Bangla - প্রেমের গল্প

তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়

Spread the love

নৈঋতা সেন


হারানো জিনিস, পাওয়া কবিতা

কলকাতা বইমেলা। ফেব্রুয়ারির শেষ বিকেল। বাতাসে পাতা ওড়া, চায়ের গন্ধ, আর সেই চিরচেনা হালকা গুঞ্জন—যা একসঙ্গে উত্তেজনা আর একাকীত্ব বয়ে আনে। অভিজিৎ তাড়াহুড়ো করে ঢুকেছিল মেলার গেট দিয়ে, একহাতে ব্যাগ, অন্যহাতে ফোনে কেউ একজনকে জানাচ্ছিল, “হ্যাঁ রে, আমি ঢুকে গেছি… স্টল নম্বর ৪১ এ আয়, হ্যাঁ, যেখানে ধ্রুব সাহিত্য আছে… ওটা সামনেই।”

হঠাৎ একটা ধাক্কা। কে যেন পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওর কাঁধে লেগে গেল। স্যরি বলার সুযোগও দেয় না। আর ওর হাতে থাকা ফোনটা আচমকাই পড়ে গেল মানুষের ভিড়ের মধ্যে। অভিজিৎ নিচু হয়ে খুঁজতে চায়, কিন্তু চারপাশে লোক, হাঁটা, জুতো, ধুলো—সবকিছু মিলিয়ে ফোনটা যেন জলে ফেলা পয়সা হয়ে যায়।
পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট—অবশেষে একপ্রকার হাল ছেড়ে দেয় সে। “গেলো রে,” নিজের মনেই বলে ওঠে।

স্টল ৪১-এর দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে, ফোনে তেমন কিছু ছিল না—তবুও মনে হচ্ছিল, একটা নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে যেন। মনের ভিতরে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছিল, ঠিক যেমনটা হয় কোনো পুরোনো বন্ধু হঠাৎ কথা বন্ধ করে দিলে।

স্টলে এসে পৌঁছলে বন্ধুদের পায় না। ওর চোখ পড়ে স্টলের একপাশে রাখা পুরোনো বইয়ের ঝুড়িতে। এমনিতে অভিজিৎ নতুন বই পড়তেই পছন্দ করে, কিন্তু আজ যেন হঠাৎ কিছু একটার টান অনুভব করে সে।
একটা পাতলা, মলিন কাভারের বই তুলে নেয়—“ছায়ার পাশে দাঁড়িয়ে” নামে একটা ছোট কবিতার বই। ভেতরে পাতাগুলো হলদেটে, কালি ফিকে। বইটা খুলতেই একটা ভাঁজ করা কাগজ নিচে পড়ে যায়।

মাটি থেকে তুলে সে দেখে—একটা হাতে লেখা কবিতা।

“যেদিন হারাবে সব শব্দ,
সেদিনও মনে রাখো—
আমি তোমার চুপ করে থাকা জানি।
যতবার ভিড়ের মধ্যে তোমার চোখ ঘুরেছে,
আমি ছিলাম, ঠিক পাশেই।
দেখনি শুধু, কারণ আমি ডাকিনি।”

হাতে লেখা অক্ষরগুলো মেয়েলি, কিন্তু স্থির। নাড়ায় অভিজিৎকে। সে কবিতাটা আরেকবার পড়ে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, এই কথাগুলো তার নিজের জীবনের মতো। ওর সেই ‘চুপ করে থাকা’ সময়, যখন সবাই পার্টি করে আর সে লাইব্রেরিতে থাকে। সেই ভিড়ের মধ্যে থাকা একা অনুভবগুলো। এমনকি ‘ডাকিনি’—এই লাইনটা যেন ওর সেই পুরোনো চিঠির মতো, যা সে এক মেয়েকে লিখেছিল কিন্তু কখনও পোস্ট করেনি।

“কে লিখেছে এটা?”
সে বইটার ভিতরে প্রথম পাতায় চোখ রাখে। “বিক্রয় করা হয়েছে—অর্পিতা দে, ক্লাস ১২, বালিগঞ্জ স্কুল।”
কিন্তু কবিতায় তো লেখিকা হিসেবে কিছু লেখা নেই। কাগজে নিচে শুধু একটা ছোট্ট ইঙ্গিত—
“পলাশের সময় হলে, স্টল ৭২।”

অভিজিৎ অবাক হয়ে যায়। এটা কি কাকতালীয়? না কি ইচ্ছে করে রাখা কিছু? সে ভাবে—যাওয়ার কী ক্ষতি? ফোন তো গেছেই, এখন গল্প যদি খুঁজেই নিতে হয়, তবে এ গল্পই হোক।

সে উঠে পড়ে হাঁটতে শুরু করে স্টল ৭২-এর দিকে। রাস্তার ধারে কিছু লাল পলাশ ফুল বিক্রি হচ্ছে।
তার মাথায় ঘোরে সেই শব্দ—পলাশের সময় হলে…”

মেলার ওই অংশে আসতেই সে দেখতে পায়, স্টল ৭২ এক ছোট প্রকাশনার। নাম—”নীল শালিক পাবলিকেশন”। বাইরে কিছু ছাপাখানার কাগজ ছড়ানো। মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল, আর তার এক পাশে বসে এক মেয়ে—চুল খোলা, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, সাদা কুর্তায় লাল পাড়ের ওড়না।

সে লেখার মধ্যে ডুবে আছে, যেন চারপাশের কোলাহল তাকে ছুঁতেই পারছে না।

অভিজিৎ একপা এগিয়ে থেমে যায়। সাহস করে বলে ওঠে, “এই… আপনি কি… অর্পিতা দে?”

মেয়ে মুখ তুলে চায়। চোখে একটা শান্ত অথচ সাহসী দীপ্তি। বলে, “না, আমি অর্পিতা নই। কিন্তু আপনি বোধহয় একটা কবিতা পেয়েছেন, তাই না?”

অভিজিৎ থমকে যায়। গলার স্বর শুকিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন?”

মেয়েটি হেসে বলে, “এই বইমেলায় সব কিছু বিক্রি হয় না। কিছু জিনিস কেবল পাওয়া যায়—ঠিক লোক যখন হারিয়ে ফেলে তখন। হয়তো আপনিও সেইরকম কেউ।”

অভিজিৎ এবার বসে পড়ে সামনের চেয়ারে।

মেয়েটির নাম কী? কবিতার পরবর্তী পঙক্তি কি সে দেবে? আর এই খেলা—এটা কি কেবল কাকতাল, না কি কোনো পুরোনো লেখা গল্পের নতুন অধ্যায়?

পরবর্তী পর্বে, আমরা জানব সেই মেয়েটির পরিচয়, আর এক নতুন কবিতার পঙক্তির সাথে শুরু হবে আরেক সন্ধ্যা…

ছায়া হয়ে থাকা মেয়েটি

অভিজিৎ বসে পড়ে সামনের প্লাস্টিকের চেয়ারে, বুকের মধ্যে যেন ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক ধোঁয়াটে প্রশ্নের জঙ্গল। মেয়েটির চোখে সরলতা আছে, কিন্তু সেই সরলতার আড়ালে একটা ধাঁধা লুকিয়ে আছে, যেটা সে অনায়াসে খুলে দেখাচ্ছে না।

“আপনি জানলেন কী করে?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করে।

“এই বইমেলায় অনেকেই হারায়,” মেয়েটি বলে, চোখ নামিয়ে। “কেউ ফোন হারায়, কেউ মন… কেউ শুধু নিজেকে। আমি শুধু অপেক্ষা করি, কে এসে খুঁজে পাবে সেই কবিতাটা।”

“মানে?” অভিজিৎ একটু চমকে ওঠে।

“মানে… আপনি যদি সত্যিই পড়েন, তাহলে বুঝবেন—কবিতাটা কেবল লেখা হয় না, অনুভব করা হয়। আর যে সেটা অনুভব করে, সে-ই খোঁজে… ঠিক যেমন আপনি এলেন।”

অভিজিৎ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটির মুখে কোনো হাসি নেই, কিন্তু কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা ওকে আরেকটু ভিতরে টেনে নিয়ে যায়।

“আপনার নামটা কি…?” ও জিজ্ঞেস করে।

মেয়েটি এবার একবার চেয়ে নেয় ওর দিকে, তারপর উত্তর দেয়—“তিয়াসা।”

তিয়াসা… নামটার মধ্যেই যেন জল আছে, তৃষ্ণা আছে, আবার স্থিরতাও আছে। অভিজিৎ নিজের অজান্তেই নামটা মনে মনে কয়েকবার বলে ফেলে।

“তাহলে, এই সব কবিতা… আপনি লিখছেন?” সে জানতে চায়।

“সব না। কিছু আমি লিখি, কিছু আসে—নিজে থেকেই। আপনি যে কবিতাটা পেয়েছেন, সেটা আমি লিখেছিলাম ঠিক, কিন্তু… সেই লেখাটাও তো আমার একা না, আপনি না থাকলে সেই অনুভবটাই হত না।”

এই কথা শুনে অভিজিৎ নিজেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এ কি কেবল বইমেলায় হঠাৎ এক অচেনা মেয়ের সঙ্গে দেখা? না কি এটা অনেক আগে থেকে লেখা একটা গল্প, যার পাতাগুলো সে খুঁজে পাচ্ছে এবার?

“আরও থাকবে?” সে জিজ্ঞেস করে, নিজের অজান্তেই।

তিয়াসা এবার হালকা হেসে বলে, “স্টল ৯৫। ‘আলো ও ছায়া’ নামে এক পুরোনো পত্রিকা বিক্রি হয়। দ্বিতীয় সংখ্যা নাও—ভেতরের শেষ পাতায় আরেকটা কবিতা আছে, আমার নয়, তবু তোমারই লেখা।”

“আমার?” অভিজিৎ থমকে যায়। “মানে?”

“সব লেখা কি নিজের হাতে লিখতে হয়?” তিয়াসা বলে। “কিছু লেখা হয়, কেবল উপস্থিতি দিয়ে।”

এইবার অভিজিৎ উঠে দাঁড়ায়। একটা কৌতূহলের আগুন যেন বুকের ভেতর জ্বলছে। সে যেতে চায়, কিন্তু যেতে গিয়ে আবার থেমে যায়।

“আচ্ছা, আমরা আবার… দেখা হবে তো?” সে জিজ্ঞেস করে।

তিয়াসা বলল, “বইমেলার গল্প কখনও শেষ হয় না। শুধু পাতায় পাতায় বদলায়।”

অভিজিৎ একবার আরেকবার তাকিয়ে নেয় ওর দিকে। ছেলেটা সাধারণ, তবু আজ যেন তার ভিতরের কেউ একজন জেগে উঠেছে—যে কবিতা বোঝে, যে অনুভব করে, আর যে নিজেকে হারিয়েও খুঁজে নিতে চায়।

স্টল ৯৫ খুঁজে পাওয়া সহজ হয় না। চারপাশে প্রচুর লোক, হাঁসফাঁস করা বাতাস, আর মাঝে মাঝে মাইকে ভেসে আসা ঘোষণা—“শেষ মুহূর্তের ডিসকাউন্ট চলছে, দ্রুত আসুন!”

অবশেষে একটা ছোট স্টলে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞেস করলে তিনি একটা পুরোনো খয়েরি বাঁধাই করা পত্রিকা এগিয়ে দেন—“আলো ও ছায়া, দ্বিতীয় সংখ্যা।”

অভিজিৎ খুঁজে পায় শেষ পাতায় একটা কবিতা। নিচে নাম লেখা নেই।

“সব শব্দ শেষ হলে
শুধু একটুখানি তাকানোই বাকি থাকে।
যদি মনে হয়, কেউ চেয়েছিল
ঠিক তোমার মতো—
জানবে, তুমি ছিলে কারো কবিতার শিরোনাম।”

অভিজিৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, বুকের ভিতর যেন কিছু একটা শব্দ না করে নড়ে ওঠে।
সে জানে না, তিয়াসা কে।
জানে না, কেন সে এমন করে বলে চলে যাচ্ছে ইশারায় ইশারায়।
কিন্তু সে এটা জানে—এই বইমেলায় তার সবচেয়ে দামি জিনিস ফোন নয়, এই কবিতাগুলো।

এগুলো কেবল ছাপার অক্ষর নয়—এগুলো যেন তাকে ফিরে দিচ্ছে তার হারানো কোনো নিজস্ব সত্তা।
আর সেই সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার পথের নাম—তিয়াসা।

চলবে…

পাতার আড়ালে যাদের কথা থাকে

স্টল ৯৫ থেকে ফিরে আসার সময় অভিজিৎ একটা অদ্ভুত হালকাভাব অনুভব করে। কবিতাটা সে যতবার পড়েছে, ততবার মনে হয়েছে কেউ যেন ওর ভিতরের না-বলা কথাগুলো শব্দ করে দিয়েছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—এটা তিয়াসা লেখেনি। কিন্তু তিয়াসাই ওকে এটার দিকে পাঠিয়েছে।
মানে কি? সে কি জানতো ওর কী লাগবে?

কয়েক কদম এগিয়েই আবার থেমে দাঁড়ায় অভিজিৎ। চারপাশে মানুষ হাসছে, বই কিনছে, সেলফি তুলছে—কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল, এরা সবাই একটা আলাদা জগতে আছে, আর সে এক ভেতরের খোঁজে ব্যস্ত।
সে পকেট থেকে বের করে সেই হলুদ কাগজে লেখা প্রথম কবিতাটা, আর তারপর ‘আলো ও ছায়া’র পত্রিকাটা।
দু’টোতেই ছিল সেই চোখের ভাষা, যা শব্দে ধরা পড়ে না, কিন্তু হৃদয়ে বাজে।

সে ভাবে, যদি এইরকম আরও কিছু কবিতা থাকে? যদি এগুলো মিলিয়ে একটা গল্প তৈরি হয়? যদি এইসব কবিতার মাঝে লুকিয়ে থাকে এক নিঃশব্দ প্রেমপত্র?

বইমেলার একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে সে চা নেয়—মাটির ভাঁড়ে গরম ধোঁয়া উঠছে। সামনে একটা ছোট ছাপাখানার স্টল, সেখানে দেখা যাচ্ছে পুরোনো পোস্টার, রঙচটা বাঁধাইয়ের বই, আর একপাশে একটা দেওয়ালে টাঙানো ঘোষণা—
আজ সন্ধে টায়—‘উল্টোদিকের মানুষ’—কবিতার পাঠ এবং আলাপচারিতা

নিচে ছোট করে লেখা—তিয়াসা চৌধুরী সহ আরও অনেকে।

অভিজিৎ চমকে যায়। তিয়াসার পুরো নাম জানতো না সে এখনো। এবার একটা সূত্র মিলল যেন। আর আজ সন্ধ্যেই সে কবিতা পড়বে।
ওর বুকের ভেতর কেমন যেন দুরুদুরু করছে।
কী বলবে সে? কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে?
এই যে ইশারায় ইশারায় এগোনো, তার একটা শেষ আছে তো?

সময় কাটে না আর। সে আশেপাশে ঘোরে, কিছু অদেখা স্টল ঘুরে দেখে। এক জায়গায় পুরোনো ক্যালিগ্রাফি করা কবিতার স্ক্রল পায়।
একটা নীল কাগজের স্ক্রলে লেখা কবিতা আবার চোখে পড়ে। লেখকের নাম নেই। শুধু নিচে আঁকা—একটা ছোট্ট ছায়া আর একজোড়া চোখ।

“আমি জানি না, তুমি আমায় খুঁজে পাবে কিনা।
আমি শুধু থাকি, প্রতিটা পাতার ফাঁকে।
যখন কেউ পড়ে, কিন্তু মন দেয় না—
তখনও আমি থাকি, ঠিক সেখানে।
কারণ আমি পাঠক নই,
আমি সেই লেখা,
যেটা তুমি ভুলে গিয়েছিলে।”

অভিজিৎ কবিতাটা পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এমনকি ওই স্ক্রলের দোকানদার এসে জিজ্ঞেস করেও ফেলে—”আপনি কি কিনবেন?”

সে উত্তর দেয় না। শুধু মাথা নাড়ে, আর চোখ তুলে দেখে সময়—বিকেল পাঁচটা পঁচিশ।
তারপর বুকের ভিতর ছেঁড়া চিঠির মতো সব ভাবনা নিয়ে ছুটে যায় সেই ঘোষণার জায়গায়, যেখানে সন্ধে ছ’টায় হবে কবিতা পাঠ।

স্টেজের পাশে জায়গা কম। সে পিছনের একটা চেয়ারে বসে। চারপাশে কবিতাপ্রেমী দর্শক, কেউ নোট নিচ্ছে, কেউ মোবাইলে রেকর্ডিং চালু করছে।
স্টেজে ওঠেন এক বৃদ্ধ কবি, তারপর এক তরুণ, তারপর আরও কেউ কেউ।
অবশেষে মাইকে ডাকা হয়—“এবং এখন, কবিতা পাঠ করবেন তিয়াসা চৌধুরী।”

অভিজিৎ হাঁপ ছাড়ে না, বরং নিশ্বাস আটকে রাখে।

তিয়াসা স্টেজে ওঠে। আজ সে পরেছে গাঢ় নীল একটা কুর্তা, আর সাদার ওপর পাতলা রূপোলি পাড়ের ওড়না। চোখে এখনও সেই পাতলা ফ্রেমের চশমা, আর হাতে ধরা একটা খাতা।

সে বলে, “এই কবিতাটা আমি কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখিনি। কিন্তু কেউ যদি পড়ে বুঝতে পারে, তাহলে হয়তো সেটা ওর জন্যই লেখা।”

“ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকো,
আমি দেখব—তোমার চোখ নামিয়ে রাখা মুখ।
শব্দের ভেতরে থেকো না,
আমি খুঁজব—তোমার চুপ করে থাকা মন।
কারণ সবাই ভালোবাসে নাম ডেকে,
আমি ভালোবাসি—না বলা সবটুকু।”

অভিজিৎ বুঝে যায়—এই কবিতা, এই মুহূর্ত, এই বইমেলা—সব কিছুর ভিতর দিয়ে সে আসলে এক নতুন নিজের দিকে এগিয়ে চলেছে।
আর তার পথপ্রদর্শক, তিয়াসা, একটা কবিতার ছায়া।

সন্ধ্যা নামে, আলো কমে আসে, কিন্তু অভিজিৎ-এর চোখে আলো বাড়ে।
তিয়াসা মঞ্চ থেকে নেমে যায়, দর্শকদের মধ্যে মিশে যায়—কিন্তু অভিজিৎ জানে এবার তাকে খুঁজতে হবে না।

এইবার সে এগিয়ে যাবে।

সেই মুখ, যেটা লেখা ছিল কবিতায়

কবিতা পাঠ শেষ হতেই আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভিড়। মঞ্চের চারপাশে কবিপ্রেমী, কলেজপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে, কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে, কেউ প্রশ্ন করছে—”আপনি কেন এমন লেখেন?” কিংবা “এই কবিতার পেছনের মানুষটা কে?”
তিয়াসা হেসে, মাথা ঝাঁকিয়ে, মৃদু স্বরে সেসব সামলাচ্ছে।

অভিজিৎ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কিছু বলতে পারছিল না। ওই চোখের ভাষাটা—যেটা সে কবিতার ভাঁজে পেয়েছিল—সেটা এখন সামনে, জ্যান্ত। কিন্তু বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুকের ভিতর কেমন যেন দুর্বল হয়ে যায়। মনে হয়, যদি কিছু বলে ফেলে ভুল? যদি সে ভুল পাঠক হয়?

তিয়াসা একসময় চোখ তুলে তাকায়। ঠিক অভিজিৎ-এর দিকে নয়, কিন্তু ওর দিকটায়। সেই মুহূর্তটা একটা কবিতার পঙক্তির মতোই—হালকা, কিন্তু স্পষ্ট।

অভিজিৎ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।

“তিয়াসা…”
তিয়াসা মুখ ঘোরায়। এবার চোখে চোখ। কিছু চমক নেই, বরং একটা চেনা আলোর মতো শান্তি।

“তুমি এসেছো, জানতাম,” সে বলে।

“তুমি জানলে কী করে?” অভিজিৎ অবাক হয়।

“কারণ তুমি পড়েছিলে। সবাই পড়ে না, কিন্তু তুমি পড়েছিলে… মন দিয়ে। সেইজন্যই তো তুমি এখানে।”

অভিজিৎ হেসে ফেলে, হালকা মাথা নাড়ায়। “এইসব কথাগুলো… সব যেন কবিতার মতো শোনাচ্ছে।”

“জীবনের ভালো জিনিসগুলো আসলে কবিতার মতোই হয়। অতটা বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়।”

তারপর একটা মুহূর্ত নীরবতা।

তিয়াসা বলে, “তুমি কি আমার কিছু বলতে চাও?”

অভিজিৎ থেমে যায়। বলে, “হ্যাঁ, বলতে চাই। আমি জানি না তুমি কে, আমি জানি না এসব তুমি কীভাবে লিখো। কিন্তু এতদিন পরে আমার মনে হচ্ছে—আমি কাউকে চিনে ফেলেছি। যাকে আগে কখনও দেখিনি। কেবল পড়েছি… কাগজে, পাতায়, আর এখন এই মুখে।”

তিয়াসা চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “তুমি কবিতা লেখো না, তাই তো?”

“না… লিখিনি কখনও।”

“তবুও একটা কবিতা তোমার ভেতরে ছিল। আমি শুধু সেই কবিতার ছায়াটা খুঁজে পেয়েছিলাম। তুমি যদি চাও, তুমি লিখতেই পারো।”

এই কথাটাই যেন অভিজিৎ-এর জীবনের প্রথম প্রশংসা। কেউ ওকে এত স্পষ্টভাবে চিনেছে বলে মনে পড়ে না তার।

তারপর তিয়াসা ওর হাতে একটা ছোট খাম তুলে দেয়।

“এটা কাল স্টল ১৪৮-এ জমা দিও। ওটা ‘স্বপ্নসূত্র’ পত্রিকার জন্য। তোমার লেখা চাই।”

অভিজিৎ অবাক হয়ে খামটা নেয়। খামটা ভিতর থেকে উষ্ণ, যেন কোনো শরীরের গরম হাত থেকে এসেছে।
সে বলতে যায়, “কিন্তু আমি তো লিখি না…”

তিয়াসা বলে, “তাই তো আজ থেকে শুরু করো। আমি দেখেছি, তুমি কীভাবে পড়ো। এখন চাই, তুমি জানো—তোমার চোখ দিয়ে কবিতা কেমন লেখা হয়।”

ভিড় কমে আসে। বাতি নেভে। দূরে কে যেন হারমোনিয়ামে ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ বাজাতে শুরু করে।

অভিজিৎ তিয়াসার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা পাথরের গায়ে যদি লতা জড়িয়ে থাকে, সে যেমন কৃতজ্ঞ হয় ছায়ার জন্য, তেমনই তিয়াসা ওকে জড়িয়ে ছিল একটা নিঃশব্দ সাহস দিয়ে।

“আমরা আবার কি দেখা করব?” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করে।

তিয়াসা হেসে বলে, “বইমেলায় দেখা একবার হয় না। বারবার হয়, শুধু স্টলটা বদলায়। আর গল্পের পর গল্প জুড়ে, আমরা একেকবার নতুন করে চিনে নিই।”

অভিজিৎ কিছু বলে না। সে শুধু মাথা ঝাঁকায়।
চলে যাওয়ার সময় সে পেছন ফিরে একবার তাকায়—তিয়াসা তখন অন্য কারও কবিতা শুনছে মন দিয়ে। সেই মুহূর্তে ওকে যেন তার নিজের গল্পের প্রথম পাঠক মনে হয়।

হাওয়ার নিচে জমা থাকা চিঠি

পরদিন সকালে অভিজিৎ খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। বইমেলার দিকে রওনা দেবার আগে বারান্দায় বসে খামের ভেতরের কাগজটা আবার একবার দেখে নেয়।
সাদা কাগজ, ওপরে মাথা ঘামানো কোনো নির্দেশ নেই। নিচে শুধু ছোট করে লেখা—
যা তুমি বলতে চাও, সেটা লিখো।
যা বলতে পারো না, সেটাই কবিতা।
—তিয়াসা

ওর মনে পড়ে, কবে শেষবার কাগজে কিছু লিখেছে সে? হয়তো স্কুলে, ইংরেজি পরীক্ষায়, একটা রচনায়।
তারপর সবটাই টাইপ করা, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, মেইল। হাতের লেখা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।

কিন্তু আজ সকালে, যেন পুরোনো কিছু ফিরে আসে।
ও কাগজে কলম ছোঁয়ায়।

“তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়—
ভিড়ের মধ্যেও আলাদা ছিলে।
তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক শব্দ,
কিন্তু আমি খুঁজে পেলাম একটামাত্র চেহারা।
যেটা বোঝে, যেটা জেনে যায়,
আর যার চোখে
আমি নিজেকে দেখি।”

এই চার লাইনের পর কলম থেমে যায়। তবুও অভিজিৎ জানে, এইখান থেকেই শুরু।

স্টল ১৪৮ খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়। সে গেট দিয়ে ঢুকে, মানচিত্র দেখে, চারদিক ঘুরে শেষমেশ পৌঁছয় এক শান্ত কোণের দিকে—যেখানে বড়ো কোনো ব্যানার নেই, নেই চিৎকার, নেই প্রচার। শুধু কয়েকটা চেয়ারে বসে কয়েকজন তরুণ, কারও হাতে খাতা, কারও হাতে মোবাইল।

সামনে টেবিলে ছোট একটা পেপারবক্সে লেখা—
স্বপ্নসূত্রকবিতার খামে জমা দিন

অভিজিৎ নিজের খামটা ওদের হাতে দেয়। একজন মেয়ে হেসে নিয়ে বলে, “তোমার নাম?”

সে একটু থেমে বলে, “অভিজিৎ। প্রথমবার… জমা দিচ্ছি।”

মেয়েটি বলে, “ভালো তো! তিয়াসা আমাদের লেখক। ও-ই বলেছে কিছু খাম আসবে আজ। তুমি হয়তো তারই পাঠানো একজন।”

এই লাইনটা শুনে বুকের মধ্যে হালকা একটা গর্জন ওঠে। ‘তার পাঠানো একজন’।
কী আশ্চর্য এই ভাষা!
কত সহজে সে হয়ে যাচ্ছে কারও কবিতার প্রেরণা!

স্টল থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে থাকে aimlessly, যেন পথ খুঁজছে না—বরং খুঁজছে নিজেকে।
মাঠের একপাশে পুস্তক-প্রদর্শনীর ফাঁকা কর্নারে গিয়ে বসে পড়ে সে। সামনে উঁচু হ্যাঙ্গার ঝোলানো, সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কবিতার পঙক্তি লেখা—যেমনঃ
ভালোবাসা মানে হারিয়ে যাওয়ার সাহস
প্রতিবার ভাঙা মানেই নতুন ছন্দের সূচনা

একটা পঙক্তির নিচে লেখা—তিয়াসা চৌধুরী, ২০১৯
তাহলে ও অনেকদিন ধরেই লিখছে। শুধু লেখেনি, নিজেকে রেখে গেছে শব্দে শব্দে।

তখনই পিছন থেকে একটা চেনা গলা—
“তুমি ঠিক পথেই এসেছো।”

অভিজিৎ ফিরে তাকায়—তিয়াসা।

আজ ওর পরনে লাল পাড়ের শাড়ি, খোলা চুলে একটা ছুঁচোচোখা চাওয়া। মনে হয়, যেন কবিতা আজ হাঁটছে বইমেলার পথে।

“তুমি কীভাবে জানলে আমি এখানে থাকব?”
তিয়াসা হেসে বলে, “যেখানে লেখা পড়ে—সেখানে লেখা এসে দাঁড়ায়।”

অভিজিৎ ওর পাশে বসে।

একটু চুপচাপ সময় কাটে। তারপর তিয়াসা বলে, “তুমি কি জানো, কবিতা কাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়?”

“কাকে?”

“ভুল পাঠককে। যে পড়ে, কিন্তু বোঝে না। যে শব্দ দেখে, কিন্তু অনুভব করে না। তুমি সেটা নও। সেইজন্যই তো আমি খুঁজেছিলাম, আর পেয়েছি।”

অভিজিৎ কিছু বলে না। শুধু ভাবে, এই মেয়েটা ওর ভিতরের অনুভবগুলো কেমন যেন ঝরনার মতো টেনে আনে। এমনকি কিছু না বললেও, ওর মনে হয়, তিয়াসা সব জানে।

“তুমি কি কোনোদিন ভালোবাসা নিয়ে লিখেছিলে?”
এই প্রশ্নটা হঠাৎই করে ফেলে অভিজিৎ।

তিয়াসা একটু থামে। চোখ নামিয়ে ফেলে। বলে, “হ্যাঁ। লিখেছিলাম। একটা নামহীন মানুষকে নিয়ে। যে ছিল, আবার ছিল না। আমি তাকে হারাইনি… সে নিজেই হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার ছায়া রয়ে গিয়েছিল কবিতায়।”

এই লাইনটা শোনার পর অভিজিৎ বুঝে যায়—তিয়াসারও কোনো না বলা গল্প আছে।
যে গল্প হারিয়েছে বাস্তবে, কিন্তু কবিতায় বেঁচে আছে।

তিয়াসা উঠে দাঁড়ায়। বলে, “চলো, আজ তোমাকে একটা স্টলে নিয়ে যাই, যেখানে বই কিনলে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে।”

“প্রশ্ন?”
“হ্যাঁ, ‘তুমি কী হারিয়েছো?’—উত্তর দিলে বইটা অর্ধেক দামে মেলে।”

অভিজিৎ হেসে ফেলে।

সে ভাবে, কী হারিয়েছে?
একটা ফোন?
একটা একাকীত্ব?
না কি, কোনো কবিতার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই পুরোনো নিজেকে?

হারানোর নামেই রাখা প্রেমের ঠিকানা

বইমেলার শেষের দিক। হাওয়ায় জমা ধুলো, বিকেলে মাইকের গলা ভারী হয়ে আসে, আর অনেক স্টলে দেখা যায় “শেষ দিনে ছাড়” লেখা পোস্টার।
তিয়াসা ও অভিজিৎ হাঁটছিল স্টলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে।
তিয়াসা সামনে, অভিজিৎ পেছনে—তবু মনে হচ্ছিল ওরা পাশাপাশি চলছে, এমনকি বাক্যহীনতাও যেন সংলাপ হয়ে উঠছিল।

একটা স্টলের সামনে এসে তিয়াসা দাঁড়িয়ে পড়ে। ছিমছাম কাঠের সাজ, গাঢ় নীল কাপড় দিয়ে মোড়া ছাদ, আর তার ওপরে সাদা হাতে আঁকা অক্ষরে লেখা—
হারিয়ে ফেলেছো কিছু? বই আছে তার জন্য।

অভিজিৎ চোখ তুলে দেখে, এক কোণে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ। চশমার ফ্রেমের ভেতর তাঁর চোখে ছিল শান্ত গভীরতা।
তাঁর সামনে একটা বোর্ডে লেখা—
একটা বই চাইলে, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে: তুমি কী হারিয়েছো?”

তিয়াসা মুচকি হাসে। বলে, “তুমি বলো।”

অভিজিৎ একটু থেমে যায়।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার সে স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল তার প্রিয় কলমটা হারিয়ে গেছে।
তারপর কলেজে, এক বন্ধুকে হারিয়েছিল—যে আজও ফোন করে না।
তারপর, নিজেকে হারিয়েছিল—যখন অফিস আর যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে সে লিখতে ভুলে গিয়েছিল।

সে ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, “আমি হারিয়েছি… আমার ভিতরের লেখককে।”

বৃদ্ধ হাসেন। বলেন, “তাহলে এই বইটা তোমার।”
একটা পাতলা, ছাই রঙের মলাটের বই এগিয়ে দেন তিনি। উপরে লেখা—
যে নিজেকে লেখে”— লেখক: অনির্বাণ

অভিজিৎ অবাক হয়। লেখকের নাম সে চেনে না, কিন্তু শিরোনামে যেন নিজেকেই দেখে।

তিয়াসা পাশ থেকে বলে, “আমি জানতাম, তুমি ওটাই পাবে। এই বইটা আমি তিন বছর আগে প্রথম পড়েছিলাম। আর তারপর থেকেই আমি মানুষকে খুঁজে বেড়াই, যারা হারিয়েছে, কিন্তু খুঁজছে না। আমি চাই—তারা খুঁজুক। তোমার মতো।”

“তুমি নিজে কী বলেছিলে?”
“আমি বলেছিলাম, আমি হারিয়েছি বিশ্বাস। আর তখন আমাকে একটা কবিতার বই দেওয়া হয়েছিল—‘শব্দের ওপারে যে চুপ করে আছে।’”

এই কথাগুলো বলার সময় তিয়াসার গলার স্বর আরেকটু নরম হয়ে আসে।
অভিজিৎ ভাবতে থাকে—এই মেয়েটা কি সত্যিই কবিতা দিয়ে মানুষ গড়ে তোলে?

হঠাৎ একঝাঁক হাওয়া ওঠে। স্টলের টেবিলের ওপর রাখা পত্রিকার পাতাগুলো উড়ে যায়।
একটা পৃষ্ঠা ওদের দিকে উড়ে এসে পড়ে। তিয়াসা সেটাকে তুলে নেয়, আর পড়ে—
যদি তুমি কাউকে চাও, যাকে তুমি চিনো নাতবে সেটা কবিতা নয়, সেটা প্রেম।

তিয়াসা এক মুহূর্ত থেমে অভিজিৎ-এর দিকে চায়।
কিছু বলে না।
কিন্তু সেই চাওয়ায় ছিল এমন কিছু, যা শব্দে নামানো যায় না।

তারা হাঁটতে শুরু করে আবার। সন্ধে নামছে। হালকা আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে, আর পেছনে বইমেলার স্পিকার গেয়ে উঠেছে রবীন্দ্রসংগীত—যে তোমায় ছেড়ে চলে গেল…”

“তুমি কি জানো, তিয়াসা,” অভিজিৎ বলে, “তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার মনে হয়, আমি আর আগের মতো নেই। কেমন যেন ভিতর থেকে বদলে গেছি। একেকটা কবিতার ভাঁজে যেন আমি নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি।”

তিয়াসা হেসে বলে, “তাই তো কবিতা। তুমি যখন নিজেকে খুঁজে পাও অন্য কারও লেখায়, তখন সেটাই আসল সংযোগ। তুমি কি জানো, আমি কখন জানি কেউ আমার লোক হয়ে উঠেছে?”

“কখন?”

“যখন সে আমার লেখা পড়ে, কিন্তু লেখার বাইরে যে আমি, তাকেও দেখতে চায়। শুধু শব্দে থাকলে হয় না, ফাঁকে ফাঁকেও থাকতে হয়।”

অভিজিৎ থেমে দাঁড়ায়।

একটু ঝুঁকে ও বলে, “তুমি কি আমায় খুঁজতে চেয়েছিলে আগে থেকেই?”

তিয়াসা বলে না। শুধু চায়।

তাদের সামনে একটা ছোট চেয়ার পড়ে আছে মাঠের কিনারায়। তারা দু’জন বসে পড়ে সেখানে। পাশে চায়ের দোকান থেকে দুটো মাটির ভাঁড় আসে।

এই মুহূর্তে মনে হয়, বইমেলার সব আলো, শব্দ, ভিড়—সব মিলিয়ে একটা গোপন জগৎ তৈরি হয়েছে, যেখানে কেবল দু’জন মানুষ, আর তাদের মধ্যে একটা অদেখা, অশব্দ সংলাপ চলছে।

তিয়াসা বলে, “এই বইমেলা শেষ হয়ে যাবে। স্টলগুলো গুটিয়ে যাবে। কিন্তু যদি তুমি লেখো… সত্যিকারের লেখো… তাহলে এ গল্প শেষ হবে না।”

অভিজিৎ মাথা নাড়ে।
সে জানে—এবার শুরু করতে হবে।

অটোগ্রাফহীন বই আর নাবলা নাম

বইমেলার শেষ দিন। মাঠের ধুলোয় গন্ধ কম, বিদায়ের টান বেশি। দুপুর গড়িয়ে গেলে লোকসংখ্যা একটু কমে আসে, কিছু কিছু স্টল এর মধ্যেই ভেঙে ফেলা শুরু হয়েছে। সেই চিরচেনা রব উঠে যায়—“আগামী বছরে আবার দেখা হবে।”

অভিজিৎ এবার একা এসেছে। তিয়াসা বলেছিল, আজ ওর একটা ছোট্ট পাঠ আছে, কিন্তু বলা হয়নি কোথায়। শুধু বলেছিল—“যদি ঠিকঠাক লেখো, আমি নিজেই খুঁজে নেব।”
এই লাইনটার মানে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ও জানে, তার পথ এখনো শেষ হয়নি।

ওর ব্যাগে একটা ছোট্ট খাতা—নিজের লেখা দিয়ে ভর্তি। প্রথম কবিতাটা, যেটা শুরু হয়েছিল “তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়”—তার পাশে এখন আরও সাতটি কবিতা আছে।
সবগুলোই তিয়াসাকে নিয়ে নয়, কিন্তু সবগুলোতেই তিয়াসা রয়ে গেছে।
কখনও শব্দে, কখনও বিরামচিহ্নে।

অভিজিৎ এবার নিজের মতো করে ঘোরে—স্টল ২২, স্টল ৪৭, পুরোনো বাংলা গল্পের দোকান, ছোট প্রকাশনা যেখানে দাম লেখা নেই—যেখানে দোকানির মুখ দেখে দাম বলে দিতে হয়।

একটা স্টলে হঠাৎ চোখে পড়ে পুরোনো ‘রবিবারের কাগজ’—বিভিন্ন পত্রিকার পুরোনো সাহিত্য সংখ্যাগুলি।
ও টানতে টানতে একটা পাতলা সংখ্যা বের করে। কাগজ হলদে হয়ে গেছে, তার ভিতরে একটা ছোট্ট কবিতা চিত্রাঙ্কনের পাশে লেখা—
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি তোমার ছায়া হব।
— লেখক নাম নেই।

নিচে একটা স্বাক্ষর আছে, কিন্তু অস্পষ্ট।

ও বইটা কিনে নেয়। না, কারণ নয় জানে, কিন্তু মনে হয়—এটা যেন কথা বলছে ওর সঙ্গে।

চায়ের দোকানে বসে খোলা পাতায় চোখ রেখে অভিজিৎ ভাবতে থাকে—এবার কী?
তিয়াসা কি আবার দেখা দেবে?
না কি এটাই ছিল তাঁর গল্পের শেষ অধ্যায়?

ঠিক তখনই পাশে এসে বসে এক মাঝবয়সী মহিলা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস।

“তুমি অভিজিৎ তো?”
অভিজিৎ চমকে ওঠে।
“আমি তিয়াসার মা,” মহিলা বলেন। “আজ সকালেই ও আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল—‘যদি অভিজিৎ নামটা শোনেন, তাহলে এটা দিয়ে দেবেন।’”

অভিজিৎ কাঁপা হাতে খামটা নেয়।
ভেতরে একটামাত্র পৃষ্ঠা।

“তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়
যখন তুমি নিজের গল্প হারিয়ে ফেলেছিলে।
আমি শুধু একটুকরো আয়না তুলে ধরেছিলাম—
যাতে তুমি নিজেকে দেখতে পাও।

এখন তোমার হাতে কলম আছে, খাতা আছে, শব্দ আছে।

আমাকে খুঁজো না আর।
আমি এখন তোমার প্রতিটা লেখা শব্দে থাকি।

তোমার—
যাকে তুমি কখনও ডাকোনি নাম ধরে,
তবু সব লেখা ওর দিকেই গেছে।”

অভিজিৎ চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। মনে পড়ে—না, সে কখনও তিয়াসার নাম ধরে ডাকেনি।
তিয়াসা—শব্দটা ওর কাছে সবসময় ছিল একটা অনুভব।
একটা মুখ, যেটা লেখা ছিল কবিতায়।

চোখ খোলার পর ও জানে, ওকে আর খুঁজতে হবে না।

ওর ভেতরে যে কবি জন্ম নিয়েছে, সে তিয়াসাকে ভুলবে না, কারণ তিয়াসা রয়ে গেছে ওর প্রতিটি লাইনের ভাঁজে।

চা শেষ হয় না, বইমেলা গুটিয়ে যায়, আলো নিভে আসে।
তবু ও জানে, এবার থেকে প্রতিটা বইমেলাই ওর কাছে একটাই গল্প বলবে—
তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়।

যে ভালোবাসা কবিতার পাতায় পড়ে থাকে

এক বছর পর।
আবার কলকাতা বইমেলা।
নতুন গেট, নতুন সাজসজ্জা, পুরোনো গন্ধ।
চায়ের স্টলে আবার ভিড়, আর সেই চিরপরিচিত ঘোষণা মাইকে—“প্রিয় বইপ্রেমীরা, স্বাগতম…”

অভিজিৎ এ বছর এসেছে লেখক হয়ে।

স্টল ৪৮, “স্বপ্নসূত্র প্রকাশন” থেকে বেরিয়েছে ওর প্রথম কবিতার সংকলন—হারিয়ে ফেলি বলেই খুঁজি
পাতলা বই, ছিমছাম নীল মলাট, উপরে কোনও ছবি নেই। শুধু ভিতরের কথাগুলো জেগে আছে।
প্রথম পাতার উৎসর্গে লেখা—
তাকে, যাকে কখনও নাম ধরে ডাকিনি। তবুও যিনি প্রতিটা শব্দের নেপথ্য সুর।

প্রথমদিনই বেশ কিছু বই বিক্রি হয়ে গেছে। কেউ কেউ এসে বলে—“এই যে, সেই অভিজিৎ না? যার কবিতা শুনলেই মনে হয় কেউ নিজের কথা লিখেছে?”

অভিজিৎ হেসে ওঠে। মাথা নাড়ে। ভাবে, এত শব্দের মাঝে একটা মানুষ নিজেকে খুঁজে পেতে পারে, এই ভাবনাটাই কী অসম্ভব সুন্দর।

স্টলের এক কোণে চুপ করে বসে সে চারপাশে তাকায়।
ভিড়, হাহাকার, খুশি, দৌড়ঝাঁপ—সব একসাথে বইমেলা নামক এই জীবন্ত চরিত্রটাকে বানিয়েছে।
তবু তার চোখ খুঁজে ফেরে একটা নির্দিষ্ট কিছু—না, কেউ, না, শুধু… একটা অনুভব।

তিয়াসা।

একবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সে আর আসেনি।
না ফোনে, না মেল-এ, না কবিতার কোন পাতায়।
শুধু থেকে গেছে অভিজিৎ-এর সমস্ত লেখার ভেতর।

সন্ধে নাগাদ এক ছাত্রী আসে বই কিনতে। বলে, “এই বইটার নামটাই তো একেবারে… যেন কারো জন্য লেখা!”

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করে, “কার জন্য?”

মেয়েটি হেসে বলে, “যে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আবার ফিরে আসবে না। তেমন কাউকে নিয়ে।”

সে মাথা নাড়ে। ভাবে, তিয়াসা কি কখনও ফিরে আসবে?
কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে—তিয়াসা বলেছিল, “আমাকে খুঁজো না। আমি থাকি তোমার প্রতিটা লেখায়।”

স্টলের ডানদিকের এক টেবিলে রাখা আছে ওর বইয়ের সাথে একটা খোলা খাতা—পাঠকদের প্রতিক্রিয়া লেখার জন্য।

সেখানে কেউ একজন লিখে গেছে—

“তোমার প্রতিটা লাইনের নিচে আমি হেঁটে বেড়াই।
তুমি হয়তো আমায় আর খুঁজো না,
তবুও আমি রয়ে যাই—
পাতার আড়ালে, ছায়ার পাশে,
এক অটোগ্রাফহীন ভালোবাসায়।”

নাম লেখা নেই।

কিন্তু হাতের লেখা?

অভিজিৎ চুপ করে বসে থাকে। খাতার পাতাটা ছুঁয়ে দেখে। বুকের ভিতর হালকা একটা স্পর্শ বাজে—না দেখা, না শোনা, শুধু অনুভবের।

তারপর সে নিজের বইয়ের এক কপি খোলে। প্রথম পাতায় লিখে—

“তোমাকে দেখেছিলাম বইমেলায়।
এখন দেখি প্রতিদিন,
যেখানেই শব্দ থাকে।”

সেই কপিটা আলাদা করে রাখে।
না বিক্রি করবে, না উপহার দেবে—এই বইটা শুধু থাকবে।
একটা কবিতার জন্য, একটা চোখের জন্য, আর একটা প্রেমের জন্য—যেটা কোনওদিন নাম পায়নি।

সূর্য নামতে শুরু করে। বইমেলার আলো জ্বলে ওঠে। ভিড় বাড়ে।
কিন্তু অভিজিৎ জানে, আজ তার কিছু কম নেই।
আজ সে শুধু একজন লেখক নয়—
সে একজন পাঠক, যাকে একদিন কবিতার পাতায় লিখে দিয়েছিল এক অচেনা মেয়ে।
যার নাম এখনো সে জানে, তবু মুখে আনেনি।
তবু জানে—ভালোবাসা সবসময় উচ্চারণে থাকে না, অনেকসময় সেটা শুধু থেকে যাওয়ায় রয়ে যায়।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-24-at-7.28.49-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *