Bangla - তন্ত্র

তান্ত্রিকের দেউল

Spread the love

অগ্নিভ বসু


মেঘে ঢাকা আকাশ, ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার চাদরে মোড়া বাঁকুড়ার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি জিপ। স্টিয়ারিংয়ের পাশে বসে ডঃ নীলাভ মুখার্জী ডায়েরির পাতায় অস্থির হাতে কিছু নোট নিচ্ছিলেন—যার বেশির ভাগই ছিল স্থানীয় পুরাতাত্ত্বিক মানচিত্রের হালনাগাদ তথ্য। তাঁর মুখে সিগারেট, চোখে ক্লান্তির ছাপ। পেছনে বসে ছিলেন গবেষক মালবিকা রায়, যিনি জানালার কাঁচ সরিয়ে বাইরের পাহাড়ঘেরা দিগন্তে তাকিয়ে ছিলেন, যেন কোন কিছু চেনার চেষ্টা করছেন—যা হয়তো কোনো ছবি বা কাহিনি পড়ে মনে গেঁথে গিয়েছিল। গাড়িচালক রঘু হাঁসদা হঠাৎ বলে উঠল, “আর একটু সামনে গেলেই গোবিন্দপাহাড়পুর, বাবু। আপনারা যেই দেউলের খোঁজ করছেন, সেটার ধ্বংসস্তূপ ওই গ্রামের ওপারেই। তবে লোকজন বলে, ওইদিকে রাতে কেউ যায় না।” নীলাভ একটু হেসে বললেন, “ভয় পাবার কিছু নেই, রঘু। ইতিহাস তো ভয় পায় না।” কিন্তু মালবিকা লক্ষ্য করলেন, রঘুর কণ্ঠে কেমন এক অদৃশ্য সন্ত্রাস। বেলা গড়িয়ে বিকেলের দিকে যখন তারা গ্রামে পৌঁছায়, দেখা গেল এক আশ্চর্য নীরবতা ঘিরে রেখেছে চারদিক। পাখির ডাক নেই, গরু-ছাগলের আওয়াজ নেই, এমনকি শিশুরাও খেলছে না। কিছু ঘরের দরজায় কপালে হলুদের ছোপ আর বাঁশের চিহ্ন। গ্রামের প্রান্তে তাদের জন্য যে পুরনো, কাঠের চালের গৃহটি ঠিক করা হয়েছে, তার পেছনেই রয়েছে সেই ধূসর পাহাড় যার কোলে লুকিয়ে রয়েছে “তান্ত্রিকের দেউল”।

সন্ধ্যা নামার একটু আগেই, মালবিকা তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখতে পান, পাহাড়ের গায়ে কুয়াশা ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা সাপের মতো। গাছের পাতা পর্যন্ত যেন ঝিমিয়ে আছে। নীলাভ সেই সময় গ্রামের প্রবীণ হরিপদ পাঁজার সঙ্গে কথা বলছিলেন। এই পাঁজা পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা প্রাচীন দেউলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল, যতদিন না এক অদ্ভুত রাতে সেই মন্দির ধসে পড়ে। হরিপদ বলেন, “তান্ত্রিক ছিল সেই দেউলের স্রষ্টা। ওনার নাম ছিল কুলভদ্রনাথ। উনি বলতেন, ‘দেউলের গর্ভে আছে শক্তির মূলচক্র। সেটা জাগ্রত হলে মানুষ ঈশ্বর হয়, আর ঈশ্বর হয় ছায়া।’” নীলাভ অবাক হয়ে শুনছিলেন, আর মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছিলেন। হরিপদ হঠাৎ থেমে বলেন, “বাবু, ক্ষমা করবেন… ওই মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ ঘাঁটবেন ঠিক আছে, কিন্তু গর্ভগৃহে ঢোকার কথা মাথা থেকেও ভুলে যান।” এই সতর্কবার্তা শুনে নীলাভ একটু হেসে বললেন, “আপনাদের গল্পের পেছনে যে সত্যি লুকিয়ে থাকে, সেটাই জানতেই তো এসেছি।” সেই রাতে মালবিকা ঘুমোতে পারলেন না। অদূরে পাহাড় থেকে ভেসে এলো এক লম্বা শ্বাসের মতো শব্দ—জানলার ধারে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, যেন কেউ অন্ধকার পাহাড় থেকে চেয়ে আছে… স্থিরভাবে, নিঃশব্দে।

রাত দুটোয় হঠাৎ করে নীলাভ উঠে বসলেন বিছানায়। ঘরে কেউ নেই, কিন্তু তাঁর মুখে অজানা ভাষার মন্ত্র গুনগুন করছে, চোখের তারা বিবর্ণ। তাঁর হাত কাঁপছে, যেন অদৃশ্য কারও উপস্থিতি তাঁকে চালিত করছে। মালবিকা তাঁর ডাক শুনে ছুটে আসেন, দেখেন—নীলাভের কপাল ঘামে ভিজে, ঠোঁট নড়ছে, অথচ চোখ খোলা। তিনি জোরে চেঁচালেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ সে চুপ করে যায়—দেহ যেন ঝিমিয়ে পড়ে। সকালে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তখন নীলাভ কিছুই মনে করতে পারেন না। তিনি শুধু বলেন, “একটা পাহাড়ি গুহা, তার ভেতরে বসে ছিল একটা ছায়া, যার চোখ লাল… আমি স্বপ্ন দেখিনি, মালবিকা, আমি… আমি যেন কোথাও ছিলাম।” মালবিকার মনের যুক্তি আর সাহসের ভিত নড়ে ওঠে। নীলাভ যে জায়গায় বসে ছিলেন, সেই মাটিতে একটা অদ্ভুত ত্রিভুজ আকৃতি আঁকা ছিল, যেন আঁকা নয়—চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল। আর তখনই মালবিকার মনে হলো—এ কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান নয়, এ এক অজানা শক্তির ডাকে সাড়া দেওয়া।

পরদিন সকালবেলাই নীলাভ ও মালবিকা রঘুকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের দিক ধরলেন। রঘুর মুখে স্পষ্ট অনিচ্ছার ছাপ থাকলেও, মালবিকার দৃঢ় দৃষ্টিতে কোনো ভয় নেই। নীলাভ, যদিও আগের রাতের ঘটনার কথা মুখে স্বীকার করেননি, তার চোখে কেমন একটা অদ্ভুত ঝলক—যা তাকে আরও দ্রুত টানছিল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের দিকে। পাহাড়ি গাছপালা, রুক্ষ পাথরের ঢাল বেয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা হাঁটার পর তারা পৌঁছাল এক খোলা জায়গায়, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বহু পুরনো পাথরের স্তম্ভ, ভাঙা অলিন্দ আর শিলালিপি—যার উপরের খোদাই এত পুরনো যে স্পষ্ট নয়, অথচ অনুভব করা যায় এর মধ্যে অমোঘ কিছু আছে। সেই ধ্বংসস্তূপের ঠিক মাঝখানে একটি গোল চত্বর—যেটা সম্ভবত ছিল মন্দিরের গর্ভগৃহের কেন্দ্র। তার মাঝখানে একটি কালো বেদি, যার উপর কেবল অদ্ভুত এক ত্রিকোণ চিহ্ন খোদাই করা। মালবিকা জোরে বলে উঠলেন, “এই চিহ্নটা আমি গতকাল আপনার কাঁথার নিচে দেখেছি!” নীলাভ চমকে গেলেন। চিহ্নটি যেন তাকিয়ে আছে—স্পষ্ট নয়, অথচ চোখে লেগে থাকে।

নীলাভ ঝুঁকে বেদির চারপাশে খনন শুরু করলেন, ধূলোমাটির নিচে পাথরের স্তর যেন লুকিয়ে রেখেছে কিছু। হঠাৎ একটি পাতলা ধাতব চাকতি পাওয়া গেল—যেটি হাতে তুলতেই গরম মনে হলো, যদিও সূর্য তখনো ঠিকমতো উঠেনি। চাকতির উপরে খোদাই করা রয়েছে এক তান্ত্রিক চক্র, যার প্রতিটি বিন্দুতে ছোট ছোট মুখের মতোন গঠন—মুখগুলো হাঁ করা, জিভ বেরনো, চোখ নেই। মালবিকা হাঁপিয়ে উঠলেও থামেন না। তিনি আশেপাশে খোঁজ করতে করতে একটি ভাঙা প্রাচীন দরজার ফ্রেম খুঁজে পান, যার উপরে লেখাঃ “যে প্রবেশ করে, সে আর ফিরে যায় না।” নীলাভ উচ্চারণ করতেই এক অদ্ভুত ধ্বনি বাতাসে ভেসে ওঠে—মৃদু, কিন্তু গভীর। রঘু ছায়ার মতো পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “এই জায়গাটা ভুলে যান, বাবু। আমার মা বলতেন, এই চিহ্ন যেখানে থাকে, সেখানে মানুষ থাকে না—ছায়া থাকে।” নীলাভ মৃদু হেসে বলেন, “ছায়া তো আলো ছাড়া হয় না, রঘু। আর আলো খুঁজতেই তো এসেছি আমরা।”

সন্ধ্যার পর সেইদিন মালবিকা একা গিয়ে হরিপদ পাঁজার সঙ্গে দেখা করেন। বৃদ্ধ তখন উঠোনে আগুন জ্বেলে বসে ছিলেন। মালবিকা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “এই ত্রিকোণ চিহ্নটার মানে কি আপনি জানেন?” পাঁজা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন, বলেন, “ত্রিকোণ মানেই তিন শক্তি—তন্ত্র, তপ, ত্যাগ। কুলভদ্রনাথ এই দেউল গড়েছিলেন, যাতে মানবশরীরেই মহাশক্তির অধিষ্ঠান ঘটাতে পারেন। তিনি বলতেন, দেহকে দেবতা করো, দেবতাকে দাস নয়, রক্তে ডুবাও, চেতনায় জাগাও। কিন্তু… কিছু একটা ভুল হয়েছিল। দেউলের গর্ভগৃহে তিনি প্রবেশ করার পর আর মানুষ রইলেন না। তাঁর শরীর গলতে শুরু করল, কিন্তু আত্মা… আত্মা ছড়িয়ে পড়ল মাটির নিচে। আজও যারা এখানে আসে, তারা তার স্বপ্ন দেখে, তার ভাষায় কথা বলে।” মালবিকার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। তিনি বুঝতে পারেন—যে যাত্রাকে নিছক প্রত্নতত্ত্বিক অভিযান বলে ভাবা হয়েছিল, সেটি ক্রমে এক চেতনার মধ্যে প্রবেশ করে যাচ্ছে। আর সেই চেতনা মানুষ নয়, ইতিহাস নয়—তান্ত্রিক অভিশাপের কুয়াশায় মোড়া এক সময়-ভেদী অস্তিত্ব।

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। বাইরের বাতাস নিস্তব্ধ, এতটাই নিঃশব্দ যে, যেন কোনো অদৃশ্য অস্তিত্ব চারপাশটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মালবিকা ঘুমিয়ে পড়লেও এক অস্বস্তি তাকে বারবার জাগিয়ে তুলছিল। হঠাৎ করেই ঘরের পাশের কক্ষে থাকা নীলাভের কণ্ঠ ভেসে এলো—মৃদু, গম্ভীর, কিন্তু আশ্চর্যভাবে চেনা নয়। শব্দগুলো ছিল ঘন আর ছন্দময়, যেন কোনো প্রাচীন মন্ত্রপাঠ, যার প্রতিটি ধ্বনি বাতাসে কেঁপে উঠছে। মালবিকা তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে গেলেন। সেখানে দেখা গেল—নীলাভ বিছানার ওপর বসে আছেন, চোখ বন্ধ, দেহ অনড়, মুখ থেকে বেরোচ্ছে সেই ভাষা যার উৎস কোথাও এই সময়ে নয়। তার চারপাশে মেঝেতে আবার সেই ত্রিকোণ চিহ্ন আঁকা, এবার সেটি আগের চেয়ে গাঢ়—মনে হচ্ছিল যেন রক্ত দিয়ে আঁকা হয়েছে। বাতাস ভারী, বাতিল গন্ধে ভরা। মালবিকা ভয় আর কৌতূহলের দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। হঠাৎই নীলাভ চোখ খুললেন—তাঁর চোখের তারা কালো, সম্পূর্ণ কালো, যার ভেতরটা যেন শূন্যতায় ভরা। তিনি একবার তাকালেন মালবিকার দিকে, আর বললেন, “গর্ভগৃহ খুলেছে… সে আসছে।”

সকালে নীলাভ যেন স্বাভাবিক ছিলেন। আগের রাতের কিছুই তাঁর মনে নেই। তিনি কেবল জানান, রাতে তিনি স্বপ্নে একটি কুয়াশায় ঢাকা চত্বর দেখেছেন, যার মাঝখানে একটা আগুন জ্বলছে, আর চারপাশে বসে আছে মুখহীন কিছু ছায়ামূর্তি। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মানুষ—যার গায়ে কেবল ছাই, কপালে লাল তিলক, আর কণ্ঠে সেই একই মন্ত্র। নীলাভ নিজের কণ্ঠেই সেই মন্ত্র শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি মালবিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মাথা ভালো আছে তো?” মালবিকা মৃদু হেসে জানালেন, “আপনি হয়তো বেশি ভাবছেন। আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি না আজ?” কিন্তু তার নিজের মনেই শুরু হয়ে গেছে এক অস্থিরতা। কি করে একটা চিহ্ন বারবার ফিরে আসে? কি করে একটা মানুষের ভেতরে ঢুকে পড়ে অন্য কণ্ঠস্বর? সেদিন দুপুরে তারা আবার সেই দেউলের ধ্বংসাবশেষে পৌঁছায়। নীলাভ এবার বেদির পশ্চিম পাশে খনন শুরু করেন। একসময় উঠে আসে এক আয়তকার প্রস্তর খণ্ড, যার উপর খোদাই আছে মানবদেহের ভেতরে ঘূর্ণি আকৃতি—তন্ত্রশাস্ত্রে যাকে বলা হয় ‘যোগনালী’। মালবিকা একনজর দেখে বলে ওঠেন, “এটা শরীরের চক্র-নকশা!” নীলাভ বলেন, “না, এটা সম্ভবত কুলভদ্রনাথ নিজে আঁকিয়েছিলেন। এখানে মানুষের শরীরকেই দেবমূর্তির বিকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে।”

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে থাকলে, ধীরে ধীরে আকাশের রং গাঢ় হতে থাকে। সূর্যের আলো বিদায় নেওয়ার আগেই পাহাড়ের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শুকনো গাছের ছায়া অদ্ভুতভাবে নড়ে ওঠে। মালবিকা চমকে ওঠেন—যেন ছায়াটা স্বাভাবিক নয়। ঘন ছায়ার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অবয়ব, যার শরীর মানুষের মতো, কিন্তু মুখ দেখা যায় না—মাথা সামান্য নিচু, চোখের জায়গায় অন্ধকার, দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে, নীলাভদের দিকে মুখ করে। মালবিকা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অবয়বটি হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল বাতাসে। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন নীলাভের দিকে, কিন্তু তিনি দেখেননি কিছুই। তারা ফিরে আসার পথে হঠাৎ ঝড় ওঠে—আকাশ কালো হয়ে যায়, পাথরের ফাঁক গলে বাতাস শিস দিয়ে উঠে, আর গাছপালা নড়ে ওঠে অদ্ভুত শব্দে। মালবিকার বুকের ভেতরে চাপা ভয় ধীরে ধীরে স্থায়ী হয়ে উঠছে। রাত যত গভীর হয়, সেই ভয় নিজের ভাষা খুঁজে পায়—মন্ত্র, ছায়া, ইতিহাসের পরতে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ঙ্কর সত্য। তান্ত্রিকের দেউল এখন কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো পুরাকীর্তি নয়—এ যেন এক জীবন্ত দেহ, যার ভিতরে কেউ ঘুমিয়ে নেই, বরং জেগে আছে, এবং কাউকে খুঁজছে, বারবার।

রাত্রি নামার পর পাহাড়ের কোলে ছায়াগুলো যেন ঘন হয়ে আসে। ঈশিতা সেই রাতে মন্দিরচূড়োর নিচে বসে কিছু পাথরের ছবি তুলছিল যখন হঠাৎই তার ক্যামেরা ফ্ল্যাশ বিকল হয়ে যায়। চারপাশে তখন শুধু নিশুতি, জঙ্গলের গন্ধ আর নিকটে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অরিত্রর নিশ্বাসের শব্দ। সেই সময়েই তাদের দৃষ্টি পড়ে মন্দিরের এক প্রাচীন প্রস্তরস্তম্ভের ওপর—যেখানে ঠিক উপরের অংশে খোদাই করা ছিল একটি অদ্ভুত চিত্রলিপি। অরিত্র ধীর কণ্ঠে বলে, “এই লেখাটা প্রাক-তান্ত্রিক যুগের, কিন্তু লিপি অনেকটাই রহস্যময়।” ঈশিতা হাতের টর্চে আলো ফেলতেই চমকে ওঠে—লিপির নিচে ছিল এক মানুষের মুখাবয়ব, যেটা মন্দিরের অন্য কোথাও দেখা যায়নি। ঠিক যেন কারও মুখকে পাথরে চেপে বসানো হয়েছে। মুখে ভয়ের ছায়া, চোখে দৃষ্টি নেই, ঠোঁটে বন্ধ একটি মন্ত্র। সেই মূর্ত মুখ দেখে ঈশিতার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামে। এমন সময়ে এক কাকের ডাক ছিঁড়ে ফেলে নিস্তব্ধতা—কিন্তু তারা বুঝতে পারে, এটা সাধারণ পাখির ডাক নয়। যেন কারও মন্ত্রোচ্চারণের সুরে গলা মেলাচ্ছে।

তাদের সেই রাত কাটে মন্দিরের চূড়ার নিচে ছোট্ট এক শালগাছের ছায়ায় বসে। অরিত্র তার ডায়েরিতে সব খুঁটিনাটি লিখে রাখছিল, কিন্তু ঈশিতা শুধু বসে ছিল চুপচাপ, যেন তার ভিতরের চোখে কিছু খুলে গেছে। হঠাৎ সে বলে ওঠে, “তুই শুনছিস, অরিত্র? কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে।” অরিত্র কান পেতে শোনে, দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাপিয়ে যেন সত্যিই কারও গলা আসছে পাহাড় থেকে নিচে নামা বাতাসের সঙ্গে। তারা ওঠে, মন্দিরের পিছন দিকে সেই অশুভ গন্ধ আর ঠাণ্ডা হাওয়া অনুসরণ করে এগোয়। সেখানে তারা আবিষ্কার করে আরেকটি ধ্বংসস্তূপ, যেটা এতদিন ঝোপের আড়ালে ছিল। তার মাঝখানে ছিল একটি ভাঙা মন্ডপ, আর তার ঠিক মাঝখানে পাথরের বেদি। ঈশিতা সেখানে গিয়ে পড়ে, হাত ছুঁয়ে দেখে এবং চোখ বুজে যেন কিছু অনুভব করতে চায়। তারপর আচমকা উঠে বলে, “এখানে আগুন লেগেছিল। এই বেদিতে কেউ জীবন্ত পোড়ানো হয়েছিল।” এই কথা শুনে অরিত্র অবাক হয়ে যায়—এমন তথ্য তার গবেষণায় আসেনি। ঈশিতা যেন কিছু অতিপ্রাকৃত অনুভব করে ফেলেছে, যেন সেই দেউলে যেটা হারিয়ে গেছে, তার স্মৃতি এখনো জমা আছে বাতাসে, গন্ধে, পাথরের খাঁজে।

সেই রাতেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে ঈশিতা আর ঘুমোতে পারে না। সে খেয়াল করে, তার হাতে যে আঙুলটা বেদির পাথরে রেখেছিল, সেখানে দাগ পড়ে গেছে—একটা সরু রেখা, যেন আগুনে ছেঁকা। অরিত্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ঈশিতা বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি আগেও এখানে এসেছিলাম, এই দেউলে… হয়তো বহু জন্ম আগে। কেউ আমায় এখানেই আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল।” অরিত্র ভয় পায়, কিন্তু গবেষণার নেশা তাকে পেছনে টানে না। সে পরদিন সকালে সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের গভীরতর অনুসন্ধানে নামতে হবে, আর খুঁজে বার করতে হবে সেই মূর্ত মুখের রহস্য, পাথরে খোদাই করা লিপির মানে এবং ঈশিতার অভিজ্ঞতার উৎস। তাদের সামনে যে রাত আসছে, তা শুধু ইতিহাসের নয়, এক প্রাচীন অভিশাপের দ্বার উন্মোচনের।

ঈশিতা চোখ খুলে দেখল সে শুয়ে আছে মন্দিরের পাথরের মেঝেতে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে শুকনো ধুলো আর ঝরা পাতা। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে, ঠিক যেন কোনো প্রাচীন ঢোলের শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে করোটির অলিন্দে। অরিত্র নেই। তার শরীরের প্রতিটি শিরায় অনুভব করল এক অদ্ভুত উত্তেজনা—ভয় আর রহস্যময় এক আকর্ষণ যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে তাকে সেই গহন অন্ধকারের দিকে। মন্দিরের বাইরের সূর্যের আলো এখন পুরোপুরি লুপ্ত—চারদিক জুড়ে ঘন কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার ভেতর এক চক্রাকারে জ্বলছে আগুনের বৃত্ত। আগুন কোনো দাহকারী তাপ ছড়ায় না; বরং এক উষ্ণ অথচ ছায়ার মতো জ্যোতি পরিব্যাপ্ত করে আছে চারপাশে। ঈশিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই বৃত্তের দিকে, পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর পুরনো পাথরের মিহি আওয়াজ তার ভয়ের স্পন্দনের সঙ্গে মিলে এক সঙ্গীত তৈরি করছে। হঠাৎ, মন্দিরের পুরনো স্তম্ভের ছায়া থেকে উঠে এলো এক মূর্তি—তার মাথায় তামার টায়রা, গায়ে লাল রঙের কাপড়, আর কপালে আঁকা একটি ত্রিকোণ যার মাঝখানে আগুনের প্রতীক। তার চোখ দুটি যেন অন্তর্যামী, সরাসরি ঈশিতার আত্মায় ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

মূর্তিটি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ফিরে এসেছিস, আয় তবে—পূর্ণ হোক চক্র।” ঈশিতা ধীরে ধীরে আগুনের বৃত্তে পা রাখল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়তে থাকল সেই সমস্ত স্বপ্নের টুকরো—পেছনের কয়েক রাতে সে দেখেছে এক আগ্নেয় মুখ, যেটা কিছু বলছে মন্ত্রের মতো করে, আর তার কপালে জ্বলছে সেই একই প্রতীক। আগুনের বৃত্তে প্রবেশ করার পর যেন সময় থেমে গেল। চারপাশে উঁকি মারছে ছায়ামূর্তি—কেউ ঠান্ডা বাতাসে সিঁথির ফাঁক দিয়ে হাসছে, কেউবা স্নায়ুর কিনারায় ফিসফিসিয়ে বলে যাচ্ছে পুরনো নাম, যেগুলো কেবল মাটির নিচে কবর দেয়া কাহিনি জানে। হঠাৎ, আগুনের ঠিক মাঝখান থেকে উঠে এল আরেকটি প্রতিচ্ছবি—এটা ছিল অরিত্র। কিন্তু তার চোখে ছিল অচেনা শূন্যতা, তার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল সেই মন্ত্র, যেটা গত কয়েক রাত ধরে ঈশিতার ঘুমে ভেসে আসছিল। “প্রবেশ করেছে সময়ের বৃত্তে, প্রকাশ হবে পুরাতন তান্ত্রিকের শক্তি,” সে বলল গম্ভীর কণ্ঠে, যা কোনো সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ছিল না—বরং কোনো যুগান্তরের অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা কণ্ঠ।

মুহূর্তের মধ্যে আগুনের বৃত্ত হঠাৎ নিভে গেল। সমস্ত মন্দির ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল, শুধু অরিত্রের কণ্ঠে অনবরত উচ্চারিত হচ্ছিল, “বিন্দু হতে বৃত্ত, বৃত্ত হতে শক্তি, শক্তি হতে প্রকাশ।” ঈশিতা পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল, মন্দিরের দেয়ালজুড়ে একেকটি পাথরের ফলকে খোদাই করা তান্ত্রিক চিত্র—কোনোটা রক্তপিপাসু দেবতার, কোনোটা চক্রে আবদ্ধ আত্মার, আবার কোনোটা আগুনে দগ্ধ একজন মানুষের, যার মাথার গঠন অরিত্রর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। হঠাৎ এক প্রবল ঝড় বইতে লাগল মন্দিরের ভেতর দিয়ে। বাতাসের ঘূর্ণি গিলে নিচ্ছিল চারদিকের ধুলো, পাতা, এমনকি শব্দ পর্যন্ত। ঈশিতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কণ্ঠ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেন এই মন্দিরে এখন ভাষা নয়, কেবল চিত্র আর প্রতিচ্ছবিই চলাচল করে। হঠাৎ সে অনুভব করল, তার কপালের ঠিক মাঝখানে কিছু গরম হয়ে উঠছে—এক অদৃশ্য আগুনের ছোঁয়া, যেটা যেন তাকে শিখিয়ে দিচ্ছে এক প্রাচীন ভাষা, যেটা তার পূর্বপুরুষদের কোনো এক ঋষি-তান্ত্রিক বংশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে। ঈশিতা এবার নিজেই মন্ত্র পড়তে শুরু করল, ধীরে ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে—এবং তখনই অরিত্র থেমে গিয়ে তার দিকে তাকাল, যেন হাজার বছরের ঘুম ভেঙে কোনো স্মৃতি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর মন্দিরের দেয়াল থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসতে লাগল এক লালাভ জ্যোতি, যার উৎস ঠিক মন্দিরের কেন্দ্রস্থল—তান্ত্রিকের গোপন আসন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে, অরিত্র আর ঈশিতা পৌঁছাল সেই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ‘ঘাঘরা’। বাঁকুড়ার অন্তর্গত হলেও, এখানে পৌঁছাতে শহরের সঙ্গে সবরকম সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। গ্রামটির মাথায় দাঁড়িয়ে সেই রহস্যময় প্রাচীন মন্দির—যার ধ্বংসাবশেষ প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ, এবং পরে যার উল্লেখ খুঁজে পান অরিত্র। জায়গাটিতে পা রেখেই ঈশিতার গা শিউরে উঠেছিল—মাটির গন্ধে যেন মিশে ছিল কোনও চাপা আতঙ্ক, আর বাতাসে ছিল নিস্তব্ধতার ভার। গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা জানালেন—“দেউলটাতে সন্ধ্যার পর কেউ যায় না। শোনা যায়, রাত হলে নাকি সেখানে মন্ত্রোচ্চারণ আর ছায়ামূর্তির আনাগোনা শুরু হয়।” অরিত্র এবং ঈশিতা বুঝে গেল, তারা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। কিন্তু ঈশিতার মধ্যে ক্রমাগত বাড়ছিল একটা দমবন্ধ করা অস্থিরতা—কিছু একটা যেন গভীর থেকে ডাকছে তাকে, অনেক পুরনো কোনও সম্পর্কের মতো।

সন্ধ্যার পর তাঁরা উঠলেন সেই পাহাড়ি পথে, দেউলের ধ্বংসাবশেষের দিকে। সঙ্গী শুধু একটা টর্চলাইট, আর কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, উঁচু-নিচু পথে চলতে চলতে অরিত্র দেখল, ঈশিতা বারবার পিছনে তাকাচ্ছে—যেন কেউ তাদের অনুসরণ করছে। পথ যত গভীরে গেল, বাতাস হয়ে উঠল আরও ভারী, পাখিরা নিশ্চুপ, আর গাছেরা যেন কান পাতছিল। হঠাৎ, একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ঈশিতা। “এই জায়গাটা… আমি এখানে আগে এসেছি,” বলেই সে ছুঁয়ে দেখল একটা ভাঙা পাথরের দেওয়াল। অরিত্র বিস্ময়ে তাকাল। “কখন, কিভাবে?” ঈশিতা মুখে কিছু না বললেও তার চোখ বলছিল—সে জানে না কেন, কিন্তু এই জায়গাটা তার চেনা। যেন স্বপ্নের মধ্যে বহুবার সে এখানে এসেছে। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি নড়ে উঠল। অরিত্র চমকে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল, কিছুই নেই। কিন্তু ঈশিতা নিশ্চুপ, তার চোখ তখন স্থির এক অদৃশ্য বিন্দুর দিকে। সে বলল, “চলো, আমরা খুব কাছে চলে এসেছি।”

অবশেষে তাঁরা পৌঁছাল সেই দেউলের ধ্বংসাবশেষে। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল শিবলিঙ্গ আর পাথরে খোদাই করা জটিল তান্ত্রিক চিহ্ন দেখে শিহরিত হল ঈশিতা। হঠাৎ একটা হাওয়া উঠল, আর সেই সঙ্গে চারপাশে বাতাসে ভেসে এল একটা অচেনা ধূপের গন্ধ—যা তারা শহরে কখনও শোঁকে না। অরিত্র বুঝল, এখানেই কোনও এক তান্ত্রিক শক্তির কেন্দ্র। সে তার নোটবুক খুলে খোদাইগুলোর ছবি তুলতে শুরু করল, আর ঈশিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই শিবলিঙ্গের দিকে। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল এক তান্ত্রিক মন্ত্র—যা সে আগে কোনওদিন শিখেনি। “ওঁ হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ै…।” অরিত্র চমকে তাকাল। “তুমি এসব কোথায় শিখলে?” কিন্তু ঈশিতা তখন যেন কোনও ঘোরের মধ্যে। হঠাৎ চারপাশে হাওয়া ঘূর্ণি খেতে লাগল, গাছেরা দুলতে শুরু করল, আর এক মুহূর্তে ঈশিতা জ্ঞান হারিয়ে পড়ল মাটিতে। অরিত্র দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু তার মনে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন—ঈশিতার সঙ্গে এই দেউলের কী সম্পর্ক? সে কি শুধু একজন গবেষক, না কি বহু শতাব্দী পুরনো কোনও রহস্যের পুনর্জন্ম?

অরিত্রর কণ্ঠে সেই মুহূর্তে কোনও শব্দ জন্মায় না। তার হাতের টর্চটা নিঃশব্দে নিচে নেমে আসে, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটা এক পলক তাকিয়ে থাকে তার চোখে—সেই চোখে নেই কোনও সাদা অংশ, শুধু কুয়াশার মতো ঘোলাটে কালো। ছায়ার শরীরটা আবছা হলেও দেখা যায়, সেটা একটা লম্বা শাল গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী, যার মাথা ঢেকে রাখা কালো ঘোমটার নিচ থেকে অদ্ভুত এক আতরের গন্ধ ভেসে আসে। অরিত্র বুঝে উঠতে পারে না, এটা বাস্তব নাকি স্বপ্ন, কিন্তু বুকের ভিতর দপদপ করছে অস্বস্তির ঢেউ। ঠিক তখনই ঈশিতা ডেকে ওঠে পিছন থেকে, “অরিত্র, তুমি কোথায়?” অরিত্র তাকাতেই দেখল, ছায়ামূর্তিটা নিঃশব্দে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের ভিতরের অন্ধকারে, আর তার চোখ দুটো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে যেন ধোঁয়ার মতো।

ঈশিতা কাছে এসে দাঁড়াতেই অরিত্র চমকে ওঠে—তার চোখে তখনও যেন সেই ছায়ার ছাপ। “কি দেখলে?” ঈশিতার প্রশ্নে সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। “মনে হল… কেউ ছিল… এক মহিলা…” সে এতটুকুই বলতে পারে। ঈশিতা তাকে নিয়ে আবার তাঁবুর দিকে ফিরে যায়, কিন্তু সারা রাত অরিত্র ঘুমাতে পারে না। রাত গভীর হলে সে শুনতে পায় দূরে মন্দির চূড়ার দিক থেকে একটানা মন্ত্রোচ্চারণ—কোনও অজানা ভাষায়, যেন বাতাসের ভেতরেও তার কম্পন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকালে গ্রাম থেকে আসা পুরনো এক লোক, ধূসর ধুতি পরা শ্যামাপাকা চুলের বৃদ্ধ বললেন, “যদি কেউ দেউলের রাতের আহ্বানে সাড়া দেয়, সে আর মানুষ থাকে না। ওখানে ওরা এখনও আছে—তন্ত্রের বন্ধনে বাঁধা, সময়ের বাইরে বন্দি।” ঈশিতা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, আর অরিত্রের গলা শুকিয়ে আসে। বৃদ্ধ সেই মন্দিরের পুরনো ইতিহাস শোনান—যে তান্ত্রিক শতাব্দী আগে এখানে ব্রহ্মচক্র তৈরি করেছিল, নারীমন্ত্র ও রক্তবহ্নির মধ্যে দিয়ে দেবতার আরাধনা করত, কিন্তু একদিন তার আরাধ্যই তাকে গ্রাস করে নেয়।

চতুর্দিকে ঘন জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা সেই জায়গায় আসা-যাওয়া অনেকটাই কঠিন। ঈশিতা এবং অরিত্র ঠিক করে, এখন আর পেছানো যাবে না। তারা গভীরতর অনুসন্ধানে নামে। অরিত্র হঠাৎ খুঁজে পায় এক পাথরের ফলকে খোদাই করা চক্রাকৃতি তন্ত্রচিহ্ন, যার কেন্দ্রে এক নারীমূর্তি, চারটি চোখ এবং জিহ্বা বের করা—কালী? না কি অন্য কিছু? সেই রাতেই আবার অরিত্রর ঘুম ভেঙে যায়—সে দেখে সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের গর্ভগৃহে, চারপাশে আগুনের আলো, আর তার সামনে বসে আছে সেই নারী, ঘোমটার নিচ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে গাঢ় লাল রক্ত, সে মৃদুস্বরে বলছে—“এত দূর এসে ফিরে যেতে নেই, অরিত্র। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।” বাস্তবে অরিত্র উঠে বসে দেখল, গায়ে হিম ঘাম, আর ঈশিতা তখনও ঘুমিয়ে। মন্দির তাকে ডাকছে—আর ডাকের ভাষা আজকাল তার খুব চেনা মনে হচ্ছে।

অরিত্রর চোখদুটি খোলা অবস্থাতেই ছিল, অথচ সে দেখছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। যেন আলো বলে কিছু নেই এই দুনিয়ায়, শুধু নিঃশব্দে এক নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘ্রাণশক্তি যেন প্রখর হয়ে উঠেছে—হাসে গন্ধ, জ্বলন্ত ধূপকাঠির ধোঁয়া, আর একটা পুরনো কাদামাটির গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। হঠাৎ একটা হিমেল হাওয়া কাঁপিয়ে দিল তাকে, কানে এল একটা স্পষ্ট উচ্চারণ—“ঈশ্বর নয়, ইচ্ছার শূন্যতায় খুঁজিস সত্তা!” অরিত্রর মাথা ঝিমঝিম করছিল। আচমকাই তার চারপাশে আলো জ্বলে উঠল, এবং সে দেখতে পেল—এক চক্রাকারে বসে আছে কালো বস্ত্র পরিহিত কিছু লোক, মুখ ঢাকা, কপালে রক্তের টিপ। মাঝখানে এক ক্ষয়প্রাপ্ত মূর্তি—হয়তো কোনও তান্ত্রিক দেবতার। একজন তান্ত্রিক উঠে দাঁড়াল এবং ধীর কণ্ঠে বলল, “তুমি চলে এসেছো, অরিত্র, তোমার পেছনের জীবন তুমি ত্যাগ করেছো। এখন তুমিই ধারক।” অরিত্র চিৎকার করে উঠতে চাইল, কিন্তু গলায় যেন কিছু আটকে গেছে—সে চিৎকার করতে পারছে না, দৌড়াতে পারছে না, এমনকি চোখও বন্ধ করতে পারছে না। এই মুহূর্তেই সেই চক্রটা হঠাৎই মিলিয়ে গেল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ খুলল। ঘরেই রয়েছে সে, ঈশিতা পাশেই বসে আছে, চোখ ভরা উদ্বেগ। ঈশিতা জানাল, সে নাকি এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চিৎকার করছিল ঘুমের মধ্যে।

ঈশিতা সেই রাতে আর ঘুমোয়নি। সে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নিশ্বাস পরীক্ষা করে দেখছিল। অরিত্রর ঘুমভাঙা চোখে যেন কোনও অভিমান আর আতঙ্ক মিলেমিশে আছে। ভোরের আলো ফুটতেই ঈশিতা জানাল—তার এক পরিচিত লোক বাঁকুড়ার আশেপাশে অনেক পুরনো সাধনাস্থল নিয়ে গবেষণা করে। হয়তো তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কিছু সূত্র পাওয়া যাবে। অরিত্র শুরুতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, তার মনের ভেতরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছিল ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত দেউলটির প্রতি। এমনটা নয় যে সে বিশ্বাস করত অতিপ্রাকৃত কিছুকে, কিন্তু তার ভিতরটা যেন বলতে চাইছিল—এটা কোনও সাধারণ প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধান নয়, এটা অনেক বড় কিছু। সেই সন্ধ্যাতেই তারা পৌঁছাল সেই ব্যক্তির বাড়ি। লোকটির নাম ছিল মিহিরবাবু—বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, দীর্ঘদেহী, হালকা ঘাড় নিচু করে কথা বলেন। তিনি এক ঝলকে চিনে ফেললেন অরিত্রকে। “তুমি কি স্বপ্নে আগুন দেখো?”—এই প্রশ্নটা অরিত্রকে স্তম্ভিত করে দিল। মিহিরবাবু জানালেন, এই দেউলটি ঘিরে বহু শতাব্দীর পুরনো এক তান্ত্রিক বিশ্বাস রয়েছে, যেখানে মানুষের ইচ্ছাশক্তিকেই ‘দেবতা’ বানিয়ে পূজা করা হত। সেই দেবতা কোনও নির্দিষ্ট রূপে নয়, ইচ্ছার আকৃতিতে ধরা দিত—আর সেই শক্তি যে একবার ডেকে আনে, সে আর পিছোতে পারে না।

তাঁদের আলোচনার সময়ে হঠাৎ মিহিরবাবুর ঘরের এক কোণ থেকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধা—চুল সাদা, চোখ দুটো কুয়াশার মতো ফ্যাকাসে। সে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ওকে নিয়ে এসেছিস, এবার দেউল ওকে ডাকবেই।” ঈশিতার হাত শক্ত করে ধরে অরিত্র। অরিত্রর মাথার ভেতর যেন ঘূর্ণি পাকাচ্ছে সবকিছু। মিহিরবাবু তখন বললেন, “তোমরা কাল সকালে রওনা হও, আমি তোমাদের নিয়ে যাব সেই পাহাড়ি গ্রামে। তবে সাবধান—যে দেউলে প্রবেশ করে, তার চেতনা আর একরকম থাকে না। সেখানে সময় বাঁক খায়, স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ওঠে, আর নিজের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেতে হয়। প্রস্তুত তো?” অরিত্রর গলা শুকিয়ে এল, তবু সে মাথা নাড়ল। বাইরে তখন গোধূলি আলো, একটা পাখির ডাকে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক। ঈশিতা জানে, অরিত্রর হাত ধরে সে এগিয়ে চলেছে এমন এক পথে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চয়তা, প্রতিটি পদক্ষেপ এক রহস্যে মোড়া। তারা জানত না সামনে কী অপেক্ষা করছে—কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিল, যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা আর থামবে না।

অরিত্রর মনজুড়ে ছিল শুধু একটাই ছবি—ভগ্নপ্রায় দেউলের কালো দরজা, আর সেই দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশিতার বিভ্রান্ত মুখ। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসা কুয়াশার মতোই, সব কিছু যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়েছিল, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিল আরও কিছু গোপন তথ্য—যেমন মন্দিরের পুরোনো নাম “কামাক্ষ্যাশ্রী তান্ত্রিক মঠ”, আর যাজকের বংশধরেরা আজও লুকিয়ে আছে এই জঙ্গলের কোনো এক কোণে। সেসব খোঁজ করতে করতে সে এসে পৌঁছল এক পুরনো অজানা শ্মশানে, যেখানে কেউ বসবাস করে না বহু বছর। সেখানে সে খুঁজে পেল কিছু প্রাচীন তাম্রলিপি, আর এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে জানতে পারল—ঈশিতার শরীর শুধু তার নয়, কোনো এক “অভিমন্ত্রিত আধার”, যেখানে তন্ত্রমন্ত্র জমে রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। অরিত্র বুঝতে পারছিল, এই রহস্য আর তার হাতের বাইরে নেই। তার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে দেউলের ইতিহাস।

ঈশিতা এদিকে, এক অদ্ভুত ঘোরে দিন কাটাচ্ছিল। শরীরের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ কমে আসছিল। প্রতিরাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর সে যেন আর নিজের মধ্যে থাকে না—ভোরে উঠে দেখে, তার জামাকাপড়ে ধুলোমাটির ছাপ, পায়ের পাতায় রক্ত। অজানা ভাষায় লিখে রাখা ডায়েরির পাতাগুলো এখন তার ঘরের প্রতিটি কোণে। কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না সে, শুধু অনুভব করছিল—তার শরীরের মধ্যে যেন দু’টি চেতনা লড়াই করছে। একরাতে হঠাৎ সে চোখ মেলে দেখে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেই, কিন্তু চোখে যেন কোনো আলোর ছায়া নেই, মুখে হাসি নয়, বরং এক নির্মম নিষ্ঠুরতা। ঈশিতা বুঝল, তার মধ্যে কেউ বাসা বেঁধেছে। সে তখন সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে মন্দিরে ফিরতেই হবে—এই যাত্রা হবে শেষবারের মতো।

চাপা আতঙ্ক আর সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় তারা আবার একসঙ্গে পৌঁছল সেই দেউলের দরজার সামনে। অরিত্রর হাতে তাম্রলিপি, আর ঈশিতার চোখে এক অমোঘ টান। দরজা খুলতেই, ভিতরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো আলো—কিন্তু তা উত্তাপ দেয় না, বরং শীতল, অথচ ছিন্নমূল স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে। তারা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করে, মন্দিরের কেন্দ্রে থাকা মূল গর্ভগৃহের দিকে। প্রতিটি ধাপ যেন ইতিহাসের গায়ে আঘাত। হঠাৎ, এক গর্জনের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা স্থান। শূন্য থেকে উদিত হল এক ধূসর ছায়া—দেউলের মূল যাজক, এক কালো পোশাক পরিহিত ছায়ামূর্তি। সে বলল, “ঈশিতা ফিরে এসেছে, কিন্তু কাকে ফিরিয়ে আনতে?” সেই মুহূর্তে ঈশিতা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আর তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে—অসংখ্য জনপদের ধ্বংস, তন্ত্রসাধনার বিভীষিকা, আর তার নিজ শরীর থেকে উদ্ভূত এক প্রাচীন রুদ্রশক্তি। এখানেই শুরু হবে চূড়ান্ত লড়াই।

১০

অরিত্রর মুখ তখন সাদা হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে সেই পুরনো মাটির প্রস্তরলিপি, তাতে খোদাই করা—“শেষের ঘণ্টা বাজলে, আবার ফিরবে যারা হারিয়েছে সব কিছু।” ঈশিতার ঠোঁট কেঁপে উঠছে। দেউলের ভেতরটা যেন কাঁপছে, এক তীব্র শব্দের কম্পনে। হঠাৎ বেদির ওপর রাখা সেই পুরনো খন্ডিত কালীমূর্তির চোখ জ্বলতে লাগল একধরনের আগুনে আলোয়। কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে মাটির তলা থেকে—ধীরে, ভারী, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ছায়ামূর্তি। তান্ত্রিক! সেই চর্মচক্ষে অদৃশ্য কিন্তু অনুভবযোগ্য অস্তিত্ব, যার উপস্থিতি এতদিন শুধু মন্ত্রোচ্চারণে আর ঘুমের ভেতর ছিল—আজ সে এসেছে সামনে, যেন জেগে উঠেছে শতাব্দী প্রাচীন ঘুম থেকে। তার গলায় রয়েছে রুদ্রাক্ষর মালা, হাতের আঙুলে কপাল-ভেদী আঙুল তুলেই ঈশিতার দিকে ইঙ্গিত। “তুমি সেই মন্ত্রপাঠ করেছ, মেয়ে। আমি ফিরে এসেছি… কিন্তু তুমি প্রস্তুত নও।”

অরিত্র চিৎকার করে উঠল, “ঈশিতা, পেছনে আসো!” কিন্তু ঈশিতা দাঁড়িয়ে রইল স্থির, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তার পা আটকে রেখেছে। হাওয়ার ঝাপটায় তার চুল উড়ছে, চোখে এক অপার্থিব জ্যোতি। দেউলের পুরনো দেওয়ালে খোদাই করা প্রতীকগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, যেন নিঃশব্দে সক্রিয় হয়ে উঠছে শতবর্ষের রহস্য। হঠাৎ করেই ঘূর্ণির মতো এক অন্ধকার ছায়া চারপাশ ঘিরে ধরল ওদের। বায়ুর গতি এত প্রবল যে, বাইরে থাকা ক্যামেরা-ড্রোন, লাইটস—সব উড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ে। তান্ত্রিকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সেই চূড়ান্ত মন্ত্র—“তৎ ত্বমসী… চণ্ডিকা বিভাবরী…” মাটিতে তৈরি হয় এক ঘূর্ণিপাক, যেখান থেকে দেখা যায় এক আলোকময় দরজা, আর এক প্রান্তে কালো অতল অন্ধকার। ঈশিতার চোখে তখন এক দ্বন্দ্ব—সে কোথায় যাবে? সে কি মায়ার দ্বার পেরিয়ে মুক্তি খুঁজবে, নাকি সত্যের মুখোমুখি হবে?

ঠিক তখনই অরিত্র ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই একা যাবি না, যা হোক—আমরা একসঙ্গে।” তান্ত্রিক ছায়া তখন থেমে গেছে। তার চোখে বিস্ময়—এই যুগের মানুষ ভালোবাসা এখনো বোঝে? এক মুহূর্তের নিরবতায় সেই কালো দরজা বন্ধ হয়ে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়া আলো আবার স্তিমিত হয়ে আসে। দেউল যেন আবার নিঃশব্দ, ঠান্ডা। তান্ত্রিক ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কুণ্ডলিনীর ধোঁয়ায়। ঈশিতা আর অরিত্র ধীরে ধীরে বাইরে আসে, দুজনেই যেন শত বছরের ক্লান্তি নিয়ে। বাইরে সকাল হয়ে গেছে। প্রথম আলোর সোনালি রশ্মি দেউলের চূড়ায় পড়ছে। তারা জানে—তাদের মধ্যে যা ঘটে গেছে, তা শুধু ইতিহাস নয়, চেতনার এক নতুন অধ্যায়, যা আজও বাঁকুড়ার পাহাড়ে বাজিয়ে চলেছে এক অদৃশ্য তান্ত্রিক ঘণ্টা।

—-

 

1000045683.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *