Bangla - তন্ত্র

তান্ত্রিকের ছায়া

Spread the love

সুমেরু দাসগুপ্ত


পর্ব ১

চৈত্রের গরম হাওয়ায় ধুলোমাখা পথে হাঁটছিল এক যুবক, নাম তার শৌর্য। পেছনের গ্রামটা বহু দূরে, সামনে যে জঙ্গলের গায়ে একটা ছোট আশ্রম, সেখানেই তার গন্তব্য। শৌর্য এক কালে শহরের ছাপোষা ছাত্র ছিল, ইতিহাসে এমএ করেছে, তবে তার পিতামহের রেখে যাওয়া কিছু পুথি তাকে টেনে এনেছে এই অচেনা পথের দিকে। ওই পুথিগুলোতে ছিল এক প্রাচীন তান্ত্রিকের জীবন, যার নাম– কৃপাচার্য। তিনি নাকি মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতেন, আর তাঁর চক্ষু ছিল ত্রিনয়ন। অনেকেই বলেন, তিনি কালো জাদু করতেন, আবার কেউ বলেন, তিনি প্রকৃত সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। এই দুই মেরুর মাঝেই শৌর্যের অনুসন্ধান।

জঙ্গলের ভেতরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাস পাল্টে গেল। এখানে যেন সময়টা পিছিয়ে গেছে শতবর্ষ। পাখিদের ডাক, বাঁশপাতার খসখস, আর দূরে বুনো কুকুরের হালকা ঘেউ ঘেউ—সব কিছু মিলে এক অদ্ভুত ছন্দ বাজছিল চারদিকে। আশ্রমে পৌঁছে শৌর্য দেখল, সেখানে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন—ধূসর দাড়ি, গা ছেঁড়া কাপড়, চোখ দুটো গভীর, যেন শত গল্প লুকিয়ে আছে তাতে। শৌর্য নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি এই আশ্রমের মহন্ত?”

বৃদ্ধ একটু হেসে বললেন, “তুই যদি উত্তর খুঁজতে এসে থাকিস, তাহলে আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।” শৌর্য থমকে গেল। এই লোক কীভাবে জানলেন সে আসছে?

বৃদ্ধ বললেন, “তোর ঠাকুরদার পুথিগুলো আমি নিজেও পড়েছি। কৃপাচার্য্য আমার গুরু ছিলেন। তবে ওঁর পথ সাধারণ লোকের জন্য নয়। তুই কি তোর চেতনার চেয়েও বড় অন্ধকারে নামতে প্রস্তুত?”

শৌর্য মাথা নাড়ল। সে জানে, উত্তর খোঁজার জন্য ভয় পেলে চলবে না। বৃদ্ধ তার হাত ধরে আশ্রমের পেছনের গুহার দিকে নিয়ে চললেন। গুহার মুখে বড় এক বটগাছ, তার শিকড় ঝুলে যেন পৃথিবীকে আঁকড়ে আছে।

গুহার ভেতরে এক বিশাল যজ্ঞমণ্ডপ। সেখানে পাথরের ওপর খোদাই করা চক্র, মান্দালা, আর নানা তান্ত্রিক প্রতীক। বৃদ্ধ একটি দীপ জ্বালিয়ে দিলেন, আলোতেই যেন পুরোনো কাল জেগে উঠল। তিনি বললেন, “তন্ত্র শুধু মন্ত্র নয়, তন্ত্র মানে অভিজ্ঞতা, ভয়, ত্যাগ আর শেষপর্যন্ত আত্মসন্ধান।”

পরদিন ভোরে শুরু হল শৌর্যের দীক্ষা। প্রথমেই তাকে শিখতে হল নিঃশব্দ ধ্যান। বৃদ্ধ বললেন, “শব্দ হলো বৃত্তি, আর তন্ত্র হলো বৃত্তির ঊর্ধ্বে যাওয়ার কৌশল। চোখ বন্ধ করে তুই যা দেখবি, সেটাই আসল।”

তিন দিন পরে এক রাতে, গুহার মধ্যে বিশেষ পূজার আয়োজন হল। বৃদ্ধ একখানা পুরোনো খোলস আনলেন—যেটা শৌর্যের ঠাকুরদার পুথিতে কৃপাচার্যের ধ্বংসাবশেষ বলে উল্লেখ ছিল। সেই খোলসে আজও লেগে ছিল পুরোনো রক্তের দাগ। শৌর্য অনুভব করল, গুহার বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, যেন কারো নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে লাগছে।

সে রাতে স্বপ্নে শৌর্য এক অদ্ভুত স্থান দেখল—চারিদিকে শ্মশান, আগুনের আলোয় ছায়া নাচছে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে বলছে, “তুই কি পারবি এই আগুন পার হতে? তোর আত্মা কি যথেষ্ট শক্তিশালী?”

ঘুম ভেঙে সে দেখল, গুহার বাইরে ঝড় উঠেছে। বৃদ্ধ তখনো ধ্যানস্থ। পরদিন সকালে বৃদ্ধ বললেন, “তোর স্বপ্নটা আসল। তুই প্রথম স্তর পেরিয়েছিস।”

এরপর শুরু হল তার যাত্রার দ্বিতীয় স্তর—ভয়ের সঙ্গে সখ্য গড়া। তাকে নিয়ে যাওয়া হল আশ্রমের পেছনের এক পরিত্যক্ত চিতায়, যেখানে বহু বছর আগে এক তান্ত্রিক আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। সেখানে সে এক রাত কাটাবে, একাকী। শুধু একটি প্রদীপ, একখানা রুদ্রাক্ষ, আর কৃপাচার্যের পুরোনো কপাল-লালিত মন্ত্র লেখা এক পুঁথি।

রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গেই শৌর্য টের পেল, কিছু একটা ওর চারপাশে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাস যেন কথাবলে, ছায়া যেন দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে। তার বুকের মধ্যে হৃদস্পন্দন বেড়ে চলল, কিন্তু সে পুঁথির মন্ত্র জপ করে চলল—“ক্লীং কালিকা এঁ হূঁ।” গা শিরশির করতে থাকলেও সে থামল না।

হঠাৎ, তার চোখের সামনে এক মেয়ের আকৃতি দেখা দিল। তার গায়ে সাদা শাড়ি, কপালে রক্তবিন্দু, আর চোখজোড়া যেন তীব্র রক্তিম। সে বলল, “তুই কে যে আমায় ডাকিস?” শৌর্য ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। কিন্তু মনে পড়ল—তন্ত্রের নিয়ম, ভয় মানেই বাধা, আর তাকে পার হতেই হবে। সে বলল, “আমি শৌর্য, জ্ঞানের সন্ধান করি।”

মেয়েটি তখন হেসে উঠল—হাসি নয়, যেন আগুনের শিখা। বলল, “তাহলে আয়, তোর পথ এই রক্ত দিয়ে লেখা।” আর তারপর সে মিলিয়ে গেল বাতাসে।

শৌর্য সেই রাতে বাঁচে কি না, তার উত্তর ছিল পরদিন বৃদ্ধের মুখে। তিনি বললেন, “তুই এখন কৃপাচার্যের ছায়ার সঙ্গে চলতে প্রস্তুত। এখনো আটটি স্তর বাকি। তোর পথ রক্তে লেখা, তবে তোর সিদ্ধান্তই ঠিক করবে তুই কিসে রূপান্তরিত হবি—সাধুকে না অসুরে।”

পর্ব ২

তৃতীয় প্রহরের কুয়াশা ভেদ করে আশ্রমের পুরোনো ঘণ্টা বেজে উঠল। শৌর্যর চোখ খুলতেই সে বুঝল, তার দেহটা যেন আর তার নিজের নেই। হাত পা ভারী, মস্তিষ্ক ঝিমধরা। কিন্তু তার ভিতর কোথাও যেন এক অন্যরকম আলো জেগে উঠেছে। আগের রাতের সেই রহস্যময় মেয়েটি, তার কণ্ঠস্বর, আর চোখের আগুন—সবকিছু এখনো তার চেতনায় ঝাপসা হয়ে ফুটে আছে। বৃদ্ধ তার সামনে এসে বসে বললেন, “তুই প্রথম সত্যের মুখোমুখি হয়েছিস। এখন থেকে শুরু হবে তোর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ।”

আশ্রমের পেছনে একটি ছোট পুকুর আছে, যার জলে কেউ আজকাল নামে না। বৃদ্ধ জানালেন, বহু শতাব্দী আগে এই পুকুর ছিল তান্ত্রিকদের ‘আবিসার কুণ্ড’। যারা নিজের গভীরতম ভয়, বাসনা ও স্মৃতি ভাসিয়ে দিতে পারত, তাদেরই অনুমতি দেওয়া হত শেষতপস্যার জন্য। শৌর্যকে সেই পুকুরে নামতে হবে, তবে শুধু শরীর নয়—সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে একটা অর্পণ।

বৃদ্ধ তাকে একটি কালচে-পার্চমেন্টের পুঁথি দিলেন। তাতে লেখা ছিল, “যাহা তুই ভয় পাইস, তাহাই তোর আরাধ্য হউক।” শৌর্য বুঝতে পারল, এই পথে বাঁচতে হলে তাকে নিজের ছায়াকে আলিঙ্গন করতে হবে। পুকুরের ধারে বসে সে চোখ বন্ধ করল, শ্বাস ধীরে টানল। তার মনে ভেসে উঠল পুরোনো শহরের দিনগুলো—ছোটবেলা, বাবার মুখ, মায়ের দীর্ঘশ্বাস, আর সেই রাত্রি, যেদিন তার দিদি নিখোঁজ হয়েছিল। কেউ জানত না সে কোথায় গেল। কিন্তু শৌর্য জানত—দিদি তন্ত্রের সঙ্গে জড়িত কিছু একটার সন্ধানে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকেই তন্ত্র তার রক্তে ঢুকে গিয়েছিল, তার নেশা হয়ে উঠেছিল রহস্য খোঁজা।

পুকুরের জলে পা দিয়েই শৌর্য টের পেল, এটা সাধারণ জল নয়। যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভিতরে, ঠান্ডা নয়, বরং গা ছমছমে উষ্ণতা। তার পা দুটো কেঁপে উঠল, কিন্তু সে পিছু হটল না। পুকুরের মাঝ বরাবর গিয়ে সে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করল, মনে মনে জপ করতে লাগল সেই মন্ত্র—“অহমেতস্য দানবস্য ছায়াসুপ্তে হৃদি নিবিষ্টা কালি চ।” হঠাৎই তার মাথার ভেতর একটা শব্দ হল—ধপ!

সে যেন তলিয়ে গেল কোনো অন্ধকার গহ্বরে। চোখ খুলে সে দেখতে পেল, চারদিক একরাশ ছায়া, আর মাঝখানে তার দিদি বসে আছেন। কিন্তু তিনি যেমন ছিলেন, তেমন নয়। চোখে কালি, কপালে রক্ত, ঠোঁটে একটা নিষ্ঠুর হাসি। তিনি বললেন, “তুই আমার পথ ধরে হাঁটছিস কেন? আমি পারিনি, তাই কি তুই পারবি?” শৌর্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এ কি তার চেতনার খেলা, না সত্যিই তার দিদির আত্মা তার সঙ্গে কথা বলছে?

সে ধীরে বলল, “আমি শুধু জানতে চাই—তুই কোথায় গেলি, তুই কি ফিরে আসতে চাস?” তার দিদি বললেন, “আমি ফিরে আসব, যদি তুই তোর শরীর আমাকে দিস। এই পুকুর আমার বাসা এখন। আমার আত্মা এই জলে আটকে আছে। তুই যদি আমায় জায়গা দিস, আমি তোকে সব তন্ত্র শেখাব।”

এই প্রস্তাবে শৌর্যর সারা দেহে কাঁপুনি ধরে গেল। তার নিজের বোন, যার মুখে সে একসময় রূপকথা শুনত, এখন তার কাছ থেকে শরীর চায়? কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার ভেতর থেকে এক কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল—“তন্ত্র নিজের ছায়া দেয়, তবে দেহ নয়। আমি তোর মুক্তি চাই, আত্মাহুতি নয়।” কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের জল টালমাটাল হতে লাগল, আর তার দিদির ছায়া এক আর্তনাদে মিলিয়ে গেল জলের নিচে।

শৌর্য আচমকা উঠে এল পুকুর থেকে। গা ভিজে, দেহ ঠান্ডায় কাঁপছে, কিন্তু তার চোখে এক নতুন দৃঢ়তা। বৃদ্ধ বললেন, “তুই দ্বিতীয় স্তর পেরিয়েছিস। তোর আত্মা এখন আর কাঁচা নয়। এখন তুই শুনবি সেই শব্দ, যেটা কেবল সিদ্ধদের কানে ধ্বনিত হয়।”

রাতের খাবার ছিল একমুঠো ফল আর মধু। খেয়ে শৌর্য গুহায় ফিরে medit করতে বসল। ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে যেন। হঠাৎ তার কানে এলো এক গম্ভীর ধ্বনি—না সেটা শব্দ নয়, যেন নিজের বুকের ভেতর কোথাও বাজছে। “কৃপা কর, অন্তঃসত্ত্বা করো তন্ত্রে”—এই শব্দ ভেসে এল তার চেতনায়। সে জানে না কোথা থেকে এল, কে বলল, কিন্তু বুঝল, তার দেহে কিছু একটার শুরু হয়ে গেছে। সে অনুভব করল, তার শিরা উপশিরায় যেন আগুন বইছে। চোখ খুলে সে দেখল, তার কপালে একটি উজ্জ্বল তিলক ফুটে উঠেছে—আপনিই, কোনো কিছু ছোঁয়া ছাড়াই।

বৃদ্ধ হাসলেন, “এবার তুই নিজেই এক পাঠক, এক পাণ্ডুলিপি। এই চিহ্ন কৃপাচার্যের অনুমতি। এখন থেকে যা দেখবি, তাই লিখবি তোর রক্ত দিয়ে। তুই তোর পথের তৃতীয় দরজায় দাঁড়িয়ে।”

গভীর রাতে আশ্রম জুড়ে হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ চলছিল। শৌর্য জানত, আগামী পর্বে তাকে নামতে হবে আত্মার গভীরে, যেখানে আর কোনো স্মৃতি, ভয় কিংবা ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সে প্রস্তুত। কারণ তার ভেতর এখন জেগে উঠেছে এক অচেনা শক্তি, যে শক্তি প্রশ্ন নয়, উত্তর।

পর্ব ৩

শৌর্যর কপালে ফুটে ওঠা তিলকটি জ্যোৎস্নার নিচে যেন জ্বলজ্বল করছিল। সে নিজেই জানে না কীভাবে সেই চিহ্ন তার দেহে এল, কে তাকে এঁকে দিল, কিংবা তার মানে কী। কিন্তু তার অন্তর বলছিল, এ চিহ্ন শুধুই শারীরিক নয়—এ একটি সাক্ষর, যা চেতনার ভিতরেও কেটে বসেছে। গুহার ঠান্ডা বাতাস, ধূপের গন্ধ আর পুরোনো পাথরের ওপর বসে সে অনুভব করল—তার ভেতরে কিছু একটা সরে গেছে, যেন কোনো একতারা থেকে টান উঠে এসেছে নিঃশব্দে।

বৃদ্ধ বললেন, “এই চিহ্ন তোর অগ্নিসূচী। এখন থেকে তোর প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি স্বপ্ন—সবকিছু তোর ভিতরে জাগাবে এক অন্য সত্য। এখন সময় এসেছে চতুর্থ স্তরে প্রবেশের, যেখানে আত্মা ছাড়িয়ে উঠতে হবে লিপ্সা ও আকাঙ্ক্ষার কুয়াশা।” শৌর্য জিজ্ঞাসা করল, “এটা কেমন স্তর?” বৃদ্ধ হেসে বললেন, “এই স্তরে তুই মুখোমুখি হবি সেই রূপের, যেটা তুই দমনে ব্যর্থ হয়েছিস জীবনে বারবার—লালসা, মোহ, প্রেম আর স্বপ্ন—সব মিলে এক জাল বোনে, যেটা ছিঁড়তে গেলে হৃদয় ছিন্ন হতে পারে।”

পরদিন ভোরে, তাকে নিয়ে যাওয়া হল আশ্রমের এক অজানা কোণে—এক গোলাপি পাথরের তৈরি গর্ভগৃহে, যার দরজা কেবল পূর্ণিমার রাতে খোলে। সেখানে একটি ছোট দেবীমূর্তি—নির্বাক, নগ্ন, চোখ বাঁধা, আর হাতে একটি খাপহীন খড়্গ। বৃদ্ধ বললেন, “এ হচ্ছে রূপান্তর দেবী—যিনি কাম ও জ্ঞান, উন্মাদনা ও ধ্যান—সবকিছুর একযোগ প্রতীক। আজ রাতে তুই এ দেবীর চরণে বসবি, এবং নিজের চরম আকাঙ্ক্ষা তার সামনে নিবেদন করবি। যদি সে গ্রহণ করে, তুই স্তর পার করবি। যদি সে প্রত্যাখ্যান করে, তোর ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে যেতে পারে।”

রাত গভীর হল। শৌর্য একাকী বসে, দীপশিখার সামনে নিজের শরীর ও চেতনার মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন টের পেল। মনে হতে লাগল, তার সমস্ত পুরোনো প্রেম, কামনা, স্পর্শ, চাহিদা—সব একে একে ফুটে উঠছে মনে। তার কলেজ জীবনের ভালোবাসা, সেই মেয়েটি, যার হাসিতে সে নিজের ঘুম হারিয়েছিল, যার চোখে সে একসময় ভবিষ্যৎ দেখত—তার স্মৃতি যেন মেঘের মতো ভেসে এল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, সেই মেয়েটিই মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে। বাস্তব, না কল্পনা, সে জানে না। মেয়েটির ঠোঁট নড়ে উঠল, “তুই কি আজও আমায় চাস?”

শৌর্যর দেহ জ্বলে উঠল এক তপ্ত ইচ্ছায়। কিন্তু তার ভেতরের আরেক কণ্ঠ বলল, “না, এটা পরীক্ষা। আমার আকাঙ্ক্ষা যদি আমার পথ হয়, তবে সেই পথেই আমি বাঁধা পড়ব।” সে ধীরে বলল, “আমি তোকে ভালবাসতাম, এখনও করি, কিন্তু আমি এখন তোর চাইতেও বড় কোনো সত্য খুঁজি।” মেয়েটি চোখ মুছে হেসে বলল, “তুই পারলি, শৌর্য। আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ নয়, উপলব্ধি। তুই উপলব্ধি করলি যে কাম মানে বন্ধন নয়, এক উপলব্ধির সেতু।”

মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটি মিলিয়ে গেল, আর দেবীমূর্তির চোখের কাপড় আপনিই খসে পড়ল। তাতে একটি অগ্নিদৃষ্টি—শান্ত, নির্লিপ্ত, কিন্তু গভীর। যেন সেই চোখ বলে উঠল, “তুই পাশ করেছিস।”

পরদিন সকালবেলা শৌর্যর দেহে হালকা জ্বর দেখা দিল, কিন্তু তার চোখে ছিল শান্তি। বৃদ্ধ বললেন, “এ জ্বর শুদ্ধিকরণ। তোর চতুর্থ স্তরের মায়া গলছে। এবার তুই প্রস্তুত পাঁচম স্তরের জন্য—তোর নিজের ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।”

সন্ধ্যেবেলা, আশ্রমের সামনে একটি বটবৃক্ষের নিচে বসে থাকল শৌর্য। বৃদ্ধ বললেন, “আজ রাতে তুই মুখোমুখি হবি ‘অন্তর্অহংকারের’। তোর সেই রূপ, যেটা তুই চিরকাল অস্বীকার করেছিস—লোভী, হিংস্র, অসৎ, কামুক, অহঙ্কারী—যে রূপ তোর ছায়ায় বাস করে। আজ তাকে আলিঙ্গন না করলে তুই নিজের প্রকৃত রূপ চিনবি না।”

রাত বাড়তেই হঠাৎ চারদিকে নেমে এল এক থমথমে নিস্তব্ধতা। বাতাস থেমে গেল, পাখিরা উধাও। বটগাছের ছায়ায় হঠাৎ ফুটে উঠল আরেকটা শৌর্য—হুবহু এক, কিন্তু চোখে হিংসা, মুখে বিদ্রূপ, আর হাতে ছুরি। সে বলল, “আমি তোর আসল রূপ। তুই যতই জ্ঞানী সাজিস, ভিতরে তুই আমিই—ভয়ানক, কামুক, হিংস্র। তুই কি আমায় মেনে নিবি?”

শৌর্য থমকে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এমন এক সত্তা, যাকে সে কেবল দুঃস্বপ্নে দেখেছে, যার অস্তিত্ব সে বরাবর অস্বীকার করেছে। কিন্তু আজ সে বুঝল, তন্ত্র মানে নিজের আলো নয়, নিজের অন্ধকারকেও আলিঙ্গন করা। সে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসল, চোখ নামাল, আর বলল, “আমি তোকেও গ্রহণ করি, কারণ তুই না থাকলে আমি সম্পূর্ণ নই।”

সে মুহূর্তে দুই শৌর্যের শরীর জড়িয়ে গেল এক আলিঙ্গনে, আর সেই ছায়ার রূপ মিলিয়ে গেল বাতাসে। তখন যেন পুরো জঙ্গল নিঃশ্বাস ফেলল একসাথে। দূরে বাজ পড়ল, আর এক জ্যোতির রেখা এসে শৌর্যর মাথার ওপরে যেন আশীর্বাদ বুলিয়ে দিল।

বৃদ্ধ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন আর বললেন, “তুই নিজের অন্ধকার আলিঙ্গন করেছিস, এখন তুই আলোয় চলার উপযুক্ত। তুই এখন একজন প্রকৃত তান্ত্রিকের অভিযাত্রী।”

পর্ব ৪

পঞ্চম প্রহরের ঘন্টাধ্বনি বাজতেই আশ্রম যেন নিঃশ্বাস ফেলল নতুনভাবে। শৌর্যর চোখে এখন এক গভীর শান্তি, কিন্তু তার দেহ যেন ক্লান্ত যুদ্ধবাজ সৈনিকের মতো—ভেতরে জমে থাকা হিম ও আগুন একসাথে ধ্বংস করে চলেছে তাকে। বৃদ্ধ সেই সন্ধ্যায় তাকে ডেকে বললেন, “তুই এখন ছয়ষ্ঠ স্তরে পৌঁছেছি, যেখানে তোর চেতনা আর বাহ্যিক নয়। এই স্তর হলো আকাশতন্ত্রের স্তর—যেখানে জ্ঞান চোখ দিয়ে দেখা যায় না, বরং শব্দের নিচে, শূন্যতার ভেতর থেকে উঠে আসে।”

শৌর্য চুপচাপ শুনছিল। তার মনে বারবার ঘুরছিল একটি শব্দ—“বীজ”—যেটা গতরাতে তার স্বপ্নে ফুটে উঠেছিল আগুনের শিখা হয়ে। স্বপ্নে সে দেখতে পেয়েছিল, আকাশে ঝুলছে এক বিশালাকার চোখ, যার কেন্দ্র থেকে বারবার ছুটে আসছে মন্ত্র। সেই চোখ তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুই এখন শব্দকে ভাঙবি, সুরকে ছেদ করবি, অর্থের নিচে খুঁজবি রূপ।”

বৃদ্ধ তার হাতে একটি ধাতব থালা দিলেন, যার ওপর খোদাই করা ছিল চক্রের মতো এক নকশা—কেন্দ্রে একটি বিন্দু, আর তাকে ঘিরে ঘুরছে আটটি রেখা। “এটাই শ্রুতি-মণ্ডল। এখানেই তুই শুনবি সেই ধ্বনি, যা সৃষ্টি আর বিনাশ একসাথে গায়। তুই আজ রাত কাটাবি এই থালার সামনে বসে, কোনো শব্দ না করে। শুধু কান দিয়ে নয়, সারা শরীর দিয়ে শুনতে হবে। যদি শোনার ক্ষমতা অর্জন করিস, তোর রক্তে বীজ মন্ত্র জন্ম নেবে।”

রাত গভীর হল। শৌর্য ধূপ জ্বেলে থালার সামনে বসে পড়ল। চারদিক নির্জন, বাতাস নিথর, পাথরের গায়ে ধাক্কা খায়নি কোনো গুঞ্জন। সময় থেমে গেছে যেন। প্রথম কিছুক্ষণ, কিছুই না—শুধু নিজস্ব নিঃশ্বাসের শব্দ। তারপর, হঠাৎ সে টের পেল, তার বুকে ধ্বনিত হচ্ছে এক অদ্ভুত কম্পন। না, সেটা হৃদস্পন্দন নয়—সেই শব্দ যেন থালা থেকে উঠে এসে তার শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। ‘হুম্ম… হুম্ম… হ্রাম…’—একটি গভীর শব্দ, যেন অস্তিত্বের ভেতরেই সুর বাজছে।

তারা ছাড়া আকাশে আর কিছু নেই। ধীরে ধীরে তার দেহ ঝিমিয়ে আসছে, কিন্তু মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আলো খুলে যাচ্ছে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে শব্দকে—হ্যাঁ, শব্দেরও রঙ আছে, রূপ আছে। একটি মন্ত্র যেন নিজেই এসে দাঁড়াল তার কপালের ঠিক সামনে—“ক্লীং”—এই এক বীজমন্ত্র। সে শব্দ যেন আকাশের দুধারে বিস্ফোরণ ঘটাল, আর শৌর্যর শরীর ভেতর থেকে কেঁপে উঠল। মনে হল তার দেহের প্রতিটি কোষে এই শব্দ নিজেকে বসিয়ে নিচ্ছে।

সে তন্দ্রার মধ্যে দেখল, তার সামনেই বসে আছে তার মা। মুখে আগুনের মতো শ্লথ হাসি, হাতে তুলসী গাঁথা। বলছেন, “তুই আমাকে ছেড়ে আসছিস, কিন্তু আমি তোকে ছাড়িনি। তোর ভেতর দিয়ে আমি দেখছি। তুই আমাকে স্মরণ কর, তুই তোর মূল চিনিস।” সেই কণ্ঠস্বর তার বুকের ভেতরে গেঁথে রইল।

ভোর হওয়ার কিছু আগে, শৌর্য হঠাৎ চমকে উঠল। তার শরীর ঘামে ভেজা, কিন্তু ঠান্ডা নয়। সে জানে—সে শুনতে পেয়েছে সেই শব্দ, যেটা ভাষায় বলা যায় না। বৃদ্ধ কাছে এসে বললেন, “তুই এখন এক বীজ ধারণ করেছিস। তোর রক্ত এখন শব্দ বহন করে। এবার তুই যা বলবি, তাই ঘটতে পারে। কিন্তু সাবধান—এই ক্ষমতা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপও হতে পারে। যেহেতু তোকে শোনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাই তোকে বলতে হবে কম। যত বেশি জানবি, তত বেশি চুপ থাকতে হবে।”

এরপরের দিনগুলোয় শৌর্য আলাদা ধ্যানে বসে থাকত। কারো সঙ্গে কথা বলত না। তার চোখের নিচে গাঢ় কালো ছায়া জমতে থাকে, কিন্তু মুখে যেন কোনো অদৃশ্য দীপ্তি। আশ্রমের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকত তার দিকে, যেন কেউ আগুনের দিকে তাকায়—ভয় আর মুগ্ধতা একসাথে।

একদিন, হঠাৎ করেই শৌর্যর দৃষ্টি আটকে গেল একটি কিশোরে—এক নতুন আগত, বয়স হবে পনেরো কি ষোলো। সে চুপচাপ এক কোণে বসে, কাঁধে একটি কাপড়, চোখে দৃষ্টির গাঢ়তা, যেন সে কাউকে খুঁজছে। শৌর্য তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুই কে?” কিশোর বলল, “আমি কৌশিক। আমি সেই রক্তের উত্তরসূরী, যাকে একদিন চিহ্ন দেওয়া হয়েছিল এই আশ্রমে। আমি এসেছি আমার দাদা শৌর্যকে খুঁজতে।”

শৌর্য স্তব্ধ। এই কৌশিক তার ভাই? যে তাকে শেষবার দেখেছিল সাত বছর বয়সে, যখন তারা আলাদা হয়ে যায়? এখন সে নিজেই চলে এসেছে এই পথে? বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বললেন, “শোন, রক্ত কখনো ডাকে না—সে টানে। যেহেতু তুই শোনার শক্তি পেয়েছিস, এবার সময় এসেছে কথা বলার। তোর শব্দে এখন সৃষ্টি আছে। এই বালক তোর উত্তরাধিকার, এবং হয়ত তোর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।”

শৌর্য গভীরভাবে তাকাল কৌশিকের চোখে। সেখানে ছিল ছায়া, আগুন, আর অন্ধকার। সে বুঝল, তার পথ এখন একা নয়। তার বীজ এখন অন্যে রোপণ করতে হবে—যেমন তন্ত্র তাকে দিয়েছে, তেমনি সে দেবে পরবর্তীকে।

সে রাতে, সে প্রথমবার নিজের কণ্ঠে উচ্চারণ করল সেই শব্দ—”ক্লীং”—ধীরে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে। শব্দটা বায়ু কেটে গিয়ে কৌশিকের বুক ছুঁয়ে ফিরে এল—নির্ভুল, নিঃশব্দ, কিন্তু স্থায়ী।

পর্ব ৫

শৌর্যর কণ্ঠে উচ্চারিত “ক্লীং” শব্দটা যেন কৌশিকের শরীরের ভেতর ঢুকে একসাথে সমস্ত দরজা খুলে দিল। তার চোখ যেন হঠাৎই অদৃশ্য কোনো আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠল। আশ্রমের নিস্তব্ধতা সে মুহূর্তে একটু কেঁপে উঠল, যেন শব্দটাই বাস্তবতাকে আলাদা করে ফেলেছে। শৌর্য বুঝল, সে কেবল বীজ উচ্চারণ করেনি—সে সেই বীজ রোপণ করেছে। কৌশিক বসে থাকলেও তার চোখ দুটো বন্ধ, ঠোঁটে ফিসফিস করে উঠল, “এই শব্দ আমি আগে কোথাও শুনেছি, কোনো ঘুমের ঘরেই হয়তো।” শৌর্য কিছু বলল না, শুধু কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল, স্পর্শে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।

পরদিন সকালে কৌশিক জানাল, সে রাতভর এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নে সে দেখতে পেয়েছে এক তামার দরজা, যেটা তার মুখের সামনেই ভাসছিল, আর তাতে লেখা ছিল—”যা দেখিস, তা সত্য নয়; যা জানিস, তা সম্পূর্ণ নয়; যা তুই হবি, তা এখনও তোর কাছে অচিন।” বৃদ্ধ গুরু তখন বললেন, “তোর ভ্রাতৃত্ব এখন পূর্ণতা পেয়েছে। এবার সময় এসেছে সপ্তম স্তরে যাওয়ার—সেই স্তরে যেখানে তোর শরীর হয়ে উঠবে তন্ত্রের পাত্র।”

শৌর্য এবং কৌশিককে একসাথে নিয়ে যাওয়া হল আশ্রমের দক্ষিণ প্রান্তের পুরনো কূপের কাছে। সেই কূপ আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী কেবলমাত্র শুদ্ধ আত্মাদের জন্য খোলা হয়—যারা নিজের শরীরকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। গুরু বললেন, “এই কূপের নিচে আছে ‘অগ্নিকোশ’—একটি অদৃশ্য আগুন, যা দেহের সমস্ত অবাঞ্ছিত শক্তি পুড়িয়ে ফেলে। তন্ত্র তখনই সত্য হয়ে ওঠে, যখন শরীর নিজেই তার পাত্র হতে পারে। তোমাদের শরীর এখন পরীক্ষায় বসবে।”

তাদের বলা হল তিনদিন উপবাস করে শুধুমাত্র নির্জন স্থানে ধ্যান করতে। শৌর্য কূপের পাশে বসে, চোখ বন্ধ করে শুনল সেই শব্দ, যেটা গতরাতে তার কণ্ঠে এসেছিল। কিন্তু এবার সেই শব্দের গভীরে যেন কোনো অদ্ভুত চিৎকার লুকিয়ে ছিল। মনে হল, কে যেন তাকে ডাকছে—তীব্র আকুতি নিয়ে, ভয় আর ভালোবাসার একসাথে মিশেলে। সেই কণ্ঠ তার চিনা নয়, কিন্তু তার রক্ত চিনে তাকে। কৌশিক পাশের গুহায় বসে, হঠাৎ করেই নিজের বুক পিটিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। যেন তার ভেতরের সব আঘাত, সব তীব্রতা একসাথে বেরিয়ে আসছে। সে জানত না কেন, কিন্তু অনুভব করল—সে নিজেই ছিল তার সব প্রতিরোধের মূল। তার ভেতরের অহঙ্কার, প্রতিযোগিতা, সেই ভাইকে হারিয়ে ফেলার ভয়—সব আজ জেগে উঠেছে।

তৃতীয় রাত, হালকা বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়তেই শৌর্যর শরীর জেগে উঠল। সে অনুভব করল, তার চর্মের নিচে কিছু একটাকে নড়ছে, যেন পুরনো কোনো বিষ, অথবা শক্তির আধার নিজেকে প্রস্তুত করছে। গায়ে কাঁপুনি, চোখ ভারী, কিন্তু হৃদয় ফুরফুরে। ঠিক সেই মুহূর্তে কূপ থেকে বেরিয়ে এল এক শ্বাস—অদৃশ্য, কিন্তু প্রবল। তা যেন শরীরের সমস্ত শিরা ছুঁয়ে বলল, “তুই প্রস্তুত।”

ভোর হওয়ার পর, গুরু বললেন, “আজ তোমরা কূপে নামবে। নিজের শরীরকে সঁপে দিতে হবে অগ্নিকে। যদি সত্যিই তন্ত্র তোমাদের গ্রহণ করে, তবে তোমরা বেঁচে ফিরবে। যদি না করে, তবে দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কিন্তু আত্মা মুক্তি পাবে।” কৌশিক একটু দ্বিধায় পড়ল, কিন্তু শৌর্য তার হাত ধরল, বলল, “আমরা একসাথেই নামব। এই পথের শুরু যেমন আমি করেছিলাম, শেষটাও আমি তোকে নিয়েই করব।” তারা দুজনে একসাথে রশির মাধ্যমে নামতে লাগল কূপের অন্ধকারে।

ভেতরে নামতেই কুয়াশার মতো এক ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল, চোখে কিছুই দেখা যায় না, শুধু শোনা যায়—একটা ধ্রুব গুঞ্জন, যেন পৃথিবীর সমস্ত আদি শব্দ একসাথে বাজছে। তারা দুজন মাটিতে পা রাখতেই চারদিক থেকে আগুনের রেখা ভেসে উঠল। সেই রেখা তাদের ঘিরে এক বৃত্ত তৈরি করল। এক গম্ভীর নারী-কণ্ঠ যেন বাতাস কেটে বলল, “কে তোমরা, যারা শরীরকে পবিত্র করতে এসেছ?”

শৌর্য বলল, “আমি সেই, যে নিজের ছায়াকে চিনেছে, শব্দকে ধারণ করেছে, আগুনকে গ্রহণ করতে চায়।” কৌশিক বলল, “আমি সেই, যার রক্তে পূর্বপুরুষের চিহ্ন, কিন্তু যার পথ নতুন। আমি জ্বলতে চাই, ভস্ম হতে চাই, কিন্তু সত্য হয়ে উঠতে চাই।” আগুন যেন সেই কথায় কেঁপে উঠল, আর হঠাৎই দুজনের শরীরের চারদিকে থেকে জ্বলে উঠল লাল আলো—আলোর মাঝে যেন নাচছে কোনো নারী অবয়ব, চুল উড়ছে, চোখে মহাশক্তির ঘূর্ণি।

তারা বুঝতে পারল—তারা এখন আর শরীরমাত্র নয়। তারা এখন ‘তন্ত্রের রসায়ন’—যেখানে আত্মা আর দেহ এক হয়ে তৈরি করছে এমন এক অস্তিত্ব, যা আর আগেকার মতো নয়।

উপরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। আশ্রমে সকলে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে অপেক্ষায়। কূপের নিচ থেকে যখন তারা বেরিয়ে এল, তখন তাদের গায়ে আর আগের পোশাক ছিল না—তাদের শরীরে কেবল এক আঁচলের মতো তান্ত্রিক চিহ্ন। তাদের চোখ দুটি দীপ্ত, কিন্তু নরম, শান্ত, কিন্তু দুর্ধর্ষ।

গুরু তাদের দেখে কেবল বললেন, “এখন তোমরা শিষ্য নও। এখন তোমরা ধারক। তন্ত্র এখন তোমাদের শরীরেই বাজবে, এবং তোমরা যা বলবে, তা ইতিহাস হয়ে উঠবে।”

পর্ব ৬

শৌর্য এবং কৌশিক যখন আশ্রমে ফিরে আসে, তখন সূর্য সদ্য উদিত, তার কিরণ যেন ঠিক তাদের গায়েই প্রথম পড়ছিল। আশ্রমের প্রবীণ সন্ন্যাসীরা তাদের সামনে বসে ধূপ জ্বালিয়ে স্তব পাঠ করছিলেন—সেই স্তব, যা কেবলমাত্র ‘ধারক’দের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এক বৃদ্ধ বললেন, “আজ থেকে তোমরা আর শিক্ষার্থী নও, তোমরা নিজেই উপনিষদ। তন্ত্র এখন তোমাদের মাধ্যমেই বাঁচবে, এবং তোমাদের ভুলও ইতিহাস হবে।” এই উচ্চারণে শৌর্যর ভেতর কাঁপন জাগে, কারণ সে জানে—তন্ত্র কেবল শক্তি নয়, দায়িত্ব; এবং সেই দায়িত্ব এখন তার রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে।

দিনগুলো পালটে যেতে লাগল। এখন শৌর্য আর কৌশিক নিয়মিত যোগ করেন অগ্নিকুণ্ডের ধ্যানে, যেখানে প্রতিটি শ্বাসে উচ্চারিত হয় বীজমন্ত্র। তারা দুজনে আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে তন্ত্রের সাধনায় ব্যস্ত—শৌর্য মূলত শব্দ ও স্পর্শতন্ত্র নিয়ে এগোচ্ছে, যেখানে কৌশিক আকর্ষিত হচ্ছে রস ও গন্ধতন্ত্রের প্রতি। তাদের ধ্যানের ধরন আলাদা, অভিজ্ঞতাও ভিন্ন, কিন্তু কেন্দ্রে তারা একই বিন্দুতে পৌঁছায়—নিজস্ব আত্মাকে ছিন্ন করে মহাশক্তির সঙ্গে মিলনের চেষ্টা।

এক রাতে, ধ্যানরত অবস্থায় শৌর্য অনুভব করল, তার চারপাশ অন্ধকার নয়, বরং আলোয় ভরা। কিন্তু সেই আলো ভয়ানক—তা যেন ছায়াকে খেয়ে ফেলে। তার মাথার ভেতর বাজছে এক মন্ত্র, যেটা সে আগে কখনো শেখেনি—“ইং রিং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে”—এতটাই তীব্রভাবে এই শব্দ তার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ল যে সে শ্বাস নিতে ভুলে গেল। সে বুঝল—এই মন্ত্র স্বতঃসিদ্ধ নয়, এই মন্ত্র কারো ডাক। কেউ বা কিছু তার দিকে ফিরছে, কে যেন চাইছে সে খুলে ফেলুক সেই অন্ধ দরজা, যেটা এতদিন বন্ধ ছিল।

সেই রাতে তার স্বপ্নে দেখা দিল সেই নারী অবয়ব, যার চোখ ছিল রক্তাভ, যার কপালে ছিল ত্রিকোণ চিহ্ন, এবং যিনি বললেন, “তুই তো আমারই দেহ! আমাকে চিনে ফেলেছিস, এখন আমাকে ডাক। কিন্তু সাবধান, যদি তুই ভয় করিস, আমি তোর রক্ত পান করব।” সকালে ঘুম ভাঙতেই শৌর্য দেখল, তার কপালে নিজে থেকেই ফুটে উঠেছে সেই ত্রিকোণ চিহ্ন। সে বুঝতে পারল—মহাকালী তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছেন।

অন্যদিকে কৌশিক সেই সময় অনুভব করছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ—তার সামনে বসে থাকা পাথরের মূর্তির গা থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে, যা তার শরীরকে রসাত্মক করে তুলছে। সে সেই গন্ধ শুঁকে অনুভব করল, তার শরীর কেবল আর মাটি নয়—এটা এক চলমান বেদি, যেখানে দেবী নিজেই বসে আছেন। সে বুঝতে পারল, সে যা খায়, যা স্পর্শ করে, তা সবই এখন দেবীর প্রসাদ। কিন্তু সেই আনন্দের মধ্যেও সে অনুভব করছিল এক ভয়ানক ফাঁকা জায়গা—তার মনে হচ্ছিল, তার পূর্বজন্মের কোনো অপূর্ণ সাধনা এখন ফিরে এসে তাকে অধিকার করতে চাইছে। এক বৃদ্ধ তাকে বললেন, “তোর শরীর যখন মাধবী হয়ে উঠবে, তখন পুরনো জন্মের কামনা-বাসনা তো জেগে উঠবেই। কিন্তু তুই যদি বেঁচে থাকতে চাস, তবে সেই বাসনাকে আগুন বানিয়ে খাইয়ে দে তন্ত্রকে।”

তাদের এই নতুন জীবনে একটা গভীর পরিবর্তন হল, যখন তাদের সামনে হাজির হল এক নারী—নাম রুদ্রপ্রিয়া, বয়স চল্লিশের মতো, গায়ের রঙ কুচকুচে, চোখে সাপের মতো গভীরতা, এবং কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা সরাসরি হৃদয়ে আঘাত করত। সে বলল, “আমি এসেছি তোমাদের পুর্বশত্রুর খোঁজে, এবং তোমাদের পূর্বপরিচয়ের জন্য। তন্ত্র শুধু শক্তি নয়, ইতিহাসও বটে। তোমাদের রক্তে রয়েছে এক প্রাচীন সাধক বংশের সূত্র, যারা চৌত্রিশ বছর আগে বিপদ ঘটিয়েছিল। সেই অপরাধ এখনও পূর্ণ হয়নি।”

শৌর্য চমকে উঠল। সে জানত না তার বংশে কোনো সাধক ছিল, যারা এমন কিছু করেছিল। রুদ্রপ্রিয়া বললেন, “তোমার পিতামহ, যোগীনাথ, একসময় ‘কালীপ্রব্রজ্যা’ নামক নিষিদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রে প্রবেশ করেছিলেন। তার অভিসন্ধি ছিল দেবীকে দেহে অধিষ্ঠিত করে অমরত্ব অর্জন। কিন্তু সেই সাধনা অসমাপ্ত থেকে যায়, এবং তার ফলেই এই আশ্রমে এক মহাদুর্যোগ আসে। সেই প্রভাব আজও আছে, এবং সেই প্রভাবকেই এখন তুমিই পূর্ণ করবে।”

এই কথা শুনে কৌশিক ভীত হয়ে পড়ে। সে চিৎকার করে বলে, “আমি তো কিছু করিনি! আমি তো শুধু এসেছি সত্যকে জানবার জন্য!” রুদ্রপ্রিয়া হেসে বললেন, “সত্য তো রক্তে থাকে, মনে নয়। যদি তুই সত্য জানতে চাস, তবে তোকে নিজের পূর্বজন্মের দরজা খুলতে হবে।” সে তাদের হাতে দিল দুটি প্রাচীন তামার পাত্র, যার মধ্যে ছিল ধূলিধূসরিত এক যন্ত্রমণ্ডল—মাঝে ত্রিভুজ, আর পাশে লেখা ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের নাম।

শৌর্য এবং কৌশিক জানত না কীভাবে তারা সেই ইতিহাস বহন করছে, কিন্তু তারা জানত—এখন তাদের সাধনা আর কেবল আত্মমুক্তির জন্য নয়, এটা এক ঋণমোচন, এক আত্ম-উদ্ধার।

সেই রাতেই তারা দুজনে একসাথে বসে তন্ত্রের সেই নিষিদ্ধ মণ্ডলে ধ্যানমগ্ন হল। বাতাস ভারী, ধূপের গন্ধ যেন অতীত খুলে দিচ্ছে। চারদিক নিঃশব্দ, শুধু মাঝেমধ্যে ভেসে আসে দূর থেকে শঙ্খধ্বনি—অথবা হয়তো তা তাদের ভেতরের রক্তের ধ্বনি।

তারা জানত, একবার যন্ত্রমণ্ডলে প্রবেশ করলে ফিরবার পথ নেই। কিন্তু তারা প্রস্তুত। কারণ এখন তারা শুধু শিষ্য নয়, তারা দায়ভারে বাঁধা দুটি আত্মা—যারা বাঁচবে, অথবা ভস্ম হয়ে দেবীর কাছে নত হবে।

পর্ব ৭

তামার যন্ত্রমণ্ডলের সামনে বসে শৌর্য ও কৌশিক অনুভব করল, তাদের শরীর আর তাদের নিজের নয়। যেন প্রতিটি রক্তকণা নিজেই উচ্চারণ করছে মন্ত্র, প্রতিটি শ্বাসে জেগে উঠছে প্রাচীন কোনো স্মৃতি। চারদিকে একটি লালাভ আলোকবৃত্ত তাদের ঘিরে ধরল, যা নিঃশব্দে উঠতে লাগল উপরের আকাশ পর্যন্ত, আর সেই আলোর ভেতর তারা দেখতে পেল নিজ নিজ ছায়া—কিন্তু সেই ছায়ায় তাদের মুখ নয়, ছিল অন্য কেউ, হয়তো সেই পূর্বপুরুষ, যাঁরা অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিলেন তন্ত্রের সাধনা। শৌর্যর সামনে দেখা দিল এক বৃদ্ধ, যাঁর কপালে অগ্নিতিলক, গলায় রুদ্রাক্ষ, এবং চোখে ক্লান্তির পাশে প্রচণ্ডতা। তিনি বললেন, “তুই আমার রক্ত। আমি চেয়েছিলাম অমর হতে, দেবীর শরীরে প্রবেশ করে মহাশক্তি পেতে। কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সেই অপরাধ তুই পূরণ করবি, অথবা সেই অভিশাপ বহন করবি চিরকাল।” শৌর্য হতবাক হয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো কিছু করিনি!” বৃদ্ধ উত্তর দিল, “তুই যদি তন্ত্র চাস, তুই যদি সত্য চাস, তবে শুধু নিজেকে নয়, আমাকেও মুক্তি দিতে হবে।”

অন্যদিকে কৌশিকের সামনে ফুটে উঠল এক নারী—তার চেহারা রুদ্রপ্রিয়ার মতো, কিন্তু বয়সে অনেক কম, কপালে চন্দনবিন্দু, মুখে তীব্র শান্তি। তিনি বললেন, “আমি তোর মাতুল পক্ষের। একসময় আমিও তন্ত্র সাধিকা ছিলাম। আমিই তোদের বংশে প্রথম ‘অন্তর্লীন তন্ত্র’ প্রয়োগ করেছিলাম। কিন্তু সেই শক্তি আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। তুই যদি সাহসী হস, তোর রক্তে আমার ছাপ আছে, তোর শরীরে সেই যন্ত্র আছে, যেটা আবার জাগবে।”

শৌর্য এবং কৌশিকের মনে হচ্ছিল তারা আর স্বপ্ন নয়, সময়ের কোনো ভিন্ন স্তরে প্রবেশ করেছে। তাদের শরীর থেকে আলাদা হয়ে যেন মন, আর মনের ভেতর এক অন্ধকার পথ, যার শেষে শুধু আগুন। হঠাৎ মণ্ডলের মাঝখান থেকে উঠে এল এক কুণ্ডলী আকৃতি—ধোঁয়ার মতো, কিন্তু সেই ধোঁয়ায় চাক্ষুষ করা যায় দুটি চোখ। সেই চোখ দুটো সোজা তাকিয়ে রইল কৌশিকের দিকে, আর বলল, “তুই কি প্রস্তুত? যদি প্রস্তুত না হস, তবে পিছু হটে যা। কারণ আমি জাগলে কেউ স্থির থাকতে পারে না।” কৌশিক গলা শুকিয়ে বলল, “আমি ভয় পাই, কিন্তু আমি পিছু হটতে পারি না।”

এই স্বীকারোক্তির পরেই তাদের শরীর কেঁপে উঠল, যেন কোনো শক্তি প্রবেশ করছে। শৌর্যর বুকের মাঝখান দিয়ে চাকা ঘোরার শব্দ উঠল, সে বুঝতে পারল—তন্ত্রের সপ্তম চক্র, সহস্রার, জেগে উঠেছে। তার চোখে দেখা দিল অদ্ভুত নীল রঙের আলো, যা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে একসাথে নিজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। সে বুঝতে পারল—তার জন্ম হয়েছিল এই পথের জন্যই। সে ভুলে যেতে লাগল নিজের নাম, পরিচয়, সম্পর্ক—শুধু থেকে গেল তার ইচ্ছা, এক তীব্র আগুনের মতো ইচ্ছা—নিজেকে খুঁজে পাওয়ার।

ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। আশ্রমের উত্তরদিকের শালগাছ গুলো কাঁপতে লাগল, আর সেই শব্দে যেন বাতাস বলছিল—”কেউ জেগে উঠেছে, কেউ ফিরে আসছে।” বৃদ্ধ গুরু সেই শব্দ শুনে বলে উঠলেন, “ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে—তারা যদি বেঁচে ফেরে, তাহলে আমাদের সময় পাল্টে যাবে।”

ভেতরে তখন শৌর্য ধীরে ধীরে চোখ খুলল। কৌশিক তখনও গভীর ধ্যানে, তার নাকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু তার মুখে এক অপার্থিব শান্তি। শৌর্য তার দিকে তাকিয়ে থাকল, বুঝতে পারল—এই ছেলেটি আর তার ভাই নয়, সে এখন এক সহযোদ্ধা, এক জীবনযাত্রী, যার শরীরের প্রতিটি কণাও এখন তন্ত্রে নিবিষ্ট।

হঠাৎ করে চারপাশে অন্ধকার নেমে এল। সেই আলো, সেই চোখ, সেই স্বপ্ন—সব যেন গিলে ফেলল এক অতল গহ্বর। শৌর্য কেবল একটা শব্দ শুনতে পেল, “এবার তোর পরীক্ষা শুরু হল। তোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই শক্তি, যেটা দেবীকে নিজ হাতে তুলতে পারে, অথবা নিজেকেই ধ্বংস করতে পারে।” কৌশিক তখন নিঃশব্দে পড়ে গেল যন্ত্রমণ্ডলের ওপর। তার দেহ নিস্তেজ, নিঃশ্বাস বন্ধ।

শৌর্য ছুটে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল, আর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করল এক প্রবল বিদ্যুৎ প্রবাহ, যা তাকে ছিটকে ফেলল। সে বুঝতে পারল, কৌশিকের শরীরে কেউ বা কিছু প্রবেশ করেছে—কিন্তু সেটি দেবী নয়, সেটি কিছু পুরনো, জীর্ণ, কিন্তু তীব্রভাবে প্রতিশোধপরায়ণ। আশ্রমের মাটি কেঁপে উঠল, যেন ভেতর থেকে কিছু জেগে উঠেছে।

রুদ্রপ্রিয়া সেই মুহূর্তে দৌড়ে এসে বললেন, “তাড়াতাড়ি তাকে জাগাও! ও যদি এখন জেগে না ওঠে, তবে তার দেহে আটকে পড়বে এক নিষিদ্ধ আত্মা, যে চিরকাল কেবল প্রতিশোধ চায়।” শৌর্য বুঝতে পারল, আর সময় নেই। সে নিজের হাত কেটে রক্ত ছিটিয়ে দিল যন্ত্রমণ্ডলে। সেই রক্ত যেন নিজের পথ খুঁজে নিল—চক্রের মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রবেশ করল কৌশিকের কপালে।

এক দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল, আর কৌশিক হঠাৎ করেই চোখ খুলল। কিন্তু সেই চোখ কৌশিকের ছিল না। সেটা ঠান্ডা, ফাঁকা, এবং অতল অন্ধকারের মতো গভীর। সে শৌর্যের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, “তুই কে?” শৌর্য বুঝল, এখনই সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে। বা এখান থেকেই শুরু হতে পারে এক নতুন যুগ, এক নতুন সত্য, যা আগুনের মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে নিতে চায়।

পর্ব ৮

“তুই কে?” এই প্রশ্ন যখন কৌশিকের মুখ থেকে বেরোলো, তখন তার গলায় কৌশিকের নিজস্ব সুর ছিল না। সেটি ছিল শুষ্ক, ধাতব, আর তাতে কাঁপন ছিল না কোনো। শৌর্য কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল তার ভাইয়ের চোখে—সেই চোখ, যেটা সে চেনে, যেটাতে একসময় ভয়, দুঃখ, হাসি সবকিছু সে দেখেছে, এখন সেখানে শুধুই শূন্যতা। শৌর্য ধীরে ধীরে বলল, “আমি তোর ভাই। আমরা একসাথে এসেছিলাম এই পথ ধরতে।” কৌশিক তখন নিঃশব্দে বসে রইল, তার চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কেবল একটি ঠাণ্ডা পরখের দৃষ্টি। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল, যন্ত্রমণ্ডলের মাঝখানে গিয়ে বলল, “এই চক্রটি আমার নয়। আমি এসেছি অন্য দেহে। আমার নাম ছিল অগ্নিবিজয়। আমি ছিলাম তন্ত্রের মূল ধারার এক শিষ্য, যাকে শিকল পরিয়ে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল আগুনের নিচে।”

এই নাম শুনে রুদ্রপ্রিয়ার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে বলল, “না… এটা অসম্ভব! অগ্নিবিজয় তো ছিল সেই… যে দেবীকে বশ করার জন্য নিজের মা-কে উৎসর্গ করেছিল! ওর শক্তি ছিল ভয়াবহ!” শৌর্য হতভম্ব হয়ে বলল, “তাহলে এই শরীরের ভিতর এখন সে-ই?” রুদ্রপ্রিয়া কাঁপা গলায় বলল, “তোর ভাইয়ের ভিতর এখন তোর পূর্বশত্রুর আত্মা। সে-ই যোগীনাথের সাধনাকে অপব্যবহার করেছিল। সেই কারণেই আশ্রমে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। আজ সে আবার ফিরেছে।” শৌর্য বোঝে, এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটা কৌশিকের হলেও ভেতরে সে এক অন্য কেউ।

অগ্নিবিজয়—অথবা কৌশিক—ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে আগুনের কুণ্ডের পাশে এসে দাঁড়ায়। সে সেখানে বসে পড়ে, আর চোখ বন্ধ করে বলে, “আমাকে যে জায়গায় কবর দেওয়া হয়েছিল, সেটাই ছিল তন্ত্রের নবম স্তর। আমি জেগে উঠেছি কারণ কেউ আমাকে ডেকেছে। কারা ডেকেছে জানি না, কিন্তু আমার কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। আমি এখন তা সম্পূর্ণ করব।” শৌর্য চিৎকার করে বলে ওঠে, “তুই যদি আমার ভাইয়ের শরীরে থেকে তন্ত্রকে কলুষিত করিস, আমি তোকে শেষ করে দেব!” অগ্নিবিজয় তখন মৃদু হেসে বলে, “তুই পারবি? তুই কি জানিস তোর নিজের ভিতরেই কি লুকিয়ে আছে?”

এই কথার মধ্যেই আশ্রমে শুরু হল প্রবল ঝড়। শালগাছ ভেঙে পড়তে লাগল, আকাশে বিদ্যুৎ ছুটে বেড়াতে লাগল, এবং মাটির নিচ থেকে ভেসে এল কান্নার মতো কোনো শব্দ। আশ্রমের প্রবীণ সাধুরা তখন মন্ত্র পড়া বন্ধ করে কাঁপতে লাগলেন। এক গুরু, যার বয়স একশোর কাছাকাছি, বললেন, “এখনই যদি ওকে বশে না আনা যায়, তবে ওর ভিতর দিয়ে খুলে যাবে সেই গেট, যেখান দিয়ে শূন্য এসে ঢুকে পড়বে এই পৃথিবীতে।”

রুদ্রপ্রিয়া তখন হাতে তুলে নিল এক পাথরের রুদ্রাক্ষ মালা। সে এগিয়ে গিয়ে অগ্নিবিজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই এই শরীর ত্যাগ কর। তুই যা ছিলি, তাই থাক, তুই আর এই দেহের অধিকারী হবি না।” কিন্তু অগ্নিবিজয় তখন উঠে দাঁড়িয়ে একদম তার কপালে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রপ্রিয়া ছিটকে পড়ে গেল, আর তার কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এ তো… মানব নয়। এ তো আগুনের আত্মা!”

শৌর্য জানে, এখন সময় এসেছে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মনের ভেতর সেই পুরোনো শব্দগুলো খুঁজে বের করে—যেগুলো তাকে বারবার ডাকত, যেগুলো ছিল ভয়ানক, কিন্তু সত্য। তার ঠোঁটের কোণে উঠে আসে সেই এক মন্ত্র—যেটা সে প্রথম শিখেছিল, কিন্তু এখনো উচ্চারণ করতে ভয় পেত: “অহং দেবী স্বরূপঃ, তন্ত্রং মম দেহে”। এই মন্ত্র উচ্চারণ করতেই তার শরীর থেকে আলো বেরোতে লাগল, এবং সেই আলো গিয়ে ছুঁয়ে ফেলল যন্ত্রমণ্ডলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অগ্নিবিজয়-কৌশিককে।

অগ্নিবিজয়ের দেহ একটু কেঁপে উঠল। সে এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে বলল, “তুই যদি সত্যিই তন্ত্র জানিস, তবে আয়। আয় মণ্ডলের কেন্দ্রে। একসাথে বসে দেখা যাক কে কাকে ধারণ করতে পারে।” শৌর্য আর সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়ল মণ্ডলের মাঝখানে। তার চোখে এখন আগুন, তার দেহে জ্বালানি হয়ে উঠেছে নিজের রক্ত, এবং তার আত্মা জেগে উঠেছে সেই প্রাচীন উত্তরাধিকারকে নিয়ে, যা ছিল ঘুমিয়ে, কিন্তু শক্তিতে পূর্ণ।

দুজন বসে পড়ল মুখোমুখি। একদিকে অগ্নিবিজয়—প্রাচীন নিষিদ্ধ সাধক, অন্যদিকে শৌর্য—উদীয়মান ধারক, যার ভেতরে আছে নিয়তি, ভয় এবং মুক্তির আগুন। মাঝখানে পবিত্র চক্র, যার প্রতিটি রেখা যেন ধ্বনি হয়ে কাঁপছে বাতাসে।

তারা দুজন একসাথে চোখ বন্ধ করল। চারপাশে নিঃশব্দ, কেবল দূর আকাশে বাজ পড়ার গর্জন। তারা উচ্চারণ করল শেষ বীজমন্ত্র—যেটা কিনা একমাত্র সেই জানে, যাকে সত্যি তন্ত্র গ্রহণ করেছে।

সেই মন্ত্রে শুরু হল যজ্ঞ। রক্ত, আলো, শব্দ, এবং আত্মা—সব মিলিয়ে যেন আশ্রম রূপ নিল এক চলন্ত দেবীমূর্তিতে। এখন প্রশ্ন একটাই—কে নিজেকে ধারণ করতে পারবে? কে বাঁচবে? আর কে হবে দেবীর ইচ্ছার বাহক?

পর্ব ৯

যজ্ঞ শুরু হওয়ার মুহূর্তেই সময় থমকে দাঁড়াল বলে মনে হল। চারপাশের পাখিরা থেমে গেল, বাতাস দাঁড়িয়ে গেল নিঃশ্বাসের মতো ভারী হয়ে। যন্ত্রমণ্ডলের মাঝখানে বসে থাকা শৌর্য ও অগ্নিবিজয় ধ্যানস্ত, কিন্তু সেই ধ্যান এক নিঃশব্দ যুদ্ধ—তাদের ভিতর চলছে জাগরণের মহাযুদ্ধ। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সাধুরা ও রুদ্রপ্রিয়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন; কেউ সাহস করলেন না এগিয়ে যেতে। আকাশের কালো মেঘ কুঁকড়ে ঘনীভূত হয়ে সেই আশ্রমের ঠিক উপরে জমে রইল, যেন এক বিরাট করাল চোখ মেলে বসে আছে নিচের লীলা দেখার জন্য।

শৌর্যর মাথার মধ্যে তখন চলছে ঝড়। সে অনুভব করল, তার স্মৃতির গভীর থেকে উঠে আসছে বহু না-জানা শব্দ, চিত্র, ভাষা—যেগুলো সে আগে কখনো জানত না, অথচ এখন নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। তার সামনে ফুটে উঠছে এক একটি দিকচক্রবাল—তন্ত্রচক্রের নানা স্তর, প্রতিটি স্তরে রয়েছে এক একটি প্রতীক, যার অর্থ শুধুই শক্তি, আত্মদহন, এবং নিয়ন্ত্রণ। অগ্নিবিজয় তখন তার স্বর অন্যভাবে মেলে ধরে—সে উচ্চারণ করে এক অদ্ভুত গানের মতো কিছু শব্দ, আর সেই শব্দের ধাক্কায় শৌর্যর কপাল জ্বলে ওঠে, যেন তার ভিতর তেজস্বী আগুন ঢুকছে।

“আমি ভয় পাই না,” শৌর্য গম্ভীর গলায় বলে। “আমি এসেছি নিজের পরিচয় খুঁজতে, তোর বিরুদ্ধে নয়। তুই যদি আমার ভাইয়ের শরীর ত্যাগ করিস, আমি তোকে তোর পথ দিতে পারি।” অগ্নিবিজয় হেসে ওঠে, সেই হাসি যেন ঝরনা নয়, ধারালো তরবারির মতো। সে বলে, “তুই কি জানিস আমার যন্ত্রণার মানে? আমি ছিলাম এক সময়কার সর্বোচ্চ সাধক, আমার শিষ্যরা তন্ত্রের আদি রচয়িতা। কিন্তু আমিই অভিশপ্ত হলাম, কারণ আমি সীমা পেরিয়েছিলাম। আমি শুধু দেবীকে ডাকিনি, আমি দেবীকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম—যা চেতনা, তা শরীরে নামলে কী হয়। সেই দণ্ড আমায় এক আগ্নিগর্ভ কূপে নামিয়ে দিয়েছিল।”

শৌর্য তখন বলে, “তুই যে পথে হাঁটিস, তাতে আত্মা পুড়ে ছাই হয়। তন্ত্র শক্তি, তন্ত্র শ্রদ্ধা—তন্ত্র কোনো দখল নয়। তুই সে ভুলটাই করেছিস। এবার থাম।” এই বলে সে নিজের কপালে অঙ্গুলিচাপ দিয়ে উচ্চারণ করে, “অগ্নিস্বরূপায়ৈ নমঃ।” সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে জ্বলে ওঠে এক অদৃশ্য আগুন, যেটা গায়ে না লাগলেও স্পর্শ করে আত্মাকে। সেই আগুন একসাথে শুদ্ধ করে এবং প্রকাশ করে সত্য।

অগ্নিবিজয় কেঁপে ওঠে। সে অনুভব করে শরীরের সীমাবদ্ধতা। কৌশিকের শরীর, যার মধ্যে সে প্রবেশ করেছে, সেটি ধীরে ধীরে দেবে আসছে তার প্রচণ্ড চেতনার ভারে। সে বুঝতে পারে, এ শরীর বেশিক্ষণ তাকে ধারণ করতে পারবে না। তার মুখে রাগের গর্জন—“তুই যদি আমায় ঠেকাস, আমি তোর ভাইকে ছিন্নভিন্ন করে দেব। ওর আত্মা আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব সেই আগুনকূপে।”

এইবার আশ্রমের উত্তর কোণের দরজা খুলে গেল হঠাৎ। হাওয়ার সঙ্গে এক অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, চন্দন আর কিছু পচা কুৎসিত জিনিসের মিলিত গন্ধ ভেসে এলো। রুদ্রপ্রিয়া ফিসফিস করে বলল, “ও এসেছে—দেবীর সত্তা। এখন সিদ্ধান্ত হবে, কে উপযুক্ত।” সেই গন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল এক বিভীষিকাময় দীপ্তি—না আলো, না আঁধার। একটি নারী-আকৃতি যার নেই স্থায়ী রূপ—এক সময় সে শিশুর মতো নিষ্পাপ, আবার এক মুহূর্তেই ভয়ানক, খোলা কেশ, রক্তাক্ত চক্ষু।

দেবী নিজেই এলেন—যিনি শক্তি, যিনি দণ্ড, যিনি করুণা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে শৌর্য মাথা নত করল, বলল, “আমি তোমার পথ চেয়েছি, আমি দেহ চাই না, আমি জ্ঞান চাই।” দেবী কাঁপা গলায় বললেন, “তুই প্রস্তুত?” শৌর্য বলল, “হ্যাঁ, যদি আমার ভেতর সত্যিই সেই ধারকত্ব থাকে, তবে আমাকে ব্যবহার করো।”

অন্যদিকে, অগ্নিবিজয় তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, “আমি এসেছি জয়ের জন্য! আমি তোর শক্তি নিজের করে নিতে চাই! আমি দেবীকে অধিকার করব!” দেবী তখন নিঃশব্দে এগিয়ে এলেন, অগ্নিবিজয়ের দিকে তাকালেন, আর বললেন, “তুই একসময় সত্যের সন্ধান করেছিলি, কিন্তু পরে নিজেই অন্ধকার হয়েছিস। তুই আর ধারক হতে পারিস না। তুই বাহক নোস, তুই এক বিষাক্ত বাসনা।” এই বলে তিনি এক হাত তুললেন, এবং সেই হাত থেকে বেরোল এক সরু রশ্মি, যা গিয়ে আঘাত করল অগ্নিবিজয়-কৌশিকের কপালে।

এক তীব্র আলোয় অগ্নিবিজয় আর্তনাদ করল, তার শরীর কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যেন ধোঁয়ার মতো গলে যাচ্ছে অস্তিত্ব। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো এক আগুন-রঙা আকৃতি—চোখে ক্রোধ, মুখে হাহাকার। সেটা বাতাসে ভেসে উঠল আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শূন্যে, যেমন করে আগুন নিভে যায় নিজেই।

কৌশিক নিঃশেষে মাটিতে পড়ে গেল। তার দেহ নিস্তেজ, কিন্তু এবার তার মুখে ফিরে এলো এক শান্তির ছাপ। শৌর্য দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের কপালে হাত রাখল—তার নিঃশ্বাস ফিরেছে। সে বেঁচে আছে। দেবী তখন শৌর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই সত্যিকারের ধারক। কিন্তু মনে রাখিস, তন্ত্র কোনো অস্ত্র নয়, এটি আয়না—যেটা দিয়ে মানুষ নিজেকেই দেখে, সুন্দর বা বিকৃত।”

তাদের মাথার উপর থেকে সরে গেল কালো মেঘ। আশ্রম জুড়ে নামল হালকা বৃষ্টি। যজ্ঞমণ্ডলের আগুন নিভে এল, আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল শান্তি।

পর্ব ১০

আকাশ এখন পরিষ্কার, ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর বাকি পড়ে আছে কেবল মাটির সেই ভিজে গন্ধ, আর আশ্রমের চারপাশে নেমে আসা এক অদ্ভুত শান্তি, যা একসাথে কষ্টের পরিতোষ আর নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতি। যজ্ঞমণ্ডলের মাঝখানে এখন পড়ে আছে কৌশিক—নিস্তেজ হলেও জীবিত। শৌর্য তার পাশে বসে, ভাইয়ের কপালে হাত রেখে স্পষ্ট অনুভব করল, শরীর আবার উষ্ণ হয়ে উঠছে, নিঃশ্বাস গভীর, স্থির। দেবী আর নেই, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি যেন চারপাশে স্নিগ্ধ আলোয় রয়ে গেছে।

রুদ্রপ্রিয়া এগিয়ে এল। সে অনেকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “শেষ পর্যন্ত তুই পারলি। কিন্তু এ তো শেষ নয়, শৌর্য।” শৌর্য ধীরে মাথা নাড়ল, বলল, “জানি। এ কেবল শুরু। আমি তন্ত্রের একটা স্তর বুঝেছি, কিন্তু বহু স্তর এখনো অজানা। সেই অজানা আমায় ডাকছে।” তখন আশ্রমের প্রবীণ গুরু, যিনি এতক্ষণ মন্ত্র জপ করে এক কোনে বসে ছিলেন, ধীরে ধীরে উঠে এসে বললেন, “তুই যে শক্তিকে ধারণ করলি, তার নাম শুধু জ্ঞান নয়। তা ত্যাগ, দহন, দৃষ্টি এবং দয়া। তোর ভিতর দেবীর ছায়া বসেছে, কিন্তু নিজেকে মানুষ মনে রেখে চলতে হবে।” শৌর্য মাথা নিচু করল। সে জানে, তার ভিতর এমন কিছু জেগে উঠেছে, যা আর সাদা-কালোর বাইরে। এখন তার মধ্যে একটা নতুন পথ—যেখানে সবকিছু একসাথে সত্য আর মায়া।

কৌশিক তখন চোখ মেলল। তার চোখে আলো নেই, কিন্তু ভয়ও নেই। সে ধীরে বলল, “শৌর্য… আমি কোথায় ছিলাম?” শৌর্য কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তুই ছিলি এক অন্ধকারের দরজার সামনে। তোর ভিতর দিয়ে কেউ আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তুই ফিরে এসেছিস। এখন সব ঠিক হবে।” কৌশিক চোখ বন্ধ করে একটু হাসল, সেই পুরোনো ভাইয়ের মতো। সে বলল, “আমার অনেক কিছু মনে নেই। কিন্তু আমি জানি, তুই ছিলি পাশে। তোর স্পর্শ, তোর ডাক আমায় ফিরিয়ে এনেছে।” তখন শৌর্য একবারের জন্যে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেই মুহূর্তে তার ভিতর দিয়ে এক তীব্র শ্বাস বেরিয়ে গেল—যেন বহুদিন ধরে আটকে থাকা কান্না এখন মুক্ত।

আশ্রম এখন ধীরে ধীরে জীবনে ফিরছে। যন্ত্রমণ্ডল ঢেকে ফেলা হচ্ছে, আগুনের ভস্ম রাখা হচ্ছে একটি তামার পাত্রে। রুদ্রপ্রিয়া এগিয়ে এসে সেই ভস্ম শৌর্যের হাতে দিল। বলল, “এ ভস্মের ভিতর আছে দেবীর অনুগ্রহ। তুই যে পথ ধরেছিস, তাতে এই অগ্নির স্মৃতি তোকে বারবার মনে করিয়ে দেবে—কে তুই, আর কোথায় ফিরতে হবে।” শৌর্য সেই ভস্ম নিজের বুকের কাছে টেনে রাখল।

এক সপ্তাহ পরে, শৌর্য আর কৌশিক আশ্রম ছাড়ল। পাহাড়ের গা বেয়ে যখন তারা নেমে এল, তখন ভোরের আলো সবকিছু মধুর করে তুলেছিল। কৌশিক আগের মতো দুর্বল নয়, কিন্তু তার চোখে এখন এক স্থিত শান্তি, যেন সে অনেক কিছু দেখেছে, বুঝেছে, হারিয়েছে আর ফিরে পেয়েছে। তারা দুজনে একজোড়া ভাইয়ের মতো হাঁটছিল—কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে।

তবে পথ কেবল সোজা নয়। এক সন্ধ্যায় শৌর্য নদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকল। সে জানে, তন্ত্র তার ভিতর একরকম আগুন জাগিয়েছে। সেই আগুন নিছক বিদ্যা নয়, তা এক দায়, এক ভার। সে জানে, অনেকেই আসবে—যারা সত্য চায়, আবার অনেকেই আসবে—যারা ক্ষমতা চায়। সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, দেবীর আলো নিয়ে। দেবী তাকে বলেছেন—“তুই তোর পথ খুঁজবি, কিন্তু অন্যের পথেও আলো ফেলবি। তুই শুদ্ধ হবি না, কিন্তু তোর অন্তর শুদ্ধতার পাত্র হবে।”

রুদ্রপ্রিয়া আর আশ্রমে নেই। সে চলে গেছে উত্তর দিকে, অন্য এক ধ্যানপথে। বিদায়ের সময় সে বলেছিল, “আমি যেখানেই যাই, জানবি, আমি তোর পাশে আছি। তুই যদি একদিন নিজেই দ্বিধায় পড়ে যাস, চোখ বন্ধ করলেই আমায় পেয়ে যাবি।”

বছর কেটে যায়। শৌর্য এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যায়। তার সাথে থাকে কৌশিক, আর সেই তামার পাত্রভর্তি ভস্ম, যেটা সে এখনো খোলে না। সে মানুষের কাছে গল্প করে, উপদেশ দেয় না, বরং শোনে। যারা তন্ত্রকে ভয় পায়, তাদের বোঝায়—তন্ত্র কোনো অন্ধকার নয়, বরং আত্মার এক আয়না। যারা তন্ত্রকে অস্ত্র বানাতে চায়, তাদের সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকে এক নীরব প্রতিরোধ হয়ে।

এক রাতে, বহু দূরের এক জঙ্গলে, আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল শৌর্য। হঠাৎ বাতাসে এক পরিচিত গন্ধ ভেসে এলো—চন্দন, ধূপ, আর এক বিন্দু রক্তের মতো তীব্র স্মৃতি। সে মাথা তুলে তাকাল—এক নারীমূর্তি, চোখে ছায়া আর আলো মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছেন। দেবী?

শৌর্য দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “তুমি ফিরেছো?” তিনি মৃদু হেসে বললেন, “আমি তো কখনো যাইনি। তুই শুধু সময় নিয়েছিস আমাকে দেখার জন্য।” শৌর্য জিজ্ঞেস করল, “আমার পথ কি শেষ হবে একদিন?” তিনি বললেন, “তোর পথ কখনো শেষ হবে না, কারণ তুই এখন নিজের আলো। আর আলোর কাজ শুধু পথ দেখানো নয়, নিজেও জ্বলে থাকা।”

রাত গভীর হয়, আগুন নিভে যায়। কিন্তু শৌর্য জানে—তার ভিতরের তন্ত্র এখন নিভবে না। সেই তন্ত্র এখন কেবল সাধনা নয়, সে এক ধ্যান, এক অহংকারহীন দৃষ্টিভঙ্গি। এবং সেই আলো নিয়েই সে হাঁটবে—চুপচাপ, নিঃশব্দে, মানুষের মুখের ভেতর দেবীর ছায়া খুঁজতে খুঁজতে।

শেষ

1000017522.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *