…” সে থেমে গেল।

সেই সন্ধে থেকেই শুরু হল মালবিকা আর অরিত্রর বন্ধুত্ব। কিছুদিন পর তা আরও গভীর হল। অরিত্র অফিস শেষে এসে মালবিকার সঙ্গে সিনেমা দেখে, ছাদে বসে বাতাস খায়, হাতে ছুঁয়ে রাখে উষ্ণতা।
একদিন মালবিকা হঠাৎ বলল, “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?”
অরিত্র থমকে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
মালবিকা হেসে বলল, “তাহলে একটা কাজ করে দেবে আমার জন্য?”
“যেকোনো কিছু,” অরিত্র বলল।

মালবিকা বলল, “আমার বাবাকে খুঁজে বের করো। আর তাকে মারো।”
এই কথার পর চারপাশটা নিঃশব্দ। যেন হঠাৎ সিনেমা বন্ধ হয়ে গেছে। অরিত্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মালবিকা তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমার বাবার নাম অশোক সেন। সে এই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। কিন্তু সে একপলকেই আমার মাকে ত্যাগ করে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে বিয়ে করে ফেলেছিল। আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে আত্মহত্যায়। আমি দেখেছি—নিজের চোখে।”
অরিত্র স্তব্ধ। এই গল্প সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি।
“তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, তাহলে প্রতিশোধটা তোমার হাতেই নেব,” মালবিকা ফিসফিস করে বলল।

সেই রাতেই অরিত্রের ঘুম ভাঙে এক ভয়ানক ঘোরে। সে জানে, তার সামনে এখন দুটি পথ—একটা ভালোবাসা, আর একটা প্রতিশোধ। কিন্তু কখনো কখনো, দুটি পথই এক হয়।

***

ঘুম ভাঙতেই অরিত্র বুঝল, তার বুকের ভেতরটা পাথরের মতো ভারি হয়ে আছে। জানলার বাইরে পূর্ণিমার আলো ছড়ানো, একটা কুকুর দূরে কোথাও ডেকে উঠল। কিন্তু অরিত্রর মাথার ভেতর কেবল একটা নাম—অশোক সেন। একটা মুখ—মালবিকা। আর একটা প্রশ্ন—ভালোবাসা কি প্রতিশোধের রঙে রাঙানো যায়?

সে উঠে পড়ল, পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ছাদে এল। হঠাৎ ছাদ থেকে দেখা গেল, নিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে মালবিকা। চুলগুলো খোলা, ঠোঁটে সেই চেনা অদ্ভুত হাসি।
“এই রাতে এখানে?”
মালবিকা কেবল বলল, “ঘুমোতে পারছিলাম না। ভাবলাম তোমার চোখে চোখ রাখলে আবার বিশ্বাস করতে পারব, তুমি সত্যিই আমার পাশে আছো।”

পরদিন অফিসের পথে অরিত্র প্রথমবারের মতো ‘অশোক সেন’ নামটা ইন্টারনেটে সার্চ করল। একগাদা সংবাদ, পুরস্কারের ছবি, টিভি সাক্ষাৎকার, আর একঝাঁক রাজনৈতিক বন্ধুত্ব। কিন্তু একটাও জায়গায় তার ব্যক্তিগত জীবনের স্পষ্ট তথ্য নেই।
“শুয়োরটা নিজের অতীত লুকিয়ে রেখেছে,” অরিত্র গজগজ করল।

পরের কয়েকদিন অরিত্র সন্ধে হলেই রূপসী হলে যেত। মালবিকা যেন ধীরে ধীরে নিজেকে খুলে দিতে শুরু করল। বলল, “জানো, মা যখন মারা গেল, আমি তখন ক্লাস নাইন। চারপাশের সবাই বলেছিল—‘তোমার মায়ের চরিত্র ভালো ছিল না।’ আমার বাবা তার নতুন বউকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতে গেছিল, আর আমি পাড়া-প্রতিবেশীর কুৎসিত চাহনির নিচে বড় হয়েছি। আমি শিখে গেছি—ভালোবাসা ভীষণ বিপজ্জনক জিনিস, যদি তা বিনিময় না পায়।”

অরিত্র বুঝে গেল, এই মেয়ে শুধু প্রতিশোধ নিতে চায় না, সে সত্যিই শেষবার কাউকে বিশ্বাস করতে চায়।
এক সন্ধেয় মালবিকা তাকে একটি পুরনো ডায়েরি দিল।
“মা লিখত,” বলল সে, “এতে বাবার সব চালাকি, চাপাবাজি, আর শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ আছে। যদি এগুলোকে কাজে লাগাতে পারো…”

অরিত্র রাতভর ডায়েরিটা পড়ল। পাতার পর পাতা ভয়ঙ্কর সত্যি। মালবিকার মা সুস্মিতা সেন ছিলেন স্থানীয় এক নাটকের দলনেত্রী। অশোক তখন নতুন ব্যবসায়ী। তাদের প্রেম, পরে গোপন বিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে অশোকের বেপরোয়া মদ্যপান, অপমান, হাত তোলা—সবই লিখে রেখেছেন সুস্মিতা।
শেষ পাতায় লেখা ছিল—
“আজ রাতেই যদি আমি কিছু করি, তা শুধু আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমার মেয়ে যেন সত্যি জানতে পারে তার মা কাকে ভালোবেসেছিল।”

এই ডায়েরি একটা আগুন। অরিত্র জানে, এখন সে চাইলে অশোক সেনের নামে FIR করাতে পারে, মিডিয়াতে ফাঁস করতে পারে। কিন্তু তাতে কি মালবিকার কষ্ট ঘুচবে?

দুদিন পর, অরিত্র সাহস করে অশোক সেনের অফিসে ফোন করল—“আমি একজন রিপোর্টার, আপনার পুরনো অতীত নিয়ে কিছু তথ্য আছে আমার কাছে। সাক্ষাৎ করতে চাই।”
ওপাশে একটু থেমে উত্তর এল, “কাল বিকেল পাঁচটায় আসুন।”

মালবিকাকে কিছু না জানিয়েই পরদিন বিকেল পাঁচটায় অরিত্র পৌঁছোল অশোক সেনের বাগানবাড়িতে। দোতলার বারান্দা থেকে সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন লোক তাকে অভ্যর্থনা করল।
“আপনি?”
“অরিত্র চৌধুরী। আমি আসলে আপনার… অতীতকে নিয়ে একটু জানতে চাই।”

অশোক সেন থেমে গেল। তারপর বলল, “অতীত বড় ভয়ানক জিনিস, মিস্টার চৌধুরী। তা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মাঝে মাঝে নিজের হাতই পুড়ে যায়।”
অরিত্র সরাসরি ডায়েরিটার ফটোকপি এগিয়ে দিল।
অশোক তাকিয়ে চুপ করে থাকল। তার চোখের পাতা কাঁপল, কিন্তু মুখ শক্ত।
“এই ডায়েরির মেয়ে কোথায়?”
“আপনারই মেয়ে, মালবিকা। সে আজও রোজ আপনার নাম শুনে রাতে ঘুমোতে পারে না।”

অশোক হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি কি জানো, আমি তাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম? তার স্কুলে গিয়েছিলাম। সে আমাকে চিনে উঠেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তখনই বুঝলাম, সে আর আমার নয়।”

অরিত্র বলল, “তবুও আপনি তো চেষ্টা করতে পারতেন—একটা চিঠি, একটা ফোন…”
অশোক বলল, “তোমরা যা খুশি করো। আমার হাত পরিষ্কার। আমার আইনজীবী সবকিছু সামলে নেবে।”
তারপর গলা নামিয়ে বলল, “তবে ছেলেটা, একটা কথা মনে রেখো—যারা প্রতিশোধের পথে হাঁটে, তারা নিজের ভালোবাসাকেও হারায়।”

সেই রাতে অরিত্র বাড়ি ফিরে দেখল মালবিকা রূপসী হলে বসে আছে একা, একগাদা সিনেমা রিলের মাঝে।
সে বলল, “তোমার বাবাকে আজ দেখা করলাম।”
মালবিকা চমকে উঠল, “তুমি আমাকে না জানিয়েই?”
“হ্যাঁ। কারণ আমি চাই তুমি নিজের চোখে সত্যিটা দেখো। চাই না তুমি কাউকে মারার জন্য বাঁচো। বরং নিজের জন্য বাঁচো।”

মালবিকার চোখে অশ্রু। সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন ভাবতাম—একদিন কেউ আমার হয়ে এই যুদ্ধটা লড়বে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমি নিজেই লড়তে পারি… যদি তুমি আমার পাশে থাকো।”
অরিত্র বলল, “আমি আছি, সবসময়। কিন্তু এখন যুদ্ধটা রক্ত দিয়ে নয়, সত্য দিয়ে লড়া উচিত।”

তখনও কেউ জানত না, এই রাতেই কিছু একটা বদলে যাবে। কারণ প্রতিশোধ থেমে থাকলেও, পুরনো আগুন কখনো নিভে না।

***

চাঁদপুর শহরের ভোরগুলো নিঃশব্দ। কিন্তু সেই ভোরটায় যখন মালবিকা রূপসী সিনেমা হলের ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছিল, তার বুকের ভিতরে যেন একটাই শব্দ—ধ্বংস।
পেছনে পায়ের আওয়াজে ঘুরে তাকিয়ে দেখে অরিত্র। হাতে কাগজের দুটো কাপ, ধোঁয়া ওঠা কফি।

“তুমি তো বলেছিলে, যুদ্ধ শেষ। তাহলে চোখে জল কেন?”
মালবিকা চুপ করে কফির কাপটা নিল। তারপর আস্তে বলল, “যুদ্ধ তো বাইরে না, অরিত্র। যুদ্ধ আমার ভেতরে।”

অরিত্র জানে, গত রাতের পর মালবিকা ভেঙে পড়েনি, বরং আরও শক্ত হয়েছে। কিন্তু কিছু যুদ্ধ এমন, যেগুলো জেতা মানেই ভেতরটা শূন্য হয়ে যাওয়া।
সে বলল, “তুমি চাইলে আমরা এখান থেকে চলে যেতে পারি। নতুন একটা শহরে, নতুন জীবন শুরু করতে পারি।”
মালবিকা মাথা নাড়ল, “না। আমি পালাতে চাই না। আমি চাই, আমার গল্পটা অন্য মেয়েরাও জানুক। যেন কেউ আর চুপ না থাকে, যেন কেউ আর মরে না, ভালোবেসে।”

সেই দিন থেকে মালবিকা নিজের ডায়েরির কিছু অংশ টাইপ করতে শুরু করল। অরিত্র সাহায্য করল। ফেসবুকে একটা পেজ খুলল—“সুস্মিতার গল্প”।
প্রথম পোস্টেই লেখা ছিল—
“একজন নারী নিজের ভালোবাসা দিয়ে ভাঙে, গড়ে। কিন্তু যদি তার সেই ভালোবাসার মানুষ তাকে ভেঙে দেয়, সে কীভাবে বাঁচে? এই পেজ তার গল্প বলে, আর আমাদের লড়াই।”

সপ্তাহখানেকের মধ্যে পেজটা ভাইরাল হয়ে গেল। স্থানীয় পত্রিকায় খবর বেরোল, ইউটিউব চ্যানেল মালবিকাকে ইন্টারভিউ করতে এল।
কিন্তু অশোক সেন চুপ করে থাকেনি। তার আইনজীবী মালবিকার নামে মানহানির নোটিস পাঠাল।
একদিন অফিস থেকে ফিরে অরিত্র দেখে, দরজার সামনে এক লোক দাঁড়িয়ে। স্যুট পরা, কালো চশমা।
“আমি মিস্টার সেনের পক্ষ থেকে এসেছি। আপনি ও মিস মালবিকা সেন যদি এই কাজ বন্ধ না করেন, তাহলে কোর্টে কেস করা হবে। আর আপনি যদি চাকরির কথা ভাবেন, তাহলে আমাদের অনুরোধ—এই লড়াই থেকে সরে আসুন।”
অরিত্র কিছু বলার আগেই লোকটা চলে গেল।

মালবিকা বলল, “দেখলে? বাবা এবার ভয় পেতে শুরু করেছে। আমি ঠিক করছি।”
অরিত্র বলল, “তবে তোমার নিজের কথা ভাবো, মালবিকা। তুমি যদি চাও, আমরা আইনি লড়াই শুরু করি। কিন্তু আমি চাই না, তোমার জীবন আবার অন্য কারও ছায়ায় ডুবে যাক।”

পরদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।
মালবিকার পেজে একটা অচেনা প্রোফাইল থেকে মেসেজ আসে—
“তোমার মা শুধু একা ভাঙেনি। আমি তার সঙ্গে কাজ করতাম। অশোক সেন তাকে শুধু মানসিকভাবে না, শারীরিকভাবেও আঘাত করত। আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি।”
সেই নাম—শুভেন্দু রায়।
মালবিকা সঙ্গে সঙ্গে তাকে কল করে। ফোনের ওপাশে কাঁপা গলা, “আমি ভয় পাই, কিন্তু আমার বিবেক আমায় জ্বালায়।”
মালবিকা তাকে শহরের এক নির্জন ক্যাফেতে দেখা করতে বলে।

সেই সন্ধেয় মালবিকা, অরিত্র আর শুভেন্দু বসে। লোকটা বছর পঁঁয়ত্রিশের মতো, চোখে আতঙ্ক, মুখে অনুশোচনা।
সে বলল, “সুস্মিতা দিদি আমার নাটকের শিক্ষক ছিলেন। খুব স্পষ্টভাষী, সাহসী একজন মানুষ। কিন্তু যখন অশোকবাবুর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়, আমি দেখি, ধীরে ধীরে উনি যেন নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছেন।”
তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “একদিন আমি ওনার বাড়ি গিয়েছিলাম স্ক্রিপ্ট আনতে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম, অশোকবাবু চিৎকার করছেন, আর সুস্মিতা দিদি মেঝেতে পড়ে আছেন।”
তারপর ফিসফিস করে বলল, “তবে আমি কিছু করিনি। আজও সেই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খায়।”
মালবিকা চোখের জল লুকিয়ে বলল, “আপনি যদি সত্যিই সাহায্য করতে চান, তাহলে কোর্টে গিয়ে সাক্ষ্য দিন।”

শুভেন্দু মাথা নোয়াল।
“আমি রাজি।”

সেই রাতটা মালবিকা আর অরিত্র একসঙ্গে কাটাল। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল।
মালবিকা বলল, “আমার মায়ের জন্য তুমি যা করছো, তা আমি কোনোদিন ভুলব না।”
অরিত্র আস্তে বলল, “আমি কেবল তোমার জন্য করিনি, মালবিকা। আমি জানি, ভালোবাসা মানে শুধু একসঙ্গে হাত ধরা নয়। কখনো কখনো, ভালোবাসা মানে কারও যন্ত্রণা নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া।”

সকালে ওরা খবর পায়, অশোক সেন নিজে একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন।
লাইভ টিভিতে দেখা যায়, চওড়া হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বলছেন, “আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কয়েকজন তরুণ-তরুণী আমার সম্মান নষ্ট করতে চাইছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেব।”
তারপর সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি একটি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি, যা নারীকল্যাণ নিয়ে কাজ করে। আমি একজন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছি।”
শেষে সংযোজন—“আমার মেয়ে মারা গিয়েছে বহুদিন আগেই। কেউ যদি নিজেকে আমার মেয়ে দাবি করে, সেটা নকল পরিচয়।”

মালবিকা দাঁত চেপে বলল, “এই মানুষটার মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলতেই হবে।”

অরিত্র বলল, “ছিঁড়ব। এখন আর তুমি একা নও।”

***

শহরের বাতাস যেন বদলে যাচ্ছে। যেন মানুষের কথার নিচে জমে থাকা কুৎসিত অতীত একে একে ভেসে উঠছে। “সুস্মিতার গল্প” পেজে প্রতিদিন নতুন নতুন মন্তব্য আসছে—কারো মা হারিয়েছে ভালোবাসার মানুষকে, কেউ বোনের গায়ে হাত তোলার ছবি পোস্ট করছে, কেউ আবার শুধুই লিখছে—“ধন্যবাদ, তোমরা মুখ খুলেছো।” কিন্তু এর মাঝেও, এক অদৃশ্য ছায়া যেন অরিত্র আর মালবিকার পিছু নিচ্ছে। কারা যেন নজরে রেখেছে তাদের।

এক রাতে অরিত্র অফিস থেকে ফেরার পথে দেখে, তার বাইকের ব্রেক কাট করা হয়েছে। কোনোভাবে সামলে বাড়ি ফিরল সে। মালবিকা বলল, “বুঝতেই পারছ, ওরা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। সামনে এগোতে হবে।”
অরিত্র বলল, “শুধু ডায়েরি আর এক সাক্ষী দিয়ে কি আমরা অশোক সেনকে ফাঁসাতে পারব?”
মালবিকা বলল, “মায়ের একটা ক্যামেরা ছিল। সবসময় পাশে রাখত। আমি খুঁজে পাইনি আজ অবধি। যদি সেটা পাওয়া যায়, যদি কোনো ছবি বা ভিডিও থাকে…”

পরদিন মালবিকা যায় পুরনো ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাট যেখানে সুস্মিতা সেন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। ফ্ল্যাটটা এখন তালাবদ্ধ, মালবিকার মামার নামে। অনেক অনুরোধের পর চাবি মেলে।
ধুলো, জং, এবং একরাশ স্মৃতি—এই ছিল সেই ফ্ল্যাটে।
ঘরের এক কোণে, কাঠের খাটের নিচে একটা ছেঁড়া ব্যাগে মেলে পুরনো ইয়াশিকা ক্যামেরা। ব্যাটারি নেই, রিল খুলে দেখে ভেতরে আটকে থাকা ফিল্ম। মালবিকা সেই ফিল্ম হাতে বেরিয়ে পড়ে।

এক পুরনো স্টুডিওতে গিয়ে ফিল্মটা ধুয়ে নিতে বলে। দোকানদার দেখে বলে, “এ তো বহু পুরনো। চেষ্টা করব।”
দুদিন পর ফোন আসে, “আপনার ফিল্মে কিছু ছবি পাওয়া গেছে। আপনাকে নিজে আসতে হবে।”
অরিত্র আর মালবিকা একসঙ্গে পৌঁছায়।

দোকানদার হাতে দেয় একগুচ্ছ ছবি। একে একে খুলে দেখে—সুস্মিতা সেনের হাসি, মালবিকার ছোটবেলার জন্মদিন, নাটকের মহড়া… আর শেষ কয়েকটা ছবিতে দেখা যায়, অশোক সেন মদের বোতল হাতে কিছু বলতে বলতে রাগে গর্জে উঠছে। একটা ছবিতে সুস্মিতা চোখে হাত দিয়ে বসে আছেন, অন্যটায় মেঝেতে পড়ে আছেন, অশোক ঝুঁকে আঘাত করতে যাচ্ছে।

মালবিকার শরীরটা কেঁপে ওঠে। সে বলল, “এগুলোই প্রমাণ। এবার ও পালাতে পারবে না।”

ওরা ছবি স্ক্যান করে ডিজিটাল প্রিন্ট করে। অরিত্র তার সাংবাদিক বন্ধু রোণকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রোণক বলে, “এই ছবি সত্যি হলে এটা বড় খবর হবে। তবে আইনি রক্ষাকবচ নিতে হবে।”
অরিত্র বলে, “তুই শুধু নিউজটা রেডি রাখ, আমরা কাগজপত্র তৈরি করছি।”

মালবিকা এবার এক আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে। প্রিয়া সেন—তিনিও একজন নারী অধিকার কর্মী। সব শুনে প্রিয়া বলেন, “এই কেসটা আমি নিঃস্বার্থভাবে নিতে রাজি। কিন্তু তুমি জানো তো, এ লড়াই দীর্ঘ হবে?”
মালবিকা বলে, “আমার মা ১৫ বছর ধরে কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি অন্তত ১৫ মাস লড়তে পারব।”

ফেসবুকে নতুন পোস্ট করা হয়—
“আমাদের সংগ্রাম শুধু একটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়, এটা প্রতিটি মেয়ের কণ্ঠস্বর। আমরা কোর্টে যাচ্ছি, প্রমাণ নিয়ে, সাহস নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে।”

সেই রাতে প্রথমবার মালবিকা চুপচাপ অরিত্রর কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমার ভেতরের আগুনটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। কিন্তু ভয়ও বাড়ছে। যদি আমি হেরে যাই?”
অরিত্র জবাব দিল না। শুধু তার হাত শক্ত করে ধরল। তারপর আস্তে বলল, “হেরে গেলে আমি তোমার পাশে বসে কান্না করব, জিতলে তোমার সঙ্গে চিৎকার করব। কিন্তু যাই হোক, আমি থাকব।”

পরদিন চাঁদপুর জেলা আদালতে মামলা দাখিল হয়—অশোক সেন বনাম মালবিকা সেন। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে—শহরের নামজাদা ব্যবসায়ীর গায়ে লেগেছে কলঙ্ক।
অশোক সেন সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেয়—“এই সব সাজানো প্রমাণ। কেউ আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।”
কিন্তু লোকজন বুঝে গেছে, এ গল্প আর গুজব নয়।
শহরের পথে পথে দেয়ালে পোস্টার—“Justice for Susmita.”
রূপসী সিনেমা হলের সামনে মোমবাতি মিছিল।

শুরু হয় আদালতের শুনানি। প্রথম দিনেই প্রিয়া সেন জানিয়ে দেন—“এই মামলা শুধু এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এই মামলা সেই সমাজের বিরুদ্ধে, যারা মেয়েদের মুখ বন্ধ রাখতে চায়।”
প্রথম সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ায় শুভেন্দু। সে কাঁপা গলায় বলে, “আমি অনেক বছর চুপ ছিলাম। এখন সময় হয়েছে বলার—আমি দেখেছি, শুনেছি, জানি—অশোক সেন একজন নির্যাতক।”

কিন্তু এরপরেই অশোক সেনের পক্ষের আইনজীবী শুভেন্দুকে জেরা করে তার চরিত্রে সন্দেহ তোলে—“আপনি কি নিজে সুস্মিতার প্রেমে ছিলেন না?”
শুভেন্দু মাথা নিচু করে বলল, “হয়তো ছিলাম। কিন্তু সত্যিটা আজও আমার চোখে পুড়ে আছে।”
শ্রোতাদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়। মালবিকার চোখে কান্না।

শেষে বিচারক বলেন, “পরবর্তী শুনানির দিন ছবি ও ডায়েরি যাচাই করা হবে। ফারেনসিক বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

সেই রাতে মালবিকা ঘুমোতে পারে না। বারবার ডায়েরির শেষ পাতাটা পড়ে।
“যদি আমার মেয়ে একদিন আমার কথা জানতে চায়, আমি চাই সে সত্যি জানুক—ভালোবাসা কোনোদিন ভুল ছিল না, কিন্তু যার প্রতি ছিল, সে ভুল ছিল।”

***

আদালতের ভিড় যেন রোজ বাড়ছে। কেউ কেউ কৌতূহলে, কেউ বা সাহসে এসে বসছে পেছনের বেঞ্চে। সুস্মিতা সেনের ডায়েরি ও ছবি এখন বিচারকের টেবিলে, লাল রঙের ফাইলের নিচে চাপা দেওয়া আগুনের মতো। আদালতের চতুর্দিকে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। কে হারবে, কে জিতবে—তার থেকেও বড় কথা, কে মুখ খুলবে?

সেই সকালেই মালবিকা উঠে দেখে তার ফেসবুক পেজে এক অচেনা মেসেজ—
“আমি তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। অনেকদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু এবার বলতে চাই, আমি জানি সে কী করতে পারে।”
নাম: অনন্যা সেন।

মালবিকার শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। এতদিন ধরে যে মানুষটা তাকে ছায়ার মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছে—তার বর্তমান স্ত্রী হঠাৎ করে কীভাবে মুখ খুলছে?
সে সঙ্গে সঙ্গে অরিত্রকে ফোন করে সব জানায়।
অরিত্র বলে, “তাকে আজই দেখা করতে বলো। কিন্তু সাবধানে, সে কি সত্যিই সাহায্য করতে চায়, না নতুন কোনো ফাঁদ?”
মালবিকা জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো?”
অরিত্র হেসে বলল, “প্রশ্নই ওঠে না, আমি আছি।”

দুপুরে তারা একটা নির্জন রেস্টুরেন্টে পৌঁছায়। এক টেবিলে বসে আছেন মাঝবয়সী, রূপহীন, ম্লান চেহারার এক মহিলা।
চোখে চশমা, মুখে রংহীন লিপস্টিক। চোখে-চোখে দেখা হতেই মালবিকা বুঝল, এ চোখে বহুদিন ধরে কান্না জমে আছে।
“তুমি মালবিকা?”
“হ্যাঁ।”
“তোমাকে ছোটবেলায় একবার দেখে এসেছিলাম, চুপচাপ স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। তখনই বুঝেছিলাম, তুমিই ওর সত্যিকারের রক্ত।”

অনন্যা এক চুমুক কফি নিয়ে বলল, “আমি ওর দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু স্বপ্ন ছিল না কখনও। অশোক যখন বিয়ের প্রস্তাব দিল, আমি ভাবলাম—এত বড়লোক মানুষ, অন্তত সম্মান দেবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।”
তার কণ্ঠস্বর থেমে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “সে একদিন আমাকেও থাপ্পড় মেরেছিল, যখন আমি জানতে চেয়েছিলাম সুস্মিতা দিদির কথা। তারপর থেকে আমি কেবল নীরব এক পুতুল হয়ে থেকেছি।”
মালবিকা বলল, “আপনি যদি চুপ না থেকে সাক্ষ্য দেন, তাহলে আমার মামলায় আপনি অনেকটা পরিবর্তন আনতে পারবেন।”
অনন্যা চুপ করে থাকেন।
তারপর ধীরে মাথা নাড়ে, “আমি সাক্ষ্য দেব। কিন্তু একটা অনুরোধ—আমার নাম যেন এতদিনে আর কাদা না হয়।”

সেইদিনই প্রিয়া সেন তাকে সাক্ষীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। মালবিকা বুঝতে পারে, একটা স্রোত বদলাচ্ছে।
কিন্তু তার ঠিক পরদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

রাত বারোটার সময় রূপসী হলের তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে একদল লোক। সিনেমা রিল ছিঁড়ে ফেলে, দেয়ালে কালি মাখিয়ে লেখে—“চুপ না থাকলে পুড়িয়ে দেব।”
পুলিশ আসে সকালে, প্রতিবেদন লেখে, কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয় না।
অরিত্র দেখে মালবিকার চোখে আর ভয় নেই, বরং আরও গভীর জেদ।
সে বলে, “এটা ওদের শেষ চেষ্টা, জানো তো? কারণ ওরা জানে, আমরা শেষ ধাক্কাটায় পৌঁছে গেছি।”

পরবর্তী শুনানির দিন অনন্যা সেন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু আমি কখনও সুখে ছিলাম না। সে আমার ওপর চিৎকার করত, অসম্মান করত। আমি নিজে তার মুখে শুনেছি, সুস্মিতা দেবীর সঙ্গে তার কী ব্যবহার ছিল। সে বলত—‘ওরা মেয়েছেলেরা কান্না করে আর দোষ চাপায়, আমি কাউকে জোর করিনি।’ আমি কেবল চুপ ছিলাম, কিন্তু আজ আর পারছি না।”

আদালত নিস্তব্ধ। অশোক সেনের আইনজীবী তীব্র আপত্তি তোলেন, “এই সাক্ষী পক্ষপাতদুষ্ট। এনার ব্যক্তিগত অসন্তোষ মামলায় যুক্ত করা যায় না।”
প্রিয়া সেন বলেন, “কিন্তু যখন একজন মহিলা আদালতের সামনে নিজের ভয়ের গল্প শোনান, তা বিচার ব্যবস্থার জন্য অমূল্য প্রমাণ হয়।”
বিচারক বলেন, “আমি এই সাক্ষ্য গ্রহণ করছি, এবং অনন্যা সেনকে পরবর্তী শুনানির দিন জেরা করার অনুমতি দেওয়া হলো।”

আদালত ছুটির পর বাইরে বেরিয়ে আসে অশোক সেন। সংবাদমাধ্যম ঘিরে ধরে তাকে। সে একবারও চোখ না তুলে শুধু বলে, “এরা সবাই আমাকে ফাঁসানোর চক্রান্ত করছে।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার দেহরক্ষীরা চিৎকার করে বলে, “রাস্তা ছাড়ো!”

ওদিকে, মালবিকা ও অরিত্র বাড়ি ফিরে দেখে ফেসবুক পেজে কয়েকটা হুমকিমূলক ইনবক্স—
“তুই যদি বাবার নাম খারাপ করিস, তোকে গায়েব করে দেব।”
“এই কেস বন্ধ কর। নয়তো ছবি ছড়িয়ে যাবে।”

মালবিকা একটুও না কাঁপিয়ে বলে, “ছড়িয়ে দাও। যেটুকু লজ্জা ছিল, সেটা আমি মায়ের সঙ্গে মাটিতে পুঁতে এসেছি। এখন আমার কিছু হারানোর নেই।”

সেই রাতে অরিত্র মালবিকার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুমি জানো, এই লড়াইয়ের জন্য অনেক মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে?”
মালবিকা বলে, “জানি। কিন্তু জানো, আমার নিজের ভেতরে যে ভয় ছিল, তাকে আমি একপায়ে পিষে মেরেছি। এখন শুধু চাই, মা যেটা বলতে চেয়েছিল, সেটা যেন পুরো দুনিয়া শোনে।”

ওদিকে, অশোক সেন নিজের বাড়ির বন্ধ ঘরে একা বসে। সামনে টিভিতে চলছে নিজেকেই নিয়ে খবর।
তার চোখে কোনো ভয় নেই।
শুধু ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা অর্ধেক হাসি।
সে বলল, “একটা মেয়ের গল্পে কেউ একজন জিতে যায় না। আমি জানি, কাকে কতদূর যেতে দিতে হয়।”

***

আদালতের চত্বরে ভোর থেকে জটলা। রোদ উঠতেই ক্যামেরার ঝলকানি আর গরম চায়ের কাপে ভাসছে নানা জল্পনা। আজই প্রথমবার সুস্মিতা সেনের লেখা ডায়েরি বিচারকের হাতে খোলা হবে।
তাঁর লেখা নয়, যেন এক নারীজাতির ক্রন্দন—যা এতদিন মেঝের নিচে চাপা পড়ে ছিল।
আর আজ সেই শব্দগুলো কাগজের পাতায় উঠে এসে এক পুরুষের মুখোশ খুলে দিতে চলেছে।

মালবিকা মাথা নিচু করে গাড়ি থেকে নামল। সে যেন কারও চোখে চোখ রাখছে না।
অরিত্র পাশে দাঁড়িয়ে।
সে বলল, “তুমি ঠিক আছ?”
মালবিকা কেবল বলল, “না। তবে আমি ঠিক করব।”
অরিত্র হাত ধরতে গেল, মালবিকা ঠেলে সরিয়ে দিল না।
এই ছোঁয়ায় ছিল যুদ্ধের আগুন, আবার আশ্রয়ের নির্ভরতাও।

আদালতে বিচারক বললেন, “সাক্ষ্যপত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি, যা সুস্মিতা সেন রচনা করেছিলেন। এতে বহু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফারেনসিক পরীক্ষা অনুযায়ী, তা আসল এবং সুস্মিতারই লেখা।”
পুরো আদালত থম মেরে গেল।

প্রিয়া সেন বললেন, “ডায়েরির কিছু অংশ পাঠ করব, যদি অনুমতি দেন।”
বিচারক মাথা নাড়লেন।
প্রিয়া খুললেন পাতাগুলি, শব্দ উচ্চারণ করলেন—
“আজ অশোক আমাকে আবার বলল—‘তুই নাচিয়ে মেয়েমানুষ, তোর সঙ্গে সংসার করা আমার পাপ।’ আমি জবাব দিইনি। কারণ জানি, আমি জবাব দিলেই আমার গায়ে হাত উঠবে। আমার শরীরটাকে যেন ওর হাতের চড়-থাপ্পড়ের জন্য রাখা হয়েছে।”

সারারুম নিঃশব্দ।
কেউ শ্বাস ফেলে। কেউ মাথা নিচু করে।
মালবিকা চোখ বন্ধ করে রাখে।

প্রিয়া আবার বলেন—
“আজ রাত্তিরে ওর ফোনে মেয়েদের নাম দেখেছি। আমি চেঁচাইনি। কারণ জানি, আমি চিৎকার করলে আমার সন্তান ভয় পাবে। আমি চাই, অন্তত আমার মেয়ে ভালোবাসা বলতে কাঁদা না বুঝুক।”

এইসব শব্দ যেন আদালতের দেওয়াল ঠেলে শহরের গলিতে গলিতে বেজে ওঠে।

অশোক সেন এই পুরো সময়টায় স্থির মুখে বসে ছিল। এবার হঠাৎ বলে ওঠে, “এই সব আবেগ দিয়ে সত্যি চাপা যায় না। একটা মহিলার ব্যক্তিগত কষ্ট সবার চোখে জল এনে দিতে পারে, কিন্তু সেটা প্রমাণ নয়।”
বিচারক বলেন, “আপনার বক্তব্য আমরা শুনেছি। আপনাকে জেরা করার সুযোগ দেওয়া হবে।”

এরপর দাঁড়ান অশোক সেনের আইনজীবী, তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এই ডায়েরিতে কোনো তারিখ নেই। আপনি কীভাবে জানবেন, এগুলো ঘটেছে?”
প্রিয়া বলেন, “মহিলার মৃত্যু ২০১১ সালের এপ্রিল। তার আগের ছ’মাসে লেখা পাতাগুলি আমরা পেয়েছি। এবং তার কণ্ঠে, তার ভাষায় সেই যন্ত্রণার সময়রেখা স্পষ্ট।”
জজ বলেন, “ডায়েরির মূলপাঠ আদালতের অন্তর্ভুক্ত করা হলো।”

শুনানি শেষ হলে আদালত মুলতুবি ঘোষণা করে।
মালবিকা ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চে বসে পড়ে।
অরিত্র পাশে বসে বলে, “আজ তুমি যা করেছো, সেটা শুধু একজন মেয়ের হয়ে নয়। এক গোটা সমাজের হয়ে।”
মালবিকা চুপ করে থাকে।
তার চোখে কেবল মায়ের মুখ ভেসে উঠছে। রাত্রির ছায়া, কান্নায় ভিজে যাওয়া বিছানা, আর সেই লুকানো ক্যামেরার ক্লিক।

রাত্তিরে রূপসী সিনেমা হলের দরজায় আবার কে যেন কড়া নাড়ে।
অরিত্র দরজা খুলতেই দেখে এক তরুণী দাঁড়িয়ে।
চোখে অস্বস্তি। হাত কাঁপছে।
“আমি ফারহানা। আমি আপনার পেজে লিখেছিলাম… আমি… আমি কোর্টে কথা বলতে চাই।”
মালবিকা এগিয়ে আসে।
ফারহানা বলে, “আমি অশোক সেনের গাড়িচালকের মেয়ে। ছোটবেলায় বাবার মুখে অনেক গল্প শুনেছি। একবার নাকি আপনার মা এক রাতে গাড়ির মধ্যে বসে খুব কাঁদছিলেন। বাবার কাছে বলেছিলেন, ‘আমায় কোথাও নিয়ে চলো। এই লোকটা আমায় মেরে ফেলবে।’ তারপর ওঁকে টেনে নামানো হয়েছিল।”
মালবিকা বলে, “তুমি কোর্টে গিয়ে এগুলো বলতে পারবে?”
ফারহানা মাথা নাড়ে, “পারব। কারণ আমিও কাঁদতে কাঁদতে বড় হয়েছি।”

পরদিন প্রিয়া তাকে সাক্ষী হিসেবে যুক্ত করেন।
একটার পর একটা প্রমাণ, একটার পর একটা মুখ।
অশোক সেনের চারপাশের দেয়াল যেন ফাটতে শুরু করেছে।

ওদিকে অশোকের বাড়িতে আর এক গল্প।
অনন্যা সেন এখন কথা বলছে তার আইনজীবীর সঙ্গে—
“আমি ডিভোর্স চাই। আমি এখন নিজের নামেই বাঁচতে চাই।”
আইনজীবী চমকে বলে, “এত বছর পর?”
অনন্যা বলে, “হ্যাঁ। কারণ আমি প্রথমবার কারও মুখে নিজের গল্প শুনলাম। আর সেই মেয়ে আমারই স্বামীর মেয়ে।”

অরিত্র এক সন্ধেয় মালবিকাকে বলে, “জানো, তুমি চাইলেই সিনেমা বানাতে পারো এই গল্পটা নিয়ে। শুধু সাহসই তো গল্পের সবচেয়ে বড় নায়ক।”
মালবিকা হেসে বলে, “তুমি কি জানো, আমি এতদিন সিনেমায় হারিয়ে যেতে চেয়েছি, কারণ বাস্তবটা ভয় পাই? এখন আমি আর পালাতে চাই না। এখন আমি চাই, আমার বাস্তবটাকেই সিনেমা বানাতে।”

রাতে সে ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লিখে—
“মা, আজ আমি মুখ খুলেছি। তুমি বলেছিলে, ভালোবাসা মানে কেবল কষ্ট নয়। আমি আজ বুঝেছি, ভালোবাসা মানে কারও জন্য আলো জ্বালানো। আর প্রতিশোধ? প্রতিশোধ মানে কাউকে অন্ধকারে রেখে নয়, সবাইকে আলোর দিকে টেনে আনা।”

***

চাঁদপুর আদালতের চতুর্থ সপ্তাহ। এই কেস এখন আর শুধু মালবিকা বনাম অশোক সেন নয়—এ শহরের, এই সমাজের মুখোশ বনাম মুখ খুলে ফেলা সাহসের নাম। আদালতের বাইরে জমছে সাংবাদিক, স্টুডেন্ট, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এমনকি স্কুলপড়ুয়া ছেলেরাও মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে। পোস্টারে লেখা—“আমার মায়ের গল্প, তোমারও হতে পারত।”

আজ আদালতে দাঁড়াবে ফারহানা। অল্প বয়সী মেয়ে, মাথায় ওড়না, হাতে চটের ব্যাগ। ভয় ভেঙে নিজের বাবার মুখে শোনা সত্যিগুলো আজ উচ্চারণ করবে প্রকাশ্যে।
ফারহানা দাঁড়িয়ে বলল, “আমার বাবা ছিলেন অশোক সেনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছেন। উনি অনেক রাত অবধি বাড়ি ফিরতেন না, অনেক নারী আসতেন গোপনে। আমার বাবা একদিন বাড়ি ফিরে বলেছিলেন, ‘আজকেই সুস্মিতা ম্যাডামকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে হচ্ছিল, উনি খুব কাঁদছিলেন।’ বাবার কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে।”
প্রিয়া সেন প্রশ্ন করলেন, “তোমার বাবা কি এখন জীবিত?”
“না ম্যাডাম। উনি তিন বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু উনি সব লিখে রেখেছিলেন একটা নোটবুকে।”

ফারহানা কাঁপা হাতে একটি পুরোনো খাতা বের করল। হাতের লেখায় লেখা—
“আজ ৩রা ফেব্রুয়ারি। সুস্মিতা ম্যাডামকে খুব ভয় পেয়ে দেখলাম। গায়ে কালশিটে দাগ। উনি বললেন, ‘আমার মেয়েকে নিয়ে পালাতে চাই।’ কিন্তু সাহস পাইনি। গাড়ি ঘোরাতে পারিনি।”

বিচারকের চোখে শীতলতা। অশোক সেনের মুখে এবার খানিক অস্বস্তি। তার আইনজীবী বলেন, “এই নোটবুক তো প্রমাণ নয়। এটা কেবল গল্প।”
প্রিয়া বলেন, “যে সমাজে একজন চাকর-বাহকও ভয় পেয়ে যায় সত্যি বলার আগে, সেই সমাজেই এটাই সবচেয়ে বড় সাহসের প্রমাণ।”
বিচারক নোটবুকটি গ্রহণ করে বলেন, “এটি বিচারের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”

সেই রাতে মালবিকা একা রূপসী সিনেমা হলে বসে ছিল। স্ক্রিনে তখন কোনো ছবি নেই। শুধু একটা ফাঁকা পর্দা।
অরিত্র এসে ধীরে পাশে বসে বলল, “আজ তুমি কী ভাবছ?”
মালবিকা বলল, “মাঝেমাঝে মনে হয়, আমি যে সত্যি কথাগুলো বলছি, তাও কি কেউ বিশ্বাস করছে? সমাজ তো সবসময় চোখে দেখে না, কানে শোনে না, শুধু ভয় দেখে।”
অরিত্র বলল, “ভয় আর বিশ্বাস—দুটোই সংক্রামক। তুমি একটা বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছো, সেটা অনেকের মনে পৌঁছেছে। এখন সেটা ছড়িয়ে পড়বে। আজ যারা কাঁপছে, কাল তারা গলা তুলবে।”
মালবিকা বলল, “তুমি কি কখনো আমার ওপর সন্দেহ করেছিলে?”
অরিত্র চুপ করে রইল। তারপর বলল, “শুধু একবার—যখন তুমি বলেছিলে, ‘তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই।’ আমি ভাবতাম, এই মেয়েটা কি শুধু প্রতিশোধে জ্বলছে, নাকি ভালোবাসতেও জানে?”
মালবিকা বলল, “তুমি যা করেছো, তাতে আমি নিজেকেই আবার ভালোবাসতে শিখেছি।”

পরদিন হঠাৎ করেই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
চাঁদপুরের এক লোকাল নিউজ চ্যানেল সাক্ষাৎকার নেয় একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের।
তিনি বলেন, “২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সুস্মিতা সেনের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে ক্লোজ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় অশোক সেনের বিশেষ অনুরোধে কিছু মেডিকেল রিপোর্ট ‘হারিয়ে যায়।’ আমি নিজে সবটা জানতাম, কিন্তু উচ্চতর কর্তৃপক্ষের চাপে কিছু বলতে পারিনি।”
এই ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়।
আবার নতুন সাক্ষ্য, আবার নতুন আশ্বাস।

আদালতে এই ভিডিও জমা পড়ে।
বিচারক বলেন, “পুনরায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মামলার তদন্ত হোক।”
অশোক সেনের আইনজীবী মাথা চাপড়ে বলেন, “আপনারা মিডিয়ার কথায় আদালত চালাবেন?”
প্রিয়া বলেন, “আমরা মিডিয়ার কথায় নয়, মানুষের যন্ত্রণার কথায় আদালত চালাতে চাই।”

মালবিকার মা যেন আবার বেঁচে উঠেছেন এই শব্দে, এই কাগজে, এই সাক্ষ্যে।
আর অরিত্র বুঝে যায়—ভালোবাসা আর প্রতিশোধ আলাদা জিনিস নয় সবসময়। কোনো ভালোবাসার শেষ মাথায় যদি অপমান থাকে, তবে তার প্রতিশোধ অনিবার্য।

সন্ধের দিকে অরিত্র হাঁটছিল শহরের ব্যস্ত বাজারে, হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।
পিঠে ব্যথা পেয়ে মাটিতে পড়েও সে দেখতে পায়, একটা বাইক ছুটে যাচ্ছে দ্রুত। বাইকের পেছনে কেউ চিৎকার করছিল—“ফের মুখ খুললে শেষ করে দেব।”
রক্ত জমে আসে ঠোঁটে, কিন্তু চোখে তখনও একটাই ছবি—মালবিকার মুখ।

রাত ১১টায় অরিত্র হাসপাতালে ভর্তি।
মালবিকা ছুটে এসে দাঁড়ায়, তার চোখ কাঁদছে না, কিন্তু গাল বেয়ে একটা ফোঁটা জল গড়াচ্ছে।
“তুমি কেন কিছু বলোনি?”
অরিত্র ফিসফিস করে বলল, “তোমার গল্প থামুক সেটা আমি চাইনি। আমি চাই তুমি শেষ অবধি লড়ো।”

মালবিকা চুপ করে তার কপালে হাত রাখে। তারপর বলে,
“তুমি আমাকে ভালোবেসে জিতেছো, আর আমি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এখন বুঝতে পারছি—ভালোবাসা কী ভয়ংকর রকম আশ্চর্য এক জিনিস।”

***

হাসপাতালের সাদা চাদরে ঢাকা অরিত্রর শরীরটা নিঃসাড় শুয়ে, কেবল তার চোখ দুটো টের পাচ্ছে মালবিকার স্পর্শ। মালবিকা জানে, এই ছেলেটা আজ তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, অথচ সে নিজের রাগ, ক্ষোভ আর প্রতিশোধের তীব্রতায় বারবার অরিত্রকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

ডাক্তার বললেন, “সামান্য মাথায় আঘাত। একদিন অবজারভেশনে রাখতে হবে। তবে মানসিকভাবে বেশ চাপে ছিল, বুঝতেই পারছেন।”
মালবিকা একগাল নিঃশ্বাস ফেলল। সে জানে, অরিত্র কখনও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। মুখে বলে ভালোবাসা শেখেনি সে। কিন্তু যেভাবে সে পাশে থেকেছে, তা যে কোনো শব্দের চেয়ে অনেক বেশি।

রাতে মালবিকা একা হাসপাতালের করিডোরে হাঁটছিল। মোবাইলে তার হাতে অনেক মেসেজ—ভক্তি, সমর্থন, ধন্যবাদ, আবার হুমকি আর অভিশাপও।
একটা অচেনা নাম থেকে মেসেজ আসে—
“তুমি কি জানো, তোমার মা আসলে মরেনি। সে এখনও বেঁচে আছে, শুধু অন্য নামে।”

মালবিকার হাত ঠান্ডা হয়ে আসে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই মেসেজ কি স্রেফ প্রলাপ? নাকি নতুন কোনও পরত খুলছে?

সেই রাতেই সে বসে পড়ে ডায়েরি নিয়ে। শেষের দিকে কিছু পৃষ্ঠা অবধি সে কখনও পড়েনি। এবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পায়—
“আজ যদি আমি আর না থাকি, তাহলে আমার মেয়েকে বলে দিও, আমি তাকে ভালোবেসেই গেলাম। আমার শেষ চিঠি আমি রেখেছি আমার নাটকের পুরনো স্ক্রিপ্টের মাঝে।”

রূপসী সিনেমা হলের স্টোররুমে ছুটে যায় মালবিকা। বহু পুরনো, সাদা হয়ে যাওয়া কাগজের গাদা ঘেঁটে অবশেষে একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট পায়—“অন্তিম দৃশ্য”। তার ভেতরে ভাঁজ করা একটা হলুদ কাগজ। খোলা মাত্র চোখে জল চলে আসে।

“মালু,
যদি কখনও এই চিঠিটা পাও, তাহলে জেনে নিও—আমি চাইনি তুমি আমার মতো হও। আমি চাই তুমি গলা তোলো। তোমার কণ্ঠস্বর হোক অন্যদের আশ্বাস। অশোককে ঘৃণা করো, কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে নয়। ভালোবাসার ক্ষমতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র—আমি তা জেনেছি দেরিতে। তুমি যেন তা সময়মতো বোঝো।
— মা”

মালবিকা চিঠিটা বুকে চেপে ধরল। সে এবার নিশ্চিত, তার লড়াই এখন শুধু মায়ের পক্ষেই নয়—নিজের ভেতরের সেই ভালোবাসাকেও স্বীকৃতি দেওয়ার লড়াই।
সে জানে, আগামী শুনানি দিন হয়তো অশোক সেন নিজে সাক্ষ্য দিতে আদালতে উঠবে। তার সামনে দাঁড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।

পরদিন সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখে অরিত্র উঠে বসেছে। চোখে ক্লান্তি, মুখে শান্ত হাসি।
“তুমি আবার একা গিয়ে সিনেমার স্টোর ঘেঁটে ফেলেছো?”
মালবিকা হেসে বলল, “জানি, তুই আমাকে আটকাবি না।”
অরিত্র বলল, “আটকাতে চাই না। শুধু চাই, তোকে হারাতে না হই।”

দুপুরে মালবিকা সাংবাদিক বৈঠক ডাকে। প্রথমবার সরাসরি মিডিয়ার সামনে মুখ খুলে বলে—
“আমি অশোক সেনের মেয়ে। আমার মা আত্মহত্যা করেনি, তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের, কোনো সংগঠনের মুখপাত্র নই। আমি একজন মেয়ে, যে কেবল তার মায়ের সম্মান ফিরিয়ে দিতে চাই। যারা বলছে, এই মামলা আমার ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, তারা ভুল বলছে—এটা আমার ভালোবাসার লড়াই। আমি শুধু চাই, আমার মতো কোনো মেয়ে যেন ঘরেই নীরবে পুড়ে না মরে।”

এই বক্তব্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রেন্ডিং হয় #JusticeForSushmita, #MothersVoice, #MalavikaSpeaks।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল একটাই বার্তা—“একটা মেয়ে আজ কাঁদছে না, সে লড়ছে। আর আমরা তার পাশে আছি।”

তারপর আসে সেই দিন—যেদিন অশোক সেন নিজে আদালতে দাঁড়াবে।
বিচারক বলেন, “আপনি কি এই মামলার বিষয়ে নিজে কিছু বলবেন?”
অশোক উঠে দাঁড়ায়। সুসজ্জিত, গলায় হালকা হাসি।
সে বলে, “আমি একজন সমাজসেবী, শিল্পপতি এবং জনদরদী নাগরিক। এই মামলাটি আমার বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত, যেটা তৈরি হয়েছে আমার অতীত ব্যবহার করে। আমি স্বীকার করি, আমি সুস্মিতা সেনকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তার মৃত্যু আমার জন্যও একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আমি তাকে আঘাত করিনি। কিন্তু সম্পর্ক ভাঙলে যন্ত্রণা হয়, আর সেই যন্ত্রণার থেকে কেউ কেউ পালাতে চায়।”

প্রিয়া সেন বলে, “আপনি বলছেন আপনি আঘাত করেননি। তাহলে ছবিগুলো? তাহলে ডায়েরি? তাহলে প্রত্যক্ষ সাক্ষী?”
অশোক একটু থেমে বলে, “ছবি নকল হতে পারে। ডায়েরি আবেগপ্রবণ বানানো লেখা। আর প্রত্যক্ষ সাক্ষী? তারা কি কোনো প্রলোভনের শিকার হয়নি?”
আদালত ফিসফিস করে ওঠে।

মালবিকার হাত কাঁপছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনি আমার বাবাও নন, মানুষও নন। আপনি একজন কাপুরুষ, যে একজন নারীর কান্নাকে ‘নাটক’ বলে উড়িয়ে দিতে চায়। আমি লড়ছি আপনার সঙ্গে নয়, আপনার মতো হাজার অশোকের বিরুদ্ধে, যারা নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়।”

বিচারক বলেন, “আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে রায়দানের তারিখ নির্ধারণ করছে। আগামী সপ্তাহে রায় ঘোষণা করা হবে।”

রাতের রূপসী সিনেমা হলে স্ক্রিনে তখন কেবল একটাই বাক্য—
“শেষ দৃশ্য এখনো বাকি।”

***

চাঁদপুর জজ কোর্টের রায়দানের দিন। শহরের রাস্তায় চিপসে চিবানো কিশোরের মুখেও আলোচনা—“আজ অশোক সেনের রায়।” রিকশাচালক বলছে, “মেয়েটা বাঘিনী, সাবাশ।” কেউ বলছে, “শুনছি বড় কেস, হাইকোর্ট পর্যন্ত যাবে।”

মালবিকা চোখে কালো কাজল, মুখে ম্লান অথচ দৃঢ় হাসি নিয়ে পৌঁছায় কোর্টে। পাশে অরিত্র—যে আজও সেই প্রথম দিনের মতোই চুপচাপ হাঁটছে, শুধু চোখে ধরা পড়ে উদ্বেগ আর গর্বের সহাবস্থান।

কোর্টের ভেতর ভিড় উপচে পড়ছে। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, ব্লগার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর—সবাই এক জায়গায়। বিচারক ঢুকতেই নিস্তব্ধতা।

বিচারক বলেন, “এই মামলা দীর্ঘ চলেছে। বহু সাক্ষী, বহু প্রমাণ, বহু ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাপের মুখেও আমরা একটি স্পষ্ট সত্যের সন্ধানে ছিলাম। সুস্মিতা সেনের মৃত্যু আত্মহত্যা হিসেবে রেকর্ড হয়েছিল, কিন্তু আমাদের প্রাপ্ত তথ্য, চিঠি, ছবি ও সাক্ষীর ভিত্তিতে আদালত এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছে না।”

ঘরের মধ্যে এক গা-ছমছমে গুঞ্জন।
বিচারক জারি রাখেন, “তবে যেহেতু প্রমাণের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে হত্যার ইন্ধন প্রমাণ হয়নি, তাই ফৌজদারি ধারায় অশোক সেনকে খালাস দেওয়া হলো। কিন্তু… মানসিক নির্যাতন ও গৃহ-সহিংসতা বিষয়ে ডায়েরি, ছবি ও স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করছে।”

মালবিকার বুকের ভেতরটা ধপধপ করতে থাকে।
বিচারক বলেন, “অশোক সেনকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে, যার পুরোটাই ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ তহবিল’-এ যাবে। তিনি আর কোনো সরকারি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা পাবেন না। সমাজের সামনে তিনি একজন ‘পিতৃতান্ত্রিক নির্যাতকের’ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।”

আদালতে কারও হাততালি দেওয়া বারণ, তবু চারপাশে নিঃশব্দে জল ভিজিয়ে দেয় গাল।
অশোক সেন মাথা নিচু করে বসে, আর কিছু বলেনি।
মালবিকা উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে না আছে আনন্দ, না আছে প্রতিশোধের তৃপ্তি—শুধু শান্তি।
সে ফিসফিস করে বলে, “মা, আজ তুই শান্তিতে থাকিস।”

রাত্তিরে রূপসী সিনেমা হলে বসে মালবিকা আর অরিত্র। পর্দায় আবার সেই পুরনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিল্ম—স্মৃতি, কান্না আর কিছু অনুচ্চারিত প্রেম।
অরিত্র বলে, “আজ তুমি কাঁদছো না?”
মালবিকা বলে, “না। আজ আমি জানি, আমি শুধু কারও কন্যা নই। আমি নিজে একজন। আমি এখন অন্যদের গল্প শোনানোর জায়গায় দাঁড়িয়ে।”

হঠাৎ মালবিকা বলল, “তুমি কি এখনও আমার সঙ্গে থাকবে?”
অরিত্র চমকে বলল, “মানে?”
“আমি বদলে গেছি, জানো তো? আমি আর সেই পুরনো ভয় পাওয়া মেয়ে নই।”
অরিত্র বলে, “তুমি বদলাও। হাজারবার বদলাও। আমি থাকবই। কারণ আমি ভালোবেসেছি তোমার সেই চোখের গভীরতাকে, যেটা সাহসকে চেনে।”

মালবিকা উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে যায়। রূপসীর বাইরের রাস্তায় ছেলেমেয়েরা মোমবাতি জ্বালিয়ে গান গাইছে—
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…”

পেছন থেকে এসে অরিত্র তার কাঁধে হাত রাখে। মালবিকা বলে,
“আমি ঠিক করেছি, মায়ের চিঠি, ডায়েরি, সব প্রমাণ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাবো। নাম রাখব ‘তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই’। যেন পৃথিবী জানে, ভালোবাসা সবসময় কবিতা নয়—কখনো কখনো প্রতিবাদও।”

অরিত্র হাসে, “তুমি চাইলে আমি স্ক্রিপ্ট লিখে দেব।”
মালবিকা বলে, “তুমি আমার জীবনের স্ক্রিপ্টেই তো আছো।”

তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে যেন অনেকটা পথ হাঁটা শেষ হয়।

তারপরের দিনগুলোতে মালবিকা শহরে নানা জায়গায় ডেকে পড়ছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, ছোট মেয়েরা এগিয়ে এসে বলছে—“দিদি, আপনাকে দেখে সাহস পাই।”
সে মনে মনে ভাবছে, হয়তো মা ওপরে কোথাও বসে বলছে—“দেখেছো, আমার মালু কেমন করে জবাব দিয়েছে!”

তবে অশোক সেন?
সে এখন কারাগারের ঘরবন্দি। কোনো টিভি, কোনো পত্রিকা আর তার ছবি ছাপে না।
একদিন এক সাংবাদিক গিয়েছিল সাক্ষাৎকার নিতে। অশোক শুধু বলেছিল,
“আমি ক্ষমতাবান ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমি দোষী হলেও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। ভুল ভেবেছিলাম। এখন আমি জানি, মেয়েদের চোখের জল একদিন আগুন হয়ে ফেরে।”

সেইদিন রাতে মালবিকা তার মায়ের ছবির সামনে বসে।
হাত রাখে ছবিতে, বলে,
“আজও যদি কেউ বলে—‘তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই’, আমি বলব, না, বেঁচে থেকো। ভালোবেসে বদলে দাও পৃথিবী।”

***

নির্বাচনী মৌসুম, শহরের চারদিকে ব্যানার-পোস্টারে ভরে উঠেছে চাঁদপুর। কিন্তু এই নির্বাচনের পোস্টারে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে—কারও পোস্টারে মুখ নয়, বরং লেখা—“আমি চাই না মেয়েরা চুপ থাকুক।” কেউ আবার লিখছে—“ভালোবাসা যেন আঘাতের নাম না হয়।”

এই বদলের কেন্দ্রে এখন মালবিকা সেন। অশোক সেনের কেসের রায় ঘোষণার ঠিক এক মাস পরে মালবিকা এখন পুরোপুরি ব্যস্ত—স্ক্রিপ্ট লেখা, সাক্ষাৎকার দেওয়া, আর পুরনো কাগজপত্র সাজানোয়।
রূপসী সিনেমা হল এখন আর ধুলোয় ঢাকা নয়। সেখানে বসছে ‘চাঁদপুর উইমেন রিল কাউন্সিল’-এর প্রথম বৈঠক। মালবিকা আর প্রিয়া সেন মিলে তৈরি করছেন এমন একটা জায়গা, যেখানে মেয়েরা এসে নিজের গল্প বলতে পারবে, কাউকে ভয় না পেয়ে।

একদিন এক স্কুলছাত্রী এসে বলে, “দিদি, আমি জানি না মায়ের বিয়ে ঠিক আছে কি না। আমি কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু তোমার ভিডিও দেখে সাহস পেয়েছি।”
মালবিকা চুপ করে শুনে। তারপর বলে, “কোনো ভয় নেই। তুমি শুধু নিজের ভিতরের কণ্ঠস্বরটাকে চুপ করতে দিও না।”

অন্যদিকে, অরিত্র তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে পুরো সময় দিচ্ছে ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্টে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে সে লিখছে—
“তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই—একজন মেয়ের ভালোবাসা থেকে উঠে আসা জ্বলন্ত যন্ত্রণা, যা একদিন বিদ্রোহ হয়ে দাঁড়ায়।”

মালবিকা একদিন অরিত্রকে বলে, “জানো, আগে ভাবতাম, ভালোবাসা হল কবিতা। এখন মনে হয়, ভালোবাসা হল দায়—কারও পাশে থেকে তাকে না হারানোর দায়। তুমি তো আমার সব ঝড়ের ভিতরেও থেকেছো।”
অরিত্র চোখ না তুলে বলে, “কারণ তুমি ঝড় হলেও, তুমি আমারই আকাশ।”

এক সন্ধ্যায়, রূপসী সিনেমা হলের বড় স্ক্রিনে প্রথমবার ‘তোমাকে ভালোবেসে মরে যাই’ নামক ডকুমেন্টারির প্রিমিয়ার হয়। ভেতরে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, স্কুলের শিক্ষক, হাউসওয়াইফ, টিনএজার, সকলেই বসে। স্ক্রিনে মালবিকার কণ্ঠ শোনা যায়—
“আমি মালবিকা সেন। আমার মা সুস্মিতা সেনের কণ্ঠস্বর হারিয়ে গিয়েছিল। আমি সেই হারানো শব্দকে খুঁজে বের করেছি। এবং আমি চিৎকার করে বলতে চাই—ভালোবাসা মানেই সহ্য করা নয়। ভালোবাসা মানে নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করা।”

প্রেক্ষাগৃহে কেউ হাত চাপড়ায় না। বরং শেষ হলে দাঁড়িয়ে নীরবে মাথা নোয়ায়। যেন সম্মান জানানো সেই মায়ের যন্ত্রণাকে, আর সেই মেয়ের সাহসকে।

মালবিকা আর অরিত্র বাইরে এসে দাঁড়ায়।
আকাশে তখন হালকা মেঘ, বাতাসে সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো এক নিঃশব্দ তৃপ্তি।
অরিত্র বলে, “এটা তোমার গল্প, কিন্তু এখন এ গল্প সবার।”
মালবিকা বলে, “তোমারও। কারণ তুমি না থাকলে এই গল্পটা থেমে যেত।”
তারপর মালবিকা হেসে বলে, “তুমি জানো, আমি ভয় পেতাম তোমাকে ভালোবাসতে?”
অরিত্র চমকে যায়, “কেন?”
“কারণ আমি ভাবতাম, যাকে ভালোবাসা যায়, সে একদিন হারায়। কিন্তু এখন বুঝেছি, সত্যিকারের ভালোবাসা পালায় না, পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে।”

রাতে ঘরে ফিরে মালবিকা আবার সেই চিঠিটা পড়ে। মায়ের হাতের লেখা, অদ্ভুত শক্ত এক ভাষা—
“তুমি যদি কোনোদিন সত্যি কাউকে ভালোবাসো, তাহলে তার জন্য পৃথিবী বদলে দিও। কাঁদো, ভেঙে পড়ো, আবার উঠে দাঁড়াও। কিন্তু নিজের ভিতরের মালবিকাকে কখনও হারিয়ে ফেলো না।”

এখন সেই মালবিকা হারায়নি। বরং অন্যদের খুঁজে বের করেছে, যারা নিজেদের গল্প বলতে ভয় পায়।

একদিন খবর আসে—অশোক সেন জেলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁকে স্থানান্তর করা হয়েছে এক সরকারি হাসপাতালে।
অনন্যা সেন এখন সরকারি প্রক্রিয়ায় ডিভোর্স কেস জিতেছেন। তিনি বলেন, “আমি এখন নিজেই দাঁড়িয়ে থাকতে শিখেছি। মালবিকার সাহস আমায় নতুন চোখ দিয়েছে।”

মালবিকা এই খবর শুনে কিছু বলেনি। শুধু জানালার পাশে বসে ছিল অনেকক্ষণ।
অরিত্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি একটুও কষ্ট পাচ্ছো?”
মালবিকা মাথা নাড়িয়ে বলল, “কষ্ট না। হয়তো একটু ফাঁকা লাগছে। আমি যার বিরুদ্ধে এতদিন লড়েছি, সে আজ দুর্বল। কিন্তু আমি জানি, এই ফাঁকাটা পূরণ করবে আমার কাজ। আমি থামব না।”

শেষ দৃশ্যে মালবিকা দাঁড়িয়ে থাকে রূপসী সিনেমা হলের ছাদে। বাতাসে উড়ছে এক ব্যানার—
“ভালোবাসা মানে প্রতিবাদ, যদি তাতে সম্মান না থাকে।”

আর ক্যামেরা ধীরে ধীরে জুম আউট করে দেখায়—
এক শহর, এক মেয়ে, আর এক চিৎকার—যা এবার আর থামবে না।

(সমাপ্ত)

1000018788.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *