দেবাশিস রুদ্র
১
ভবানীপুরের গলিপথে ঢুকে গেলে একসময় মনে হয়, যেন শহর থমকে গেছে এক শীতল অভিশপ্ত নিঃশব্দে। এখানকার পুরনো পাঁচিল, দোতলা দালানগুলো, টালির ছাদের ফাঁক গলে ঢুকে পড়া আগাছা, আর ভিজে অন্ধকার ঘরের জানলা থেকে যেন ইতিহাসের অতীত গন্ধ বেরিয়ে আসে। এমনি এক বিকেলে, প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করে, মল্লিকবাজার থেকে ট্যাক্সি করে নামলেন মহুয়া পাল। এক হাতে সুটকেস, অন্য হাতে ছাতা। চোখে কৌতূহলের দীপ্তি। ভবানীপুরের ‘শ্রীগুরু নিবাস’ নামক প্রাচীন বোর্ডিং হাউসটি তার নতুন ঠিকানা হতে চলেছে। কলেজে পড়ার সুবাদে আত্মীয়-স্বজনের থেকে কিছুটা দূরে থাকার সুযোগ পেয়ে সে খুশি হয়েছিল, কারণ তার ভেতরের অনুসন্ধিৎসু মন চেয়েছিল একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে, পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের মতো করে পুরনো কাহিনি ও লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা চালাতে। শ্রীগুরু নিবাস—নামটা শুনলেই যেন কোথাও একটা তান্ত্রিক ছায়া মিশে থাকে। লোকে বলে, স্বাধীনতার অনেক আগে, এখানে থাকতেন এক রহস্যময় সাধক রুদ্রানন্দ তান্ত্রিক। গলির ভেতর এমন গা ছমছমে আবহে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িটা যেন নিজের মধ্যেই একটা মন্ত্রপূত মহল, যেখানে সময় থমকে গেছে, এবং প্রতিটি দেয়ালে যেন লুকিয়ে আছে কোনও অলক্ষ শক্তির নিরব গর্জন।
বোর্ডিংয়ের মালিক গোবিন্দ বসু দরজা খুলে তাকে অভ্যর্থনা করলেন। চোখে ভারি চশমা, কপালে ভাঁজ, এবং মুখে যেন চিরস্থায়ী এক ক্লান্তির ছাপ। তিনি ধীর গলায় বললেন, “এই সময়ে নতুন কেউ আসে না সাধারণত। আপনি সাহসী মেয়ে, তা বলতেই হয়।” মহুয়া হেসে উত্তর দিল, “আমার সাহসের থেকে বেশি কৌতূহল কাজ করে, কাকু।” গোবিন্দবাবু কেবল হেঁসে ঘরের চাবি দিলেন। মহুয়ার ঘরটি ছিল বোর্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার শেষ ঘর — ৩২ নম্বর। তার একপাশে লাগোয়া ৩৩ নম্বর ঘরটি বহু বছর ধরে বন্ধ। দরজায় তালা ঝুলছে, আর তার গায়ে লাল কালি দিয়ে আঁকা একটি চক্রচিহ্ন, যার মধ্যে বীজমন্ত্রের মতো কিছু লেখা। মহুয়া এক ঝলক তাকিয়েই যেন বুঝে গেল, এই ঘরেই কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে, যেটা তাকে টানছে এক অজানা আকর্ষণে। ঘরে ঢুকে সে প্রথমে জানলা খুলল — বাইরে শিউলি গাছ, যার গন্ধে চারপাশ মিষ্টিমধুর হয়ে আছে, কিন্তু সেই গন্ধের নিচে যেন কোনও পুরনো কাঠ, ঘাম আর ধূপের গন্ধ মিশে আছে। হালকা আলোয় দেওয়ালের কোণায় ছায়া লেগে অদ্ভুত আকৃতি নিচ্ছে, আর সে টের পাচ্ছে, এই বোর্ডিংয়ের নির্জনতা কেবল একাকীত্ব নয় — বরং কিছু একটা গভীরভাবে লুকিয়ে আছে, যেটা প্রতিনিয়ত তাকিয়ে থাকে।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডিংয়ের নিঃশব্দতাও যেন ভারী হয়ে উঠল। মহুয়া জানালার পাশে বসে পড়ছিল, এমন সময় ঘড়িতে রাত ঠিক তিনটে বাজল। আচমকা সে জানলার পাশে কিছু নড়াচড়ার শব্দ পেল — যেন শীর্ণ কোনও হাত জানলার রেলিং ধরে উপরে উঠছে। সে উঠে জানলায় তাকাল — কিছু নেই, কেবল ধোঁয়ার মতো কিছু একটা নিচে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপরে হঠাৎ করেই তার ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা আয়নার পেছন থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, যেন কেউ ফিসফিস করে কিছু বলছে — “ত্রয়োদশীর রাত… মণ্ডল জাগে…”। মুহূর্তেই সে পিছনে ঘুরে দাঁড়াল — কেউ নেই। কিন্তু আয়নায় সে নিজের মুখ ছাড়াও যেন আরও একজোড়া চোখ দেখতে পেল, যেগুলি ছিল গাঢ় লাল, যেন রক্তপিপাসু আগুনের ফুলকি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বোর্ডিংয়ের অন্য বাসিন্দাদের মধ্যে দু-একজনকে দেখতে পেল, যারা প্রায় কথা বলেন না, মাথা নিচু করে থাকেন, এবং কারও চোখে-চোখ পড়লে তীব্র এক অস্বস্তি জন্মায়। গোবিন্দ বসুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “এই বোর্ডিং-এ বেশি প্রশ্ন করা ভালো নয় মা। প্রত্যেকটা ঘর নিজস্ব নিয়মে চলে। কিছু জিনিস জানতে নেই।” মহুয়া শুধু মুচকি হেসে নিজের মনে বলল — “ঠিক সেখান থেকেই তো শুরু হয় আমার যাত্রা।”
২
পরদিন দুপুরে মহুয়া প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে বসে পুরাতন বঙ্গতান্ত্রিক ইতিহাস নিয়ে কিছু বই ঘাঁটছিল। আগের রাতের অভিজ্ঞতা তার মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। আয়নার মধ্যে সেই রক্তচোখ, জানলার পাশে নিঃশব্দে মিলিয়ে যাওয়া ছায়া, আর ওই কণ্ঠস্বর – “ত্রয়োদশীর রাত… মণ্ডল জাগে…” – বারবার ঘুরেফিরে কানে বাজছিল। সে ‘তান্ত্রিক মণ্ডল’, ‘ত্রয়োদশী তিথি’, ও ‘রুদ্রানন্দ’ শব্দগুলো ঘিরে অনুসন্ধান শুরু করল। এক পুরনো পাণ্ডুলিপির পাতায় একটি চক্রচিহ্ন দেখে তার গা কেঁপে উঠল — এটাই সেই চিহ্ন, যা ৩৩ নম্বর কক্ষের দরজায় আঁকা ছিল! পাশে লেখা ছিল – “অগ্নিকুণ্ড তন্ত্র – শ্মশানের মধ্য হতে আহ্বান”। লেখাটি ছিল অর্ধেক পোড়া, তবে তাতে বোঝা যাচ্ছিল এটি এক নিষিদ্ধ মণ্ডল — যেটি তৈরি হলে মৃত আত্মাকে কিছু সময়ের জন্য বাঁধা রাখা যায়, অথবা অস্থির আত্মাকে বশীকরণ করা যায়। লাইব্রেরির এক কোণে বসা পাণ্ডুলিপি বিশারদ পান্নালাল চক্রবর্তী মহুয়ার চোখে কৌতূহলের ঝলক দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “মণ্ডল নিয়ে এত উৎসাহ কেন, মেয়েটি?” মহুয়া কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমি একটা পুরনো বোর্ডিংয়ে থাকি… যেখানে এই চিহ্নটা আঁকা আছে একটা তালাবন্ধ ঘরে। শুনেছি, রুদ্রানন্দ তান্ত্রিক ওখানে থাকতেন। জানেন কিছু?” পান্নালাল মৃদু হেসে বললেন, “রুদ্রানন্দ? আহা, সে তো এক বিশাল চরিত্র! আধা মানুষ, আধা ছায়া। তাকে ঘিরে বহু রহস্য আছে, তবে ওই চিহ্ন সহজ নয়, মেয়েটি। যেদিন ওই মণ্ডল জাগে, বোঝো কেউ না কেউ তপস্যার রক্ত দিয়েছে।” মহুয়ার রক্ত জমে গেল।
সন্ধ্যার পর বোর্ডিংয়ে ফিরেই মহুয়া ঠিক করল ৩৩ নম্বর ঘরটা আর একবার ভালোভাবে খতিয়ে দেখবে। সে ধীরে ধীরে করিডোর পেরিয়ে গেল তালাবদ্ধ ঘরের সামনে। পেছনে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই, কেবল একটা পুরনো পাখার কাঁপা শব্দ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। সে দেওয়ালে আঁকা চক্রচিহ্নের ওপর আঙুল বুলিয়ে দেখতে লাগল — হঠাৎ একটা হালকা কম্পন অনুভব করল, যেন দেওয়ালের পেছনে কিছু নড়ছে। তালার পাশে ছত্রভঙ্গ রঙের নিচে হঠাৎ সে খুঁজে পেল একটা ক্ষুদ্র খাঁজ – সেখানে একটা ছোট কিছু বসানো থাকলে দরজা খুলে যেতে পারে। মনে পড়ল পান্নালাল বলেছিলেন, “ওই মণ্ডল আত্মার গেটওয়ে, কিন্তু খুলতে হলে চিহ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে যন্ত্র স্থাপন করতে হয়।” মহুয়া তৎক্ষণাৎ ঠিক করল, আগামীকাল সে আবার পান্নালালের সঙ্গে দেখা করবে। তার ধারণা, রুদ্রানন্দের ব্যবহৃত কোনও যন্ত্র এখনও কোথাও লুকিয়ে আছে — হয়তো এই বোর্ডিংয়েরই ভিতরে। রাত নেমে এলে সে নিজের ঘরে ফিরল, কিন্তু এই রাতে বাতাসে যেন আরও বেশি ভারী ছায়া ঘুরছিল। ঘুমাতে গিয়ে সে দেখতে পেল, স্বপ্নে সে ৩৩ নম্বর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকেছে — ভিতরে দেওয়ালের চারপাশে আঁকা নানা ধরনের চক্র, মাটিতে ছাই ছাই রঙ, আর ঘরের মাঝখানে বসে আছেন একজন দীর্ঘ চুলের, কালো বসনে ঢাকা পুরুষ — রুদ্রানন্দ! তিনি চোখ তুললেন, আর বললেন, “তুমি চলে এসেছো… এখন আর ফেরার পথ নেই।”
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে সে দেখল, জানলার কাচে যেন আঙুল দিয়ে আঁকা কিছু শব্দ — “চিহ্ন বুঝলে পথ খুলবে। পথ খুললে ছায়া বেরোবে।” এই লেখাটি কোথা থেকে এল, কবে এল, সেটা বুঝে ওঠার আগেই, গোবিন্দ বসু দরজায় টোকা দিলেন। হাতে এক ধূসর খাম — “এই চিঠিটা আজ সকালে তোমার নামে কেউ ছেড়ে গেছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখেনি। কেমন অদ্ভুত, না?” মহুয়া চিঠিটা খুলে পড়ল — ভিতরে লেখা কেবল এক লাইন — “পূজোর ত্রয়োদশীর রাতের আগে সময় কম। রুদ্রচক্র জেগে উঠবে।” তার নিচে কোনও নাম নেই, কেবল আঁকা একটি ত্রিকোণ মণ্ডল, যা কালো কালিতে দাগানো। মহুয়া বুঝল, এবার তাকে থামলে চলবে না — রহস্যটি কেবল ইতিহাস নয়, বরং তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সে হয়তো এক অদৃশ্য খেলার পুতুল হয়ে উঠেছে, যেখানে নিয়ম লেখা আছে মৃতের হাতে।
৩
রাত দশটা। মহুয়া বোর্ডিং হাউসের ছাদে উঠে এসেছে চুপচাপ। নিচের শহর ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল গ্যাসলাইট আর দূরের ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি সময়কে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ছাদের এক কোণে একটা পাথরের জায়গা, যেটা দেখতে ছোট্ট মঞ্চের মতো, চারদিকে কালো পাথরে ঘেরা। সেই জায়গাটায় পুরনো ধূপের গন্ধ লেগে আছে, যেন কেউ প্রায় প্রতিদিনই সেখানে কিছু জ্বালায়। আজ রাতে মহুয়া অপেক্ষা করছে পান্নালাল চক্রবর্তীর জন্য — তিনি কথা দিয়েছিলেন, তান্ত্রিক মণ্ডল ও বোর্ডিংয়ের ইতিহাস নিয়ে তার সঙ্গে ছাদেই দেখা করবেন। কিন্তু ঘড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ নেই, হাওয়ায় অদ্ভুত একটা ঠান্ডা। হঠাৎ মহুয়ার কানে এল নিচের করিডোর থেকে কার যেন হালকা পায়ের শব্দ। সে নিচে নামার জন্য এগিয়ে গেল, কিন্তু যেই না সিঁড়ির কাছে পৌঁছেছে, দেখল নিচে কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে মুখ দেখা যায় না, কিন্তু ছায়াটা যেন তার দিকে এক ঝলকে তাকিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। মহুয়া অবাক হয়ে নিচে গেল, কোথাও কেউ নেই — শুধু করিডোরের দেয়ালে একটা জায়গায় হালকা ভেজা দাগ, যেন কেউ সবে এখান দিয়ে গিয়েছে। দেয়ালের এক কোণায় আচমকা চোখে পড়ল — রক্তরঙে আঁকা একটি ছোট ত্রিকোণ চিহ্ন, তার নিচে লেখা, “ত্রয়োদশীর আগমনে দ্বার খুলিবে। রক্ষাকবচ প্রস্তুত কর।” মহুয়া বুঝল, সময় সত্যিই কম। কিন্তু কে লিখল, কে এল — কিছুই তার বোধগম্য নয়।
পরদিন দুপুরে, কলেজের পরে পান্নালাল চক্রবর্তীর সঙ্গে এক ছোট কফি হাউসে দেখা হল। তিনি মহুয়ার চিঠিটি দেখে কিছুটা ভ眉 করলেন। “ত্রিকোণ মণ্ডল… বোঝো মেয়েটি, এইটা কিন্তু শ্মশানতন্ত্রের বীজরূপ। এই ধরনের চিহ্ন কেবলমাত্র কোনো আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা আত্মাকে আহ্বান করার জন্য ব্যবহৃত হয়। রুদ্রানন্দ যদি সত্যিই এই মণ্ডল স্থাপন করে থাকেন, তবে সেটা কেবল সাধনার জন্য নয় — কোনও বড় উৎসর্গের জন্য ছিল।” মহুয়া বলল, “আপনি বলেছিলেন এক বিশেষ যন্ত্র দরকার মণ্ডল সক্রিয় করতে — ওটা কেমন দেখতে?” পান্নালাল পকেট থেকে এক পুরনো কাগজ বার করে দেখালেন — সেখানে আঁকা ছিল একটি স্ফটিকের তৈরি রুদ্রবীজ — দেখতে তিন কোনা, মাঝখানে লাল বিন্দু। “এই বীজ ছাড়া ওই চক্র নিস্ক্রিয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই যন্ত্র হারিয়ে গেছে রুদ্রানন্দের মৃত্যুর পর থেকেই।” মহুয়া মুহূর্তেই ভাবল — বোর্ডিংয়ের ভেতরে কোথাও কি সেটা লুকানো আছে? পান্নালাল তাকে বললেন, “তোমার ঘরের পাশের ৩৩ নম্বর কক্ষ যদি এখনও তালাবদ্ধ হয়, তাহলে একমাত্র ওখানেই পাওয়া যেতে পারে এই বীজ। তবে খেয়াল রেখো — ওই ঘর খোলার মানেই হলো, সিল ভাঙা। ছায়াগুলি মুক্ত হয়ে পড়বে।” মহুয়া তার চোখে নতুন আগুনের ছায়া নিয়ে মাথা ঝাঁকাল — সে জানে, তাকে থামলে চলবে না। সে বোঝে, রুদ্রানন্দ তাকে নিজেই ডেকেছেন, নিজেই পথ দেখাচ্ছেন।
রাতে ঘরে ফিরেই সে শুরু করল নতুন অনুসন্ধান। সে তার ঘরের মেঝেতে কাঁচের বোতল ফেলে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা ইট সরিয়ে ফেলে, এবং সেই ফাঁকে একটি কাঠের বাক্স দেখতে পায়। বাক্সটি ছিল জংধরা, পাথর-কাঠ মিলিয়ে তৈরি। খুলতেই দেখা গেল সেই স্ফটিক — তিন কোনা, যার কেন্দ্রবিন্দু লাল রঙে দীপ্তিমান। তার পাশে একটি ছেঁড়া কাগজ — রুদ্রানন্দের নিজের হাতে লেখা মনে হয় — “এই রুদ্রবীজ যেদিন ফের আলো দেখবে, বোর্ডিং ফের জাগবে। যে এটি ধারণ করিবে, তার শরীর হইবে বাহন।” মুহূর্তে ঘরের বাতাস পাল্টে গেল। জানলার কাচ ঠকঠক শব্দ করতে লাগল, আর দরজার নিচ দিয়ে হালকা ছায়া যেন ঘরে ঢুকে পড়ল। মহুয়া বীজটি তুলে নিয়ে ছাদের দিকে ছুটল — সেখানে আবার সেই পাথরের মঞ্চ, এবং আশেপাশে ছায়ায় মোড়া চারদিক। সে যখন বীজটি মণ্ডলের মাঝে রাখল, ঠিক সেই মুহূর্তে চারদিক থেকে শুরু হল কান্না, মন্ত্র, আর পিশাচছায়ার মৃদু কণ্ঠস্বর — “উৎসর্গ কোথায়…? রক্ত কোথায়…? বাহক এসেছো…?” মহুয়া পিছনে ফিরে দেখল, তার ছায়া একা নয়, আরেকটি ছায়া তার ঠিক কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গল্পের শুরু এখানেই, যেখানে ছায়া ও আলো এক হয়ে রচনা করে এক নতুন তন্ত্রের কাহিনি।
৪
পরদিন সকালবেলা মহুয়া ঠিক জানত না — সে আসলে ঘুমিয়েছিল কি না। যেন পুরো রাতটাই তার সামনে নানা ঘটনার দোলাচল ছিল। ছাদের পাথরের মণ্ডলে রুদ্রবীজ স্থাপনের পরে যে ছায়ামূর্তি তার কাঁধে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটি যেন চুপচাপ তার শরীর ছুঁয়ে নিজের উপস্থিতি চিহ্নিত করেই মিলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ছোঁয়া অদ্ভুতভাবে তার শরীরে এখনও রয়ে গেছে — যেন চামড়ার নিচে এক ঠান্ডা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, চোখে লেগে আছে কুয়াশার পর্দা। চুল আঁচড়াতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, তার কপালে যেন হালকা করে আঁকা একটি চক্রচিহ্ন ফুটে উঠেছে — সে আগে কখনও ছিল না, এবং দাগটি মুছতে গেলে আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। নীচে নাস্তার টেবিলে বসে মহুয়া দেখল বোর্ডিংয়ের বাকিরা আজ আরও নিরুত্তাপ। গোবিন্দ বসু পর্যন্ত যেন একটু বেশি গম্ভীর। কিন্তু আজ নতুন একজন এসেছেন বোর্ডিং-এ — ছেঁড়া ধুতি, ধূলিমলিন ঝোলানো ব্যাগ আর চোখে স্থির চাহনি। নাম বললেন না, কেবল জানালেন তিনি কিছুদিন থেকে প্রাচীন স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু মহুয়ার মনে হল, তিনি যেন অনেক কিছু জানেন — বিশেষ করে তার চোখ রুদ্রচক্রের দিকেই বারবার চলে যাচ্ছিল।
রাত গড়াতে না গড়াতেই ঘটল প্রথম বিপর্যয়। বোর্ডিংয়ের ৩০ নম্বর ঘরে থাকা প্রবীণ অবিবাহিত শিক্ষক মৃণালবাবু হঠাৎ হাহাকার করে ছুটে বেরিয়ে এলেন — তার মুখে আতঙ্কের ছাপ, শরীর কাঁপছে। বললেন, “ঘরের মধ্যে কেউ বসে আছে… আমার বিছানায়… তার চোখ লাল… আর ঠোঁট নেই… কেবল গর্জন!” গোবিন্দবাবু দৌড়ে গিয়ে দেখলেন, ঘরে কেউ নেই। কিন্তু বিছানার চাদরে হালকা ছাইয়ের ছাপ, যেন কেউ সদ্য শ্মশান থেকে এসেছে। মহুয়া জানে, এ কেবল শুরু। সে বোঝে, রুদ্রবীজ সক্রিয় হওয়ার পর এই বোর্ডিং যেন এক যন্ত্রের মতো কাজ করছে — যার প্রতিটি কক্ষ, করিডোর, জানলা ও ছাদ হয়ে উঠেছে এক-একটা তান্ত্রিক পথ। ওই রাতে সে ফের ৩৩ নম্বর ঘরের তালা ছুঁয়ে দেখল — এবার সেটা আর ঠান্ডা নয়, বরং যেন স্পন্দিত হচ্ছে। হঠাৎ তালার নিচে সে খুঁজে পেল একটি ছোট কাগজ – সেখানে লেখা, “বাহক চিনে নিয়েছি। উৎসর্গ হবে ত্রয়োদশীতে। প্রস্তুত হও।” কাঁপা হাতে সে কাগজটি পড়ল, আর মনে পড়ে গেল তার স্বপ্নে দেখা সেই আগুনচক্ষু রুদ্রানন্দ — যিনি বলেছিলেন, “এখন আর ফেরার পথ নেই।”
ভোর রাতে, ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে মহুয়া স্পষ্ট দেখতে পেল — দূরের শূন্যে কেউ হেঁটে আসছে, যেন মেঘের গায়ে ছায়া ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সেই ব্যক্তিটি ছিল আগন্তুক — যিনি আজ সকালেই বোর্ডিং-এ উঠেছিলেন। তিনি তার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “তুমি রুদ্রবীজ জাগিয়ে তুলেছ, এখন তোমার শরীরেই গোপন চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তুমি চিহ্নধারী — তন্ত্রের বাহক। বোর্ডিং তোমার শরীরকেই এখন পাথেয় করে তুলবে।” মহুয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা তার পকেট থেকে বের করল একটি কাঠের পাত — যেখানে আঁকা আছে বোর্ডিং হাউসের নকশা, কিন্তু তাতে প্রতিটি ঘরের ওপর লাল বিন্দু, কিছু ঘর কালো ক্রসচিহ্নে। সে বলল, “এই ঘরগুলোতে আত্মা আটকে আছে — আর ৩৩ নম্বর ঘরটি একমাত্র দ্বার, যেখানে রুদ্রানন্দ এখনও অপেক্ষা করেন, জাগরণের জন্য।” সে আরও যোগ করল, “তোমার হাতে সময় আছে মাত্র তিন দিন — ত্রয়োদশীর রাত এলেই চক্র সম্পূর্ণ হবে। তোমার শরীর হবে পূর্ণাহুতি। অথবা… তুমি যদি চক্রের বিপরীতে দাঁড়াও, তবে তোমাকে এই বোর্ডিং ছেড়ে যেতে হবে — না হলে তুমি নিজেই বোর্ডিং হয়ে উঠবে।” কথা শেষ করে লোকটি মিলিয়ে গেল, যেন বাতাসে মিশে গিয়েছে। মহুয়া জানত না, সে স্বপ্ন দেখছে নাকি জেগে। তবে সে জানে, তার কপালের চিহ্ন এখন স্পষ্ট, বুকের ভিতর কাঁপছে এক তান্ত্রিক ঢেউ, আর বোর্ডিংয়ের ছায়াগুলো যেন তার পায়ের নিচে ধীরে ধীরে জমা হয়ে উঠছে।
৫
মহুয়ার দিন শুরু হল অদ্ভুত এক সংবেদন নিয়ে — যেন তার ঘুম থেকে জেগে ওঠা নয়, বরং কেউ তাকে ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে। মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় চোখ পড়তেই সে স্পষ্ট বুঝল, তার চোখের রং বদলে গেছে — গভীর কালো পাতার নিচে একধরনের গাঢ় নীল ছায়া। চুলের ফাঁকে ছোট ছোট ঘাম, আর কপালের রুদ্রচিহ্নটি আজ আরও উজ্জ্বল। রাতে যা ঘটেছিল, তা কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আগন্তুক যিনি তাকে বলেছিলেন, “তুমি নিজেই বোর্ডিং হয়ে উঠবে” — তার কণ্ঠস্বর এখনও কানের মধ্যে কাঁপছে। মহুয়া আজ কলেজে যায়নি। ঘর থেকে বেরিয়েই অনুভব করল, বোর্ডিংয়ের প্রতিটি দেয়াল, জানালা যেন তাকে অনুসরণ করছে। করিডোরে ঝুলে থাকা প্রাচীন আলোকচিত্রগুলি — যেগুলো এতদিন ধূলিময়, বিবর্ণ ছিল — আজ যেন নতুন আলোতে জ্বলছে। বিশেষত, এক ছবিতে সে একজন মানুষকে দেখে চমকে উঠল — লম্বা চুল, কালো বসন, চোখে নিস্তব্ধ আগুন — রুদ্রানন্দ। ছবির নিচে কিছু লেখা নেই, কেবল একটি মুছে যাওয়া খোদাই — “৩৩/চক্র/বাহক”। সে বুঝে গেল, বোর্ডিং-এ কিছু খুলে যেতে শুরু করেছে। সেই সন্ধ্যায় গোবিন্দ বসু আর মহুয়ার মাঝে একটি অদ্ভুত সংঘাত হল। গোবিন্দবাবু বললেন, “তুমি যদি বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করো, এই বাড়ি তোমাকে ছাড়বে না। তোমার কপালে যে চিহ্ন ফুটেছে, সেটা আমি ছোটবেলায় আমার ঠাকুরদার শরীরেও দেখেছি — তারপর তিনি তিনদিনের মধ্যে নিখোঁজ হয়ে যান। ফিরে আসেননি।”
মহুয়া নীচতলার গুদামের ঘরে চলে গেল — যেখানে বহু পুরনো কাগজ, দলিল আর কাঠের বাক্স রাখা থাকে। আলো প্রায় নিভে আসা, বাতাসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর মেঝেতে ধুলোয় ঢাকা একটি লোহার ট্রাঙ্ক — খুলে দেখল একরাশ ছেঁড়া কাগজ, পুরনো ডায়েরি, আর একটি কাঠের ভাঙা বাটি। তার ভেতরেই একটি পুরনো খাম — খুলতেই সে যা পেল, তা এক মৃতের দিনলিপি। পাতাগুলি হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু লেখার কালি এখনও স্পষ্ট। লেখা শুরু: “১২ই আশ্বিন, ১৯৪১ — আমি, রুদ্রানন্দ, আজ বোর্ডিংয়ে প্রবেশ করিলাম। এই স্থানটি এক তান্ত্রিক চক্রের কেন্দ্র, যেখানে ছায়া ও চেতনার সংযোগ ঘটে। আমি চিহ্ন দেখেছি — বাহক আসিবে, তার কপালে ফুটিবে চিহ্ন, এবং আমি তাহার শরীর ব্যবহার করিব।” মহুয়ার নিঃশ্বাস গলায় আটকে যায়। ডায়েরির পরের পাতাগুলি ধীরে ধীরে আরও ঘনভয়ংকর হয়ে ওঠে — “ত্রয়োদশীর রাতে পূর্ণমণ্ডল স্থাপনের জন্য আত্মার আহ্বান করিলাম। একটি কুমারী আত্মা — মীরা। সে ভয় পাইল, চিত্কার করিল। বোর্ডিং তাহাকে আত্মসাৎ করিল। আমি জানি, সে এখনও বন্দি আছে। ৩৩ নম্বর কক্ষই তাহার শ্রাদ্ধস্থল।” এই নামটিই মহুয়াকে কাঁপিয়ে দিল — মীরা দে! সেই ছাত্রী, যার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গিয়েছিল! তাহলে সে কি মৃত, নাকি এখনও কোথাও আটকে আছে?
ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা: “যদি কখনও রুদ্রবীজ জাগে, বোর্ডিংয়ের ছায়াগণ পুনরায় জাগিবে। বাহক আসিবে, চিহ্নধারী হইবে। আমার আত্মা তাহার মধ্য দিয়া মুক্তি পাইবে। কিন্তু সতর্কতা — আত্মা যদি বিভ্রান্ত হয়, তাহা হইলে বাহকও ছায়া হইয়া যাইবে।” মহুয়ার মাথা ঘুরে উঠল। সে বোঝে, এখন তার সামনে দুটি রাস্তা — রুদ্রানন্দকে রোধ করা, অথবা তার বাহক হয়ে ত্রয়োদশীর রাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। ডায়েরির পাশে সে একটি পুরনো ছবি পেল — যেখানে এক কিশোরী মেয়ের মুখ আছে, চোখে আতঙ্ক। ছবির পেছনে লেখা — “মীরা, উৎসর্গ ১৯৪১”। হঠাৎ ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। গুদামের ভেতর থেকে কেমন এক ঘন ধোঁয়া উঠল, আর তার ঠিক সামনে হঠাৎ এক মেয়ের ছায়া ফুটে উঠল — মুখে গভীর বিষণ্ণতা, কপালে চিহ্ন, আর ঠোঁট থেকে নিরব কান্না ঝরছে। মীরা! সে চোখে চোখ রাখল মহুয়ার দিকে, আর নিঃশব্দে বলল, “আমায় মুক্ত করো… আমাকে যন্ত্র থেকে আলাদা করো… আমি এখনও ঘুমোতে পারিনি…” মহুয়া জানে, সে এখন কেবল একজন ছাত্রী নয় — সে বোর্ডিংয়ের ইতিহাস, ছায়া আর রক্তে লেখা অতীতের কাহিনির অংশ। এবং সেই কাহিনি এখনও লেখা শেষ হয়নি।
৬
ঋক সেনের মনে এক অদ্ভুত বিষাদের ছায়া নামছিল, যেহেতু তিনি বোর্ডিং হাউসের রাত্রিকালীন গন্ধ, নিস্তব্ধতা ও অতীতের ছায়াদের ভারে এক গভীর গোলকধাঁধায় আটকে যাচ্ছিলেন। তিনি খেয়াল করলেন, বোর্ডিংয়ের রান্নাঘরের পাশে যে পুরনো কক্ষটি গত তিন বছর ধরে তালাবন্ধ ছিল, তার দরজাটি আজ একটু ফাঁকা—অথচ কেউ সেই ঘরের চাবি ব্যবহার করেছে এমন প্রমাণ নেই। কৌতূহলবশে তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, ভিতরে ছড়ানো ছিটানো অজস্র প্রাচীন বাসন, এক অদ্ভুত কালো পাথরের থালা, আর দেয়ালে রক্তের মতো লাল রঙে আঁকা ছিল একটি বৃত্তের মধ্যে কিছু সংকেত—তান্ত্রিক যজ্ঞের মত কিছু। হঠাৎ দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা যমুনা রান্নার বুড়ি গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, “ওটা ছিল রুদ্রানন্দর মৃতভোজনের ঘর, বাবু। যেদিন কেউ মরে যেত, উনি ঠিক রাত বারোটার সময় এখানে বসে কিছু খেতেন। কেউ জানত না কী, কেউ জিজ্ঞেসও করত না। শুধু জানত, পরদিন কোনো না কোনো আত্মা ঘরের পেছনের কুয়োর ধারে পাওয়া যেত। আর আজ সে থালা আবার নিজের জায়গায় এসে গেছে… বুঝলেন তো?” এই কথার পরে ঋক বুঝতে পারেন, রুদ্রানন্দ এখনও বোর্ডিং ছাড়েননি, তার ছায়া এখনও এই রান্নাঘরের চারপাশে জ্বলছে।
ঋক সেই রাতেই ভেতরের সেই ঘরে ক্যামেরা বসান, ঠিক করেন যে যাই হোক, আজ তিনি চোখে দেখবেন রুদ্রানন্দের সেই রহস্যময় ‘মৃতভোজন’। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডিং যেন অন্য এক সত্তায় রূপ নেয়। আলো কমে আসে, ছায়ারা দীর্ঘ হয়, আর বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ধূপের গন্ধে। ঘড়ি যখন ঠিক বারোটা বাজায়, সেই পুরনো থালাটির চারপাশে যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। ক্যামেরার লেন্সে এক অস্পষ্ট ধূসর শরীরী দেখা যায়, বসে আছে থালার সামনে, মাথায় রুদ্রাক্ষ মালা, চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে—সে বসে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে কি যেন খাচ্ছে। হঠাৎ একটা ছায়া, যেন নারীদেহ, সাপের মতো কুঁচকে তার পায়ের কাছে গড়িয়ে আসে, আর রুদ্রানন্দের কণ্ঠস্বর যেন শোনা যায়—“এই আত্মা আজ স্বেচ্ছায় এলো, তোমাদের কেউ তাকে বাধা দিল না!” পরক্ষণেই সেই নারীর ছায়া মিলিয়ে যায়, আর বোর্ডিং জুড়ে যেন একটা আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ে। ঋক ভীত হলেও পরদিন সেই ভিডিও বিশ্লেষণ করেন, এবং যা দেখেন, তা তাকে বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দেয়—সেই ছায়াটি ছিল বোর্ডিংয়ের নতুন মেয়েটি রত্না, যার খোঁজ কেউ পাচ্ছিল না গত রাত থেকে।
এই ঘটনার পরে বোর্ডিংয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। রত্নার নিখোঁজ হওয়ার খবর পুলিশের কাছে গেলে তারা আসে, কিন্তু রত্নার কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না—না তার ব্যাগ, না তার জামাকাপড়, এমনকি রেজিস্টারেও তার নাম আর নেই! ঋক খেয়াল করেন, রত্নার কক্ষ এখন ঠিক যেমন ছিল আগেও, তেমনি খালি—যেন কেউ কখনও সেখানে থাকেইনি। এমনকি বাকি ভাড়াটিয়ারা বলছে, “রত্না? কে রত্না? বোর্ডিংয়ে এমন কারও তো আসার কথাই শুনিনি!” ক্রমশ বোঝা যায়, এই বোর্ডিং হাউসে রুদ্রানন্দ এখন মৃত নয়—তিনি হয়ে উঠেছেন এক মৃতভোজনকারী চেতা, যিনি মৃতদের দিয়ে নিজের আত্মিক শক্তি বাড়ান, আর কখনও কখনও জীবিতদের ভুলিয়ে মৃত বানিয়ে ত্যাগ করান। ঋক এখন বোঝেন, তিনি যা ধরেছেন তা শুধু অতীতের ছায়া নয়, বরং এক বর্তমান-চলমান রক্তস্নাত তান্ত্রিক চক্র—যার মুখ তিনি খুলেছেন, অথচ জানেন না কিভাবে বন্ধ করবেন। আর ঠিক তখনই এক নতুন ভাড়াটিয়া আসে, এক তরুণী যার চোখে একই শূন্যতা, একই ক্লান্তি—যেমন ছিল রত্নার। ঋক বুঝলেন, খেলা আবার শুরু হয়েছে।
৭
পুরনো বোর্ডিং হাউসের গা ছমছমে নীরবতা যেন প্রতিদিন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। প্রতিটি রাত যেন আগের চেয়ে গভীরতর অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ছিল, আর প্রত্যেকটি করিডোরে হাঁটলে মনে হতো, কেউ যেন নীরবে পেছনে পেছনে হাঁটছে। অনির্বাণ এখন প্রায় নিশ্চিন্ত যে এই বোর্ডিং শুধু পুরনো নয়, অভিশপ্তও বটে। সৌমেনদা দিন দিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন, আর তাঁর চোখে এক অদ্ভুত ভীতি জমে আছে – যেন তিনি কিছু দেখেছেন, কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছেন না। ঐন্দ্রিলা, যিনি অতীতে তন্ত্রবিদ্যার বিরোধিতা করতেন, তিনিও এখন প্রতিদিন রাতে মন্ত্রপাঠ করেন নিজের ঘরে, হঠাৎ শোনা যায়, তিনি নিজেই যেন তান্ত্রিক রুদ্রানন্দের কিছু বই খুঁজে বার করেছেন ঘরের মেঝের নিচ থেকে। সেই বইগুলো ছিল পালি ভাষায়, আর প্রতিটিতে লেখা ছিল—“আত্মা শুধু রক্ত চায়, মুক্তি নয়।”
রাত্রির গভীরে একরাতে হঠাৎ ৩ নম্বর রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে—কেউ যেন মাটি খুঁড়ছে ধাতব যন্ত্রে। অনির্বাণ আর সৌমেনদা মিলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। অথচ ঘরের মেঝেতে ছিল আধা-খোড়া এক পাথরের খোপ, যার ভেতর থেকে এক পুরনো কাঠের বাক্স পাওয়া যায়। বাক্সটি খুলতেই তারা দেখতে পায় একটি পুরনো রক্তমাখা কাপড়ে মোড়া কংকাল, যার কপালে খোদাই করা ছিল ত্রিকোণ আকৃতির একটি চিহ্ন—ঠিক যেমনটা তারা রুদ্রানন্দের ঘরের দেওয়ালে দেখেছিল। ঐন্দ্রিলা এসে জানায়, এটি “তামসিক বন্ধন”—একটি তন্ত্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আত্মাকে বন্দি করে রাখা যায়। সে আরও বলে, সম্ভবত রুদ্রানন্দ এই কংকালটির মধ্যে কোনো আত্মাকে আবদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শক্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছে এবং এখন সেই আত্মা মুক্তির জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। বোর্ডিং-এর প্রতিটি অলক্ষ মুহূর্ত, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি দরজার ঠক ঠক – সবই যেন সেই মুক্তিপ্রত্যাশী শক্তিরই চিহ্ন।
ঐন্দ্রিলা ও সৌমেনদা সিদ্ধান্ত নেন, তারা একটি রাত্রিকালীন যজ্ঞের মাধ্যমে এই বন্ধন ছিন্ন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তন্ত্র শাস্ত্রে বলা আছে—বন্ধন ছিন্ন হলে আত্মা মুক্ত হবে না, বরং আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে যদি তাকে রক্ত উৎসর্গ না করা হয়। এই অবস্থায় অনির্বাণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কারণ তার মনে সন্দেহ জন্মায়—এই রক্তের চাহিদা কি প্রতীকী, না বাস্তব? যজ্ঞের রাতে চারিদিকে মোমবাতির আলো, ধূপের ধোঁয়া আর ধাতব ঘণ্টাধ্বনির মাঝে ঐন্দ্রিলা শুরু করেন মন্ত্রপাঠ। সৌমেন রক্তের প্রতীক হিসেবে গরুর মাংস ব্যবহার করেন, কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ বাতাসের স্রোতের মতো করে জানলা খুলে যায়, ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে এক কনকনে ঠাণ্ডা, আর সঙ্গে এক বীভৎস গন্ধ। মেঝেতে পড়ে থাকা কংকাল যেন নিজে নিজে নড়ে ওঠে, আর সেই ত্রিকোণ চিহ্ন যেন জ্বলতে থাকে লাল আভায়। তখন হঠাৎ সৌমেনদা পড়ে যান মেঝেতে আর চিৎকার করেন—“ওটা আমায় ডাকছে… আমি তার রক্ত… আমি সেই পাঁজি, যার ভাগ্যে লেখা ছিল কালীপুজোর রাতে বলি!” তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয় তান্ত্রিক রুদ্রানন্দের ছায়া, যিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, “রক্ত ছাড়া মুক্তি নয়… কেউ যাবে না, সবাই থাকবে… বোর্ডিং-এ আত্মার আস্তানা গড়ে উঠুক আবার।” তারপর আচমকা চারপাশের আলো নিভে যায়, আর বোর্ডিং যেন নিজেই শ্বাস নিতে শুরু করে—দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে ঘরের প্রতিটি কোণ, আর ছাদের ফাঁকে ঝুলে থাকা পুরনো বাতাস যেন বলে ওঠে, “তোমরা কেউ মুক্ত নও…”
৮
রাত্রি তখন গভীর। বোর্ডিং হাউসের পুরনো ঘড়ির কাঁটা টুং টুং করে বারোটা ঘোষণা করল, আর সেই টানেই যেন গোটা বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি শুরু হল। অয়ন আর সুচেতা তখনো বোর্ডিংয়ের মধ্যেই, বসে আছে লাইব্রেরির পাশে ছোট একটা ঘরে, যেখানে প্রাচীন কাগজ, ছেঁড়া জ্যোতির্বিদ্যার নোট আর রুদ্রানন্দের হাতের লেখা ডায়েরি রাখা ছিল। অয়ন রুদ্রানন্দের লেখা শেষ পাতাটি পড়ে চুপ করে বসে ছিল—“যেই দিন আমার দেহ এই মাটির গর্ভে মিলায়ে যাবে, সেই দিন ‘দ্বার’ খুলিবে। যে প্রবেশ করিবে, সে ত্যাগ করিবে নিজের ছায়া।” ডায়েরির পৃষ্ঠার অদ্ভুত কালিতে লেখা এই বাক্যগুলো যেন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সুচেতা হঠাৎ চুপচাপ উঠে জানালার ধারে চলে গেল। বাইরে অন্ধকারে কিছু একটা নড়াচড়া করছে—না, সেটাকে মানুষ বলা চলে না। মাথা ছিল না, কিন্তু কাঁধে জট পাকানো চুলের মত কিছু ঝুলছিল, আর তার পা ছিল উল্টোদিকে। সে ধীরে ধীরে ৫ নম্বর ঘরের দিকে এগিয়ে চলেছে। সুচেতার ঠোঁট শুকিয়ে এল। সে ফিসফিস করে বলল, “অয়ন, ওটা কি রুদ্রানন্দের সেই ‘অবতার’?” অয়ন কোনো উত্তর দিল না, শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকল।
সন্ধ্যার আগেই তারা আবিষ্কার করেছিল রুদ্রানন্দ আসলে ‘ভয়’কে বন্দি করার সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটি করে অলক্ষ ছায়া বাস করে—একটি যা আমাদের অজ্ঞানতার প্রতিফলন, লোভ, হিংসা, ভয়। রুদ্রানন্দ বোর্ডিংকে ব্যবহার করেছিলেন এক পরীক্ষাগার হিসেবে, যেখানে তিনি বোর্ডারদের মানসিক দুর্বলতাগুলোকে আলাদা করে টেনে বের করতেন এবং সেই ভয়কে ‘রূপ’ দিয়ে তাদেরই ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন। একে একে সকল ঘর এইভাবে শূন্য হয়ে গিয়েছিল, শুধু ১ নম্বর ঘর ছাড়া—যেটি ছিল রুদ্রানন্দের নিজস্ব ধ্যানক্ষেত্র। অয়ন এবং সুচেতা ১ নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ দরজাটা নিজের থেকেই খুলে গেল। ঘরের ভেতর ঢুকেই তারা দেখল একটি কাঁচের গোল ঘেরাটোপের মধ্যে বসে আছে এক অবয়ব—তার চুল ঘন কালো, চোখ দু’টি সম্পূর্ণ সাদা, মুখে প্রশান্তির ছায়া, কিন্তু তার ছায়া ছিল না! সে হঠাৎ মুখ খুলে বলল, “আমি সেই ‘আত্ম’ যাকে রুদ্রানন্দ মুক্ত করতে পারেননি। এখন তোমরা এসেছো, তোমাদের ভয় আমাকে মুক্ত করবে।” সঙ্গে সঙ্গে ঘরজুড়ে বাতি নিভে গেল। অয়ন আর সুচেতা অন্ধকারে একে অপরের হাত চেপে ধরে থাকল, আর অনুভব করল তাদের মনের সবচেয়ে ভয়ংকর স্মৃতিগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে—অয়নের বাবার আত্মহত্যা, সুচেতার ছোট বোনের অগ্নিদগ্ধ দেহ। তাদের মনে হল তারা যেন সেই স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গেছে, তার থেকে বেরোবার পথ নেই।
ঠিক তখনই ভেতরের গোল ঘেরাটোপ ভেঙে গেল। অবয়বটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং তাদের দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু এবার আর তারা ভয় পেল না। অয়ন এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যদি আমাদের ভয় হয়, তবে আমাদের মুক্তিও হতে পারো।” অবয়বটি একবার হাসল—একটা নির্জন, নীরব হাসি, যেন বহুবছরের ক্লান্তি ঝরিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে মিলিয়ে গেল ধোঁয়ার মত। সঙ্গে সঙ্গে আলো ফিরে এল, আর বোর্ডিংয়ের প্রতিটি দরজা খুলে গেল একসঙ্গে। বোর্ডিং যেন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মুক্ত হল। বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটছে, পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। অয়ন এবং সুচেতা বোঝে এই রাতের পরে তারা আর আগের মত থাকবে না। রুদ্রানন্দ হয়তো তাদের জন্যই এই বোর্ডিংকে প্রস্তুত রেখেছিলেন—যারা ভয়কে গ্রহণ করতে শিখবে, তাকে জিততে নয়, বরং বাঁচতে শিখবে। তারা ধীরে ধীরে বোর্ডিং হাউস থেকে বেরিয়ে পড়ে, পিছনে তাকিয়ে দেখে বোর্ডিংটা একেবারে স্তব্ধ—কিন্তু সেই স্তব্ধতা এবার ভয়াবহ নয়, বরং একধরনের শান্তি, যেন এক যুগের সমাপ্তি হয়ে গেছে।
৯
সন্ধ্যার ছায়া যখন রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে, তখন বোর্ডিং হাউসের বারান্দায় পায়ে পড়া চাঁদের আলো যেন মৃতদের আত্মার মতোই ধীর, নিঃশব্দে সরে যেতে থাকে। সেই সময়েই হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায়—এক অদ্ভুত বৃদ্ধ, যিনি দীর্ঘ চুল, কুঁচকে যাওয়া ত্বক এবং গায়ে সাদাকালো তিলক লাগানো অবস্থায় বোর্ডিং হাউসের ফটকে এসে দাঁড়ান। কেয়া, জানালার আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখেছিল তাকে—চোখদুটো ছিল অস্বাভাবিক জ্বলন্ত, যেন বহু যুগ আগে দেখা রুদ্রানন্দের কোন ছাত্র যেন। তিনি কেবল বলেছিলেন, “বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়নি, বৃত্ত খুলে গেছে।” বলেই, একটি ছোট্ট কাপড়ে মোড়া কাঠের বাক্স রেখে চুপচাপ চলে যান। বাক্সের ভেতর ছিল একজোড়া পিতলের ডাইস এবং একটি পুরাতন লাল কাপড়ে মোড়ানো তালপট্টি, যার গায়ে প্রাচীন সংস্কৃত মন্ত্র লেখা। এই বাক্স কেয়ার হাতে আসার পর থেকেই বোর্ডিং হাউসে অদ্ভুত শব্দ শুরু হয়—রাতে কারা যেন দেয়াল টেনে চলে, কাঠের দরজার ওপারে কেউ নিঃশ্বাস ফেলে, রান্নাঘরের আগুন নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে আবার নিভেও যায়।
অন্যদিকে, রুদ্রানন্দের ঘরের দেয়ালে থাকা ময়লা চিত্রের মাঝে একটি অংশ খসে পড়ে, এবং তার নিচ থেকে বেরিয়ে আসে একটি শঙ্খের নকশা—যা তন্ত্রশাস্ত্রে ‘ভয়ংকর সংকেত’ বলে চিহ্নিত। দেবর্ষি বিষয়টি প্রথম লক্ষ করে, এবং তার পরেই শুরু হয় তার দুর্ভেদ্য জ্বর, দেহে অদ্ভুত দাগ, মস্তিষ্কে অপার্থিব কণ্ঠস্বরের অনুপ্রবেশ। সে রাতে কেয়া, শম্ভু আর প্রিয়ম সমস্ত সাহস একত্র করে রুদ্রানন্দের ঘরে প্রবেশ করে। সেখানে তারা আবিষ্কার করে, ঘরের মেঝেতে সাদা চকের আঁকা একটি ষড়ভুজ আকৃতি, যার প্রতিটি কোণ থেকে কালো সুতো বেরিয়ে দরজার দিকে গেছে। একে ঘিরেই জ্বলছিল পাঁচটি মোমবাতি, অথচ ঘর ছিল তালাবদ্ধ। কার হাত এঁকেছে এই সংকেত? কীভাবে মোমবাতি জ্বলে উঠল? প্রশ্নের উত্তর নেই, কেবল আতঙ্ক বাড়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বাক্সটি খোলা উচিত নয়। কিন্তু এর আগেই শম্ভু ভুল করে এক ডাইস ছুঁয়ে ফেলে, আর সেই সঙ্গে বোর্ডিং হাউস যেন অন্য মাত্রায় প্রবেশ করে—ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘোরে, দেয়ালের ঘড়ির কাঁচে দেখা যায় একজন নগ্ন পুরুষ তন্ত্রসাধনায় মগ্ন, কারো মাথা ঘোরে, কারো নাক দিয়ে রক্ত পড়ে, শব্দের ভেতরে কেউ যেন বলে—”বৃত্ত সম্পূর্ণ করো… না হলে মুক্তি নেই!”
পরদিন সকালে কেয়া আবিষ্কার করে, বোর্ডিং হাউসের পুরাতন রেজিস্টারে একটি অদ্ভুত নাম যোগ হয়েছে—”শ্রী রুদ্রানন্দ, ঘর নং ১২, আগমন: আজ।” অথচ ঘর ১২টি তো বহু বছর আগেই বন্ধ, কারণ সেটিই ছিল রুদ্রানন্দের সাধনার আসন, যার দরজা পেরিয়ে কেউ কখনও ফেরেনি। প্রিয়ম এর প্রতিবাদ করে, কিন্তু কেয়া তাকে বোঝায়—এটাই সেই সময়, যখন বোর্ডিং হাউসের ইতিহাসের পরবর্তী অধ্যায় রচিত হবে। তারা ঠিক করে, আজ রাতে ঘর ১২-তে ঢুকবে। দরজা খুলতেই দেখা যায়, একটি পুরোনো কাঠের পিঁড়িতে বসে কেউ আছে। কিন্তু যেতেই দেখা যায়, চেয়ার ফাঁকা। কেবল একটি শ্বাসের শব্দ ভেসে আসে, আর ঘরের ঠিক মাঝখানে শুয়ে থাকে একজন মৃতদেহ—সে ছিল দেবর্ষি, যার শরীরের ওপর লালচে দাগে আঁকা সেই একই ষড়ভুজ, পিঠে তান্ত্রিক লেখার ছাপ, চোখ দুটো খোলা, কিন্তু কিচ্ছু দেখে না। বোর্ডিং হাউসের অন্ধকার তখন আরও গভীর হয়ে ওঠে, আর একবারেই পরিষ্কার হয়—তাদের সামনে সময় আর স্থান মিলে এক অদ্ভুত ফাঁদ তৈরি করেছে। কেয়া বোঝে, রুদ্রানন্দ ফিরেছেন। তিনি নিজে নন—তাঁর ছায়া, তাঁর অভিসম্পাত, তাঁর অসমাপ্ত সাধনার ধোঁয়া ফিরেছে। এখন যদি কেউ সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ না করে, তবে বোর্ডিং হাউস শুধু অভিশপ্তই নয়—সে হয়ে উঠবে জীবন্ত, এক লালসায় পুড়ে যাওয়া চেতনার খাঁচা।
১০
ভোরবেলার আলো ফুটে উঠতেই বোর্ডিং-এর আঙিনা কুয়াশায় ভরে উঠল, আর তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল রক্তিম-আকাশে ছায়াময় হয়ে ওঠা পুরনো মন্দিরের গম্বুজটি। যজ্ঞমণ্ডপের প্রস্তুতি রাতেই শেষ হয়েছিল—কৃষ্ণকালো আলপনায় আঁকা ষড়ভুজ, মাঝখানে প্রাচীন লিপিতে রক্তদাগের মতো চিহ্ন, আর চারদিকে শঙ্খ, ধুনো ও ধুপের গন্ধে ভারী বাতাস। তানিয়া, অর্ণব, আর বৃদ্ধ সাধক শ্রীধর একত্রিত হয়েছিলেন—তাঁদের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছিলেন আবহাওয়া অফিসের প্রাক্তন কর্মচারী চক্রবর্তী, যিনি বহু বছর আগেই বোর্ডিং ছেড়ে গিয়েছিলেন রুদ্রানন্দের মৃত্যুর পর। তিনি ফিরেছেন কারণ বারবার একই স্বপ্নে তাঁকে ডাকা হচ্ছিল—“তোর প্রায়শ্চিত্ত এখনও বাকি।” রুদ্রানন্দের শেষ অব্যক্ত ইচ্ছা—একটি অসমাপ্ত যজ্ঞ—যা ছিল মোক্ষের দ্বার। এই যজ্ঞই ছিল আসলে সমগ্র বোর্ডিংকে তান্ত্রিক প্রেতবলয়ের হাত থেকে মুক্ত করার শেষ চেষ্টার উপায়। প্রত্যেককে নির্দিষ্ট ভূমিকায় নিযুক্ত করা হল। তানিয়া দেবী কামাখ্যার আরাধনায় পূজারিণী, অর্ণব মহাকালীর সন্ন্যাসীর ভূমিকায়, আর চক্রবর্তী স্বীকার করলেন, তিনি-ই ছিলেন রুদ্রানন্দের চূড়ান্ত শিষ্য, যিনি ভয়ে সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
যজ্ঞ শুরু হতেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল, বেলপাতা আর হলুদ ফুল উড়ে বেড়াতে লাগল ঘূর্ণির মতো। শঙ্খধ্বনি ও মন্ত্রোচ্চারণে মিশে উঠল বহুকাল ধরে জমে থাকা অভিশাপের চিৎকার। সেই মুহূর্তে বোর্ডিং-এর প্রত্যেক রুম যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—ঘরের দেয়াল থেকে বেরিয়ে এলো অসংখ্য মুখ, যাঁরা একসময় এখানে শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন। একজন বৃদ্ধা বারবার বলছিলেন, “আমার চুল তোকে কে দিল? ওটা তো আমার মাথার চুল ছিল।” ছোট্ট ছেলের কণ্ঠে শোনা গেল—“আমি খেলতে গিয়ে আর বাড়ি ফিরিনি।” শ্রীধর তাঁদের শান্ত করতে করতে বললেন, “তোমরা মুক্তি চাও তো? তবে চুপচাপ দাঁড়াও—আজ তোমাদের জন্য শেষ বার আগুন জ্বলছে।” হঠাৎই বোর্ডিং-এর ছাদ ফাটল—তার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এল এক বিশাল কালো আকার, যার মুখ ছিল অর্ধেক মানুষের, অর্ধেক বকের মতো—সে-ই ছিল রুদ্রানন্দের ডাকা অসুর, যে অধিষ্ঠান নিয়েছিল এই বাড়ির উপর। কিন্তু কেউ জানত না, যজ্ঞ শুরু হলে সেই অসুর আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তার শক্তি মন্ত্রপাঠ থেকে নয়, ভয়, সংশয় আর অপরাধবোধ থেকে তৈরি হয়। অর্ণবের কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল—সে দেখল তার দিদার ছায়া সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে তীব্র অভিমান—সে-ই তো সেই রাতে ওর ডাক উপেক্ষা করেছিল। তানিয়া ছুঁয়ে ফেলল তার মৃত দিদার কাপড়, যেটা এতদিন তার ট্রাঙ্কে ছিল—তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সেই নারীর আত্মা, যিনি একদিন তান্ত্রিক রীতিতে বলি হয়েছিলেন।
শেষ লগ্নে চক্রবর্তী নিজেকে বলির পাত্র রূপে মেনে নিয়ে বললেন, “আমি পালিয়েছিলাম, রুদ্রানন্দকে প্রতারণা করেছিলাম, আর আজ তোমরা মুক্তি পাও, যদি আমার রক্তে এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়।” তাঁর কণ্ঠে ওঠা শেষ মন্ত্রধ্বনি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, আর যজ্ঞকুণ্ডে আগুন গিয়ে স্পর্শ করল ছাদের কালো ছায়াটিকে। সেই ছায়া একটিবার কেঁদে উঠল—আসলে সে-ও তো মুক্তি চেয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘকাল অভিশপ্ত হয়ে আটকে ছিল মানুষের পাপ আর অপূর্ণতা দিয়ে তৈরি বলয়ে। আলো ছড়িয়ে পড়ল পুরো বোর্ডিং-এ, যেন অদৃশ্য কেউ হাত দিয়ে সমস্ত কষ্ট মোছে দিচ্ছে। রক্তের গন্ধ ধীরে ধীরে ধূপে মিশে গেল, বোর্ডিং-এর দরজা খুলে গেল আপনিই, আর ভেতর থেকে শুধু বেরিয়ে এল এক নরম বাতাস আর শালপাতার শব্দ। তানিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, “আমার দাদু এখানে ছিলেন—উনি কি মুক্তি পেলেন?” শ্রীধর বললেন, “আজ যারা ডাকেনি, তারাও মুক্তি পেল।” অর্ণব জানাল, বোর্ডিং-এর রুম নম্বর ৭ থেকে একটা মোহর ভরা বাক্স পাওয়া গেছে—রুদ্রানন্দের তাম্রলিপি লেখা ছিল তার উপরে—“মুক্তি হলেই বোঝো, ক্ষমা পাও।”
বোর্ডিং হাউস আজও আছে, কিন্তু এখন তা আর ভূতুড়ে নয়। মানুষজন আসেন, থাকেন, ঘোরেন। কেউ কেউ বলে—রুম নম্বর ৫-এ সন্ধেবেলায় ধূপের গন্ধ আসে, আর কারও কারও ঘুমে এক বৃদ্ধ এসে আশীর্বাদ করে যান। অর্ণব শহর ছেড়ে আবার ফিরে গেছে তার সাংবাদিকতার কাজে, তানিয়া এখন গাইডেড হেরিটেজ ট্যুর চালান বোর্ডিং ঘিরে, আর শ্রীধর নিঃশব্দে মন্দিরের পাশের গম্বুজে বসে থাকেন, কখনও কিছু বলেন না, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেউ কেউ বলে, চক্রবর্তীর আত্মা আজও যজ্ঞমণ্ডপের নিচে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, কারণ অবশেষে তান্ত্রিক বোর্ডিং হাউসের যজ্ঞ শেষ হয়েছে, এবং রুদ্রানন্দের অভিশাপ পরিণত হয়েছে আশীর্বাদে।
সমাপ্ত