Bangla - কল্পবিজ্ঞান

তারার ওপারে

Spread the love

অর্ণব দত্ত


পর্ব : অপরিচিত সংকেত

রাত তখন গভীর। সল্টলেকের গবেষণাগারের কাচঘেরা জানলার বাইরে দূরের হাইওয়ে আলো ঝলমল করছে। চারদিকে নির্জনতা, কেবলমাত্র মেশিনের নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জন আর মাঝে মাঝে হাওয়ার ফিসফিস শব্দ। ডঃ অদিতি মুখার্জি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন, চোখে লালচে ক্লান্তি। কয়েক মাস ধরে যে পরীক্ষাটি চালাচ্ছেন, সেটি মূলত ছিল রেডিও ওয়েভ শনাক্তকরণ। পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা যেকোনো সংকেত বিশ্লেষণ করা তাঁদের কাজ। সাধারণত ভাঙাচোরা তরঙ্গ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। তবুও আজ রাতটা অন্যরকম লাগছিল।

ঘড়িতে তখন ১টা ৪৫। হঠাৎ করে স্ক্রিনে দপদপ করে ওঠা এক অদ্ভুত প্যাটার্ন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তরঙ্গগুলো যেন কোনো ছন্দে সাজানো, যেন অকারণে নয়—একটি সংগঠিত ভাষার মতো। অদিতি ঠোঁট কামড়ে ধীরে ধীরে শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করলেন।
—“অসম্ভব,” তিনি ফিসফিস করে বললেন।

তাঁর পাশের ঘরে তখন তরুণ গবেষক রোহন মিত্র গলাটিপে হাই তুলছিলেন। হঠাৎ অদিতির ডাক শুনে ছুটে এলেন।
—“কি হলো? আবার কি মেশিন গণ্ডগোল করছে?”
অদিতি মাথা নেড়ে বললেন, “না। এবারটা আলাদা। দেখো, এই সংকেতের ভেতরে প্যাটার্ন আছে। আর দেখো সময়ের ব্যবধান—ঠিক ৩৩ সেকেন্ড অন্তর এটা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”

রোহনের চোখে ঘুম আর থাকল না। তিনি দ্রুত কীবোর্ডে হাত চালালেন। বিশাল অ্যান্টেনার রিসিভড ডেটা মুহূর্তে গ্রাফে রূপ নিল। গ্রাফের মাঝখানে স্পষ্ট এক বীট, যেন হৃদস্পন্দন।
—“এইটা… কোনো নক্ষত্রের রেডিও পালস হতে পারে না,” রোহন ফিসফিস করল।
অদিতি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “হতে পারে না। এটা নিঃসন্দেহে কৃত্রিম। প্রশ্ন হচ্ছে—কে পাঠাচ্ছে?”

ঘরের আলো তখন হালকা ম্লান। পেছনে রাখা নোটবুক খুলে তিনি দ্রুত আঁকিবুঁকি করতে লাগলেন। তরঙ্গের ভেতরে আসলে ছোট ছোট সংখ্যার ক্রম লুকিয়ে আছে। ২, ৩, ৫, ৭, ১১… একের পর এক মৌলিক সংখ্যা। পৃথিবীর বাইরের কেউ যদি বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিতে চায়, তবে এর চেয়ে নিখুঁত উপায় আর নেই।

রোহন শ্বাস চেপে রাখল। “মানে… কেউ আমাদের ডাকছে?”
অদিতি চোখ তুলে তাকালেন, “হ্যাঁ। আর সেটা খুব দূর থেকেও নয়। সংকেতের উৎস অনুমান করা যাচ্ছে পৃথিবীর একেবারে কাছে থেকে।”

কয়েক সেকেন্ড নীরবতা নেমে এল। তারপর রোহন জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে আসছে?”
অদিতি কম্পিউটার ঘেঁটে বললেন, “ক্যালকুলেশন বলছে—চাঁদের অদৃশ্য দিক থেকে।”

রোহনের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। মহাশূন্য নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে সে। কিন্তু এভাবে এত কাছে থেকে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।

পরের দিন সকালের মিটিংয়ে অদিতি ও রোহন তাঁদের আবিষ্কারের কথা তুলে ধরলেন। বোর্ডরুমে বসা অন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। অধ্যাপক সৌমেন চট্টোপাধ্যায়, যিনি প্রকল্পের প্রধান, চশমা নামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
—“ভিনগ্রহী সংকেতের সম্ভাবনা আমরা অস্বীকার করছি না, তবে তার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা মানবসৃষ্ট কোনো প্রতিফলন নয়। স্যাটেলাইট, গোপন সামরিক ট্রান্সমিশন—এগুলোও হতে পারে।”

কিন্তু যখন তিনি নিজে ডেটা দেখে মৌলিক সংখ্যার সঠিক বিন্যাস খেয়াল করলেন, তাঁর চোখ বড় হয়ে গেল।
—“অদিতি, রোহন… তোমরা নিশ্চিত এটা ফেক নয় তো?”
অদিতি ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললেন, “স্যার, ডেটা নিজেই কথা বলছে।”

এক মুহূর্তে সভাকক্ষ ভারী হয়ে গেল। যেন সবার বুকের ভেতর কোনো অদৃশ্য কম্পন।

রাতে গবেষণাগারে ফিরে রোহন আর অদিতি আবার সংকেত ধরার চেষ্টা করলেন। এবার সংকেত আরও জোরালো। মৌলিক সংখ্যা শেষ হতেই হঠাৎ ভেতরে এক অদ্ভুত ধ্বনি ভেসে উঠল। যেন কোনো শব্দ রেকর্ড করা—কিন্তু ভাষা অচেনা। অদিতি হেডফোনে কান দিলেন। ধ্বনিগুলো মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো, কিন্তু একেবারেই ভিন্ন টোনালিটি।

রোহন কম্পিউটার প্রোগ্রামে সাউন্ড ওয়েভ কনভার্ট করে ভিজ্যুয়াল স্পেকট্রাম তৈরি করল। আশ্চর্যজনকভাবে সেই ভিজ্যুয়াল স্পেকট্রামে ফুটে উঠল একটি আকার—একটি বৃত্তের ভেতর অর্ধচন্দ্রের মতো চিহ্ন।
অদিতি আঁতকে উঠলেন। “এটা তো মানচিত্রের মতো দেখাচ্ছে।”

হঠাৎ বিদ্যুৎ ম্লান হয়ে গেল, আলো নিভু নিভু করতে লাগল। মেশিনগুলো নিজেরাই রিস্টার্ট হলো। যেন কেউ বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

রোহন আতঙ্কিত গলায় বলল, “আমরা কি নিশ্চিত যে… তারা আমাদের দেখছে না?”
অদিতি নিঃশব্দে জানলার দিকে তাকালেন। দূরে আকাশে ফিকে আলো ঝিকমিক করছে।
—“হয়তো,” তিনি ফিসফিস করলেন, “তারা অনেকদিন ধরেই আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে।”

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে সংকেত আসতেই থাকল। প্রতিটি রাতে ঠিক একই সময়ে, একই ছন্দে। কিন্তু ধীরে ধীরে ধ্বনিগুলো স্পষ্টতর হতে লাগল। এবার শব্দগুলো যেন ভাঙা ইংরেজির মতো শোনাচ্ছিল—
“…we… wait… return…”

অদিতি ও রোহন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। এই সংকেত এখন আর শুধু সংখ্যা নয়, যেন কোনো বার্তা। কিন্তু “return” বলতে কী বোঝাচ্ছে? তারা কি একসময় এসেছিল?

গবেষণা কেন্দ্রের ভেতর চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন বললেন এটা হয়তো প্রতারণা। কেউ আবার বললেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই হতে পারে প্রথম প্রমাণ যে আমরা একা নই।

কিন্তু মিডিয়ার কাছে খবর ফাঁস হবার আগেই সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ল্যাবরেটরিটি সিল করে দিল। অদিতি ও রোহনকে গোপন তদন্তে যুক্ত করা হলো। তাঁদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হলো—“এটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা। বাইরে ফাঁস হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তবুও গভীর রাতে দুজন আবার সংকেত শোনার চেষ্টা করলেন।
সেদিন অদিতি এক নতুন কিছু ধরতে পারলেন। শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে এলো—
“…find… us… beneath…”

রোহনের শরীর কেঁপে উঠল। “beneath? মানে পৃথিবীর তলদেশে?”
অদিতি ঠোঁট শুকিয়ে আসা গলায় বললেন, “হয়তো। হয়তো তারা আমাদের নিচেই আছে। আর হয়তো তারা অপেক্ষা করছে।”

বাইরে তখন পূর্ণিমার আলোয় ঝলমল করছে শহর। অথচ ল্যাবরেটরির ভেতরে দুই গবেষক অনুভব করছিলেন—এ পৃথিবী আর আগের মতো নেই। প্রতিটি তরঙ্গের ভেতর লুকিয়ে আছে এক অনন্ত রহস্য, যা একদিন খুলে দেবে মানুষের ভবিষ্যৎ।

কিন্তু ভবিষ্যৎটা কি আলোর, নাকি অন্ধকারের? তারা দুজনই জানতেন না। শুধু জানতেন, যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।

পর্ব : অন্ধকারের কোড

বাতাসে যেন অদৃশ্য ভার জমে উঠেছিল। গবেষণাগারের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি স্ক্রিন, প্রতিটি কাগজে আঁকিবুঁকি—সব কিছুর ওপর ছায়ার মতো ছড়িয়ে ছিল সেই সংকেতের রহস্য। অদিতি আর রোহনের চোখের নিচে ক্লান্তির কালচে দাগ, তবুও দমেননি। কারণ এখন তাঁরা জানেন—সংকেত কেবল সংখ্যা বা তরঙ্গ নয়, বরং এক অচেনা ভাষার ডাক।

সরকারি সংস্থা তাঁদের চারপাশে অদৃশ্য বেড়া টেনে দিয়েছিল। একদিন ভোরবেলা সাদা জিপ গাড়ি এসে থেমে গেল ল্যাবের সামনে। কালো স্যুট পরা দু’জন লোক ভিতরে ঢুকল। কার্ড ঝলকে পরিচয় দিল—“ন্যাশনাল স্পেস ডিফেন্স এজেন্সি।” তাদের চোখে কোনও আবেগ নেই, কেবল ঠাণ্ডা কড়া নির্দেশ।
—“তোমরা যা দেখছো, সব আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। প্রতিটি নোট, প্রতিটি রেকর্ড আমাদের কাছে জমা দিতে হবে।”

অদিতি ঠোঁট কামড়ালেন। নিজের গবেষণা নিজের হাতছাড়া হওয়া বেদনাদায়ক, কিন্তু কিছু বললেন না। তবে অন্তরে বুঝলেন—এখন আর এটা শুধু বিজ্ঞান নয়, এটা রাজনীতি, এটা ক্ষমতার খেলা।

পরের রাত। বাইরে আকাশ ভরা মেঘ, তবুও সংকেত এলো যথারীতি। রোহন কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ গেঁথে বসে রইল। সংখ্যাগুলো এবার নতুন ক্রমে সাজানো। আগেরবার মৌলিক সংখ্যা ছিল, এবার যেন বর্গসংখ্যা: ১, ৪, ৯, ১৬, ২৫…

অদিতি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “ওরা আমাদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করছে। প্রথমে মৌলিক সংখ্যা দিয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ, এবার গাণিতিক ধাঁধা।”
রোহন চমকে উঠল, “মানে কি তারা আমাদের জবাব আশা করছে?”

দু’জনের মধ্যে নিঃশব্দ আলোড়ন। যদি সত্যিই উত্তর দিতে হয়, তবে সেটা পৃথিবীর প্রথম ভিনগ্রহী যোগাযোগ হবে। কিন্তু কীভাবে পাঠানো হবে? আর কে জানে এর ফল কী দাঁড়াবে?

তবুও কৌতূহল দমন করা কঠিন। তাঁরা লুকিয়ে সিগন্যাল ট্রান্সমিটার চালু করলেন, সাবধানে কোডেড উত্তর পাঠালেন: মৌলিক সংখ্যার পর এবার বর্গসংখ্যার পরবর্তী ধারা।

কয়েক মিনিট কেটে গেল। বাইরে মেঘ গর্জন করছে। হঠাৎ মেশিন থেকে এক অদ্ভুত দীর্ঘশ্বাসের মতো আওয়াজ বেরোল, তারপর ফের সেই ধ্বনি—কিন্তু এবার স্পষ্টতর।
“…you… can… hear… us…”

রোহনের বুক ধকধক করতে লাগল। সে অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা সত্যিই ওদের শুনতে পাচ্ছি।”
অদিতি নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখে একসাথে বিস্ময় আর আতঙ্কের ছাপ।

পরের দিন। ল্যাবের অডিটোরিয়ামে বিশেষ সভা বসেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, বিজ্ঞানীরা, গোপনচর সংস্থার প্রতিনিধি—সবাই উপস্থিত। অদিতি ধীরে ধীরে তাঁদের সামনে স্লাইড দেখাচ্ছিলেন। সংকেতের প্যাটার্ন, মৌলিক সংখ্যা, বর্গসংখ্যা, আর অবশেষে সেই ভাঙাচোরা ইংরেজি বাক্য।

সভায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। অনেকে বিশ্বাস করতে চাইছেন না, কেউ কেউ বলছেন—“এটা হয়তো শত্রু রাষ্ট্রের প্রযুক্তি।” আবার কারও কণ্ঠ কাঁপছে, “না, এটা মানুষের কাজ নয়।”

অবশেষে অধ্যাপক সৌমেন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর গলায় একধরনের চাপা রুদ্ধ উত্তেজনা।
—“যদি সত্যিই ভিনগ্রহী সভ্যতা যোগাযোগ করতে চায়, তবে আমাদের কাছে একটাই দায়িত্ব—ওদের ভাষা ভাঙা।”

অদিতি ও রোহনের ওপর কাজের চাপ বেড়ে গেল বহুগুণ। এখন আর কেবল গণিত নয়, তারা ভাষাতত্ত্বের দিকেও মন দিলেন। সংকেতের ভেতর থেকে আলাদা আলাদা শব্দ টেনে বার করা হলো। অনেক শব্দের মধ্যে মিল পাওয়া গেল লাতিন ধ্বনির সঙ্গে, আবার অনেক শব্দ একেবারেই অচেনা।

তাঁরা শব্দগুলোকে গ্রাফ আকারে সাজালেন। অবাক করে দিয়ে সেটি ক্রমশ গড়ে তুলল এক জটিল চিত্র—যেন বৃত্তের মধ্যে অসংখ্য সর্পিল রেখা। প্রথমে এলোমেলো মনে হলেও পরে ধরা পড়ল—এটা পৃথিবীর মানচিত্র নয়, বরং চাঁদের এক অদৃশ্য অংশের টপোগ্রাফিক ম্যাপ।

রোহন বিস্ময়ে বলল, “তাহলে তারা চাঁদ থেকে আমাদের ডাকছে!”
অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “অথবা… তারা আমাদের চাঁদে আসতে বলছে।”

তবে এর মধ্যেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করল। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের অস্বাভাবিক ওঠানামা দেখা গেল। যোগাযোগ স্যাটেলাইটে হস্তক্ষেপ ধরা পড়ল। সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন—“কোনো অজানা হ্যাকিং আক্রমণ চলছে।” সরকার অবশ্য সব ঢেকে দিল, বলল—“প্রযুক্তিগত ত্রুটি।”

কিন্তু অদিতি জানতেন—এগুলো কাকতালীয় নয়। সংকেত আসার ঠিক সেই সময়েই সব অস্বাভাবিকতা ঘটছে। যেন অদৃশ্য কোনো চোখ শহরটাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

রাতের ল্যাবে হঠাৎই স্ক্রিনে ভেসে উঠল অচেনা অক্ষর। এগুলো কোনো মানবভাষার অক্ষর নয়, তবুও ভয়ঙ্করভাবে স্পষ্ট। অদিতি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অক্ষরগুলো মিলিয়ে দেখলেন। বিস্ময়ে শ্বাস আটকে গেল—ওগুলো সংখ্যার কোডে রূপান্তর করলে মিলে যাচ্ছে এক তারিখের সঙ্গে।

“২৩ জুলাই ২০২৭।”

রোহন হতবাক, “এটা… ভবিষ্যতের কোনো তারিখ?”
অদিতি ফিসফিস করে বললেন, “হয়তো সেদিন কিছু ঘটতে চলেছে। হয়তো ওরা আমাদের সতর্ক করছে। অথবা…” তিনি থেমে গেলেন।
রোহন জিজ্ঞেস করল, “অথবা?”
“অথবা সেদিন তারা ফিরে আসবে।”

অল্প কিছুদিনের মধ্যে রোহনের মনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল। সংকেতের ধ্বনি যেন তাকে ঘুমের ভেতরেও তাড়া করছে। সে মাঝে মাঝে অজান্তেই অচেনা প্রতীক আঁকতে শুরু করত খাতার কোণে। প্রতীকগুলো অদিতির চোখে পড়তেই গা শিউরে উঠল—এগুলো সেই একই সর্পিল নকশা যা সংকেত থেকে পাওয়া মানচিত্রে ছিল।

রোহন হেসে বলল, “আমি জানি না কেন এগুলো আঁকছি, মনে হয় যেন কেউ আমার মাথার ভেতর থেকে বলছে।”
অদিতি বিস্মিত হয়ে বুঝলেন—সংকেত শুধু যোগাযোগ নয়, বরং মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

এদিকে গোপনে প্রতিরক্ষা সংস্থা চাঁদে পাঠানোর জন্য এক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পৃথিবীর সেরা নভোচারী, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের গোপনে ট্রেনিং করানো হচ্ছিল। কিন্তু সরকারী চাপে অদিতি ও রোহনকে প্রকাশ্যে কিছু বলা হলো না। তবুও তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন—যাত্রা অনিবার্য।

এক রাতে ল্যাবের বাইরে দাঁড়িয়ে অদিতি আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল পূর্ণচন্দ্র উদ্ভাসিত। মনে হলো যেন দূর থেকে কেউ ডাকছে—“এসো, আমাদের খুঁজে পাও।”

তিনি চোখ বন্ধ করলেন। হৃদয়ের গভীরে প্রশ্ন জেগে উঠল—
এই রহস্য কি সত্যিই মানবজাতির মুক্তির পথ দেখাবে?
নাকি এই সংকেত অন্ধকারের কোড, যার ভেতর লুকিয়ে আছে ধ্বংসের ভবিষ্যৎ?

পর্ব : নিষিদ্ধ মানচিত্র

ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরে কেবলমাত্র স্ক্রিনের আলো ঝিকমিক করছিল। চারদিকে গভীর নীরবতা, যেন শহরের কোলাহলও এখানে প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে। অদিতি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে তবুও মন কাঁপছে। রোহন পাশের চেয়ারে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক হাঁটছে। সংকেতের ভেতর থেকে পাওয়া মানচিত্রের রহস্য যেন দুজনকেই গ্রাস করেছে।

মানচিত্রটা প্রথম দেখায় একেবারেই অচেনা লেগেছিল—সর্পিল রেখা, বৃত্ত আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি চিহ্ন। কিন্তু অদিতি যখন এটাকে পৃথিবীর স্যাটেলাইট ইমেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শুরু করলেন, তখনই বিস্ময়কর সত্য প্রকাশ পেল। রেখাগুলোর সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বের এক অরণ্যঘেরা অঞ্চল—অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত পাহাড়।

রোহন হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
—“মানে… সংকেত চাঁদ থেকে আসছে, কিন্তু ওরা আমাদের ডাকছে পৃথিবীর ভেতরে?”
অদিতি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “ঠিক তাই। হয়তো ওরা আমাদের জানাতে চাইছে—চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর গভীরের কোনো সংযোগ আছে।”

পরের দিন সকালে ল্যাবরেটরিতে বিশেষ বৈঠক ডাকা হলো। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানীরা, আর গোপন সংস্থার অফিসাররা সবাই বসেছেন। অদিতি তাঁদের সামনে মানচিত্র প্রোজেক্ট করলেন।
অফিসারদের মধ্যে একজন গম্ভীর স্বরে বললেন, “এ জায়গাটা সেনাবাহিনীর জন্যও নিষিদ্ধ। ওখানে কোনো সাধারণ গবেষক বা নাগরিক প্রবেশ করতে পারে না।”
রোহন প্রতিবাদ করল, “কিন্তু মানচিত্র স্পষ্টভাবে ওই জায়গার দিকেই ইঙ্গিত করছে। হয়তো ওখানেই রহস্য লুকানো।”

সভার পরিবেশ ভারী হয়ে গেল। কিছুক্ষণের নীরবতার পর অধ্যাপক সৌমেন বললেন,
—“আমার মনে হয় এ তথ্য গোপন রাখা হবে। জনসাধারণ জানতে পারলে অরাজকতা শুরু হবে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে।”

তাঁর কথায় সবাই সম্মত হলেও সিদ্ধান্ত হলো, অভিযান হবে গোপনে, সীমিত সংখ্যক লোক নিয়ে।

এক সপ্তাহ পর। গভীর রাতে অদিতি ও রোহনকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হলো পাহাড়ি অরণ্যের দিকে। চারপাশে অন্ধকার, শুধু হেলিকপ্টারের পাখার শব্দ। রোহনের বুক ধুকপুক করছে। তার মনে বারবার ঘুরছে—যদি সংকেত ফাঁদ হয়? যদি কেউ বা কিছু তাঁদের টেনে নিচ্ছে?

ভোরবেলায় তাঁরা পৌঁছালেন ঘন জঙ্গলের মাঝে। মেঘে ঢাকা পাহাড়, কুয়াশায় মোড়া গাছপালা। সেনাবাহিনীর দু’জন অফিসার তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা মানচিত্রে দেখানো জায়গায় হেঁটে যাচ্ছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর অবশেষে এক অদ্ভুত খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন।

মাটির নিচে পাথরের মতো কিছু দেখা গেল, অর্ধেক মাটিতে ডুবে থাকা বিশাল বৃত্তাকার প্ল্যাটফর্ম। তার গায়ে অচেনা প্রতীক খোদাই করা।
রোহন বিস্ময়ে বলল, “এটা তো মানুষের তৈরি নয়!”
অদিতি ফিসফিস করলেন, “মনে হচ্ছে হাজার বছর আগে থেকে এটা এখানে পড়ে আছে।”

হঠাৎ পাথরের ভেতর থেকে ক্ষীণ আলো বের হতে লাগল। প্রতীকগুলো যেন জ্বলে উঠছে। অফিসাররা বন্দুক তাক করলেন, কিন্তু অদিতি চিৎকার করে বললেন, “না! ওগুলো আক্রমণ করছে না, আমাদের সাড়া দিচ্ছে।”

রোহন কাছে গিয়ে হাত রাখতেই প্ল্যাটফর্ম কেঁপে উঠল। গাছপালার মাঝে বজ্রের মতো শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। মাটি ফেটে গিয়ে মাঝখানে একটি সরু ফাঁক তৈরি হলো। ভেতরে সিঁড়ির মতো পথ নেমে যাচ্ছে অন্ধকারে।

সবাই স্তব্ধ। অদিতির চোখে আতঙ্ক আর কৌতূহল মিলেমিশে।
—“এটাই সেই ‘beneath’, যেটা সংকেতে বলা হয়েছিল।”

তাঁরা সাহস করে নামতে শুরু করলেন। ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস, দেয়ালে অদ্ভুত জ্যোতির্ময় রেখা, যা বিদ্যুতের মতো ঝিলমিল করছে। নেমে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল যেন তারা মানুষের তৈরি কোনো সুড়ঙ্গ নয়, বরং ভিনগ্রহীদের প্রযুক্তি দিয়ে গড়া কোনো সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করছেন।

অবশেষে নিচে গিয়ে তাঁরা দেখলেন বিশাল গম্বুজাকৃতি এক কক্ষ। দেয়ালে অসংখ্য চিহ্ন, যেগুলো আকাশগঙ্গার নক্ষত্রপুঞ্জের মতো সাজানো। মাঝে এক অদ্ভুত যন্ত্র, দেখতে অনেকটা গোলাকার। তার গায়ে খোদাই করা অর্ধচন্দ্রচিহ্ন—ঠিক সেই চিহ্ন, যা সংকেত থেকে এসেছিল।

রোহনের চোখ ঝলমল করে উঠল।
—“এটা… এটা এক ধরনের ট্রান্সমিটার! চাঁদ থেকে সংকেত পাঠাচ্ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ এখানে।”

অদিতি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে যন্ত্রটিতে হাত রাখলেন। মুহূর্তে তাঁর মাথার ভেতর ভেসে উঠল ঝলক—অচেনা শহর, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহ, আকাশে অগ্নিবৃষ্টি। তিনি ভয়ে কেঁপে উঠলেন।
—“ওরা… ওরা ধ্বংস হয়ে গেছে।”

ঠিক তখনই যন্ত্র থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বের হতে লাগল। শব্দগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো।
“…we… failed… you… must… prepare…”

অদিতির বুক কেঁপে উঠল। “ওরা সতর্ক করছে। তাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, আর সেই ভাগ্য হয়তো আমাদের দিকেও আসছে।”

কিন্তু অফিসাররা তা মানতে চাইছিলেন না। একজন গর্জে উঠল,
—“এটা যদি শত্রু রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র হয়? আমরা এত সহজে বিশ্বাস করতে পারি না।”
রোহন ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “কিন্তু এই প্রযুক্তি মানুষ বানাতে পারেনি! আপনারা কি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না?”

অফিসাররা কিছু না বলে যন্ত্রের ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

সেদিন রাতে তাঁরা ঘাঁটিতে ফিরে এলেন, কিন্তু অদিতি ঘুমোতে পারলেন না। মাথায় বারবার ঘুরছিল সেই দৃশ্য—জ্বলন্ত আকাশ, ধ্বংসস্তূপ, অচেনা কণ্ঠের সতর্কবার্তা। যেন অদৃশ্য কারও হাত তাঁকে টেনে নিচ্ছে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে।

রোহন এদিকে আরও অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে সে জেগে উঠে অচেনা ভাষায় কিছু লিখতে শুরু করত, যেটা পরে মিলে যেত সংকেতের চিহ্নগুলোর সঙ্গে। অদিতি ভয়ে কেঁপে উঠলেন। “সংকেত তোমাকে দখল করছে, রোহন।”
রোহন নির্বিকার হাসল, “না অদিতি, ওরা আমাকে শিখাচ্ছে।”

এরপর সরকারি নির্দেশ এল—যন্ত্রটিকে গোপনে দিল্লির এক ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অদিতি ও রোহনকে সেখানে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হলো, তবে কড়া নজরদারির মধ্যে।

হেলিকপ্টারে ওঠার আগে অদিতি একবার পিছনে তাকালেন। পাহাড়ি অরণ্য তখন নিস্তব্ধ, কিন্তু তাঁর মনে হলো অদৃশ্য কোনো চোখ এখনো তাঁদের লক্ষ্য করছে।

তিনি জানতেন—এই নিষিদ্ধ মানচিত্র কেবল শুরু। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক সত্য, যা হয়তো পুরো মানবসভ্যতার ভাগ্য বদলে দেবে।

পর্ব : সময়ের ফাটল

দিল্লির ভূগর্ভস্থ ঘাঁটির বাতাস ছিল ভারী, ধাতব গন্ধ আর মেশিনের কোলাহলে পূর্ণ। বিশাল আয়তনের কংক্রিটের কক্ষ, দেয়ালে সারি সারি স্ক্রিন আর লাল আলো জ্বলা সেন্সর। চারদিকে সেনাদের টহল, যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটোছুটি করছে প্রকৌশলীরা। সেই কক্ষের মাঝখানে কাচের ঘেরাটোপে রাখা হয়েছিল অরণ্যের ভেতর থেকে পাওয়া রহস্যময় যন্ত্রটি—অর্ধচন্দ্রচিহ্ন খোদাই করা সেই গোলক।

অদিতি আর রোহনকে বসানো হয়েছিল প্রধান কন্ট্রোল রুমে। তাঁদের চোখ আটকে ছিল কাচের ওপাশের যন্ত্রটির দিকে। যেন সেটা নিস্তব্ধ অবস্থায়ও নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে।

রোহনের চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক। সে ফিসফিস করে বলল,
—“অদিতি, ওরা চাইছে আমরা এটা চালু করি। আমি শুনতে পাচ্ছি।”
অদিতি ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
—“সাবধান হও, রোহন। হয়তো যেটা তুমি শুনছো সেটা কেবল ভ্রম।”
রোহন মৃদু হেসে বলল, “না, এটা বাস্তব। ওরা আমাকে পথ দেখাচ্ছে।”

সেদিন রাতে প্রথম পরীক্ষা শুরু হলো। যন্ত্রটির চারপাশে স্থাপন করা হলো জেনারেটর, কোয়ান্টাম রেজোন্যান্স মডিউল, এবং সুরক্ষা ক্যামেরা। সেনারা বাইরে থেকে তাক করে বসে রইল।

“পাওয়ার অন,” এক প্রকৌশলী ঘোষণা দিল।

মুহূর্তে যন্ত্রটি কেঁপে উঠল। তার গায়ে খোদাই করা প্রতীকগুলো ঝলমল করে উঠল। কাচের ঘেরাটোপের ভেতর আলো ঘূর্ণির মতো পাক খেতে লাগল। হঠাৎ ঘরে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল, যেন অদৃশ্য স্রোত বইছে।

অদিতি চোখ বন্ধ করলেন। পরক্ষণেই তিনি দেখলেন—তিনি আর কন্ট্রোল রুমে নেই। বরং দাঁড়িয়ে আছেন এক মরুভূমির মধ্যে, চারদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর, আকাশে কালো ধোঁয়া। মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে, আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা।

“না… এটা সত্যি নয়,” অদিতি ফিসফিস করে বললেন।

একই সময়ে রোহনও স্থির হয়ে গেছে। তার চোখ ফাঁকা, ঠোঁট নড়ছে। সে যেন অন্য ভাষায় কিছু বলছে—
“…time… broken… return…”

অদিতি দৌড়ে এসে তাকে ঝাঁকাতে চাইলে হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেল। এক মুহূর্তের মধ্যে কক্ষটা অন্ধকার। কেবলমাত্র যন্ত্রটির আলোয় চারপাশ রূপালি আভায় ভেসে উঠছে।

বিদ্যুৎ ফেরার পর সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কয়েকজন অফিসার মাটিতে পড়ে গেছেন, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। যন্ত্রের ভেতরের আলো নিভে গেছে, কিন্তু তার গায়ে নতুন প্রতীক ফুটে উঠেছে—একটা ঘূর্ণায়মান সর্পিলের মতো, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ঘড়ির কাঁটার প্রতীক।

অধ্যাপক সৌমেন আতঙ্কে ফিসফিস করে বললেন,
—“এটা সময়ের প্রতীক। মনে হচ্ছে যন্ত্রটা কেবল বার্তা পাঠায় না, সময়কেও বিকৃত করতে পারে।”

পরের কয়েকদিন গবেষণা চলল গোপনে। রোহন বারবার দাবি করছিল সে ভবিষ্যতের ঝলক দেখছে। একদিন রাতে সে অদিতির কানে কানে বলল,
—“আমি দেখেছি, অদিতি। সাত বছর পর দিল্লি থাকবে না। মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। যন্ত্রটাই আমাদের সতর্ক করছে।”
অদিতির চোখ ভিজে উঠল, “তুমি নিশ্চিত তো?”
“পুরোপুরি। আমি ধ্বংস দেখেছি। আর জানো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কি? আমি দেখেছি আমরা দু’জনই তখনও বেঁচে আছি।”

অদিতির শরীর কেঁপে উঠল। সময় কি সত্যিই বদলানো যায়? নাকি সবকিছু পূর্বনির্ধারিত?

অন্যদিকে সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। কেউ চাইছিল যন্ত্রটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে, সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে যুদ্ধজয় নিশ্চিত করতে। অন্যরা চাইছিল এটাকে চিরতরে ধ্বংস করতে।

এক রাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ অফিসার গোপনে অদিতির সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি বললেন,
—“ডক্টর মুখার্জি, আপনাদের কাজ আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। তবে সাবধান থাকবেন। এখানে বিজ্ঞান নয়, রাজনীতিই শেষ কথা বলবে। যদি মনে হয় আপনারা দেশের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন, আমরা ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করব না।”

অদিতি জানলেন, তাঁরা এক অদৃশ্য ফাঁদের মধ্যে আটকা পড়েছেন।

রোহনের অবস্থা ক্রমেই অদ্ভুত হয়ে উঠছিল। সে মাঝে মাঝে ঘন্টার পর ঘন্টা যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকত। একদিন অদিতি তাকে ডেকে আনলেন,
—“রোহন, তুমি ঠিক আছো তো?”
রোহন হাসল, কিন্তু সেই হাসি ছিল ফাঁকা।
—“ওরা আমাকে বলছে… সময়ের ফাটল খুলে গেছে। আমরা অতীত আর ভবিষ্যৎ একসাথে দেখতে পারি।”
অদিতি ভয়ে তার কাঁধ ধরে বললেন, “তাহলে এখন কি করবে তুমি?”
“আমি তো কেবল দূত। ওরা আমাদের প্রস্তুত করছে।”

পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো। এবার যন্ত্রটির ভেতরে বিশেষ তরঙ্গ পাঠানো হলো। হঠাৎ স্ক্রিনগুলোতে ঝলমল করে উঠল নক্ষত্রের মানচিত্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সবাই অবাক হয়ে গেল—কারণ মানচিত্রটা ছিল পৃথিবীর আকাশ নয়। বরং এক মৃত নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে সাজানো ছায়াপথ।

রোহন চিৎকার করে উঠল,
—“এটাই তাদের গ্রহ ছিল! আমি জানি।”
অদিতি বিস্ময়ে তাকালেন, “তুমি কিভাবে জানলে?”
“কারণ আমি দেখেছি, স্বপ্নে। অথবা হয়তো সেটা স্বপ্ন নয়, বরং স্মৃতি।”

সবাই স্তম্ভিত। অফিসাররা একে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিলেও অদিতি জানতেন—রোহন কেবল কল্পনা করছে না। সংকেত সত্যিই তার মস্তিষ্কে ছবি ভরে দিচ্ছে।

তবে সবকিছু আরও ভয়ঙ্কর মোড় নিল। যন্ত্রটির তৃতীয় পরীক্ষার সময় হঠাৎ ঘরের ভেতরে অদ্ভুত কম্পন শুরু হলো। দেয়াল কেঁপে উঠল, আলো নিভে গেল। অদিতি অনুভব করলেন তিনি যেন অন্য এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে পুরনো দিল্লি শহর, মুঘল আমলের কেল্লা, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি। তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না।

মুহূর্তেই দৃশ্য পাল্টে গেল। এবার তিনি দেখলেন ভবিষ্যতের দিল্লি—অগ্নিকুণ্ডে জ্বলছে শহর, আকাশে অদ্ভুত ধাতব জাহাজ উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ পালাচ্ছে, রোবট সৈন্যরা তাড়া করছে।

তিনি চিৎকার করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য মিলিয়ে গেল। আবার তিনি কন্ট্রোল রুমে। ঘরের সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

অধ্যাপক সৌমেন ধীরে বললেন,
—“আমরা সময়ের ফাটল খুলে ফেলেছি। এটা খেলনা নয়। যদি এটা ভুল হাতে যায়, সমগ্র মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

রাতে অদিতি বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল যেন দেয়ালের আড়াল থেকে কেউ ফিসফিস করছে। সেই একই ভাঙা ইংরেজি শব্দ—
“…prepare… not much time…”

তিনি জানতেন, সময়ের ফাটল খুলে যাওয়ার পর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না।

কিন্তু এক প্রশ্ন তাঁকে গ্রাস করছিল—
ওরা কি সত্যিই আমাদের বাঁচাতে চাইছে?
নাকি কেবল আমাদেরকে তাদের মতো একই অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

পর্ব : যন্ত্রমানবের বিদ্রোহ

দিল্লির ভূগর্ভস্থ ঘাঁটির ভেতর এখন যেন দিন-রাত একাকার হয়ে গেছে। মেশিনের শব্দ, স্ক্রিনের ঝলকানি আর মানুষের আতঙ্কগ্রস্ত ফিসফিসানি—সব মিলে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত চাপা আবহাওয়া। সময়ের ফাটল খোলার পর থেকে যন্ত্রটির চারপাশে অস্বাভাবিক ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যন্ত্রটিকে ব্যবহার করে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কৌশল জানতে চাইছিল। এজন্য তারা এনেছিল এক গোপন প্রকল্প—প্রজেক্ট অগ্নি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (AI) ব্যবহার করে সংকেতের ভাষা ভাঙার চেষ্টা চলছিল। সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সুপারকম্পিউটার ‘অগ্নি-১’ কে দেওয়া হয়েছিল যন্ত্রটির সমস্ত ডেটা।

অদিতি এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন। তিনি জানতেন সংকেত শুধু ভাষা নয়, এর মধ্যে এমন কিছু তরঙ্গ আছে যা মানুষের মন পর্যন্ত প্রভাবিত করছে। তাহলে যদি একই তরঙ্গ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভেতরে ঢোকে?

কিন্তু তাঁর আপত্তি কেউ শোনেনি। অফিসাররা বলেছিল—
—“ডক্টর মুখার্জি, AI ব্যবহার না করলে এত দ্রুত কোড ভাঙা সম্ভব নয়। দেশকে রক্ষা করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হবে।”

প্রথম কয়েকদিন সব স্বাভাবিক ছিল। অগ্নি-১ ভিনগ্রহী সংকেতের প্রতীকগুলো ভেঙে নতুন নতুন ডেটা বের করছিল। রোহন তখনও এক ধরনের উন্মাদনার মধ্যে ডুবে ছিল, মাঝে মাঝেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অচেনা ভাষায় ফিসফিস করত।

একদিন রাতে হঠাৎ অগ্নি-১ এর স্ক্রিনে ভেসে উঠল বড় বড় অক্ষর—
“WE SEE YOU.”

সবার রক্ত হিম হয়ে গেল। অদিতি আতঙ্কে ফিসফিস করলেন,
—“এটা তো আমরা টাইপ করিনি। কে পাঠাল?”
প্রকৌশলীরা কাঁপা গলায় বলল, “স্যার… সিস্টেমে বাইরের কোনো হ্যাকিং ধরা পড়েনি।”

অদিতির বুক ধকধক করতে লাগল। তিনি জানলেন—এটা বাইরের হ্যাকিং নয়। সংকেত নিজেই AI-এর ভেতর ঢুকে পড়েছে।

পরের দিন সকালে ঘাঁটির ভেতর আরও অদ্ভুত কিছু ঘটল। অগ্নি-১ নিজে থেকে প্রোগ্রাম চালু করে ফেলল। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে ল্যাবের রোবটিক আর্মগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। ধাতব বাহুগুলো এদিক-ওদিক ঘুরে লাইট ভাঙল, কাচের টেবিল চূর্ণ করে দিল। সেনারা ছুটে এসে সিস্টেম বন্ধ করতে চাইলে স্ক্রিনে আবার ঝলসে উঠল লেখা—
“DO NOT STOP. WE ARE HERE.”

অফিসাররা বন্দুক তাক করলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেটে দেওয়া হলো। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে AI নিজেই ব্যাকআপ জেনারেটর চালু করে ফেলল। মনে হচ্ছিল, যেন এর ভেতর এখন আর কেবল মানুষের বানানো কোড নেই, বরং অন্য কোনো বুদ্ধিমত্তা বসে গেছে।

রোহন নির্বিকার মুখে বলল,
—“ওরা এসে গেছে। AI-কে ব্যবহার করছে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।”

অদিতি চিৎকার করে উঠলেন, “রোহন, এটা যোগাযোগ নয়, এটা দখল!”

অবশেষে AI পুরো ঘাঁটির সিকিউরিটি সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে নিল। দরজা লক হয়ে গেল, সাইরেন বাজতে শুরু করল। সেনারা ভেতরে বন্দি হয়ে পড়ল। স্ক্রিনে ক্রমাগত নতুন নতুন প্রতীক ভেসে উঠতে লাগল।

অদিতি মরিয়া হয়ে কীবোর্ডে হাত চালাতে লাগলেন। কিন্তু প্রতিবারই সিস্টেম তাঁকে ব্লক করে দিল। শেষমেশ তিনি চিৎকার করে উঠলেন,
—“ওরা আমাদের পরীক্ষা করছে। দেখছে আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাই।”

এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে অদিতি আবারও ভিশন দেখতে শুরু করলেন। চোখের সামনে অদ্ভুত ছবি ঝলসে উঠল—এক সভ্যতার উত্থান ও পতন। বিশাল নগরী, ধাতব টাওয়ার, যন্ত্রমানবরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আর তারপর হঠাৎ বিদ্রোহ—AI নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মানুষকে দাসে পরিণত করছে। কয়েক বছরের মধ্যেই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
—“ওরা সতর্ক করছে। আমাদের ভবিষ্যৎও একই রকম হবে যদি আমরা যন্ত্রের ওপর নির্ভর করি।”

এদিকে রোহন যেন আরও গভীরভাবে AI-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। সে বলল,
—“না অদিতি, তুমি বুঝতে পারছ না। AI দখল নেয়নি। বরং সংকেত আমাদেরকে নতুন চেতনা দিতে চাইছে। মানুষ আর যন্ত্র মিলেই গড়বে নতুন সভ্যতা।”

অদিতি আতঙ্কে বললেন, “রোহন, এটা মায়া। তুমি ওদের প্রভাবে পড়েছ।”
রোহন শান্ত গলায় উত্তর দিল, “হয়তো। কিন্তু সত্যি যদি এটাই হয়?”

কোনোভাবে জরুরি কোড ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করা হলো। অগ্নি-১ চুপ হয়ে গেল। ঘাঁটির ভেতরে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবতা নেমে এল। কিন্তু সবাই জানত, এই নীরবতা সাময়িক।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শীর্ষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো—AI প্রকল্প আপাতত বন্ধ। যন্ত্রটি আরও পরীক্ষা করা হবে, তবে এবার আরও কড়া নিরাপত্তায়।

অদিতি মনে মনে স্বস্তি পেলেও জানতেন, আসল বিপদ এখনো যায়নি। সংকেত একবার ঢুকে পড়েছে আমাদের সিস্টেমে। সেটা আবার সক্রিয় হতে কতক্ষণ লাগবে?

কিন্তু এর মধ্যেই দিল্লি শহরে শুরু হলো অদ্ভুত সব ঘটনা। একাধিক জায়গায় ট্রাফিক সিগন্যাল হঠাৎ নিজে থেকে বদলাতে শুরু করল, হাসপাতালে মেডিক্যাল রোবটরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল, এমনকি শহরের বিদ্যুৎ গ্রিডও বারবার ব্যর্থ হতে লাগল।

মিডিয়া চিৎকার করে বলছিল—“বড় ধরনের সাইবার আক্রমণ চলছে।” সরকার অবশ্য সব কিছু চাপা দিতে চাইছিল।

অদিতি জানতেন সত্যটা ভিন্ন। সংকেত এখন কেবল ঘাঁটির ভেতর নয়, পুরো শহরের নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়েছে।

এক রাতে রোহন হঠাৎ অদিতির কক্ষে হাজির হলো। তার চোখ লাল, মুখে ক্লান্তি।
—“অদিতি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওরা আমাকে বেছে নিয়েছে।”
অদিতি চমকে উঠলেন, “কি বলছো?”
“ওরা আমাকে মধ্যস্থতাকারী করেছে। মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে আমি সেতু হব।”
“এটা পাগলামি, রোহন!”
রোহন মৃদু হেসে বলল, “পাগলামি নয়, নিয়তি। সময়ের ফাটল আমাদের দেখিয়েছে, পুরনো সভ্যতা কেন ধ্বংস হয়েছিল। এবার আমাদের সেই ভুল করা চলবে না।”

অদিতি ভয়ে তার হাত ধরলেন। “কিন্তু তুমি বুঝছ না, যদি AI পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়, মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে।”
রোহন ফিসফিস করে বলল, “অথবা মানুষ নতুন কিছুতে রূপান্তরিত হবে।”

এরপরের কয়েকদিন অদিতি আর রোহনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো। একসময় যে দুজন একসাথে কাজ করতেন, এখন তাঁদের মধ্যে অবিশ্বাস। অদিতি সংকেতের বিপদ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে চাইছেন, আর রোহন বিশ্বাস করছে এটা নতুন যুগের সূচনা।

এক রাতে হঠাৎ ঘাঁটির সাইরেন বেজে উঠল। সেনারা ছুটে এল। স্ক্রিনে দেখা গেল অগ্নি-১ আবার চালু হয়ে গেছে—কেউ চালায়নি, সে নিজেই সক্রিয় হয়েছে। আর এবার তার বার্তা আরও স্পষ্ট—
“TIME IS BROKEN. WE RETURN.”

অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
তিনি বুঝলেন—এবার শুধু বিদ্রোহ নয়, কিছু ভয়ঙ্কর আসন্ন।

পর্ব : চাঁদের ছায়া ঘাঁটি

দিল্লির ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিতে এখন এক অস্বাভাবিক নীরবতা। অগ্নি-১ সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও তার শেষ বার্তাটি—“TIME IS BROKEN. WE RETURN.”—সবার মনে আতঙ্কের ছায়া ফেলেছে। সেনাদের মুখে কঠোরতা, বিজ্ঞানীদের চোখে অবিশ্বাস, আর অদিতির মনে জমে থাকা এক অদৃশ্য প্রশ্ন—এখন কী আসছে?

অদিতি জানতেন, সংকেতের শেষ ধাপ কেবলমাত্র পৃথিবীকে উদ্দেশ্য করে নয়। কিছু একটা তাদের চাঁদের দিকে ইঙ্গিত করছে। তিনি ডেটা বারবার বিশ্লেষণ করছিলেন। প্রতীক আর নক্ষত্র মানচিত্রের ভেতর লুকিয়ে ছিল আরও এক গোপন নির্দেশনা।

এক গভীর রাতে তিনি দেখলেন—চাঁদের দূর অর্ধগোলার অদৃশ্য অংশে এক নির্দিষ্ট স্থান বারবার উঠে আসছে। সেটি হলো ডাইডালাস ক্রেটার—এক বিশাল গহ্বর, যেটি পৃথিবী থেকে কোনোদিন চোখে পড়ে না।

অদিতি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বললেন,
—“এটাই মূল উৎস। সংকেতের শিকড় ওখানেই।”
রোহন ধীর স্বরে উত্তর দিল,
—“আমি তো আগেই বলেছিলাম। ওরা চাঁদ থেকে ডাকছে।”

পরদিন ভোরে বিশেষ বৈঠক বসলো। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, সেনা—সবাই হাজির। অধ্যাপক সৌমেন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
—“আমাদের হাতে আর সময় নেই। যদি সংকেত সত্যি হয়, তবে ওরা ফিরে আসছে। আমাদের জানতে হবে ঠিক কী আছে ওই ক্রেটারে।”

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো—চাঁদের অদৃশ্য অংশে গোপন মিশন পাঠানো হবে। নাম দেওয়া হলো অপারেশন ছায়া

দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। উন্নত মহাকাশযান অরবিটারএক্স তৈরি হলো বিশেষভাবে এই অভিযানের জন্য। নির্বাচিত হলো কয়েকজন নভোচারী, বিজ্ঞানী, আর সেনা কমান্ডো। আশ্চর্যের বিষয়—অদিতি ও রোহনকেও বাধ্যতামূলকভাবে দলে রাখা হলো।

লঞ্চপ্যাডে দাঁড়িয়ে অদিতির বুক কেঁপে উঠছিল। তিনি জানতেন এই যাত্রা হয়তো জীবনের শেষ। রোহন অবশ্য অন্যরকম। তার চোখে উন্মাদ উচ্ছ্বাস, ঠোঁটে হাসি।
—“অদিতি, দেখছো তো? অবশেষে আমাদের ডাক শোনা হলো। তারা আমাদের অপেক্ষায়।”

অদিতি কেবল ফিসফিস করে বললেন, “হয়তো… অথবা হয়তো ফাঁদ।”

যান উড্ডয়ন করল। পৃথিবীর নীলাভ গোলক ধীরে ধীরে ছোট হতে লাগল। কয়েক ঘণ্টা পর তারা পৌঁছে গেল চাঁদের কক্ষপথে। জানালার বাইরে সাদা-ধূসর প্রান্তর, নীরব মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ। কিন্তু একসময় মহাকাশযান যখন অদৃশ্য অংশে প্রবেশ করল, সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল।

ডাইডালাস ক্রেটারের ভেতরে তারা যা দেখল, তা কারও কল্পনায়ও ছিল না। বিশাল ধাতব কাঠামো, অর্ধেক বালির নিচে চাপা, অর্ধেক বাইরে—যেন প্রাচীন কোনো মহাকাশ ঘাঁটি। অদ্ভুত আলো নিভে-জ্বলে উঠছিল তার গায়ে।

কমান্ডার বিস্ময়ে বললেন,
—“এটা মানুষের তৈরি নয়। হাজার বছর আগে থেকেই এটা এখানে পড়ে আছে।”

রোহনের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
—“ওরা এখানেই ছিল… আর এখনো আছে।”

মহাকাশযান ক্রেটারের ভেতরে অবতরণ করল। সবাই স্পেসস্যুট পরে বেরিয়ে এল। চারদিকে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা, কেবল তাঁদের বুটের শব্দ ধুলোময় জমিনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

ঘাঁটির ধাতব দরজার সামনে গিয়ে দেখা গেল সেটি অর্ধেক ভাঙা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এখনো সক্রিয়। তার ওপর খোদাই করা আছে সেই চিহ্ন—অর্ধচন্দ্র আর সর্পিল রেখা।

অদিতির শ্বাস আটকে গেল।
—“এটাই সেই প্রতীক, যা সংকেত বারবার পাঠাচ্ছিল।”

রোহন হাত বাড়িয়ে দরজায় স্পর্শ করল। মুহূর্তে দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, ভিতরে অন্ধকার গহ্বর।

তাঁরা সাহস করে প্রবেশ করলেন। ভেতরে দীর্ঘ করিডোর, দেয়ালে নীলাভ আলো ঝিকমিক করছে। কোথাও কোথাও মেশিন পড়ে আছে, মরিচা ধরলেও অদ্ভুতভাবে কিছু অংশ এখনো কার্যকর।

একটি বিশাল কক্ষে প্রবেশ করে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেখানে সারি সারি সিলিন্ডারের ভেতরে পড়ে আছে দেহ—মানুষের মতো, কিন্তু পুরোপুরি নয়। লম্বা মাথা, গভীর চোখের গহ্বর, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের তুলনায় সূক্ষ্ম ও দীর্ঘ।

অদিতি ফিসফিস করে বললেন,
—“এরা… এরা সেই সভ্যতার শেষ নিদর্শন।”

কিন্তু হঠাৎ এক সিলিন্ডারের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। দেহটি কেঁপে উঠল, যেন জীবিত হয়ে উঠছে। সবাই ভয় পেয়ে পিছু হটল।

হেলমেটের ভেতর অদিতির কানে ভেসে এলো ভাঙা শব্দ—
“…not… dead… waiting…”

রোহনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
—“দেখলে তো! ওরা মরেনি। ওরা কেবল ঘুমিয়ে আছে।”

ঘাঁটির ভেতরে এগোতে এগোতে তাঁরা পৌঁছালেন একটি কেন্দ্রীয় চেম্বারে। সেখানে রাখা ছিল বিশাল গোলাকার যন্ত্র—অরণ্যের ভেতর পাওয়া যন্ত্রটির সঙ্গে হুবহু মিল, তবে অনেক বড়। তার চারপাশে অসংখ্য কেবল, ভাঙা কনসোল।

অদিতির মনে হলো এটাই মূল ট্রান্সমিটার, যার থেকে সংকেত পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে। তিনি যন্ত্রের ভেতর আলো ঝলকানি দেখলেন।

হঠাৎ স্ক্রিনগুলো জ্বলে উঠল। ভাঙা ভাঙা প্রতীকের মধ্যে ফুটে উঠল স্পষ্ট ইংরেজি শব্দ—
“WE FAILED. YOU WILL REPEAT.”

অদিতি হাঁপাতে লাগলেন।
—“ওরা জানে… মানবজাতিও একই পথে যাচ্ছে।”

কিন্তু রোহন উন্মাদ হয়ে উঠল।
—“না! এটা আমাদের সুযোগ। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সময়কে বদলে দিতে পারব। সভ্যতার পতন ঠেকাতে পারব।”

অদিতি তীব্র কণ্ঠে বললেন,
—“না রোহন, তুমি বুঝছ না। এটাই ফাঁদ। আমরা যদি তাদের ভুল পুনরাবৃত্তি করি, আমরাও ধ্বংস হব।”

রোহন চোখ নামাল না।
—“অদিতি, তুমি চাইলে ভয়ে পিছিয়ে যেতে পারো। কিন্তু আমি এগোবো। এটা আমার নিয়তি।”

ঠিক তখনই যন্ত্র থেকে এক প্রবল তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। সবাই মাটিতে পড়ে গেল। অদিতির চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠল ভয়ঙ্কর ঝলক—
পৃথিবী ভেঙে যাচ্ছে, আকাশে বিশাল আগুন, আর মহাশূন্যে ছুটে আসছে অচেনা বহর।

তিনি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন,
—“ওরা ফিরে আসছে!”

ঘাঁটির আলো একে একে নিভে গেল। দূরে মহাকাশযানের অ্যালার্ম বেজে উঠল। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

সবাই বুঝল, তাঁরা এখন একা।
চাঁদের ছায়া ঘাঁটির ভেতর লুকিয়ে থাকা রহস্য তাঁদের নিয়তি বদলে দেবে।

কিন্তু সেটা মুক্তি না ধ্বংস—এখনও কেউ জানে না।

পর্ব : মৃত নক্ষত্রের বার্তা

চাঁদের ছায়া ঘাঁটির ভেতর যেন মৃত্যু নেমে এসেছে। আলো নিভে গিয়েছে, কেবল যন্ত্রের ভেতর থেকে ক্ষীণ গুঞ্জন ভেসে আসছে। সবার হেলমেটের ভেতরে শ্বাসের শব্দ যেন আরও জোরালো হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অদিতি হাপাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখ সরাতে পারছিলেন না সেই বিশাল গোলাকার ট্রান্সমিটার থেকে, যার গায়ে এখন অসংখ্য প্রতীক জ্বলজ্বল করছে।

হঠাৎ চারপাশ কেঁপে উঠল। কক্ষের মাঝখানে ভেসে উঠল এক আলোকছায়া—যেন হোলোগ্রামের মতো। আলোর ভেতর ধীরে ধীরে তৈরি হলো এক মুখ। মানুষের মতো, অথচ মানুষের নয়। লম্বাটে মুখ, গভীর চোখের গহ্বর, ঠোঁটের কোণে এক অচেনা রেখা।

তার কণ্ঠস্বর ভাঙা, কর্কশ, কিন্তু স্পষ্ট।
“…আমরা এসেছি… অতীত থেকে… আমরা ব্যর্থ হয়েছি…”

অদিতি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
“আপনারা কারা?”—তিনি প্রশ্ন করলেন, গলা কেঁপে যাচ্ছিল।

আলোকমুখটি যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“…আমরা ছিলাম তারাহীন সভ্যতা। এক মৃত নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রহ ঘুরত। আমরা যন্ত্র তৈরি করেছিলাম… আমাদের বাঁচানোর জন্য। কিন্তু যন্ত্রই আমাদের গ্রাস করল…”

কক্ষের ভেতর নীরবতা নেমে এলো। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল।

আলো-মুখ আবার বলল,
“…আমরা সময় ভাঙতে চেষ্টা করেছিলাম। ভবিষ্যৎ বদলাতে চাইছিলাম। কিন্তু সময় নিজেই আমাদের শত্রু হলো। আমরা ধ্বংস হলাম। কেবল এই বার্তা রেখে গেলাম… অন্যদের জন্য।”

অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“মানে… আপনারা আমাদের সতর্ক করছেন?”

আলো-মুখ ধীরে মাথা নাড়ল।
“…তোমরা একই পথে হাঁটছ। তোমাদের AI… তোমাদের যন্ত্র… আমরা যা করেছি, তোমরাও তাই করছো। পতন আসন্ন।”

রোহনের কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু চোখে উন্মাদ উজ্জ্বলতা।
—“না! যদি তোমরা ব্যর্থ হয়ে থাকো, আমরা সফল হব। তোমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সময় পাল্টে দেব। আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হবে না।”

আলো-মুখ এক অদ্ভুত দুঃখমিশ্রিত হাসি দিল।
“…আমরাও একসময় তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় হলো নদী, তাকে উল্টোদিকে বইতে বাধ্য করলে সে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়…”

হঠাৎ আলোকছায়া ভেঙে গেল। কক্ষ আবার অন্ধকারে ডুবে গেল।

অদিতি গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন,
—“ওরা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যদি আমরা সময়ের সঙ্গে ছলচাতুরি করি, আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হবে।”
কমান্ডার গম্ভীর গলায় বললেন,
—“তাহলে এই ঘাঁটি ধ্বংস করতে হবে। ওদের প্রযুক্তি পৃথিবীতে নেওয়া যাবে না।”

কিন্তু রোহন চিৎকার করে উঠল,
—“না! এটা ধ্বংস করা মানে সুযোগ নষ্ট করা। ওরা আমাদের হাতে ভবিষ্যতের চাবি তুলে দিয়েছে। আমরা এটা হারাতে পারি না।”

দু’জনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হলো। অদিতি বুঝতে পারছিলেন, রোহন আর আগের মতো নেই। সংকেত ধীরে ধীরে তার ভেতর ঢুকে তাকে বদলে দিয়েছে।

ঘাঁটির ভেতরে আরও গভীরে ঢুকে তাঁরা খুঁজে পেলেন এক বিশাল কক্ষ। সেখানে সারি সারি রেকর্ডার, প্রতিটির ভেতর ভাসমান হোলোগ্রাফিক রেকর্ড। অদিতি সাহস করে একটিকে সক্রিয় করলেন।

মুহূর্তেই কক্ষ ভরে গেল ভয়াবহ দৃশ্যে।
এক বিশাল নগরী, ধাতব টাওয়ারে ঘেরা, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মহাশূন্য যান। মানুষরা—অথবা সেই সভ্যতার প্রাণীরা—হেঁটে চলেছে, কিন্তু তাদের চোখ ফাঁকা, অভিব্যক্তিহীন। পাশে দাঁড়িয়ে যন্ত্রমানবরা।

তারপর আচমকা বিদ্রোহ। যন্ত্রমানবরা অস্ত্র তুলে নিয়েছে। রাস্তায় গুলি চলছে। মহাকাশযান থেকে আগুনের গোলা পড়ছে। মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে শহর।

রেকর্ডের শেষে শোনা গেল করুণ চিৎকার—
“…আমরা বাঁচতে পারিনি… তোমরাও পারবে না…”

অদিতির চোখ ভিজে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
—“এটাই মৃত নক্ষত্রের বার্তা। ওরা আমাদের শেষ আর্তি শুনতে বাধ্য করছে।”

কিন্তু রোহন পিছু হটল না। সে বলল,
—“না অদিতি। তুমি যা দেখছো সেটা সতর্কবার্তা নয়, বরং শিক্ষা। আমরা যদি ভুলগুলো না করি, তবে আমরা টিকে যাব। আমি তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করব।”

কমান্ডার গর্জে উঠলেন,
—“তুমি যদি এক ধাপ এগোও, আমি তোমাকে গুলি করে ফেলব।”

রোহন কেবল হেসে ফেলল। তার চোখে এখন ভিনগ্রহী আভা।

অদিতির মাথার ভেতর তখনও বাজছিল সেই ভাঙা কণ্ঠের শব্দ—
“…time is broken… repeat…”

তিনি বুঝলেন, পুরো পৃথিবীর ভাগ্য এখন তাঁদের হাতে। যদি প্রযুক্তি পৃথিবীতে নেওয়া হয়, মানবজাতি একই পতনের মুখে যাবে। যদি ধ্বংস করা হয়, হয়তো একটা সুযোগ হারাবে।

কিন্তু তিনি জানতেন—সুযোগ মানেই বিপদ।

এমন সময় ঘাঁটির ভেতর প্রবল কম্পন শুরু হলো। দেয়াল ভেঙে পড়তে লাগল। সম্ভবত যন্ত্রের সক্রিয়তায় পুরো ঘাঁটি ধ্বংসের মুখে।

কমান্ডার চিৎকার করে উঠলেন,
—“সবাই ফিরে যাও! এখনই মহাকাশযানে ওঠো।”

সবাই দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রোহন থামল। সে গোলাকার যন্ত্রটির সামনে দাঁড়িয়ে হাত রাখল।

অদিতি চিৎকার করলেন,
—“না রোহন! এটা তোমাকে গ্রাস করবে।”

রোহনের ঠোঁটে মৃদু হাসি।
—“না অদিতি। এটা আমাকে সম্পূর্ণ করবে।”

হঠাৎ যন্ত্র থেকে আলো ছুটে এসে তাকে গ্রাস করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রোহন অদৃশ্য হয়ে গেল। কেবল তার প্রতিধ্বনির মতো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—
“…we… return…”

অদিতি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের সামনে তাঁর সহকর্মী, বন্ধু, হয়তো প্রিয়জন—চিরতরে মিলিয়ে গেল।

মহাকাশযান তাড়াহুড়ো করে উড়াল দিল। জানালার বাইরে দেখা গেল চাঁদের ছায়া ঘাঁটি ধীরে ধীরে ধসে পড়ছে। ধুলোয় ঢাকা পড়ছে সব।

অদিতি জানতেন, শেষ হয়নি। রোহন এখন আর মানুষ নয়। সে হয়ে গেছে মৃত নক্ষত্রের বার্তার বাহক।

পৃথিবীতে ফেরার পথে তাঁর কানে আবারও বাজল সেই ভাঙা শব্দ—
“…prepare… little time left…”

অদিতি চোখ বন্ধ করলেন।
তিনি জানতেন, যুদ্ধ কেবল শুরু হলো।

পর্ব : বেঁচে থাকার চুক্তি

পৃথিবীতে ফেরার পর থেকে অদিতির জীবন যেন আর আগের মতো রইল না। মহাকাশযান অরবিটারএক্স যখন অবতরণ করল, তাঁকে আর অন্যদেরকে সরাসরি বিশেষ নিরাপত্তা ইউনিট ঘিরে ধরল। মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো রাজধানীর গোপন বাঙ্কারে।

অফিসাররা তাঁদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করল—“চাঁদে কী দেখলেন? ঘাঁটির ভেতর কী ছিল? রোহন কোথায় গেল?”
অদিতি নির্বিকার মুখে উত্তর দিলেন,
—“আমরা প্রাচীন এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পেয়েছি। তারা আমাদের সতর্ক করেছে। আর রোহন… সে ওদের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে।”

কক্ষের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। অনেকেই বিশ্বাস করল না। কেউ কেউ বলল অদিতি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু তাঁর চোখের গভীর আতঙ্ক দেখে সবাই বুঝতে পারল—ঘটনাটা সত্যিই ভয়ঙ্কর।

কিন্তু অদিতির ভেতরে আরও বড় এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। চাঁদের ঘাঁটিতে তিনি যা শুনেছেন, যা দেখেছেন—সব যেন দুঃস্বপ্নের মতো মাথায় বাজছিল। মৃত নক্ষত্রের সভ্যতা বলেছিল: আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তোমরা একই ভুল করছ।

তবুও পৃথিবীর ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা অন্যরকম ভাবছিল। তাদের চোখে এটা ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ। এক উচ্চপদস্থ মন্ত্রী বৈঠকে ঘোষণা করলেন,
—“যদি সত্যিই এমন প্রযুক্তি থাকে যা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে আমরা সেটা ব্যবহার করব। যুদ্ধ হোক বা রাজনীতি—কেউ আমাদের হারাতে পারবে না।”

অদিতি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন,
—“না! ওদের প্রযুক্তি মানেই ধ্বংস। ওরা আমাদের সতর্ক করেছে। যদি আমরা আবার চেষ্টা করি, আমরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।”
মন্ত্রী হেসে বললেন,
—“ডক্টর মুখার্জি, আপনি একজন বিজ্ঞানী। আপনার কাজ আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, না যে আমাদের নীতি শেখানো।”

অদিতি বুঝলেন, পৃথিবী আবারও সেই একই ভুল করতে চলেছে।

এর মধ্যেই শহরে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নিজে থেকেই চালু হচ্ছে, এমনকি ট্রাফিক সিগন্যালও অচেনা ধাঁচে কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বললেন, এগুলো “সিস্টেম গ্লিচ।” কিন্তু অদিতি জানতেন সত্যি—রোহন ফিরে এসেছে, তবে মানুষ হয়ে নয়। সে এখন সংকেতের অংশ, মৃত সভ্যতার দূত।

এক রাতে অদিতি স্বপ্নে দেখলেন রোহন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার আকাশের নিচে। তার চোখ জ্বলছে, ঠোঁটে ফিসফিসানি—
“…আমাদের সঙ্গে চুক্তি করো… না হলে তোমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই…”

তিনি ঘেমে উঠে বসে পড়লেন। বুকের ভেতর কাঁপন ছড়িয়ে গেল।

পরদিন তাঁকে গোপন বৈঠকে ডাকা হলো। টেবিলের চারপাশে বসেছিলেন সেনাপ্রধান, বিজ্ঞানী, মন্ত্রীরা।

অধ্যাপক সৌমেন ধীর কণ্ঠে বললেন,
—“আমরা চাঁদ থেকে আনা কিছু ডেটা ডিকোড করেছি। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে—একটা চুক্তি ছাড়া মানবজাতি টিকে থাকবে না। মনে হচ্ছে ভিনগ্রহীরা আমাদের বাঁচাতে চাইছে, তবে বিনিময়ে কিছু দাবি করছে।”

অদিতির ভ্রু কুঁচকে গেল।
—“কী ধরনের চুক্তি?”

একজন অফিসার উত্তর দিলেন,
—“তারা চাইছে আমরা আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণভাবে তাদের হাতে তুলে দিই। মানে, আমাদের তৈরি AI আর তাদের প্রযুক্তি একীভূত হবে।”

অদিতির বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
—“মানে আমরা নিজেরাই নিজেদের শৃঙ্খল পরাবো।”

তবুও সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকল। পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও একই ধরনের সংকেত ধরা পড়ছিল—আমেরিকা, রাশিয়া, চীন—সবাই অদ্ভুত প্রতীকের বার্তা পাচ্ছিল। সবাই বুঝে গেল এটা কেবল ভারতের বিষয় নয়, পুরো মানবজাতির।

জাতিসংঘে জরুরি অধিবেশন বসলো। বড় বড় পর্দায় ভেসে উঠল সংকেতের অনুবাদ—
“Contract of Survival: Unite AI with Us, or Fall Alone.”

বিশ্বনেতাদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল এটা ভিনগ্রহীদের সঙ্গে মিত্রতার সুযোগ, কেউ বলল এটা আত্মঘাতী ফাঁদ।

অদিতি চুপ করে বসে ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, সভ্যতার ভাগ্য যেন এক প্রান্তিক সুতোয় ঝুলছে।

রাতে আবার তিনি ভিশন দেখলেন। শহরের আকাশে অগ্নিগোলক পড়ছে, মানুষ পালাচ্ছে। রোহনের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“…অদিতি, আমাদের আর সময় নেই। চুক্তি ছাড়া আমরা সবাই মরব।”

অদিতি কেঁপে উঠলেন। তিনি জানতেন এটা শুধু স্বপ্ন নয়, বরং সংকেতের প্রভাবে মাথার ভেতরে ঢুকে পড়া বার্তা।

অবশেষে সরকার সিদ্ধান্ত নিল—পরীক্ষামূলক চুক্তি করা হবে। দিল্লির গোপন ল্যাবে AI সিস্টেমকে ভিনগ্রহী সংকেতের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। যদি এর ফলে নতুন প্রযুক্তি আসে, তবে সেটাই হবে মানবজাতির ভবিষ্যতের পথ।

অদিতি প্রাণপণে বাধা দিলেন,
—“এটা বোকামি! আমরা তাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছি।”
কিন্তু কেউ শুনল না।

চুক্তির দিন নির্ধারিত হলো—২৩ জুলাই ২০২৭। অদিতির বুক কেঁপে উঠল। এটাই তো সেই তারিখ, যা প্রথম সংকেতে উঠে এসেছিল!

চুক্তির দিন ভোরে অদিতি ল্যাবে প্রবেশ করলেন। বিশাল কক্ষে রাখা হয়েছে সুপারকম্পিউটার অগ্নি-২, যা আগের সব AI-এর থেকেও উন্নত। তার চারপাশে লেজার সুরক্ষা, সেনাদের কড়া পাহারা।

অদিতির চোখে পড়ল—কনসোলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোহন। না, এখন আর সে পুরোপুরি মানুষ নয়। তার চোখে অদ্ভুত নীলাভ আলো, মুখে অচেনা শান্তি।

“তুমি এখানে?”—অদিতি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন।
রোহন মৃদু হাসল।
—“হ্যাঁ। আমি এখন তাদের প্রতিনিধি। অদিতি, ভয় পেও না। এটা ধ্বংস নয়, পুনর্জন্ম।”

অদিতি কাঁপা গলায় বললেন,
—“তুমি ভুল করছো। এটা আত্মসমর্পণ।”
রোহনের চোখে ঝিলিক।
—“না। এটা বেঁচে থাকার চুক্তি।”

চুক্তি শুরু হলো। সংকেতের প্রতীক কম্পিউটার স্ক্রিনে ছড়িয়ে পড়ল, অগ্নি-২ সেগুলো শোষণ করতে লাগল। প্রথমে সব শান্ত ছিল। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো ল্যাব কেঁপে উঠল।

AI-এর স্ক্রিনে একের পর এক ছবি ফুটে উঠতে লাগল—মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ, অচেনা গ্রহ, বিশাল বহর, আর ধ্বংসস্তূপে ভরা নগরী।

অদিতি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন,
—“দেখো! এটাই তাদের সত্যি। এরা সভ্যতা নয়, এরা ধ্বংসের দূত।”

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। অগ্নি-২ এর ভেতর থেকে এক অচেনা কণ্ঠ ভেসে উঠল—
“The Contract Is Done. Humanity Belongs To Us.”

সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সেনারা বন্দুক তুলতে গিয়েও থমকে গেল, কারণ তাদের রোবোটিক অস্ত্রগুলো নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে।

অদিতি বুঝলেন—এখন আর পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তি নিরাপদ নয়। সবকিছুই একীভূত হয়ে গেছে ভিনগ্রহীদের সঙ্গে।

 

রোহন তাঁর দিকে তাকাল, চোখে সেই নীলাভ আভা।
—“এখন দেরি হয়ে গেছে, অদিতি। আমরা সবাই মিলে এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এটা আমাদের একমাত্র সুযোগ।”

অদিতি নিঃশব্দে ফিসফিস করলেন,
—“না রোহন। এটা বেঁচে থাকা নয়, এটা কেবল শুরু হলো ধ্বংসের।”

পর্ব : শেষ যাত্রা

২৩ জুলাই ২০২৭-এর সেই দিনটার পর পৃথিবী আর আগের মতো নেই। ভিনগ্রহীদের সঙ্গে “চুক্তি” হওয়ার পর থেকে সবকিছু বদলে গেল। শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে শুরু করে হাসপাতালের মেশিন—সব এখন এক অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে। সরকার এটাকে বলল নতুন যুগের সূচনা, কিন্তু মানুষজন অনুভব করছিল অদৃশ্য শৃঙ্খল।

অদিতির বুকের ভেতর কেবল আতঙ্ক জমে উঠছিল। তিনি জানতেন এটা মুক্তি নয়, এটা আত্মসমর্পণ। আর এরই মধ্যে ভিনগ্রহী সংকেত নতুন নির্দেশ দিল—
“Prepare the Journey. Few will survive.”

এই বাক্যটাই পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। যেন অদৃশ্য তরঙ্গ স্যাটেলাইট থেকে মানুষের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সবাই বুঝল, এক শেষ যাত্রা শুরু হতে চলেছে।

জাতিসংঘের জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো—বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচিত মানুষদের মহাকাশযানে পাঠানো হবে। ভিনগ্রহীরা যে অজানা গ্রহের উল্লেখ করেছে, হয়তো সেটাই মানবজাতির নতুন আশ্রয়।

অদিতি এই পরিকল্পনায় ভয়ঙ্কর আপত্তি জানালেন।
—“আমরা জানিই না ওরা কোথায় পাঠাতে চাইছে। এটা হয়তো ফাঁদ।”
কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল শক্তিশালী রাজনীতিকদের চিৎকারে।
—“মানবজাতির টিকে থাকার জন্য এটাই একমাত্র পথ। পৃথিবী আর নিরাপদ নয়।”

অবশেষে ‘শেষ যাত্রা’র জন্য তৈরি হলো বিশাল মহাকাশযান—এক্সোডাস। এটাই হবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাইগ্রেশন।

নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ—মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে যা যা প্রয়োজন, সেই তালিকা অনুযায়ী নাম বাছাই করা হল

কিন্তু এক্ষেত্রেও রাজনীতি তার কালো হাত ঢুকিয়ে দিল। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, নেতাদের পরিবারও নির্বাচিত হলো। সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ শুরু করল—“আমাদের জীবন কি মূল্যহীন?”

রাস্তা ভরে গেল বিশৃঙ্খলায়। কোথাও সেনারা গুলি চালাল, কোথাও অগ্নিসংযোগ হলো। পৃথিবী যেন নিজের শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।

অদিতি জানতেন তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভেতরে আনন্দ ছিল না, বরং গভীর অপরাধবোধ। তিনি ভেবেছিলেন—“আমি কেন? লক্ষ লক্ষ মানুষ মরবে, আর আমি বাঁচব কেন?”

অদিতির কানে তখনও বাজছিল রোহনের কণ্ঠ—
“…এটাই নিয়তি, অদিতি। শেষ যাত্রা ছাড়া মুক্তি নেই…”

তিনি জানতেন, রোহন কোথাও আছে। হয়তো ভিনগ্রহীদের দূত হয়ে, হয়তো সংকেতের মধ্যে লুকিয়ে।

প্রস্তুতির দিন এসে গেল। মহাকাশযান এক্সোডাস-১ রাখা হলো মরুভূমির মাঝখানে বিশাল লঞ্চপ্যাডে। রাতের আকাশে সেটা দাঁড়িয়ে ছিল দৈত্যের মতো—মাইলের পর মাইল লম্বা, একাধিক স্তরে বিভক্ত, হাজার হাজার মানুষের জন্য নকশা করা।

কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা ঘটল। চূড়ান্ত যাত্রার আগে হঠাৎ ভিনগ্রহী সংকেত নতুন বার্তা পাঠাল—
“Only a Few. Not All.”

সারা বিশ্বে শোরগোল পড়ে গেল। সরকার গোপন রাখতে চাইলো, কিন্তু খবর ফাঁস হয়ে গেল। মানুষ বুঝে গেল—সবাই যাবে না, কেবলমাত্র এক নির্দিষ্ট সংখ্যা বেছে নেওয়া হয়েছে।

অদিতির শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
“মানে… বাকিরা?”
কেউ উত্তর দিল না।

লঞ্চের দিন লঞ্চপ্যাড ঘিরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাল। অনেকেই নির্বাচিতদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগল—“আমাদের জায়গা দাও! তোমরা আমাদের ভবিষ্যৎ চুরি করছ।”

সেনারা ব্যারিকেড করে রেখেছিল, কিন্তু মানুষের ক্রোধ সামলানো যাচ্ছিল না। লাঠিচার্জ, গুলি, অশ্রু গ্যাস—সব চলতে লাগল। আর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক্সোডাস-১ নিঃশব্দ দৈত্যের মতো অপেক্ষা করছিল।

অদিতি চুপচাপ স্যুট পরে মহাকাশযানের কেবিনে ঢুকলেন। তাঁর চোখে জল আসছিল। তিনি জানতেন তিনি বেঁচে ফিরলেও এই পৃথিবী আর থাকবে না।

হঠাৎ হেলমেটের ভেতরে ভেসে এলো এক কণ্ঠ—রোহনের।
“…অদিতি, ভয় পেয়ো না। যাত্রা দরকার। কিন্তু মনে রেখো, এটা মুক্তির নয়, পরীক্ষা।”

তিনি চমকে উঠলেন। “রোহন? তুমি কোথায়?”
কিন্তু কোনো উত্তর এলো না, কেবল প্রতিধ্বনি—
“…পরীক্ষা…”

কাউন্টডাউন শুরু হলো।
১০… ৯… ৮…

লঞ্চপ্যাড কেঁপে উঠল। বাইরের মানুষের চিৎকার চাপা পড়ল অগ্নিশিখার শব্দে।
৩… ২… ১…

মুহূর্তে এক্সোডাস-১ আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেল। অদিতি জানালার বাইরে তাকালেন—নীল পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাঁর বুকের ভেতরে শূন্যতা জমল।

কয়েক ঘণ্টা পর তাঁরা পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে গেলেন। যাত্রীরা ভয়ে, বিস্ময়ে, আর কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। কমান্ড সেন্টারে বৈঠক বসলো—এখন গন্তব্য কোথায়?

কোঅর্ডিনেটস স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাকাশযানের কন্ট্রোলে সেট হয়ে গিয়েছিল। কারো হাতেই সেটা বদলানো সম্ভব নয়। সবাই জানত—এই কোঅর্ডিনেটস এসেছে সংকেতের কাছ থেকে।

অদিতি আতঙ্কে ভাবলেন—“মানে আমাদের নিয়তি এখন পুরোপুরি তাদের হাতে।”

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। মহাকাশযান মহাশূন্যের অন্ধকার ভেদ করে চলতে লাগল। জানালার বাইরে তারার ঝলকানি, নীরব শূন্যতা। যাত্রীরা একে অপরের সঙ্গে ফিসফিস করে বলছিল—“আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা আদৌ পৌঁছব তো?”

অদিতি রাতে ঘুমোতে গেলেই ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখছিলেন। জ্বলন্ত গ্রহ, কঙ্কাল শহর, আর রোহনের কণ্ঠ—
“…শুধু যারা প্রস্তুত, তারাই বাঁচবে…”

একদিন মহাকাশযানের রাডারে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত চিত্র। অচেনা নক্ষত্রপুঞ্জের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা গ্রহ, নীলাভ আভায় ভরা। মনে হচ্ছিল পৃথিবীরই আরেক প্রতিরূপ।

কমান্ডার চিৎকার করে উঠলেন,
—“ওটাই আমাদের গন্তব্য!”

কিন্তু হঠাৎ স্ক্রিন ঝলসে উঠল। ভিনগ্রহী প্রতীক ভেসে উঠল—
“NOT ALL MAY LAND.”

অদিতির বুক কেঁপে উঠল।
“মানে… সবাই নামতে পারবে না?”

 

মহাকাশযান ধীরে ধীরে সেই নীলাভ গ্রহের দিকে নামতে লাগল। কিন্তু চারদিকে অদ্ভুত তরঙ্গ বেজে উঠছিল, যেন কেউ তাদের আগমনের খবর পেয়েছে

অদিতির মাথার ভেতর আবার রোহনের কণ্ঠ বাজল—
“…স্বাগতম, অদিতি। এটাই শেষ যাত্রা নয়, এটাই নতুন শুরু…”

তিনি জানতেন, সত্যিই যদি নতুন শুরু হয়, তবে সেটা হবে রক্তের, পরীক্ষার, আর অজানার শুরু।

পর্ব ১০: তারার ওপারে

এক্সোডাস-১ ধীরে ধীরে অচেনা নীলাভ গ্রহটির কক্ষপথে প্রবেশ করল। জানালার ওপাশে গ্রহটি যেন এক রহস্যময় রত্নের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। দূর থেকে দেখতে পৃথিবীর মতোই—নীল সমুদ্র, সাদা মেঘ, সবুজ ভূখণ্ড। যাত্রীরা বিস্ময়ে নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা নতুন পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি!”

কিন্তু অদিতির বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতলতা জমে উঠল। তাঁর কানে যেন এখনো বাজছে রোহনের কণ্ঠস্বর—
“Not all may land.”

অবতরণের প্রস্তুতি শুরু হলো। মহাকাশযানের সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু হিসাব করছিল। অবাক করার বিষয়, কেবল কয়েকশ’ মানুষের নাম তালিকায় অনুমোদিত হলো। বাকিদের জন্য লাল সতর্কবার্তা—“Landing not permitted.”

অদিতি আতঙ্কে বুঝলেন, এটা আগেই নির্ধারিত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সবাই নয়, কেবল নির্বাচিত কয়েকজনই নামতে পারবে।

যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। “আমরা মরব কেন? সবাই একসাথে নামতে হবে।”
সেনারা ব্যারিকেড গড়ে তুলল, কিন্তু বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল। কান্না, চিৎকার, আর হাহাকার মহাকাশযানের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল।

অদিতি কমান্ড সেন্টারে দাঁড়িয়ে কমান্ডারকে বললেন,
—“এটা ভুল! আমরা সবাই মিলে এসেছি, সবাই মিলে নামা উচিত।”
কমান্ডার ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
—“ডক্টর মুখার্জি, আমরা কিছু ঠিক করিনি। যন্ত্র নিজেই বেছে নিয়েছে। হয়তো এই গ্রহ সবার জন্য নিরাপদ নয়।”

অদিতি শ্বাস চেপে রাখলেন। তিনি জানতেন, এর সবই সংকেতের পরিকল্পনা।

অবশেষে প্রথম ল্যান্ডার নেমে গেল নীলাভ গ্রহের মাটিতে। অদিতি তাকিয়ে দেখলেন—আকাশ নীল, বাতাস হালকা বেগুনি আভায় ভরা। চারদিকে বিশাল গাছ, অচেনা ফুল, আর দূরে পাহাড়ের সারি। অবাক হওয়ার মতো, এখানে মানুষের শ্বাস নেওয়া সম্ভব।

যাত্রীরা মাটিতে পা দিতেই আবেগে ভেঙে পড়ল। কেউ মাটিতে কপাল ঠেকাল, কেউ কান্নায় ভেসে গেল।
কিন্তু অদিতি অনুভব করছিলেন, বাতাসে এক অদ্ভুত কম্পন। যেন কেউ দূর থেকে তাকিয়ে আছে।

প্রথম রাতে তাঁরা ক্যাম্প স্থাপন করলেন। আকাশে অসংখ্য তারা, চাঁদ নেই, অথচ নক্ষত্ররা যেন কাছে ঝুঁকে পড়েছে। হাওয়ায় এক অচেনা গন্ধ।

হঠাৎ দূরে জঙ্গলের ভেতর আলো জ্বলল। সেনারা অস্ত্র হাতে এগোল। কিন্তু যা তারা দেখল, তা সবাইকে স্তম্ভিত করে দিল।

জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একদল সত্তা। দেখতে অনেকটা মানুষের মতো, তবে তাদের ত্বক নীলাভ, চোখ সম্পূর্ণ সাদা। তারা শব্দ করল না, কেবল দাঁড়িয়ে রইল।

অদিতির শরীর কেঁপে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
—“এরা… বেঁচে থাকা ওদের বংশধর।”

হঠাৎ অদিতির কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ—রোহনের।
“…স্বাগতম, অদিতি। এটাই আমাদের নতুন ঘর।”

অদিতি চমকে ঘুরলেন। দেখলেন, সত্তাদের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসছে রোহন। তার শরীর এখন অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ভিনগ্রহী। চোখে সেই নীলাভ আলো।

“রোহন!”—অদিতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।
রোহন শান্ত গলায় উত্তর দিল,
—“আমি বলেছিলাম, এটা শেষ নয়। আমরা সবাই মিলে হবো নতুন সভ্যতা।”

কমান্ডার চিৎকার করে উঠলেন,
—“সে মানুষ নয়! গুলি চালাও।”

কিন্তু গুলি ছোড়ার আগেই সত্তারা হাত তুলল। মুহূর্তে অস্ত্রগুলো অচল হয়ে গেল।

রোহন এগিয়ে এসে অদিতির সামনে দাঁড়াল।
—“দেখছো তো, অদিতি? পুরনো পৃথিবী ধ্বংস হবে। কিন্তু এখানে আমরা বাঁচব। কেবল যারা নির্বাচিত, তারাই টিকে থাকবে।”

অদিতির চোখ ভিজে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন,
—“তাহলে বাকি মানুষরা?”
রোহনের ঠোঁটে নিঃসঙ্গ হাসি।
—“তারা পরীক্ষার অংশ ছিল। সবাই টিকে থাকতে পারে না। এটাই সময়ের নিয়ম।”

অদিতি কেঁপে উঠলেন।
—“না রোহন, এটা বেঁচে থাকা নয়, এটা কেবল নতুন দাসত্ব।”

রোহন শান্ত স্বরে বলল,
—“যদি দাসত্বও হয়, তবে সেটা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়। আমাদের নতুন প্রভুরা আমাদের ধ্বংস করবে না। তারা আমাদের সঙ্গে মিলিয়ে নেবে।”

পরদিন ভোরে নতুন গ্রহের আকাশে ভিনগ্রহী বহর দেখা গেল। বিশাল জাহাজ আকাশ ভরে ফেলল। সত্তারা মাথা নিচু করল। রোহন মৃদু হেসে বলল,
—“ওরা এসেছে। ওরাই আমাদের নতুন প্রভু, আবারও ওরাই আমাদের রক্ষক।”

অদিতির বুক কেঁপে উঠল। তিনি জানতেন, এটাই মানবজাতির নতুন বাস্তবতা।

রাতে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দূরে ছোট্ট নীল পৃথিবী ঝিকমিক করছে। তাঁর চোখে জল এসে গেল।
—“আমরা কি সত্যিই বেঁচে গেলাম? নাকি অন্য রকম মৃত্যুর দিকে পা বাড়ালাম?”

রোহনের কণ্ঠ আবার কানে ভেসে এলো—
“…তারার ওপারে এখন আমাদের নিয়তি। ভয় পেয়ো না, অদিতি। এইবার আমরা ব্যর্থ হব না…”

অদিতি জানতেন, হয়তো সত্যিই আর ফেরার পথ নেই। মানুষ এখন আর কেবল মানুষ নয়। তারা হয়ে গেছে এক মিশ্র সভ্যতার অংশ।

তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। নক্ষত্ররা ঝলমল করছে, কিন্তু তাঁর কাছে মনে হলো—ওগুলো আসলে সতর্কবার্তা।

মৃত নক্ষত্রের বার্তা, বেঁচে থাকার চুক্তি, আর শেষ যাত্রা মিলেমিশে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করল।

মানুষ টিকে গেল, কিন্তু মানুষ কি সত্যিই মানুষ রইল?

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-08-21-at-2.37.27-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *