প্ৰতুল দে
১
চায়ের গন্ধে ভেজা বিকেল
হাসপাতালের নিঃশব্দ করিডোর, মেয়ের বিদেশ থেকে আসা না আসা নিয়ে হিসেব, রোজকার ডায়েরির পাতায় অনুপস্থিত মানুষটার অদৃশ্য ছায়া—এসবের মাঝখানে অনন্যা সেন নিজের জীবনের হিসেবনিকেশ করতে করতে কখন যে পঞ্চাশের ঘর পেরিয়ে এসেছেন, সেটা বুঝতেও পারেননি। স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসারটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছিল, একটা দীর্ঘ নিঃশব্দতায় আবৃত একাকীত্ব। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির ছোট্ট ফ্ল্যাটটা যেন ধীরে ধীরে তার ঘর নয়, নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হয়ে উঠেছিল। একমাত্র মেয়ে দীপা বিয়ের পর লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার পরে সেই নিঃশব্দতা আরও ঘনীভূত হয়, যেন পুরোনো আসবাব, দেয়ালের রং, ড্রয়ারের ভাঁজে ভাঁজে শুধু স্মৃতি জমে থাকে, জীবনের চলন নয়। কিন্তু সব কিছু পালটে গেল শোভনার ফোনে। “তুই আমার হোমস্টেতে আয় ক’টা দিন, পাহাড় দেখবি, মন ভালো হবে,” বলেছিল শোভনা—অনন্যার স্কুলজীবনের বান্ধবী, এখন দার্জিলিঙের কাছাকাছি এক পাহাড়ি চা-বাগানে হোমস্টে চালায়। প্রাথমিকভাবে যেতে চায়নি অনন্যা। বয়সটা কি এসব বেড়ানোর? সবাই বলে, এই বয়সে নাকি মানুষ স্বস্তি খোঁজে, নতুনতা নয়। কিন্তু হঠাৎ এক বিকেলে যখন সে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখল বৃষ্টি নামছে, আর তার চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে—ঠিক তখনই ফোন তুলে বলেছিল, “শুভ, আমি আসছি।”
দার্জিলিঙ পৌঁছনোর পর প্রথম যে জিনিসটা তার মন ছুঁয়ে গেল, সেটা পাহাড়ের গন্ধ নয়, রঙিন কাপড়ে মোড়া হোমস্টেটা নয়, বরং ছিল ওই চা-বাগানের বাতাস। গাঢ় সবুজ পাতা আর পাতলা রোদ মেশানো যে নীরবতা, তা কলকাতার কোলাহলময় ছাদ কিংবা বাজারের গলির থেকে একেবারে ভিন্ন। শোভনার হোমস্টের বারান্দা থেকে তাকালেই দেখা যায়—সিঁড়ির মতো নেমে যাওয়া চা-বাগান, যার ভেতর দিয়ে সরু পথ চলে গেছে নিচের দিকে। অনন্যা প্রথমদিনই হাঁটতে বেরোলেন, একটা ছাতা হাতে, ধীরে ধীরে, যেন নিজেরই ভিতরটা একবার দেখে নিতে চাইছিলেন। সেই পথেই প্রথম দেখা আদৃত্যের সঙ্গে—একজন গা-ছমছমে দৃষ্টির বন বিভাগের অফিসার, বয়সে অন্তত ছাব্বিশ। প্রথম পরিচয় খুবই সাদামাটা: “এই পথে সন্ধের পরে না হাঁটাই ভালো ম্যাডাম, বন্য শুয়োর থাকে।” এতোটুকু কথার মধ্যে কোনও অভিমান ছিল না, শুধু সতর্কতা। অনন্যা একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানকার?” উত্তর এল মাথা নাড়িয়ে, “আমি শুধু গাছদের মানুষ, ম্যাডাম। বাকিরা সব পথচারী।” তারপর তারা দুজনে কিছু দূর হাঁটলেন, কিন্তু কথাবার্তা বিশেষ এগোয়নি। অনন্যা সেইদিনই বুঝেছিলেন, এই তরুণ ছেলেটির চোখে একটা অভ্যস্ত নির্জনতা আছে, ঠিক যেমনটা তার নিজের চোখে আছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
এরপরের ক’দিন অনন্যার কাটে প্রকৃতির সঙ্গে কথোপকথনে। সকালের নরম রোদে বই নিয়ে বসা, দুপুরে চা-বাগানের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া, আর সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বাতাসের শব্দ শোনা। মাঝে মাঝে আদৃত্যর সঙ্গে দেখা হয়—কখনও বাগানের এক কোনায়, কখনও পাখি দেখে ফিরছেন এমন মুহূর্তে। তারা কোনওদিনই একসঙ্গে বসে গল্প করেনি, কিন্তু এই চুপচাপ পাশে থাকার অভ্যেস যেন এক আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। শোভনা মাঝে মাঝে মজা করে বলে, “তোর চোখে আমি অন্য রোদ দেখি রে, এই পাহাড়টা কিছু একটা করে দিয়েছে তোকে।” কিন্তু অনন্যা জানেন, পাহাড় না, এই নিঃশব্দ সম্পর্কটা, এই ছেলেটির অব্যক্ত মায়া—এটাই তার ভিতরের জমে থাকা শূন্যতাকে অল্প অল্প করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তিনি জানেন না, এর শেষ কোথায়। জানতেও চান না। শুধু অনুভব করতে চান, যে দীর্ঘকাল পর কেউ একজন চায়ের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে বলছে—“তুমি আছো”, আর অনন্যার হৃদয়ের এক গভীর গোপন কোণে সেই উত্তর ঘুরে ফিরে আসে: “আমি নেই, কিন্তু ছিলাম, এবং…আবার হব।”
২
দেখা সেই জলধারার ধারে
তৃতীয় দিনটা ছিল একটু অন্যরকম। সকাল থেকেই পাহাড় ঢেকে রেখেছিল এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা—না কুয়াশা, না মেঘ। শোভনা বলেছিল, “আজ মুসুরির জলের ধারে যাবি নাকি? মন্দিরের পাশে একটা পুরোনো ট্রেইল আছে, একা একা হাঁটলে ভালো লাগবে। লোকজনও তেমন নেই।” অনন্যা রাজি হয়। চা-বাগানের কিনার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছতে হয় ছোট্ট এক পাহাড়ি ঝরনার কাছে—স্থানীয়রা যাকে বলে “মুসুরির জলের ধারা”। এটা কোনও ট্যুরিস্ট স্পট নয়, বরং গ্রামের মানুষজনের বিশ্বাসের জায়গা। ঝরনার পাশে একটা ছোট পাথরের মন্দির, যার গায়ে শিবলিঙ্গ আর বেলপাতার গন্ধ। কিন্তু অনন্যার নজর সেদিকে যায় না, বরং ধারা থেকে নেমে আসা পাথুরে পথের মোড়ে সে দেখে একজন বসে আছে—ঘাড় নিচু করে, হাঁটু মুড়ে। আদৃত্য। হাতে একটা স্কেচবুক, আর সামনের পাতায় আঁকা সেই জলধারা। ছেলেটা যেন পাহাড়েরই একটা অঙ্গ হয়ে গেছে—একাকী, দৃঢ় আর তীব্রভাবে জীবন্ত। তিনি কাছে গিয়ে দাঁড়ান, কিন্তু কিছু বলেন না। এমনকি পা টিপে টিপে এগোন, যেন ছেলেটির নির্জনতাকে বিঘ্ন না ঘটে। তবুও আদৃত্য বুঝতে পারে, মুখ না ঘুরিয়েই বলে, “আজ জলটা একটু বেশি শব্দ করছে, না?”
অনন্যা একটু থতমত খেয়ে যান। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বসে পড়েন পাশেই একটা পাথরের ওপর। “তুমি জলকে শুনো?” প্রশ্নটা অবাক হয়ে বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। আদৃত্য তখনও স্কেচের দিকেই তাকিয়ে, বলেন, “সবচেয়ে গভীর কথাগুলো জলই বলে। মানুষ তো শুধু চেঁচায়।” এই কথাটা যেন অনন্যার বুকে কেমন এক কাঁপুনি তুলে দেয়। এই ছেলেটির কথায় এমন এক অভিজ্ঞতার ছায়া, যা বয়সে বড় কারও মুখে শোনা যায় সচরাচর। তিনি ধীরে ধীরে জানতে পারেন, আদৃত্যর বাবাও বন দপ্তরে ছিলেন। শৈশব কেটেছে সিমলার এক চড়াই পথঘেরা সরকারি বাংলোয়। মা ছিলেন অবসাদগ্রস্ত, জীবনের শেষ কয়েক বছর কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই শূন্যতা আদৃত্যকে মানুষ করেছে পাহাড়, গাছ আর নদীর মধ্য দিয়ে। “মানুষের মুখে আমি বিশ্বাস হারিয়েছি ছোটবেলায়,” সে বলে, “তাই শব্দের থেকে ছায়া বেশি আপন লাগে।” অনন্যার মনে পড়ে, স্বামীর মৃত্যুর পর কতবার সে ডায়েরির পৃষ্ঠায় লিখেছে কিন্তু কাউকে বলেননি; কত কথা জমে গেছে কণ্ঠনালীর নিচে, বেরোতে পারেনি। আর আজ সেই অপূর্ব বিকেলে, পাহাড়ি ঝরনার ধারে, একজন অপরিচিত তরুণ তার কাছে এমন কথা বলে ফেলল যা হয়তো এতদিনে কেউ বলেনি।
চলে আসার সময় তারা পাশাপাশি হাঁটছিল। অনন্যা লক্ষ্য করেন, আদৃত্য একটু পিছিয়ে হাঁটে—না দূরে, না একদম কাছে—একটা নিরাপদ দূরত্ব রেখে, ঠিক যেমনটা কেউ মৃদু শ্রদ্ধায় ভরা সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়। মাঝে মাঝে পাথরের গায়ে হাত ছুঁয়ে দেখে, যেন পাহাড়ের শরীর চিনে নিচ্ছে। হঠাৎ অনন্যা থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি প্রতিদিন এখানে আসো?” আদৃত্য মাথা নাড়ে, “না, শুধু যেদিন মনে হয়, কিছু বলা দরকার।” উত্তরে অনন্যা একটু হাসেন, আর বলেন, “তাহলে আজ হয়তো আমার দিন ছিল।” সেই মুহূর্তে ঝরনার গর্জন যেন একটু থেমে গিয়ে নিঃশব্দে শুনে নেয় দু’জন মানুষের কথোপকথন—যেখানে না ছিল প্রেম, না বন্ধুত্ব, কিন্তু ছিল সেই গভীর আত্মিক স্বীকৃতি, যা শুধু নিঃসঙ্গতাই চেনে। পাহাড়ি রোদের নিচে তারা দুজনে নামতে থাকেন সেই পাথুরে পথ বেয়ে, দুজনেই জানেন না ঠিক কী নাম এই সম্পর্কের, শুধু জানেন—এই দেখা, এই শেয়ার করে ফেলা স্মৃতি, এই শব্দ আর নীরবতার মিশ্রণ…কোনও না কোনও ছায়া রেখে যাবে দুজনের মাঝখানে।
৩
বৃষ্টির মধ্যে দু’জন
দার্জিলিঙের আকাশ যেন হঠাৎ করেই বদলে যেতে জানে। সকালবেলা নীলচে রোদ, আর দুপুরের পরেই নামল ধোঁয়াশা, ছাইরঙা মেঘের দাপটে পাহাড় যেন ঢেকে গেল এক পুরু চাদরে। শোভনা সকালেই বলে রেখেছিল, “আজ বেরোস না অনু, ওই বাগানের দিকে মেঘ জমছে।” কিন্তু সেই নিষেধ যেন অনন্যার কানে ঢোকেনি, বা হয়তো ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। তার মধ্যে এক অদ্ভুত আনচান কাজ করছিল সারাদিন—একটা নির্দিষ্ট অস্থিরতা। সকালবেলায় আদৃত্যর সঙ্গে দেখা হয়নি, গতকালের জলধারার ধারেকাছে বসা সেই মুহূর্তটার পর থেকে মনের ভিতর যেন অজান্তেই একটা ভাবনার রেখা গেঁথে গেছে। তাই দুপুরের ঠিক পরেই একটা ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন—শুধু হাঁটতে নয়, বরং একটা অজানা আকর্ষণে টান অনুভব করে। বাগানের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি বুঝতে পারেন আকাশ গাঢ় হয়ে আসছে, বাতাসে ভেসে আসছে অদ্ভুত এক সোঁদা গন্ধ—চায়ের পাতার গন্ধ নয়, বরং জমতে থাকা বৃষ্টির, ভেজা মাটির। ঠিক সেই সময় শুরু হল টুপটাপ, প্রথমে কয়েক ফোঁটা, তারপর ক্রমশ ঝেঁপে নামল বৃষ্টি। পাহাড়ি বৃষ্টির আলাদা হাড়ে কাঁপানো রকমফের—না গর্জন, না বজ্রপাত, শুধু এক ঘন স্রোতের মত ঢেকে ফেলা জলকণা।
অনন্যা এক পাথরের নিচে দাঁড়িয়ে পড়েন। ছাতার নিচে বাঁচা যায় না এই বৃষ্টিতে। চারপাশে কেউ নেই, কুয়াশার মতো বৃষ্টির দেয়ালে পুরো পাহাড়টাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। তিনি ভাবছিলেন, যদি নিচের রাস্তা ভিজে যায়, তাহলে ফেরা কঠিন হবে। সেই মুহূর্তে কুয়াশার মধ্যে একটা ছায়া এগিয়ে আসে—মাথায় হুড, গায়ে খাকি রঙের রেইনকোট, হাতে একটা ছাতি। আদৃত্য। তার মুখে কোনও চমক নেই, শুধু ঠান্ডা স্বরে বলে, “এই সময় বেরোনো ঠিক হয়নি ম্যাডাম। রাস্তা নিচে নামছে, পিচ্ছিল।” তারপর নিজেই ছাতিটা অনন্যার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “আমার সঙ্গে চলুন, ওপরে একটা কাঠের শেড আছে বন দপ্তরের।” দুজনে পাথুরে পথে হাঁটতে শুরু করেন, ঘন বৃষ্টির মধ্য দিয়ে। পাশ থেকে ছাতার গা ঘেঁষে অনন্যার কাঁধে জলছাপ পড়ে, কিন্তু তার মুখে কোনও বিরক্তি নেই। বরং একটা প্রশ্রয়, এক অদ্ভুত আরামে ঢেকে যায় তার সারা মন। শেডে পৌঁছে দুজনে বসে পড়ে—সামনে কাঠের বেঞ্চি, একপাশে চা তৈরির পুরোনো কেটলি, পাশে শুকনো পাতা জমে থাকা মেঝে। আদৃত্য কেটলি দেখে জিজ্ঞেস করে, “চা খেতে চান?” অনন্যা একটু হেসে বলে, “এই আবহাওয়ায় চা না হলে বাঁচা দায়।” বনবিভাগের হেল্পার ছিল একজন বৃদ্ধ পাহাড়ি লোক, তার হাতেই তৈরি হয় আদা দেওয়া কড়া চা। বাইরে তখনও ঝরছে বৃষ্টি, আর শেডের ভিতরে দুজন বসে কথা বলছেন—কিন্তু সেই কথার বিষয়বস্তু ছিল অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দে ঘেরা।
অনন্যা জিজ্ঞেস করেন, “তুমি এখানে কতদিন?” আদৃত্য জানায়, “দেড় বছর হয়ে গেল, আগে সিকিমে ছিলাম। পাহাড়ই টানে।” তারপর দুজনের মধ্যে চলতে থাকে অনেক না বলা কথা—প্রকৃতি, শূন্যতা, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুহূর্তগুলো। অনন্যা বলেন, “বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শিকড় খোঁজে, কিন্তু কিছু মানুষ আছে যাদের শিকড় হয় না, তারা হাওয়া হয়।” আদৃত্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, “কিন্তু হাওয়াও তো ফিরে আসে কোনও গন্ধ বয়ে নিয়ে।” অনন্যার মনে হয়, এই কথার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে একটা স্পর্শ, একটা ইঙ্গিত। বৃষ্টির মধ্যে তারা দুজন, এক কাঠের ঘরের নিচে বসে, চায়ের কাপ হাতে—এই মুহূর্তটা কি শুধুই বন্ধুত্ব? নাকি বয়স, পেশা, পরিচয়ের বাইরে এক গভীর অনুভব? পাহাড়ি বৃষ্টির মতোই সেই অনুভব জমে রইল ঘন আকাশে, বয়ে গেল, কিন্তু ধরা দিল না—একটা শূন্যতা পূরণের গোপন প্রতিশ্রুতি হয়ে।
৪
পাহাড়ি রাত, নিঃশব্দ চাঁদ
পাহাড়ের রাত যেন অন্য এক পৃথিবী—যেখানে শব্দেরা নীরব হয়, বাতাস গা ঘেঁষে যায় অদৃশ্য শীতলতায়, আর আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে মখমলের মতো। সেইরকম এক রাতে অনন্যার দরজায় কড়া নড়ে। বাইরে তখন ঘন অন্ধকার। শোভনা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আদৃত্য ডেকেছে তোকে। আজ জঙ্গলের একটা রাতের প্যাট্রোল আছে, সে চাইছে তুই একবার ওদের সঙ্গে যাস। তুই তো বলেছিলি একদিন দেখতে চাস!” অনন্যা প্রথমে দ্বিধায় পড়ে যান, এই বয়সে রাতে জঙ্গলে যাওয়ার কথা ভাবলেও যেন বুক ধড়ফড় করে। কিন্তু কোথা থেকে যেন এক অদ্ভুত সাহস এসে ভর করে তার শরীরে। হয়তো এই সাহসটাই তার নিঃসঙ্গ জীবনের নতুন উত্তর—যেখানে অপেক্ষা নয়, সিদ্ধান্ত জরুরি। পরের এক ঘণ্টায় তিনি তৈরি হয়ে নেন—আলো-সহ ছড়ি, গরম জ্যাকেট, আর মনের ভিতর অল্প কাঁপুনি। শোভনার গাড়িতে বসে পৌঁছন ছোট্ট পাহাড়ি থানার বনবিভাগ অফিসের সামনে। আদৃত্য সেখানে অপেক্ষা করছিল—চোখে টর্চের আলোকছায়া, মুখে একান্ত মনোযোগ।
পাহাড়ি রাস্তা ধরে জিপগাড়ি চলছিল ঘন অন্ধকারের মধ্যে। আশেপাশে শুধুই বন—ঘন বাঁশঝাড়, শালগাছ, দূরে কোথাও রাতচরা পাখির আওয়াজ। গাড়ির ভেতরে অনন্যা, আদৃত্য ও আরও দুজন রেঞ্জ কর্মী। কথা হয় কম, কিন্তু নীরবতার মধ্যেও একটা স্বস্তি আছে। অনন্যা জানেন না ঠিক কী খুঁজছেন তিনি, কিন্তু তার মনে হয়, আজকের রাতটা যেন তাকে জীবনের কোনো পুরোনো অংশ থেকে ছিঁড়ে নতুন কিছুতে নামিয়ে দেবে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর গাড়ি থামে। তারা পায়ে হেঁটে পৌঁছন একটা উঁচু জায়গায়, যেখানে বনদপ্তরের একটা কাঠের ওয়ার্ডেন হাউস আছে। মেঝেতে ম্যাট, সামনে ছোট ক্যাম্পফায়ার, আর ওপরে আকাশ—যেখানে চাঁদ যেন নিচে নামতে চায়, পাহাড়ের গায়ে হাত রাখে মৃদু স্নেহে। অনন্যা চুপ করে বসে, তার পাশেই আদৃত্য। আগুনের আলোয় দুজনের মুখে ছায়া খেলে যায়। কিছুক্ষণ পর আদৃত্য বলতে শুরু করে—একটা গল্প, তার মায়ের। কীভাবে মানসিক অসুস্থতা তার শৈশবকে গ্রাস করেছিল, কীভাবে সে একা একা বড় হয়েছে। “আমি কাউকে কখনো বলিনি এই কথা,” বলে সে, “শুধু মনে হয়েছিল, আপনাকে বলা যায়।”
অনন্যার চোখে জল এসে যায়। এতদিন পরে কেউ তাকে ‘আপনি’ বলে মনে করে নিজের গল্প বলছে—এমন অনুভব তার জীবনে বহুদিন ছিল না। সে বলে, “আমি জানি একা বেড়ে ওঠার ব্যথা কেমন হয়। আমার মেয়েও অনেকটা সেইরকম। ও আজকাল কথা কম বলে, ব্যস্ত থাকে নিজের জীবনে। অথচ এক সময় আমরা খেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম।” এই কথাগুলো বলার সময় তার গলা কেঁপে ওঠে, আর আদৃত্য মাথা নিচু করে শোনে। তারা কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেয় না, শুধু বোঝে—এই পাহাড়ি নিঃশব্দতা তাদের যেভাবে মেলে দিয়েছে, তা শহরের শোরগোল কোনওদিন পারত না। রাত বাড়ে, আগুন নিভে আসে, তবুও তারা বসে থাকে পাশাপাশি। চাঁদের আলোয় জঙ্গলের ভেতরে কোনও গাছের ছায়া পড়ছে অনন্যার মুখে, আর আদৃত্যর চোখের দৃষ্টিতে মিশে যাচ্ছে সেই ছায়ার আলোছায়া। এই রাত যেন কোনও প্রেমের ঘোষণা নয়, বরং সেই নিঃশব্দ চুম্বন, যা স্পর্শ না করেও অনুভবের গভীরে বসে থাকে—অনন্ত সময় ধরে।
৫
পুরোনো ছবি, নতুন অর্থ
হোমস্টের ঘরে ফিরে আসার পর অনন্যা বুঝতে পারলেন, সেই পাহাড়ি রাত তাকে পাল্টে দিয়েছে। চোখে যেন নতুন একটা আলো, ভেতরে জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে ক্লান্তি কেমন শুকিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তিনি আয়নায় তাকিয়ে ভাবলেন—কী আশ্চর্য, এই বয়সে এসেও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়? স্বামীর মৃত্যুর পর এতগুলো বছর শুধু মেয়ের খবর, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, রান্নাঘরের তালিকা—এই দিয়েই তৈরি হয়েছিল তার পরিচয়। কিন্তু গত ক’দিনের প্রকৃতির সান্নিধ্য আর আদৃত্যর উপস্থিতি যেন সেই পরিচয়টাকেই প্রশ্ন করছে, নাড়িয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে। সকালে বারান্দায় বসে তিনি পুরোনো একটি অ্যালবাম খুলে বসেন—যেটা সঙ্গে এনেছিলেন নিজের মন ভাল করার জন্য। শোভনার বাড়িতে বসে পাহাড়ি রোদে পুরোনো ছবিগুলো যেন নতুন হয়ে উঠছে—কোনটায় দীপা ছোট্ট, স্কুলে যাচ্ছেন; কোনটায় স্বামী অনির্বাণ এক হাতে অনন্যার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন দার্জিলিঙেরই অন্য এক পাহাড়ি ছায়ায়।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলতেই দেখা যায়, আদৃত্য দাঁড়িয়ে। হাতে কিছু পাহাড়ি বুনো ফুল, চোখে যেন হালকা সংকোচ। “আপনার জন্য এনেছি,” বলে এগিয়ে দেয় ফুলগুলো। অনন্যা একটু হেসে বলেন, “তুমি বুঝি জানো আমি ফুল ভালোবাসি?” আদৃত্য মাথা নাড়েন, “আমি জানি আপনি নিঃশব্দতা ভালোবাসেন। ফুলগুলোও তেমনই, শব্দ করে না।” কথা শেষ হতেই তার চোখ পড়ে টেবিলের ছবির অ্যালবামে। অনন্যা একটু ইতস্তত করলেও তাকে বসতে বলেন, আর বলেন, “দেখবে?” আদৃত্য ধীরে ধীরে অ্যালবামের পাতা ওলটাতে থাকে। প্রতিটি ছবির মধ্যে আটকে আছে জীবনের একেকটি অধ্যায়—চোখে পড়ে অনির্বাণের হাসি, দীপার ছোট্ট হাত ধরা ছবি, অনন্যার শাড়ির কোঁচে লেগে থাকা সিঁদুর। আদৃত্য হঠাৎ বলে ওঠে, “আপনার চোখে তখনও এখনকার মতো একই রকম মায়া।” অনন্যা থেমে যান। বহুদিন কেউ এমন করে তাকায়নি তার দিকে, এমন শব্দ ব্যবহার করেনি, যা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়—ভেতরের সত্তাকেই ছুঁয়ে দেয়।
এরপর তারা কথা বলেন অনেকক্ষণ। অনন্যা শোনান তার শিক্ষকতা জীবনের গল্প, কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একটা পৃথিবী গড়ে তুলেছিলেন। “আমি ক্লাসে সবসময় চেষ্টা করতাম, যাতে কেউ নিজেকে ছোট মনে না করে,” বলেন তিনি, “কারণ ছোটবেলায় আমিও সেটা অনুভব করেছিলাম।” আদৃত্য চুপ করে শোনে, মাথা হেলিয়ে বলে, “তাই বুঝি আপনি কাউকে দৃষ্টিতে বিচার করেন না।” সেই একবাক্যে যেন অনন্যার সমস্ত লুকানো দুঃখ, অভিমান, ত্যাগ ও ভালোবাসা—সব স্বীকৃতি পায়। তার চোখের কোণে জল এসে যায়। জানালার বাইরে তখন পাহাড়ের রোদ নেমে আসছে ঝুপ করে, বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ। সেই মুহূর্তে তারা দুজনে বুঝতে পারেন—এই সম্পর্কটা কোনও নাম চায় না। এটা একটা অনুভব, একটা নির্জন সাহচর্য, যা হয়তো অল্প কয়েক দিনের জন্য, হয়তো অনন্তকাল। কিন্তু তাতে তার গভীরতা কমে না। পুরোনো ছবিগুলো তাদের সামনে নতুন অর্থ নিয়ে আসে—যেখানে অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমানের নিঃশব্দ সংলাপে মিশে যায়, আর দুই ভিন্ন বয়স, ভিন্ন যাপন এক আশ্চর্য সমান্তরালে হাঁটতে শুরু করে।
৬
মুখোমুখি প্রশ্ন
পাহাড়ে শীত গাঢ় হতে শুরু করেছে। বাতাসে নামছে রাতের ঝিম ধরা ঠান্ডা, আর সঙ্গে সঙ্গে হোমস্টের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে কাঠের উনুনে রান্না করা মেথি-আলুর ঝোলের গন্ধ। অনন্যা বারান্দায় বসে আছেন, হাতে চায়ের কাপ, চোখে ধরা পড়ছে দূরের কোনো অদৃশ্য শিখরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা অভ্যেস। ক’দিন ধরে পাহাড়ে কাটানো সময়টা যেন তার জীবনের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যকে আস্তে আস্তে পালটে দিচ্ছে—একটা চুপচাপ ভালো লাগা, এক নিঃশব্দ গ্রহণ, যা ভাষার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু সেই সন্ধেয় হঠাৎ শোভনা এসে বসল তার পাশে, মুখে একটু ঠোঁটকাটা হাসি আর চোখে কৌতূহলের আভা। “শুনছি বনদপ্তরের ছেলেটার সঙ্গে তো তোর বেশ বন্ধুত্ব জমেছে?”—বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা নিরবধি ভ্রুকুটি খেলে গেল অনন্যার মুখে। “মনে রাখিস, এই পাহাড়ে লোকজনের চোখ নাকি সজাগ,” বলে শোভনা, গলায় সেই পুরোনো বন্ধুত্বের ঝাঁঝ মিশিয়ে। অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তার বয়স, তার নিঃসঙ্গতা, সমাজের চোখ—সব একসাথে যেন চায়ের ধোঁয়ার মতো জমে উঠল বারান্দার বাতাসে। তারপর ধীরে বললেন, “তোর চোখেও কি শুধু বয়সটাই ধরা পড়ে, শোভনা? না কখনো মনটাও দেখিস?”
শোভনা থমকে যায়। একটু পরে কণ্ঠস্বর বদলে বলে, “আমি শুধু চাই তুই আঘাত না পাস, অনু। ছেলেটার বয়স অর্ধেক। কাল তো ফিরে যাবি, তারপর কী থাকবে?” অনন্যা হেসে ফেলেন, সেই হাসিতে একটা গভীর ক্লান্তি মিশে থাকে। “তুই জানিস, এই বয়সে এসে মানুষ কিচ্ছু চায় না—না প্রতিশ্রুতি, না গলা ছুঁয়ে থাকা ভালোবাসা। শুধু কেউ পাশে বসে চুপচাপ একটা গল্প বলুক, সেইটুকুই যথেষ্ট।” সেই রাতে ঘরে ফিরে ডায়েরির পাতা খুলে লেখেন—“আজ আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম—যদি সমাজ না থাকত, যদি বয়সের হিসেব না থাকত, আমি কি এই অনুভবটাকে অস্বীকার করতে পারতাম?” বাইরে তখন জোনাকি জ্বলে, পাহাড়ে বয়ে যাচ্ছে একরাশ শব্দহীন হাওয়া। অনন্যা বুঝতে পারছেন, এই প্রশ্ন শুধু শোভনার নয়, তার নিজের ভিতরের কণ্ঠও এটাই বলছে। আদৃত্যর উপস্থিতি তার জীবনে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, সেটার নামকরণ সমাজ দিক বা না দিক, তিনি নিজের মধ্যে তা গ্রহণ করছেন নিঃশব্দে।
পরদিন সকালের আলো একটু উজ্জ্বল। পাহাড়ের গায়ে পড়ছে সোনালি রোদ, আর বাগানের পাতা কুয়াশা মুছে ফেলে ঝলমলে হয়ে উঠছে। অনন্যা একা হাঁটতে বেরোন, আর পথের এক ধারে দেখি—আদৃত্য দাঁড়িয়ে আছেন, চুপচাপ, দু’হাত পকেটে ঢোকানো। চোখে এক ধরনের জিজ্ঞাসা। অনন্যা কাছে গিয়ে বলেন, “তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল।” তারা দুজনে পাশাপাশি হাঁটেন। অনন্যা বলেন, “আমার বয়স তোমার দ্বিগুণ, আমি জানি। কিন্তু একটা কথা বলতে চাই—এই কয়েকটা দিন আমি নিজের মধ্যে একটা আলাদা আলো পেয়েছি, যেটা বহুদিন ছিল না। সেটা তোমার জন্য।” আদৃত্য থেমে গিয়ে বলেন, “আপনার বয়স আমি দেখিনি কখনো। আমি শুধু দেখেছি একজন মানুষ, যিনি শব্দের মধ্যেও নীরবতা খুঁজে পান। আমি জানি এই সময়টা ক্ষণিকের, হয়তো আপনি চলে যাবেন। তবুও আমি চাই এই কয়েকটা দিন আমার মনেও থেকে যাক।” পাহাড় তখন নিশ্চুপ। শুধু পাখিদের ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়া, আর দু’জন মানুষের চোখে চোখ রাখা। এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই, কোনো শর্ত নেই, তবু এক অপূর্ব স্পষ্টতায় দাঁড়িয়ে থাকে সেটা। অনন্যা ফিরে তাকান, আর মনে মনে বলেন—হ্যাঁ, এই প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া গেল, মুখোমুখি।
৭
তির্যক আলোয় আদৃত্য
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে পাহাড়ের আলো কেমন হয়ে যায়—সোনালি নয়, ছাইও নয়, যেন কোনো পুরোনো ছবি থেকে ছিঁড়ে আনা দৃষ্টির মতো। সেই আলোয় অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে ঝিম ধরা উদাসীনতা আর বুকের ভিতর একধরনের চাপা না-পাওয়া অনুভব। শোভনার কথা, সমাজের দৃষ্টি, বয়সের ফিসফাস—সবকিছু মিলিয়ে একরকম গ্লানি তাকে স্পর্শ করছিল। অথচ সেই ফাঁকেই মনের ভিতরে একটা কোণ উজ্জ্বল হয়ে আছে, যেটা গত ক’দিনের সাহচর্যে জন্ম নিয়েছে। তিনি জানেন, এর পরিণতি হয়তো কিছু নয়—না সম্পর্ক, না সংজ্ঞা। কিন্তু মন মানে না, কারণ এই পাহাড়, এই নিঃশব্দতা, আর একজন আদৃত্য—সব মিলে জীবনকে এক নতুন রঙে রাঙিয়েছে। এমন সময় পেছন থেকে কণ্ঠস্বর শোনা যায়—“আপনি একা বসে থাকলে পাহাড় রাগ করে, জানেন?” ফিরে তাকিয়ে অনন্যা দেখেন, আদৃত্য এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দার বাঁকে। তার মুখে একরাশ ক্লান্তি আর চোখে হালকা অবসন্নতা, যেন আজকের দিনটা তাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে।
অনন্যা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “সব ঠিক তো? খুব চুপচাপ লাগছে তোমায়।” আদৃত্য হালকা হাসে, তারপর বলেন, “আজ একটা এলাকা থেকে একটা বাচ্চা চিতাবাঘ উদ্ধার করতে হয়েছিল। মা নেই। প্রায় মরে যাচ্ছিল। আমি কোলে করে নিয়ে এসেছি, ও আমার ঘরের পাশে শুয়ে আছে।” কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যায়—এই প্রাণীটির প্রতি তার কতটা টান, কেমন করে সে নিজের নিঃসঙ্গতাকে ভরিয়ে রাখে এই নির্জন সঙ্গীদের মধ্যে। একটু থেমে আদৃত্য বলে, “আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষের থেকে জন্তুরা অনেক বেশি বোঝে। তাদের চোখে কোনো মুখোশ থাকে না। আপনার চোখে আমি সেই সরলতা দেখেছি, জানেন?” এই কথা শোনার পর অনন্যা চুপ করে থাকেন। বাতাসে ঝুলে থাকে শব্দ, দুলে ওঠে অপ্রকাশ্য অনুভব। তারপর ধীরে ধীরে আদৃত্য বলতে শুরু করে নিজের অতীতের আরও কিছু টুকরো—তিন বছর আগে একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, নাম ছিল শ্রুতি। শহরে থাকতেন, সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল আগ্রহ থেকে, কিন্তু শেষ হয়েছিল বিষণ্নতায়। “আমি বুঝেছিলাম, আমরা দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ। আমি প্রকৃতির ভেতর খুঁজি মুক্তি, আর ও খুঁজত মোবাইল স্ক্রিনে। সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি স্থির করেছিলাম, আর কিছুতেই জড়াবো না—কিন্তু এখন…”
“কিন্তু এখন?”—অনন্যার গলা কাঁপে। আদৃত্য চুপচাপ বলে, “এখন আমি বুঝি, কিছু সম্পর্ক জন্ম নেয় না-থাকা থেকেও। আপনি না থাকলেও আপনার ছায়া থেকে যায়। আপনার কথা না বললেও আপনার ভাবনা আমার মাথায় আসে। আপনি স্পর্শ না করলেও আপনার উপস্থিতি আমাকে ঘিরে রাখে। এটা কি ভুল?” অনন্যার চোখ ভিজে ওঠে। এত সরলভাবে কেউ কোনোদিন তাকে বলেনি—তার অস্তিত্ব, তার নিঃশব্দ উপস্থিতি, এমন কারও মনের আকাশে ধরা পড়ে। তিনি কোনো জবাব দেন না, শুধু হালকা মাথা নেড়ে বলেন, “এই আলোয়, যখন সূর্য ডোবে আর চাঁদ ওঠে না—তখনই এমন কথারা জন্ম নেয়। হয়তো আমাদের জায়গা এই আলোয়, তির্যকভাবে। সম্পূর্ণ নয়, অসম্পূর্ণের মধ্যে পূর্ণতা খোঁজার মতো।” তারা দুজনেই জানেন, এই অনুভবের কোনো সহজ রাস্তাই নেই, তবু এটাই সত্যি। পাহাড়ের এই আলোয়, নৈঃশব্দ্যে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে, যেন দুটি ছায়া—আলোর মতো কাছে, আবার অন্ধকারের মতো নির্জন, অথচ গাঢ় সংযুক্ত।
৮
দূরত্বের সংলাপ
পরদিন সকালটা অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল ছিল। আকাশ নীল, রোদ ঠিকরে পড়ছে বাগানের পাতা জুড়ে, আর বাতাসে কেমন একটা ঝকঝকে ধোয়া গন্ধ। কিন্তু এই উজ্জ্বলতার ভিতর অনন্যার মনের আকাশটা যেন ঘন মেঘে ভরা—তীব্র আলোতে যেন কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। কাল রাতের সেই কথোপকথন, আদৃত্যর স্বীকারোক্তি, নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে আজ যেন তার মন দুলছে এক অস্থির দ্বিধায়। বারান্দায় বসে শোভনার দেওয়া চায়ের কাপটা হাতে ধরে রোদে চেয়ে থাকেন, কিন্তু চোখ থামে না কোথাও। ভিতরে ভিতরে জানেন, এই ঘনিষ্ঠতা, এই সাহচর্য ঠিক কেমন ঝুঁকির, সমাজ কী বলবে, মেয়ে জানলে কী ভাববে, এমনকি আদৃত্য যদি হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে পড়ে এই অসম সম্পর্কের ভারে? এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খুব স্বাভাবিক স্বরে, নিজের অজান্তেই তিনি বলেন, “আজ একটু একা থাকতে চাই।” কারো প্রতি নয়—না শোভনা, না আদৃত্যের প্রতি—শুধু নিজের মধ্যে ফিরে যাওয়ার একটা তীব্র টান।
দিনটা কাটে নিঃশব্দে। অনন্যা আজ আর বাগানে বেরোন না, কারও সঙ্গে দেখা করেন না। দুপুরে ডায়েরি নিয়ে বসেন, কিন্তু লিখতে পারেন না—শুধু দুচোখের কোণে শব্দেরা জমে থাকে, বেরোয় না। বিকেলের দিকে জানালা দিয়ে দেখেন, দূরে আদৃত্যর হুডি-পরা অবয়বটা পাহাড়ের পথ ধরে নেমে যাচ্ছে—কোনো দিকে তাকায় না, হাত পকেটে, পা একটু থেমে থেমে। যেন কেউ কিছু না বুঝেও সব বুঝে গেছে। সন্ধ্যেয় শোভনা এসে বলে, “তুই আজ খুব চুপচাপ, কিছু বলবি?” অনন্যা মাথা নাড়েন, “চুপ করে থাকাই ভালো আজ। চুপ থাকলে মন শুনতে পায়।” রাতে খাবার টেবিলে আদৃত্য ছিল না। শুনলেন, সে আজ রাতে অন্য রেঞ্জ অফিসে থাকবে—একটা বন্য হাতির সিগনাল এসেছে, পাহাড়ি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি করছে। কথাটা শুনে অনন্যার বুকের ভিতর হঠাৎ একটা ফাঁপা জন্ম নেয়, একটা অদৃশ্য শূন্যতা—যেখানে কেবল অপেক্ষা থাকে, কিন্তু তা কারও জন্য নয়, শুধু একটা অপরাধবোধের মতো।
রাত গভীর হলে তিনি চুপচাপ বারান্দায় আসেন, আকাশে তখনও চাঁদ ওঠেনি, কিন্তু তার আলোর পূর্বাভাস গাছের পাতায় পড়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ে, গত রাতে এই সময়েই তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল—কিছু না বলে সব বলেছিল। আজ তিনি একা। হাতে ফোন থাকে, কিন্তু কল করার সাহস হয় না। ডায়েরির পাতায় লিখেন—“আমি দূরে থাকলাম, হয়তো ভুল করে। কিন্তু এই দূরত্বেও তার উপস্থিতি কমে না। সে আছে আমার নিঃশ্বাসে, আমার না বলা কথায়, আমার দৃষ্টির প্রান্তে।” সেই রাত ছিল একধরনের অদৃশ্য সংলাপ—যেখানে কেউ মুখে কিছু বলেনি, তবুও দু’টি হৃদয়ের মধ্যেকার দূরত্বের শব্দ পাহাড়ের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দূরত্ব ছিল বাস্তব, কিন্তু ভেতরকার টান ছিল বাস্তবের বাইরের কিছু, যা ধরা যায় না—শুধু অনুভব করা যায়।
৯
এক কাপ চা, অনুপস্থিত কথা
পরদিন ভোরে খুব হালকা বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙে অনন্যার। পাহাড়ে এমন বৃষ্টি যেন আবেগের মতো—নরম, টিপটিপে, অথচ অদ্ভুত এক ভার রেখে যায় মনের ভিতরে। জানালার কাচে জমে থাকা জলকণায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, আর মন যেন একটু হালকা হয়ে আসছে। কিন্তু অনন্যা জানেন, আজকের দিনটা অন্যরকম। কারণ কাল রাতে তিনি কিছু না বলেই অনেক কিছু বলে ফেলেছেন। আদৃত্যকে এড়িয়ে যাওয়া, নিঃশব্দে দূরে সরে আসা—তা কিছু না বললেও বলেই দেয় কতটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে ভেতরে। সকালে শোভনা এসে বলে, “আদৃত্য খুব ভোরে ফিরেছে, কাল রাতের পাহাড়ি হাতির দল ওর সব প্ল্যানই গুবলেট করে দিয়েছে। সারা রাত জঙ্গলে ছিল।” এই কথা শোনার পর অনন্যার বুকের ভিতর হালকা ব্যথা ওঠে। কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন—তার চুপ করে যাওয়া, তার কিছু না বলার মধ্যেও একটা প্রশ্ন রেখে গেছে ছেলেটির মনে।
একটা চিঠির মতো মনে হয় তার মনের কথাগুলো—যেটা লেখা আছে, কিন্তু পৌঁছায়নি ঠিক জায়গায়। তাই তিনি এক কাপ চা বানিয়ে একা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ভিজে বাগানপথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছান বনবিভাগ অফিসের সামনে। সেখানে কেউ নেই। শুধু পেছনের কাঠের শেডে আদৃত্য বসে আছে, চোখে ক্লান্তি, মুখে অভিমান মেশানো নিশ্চুপতা। তিনি চুপ করে গিয়ে পাশে বসেন, হাতে থাকা কাপটা এগিয়ে দেন—“এই চা-টা শুধু তোর জন্য, বাকিটা আমার মন।” আদৃত্য চোখ তুলে চায়, সেই চোখে প্রশ্ন নেই, অভিযোগও নেই—শুধু একরাশ নীরব কৌতূহল। অনন্যা বলেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম আদৃত্য, জানিস? ভয় পেয়েছিলাম, যদি এই বন্ধুত্বটাও ভেঙে যায়, যদি তুই ক্লান্ত হয়ে পড়িস, যদি সমাজের চোখ আমায় ছোট করে তোলে। আমি ভুল করেছিলাম দূরে গিয়ে, বুঝেছি তোর স্পর্শ ছাড়াই তুই থাকিস আমার মধ্যে।”
আদৃত্য তখন একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, তারপর ধীরে মাথা হেলিয়ে বলে, “আপনি যদি ভুল করেন, আমিও তো করি। আপনাকে বোঝার আগেই ধরে নিই আপনি চলে যেতে চান। অথচ আমারও ভয় ছিল—আপনাকে যদি আটকে ফেলি, আপনি হয়তো আমার থেকে ঘৃণা নিয়ে চলে যাবেন। তাই চুপ করে ছিলাম।” তারা দুজনেই বুঝতে পারেন, এই সম্পর্ক কোনো মানে খোঁজে না, খোঁজে অনুভব। আজ তারা একে অপরের পাশে বসে থাকে, ঠিক যেমন চা-বাগানের পাতারা ভিজে থাকে বৃষ্টিতে—কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই, শুধু স্বাভাবিকভাবে। সেই চায়ের কাপ, সেই অনুপস্থিত কথাবার্তা—সবকিছু যেন হয়ে ওঠে নতুন করে একে অপরের মনের কাছে ফেরা। সম্পর্ক আবার কোনও নতুন মোড় নেয় না, শুধু ফিরে আসে সেই জায়গায়, যেখান থেকে তারা দূরে গিয়েছিল। আর পাহাড়—সব শুনে, সব চুপ করে মেনে নেয়।
১০
তুমি আছো, আমি নেই
অনন্যার পাহাড়ে থাকার শেষ দিন। হোমস্টের জানালায় ঝুলে থাকা সাদা পর্দাটা বাতাসে দুলছে, আর সকালের রোদ তার মুখের অর্ধেক জুড়ে ছায়া ফেলে দিয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে স্যুটকেস গুছিয়ে নিচ্ছেন—জুতো, কয়েকটা শাড়ি, ও সেই পুরোনো অ্যালবামটা, যেটা এখানে থাকতেই যেন বদলে গেছে। প্রতিটি ছবির মানে পাল্টেছে, রং পেয়েছে আদৃত্যর সাহচর্যে। ঠিক তখনই তিনি খেয়াল করেন, ডায়েরির ভিতরে একটা ছোট্ট কাগজ ঢুকানো—আদৃত্যর হাতের লেখা, হয়তো কখন রাতে রেখে গেছে। তাতে লেখা—“আপনি যাচ্ছেন, জানি। আমি কোনওদিন কিছু চায়নি, আজও চাই না। শুধু জানবেন, আপনি আমার জীবনে একটা পাহাড়ি চুপচাপ নদীর মতো এসে গেছেন—সব না ভেঙে, কিছুকে বাঁচিয়ে। আপনি ছিলেন বলেই আমি এখন একা হয়ে থাকলেও ভয় পাই না। আপনি আছেন বলেই আমি নেই, তবু সম্পূর্ণ।”
এই অল্প কয়েকটি লাইনে যেন অনন্যার সমস্ত শ্বাস আটকে আসে। তিনি বুঝে যান, কিছু সম্পর্ক চিৎকার করে না, দাবি জানায় না, শুধু থেকে যায় হৃদয়ের গভীরে, এক নিঃশব্দ চিহ্ন হয়ে। তার চোখ বেয়ে জল নামে না, শুধু ভেতরে এক আশ্চর্য শূন্যতা জন্ম নেয়—যেটা বেদনার নয়, বরং পূর্ণতার, কারণ কেউ একজন তাকে সত্যিকারের বুঝেছে। গাড়ি আসার সময় হয়। শোভনা হালকা গলায় বলে, “তোকে দেখে চিনতে পারছি না, অনু। যেন কোনো পাহাড়ি ধ্যান থেকে ফিরলি।” অনন্যা হেসে বলেন, “কখনো কখনো মানুষ পাহাড়েই চুপ করে থেকে যেতে চায়। কিন্তু যেতে পারে না।” গাড়ি চলে যখন, পেছনের জানালা দিয়ে তিনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন—দেখতে পাননি আদৃত্যকে, কিন্তু অনুভব করেছেন তাকে। দূরে কাঠের শেড, ভিজে পথ, বৃষ্টিতে সিক্ত বাগান—সব যেন তার চোখে এক চিত্রপট হয়ে ছড়িয়ে আছে।
তিন মাস পরে, কলকাতার অ্যাপার্টমেন্টে একদিন বিকেলে তিনি চায়ের কাপ হাতে আবার সেই ডায়েরি খুললেন। অনেকটা পাতা লিখে ফেলেছেন এখন—প্রতিদিন একটা করে স্মৃতি, একটা করে অনুভব। দীপা আসে দেখতে, বলে, “মা, তোমার লেখাগুলো অসাধারণ। বই করলে কেমন হয়?” তিনি শুধু বলেন, “একটা জীবন যদি না বলা থাকে, তা হলে তো বাঁচাটা অসম্পূর্ণ।” সেই ডায়েরির শেষে তিনি লিখেন—“তুমি আছো, আমি নেই—কারণ তোমার ভেতরেই আমি থেকে গেছি। তুমি পাহাড়, আমি সেই মেঘ—যে ছুঁয়ে যায়, কিন্তু রয়ে যায় তোমার চূড়ায়। আমরা না থেকেও একসাথে।” এই শেষ বাক্যটা লিখে, তিনি বুঝে যান—সেই পাহাড়ি দিনে পাওয়া সম্পর্ক, বয়সের সীমার বাইরে গড়ে ওঠা হৃদ্যতা, সমাজের চোখের আড়ালে জন্ম নেওয়া বোঝাপড়া—সব কিছুই সত্যি ছিল। কিছু অনুভব থেকে যায় না-থাকায়, ঠিক যেমন পাহাড়ে কেউ একবার এলে সে চিরকাল থেকে যায় বাতাসে।
বছরখানেক কেটে গেছে। অনন্যা এখন বইমেলায় দাঁড়িয়ে আছেন, তার নিজের লেখা প্রথম বই “তুমি আছো, আমি নেই” হাতে নিয়ে। চায়ের কাপে ভর করে তার হাত কাঁপে না, মুখে একধরনের শান্ত সম্মতি—একটা দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ শেষ করে যিনি ফিরে এসেছেন নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে। বইয়ের পাতায় পাতায় গেঁথে আছে পাহাড়ি দিন, কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক, কাঠের শেডে ভাগ করা চায়ের কাপ, আর এমন এক সম্পর্ক যা নাম চায় না—চায় অনুভব। পাঠকরা এসে বলেন, “আপনার ভাষায় এমন এক নিঃশব্দতা আছে, যেটা ছুঁয়ে যায়।” অনন্যা শুধু হাসেন, কারণ তিনি জানেন, সেই নিঃশব্দতার উৎস এক পাহাড়ি সন্ধ্যায়, এক চোখের দিকে তাকানো বিশ্বাসে, এক বুক চেপে রাখা সাহচর্যে।
বইয়ের শেষ পাতায় রয়েছে এক অল্প কয়েক লাইনের উত্সর্গ:
“এই বইটি তাদের জন্য—যারা বয়সে নয়, হৃদয়ে পূর্ণ হয়।
যারা ভালোবাসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা,
আর যারা জানে—সব সম্পর্ক বলা যায় না,
কিন্তু অনুভব করে গেলে তা চিরকাল থাকে।
তুমি পাহাড়, আমি সেই মেঘ—
একবার এসে গেছি, আর কখনও ফিরিনি।”
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাঠক বইটা উল্টে পড়ে দেখছে। সাদা পাতার ভাঁজে একটি শুকনো বুনোফুল রাখা—যেটা হয়তো এক পাহাড়ি সকাল থেকে চলে এসেছে এই শহরের বুকেও।
সমাপ্ত




