অরিন্দম সেনগুপ্ত
পর্ব ১ – নগরীর নীচে
প্রাচীন নগরীর বুক চিরে যখন প্রথম খননের কোদাল পড়ল, তখন কারো ধারণা ছিল না কী অদ্ভুত রহস্য উন্মোচিত হতে চলেছে। নদীর ধারে বসে থাকা নগরটির ইতিহাস বহুবার লেখা হয়েছে, বহুবার পড়া হয়েছে, কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আধিকারিকেরা জানতেন, কাগজে লেখা ইতিহাস আর মাটির নীচে চাপা ইতিহাসের মাঝে কতখানি ফারাক থাকে। ড. দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই অভিযানের প্রধান। তাঁর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু চোখে এক ধরনের অদম্য কৌতূহল। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় বসে বসে তিনি বহুবার এমন সব পুঁথি পড়েছেন যেখানে বলা হয়েছে এই নগরী একসময় আচার, যজ্ঞ আর রহস্যময় তন্ত্রচর্চার কেন্দ্র ছিল। তবে সবটাই ছিল কল্পকথা—অন্তত তিনি তাই ভেবেছিলেন।
খননের প্রথম কয়েকদিন গেল নিরুত্তাপ। ভাঙা মাটির পাত্র, পোড়া ইট, কিছু অলঙ্কারের খণ্ড ছাড়া বিশেষ কিছু হাতে আসেনি। কিন্তু সপ্তম দিনে এক শ্রমিকের কোদাল ধাতব শব্দ করল। মাটি সরাতেই দেখা গেল পাথরের তৈরি সিঁড়ি, যা নীচে নেমে গেছে অন্ধকারের গভীরে। চারপাশে তখন হাওয়া হঠাৎ যেন ভারি হয়ে উঠল। পাখিরা চঞ্চল ডাক ছেড়ে উড়ে গেল, কুকুরেরা অকারণে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। দেবাশিস নেমে গেলেন সিঁড়ির ধাপ গুনে গুনে, পাশে হাতে টর্চ নিয়ে রঞ্জন, তাঁর সবচেয়ে তরুণ সহকারী।
সিঁড়ির শেষে ছিল একটি ছোট্ট পাথরের দরজা। দরজার গায়ে অদ্ভুত সব খোদাই—কেউ যেন অজানা কোনো ভাষায় মন্ত্র লিখেছে। রঞ্জন টর্চের আলো ফেলতেই মনে হল খোদাই করা অক্ষরগুলো একটু নড়েচড়ে উঠল, যেন শ্বাস নিচ্ছে। দেবাশিস মনস্থির করে হাত রাখলেন দরজার পাথরে। দরজা ঠেলতেই ঘরঘর করে শব্দ করে ভেতরে খুলে গেল।
ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র ঠান্ডার এক ঝাঁকুনি তাদের আঘাত করল। ঘরের মাঝখানে বসানো আছে এক কালো পাথরের মূর্তি—মুখ বিকৃত, যেন হাহাকার করছে। চোখ দুটি গভীর খাদ, কিন্তু টর্চের আলো পড়তেই মনে হল লালচে কিছু ঝিলিক দিচ্ছে। দেয়াল ঘিরে খোদাই করা আছে জটিল মন্ত্রচক্র, সর্পিল রেখার মধ্যে অদ্ভুত চিহ্ন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
দেবাশিস মূর্তির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর বুকের ভেতর তখন অদ্ভুত কাঁপুনি। এই কি সেই প্রাচীন কাহিনির দেবতা? নাকি কোনো অভিশপ্ত প্রতিমা, যাকে চিরকাল মাটির তলায় চাপা রাখাই ছিল নগরীর বেঁচে থাকার উপায়? রঞ্জন ফিসফিস করে বলল, “স্যার, মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকিয়ে আছে।”
সত্যিই, ঘরের ভেতরে একটা উপস্থিতির ভার অনুভূত হচ্ছিল। বাতাস স্থির, তবু কানে আসছিল হালকা গুঞ্জন, যেন হাজার মানুষের একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ। খননের অন্য সদস্যরা ভয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছিল না। দেবাশিস জোর করেই তাদের ডেকে আনলেন। তারা মূর্তির চারপাশে আলো ফেলল, ছবি তুলল, খোদাই নকশা নোট করল। কিন্তু কাজের ফাঁকেই প্রত্যেকের শরীর কেঁপে উঠছিল—কারণ বোঝা যাচ্ছিল না।
সন্ধ্যার পর খননক্ষেত্র থেকে বেরোতে গিয়ে দেবাশিস লক্ষ্য করলেন, শহরের দিক থেকে কুয়াশার চাদর নেমে আসছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিক, কিন্তু এমন ঘন কুয়াশা সাধারণত হয় না। তিনি নিজের নোটবুকে লিখলেন—“প্রথম গোপন কক্ষ উন্মোচিত। অস্বাভাবিক ঠান্ডা ও কুয়াশা লক্ষ্য করা গেল। মূর্তির চোখে লাল ঝিলিক—সম্ভবত প্রতিফলন, কিন্তু উৎস অজানা।”
রাতে হোটেলে ফিরে সবাই খাবার টেবিলে বসে আলোচনা করতে লাগল। একজন শ্রমিক কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ও মূর্তিটাকে নাড়াচাড়া করা উচিত নয়। আমার ঠাকুরদা বলতেন, এই নগরী মাটির নীচে আছে কারণ ঈশ্বর তাই চেয়েছিলেন।” দেবাশিস ধমক দিলেন, “আমরা ইতিহাস খুঁজতে এসেছি, কুসংস্কার মানতে নয়।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও অস্থির ছিলেন। ঘরে ফিরে জানলার ধারে বসে থাকতেই তাঁর মনে হল দূরে অন্ধকারের মধ্যে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।
পরের দিন আবার খনন শুরু হল। এবার মূর্তির পাদদেশ খুঁড়তে গিয়ে মেলে কিছু ভাঙা অলঙ্কার, তামার পাতায় খোদাই করা চিহ্ন, আর একখণ্ড মানব অস্থি। রঞ্জন সেটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ ঝাঁকুনি খেল, যেন বিদ্যুতের ধাক্কা লাগল। সে চিৎকার করে উঠল, আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার চোখ একেবারে ফাঁকা সাদা হয়ে গেল। সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পরে রঞ্জন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে বলল, “আমি কিছু দেখেছিলাম… আগুনে মোড়া নগর, মূর্তির সামনে রক্তাক্ত যজ্ঞ।” দেবাশিস চুপ করে গেলেন।
রাতে তাঁরা ঘুমোতে গেলেও ঘরে ঘরে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল—দরজা কেঁপে উঠছে, দেওয়ালে আঁচড়ের দাগ পড়ছে, বাতি নিজে থেকে নিভে যাচ্ছে। এক সহকারী ভোরবেলা ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। দেবাশিস বুঝলেন, এবার ঘটনাগুলো কেবল কাকতালীয় নয়। কিছু যেন জেগে উঠছে।
তৃতীয় দিনে স্থানীয় সংবাদপত্রে বেরোল ছোট্ট খবর—শহরের বাজার থেকে এক বৃদ্ধ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সাক্ষীরা বলছে, তিনি হাঁটছিলেন, হঠাৎ শরীর কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। পুলিশ ঘটনাকে গুরুত্ব দিল না, কিন্তু দেবাশিসের মনে আতঙ্ক জন্ম নিল। মূর্তির সাথে এই অদৃশ্য হওয়ার যোগ থাকতে পারে?
রাতে তিনি আবার নোটবুক খুললেন। লিখলেন—“মূর্তির চারপাশে অদ্ভুত শক্তি। দলের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। স্থানীয়দের মধ্যে কুসংস্কার প্রবল। কিন্তু অস্থিরতার মাঝেও মনে হচ্ছে ইতিহাসের এক অদেখা দরজা খুলে যাচ্ছে।”
এবং সেই রাতেই, শোবার আগে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেবাশিস দেখলেন—দূরে খননক্ষেত্রের দিক থেকে লালচে আলো উঠছে, যেন মাটির তলা থেকে কেউ এক বিশাল প্রদীপ জ্বালিয়েছে। তিনি জানতেন, এই আলো নিছক বৈজ্ঞানিক কারণে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
পর্ব ২ – মন্ত্রচক্রের জাগরণ
প্রথম কক্ষ আবিষ্কারের পর থেকেই দলের ভেতরে অস্বস্তি জমতে শুরু করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় রঞ্জনের আচরণ অদ্ভুত রূপ নিল। সারাদিন খননের কাজ শেষে যখন সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসেছে, রঞ্জন তখনও ঘরে বসে কাগজে মন্ত্রচক্রের প্রতিলিপি আঁকছিল। খোদাই করা প্রতিটি রেখা, প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি অচেনা অক্ষরকে টর্চের আলোয় হুবহু কপি করতে গিয়ে তার চোখ লাল হয়ে উঠছিল।
হঠাৎই কাগজের ওপর হাত কেটে গেল তার। আঙুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ল। সে খেয়ালই করল না, বরং রক্ত দিয়ে বাকি চক্রের ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে শুরু করল। সেই মুহূর্তে বাইরে হাওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত হাহাকার শোনা গেল—যেন দূরে বহু লোক একসঙ্গে গাইছে কোনো অজানা স্তোত্র।
দেবাশিস দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করলেন। রঞ্জনের চোখ তখন অর্ধেক বন্ধ, ঠোঁট নড়ে উঠছে। অচেনা ভাষায় সে কিছু আওড়াচ্ছিল। গলার স্বর ভারি, যেন ওটা তার নিজের নয়। দেবাশিস ছুটে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলেন, কাগজ টেনে নিলেন। রঞ্জন তখন হঠাৎ ছটফট করতে শুরু করল, গলা থেকে গর্জন বেরোল। অন্যরা ছুটে এসে তাকে সামলাল। কয়েক মিনিট পরে সে ধপ করে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
রাত গভীর হল। খনন শিবিরের তাঁবুতে সবাই ভয়ে জেগে রইল। বাইরে ঘন কুয়াশা, চাঁদের আলো যেন মাটিতে পড়তেই সাহস পাচ্ছে না। এক শ্রমিক বলল, “এইসব মন্ত্রের খেলা আমাদের সর্বনাশ করবে। কালো মূর্তিকে চাপা দিয়েছিল কারণ এটাই নগরীর অমঙ্গল।” দেবাশিস রাগ দেখালেন না। তিনিও ভেতরে ভেতরে কাঁপছিলেন।
পরদিন সকালে রঞ্জন স্বাভাবিক হয়ে উঠল। কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। সে যেন কিছু মনে করতে পারছে না। শুধু বারবার বলছিল, “মন্ত্রচক্র সম্পূর্ণ না হলে দরজা খুলবে না।” সবাই অবাক হয়ে তাকাল, কিন্তু সে আবার চুপ হয়ে গেল।
এদিকে শহরে ঘটতে শুরু করল অদ্ভুত সব ঘটনা। এক গলিপথে মানুষজন দেখল—মাটির ওপর হঠাৎ ছায়ার মতো কালো রেখা আঁকা হয়েছে, যেন কেউ জটিল নকশা এঁকেছে। আবার রাতে কয়েকজন বলল, তারা দেখেছে রাস্তায় ধোঁয়ার ভেতর অচেনা মূর্তি হেঁটে যাচ্ছে। পুলিশ ঘটনাকে গুজব বলে এড়িয়ে গেল। কিন্তু স্থানীয় সংবাদপত্র শিরোনাম করল—“অদৃশ্য পথিকেরা কি ফিরে এসেছে?”
খননক্ষেত্রে কাজ থেমে গেল না। মূর্তির চারপাশ খুঁড়তে গিয়ে আরও কিছু তামার পাত পাওয়া গেল, তাতে খোদাই করা সেই একই অক্ষর। দেবাশিস রাতভর বইপত্র ঘেঁটে বুঝলেন, এগুলো কোনো প্রাচীন আচারসংক্রান্ত প্রতীক—যা নাকি দুনিয়ার সীমানা ভেঙে অন্য জগতের শক্তিকে ডেকে আনতে পারে।
সন্ধ্যায় তিনি রঞ্জনকে ডেকে বললেন, “তুমি ঠিক কী মনে করলে কাল রাতে? কী দরজা?” রঞ্জন শূন্য চোখে তাকিয়ে বলল, “দরজা তো আমরা খুলেছি, স্যার। এখন শুধু ওরা আসার অপেক্ষা।” দেবাশিসের বুকের ভেতর ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
রাত নেমে এলে তাঁবুগুলির ভেতর শোনা গেল অদ্ভুত শব্দ—টুপটাপ জলের মতো, অথচ চারপাশ শুকনো। আবার কেউ কেউ বলল, দূরে শ্মশানের মতো গন্ধ ভেসে আসছে। এক শ্রমিক ভয় পেয়ে পালাতে চাইলে হঠাৎ ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে হাতের মতো কিছু বেরিয়ে তাকে টেনে নিল। সবাই দৌড়ে গেল, কিন্তু লোকটা নেই। মাটিতে শুধু এক জোড়া জুতোর দাগ।
ড. দেবাশিস এবার বুঝলেন, বিষয়টি আর কেবল প্রত্নতত্ত্বের খেলা নয়। অদৃশ্য কোনো শক্তি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। তিনি নোটবুকে লিখলেন—“রঞ্জনের মাধ্যমে মন্ত্রচক্র সক্রিয় হয়েছে। নগরীর ভেতরে হয়তো এক ভিন্ন মাত্রার দরজা খুলে গেছে। খনন অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। কিন্তু সরকারের অনুমতি ছাড়া তা সম্ভব নয়।”
রাতের আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল। মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেবাশিস দেখলেন, কালো চোখের ফাঁকা গহ্বর থেকে লালচে আলোর রেখা ফুঁটে উঠছে—মাটির নীচের কোনো গভীর থেকে, যেন তাকে ডাকছে।
পর্ব ৩ – অদৃশ্য পথিক
শহরের সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। বাজারের দোকান খোলা, রাস্তায় ভিড়, গরম চায়ের ভাঁপে কুয়াশার আভা। কিন্তু মধ্যাহ্নের আগেই ছড়িয়ে পড়ল এক ভয়াবহ খবর—একজন বয়স্ক পথিক হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেছে সবার সামনে। বাজারের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বলল, লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল, আচমকা যেন কুয়াশার পেঁচিয়ে ধরা বৃত্তে ঢুকে মিলিয়ে গেল। তার গলিত কণ্ঠে শুধু শোনা গিয়েছিল এক টুকরো আর্তনাদ।
দুপুরে পুলিশের দল ঘটনাস্থলে গিয়ে চারপাশ তল্লাশি করল। কোনো চিহ্ন নেই, শুধু মাটির ওপর আঁকাবাঁকা রেখার মতো দাগ—যেন কেউ ছুরি দিয়ে মাটি কেটেছে। পুলিশ এটাকে গুজব বলে চেপে দিতে চাইছিল, কিন্তু সাক্ষীদের ভিড় এতটাই প্রবল যে স্থানীয় সংবাদপত্রে বড় শিরোনাম বেরোল—“অদৃশ্য পথিক, নগরীর অভিশাপ কি ফিরে এল?”
এই খবর পৌঁছল খননক্ষেত্রে। দেবাশিস উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রঞ্জন তখনও অদ্ভুত শূন্য চোখে বসে থাকে, মাঝে মাঝে মন্ত্রের মতো ফিসফিস করে। দেবাশিস তাকে প্রশ্ন করলে সে শুধু বলল, “দরজা খুলেছে, তাই তো মানুষ ওপারে যাচ্ছে।” বাকিরা ভয়ে গা শিউরে উঠল।
সন্ধ্যায় শিবিরের কাছে দু’জন শ্রমিক খোঁজ দিল, তারাও অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে। গলিপথে হঠাৎ অচেনা এক পথিক বেরিয়ে এল, মাথা ঢেকে কালো কাপড়ে, চোখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু যখন কাছে যাওয়া হল, তখন লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শ্রমিকেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল।
রাত নেমে এল। খননক্ষেত্রকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁবুগুলির ভেতর ভারি নীরবতা। শুধু দূরে কুকুরের চিৎকার আর শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। দেবাশিস হাতে লণ্ঠন নিয়ে আবার সেই গোপন কক্ষে ঢুকলেন। কালো মূর্তিটি এখন আরও ভিন্ন রূপ নিয়েছে—চোখের ফাঁকা গহ্বর যেন আলোর বদলে অন্ধকার গিলে নিচ্ছে। দেয়ালের মন্ত্রচক্রে টর্চের আলো ফেলতেই মনে হল খোদাই করা অক্ষরগুলো কেঁপে উঠছে।
তিনি কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, চক্রের এক কোণে নতুন দাগ পড়েছে। এটা মানুষের আঁচড় নয়, যেন ভেতর থেকে কেউ বেরোতে চাইছে। দেবাশিসের বুকের ভেতর হিমেল বাতাস বয়ে গেল। তিনি কাগজে সব নোট করে রাখলেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কারো শ্বাস তাঁর ঘাড়ে পড়ছে।
রাত আরও গভীর হলে আবার ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। শিবিরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা শুনল পায়ের শব্দ। লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়ে দেখে—এক অচেনা মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কালো ছায়ায় ঢাকা, মুখ স্পষ্ট নয়। তারা ডাকতেই লোকটা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। প্রহরীরা ভয় সামলে কাছে গেল, কিন্তু হঠাৎই তাদের চোখের সামনে লোকটা মিলিয়ে গেল বাতাসে। শুধু মাটিতে রয়ে গেল একজোড়া ভেজা দাগ, যেন জলের ছাপ।
প্রহরীরা আতঙ্কে ছুটে গিয়ে দেবাশিসকে ডেকে আনল। তিনি বাইরে এসে মাটির সেই ভেজা ছাপ লক্ষ্য করলেন। হাত দিয়ে ছুঁতেই আঙুলে ঠাণ্ডার ঝাপটা খেল, যেন বরফের চেয়েও শীতল। তখনই রঞ্জন তাঁবুর ভেতর থেকে উচ্চস্বরে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল। তার গলা আর তার নিজের মতো শোনাচ্ছিল না—গর্জনময়, গভীর, যেন কারো প্রাচীন কণ্ঠ ফিরে এসেছে।
সবাই ছুটে গিয়ে তাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করল। রঞ্জনের চোখ একেবারে ফাঁকা, ঠোঁট থেকে বেরোল অচেনা শব্দ—“অতিথিরা এসে গেছে। নগরী আবার পূর্ণ হবে।”
এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই শিবিরের চারপাশে হাওয়ার ঝড় উঠল। তাঁবুর দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যেতে লাগল, আগুনের আলোর শিখা দপ করে নেভে গেল। চারপাশের অন্ধকারে সবাই শুনতে পেল ভেসে আসা পায়ের শব্দ—শত শত মানুষ একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে, অথচ কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
দেবাশিস নিজের বুক চেপে ধরলেন। তিনি জানলেন, শহরে নিখোঁজ হওয়া মানুষগুলো হয়তো নিছক হারিয়ে যায়নি—তাদের টেনে নেওয়া হচ্ছে অন্য কোনো অদৃশ্য দুনিয়ায়। আর সেই দুনিয়ার দরজা খুলছে এখানেই, এই নগরীর মাটির নিচে।
রাতের শেষভাগে, নিস্তব্ধতার মাঝে তিনি নোটবুকে লিখলেন—
“অদৃশ্য পথিকেরা সত্যি। নগরী আবার জেগে উঠছে।”
পর্ব ৪ – কালো মূর্তির চোখ
দিন কয়েকের মধ্যেই শিবিরে ভয় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে শ্রমিকেরা কাজ করতে চাইছিল না। কেউ বলছিল রাতে ফিসফিস শব্দ শোনে, কেউ দাবি করছিল, দূরে অদ্ভুত ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে। ড. দেবাশিস নিজের দলের মনোবল ধরে রাখার জন্য ঘোষণা করলেন—মূর্তিটিকে স্থানান্তর করতে হবে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিয়ম মেনে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেলে গবেষণা সহজ হবে, আর চারপাশের আতঙ্কও কিছুটা কমবে।
সেদিন সকালেই শুরু হল কাজ। কয়েকজন মজবুত শ্রমিক লরি এনে দাঁড় করাল। লোহার দড়ি আর লিভার ব্যবহার করে কালো মূর্তিটিকে তোলা শুরু হল। মূর্তিটি নড়তেই চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠল। হঠাৎ মনে হল মাটির নিচ থেকে গুঞ্জন উঠছে—অসংখ্য গলা একসঙ্গে কোনো মন্ত্রপাঠ করছে।
দেবাশিস গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। রঞ্জন তখন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ আধখানা বন্ধ, ঠোঁট কাঁপছে। কেউ খেয়াল করল, মূর্তিটি যখন দড়িতে বাঁধা হল, তার চোখের ফাঁকা খাদ থেকে লালচে আলো ফুঁটে উঠছে। প্রথমে সামান্য, তারপর তীব্র।
একজন শ্রমিক ভয়ে চিৎকার করে হাত ছেড়ে দিল। তার দেহ কেঁপে উঠল, তারপর ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। সে আর ওঠেনি। বাকিরা আতঙ্কে পেছনে সরে গেল। কিন্তু দেবাশিস দৃঢ় গলায় বললেন, “থামবে না, ওটা তুলতেই হবে।”
লোহার লিভার চাপতেই মূর্তিটি ধীরে ধীরে ওপরে উঠল। কিন্তু তখনই হঠাৎ এমন ঘটনা ঘটল যা কারোর কল্পনাতেও ছিল না। মূর্তির চোখ থেকে দুটো আলোর রশ্মি বেরোল—রক্তাভ, জ্বলন্ত। সরাসরি ছুটে গেল রঞ্জনের দিকে। রঞ্জন কেঁপে উঠল, তারপর ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। তার গলা থেকে বেরোল গর্জন—যেন অন্য কেউ কথা বলছে।
“আমাকে জাগ্রত করেছো কেন?”—এই শব্দ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হল। অথচ রঞ্জনের ঠোঁটই নড়ছিল। চোখ তখন পুরো সাদা, শরীর ধীরে ধীরে কাঁপছে।
দেবাশিস দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরতে চাইলে হঠাৎ মূর্তির আলো আরও তীব্র হয়ে উঠল। শ্রমিকরা আতঙ্কে পালাতে লাগল। লরির দড়ি ছিঁড়ে গেল, আর মূর্তিটি গড়িয়ে আবার মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভে গেল।
শিবির নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেবল রঞ্জন মাটিতে পড়ে শ্বাস নিতে নিতে বলল, “সে ফিরছে… নগরী আবার খুলবে।”
দেবাশিস বুঝলেন, বিষয়টি আর কেবল প্রত্নতত্ত্ব নয়। এখানে অজানা শক্তির খেলা চলছে। কিন্তু সরকারি অনুমতি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহ তাঁকে থামতে দেবে না। তিনি কাগজে লিখলেন—
“মূর্তিকে নাড়িয়ে দিলে তার প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর। লাল আলো সরাসরি জীবিত মানুষকে আঘাত করছে। রঞ্জনের শরীরের ভেতর দিয়ে অন্য শক্তি কথা বলছে।”
রাত নামার পর আবারও শিবিরের বাইরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পাহারাদার বলল, দূরে যেন লালচে চোখওয়ালা ছায়ারা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেহ নেই, কেবল চোখ। বাতাস ভারি হয়ে উঠছে, কুকুরেরা একসঙ্গে চিৎকার করছে।
দেবাশিস লণ্ঠন হাতে গিয়ে দেখলেন—আসলে অন্ধকারের ভেতরেই চোখদুটো জ্বলছে। যেন মূর্তির আলো আলাদা হয়ে শত শত ছায়ায় ভাগ হয়ে গেছে। সেই চোখগুলো নীরবে তাকিয়ে আছে খননক্ষেত্রের দিকে।
দল ভয় পেয়ে তাঁবুতে ঢুকে গেল। কেবল দেবাশিস রাতভর বসে রইলেন, নোট লিখতে লিখতে। মনের ভেতর একটাই প্রশ্ন বাজছিল—এই মূর্তি কি সত্যিই কেবল পাথর? নাকি এর ভেতর লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন জগতের প্রবেশদ্বার?
ভোর হওয়ার আগেই রঞ্জন আবার জেগে উঠল। সে মৃদুস্বরে বলল, “দেবাশিস স্যার, চোখে চোখ রাখবেন না। ওরা ডাকছে।”
দেবাশিস শিউরে উঠলেন। তিনি জানতেন, খননের এই অধ্যায় কেবল শুরু মাত্র।
পর্ব ৫ – নগরীর অতীত
কালো মূর্তিকে স্থানান্তরের ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর রঞ্জনের অদ্ভুত আচরণের পরে খননের কাজ কার্যত থমকে দাঁড়াল। দলের মধ্যে আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে বেশিরভাগ শ্রমিক সরে যেতে চাইছে। তবু ড. দেবাশিস থামলেন না। তাঁর ভিতরের গবেষক জানত, মূর্তি ও মন্ত্রচক্রের মধ্যে লুকোনো ইতিহাসই আসল চাবিকাঠি। আর ইতিহাস যতই অন্ধকার হোক, তাকে উন্মোচন করতেই হবে।
পরদিন সকালে তিনি গাড়ি নিয়ে শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে গেলেন। লাইব্রেরিটি একসময় জমিদার পরিবারের অংশ ছিল, এখন সরকারি আর্কাইভ। অন্ধকার, ধুলোমাখা তাকগুলোতে সারি সারি পুঁথি আর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি জমে আছে। কাগজের গন্ধে যেন সময় থমকে গেছে। দেবাশিস পরিচিত গ্রন্থাগারিককে বললেন—“অন্ধকার নগরী বা শাপগ্রস্ত যজ্ঞের কোনো উল্লেখ আছে কি?” বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক একটু থমকাল, তারপর নীচু স্বরে বললেন, “আপনি খননক্ষেত্রের কথা বলছেন তো? ওসব খোঁচাবেন না স্যার। এই শহর আগেও একবার ধ্বংস হয়েছিল। বইতে আছে।”
দেবাশিস তাক থেকে বার করলেন একটি প্রাচীন পুঁথি—‘তন্ত্রসিদ্ধান্ত সংহিতা’। পুঁথিতে বর্ণনা করা হয়েছিল এক নগরীর কথা যেখানে ‘অপর জগতের শক্তি আহ্বান’ ছিল দৈনন্দিন সাধনার অঙ্গ। সাধকরা বিশ্বাস করত, মন্ত্রচক্রের মাধ্যমে তারা পরলোকের দেবশক্তিকে ডেকে আনতে পারে, আর সেই শক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এক অধ্যায়ে লেখা ছিল—
“যেদিন নগরীর কালো প্রতিমা রক্তে স্নাত হয়, সেদিন পৃথিবীর দরজা ভেঙে যায়। জীবিতেরা অদৃশ্য হয়ে যায়, মৃতেরা ফিরে আসে। তখন নগরী রক্তের সমুদ্র হয়ে ওঠে।”
এই পড়তে পড়তেই দেবাশিসের বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তিনি কাগজে নোট করলেন—
“কালো প্রতিমা = মন্ত্রচক্রের কেন্দ্র। ইতিহাসে বলা আছে নগরী হঠাৎ ধ্বংস হয়েছিল। সম্ভবত প্রতিমা সক্রিয় হয়ে পুরো নগরীকে গ্রাস করেছিল।”
দুপুরে তিনি আবার শিবিরে ফিরলেন। দলের অন্য সদস্যরা তাঁকে ঘিরে ধরল। কেউ বলল, “স্যার, আমরা আর থাকব না। শ্রমিকেরা সব পালাচ্ছে। রাতে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, ছায়া দেখা যায়।” দেবাশিস তাদের শান্ত করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁর নিজের কণ্ঠেও তখন ভয়ের ছাপ।
সন্ধ্যায় রঞ্জন হঠাৎই চুপচাপ দেবাশিসের ঘরে এসে দাঁড়াল। তার চোখ শূন্য, ঠোঁটে একরকম অদ্ভুত হাসি। সে বলল, “আপনি জানেন তো, এই নগরী কখনো মারা যায়নি? মাটির নীচে ঘুমিয়ে ছিল শুধু। আমরা আবার জাগিয়ে তুলেছি।”
দেবাশিস আঁতকে উঠলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এসব কীভাবে জানো?” রঞ্জন উত্তর দিল, “ওরা আমায় বলে। মূর্তির ভেতর থেকে। নগরীর অতীত আমিই দেখেছি।” তারপর সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল, মাথায় হাত রেখে হাহাকার শুরু করল।
রাত বাড়তেই শিবিরের চারপাশে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখা দিতে লাগল। কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে এল ঢাক-ঢোলের শব্দ, যেন কোথাও পূর্ণিমার যজ্ঞ চলছে। তাঁবুর বাইরে যারা বেরোল তারা দেখল—আকাশে আগুনের মতো লাল রেখা আঁকা।
ড. দেবাশিস চুপচাপ নোট লিখলেন—
“অতীতের ইতিহাস বর্তমান হয়ে উঠছে। নগরীর ধ্বংস হয়েছিল অভিশপ্ত যজ্ঞের ফলে। সেই একই আচার আবার ফিরে আসছে। যদি এটা থামানো না যায়, শহর ফের হারিয়ে যাবে।”
তবে তাঁর মনে আরেকটা প্রশ্ন জন্ম নিল—কীভাবে? কীভাবে থামাবেন এক নগরীর অভিশপ্ত পুনর্জন্ম?
সেই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে তিনি জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। দূরে খননক্ষেত্রের দিক থেকে লালচে আলোর ঝলকানি উঠছিল। আর তাঁর মনে হচ্ছিল, নগরীর অতীত আসলে কোনো মৃত ইতিহাস নয়—বরং সক্রিয়, অদৃশ্য এক শক্তি, যা ধীরে ধীরে শহরটিকে গ্রাস করতে আসছে।
পর্ব ৬ – উন্মাদনার ছায়া
দিন যত এগোতে লাগল, খননের শিবিরে অস্থিরতা ততই বাড়তে থাকল। কালো মূর্তির চোখে লালচে আলোর ঝলক আর রঞ্জনের অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী দলের প্রত্যেককে ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে তুলেছিল। দেবাশিস যতই যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে এগুলো হয়তো মানসিক চাপের ফল, কিন্তু বাস্তবের দৃশ্যগুলো আর কোনোভাবেই কাকতালীয় মনে হচ্ছিল না।
প্রথম আঘাত এল অর্ক নামে এক সহকারী প্রত্নতত্ত্ববিদের উপর। রাতের বেলা সে হঠাৎ ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখল, অর্ক একেবারে নগ্ন শরীরে খননক্ষেত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, দু’হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করছে—“আগুন… আগুন নামছে।” তার চোখ উল্টে গেছে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। কয়েকজন গিয়ে তাকে ধরল, কিন্তু সে এমনভাবে ছটফট করছিল যেন ভেতরে অন্য কেউ বসে আছে। অবশেষে তাকে বাঁধা হল। পরদিন ভোরে সে আর জেগে উঠল না।
দল স্তম্ভিত হয়ে গেল। অর্কের মৃত্যু শিবিরের ওপর আরও এক অশুভ ছায়া ফেলল। শ্রমিকেরা দল বেঁধে পালাতে শুরু করল। কেবল কিছু লোক থেকে গেল, তারা হয়তো টাকার লোভে, হয়তো কৌতূহলে। দেবাশিস নিজেও অনুভব করছিলেন, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা কাঁপন নেমে আসছে।
এরপর পাগল হলেন আরেকজন—পিয়ালী। তিনি একজন গবেষক, খননের অঙ্কন বিভাগ সামলাতেন। হঠাৎই তাকে দেখা গেল কাগজে কাগজে আগুনের রেখা, রক্তাক্ত দেবীর চোখ, শ্মশানের দৃশ্য আঁকছে। তার আঙুলে কালি নয়, ছিল নিজস্ব রক্ত। সবাই তাকে থামাতে গেলে সে চেঁচিয়ে উঠল—“ওঁ আসছে! নগরী আবার খুলছে।” অবশেষে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হল।
এইসব ঘটনার মাঝে রঞ্জন এক অদ্ভুত কেন্দ্র হয়ে উঠল। সে দিনে চুপচাপ থাকে, কিন্তু রাতে মন্ত্র আওড়ায়। তার কণ্ঠে তখন হাজারো গলার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। দেবাশিস এক রাতে তাকে ধরে প্রশ্ন করলেন—“তুমি এসব কোথায় শিখলে?” রঞ্জন শান্ত স্বরে বলল, “আমি শিখিনি, স্যার। তারা আমাকে শেখাচ্ছে। নগরীর আত্মারা।”
দেবাশিস বুঝতে পারলেন, দলের উপর ভর করছে এক প্রকার সমষ্টিগত উন্মাদনা। কিন্তু এ যেন নিছক মানসিক ভাঙন নয়—বরং কোনো অদৃশ্য শক্তি সবাইকে গ্রাস করছে।
শহরেও শুরু হল আতঙ্ক। খবর আসতে লাগল লোকজন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কেউ বাজার থেকে, কেউ বাড়ির ভেতর থেকে, কেউ বা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। প্রত্যেকের বর্ণনায় মিল আছে—ঘন কুয়াশা, তারপর এক মুহূর্তে অদৃশ্য হওয়া। শহরের মানুষ বলতে লাগল—“প্রাচীন নগরী জেগে উঠেছে।”
রাতে দেবাশিস খননকক্ষের মন্ত্রচক্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টর্চের আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখলেন—মন্ত্রচক্রের ভেতরে লাল দাগ ছড়িয়ে পড়েছে। মনে হল, যেন ওখানকার পাথর রক্ত শুষে নিয়েছে। দেয়ালের ওপর আলো ফেলতেই তাঁর চোখে ভেসে উঠল আগুনে মোড়া নগরীর দৃশ্য, মানুষ দৌড়াচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ অদৃশ্য হচ্ছে।
তিনি আঁতকে সরে গেলেন। কিন্তু হঠাৎই শুনতে পেলেন কানে কানে কেউ ফিসফিস করছে—“তুমি আমাদের ডাকেছো। পালানোর পথ নেই।” চারপাশে কেউ ছিল না, অথচ গলা স্পষ্ট।
রাতভর দেবাশিস ঘুমোতে পারলেন না। তিনি নোটবুকে লিখলেন—
“উন্মাদনার ছায়া এখন স্পষ্ট। আমাদের দলের মৃত্যু, পাগল হওয়া ও রঞ্জনের ভবিষ্যদ্বাণী—সবই নগরীর জাগরণের অংশ। হয়তো আমরা ধীরে ধীরে এক প্রাচীন শক্তির হাতে খেলনা হয়ে যাচ্ছি।”
ভোর হতেই খননক্ষেত্র থেকে অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল—যেন শত শত মানুষ একসঙ্গে তালি দিচ্ছে। শিবিরের সবাই ভয়ে জমে গেল। আর দেবাশিস তখনও বুঝে উঠতে পারছিলেন না—এ কি নিছক ভ্রম? নাকি সত্যিই নগরীর ঘুম ভাঙছে?
পর্ব ৭ – রাত্রির গলিপথ
শহরের মানুষ তখন আর নিছক গুজবের মধ্যে নেই। একের পর এক নিখোঁজ ঘটনার জেরে রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করেছে। রাত নামলেই যেন নগরীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে অদৃশ্য এক আতঙ্ক। দেবাশিস সংবাদপত্রে খবর পেলেন—আরো তিনজন মানুষ হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলল, তারা এক অদ্ভুত কুয়াশার ভেতরে ঢুকে ফেরেনি।
এই কুয়াশার উৎস খুঁজতে বেরোলেন দেবাশিস। সেদিন রাতে তিনি সঙ্গে নিলেন রঞ্জন আর দুজন সহকারীকে। তারা হেঁটে গেল শহরের এক পুরনো গলিপথে, যেটা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। গলিপথটা সরু, দুই পাশে ভাঙাচোরা ইটের বাড়ি, জানালা-দরজা অর্ধেক ভাঙা। রাত তখন গভীর, চাঁদ মেঘে ঢাকা।
তারা যখন মাঝপথে পৌঁছল, তখন হঠাৎই বাতাস স্থির হয়ে গেল। যেন শহরের সব শব্দ একসঙ্গে থেমে গেছে। কুকুরের ঘেউ ঘেউ, পোকামাকড়ের ডাক—কিছুই নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে গলিপথের মাঝখানে ঘনীভূত হতে শুরু করল ধোঁয়ার মতো কুয়াশা।
দেবাশিস লণ্ঠন তুলতেই দেখলেন, কুয়াশার ভেতরে খোলা দরজার মতো এক অদ্ভুত ফাঁক তৈরি হয়েছে। ফাঁকটা আলো শুষে নিচ্ছে, যেন ভেতরে অন্তহীন অন্ধকার। রঞ্জন থমকে দাঁড়িয়ে বলল—“এটাই সেই পথ, স্যার। নগরীর দরজা।”
দেবাশিস কাছে যেতেই ভেতর থেকে ভেসে এল গানের মতো এক সুর—কোনো মানবকণ্ঠ নয়, বরং বহু কণ্ঠ একসঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। তার সহকারীরা আতঙ্কে চিৎকার করে পেছনে সরে গেল।
হঠাৎই একজন বৃদ্ধ ছুটে এলেন পাশের বাড়ি থেকে। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আমার নাতিকে ওরা নিয়ে গেছে! এই দরজার ভেতর দিয়েই মিলিয়ে গেল সে।” বৃদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দেবাশিস এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন, কিন্তু বৃদ্ধের চোখে তখন শূন্য দৃষ্টি—যেন ভেতরের অন্ধকারে তাকিয়ে আছেন।
মুহূর্তেই কুয়াশার ফাঁক তীব্রভাবে ঘূর্ণি তুলল। ভিতর থেকে ঠান্ডা ঝড় বেরোল। রঞ্জনের ঠোঁট থেকে মন্ত্র বেরোতে লাগল, সে নিজের অজান্তেই আওড়াচ্ছিল। দেবাশিস হঠাৎ দেখলেন—ফাঁকের ভেতরে এক ঝলক লাল আলো, আর কয়েকটা ছায়ামূর্তি হাত বাড়িয়ে আছে।
তিনি মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বললেন, “ফিরে যাও!” তারপর লণ্ঠনটা ফাঁকের ভেতরে ছুঁড়ে মারলেন। আলো ছিটকে গিয়ে মুহূর্তেই ঘূর্ণি কেটে গেল। কুয়াশা মিলিয়ে গেল, অন্ধকার আবার স্বাভাবিক হল। সবাই হাঁপাতে লাগল।
কিন্তু বৃদ্ধ তখন মাটিতে পড়ে আছেন, বুক চেপে হাহাকার করছেন—“ওকে ফিরিয়ে দাও, দয়া করে ফিরিয়ে দাও।” দেবাশিস চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি এক নিষিদ্ধ শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
শিবিরে ফিরে তিনি নোটবুকে লিখলেন—
“রাত্রির গলিপথে অন্য জগতের দরজা দেখা গেল। মানুষের অদৃশ্য হওয়ার রহস্য স্পষ্ট। নগরী তার হারানো বাসিন্দাদের ফিরিয়ে আনছে, আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।”
রঞ্জন তখনও ফিসফিস করছে—“এটা কেবল শুরু, স্যার। পরের পূর্ণিমায় নগরী পুরো দরজা খুলবে।”
দেবাশিস জানতেন, শহরের জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে।
পর্ব ৮ – অন্য দুনিয়ার সীমানা
রাত্রির গলিপথের সেই অদ্ভুত দরজার অভিজ্ঞতা দেবাশিসকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তবু গবেষকের মন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আরও গভীরে। তিনি জানতেন, অদৃশ্য হওয়া মানুষগুলো নিছক হারিয়ে যায়নি—তাদের টেনে নেওয়া হয়েছে এক ভিন্ন জগতে। প্রশ্নটা ছিল কেবল একটাই: কীভাবে?
পরদিন সকালে শিবিরে প্রবল অশান্তি। কয়েকজন শ্রমিক দাবি করল, তারা স্বপ্নে দেখেছে নিজেদের শহর নয়, এক অচেনা রক্তমাখা নগরীতে দাঁড়িয়ে আছে। আগুনে মোড়া মন্দির, রক্তের নদী, আর চারদিকে হাহাকার। জেগে ওঠার পরও তাদের শরীর কাঁপছিল। দেবাশিস তাদের শান্ত করলেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁরও বুক হিম হয়ে যাচ্ছিল।
রঞ্জন তখনও অস্বাভাবিক। সে সারাদিন এক কোণে বসে থাকে, রাত নামলেই মন্ত্র আওড়ায়। তার চোখ ফাঁকা, ঠোঁট কাঁপে, আর মাঝে মাঝে অচেনা ভাষায় চিৎকার করে ওঠে। এক রাতে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে বলে উঠল—“ওরা দরজার ওপারে অপেক্ষা করছে। নগরী পুনর্জন্ম পাবে। এই পৃথিবীর আর সময় নেই।”
দেবাশিস তাকে থামাতে চাইলে রঞ্জনের গলা একেবারে অন্য কারও মতো শোনাল। গভীর, গর্জনময় স্বরে সে বলল—“আমাদের রক্ত চাই। প্রতিমা ছাড়া নগরীর পেট ভরবে না।” সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
পরদিন খননের সময় ঘটে গেল নতুন বিপর্যয়। মাটির ভেতর খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে দল হঠাৎই এক গর্তে পড়ে গেল। গর্তের ভেতর থেকে দেখা গেল অন্যরকম দৃশ্য—যেন এক জানলা খুলে গেছে অন্য মাত্রায়। ভিতরে তারা স্পষ্ট দেখল—রক্তে ভেসে যাওয়া নগরী, আগুনে মোড়া মন্দির, কালো ছায়ারা হাহাকার করছে।
এক শ্রমিক চিৎকার করে দৌড়ে পালাতে চাইলে হঠাৎই গর্তের ভেতর থেকে হাতের মতো কিছু বেরিয়ে এসে তাকে টেনে নিল। মুহূর্তেই সে অদৃশ্য। সবাই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। দেবাশিস মরিয়া হয়ে গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করলেন, কিন্তু তাঁর চোখে তখনও ভেসে উঠছিল সেই ভিন্ন জগতের দৃশ্য।
রাতে শহরের আরও কয়েকজন মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেল। সংবাদপত্রে শিরোনাম উঠল—“শহর কি অন্য জগতে ডুবে যাচ্ছে?” প্রশাসন ঘটনাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিল, কিন্তু আতঙ্কে লোকজন ঘর থেকে বেরোতে ভয় পাচ্ছে।
দেবাশিস এবার বুঝলেন, নগরী ধীরে ধীরে তার সীমানা মুছে ফেলছে। পৃথিবী আর অন্য দুনিয়ার মাঝখানে যে দেয়াল ছিল, সেটা ভেঙে পড়ছে। প্রতিমা সেই দেয়ালের চাবিকাঠি। আর রঞ্জন এখন সেই প্রতিমার মাধ্যম।
তিনি নোটবুকে লিখলেন—
“অন্য জগতের সীমানা ফেটে যাচ্ছে। মানুষ অদৃশ্য হচ্ছে মানে তারা ওদিকের নগরীতে টেনে নেওয়া হচ্ছে। নগরীর পুনর্জাগরণ এখন অনিবার্য।”
ভোরের আগে তিনি হঠাৎ ঘুম ভেঙে জানলার বাইরে তাকালেন। দূরে শিবিরের সীমানায় কুয়াশার ভেতর স্পষ্ট দেখা গেল কয়েকটা ছায়া—তারা দাঁড়িয়ে আছে, আর লালচে চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আর সেই ছায়াদের ভেতরে তিনি যেন চিনে ফেললেন অর্ক আর পিয়ালীর মুখ।
তাঁর শরীর কেঁপে উঠল। মৃতরা কি ফিরে আসছে? নাকি তারা অন্য জগত থেকে ডাকছে জীবিতদের?
পর্ব ৯ – যজ্ঞের পুনর্জাগরণ
শহরের মানুষ তখন ভয়ে ঘর থেকে বেরোতে পারছিল না। চারপাশে নিখোঁজ হওয়ার খবর, কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া ছায়ামূর্তি, আর রাত্রির গলিপথের গল্প—সব মিলিয়ে নগরী যেন এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি। ঠিক এই সময় হাজির হল একদল অচেনা মানুষ। কালো পোশাকে মুখ ঢাকা, হাতে লাল কাপড়ে মোড়া পুঁথি আর ধাতব পাত্র। তারা দাবি করল—“আমরা নগরীর রক্ষক। সময় এসেছে যজ্ঞ পুনর্জীবিত করার।”
দেবাশিস প্রথমে ভেবেছিলেন, এরা হয়তো কোনো গোপন ধর্মীয় সম্প্রদায়। কিন্তু যখন তিনি লক্ষ্য করলেন, তাদের মন্ত্রচক্রের প্রতিটি রেখা মুখস্থ, আর কালো প্রতিমার সামনে এসে তারা নিখুঁতভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করছে—তখন তাঁর ভিতরটা কেঁপে উঠল। এরা নিছক মানুষ নয়, এরা সেই প্রাচীন সাধকদের উত্তরসূরি, যারা শহরের পতনের পরও গোপনে বেঁচে থেকেছে।
রাত্রি তখন পূর্ণিমার আগের রাত। প্রতিমার চারপাশে জ্বলে উঠল শত শত প্রদীপ। কালো পোশাকের মানুষগুলো বসে পড়ল মন্ত্রচক্রের ভেতর। ধূপ, রক্ত, আর অদ্ভুত ভেষজের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠল। রঞ্জন যেন তাদের নেতা হয়ে উঠল। তার চোখ পুরো সাদা, আর ঠোঁট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বেরোচ্ছে মন্ত্র।
দেবাশিস মরিয়া হয়ে তাদের থামানোর চেষ্টা করলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, “তোমরা যা করছো, তাতে নগরী ধ্বংস হবে। এটা ইতিহাসে লেখা আছে।” কিন্তু কেউ শোনেনি। বরং এক মুখোশধারী হাসতে হাসতে বলল—“ধ্বংসই তো আমাদের লক্ষ্য। ধ্বংসের ভেতর দিয়েই নগরীর জন্ম।”
মন্ত্রপাঠ তীব্র হয়ে উঠল। প্রতিমার চোখ থেকে ফের লাল আলো বেরোল। সেই আলো এবার সোজা আকাশের দিকে উঠল, আর হঠাৎই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। শহরের ভেতর থেকে কান্না, হাহাকার, আর পশুর মতো ডাক ভেসে আসতে লাগল। বিদ্যুৎ ঝলকে চারপাশ কেঁপে উঠল।
হঠাৎ এক শ্রমিক ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইলে মন্ত্রচক্রের ভেতর থেকে লালচে হাত বেরিয়ে তাকে টেনে নিল। মুহূর্তেই সে অদৃশ্য। সবাই আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল। দেবাশিস ছুটে গিয়ে মন্ত্রচক্র ভাঙার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার দেহ ছিটকে পড়ে গেল একপাশে।
এবার প্রতিমার চারপাশে আগুনের বৃত্ত জ্বলে উঠল। আগুনের ভেতর থেকে ভেসে এল বিকট গর্জন—যেন কোনো প্রাচীন দেবতা জেগে উঠছে। রঞ্জনের ঠোঁট থেকে বেরোল শেষ বাক্য—“অতিথিরা এসেছেন। নগরী ফিরে আসবে।”
আকাশে তখন রক্তাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে। শহরের মানুষ আতঙ্কে জানালা বন্ধ করে প্রার্থনা করতে লাগল। আর দেবাশিস জানতেন, যদি এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়, তাহলে নগরী আবার গিলে নেবে সবকিছু।
তিনি মরিয়া হয়ে নোটবুক খুলে লিখলেন—
“যজ্ঞ শুরু হয়েছে। প্রতিমা সক্রিয়। শহরের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে আজ রাতের ওপর।”
তারপর লণ্ঠন হাতে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন—এ যজ্ঞ তাঁকে থামাতেই হবে, নয়তো শহরের শেষ ভোর আর কোনোদিন আসবে না।
পর্ব ১০ – নগরীর অন্তিম
যজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ণিমার আলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল লাল কুয়াশায়, যেন চাঁদ নিজেই মন্ত্রচক্রের ভেতর আটকা পড়েছে। কালো পোশাকের সাধকেরা একসঙ্গে মন্ত্র আওড়াচ্ছিল, আর প্রতিমার চোখ থেকে আগুনের মতো রক্তাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই আলো শহরের গলিপথে ছড়িয়ে গিয়ে প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি মানুষের শ্বাসকে গ্রাস করছিল।
দেবাশিস জানতেন, সময় আর বেশি নেই। তিনি মরিয়া হয়ে আগুনের বৃত্তের দিকে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু তীব্র ঝড়ে তিনি ছিটকে পড়লেন দূরে। তার নোটবুক মাটিতে পড়ে খুলে গেল, পাতার ওপর লাল আলো ঝলসে উঠল। মনে হল, লেখা অক্ষরগুলো নিজেরাই কেঁপে উঠছে।
রঞ্জন তখন প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গলা আর মানুষের মতো নয়—গভীর, বজ্রধ্বনির মতো। সে ঘোষণা করল—“অন্য জগতের দরজা খুলে গেছে। নগরী ফিরে আসছে।” তার হাত কেটে রক্ত মূর্তির পায়ের কাছে ছড়িয়ে দিল। মুহূর্তেই মাটির নীচ থেকে এক গর্জন উঠল। চারপাশ কাঁপতে লাগল।
শহরের মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বেরোতে লাগল। কেউ দৌড়ে যাচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ প্রার্থনা করছে। কিন্তু পালানোর পথ আর খোলা ছিল না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ একে একে কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। তাদের চিৎকার বাতাসে ভেসে থাকলেও শরীরের কোনো অস্তিত্ব আর পাওয়া যাচ্ছিল না।
দেবাশিস মরিয়া হয়ে প্রতিমার কাছে গিয়ে শেষ চেষ্টা করলেন। হাতে থাকা লণ্ঠন উঁচিয়ে প্রতিমার মাথায় আঘাত করলেন। এক মুহূর্তের জন্য প্রতিমা কেঁপে উঠল, লাল আলো নিভে গেল। মনে হল, যজ্ঞ থেমে গেছে।
কিন্তু ঠিক তখনই ভেতর থেকে বেরোল এক অদৃশ্য বিস্ফোরণ। দেবাশিস ছিটকে পড়লেন। আগুনের বৃত্ত আকাশ পর্যন্ত উঠে গেল। প্রতিমার চোখ থেকে আগুন বেরিয়ে সরাসরি তাঁকে গ্রাস করল। তাঁর শরীর ঝলসে গেলেও তিনি শেষ মুহূর্তে একটাই কথা চিৎকার করে উঠলেন—“ইতিহাস আবার নিজেকে পুনরাবৃত্ত করছে!”
শহর তখন ভয়ঙ্কর দৃশ্যে পরিণত। বাড়িঘর ধসে পড়ছে, মাটির ফাঁক দিয়ে কালো কুয়াশা বেরোচ্ছে, নদীর জল রক্তাভ হয়ে উঠছে। শত শত মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর আকাশে অদ্ভুত ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ এক বিকট শব্দে প্রতিমার চারপাশের জমি ধসে পড়ল। আগুন, কুয়াশা, ছায়া—সব একসঙ্গে গ্রাস করে নিল খননক্ষেত্রকে। মুহূর্তেই পুরো এলাকা মাটির নিচে ডুবে গেল।
ভোরবেলা শহরের মানুষ যখন বাইরে এল, তারা দেখল নগরীর অর্ধেকটাই মাটির নিচে চলে গেছে। রাস্তা, বাড়ি, বাজার—সব ধ্বংসস্তূপে চাপা। খননক্ষেত্র আর নেই, কেবল ফাটল ধরা মাটি। দেবাশিসকেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
সংবাদপত্রের শিরোনাম উঠল—“অর্ধেক শহর মাটির নিচে, রহস্য অমীমাংসিত।” প্রশাসন ঘোষণা দিল ভূমিকম্পের কারণে দুর্ঘটনা। কিন্তু স্থানীয়রা জানল—অভিশপ্ত নগরী আবার জেগে উঠেছিল, আবার মাটির নিচে চাপা পড়ল।
কিন্তু গুজব ছড়াল, রাত গভীর হলে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে শোনা যায় মন্ত্রপাঠ, দেখা যায় লালচে আলো। কেউ কেউ দাবি করল, কুয়াশার ভেতর অচেনা মুখ দেখা গেছে—অর্ক, পিয়ালী, এমনকি দেবাশিসও।
নগরী আবার মাটির নিচে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কতদিনের জন্য—সেই উত্তর আজও অজানা।




