Bangla - ভূতের গল্প

তেঁতুলগাছের চোখ

Spread the love

গ্রামের নাম ঘোলশ্বরীপুর। নদিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, পদ্মা নদীর এক পুরনো শাখার ধারে গড়ে ওঠা এই গ্রাম বহু শতাব্দীর পুরোনো। শস্যে ভরা মাঠ, ঘন বাঁশঝাড়, আর ভাঙন–খাওয়া কাদামাটি মেশানো গলিঘুপচি পথ দিয়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের বসতি। দিনের বেলা এখানকার জীবন ঠিক যেমন সরল, তেমনি হাসিখুশি; কিন্তু রাত নামলেই এক ভিন্ন ছায়া নেমে আসে এই জনপদে। গ্রামের সবচেয়ে বড় রহস্য হল মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল তেঁতুলগাছ। গ্রামের বৃদ্ধেরা বলেন, এই গাছ অন্তত চারশো বছরের পুরোনো। এর ছায়ার নীচে একসময় পুঁথি পাঠ হতো, বউভাতের ভোজ বসত, আবার মহামারীর সময় কবরও দেওয়া হয়েছে এরই তলায়। কিন্তু যত পুরোনো স্মৃতি তেঁতুলগাছ ঘিরে রয়েছে, ততই ভয়ঙ্কর হয়েছে এর কিংবদন্তি। গাছের কাণ্ডে একটি চোখের মতো দাগ দেখা যায়—যেন পাথরের ওপরে খোদাই করা। দিনে সূর্যের আলোয় সেটি স্রেফ অদ্ভুত খাঁজের মতো মনে হয়; কিন্তু গ্রামের লোকেরা শপথ করে বলে, রাত নামলেই সেই চোখ নাকি সত্যি খোলে। বাতাসে হালকা শোঁ শোঁ আওয়াজ, জোনাকির আলো ঝলকানি, আর হঠাৎ করেই ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সেই চোখ—যে একবার তাকায়, সে আর বাঁচে না। বহু বছর আগে নাকি গ্রামের এক রাখাল ছেলেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল গাছের তলায়। এরপর থেকে মানুষ রাতের বেলা ওদিকটায় হাঁটাহাঁটি করা বন্ধ করে দেয়।

রিতু ছিল ষোলো–সতেরো বছরের এক কিশোরী। পড়াশোনায় ভালো, কৌতূহলী, আর অল্প–বিস্তর দুষ্টুমিও করে। গ্রামের স্কুলে পড়ে সে, কিন্তু মনে মনে সবসময় বড় শহরের বই–খাতা আর রহস্যের গল্পে ডুবে থাকতে ভালোবাসে। তার বন্ধু হিমাংশু, বছর কুড়ির এক তরুণ, পাকা ধান কেটে সংসার চালায়, কিন্তু মনের ভেতরে আছে দারুণ সাহস আর যুক্তিবাদী মানসিকতা। অন্যদিকে মধু, বছর পনেরোর এক সরল মেয়ে, তাদের সঙ্গে সবসময় থাকে, যদিও ভয়ে ভয়ে। এই তিনজনই গ্রামের অন্য বাচ্চাদের মতো অনেকবার তেঁতুলগাছের গল্প শুনেছে। কোনো কোনো রাতে দূর থেকে দাঁড়িয়ে তারা গাছটাকে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সাহস করে কাছে যায়নি। এক বিকেলে, মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে হিমাংশু বলল, “শোন রিতু, এতদিন ধরে সবাই বলছে গাছটার চোখ নাকি রাতে খোলে। কিন্তু আমি একবারও তা দেখিনি। মানুষ কি শুধু ভয় দেখাবার জন্য এসব বানায় না?” রিতু উত্তর দিল, “আমিও তাই ভাবি। কিন্তু যদি সত্যি কিছু থাকে? গল্পগুলো তো এমনি এমনি তৈরি হয় না।” পাশে দাঁড়ানো মধু কেঁপে উঠল, “ওসব বলিস না। বদ্রি কাকা তো কতবার বলেছেন, রাতের বেলা ওই পথ এড়িয়ে চলতে।” কথাটা শুনে হঠাৎই মনে পড়ল তাদের সেই প্রতিবেশী বদ্রির কথা, যিনি গ্রামে ভয়ংকর গল্প শোনানোর জন্যই বিখ্যাত।

বদ্রি পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক লোক, চেহারায় দাগ, চোখে চশমা, আর কণ্ঠে সবসময় অদ্ভুত রহস্যের সুর। তিনি বলেন, এক সময়ে তাঁর নিজের চোখের সামনে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা, তিনি ছিলেন তখনো তরুণ। পূর্ণিমার রাতে বউভাত থেকে ফিরছিলেন, হঠাৎ দেখেন গাছের কাণ্ডে হালকা আলোর ঝলকানি। প্রথমে ভেবেছিলেন জোনাকি। কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই স্পষ্ট দেখতে পান, খাঁজের ভেতর থেকে যেন এক চোখ ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। সেই চোখে ছিল না কোনো মানবীয় অনুভূতি, না ছিল রাগ না দয়া—শুধুই গভীর অন্ধকার। আতঙ্কে তিনি দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন। সেই ঘটনার পর থেকে বদ্রির ভেতরে ভয়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত বিশ্বাস জন্ম নেয়। তাই তিনি বারবার বাচ্চাদের সতর্ক করেন—“রাতে ওই গাছের দিকে তাকাস না। চোখ খুললে জীবন্ত মানুষও পাথর হয়ে যায়।” গ্রামের লোকেরা বদ্রিকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও অদ্ভুতভাবে সবাই তাঁর সতর্কবাণী মেনে চলে। রিতু, হিমাংশু আর মধু প্রতিদিনই এইসব গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছে। তবুও তাদের ভেতরে এক ধরনের টান ছিল—কেন এত ভয়? কেন এত রহস্য? সত্যিই কি কোনো শক্তি আছে এই তেঁতুলগাছে?

সেই সন্ধ্যায়, শীতল হাওয়ায় গাছের দিকে তাকিয়ে তিন বন্ধু আবারও আলোচনা শুরু করল। রিতু একগাল হাসি দিয়ে বলল, “দেখ, গাছ তো আমাদের কতদিনের পুরোনো। দিনে কত মানুষ বসে গল্প করে, গরু–ছাগল বাঁধে। তখন তো কিছু হয় না। তাহলে রাতে হবে কেন?” হিমাংশু মাটিতে একটা কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল, “গল্পটা হয়তো অযথা ভয় ছড়ানোর জন্যই বানানো। হয়তো রাতের অন্ধকারে ছায়া আর বাতাসের খেলাই চোখ খোলার মতো মনে হয়।” কিন্তু মধু কেঁপে ওঠে, “না না, আমি শুনেছি বুড়ো মনোহর গত বছর ওই গাছের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর থেকে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারত না। কয়েক মাসের মধ্যে মারা গেল।” কথাটা শুনে রিতুর বুকের ভেতর ঠকঠক করে উঠল, যদিও সে চেপে রাখল। বদ্রি তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার কর্কশ গলায় বলল, “শোন, তেঁতুলগাছের চোখ কারও সাথে মজা করে না। গ্রামের যাদের দেখেছিস মারা গেছে বা অর্ধমৃত হয়েছে, তাদের সবার ইতিহাস ওই গাছের সঙ্গে জড়িত। এ কথা মনে রাখিস।” সন্ধ্যার হালকা অন্ধকারে তাঁর চোখে যেন অন্যরকম ঝিলিক দেখা গেল। তিন বন্ধু একে অপরের দিকে তাকাল। মধু আঁচল চেপে ধরল। হিমাংশু মুখে শক্ত ভাব আনল, আর রিতুর ভেতরে জন্ম নিল ভয় আর কৌতূহলের অদ্ভুত মিশ্রণ।

_

গ্রামে সেই রাতে কেমন যেন অন্যরকম নীরবতা নেমে এসেছিল। শীতের রাত, আকাশ ভরা তারার আলো আর দূরে জোনাকির ক্ষীণ ঝিলিক। পদ্মার ভাঙন খাওয়া ধারে জলরাশি কালো অন্ধকারে এক অদ্ভুত শব্দ তুলছিল। ঘোলশ্বরীপুরের অধিকাংশ ঘরে তখন প্রদীপ নিভে গেছে, কেবলমাত্র কিছু কিছু জানালা দিয়ে কেরোসিনের আলো ভেসে আসছে। রিতু সারা দিনই অস্থির বোধ করছিল, বদ্রি কাকার গল্প যেন তার কানে বাজছিল বারবার। একসময় মায়ের ঘুমিয়ে পড়ার পর সে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাতের টর্চটা পুরোনো, আলোর রঙ কেমন হলদেটে, কিন্তু তার ভেতরে এক অদম্য কৌতূহল। হিমাংশু আগেই ঠিক করেছিল আজ রাতে সে সত্যি যাচাই করবে। তাই পাটকাঠির বেড়ার ধারে তারা দেখা করল। হিমাংশুর হাতে একটা লণ্ঠন, আর মুখে নির্লিপ্ততা, যদিও চোখেমুখে ভয়ের রেখা স্পষ্ট। রিতু ফিসফিস করে বলল, “তুই কি নিশ্চিত? যদি কিছু সত্যিই থাকে?” হিমাংশু মৃদু হেসে উত্তর দিল, “আমাদের প্রমাণ চাই। সবাই শুধু বলে, কিন্তু কেউই দেখেনি। আজ আমরা নিজের চোখে দেখব।” তাদের পায়ের শব্দে শুকনো পাতা মচমচ করে উঠছিল, কুকুর ডাকছিল দূরে, আর মাঠের ঘাসে শিশির জমে উঠছিল। পুরো পরিবেশ যেন শ্বাসরুদ্ধকর, যেন প্রকৃতি নিজেই অপেক্ষা করছে কিছু ঘটনার।

তেঁতুলগাছটা দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের মাঝ মাঠে। রাতের অন্ধকারে তার ছায়া যেন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। গাছের ডালপালা মাটির অনেকটা নিচ পর্যন্ত নেমে এসেছে, যেন হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি আসতেই একটা হালকা শোঁ শোঁ শব্দ কানে এল। রিতু থেমে গেল, “শোন, হিমাংশু, এই আওয়াজটা কেমন?” হিমাংশু কণ্ঠ শক্ত করে বলল, “হাওয়ার শব্দ, আর কিছু না।” কিন্তু দুজনের মনেই সন্দেহ জেগে উঠেছিল। ধীরে ধীরে তারা এগোল। গাছের কাণ্ডে আলো ফেলতেই দেখা গেল সেই অদ্ভুত দাগ। চোখের মতো খাঁজটা এতটাই নিখুঁত যে সত্যিই মনে হচ্ছিল মানুষ খোদাই করে রেখেছে। রিতু কণ্ঠরোধ করে বলল, “দেখ! একেবারে চোখের মতো।” হিমাংশু একটু ঝুঁকে লণ্ঠনের আলো ঘোরাল। আলোর ঝলকানিতে স্পষ্ট দেখা গেল সেই গভীর দাগ, যার ভেতরে যেন অদ্ভুত ছায়া লুকিয়ে আছে। দুজনেই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। মনের ভেতর জমাট বাঁধা ভয় সত্ত্বেও কৌতূহল তাদের পা আটকে দিল না। হঠাৎ করেই রিতুর বুক ধক করে উঠল—খাঁজের ভেতরে যেন কিছু নড়ছে!

শুরুতে মনে হচ্ছিল বাতাসে দুলছে ছায়া, অথবা আলোয় চোখের মতো লাগছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হলো—না, সেটা কেবল ছায়া নয়। খাঁজটা আস্তে আস্তে আরও গাঢ় হচ্ছে, যেন ভেতর থেকে আঁধার উঁকি দিচ্ছে। রিতু হাঁফ ছেড়ে বলল, “হিমাংশু, আমি দেখছি… এটা নড়ছে।” হিমাংশুর ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে চোখ মুছে আবার তাকাল। সত্যিই, দাগটা যেন জীবন্ত কোনো চোখের মতো কাঁপছে, পলক ফেলতে চাইছে। হঠাৎ করে চারপাশের হাওয়া থেমে গেল, যেন প্রকৃতি স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। দূরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল, কিন্তু সেটা যেন আরও ভয় বাড়িয়ে দিল। রিতু টর্চ শক্ত করে ধরল, আলো একবার ছুটে গেল গাছের মাথায়, ডালে বসে থাকা পেঁচা উড়ে গেল ফুঁসফুঁস শব্দে। চোখ ফেরাতেই দেখা গেল—খাঁজটা আর শুধু দাগ নয়, সত্যিই চোখের মতো গোলাকার, যেন সাদা রেখা ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে। মুহূর্তের জন্য রিতুর মনে হলো, সেই চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রক্ত হিম হয়ে গেল তার। হিমাংশুর মুখ শুকনো, কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু চোখ সরাতে পারছে না।

তারপরেই ঘটল ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস বইল, লণ্ঠনের আলো দপ করে নিভে গেল। অন্ধকারে খাঁজের ভেতর থেকে যেন অদ্ভুত আলোর রেখা ছড়িয়ে উঠল—অত্যন্ত ক্ষীণ, তবু চোখের মতো জীবন্ত। রিতু চিৎকার করে উঠল, “চল পালাই!” হিমাংশুও আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দুজনেই প্রাণপণে ছুটল গ্রামমুখী পথে। তাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ, বুক ধড়ফড়, আর পেছন থেকে যেন কিছু অদৃশ্য দৃষ্টি তাদের অনুসরণ করছে। শ্বাসকষ্টে তারা যখন গ্রামের প্রথম কুঁড়েঘরের কাছে এসে দাঁড়াল, তখনও বুক ধড়ফড় করছিল, আর কানে বাজছিল সেই অদ্ভুত চোখের দৃশ্য। রিতু কেঁদে ফেলল আতঙ্কে, বলল, “ওটা সত্যি… ওটা চোখই ছিল।” হিমাংশু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “হয়তো… অথবা আমরা ভুল দেখেছি। কিন্তু যা-ই হোক, আমি আর ওদিকে যাব না।” দুজনেই নীরব হয়ে গেল। রাতের আকাশ তখন শান্ত, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে দোলা দিচ্ছিল এক অজানা আতঙ্ক। তারা বুঝল, কিংবদন্তির প্রথম সাক্ষী তারা নিজেরাই হয়ে গেছে।

_

রাতের সেই ঘটনার পর থেকে রিতুর মন একেবারেই অস্থির হয়ে উঠেছিল। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তেঁতুলগাছের সেই কাণ্ডে থাকা দাগ, যা সত্যিই যেন নড়ে উঠেছিল। সে জানত, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু তার মনের ভেতরে যে কৌতূহল জন্মেছিল, সেটাকে সহজে দমন করা সম্ভব নয়। সারা রাত সে ঘুমোতে পারেনি, ভোরবেলা উঠেই জানালার বাইরে তাকিয়ে গাছটার দিকে যেন এক অদ্ভুত টান অনুভব করছিল। হিমাংশু তাকে বোঝাতে চাইছিল—“ওসব বাদ দে, রিতু। আমরা ভুল দেখেছি।” কিন্তু রিতু কোনোভাবেই মানতে পারছিল না। সে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “না, এ শুধু গল্প নয়। সত্যিই কিছু আছে ওই গাছে। আমি সেটা খুঁজে বের করব।” হিমাংশু প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত বন্ধুর জেদ দেখে চুপ করে গেল। অন্যদিকে মধু একেবারেই ভীত। সে বারবার বলছিল, “আমরা বিপদে পড়ব, রিতু। বদ্রি কাকা তো বারবার সতর্ক করেছেন।” কিন্তু রিতু তার কথার তোয়াক্কা করল না। বরং সে সিদ্ধান্ত নিল প্রথমেই বদ্রির কাছ থেকে সব গল্প বিস্তারিতভাবে শুনবে। যতই মানুষ ভয় দেখাক, আসল সত্য জানার একমাত্র উপায় হল তথ্য সংগ্রহ করা।

সন্ধ্যায় তিন বন্ধু গিয়ে হাজির হল বদ্রির উঠোনে। কাকভোর থেকে গরু চরাতে বের হওয়া এই মানুষটি সন্ধ্যার পর বেশিরভাগ সময় বারান্দায় বসে হুঁকো টানতে টানতে গল্প শোনাতে ভালোবাসেন। তাদের দেখে বদ্রি ভুরু কুঁচকালেন, “কী রে, আবার তেঁতুলগাছের গল্প শুনতে এসেছিস?” রিতু নির্ভয়ে বলল, “কাকা, আপনার কাছেই তো সব শুনেছি। কিন্তু আপনি যা বলেন, তার সত্যিই কোনো ভিত্তি আছে তো? আপনি নিজে কি দেখেছেন?” বদ্রি গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তাঁর চোখের ভেতর যেন পুরোনো স্মৃতির ছায়া। তিনি বলতে শুরু করলেন—“ত্রিশ বছর আগের কথা। আমি তখন যুবক। পূর্ণিমার রাতে গাছটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কাণ্ডে হঠাৎ আলো ফুটে উঠল। মনে হলো জোনাকি। কিন্তু না, সেটা ছিল না। আমি দেখলাম, চোখের মতো দাগটা ধীরে ধীরে খুলছে। ভেতরে ছিল কালো এক গভীরতা, যেখানে কোনো আলো নেই। সেই চোখ আমার দিকে তাকিয়েছিল। বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি প্রাণপণে দৌড়ে পালিয়েছিলাম।” বদ্রির গলা কেঁপে উঠল। তিনি আরও বললেন, “এরপর থেকে আমি কাউকে আর কাছে যেতে দিইনি। যারা গেছে, তাদের অনেকেই মারা গেছে অল্পদিনের মধ্যে। এটা আমি কল্পনা করিনি, সত্যিই ঘটেছে।” তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা রিতুর মনে একধরনের ভয় তৈরি করল, কিন্তু কৌতূহলকে দমন করতে পারল না।

হিমাংশু এবার গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল, “কাকা, আপনি কি মনে করেন ওটা ভূত–প্রেতের ব্যাপার? নাকি অন্য কিছু?” বদ্রি চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “কে জানে ওটা কী। কেউ বলে, পুরোনো কালে এখানে শ্মশান ছিল। আবার কেউ বলে, এক সাধু গাছটার নিচে সাধনা করতে করতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁর অপূর্ণ সাধনার শক্তি গাছে আটকে আছে। আমি শুধু জানি, এটা মানুষের চোখ নয়, কিন্তু চোখের মতোই আমাদের দিকে তাকায়।” মধু আঁচল দিয়ে মুখ চাপা দিল। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল ভয়ে। কিন্তু রিতুর কণ্ঠে যেন এক অন্যরকম দৃঢ়তা জন্ম নিল, “আমি সত্যিটা জানতে চাই। শুধু গল্প শুনে থামব না।” বদ্রি বিরক্ত হয়ে উঠলেন, “তোকে আমি সাবধান করছি, রিতু। সত্য খুঁজতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারাবি। দূরে থাক তেঁতুলগাছ থেকে।” কিন্তু রিতু ততক্ষণে মনে মনে স্থির করে ফেলেছে—সত্য উদ্ঘাটন করতেই হবে।

কয়েকদিন পর চাঁদহীন এক রাতে তিন বন্ধু আবারও রওনা দিল গাছের দিকে। এবার আর স্রেফ কৌতূহল নয়, একধরনের পরিকল্পনা নিয়ে তারা যাচ্ছিল। রিতুর হাতে নতুন টর্চ, হিমাংশুর হাতে একটা লাঠি আর মধুর হাতে ছোট্ট প্রদীপ। গ্রামের লোকেরা তাদের থামাতে চেষ্টা করেছিল। কারও কারও চোখে দয়া, কারও চোখে আতঙ্ক। এক বৃদ্ধা তো কেঁদে ফেললেন, “ওদিকে যাস না বাবা, তুই আর ফিরবি না।” কিন্তু তিনজনেই কারও কথা শুনল না। তারা একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিল, যদি কিছু ঘটে, সবাই মিলে পালাবে। মাঠ পেরিয়ে যখন তারা তেঁতুলগাছের কাছে পৌঁছাল, তখন চারপাশ এতটাই অন্ধকার যে নিজেদের ছায়াও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। দূরে পেঁচার ডাক, কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর অজানা কীটপতঙ্গের শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা একেবারেই অস্বস্তিকর। গাছটা যেন বিশাল দৈত্যের মতো তাদের ওপর ঝুঁকে আছে। হিমাংশু ফিসফিস করে বলল, “যদি কিছু দেখি, তাড়াতাড়ি ফিরে যাব।” রিতু টর্চের আলো কাণ্ডের দিকে ফেলল। আবারও দেখা গেল সেই চোখের মতো দাগ। তাদের বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু এবার তারা পালাল না। বরং ধীরে ধীরে আরও কাছে গিয়ে দাঁড়াল, যেন সত্যিই রহস্যটা হাতের মুঠোয় ধরে ফেলবে।

_

গ্রামের রাতগুলো এমনিতেই নীরব আর রহস্যময় হয়, কিন্তু সেই রাতটা যেন অন্য সব রাতের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে উঠেছিল। আকাশে ছিল না কোনো চাঁদ, কেবল মেঘ ঢাকা আকাশের আড়াল থেকে একটুখানি তারা জ্বলজ্বল করছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল মাটির সোঁদা গন্ধ আর নদীর জলতরঙ্গের হালকা শব্দ। ঠিক এই সময়েই গ্রামে ফিরছিল কৃষ্ণপদ, যুবক বয়সের এক চঞ্চল ছেলে। দিনের পর দিন শহরে কাজ করে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সে গ্রামের গল্পগুলোকে কখনও গুরুত্ব দেয়নি। তেঁতুলগাছ নিয়ে এত গল্প শুনেও সে হাসাহাসি করেছে—“সবই বাজে কুসংস্কার। ভূত–টুত বলে কিছু নেই।” সেই রাতেই, অজান্তেই সে হয়ে উঠল গ্রামের আতঙ্কের প্রথম শিকার। গাঁয়ের প্রান্তে তার পথ কেটে গেল তেঁতুলগাছের দিক দিয়ে। সবার মতো ঘুরে যাওয়ার পরিবর্তে সে সোজা এগিয়ে গেল গাছটার পাশ দিয়ে, মনে মনে হেসে উঠল গ্রামের মানুষের ভীরুতাকে নিয়ে।

কৃষ্ণপদ যখন গাছের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল, তখন আচমকা কেমন যেন এক শীতল হাওয়া বইল। গাছের ডালপালা অস্বাভাবিকভাবে দুলে উঠল, অথচ বাতাস তেমন প্রবল ছিল না। কাণ্ডের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল কৃষ্ণপদ। সেখানে সেই চেনা দাগ—চোখের মতো গভীর খাঁজ। প্রথমে সে অবহেলায় হেসে ফেলল, কিন্তু হঠাৎ করেই দাগটা যেন আলো ছড়াতে শুরু করল। চোখের পাতার মতো কাঁপতে লাগল গাছের কাণ্ড, আর ঠিক তার সামনে এক অদ্ভুত কালো ছায়া ফুটে উঠল। কৃষ্ণপদ চোখ সরাতে পারল না। মনে হলো এক অদৃশ্য শক্তি তার মাথা চেপে ধরেছে, তাকে বাধ্য করছে ওই চোখের দিকে তাকাতে। চোখের ভেতরে ছিল এক গভীর শূন্যতা, যেন মহাশূন্যের মতো অন্ধকার, অথচ ভেতরে এক অজানা টান। হঠাৎ করেই তার বুক ধকধক করতে শুরু করল, শরীর জমে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার ঠোঁট থেকে শব্দ বেরোল না, শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তারপরই ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। গ্রামের দূর প্রান্ত থেকে কুকুরগুলো হাউল করতে লাগল, যেন বুঝে গেল কিছু অস্বাভাবিক ঘটেছে।

সকালে কৃষ্ণপদকে পাওয়া গেল তেঁতুলগাছের নিচে পড়ে থাকতে। তার শরীর ঠান্ডা, মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কেউ বলল সে অজ্ঞান হয়েছে, কেউ বলল সে মারা গেছে। গ্রামে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল খবর—“গাছের চোখ আবার খোলা পড়েছে!” লোকজন দৌড়ে এল, কেউ দূর থেকে দাঁড়িয়ে রইল, কাছে যেতে সাহস করল না। গ্রামের বৃদ্ধরা কাঁপা গলায় বলতে লাগল, “আমরা বলেছিলাম, ওই গাছের চোখে তাকালে প্রাণ যায়।” মহিলারা আতঙ্কে সন্তানদের আঁকড়ে ধরল, শিশুরা কেঁদে উঠল। কৃষ্ণপদকে টেনে নিয়ে আসা হলো গ্রামের ভেতরে, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু ডাক্তারও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি শুধু বললেন, “এমন অদ্ভুত অবস্থা আমি কখনও দেখিনি। শরীরে কোনো আঘাত নেই, তবে হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। মনে হচ্ছে প্রবল ভয়ে মারা গেছে।” এ খবর পুরো গ্রামকে কাঁপিয়ে দিল। এক মুহূর্তে মানুষ বুঝে গেল, কিংবদন্তি আর গল্প নয়, এটা বাস্তব।

রিতু আর হিমাংশুর বুকের ভেতর আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল অপরাধবোধ। তারা জানত, কয়েক রাত আগেই তারাও গাছটার চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিল। যদি তখন চোখটা পুরোপুরি খুলে যেত, তবে আজ কৃষ্ণপদের মতো তারাই পড়ে থাকত গাছের নিচে। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, কোনো কথা না বলেও বুঝে গেল মনে মনে কী ভাবছে। মধু ফিসফিস করে বলল, “তোমরা এবার বিশ্বাস করলে? ওটা সত্যি অভিশপ্ত।” হিমাংশু ঠোঁট কামড়ে ধরল, রিতুর চোখ লাল হয়ে উঠল ভয়ে আর রাগে। রিতু ফিসফিস করে বলল, “আমরা দেরি করে ফেলেছি। প্রথম শিকার হয়ে গেল কৃষ্ণপদ। কিন্তু এই রহস্যের শেষ না করলে এর শিকার আরও হবে।” গ্রামের লোকেরা এখন আরও ক্ষিপ্তভাবে তাদের সতর্ক করতে লাগল। কিন্তু রিতু জানত, যতই আতঙ্ক ছড়াক, গাছটার ভেতরে কী আছে, তা না জেনে থামা যাবে না। কৃষ্ণপদের মৃত্যু যেন এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলল, আর তেঁতুলগাছের চোখ—যা আগে কিংবদন্তি ছিল—এবার সত্যি হয়ে উঠল গ্রামের জীবন্ত অভিশাপ।

_

কৃষ্ণপদের মৃত্যুর পর থেকে গ্রাম যেন এক অদৃশ্য ভয়ের আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। দিনমজুরেরা কাজ শেষে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসতে লাগল, গৃহিণীরা সন্তানদের আঁকড়ে ধরে রাত নামার পর বাইরে বের হতে মানা করল। অথচ এ সবের মাঝেও রিতুর মন এক অদ্ভুত টানে টানতে লাগল গাছটির দিকে। তার মনে হচ্ছিল, এই গাছ কেবল কোনো প্রেতাত্মার আবাস নয়, বরং এর গভীরে আরও কিছু আছে—এক অচেনা শক্তি, এক জীবন্ত সত্তা, যা মানুষের ভয়কে নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। রাতে শুয়ে যখন সে চোখ বন্ধ করত, তখনই দেখা দিত সেই চোখ। ঘুমের ভেতরেও স্পষ্টভাবে ভেসে উঠত কাণ্ডের দাগ, যেটা ধীরে ধীরে খুলে যেন তাকিয়ে আছে সরাসরি তার দিকে। ভয়ানক দৃষ্টিটা শুধু আতঙ্কই ছড়াত না, বরং সতর্ক করত—“দূরে থাকো, নয়তো শেষ।” ভয়ে রিতু চমকে উঠে বসত, কিন্তু আবারও সে নিজেকে বোঝাত, হয়তো এ কেবল কল্পনা। কিন্তু যত রাতই কাটত, চোখটা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠত, তার নিঃশ্বাসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল।

শুধু রিতুই নয়, হিমাংশু আর মধুও একই অভিজ্ঞতার শিকার হতে লাগল। তারা একে অপরকে কিছুদিন কিছু বলেনি, কিন্তু একদিন ভোরবেলা দেখা করার সময় হিমাংশু হঠাৎ বলে ফেলল, “রাতভর ঘুমাতে পারিনি। স্বপ্নে সেই চোখটা আবারও দেখলাম। মনে হলো আমাকে ডেকে নিচ্ছে।” মধুর গলায় কাঁপুনি, “আমারও তাই। কিন্তু সে ডাকে সাড়া দিলে কী হবে?” রিতু এবার নির্দ্বিধায় জানাল, “আমিও সেই চোখ দেখছি প্রতিরাতে। এর মানে, এটা শুধু কাণ্ডের দাগ নয়। ওটা জীবন্ত, আমাদের চিনতে পারছে, আমাদের খুঁজে নিচ্ছে।” তিনজনের শরীর শীতল হয়ে গেল এই উপলব্ধিতে যে, তারা কেবল দিনের বেলায় নয়, রাতের ঘুমের ভেতরেও সেই চোখের শিকার হয়ে পড়ছে। চোখটি যেন গাছের সঙ্গে বাঁধা কোনো অভিশাপ নয়, বরং এক সক্রিয় শক্তি, যে মানুষের আত্মার ভেতর ঢুকে ভয় বুনে দেয়।

এদিকে গ্রামে গুজব আরও দ্রুত ছড়াতে শুরু করল। কেউ বলল, তেঁতুলগাছ এক অভিশপ্ত দেবতার আসন, যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা করলে শাস্তি হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। কেউ বলল, গাছটার ভেতরে কোনো অজানা আত্মা বন্দি আছে, আর সে মানুষের মনের ভয় খেয়ে বেঁচে থাকে। আরও অদ্ভুত ছিল এই যে, কৃষ্ণপদের মৃত্যুর পর যেসব লোক গাছটাকে অস্বীকার করছিল বা ঠাট্টা করেছিল, তারা প্রত্যেকেই রাতে ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। স্বপ্নে দেখা যেত, চোখটা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর কণ্ঠস্বর ফিসফিস করছে—“বিশ্বাসঘাতকতা করলে বাঁচবে না।” কয়েকজন এমনকি অসুস্থ হয়ে পড়ল, কারও জ্বর উঠল, কারও বুক ধড়ফড় শুরু হলো। গ্রামের মহিলারা মন্ত্রপাঠ শুরু করল, পুরোহিতরা হোমযজ্ঞ করতে লাগল। তবুও আতঙ্ক কমল না, বরং আরও বাড়ল। গুজব ছড়িয়ে গেল—যে কেউ গাছকে অস্বীকার করবে বা গাছের অভিশাপ নিয়ে মজা করবে, সে শীঘ্রই প্রাণ হারাবে।

এইসব ভয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই রিতু হিমাংশু আর মধু বুঝে গেল, গাছটা শুধু এক অভিশাপ নয়, বরং এক জীবন্ত শক্তির আধার। তার কাণ্ডের দাগটা নিছক কোনো প্রাকৃতিক দাগ নয়, সেটা এক চোখ—অদ্ভুত, অমানবিক চোখ—যা দেখতে পায় মানুষের মনের গভীরতাও। দিনের বেলা হয়তো সেটা নীরব থাকে, কিন্তু রাত হলেই মানুষের অবচেতন মনে ঢুকে তাদের দমিয়ে রাখে ভয় দিয়ে। রিতু একদিন দৃঢ়স্বরে বলল, “আমরা যদি সত্যিই রহস্যটা ভাঙতে চাই, তবে আমাদের গাছের চোখকে কেবল এড়িয়ে চললেই চলবে না। আমাদের বুঝতে হবে, এটা আসলে কী—শাপ, আত্মা, নাকি অন্য কিছু।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, যতই তারা এই শক্তিকে বোঝার চেষ্টা করবে, চোখটা ততই তাদের আরও কাছে টেনে নেবে। আর একদিন হয়তো তাদেরও দাঁড়াতে হবে সেই কৃষ্ণপদের জায়গায়—অভিশপ্ত চোখের প্রথম শিকার নয়, বরং তার পরের শিকার হয়ে।

_

রাতের অন্ধকারে সাহস সঞ্চয় করে বেরোনো সহজ কাজ ছিল না। তবুও রিতু, হিমাংশু আর মধু যেন এক অজানা শক্তির টানে আবারও তেঁতুলগাছের দিকে রওনা দিল। চারপাশ তখন গভীর নীরব, শুধু নদীর গর্জনময় হাওয়ার শব্দ কানে আসছিল। গ্রামবাসীর ঘরগুলোতে সব আলো নিভে গেছে, কেবল কোথাও কোথাও ম্লান কুপির আলো জ্বলছিল। তিনজনের মধ্যে কেউ কোনো কথা বলছিল না, তবুও তাদের চোখের ভেতর স্পষ্ট ছিল এক অটল সংকল্প—এই রহস্যকে বোঝার জন্য তারা যেকোনো ঝুঁকি নিতে রাজি। গাছের কাছে পৌঁছে তারা আগে যেমন ভয় পেয়েছিল, এবার সে ভয়কে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল। রিতু ধীরে ধীরে বলল, “আমরা এবার সরাসরি চোখের দিকে তাকাব না। শুধু চারপাশ পর্যবেক্ষণ করব। মনে রেখো, ভয়ের কাছে হারলে গাছটা আমাদের গ্রাস করবে।” বাকিরা চুপচাপ মাথা নাড়ল।

গাছের চারপাশে দাঁড়িয়ে তারা প্রথমবার লক্ষ্য করল, বাতাস এখানে অন্যরকম। গাছের গোড়ার মাটি যেন অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা, অথচ আশেপাশে তেমন কোনো শীত নেই। হিমাংশু খেয়াল করল, গাছটার পাতাগুলো অন্য সব তেঁতুল পাতার মতো নয়—রাতে অদ্ভুত এক ধাতব ঝিলিক দিচ্ছিল, যেন আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ভেতর থেকে। মধু নিচু হয়ে গোড়ার মাটিতে হাত রাখল, হঠাৎ চমকে উঠল, “মনে হলো মাটির ভেতর থেকে কিছু একটা নড়ছে।” তারা একে অপরের দিকে তাকাল, আতঙ্ক স্পষ্ট হলেও এবার তারা পিছিয়ে গেল না। গাছটার ডালপালাগুলো যেন তাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল, আস্তে আস্তে দুলতে লাগল, অথচ বাতাস ছিল প্রায় থেমে যাওয়া। মুহূর্তের জন্য রিতুর মনে হলো, গাছটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে—তার ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় অন্ধকার জমে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এটা কোনো সাধারণ গাছ নয়, এটা যেন সত্যিই এক জীবন্ত প্রাণী, যা চারপাশের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর তারা বুঝতে পারল, গাছের আশেপাশের শব্দও অস্বাভাবিক। গ্রামে তখনও দূরে কোথাও কুকুর ডাকছিল, কিন্তু গাছের চারপাশে এসে যেন সব শব্দ মিলিয়ে গেল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, পাখির ফিসফিসানি, এমনকি বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ—সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মধু ফিসফিস করে বলল, “আমরা একা নই… গাছটা আমাদের শুনছে।” হিমাংশুর কাঁপা গলায় উত্তর এল, “আর শুধু শুনছে না, আমাদের চারপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নীরবতা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়।” রিতু চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত চারপাশের আবহ শোনার চেষ্টা করল, আর সত্যিই মনে হলো, অদৃশ্য কোনো সত্তা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। যতই তারা শান্ত থাকার চেষ্টা করুক, বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যাচ্ছিল ভয়ে। কিন্তু ভয়ের আড়ালেই যেন লুকিয়ে ছিল সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ।

তিনজন অনেকক্ষণ ধরে চোখের দিকে না তাকিয়ে গাছের গায়ে হাত রাখতে সাহস করল না, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করেই তারা অনুভব করল, এ গাছ মানুষের চেনা প্রকৃতির অংশ নয়। এর গায়ে আঙুল বোলানো মানে হয়তো নিজের আত্মাকে এক অজানা শক্তির হাতে তুলে দেওয়া। তবু তারা বুঝল, আর কয়েকবার চেষ্টা না করলে রহস্যটা ধরা দেবে না। সেই রাতটা ছিল এক রকম প্রথম পরীক্ষা, যেখানে তারা শিখল—তেঁতুলগাছটা নিছক একটি গাছ নয়, বরং এক জীবন্ত সত্তা, যে ভয়কে অস্ত্র করে চারপাশের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। রিতু দৃঢ় গলায় বলল, “আজ আমরা শুধু দেখেছি, অনুভব করেছি। কিন্তু একদিন আমাদের চোখের দিকেও তাকাতে হবে। না তাকালে সত্যি ধরা দেবে না।” তার কথায় হিমাংশু আর মধু থমকে গেলেও, মনের ভেতরে জেগে উঠল এক অদ্ভুত সাহস—হয়তো এ ভয়কেই ভাঙতে হবে একদিন। গাছটা যেন তাদের কাছে ক্রমে রহস্য নয়, বরং এক শত্রুর মতো হয়ে উঠছিল, যার মুখোশ খুলে দেওয়াই এখন তাদের লক্ষ্য।

_

পরদিন সকালে রিতু, হিমাংশু আর মধু গিয়ে হাজির হলো বদ্রির উঠোনে। বুড়ো বদ্রি তখন বসে কাঁসার লোটায় জল খাচ্ছিল, চোখে যেন অনেকটা রাত জাগার ক্লান্তি। তাদের দেখে ভুরু কুঁচকালেও, বুঝতে পারল তিনজনই কিছু জানতে মরিয়া। রিতু এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, “বদ্রিদা, আমরা গতরাতে গাছটার চারপাশে গিয়েছিলাম। ওটা যে জীবন্ত শক্তি, আমরা বুঝেছি। কিন্তু কেন? এর পেছনে কী ইতিহাস আছে?” বদ্রি প্রথমে কিছুই বলল না, কেবল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হিমাংশু তাড়াহুড়ো করে যোগ করল, “আমাদের ভয় দেখিয়ে থামানো যাবে না। যদি সত্যি বিপদ থাকে, আমাদের জানা দরকার।” বুড়ো বদ্রি তখন ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমরা যেটার সঙ্গে খেলা করছ, সেটা নিছক কৌতূহল নয়। এর সঙ্গে এই গ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে—যে ইতিহাস জানলে তোমাদের আর ঘুম হবে না।”

বদ্রি গলা খাঁকারি দিয়ে গল্প শুরু করল। বহু বছর আগে, যখন সে ছোট ছিল, তখনো এই গাছ ছিল গ্রামের মাঝখানে। শোনা যায়, আরও পুরোনো সময়ে এক লোক, নাম ছিল গজানন, সে ছিল ভীষণ সাহসী আর জেদি। গজানন বিশ্বাস করত, তেঁতুলগাছের কাণ্ডে থাকা দাগটা কোনো অভিশাপ নয়, কেবলই প্রাকৃতিক খোদাই। গ্রামবাসীরা বারবার তাকে সতর্ক করত—“ও দাগে তাকিও না, এটা তৃতীয় চোখ, এটা খোলা মানেই মৃত্যু।” কিন্তু গজানন সবাইকে অবজ্ঞা করে বলেছিল, “আমি প্রমাণ করব, এ সব ভয় কেবল কুসংস্কার।” এক অমাবস্যার রাতে সে একা গিয়ে গাছটার সামনে দাঁড়াল। গ্রামের কয়েকজন দূর থেকে তাকে দেখতে গিয়েছিল। সবাই বলে, গজানন প্রথমে কিছুই টের পায়নি, কিন্তু হঠাৎ তার গলা শুকিয়ে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আর সে চিৎকার করে উঠল—“ওটা নড়ছে!” মুহূর্তের মধ্যে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ভোরের আলোয় দেখা গেল, তার দেহ অদ্ভুতভাবে শক্ত হয়ে গেছে, যেন শীতের মধ্যে জমে গেছে। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল—তার চোখ দুটো পুরোপুরি ফাঁকা, দৃষ্টিশূন্য।

বদ্রি থেমে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। রিতুর গলা শুকিয়ে এলো, সে ফিসফিস করে বলল, “তারপর?” বুড়ো তখন আবার শুরু করল, “গজাননের মৃত্যুর পর থেকে গ্রামের মানুষ গাছটাকে আর তেঁতুলগাছ বলে না। তারা বলতে লাগল ‘তৃতীয় চোখের গাছ’। তখন থেকে অদ্ভুত ঘটনাও বাড়তে লাগল। শোনা যায়, যে রাতে কেউ চোখের দিকে তাকাত, সে হয় অদ্ভুতভাবে মারা যেত, নয়তো পাগল হয়ে যেত। এমনকি যারা সরাসরি তাকায়নি, কিন্তু গাছটাকে অবজ্ঞা করেছে, তাদেরও স্বপ্নে সেই চোখ হাজির হয়েছে। অনেকেই জ্বরে কাতর হয়েছে, কেউ কেউ রাতে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছে। গ্রামের প্রবীণরা বিশ্বাস করতেন, গজানন আসলে কোনো অভিশাপ ভেঙেছিল, আর তার প্রতিশোধেই গাছটা এক জীবন্ত শক্তি হয়ে উঠেছে। তারা বলত, গাছের ভেতরে আসলে এক অদৃশ্য আত্মা বন্দি—এক আত্মা, যার শক্তি ছিল মানুষের মন ও ভয় নিয়ন্ত্রণ করা।”

রিতু, হিমাংশু আর মধু নিঃশব্দে বদ্রির কথা শুনছিল। তারা বুঝল, এ গাছ নিছক কুসংস্কারের ফসল নয়, এর সঙ্গে সত্যিই ইতিহাস জড়িত। রিতুর মনের ভেতর কেমন করে যেন গজাননের ছবি ভেসে উঠল—এক সাহসী মানুষ, যিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, আর বিনিময়ে হারিয়েছিলেন প্রাণ। হিমাংশু ফিসফিস করে বলল, “মানে গাছটা কেবল চোখ নয়, ওটা এক অভিশপ্ত সত্তা।” বদ্রি গভীর দৃষ্টিতে তাকাল, “হ্যাঁ, অভিশপ্ত… কিন্তু শুধু অভিশাপ নয়। ও গাছের ভেতরে কোনো শক্তি ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছে। তাই আজও যারা অবজ্ঞা করে, তাদের স্বপ্নে সেই চোখ হাজির হয়। মনে রেখো, তৃতীয় চোখ শুধু দেখে না, শোনেও… তোমাদেরও।” এই শেষ কথাগুলো যেন শীতল বাতাসে ছুরির মতো কেটে গেল তিনজনের শরীরে। তারা বুঝতে পারল, ইতিহাসটা কোনো সমাধান দেয়নি, বরং আরও গভীর রহস্যের দরজা খুলে দিল।

_

সেদিন রাতটা যেন শুরু থেকেই অস্বাভাবিক ছিল। গ্রাম জুড়ে এমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যা সাধারণত শুধু ঝড়ের আগের রাতে দেখা যায়। আকাশে পূর্ণিমার আলো থাকলেও মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে সেটি ঢেকে যাচ্ছিল, ফলে চারপাশে আলো–আঁধারির খেলা তৈরি হচ্ছিল। রিতু, হিমাংশু আর মধু জানত, আজকের রাত অন্য সব রাতের মতো হবে না। তবু অদৃশ্য এক টানে তারা গাছটার সামনে এসে দাঁড়াল। তেঁতুলগাছের কাণ্ডটা কালো অন্ধকারে আরও ভয়ঙ্কর লাগছিল। তিনজনই নীরবে দাঁড়িয়ে দম আটকে দেখছিল, হঠাৎ কাণ্ডের মাঝখানের সেই দাগটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে দাগের ভেতর থেকে এক অস্পষ্ট আলো বের হতে লাগল, ঠিক যেন অন্ধকারে কোনো চোখ খুলছে। আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের হাওয়া ভারী হয়ে উঠল, যেন মাটির ভেতর থেকে গাছের শিকড়গুলো শ্বাস নিচ্ছে।

হিমাংশু কেঁপে উঠে ফিসফিস করে বলল, “চোখটা… ওটা নড়ছে।” রিতু তার কাঁধে হাত রাখল, কিন্তু তার নিজের হাতও কাঁপছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে গাছটা শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে নেই, বরং তাদের অস্তিত্বকে মেপে দেখছে। মধু হঠাৎ করেই এক তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে দিল, কারণ সে পরিষ্কারভাবে দেখল চোখের পলক নড়ে উঠল। সেই চিৎকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই চারপাশের পরিবেশ যেন বদলে গেল। সমস্ত শব্দ মিলিয়ে গিয়ে নিস্তব্ধতার বদলে এক অদ্ভুত গুঞ্জন ভেসে উঠল, যেন অগণিত কণ্ঠস্বর একসঙ্গে ফিসফিস করছে। রিতু আর হিমাংশু আতঙ্কিত হয়ে মধুকে টেনে পেছনে আনতে চাইলো, কিন্তু তাদের পা যেন মাটিতে আটকে গেল। মনে হচ্ছিল, গাছের দৃষ্টি তাদের শিরদাঁড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পরীক্ষা করছে।

হঠাৎই প্রবল এক ঝাপটা হাওয়া তাদের দিকে ধেয়ে এল, অথচ আশেপাশে কোনো বাতাস বইছিল না। সেই ঝাপটা যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির হাত, যা তাদের বুকের ভেতরে ঢুকে ফুঁড়ে দিচ্ছে। তিনজনই একসঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, বুক ফেটে যাচ্ছে মনে হলো। চোখের আলো ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছিল, আর সেই আলোতে তারা অনুভব করছিল নিজেদের স্মৃতিগুলো যেন কেউ উল্টেপাল্টে দেখছে। রিতুর মনে ভেসে উঠল তার শৈশবের ছবি, মধুর মনে ভেসে উঠল বহুদিন আগের এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, আর হিমাংশুর চোখে দেখা দিল তার সবচেয়ে গভীর গোপন ভয়। তারা বুঝল, এটা কেবল একটা চোখ নয়—এ এক দৃষ্টি, যা মানুষের ভেতরের ভয়, গোপন স্মৃতি আর দুর্বলতাকে উন্মোচন করে। এই শক্তি যেন তাদের ভাঙার চেষ্টা করছে, পরীক্ষা করছে তারা আদৌ এর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে কি না।

মিনিটগুলো কেটে যাচ্ছিল ভয়াবহ ধীরতায়। তাদের দেহ মাটিতে কাঁপছিল, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, তারা বেঁচে ছিল। চোখটা যেন তাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, কিন্তু শেষ আঘাত করছে না। হঠাৎ আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এলো, আবার সেই চোখ অদৃশ্য দাগের আড়ালে ঢেকে গেল। চারপাশের পরিবেশ আবার নিস্তব্ধতায় ভরে উঠল, বাতাস থেমে গেল, রাতের প্রকৃতি স্বাভাবিক হতে লাগল। কিন্তু তিনজন জানত, কিছুই আর স্বাভাবিক নেই। তারা মাটিতে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে টের পেল—চোখ তাদের ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু এ কেবল শুরু। রিতু কাঁপা গলায় বলল, “ওটা… আমাদের দেখছে। আমরা আর দর্শক নই… আমরা শিকার।” হিমাংশু কিছু বলল না, শুধু নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল সেই গাছটার দিকে, যেটা এখন আগের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর, আরও জীবন্ত মনে হচ্ছিল।

_

পরদিন সকালে রিতু আর হিমাংশু ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে এক অদ্ভুত জাগরণ হচ্ছিল। মধু তখনো ভয়ে কিছু বলতে চাইছিল না, অথচ রিতু আর হিমাংশু বারবার মনে মনে হিসেব করছিল, চোখের ভয়াবহ শক্তি তাদের শেষ করে দিতে পারত, কিন্তু করেনি কেন? তারা একে অপরকে প্রশ্ন করতে করতে অবশেষে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে, চোখটি কোনো অন্ধ প্রতিহিংসার উৎস নয়, বরং এক ধরনের বাছাই করা শক্তি। সে ভয় দেখায়, পরীক্ষা করে, কিন্তু সরাসরি আঘাত করে তখনই, যখন মানুষ নিজের ভেতরে ভয় বা অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ায়। রিতু মনে মনে বারবার ফিরে দেখছিল রাতের মুহূর্তগুলো—কিভাবে তার ভয়কে চোখটা উন্মোচন করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মেরে ফেলেনি। সে অনুভব করল, চোখের ভেতরে লুকানো আছে এক প্রাকৃতিক শক্তি, যা মানুষকে বিচার করে তাদের অন্তরের সাহস আর শ্রদ্ধার ভিত্তিতে।

হিমাংশু প্রথমে দ্বিধায় ছিল। সে ভাবছিল, হয়তো এটা কেবল কাকতালীয়, হয়তো গাছটা তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে অন্য কোনো কারণে। কিন্তু বারবার যখন রিতু নিজের যুক্তি ব্যাখ্যা করল, তখন তার মনও নরম হতে লাগল। “দেখো,” রিতু বলল, “যারা ভয়ে পাথর হয়ে তাকায়, তারাই শিকার হয়। বদ্রি যেভাবে গজাননের কথা বলেছিল, সে গাছকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে মৃত্যুকে ডেকে এনেছিল। গাছকে অবজ্ঞা করা মানে চোখকে রাগানো। কিন্তু আমরা গতরাতে অবজ্ঞা করিনি, আমরা চেষ্টা করছিলাম বুঝতে।” হিমাংশু মাথা নাড়ল, সে উপলব্ধি করল, সত্যিই তাদের ভেতরের ভয় যতই বাড়ছিল, চোখ তাদের কষ্ট দিচ্ছিল, কিন্তু যখন তারা স্থির থেকে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল, চোখের শক্তি ধীরে ধীরে থেমে গিয়েছিল। যেন পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এই উপলব্ধি তাদের ভয়কে বদলে দিল, আরেক রকম দায়িত্ববোধ জন্ম দিল।

সেই সন্ধ্যাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিল গ্রামের লোকদের এই সত্য জানাবে। কিন্তু সহজে সেটা করা সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষরা বহু প্রজন্ম ধরে গাছটাকে শুধু অভিশাপ হিসেবে দেখেছে, ভয় করেছে, ঘৃণা করেছে। তাদের বোঝানো কঠিন ছিল। তবুও রিতু সাহস করে এক আড্ডার আসরে বলল, “তেঁতুলগাছের চোখ আমাদের শত্রু নয়। ও আমাদের পরীক্ষা করে। যে ভয়ে ভেঙে পড়ে, সে শিকার হয়। কিন্তু যদি আমরা ওর শক্তিকে সম্মান করি, ভয় না পাই, তবে ও কিছুই করতে পারবে না।” লোকেরা প্রথমে হেসে উঠল, কেউ কেউ ভয় পেয়ে গাল দিল, “পাগল মেয়েমানুষ, এসব বলে অশান্তি ডেকে আনবি।” কিন্তু রিতু থামল না। সে দৃঢ় গলায় বলল, “আমি নিজে দেখেছি। আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু শেষে সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি এখনো বেঁচে আছি। হিমাংশুও আছে। মধুও।” ধীরে ধীরে লোকজন চুপ হয়ে গেল। কেউ সরাসরি বিশ্বাস করল না, কিন্তু তাদের চোখে একফোঁটা সন্দেহের আলো জ্বলল—যদি সত্যিই কথাগুলো ঠিক হয়?

দিনগুলো কেটে যেতে লাগল, আর গ্রামে গুজবের ঢেউ উঠল নতুনভাবে। কেউ বলল, “হয়তো গাছটা আসলে কোনো দেবতার আশীর্বাদ।” কেউ বলল, “না, এ এক পরীক্ষা, অভিশাপ নয়।” বদ্রি প্রথমে কিছু বলেনি, শুধু নিরবে দেখছিল। কিন্তু একদিন সে সামনে এসে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি হয়তো ভুল বলছ না। আমি এত বছর ধরে যা ভেবেছি, আজ তোমরা নতুন মানে খুঁজে পেয়েছ। হয়তো গাছ আমাদের ধ্বংস করতে নয়, আমাদের ভয়কে সামনে আনতে এসেছে। যে শ্রদ্ধা করবে, সে বাঁচবে।” তার এই কথাতেই গ্রামবাসীরা আরও নড়েচড়ে বসে। ধীরে ধীরে এই সত্য ছড়িয়ে পড়তে লাগল, মানুষ গাছটাকে আর নিছক অভিশাপ মনে করল না, বরং এক শক্তিশালী প্রহরী হিসেবে দেখতে শুরু করল। আর রিতু আর হিমাংশু বুঝল—তাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। চোখের রহস্য পুরোপুরি বোঝা বাকি, কিন্তু অন্তত গ্রামটা ভয় থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ নিয়েছে।

_

ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের ভয় বদলে যেতে লাগল। যেই তেঁতুলগাছকে এতদিন তারা অশুভের প্রতীক ভেবে এড়িয়ে চলত, সেই গাছকে তারা এখন অন্য চোখে দেখতে শুরু করল। বদ্রির স্মৃতি, বয়স্কদের গল্প, আর রিতুর সাহসিকতা গ্রামবাসীর মনকে নাড়া দিল। মানুষ বুঝতে পারল, গাছের চোখ আসলে কোনো শয়তানি শক্তি নয়, বরং প্রাকৃতিক এক সতর্কবার্তা। এটি যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে দেওয়া এক শিক্ষা—ভয় মানুষকে গ্রাস করে, কিন্তু সম্মান আর সাহস মানুষকে রক্ষা করে। যখন রাত নামত, কেউ কেউ দূর থেকে গাছটার দিকে তাকাত, আর তারা অবাক হয়ে দেখত যে গাছের চারপাশে সেই পুরোনো ভয়ানক অন্ধকার আর নেই, বরং এক ধরনের নীরব মর্যাদা ছড়িয়ে আছে। গ্রামের শিশুদের কাছে গাছটি ভয়ের গল্পের উৎস থেকে পরিণত হলো বিস্ময়ের প্রতীকে, আর বয়স্করা ধীরে ধীরে স্বীকার করল যে এতদিন তারা ভয়কে আঁকড়ে ধরে ভুল করেছিল।

রিতু, হিমাংশু আর মধু এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তারা শুধু রহস্য উদঘাটন করেনি, বরং গ্রামে নতুন এক মানসিক জাগরণ এনেছিল। রিতু প্রায়ই বলত, “ভয় মানুষকে দুর্বল করে, কিন্তু কৌতূহল আর শ্রদ্ধা মানুষকে শক্তি দেয়।” হিমাংশু তখন যোগ করত, “আমরা যদি নিজের ভেতরের ভয়কে জয় করতে পারি, তবে বাইরের কোনো শক্তি আমাদের কাবু করতে পারবে না।” মধু, যে একসময় সবচেয়ে ভয় পেয়েছিল, এখন অন্য শিশুদের বোঝাত, “ওই চোখটা খারাপ নয়। শুধু পরীক্ষা নেয়। আমরা যদি সাহসী হই, কিছু হবে না।” ধীরে ধীরে এই কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ল, আর গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাহস নিয়ে বড় হতে শুরু করল। তারা আর ভয়ে কুঁকড়ে থাকল না, বরং অজানাকে জানার ইচ্ছে তাদের চালিত করল।

বছর কয়েক পর গ্রামটির চেহারাই বদলে গেল। গাছের গল্প এখনো শোনা হতো, কিন্তু সেটি ভয়ের গল্প নয়, বরং শিক্ষা আর কৌতূহলের গল্প। বাইরের লোকেরা এলে গ্রামের মানুষ গর্ব করে বলত, “আমাদের গাছের চোখ আছে, ওটা আমাদের পাহারা দেয়।” রাতে গাছের কাণ্ডে সেই চোখের দাগ মাঝে মাঝে নড়ে উঠত, কিন্তু কেউ আর আতঙ্কিত হতো না। বরং তারা জানত, এটি প্রকৃতির প্রহরী—যারা সম্মান নিয়ে আসে, তাদের সুরক্ষা দেয়, আর যারা ভয় বা অবজ্ঞা নিয়ে আসে, তাদের সতর্ক করে। বদ্রি শেষ বয়সে হাসিমুখে বলেছিল, “আমি এতদিন ভেবেছিলাম গাছটা অভিশাপ। আসলে এটা আশীর্বাদ।” তার এই স্বীকারোক্তি গ্রামে নতুন এক শান্তি নিয়ে এলো।

শেষমেশ তেঁতুলগাছ কেবল একটি গাছ নয়, বরং গ্রামের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠল। রিতু, হিমাংশু আর মধুর নামও সেই ইতিহাসে যুক্ত হলো। তারা দেখিয়েছিল, ভয়কে জয় করলে রহস্য ভয়ঙ্কর থাকে না, বরং জ্ঞান আর শক্তির উৎস হয়ে ওঠে। গ্রামে উৎসবের দিনগুলোতে শিশুরা গাছের নিচে খেলত, বয়স্করা গল্প শোনাত, আর সবাই মিলেমিশে গাছটির সামনে প্রদীপ জ্বালাত, সম্মানের প্রতীক হিসেবে। তেঁতুলগাছের চোখ রাতে আজও খোলে, কিন্তু আর আতঙ্ক ছড়ায় না—বরং নীরবে স্মরণ করিয়ে দেয়, ভয় নয়, সাহস আর শ্রদ্ধাই মানুষের আসল শক্তি। সেই চোখই গ্রামের মানুষের মনে চিরকাল অমলিন রহস্য হয়ে বেঁচে থাকল, এক ইতিহাস, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে।

***

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *