মণিষা মুখোপাধ্যায়
অধ্যায় ১: “চিত্রের টানে”
কলকাতার ছিমছাম ফ্ল্যাটে বসে ঐশী সেন তার স্কেচবুক আর ল্যাপটপের মাঝে ডুবে ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনায়। পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প নিয়ে তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্প, বিশেষ করে চালচিত্র। চালচিত্র—বাংলার মন্দিরের চাল বা চূড়ার নিচে আঁকা একরকম ন্যারেটিভ চিত্রপট, যা দেব-দেবীর কাহিনি বা পুরাণকথা বলে দেয়। কিন্তু বাঁকুড়ার ‘ধনেশ্বরপুর’ নামের একটি ছোট্ট গ্রামে একটি পরিত্যক্ত মন্দির আছে, যার চালচিত্রে নাকি পুরাণ নয়—তান্ত্রিক চিত্র রয়েছে। তার অধ্যাপক, ডঃ রূপক দত্ত, এই মন্দিরের একটি কালো-সাদা ছবির কপি ঐশীকে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “এটা কিছুটা ব্যতিক্রমী। তুই চাইলে এইটার উপর কাজ করতে পারিস, কিন্তু সাবধানে।” ঐশীর মন এই কথা শোনার পর থেকেই ছটফট করছিল। চিত্রে যেন কিছু একটার আহ্বান ছিল—অদৃশ্য এক চাহনি, বা একটা দৃষ্টিহীন চোখ, যা তাকে একান্ত নিজের করে নিতে চাইছিল।
বাঁকুড়ার পথে ট্রেনের জানালার বাইরে দেখতে দেখতে ঐশী ভাবছিল, লোকেরা এত ভয় পায় কেন? সে তো শিল্প দেখবে, তন্ত্র নয়। টোটো করে গ্রামে পৌঁছে যখন সে প্রথম ধনেশ্বরপুর মন্দিরের ধারে নামে, তখন সন্ধে নেমে এসেছে। গ্রামের মানুষজন তার আগমনে উৎসুক, কিন্তু মুখে চেপে রাখা আতঙ্ক স্পষ্ট। বৃদ্ধ একজন এগিয়ে এসে বলে, “মেয়ে, ওখানে যেও না, ঐ চালচিত্রে দৃষ্টিসম্পর্ক হয়, পিশাচের চিত্র ওটা। আগেও একবার কলকাতা থেকে কেউ এসেছিল, পরে পাগল হয়ে গেছিল।” ঐশী হেসে ফেলে, “বাবা, আমি ইতিহাস পড়ি। ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না।” কিন্তু তার হাসির পেছনে একটা হালকা শীতলতা জমে থাকে। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীর্ণ বৃদ্ধ, পঞ্চু কাকা, চোখ সরিয়ে নেয় না তার দিক থেকে। ঐশী তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কী এখানে থাকেন?” তিনি মাথা নাড়েন, “দেখভাল করি। ভিতরে ঢুকবে?” ঐশী চাবি চাইলে তিনি অনিচ্ছায় দেয়ালের পেছন থেকে একটা লোহার চাবির গোছা বার করে এগিয়ে দেন। ঐশী যখন প্রবেশদ্বার খুলে ভিতরে ঢোকে, তখন মন্দিরের শীতলতা তাকে ঘিরে ফেলে—ঘামে ভেজা পিঠে ঠান্ডা হাওয়া যেন কামড় বসায়।
মন্দিরের ভিতরটা ধ্বংসপ্রায়, ধুলো জমে আছে দেয়ালে, কিন্তু চালচিত্র তখনও অক্ষত। তার চোখ সেদিকে পড়তেই থেমে যায়। এটি কোনও দেবতার পরিচিত রূপ নয়—চিত্রে এক অর্ধনগ্ন পুরুষ, কুণ্ডলিত চুল, রক্তজবা হাতে, দাঁড়িয়ে এক অগ্নি-বৃত্তে। চারপাশে অদ্ভুত প্রতীক—ত্রিভুজ, বৃत्त, ঘূর্ণি—আর কিছু প্রাণী, যাদের চোখ নেই। একটি অংশে চিত্রের একটি রেখা এমনভাবে বাঁকানো, যেন এক বিশেষ দিক নির্দেশ করছে। ঐশী এগিয়ে গিয়ে সেই অংশে হাত রাখে, এক মুহূর্তে অনুভব করে চিত্রে একটি তীব্র কম্পন। সে হাত সরিয়ে নেয়, ধাঁধাঁ লাগা মাথা নিচু করে দেয়ালের পাশে বসে পড়ে। পঞ্চু কাকা তাকে ডাকে, “মেয়ে, ঠিক আছিস?” ঐশী চোখ মেলে বলে, “হ্যাঁ… কিছু হয়নি।” কিন্তু সেই রাতে তার ঘুম আসে না। ঘরের জানলা দিয়ে সে দেখতে পায় মন্দিরের শিখরদিকের চালচিত্র থেকে যেন ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যে একটা মুখ তৈরি হচ্ছে।
পরদিন সকালে ঐশী চিত্রের একটা অংশ স্কেচ করতে গিয়ে দেখতে পায়, তার স্কেচবুকে রং গাঢ় হয়ে যাচ্ছে—যেন নিজে নিজে ছড়িয়ে পড়ছে। সে ছবি তুলতে গেলে দেখতে পায় মোবাইলের ক্যামেরা সেই অংশে ঝাপসা হয়ে যায়, কিন্তু অন্য অংশ স্বচ্ছ। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করা দিব্যেন্দু মুখার্জি নামে এক ব্যক্তি ঐশীর কথা শুনে আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। দিব্যেন্দু চালচিত্র নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তার গলায় কেমন যেন একটা কাঁপুনি। “এই চিত্রটা বিশেষ,” সে বলে, “এটা চিত্র না, এটা এক তান্ত্রিক মণ্ডল। আগে একবার কেউ এটার ব্যাখ্যা করতে গিয়েছিল, তার পর…” তার কথা শেষ হয় না। ঐশী প্রশ্ন করে, “এই চিত্রে কে আছেন? এটা কোন দেবতা?” দিব্যেন্দু সোজাসুজি জবাব দেয় না। শুধু বলে, “একজন তান্ত্রিক, নাম ছিল নীলধ্বজ। এই মন্দিরেই সে তপস্যা করত। একসময়… একসময় নিজেকে নিজেই চিত্রের মধ্যে বন্দি করে।” ঐশী বিস্মিত হয়, “কিন্তু কেউ চিত্রে নিজেকে বন্দি করে কিভাবে?” দিব্যেন্দু বলে, “তন্ত্রে সম্ভব। চালচিত্রটা একটা দরজা, ঠিকভাবে না বুঝে কেউ যদি খুলে ফেলে—তাহলে সেই শক্তিকে কেউ আটকাতে পারবে না।” ঐশীর চোখে সেই পুরনো ছবির মতোই আবার একবার সেই অদ্ভুত চোখের চাহনি জ্বলজ্বল করে ওঠে। এই কি তবে শুরু? না কি চিত্র তাকে নিয়েই খেলা শুরু করেছে?
অধ্যায় ২: “রেখার অন্তরালে”
ঐশী পরদিন সকালেই স্কেচবুক আর ক্যামেরা হাতে নিয়ে আবার হাজির হয় মন্দিরে। দিনের আলোয় চালচিত্রটিকে বিশ্লেষণ করলেই হয়তো সে বুঝতে পারবে—গতকালের রাতের অনুভূতিগুলো ছিল নিছক বিভ্রম। কিন্তু মন্দিরের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে সে দেখতে পায় দরজার কপাট খানিকটা ফাঁকা, অথচ কাল সে নিজেই তালা লাগিয়ে বেরিয়েছিল। সন্দেহের চোখে চারপাশে তাকিয়ে সে ভিতরে ঢোকে। চালচিত্র ঠিক আগের জায়গাতেই, কিন্তু চিত্রের একটি অংশ—যেখানে আগুনের শিখার মধ্য থেকে একটি মুখ বেরিয়ে আসছিল—তা যেন আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঐশী নিজেকে বলল, “এটা নিশ্চয়ই আমার কল্পনা।” সে ল্যাপটপ খুলে আগের ছবিগুলোর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বুঝতে পারে—চিত্রে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে। আগের ছবিতে সেই মুখ ছিল আবছা, এখন যেন তার চোখ স্পষ্ট, এবং ভয়ানক ঘৃণায় ভরা।
পাশ থেকে হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “চিত্র নিজে নিজেই রূপ নেয়।” ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে ঐশী দেখে দিব্যেন্দু সেখানে দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি, আর মুখে সেই একই অস্বস্তিকর কাঁপুনি। সে বলে, “আমি গতকাল রাতে ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে।” পাণ্ডুলিপিটি ঐশীর হাতে দিয়ে সে ব্যাখ্যা করে—এটি তার ঠাকুরদার সংগ্রহে ছিল, এবং তাতে ‘চিত্রতন্ত্র’ নামক এক নিষিদ্ধ ধারার বর্ণনা আছে। ঐশী অবিশ্বাস নিয়ে বলে, “তোমরা সবাই কেন একটা শিল্পকর্মকে অতিপ্রাকৃত করে তুলছ?” দিব্যেন্দু উত্তরে কাঁপা গলায় বলে, “কারণ এই চিত্র শিল্প নয়, এটি তন্ত্র। এখানকার প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রং তান্ত্রিক মুদ্রা বহন করে। এগুলো দেখে ফেললে, তার প্রতিক্রিয়াও তোমার মধ্যে শুরু হয়।” ঐশী ব্যঙ্গ করে বলে, “তা হলে কাল রাতেই আমার কিছু হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।” দিব্যেন্দু চুপ করে থাকে। তার চোখের দৃষ্টি বলে দেয়, ঐশী হয়তো নিজেই বুঝছে না তার ভেতরে কী শুরু হয়ে গেছে।
ঐশী চিত্রের একটি বিশেষ অংশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে—সেখানে একটি ত্রিভুজের ভিতরে আটটি বিন্দু, যার মাঝে একটি ছোট শঙ্খ চিহ্ন। তার মনে পড়ে, ভারতীয় তন্ত্রে এমন প্রতীককে বলা হয় ‘বিন্যাস চক্র’—যেখানে প্রতিটি বিন্দু এক এক শক্তি কেন্দ্র নির্দেশ করে। এমন সময় পেছন থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে, এবং সে অনুভব করে কারো দৃষ্টি তার ঘাড়ে। পেছনে তাকিয়ে সে কাউকে না দেখে আবার স্কেচ করতে থাকে, কিন্তু হঠাৎ কাঁধে কারও হালকা স্পর্শ অনুভব করে লাফিয়ে উঠে পড়ে। পেছনে দিব্যেন্দু ছাড়া কেউ নেই, এবং সে স্পষ্টভাবে বলে—সে কিছু করেনি। ঐশী মনে মনে ভাবে, হয়তো স্নায়বিক চাপই এসব ঘটাচ্ছে, কিন্তু নিজের অজান্তেই তার হাত ক্রমাগত চালচিত্রের চোখ আঁকতে থাকে, যেন সেই চাহনি তাকে ভুলতে দিচ্ছে না। সন্ধের দিকে মন্দির থেকে বেরিয়ে পঞ্চু কাকার সঙ্গে দেখা হলে তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, “চিত্রে তাকিও না বেশি। চিত্র তাকায় ফিরে।” ঐশী হাসতে চাইলেও এবার তার ভিতরের কোথাও কেঁপে ওঠে।
রাত গভীর হলে ঐশী ল্যাপটপে ছবি তুলতে গিয়ে দেখে, তার চেহারার পেছনে কিছু ছায়াময় অবয়ব ধরা পড়েছে। সে স্ক্রিন জুম করে দেখে—ছায়া একটাই, কিন্তু তার মুখ ঠিক সেই আগুনঘেরা মুখের মতো। সে ঝট করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু তখনই জানলার পর্দা নড়ে ওঠে। সে চমকে তাকায়—কেউ নেই। তার ঘুম আর আসে না। মাঝরাতে সে দরজার বাইরে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়—চালচিত্রের চারপাশে যেন হালকা লালচে আলো জ্বলছে, আর অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ধাতব শব্দ, যেন কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে—কিন্তু সেটা উৎসবের নয়, বরং এক ধ্বংসের আহ্বান। ঐশী জানে না, সে কী দেখে ফেলেছে, কিন্তু তার মধ্যে এক অজানা ভয় জন্ম নিচ্ছে—একটু একটু করে, প্রতিটি রেখার অন্তরালে।
অধ্যায় ৩: “নীলধ্বজের নাম”
সকালে ঘুম ভাঙতেই ঐশী বুঝতে পারে তার চোখে যেন কুয়াশা জমে আছে। সে আয়নায় তাকিয়ে দেখে চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, আর পাতার নীচে গাঢ় কালি। যেন বহুদিন ঘুমোনি। গতরাতের অদ্ভুত শব্দ আর জানলার ও-পাশে চালচিত্রের সেই লাল আভা কি শুধুই মানসিক? তার মাথা ভার হয়ে আছে, যেন চিত্রের রেখাগুলো এখনো ঘোরাফেরা করছে মস্তিষ্কে। এক কাপ চা খেয়ে, চোখে ঠাণ্ডা জল দিয়ে সে নিজেকে সামলায় এবং পাণ্ডুলিপিটি আবার খুলে পড়ে—‘চিত্রতন্ত্র’ নামক অধ্যায়টিতে লেখা ছিল এক রহস্যময় চরিত্রের নাম: নীলধ্বজ। ঐশীর কাঁধ বরাবর ঠান্ডা শিরশিরে স্রোত বয়ে যায়। নামটা তার অজানা নয়, গতকাল দিব্যেন্দু মুখার্জি কথায় কথায় বলেছিল, “এই মন্দিরে এক তান্ত্রিক বাস করত, যে নিজের আত্মা চিত্রে বেঁধে রেখে গিয়েছিল।” কিন্তু আজ যখন ঐশী সেই নামটা বইয়ে স্পষ্টভাবে পড়ে—সঙ্গে একটা রূপরেখা আঁকা মুখ দেখে—সে চমকে ওঠে। ওই মুখই তো… ওই চোখই তো সে স্কেচে বারবার আঁকছিল, অজান্তে!
দিব্যেন্দু এসে দাঁড়ায় দরজার কাছে, মুখ গম্ভীর। তার হাতে একটি পুরোনো খাতা, যার পাতাগুলো প্রায় ঝরে যাচ্ছে। সে চুপচাপ ঐশীর পাশে বসে বলে, “তুই জানিস না কী নিয়ে খেলছিস। নীলধ্বজ একটা মানুষ ছিল না, একটা অভিশাপ ছিল।” ঐশী অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। দিব্যেন্দু কথা শুরু করে—“এই গ্রামে একসময় একটা গোপন তান্ত্রিক সংঘ ছিল, নাম ছিল ‘অগ্নিচক্র’। নীলধ্বজ তাদের প্রধান। সে বিশ্বাস করত, শিল্পের মাধ্যমেই আত্মাকে বন্দি রাখা যায়। এক বিশেষ দিনে, পঁচিশজন শিষ্য নিয়ে সে মন্দিরে প্রবেশ করে, বলি দেয়, আর তার আত্মা চালচিত্রে প্রবেশ করিয়ে দেয়। কারণ, মৃত্যুর পরও সে ফিরে আসতে চেয়েছিল—তান্ত্রিক শক্তি নিয়ে, নতুন শরীরে। তার সেই প্রত্যাবর্তন থামাতে, মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা পাণ্ডুলিপি রেখে যান, যাতে ভবিষ্যৎ কেউ ভুল না করে।” ঐশী কাঁপা গলায় বলে, “আমি কি তবে সেই ভুলটা করেই ফেলেছি?” দিব্যেন্দু মাথা নিচু করে।
ঐশী কিছু বলার আগেই দরজার বাইরে পঞ্চু কাকার হাঁক শোনা যায়—“ছেলের মা, এইবার চিত্র থামবি না। বৃষ্টি আসছে, কিন্তু বাতাস গরম, তোর শরীর নষ্ট হয়ে যাবে।” ঐশী দরজা খুলে দেখে, আকাশে মেঘ, কিন্তু গায়ের ওপর এক অদ্ভুত রকম গরম বাতাস। সে আবার মন্দিরে যেতে চায়, এবার রেকর্ডার আর ক্যামেরা নিয়ে। দিব্যেন্দু না করেও সঙ্গে যায়। মন্দিরের ভেতর ঢুকেই তারা দেখে চালচিত্র আরও গাঢ় রঙে ফুটে উঠেছে, যেন কেউ রাতে রং চড়িয়ে গেছে। আগুনঘেরা তান্ত্রিক মুখটির ঠোঁট যেন একটু বেশি বেঁকে আছে, এবং এক চোখে লাল রেখার ছোঁয়া—যা আগের চিত্রে ছিল না। ঐশী চালচিত্রের এক কোণে নতুন একটা প্রতীক খুঁজে পায়—এক খোলা হাত, যার তালুতে রক্তফোঁটার চিহ্ন। পাণ্ডুলিপি উল্টে ঐশী পড়ে—এই প্রতীক মানে “আহ্বান শুরু”, অর্থাৎ নীলধ্বজ চিত্র থেকে বেরোতে শুরু করেছে।
হঠাৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাটারি সম্পূর্ণ খালি, অথচ কিছুক্ষণ আগেই ফুল চার্জে ছিল। মন্দিরের চারদিকে অন্ধকার যেন ঢুকে পড়ছে, অথচ সময় তখন দুপুর। ঐশী অনুভব করে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, আর তার কানে ফিসফিসানি—“আমায় দেখেছিস, এবার দরজাটা খুলে দে…” সে কাঁপতে কাঁপতে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে, দিব্যেন্দুও তার পেছনে ছুটে। তারা জানে—এই চালচিত্র আর নিছক চিত্র নয়, এটা এক অলৌকিক বন্দিশালা। কিন্তু দরজা যদি খুলেই গিয়ে থাকে, তবে সময় খুব অল্প। নীলধ্বজ ফিরে আসছে—প্রতীক একে একে জাগছে, রেখা বদলাচ্ছে। আর তার চাহনি যেন ঐশীর আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অধ্যায় ৪: “চোখের পেছনে ছায়া”
মন্দির থেকে ফেরার পর ঐশী বারবার আয়নায় নিজের মুখ দেখে, আর প্রতিবারই একটা মুহূর্ত আসে যখন সে নিশ্চিত হয়—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যেই না সে ঘুরে তাকায়, কিছুই থাকে না। জানলার পর্দা, দেয়ালের ছায়া, কিংবা ঘরের কোনা—সবকিছুই যেন চোখের ফাঁকি দিচ্ছে। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই চোখ। চিত্রের আগুনঘেরা চোখটা এখন যেন তার চারপাশে ঘুরছে, শুধু চালচিত্রেই নয়—তার কল্পনায়, ঘুমে, এমনকি স্কেচবুকেও। ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, নিজেরই আঁকা একটি পেন্সিল স্কেচে সেই চোখটা বারবার ফিরে আসছে, যদিও সে কখনও সেভাবে আঁকেনি। খেয়াল না করেই সে এই রকম চোখ অজান্তেই এঁকে চলেছে, আর প্রতিটি চোখ যেন কিছু বলছে—“তুই আমার দৃষ্টি তোলেছিস, এবার তোকে দেখতে হবে আমায়।”
একদিন দুপুরে দিব্যেন্দু এসে বলে—“আজ মন্দির বন্ধ থাক। কাল অমাবস্যা, আগেরবারও ওই সময়েই কিছু অস্বাভাবিক হয়েছিল।” ঐশী তা শুনে কিছু না বললেও মনে মনে স্থির করে সে ওই রাতেই মন্দিরে যাবে। তার দরকার আরও প্রমাণ, কারণ এ গবেষণাপত্র এখন শুধুই থিসিস নয়, বরং সে নিজেই এক অতিপ্রাকৃত ঘটনার কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। রাত গভীর হলে, পঞ্চু কাকার নজর এড়িয়ে, সে একাই মন্দিরের দিকে রওনা দেয়। রাস্তা শুনশান, আর চারপাশে কুকুরের হালকা ডেকে ওঠা ছাড়া কোনও শব্দ নেই। মন্দিরের দরজায় পৌঁছতেই সে দেখে দরজাটা সামান্য খোলা, ঠিক যেমনটা আগেরদিন ছিল। ভিতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত কুয়াশা যেন চোখে লেগে যায়—চিত্রে রঙগুলো স্পষ্ট, কিন্তু যেন থ্রিডি রূপে ওঠে এসেছে, একটু সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
সে চিত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, এবং দেখে—তান্ত্রিক মুখটা এখন একটু একটু করে বাঁকছে, ঠোঁটের কোণায় যেন বিদ্রূপের হাসি। ঠিক সেই সময়, তার মাথার ঠিক পেছনে একটি ধাতব শব্দ হয়—চক্র ঘোরার মতো। সে পিছনে তাকিয়ে দেখে মন্দিরের কোণায় এক পুরোনো পিতলের ঘন্টার দোলন আপনমনে দুলছে, অথচ বাতাস নেই। হঠাৎ একটি ছায়া পাশ দিয়ে হেঁটে যায়—একটি দীর্ঘ, কুণ্ডলিত চুলওয়ালা অবয়ব, যার পা নেই, কিন্তু ছায়া আছে। ঐশী তার ল্যাপটপ বার করে রেকর্ড করতে চায়, কিন্তু স্ক্রিনে হঠাৎ করেই ‘ACCESS DENIED’ লেখা ভেসে ওঠে। চিত্রের ভিতর থেকে যেন ফিসফিস শব্দ আসে—“দৃষ্টি দিয়ে মুক্তি আনিস? তবে তার মূল্য দিতে হবে তো…”
পেছনে পেছনে ছায়াটা হাঁটে, এবং একসময় ঐশী টের পায় তার চোখটা যেন ঘোরাফেরা করছে না, বরং ঠিক পেছনে কোনও দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। হঠাৎ করে মন্দিরের চারদিকের আলো নিভে যায়, শুধুমাত্র চালচিত্র থেকে একটি আগুনরঙা আভা চারপাশে ছড়াতে থাকে। সে তখন বুঝে যায়—এই চিত্র শুধু দৃষ্টির খেলা নয়, এটা একধরনের জাগ্রত তন্ত্র, যেখানে প্রত্যেক দৃষ্টিপাত এক ধরণের আহ্বান, আর প্রত্যেক ভয় একধরণের উৎসর্গ। সেই ভয় যখন চূড়ান্তে পৌঁছায়, তখন তান্ত্রিকের আত্মা সত্যিকারভাবে প্রবেশ করতে পারে আমাদের জগতে। ঐশী জানে না সে কীভাবে পালিয়ে এল, কিন্তু যখন সে হুঁশ ফিরে পায়, তখন সে তার নিজের ঘরের দরজার সামনে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে, আর পায়ের কাছে মাটিতে আঁকা সেই চিহ্ন—এক চোখওয়ালা ত্রিভুজ, ঠিক চালচিত্রের মতো। এবার সে আর সন্দেহ করে না, জানে—নীলধ্বজ তাকে বেছে নিয়েছে, এবং চোখের পেছনে যে ছায়া চলছিল এতদিন, সে আর কল্পনা নয়—সে এখন বাস্তব।
অধ্যায় ৫: “অন্ধকারের নকশা”
পরদিন সকালে ঐশী বারবার চেষ্টা করে গতরাতের ঘটনার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে। কিন্তু তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত রুক্ষতা, শরীরে অবসাদ আর চোখের নিচে গাঢ় কালশিটে দাগ স্পষ্ট করে দেয়—এই অভিজ্ঞতা শুধুই মানসিক নয়। সে জোর করে বলার চেষ্টা করে, “হয়তো আমি হ্যালুসিনেশন করছি… অত কাজের চাপ…” কিন্তু তার হাতের স্কেচবুকে আঁকা সেই একচোখো ত্রিভুজচিহ্ন, তার দরজার সামনে মাটিতে আঁকা থাকা সেই একই প্রতীক, এবং রাতের ফিসফিসানির স্মৃতি যেন নিজের উপস্থিতি বারবার ঘোষণা করে। ঐশী পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় অধ্যায় খুলে পড়ে, যেখানে তান্ত্রিক মণ্ডল রচনার বর্ণনা দেওয়া আছে। চিত্রতন্ত্রে ব্যবহৃত রেখা, বৃত্ত, বিন্দু, এবং ত্রিভুজের বিন্যাস কোনও সাধারণ অলঙ্করণ নয়—বরং এক ‘চক্র’ বা বন্ধনমালা, যেটি নীলধ্বজের আত্মাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পথনির্দেশিকা। আর ভয়ংকর ব্যাপার হলো, ঐশী নিজেই তা ধাপে ধাপে পূর্ণ করে ফেলছে—অজান্তে।
এই খবর নিয়ে ঐশী ছুটে যায় দিব্যেন্দুর কাছে। তার মুখ আরও শীর্ণ, চোখের কোণে রক্তচাপ। সে বলে, “আমি পাণ্ডুলিপির সবটা পড়িনি, ঐশী… কারণ কিছু অংশ খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু এখন আমাদের পড়তেই হবে।” তারা দুজনে মিলে সেই অংশগুলো পড়ে যেখানে বলা আছে, “যদি কেউ চিত্রতন্ত্র সম্পূর্ণ করে ফেলে, তবে তান্ত্রিক আত্মা পুনরায় শরীর খুঁজতে শুরু করে। এবং সে শরীর এমন একজনের দরকার যে দৃষ্টির উৎস ছিল।” ঐশীর মাথা ঘুরে যায়—“মানে? দৃষ্টির উৎস?” দিব্যেন্দু তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই। তুই প্রথম চালচিত্রটাকে গভীরভাবে দেখেছিস, অনুভব করেছিস, ছুঁয়েছিস… মানে তুই চিত্রতন্ত্রের ‘নয়ন-সংযোগ’। নীলধ্বজ তোকে বেছে নিয়েছে।” ঐশী দৌড়ে আয়নার সামনে যায়, এবং এবার খুব স্পষ্ট দেখতে পায়—তার চোখের মণির আশেপাশে অদ্ভুত একটা গাঢ় নীল ছায়া, যা চোখের ভিতরেই যেন পাক খাচ্ছে। ভয় আর রাগে সে ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলে, কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেই ত্রিভুজ চিহ্ন আর নীচে লেখা—“নজর দিয়েছিস, এবার দরজা খুল।”
ঐশী আর দিব্যেন্দু সিদ্ধান্ত নেয়, এখন যদি কিছু করা না হয়, তবে শুধু ঐশী নয়—পুরো গ্রাম, এমনকি বৃহত্তর এলাকা তছনছ হতে পারে। তারা পঞ্চু কাকার কাছে গিয়ে সব জানায়। বৃদ্ধ ধীর গলায় বলে, “এই চালচিত্র বন্ধ করতে গেলে চাই ‘রুদ্ধ তন্ত্র’, আর তার চাবি আছে মন্দিরের পেছনের গর্তে—যেখানে প্রথম রক্তপাত হয়েছিল। ওইখানে প্রথম বলি দেওয়া হয়েছিল—এক শিশু, যাকে তান্ত্রিক বলেছিল ‘শুদ্ধ উৎসর্গ’। সেই স্থানে গোপন এক নকশা খোদাই করা আছে, যেটি রুদ্ধ তন্ত্র সম্পন্ন করতে পারে।” দিব্যেন্দু তখন স্বীকার করে নেয়—তার পূর্বপুরুষ ছিল সেই বলির ঘটনার সঙ্গী, এবং আজ তাদের রক্তের মধ্যে দায় রয়ে গেছে। ঐশী যেন আবার আঁধারে ডুবে যেতে থাকে, কারণ সে এখন বোঝে, তার জীবন শুধু ব্যক্তিগত গবেষণা নয়, বরং শতাব্দীপ্রাচীন এক অভিশপ্ত ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু।
রাত নামলে, তারা তিনজন একসঙ্গে যায় মন্দিরের পেছনের অংশে, যেখানে জঙ্গল ঘিরে আছে পাথরের একটা নিচু মণ্ডপ। তার মাটি সরিয়ে বের হয় একটা পাথরের চাকতি, যাতে খোদাই করা সেই ত্রিভুজ, চক্র আর এক চোখ। দিব্যেন্দু রক্ত দিয়ে সেই চিহ্নে স্পর্শ করতেই এক ঝলকে বাতাস চারপাশে ঘুরে ওঠে, আর অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। বাতাসে ভেসে আসে এক উচ্চারণ—“দেখেছিস, ছুঁয়েছিস, এখন বলি দিতে হবে।” ঐশীর চোখ সামনে পড়তেই সে দেখে চিত্রের মুখ তার স্বপ্নের মতন জীবন্ত হয়ে উঠছে, আর তার নিজের হাত—নিজেই সেই চোখ আঁকছে, আবারও, শেষবারের মতো। এখন তন্ত্র সম্পূর্ণ, অন্ধকারের নকশা পূর্ণ, আর নীলধ্বজ প্রস্তুত—উৎসর্গ গ্রহণ করে শরীর ধারণ করতে। শুধু প্রশ্ন একটাই—কাকে নিতে চলেছে সে? দিব্যেন্দু? না ঐশী নিজে? উত্তরের আগে শুধু নিস্তব্ধতা।
অধ্যায় ৬: “বলির পাঁঠা”
পাথরের সেই প্রাচীন মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকা ঐশী, দিব্যেন্দু এবং পঞ্চু কাকা যেন সময়ের বাইরে এসে পড়েছে। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে থেকে উঠে আসছে অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণের মতো গর্জন—যেন মাটির নিচে কেউ কিছু বলছে, আর তার প্রতিধ্বনি ঘুরে ফিরে মস্তিষ্কের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে। পঞ্চু কাকার কণ্ঠ কঠিন, সে বলে, “যেই বলি ছাড়া এই চিত্র বন্ধ হবে না, সেই উৎসর্গ আজ চাই। নাহলে এই তান্ত্রিক আত্মা পুরো গ্রাম গ্রাস করবে।” ঐশী কাঁপা কণ্ঠে বলে, “কিন্তু কে হবে সেই বলি?” দিব্যেন্দু তখন মাথা নিচু করে বলে, “আমার পূর্বপুরুষ এই পাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমিই সেই রক্তরেখার ধারক। আমাকে দাও বলি।” পঞ্চু কাকা গর্জে ওঠে, “এই সিদ্ধান্ত তোদের নয়! চিত্র তো ঠিক করে রেখেছে তার পাঁঠা!” ঐশী হতভম্ব হয়ে যায়। তার মানে—চিত্র কি তাহলে তাকেই বেছে নিয়েছে?
হঠাৎ, বাতাস ভারী হয়ে আসে। চারপাশে হালকা ধোঁয়া, আর তার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয় সেই মুখ—নীলধ্বজের মুখ। আগুনে পুড়ে যাওয়া চোখ, কুণ্ডলিত চুল, আর এক অদ্ভুত ত্রিভুজময় মস্তক। সে যেন কিছু বলছে না, কিন্তু তার দিকে তাকালেই ঐশীর মনে হচ্ছে মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছে কোনো আদেশ, কোনো নিষ্ঠুর ডাক। তার শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ঐশী, পা এগিয়ে চলে চক্রের কেন্দ্রের দিকে—যেখানে সেই চিহ্ন আঁকা পাথর রক্ত চায়। ঠিক তখন, দিব্যেন্দু চিৎকার করে তার হাত টেনে ধরে, এবং নিজের ছুরিকাটা আঙুল দিয়ে সেই পাথরের গায়ে ছুঁয়ে দেয়। রক্ত লেগে যায়। মুহূর্তেই এক গর্জনে চারপাশ কেঁপে ওঠে। চালচিত্রে যেন হঠাৎ করে আগুন ধরে যায়, এবং সেই আগুন দিয়ে আঁকা মুখ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। “তুই না! না!”—মনের ভেতর সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার।
দৃশ্যটা এমন হয় যেন সবকিছু একসঙ্গে গলে যাচ্ছে—চিত্র, রেখা, মুখ, মাটি, বাতাস। পঞ্চু কাকা উচ্চস্বরে এক অদ্ভুত মন্ত্র জপ করতে থাকে, এবং হঠাৎ একঝলকে চারপাশ ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর, সব স্থির। পাথরের ওপর রক্ত শুকিয়ে গেছে, চালচিত্র যেন নিস্তেজ, চিত্রের মুখ ধ্বসে পড়েছে রেখার ভেতরে। ঐশী হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে। দিব্যেন্দু নিঃশব্দে পড়ে আছে—অচেতন। পঞ্চু কাকা তার কাঁধে হাত রাখে, “শেষ হ’লে, কাকুতি মিনতি করেও তোর চেহারা বাদ যাবে না, মা। কিন্তু আজ তুই বেঁচে গেছিস।” ঐশী জানে না কী বাঁচল, কী হারাল, কিন্তু তার মনের গভীরে কেবল একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—“বলির পাঁঠা”।
রাত পেরোলে সকালের আলোয় দিব্যেন্দু জ্ঞান ফিরে পায়। পাথরের গায়ে যে ত্রিভুজ-চিহ্ন ছিল, তা মুছে গেছে, চালচিত্র স্থির—কিন্তু দেয়ালের এক কোণে হঠাৎ করে ঐশী একটি নতুন রেখা দেখতে পায়। সেটা আগের চিত্রে ছিল না—এখন আছে এক চোখ, এক মুখ, আর এক নারী-মূর্তি। সেই নারী দেখতে অনেকটা… নিজেকেই মনে হয়। সে বুঝতে পারে, চিত্র তাকে এখনও ছাড়েনি। হয়তো আজকের জন্য মুক্তি মিলেছে, কিন্তু চিত্র তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, তার ‘চোখে’ ঘর বেঁধেছে। এই খেলাটা এখনই শেষ নয়—তান্ত্রিক হয়তো হেরেছে, কিন্তু চিত্র এখন তার প্রতিচ্ছবি। এবং বলির তালিকা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি…
অধ্যায় ৭: “চিত্রের ভিতর চাহনি”
বাঁকুড়ার আকাশে তখন শীতের কুয়াশা ঘনিয়ে এসেছে। মন্দিরের আশপাশের মানুষজন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে, কিন্তু ঐশী জানে—সব স্বাভাবিক নয়। পাথরের সেই বলির চিহ্ন মুছে গেছে ঠিকই, দিব্যেন্দু অল্প বিস্মৃতি নিয়ে স্কুলে ফিরে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঐশীর প্রতিদিনের জীবনে এখন ঢুকে পড়েছে এক অন্যমাত্রার শূন্যতা। যে আয়নাতে সে প্রতিদিন মুখ দেখে রোজকার দিন শুরু করত, সেই আয়নাতেই এখন মাঝেমধ্যে দেখতে পায় অন্য এক মুখ—এক নারীর মুখ, যাকে সে খুব চেনা মনে হয়। যেদিন সে প্রথম অনুভব করল মুখটা নিজের, কিন্তু চাহনিটা তার নয়—সেদিন থেকেই তার ঘুম উড়ে গেছে।
সন্ধ্যা নামার পরে ঐশী আবার পুরোনো চালচিত্রের ফটোগুলো খুলে দেখে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চিত্রের ত্রিভুজ, আগুনের রেখা, সেই মুখ—সব ঠিকঠাক। কিন্তু এবার চোখ আটকে যায় একটি নতুন খুঁটিনাটিতে—চিত্রের এক কোণে, আগুনঘেরা বৃত্তের পাশে একটা অতিক্ষুদ্র সিলুয়েট। সেটি যেন নারী, তার কাঁধে একটা বই। স্ক্রিনে জুম করে দেখতেই হিমশীতল শ্বাস এসে পড়ে ঐশীর গলায়—এই অবয়বটা অবিকল তার মতো। সে তো আগে ছিল না! ঐশী এবার ভয়ে নয়, রাগে উন্মত্ত হয়ে যায়। তার মনে হয়, নীলধ্বজ তাকে চিত্রের ভিতরে টেনে নিতে চাইছে, আস্তে আস্তে, যেন ঐশী নিজেই হয়ে উঠছে নতুন চিত্রতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু।
সে আবার যায় মন্দিরে, দিব্যেন্দুকে সঙ্গে নেয় না। পঞ্চু কাকা এবার চুপচাপ দরজা খুলে দেয়, বলে, “এবার শেষ কর, মা। অতীত বারবার ফিরে আসে না।” ঐশী গৃহমধ্যের নিঃশব্দতা পেরিয়ে আবার দাঁড়ায় সেই চালচিত্রের সামনে। এইবার চিত্র যেন আর দু’ডাইমেনশনাল নয়—রেখাগুলোর মধ্য থেকে আলো বেরিয়ে আসে, চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট—এবার আর প্রতীক নয়, এ যেন এক প্রত্যক্ষ মুখোমুখি হওয়া। হঠাৎ পেছন থেকে ফিসফিসানি—“তুই চিত্রে থাক, আমি বাহিরে থাকি। খেলাটা এবার বদলাব।” চমকে ফিরে তাকায় ঐশী—কেউ নেই।
ঠিক তখন, চিত্রের আগুনঘেরা চোখের মণি থেকে ছুটে বেরোয় এক রেখা, দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। ঐশীর কাঁধে বসে থাকা স্কার্ফ এক ঝলকে সরে যায়, এবং তার কাঁধে গরম একটা ছোঁয়া অনুভব হয়—এক চিহ্ন আঁকা হয়ে গেছে। সে আয়না তুলে দেখে—এক ক্ষীণ ত্রিভুজ এখন তার গলায় গেঁথে গেছে। তার মানে—চিত্র তাকে শুধু নির্বাচন করেনি, বরং দাগও দিয়ে গেছে। সে বুঝে যায়, কেবল চিত্র বন্ধ করলেই চলবে না, তাকে চিত্রের ভিতর ঢুকে, কেন্দ্রের নকশাকে উল্টে দিতে হবে।
ঐশী এবার সিদ্ধান্ত নেয়—সে চিত্রে প্রবেশ করবে। এই প্রবেশ শুধু এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা নয়, বরং এক ঝুঁকিপূর্ণ আত্ম-ত্যাগ, যেখানে তার দেহ থাকবে বাইরের জগতে, কিন্তু চেতনা প্রবেশ করবে রেখার ভিতর। পাণ্ডুলিপির এক গোপন মন্ত্র, “নয়ন-বান্ধন মুদ্রা” ব্যবহার করেই এই প্রবেশ সম্ভব। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় ঐশী মন্দিরের ভিতর চিত্রের সামনে বসে আছে, চোখ বন্ধ, উচ্চারণ করছে সেই নিষিদ্ধ মন্ত্র—“ত্র্যস্তম্ নীলধ্বজং বন্ধে, চিত্রং যাহি মাং গ্রহ।” বাতাস গাঢ় হয়, মেঝে কেঁপে ওঠে, এবং ঐশীর শরীর অবশ হয়ে পড়ে যায়। চালচিত্রে এক মুহূর্তে আলো জ্বলে ওঠে—চিত্রের কেন্দ্র থেকে যেন কোনো দৃষ্টি এবার তাকিয়ে আছে বাইরে নয়, বরং ভিতরের দিকে। ঐশী এখন আর দর্শক নয়, সে নিজেই এখন চিত্রের অন্তরালে—প্রবেশ করেছে সেই অলৌকিক ক্ষেত্র, যেখানে রেখা মানে পথ, আর চোখ মানে দ্বার। চিত্রের ভিতর শুরু হয়েছে নতুন খেলা।
অধ্যায় ৮: “রেখার ভিতর রাজত্ব”
চোখ বন্ধ করার পর মুহূর্তেই যেন ঐশী পড়ে যায় এক সীমাহীন শূন্যতার মাঝে—না আলো, না অন্ধকার, শুধু চলমান রেখা, ছায়া, আর অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণে মোড়া এক নির্জন গোলক। সে জানে, সে আর মন্দিরে নেই—এখন সে চিত্রের ভিতরে, এক তান্ত্রিক নির্মিত জগতে, যেখানে প্রতিটি রেখা একেকটি পথ, প্রতিটি রঙ একেকটি ভিন্ন শক্তির সত্তা। এখানে বাস্তব সময় কাজ করে না, এখানে সিদ্ধান্ত মানে শুধু চলা নয়—এটা মানে আত্মাকে রক্ষা করা অথবা উৎসর্গ করে দেওয়া। তার সামনে ভেসে ওঠে ত্রিভুজাকৃতির এক দরজা, যার প্রতিটি কোণে আগুনের শিখা নেচে চলেছে। ঐশী এগিয়ে যেতে না যেতেই সামনে এসে দাঁড়ায় এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি—যার মুখ তার নিজের, কিন্তু চোখদুটি একেবারে খালি, মণিবিহীন। ছায়াটি বলে, “তুই এসেছিস, কিন্তু এখান থেকে ফিরে যাওয়া মানে হবে নীলধ্বজকে জাগ্রত করে যাওয়া। তোর শরীর এখন খালি খোলস, আর আমি প্রস্তুত সেই খোলস ধারণ করতে।” ঐশী চিৎকার করে বলে, “আমি এসেছি চিত্র ভাঙতে, উৎসর্গ হতে নয়!” ছায়াটি কুৎসিত হাসি হেসে বলে, “তুই নিজেই তোর বলি। তোর চেতনা মানে আমার মুক্তি।”
হঠাৎ চারপাশের রেখাগুলি পাক খেতে খেতে এক বিশাল গোলক তৈরি করে, যার কেন্দ্রে আগুনঘেরা চোখ! সেই চোখ তাকিয়ে থাকে সরাসরি ঐশীর দিকে, তার ভিতরটাকে ভেদ করে। ঐশী বোঝে, এটি নীলধ্বজের মূল দর্শন—চিত্রতন্ত্রের কেন্দ্রমণি। পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল, “যদি কেউ চিত্রের ভিতর প্রবেশ করে এবং কেন্দ্রে গিয়ে মুদ্রা উল্টাতে পারে, তবে চিত্রতন্ত্র ছিন্ন হবে।” তার মানে ঐশীকে সেই কেন্দ্র স্পর্শ করতে হবে, কিন্তু তাতে রয়েছে বিপদ—সেই জায়গায় পৌঁছালে আত্মা দেহচ্যুত হয়ে যেতে পারে চিরতরে। তখন সে শুধু রেখা হয়ে যাবে, আর নীলধ্বজ তার শরীর দখল করে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এই দ্বিধার মাঝে দাঁড়িয়ে ঐশী শুনতে পায় পরিচিত এক কণ্ঠ—দিব্যেন্দুর। সেই কণ্ঠ দূরে কোথাও বলছে, “ঐশী, তুই পারবি। তুই চিত্র না, তুই চিত্রী।”
এই শব্দে সাহস ফিরে পায় ঐশী। সে চিত্ররেখার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে কেন্দ্রমণির দিকে এগিয়ে যায়। আগুনের রেখা ছুঁয়ে যায় তার দেহ, প্রতিটি স্পর্শে স্মৃতি পুড়ে যায়—শৈশব, পড়াশোনা, শহরের জানলা, মা’র মুখ… সব ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার চোখে এখন একটাই লক্ষ্য—চিত্রভাঙন। কেন্দ্রে পৌঁছে সে দেখে ত্রিভুজরূপী একটি নকশা, যার উপর লেখা, “অভিনয় নয়, আত্মবিসর্জন।” ঐশী নিজের কাঁধে আঁকা সেই আগের চিহ্নে হাত রাখে, এবং উচ্চারণ করে, “ত্র্যস্তম্ নীলধ্বজং নাশয়, চিত্রং ভেদ। আমি ফিরতে চাই না, আমি চাই আলো।” মুহূর্তেই পুরো গোলক আলোয় ভরে ওঠে, রেখাগুলি একে একে ছিন্ন হয়, আর চোখটি ফেটে গিয়ে হাজার শিখায় পরিণত হয়।
অন্যদিকে মন্দিরের ভিতরে দিব্যেন্দু দেখতে পায় ঐশীর দেহ ধীরে ধীরে আলোয় ঝলমল করছে, এবং হঠাৎই একটি হালকা শ্বাস টেনে নিয়ে সে চোখ খুলে বসে পড়ে। তার চোখ স্বচ্ছ, তার মুখ স্তব্ধ। সে ধীরে বলে, “আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু আমি ঐশী হয়েও এক নতুন চেতনা। চিত্র শেষ হয়েছে না, আমি চিত্রের ভিতর হেঁটে এসে এক নতুন রেখা নিয়ে ফিরেছি।” তখনই তারা দুজনে মন্দিরের চালচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখে—আগের তান্ত্রিক মুখটি নেই, কিন্তু একটি নতুন রেখা দেখা যাচ্ছে—এক চোখ বন্ধ, আর এক চোখ খোলা। এবং তার নীচে লেখা—“জাগরণ চক্র শুরু হ’লো।”
চিত্র ভেঙেছে, না কি রূপ বদলেছে? নীলধ্বজ হয়তো ধ্বংস হয়নি, শুধু জায়গা বদলে নিয়েছে—রেখার ভেতর থেকে এবার মানুষকে দেখে, চোখের ভেতর নয়, মনোরেখায়। আর ঐশী? সে কি চিত্র থেকে মুক্ত, না কি চিত্র এখন ওর সঙ্গেই বেঁচে রয়েছে?
চিহ্নটা এখনও ওর কাঁধে আছে…
অধ্যায় ৯: “রেখার বাইরের দৃষ্টি”
বাঁকুড়ার আকাশে তখন সন্ধ্যার লাল আভা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে যাচ্ছে। মন্দিরের চালচিত্র, যেটি একসময় নীলধ্বজের তান্ত্রিক আত্মার আবাস ছিল, এখন নিঃসাড়। আগুনঘেরা চোখ নেই, মুখের বেঁকে থাকা বিদ্রূপ মুছে গেছে, কিন্তু ঐশী জানে—চিত্রের মুখ নয়, বরং তার মন এখন সেই বোধ বহন করে। সে এখন শুধু এক শিল্প ইতিহাসের ছাত্রী নয়, সে এখন এক প্রত্যক্ষদর্শী, এক জীবন্ত রেখার বাহক, যার শরীর আর মন দুটোই স্পর্শ পেয়েছে অতীত, তন্ত্র, আর অদৃশ্য এক শক্তির। দিব্যেন্দু ও পঞ্চু কাকা তার পাশেই থাকলেও তারা জানে—ঐশী আর আগের মতো নেই। কখনও কখনও সে রাতবিরেতে একা বসে থাকে, স্কেচবুক খুলে, যেখানে তার হাত নিজেই আঁকতে থাকে এক নতুন ধরণের রেখা—রৈখিক নয়, স্পন্দনশীল। ঐশী বারবার সেই রেখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করে এক নতুন আকর্ষণ—চিত্রটা যেন ওকে ছাড়ছে না, বরং ওকে দিয়েই আরও কিছু তৈরি করতে চাইছে।
একদিন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক দল গবেষক আসে ঐশীর থিসিস দেখতে। তারা মুগ্ধ হয় ঐশীর বিশ্লেষণ, তার তুলনামূলক রেখা ব্যাখ্যা, এবং সর্বোপরি সেই চালচিত্রের একমাত্র নথিভুক্ত রূপ নিয়ে। কিন্তু গবেষক দলের একজন, প্রাচীন শিল্পকলায় পিএইচডি করা অধ্যাপক মালবিকা সরকার, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে চিত্রের নতুন রেখার দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই ধরনের রেখা আগে কোথাও দেখিনি… এক অদ্ভুত মিশ্র রীতির ইঙ্গিত। এটা কি ঐশী নিজেই এঁকেছে?” ঐশী কিছু বলে না, শুধু হেসে বলে, “এটা চিত্রের নিজস্ব ভাষা।” সেইদিনই অধ্যাপক বলেন, “তুমি যদি এই কাজকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিতে চাও, আমরা সহযোগিতা করবো।” কিন্তু ঐশীর মন দ্বিধায় ডোবে—এই চিত্র কি সত্যিই পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত করার মতো? যদি নীলধ্বজের চেতনা কোথাও লুকিয়ে থাকে, যদি এই নতুন রেখার ভিতর কোনও গোপন সংকেত থাকে?
ঐশী রাতের বেলায় আবার মন্দিরে যায়, একা। চালচিত্র এখন শান্ত, তবুও তার চোখের সামনে এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—এক নতুন রেখার প্যাটার্ন, যেটা সে আঁকেনি। এইবার ত্রিভুজের ভেতর রয়েছে একটি খোলা হাত, আর তার ভিতর অক্ষরে লেখা—“তুমি আমার সৃষ্টি, আমি তোমার ধারক।” সে চমকে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই আগুনঘেরা চোখ, সেই গোলক, সেই ফিসফিসানি। সে বুঝতে পারে, তার মনের একটা অংশ এখন চিত্রের অংশ হয়ে গেছে। এবং সেই অংশই চিত্রকে চালিত করছে নতুনভাবে। সেই চেতনা হয়তো নীলধ্বজ নয়, কিন্তু তারই এক ভিন্ন রূপ—যেটা জন্ম নিয়েছে ঐশীর ভিতর দিয়ে।
সে ফিরে আসে, কিন্তু এখন আর গবেষণার ভাষায় কথা বলে না। সে বলতে শুরু করে রেখার গল্প—যেভাবে প্রতিটি রেখা কোনও না কোনও দৃষ্টি ধারণ করে, যেভাবে শিল্প একটা দেহ হয়ে ওঠে আত্মার, আর যেভাবে মানুষ শিল্পের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে হয়ে ওঠে একটা চলমান চিত্রপট। তার থিসিস এখন আর শুধু মন্দিরের চালচিত্র নিয়ে নয়—এটা এখন মানুষ এবং রেখার সম্পর্ক, আত্মা এবং নকশার মধ্যেকার সেই তীর্যক সেতুবন্ধন।
কিন্তু একদিন ভোরে, যখন সে ঘুমিয়ে আছে, আয়নার সামনে রাখা স্কেচবুক খুলে যায় নিজে থেকেই। বাতাস পাতাগুলো উল্টে দেয়, আর শেষ পাতায় ভেসে ওঠে সেই একই ত্রিভুজ—খোলা চোখ, এক নতুন মুখ, এবং নীচে লেখা—
“এবার তুই আঁক, আমি দেখি।”
চিত্র এবার তার দৃষ্টি ধার করে নিচ্ছে। চিত্র বন্ধ হয়নি। চিত্র এখন ঐশীর ভিতর দিয়েই নিজেকে তৈরি করছে—নতুনভাবে, নতুন দৃষ্টিতে।
নীলধ্বজ হয়তো নেই, তবে রেখা এখন কথা বলে।
অধ্যায় ১০: “শেষ রেখা, শূন্য দৃষ্টি”
বাঁকুড়ার সেই পুরনো মন্দির, যেখানে একসময় নীলধ্বজের আত্মা আগুনের রেখায় বন্দি ছিল, এখন শূন্য। চালচিত্রের দেয়ালটিকে নতুনভাবে রক্ষণা করা হয়েছে—সুরক্ষিত কাচে ঢাকা, পর্যবেক্ষণের জন্য লাইটিং বসানো, গবেষণার দাগ দিয়ে চিহ্নিত রেখা রাখা। কিন্তু কেউ জানে না, এই দেয়ালে যা আছে, তা কেবল ইতিহাস নয়, বরং এক জাগ্রত চেতনা, যেটা সময়ের ওপারে দাঁড়িয়ে এখন অন্য এক পথ খুঁজছে। ঐশী এখন কলকাতার এক শিল্প-গবেষণা সংস্থায় কাজ করে। তার থিসিস আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়, কিন্তু সে কোনও পুরস্কার নিতে যায় না। তার কাজ এখন আর কাগজে নয়—সে চোখ বন্ধ করে ‘দেখে’, আর দেখার পরে হাতে রেখা আঁকে। তার প্রতিটি রেখা যেন এক বার্তা, এক শব্দহীন ভাষা—যেটা কেবল চিত্র বুঝতে পারে, আর কখনও কখনও—চিত্রের মধ্য দিয়ে আরও কেউ।
একদিন এক নতুন ছাত্রী আসে ঐশীর কাছে, নাম রিতিকা। সে বলে, “ম্যাম, আমি আপনার আঁকা এই রচনাগুলোর ভিতর অদ্ভুত টান অনুভব করি। যেন কেউ আমাকে ডাকছে। আমি ঘুমোতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, স্কেচবুক নিজের থেকে খুলে যায়।” ঐশী চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। সে জানে, এই গল্প আর থামেনি—এই চিত্র এখন একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। যেমন একদিন নীলধ্বজ আঁকত, তারপর ঐশী সেই রেখার পথ ধরে ঢুকেছিল, এখন সেই পথ নতুন কারও দিকে এগোচ্ছে। চিত্র মানে শুধু লিপি নয়, এটি এক চেতনার চক্র, যা ছুঁয়ে যায় সেইসব মানুষকে, যাদের ভিতরে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছা প্রখর, আর যারা বিশ্বাস করে রেখার মধ্যেও আত্মা থাকতে পারে।
রাতের বেলায় ঐশী নিজের ডেস্কে বসে, হাতে পেনসিল, সামনে সাদা কাগজ। বাতাস নিঃশব্দ। সে চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর তার হাত চলে, এবং আঁকা হয়ে যায় এক অদ্ভুত নকশা—এক গোল চক্র, যার কেন্দ্র ফাঁকা, শুধু এক বিন্দু। তার পাশে লেখা—“চিত্র শেষ নয়, আমি শুধু খাতা পাল্টেছি।” ঐশীর চোখ খোলে, সে জানে এ লেখা তার নয়। সে কাঁধে হাত রাখে—পুরোনো ত্রিভুজচিহ্ন মুছে গেছে, কিন্তু তার বদলে এক নতুন গাঢ় ছাপ দেখা যাচ্ছে, যেন কেউ আবার আঁকা শুরু করেছে।
সে জানে, এই চিত্র এখন নিখুঁতভাবে বদলেছে—এটি আর তান্ত্রিকের অভিশাপ নয়, বরং এক চিন্তার উৎস, এক অসীম প্রবাহ। তবু, তার ভিতরের ভয় বলে—যদি কখনও কেউ আবার সেই পুরোনো কেন্দ্র খুঁজে পায়? যদি কেউ আবার ‘চিত্রতন্ত্র’ পুরো করে ফেলে?
গল্প শেষ হয় ঐশীর হাতে আঁকা সেই শেষ পাতার এক চিত্র দিয়ে—যেখানে কোনও চোখ নেই, কোনও মুখ নেই, শুধু রেখা—যা চলতে চলতে মিলিয়ে যায় শূন্যে।
আর তার নিচে লেখা—
“এই শূন্যতাই আমার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।”
চিত্র চুপচাপ রয়ে গেছে। তবে যারা ‘দেখে’, তারা জানে—
চিত্র এখনো তাকিয়ে আছে… তোমার দিকেই।
(সমাপ্ত)