পাৰ্থ প্ৰতিম মুখার্জী
পূর্ণিমার রাত ছিল শান্তিনিকেতনের। আশ্রমের চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, শুধু দূরে মাঠের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এমন রাতে আকাশে এক বিরল দৃশ্য ফুটে উঠল—দিগন্ত জুড়ে টানা লালচে আগুনের রেখা, যেন কেউ জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে দিয়েছিল আকাশের বুকের ভেতর দিয়ে। গ্রামের ছেলেরা উল্লাস করে চিৎকার করল—“উল্কাপাত!” মহিলারা মন্দিরের ঘন্টার শব্দ তুলল, ভাবল দেবতার আশীর্বাদ নেমে এসেছে। কিন্তু বৃদ্ধ লোকেরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তাদের চোখে ভয়, কপালে ঘাম, ঠোঁটে নিঃশব্দ ফিসফিসানি। তারা জানত, এটা কেবল কোনো নক্ষত্রপতন নয়—এটা “তান্ত্রিক পথ,” যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অন্ধকার ইতিহাস। বহু বছর আগে শোনা গিয়েছিল, এক তান্ত্রিক পূর্ণিমার রাতে এই ভূমিতেই অপূর্ণ সাধনায় মৃত্যু বরণ করেছিল। তখন থেকে, প্রতি কয়েক দশকে, আকাশে এই আগুনের রেখা দেখা দেয়। বিশ্বাস করা হয়, সেই তান্ত্রিক আত্মা মুক্তি খুঁজে ফিরছে—কিন্তু ভুল মানুষ তাকে ডাকলে, ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসে। তাই গ্রামের বয়স্করা সেদিন রাতেই দরজা-জানালা বন্ধ করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেছিল, যাতে কেউ অজ্ঞানে বা কৌতূহলে ওই আত্মাকে না ডাকে।
কিন্তু গ্রামের তরুণদের কৌতূহল দমন করা গেল না। শান্তিনিকেতনের আশেপাশে যারা পড়াশোনা করে, তারা মোবাইল ফোনে ভিডিও তুলতে ছুটে গেল মাঠের দিকে। আগুনের রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, যেন সারা আকাশ কেটে দেওয়া হয়েছে এক অগ্নিস্রোতে। কেউ কেউ বলছিল, “এটা তো নিশ্চয় কোনো ধূমকেতু, বিজ্ঞানের ব্যাপার।” কেউ আবার মজা করে বলল, “তান্ত্রিক আত্মা এসে পড়বে এবার।” কিন্তু সেই হাসিঠাট্টার মাঝেই এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এলো। পূর্ণিমার আলোতেও চারপাশ কেমন অন্ধকার, ভারী হয়ে উঠল। গাছের ডালপালা কেঁপে উঠতে লাগল, অথচ বাতাসের হাওয়া নেই। তখনই গ্রামের এক বৃদ্ধ, রতন কাকু, ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করলেন—“চলে যাও, ওটা খেলা নয়। ওই আলো মানে বিপদ!” ছেলেরা থমকে গেল বটে, কিন্তু কেউ কেউ তবু থামল না। তাদের চোখে যেন জাদু ঢুকে গেছে, ওই আগুনের রেখার রহস্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। আর আশ্রমের ভেতর, অধ্যাপক দেবপ্রসাদ, যিনি সংস্কৃত আর লোকসাহিত্য পড়ান, নীরবে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, পুরোনো পুঁথিতে পড়া বর্ণনাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। সেই সব গ্রন্থে লেখা ছিল—“অগ্নিরেখা দেখা দিলে বুঝিবে, এক আত্মা পথ খুঁজিছে। তাহাকে থামাইলে বিনাশ, তাহাকে মুক্তি দিলে শান্তি।”
রাত আরও গভীর হলো। আগুনের রেখা মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে, কিন্তু তার ছাপ থেকে গেল মানুষের মনে। কেউ ভয়ে শুতে পারল না, কেউ আবার বিস্ময়ে। কিন্তু সেদিন থেকেই গ্রামের পরিবেশ বদলাতে শুরু করল। পুকুরের জলে অচেনা প্রতিফলন দেখা যেতে লাগল, রাতের বেলা আশ্রমের ধূসর করবীর বাগানে হঠাৎ শোনা যেত মৃদু কণ্ঠস্বর, যেন কেউ মন্ত্র পড়ছে। লোকেরা বলল, এগুলো আগুনের রেখার পরিণতি। শিশুদের চোখে দুঃস্বপ্ন ঢুকে পড়ল, গৃহপালিত পশুরা হঠাৎ মাঝরাতে চিৎকার করে উঠতে লাগল। গ্রামের বৃদ্ধরা ভয় পেয়ে বলল, “অপঘাত আসন্ন।” অথচ কিছু তরুণের মনে হলো, এটাই সুযোগ। যদি সত্যিই কোনো প্রাচীন তান্ত্রিক আত্মা মুক্তি খুঁজে বেড়ায়, তবে যদি তারা তাকে ডেকে আনতে পারে? তার থেকে যদি শক্তি বা জ্ঞান পাওয়া যায়? সেই ভাবনাই তাদের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিল। কিন্তু কেউ জানত না, সেই আগুন খেলতে খেলতেই কবে গ্রাস করবে পুরো গ্রামকে। পূর্ণিমার রাতে দেখা সেই আগুনের রেখা কেবল আকাশের খেলা ছিল না—ওটা ছিল এক অশুভ সূচনা।
–
বিশ্বভারতীর শান্ত পরিবেশে অরিন্দমের জীবন কেটে যাচ্ছিল গবেষণার খোঁজে, তবে সে ছিল সবসময়ই একটু ভিন্ন। বয়সে মাত্র সাতাশ, কিন্তু লোকজ প্রাচীন সাহিত্য আর তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে তার অদম্য আগ্রহ ছিল। বন্ধুদের হাসাহাসির মধ্যেও সে অদ্ভুত সব গ্রন্থ খুঁজে বের করত—যেখানে পুরোনো কিংবদন্তি, অচেনা লিপি আর জনশ্রুতি লেখা থাকত। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির এক নির্জন কোণে, পুরোনো পুঁথিগুলির স্তূপ ঘাঁটতে গিয়ে সে খুঁজে পেল একটি ভঙ্গুর, অর্ধেক ছেঁড়া, তালপাতার পুঁথি। অন্যদের চোখে সেটি অমূল্য ছিল না, কারণ বেশিরভাগ অংশেই অক্ষর মুছে গিয়েছে, কালি ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু অরিন্দম যখন পাতাগুলো উল্টাচ্ছিল, তার দৃষ্টি হঠাৎ আটকে গেল এক বিশেষ অংশে। সেখানে এক অদ্ভুত মন্ত্র লেখা ছিল, যার চারপাশে কালো কালি দিয়ে বৃত্ত আঁকা। মন্ত্রের ওপরে সংস্কৃত ভাষায় সতর্কবার্তা খোদাই করা—“যদি অগ্নিরেখার রাত্রে এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়, তবে পথভ্রষ্ট আত্মা এসে উপস্থিত হইবে। তাহার আহ্বানে পূরণ হইতে পারে ইচ্ছা, কিন্তু ভ্রান্ত আহ্বান মানেই মৃত্যু।” পড়েই অরিন্দমের শরীর কেঁপে উঠল। যেন এই শব্দগুলো কাগজে লেখা নয়, তার কানে সরাসরি ফিসফিস করে বলা হচ্ছে। বাইরে তখন ঝরাপাতার শব্দ, বাতাসে শুষ্কতা—সব মিলিয়ে লাইব্রেরির কোণে এক ভয়ানক আবহ তৈরি করল। তবুও তার চোখে ঝিলিক ফুটল, কারণ সে অনুভব করল, এটাই হয়তো সেই রহস্য, যেটি নিয়ে গ্রাম জুড়ে এত কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে।
অরিন্দম পুঁথিটি গোপন করে নিজের ব্যাগে রেখে দিল। নিয়মমাফিক এমন গ্রন্থ বের করে আনা নিষেধ, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এটি যদি অন্যদের হাতে যায় তবে হয়তো হারিয়ে যাবে বা ভুলে যাবে ইতিহাস। সে চাইল নিজেই এর রহস্য উন্মোচন করতে। রাত বাড়ার পর নিজের কক্ষে বসে আবার পড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে মন্ত্রের প্রতিটি শব্দ তার মনে গেঁথে গেল—“অগ্নিরেখায় আহ্বান, ছায়ায় মুক্তি, চক্ষু খুলে আসুক ত্রাণ।” কিন্তু যতই সে পড়ছিল, ততই এক অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ধরছিল তাকে। মনে হচ্ছিল, কারও অদৃশ্য দৃষ্টি তার ওপর স্থির হয়ে আছে, যেন কারও প্রতীক্ষিত আহ্বানের জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছে। অরিন্দম মন্ত্রের নিচে লেখা সতর্কবার্তাটিও পড়ল—“ভুল আহ্বান মানেই মৃত্যু।” কয়েক মুহূর্তের জন্য তার ভেতরে ভয় কাজ করল, মনে হলো এই খেলা আগুন নিয়ে খেলা। কিন্তু কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা আর রহস্য জানার নেশা তার ওপর চেপে বসল। সে ভাবল, এতদিনে কে-ই বা এই মন্ত্র জানত? হয়তো গ্রামবাসীরা কেবল কুসংস্কারেই বিশ্বাস করত, কিন্তু প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে ছিল এই পুঁথিতে। যদি সে প্রমাণ করতে পারে এটি কেবল মিথ নয়, তবে তার গবেষণা যুগান্তকারী হবে।
পরবর্তী কয়েক দিনে অরিন্দম গোপনে পুঁথিটি পড়তে থাকল। দিনে ক্লাস বা আলোচনায় থাকলেও, রাত হলেই টেবিলের বাতি জ্বেলে গোপনে পাতা উল্টাত সে। প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছিল—কোথায় বসতে হবে, কোন দিকের দিকে মুখ করতে হবে, কেমন আগুন জ্বালাতে হবে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কখন মন্ত্রপাঠ করতে হবে। সবকিছুর শেষে বারবার সেই একই সতর্কবার্তা ফিরে আসছিল—“সতর্ক থাকো, কারণ ভুল মানুষ ডাকলে মৃত্যু অনিবার্য।” অরিন্দম বারবার ভেবে দেখত, ‘ভুল মানুষ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কারো হৃদয়ের অশুদ্ধতা? কারো উদ্দেশ্যের ভ্রান্তি? নাকি তান্ত্রিক আত্মাই ঠিক করে নেয় কার জন্য মুক্তি আর কার জন্য মৃত্যু? সে বুঝতে পারল না, তবু মনের গভীরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জমে উঠতে লাগল। বাইরে গ্রামজুড়ে তখনও আগুনের রেখার আলোচনায় তোলপাড়—কেউ ভয়ে কাঁপছে, কেউ আবার হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অরিন্দম জানত, এখন তার হাতে চাবিকাঠি আছে। এই পুঁথি যদি সত্যি হয়, তবে একদিন যখন আবার আকাশে আগুনের রেখা দেখা দেবে, তখন সবার সামনে প্রমাণ করে দিতে পারবে, প্রাচীন লোককথা নিছক কল্পকাহিনি নয়। সে জানত না, এই কৌতূহলই ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক নিষিদ্ধ অন্ধকারের দিকে, যেখানে প্রতিটি শব্দই তার নিজের ভাগ্য লিখে দেবে।
–
অরিন্দমের পুঁথি ও মন্ত্র নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে—তবে প্রত্যাশিত উত্তেজনার পরিবর্তে লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে গেল। গরম চা বানানোর সময়, রাস্তার মোড়ে, পুকুরের ধারে—প্রতিটি জায়গায় অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। অরিন্দম যখন গ্রামে এই পুঁথি ও তার আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, বৃদ্ধ থেকে নবীন সকলেই হঠাৎ চুপ করে গেল। কেউ কেউ চোখ মেলে তাকাল, কেউ আবার তাড়াহুড়া করে পাশের বাড়িতে চলে গেল যেন কেউ শুনে ফেলবে। গ্রামের পুরোনো লোকেরা, যারা বয়সে বেশি এবং অনেক ঘটনা দেখেছে, তখন কেবল নীরবে হা-হা করে না, বরং আঙুল তুলে সতর্ক করল। তারা বলল—“এই মন্ত্র কোনো খেলার জিনিস নয়, সন্তানেরা। কয়েক দশক আগে এক সাধক, আমাদের গ্রামে জন্ম নেওয়া, এই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। সে পূর্ণিমার রাতে আগুনের রেখার সময় মন্ত্রপাঠ করেছিল, এবং পরদিন সকালে সে নিখোঁজ হয়ে গেল।” অরিন্দম শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। তার গবেষণার মধ্যে শুধু রহস্য ছিল, কিন্তু বাস্তবের এই ভয় তাকে স্তব্ধ করে দিল। বৃদ্ধেরা আরও বলল, নিখোঁজ সাধকের কক্ষের মেঝেতে শুধু ছাই এবং চারপাশে কালো দাগ পাওয়া গিয়েছিল করবীর বাগানে, যেন কেউ বা কিছু অদৃশ্য অগ্নি দিয়ে তার উপস্থিতি মুছে দিয়েছে। সেই মুহূর্তে অরিন্দমের মনে কাঁপুনি নামল, কারণ যা তিনি ভাবছিলেন কল্পকাহিনি, তা গ্রামবাসীর মুখে বাস্তব রূপ নিয়ে হাজির।
গ্রামের বাতাবরণই তখন অদ্ভুত হয়ে উঠেছিল। সন্ধ্যার পর সব বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে যেত, যেন অদৃশ্য কোনো হুমকি নেমে এসেছে। শিশুরা ঘরে ঢুকে বলত, “আজ রাতে আকাশে আগুনের রেখা দেখা যাবে কি না?”—তাদের ভয়ে চোখে জল। পশুরা হঠাৎ করে চিৎকার করত, গরু ঘর ছুঁড়ে দৌড়াত। কেউ কেউ বলল, “অরিন্দম, এই পুঁথি ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ভুলভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, আমাদের গ্রামকেই শেষ করতে পারে।” অরিন্দম যতই নিজের জ্ঞান এবং কৌতূহলকে ধরে রাখার চেষ্টা করত, ততই অনুভব করত, এই গ্রামের আতঙ্কের মধ্যে এক বাস্তব ভয় লুকিয়ে আছে। রাতে, যখন সে ঘরে বসে পুঁথি খোলার চেষ্টা করত, তখন মৃদু বাতাসের সঙ্গে কানের কাছে ফিসফিস শুনতে পেত। মনে হচ্ছিল, যেন নিখোঁজ সাধকটির আত্মা নিজের প্রিয় স্থান—করবীর বাগান থেকে—দেখছে এবং সতর্ক করছে। অরিন্দম বুঝতে পারল, এটি কেবল একটি গবেষণা নয়, এটি এক বাস্তব পরীক্ষা, যেখানে ভুলের কোনো জায়গা নেই।
পরের কয়েকদিন অরিন্দম লক্ষ্য করল, গ্রামের মানুষ কেবল আতঙ্কিত নয়, তারা সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কেউ কাউকে বাইরে বের হতে দিচ্ছে না, কেউ রাতে ঘর থেকে বাইরে পা রাখছে না। করবীর বাগান যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে—কিছু মানুষ বলল, সেখানে অদৃশ্য পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কখনও ধোঁয়ার মতো ছায়া ভেসে যাচ্ছে রাতের আকাশে। গ্রামের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে আগুনের রেখার পর রাতেই নিখোঁজ সাধকের আত্মা ফিরে আসছে, এবং যদি কেউ পুঁথি ব্যবহার করে তার আহ্বান করে, তবে সে শুধু নিজেকে নয়, পুরো গ্রামকেই বিপদে ফেলবে। অরিন্দমকে বারবার প্রশ্ন করতে হলো নিজের ওপর—“আমি কি সত্যিই মন্ত্রপাঠের চেষ্টা করব, নাকি ইতিহাসকে শুধুই অধ্যয়ন হিসেবে দেখব?” তার মনে কৌতূহল এবং ভয় একসঙ্গে জেগে উঠল। কিন্তু অরিন্দম জানত, একদিন সেই আগুনের রেখা আবার দেখা দেবে, এবং পুঁথি যদি সত্যিই কাজ করে, তবে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—প্রাচীন রহস্য উন্মোচন করবে, নাকি গ্রামবাসীর নিরাপত্তা রক্ষা করবে। এই দ্বন্দ্ব তার মনকে অচল করে দিয়েছিল, আর গ্রামবাসীর ভীতির আবহই ক্রমশ তাকে আরও গভীর রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
–
পূর্ণিমার রাতের নিস্তব্ধতা চারপাশে একটি অদ্ভুত চাপ তৈরি করছিল। অরিন্দম, তার সহপাঠী রোহিনী এবং স্থানীয় গাইড নবকুমার ঠিক করেছিল, এ রাতেই তারা মন্ত্রপাঠের চেষ্টা করবে। দিনের আলো ম্লান হয়ে গেছে, বাতাসও যেন স্থির হয়ে গেছে, আর গ্রামের সব ঘর-দোয়ারা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা করবীর বাগানের দিকে এগোতে শুরু করল, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আরো গভীর রহস্যের দিকে টেনে নিচ্ছিল। অরিন্দম পুঁথিটি গোপন রাখল, রোহিনী আলোর জন্য ছোট প্রদীপগুলো হাতে ধরল, আর নবকুমার বাগানের চারপাশ পরীক্ষা করছিল যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি সেখানে না থাকে। প্রতিটি কাঁটা, পাতা, এবং ঘাসের শব্দ তাদের কানে ভীষণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠল। দূরে, ঝোপঝাড়ের মধ্যে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছিল—এ যেন অদৃশ্য কোনো অশুভ উপস্থিতির বার্তা। আকাশে ধীরে ধীরে আগুনের রেখা ফুটে উঠতে শুরু করল, লালচে আলোটা যেন তাদের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিল, আবার সতর্কও করছিল। অরিন্দমের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, কারণ সে জানত, প্রতিটি মুহূর্তে ইতিহাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে তার জীবনও অনির্দেশ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
তারা বাগানের মধ্যে এক বিশেষ স্থানে আসন স্থাপন করল। প্রদীপগুলো চারপাশে সাজাল, যাতে আলো এবং ছায়া মন্ত্রপাঠের জন্য নিখুঁত পরিবেশ তৈরি করে। অরিন্দম পুঁথি খুলে বসল, রোহিনী পাশে বসে তার হাত ধরে উৎসাহ দিল, আর নবকুমার চারপাশে চোখ রাখল। বাতাস হালকা কাঁপছিল, যেন প্রকৃতিই তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে। তারা মন্ত্রপাঠের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করল, প্রতিটি শব্দ মনেই গেঁথে নিল। আকাশে আগুনের রেখা ক্রমশ উজ্জ্বল হতে লাগল, যেন তারা অপেক্ষা করছে—মন্ত্রের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। অরিন্দম মনে মনে ভাবল, “এ যদি সত্যিই কাজ করে, তবে আমরা শুধু রহস্য উন্মোচন করব না, আমরা সেই প্রাচীন শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করব।” রোহিনী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল, চোখে মিশ্র অনুভূতি—ভয়, উত্তেজনা, আর কৌতূহল। নবকুমার বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিল, যেন নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল, কেউ বা কিছু তাদের ওপর নজর রাখছে কি না। এই সময়, করবীর বাগানের বাতাসে হঠাৎ এক মৃদু শীতল স্রোত বয়ে গেল, যা তাদের কাঁপিয়ে দিল, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের মনকে আরও স্থির করল।
শেষ মুহূর্তে তারা প্রস্তুত হয়ে উঠল। অরিন্দম পুঁথির প্রতিটি শব্দ মনেই গেঁথে নিল, রোহিনী এবং নবকুমারও প্রস্তুত। বাতাসের সঙ্গে প্রতিটি প্রদীপের আলোর প্রতিফলন যেন অদৃশ্য পথ খুলে দিচ্ছিল। শিয়ালের ডাক ক্রমশ দূরে হারাতে লাগল, কিন্তু আগুনের রেখা আকাশে আরও স্পষ্ট, আরও জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল। তারা বুঝল, এই মুহূর্তে তাদের কর্ম আর সতর্কতা একসঙ্গে যাচাই হতে চলেছে। একদিকে কৌতূহল ও গবেষণার তাগিদ, অন্যদিকে অজ্ঞাত ভয় এবং গ্রামের সতর্কতা—সবই মিলেমিশে তৈরি করল এক অদ্ভুত উত্তেজনা। অরিন্দম প্রথম শব্দ উচ্চারণ করল, ধীরে ধীরে, স্পষ্টভাবে, আর রোহিনী তার পাশে সমর্থন দিল। নবকুমার চারপাশে নজর রাখছিল, যেন কোনো বিপদ আসার আগেই থামানো যায়। আকাশে আগুনের রেখা ক্রমশ যেন মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতি খুঁজছে, লালচে আলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। রাতটা স্থির, বাতাস হালকা কাঁপছে, এবং তারা তিনজন—একটি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, পূর্ণিমার রহস্যের সঙ্গে মুখোমুখি—প্রস্তুত হয়ে গেল এক নিষিদ্ধ শক্তির আহ্বান করার জন্য।
–
মন্ত্রপাঠ শেষ হতেই করবীর বাগানের পরিবেশ একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে গেল। প্রদীপের আলোর নরম আলো হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে গেল, বাতাসে ঠান্ডা ঝাঁঝ দেখাতে লাগল, যেন অদৃশ্য হাতগুলো চারপাশের শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আগুনের রেখা আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসল, মাটির ওপর যেন লালচে আগুনের স্রোত সৃষ্টি করল। প্রতিটি পাতার কাঁপন, ঘাসের নরম দুলন, এমনকি বাতাসের ফিসফিসানি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। অরিন্দম, রোহিনী এবং নবকুমার চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল—মহাসূক্ষ্ম আতঙ্ক এবং বিস্ময়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ তাদের মধ্যে। হঠাৎ ছায়ার ভেতর থেকে একটি কৃশকায় অবয়ব ধীরে ধীরে সামনে এল। তার মুখোশ বা পোশাক ছিল না, শুধুই পাতলা সন্ন্যাসীর অবয়ব, চোখ দুটো লাল আগুনের মতো জ্বলজ্বলে। প্রতিটি পদক্ষেপে মাটির কচকি এবং বাতাসের শব্দ মিশে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা তৈরি করল। অরিন্দমকে মনে হলো, এটি কেবল দৃষ্টি নয়—প্রকৃতিই যেন থেমে গেছে এবং সময় স্থির হয়ে গেছে।
ছায়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা তান্ত্রিকের কণ্ঠে এক অদ্ভুত গর্জন উঠল। “আমাকে মুক্তি দাও, নয়তো তোমাদের আত্মা আমি বেছে নেব।” শব্দগুলো বাতাসের সঙ্গে মিশে ঘরে ঘরে, বাগানের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। অরিন্দমের হাত কাপাতে লাগল, রোহিনী তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু ভয় তাকে চুপ থাকতে বাধ্য করল। নবকুমার তড়িঘড়ি করে প্রদীপগুলো উঁচু করে ধরে রাখল, যেন আলো এই অদৃশ্য শক্তিকে সরাসরি মোকাবিলা করতে পারে। তান্ত্রিকের চোখ যেন তাদের ভেতরের ভয়, আগ্রহ এবং কৌতূহল সবকিছু পড়ে দেখছিল। তার উপস্থিতি কেবল শরীরিক নয়, মানসিকভাবে তারা ধাক্কা খাচ্ছিল। বাতাসের প্রতিটি স্রোত যেন তার ইচ্ছার সঙ্গে মিলিত হয়ে চারপাশের পাতা, শাখা, এবং ঘাসকে নাচাচ্ছিল।
অরিন্দম বুঝতে পারল, মন্ত্রপাঠ কেবল আহ্বান নয়, এটি একটি চুক্তি। এই শক্তি রক্তচাপ, মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা এবং সাহস পরীক্ষা করবে। তিনি রোহিনীকে চুপচাপ আস্থা দিতে চেষ্টা করল, নবকুমারকে সংকেত দিল যেন কোনো হঠাৎ হামলা বা বিপদ ঘটলে তারা প্রস্তুত থাকে। তান্ত্রিক ধীরে ধীরে তাদের কাছে এগোচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে যেন পৃথিবীর স্থিতি কমে আসছে। “মুক্তি দিতে হবে,” তার কণ্ঠে পুনরায় উচ্চারিত হলো, “নাহলে তোমাদের আত্মা আমার অধীনে থাকবে।” অরিন্দম মনে মনে ভাবল, এটি শুধু পরীক্ষা নয়, এটি তাদের নিজের সীমারেখা চিহ্নিত করবে—কী ভয় তারা সহ্য করতে পারে, কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আর কোন সীমা অতিক্রম করলে জীবনের চূড়ান্ত ঝুঁকি তৈরি হয়। আগুনের রেখা মাটির সঙ্গে মিশে, তান্ত্রিকের লালচে চোখের জ্বলজ্বলে আলোর সঙ্গে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক অনন্ত নিরীক্ষার আঙ্গিক। তারা বুঝল, যে রাতটা শুরু হয়েছিল গবেষণার জন্য, তা এখন রূপান্তরিত হয়ে এক বাস্তব সংঘাত, যেখানে আত্মা, কৌতূহল, এবং মৃত্যু—সবই একই জায়গায় মিলেছে।
–
অরিন্দম তার সাহস জোগাড় করে অবয়বটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি কে?” মৃদু হাওয়া ভেতরে কেঁপে উঠল, বাতাস যেন স্থির হয়ে গেল, এবং চারপাশের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠল। ছায়ার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে কণ্ঠ বের হলো—“আমি এক তান্ত্রিক, যাকে শতাব্দী আগে তার শিষ্যরা প্রতারণা করে হত্যা করেছিল। আমি এই বাগানে আটকে আছি, মুক্তির অপেক্ষায়। কিন্তু মুক্তি পেতে হলে আমাকে সঠিক মানুষ ডাকতে হবে।” অরিন্দম শুনে অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, যে মন্ত্র তারা উচ্চারণ করেছে, তা সঠিকভাবে ছিল না। তারা শুধু কৌতূহল এবং গবেষণার তাগিদে মন্ত্রপাঠ করেছিল, অথচ প্রাচীন শক্তি ঠিক সেই মুহূর্তেই তাদের ভুল বোঝায় নিয়েছে। বাতাসে হঠাৎ এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হলো। প্রদীপগুলো ঝাপসা হতে লাগল, লাল আগুনের রেখা মাটির সঙ্গে আরও গভীরভাবে মিশে গেল, আর বাতাসের মধ্য দিয়ে যেন অদৃশ্য চাপে তাদের বুক চাপা পড়ছে। অরিন্দম, রোহিনী এবং নবকুমার তিনজনই অনুভব করল—এখন তারা কেবল পরীক্ষার মধ্যে নেই, তারা সত্যিকার বিপদে ফেঁসে গেছে।
হঠাৎ নবকুমারের শরীর কাঁপতে লাগল, সে অসহায়ভাবে পিছনে পিছনে হেলে পড়ল এবং অচেতন হয়ে গেল। রোহিনী আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করল, অরিন্দম দ্রুত তার দিকে দৌড়াল। তান্ত্রিকের চোখের আগুনের মতো লালচে দীপ্তি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল। “তোমরা ভুলে গেছো,” তার কণ্ঠে এক ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণতা যুক্ত হলো, “সঠিক আহ্বান ছাড়া আমি মুক্তি পাই না, কিন্তু তোমরা আমাকে ডাকলে—তোমাদের ওপর আমার অধিকার শিখর পায়।” অরিন্দমের হাত কাঁপছিল, সে রোহিনীর দিকে তাকাল, যারা চুপচাপ ভয় থেকে স্থির হয়ে আছে। মনে হলো, চারপাশের প্রতিটি পদক্ষেপ, বাতাসের প্রতিটি নড়াচড়া, এমনকি তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস—সবই তান্ত্রিকের ইচ্ছার অধীনে। সে বুঝতে পারল, যে ভুল মন্ত্র পাঠ করা মানেই কেবল বিপদ নয়, এটি মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছে। বাতাসে হঠাৎ এক ঘোলা গন্ধ, পোড়া কাঠের ধোঁয়া মিশে গেল। অরিন্দম বুঝতে পারল, যে এখন শুধু সাহস আর জ্ঞানই তাদের রক্ষা করতে পারে, আর এক মুহূর্তেরও ভুল মৃত্যুর ফাঁদকে আরও দৃঢ় করতে পারে।
রোহিনী দ্রুত নবকুমারের পাশে গিয়ে তার শ্বাস পরীক্ষা করল, কিন্তু সে নিস্তব্ধ। অরিন্দম বুঝতে পারল, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কীভাবে এই তান্ত্রিককে শান্ত করা যায় এবং একই সঙ্গে নবকুমারের প্রাণ রক্ষা করা যায়। বাতাসে তীব্র শীতলতা, বাতাসের দিক পরিবর্তন, আগুনের রেখার নাচ—সবই নির্দেশ করছিল, যে আত্মার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তিনি পুঁথির পাতাগুলো দ্রুত ঝরঝরে পড়ল, মনে মনে সতর্কবার্তা মনে করল—“ভুল মানুষ ডাকলে মৃত্যু অনিবার্য।” সেই সতর্কবার্তা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তান্ত্রিকের কণ্ঠ ক্রমশ বাড়তে লাগল, “দ্রুত করো, সঠিক আহ্বান করো, নাহলে তোমাদের মধ্য থেকে এক একজনকে আমি বেছে নেব।” অরিন্দম বুঝতে পারল, কেবল সাহস যথেষ্ট নয়, মন্ত্রের নিখুঁত জ্ঞান, ধৈর্য, এবং সঠিক আহ্বান ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না। বাতাসে ক্রমশ এমন এক ধ্বনি ভেসে আসছিল, যেন পৃথিবী, আকাশ, এবং আগুন—সবই মিলিত হয়ে এই ঘন্টা তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের স্বপ্ন, বিশ্বাস, এবং সাহস—সবই এখন পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে। অরিন্দমের মনে হলো, এই ভুল আহ্বান শুধু নবকুমারের জন্য নয়, তারা সবাই ধীরে ধীরে সেই তান্ত্রিকের অচেনা ক্ষমতার জালে ফেঁসে যাচ্ছে।
–
রোহিনী পুরো রাত জুড়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। অরিন্দম এবং নবকুমারের বিপদের মুখোমুখি অবস্থায় সে একমাত্র সম্ভাব্য মুক্তির আশায় দাঁড়িয়ে ছিল। পুঁথির শেষ পাতায় লেখা মন্ত্রটি ছিল গোপন এবং শক্তিশালী—সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে তান্ত্রিকের ক্রোধ শুধু বাড়বে। বাতাস হালকা কাঁপছিল, প্রদীপের আলো ফিকে হয়ে আসছিল, আর আগুনের রেখা মাটির সঙ্গে মিশে ঝলমল করছিল। রোহিনী গভীর শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল, মনে মনে পৃষ্ঠাগুলোর শব্দগুলি গেঁথে নিল। তার হৃদয় কাঁপছিল, কিন্তু সাহসও জাগছিল, কারণ সে জানত, এই মন্ত্রই আত্মাকে মুক্ত করার চাবিকাঠি। চারপাশের ছায়া ধীরে ধীরে ঘন হয়ে উঠল, বাতাসের প্রতিটি নড়াচড়া যেন তাকে থামাতে চাচ্ছিল। হঠাৎ তান্ত্রিকের ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়ালো, অসংখ্য ভয়ঙ্কর রূপে—কখনও কৃশ, কখনও ভয়ঙ্কর কালের দানবের মতো, কখনও আবার তার মৃত দাদুর পরিচিত কণ্ঠে। রোহিনী প্রথমে কেঁপে উঠল, মনে হলো তার সাহস সব হারিয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরের দৃঢ়তা তাকে থামতে দিল না।
তান্ত্রিক আত্মা ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। বাতাসে তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো, “রুখো, তুমি পারবে না!” হঠাৎ আগুনের রেখার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চারপাশের ছায়াগুলো নাচতে লাগল, এবং বাতাসে ঘোলা ধোঁয়ার মতো এক অদ্ভুত শক্তি সৃষ্টি হলো। রোহিনী চোখ বন্ধ করে পুঁথির মন্ত্রটি উচ্চারণ শুরু করল। প্রতিটি শব্দ তার মন দিয়ে ধীরে ধীরে বের হচ্ছিল, কিন্তু তান্ত্রিক আত্মা তাকে থামানোর চেষ্টা করে, কখনও ভীতিকর ছায়ার রূপে, কখনও মৃত দাদুর কণ্ঠে। রোহিনী অনুভব করল, তার ভেতরের সাহসের চাপে সে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে—ভয় এবং দুশ্চিন্তা তাকে থামাতে চাচ্ছে, কিন্তু মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আরও শক্তিশালী। সে জানত, যদি একটি শব্দও ভুল হয়, তবে তান্ত্রিকের ক্রোধ তাদের তিনজনকে গ্রাস করবে। তাই সে নিজের হৃদয়কে ধীর করে শিথিল করল, প্রাচীন শব্দগুলোকে প্রতিটি স্বরে উচ্চারণ করতে লাগল, যেন শব্দগুলি বাতাসে মিশে এক শক্তিশালী ঢেউ তৈরি করছে।
মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তান্ত্রিকের চোখের আগুন ক্রমশ ফিকে হতে লাগল। তার ছায়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে বিকৃত হতে শুরু করল, চারপাশের বাতাসে কেঁপন ঘটল, কিন্তু রোহিনী থামল না। ধীরে ধীরে, তার শেষ শব্দগুলো বাতাসে মিলিত হলো, আর আগুনের রেখার আলোর সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তান্ত্রিক আত্মার রূপ ক্রমশ গলে যেতে লাগল, লালচে দীপ্তি কমে আসল, এবং বাতাসের শীতলতা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। রোহিনী চোখ খুলল, দেখল, নবকুমার ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে, আর অরিন্দম আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে। করবীর বাগান শান্ত হয়ে গেছে, আগুনের রেখা ম্লান হয়ে গেছে, আর চারপাশের ছায়া দূরে সরে গেছে। রোহিনী বুঝতে পারল, সাহস, মনোসংযোগ এবং সঠিক মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে তারা তান্ত্রিককে মুক্ত করতে পেরেছে। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, কৌতূহল এবং ভয়—দুইয়ের সমন্বয়েই প্রকৃত লড়াই জেতা যায়। রাতটা শেষ হলেও, রোহিনী জানত, এই অভিজ্ঞতা তাকে জীবনের সবচেয়ে গভীর শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে—সঠিক সিদ্ধান্ত, ধৈর্য, এবং সাহস ছাড়া এমন শক্তিকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
–
পূর্ণিমার রাতের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে কমতে থাকল। আগুনের রেখা আকাশে একেবারে উজ্জ্বল থেকে ফিকে হয়ে ভেঙে গেল, এবং বাতাসে সেই ধাক্কা ধীরে ধীরে হারাতে লাগল। তান্ত্রিক আত্মা, যে রাতভর তাদের ভয়ে কাঁপিয়ে রেখেছিল, এক বিকট হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে যেতে লাগল। তার লালচে চোখের দীপ্তি ধীরে ধীরে নিঃশব্দে কমতে থাকল, আর বাতাসের শীতলতা একই সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল। অরিন্দম, রোহিনী, এবং নবকুমার একদিকে নিজেদের নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল, অন্যদিকে চারপাশের শান্ত পরিবেশ তাদেরকে সাময়িক স্বস্তি দিল। মনে হলো, সেই প্রাচীন শক্তি এখন মুক্তি পেয়েছে, আর বাগান আবার তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেয়েছে। ধীরে ধীরে তারা নিজেদেরকে সমর্থন করে বসল, মনে মনে ভাবছিল—সবই শেষ হয়ে গেল। আতঙ্ক, ভয়, এবং উত্তেজনা—সব এখন শুধু স্মৃতি। তারা ভাবতে লাগল, এতোক্ষণ যে বিপদ ও রহস্যের মুখোমুখি হয়েছিল, তার শেষ অবসান ঘটেছে।
তবে পরদিন সকালটি যেন নতুন এক প্রশ্নের আগমন ঘটাল। সূর্যের আলোয় করবীর বাগানের দিকে তাকিয়ে তারা বিস্মিত হয়ে গেল—গাছে নতুন অগ্নিরঙা ফুল ফুটে আছে। আগের লালচে দীপ্তির মতো, এই ফুলগুলোও যেন তীব্রতা এবং শক্তির নিদর্শন বহন করছে। অরিন্দম প্রথমে মনে করল, হয়তো এটি শুধু প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা। কিন্তু রোহিনী এবং নবকুমারও একই রকম অবস্থা অনুভব করল—ফুলগুলো যেন প্রাচীন তান্ত্রিক আত্মার উপস্থিতি প্রকাশ করছে। প্রতিটি পাপড়ি যেন অদৃশ্য শক্তির নিদর্শন, আর বাতাসের সঙ্গে ফিসফিসানি তাদের মনে করাচ্ছে, যে রাতের ঘটনার পুরো রহস্য এখনও শেষ হয়নি। তারা বুঝতে পারল, মুক্তি পাওয়া গেল কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এই অগ্নি ফুল শুধু স্মৃতি নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা—যে প্রাচীন শক্তি এখনও বাগানের চারপাশে বিরাজমান।
সকালের এই দৃশ্য তাদের মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করল। একদিকে তারা আনন্দিত—তান্ত্রিক আত্মাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে সেই ফুল ও তার উপস্থিতি যেন শংকার নতুন দ্যুতি তৈরি করছে। তারা বুঝতে পারল, সত্যিকার মুক্তি মানেই সম্পূর্ণ নিঃসরণ নয়; কখনও কখনও মুক্তি এবং অভিশাপ একসঙ্গে আসে। এই ফুল, এই নিঃশব্দ উপস্থিতি, এক অমীমাংসিত রহস্যের প্রতীক হয়ে রয়ে গেল। অরিন্দম, রোহিনী, এবং নবকুমার তিনজনেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল—তাদের সাহস, ধৈর্য, এবং মন্ত্রপাঠের প্রজ্ঞা কি সত্যিই তান্ত্রিককে মুক্ত করেছে, নাকি কেবল একটি নতুন অভিশাপের সূচনা করেছে? তারা জানত না, ভবিষ্যতে এই অভিশাপ তাদের কাছে কী রূপে ফিরে আসবে। করবীর বাগান শান্ত, আকাশে স্বাভাবিক আলো—সবকিছু যেন স্বাভাবিক, কিন্তু নতুন অগ্নিরঙা ফুলগুলো চুপচাপ স্মরণ করাচ্ছে, যে রাতের রহস্য কখনও পুরোপুরি সমাধান হয় না। মুক্তি নাকি অভিশাপ—সে প্রশ্ন চিরকাল অমীমাংসিত থেকে গেল, আর সেই অমীমাংসিততা অরিন্দমদের মনে এক অদ্ভুত শিহরণ রেখে গেল, যা তারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারবে না।
-সমাপ্ত-