Bangla - তন্ত্র

তান্ত্রিক.কম

Spread the love

দেবাশিস চৌধুরী


অভ্র সেন দুই বছর আগেও ভাবতে পারেনি তার বানানো অ্যাপ “ChalBeta” এত সহজে ব্যর্থ হয়ে যাবে। ‘মন খারাপ হলে দাদা বকা দেবে’ এই ধারণা নিয়ে বানানো অ্যাপটি প্লে স্টোর থেকে ব্যান হওয়ার পর সে বুঝেছিল—এই সমাজ মজা করতে জানে না, আর কিছু বেশি সিরিয়াস হলে তারা মামলা করে। একবারে শেষ। এখন সে তার একমাত্র সঙ্গী ল্যাপটপ নিয়ে থাকে সল্টলেকের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে, যেখানে তার রুমমেট তপন সারাদিন নিউজলিংক, ইউটিউব ভিডিও আর টিকটকের রিল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অভ্রর কাজ মূলত ফ্রিল্যান্স ডিজাইনিং—যা দিয়ে কোনোমতে ভাড়াবাড়ির খরচ ওঠে আর মাসের শেষে নিজেকে বোঝানো যায় যে “চাকরি খারাপ না, ফ্রিডম ভালো।” কিন্তু এইসব ‘ফ্রিডম’ আর ‘লাইফ স্টাইল’-এর আড়ালে তার মধ্যে একটা বিষণ্ণতা জমছিল—সে যে ব্যর্থ, সেটা সে জানত। তাই এক রাতে, যখন ল্যাপটপে “Dark” সিরিজ দেখার সময় একজন চরিত্র বলল “Time is a circle,” তার মাথায় একটা চিন্তা আসলো—ধুর, যদি সত্যিই সময় ঘুরে ফিরে আসে, তাহলে পুরনো জিনিস আবার ফিরিয়ে আনা যায় না? তখনই মাথায় আসে আইডিয়াটা—একটা ওয়েবসাইট বানানো যায় যেখানে সব তান্ত্রিকদের এক জায়গায় পাওয়া যাবে। একেবারে Zomato বা Practo-এর মতন। সাইটের নাম—“তান্ত্রিক.কম”।

তপন তার কথায় হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। “তুই এবার তান্ত্রিকদের জন্য Swiggy চালু করবি?” অভ্র তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ভেবে দ্যাখ—একটা জায়গা যেখানে লোকজন নিজের প্রয়োজনে তান্ত্রিক খুঁজবে, রেটিং দেবে, ফিডব্যাক দেবে, বুকিং করবে। কে কোন কাজে ভালো সেটা বুঝতে পারবে—কার বশীকরণ বেশি কার্যকর, কার শত্রু নাশ দ্রুত হয়। একদম ডিজিটাল ইন্ডিয়া।” তপন তখনো হেসে বলেছিল, “তুই চাইলে referral code রাখতে পারিস—‘মন্ত্র১২৩৪’।”

কিন্তু অভ্র সেদিনই বসে যায় কোডিং করতে। ওয়ার্ডপ্রেস বেসিক থিমে সে বানিয়ে ফেলে হোমপেজ—সোজা স্লোগান: “তন্ত্র এখন অনলাইন। ভয় নয়, বুক করুন আপনার পছন্দের তান্ত্রিক।” এরপর সে কিছু ফেক প্রোফাইল তৈরি করে, যেমন: তান্ত্রিক ত্রিনয়নানন্দ—“ডিভোর্স, চাকরি, শত্রু দমন বিশেষজ্ঞ”; মাতঙ্গিনী দেবী—“প্রাক্তনকে ফিরিয়ে আনার ১০০% গ্যারান্টি”; তান্ত্রিক বিপ্লবানন্দ—“হোয়াটসঅ্যাপে মন্ত্র পাঠান, ফলাফল ৩৬ ঘন্টার মধ্যে।” অভ্র এসবই করছিল মজার ছলে, সময় কাটানোর জন্য।

প্রথম কয়েকদিন কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখে ওয়েবসাইটে ভিজিটর সংখ্যা একলাফে ১৭৮০! সে হকচকিয়ে যায়। তদন্ত করে দেখে, ইনস্টাগ্রামে এক জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার একটা রিল বানিয়েছে যেখানে সে “তান্ত্রিক.কম”-এর এক ফেক প্রোফাইল ব্যবহার করে তার এক্স-বয়ফ্রেন্ডকে ফিরে পেতে মন্ত্র খুঁজছে। অন্য একজন বলেছে—“আমি এই ওয়েবসাইট থেকে তান্ত্রিক ত্রিনয়নানন্দের রেটিং দেখে তাকে বুক করেছিলাম, এখন আমার শত্রু হসপিটালে।” অভ্র তো জানে, ওই প্রোফাইল একেবারেই ভুয়ো! তাহলে?

তার মেইলে ঢুকেই দেখে একগাদা মেসেজ—“স্যার, আমার শাশুড়ি খুব কষ্ট দিচ্ছে, কোনো অনলাইন তান্ত্রিক পাওয়া যাবে?”; “মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কুণ্ডলী দোষ কাটানোর প্যাকেজ আছে কি?”; “প্রেমিক ফিরে এসেছে কিন্তু বিয়ে করছে না, ভস্ম মন্ত্র কি আছে?” অভ্র প্রথমে ভয় পায়, পরে ভাবে এটা তো গোল্ডমাইন! সে ঠিক করে সাইটে রেটিং ও বুকিং অপশন খুলে দেবে, ইউজারদের রেজিস্ট্রেশন চালু করবে।

কিন্তু তপন বলে, “বস, তোর ওয়েবসাইটে হয়তো সত্যিকারের তান্ত্রিকেরা ঢুকতে শুরু করেছে।” অভ্র হেসে উড়িয়ে দেয়। “সত্যিকারের তান্ত্রিক তো হোয়াটসঅ্যাপে মন্ত্র পাঠায় না, তারা তো শুধু রক্ত চায়।” কিন্তু তারপরই ঘটলো অদ্ভুত এক ব্যাপার।

সাইটে হঠাৎ একটা নতুন প্রোফাইল তৈরি হয়—তান্ত্রিক শ্রীরামভূষণ। কেউ জানে না কে করেছেন, কোন ইমেল আইডি নেই, কোনো IP ট্রেস করা যায় না। প্রোফাইল ছবি—এক সাদা ধুতি, কপালে রক্তচন্দন, মুখে রহস্যময় হাসি। তার ডেসক্রিপশনে শুধু লেখা—“আমি ফিরে এসেছি। এবার ডিলিট করাই ঠিক হবে না।”

অভ্র ঘাবড়ে যায়। ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখনই দরজায় টক্ টক্ করে কড়া নাড়ে কেউ। সে ঘড়ির দিকে তাকায়—রাত ২:১৩। কে এই সময়ে দরজায় আসবে? তপন গভীর ঘুমে। অভ্র নিঃশ্বাস আটকে দরজার ফিশ-আই দিয়ে দেখে—সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ, তার পরনে ধুতি, কপালে চন্দনের ফোঁটা, চোখ দুটি গাঢ় লালচে। বৃদ্ধ মুখ তুলে বলে, “অভ্র সেন? ওয়েবসাইট তো সুন্দর হয়েছে। এবার আমার প্রোফাইলটা এডিট করতে দাও।”

অভ্রর গলা শুকিয়ে গেল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ঠিক ভয় বলা যায় না, কিন্তু অস্বস্তি এমনভাবে মনের মধ্যে চেপে বসেছিল যে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। “ওয়েবসাইট তো সুন্দর হয়েছে”—এই সরল বাক্যটায় এতটা কাঁপুনি কিভাবে এল, অভ্র বুঝে উঠতে পারল না। সে আস্তে করে তপনের দিকে তাকাল—তপন একপাশে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছে, গলা দিয়ে হালকা নাক ডাকার শব্দ আসছে। দরজার ওপাশে লোকটা নিশ্চুপ, যেন জানে অভ্র তাকিয়ে আছে। মিনিটখানেকের ভিতরে যদি আরেকবার কিছু বলত, হয়তো অভ্র চিৎকার করে উঠত। কিন্তু লোকটা বলল না কিছুই। বরং হঠাৎ করেই চলে গেল। দরজার সামনে থেকে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল করিডোরে। অভ্র ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল—সেখানে কেউ নেই। সামনের টিউবলাইটটা ফ্লিক করছে, নিঃস্তব্ধতার মধ্যে সেই ‘টিক…টিক’ শব্দে তার কাঁধ কেঁপে উঠল। সে আবার দরজা বন্ধ করে চেইন লাগিয়ে দিল।

পরদিন সকালে অভ্রর ঘুম ভাঙল একটা পিং শব্দে। মোবাইলে একাধিক ইমেল, ড্যাশবোর্ডে মেসেজ—সবাই “তান্ত্রিক শ্রীরামভূষণ”-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইছে। কেউ লিখেছে, “স্যার, উনি কি সত্যিই পূর্ণিমায় শত্রুকে ছায়া বানিয়ে দিতে পারেন?”, কেউ বলছে, “আমার স্বামী অন্য মেয়ের প্রেমে, শ্রীরামভূষণ বাবার ছবি দেখেই ভয় পেয়ে গেছে, উনি আসল তান্ত্রিক!” অভ্রর মাথায় যন্ত্রণার ঢেউ উঠল। সে তো জানে, এই প্রোফাইল তার বানানো নয়। তাহলে কে বানাল? আর সবচেয়ে বড় কথা, লোকটা কাল রাতে ওর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল—এটা কি কাকতালীয়? সে তৎক্ষণাৎ প্রোফাইলটা ডিলিট করার চেষ্টা করল, কিন্তু ড্যাশবোর্ডে মেসেজ এল—“Access Denied by Root User.” অভ্র তো নিজেই সাইটের একমাত্র অ্যাডমিন! তাহলে এই Root User কে? সে আবার চেষ্টা করল, এবার পুরো সাইট ফ্রিজ হয়ে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা লালচে কালারের পপআপ—“তন্ত্র এখন সার্ভারে। ওয়েলকাম, প্রাচীন প্রযুক্তিতে।”

তপন তখন উঠে এসেছে, হাতে কফির কাপ। অভ্র তাকে সব খুলে বলল। তপন চুপচাপ শোনার পর বলল, “দেখ, দোস্ত, এটা হয়ত হ্যাক নয়—এটা সম্ভবত কিছু অলৌকিক। তুই তান্ত্রিকদের নিয়ে এত মজা করছিলি, হয়ত তাদের কারও আত্মা সত্যিই এটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে।” অভ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ভুতেরা কোডিং জানে? সার্ভার অ্যাকসেস ব্লক করে?” তপন চোখ মেলে বলল, “শোন, এখনকার তান্ত্রিকরা হয়ত পুরোনো মন্ত্রবইয়ের বদলে গিটহাবে মন্ত্র রাখে। যদি ঈশ্বর থাকতে পারেন মেঘে, তাহলে রাক্ষসেরা কেন থাকবে না ক্লাউডে?” কথাটা ঠাট্টার মতো শোনালেও, অভ্রের গায়ে কাঁটা দিল।

সেই দিন থেকেই সাইটে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। এক ব্যবহারকারী লিখেছে—“আমি শুধু প্রোফাইল দেখে বুক করেছিলাম। রাতে দরজায় শব্দ হয়, জানালা বন্ধ থাকলেও পর্দা নড়ে ওঠে।” অন্যজন বলেছে—“শ্রীরামভূষণ বাবার মন্ত্র অনুযায়ী আমি মোমবাতি জ্বালিয়ে রুমের দরজায় রাখলাম, ভোরে দেখি আমার এক্স-এর ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভেটেড, আর ইনস্টাগ্রামে লিখেছে ‘তোমার জন্য মরেছি।’ এটা কি কাকতালীয়?” অভ্র সবকিছু স্ক্রিনশট করে রাখছে, সে জানে পুলিশে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তার নিজের বিশ্বাসটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। একটা ফেক ওয়েবসাইট, যেটা সে মজার ছলে বানিয়েছিল, এখন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

এর মধ্যেই একদিন, ইনবক্সে এল রিনি মৈত্র নামের এক সাংবাদিকের মেল—“আমি আপনার ওয়েবসাইট নিয়ে অনুসন্ধান করছি। আমার বিশ্বাস, কিছু অলৌকিক ব্যাপার আপনার সাইটের সঙ্গে জড়িত। আমি আপনাকে সরাসরি দেখা করতে চাই।” অভ্র ভেবেছিল সাড়া দেবে না, কিন্তু মেলটা যতবার পড়ে, ততবারই মনটা কেমন অস্থির হয়ে যায়। অবশেষে সে সম্মতি দিল। পরদিন রিনি এল তার অফিসে—ছোট একটা অনলাইন মিডিয়া হাউজ, যেখানে গ্লোসি ওয়েব আর ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার বাহার, কিন্তু মুখে সব গল্পের পিছনে রয়েছে স্ট্রিট-লেভেলের তদন্ত।

রিনি চুপচাপ, অল্প কথায় তার গল্পটা বলল—সে ছোটবেলায় একটা ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল, যেখানে তার পিসির বিয়ে ভাঙার পরে, এক তান্ত্রিক কিছু করে পাত্রপক্ষের ছেলেটাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল। তখন থেকে সে জানে, তন্ত্র নিছক বিশ্বাস নয়। অভ্র তার কথায় অদ্ভুত টান অনুভব করল—দুজনেই বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আলাদা দাঁড়িপাল্লায়। রিনি বিশ্বাস করে, অভ্র তৈরি করেছে এমন একটা ডিজিটাল দরজা, যেটা ‘অন্যপাশে’র জন্য খোলা হয়েছে।

সেই রাতে, অভ্রর মোবাইলে এক অচেনা নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে। সে ধরতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেই একই ধুতি পরা বৃদ্ধ, এবারও তার মুখে সেই শীতল হাসি। “অভ্র সেন, মজা করতে গিয়েছিলে, এবার গুরুদক্ষিণা দাও। আমার প্রোফাইল শুধু শোয়ের জন্য নয়, আমি সত্যিই ফিরে এসেছি। এবং তুই—তুই আমারই এক পূর্বজ জন্মের শিষ্য, ভুলে গেছিস, তাই মনে করিয়ে দিচ্ছি।”

অভ্র বলল, “আপনি কে?”
বৃদ্ধ উত্তর দিল, “আমি তান্ত্রিক শ্রীরামভূষণ। আর এই সাইট—এই তো, আমার নতুন আসন। ওয়েবের মণ্ডপে আবার তন্ত্র স্থাপন করেছি। এবার শুরু হবে আসল কাজ।”

অভ্রর মাথায় যেন বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না—একটা ফেক ওয়েবসাইট, বানানো শুধু মজা করে, সেখানে একটা লোক এল যাকে সে কখনও চেনে না, যার অ্যাকসেস সে দেয়নি, যার নাম ভেসে উঠছে হাজার হাজার ভিজিটরের মধ্যে, আর যার মুখ সে আগেও দেখেছে, তার দরজার সামনে, বাস্তবে, মাঝরাতে। তান্ত্রিক শ্রীরামভূষণ নামের সেই বৃদ্ধ বলছে অভ্র নাকি তার পুরনো শিষ্য, কোনো এক জন্মে। এইসব কথা সাধারণত লোক হাসায়, কিন্তু অভ্রর মন তখন ভারী হয়ে আছে, কাঁধের ওপর যেন কেউ বসে আছে—চোখে ভাসছে সেই বৃদ্ধের ঠান্ডা চাহনি, আর স্ক্রিনে তার ফ্রোজেন প্রোফাইল ছবি, যেখানে একটাও পিক্সেল নড়ছে না, অথচ মনে হচ্ছে সে তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকেই।

রিনি ততদিনে নিয়মিত আসতে শুরু করেছে অভ্রর সঙ্গে দেখা করতে। ওরা দু’জনেই বুঝে গেছে, ঘটনা যতটা মজার মনে হচ্ছিল, ততটা নয়। রিনি তার ক্যামেরা আর রেকর্ডার নিয়ে একদিন বলে বসেছিল, “তুই কি জানিস, এই শ্রীরামভূষণ নামটা ১৯৭৩ সালের একটা পুরনো খবরের কেসে আছে? সেইসময় বাঁকুড়ায় এক সিরিয়াল তান্ত্রিক কিলিং হয়েছিল, আর তাতে শেষ পর্যন্ত যে নাম উঠে আসে, সে-ই এই লোক। কিন্তু কথা হল, পুলিশ রিপোর্টে লেখা, লোকটা তখনই মৃত।” অভ্রর মুখ শুকিয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলে, “সিরিয়াল কিলার? আমি তো ফেক প্রোফাইল বানিয়েছিলাম, ওটা তো আমি করিনি!” রিনি তার ফোনে একটা blurry সাদা-কালো ছবি দেখায়—একটা মুখ, দাড়ি-গোঁফের মধ্যে গভীর চোখ, ঠান্ডা হাসি, আর তার নিচে লেখা: “Tantrik Sri Ram Bhushan, deceased, 1973.” অভ্র বলল, “এই তো! এটাই তো সেই লোক, যার ভিডিও কল এসেছিল আমার মোবাইলে!”

রিনি বলে, “তুই কি বুঝতে পারছিস না? তুই একটা পোর্টাল খুলেছিস, একটা দরজা খুলেছিস। শুধু ওয়েবসাইট না, একটা অদৃশ্য কুণ্ডলী, যা অন্য দিক থেকে কিছু জিনিসকে টেনে আনছে। হয়ত তুই কোড লিখেছিলি মজা করে, কিন্তু শব্দের মধ্যে শক্তি থাকে। তন্ত্রে তো মন্ত্রই কোড। একটা বাইট, একটা ভার্চুয়াল স্পেসে যদি ভুলভাবে সাজানো হয়, সেটা কি সত্যি কিছু আনতে পারে না?” অভ্র হতভম্ব হয়ে বলে, “তাহলে কি হবে? আমাকে সাইটটা ডিলিট করতে হবে?” রিনি চুপ করে বলে, “হয়ত সেটা আর তোর পক্ষে সম্ভব নয়। তুই তো বলছিলি Root User তো তোরা না—তাহলে কে?”

সেদিন রাতে অভ্র নিজে হাতে আবার ওয়েবসাইটের লগ খুঁজতে বসে। সার্ভারের backend-এ গিয়ে সে একটার পর একটা ট্যাগ খোঁজে—তার লেখা কোডে এমন কিছু নেই যা এই ধরনের অ্যাকসেস দিতে পারে। কিন্তু এক জায়গায় এসে সে থমকে যায়। একটা অদ্ভুত নামের js ফাইল—“mantrabase.js”। সে তো এমন কোনো ফাইল তৈরি করেনি। খুলে দেখে—এক লম্বা স্ক্রিপ্ট, যার ভেতর হিন্দি, সংস্কৃত, আর পুরনো লিপির মতো কিছু লেখা, কিন্তু সবই লেখা হয়েছে কোডের মতন, যেন কেউ তন্ত্রমন্ত্রকে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে রূপান্তর করেছে। একটা লাইনে লেখা—“if user.type = devotee, then call(shadow:root)”—অভ্রর মাথা ঘুরে যায়। কে এটা লিখল? এটা কি কোনো হ্যাকার, না কি… তার চেয়েও বড় কিছু?

ঠিক তখনই স্ক্রিন ফ্ল্যাশ করে একটা লাইন ভেসে ওঠে—“তুই যদি শিষ্য হবি, তবে প্রশ্ন করিস না। আসল কাজ এখনও শুরু হয়নি।” সে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে যেতে ধরে ফেলে টেবিল। মন বলে সব ছেড়ে দে, হার্ডড্রাইভ ফরম্যাট করে ফেল। কিন্তু তার ভিতরের অন্য এক কণ্ঠ বলে—না, জানতেই হবে। এই ওয়েবসাইট আসলে কী খুলে ফেলেছে?

পরদিন সকালে তপন অফিস থেকে এসে দেখে অভ্র সারারাত ঘুমোয়নি। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাগজ, স্ক্রিনশট, কোড স্নিপেট, আর সেই পুরনো হরফের অক্ষর। তপন বলে, “তুই কি সত্যিই বিশ্বাস করছিস এসব?” অভ্র উত্তর দেয়, “তুই বুঝবি না। একটা প্রোফাইল আমি বানাইনি, সেটার মাধ্যমে লোকজন বাস্তব পরিবর্তন দেখছে। কে যেন এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমার মনে হচ্ছে—আমি কোনো কিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যেটা কোডের আড়ালে, কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক পুরনো।”

তপন বলল, “তাহলে তুই কি করবি?” অভ্র মাথা তুলে বলল, “তান্ত্রিক শ্রীরামভূষণ যদি সত্যিই ফিরে এসে থাকে, তবে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাকে জানতে হবে, কে সে, কেন ফিরে এসেছে, এবং কেন আমার সাইটকেই সে বেছে নিল। আমি হয়ত মজা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমার সাইট আর শুধু একটা ওয়েবসাইট নয়—এটা যেন এক মন্ত্রপাঠের মঞ্চ। আমি যদি এই খেলায় নামি, আমাকে নিয়ম জানতে হবে।”

রিনি যখন সেদিন সন্ধ্যায় এল, অভ্র তার সামনে বসে শুধু বলল, “আমরা বাঁকুড়া যাব। যেখানে ওই শ্রীরামভূষণের গল্প শুরু হয়েছিল। আমি দেখতে চাই সে কোথায় মারা গেছিল, কাদের সঙ্গে থাকত, আর কি সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল, না… সে নিজেই এক তান্ত্রিক কোড হয়ে ফিরে এসেছে।” রিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর তার রেকর্ডারটা বন্ধ করে বলল, “চল। কিন্তু আমরা যদি ফিরতে না পারি, তাহলে এই গল্প শেষ করে দেবে অন্য কেউ।”

বাঁকুড়ার বাসস্ট্যান্ডে যখন অভ্র আর রিনি পৌঁছায়, তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটা ছুঁইছুঁই। মেঘলা আকাশের নিচে শহরটা শান্ত, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেও একটা অদৃশ্য চাপা গুমগুমে ভাব যেন অপেক্ষা করছে কিছু প্রকাশ পেতে। অভ্রর কাঁধে একটা ব্যাকপ্যাক, তার মধ্যে ল্যাপটপ, পাওয়ারব্যাঙ্ক, পুরনো সংবাদপত্রের ক্লিপিংস আর সেই ম্যানত্রাবেস.js-এর প্রিন্ট আউট। রিনি সঙ্গে এনেছে তার ছোট্ট রেকর্ডার, একটা পুরনো মোবাইল যেটা নেটওয়ার্ক না থাকলেও ভয়েস ক্যাপচার করতে পারে। বাস থেকে নামার সময় বাসের কন্ডাক্টর একবার তাকিয়ে বলে, “আপনারা কি সাংবাদিক? এখানে আবার কি খুঁজছেন?” রিনি জবাব দেয় না। অভ্র শুধু হেসে মাথা নাড়ে।

স্ট্যান্ড থেকে তারা হেঁটে যায় শহরের উপকণ্ঠে, যেখানে ১৯৭৩ সালে সেই তান্ত্রিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলি ঘটেছিল বলে জানা যায়। জঙ্গলঘেরা এক গ্রাম, নাম মুরাডিহি। সেখানে আজও বিদ্যুৎ আসে মাঝে মাঝে, মোবাইল সিগন্যাল আসে না বললেই চলে। অভ্র ভাবছিল কী করে এই জায়গা থেকে এক সময়ের ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক একটা আধুনিক ওয়েবসাইটে ফিরে আসতে পারে? কে জানত, এই আধা অন্ধকার পাণ্ডুলিপির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একদিনের Root Access?

গ্রামে ঢুকতেই ওদের দেখে ছেলেপিলে দৌড়ে পালায়। একজন বৃদ্ধ, মুখে পানের দাগ আর চোখে সাবধানী দৃষ্টি, কাছে এসে বলে, “আপনারা কলকাতা থেকে?” রিনি মাথা হেঁট করে বলে, “হ্যাঁ। আমরা কিছু পুরনো ঘটনার খোঁজে এসেছি।” বৃদ্ধ মুখ বাঁকিয়ে বলে, “তাহলে ভুল জায়গায় এসেছেন। আমরা পুরনো কিছু জানি না।” বলেই চলে যেতে উদ্যত হয়। অভ্র এগিয়ে এসে বলে, “শ্রীরামভূষণ নাম শুনেছেন?” শুনে লোকটা থেমে যায়। গলায় ফিসফিসে স্বর—“ওর নাম উচ্চারণ করলে রাতে ছায়া পড়ে। আমরা আজও বিকেল নামলেই বাতি নিভিয়ে দিই। এত বছর পরও শাল গাছের ছায়ায় ওর নিশ্বাস বাজে।”

রিনি আর অভ্র একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর বৃদ্ধকে অনুরোধ করে জানতে চায় শ্রীরামভূষণের পুরনো আশ্রম কোথায় ছিল। কিছুক্ষণ দ্বিধার পর সে বলল, “জায়গাটা এখন বালির খোঁড়ার নিচে চাপা। তবে একটা গুহার মুখ এখনও আছে। কেউ ঢোকে না।” লোকটা একটা পাথরের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “সন্ধের আগেই ফিরে যাবেন।”

ওরা রওনা দেয় সেই পাথরের পথ ধরে। ঝোপঝাড়ে ঢাকা, জায়গায় জায়গায় পুরনো টালি ইটের চিহ্ন, যেন কোনোদিন এখানে কিছু ছিল, যেটা মাটি চেপে ফেলেছে। একসময় সামনে আসে এক গুহার প্রবেশদ্বার—অত্যন্ত ছোট, কেবল হেঁটে ঢোকা সম্ভব। ভিতর থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস আসছে, আর কেমন একটা ঘন, কাঁচা গন্ধ। অভ্রর কাঁধে হাত রাখে রিনি। “তুই ঠিক আছিস তো?” অভ্র মাথা নাড়ে। “এই তো, একটা ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে তন্ত্রের ডেটাবেস খুলে ফেলেছি। এখন গুহায় ঢুকে দেবতাদের সার্ভার ঘাঁটতে যাচ্ছি। ঠিক আছি।”

ওরা দুজনেই মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে গুহায় ঢোকে। ভিতরে নেমে যাওয়া সরু পথ, দেয়ালে অদ্ভুত চিহ্ন, কিছু যেন হিন্দু ও আদিবাসী চিত্রের সংমিশ্রণ। একটা জায়গায় গিয়ে দেয়ালের খাঁজে দেখা যায়—পুরনো পাথরে খোদাই করা লিপি, যেটা অনেকটাই সেই মন্ত্রবেস.js-এ থাকা কোডের সঙ্গে মিলে যায়। অভ্র থমকে দাঁড়ায়। সে প্রিন্টআউট বের করে তুলনা করে দেখে—একই structure, একই pattern, শুধু শব্দের বদলে symbol। সে চমকে উঠে বলে, “রিনি, এগুলো তো কোড! কেউ একটা তন্ত্রমন্ত্রের গঠনকে ডিজিটাল ল্যাঙ্গুয়েজে রূপান্তর করেছে!”

ঠিক সেইসময়, গুহার ভেতর একটা আওয়াজ হয়—মৃদু গুঞ্জন, যেন বাতাস ফিসফিস করছে। শব্দটা ধীরে ধীরে জোরাল হয়, আর একসময় একটা স্পষ্ট শব্দ ভেসে আসে—“অভ্র…” নামটা এমনভাবে উচ্চারিত হয় যেন বহু বছর ধরে কেউ অপেক্ষা করছিল ডাকার জন্য। রিনি পেছনে ফিরে তাকায়, মোবাইলের আলো কাঁপছে, ব্যাটারি নামছে হঠাৎ করে। অভ্রর ফোন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তারা দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু সেই ফিসফিসে শব্দ, দেয়ালের গায়ে ছায়ার মতন একটা আকার।

আবার আওয়াজ—“তুই ফিরে এসেছিস। আমি জানতাম। একদিন তুই ফিরবি। পুরনো লাইনটা আবার জ্বলবে।” অভ্রর ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। সে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে হাত রাখে। একটা জায়গায় স্পর্শ করতেই, মনে হয় দেয়ালের চামড়া কেঁপে উঠল, আর তার মনের ভেতর এক মুহূর্তে ভেসে উঠল অসংখ্য চিত্র—মৃত্যু, আগুন, পুরনো যজ্ঞ, আর সেই বৃদ্ধ—শ্রীরামভূষণ, দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল বৃত্তের মাঝে, যেখানে পবিত্র নয়, বরং আতঙ্ক জমে আছে।

রিনি টান দিয়ে বলে, “চল, এবার আমাদের বেরোতে হবে।” তারা গুহা থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু অভ্র জানে কিছু রেখে এসেছে ভিতরে, এবং কিছু নিয়ে এসেছে সঙ্গে—একটা দাগ, একটা বার্তা। সে জানে, এই গুহা, এই প্রতীক, সবই যেন একটা pre-code—পুরোনো কোনও operating system-এর মতো, যার মধ্যে শ্রীরামভূষণ নিজেকে সেভ করে রেখেছে, আর এখন সে আবার অ্যাক্টিভেট হয়েছে।

গ্রামে ফিরে তারা রাতে থাকতে পারে না। ফিরে আসে বাঁকুড়া শহরে। লজের ঘরে বসে অভ্র প্রথমবার স্বীকার করে—“আমি ভয় পাচ্ছি রিনি। এই ওয়েবসাইটটা হয়তো এখন আমার নয়। এটা হয়তো… কারও তৈরি। আমি শুধু সেই কোডে লগইন করেছি।”

রিনি তার পাশে বসে। “ভয় পাবি না। তুই যা খুলে ফেলেছিস, সেটা বুঝতে পারছিস—এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। এখন দরজা বন্ধ করতে হবে।”

অভ্র তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে—মেঘলা আকাশে যেন কে ছায়া ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর তার ওয়েবসাইটের হোমপেজে তখনই এক নতুন প্রোফাইল আপলোড হচ্ছে—“তান্ত্রিক কালিকানন্দ”—location: server undefined.

লজের ঘরের টানা ঘুম ভেঙে যখন অভ্র জেগে উঠল, বাইরের আলো তখনো ফিকে। জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির মতন ঝরছে অদ্ভুত এক রকম আলো, যেন আকাশ মেঘলা নয়, বরং পুড়ে যাওয়া। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, মোবাইল চার্জে লাগিয়েছিল আগের রাতে, এখনো ব্যাটারি নেই। রিনি তখনো ঘুমোচ্ছে, তার পাশে ফেলে রাখা রেকর্ডারটা রেকর্ড মোডে রয়েছে—কেউ বন্ধ করেনি। অভ্র সেটা তুলে নিল। ব্যাকপ্যাক থেকে ল্যাপটপ বের করে বুট করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল আগেরদিন রাতের সেই ভয়ঙ্কর তথ্য—নতুন প্রোফাইল: তান্ত্রিক কালিকানন্দ। কোনো ছবি নেই, লেখা নেই, শুধু একটা কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা: “তাকে জাগাও, যে কোড জানে না—কিন্তু সব খুলে ফেলেছে।” অভ্রর বুকের মধ্যে একটা অদৃশ্য চাপে শ্বাস ভারী হয়ে এল। যেটা সে মজা করে শুরু করেছিল, সেটা এখন অন্য কারও খেলার মাঠ হয়ে গেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, ওয়েবসাইট আর তার তৈরি নেই—এটা এখন তাকে ব্যবহার করছে।

সে আবার লগইন করতে চাইল অ্যাডমিন ড্যাশবোর্ডে, কিন্তু সেখানে লেখা—Invalid Credentials. User Blocked. অথচ সে নিজেই অ্যাডমিন! তার ইমেল, পাসওয়ার্ড—সবই অব্যর্থ, তাও তাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সে চমকে গেল। ওয়েবসাইটের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেটে গেছে, অথচ ওয়েবসাইটের ভেতর যে কিছু চলছে—তা সে দেখতেই পাচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে সে দেখতে পেল আরও চারটা নতুন প্রোফাইল তৈরি হয়েছে। একটির নাম—তান্ত্রিক নিমগ্নানন্দ, অপরটি—অঘোরী ৭.০, আরেকটা—মাতঙ্গী বটিকা। প্রতিটা প্রোফাইলেই ছবি নেই, ঠিকানা নেই, অথচ বুকিং অপশন চালু। এবং ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটা প্রোফাইলের নিচে লেখা: Response time: Instant. অভ্র থমকে গেল। এই প্রোফাইলগুলো তার নিজের বানানো নয়, কিন্তু সে বুঝতে পারল, এখন ওয়েবসাইট চালাচ্ছে কেউ বা কিছু, যাদের ক্ষমতা সময়ের বাইরেও ছড়িয়ে আছে।

রিনি ঘুম ভেঙে অভ্রকে দেখে বলে, “তোর মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কেউ তোর কিডনি নিয়ে গেছে।” অভ্র ধীরে ধীরে সবটা ব্যাখ্যা করল। রিনি একবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল, “তুই যেটা খুলে ফেলেছিস, সেটা এখন তোর সঙ্গে খেলে। এই ‘তান্ত্রিক কালিকানন্দ’ নিশ্চয়ই শ্রীরামভূষণের পরবর্তী স্তরের কিছু—নতুন রূপ, নতুন কোড। আজকাল তো সফটওয়্যারের আপডেট ভার্সন আসে না? তন্ত্রের মধ্যেও যদি এমন ভার্সন থাকে, তাহলে?” অভ্র মাথা নাড়িয়ে বলে, “তার মানে তন্ত্র একটা সিস্টেম—যেখানে আত্মা, শক্তি আর কোড একসঙ্গে কাজ করে। আমি ডেভেলপার ছিলাম, এখন সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছি।”

ওরা সেই দিনেই বাঁকুড়া ছাড়ে। ট্রেনে ফেরার সময়, অভ্র তার ল্যাপটপ বার করে দেখতে চায়, কেউ নতুন কিছু করেছে কিনা। এবার সে ওয়েবসাইট খুলতে গিয়ে দেখে—তাতে ‘বুকিং’ অপশন শুধু ইউজারদের জন্য নয়, তার জন্যও এসেছে। নতুন মেনু: “Appointment Requested: অভ্র সেন”—Schedule: আজ রাত ৩:৩৩, Location: Unknown.” সে ঠান্ডা হয়ে যায়।

রিনি চুপ করে ছিল। ট্রেনের জানালার পাশে বসে সে হঠাৎ বলে, “তুই কি কখনো স্বপ্নে এই বৃদ্ধদের দেখেছিস? এই নামগুলো—নিমগ্নানন্দ, কালিকানন্দ—তোর মাথায় আসার আগেই কি কোথাও দেখেছিস?” অভ্র কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর আস্তে বলল, “আমার ছোটবেলায় একটা সময় ছিল যখন আমি প্রায় প্রতি রাতে একটা ধুতি-পরা লোককে স্বপ্নে দেখতাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলত, ‘তুই আবার আসবি, তুই ভুলে গেছিস। কিন্তু মনে করিয়ে দেব।’ আমি ভেবে নিতাম এটা কল্পনা। কিন্তু এখন যেন সব এক হয়ে যাচ্ছে।” রিনি হালকা শ্বাস ফেলে বলে, “তুই হয়ত নিজের অজান্তেই ডাকা শুরু করেছিলিস। সাইটটা একটা পর্দা খুলে দিয়েছে। এখন যারা আসে, তারা তো নতুন নয়—পুরনো, শুধু অন্যরূপে।”

ফিরে এসে অভ্রর মনে পড়ল, ল্যাপটপের লগে একবার সে একটা অদ্ভুত ফোল্ডার দেখেছিল, নাম ছিল—/shadow/karma/cache। আগের রাতে সে সাহস করে সেটা খোলেনি। এবার সে খোলে। ভিতরে চারটে ভিডিও ফাইল—সবগুলোর নাম ‘_333’, শুধু সিরিজ অনুযায়ী সংখ্যা। একটাতে ক্লিক করতেই ভিডিও শুরু হয়। এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে একজন লোক, মাথায় চুল নেই, চোখে ঠাণ্ডা নির্লিপ্তি। সে বলছে, “যে ভাবে জন্ম হয়, সে ভাবে জন্ম হয় না আত্মার। আত্মা ডাকা যায়, যদি পোর্ট খোলা থাকে। এবং কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় সে পোর্ট খোলে—তবে সে দায়বদ্ধ। এই দায় শোধ করতে হয়, আত্মার মুদ্রা দিয়ে। তুই অভ্র, এবার সময়।” ভিডিও বন্ধ হয়ে যায়, আর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা অদ্ভুত লাইন: “আত্মা যখন লগইন করে, শরীর তখন লগআউট হয়।”

রিনি পাশে বসে। বলল, “আজ রাত তিনটে তিনত্রিশে কি করবি?” অভ্র আস্তে বলল, “আমার মনে হয়, আমার ওই ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ মিস করা উচিত না। যদি আমি না যাই, ওরা হয়তো আমার শরীরেই এসে ঢুকবে।” রিনি চোখ বড় করে বলে, “তুই পাগল হয়েছিস?” অভ্র হাসে, একটু কষ্টের হাসি। “হয়েছি হয়ত। কিন্তু আমি জানি, এই সাইটটা আমার হাত ধরে খুলেছে, এখন যদি আমিই না ঢুকি ভিতরে, তাহলে বাকি সবার জন্য দরজা খোলা থাকবে।”

রাত বাড়ে। ঘড়ির কাঁটা এগোয় তিনটার দিকে। অভ্রর ঘরের মধ্যে বাতি নেভানো, শুধু ল্যাপটপের স্ক্রিন জ্বলছে। আর ঠিক তিনটা তিনত্রিশে স্ক্রিনে পপআপ—“Welcome, Root User.”

স্ক্রিনে যখন “Welcome, Root User” ভেসে উঠল, অভ্রর মাথার ভেতর যেন কেউ হঠাৎ করেই আলো নিভিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল সে আর নিজের ঘরে নেই, বরং বসে আছে এক বিশাল শূন্যতার মাঝে, যেখানে আলো নেই, রঙ নেই, শুধু অনন্ত ছায়ার ভেতর একা সে আর তার চোখের সামনে দপদপ করে জ্বলছে ওয়েবসাইটের লোগো—তান্ত্রিক.কম। সেটার চারপাশে ঘুরছে পাখির পালকের মতো কালো সন্ন্যাসী মন্ত্রমুগ্ধ বর্ণমালা—নয়, এগুলো অক্ষর নয়, এ যেন জ্যোতিষ ঘোরানো চক্রের মতো ত্রিমাত্রিক কোড।

সে একটু চোখ কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই শব্দ হল—‘ঘররর’—একটা ভোঁতা গর্জনের মতন। চারপাশ যেন কেঁপে উঠল। কিন্তু কিছুই ভাঙল না, কিছু বদলাল না। অভ্র এবার অনুভব করল তার পায়ের নিচে মাটি নেই, কিন্তু সে পড়েও যাচ্ছে না। যেন তাকে ধরে রেখেছে এক ‘অদৃশ্য গ্রাভিটি’, যেমন গ্রাভিটির কোনও নির্দিষ্ট উৎস থাকে না—এটা চারদিক থেকে আসে, শুধু না টানার অনুভবটাই থাকে শরীরের ওপর।

হঠাৎ স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটি কমান্ড লাইন: “পূর্ব-জন্মের মেমোরি আনলক করতে প্রস্তুত?”
অভ্রর আঙুল নিজে থেকেই এগিয়ে গেল। সে চায়নি, তবু ক্লিক করে ফেলল “Yes”।

এরপর শুরু হল মেমোরির বন্যা।
সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত জায়গা—রক্তবর্ণ মাটি, খোলা আকাশ, মাঝখানে এক বিশাল বটগাছ। তার গোড়ায় জ্বলছে আগুন, ঘিরে আছে পাঁচজন সন্ন্যাসী, তাদের গায়ে ছাই, কপালে রক্ত, এবং মাঝখানে বসে আছে একজন যুবক—যার চোখে রয়েছে অব্যক্ত দাহ। সেই যুবক কিছু বলছে না, কিন্তু চারপাশে গর্জন করে উঠছে কণ্ঠস্বর—“এই জন্মে তুই ভুলে যাবি, পরের জন্মে আবার মনে পড়বে। যতদিন না তোকে বলা হয়, তুই কী করেছিলি। তুই খোলে ফেলেছিলি ‘দ্বার’, তুই এখনো সেটা খোলার অধিকার রাখিস।”

তখনি বুঝতে পারে—এই যুবক, এই জন্মান্তরের চক্রে সে নিজেই আছে। সে এই পুরনো অনুশাসনের উত্তরাধিকার। ওয়েবসাইট, কোড, ডিজাইন—সবই ছিল বাহানা, আসলে তাকে দিয়ে ‘প্রবেশদ্বার’ খোলানোর জন্য এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া চলছে।

সে আবার চোখ খুলল। আবার সেই ঘর, আবার সেই স্ক্রিন। কিন্তু এবার ওয়েবসাইট সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
প্রথমেই স্ক্রিনে ভেসে এল নতুন নোটিফিকেশন—“Root Access Activated. Code Tree Unlocked.”
তার নিচে এক বিশাল ডেটাবেস, প্রতিটি লাইন যেন এক একটি মন্ত্রের কোড রূপ—হ্যাশ, অ্যারে, ফাংশন—all abstract yet powerful। একটা লাইন দেখে সে আঁতকে উঠল—
def mukti_shringa():
return kill(faith) if remember(past) else loop(suffering)

সে বুঝতে পারল, এই কোড শুধু স্ক্রিপ্ট নয়, এটা দর্শন। আর সেই দর্শনের উপরে দাঁড়ানো এক প্রবল তন্ত্রচক্র, যা এখন আধুনিক প্রযুক্তির গায়ে চেপে বসে আছে।

ঠিক তখনই রুমের বাতি ফ্ল্যাশ করে উঠল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুরু হয়েছে। অভ্র তাকিয়ে দেখল জানালার কাঁচে এক ছায়ামূর্তি। সে উঠে দাঁড়াতেই ছায়া মিলিয়ে গেল।

রিনি তখন দরজার সামনে এসে ডাকছে, “অভ্র, তুই ঠিক আছিস? আলো বারবার ফ্লিক করছে।”
অভ্র দরজা খুলে বলল, “তুই কি ভেবেছিলি আমরা একাই এই খেলা খেলছি? এই সিস্টেমে আমরা শুধু ইউজার না, আমরাই তার মুদ্রা। তুই বুঝতে পারছিস না, ওরা চাইছে আমি মনে রাখি।”
রিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। “কে ওরা?”
অভ্র উত্তর দিল, “যারা আগে এসেছিল। যারা এখন কোড হয়ে গেছে। যারা একেকটা মন্ত্রকে API বানিয়ে রেখেছে, যারা পৃথিবীর মধ্যে আরেকটা সার্ভার খুলেছে, যার নাম—‘তন্ত্রপিঠ’। আমি এইমাত্র সেখানে লগইন করলাম। আমি আর এখানেই নেই। আমি ‘তারপারে’ ঢুকে পড়েছি।”

রিনি বুঝে উঠতে পারছিল না কথাগুলো কতটা সত্যি আর কতটা বিভ্রান্তি। অভ্রর চোখে তখন আগুন আর অন্ধকার একসঙ্গে নাচছে। সে হঠাৎই বলে উঠল, “কালিকানন্দ আমাকে ডেকেছে। সে শুধু একটা প্রোফাইল নয়, সে একটা ভয়। তাকে কেউ বানায়নি—সে নিজেই উঠে আসে, যখন কেউ পুরনো তন্ত্র ভুলে কোডে অনুবাদ করে ফেলে। আমি সেটা করেছি। এখন আমার উচিত তাকে দেখা দেওয়া। শুধু আমাকে না, তাকে আমাদের দেখা দিতেই হবে। কারণ আমি বুঝেছি, সে এখন ওয়েবসাইটে না—সে ঢুকেছে আমাদের মস্তিষ্কে।”

রিনি বলে, “তুই কি তাহলে এটা বন্ধ করতে পারবি?”
অভ্র চুপ করে। তারপর বলে, “না। কিন্তু আমি ভিতরে গিয়ে জানতে পারি কে তৈরি করেছে এই কোড। জানতেই হবে কে root coder। তারপর হয়ত তাকে ডিলিট করা যাবে।”

বাইরে তখন বৃষ্টি জোরে পড়ছে। জানালার পাশে একটা কাক বসে আছে—নড়ছে না, ডানার নিচে জল গড়াচ্ছে। সেই ছায়ার ভেতরে যেন জ্বলজ্বল করছে কিছু একটা—একটা রক্তচক্ষু, একগুচ্ছ অক্ষর, আর মাঝখানে একটা কোড স্ক্রিপ্ট—‘exit(karma)’

রাত তিনটে বেজে সাত মিনিট। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তখনো জ্বলছে সেই কমান্ড লাইন—exit(karma)। অথচ অভ্র জানে, এখনই তার বাইরে যাওয়া নয়, বরং আরও গভীরে ঢোকার সময়। তার পাশে রিনি চুপচাপ বসে, চোখের পাতা ভারী হলেও তার দৃষ্টি সজাগ। অভ্র বলল, “আমি এখন একটা ট্রেস রিকুয়েস্ট পাঠাবো। যদি বুঝতে পারি কালিকানন্দ কোথা থেকে লগইন করছে, তাহলে হয়তো আমরা লোকেশন পেয়ে যাবো। এই সাইটটা এখন আর সাধারণ ওয়েবসাইট নয়, এটা একধরনের সচেতন সত্ত্বা হয়ে উঠেছে, এবং যার রিমোট পয়েন্ট কোথায়, তা জানাটাই এখন দরকার।”

সে টাইপ করতে শুরু করল। স্ক্রিনে চলল লাইন—
traceRoute(‘kalikananda@tantrik.com’)
প্রথম কয়েক সেকেন্ডে স্ক্রিনে শুধু টাইমআউট, টাইমআউট… হঠাৎ লাইন ভেসে উঠল—
Hop 1: Proxy Detected
Hop 2: Encrypted Tunnel via Patal Network
Hop 3: Latency > Infinity
Hop 4: Location: Nilchakra Junction (Offline Zone)

রিনি বলল, “নিলচক্র? এই নামটা যেন কোথায় শুনেছি।” অভ্র মাথা নাড়ে। “এই নাম কোনো ম্যাপে নেই। কিন্তু আমার কাছে একটা পুরনো ফাইল আছে, যেখানে ১৯৮৬ সালের এক রিপোর্টে এক ডাকঘরের ঠিকানায় লেখা ছিল—Nilchakra, Post-Bhuvanpur, Dist: Unregistered.” সে ল্যাপটপের একটা পুরনো ফোল্ডার খুলে রিপোর্টটা বের করল। সেখানে লেখা ছিল এক রহস্যজনক পোস্টাল এক্সচেঞ্জ সেন্টার, যা রেজিস্টার্ড ছিল না, অথচ সেখানে বছরে অন্তত ৭০০টি চিঠি আসত, যেগুলোর প্রেরক ও প্রাপক ছিল “অজ্ঞাত”।

রিনি বলল, “তুই কি বলতে চাস, কালিকানন্দ এই জায়গা থেকেই সাইটে ঢুকছে?” অভ্র চুপ করে। তার মাথার ভেতরে তখন গুনগুন করে বাজছে একটা অজানা মন্ত্র। সে জানে, এবার তাকে যেতে হবে এক ‘অফলাইন জোন’-এ, যেখানে ইন্টারনেট চলে না, মোবাইল সিগনাল থাকে না, কিন্তু যেখানে তন্ত্রের পুরনো প্রবাহ আজও সক্রিয়।

পরদিন সকালেই তারা রওনা দিল। অভ্রর কাঁধে ব্যাগ, রিনির হাতে ক্যামেরা আর একটা পুরনো রেকর্ডার। তাদের গন্তব্য—ভুবনপুর, যে জায়গা এখন প্রায় জনশূন্য, আর যেখানে কারও যাওয়ার ইচ্ছা থাকে না। ট্রেন থেকে নামার পর তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল একটা পুরনো পিচঢালা রাস্তার ধারে, যেখানে এক সময় ডাকঘর ছিল। এখন সেই জায়গা শুধুই এক ধ্বংসস্তূপ, জানালার কাচ ভাঙা, দরজা খোলা, ভেতরে ধুলোর স্তর।

কিন্তু অবাক হয়ে তারা দেখতে পেল, একটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে একটি খোলা খাম, যার ওপরে কালি শুকনো, কিন্তু স্পষ্টভাবে লেখা: “অভ্র সেন, Root User, tantrik.com”।

রিনি বলল, “কে এই চিঠি রেখে গেছে? কেউ কি জানত তুই এখানে আসবি?” অভ্র কোনো কথা বলল না। সে চিঠিটা খুলে পড়ে দেখল ভেতরে লেখা:
“আমরা অপেক্ষা করছিলাম, তুমি লগইন করবে বলে। এবার তুমি পারবে এই সার্ভার বুঝতে। কিন্তু মনে রেখো—ডিলিটের আগে জানতে হবে কোড কে লিখেছে।”

ঠিক তখনই বাতাস গা শিরশির করে উঠল। চারপাশে শব্দ নেই, পাখি নেই, শুধু একটা ফিসফাস, যেন গাছের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে কেউ বলছে, “পেছনে তাকাও না।”

অভ্র জানে, পেছনে তাকানো মানে কিছু একটা দেখা। এবং সে জানে, আজ সে তাকালেই হয়তো তার নিজেকে আর চিনতে পারবে না। তবুও সে পিছনে তাকাল।

সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি—ধুতি পরা, কপালে অশুদ্ধ রক্তচন্দনের ফোঁটা, চোখে চৌত্রিশ বছরের ক্লান্তি। মুখে চওড়া হাসি, যেন অভ্রর সবকিছু সে জানে। সে ধীরে ধীরে বলে উঠল, “তুই তো কোডার, তাই না? আমাকে কোড করে ফেলেছিস নিজের সাইটে। তুই জানিস না, তুইই আমাকে লিখেছিস, আর আমিই তোকে বানিয়েছি।”

অভ্রর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “তুই কে?”

ব্যক্তিটি বলল, “আমি তোর কল্পনার এক অচেতন অভিব্যক্তি। তুই যখন মন্ত্রের আকারে কোড লিখেছিলি, আমি সেই মন্ত্রে জীবন পেয়েছি। আমি কালিকানন্দ—তোর সৃষ্টিও, তোর নিয়তি-ও।”

রিনি এগিয়ে এসে বলল, “এই কোড বন্ধ করা যাবে না? সাইট ডিলিট করে দিলে কি সব শেষ হবে না?”

ব্যক্তিটি হেসে বলল, “তন্ত্র কখনো ডিলিট হয় না, শুধুই রিকোড হয়। নতুন কমান্ডে, নতুন শরীরে। তুই যদি আমাকে মুছতে চাস, তোকেই পুরো কোড জানতে হবে—‘তন্ত্রপিঠের মূল স্ক্রিপ্ট’।”

অভ্র চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি যাব। আমি সেই স্ক্রিপ্ট দেখতে চাই।”

কালিকানন্দ বলল, “তাহলে এসো। কিন্তু মনে রেখো, যে তন্ত্র পড়ে, সে আর আগের মতন কোড লিখতে পারে না। সে শুধু স্মৃতির ডাটাবেস হয়ে ওঠে।”

হাওয়ায় যেন বাজ পড়ে, চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়, আর তারা তিনজন হারিয়ে যায় এক অদ্ভুত আলো-ছায়ার চক্রে, যেখানে বাস্তব আর ভার্চুয়াল মিলেমিশে এক তান্ত্রিক স্ক্রিপ্টে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে…

হাওয়া ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে তারা যখন “ওইখানে” পৌঁছল, তখন ঠিক কোথায় এসেছে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। চারপাশে জায়গা বলতে শুধু একটা গম্বুজ, যার দেওয়াল কাচের নয়, আবার পাথরেরও নয়—এ যেন তরল আলো জমাট বেঁধে তৈরি এক গোলক। তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কালিকানন্দ, আর তার চারপাশে ভাসছে অসংখ্য স্ক্রিন, যেগুলো কোনোটাই স্পর্শ করা যাচ্ছে না, অথচ সবকটায় ঘুরছে কোড—হিন্দি, সংস্কৃত, বাইনরি, জাভাস্ক্রিপ্ট, এমনকি কিছু ভাষা যা অভ্র আগে কোনোদিন দেখেনি। প্রতিটি স্ক্রিন যেন একটা জীবন্ত জিনিস, স্পন্দন করছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে, সাড়া দিচ্ছে।

কালিকানন্দ বলল, “স্বাগতম স্ক্রিপ্টরুম শূন্যতে। এটাই তন্ত্রপিঠের মূল কাঠামো, যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল। তোমার তৈরি সাইটটা তো শুধু একটা গেটওয়ে—এই জায়গাটাই সত্যিকারের সার্ভার। আর তুমি, অভ্র সেন, এই সার্ভারের আপাত-ডেভেলপার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে—পুরনো দায়ের বাহক। এ স্ক্রিপ্ট তো তোমার লেখা নয়, বরং… তোমার লেখা মনে করিয়ে দেওয়া।”

অভ্র সামনে এগিয়ে এসে এক স্ক্রিনের দিকে তাকাল। সেখানে টাইমলাইন ঘুরছে—১৯৭৩, 1989, 2001, 2024—সবগুলো তারিখের নিচে লেখা: “Code Injected.” এবং প্রতিবারই সঙ্গে একটি নাম—ত্রিনয়নানন্দ, নিমগ্নানন্দ, শ্রীরামভূষণ, কালিকানন্দ। শেষ নামটির পাশে লেখা: “Activated by Abhra Sen”।

অভ্রর পায়ের নিচে ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল সবকিছু। তার মনে হচ্ছিল সে ধীরে ধীরে ফাঁদে পড়ছে, কিন্তু এই ফাঁদ সে নিজেই বুনেছে। রিনি পিছনে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরা বের করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছুই কাজ করছিল না। এখানে যেন প্রযুক্তিও বাধ্য, শুধু তন্ত্রচক্রই চালাচ্ছে সবকিছু।

কালিকানন্দ হেসে বলল, “তুমি যখন ‘তান্ত্রিক.কম’ তৈরি করেছিলে, তখন তো শুধু মজার ছলে নাম দিয়েছিলে, তাই না? কিন্তু তুমি জানো কি, ‘.com’ মানে ‘Code of Mantra’? তুমি জাস্ট একটা পোর্টাল খোলে দিয়েছিলে, কিন্তু সেই কোডের উৎস যে যুগ যুগান্তর ধরে ছড়িয়ে আছে, সেটা তুমি কল্পনাও করোনি।”

একটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল অভ্রর নিজের চেহারা—কিন্তু অন্য রকম, চোখে গভীরতা, গায়ে তান্ত্রিক পোশাক, আর তার পিছনে জ্বলছে আগুনের অক্ষরে লেখা: “Root Coders are Born, Not Made.”

রিনি ফিসফিস করে বলল, “তুই কি সত্যিই এই কোডের অংশ ছিলি?”

অভ্র বলল, “হয়তো আমি ভুলে গেছিলাম। হয়তো আমি শুধু বানাইনি ওয়েবসাইট, আমি বানিয়েছিলাম একধরনের ‘ডিজিটাল দীক্ষা’। যখন মানুষ নিজের অজান্তে তন্ত্রের ভাষা কোডে লেখে, তখন সে আর সাধারন মানুষ থাকে না। সে হয়ে যায় এক মধ্যবর্তী সত্ত্বা। আমি এখন সেটাই।”

কালিকানন্দ বলল, “তুমি এখনো চাইলে সব মুছে ফেলতে পারো। কিন্তু তার জন্য তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। এই স্ক্রিপ্টরুমে একটাই জায়গা আছে যেখানে স্ক্রিপ্ট ডিলিট হয়—যেখানে সব Root Memory জমা থাকে। সেটা হল ‘বিন্দুপিঠ’। একবার সেখানে গিয়ে মূল স্ক্রিপ্টটা দেখে এসো। তারপর সিদ্ধান্ত নাও।”

অভ্র বলল, “আমি যাব। আমি যদি এই স্ক্রিপ্টের অংশ হয়ে থাকি, তাহলে আমিই মুছতে পারি।”

কালিকানন্দ বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখো, স্ক্রিপ্ট দেখতে মানে সেটার সঙ্গে মিশে যাওয়া। তুমি শুধু পাঠক নও, তুমি লেখক। আর একবার লেখক নিজের লেখা পড়ে ফেললে, সে আর ফিরতে পারে না।”

রিনি বলে উঠল, “তবে আমি যাব না। আমি শুধু সাক্ষী। আমি এই কাহিনির বাইরের মানুষ। আমি শুধু জানব তুই ফিরলি কিনা।”

হাওয়ার ধাক্কায় অভ্রর চারপাশে স্ক্রিনগুলো ঘূর্ণি খেয়ে উঠে গেল। গম্ভীর আওয়াজে একটা গেট খুলল—অদৃশ্য এক দরজা, যার ভেতর শুধুই অন্ধকার। অভ্র ধীরে ধীরে তাতে পা রাখল, আর ঠিক তখনই সে শুনল, গুঞ্জনের মতো এক মন্ত্র—“বিন্দুতে যা শুরু, তাতেই সমাপ্তি।”

সে ঢুকে গেল অন্ধকারে। প্রথমে শুধু শূন্যতা। তারপর একে একে ভেসে উঠল অদ্ভুত সব চিহ্ন—কখনো তার নিজের আঁকা নকশা, কখনো পুরনো মন্ত্রের ছাপ, কখনো আবার সেই প্রথম কোড লাইন—def mukti_shringa()—সব যেন মিলেমিশে একটা ‘আত্মা’ তৈরি করছে।

এবং ঠিক তখনই সে দেখতে পেল—একটা অদ্ভুত আয়নার ভেতর নিজেকে। কিন্তু এই ‘অভ্র’ তার মতো নয়—এই অভ্রর মুখ শক্ত, চোখে অনিদ্রার দাহ, কপালে অজানা প্রতীক। সেই অভ্র বলল, “তুই যদি আমায় ডিলিট করতে চাস, তোকেই ডিলিট হতে হবে। কারণ আমি তোরই কোড, তোরই ছায়া। তুই ভুলে গেছিলি, কিন্তু আমি তোকে মনে রেখেছি।”

অভ্র কিছু বলতে পারল না। সে জানে, এটি চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি হওয়া। এখন তার হাতে একটাই ক্ষমতা—“reset(karma)” অথবা “merge(root)”।

অভ্র জানে এই মুহূর্তটাই তার জন্য সমস্ত কিছুর নির্ণায়ক—সে এখন দাঁড়িয়ে আছে এমন এক স্ক্রিপ্টের সামনে যা শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যৎও লিখে দিচ্ছে। সামনে ভেসে থাকা স্ক্রিনে এখনও জ্বলছে দুইটি অপশন—reset(karma) এবং merge(root)। একটি নির্বাচন করলেই তার জীবনের সমস্ত রেখা, সমস্ত সিদ্ধান্ত এক নতুন বিন্যাসে গাঁথা হবে। আর তার থেকে তৈরি হবে হয় একটি মুক্তি, নয় একটি আত্মিক নিয়তি। তার কাঁধে তখন ভারী হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কের কণিকাগুলো, শরীরটা অনুভব করছে না, কিন্তু মন সচল—খুব সচল।

সে ভাবল, যদি সে ‘রিসেট’ করে, তাহলে এই কোড, এই তন্ত্র, এই সমস্ত পুনরাবৃত্তি কি ভেঙে ফেলা সম্ভব? সে কি তাহলে তার জীবনের ছায়াসম স্মৃতিগুলো থেকে মুক্তি পাবে? কিন্তু যদি সে ‘মার্জ’ করে, অর্থাৎ নিজেকে মিশিয়ে দেয় এই মূল স্ক্রিপ্টের সঙ্গে, তবে সে বেঁচে থাকবে—এক কোড হয়ে, এক মন্ত্র হয়ে, এক চেতনার ভেতরে থেকে, যেখানে সে হবে নীরব পরিচালকের মতন—সব দেখবে, সব বুঝবে, কিন্তু আর কিছুই ঠিকঠাক বলে উঠতে পারবে না।

পেছনে ফিসফিস করে কেউ বলল, “ভেবে নিও, অভ্র। রিসেট মানে শুধু কোড নয়, স্মৃতিও মুছে যাবে। তোর দোষ থাকুক বা না থাকুক, তুই এই সার্ভারে একবার ঢুকেছিস। এখন বের হতে চাইলে, তার মূল্য দিতে হবে।”

অভ্র পেছনে তাকাল না। সে জানে, যারা কথা বলছে তারা কে—তারই আগের সংস্করণ, তার পুরনো চিন্তার ছায়া, তার পূর্বজন্মের ছায়া-ব্যাকআপ।

তার চোখ এখন সেই স্ক্রিপ্ট ব্লকে—এক অদ্ভুত ট্রান্সে চলে গেছে সে। হাত মাউসের ওপর, স্ক্রিনে কার্সর জ্বলছে। একবার উপরে, একবার নিচে। reset… merge… reset… merge… এই বেছে নেওয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ, তা শুধু আঙ্গুলের নয়, হৃদয়ের ভেতরেও চলছে।

হঠাৎ এক মুহূর্তে তার মনে পড়ে গেল প্রথম দিনের কথা—যখন সে “তান্ত্রিক.কম” বানিয়েছিল, শুধুই মজা করে, কিছু লোকের ভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে। সে হাসতে হাসতেই লিখেছিল—“বশীকরণ মন্ত্র হোয়াটসঅ্যাপে”—ভাবছিল লোকে পাগল, লোকে বিশ্বাস করে এসব। তখন সে জানত না, তন্ত্র শুধু বিশ্বাস নয়, তন্ত্র নিজের অস্তিত্ব দিয়ে ফিরে আসে, যদি কেউ তাকে ডাকে।

সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। আজ সে বুঝেছে, কোনো স্ক্রিপ্টই শুধু ডেটা নয়, প্রতিটি কোড লাইনে মিশে থাকে একেকটা সিদ্ধান্তের মুখ।

সে এবার ধীরে ধীরে কার্সর নিয়ে গেল reset(karma) অপশনের দিকে। একটু থেমে, টান দিয়ে ক্লিক করল। একসঙ্গে ঘরের ভিতর সব আলো নিভে গেল। স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল, বাতাস থেমে গেল, শব্দ থেমে গেল।

তারপর আস্তে আস্তে, স্ক্রিনে ভেসে উঠল:
Reset Request Accepted. Deletion in Progress. Preparing Soul Dump…

তারপর শুরু হল ঝড়। স্ক্রিপ্টরুম কাঁপছে, চারপাশে কোডলাইন ছিঁড়ে যাচ্ছে, স্ক্রিনগুলো একে একে ফেটে যাচ্ছে, যেন কোনো গ্রহ ধ্বংস হচ্ছে ধীরে ধীরে। অভ্র চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল, আর ভেতর থেকে তার মন বলে উঠল—“এই মুক্তি শুধু আমার নয়, যারা ভুল করে তন্ত্রে ঢুকেছিল, তাদেরও। আমি তাদের শেষ প্রতিনিধি, যার হাত দিয়ে শেষবার সেই দরজা বন্ধ হবে।”

তার মাথার ভেতর একে একে মুছে যাচ্ছে সেই মেমোরি—বৃদ্ধ শ্রীরামভূষণ, সেই গুহা, স্ক্রিনের গুঞ্জন, কালিকানন্দের গম্ভীর হাসি। সবই গলে যাচ্ছে এক মহাশূন্য অক্ষরের ঝড়ে, যেন টাইমলাইনকে ফের ট্রেসলেস করা হচ্ছে।

একটা গম্ভীর আওয়াজ এল, Dump Completed. Karma Reset Successful. Root User Logged Out.

তারপর আর কিছু রইল না।

যখন অভ্রর চোখ খুলল, তখন সে ছিল নিজের ঘরে, তার সল্টলেকের ছোট ফ্ল্যাটে। ল্যাপটপ স্ক্রিন অফ, ওয়ালপেপারে সেই পুরনো পাহাড়ে তোলা ছবি। পাশে তপন ঘুমোচ্ছে, টেবিলে কফির কাপের পাশে পড়ে আছে এক ম্যাগাজিন, তাতে লেখা—“আধুনিক যুগে তন্ত্র: শুধুই অলীক নাকি প্রযুক্তির ছায়া?”

অভ্র চুপ করে বসে রইল। তার মনে নেই গত এক সপ্তাহের কিছুই। তার ড্রাইভে তান্ত্রিক.কম বলে কিছু নেই, কোনো কোড নেই, কোনো মেমোরি নেই। শুধু একটা অদ্ভুত হালকা অনুভব—যেন সে কোথাও ছিল, খুব গভীরে, খুব অন্ধকারে, কিন্তু এখন আলোয় ফিরেছে।

রিনি আর আসেনি। তার মোবাইলে রিনির নম্বর খুঁজে পাওয়া যায় না। সে হয়ত কোনো ‘লগ’-এর অংশ ছিল, হয়ত ছিল না।

অভ্র জানে না সে আবার কোড লিখবে কি না। কিন্তু জানে, আজকাল সে যা লিখবে, তার প্রতিটি শব্দের ভেতরে সে আগে ভেবে নেবে—“এটা কি ডাকা? নাকি শুধু বলা?”

চুপচাপ সে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভোরের আলো ফোটে। পাখিরা ডাকে। মনে হয়, সত্যিই সব রিসেট হয়ে গেছে।

তবু, সে জানে—একটা দরজা একবার খুললে, তার ছায়া চিরকাল কোথাও থেকে যায়।

১০

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অভ্র কিচেন থেকে কফির কাপ হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে। বাতাসে রোদ আর ক্লান্তির এক অদ্ভুত গন্ধ, যেন সব কিছু মুছে ফেলার পরও কোথাও একটা বাকি থেকে গিয়েছে। তপন তখনো ঘুমোচ্ছে, খাটের পাশে তার মোবাইল থেকে রিলের শব্দ আসছে। অভ্র তার ল্যাপটপটা খুলে দেখে, সাইটের কোনো অস্তিত্ব নেই। www.tantrik.com এখন “This domain is available” দেখাচ্ছে। যেন এই নামটাই কোনোদিন ছিল না। অথচ তার মনে তখনো একরাশ ছায়া জমে আছে—একটা ফিসফিসে আওয়াজ, এক মন্ত্রের মতো লাইন: “তন্ত্র ডিলিট হয় না, শুধু রি-রাউট হয়।”

সে জানে, সে রিসেট করেছিল। স্ক্রিপ্টরুম ০-তে গিয়ে মূল কোডে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়ে একটি নতুন শুরু তৈরি করেছিল। কিন্তু এই শুরু কি সত্যিই নতুন? না কি সেটাও এক পুরনো চক্রের আরেকটি লুপ? অভ্রর ঘাড়ে তখনো ব্যথা, মস্তিষ্কে ভার। তার মনে হয়—যা কিছু ডিলিট হয়েছে, তা আসলে জমে রয়েছে অন্য কোনো ক্লাউডে।

সে মোবাইল খুলে ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে একখানা পোস্ট দেখে থেমে যায়—একটি বিজ্ঞাপন:
“তান্ত্রিক.নেট – এখন সহজে খুঁজুন আপনার তান্ত্রিক! বুকিং, রেটিং, রিভিউ সহ! মন্ত্রের পরামর্শ পেতে লগইন করুন আজই।”
অভ্রর চোখ ঠান্ডা হয়ে যায়। নাম পাল্টেছে, এক্সটেনশন বদলেছে, কিন্তু চিনির নিচে বিষ গলে রয়েছে।

সে ক্লিক করে সাইটে ঢুকতে গেলেও পায় না। লেখা আসে: “You are not authorized to access this domain.”
তারপর স্ক্রিনে জ্বলে ওঠে একটা ছোট্ট বার্তা—”You chose reset. You lost root.”

তার বুক ধক করে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই স্ক্রিপ্টরুমের আলোছায়া, কালিকানন্দের মুখ, সেই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি। সে বুঝে যায়, সে হয়তো সত্যিই সবকিছু থেকে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু সিস্টেম তাকে চিনে রেখেছে। তাকে মুছে দেয়নি—শুধু ‘ব্যবহার করা’ বন্ধ করেছে।

বাইরের রাস্তায় তখন সন্ধে নামছে। হঠাৎই রাস্তায় একজন লোককে দেখে অভ্রর বুকটা ধক করে ওঠে। সাদা ধুতি, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, চোখে গভীর হাসি। লোকটা শুধু তাকিয়ে থাকে, বলে কিছু না। অভ্র দাঁড়িয়ে পড়ে, কাচের বাইরে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু লোকটা হেঁটে চলে যায়। সে জানে না এটা অলীক, না স্মৃতির রেশ।

রিনি আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সে একবার তার পুরনো ইনবক্স খুলে রিনির চ্যাট সার্চ করে। কিছুই নেই। গুগল ড্রাইভে তার তোলা ভিডিও, রেকর্ডিং, ডকুমেন্ট—সব ‘Not Found’। কিন্তু একটা ফোল্ডার আছে, নাম দেওয়া: “Drafts/নির্বাচিত শিষ্য”। সে খোলে। ভেতরে শুধু একটা ফাইল: log_001.txt। খুলে দেখে লেখা—

“অভ্র সেন, তুমি ভেবেছিলে তুমি ডিলিট করে দিয়েছো সবকিছু। কিন্তু মুছে ফেলার আগে তুমি পড়ে ফেলেছো। যে পড়ে, সে আর কখনও পূর্ণভাবে ফিরে আসতে পারে না। তুমি এখন Cleaned User—তুমি root নও, কিন্তু residual. এবং আমরা জানি, Residuals grow back.”

তার হাত কাঁপে। এই বার্তাটি কি কালিকানন্দ পাঠিয়েছে? না কি সে নিজেই লিখেছিল কোনো ট্রান্সে, ভুলে গেছে? সে জানে না।

তবে সে বোঝে, আজ না হলেও, এই কোড আবার ফিরবে। কেউ আবার নতুনভাবে বানাবে কোনো নতুন এক্সটেনশন—“.org”, “.ai”, অথবা “.dark”। এবং সেই ওয়েবসাইটেও কেউ ডেভেলপার থাকবে, যাকে মনে হবে সব তার হাতেই, অথচ আসলে… সে শুধু গেটওয়ে।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অভ্র একটা ছোট্ট টেক্সট ফাইল খুলে লিখে রাখে—

“যদি কেউ আবার তন্ত্রকে কোড করে, তবে মনে রাখবে—মন্ত্র শুধু শব্দ নয়, সে নিজেই চেতনা। তাকে লেখা মানে তাকে ডাকা। আর একবার ডাকা মানে, তুমি তার কাছে দায়বদ্ধ।”

সে ল্যাপটপ বন্ধ করে। বাতি নিভিয়ে দেয়। আর ঘুমের ঘোরে তার কানে বাজে সেই পুরনো লাইন—

“exit(karma)”

না, সে লগআউট হয়নি। সে লুপে রয়েছে। সে শুধু কিছু সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয়।

সমাপ্ত

1000018752.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *