Bangla - প্রেমের গল্প

তাহাদের দেখা হয়েছিল মাঘের শীতে

Spread the love

ঊর্মি দাশগুপ্ত


মাঘ মাসের এক কুয়াশাভরা সকালে বাস থেকে নামল সুদীপ। বোলপুরের পরে আরও চল্লিশ মিনিটের রাস্তা ধরে পৌঁছেছে নদীপারের ছোট্ট গ্রাম ‘চণ্ডীপুর’। ঠান্ডার কামড়ে কাঁপছিল চারদিক, ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির রোদ উঠলেও গলে না। হালকা বাদামি রঙের মাফলার জড়িয়ে সে তাকিয়ে রইল চারপাশে—বাঁশঝাড়, সরু মাটির পথ, আর দূরে গাঁয়ের মাঠে কিছু কাক খুঁটে বেড়াচ্ছে। মোহন কাকার সাইকেলের টুং টাং শব্দে সে ফিরে এল বাস্তবে। “এই তো! পৌছেও গেলে,” মোহন কাকা হাসলেন। মোটা চাদর জড়ানো শরীর আর রুক্ষ গলা, তবে চেহারায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট। কলেজে পড়ার সময় সুদীপ একবার এক সেমিনারে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, তখনই বলেছিলেন—”তুই যদি গ্রাম নিয়ে কোনোদিন গবেষণা করিস, চলে আয় আমাদের চণ্ডীপুরে, এখানকার লোকজন আর সংস্কৃতি তোকে নিরাশ করবে না।” সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এলো আজ। নিজের থিসিসের জন্য, কিন্তু মন বলে অন্য কিছু। সাইকেলের পেছনে বসে গ্রামের ভিতর ঢুকল সে, চারপাশের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল—কোথাও মাঠে সরিষা ফুটেছে, কোথাও মেয়েরা পুকুর ঘাটে হাঁটু জলে বসে কাপড় কাচছে। কুয়াশার চাদরে মোড়া গ্রামটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে—শহরের মত তাড়াহুড়ো নেই, হর্ন নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। মোহন কাকার উঠোনে নামতেই গৃহস্থালি গন্ধে ভরে উঠল নাক—পিঠে বানানোর খড়ের আঁচ, ধোঁয়ার সঙ্গে মেশানো সর্ষের তেল, পাকা কলার গন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই চায়ের পেয়ালা হাতে তাকে ডেকে বসালেন কাকার বৌদি, আর পাশেই বসে ছিল একজন মেয়ে—শ্যামলা, দীঘল চুল, গলায় নীল-সাদা গামছা, চোখে বই পড়ার মত গভীর মনোযোগ, অথচ কোনো বই ছিল না হাতে। সুদীপ একটু নড়েচড়ে বসতেই মেয়েটির চোখ পড়ল তার দিকে—সুস্থির, নির্ভার, কিন্তু একরকম কৌতূহল যেন সেখানে জমে ছিল।

মেয়েটির নাম জানা গেল দুপুরে—মাধবী মণ্ডল। স্থানীয় স্কুলে সহশিক্ষিকা, কিন্তু তার পরিচয় শুধুই পেশাগত নয়। গ্রামের যে কোনও বিষয় জিজ্ঞাসা করলেই সে ঝরঝরে করে বলে দেয়। সুদীপ প্রথমে ভেবেছিল গবেষণার কাজ করতে গিয়ে কেবল তথ্যই সংগ্রহ করবে—লোকসংস্কৃতি, গান, রীতিনীতির চালচিত্র। কিন্তু মাধবীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই সে বুঝতে পারল, এখানে কেবল বাইরে থেকে দেখা রূপ নয়—ভেতরে এক গভীর বোধ লুকিয়ে রয়েছে। সে কথা বলে স্পষ্ট উচ্চারণে, কোনো দ্বিধা নেই, অথচ মধ্যে মধ্যে তার চোখ আড়াল হয়ে যায় অন্য কোনো ভাবনায়। দুপুরে যখন পুকুরের ঘাটে সবাই পিঠে বানাতে ব্যস্ত, তখন সুদীপ এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখে মাধবী মাটির হাঁড়িতে নারকেল-কুঠানো দিয়ে গরম করে পিঠের পুর বানাচ্ছে। চোখে পড়ার মত কিছু নয়, কিন্তু সেই সহজ, গৃহস্থালি দৃশ্যটা যেন তার অন্তরে গেঁথে যায়। শহরের যে মেয়েদের সে জানে, তারা অন্যরকম—কৃত্রিমতা আর অভ্যস্ত হুডির আড়ালে লুকিয়ে থাকে একাকীত্ব, অথচ এই মেয়েটি যেন নিজের পৃথিবী নিজের হাতে গড়ে তুলেছে। মাধবী বারবার কথা বলার সময় তার চোখে চোখ রাখে না, কিন্তু প্রতিটা প্রশ্নে যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, তা সুদীপকে নাড়া দেয়। বিকেলে মাধবী তার সঙ্গে হাঁটতে বেরোয় মোহন কাকার অনুরোধে—সেই সময়ই তারা প্রথমবার নিজেদের কথা বলতে শুরু করে। সুদীপ জানতে পারে, মাধবী ছোট থেকেই এই গ্রামে, শহরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু বাবার অসুস্থতায় ফেরা হয়ে ওঠেনি। সে আক্ষেপ করে না, বরং বলে—”এই গাঁয়ের মেয়েদের জীবন এমনই হয়, ভেবেই নিতে হয় যা পাওয়া যায় তাই নিয়েই এগোতে হয়।” কথাটার মধ্যে যেমন বেদনা ছিল, তেমনই ছিল এক অনমনীয় বাস্তববোধ।

সন্ধ্যার সময় পুব আকাশ লাল হতে হতে হারিয়ে যায় নীল কুয়াশায়। মাধবী তখন সানাইয়ের সুর শুনিয়ে নিয়ে আসে এক মন্দিরের ধারে, যেখানে লোকেরা বসে গানের আসর করে। সুদীপ বিস্ময়ে দেখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা কী গভীর আবেগ নিয়ে গেয়ে চলেছে পুরনো পালাগান, ভাটিয়ালি, বাউল গান। সেখানেই মাধবীর গলায় শুনে সে এক পুরনো লোকগীতি—“যত দূরে যাই, মাটির গন্ধ ফেরায়…” গান শেষ হতেই চারপাশে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, আর সেই মুহূর্তেই সুদীপ বুঝে যায়—সে শুধু গবেষণার জন্য আসেনি এখানে। এই মেয়েটির চোখের ভিতর এক আলাদা পৃথিবী লুকিয়ে আছে, যা সে আগে কখনও দেখেনি। নিজের ক্যামেরা, ডায়েরি, রেকর্ডার সবই সরে গিয়ে তার চোখে তখন শুধু মাধবী। কিন্তু শহরের মানুষ, সে জানে, তেমন সহজে কোনও গ্রামীণ মেয়ের বিশ্বাস পায় না। রাত বাড়ে, পিঠে-পুলি আর উনুনের আগুনে গা গরম করে সে উঠে পড়ে শোবার ঘরে। জানলার ফাঁক দিয়ে কুয়াশা ঢুকে পড়ছে, দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। সুদীপ চাদর গায়ে দেয়, কিন্তু তার ভিতরের আলোড়ন যেন থামে না। হয়ত এই গ্রামে তার গবেষণা শেষ হবে কয়েক সপ্তাহে, কিন্তু এই মেয়েটির উপস্থিতি থেকে যাবে বহু বছর ধরে—যেমন কোনো এক অজানা শীতের রাতে দেখা স্বপ্ন, যেটা ঘুম ভাঙার পরেও ভোলা যায় না।

***

পরদিন সকালটা যেন আগের তুলনায় আরও নিস্তরঙ্গ ছিল। মাঘের কুয়াশা যেন এক অদৃশ্য পর্দার মতো গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছিল, আর সেই চাদরের ভিতর হেঁটে চলছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধারা, হাতে ছেঁড়া গামছা ধরে গরু হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন মাঠে। সুদীপ উঠেই বাইরে এসে দাঁড়ায় উঠোনে—হাতে চায়ের কাপ, গায়ের উপর ছড়িয়ে থাকা রোদ, আর দূরে কোথাও নারকেলের গায়ে বাজে কাকের কণ্ঠস্বর। মাধবী তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে, মাথায় ওড়না, হাতে একটা খাতা, গাছতলায় বসে কিছু যেন লিখছিল। তার চোখের কোণে যে মনোযোগ ছিল, তাতে বোঝা যায় এ শুধু সময় কাটানো নয়—এই মেয়েটি জীবনের ছোট ছোট জিনিসগুলোকে ধরে রাখে, যেন জীবনের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা খোঁজে। সুদীপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর এগিয়ে গিয়ে বলে, “এখানে তোমরা সকালবেলা লিখতেও পারো?” মাধবী মুখ তুলে হেসে বলে, “গাঁয়ের মানুষ দিনে কাজ করে, আর ভাবনা আসে ভোরে।” সেই এক সরল বাক্যে সুদীপ আবার কেমন চুপ করে যায়। তাদের কথাবার্তা যেন অচেনা, অথচ ভীষণ সহজ। শহরে তো এই কথারই বড় অভাব—সোজা করে বলা, চোখে চোখ রেখে বলা। মাধবী তার খাতা বন্ধ করে বলে, “আপনার গবেষণার কাজ কেমন চলছে?” সুদীপ বলে, “শুরুই তো করিনি ভালো করে, খালি মনে হচ্ছে, এখানে এসে আমি ভুলে যাচ্ছি গবেষণা—বরং নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি।” মেয়েটি চোখে চোখ রাখে না, কিন্তু একটা মৃদু হাসি মুখে খেলে যায়। সে বলে, “তা ভালোই তো—যত দিন আছেন, থাকুন আপন করে।”

সেই দুপুরে তারা আরও অনেক কথা বলে—ধীরে ধীরে, সহজ গতিতে। মোহন কাকা তাদের নিয়ে যান পাশের গ্রামে, যেখানে এক পুরনো লোকশিল্পীর সঙ্গে দেখা হয়। মাধবীই সব কথা বলেন, পরিচয় করিয়ে দেন, গানের কথা লেখেন খাতায়। সুদীপ মাঝে মাঝে রেকর্ড করে, কখনও ছবি তোলে, কিন্তু তার চোখ পড়ে থাকে অন্যদিকে—মাধবীর ভ্রু কুঁচকে যাওয়ার ধরণে, কথা বলার সময় মাথা হালকা একদিকে হেলানোর ভঙ্গিতে, আর মাঝে মাঝে যখন সে চুপ করে যায়, তখন তার গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা মুখটায়। এক জায়গায় তারা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় খেজুর বাগানের মধ্যে—চুপচাপ, পাতার ফাঁকে আলো এসে পড়ছে মাধবীর চুলে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “আপনারা শহরের মানুষ কি গ্রামে এসে কিছু বদলাতে পারেন সত্যিই?” প্রশ্নটা খুব সাধারণ মনে হলেও, সুদীপ বুঝে যায়, এটা শুধুই তথ্য নয়—এই প্রশ্নের মধ্যে আছে এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভার। সে থেমে গিয়ে ভাবে, তারপর ধীরে বলে, “আমরা বদলাতে পারি কি না জানি না, তবে শেখার চেষ্টা করি। অনেক সময় গ্রামের মানুষদের জীবনই আমাদের শেখায়—কীভাবে বাঁচতে হয়।” মাধবী একটু তাকায় তার দিকে, এবার চোখে চোখ রেখে। আর কিছু বলে না, শুধু বলে, “অনেকেই আসে, দেখে যায়, আর বলে—এখানে জীবন থেমে আছে। কিন্তু আমরা তো থেমে থাকি না, শুধু দৌড়াই না তোমাদের মত।” সেই কথা যেন সুদীপের বুকের ভিতর কোথাও গিয়ে থামে।

সন্ধ্যায় ফিরে এসে তারা উঠোনে বসে—চায়ের কাপ পাশে, মাটিতে বেতের মোড়া। পেছনে ধূপের গন্ধ, সামনে জ্বলে উঠেছে মাটির প্রদীপ। আলো-আঁধারির এই পরিবেশে কথাগুলো আরও খোলামেলা হয়ে ওঠে। সুদীপ জানতে চায়, “তুমি কি কখনো শহরে যাওয়ার কথা ভেবেছো? পড়াশোনা বা কাজের জন্য?” মাধবী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “ভাবতাম, ছোটবেলায় ভাবতাম খুব—কলকাতায় গিয়ে বড় স্কুলে পড়াবো, হয়ত ইংরেজি মিডিয়ামে। কিন্তু সময় আর বাস্তবতা মিলিয়ে দেয় সব স্বপ্ন। বাবা অসুস্থ হলেন, মা একা সামলাতে পারছিলেন না, তখন মনে হল—নিজেদের লোকের জন্য কিছু না করে বাইরে গিয়ে কী হবে?” তার কণ্ঠে কোনো হতাশা নেই, বরং যেন এক স্থিরতা। সুদীপ মনে মনে ভাবে—এমন একটা মেয়ে যদি শহরে জন্মাত, হয়ত একদম আলাদা জীবন পেত। কিন্তু তার মাধবী তো এইখানেই, এই গন্ধে, এই আলোয়—যেখানে পিঠের উনুন জ্বলছে, আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বাউল সুর। সময় থেমে থাকে কিছুক্ষণের জন্য, তারা চুপ করে থাকে দু’জনেই। মাধবী তারপর বলে, “আপনার গবেষণায় আমি সাহায্য করতে পারি চাইলে, তবে আমি শুধু গ্রামের কথা বলবো, শহরের কিছু জানি না।” সুদীপ একটুও না ভেবে বলে, “তোমার জানাটাই আমার কাজের আসল উপাদান।” দু’জনেই তখন জানে, এই কথোপকথন শুধুই কাজ নিয়ে নয়—এখানে এক আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছে, যা বলার ভাষা পায় না, কিন্তু নিঃশব্দে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন মাঘের শীত—ধীরে ধীরে, অথচ গাঢ়ভাবে।

***

চণ্ডীপুরে সূর্য ডোবার ঠিক আগে নদীর পাড়ে যেন এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা নামে। বাতাসে ধানের গন্ধ মেশে, পাখিরা ফিরতে শুরু করে গাছে, আর নদীর ওপারে ছায়া ঢেকে ফেলে চরাভূমি। মোহন কাকা বিকেলে বলেছিলেন, “আজ সন্ধ্যায় মাধবী তোমায় নিয়ে যাবে নদীর ধারে, গাঁয়ের পুরনো ঠাকুরদালানটা দেখতে।” সুদীপ চুপ করে শুনেছিল, কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করছিল। বিকেল নামতেই মাধবী এসে দাঁড়ায় উঠোনে—চাদর জড়ানো শরীর, হাতে একটি টোকা ঝোলানো ব্যাগ, আর সেই চেনা গামছাটা গলায়। “চলুন?”—তার স্বরে কোনো দ্বিধা নেই। তারা পাড়ার গলি পেরিয়ে হাঁটতে থাকে সরু পাঁকে বাঁধানো পথে, যেটা নদীর দিকে নামে। গাছপালার মধ্যে দিয়ে সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ছিল ঘাসে, আর কুয়াশা ধীরে ধীরে নামছিল যেন। হাঁটার সময় দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা হয় না—শুধু মাঝে মাঝে মাধবী থেমে কিছু দেখায়, “ওই গাছটার নিচে বসে কীর্তন হয় সন্ধ্যেবেলা”, “ওইখানে এক বুড়ি থাকতেন, লোক বলত তাঁর চোখ নাকি ঝলসে যেত রাগে।” সুদীপ শোনে মন দিয়ে, মাঝে মাঝে ক্যামেরা তোলার ভান করে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে মাধবীর মুখে। নদীর ধারে পৌঁছে দেখে একটা পুরনো দালান—নির্জন, খোলা ছাদে কিছু কাঁসার ঘণ্টা ঝোলানো, বাতাসে তার শব্দ হয় টুং টাং করে। চারপাশে পাতা ঝরা, আর নদীর ধারে বসার মতো একপাটি মোটা পাথর রাখা। মাধবী বসে পড়ে, গা গুটিয়ে বলে, “এখানে বসলে ভালো লাগে। অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। শীতকালে এখানে কেউ আসে না, খুব ঠান্ডা পড়ে।”

সুদীপ পাশে বসে। প্রথমবার সে এতটা কাছ থেকে দেখছে মাধবীর মুখ—পাশের চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, ঠোঁটের কোনে শীতের লালচে দাগ, চোখে যেন দূরে হারিয়ে যাওয়ার আকুলতা। সে চুপ করে বলে, “তুমি গান গাও তো? আগের দিন মন্দিরে শুনেছিলাম।” মাধবী মাথা ঝাঁকায়, “গাই—মা শেখাতেন। আগে গান ছিল খুব প্রিয়, এখন সময় কম পাই।” হঠাৎ সে বলে, “আপনিও গাইতে পারেন?” প্রশ্নটা সরাসরি, কিন্তু মুখে হাসির ছোঁয়া। সুদীপ বলে, “শহরের লোকেরা গানের চেয়ে গান শোনা ভালো বোঝে, গাওয়া নয়।” মাধবী একটু হেসে নেয়, তারপর আস্তে আস্তে শুরু করে একটা পুরনো বাউল গান, গলা খুব উঁচু নয়, কিন্তু গায়ে কাঁটা দেওয়া আবেগ।

“আমার মন ভেসে যায়, রঙিন পালতোলা নাওয়ে…
কোন ঘাটে ভিড়বে সে নাও, কেহ জানে না কেহ জানে না…”
সুদীপ বুঝে ওঠে না, গান শুনছে না, না কি সময় থেমে গেছে। মাধবী গান শেষ করে চুপ করে বসে থাকে, নদীর দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পর বলে, “গানের মধ্যে যে জিনিসটা থাকে, শহরের জীবনে সেটা হারিয়ে যায়, জানেন?”
সুদীপ তার দিকে না তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, জানি। অথবা হয়ত আমরা জানতেও চাই না।”

আলো মুছে যেতে থাকে চারদিক থেকে। দূর থেকে বাঁশবনে সাঁঝের পাখির ডাক শোনা যায়, আর নদী যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে ঠান্ডায়। মাধবী উঠে দাঁড়ায়, তার ওড়নাটা কাঁধে টেনে নেয় শক্ত করে। “চলুন,” সে বলে। সুদীপ উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু মনে হয় কিছু একটা বলা বাকি থেকে যাচ্ছে। তারা ফিরে আসতে থাকে হাঁটতে হাঁটতে, অন্ধকার একটু একটু করে গ্রাস করছে মাঠের ধুলো। হঠাৎ সুদীপ থেমে বলে, “তুমি জানো, আমি এমন সময় খুব ভয় পাই।”
মাধবী তাকায়, “কেন?”
সুদীপ বলে, “কারণ আমি জানি, এই মুহূর্তটা আবার আসবে না।”
মাধবী তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্ত, তারপর বলে, “সব সময় তো ফিরে আসা যায় না, কিছু কিছু সন্ধ্যা কেবল একবারই আসে।”
সেই কথার পর দুজনেই আর কিছু বলে না। পথের পাশে গাছের ছায়া নেমে আসে, তারা ধীরে হাঁটে, যেন সময়ের ভেতর দিয়ে। বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে দূরে, আর পেছনে পড়ে থাকছে একটা নদীর পাড়, একটা গান, আর একটি সন্ধ্যা—যা হয়তো সত্যিই আর কোনও দিন আসবে না।

***

চণ্ডীপুরের শান্ত সকালগুলো এমনই—কখনো ঘুম ভাঙে পাখির ডাক, কখনো দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। তবে আজকের সকালটা কিছুটা অস্থিরতায় ভরা। মোহন কাকার উঠোনে বসে চায়ের কাপ হাতে ধুঁয়ে আসা শীতের রোদে গা ভেজাচ্ছিল সুদীপ, হঠাৎই ফোনটা কেঁপে উঠল। ওপাশে অরিত্র—বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, থিসিসে সহগবেষক। উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “দ্যাখ, প্রেজেন্টেশনের তারিখ এগিয়ে এসেছে। আগামি সপ্তাহেই জমা দিতে হবে! কাজের প্রায় সবটা তো তুই চণ্ডীপুরে বসে করে ফেলেছিস, এবার ফিরে আয়, এডিট করতে হবে, স্লাইড বানাতে হবে।” সুদীপ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। দূরে একটা কাক ডাকা থামিয়ে বসে পড়েছে বাঁশের মাথায়। অরিত্রর কথায় সে কোনো উত্তরের ছাঁপ না দিয়ে শুধু বলল, “ঠিক আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরছি।” কিন্তু ফোনটা কেটে দেবার পর সে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, যেন দিশেহারা হয়ে গেছে। ক’দিনের এই গ্রামজীবন তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে, শহরের ফিরে যাওয়া এখন মনে হচ্ছে এক নির্মম ছেদ। সে বুঝতে পারছে, কলকাতা তাকে ফেরত চাইছে—তাদের ভাষায়, সময়মতো দায়িত্ব পালন করতে হবে। অথচ তার মন পড়ে আছে পাটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের চোখে।

সেদিন দুপুরে সে মাধবীর সঙ্গে দেখা করল। স্কুল ছুটির পর মাধবী হাঁটছিল নদীর দিকে, সেদিকে হেঁটেই সুদীপ তাকে ডাকল। “তুমি কি ব্যস্ত?” মাধবী তাকাল, “না, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।” তারা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। পথের দুপাশে সর্ষের ক্ষেত, এক পায়ে পথ দিয়ে ধুলো উড়ছে। সুদীপ বলল, “একটা খবর দেবার ছিল।” মাধবী থেমে তাকাল, মুখে কোনো প্রকাশ নেই। “কলকাতা ফিরতে হবে কয়েকদিনের মধ্যে। প্রেজেন্টেশন জমা দিতে হবে।” মাধবী মাথা নিচু করে বলল, “বুঝেছি, আপনি তো এমনিতেই থাকার জন্য আসেননি। কাজ শেষ হলে ফিরবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।” কথাগুলোর মাঝে কি ছিল হালকা বিষাদ, না কি কেবল বাস্তবতার কঠিন ভাষ্য—সুদীপ বোঝে না। সে ধীরে বলে, “তবে একটা কথা বলি মাধবী… জানো, এই কয়েকটা দিন… তুমি… এই গ্রামটা… সবকিছু যেন বদলে দিয়েছে আমাকে।” মাধবী এবার একটু তাকায় তার দিকে। চোখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু তাতে মিশে আছে একধরনের চেপে রাখা বিশ্বাস। “মানুষ বদলায়,” সে বলে, “শুধু প্রশ্ন হল, সেই বদলটা টিকে থাকে কিনা।” এই একটা বাক্য যেন ছুরির মত বিঁধে যায় সুদীপের ভিতরে। মাধবী কি তার উপর ভরসা করছে না? না কি কেবল এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে বলছে তাকে? তারা চুপ করে হাঁটে—দুজনেই জানে, সময় কম।

বিকেলে মোহন কাকার উঠোনে বসে সুদীপ তার ডায়েরির পাতায় নামিয়ে রাখে কিছু শব্দ—‘গাঁয়ের সন্ধ্যা’, ‘মাধবীর গান’, ‘অপ্রকাশিত আকর্ষণ’। ডায়েরির পাশে পড়ে থাকে মাধবীর হাতের ছোঁয়া লাগা একটা খুদে নোট—একদিন সুদীপকে লোকসংগীতের রেফারেন্স দিয়েছিল সে, সেই পাতাটা। সেইটুকু কাগজে মাধবীর হাতের লেখা যেন স্পর্শ হয়ে গেছে তার অনুভবের ওপর। সে জানে, ফিরে যেতে হবে—সময় ও কাজের চাপে। কিন্তু সে নিশ্চিত নয়, তার অনুভূতিরা কীভাবে তাকে শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মাধবী সন্ধ্যায় আর দেখা করতে আসেনি, মোহন কাকার স্ত্রী বললেন, “মেয়েটা আজ একটু মনমরা, স্কুল থেকে ফিরেই ঘরে ঢুকে গেছে।” সুদীপ জানে, কিছু অনুভব এমন থাকে যেগুলোর নাম দেওয়া যায় না, কেবল একটা মেঘের মত জমে থাকে শরীরের ভেতর। তারও বুকের ভেতর সেরকম মেঘ জমেছে—শহরের জীবনের টান আর গ্রামের জীবনের শান্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে যেন দুলছে দুই দিকের হাওয়ায়। পরদিনের ভোরে তার রওনা দেবার কথা। কিন্তু এই গ্রাম আর এই মাঘের বাতাসে সে ফেলে রেখে যাবে এমন কিছু, যা শহরের হাজার ব্যস্ততায়ও ভুলে যাওয়া যাবে না।

***

চণ্ডীপুরে সুদীপের শেষ রাত। সকালের ট্রেনে ফিরতে হবে কলকাতায়, তার আগের সন্ধ্যেটা যেন অন্য সব সন্ধ্যার চেয়ে নিঃসঙ্গ, ভারি। পাখির ডাক কেমন দূরে দূরে মনে হয়, আর উঠোনের এক কোণে আগুন পোহানো বুড়োরাও আজ কম কথা বলছে। মোহন কাকা বারবার বলে, “এই কয়দিনে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিস তুই, যেন এটাই তোর বাড়ি।” সুদীপ কিছুই বলে না, শুধু গলা নিচু করে মাথা ঝাঁকায়। কিন্তু তার মন ছুটে যাচ্ছে বারবার সেই নদীর ধারে, সেই পাথরের বসার জায়গায়, সেই ঠান্ডা হাওয়া যেখানে একদিন গানের সুরে জড়িয়ে গিয়েছিল মাধবীর নিঃশব্দ আত্মপ্রকাশ। বহু ভেবেও শেষদিনের আগে আর মাধবীর মুখোমুখি হওয়া হয়নি—সে আসেনি, সুদীপ ডাকেনি। আজ রাতটা যেন শেষ সম্ভাবনার রাত, সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার না হলেও অন্তত উচ্চারণের সময়। তাই সুদীপ চুপচাপ নিজের নোটবুক, ডায়েরি, ক্যামেরা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির পেছনের সরু গলি ধরে হাঁটতে বেরোয়। চারদিকে হালকা কুয়াশা, আকাশে তারারা যেন আজ আরও ঝিমিয়ে আছে। সে ভাবছিল, হয়তো আর দেখা হবে না, হয়তো এই ক’দিনের গল্পটুকু কেবল মাথার মধ্যে রেখে যেতে হবে। কিন্তু ঠিক তখনই, বাঁশঝাড়ের পাশে দেখা গেল তাকে—চাদর গায়ে জড়িয়ে, মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে মাধবী। যেন এই সন্ধ্যা তারও অপেক্ষার ছিল।

মাধবী কিছুই বলে না প্রথমে, শুধু পাশে এসে দাঁড়ায়। দুইজনেই বোঝে, কথা বলার প্রয়োজন নেই—কারণ আজকের নীরবতাটাও নিজেই এক ভাষা। সুদীপ হালকা গলায় বলে, “তুমি এসেছো ভেবেই ভালো লাগছে। ভাবছিলাম, দেখা না করেই ফিরতে হবে।” মাধবী চোখে চোখ রাখে না, বলে, “তোমার ফিরতেই তো কথা ছিল। দেখা-না-দেখা আসলে কিছু বদলায় না।” কথাটা শুনে সুদীপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুমি জানো তো, আমি এ ক’দিনে অনেক কিছু পেয়েছি—তথ্য, গান, গল্প… কিন্তু তার বাইরেও কিছু ছিল, যেটা আমি বুঝেছি… তোমার সঙ্গে থেকেও বলিনি।” বাতাসে হঠাৎ করে গন্ধ ভেসে আসে—হয়তো কারো রান্নাঘর থেকে সরষে ফোড়নের গন্ধ, হয়তো পিঠের উনুন। মাধবী চোখ মেলে তাকায় তার দিকে—গভীর, ধীর আর অস্পষ্ট অভিমান নিয়ে। “তুমি জানো?” সে বলে, “আমি তো আগেই জানতাম তুমি ফিরে যাবে। তাই তো কিছু জিজ্ঞেস করিনি, কিছু বলতেও চাইনি। কিন্তু তবু… কোনো কোনো সন্ধ্যায় মনে হয়েছিল, তুমি যদি শুধু একবার জিজ্ঞেস করতে, আমি হয়তো কিছু বলতাম।” কথাগুলো এমনভাবে বেরিয়ে এল, যেন অনেকদিন আটকে ছিল, আর এখন ঠান্ডা হাওয়ার মত ঝরে গেল গলার ফাঁক দিয়ে।

সুদীপের গলা শুকিয়ে আসে। “তুমি চাও আমি না যাই?” প্রশ্নটা করে সে ধীরে, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত কান্না চেপে বসে থাকে। মাধবী হাসে—একটা শীতল, বিষণ্ণ হাসি। “তোমার ইচ্ছের ওপরে কি আমি কিছু চাইতে পারি, সুদীপ? শহরের লোকেরা তাদের পথ নিজেই ঠিক করে নেয়। গ্রামের মেয়েরা শুধু দেখে… তারপর ভুলে যেতে শেখে।” কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলে না। কেবল নদীর দূরের শব্দ আসে—ধীরে ধীরে, শান্ত, যেন সব কথার শেষেও একটা স্থির সুর বাজে। মাধবী হঠাৎ একটা কাগজ বাড়িয়ে দেয়। “তোমার ডায়েরিতে যেটা খুঁজছিলে, হয়তো সেটা।” সুদীপ খেয়াল করে—তাদের সেই দিনকার কথোপকথনের একটা অংশ লিখে রেখেছিল মাধবী, তার নিজের হাতে। “এইটুকু রাখো… যদি কোনোদিন ফিরে আসো, মনে পড়বে,” বলে সে। তারপর আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায় সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে। সুদীপ তাকিয়ে থাকে—চুপচাপ, স্থির। তার মনে হচ্ছিল, যেন এই মাঘের শীতে কোনো এক গল্প শেষ হয়ে গেল না বলে—শুধু ভেসে রইল বাতাসে, নদীর জলে, আর দুটি ঠান্ডা চোখে জমে থাকা অনুচ্চারিত ভালোবাসায়।

***

কলকাতা ফিরে আসার পরও সুদীপের মনে চণ্ডীপুর লেগে রইল মেঘের মতো—অস্পষ্ট, ছায়াময় অথচ সর্বত্র। শহরের চেনা রাস্তা, ক্যাফে, মেট্রো, লাইব্রেরি—সবকিছুই যেন এক ভিনজগত। বন্ধুরা ভাবল, সে খুব মনোযোগ দিয়ে থিসিসের কাজ করছে। অরিত্র খুশি হয়ে বলল, “তুই দারুণ ডেটা এনেছিস রে, প্রেজেন্টেশনে আমরা নিশ্চয়ই সেরা হব।” সুদীপ হেসে ওঠে, কিন্তু তার চোখে সেই চণ্ডীপুরের সরু পথ, পাটখেতের পেছনে বসে থাকা মাধবী, নদীর ধারে সেই ঠান্ডা সন্ধ্যারা ভেসে ওঠে। দিনের পর দিন কেটে যায়, কিন্তু মাধবীকে সে এক মুহূর্তও ভুলতে পারে না। সেই শেষ রাতের দেখা, সেই চোখের ভাষা, সেই না বলা কথাগুলো—সবকিছু একেকটা অসমাপ্ত বাক্যের মত ঘুরে বেড়ায় তার মধ্যে। অনেক সময় সে ফোনটা হাতে নেয়, কিন্তু মনে পড়ে—মাধবীর কাছে কোনো স্মার্টফোন নেই। সামাজিক মাধ্যমে খোঁজার উপায় নেই। তাকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায়… চিঠি। হ্যাঁ, হয়তো একটা চিঠিই পারে সেই দূরত্বটা পার করে দিতে। এবং ঠিক সেই ভাবনা থেকেই এক বিকেলে, জানালার পাশে বসে, সুদীপ এক চিঠি লিখে ফেলে।

চিঠিটা সহজ ছিল না। ভাষা খুঁজতে গিয়ে সে বহুবার কলম থামিয়েছে, কিন্তু অবশেষে লিখল—

“প্রিয় মাধবী,

শহরের ভিড়ে বসে যখন এই চিঠি লিখছি, তখনও আমার চোখের সামনে তোমার মুখ—নদীর পাড়ে শেষবার দেখা হয়েছিল যেভাবে। হয়তো এই চিঠির কোনো মানে নেই তোমার কাছে। হয়তো তুমি এখন ভুলেই গেছো সেই শীতের সন্ধ্যাগুলো। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। আমি বুঝেছি, যা কিছু আমার থিসিসের মূল বিষয় বলে ভেবেছিলাম, তার থেকেও বেশি কিছু রেখে এসেছি আমি তোমার কাছে—আমার কিছু না বলা অনুভব, কিছু না ছোঁয়া ইচ্ছা।

তুমি বলেছিলে, ‘শহরের লোকেরা তাদের পথ নিজেই ঠিক করে নেয়।’ আমি জানি, আমার ফেরাটা একরকম নিজের ঠিক করে নেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তোমার প্রতি যা অনুভব করি, সেটা কম।

যদি একদিন তোমার ইচ্ছে হয়, তুমি লিখো। শুধু জানিও, তোমার লেখা একটা চিঠি আমার জীবনের সবচেয়ে সত্য অনুভব হয়ে থাকবে।”
চিঠিটা পোস্ট করে সে এক অদ্ভুত অস্থিরতা নিয়ে ফিরে এল বাড়ি। তারপর কেটে গেল এক সপ্তাহ… দুই সপ্তাহ… তারপর পুরো এক মাস।

মার্চের শুরুতে একদিন ডাকপিয়ন এল। সুদীপ তখন জানালা খুলে বসে, পুরোনো গান শুনছিল—ঠিক যেমন শুনত চণ্ডীপুরে বিকেলে। খামটা হাতে নিয়েই বুক ধক করে উঠল—খামের কোণে লেখা, ‘চণ্ডীপুর, ডাকঘর—নলহাটি’। হাতে লেখা অক্ষরে শুধু লেখা ‘সুদীপ সরকার’-এর নাম। ভেতরে ছিল একটা পাতলা চিঠি—একটি হলদে কাগজে মাধবীর হাতের লেখা, কালি কিছুটা ঝাপসা হলেও অক্ষর ছিল নিখুঁত।

“সুদীপ,

তোমার চিঠি পেয়েছি। পড়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। ভাবছিলাম, উত্তর দেওয়া উচিত কিনা।

জানো, আমরা গ্রামের মেয়েরা এমন হয়েই বড় হই—প্রত্যাশা না করতে শিখি, আশা না করতে শিখি। কিন্তু আমি যদি বলি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখন নদীর পাড়ে হেঁটে গেলে তোমার কথাই মনে পড়ে?

তুমিই বলেছিলে—সব অনুভব ভাষায় ধরা যায় না। আমি তো বলতেই পারিনি… না বলা সেই কথাগুলোর কিছুই তোমার চিঠিতে ছিল।

তুমি ভালো থেকো। যদি কখনো আবার আসো, আমি অপেক্ষায় থাকব।”
সুদীপ জানত না, এই চিঠিটা তার জীবনে কী পরিবর্তন আনবে। সে শুধু জানত—এই একটা চিঠি যেন শহরের মেঘঢাকা আকাশে একটা ছোট্ট রোদ্দুর হয়ে এলো। মাধবী, যে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, কোনো প্রতিশ্রুতি চায়ওনি—শুধু বলেছে, সে অপেক্ষা করবে।

***

বসন্ত এসে গেছে কলকাতায়—রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে, ট্রামে উঠলে জানালা দিয়ে গরম হাওয়া এসে লাগে মুখে, আর সন্ধ্যাবেলায় কলেজ স্ট্রিটে হাঁটলে ফুলের গন্ধে মন কেমন করে। কিন্তু সুদীপের মনে এই রঙিন শহরের কোনও গন্ধই ছুঁয়ে যায় না ঠিকমতো। মাধবীর সেই চিঠিটা এখনও তার টেবিলের ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেওয়া—প্রতিদিন একবার করে বের করে পড়ে সে, যেন প্রতিটি অক্ষর তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই নদীর পাড়ে, সেই সন্ধ্যার কথা, সেই না বলা অনুভবগুলোর কাছে। বন্ধু অরিত্র নতুন গবেষণার কাজে ব্যস্ত, সবাই ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় ডুবে, কিন্তু সুদীপ জানে, তার ভবিষ্যৎ শহরের চাকচিক্যে নেই—তার ভিতরের ডাকে সে একদিন আবার ফিরে যাবে চণ্ডীপুরে। ফেরা মানেই শুধু দেখা নয়, ফেরার মানে হলো বোঝা—কে কাকে হারিয়েছে, কে কাকে ধরে রেখেছে চুপচাপ, কার মনের কোন খাতে জমে আছে চুপ করে বয়ে চলা নদীর মতো ভালোবাসা।

তাই এক শনিবার সকালে, সে আবার ট্রেনে ওঠে—হাতব্যাগে কিছু বই, ডায়েরি, আর মাধবীর জন্যে একটা ছোট্ট উপহার—চন্দন কাঠে খোদাই করা একটা বুকমার্ক, যাতে লেখা: “তোমার গল্প এখনো শেষ হয়নি”। ট্রেন বোলপুর ছাড়িয়ে গিয়েছে, জানালার ধারে বসে সুদীপ দেখে মাঠের উপর হলুদ ছড়িয়ে আছে—সরষে ফুল ফুটে আছে আবার। সেই পুরনো প্ল্যাটফর্মে নেমে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে পড়ে সেই প্রথম দিন, যখন সে নেমেছিল শুধু গবেষণার উদ্দেশ্যে। তখন তার চোখে ছিল তথ্য, আজ তার চোখে অপেক্ষা। গ্রামের পথগুলো যেন আরও চেনা হয়ে গেছে, উঠোনের মাটির গন্ধ, বাঁশঝাড়ের ছায়া, আর দূরে কোনো ঘর থেকে ভেসে আসা সানাইয়ের সুর—সবকিছু মিশে আছে এক শান্ত অথচ গভীর ভালোলাগায়। মোহন কাকা দূর থেকে দেখে বলে ওঠেন, “আরে, আমাদের শহুরে সাহেব আবার ফিরে এসেছে? বিয়ে না থিসিস?”
সুদীপ হেসে বলে, “বিয়ে না কাকা, কিছু অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে এসেছি।” কাকার চোখে যেন কিছু একটার ইঙ্গিত থাকে, সে আর কিছু না বলেই হেসে চলে যায়।

মাধবী তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। উঠোনে বসে অপেক্ষা করে সে—চায়ের কাপ সামনে, মন তার ছুটে যাচ্ছে দূরে। তারপর বিকেল নামার একটু আগে, সেই একই সরু পথ ধরে, হাতে খাতা আর গলায় ওড়না জড়িয়ে এসে দাঁড়ায় মাধবী। তাকে দেখে প্রথমে থমকে যায়, মুখে অবাক হওয়া মিশ্রিত অভিমান। “তুমি?”—শুধু এটুকুই বলে।
সুদীপ উঠে দাঁড়ায়, বলে, “তোমার চিঠিটা পেয়েছি। এতদিন ধরে ভাবছিলাম কেবল—তোমার সেই অপেক্ষার কথা… আমি কি ফিরতে পারি?”
মাধবী চোখ নামিয়ে বলে, “ফেরার তো সময় থাকে না, ইচ্ছে থাকে।”
সুদীপ ধীরে কাছে গিয়ে বুকমার্কটা বাড়ায়, বলে, “তোমার গল্পটা যদি আমাকেও একটু অংশ নিতে দাও…”
মাধবী এবার তাকায়, গভীরভাবে, নরমভাবে। তার চোখে জল নেই, কিন্তু সেই চাহনিতে এতটা নীরব সম্মতি, এতটা গভীর বিশ্বাস যে সে বলে না কিছুই—শুধু হাত বাড়িয়ে নেয় সেই ছোট্ট উপহারটা।
পেছনে তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধানের গায়ে, আকাশে লালচে আভা, আর বাতাসে শুধু একটাই শব্দ— ফেরা।

***

চণ্ডীপুরে আবার শীত নেমেছে, তবে এবার সেই শীতে আগের মতো নিঃসঙ্গতা নেই। নদীর ধারে এখনো সন্ধ্যা নামে নিঃশব্দে, বাঁশঝাড়ে পাখিরা ঘরে ফেরে, আর সরষে ফুল ফুটে থাকে নিঃশব্দ সৌন্দর্যে। তবে এবার সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে একা বসে থাকে না মাধবী। এখন প্রায়ই সেখানে দেখা যায় সুদীপ আর মাধবীকে পাশাপাশি হাঁটতে—কখনো কথা হয়, কখনো শুধু দুজনের নীরবতা একে অপরের চেয়ে কথা বলে। শহরে ফিরে যাওয়ার পরে সুদীপের জীবনে যা ছিল—প্রকাশনা, থিসিস, সম্মেলন—তা আজও আছে, কিন্তু সে এখন বারবার ফিরে আসে গ্রামে। মোহন কাকার উঠোন যেন তার নতুন ঠিকানা, উঠোনের ধারে বসেই মাধবী তার খাতা খুলে দেখায় নতুন শিক্ষার্থীদের নাম, সুদীপ তার ডায়েরিতে লেখে—এই গ্রাম, এই সম্পর্ক, এই ভালোবাসা এখন আর গবেষণার বিষয় নয়, বরং জীবনের নিজের ভাষা।

মাধবীর চুলে এখনো সেই মৃদু ঢেউ, কিন্তু মুখে এসেছে এক নতুন নিশ্চিন্ত ভাব। সে হাসে আগের মতোই, তবে তাতে এখন ভরসার ছোঁয়া বেশি। গ্রামে অনেকেই জানে, ‘শহরের সেই ছেলেটা’ এখন নিয়মিত আসে, শুধু লোকগানের নোট নেওয়ার জন্য নয়, বরং এখানে তার একটা জীবন গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। শহরের ছেলেটা আর কেবল শহরের নেই। সে এখন হাঁটে মাঠের আইল ধরে, পাড়ার মেলাতে অংশ নেয়, চা-ওয়ালার কাছে বসে শুনে গ্রামের গল্প, আর নদীর ধারে বসে মাধবীর গলা থেকে শোনে পুরনো বাউলগান—

“ভালোবাসা যেন নদীর মত, বইতেই থাকে…
দুই পাড় শুধু জানে কাকে কোথায় ছোঁয় না ছোঁয়।”
মাধবী গাইলে সুদীপ তার ক্যামেরা নিচু করে, শুনে যায় চুপচাপ। কারণ সে জানে, এই গান শুধু সংগীত নয়, বরং তার জীবনের নিজস্ব সুর।

এক বিকেলে, সরু মাটির রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাধবী বলে ওঠে, “সেদিনের সন্ধ্যেটা মনে পড়ে?”
সুদীপ বলে, “যে সন্ধ্যায় আমি ফিরছিলাম, আর তুমি কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলে?”
মাধবী হেসে বলে, “হ্যাঁ, না বলেই… কিন্তু মনে মনে অনেক কথা ছিল। এখন ভাবি, যদি না ফিরতে?”
সুদীপ থেমে দাঁড়িয়ে বলে, “তাহলে এই শীতটাই হয়তো থেকে যেত একটা অসমাপ্ত গল্প হয়ে।”
মাধবী থামে না, হাঁটতে হাঁটতে বলে, “তবে গল্পগুলোও যে ফিরে আসতে পারে, সেটা তো তুমি দেখিয়ে দিয়েছো।”
পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল ধানের গায়ে, আর সামনে—দুজন মানুষের এক হওয়া জীবনের পথ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল… কথা, না বলা কথা, আর ফিরে আসা ভালোবাসার নতুন মানে নিয়ে।
তাহাদের দেখা হয়েছিল মাঘের শীতে… কিন্তু সেই দেখা শুধু শীতকালেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তা ছুঁয়ে ফেলেছিল পুরো জীবনকে।

—–

 

1000042158.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *