আকাশ ধর
১
গ্রীষ্মের বিকেল তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার দিকে গড়াচ্ছে। গ্রামের প্রান্তের ফাঁকা মাঠ আর অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ধারে ছড়িয়ে থাকা বাতাসে ধুলো উড়ছে। অরিন, ষোল বছরের কিশোর, একা একাই হাঁটছিল। পড়াশোনায় মাঝারি মানের হলেও তার মন ছিল অন্য জগতে—আকাশে। প্রায়ই সে চুপচাপ মাঠে বসে তারাগুলো গুনত, কল্পনা করত ওপারে কী আছে। সেইদিনও সে একই অভ্যাসে মাঠের কিনারায় চলে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎই তার চোখে পড়ে গেল একটি অদ্ভুত দৃশ্য। ঝড়ে ভেঙে পড়া একটি পুরোনো বটগাছের শেকড়ের নিচে কিছু যেন জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে প্রথমে মনে হলো হয়তো কাচের টুকরো, সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিন্তু কাছে যেতেই অরিন দেখল, এটা মোটেও সাধারণ কিছু নয়। মাটির অর্ধেক ভেতরে চাপা পড়া একটি অচেনা ধাতব বস্তু থেকে হালকা নীল আলো বের হচ্ছে।
অরিনের বুক ধুকপুক করতে লাগল। গ্রামের ছেলে হলেও তার কল্পনার জগৎ সবসময়ই অদ্ভুত সব প্রশ্নে ভরা। “ভিনগ্রহের কিছু? না কি পুরোনো কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র?”—মনে মনে প্রশ্ন জাগল। ভয় আর কৌতূহলের টানাপোড়েনে সে বস্তুটির উপর হাত রাখল। মুহূর্তেই যেন শরীর দিয়ে বিদ্যুতের মতো কাঁপুনি ছুটে গেল। বস্তুটি ছিল একটি গোলাকার ডিস্কের মতো, যার চারপাশে খোদাই করা চিহ্নগুলো একে একে জ্বলে উঠল। অরিন হাত সরাতে পারল না—যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। হঠাৎই তার চোখের সামনে চারপাশের অন্ধকার মাঠ মিলিয়ে গিয়ে তৈরি হলো অসীম তারাভরা আকাশ। পুকুর, গাছ, মাঠ, সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল, আর সে দাঁড়িয়ে রইল আলোর বৃত্তের মধ্যে। চারদিকে শুধু তারা, নীলাভ কুয়াশা আর দূরে ঘূর্ণায়মান গ্রহগুলো। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন আর পৃথিবীতে নেই, বরং আকাশের বুকের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।
অবাক হয়ে অরিন শ্বাস নিল, চোখের পাতা ফেলে আবার খুলল—কিন্তু দৃশ্য একই রইল। আলো আরও তীব্র হলো, আর সেই সঙ্গে তার কানে ভেসে এলো এক অচেনা ধ্বনি, যেন ভাঙা রেডিওর মতো শব্দ। হঠাৎই ডিভাইসের গায়ে খোদাই করা চিহ্নগুলো সুরের মতো বাজতে শুরু করল। অরিনের চোখে তখন বিস্ময়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত টান জেগে উঠল। এই ডিভাইস তাকে ডাকছে, তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু ঠিক তখনই আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর চারপাশে আবার দেখা দিল পুরোনো গ্রামের প্রান্তের সেই ভাঙা গাছ আর অন্ধকার মাঠ। অরিন হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে তাকাল—সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু মাটির নিচে আধা-ডোবা অদ্ভুত যন্ত্রটা থেকে এখনও হালকা নীল আভা বেরোচ্ছে। সে কাঁপা হাতে যন্ত্রটিকে বুকের কাছে টেনে নিল, বুঝল—আজকের দিনটি তার জীবনের চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছে। সে জানত না ঠিক কী পেয়েছে, কিন্তু অন্তরের গভীরে একটা অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে উঠল—এটা শুধু একটি বস্তু নয়, বরং এক দরজা, যার ওপারে অপেক্ষা করছে অসীম মহাকাশ, অজানা রহস্য, আর তার জীবনকে পাল্টে দেওয়ার মতো এক ভ্রমণ।
২
সন্ধ্যার পর থেকে অরিনের মন আর পড়াশোনায় বা খেলাধুলায় একেবারেই বসছিল না। সারাক্ষণ তার চোখে ভাসছিল সেই উজ্জ্বল যন্ত্রটির নীল আলো আর তারাভরা আকাশের সেই অলৌকিক দৃশ্য। সারাদিন কেটে গেল এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠায়—এটা কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি চোখের ধোঁকা? অবশেষে রাতে ঘুমোতে না পেরে অরিন নিঃশব্দে উঠোন পেরিয়ে গোপনে চলে গেল ভাঙা গাছটার কাছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের নদীর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। যন্ত্রটা তখনও মাটির নিচে হালকা নীল আভা ছড়াচ্ছিল, যেন তাকে ডাকছে। অরিন বুক ধড়ফড় করতে করতে বস্তুটা হাতে তুলে নিল। এবার সে সাহস করল পাশে থাকা একটি অদ্ভুত খাঁজকাটা বোতাম চেপে ধরতে। মুহূর্তেই যেন পৃথিবী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল—চারপাশে আলো বিস্ফোরিত হলো, বাতাস কেঁপে উঠল, আর পরের মুহূর্তেই অরিন বুঝতে পারল সে আর গ্রামে নেই। সে যেন এক বিশাল শূন্যতার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে, চারদিকে অসংখ্য তারা, জ্বলজ্বলে নক্ষত্রমণ্ডলী আর দিগন্ত জুড়ে রঙিন গ্যালাক্সির আলো। অরিন স্তম্ভিত হয়ে গেল—তার বুক ভরে উঠল বিস্ময় আর আনন্দে, যেন তার শৈশবের সব কল্পনা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
অরিনের পায়ের নিচে কোনো জমি নেই, কিন্তু তবুও সে নিজেকে ভাসমান অবস্থায় অনুভব করছিল। তার সামনে ধীরে ধীরে এক গ্রহ ভেসে উঠল—নীলাভ আর সোনালি আভায় ঢাকা, যার চারপাশে তিনটি চাঁদ ঘুরছে। সে এগোতে এগোতে দেখতে পেল গ্রহের মেঘের স্তর ভেদ করে ঝলমলে শহরের মতো আলোকছটা। সেই দৃশ্য এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে তার চোখ ভিজে উঠল আনন্দে। দূরে আবার দেখতে পেল একদল উজ্জ্বল রিং—যেন শনি গ্রহের বলয়, কিন্তু রঙে আরও বিচিত্র, নীল, বেগুনি, সবুজ মিলেমিশে এক অপার্থিব আলোকচ্ছটা তৈরি করেছে। অরিন হাত বাড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু সে অনুভব করল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আরও দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার কানে আবার সেই অচেনা ভাঙা রেডিওর মতো শব্দ ভেসে উঠল, আর ডিভাইসের ভেতর থেকে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি বের হলো। ভয় আর বিস্ময়ে অরিন আর এগোতে সাহস পেল না। তখনই ডিভাইসের চারপাশ থেকে আলো বেরিয়ে আসতে লাগল, তাকে ঘিরে ধরল, আর চোখের সামনে সবকিছু ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অরিন অনুভব করল যেন তাকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে—তার শরীর এক ঝাঁক আলো ভেদ করে ছুটে চলেছে, আর পরের মুহূর্তেই সে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।
শ্বাসকষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ খুলতেই সে বুঝতে পারল, সে আবার গ্রামের সেই পুরোনো বটগাছের নিচে পড়ে আছে। চারপাশে রাতের অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সব আগের মতোই। প্রথমে মনে হলো হয়তো কয়েক মিনিটই কেটে গেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরেই সে অবাক হয়ে গেল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মা আঁকড়ে ধরলেন তাকে, চোখে পানি: “অরিন! কোথায় ছিলি এতদিন?” অরিন হতভম্ব—“এতদিন মানে? আমি তো একটু আগেই গিয়েছিলাম!” বাবা কঠিন গলায় বললেন, “এক মাস! পুরো এক মাস তুই নেই!” অরিনের মাথা ঘুরে গেল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল যে সে তো মাত্র কয়েক মিনিট আগেই গিয়েছিল। কিন্তু ক্যালেন্ডার আর গ্রামের মানুষের মুখে একই কথা—সে আসলেই এক মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। অরিন নিজের হাতে ধরা ডিভাইসটার দিকে তাকাল, যার নীল আলো তখনও ক্ষীণভাবে জ্বলছিল। বুকের ভেতর ভয়ের শীতল স্রোত নেমে এলো—এটা কেবল তারাদের পথে ভ্রমণের যন্ত্র নয়, এটা সময়কেও ভেঙে দিচ্ছে। সে বুঝতে পারল, তার কৌতূহল তাকে এমন এক খেলায় টেনে এনেছে, যার পরিণতি অজানা, আর যার মূল্য হয়তো তাকে প্রিয়জন ও বাস্তবতার মধ্যেই দিতে হবে।
৩
রাতটা অরিনের চোখে একটুও ঘুম আসেনি। মা–বাবার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি আর গ্রামের মানুষের প্রশ্ন তাকে দমবন্ধ করে তুলছিল। সবাই ভাবছে সে হয়তো কোথাও পালিয়ে গিয়েছিল বা হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অরিন জানে সত্যটা অন্যরকম। তার বুকের ভেতরে গোপন আগুনের মতো জ্বলছিল সেই ডিভাইস, যা এখনও তার বিছানার নিচে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা। অদ্ভুতভাবে বস্তুটা যেন শ্বাস নিচ্ছে—মাঝে মাঝে নীল আভা জ্বলে উঠছে, আবার নিভে যাচ্ছে। অরিন চুপচাপ সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ভয়ের সঙ্গে এক অদম্য কৌতূহল কাজ করছিল—এই যন্ত্রের ভেতরে আসলে কী আছে? কেন তাকে এমন ভ্রমণ করায়? আর কেন সময়ের হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়? অবশেষে, মধ্যরাত পেরোতেই অরিন সাহস করে ডিভাইসটা হাতে তুলে নিল। তখনই হঠাৎ চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, বাতাস যেন থেমে গেল। যন্ত্রটার ভেতর থেকে আলো ছড়িয়ে উঠল, আর তার সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত আলোকমূর্তি—শরীর নেই, রূপ নেই, শুধু আলোর স্পন্দন।
অরিন প্রথমে ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু মূহূর্তের মধ্যেই আলো থেকে ভেসে এলো এক স্বচ্ছ কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বর ছিল গভীর অথচ নিরপেক্ষ, যেন মানুষের নয়। সে বলল—“আমি অ্যালট্রা। আমি সময়ের ভ্রমণপথের রক্ষক। তুমি যে বস্তু পেয়েছ, তা কেবল একটি যন্ত্র নয়, এটি এক সেতু—যা তোমাকে নক্ষত্রের ওপারে নিয়ে যেতে পারে।” অরিন স্তম্ভিত হয়ে শুনছিল। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেন আমি ফিরলেই সময় পাল্টে যায়? কেন আমার একদিন এখানে এক মাস হয়ে যায়?” আলোসত্তা ধীরে ধীরে উত্তর দিল—“কারণ এই যন্ত্র শুধু স্থান ভেদ করে না, সময়কেও ভাঙে। প্রতিবার তুমি ভ্রমণ করলে পৃথিবীর সময়রেখায় ফাঁক তৈরি হয়। একে আমরা বলি ‘সময় ফাঁক’। তুমি যতবার এই যন্ত্র ব্যবহার করবে, ততবার তোমার জগৎ আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকবে।” অরিন আতঙ্কিত হয়ে উঠল। সে তো বুঝতেই পারেনি, তার কৌতূহল এমন ভয়ঙ্কর মূল্য নিয়ে আসবে।
অ্যালট্রার কণ্ঠস্বর থেমে গিয়ে আবার ভেসে এলো—“তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে তারাদের পথ দেখাব, কিন্তু প্রতিবার তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি কি অজানা জগতের সৌন্দর্য দেখবে, নাকি নিজের পৃথিবীকে রক্ষা করবে।” অরিনের মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরছিল। এই আলোসত্তা কে? সে কি সত্যিই রক্ষক, নাকি কেবল এক প্রলুব্ধকারী ফাঁদ? তবু অরিন অনুভব করল, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক রহস্য যা মানুষ কোনোদিন জানেনি। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হলো—একদিকে পরিবার, মা-বাবা, বোন মায়া; অন্যদিকে সীমাহীন মহাশূন্য, অজানা গ্রহ আর নতুন জীবনের সন্ধান। সে জানে, যন্ত্রটা সে ফেলে দিতে পারবে না, আবার এটাও জানে, প্রতিবার এর ব্যবহার তাকে প্রিয়জনদের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। আলোসত্তা অ্যালট্রা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, ডিভাইস আবার নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। কিন্তু অরিনের অন্তরে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়—সে বুঝল, এটি কেবল একটি অভিযান নয়, বরং সময়ের সঙ্গে তার যুদ্ধের সূচনা।
৪
অরিন কয়েকদিন ধরে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত গোপন বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছিল। কারও সঙ্গে কিছু বলতে পারছিল না—না মা-বাবার সঙ্গে, না বন্ধুর সঙ্গে। গ্রামের মানুষ তো আগেই তাকে নিয়ে ফিসফাস করছে, “এক মাস ধরে কোথায় ছিল ছেলেটা,” সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তার ছোট বোন মায়া—যার বয়স মাত্র বারো—তার সঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নেওয়ার অভ্যাস ছিল অরিনের। মায়া ছিল কল্পনাপ্রবণ, খাতায়-খাতায় ছবি আঁকা তার নেশা। কখনও গাছপালা, কখনও আকাশ, আবার কখনও অদ্ভুত প্রাণীর ছবি আঁকত সে। এক রাতে অরিন সাহস করে মায়াকে ডেকে নিল নিজের ঘরে। জানালার পাশে বসে মায়ার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে খুলে বলল পুরো গল্পটা—কীভাবে সে ভিনগ্রহী যন্ত্র পেয়েছে, কীভাবে মহাশূন্যের ভেতরে চলে গিয়েছিল, আর ফিরে এসে দেখেছে পৃথিবীতে এক মাস কেটে গেছে। মায়া প্রথমে হেসে উঠল, মনে করল ভাই হয়তো মজা করছে। কিন্তু অরিন যখন গুরুত্বের সঙ্গে তার দেখা নক্ষত্রমণ্ডল, রঙিন বলয় আর অচেনা গ্রহের বর্ণনা দিল, মায়ার মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠল। সে হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না, কিন্তু ভাইয়ের চোখের ঝলক তাকে থামিয়ে দিল।
মায়া চুপ করে খাতাটা বের করল, পেন্সিল হাতে নিল। অরিনের বলা প্রতিটি দৃশ্য সে আঁকতে শুরু করল। প্রথমে আঁকল অসীম শূন্যতার ভেতরে ভাসমান রঙিন বলয়, তারপর আঁকল তিন চাঁদওয়ালা অচেনা গ্রহ, তারপর উজ্জ্বল নীল-সবুজ আলোয় ভেসে থাকা এক শহর। অরিন বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল, মায়া যেন একেবারে তার চোখে দেখা দৃশ্যগুলো কাগজে ফুটিয়ে তুলছে। আঁকার পর মায়া বলল, “তুমি যদি সত্যিই এসব দেখে থাকো, তাহলে তোমার গল্প আমার ছবিতে বেঁচে থাকবে।” সেই রাত থেকে প্রতিবার অরিন নতুন ভ্রমণ করলে ফিরে এসে মায়াকে সব বলে দিত, আর মায়া খাতায় খাতায় সেই দৃশ্যগুলো বন্দি করত। ধীরে ধীরে ছবিগুলো যেন শুধু আঁকা থাকল না, এক অদ্ভুত শক্তি সঞ্চারিত হলো তাতে। কয়েকটি ছবিতে এমন সব দৃশ্য ফুটে উঠল, যা অরিন এখনও দেখেইনি। যেমন, এক ছবিতে মায়া আঁকল এক ছায়ামূর্তির দল, যারা সময়ের দেয়াল ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন আঁকাটা দেখে কেঁপে উঠল, কারণ অ্যালট্রা তাকে একদিন সতর্ক করেছিল “সময় প্রহরী” নামের কিছু সত্তার কথা, যাদের সে এখনও দেখেনি।
প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কেবল কল্পনা, কিন্তু কিছুদিন পরের ভ্রমণে সত্যিই দূরের এক ছায়ার মতো আভাস পেল অরিন। মায়ার আঁকা ছবির সঙ্গে তার দেখা জগতের মিল দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মনে হলো, মায়ার আঁকা যেন কেবল শিল্প নয়, এক ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী। ধীরে ধীরে মায়ার খাতাগুলো অরিনের কাছে হয়ে উঠল ভ্রমণের মানচিত্রের মতো। তার চোখে ভয় আর বিস্ময় জমা হতে লাগল—এমন কি সম্ভব, মায়া নিজের অজান্তেই সেই ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে? মায়ার ছোট্ট হাতে আঁকা ছবির পাতায় যেন লুকিয়ে আছে তার পরবর্তী ভ্রমণের গন্তব্য, এমনকি বিপদের ইঙ্গিতও। সেই রাতে অরিন মায়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, সে এই ভ্রমণের পথ ছাড়বে না। কারণ এখন আর এটা কেবল তার একার রহস্য নয়, বরং দুই ভাইবোনের ভাগাভাগি করা এক গোপন অধ্যায়, যেখানে আঁকায় লুকিয়ে আছে মহাশূন্যের ভবিষ্যৎ।
৫
অরিনের ভেতরে তখন দারুণ এক দ্বন্দ্ব চলছিল। অ্যালট্রার সঙ্গে কথোপকথনের পর থেকে সে নিজেকে আর আগের মতো সাধারণ ছেলে মনে করতে পারছিল না। দিনগুলোতে পড়াশোনা, খেলাধুলা বা সাধারণ গ্রামীণ জীবনের বাইরে তার চিন্তাভাবনা আকাশগঙ্গার অসংখ্য তারা ঘিরে ছিল। কিন্তু এইসব ভ্রমণ আর সময় ফাঁকের অভিজ্ঞতা সে একা বয়ে নিয়ে চলছিল। তার বুকের ভেতরে যেন এক অজানা ভার জমে উঠেছিল, যা কারো সঙ্গে না বললে দমবন্ধ হয়ে আসত। তখনই সে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুদ্রর কথা ভাবল। রুদ্র আর অরিন ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে—খেলাধুলা, নদীতে সাঁতার কাটা, মেলায় ঘোরা সবকিছুতেই তারা ছিল অবিচ্ছেদ্য। অরিন জানত, যদি কাউকে বিশ্বাস করে গোপন কথাটা বলা যায়, তবে সেটা রুদ্রই। এক বিকেলে, যখন গ্রামের মাঠে দু’জন বসে আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখছিল, অরিন হঠাৎ থমকে গিয়ে বলল—“রুদ্র, আমি তোকে একটা জিনিস বলব, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, কারো কাছে বলবি না।” রুদ্র হেসে বলল—“তুই আবার এত গুরুগম্ভীর কেন? বল, আমি তোকে কখনও ঠকাইনি।” অরিনের কণ্ঠে কাঁপন ছিল, কিন্তু সে শেষমেশ বলে ফেলল—ঝড়ে ভাঙা গাছের নিচে পাওয়া অদ্ভুত যন্ত্র, তার প্রথম ভ্রমণ, মহাশূন্যের গ্রহ-নক্ষত্র আর ফেরার পর সময়ের ফাঁক।
প্রথমে রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর হেসে উঠল—“তুই কি সিনেমার গল্প বানাচ্ছিস? নাকি কোনো সায়েন্স ফিকশন বই পড়ে এসেছে?” অরিনের বুকটা ধক করে উঠল। সে মরিয়া হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, অ্যালট্রার কথা, মায়ার আঁকায় ভেসে ওঠা দৃশ্য, এমনকি অদ্ভুত সময়ের হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু রুদ্র শুনে শুনে শুধু মাথা নাড়ল আর বলল—“দেখ অরিন, আমি তোকে ছোটবেলা থেকে চিনি। তুই সবসময় একটু কল্পনায় ডুবে থাকিস। হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখে এসব বিশ্বাস করেছিস।” অরিন আহত চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল, কিন্তু তর্ক করল না। ভেতরে ভেতরে তার মনে হলো, এই গোপনীয়তার ভার সে একাই বহন করবে। দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু রুদ্রর মনে সন্দেহের বীজ বোনা হয়ে গিয়েছিল। সে খেয়াল করতে লাগল, অরিন হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে যায়, ফোনে পাওয়া যায় না, কিংবা তার চোখে যেন অন্যরকম এক শূন্যতা ভেসে থাকে।
একদিন সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটল। অরিন আবার ডিভাইসের বোতাম টিপে চলে গিয়েছিল মহাশূন্য ভ্রমণে, আর পৃথিবীতে কেটে গিয়েছিল কয়েক সপ্তাহ। যখন সে ফিরল, তখন চারপাশের মানুষজন হতবাক। গ্রামে সবাই বলছিল, “অরিন তো নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল! কোথায় ছিল এতদিন?” অরিন কোনো উত্তর দিল না, শুধু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রুদ্র তখন নিজের চোখে দেখল—তার বন্ধুটি সত্যিই অদ্ভুত কিছু করছে। সে বুঝল, অরিনের বলা কথাগুলো মিথ্যা নয়। সেদিন রাতে রুদ্র অরিনের কাছে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। অনেকক্ষণ পর সে ফিসফিস করে বলল—“অরিন, আমি তোকে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন দেখছি তুই সত্যিই অন্যরকম কিছু পেয়েছিস। আমি জানি না এটা কী, কিন্তু আমি তোকে আর একা থাকতে দেব না। আমি পাশে আছি।” অরিনের বুক হালকা হয়ে গেল। তার চোখে জল ভরে উঠল। সে প্রথমবারের মতো অনুভব করল, এই রহস্যময় ভ্রমণ আর সময় ফাঁকের বোঝা আর শুধু তার একার নয়, বরং বন্ধুত্বের শক্তি তাকে সাহস জোগাবে। সেই রাত থেকে তারা দু’জন একসঙ্গে ঠিক করল—ডিভাইসের রহস্য উন্মোচনের পথ তারা দু’জন মিলে খুঁজবে।
৬
অরিন যখনই ডিভাইসটি ব্যবহার করত, তার ভেতরে ভয় আর উত্তেজনা একসঙ্গে কাজ করত। প্রথমবার মহাশূন্য দেখার বিস্ময় তাকে এতটা মাতাল করে দিয়েছিল যে, সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলায় সে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ভ্রমণের পরই ধীরে ধীরে সে বুঝতে শুরু করল—এই ভ্রমণের আসল খেলা পৃথিবীতে নয়, বরং সময়ের বুকে। একবার এক ঝলকে দূর নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ফিরে এসে সে দেখল, গ্রামের স্কুলে তার সহপাঠীরা পরীক্ষার খাতা জমা দিচ্ছে, অথচ তার কাছে মনে হচ্ছিল সে তো কেবল গতকালই পড়তে বসেছিল। আরেকবার যখন ফেরত এল, তখন অবাক হয়ে দেখল রুদ্রর গোঁফের রেখা ফুটে উঠেছে, মায়া একেবারে অন্যরকমভাবে লম্বা হয়ে গেছে। অথচ অরিনের কাছে কেবল কয়েক ঘন্টা আগে ভ্রমণে যাওয়া মনে হচ্ছিল। এই অদ্ভুত অসামঞ্জস্য তাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে তুলল। মায়ের চোখে জল, বাবার রাগ, গ্রামবাসীর কৌতূহল—সব মিলিয়ে সে এক অচেনা মানুষের মতো নিজের পৃথিবীতে ফিরে আসছিল। সে বুঝতে পারছিল না, কোনটা বাস্তব আর কোনটা ভ্রমণের ধোঁয়াশা।
দিন যত এগোচ্ছিল, অরিনের মনে ততই আতঙ্ক বাসা বাঁধছিল। সে চেষ্টা করছিল ডিভাইসের ভেতরের অ্যালট্রার সঙ্গে কথা বলে বোঝার, কিন্তু অ্যালট্রা কেবল একটাই উত্তর দিত—“সময় সরলরেখা নয়, এটি এক জটিল তরঙ্গ। তুমি প্রতিবার ভ্রমণ করলে এই তরঙ্গ ভেঙে যায়, আর তুমি ফিরে আসো তার ভিন্ন বিন্দুতে।” কথাগুলো শুনে অরিনের ভেতরে আরও দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সে একদিকে এই মহাজাগতিক রহস্যে অভিভূত হচ্ছিল, অন্যদিকে আতঙ্কিত হচ্ছিল যে, হয়তো একদিন ফিরে এসে দেখবে পৃথিবী শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে রুদ্রও বিষয়টি উপলব্ধি করল। সে অরিনকে সতর্ক করল—“এভাবে বারবার গেলে তুই হয়তো আমাদের হারিয়ে ফেলবি। তুই যে জায়গায় ফিরবি, সেখানে আমরা আর থাকব না।” কথাগুলো শুনে অরিন গভীর রাতে ছাদের উপর বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। তার কাছে আকাশ এখন আর কেবল তারা ভরা সৌন্দর্য নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর অচেনা খাদের মতো, যেখানে ঢুকে পড়লেই ফিরে আসা অনিশ্চিত।
সময়ের এই ভাঙনের খেলা ধীরে ধীরে তার চারপাশের সম্পর্কগুলোতেও ছাপ ফেলতে শুরু করল। গ্রামে সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল—“এতদিন কোথায় থাকে ছেলেটা? কেন তার শরীরে বয়স বাড়ছে না?” মা-বাবার মনেও ভয় চেপে বসল। মায়া একমাত্র যার চোখে এখনো বিশ্বাস ঝলমল করে, সে আঁকতে থাকে অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য, যেখানে সময়ের ক্যালেন্ডার ভেঙে যাচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘুরছে। একদিন সে আঁকায় এমন এক ছবি এঁকে ফেলল, যেখানে দেখা যায় অরিন দাঁড়িয়ে আছে অথচ চারপাশে একইসঙ্গে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত—সময় যেন সব ঋতুকে একসাথে মিশিয়ে দিয়েছে। অরিন ছবিটি দেখে শিউরে উঠল। সে জানত, এটাই তার সত্যি। প্রতিবার তারার পথে ভ্রমণ করলে সে শুধু মহাশূন্যে যায় না, বরং সময়ের ভেতর ঢুকে পড়ে, আর সময়ের ভাঙন তাকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে। তবু অদ্ভুতভাবে, ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করছিল—এই ভয়ই তাকে আরও টানছে অজানার দিকে। সে জানত, সামনে আরও কঠিন পরীক্ষার অপেক্ষা করছে, যেখানে সময় আর বাস্তবতার সীমানা একেবারে ঝাপসা হয়ে যাবে।
৭
অরিনের মনে হয়েছিল, এই ভ্রমণটা অন্যগুলোর মতোই হবে—ডিভাইসের উজ্জ্বল বোতাম টিপতেই সে ছিটকে যাবে অজানা মহাশূন্যে, নক্ষত্রপুঞ্জের ঝলক তার চোখে ভেসে উঠবে, আর তারপর আবার কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েক দিনের ব্যবধান নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু এবার সবকিছু বদলে গেল। যখন তার শরীর ঝড়ের মতো আলো-অন্ধকার ভেদ করে ফের পৃথিবীর মাটিতে স্থির হলো, তখন সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে পরিচিত গাছপালা, পাখির ডাক সব ছিল, কিন্তু যেন কোথাও অচেনা এক পর্দা টানা। সে বাড়ির দরজায় পৌঁছে ডাক দিল—“মা, আমি এসেছি।” কোনো সাড়া মিলল না। ঘরে ঢুকতেই তার চোখে ধাক্কা খেল—সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী, তার চেহারায় অদ্ভুত পরিচিত ছায়া, অথচ পরিণত দৃষ্টির গভীরতা। অরিন এক মুহূর্তে বুঝে গেল—সে তার ছোট বোন মায়া। কিন্তু মায়া আর বারো বছরের চঞ্চল মেয়ে নয়, বরং পঁচিশ বছরের পরিণত নারী। সেই ক্ষণে অরিনের মাথা ঘুরে উঠল। তার মনে হলো, সে যেন কোনো স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়েছে, যেখানে সময় তার কাছ থেকে প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়ে গেছে।
মায়া এগিয়ে এলো, চোখে বিস্ময় আর ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টি। “অরিন? সত্যিই তুমি? তুমি তো… তুমি তো অনেক বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিলে।” তার কণ্ঠে কম্পন ছিল, কিন্তু চোখে ঝরে পড়ছিল বছরের পর বছর জমে থাকা অপেক্ষার ভার। অরিন অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে বলতে পারল না কেমন করে বোঝাবে—তার কাছে এটা কেবলমাত্র কয়েক দিনের ফাঁক, কিন্তু পৃথিবীতে কেটে গেছে এক যুগের বেশি। মায়ার চোখে শিশুকালের স্নিগ্ধতা নেই, আছে সংগ্রামের ছাপ, এক অচেনা শক্তি। সে জানাল, বাবা-মা আর নেই, তাদের জীবনের শেষ সময়ে মায়া একাই সব সামলেছে। গ্রামের লোকেরা বহুবার বলেছে, অরিন আর ফিরবে না। মায়া চেয়েছিল বিশ্বাস করতে, কিন্তু বছরের পর বছর সেই বিশ্বাস ধুলোয় মিশেছে। আজ হঠাৎ অরিনকে দেখে তার বুকের ভেতরের ক্ষোভ আর ভালোবাসা মিলেমিশে এক অদ্ভুত ঝড় তোলে। অরিন মাটির দিকে তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে বলল—“আমি তোকে হারাতে চাইনি, মায়া। আমি চেয়েছিলাম সবকিছু ভাগ করে নিতে, কিন্তু সময় আমাকে ফাঁকি দিয়েছে।” মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—“সময় তোকে ফাঁকি দেয়নি, দাদা। তুই-ই আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলি।”
অরিনের বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠল। সে বুঝতে পারল, যতই সে নক্ষত্র ভ্রমণ করুক, তার যাত্রা এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি করছে, যেখানে তার প্রিয়জনদের কাছে পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। মায়াকে দেখে তার চোখে জল চলে এলো—সে একসাথে দু’জন মায়াকে দেখছিল, ছোট্ট বোন যে তার আঁকা ছবি দিয়ে স্বপ্ন বুনত, আর আজকের পরিণত নারী যে একা দাঁড়িয়ে জীবনের বোঝা বইছে। সেই মুহূর্তে অরিনের মনে হলো, ভ্রমণ আর আবিষ্কারের আনন্দের চেয়ে আপনজনদের হারানোর যন্ত্রণা অনেক গভীর। কিন্তু ডিভাইসের অদৃশ্য টান এখনো তাকে ছাড়েনি; সে জানত, একদিন হয়তো আবার ভ্রমণে যাবে, আর হয়তো তখন ফিরে এসে দেখবে মায়ার চুলে পাক ধরেছে। তার মন ভেঙে পড়লেও, ভেতরে ভেতরে একটা প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল—যেভাবেই হোক, তাকে এই সময় ভাঙনের রহস্য ভেদ করতেই হবে। না হলে একদিন সে সম্পূর্ণভাবে আপনজনদের হারিয়ে একা হয়ে যাবে। সেই রাতেই অরিন আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করল—“সময়কে আর আমাকে আলাদা করতে দেব না। মায়া, এবার আমি সত্যিই তোমার জন্য লড়ব।” আর মায়া নীরবে তাকে দেখল, তার চোখে ছিল অভিমান, কিন্তু একচিলতে বিশ্বাসও লুকিয়ে ছিল।
৮
রাত ছিল অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল অসংখ্য তারা যেন অরিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সেদিন তারারা সাধারণের মতো ঝলমল করছিল না—তাদের আলো যেন কাঁপছিল, টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে আসছিল পৃথিবীর বুকে। অরিন প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো ডিভাইসের প্রভাবে তার চোখে ভ্রম দেখাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ উঠল, আর আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এলো কয়েকটি অদ্ভুত ছায়াসত্তা। তারা মানুষের মতো নয়, আবার পুরোপুরি আলোও নয়। যেন সময়ের ভেতর থেকে কেটে নেওয়া টুকরো অংশ, যেগুলো আকার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের উপস্থিতি ঘিরে চারপাশের বাতাস জমে উঠল, আর ঘড়ির কাঁটা যেন হঠাৎ থেমে গেল। অরিন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্তাগুলো একই সঙ্গে ভয়ানক আর মহিমান্বিত—এরা “সময় প্রহরী।” তাদের একজন গভীর, প্রতিধ্বনির মতো কণ্ঠে বলল—“অরিন, তোমার ভ্রমণ সময়ের ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছে। প্রতিবার তুমি মহাশূন্যে গেলে আর ফিরে এলে, বাস্তবের ধারায় ফাঁক তৈরি হয়। এই ফাঁক যত বাড়ছে, পুরো সৃষ্টি ধ্বংসের মুখে এগোচ্ছে।”
অরিন কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—“তাহলে আমি কী করব? আমি তো শুধু অজানাকে দেখতে চাইছিলাম। আমি কারো ক্ষতি করতে চাইনি।” ছায়াসত্তাগুলোর চোখে ঝলসে উঠল তীব্র আলোর রেখা। আরেকজন প্রহরী বলল—“অজানা খুঁজে পাওয়া অপরাধ নয়। কিন্তু তুমি সময়কে উপেক্ষা করেছ, তাকে ভেঙেছ। সময় কেবল একধারার নদী নয়, বরং কোটি কোটি জীবনের নিশ্বাস। তুমি যখন ফাঁক তৈরি কর, তখন ভবিষ্যৎ ভেঙে যায়, অতীত বদলে যায়, আর বর্তমান ভেসে যায় শূন্যতায়।” কথাগুলো শুনে অরিনের বুকের ভেতর শীতলতা জমল। সে হঠাৎ মায়ার কথা মনে করল—কীভাবে তার ছোট বোন একদিনে পরিণত নারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ তো কেবল তার পরিবারের নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য হুমকি। সে কাতর স্বরে বলল—“আমি কি তবে ডিভাইসটা ধ্বংস করে দেব?” প্রহরীরা একসাথে মাথা নাড়ল। “এটা তোমার হাতে নয়। ডিভাইস এসেছে মহাশূন্যের গভীর থেকে, যেখানে সময়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তাকে নষ্ট করা যাবে না। কেবল তুমি নিজের ভ্রমণ থামাতে পারো। থামাও, নইলে সময় নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তোমাকেই মুছে ফেলবে।”
অরিন নীরব হয়ে গেল। তার মনে চলতে লাগল প্রবল দ্বন্দ্ব। ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা, দিয়েছে মহাবিশ্বের রহস্য ছুঁয়ে দেখার আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দের মূল্য যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা সে আগে কল্পনাও করেনি। সময় প্রহরীরা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল, কিন্তু তাদের শেষ সতর্কবাণী বাতাসে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে রইল—“মনে রেখো, সময় কারো বন্ধু নয়, কারো শত্রুও নয়। কিন্তু তাকে অমান্য করলে সে তোমাকে মুছে দেবে।” চারপাশের নিস্তব্ধতা আবার স্বাভাবিক হলো, পাখির ডাক শোনা গেল, বাতাস বইতে শুরু করল, কিন্তু অরিন জানত তার জীবন আর আগের মতো নেই। সে আকাশের দিকে তাকাল, চোখ ভিজে উঠল। “আমি কি সত্যিই থামতে পারব?”—এই প্রশ্ন তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। আর দূরে, মায়া ঘরের জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল, তার আঁকা খাতায় ঠিক এই দৃশ্যই ফুটে উঠেছিল—অরিন আর চারপাশে ভাসমান ছায়াপ্রহরী। যেন ভবিষ্যৎ আবারও তার হাতে ধরা দিচ্ছে।
৯
অরিনের ভেতরে তখন এক অসহনীয় ঝড় বইছে। একদিকে তার হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা তীব্র টান, অজানার প্রতি লোভ, তারার পেরোনো পথের রহস্য আর ভিনগ্রহের আলোছায়া—সবকিছু তাকে ডাকে। সে জানে, ডিভাইসের বোতাম টিপলেই আবার ঝলসে উঠবে মহাবিশ্বের দরজা, সে দেখতে পাবে এমন সব বিস্ময় যা পৃথিবীর আর কোনো মানুষ কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু অন্যদিকে আছে বাস্তবের শিকড়—তার পরিবার, তার বন্ধু, তার পৃথিবী। প্রতিবার ভ্রমণের পর সময়ের ভাঙন তাকে দেখিয়েছে ভয়ঙ্কর সত্য—মায়া একদিনে কিশোরী থেকে প্রৌঢ়তায় পা রেখেছে, বাবা-মায়ের শেষ মুহূর্ত সে মিস করেছে, রুদ্রর চোখে জমেছে অবিশ্বাস ও আতঙ্ক। অরিন বুঝতে পারছে, তার এই যাত্রা কেবল তাকে নয়, চারপাশের সবকিছুকে বদলে দিচ্ছে। তবুও বোতামের নীল আলো যেন তাকে টানছে, ফিসফিস করে বলছে—“আরও একবার এসো, আরও একবার।” এই টান থেকে মুক্তি পাওয়া তার কাছে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে।
রুদ্র আর মায়া এই পরিবর্তন স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল। তারা দু’জনেই এক রাতে অরিনকে বসিয়ে কথাগুলো খোলাখুলি বলল। রুদ্র দৃঢ় কণ্ঠে বলল—“দেখ অরিন, আমি তোকে যতদিন চিনি, জানি তুই স্বপ্নবাজ। কিন্তু এবার স্বপ্নের সাথে সাথে ভয়ানক দায়িত্বও এসেছে। সময় প্রহরীরা যেটা বলেছে, সেটা মিথ্যে হতে পারে না। তুই যদি আবার ভ্রমণে যাস, হয়তো পৃথিবীর জন্য বিপর্যয় নামবে।” মায়া তার আঁকা ছবি সামনে রাখল—সেখানে দেখা যাচ্ছে কাঁটার মতো ভেঙে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা আর পৃথিবীর মাঝখান ফেটে যাচ্ছে। মায়ার চোখ ভিজে উঠেছিল—“দাদা, আমি ছোটবেলা থেকেই তোকে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু এখন আমি চাই না, তুই আবার হারিয়ে যাস। আমি একা হয়ে যেতে চাই না। বাবা-মা তোকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেছেন। এবার যদি তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাস, আমি বাঁচব না।” অরিনের বুক কেঁপে উঠল। সে অনুভব করল, এই মহাজাগতিক যন্ত্র তার প্রিয়জনদের সঙ্গে তাকে কেবল দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
অরিনের চোখের সামনে ভেসে উঠল দুটি পথ। প্রথম পথ—ডিভাইসের আলোকে অনুসরণ করে মহাবিশ্বে হারিয়ে যাওয়া, অমর জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া, কিন্তু বিনিময়ে হারাতে হবে সময়, আপনজন, আর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। দ্বিতীয় পথ—ডিভাইসকে একপাশে সরিয়ে রেখে জীবনের বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরা, মায়ার পাশে থাকা, রুদ্রকে সঙ্গ দেওয়া, পৃথিবীকে সময়ের ভাঙন থেকে রক্ষা করা। সে গভীর শ্বাস নিল। তার আঙুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডিভাইসের বোতামের ওপর গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ হাত সরিয়ে নিল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, চোখে অশ্রু ভেসে উঠেছিল—“আমি জানি, আমার ভেতরে ভ্রমণের তৃষ্ণা শেষ হবে না। কিন্তু আমি যদি নিজের আনন্দের জন্য সবকিছু ধ্বংস করে দিই, তবে আমি আর অরিন থাকব না। আমি কেবল এক স্বার্থপর মানুষ হয়ে যাব। আমি সেটা হতে চাই না।” রুদ্র আর মায়া তখন নিঃশব্দে তার পাশে দাঁড়াল। তারা জানল, অরিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অরিন ধীরে ধীরে ডিভাইসটি মাটিতে নামিয়ে রাখল, যেন এটিকে চিরকালের জন্য বিদায় জানাচ্ছে। আকাশে তখন তারা জ্বলছিল, কিন্তু এবার অরিনের চোখে তারা আর টান সৃষ্টি করল না—সে বুঝে গেছে, সময়ের ভারসাম্য রক্ষা করাই তার আসল ভ্রমণ।
১০
অরিন অনেক রাত ধরে একা বসে ছিল সেই পুরোনো ভাঙা গাছের তলায়, যেখানে প্রথমবার সে রহস্যময় যন্ত্রটি পেয়েছিল। চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে, কেবল তারাগুলো ঝলমল করছে আকাশের বুক জুড়ে। ডিভাইসের বোতামটিতে মৃদু আলো জ্বলছে, যেন তাকে আবার ডাকছে। দিন, মাস, এমনকি বছর পার হয়ে অরিন বুঝেছে—এই যন্ত্রকে একেবারে অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যতই পরিবার আর বন্ধুদের কথা ভেবে নিজেকে থামাতে চেয়েছে, ততই ভেতরের অদম্য কৌতূহল তাকে পীড়ন করেছে। সময় প্রহরীদের সতর্কবার্তা এখনো তার কানে বাজছে, কিন্তু সেই সঙ্গে বাজছে মহাশূন্যের অসীম রহস্যের সুর। অনেক ভেবেচিন্তে অরিন সিদ্ধান্ত নিল—এবারই হবে তার শেষ ভ্রমণ। পৃথিবীকে সে মুক্তি দেবে সময়ের ভাঙন থেকে, কিন্তু নিজেকে মুক্তি দিতে পারবে না। তাই আজকের যাত্রা হবে বিদায়ের যাত্রা, ফিরে আসার নয়। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল—“বিদায়, মায়া। বিদায়, রুদ্র। এবার আমি সময়ের সঙ্গে আর যুদ্ধ করব না, বরং নিজেকে তার কাছে সঁপে দেব।”
ডিভাইসের বোতাম টিপতেই চারপাশে আলো ফেটে বেরোল, অরিনের শরীর মুহূর্তেই হালকা হয়ে গেল। পৃথিবীর সব শব্দ মিলিয়ে গেল, কেবল তার কানে ভেসে আসতে লাগল অচেনা সুর, যেন মহাবিশ্বের স্পন্দন তাকে বুকে টেনে নিচ্ছে। সে চোখ মেলতেই দেখল—অগণিত তারা তার চারপাশে ঘুরছে, আলোর নদী ছুটছে শূন্যতার বুক চিরে। গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু—সবকিছু একসাথে তার সামনে নেচে উঠল। সে অনুভব করল, আর কোনো ভয় নেই, আর কোনো বাঁধন নেই, সে যেন হয়ে গেছে তারাদেরই অংশ। অরিন বুঝতে পারল, এই যন্ত্রের উদ্দেশ্য হয়তো ছিল না কেবল ভ্রমণ—বরং একজন মানুষকে মহাশূন্যের অমর স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। তার শরীর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে লাগল, যেন সে গলে গিয়ে তারার আলোয় মিশে যাচ্ছে। এক ক্ষণে তার সমস্ত অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়ল অসীম মহাশূন্যে, আর পৃথিবীতে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সেই শেষ মুহূর্তে অরিনের মুখে একটুকরো শান্তির হাসি ছিল—সে জানত, এবার আর সময় ভাঙবে না।
পৃথিবীতে অরিনের শেষ যাত্রার পর হঠাৎ করেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। সময়ের ফাঁক, অদ্ভুত অমিল আর ভয়ের ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। রুদ্র দেখল, ঘড়ির কাঁটা আবার স্বাভাবিক ছন্দে ঘুরছে, দিন-রাত আর এলোমেলো হচ্ছে না। মায়া খাতার পাতায় আঁকতে আঁকতে হঠাৎ থেমে গেল—তার মনে হলো, দাদা এবার সত্যিই চলে গেছে, কিন্তু তার ভ্রমণের ছাপ রয়ে গেছে এই পৃথিবীতে। সে আঁকল এক বিশাল আকাশভরা তারা, আর তাদের মাঝখানে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এক তরুণের ছায়া। মানুষ যখন সেই আঁকা দেখত, তখন তারা ভাবত—হয়তো এটা কেবল কল্পনা, হয়তো গল্প। কিন্তু মায়ার চোখ জানত, এটা বাস্তবের স্মৃতি। গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল অরিনের কিংবদন্তি—এক ছেলেটি যে তারাদের পথে পাড়ি দিয়েছিল, আর আর কোনোদিন ফেরেনি। পৃথিবী সময়ের ভারসাম্য ফিরে পেল, কিন্তু আকাশের প্রতিটি তারা যেন আজও অরিনের নাম ডাকতে ডাকতে ঝলমল করে। আর মায়ার আঁকা ছবিগুলো রয়ে গেল তার একমাত্র স্মারক—ভাইয়ের শেষ যাত্রার গল্প, যে গল্প হয়তো কখনো শেষ হবে না।
শেষ