তাপস মিত্র
১
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির শেষ প্রান্তে একটি পুরোনো, প্রায় পরিত্যক্ত স্টুডিও—যার নাম ‘নৃত্যনিকেতন’—সেখানে প্রায় ছয় বছর পর ফিরে এল অর্ণবী সেন। একসময় এই স্টুডিও তার প্রথম নাচ শেখার জায়গা ছিল, যেখানে প্রতিটি কাঠের মেঝে, প্রতিটি আয়না তাকে শিখিয়েছিল শরীরের ভাষা। এখন সে দেশের খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী, দেশে-বিদেশে শো করে বেড়ায়, অথচ মনটা ফিরে আসে এই পুরোনো কাঠের দরজার নিচে জমে থাকা ধুলোর গন্ধে। গুরু মীরা বসুর ডাকে এসেছিল আজ, স্টুডিওর নীচের পুরোনো ঘরে কিছু পুরনো উপকরণ খুঁজে বের করতে হবে—পুরোনো পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, কিছু অলঙ্কার—যেগুলো তাদের নতুন নাট্য প্রযোজনায় ব্যবহৃত হবে। অর্ণবী একাই ঢুকেছিল সেই ঘরে। জানালার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল দুপুরের কমলা আলো। বাতাসে ঘরে জমে থাকা বইপত্র, কাপড় আর কাঠের সিঁড়ির গন্ধ মিশে গিয়ে তৈরি করেছিল এক ধূলিধুসর অতীতের আস্তরণ। এক কোণে ধুলোমাখা একটি ছোট কাঠের বাক্স চোখে পড়ল। বাক্সটির গায়ে লেখা ছিল—“গজানন নাথ, ১৮৯৭”। অর্ণবী ধীরে ধীরে বাক্সটি খুলল। তার ভিতরে পাওয়া গেল একটি জোড়া ঘুঙুর—তামার রঙের, প্রায় কালো হয়ে আসা, কিন্তু তাতে সূক্ষ্ম কাজ করা ছিল। ঘুঙুরদুটো হাতে নিয়ে সে অনুভব করল এক অদ্ভুত ঠান্ডা—যেন মাটির নিচ থেকে উঠে আসা হিমেল বাতাস ছুঁয়ে গেল তার তালু। সঙ্গে সঙ্গে সে শুনতে পেল মৃদু ঝঙ্কার, যদিও সে তখনও ঘুঙুর নাড়ায়নি। সেই মুহূর্তে ঘরের আলো যেন একটু ঘন হয়ে এল, ঘড়ির কাঁটা থেমে গেল বলে মনে হল। সে যেন কোনো এক প্রাচীন সময়ের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল।
সেই রাতেই প্রথম অদ্ভুত স্বপ্নটি দেখে অর্ণবী। স্বপ্নে সে নিজেকে দেখে একটি অচেনা মঞ্চে, অন্ধকারের ভেতরে চারপাশে শত শত জ্বলন্ত প্রদীপ, মাথার ওপর লাল কাপড়ের চাঁদোয়া। নাচের ছন্দে সে একের পর এক কঠিন ভঙ্গিমায় শরীর মোচড়ায়, তার পায়ের প্রতিটি আঘাতে ঘুঙুরের ঝঙ্কার যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল—তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ, যারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। চোখ বড় বড়, যেন তারা মুগ্ধ নয়—ভীত। এবং প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্যে কেউ একজন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে ঘামে ভিজে উঠল অর্ণবী। টেবিলের পাশে রাখা ঘুঙুরজোড়া নিজে থেকেই মৃদু আওয়াজ করছিল, অথচ জানালা বন্ধ, বাতাস নেই। সকালে উঠে সে নিজেকে বোঝালো—স্বপ্ন, কাকতালীয় সব কিছু। কিন্তু যখন ঘুঙুরের পাশে দেখতে পেল লাল দাগ—যেটা ঠিক যেন শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো—তখন সে আর সহজভাবে নিতে পারল না ব্যাপারটিকে। তবু শিল্পীর মন তখন মুগ্ধ, রহস্যে জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ তার মধ্যে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নাচের জন্য এমন কিছু অলৌকিক কিছু পেতে কার না ভালো লাগে? সে ভাবল—শুধু একবার পরে দেখি, হয়তো কোনো ভুল ভাবছি।
পরের সপ্তাহে একটি গ্যালারি উদ্বোধনের পারফরম্যান্সে ঘুঙুরটি পরে মঞ্চে ওঠে অর্ণবী। তার পা যেন নিজেই ছন্দ খুঁজে নেয়, দেহে যেন এক অপার্থিব শক্তি ভর করে। দর্শকবৃন্দ একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। সাংবাদিকেরা বলে, “এ যেন শরীর নয়, আত্মা নাচছে।” নাচ শেষ হওয়ার পর ক্লান্ত অর্ণবী ফিরে আসে স্টুডিওতে, সেদিনই প্রথম অনুভব করে—এই ঘুঙুরে কিছু আছে। কারণ সেদিন রাতেই খবর আসে—গ্যালারির বৃদ্ধ নিরাপত্তারক্ষী প্রদীপ চৌধুরী হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে সে নাকি চিৎকার করেছিল—“ঘুঙুর বাজছে, কে আছে?” কেউ তখন ঘুঙুর বাজাচ্ছিল না, মঞ্চ খালি ছিল, আর অর্ণবী স্টুডিওতেই ছিল। বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় দেখার চেষ্টা করলেও, তার ভেতরের কোনও অনুভূতি বলছিল—সব কিছুই খুব সরু সুতোয় বাঁধা। এবং সেই সুতো টানতেই অর্ণবী এখন ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে চলেছে এক অতল অন্ধকারে—যার নাম তান্ত্রিকের ঘুঙুর।
২
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘ছায়াপথ গ্যালারি’—এই নতুন আর্ট স্পেসটির উদ্বোধনে অর্ণবী সেনের নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই টিকিট শেষ। শিল্পী, সাংবাদিক, উদ্যোক্তা, ছাত্রছাত্রী—সবার ভিড়ে হল যেন শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। অর্ণবী নিজেও জানত না, আজকের পারফরম্যান্সটা কেমন হবে। যদিও স্ক্রিপ্ট সাজানো, সঙ্গীত ঠিক করা, তার নিজস্ব কোরিওগ্রাফি যেমন থাকে, তেমনভাবেই তৈরি, কিন্তু আজ প্রথমবার সে ‘ঘুঙুরটা’ পরে মঞ্চে উঠবে। ব্যাকস্টেজে আয়নার সামনে বসে সে নিজের পায়ে ঘুঙুর বাঁধছিল—তামাটে রঙের পুরোনো পিতলের গায়ে সূক্ষ্ম অলংকরণ, যার প্রতিটা ঘণ্টি বাজলে একরকম ভারি আওয়াজ বেরোয়, যেন বহু পুরনো মন্দিরের ঘন্টার শব্দ। প্রতিটি বাঁধা তার মনে এক অজানা ছন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যখন সে হাঁটছিল, তার পায়ের শব্দ ছাড়াও মনে হচ্ছিল যেন আরও কারও পা চলেছে তার পাশে, অদৃশ্য কেউ। অর্ণবী আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখল—কিন্তু যেন নিজের চেহারায় কোথাও একটুখানি বদল। চোখের নিচে হালকা ছায়া, ঠোঁটে নিষ্ঠুর এক অচেনা হেসি। সে চমকে উঠল, আবার তাকাল, এবার স্বাভাবিক। সব কিছুই কি তার মনের ভুল? সময় চলে আসছে। মঞ্চে ওঠার আগে তার গলায় হালকা কাপুনি, অথচ শরীর ভরা এক অদ্ভুত শক্তিতে। যেন আজ সে নাচবে না—কারও হয়ে কিছু আদায় করবে।
নৃত্য শুরু হতেই হল নিঃশব্দ হয়ে গেল। সে গানের তাল ধরেনি, তাল ধরেছে ঘুঙুরের মৃদু ঝঙ্কার। সঙ্গীত যেন পিছিয়ে পড়ছিল তার শরীরের গতি থেকে। দর্শক চমকে দেখল—নাচের প্রতিটি ভঙ্গি যেন কোরিওগ্রাফির বাইরে গিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, হাতের ভঙ্গিতে এক ধরনের আক্রোশ, চোখে যেন যন্ত্রণার খেলা, আর পায়ের ছন্দে ছিল—ধ্বংসের হুঙ্কার। প্রতিটি পায়ের আওয়াজে ঘুঙুর যেন চিৎকার করছে, তার নাচের মধ্য দিয়ে যেন এক বধ্যভূমির স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। একজন দর্শক পরে বলেছিল—“আমার মনে হয়েছিল সে কেবল নাচছে না, সে যেন কিছু টেনে নিচ্ছিল আমাদের বুকের ভেতর থেকে।” পুরো ১৫ মিনিটের সেই পরিবেশনা শেষে অর্ণবী চুপচাপ মঞ্চ থেকে নামল। করতালির ধ্বনি কানে ঢুকছিল না। তার শ্বাস চলছিল অগভীরভাবে, বুকটা হালকা ব্যথা করছিল। তবু তার মনে হচ্ছিল—সে আজ নেচে যা চেয়েছিল, তা ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সেটা কী, তা সে নিজেও জানত না। সেদিন রাতেই সে বাড়ি ফিরে এল, খুব ঘুম পাচ্ছিল না। একবার সে শুনতে পেল—ঘরের ভেতর ঘুঙুর বাজছে মৃদু করে, যদিও সে তখন ঘুঙুর আলমারির মধ্যে লক করে রেখেছে। সে উঠে আলো জ্বালিয়ে খুঁজল, কিছুই পেল না। এমন সময় ফোন এলো—“প্রদীপদা মারা গেছেন।” সেই গ্যালারির নিরাপত্তারক্ষী, একরত্তি শান্ত মানুষ, যিনি সেদিন শোয়ের পর রাত জাগছিলেন, হঠাৎ মারা যান। রিপোর্ট বলছে স্ট্রোক। কিন্তু আরও ভয়ানক খবর ছিল—মৃত্যুর আগে তিনি বার বার চিৎকার করছিলেন—“ঘুঙুর বাজছে! কে নাচছে? থামাও!” গ্যালারির ক্যামেরা ফুটেজে কিছুই দেখা যায়নি, অথচ রাত ১২টা ১৪ মিনিটে তার দৃষ্টিপাত ছিল গ্যালারির মূল মঞ্চের দিকে—যেটা তখন বন্ধ ছিল, আলো নেভানো।
পরদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় অর্ণবীর ছবি ছাপা হয়েছিল—“অসাধারণ পারফরম্যান্সে মুগ্ধ শহর” শিরোনামে। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল ছোট্ট একটি সংবাদে—“রহস্যজনক মৃত্যু নিরাপত্তারক্ষীর”। তার মন কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল। সে আবার খুলে দেখল ঘুঙুরজোড়া—এবার তাতে রক্তের হালকা ছোপ। সে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই শুনতে পেল এক অদ্ভুত গুঞ্জন—যেন কেউ মৃদু স্বরে মন্ত্র পড়ছে। ঠিক তখনই তার দরজায় কড়া নাড়ল এক ব্যক্তি—ঋত্বিক ধর, সাংবাদিক, যার আগ্রহ প্যারানরমাল বিষয় ঘিরে। সে এসেছিল শুধু প্রশ্ন করতে—“ঘুঙুরটা কি আপনার?” অর্ণবী কিছু বলার আগেই সে এক ছেঁড়া ছবি দেখাল—এক শতাব্দী পুরনো নর্তকীর ছবি, যিনি এক তান্ত্রিকের নির্দেশে ঘুঙুর পরে নাচতেন বলি দেওয়ার জন্য। “এই ঘুঙুরটার ইতিহাস আপনি জানেন তো?”—ঋত্বিকের সেই প্রশ্ন অর্ণবীর জীবনে এক নতুন দরজা খুলে দিল, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব ছিল না।
৩
ঋত্বিক ধর, নিজের পেশার বাইরে এক অদ্ভুত জগতের সন্ধানী, বহু বছর ধরে কলকাতার অলিগলি, গ্রন্থাগার, পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, এবং প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া লোককথার খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার লেখালেখির বিষয়বস্তু মূলত অলৌকিক, অথচ গবেষণামূলক—যেখানে পুরনো ইতিহাস, অশরীরী শক্তি, এবং আধুনিক যুক্তিবাদের সংঘর্ষে গাঁথা থাকে গল্প। “তান্ত্রিক লোকাচার ও নৃত্যতন্ত্র” নিয়ে তার একটি পুরোনো অসম্পূর্ণ গবেষণা ছিল, যার একটি অধ্যায়েই ছিল ‘ঘুঙুরের বলি’ নামক এক রহস্যময় অনুচ্ছেদ। সেখানেই প্রথম পড়ে গিয়েছিল ‘গজানন নাথ’-এর নাম—এক বিস্মৃত তান্ত্রিক যিনি বিশ্বাস করতেন নৃত্যই আত্মার সর্বোচ্চ আহুতি, এবং প্রতিটি নিখুঁত ভঙ্গিমা একেকটি প্রাণের বিনিময়ে সম্ভব। তাকে ঘিরে প্রচুর কুসংস্কার আর গা ছমছমে কিংবদন্তি রয়ে গেছে—বিশেষত পুরুলিয়ার কোন এক দুর্গম অঞ্চলে তার সাধনক্ষেত্র বলে কথিত ছিল। ঋত্বিক যখন খবর পায় ‘ছায়াপথ গ্যালারিতে’ অর্ণবী সেনের নাচের পরে রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে, এবং সেই পারফরম্যান্সে অর্ণবী এক জোড়া প্রাচীন ঘুঙুর পরে ছিলেন, তখনই তার সব পুরোনো তথ্য একরকম আলোড়িত হয়ে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, এ যেন কাকতালীয় নয়—এর পেছনে কোনো গভীরতর ইতিহাস কাজ করছে। অর্ণবীর পরিচিত একজন সাংবাদিক বন্ধুর মাধ্যমে সে যোগাযোগ করে ঠিকানা সংগ্রহ করে, এবং সেইদিন সকালেই এসে উপস্থিত হয় অর্ণবীর বাড়ির সামনে—হাতে সেই ছেঁড়া ছবি, যেখানে কুয়াশায় মোড়া এক পুরাতন কাঠের মঞ্চে, ঘুঙুর পরা এক নারী নাচছে, আর পেছনে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ—চোখে সুর্মা, গলায় রুদ্রাক্ষ, হাতে খঞ্জর—যাকে ঐতিহাসিক দলিলগুলোতে বলা হয়েছে গজানন নাথ।
অর্ণবী প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। মিডিয়ার একজন অদ্ভুত লোক সকালবেলা এসে তার দরজায় দাঁড়িয়ে, প্রাচীন গল্প শোনাচ্ছে, তার নাচ নিয়ে গবেষণা করতে চায়—এসব তাকে অস্বস্তিকর ঠেকছিল। তবে যখন ঋত্বিক ঘুঙুরের ছবি দেখায়, আর সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয় ঘুঙুরের গায়ে খোদাই করা চিহ্নগুলো আসলে “কালী তন্ত্রের সঙ্গীত মুদ্রা”, যেগুলো সাধারণ মানুষের অচেনা, কিন্তু শক্তিশালী তান্ত্রিক প্রতীক—তখন অর্ণবী থমকে যায়। সে কোনোমতে বোঝাতে চায়, এগুলো কাকতালীয়, কিন্তু ভেতরে সে নিজেই জানে—কিছু একটা ভুল হচ্ছে। ঋত্বিক তাকে তার গবেষণার ডায়েরি দেখায়—পুরনো সংবাদপত্র কাটিং, প্রাচীন দলিল, কিছু অদ্ভুত ঘটনা যেখানে বলা আছে—“এক ঘুঙুরধারী নর্তকীর নাচের পর আত্মহত্যা”, “মন্দিরে বলিদান দেওয়ার আগে দেবদাসীর মৃত্যু” ইত্যাদি। সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল—এক অদ্ভুত ঘুঙুর, আর নাচের ছলে আত্মার আহুতি। অর্ণবী যেন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকে, চোখ স্থির, গলা শুকিয়ে আসে। সে বোঝে না কীভাবে বলবে, কিন্তু সে জানে তার প্রতিটি নাচের পর এখন ঘুমে ঘুঙুর বাজে, আয়নায় অচেনা মুখ দেখা যায়, এবং হৃদয়ের গভীরে এক কন্ঠস্বর ফিসফিস করে—“আরেকটা নাচ, আরেকটা বলি।” সে অবশেষে ডেকে আনে ঋত্বিককে ঘরের ভেতরে, ঘুঙুরের বাক্স দেখায়, সেই লাল দাগ দেখায় যা সে তুলতে পারছে না। ঋত্বিক বাক্সটা খুলে ঘুঙুর দেখে—কিছুটা স্তব্ধ হয়। তার মুখে তখন ভয় আর উত্তেজনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া—“এটা আসলেই গজাননের ঘুঙুর। এটাতে এখনও মন্ত্র শক্তি সক্রিয় রয়েছে।”
ঋত্বিকের কণ্ঠে শোনা যায় ভয়ের পাশাপাশি আকর্ষণ। সে বলে, “এই ঘুঙুর নৃত্যকে শক্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু প্রতিটি শক্তির জন্য কিছু দাম দিতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে… মনে হয় দামটা প্রাণ।” অর্ণবী শিউরে ওঠে। সে আরেকবার ভাবে, এটা যদি সবই মনগড়া হয়? কিন্তু যখন তার মনের ভেতর সেই স্বপ্নের দৃশ্যগুলো জেগে ওঠে—যেখানে দর্শকদের মধ্যে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল কেউ কেউ, যখন সে মনে পড়ে যায় নিরাপত্তারক্ষীর চিৎকার—“ঘুঙুর বাজছে!”—তখন আর যুক্তির আশ্রয়ে দাঁড়াতে পারে না। সে কাঁপা গলায় বলে—“আমি কি… খুন করছি?” ঋত্বিক মাথা নাড়ে, “না, আপনি খুন করছেন না। কিন্তু কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন।” অর্ণবী ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সে যা ভাবছিল অলৌকিক গল্প, তা আসলে তার জীবনের বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার শিল্প, তার নৃত্য, তার শরীর এখন এক প্রাচীন তন্ত্রশক্তির বাহক। এই ঘুঙুর যদি গজাননের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তার প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি পায়ের আওয়াজ, প্রতিটি ঘুঙুরের ঝঙ্কার—একটি প্রাণের বিনিময়ে তৈরি। সেই রাতেই অর্ণবী সিদ্ধান্ত নেয়, সে সত্যের গভীরে প্রবেশ করবে। সে ঋত্বিকের সঙ্গে একটি চুক্তি করে—“তুমি আমাকে রক্ষা করবে, আর আমি তোমাকে সত্য দিতে সাহায্য করব।” ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। বাইরের জানালায় তখন হালকা বৃষ্টি। এবং সেই শব্দের নিচে যেন মিশে আসে মৃদু ঘুঙুরের ঝঙ্কার, যেটা কেউ শুনতে পায় না—শুধু তারা দু’জন জানে, এখন শুরু হল এক অভিশপ্ত যাত্রা—যেখানে নৃত্য আর মৃত্যু হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে প্রাচীন অন্ধকারের দিকে।
৪
পুরুলিয়ার সীমান্তঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম—ঘাঘরা, পাহাড়ে ঘেরা, জঙ্গল ছাওয়া সেই জায়গাটা আজও লোকমুখে ভয়ঙ্কর। জায়গাটার নাম শোনালেই স্থানীয়দের মুখে কেমন একটা ছায়া নেমে আসে। এখানে দিনের শেষে মানুষ ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে, সন্ধ্যার পর আলো জ্বলে না, সাঁকো পেরিয়ে কেউ যায় না, আর রাতের গভীরে কখনো কখনো শোনা যায় মাদল আর ঘুঙুরের আওয়াজ। ঋত্বিক সেই জায়গার নাম অনেক আগেই শুনেছিল তার গবেষণায়, কিন্তু কখনো সেখানে যাননি—আজ অর্ণবীর সঙ্গে এই অলৌকিক যাত্রার সঙ্গী হওয়ার পর, তার মনে হল সময় এসেছে ইতিহাসের উৎসে পৌঁছানোর। কিছু দুর্লভ পুঁথি, পুরাতন নথি আর লোকজ গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তিনি যে নাম বারবার পেয়েছিলেন, সেটি হলো গজানন নাথ—এক অতিমানবিক ক্ষমতাসম্পন্ন তান্ত্রিক, যিনি উনিশ শতকের শেষদিকে ‘নৃত্যতন্ত্র’ নামে এক রহস্যময় সাধনা শুরু করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, “দেহ-ভঙ্গিমা আর ছন্দের মাধ্যমে আত্মা আহ্বান ও বিসর্জন—এই দুটি একসাথে করা যায়।” এবং এই তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে সে তৈরি করেছিল এক জোড়া ঘুঙুর, যার প্রতিটি ঘণ্টি একটি মন্ত্রবন্ধে বাঁধা, যেখানে প্রতিটি মুদ্রা প্রাণ আহ্বানের উপায়। তবে গজাননের সাধনার প্রধান অংশ ছিল এক তরুণী—তাঁরই শিষ্যা, যার নাম ইতিহাস আজ ভুলে গেছে, কিন্তু যাকে ‘প্রথম বলি’ বলে ডাকা হয় লোককথায়। প্রতিটি পারফরম্যান্সের পর কেউ না কেউ হারিয়ে যেত। একদিন সেই ঘুঙুর পরে নৃত্যরত অবস্থায় গজাননের মৃত্যু ঘটে, অথবা হারিয়ে যান। কেউ বলে, তিনি নিজেই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, কেউ বলে—মূর্তিমান শক্তি তাঁকে গ্রাস করেছিল। তারপর সেই ঘুঙুর চিরতরে লোপাট হয়ে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, তার শিষ্যা হয়তো সেটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন এই তত্ত্বের কথা মানুষ ভুলে যায়—শুধু গ্রামীণ বিশ্বাস আর ভয়ের গল্পে রয়ে যায় “তান্ত্রিকের ঘুঙুর” নামটি।
ঋত্বিক সেই সব তথ্য জোগাড় করে একটি ফোল্ডারে সাজিয়ে অর্ণবীর সামনে রাখে। অর্ণবী চুপ করে শুনছিল, তার চোখে কোনো ভয় নেই, বরং একরকম স্তব্ধতা। সে অনুভব করছিল—এই ইতিহাস, এই গল্প কেবল তথ্য নয়, এগুলো যেন তার শরীরে খোদাই হয়ে আছে, যেন বহু যুগ আগের কোনও স্মৃতি এখন তার হাড়ের মধ্যে থেকে জেগে উঠছে। “তুমি কি বলছো, আমি সেই তন্ত্রের উত্তরাধিকার?”—অর্ণবীর এই প্রশ্নে ঋত্বিক চমকে যায়। সে বলে, “আমি বলছি না তুমি কে, কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই ঘুঙুর তোমার ভেতরে থাকা কোনও চক্রকে জাগিয়ে তুলেছে।” এরকমই এক সন্ধ্যায় তারা মীরা বসুর সঙ্গে দেখা করে—অর্ণবীর গুরু, যিনি তাকে প্রথম নাচ শিখিয়েছিলেন। মীরা প্রথমে কিছু বলতে চায় না। কিন্তু যখন সে ঘুঙুরটি দেখে, তার চোখ বড় হয়ে যায়। “এটা তো আবার ফিরল?”—সে ফিসফিস করে। সে ধীরে ধীরে জানায়, অনেক বছর আগে তার গুরু মা—শ্রদ্ধেয় রোহিণী বসু—একবার তাকে এই ঘুঙুরের গল্প বলেছিলেন। রোহিণী একবার এক লোকনৃত্য প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন, যেখানে এক অচেনা মহিলা ঘুঙুর পরে এমনভাবে নেচেছিলেন যে প্রতিপক্ষ দুই দলই মঞ্চ ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে জানা যায়, সেই মহিলাকে কেউ চিনত না। শুধু রোহিণীর হাতে এই ঘুঙুর তুলে দিয়ে বলে—“যখন সময় আসবে, এটা ফিরে আসবে নিজের নর্তকীর কাছে।” মীরা তখন এসব কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বহু বছর পর সেই ঘুঙুর আবার তারই ছাত্রী অর্ণবীর হাতে ফিরে এসেছে, এটা তাকে গভীর ভাবে নাড়িয়ে দেয়। সে কাঁপা গলায় বলে—“এই ঘুঙুর খোলা মানেই এক পুরনো প্রেতচক্রকে জাগানো। আর একবার যদি চক্র শুরু হয়, তাহলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু চলতেই থাকে।”
এই কথাগুলো শোনার পর অর্ণবী আর একটুও সংশয় রাখে না—ঘুঙুরটা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার নাচ শুধু শিল্প নয়, এক ধরনের আহুতি। তবে তার মনে প্রশ্ন—“তবে কি আমি নাচ ছেড়ে দেবো? এই শক্তির কাছে হার মেনে নেবো?” মীরা চুপ করে থাকে, কিন্তু ঋত্বিক বলে ওঠে—“তুমি যদি সেই বলির চক্রের অংশ হও, তবে হয়তো তুমি সেই চক্র ভাঙতেও পারো।” এই কথাটি তার মনে গেঁথে যায়। সেই রাতটা অর্ণবী একা কাটায়, ঘরের মধ্যে সেই বাক্স খুলে রাখে, ঘুঙুর পাশে বসে। ঘরের বাতাস ভারী, জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে, বাইরে ঘন কুয়াশা, আর কোথা থেকে যেন শোনা যায় এক মন্দিরঘণ্টার আওয়াজ। ঘুঙুর তাকে ডাকছে, আবার নাচতে বলছে। কিন্তু সে এবার নিজের শরীরকে ধরে রাখে, বলে—“না, এবার আমি নাচব না তোমার আদেশে। এবার আমি জানব, আমি কে।” এর মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ে তুষার সেন—তার প্রাক্তন প্রেমিক, এবং এখন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের অফিসার। সে এসে বলে—“রিমঝিম পাল… নিখোঁজ। সে বলেছিল তোমার শোতে অংশ নেবে, তারপর আর তার খোঁজ নেই।” অর্ণবীর মুখ পাথরের মতো হয়ে যায়। কারণ সে জানে, তার পরবর্তী পারফরম্যান্সে রিমঝিমই সবচেয়ে কাছাকাছি নৃত্যশিল্পী ছিল। তার মন বলে—চক্র আবার শুরু হয়েছে, আর এইবার বলি… তারই পরিচিত মানুষ। আর এবার হয়তো শুধু বলি নয়, সত্যকে জানার বিনিময়ও চাওয়া হবে। ঘুঙুর তার পায়ের কাছে পড়ে থাকে, কিন্তু এবার যেন তার থেকে এক ছায়া উঠে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। সে জানে—গজাননের ইতিহাস এখন শুধু বইয়ে নয়, সে নিজেই সেই ইতিহাসের এক পুনর্জাগরণ।
৫
আনন্দময়ীর প্রতিদিনের জীবন এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তার ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে গা ছমছমে এক সুর—যেটা ঘুঙুরের ঝংকার নয়, বরং তার নিচে চাপা এক অস্পষ্ট কান্না। নাচ এখন কেবল প্রকাশ নয়, এক ভেতরের বন্ধ দরজা খোলার মতো। সে নিজেও বুঝতে পারে—ঘুঙুর বাঁধলে তার শরীর আর মন তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে সে দেখতে পায়, তার পা নিজের থেকে নড়ছে—ধীরে ধীরে ঘরের মাঝে ছায়া ঘিরে দিচ্ছে তাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আনন্দময়ী নিজেকে দেখে, কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি নড়ে না। ঘরে থাকা আয়নাটি একদিন কুড়ির দিদিমা তাঁকে দিয়েছিলেন, সে বলে গিয়েছিলেন, “এই আয়নাটা শুধু রূপ দেখে না, আত্মাও দেখে।” এখন সেই আয়নাতে সে দেখে এক নারী—চুল খুলে, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, আর সে ধীরে ধীরে হাসছে। ঘুম থেকে জেগে উঠে আনন্দময়ী বুঝতে পারে, সে আবার ঘুঙুর পরে ফেলেছে, তার পা ঘামে ভিজে আছে, আর পাশের পাড়ার কুকুরটা যেন অদ্ভুতভাবে কাঁদছে।
সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—ঘুঙুরটা সে খুলে রেখে দেবে। অনেক হয়েছে, এখন আর সে মৃত্যুর নাচ দেখতে চায় না। কিন্তু দুপুরে বাড়ি ফিরে এসে দেখে, ঘুঙুর জোড়া নেই। কোথাও নেই। খাটের তলা, আলমারি, পুজোর ঘর—সব জায়গা তল্লাশি করেও কিছু পায় না। তখনই ঘরের কোণে রাখা কালো বাক্সটা চোখে পড়ে, যা তান্ত্রিকের সঙ্গে ঘুঙুর আসার দিনেই এসেছে। সেদিন খোলেনি সে বাক্সটা—কারণ পুরনো, ভাঙা কাঠের বাক্সটা দেখতে অশুভ লাগছিল। কিন্তু আজ সে অদ্ভুত এক আকর্ষণে খুলে ফেলে বাক্সটি। ভিতরে ছিল আরেকটা ঘুঙুর—আগেরটার চেয়েও পুরনো, রক্ত মাখা, আর যেন নাচের আগুনে পোড়া। সে ঘুঙুর হাতে নিতেই, তার দেহে একটা কম্পন খেলে যায়, একটা অদৃশ্য সুর তার কানে বাজে, যেন কেউ বলছে, “নাচো, আনন্দময়ী… মৃত্যুর দেবী তোমার অপেক্ষায়।” সে বুঝে যায়, ঘুঙুর খুলে রাখা যায় না। সে তার শরীর থেকে এখন আলাদা নয়। এই ঘুঙুর আর সে একে অপরের সঙ্গে বাঁধা।
সন্ধেবেলায় আনন্দময়ী ডেকে পাঠায় রুদ্রদাকে—তার পুরোনো সহ-শিল্পী, যিনি আজকাল কলকাতার এক বিখ্যাত থিয়েটারে সংগীত পরিচালক। আনন্দময়ী রুদ্রদাকে সব খুলে বলে, ঠিক যেমন করে একটা প্রেতপীড়িত মানুষ বলে পায় চারপাশের মৃত্যু। রুদ্র শুনে চুপ করে যায়, তারপর বলে, “তুই যা বললি, তাতে আমি বিশ্বাস করি… কারণ তোর চোখের ভাষা তো মিথ্যে বলে না। তবে একটা উপায় আছে।” সে জানায়, বোলপুরের দিকের এক পাহাড়ি গাঁয়ে এক বৃদ্ধা আছেন—নামে মায়ারানি। তিনি নাকি তান্ত্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করতেন একসময়, এখন নির্জনে থাকেন। আনন্দময়ী ঠিক করে, সে যেতেই হবে সেখানে। কারণ এই নাচ এখন তার নয়, এটা যেন তাকে গ্রাস করছে। তার হাতের ঘুঙুরটা তখন আবার নিজের থেকে কাঁপতে থাকে, টুং টাং শব্দে যেন আগাম বলে দেয়—আগামী নাচে আবার একটি প্রাণ ঝরবে… কিন্তু এবার সে কী পারবে মৃত্যুকে হারাতে?
৬
ভোররাতে যখন শহরের আলো নিভে নিভে যায়, অর্ণবী তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের গভীরে খুঁজে ফিরছিল কে সে—নৃত্যশিল্পী, না এক হত্যার বাহক? ঘরের এক কোণে শোভা পাচ্ছিল সেই রহস্যময় ঘুঙুরজোড়া, যার ঘণ্টার আওয়াজ যেন ধাতব নয়, রক্ত-ভেজা আত্মার বিলাপ। সে চুপিচুপি বলল, “আমি তো শুধু নাচতে চেয়েছিলাম…!” কিন্তু ঘুঙুর যেন হেসে উঠল। পরপর তিনটি পারফরম্যান্সের পর, যেখানে দর্শক চোখ ফেরাতে পারেনি, সেখানেই ঘটেছে তিনটি অস্বাভাবিক মৃত্যু—একবার রিমঝিমের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, আর দু’জন দর্শকের মৃত্যুর খবর। অর্ণবী জানে কিছু একটা ভয়াবহ হচ্ছে, কিন্তু নাচের মুহূর্তে, যখন তার পায়ে বাঁধা থাকে ঘুঙুর, তখন তার শরীর যেন অন্য কারও আদেশে চলে। এদিকে, মীরা বসু—তার গুরু—দেখছিলেন তার ছাত্রী কীভাবে প্রতিটি পারফরম্যান্সের পর আরও ক্লান্ত, আরও ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, “এই ঘুঙুর শোনে না ছন্দ, শুধু আত্মার আর্তনাদ চেনে।” কিন্তু মীরা নিজেই সব বলেননি। তিনি জানতেন—গজানন নাথ শুধু তান্ত্রিক ছিলেন না, ছিলেন তাঁর পরদাদার তন্ত্রগুরু। একবার তাঁকে দিয়েই এই নৃত্যতন্ত্র শুরু হয়েছিল। মীরা সেই ভয়ানক ইতিহাসের উত্তরাধিকারী ছিলেন—এবং তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, যদি সত্যিই অর্ণবীর শরীরে জেগে ওঠে গজাননের আত্মা, তাহলে আর কেউ বাঁচবে না।
(২)
ঋত্বিক ধর তখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে অর্ণবীর পারফরম্যান্স ঘিরে ঘটে চলা মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে। সে খুঁজে বের করেছে কলকাতার এক বিস্মৃত তন্ত্রশাস্ত্রাগারের রেকর্ড, যেখানে ১৭৭২ সালের একটি প্রাচীন নৃত্য-তন্ত্র পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ ছিল “নাচে যদি প্রাণ ছুঁয়ে যায়, তবে সে নাচ দেবতার নয়, ভৈরবের আহুতি।” সেই লেখায় ছিল এক ‘গজানন নাথ’ নামক তান্ত্রিকের কথা, যে নৃত্যকে বলি-যজ্ঞে পরিণত করেছিল। সব কিছু ভয়ানকভাবে মিলে যাচ্ছে অর্ণবীর ঘটনার সঙ্গে। সেই সন্ধ্যায়, সে অর্ণবীর সঙ্গে দেখা করতে যায়, কিন্তু অর্ণবী একেবারে ভেঙে পড়েছে। সে বলে, “আমার হাতে যদি কারও মৃত্যু হয়, আমি আর মঞ্চে উঠব না।” কিন্তু ঘুঙুর যেন তাকে ডাকে, এক নেশার মতো। ঋত্বিক তাকে বোঝায়, “এই শক্তি তোমার না, এটা তোমার দেহকে ব্যবহার করছে।” তখনই অর্ণবী বলে ফেলে, “নাচের সময় আমি আমার মতো থাকি না… কেউ আমার ভেতর ঢুকে পড়ে।” এই স্বীকারোক্তিতে ঋত্বিক বুঝে যায়—অর্ণবী তান্ত্রিকের আবেশে ধরা পড়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন আসে—রিমঝিম পাল, যে অর্ণবীর সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, নিখোঁজ পাওয়া গেছে, এবং তার পারফরম্যান্স শেষেই। তার ডায়েরি থেকে পাওয়া গেছে “ঘুঙুরের শব্দ শুনলে আয়নার দিকে তাকিও না” এমন কিছু অস্পষ্ট লেখা। ঋত্বিক ভাবে, এবার তদন্তের সঙ্গে সঙ্গে এক্সোরসিজমই শেষ উপায় হতে পারে। কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন দ্বন্দ্বে পড়ে যায়—একদিকে সে বিশ্বাস করতে চায় না অলৌকিকে, অন্যদিকে যা ঘটছে তা যুক্তির আওতায় আসে না।
(৩)
তুষার সেন, তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এবং অর্ণবীর প্রাক্তন প্রেমিক, খেয়াল করে প্রতিটি মৃত্যুর পর এক অদ্ভুত মিল পাওয়া যাচ্ছে—সবাই কোনো না কোনোভাবে অর্ণবীর নাচ দেখেছিল। তিনি অর্ণবীকে জেরা করেন, কিন্তু তার চেহারায় আতঙ্ক দেখে চুপ করে যান। “তুমি ঠিক তো, অর্ণবী?” এককথায় বহু পুরোনো অনুভব ফিরে আসে। তুষার এইসব অলৌকিক বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু ক্রমাগত ঘটনাপ্রবাহ তাকে বাধ্য করছে বিকল্প চিন্তায় যেতে। হঠাৎ, এক বৃদ্ধা মহিলা থানায় এসে বলেন, “ঘুঙুর বাজলে আমি আমার মৃত ছেলেকে দেখেছি। সে আমাকে বলেছে ও এখনও মুক্তি পায়নি।” মহিলা উন্মাদের মতো, কিন্তু তার চোখে একটা চেনা যন্ত্রণা। তুষার বুঝে যান—এখানে কিছু অজানা সত্য লুকিয়ে আছে। তিনি গিয়ে মীরার সঙ্গে দেখা করেন, তাকে স্পষ্ট করে বলেন, “আপনি সব জানেন, বলুন, কীভাবে থামানো যায়?” মীরা একটু চুপ করে থেকে বলেন, “যদি অর্ণবী ঘুঙুর খুলতে না পারে, তাহলে তাকে একদিন… নিজের আত্মা বিসর্জন দিতে হবে—নাচ করে, আগুনে।” এই কথা শুনে তুষারের মাথা ঘুরে যায়। এদিকে অর্ণবী নিজেও অনুভব করছে, প্রতি রাতেই সে এক স্বপ্ন দেখে—তার চারপাশে আগুন, মঞ্চে সে একা নাচছে, আর দর্শকরা কেউ নয়, মৃত আত্মারা। তারা হাততালি দেয়, মুখে নেই হাসি, কেবল চোখে নীরব প্রতিহিংসা। ঘুম ভাঙার পর সে হাঁপাতে হাঁপাতে জেগে ওঠে—আর ঘরের কোণ থেকে শোনা যায় সেই চেনা ঝংকার—ঘুঙুর, একা, নিঃসঙ্গ, কিন্তু ভয়ানক ভাবে জীবন্ত।
৭
ঘটনাগুলো যেন কোনও অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা হয়ে যাচ্ছিল, আর সেই সুতোগুলো যেন টানছিল কেউ একজন, অন্ধকারে বসে। শ্রেয়া এখনো সেই ভয়ানক ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাজেশ্বরীর মৃত্যুর দিন থেকে তার ঘুমের মধ্যে ঘুঙুরের আওয়াজ ভেসে আসে, আর সেই নাচের শেষ দৃশ্য চোখে ভাসে, যেটা কেউ দেখেনি—কেবল শ্রেয়া অনুভব করেছিল, রাজেশ্বরীর শরীরে যেন নেমে এসেছিল এক অজানা শক্তি। কিন্তু সেই শক্তি শুধু তাকে মহিমান্বিত করেনি, তাকে গ্রাসও করেছিল। পরদিন সকালেই রাজেশ্বরীর মৃতদেহ পাওয়া যায় গানের ঘরে, চোখদুটো কেবল খোলা, আর গায়ে সেই প্রাচীন ঘুঙুর। তদন্ত চলতে থাকে, কিন্তু পুলিশ কেবল এটুকু বুঝে ওঠে যে এটা হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শ্রেয়া জানত, এর পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। সে জানত, ঘুঙুরটা কেবল একটি প্রাচীন অলঙ্কার নয়, এটি যেন এক জীবন্ত আত্মা, যার তৃষ্ণা আছে—প্রতিটি নাচের শেষেই একটি আত্মা চাই তার।
শ্রেয়া ঠিক করল আর একবার সে ঘুঙুরটি পরে নাচবে, কিন্তু এইবার সে একা থাকবে না। সে তন্ত্রবিদ সিদ্ধেশ্বরানন্দের কাছে গিয়েছিল, যিনি এই ঘুঙুরের বিষয়ে কিছু বলতে পারেন বলে শোনা যায়। সিদ্ধেশ্বরানন্দ তার ছোট্ট, ধূপে মোড়া কুটিরে বসে বলেছিলেন, “এই ঘুঙুর কোনও সাধারণ নৃত্য অলংকার নয়। এটা এক প্রাচীন তান্ত্রিকের তৈরি, যার নাম ছিল ভৈরব। সে ছিল তান্ত্রিক ও নৃত্যকার উভয়ই। তার বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি নৃত্য যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তবে সেই নাচ একটি আত্মাকে মুক্তি দিতে পারে—অথবা বন্দি করে রাখতে পারে।” শ্রেয়া যখন জানতে চাইল, তাহলে সে কীভাবে রক্ষা পেতে পারে এই ঘুঙুরের অভিশাপ থেকে, সিদ্ধেশ্বরানন্দ বললেন, “এই ঘুঙুর এখন তোমার আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তুমি চাইলে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি জানো, কখন এবং কীভাবে নাচ শেষ করতে হয়, তবে তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারো এর শক্তি।” এই কথা শুনে শ্রেয়া ঘরে ফিরে আসে, এক গভীর দ্বন্দ্বে। সে বুঝতে পারে, এই ঘুঙুর শুধু অভিশপ্ত নয়, এটি শক্তিও বটে—নিয়ন্ত্রণ করলেই তা আশীর্বাদ হতে পারে।
সেই রাতে, শ্রেয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুঙুর পরল। তার চোখে ছিল অনমনীয় প্রতিজ্ঞা, আর মনে ছিল সিদ্ধেশ্বরানন্দের কথা। সে জানত, এই নাচ যেন না হয় আরেকটি মৃত্যুর কারণ। সে শুরু করল ধীর ছন্দে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার পায়ের নিচে যেন নিজেই জমতে লাগল আগুন। তার দেহে যেন ঢুকে পড়ল আরেকটি সত্তা। ঘরের মধ্যে বাতাস ভারী হয়ে এল, মেঝেতে অদৃশ্য পায়ের ছাপ ফুটে উঠল। ঘরের কোণে রাখা আয়না যেন কাঁপতে শুরু করল। আর তখনই সেই ছায়ামূর্তি—যেটি প্রতিবার শ্রেয়ার ঘুমে আসত—প্রকাশ পেল বাস্তবে। সেটা রাজেশ্বরী নয়, সেটা ছিল ভৈরবের আত্মা—নাচের তান্ত্রিক, যিনি আবারো ফিরে এসেছে তার প্রিয় ঘুঙুরের টানে। সে বলল, “তুমি মুক্ত করতে পারো আমাকে, নইলে আমিই বন্দি করব তোমাকে।” শ্রেয়া থেমে গেল। সে জানত, এখন সে নৃত্য না শেষ করলে সে নিজেই হবে পরবর্তী বলি। কিন্তু সে ভয়কে কাটিয়ে শেষ করল সেই নিষিদ্ধ মুদ্রাগুলো, যেগুলো সে আগে কখনও শেখেনি, কিন্তু যেন শরীর নিজে থেকেই তা জানত। নাচের শেষে হঠাৎ একটি ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের মধ্যে ঘূর্ণি তৈরি করল, ঘুঙুর ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ল, আর সেই ছায়ামূর্তি হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল। শ্রেয়া হাঁপাচ্ছিল, কিন্তু এই প্রথমবার, সে বেঁচে রইল। আর কেউ মারা গেল না। ঘুঙুর এখন স্তব্ধ, যেন গভীর নিদ্রায়। কিন্তু শ্রেয়া জানত, এই ঘুম কখনোই চিরস্থায়ী নয়। ছায়ার পুতুল এখনও একদিন জেগে উঠতে পারে।
৮
রাত্রি গভীর, কলকাতার আকাশ যেন ঘুমিয়ে পড়েছে আলো-আঁধারির নরম চাদরে। গড়িয়াহাটের উপশহরের ফ্ল্যাটে একা বসে ছিল অরিত্র, চোখে ক্লান্তি, মন জর্জরিত দ্বন্দ্বে। ডান পায়ের পাতায় বাঁধা সেই ঘুঙুর এখন তার জীবনের কেন্দ্রে—আশীর্বাদ, না কি অভিশাপ! শেষ নাচের পরের মৃত্যুটি ছিল একজন ছিন্নমূল বালকের, যার চোখে ছিল অনাহার আর প্রশ্ন। অরিত্র নিজেই জানত না, কীভাবে নাচ শেষে সে বালকটি হঠাৎ রাস্তায় পড়ে গিয়ে নিথর হয়ে যায়। পুলিশ এসে বলে—হৃদ্রোগে মৃত্যু। কিন্তু অরিত্র জানত, প্রতিবার তার নাচের পর এমনই কিছু হচ্ছে, যা সে চায় না। অথচ ঘুঙুর খুলে ফেলতেও ভয় পাচ্ছে সে—কারণ তখন তার নাচ থেকে যেন প্রাণ সরে যায়। তান্ত্রিকের দেওয়া ঘুঙুর—এই শক্তি কি আসলে অশুভ কোনো শক্তির বিনিময়ে? সেই প্রশ্ন তাকে ছিঁড়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। এদিকে পৃথা, তার সহশিল্পী এবং বন্ধু, এইসব অদ্ভুত কাকতালীয় মৃত্যুর সঙ্গে অরিত্রর সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। পৃথা তার সঙ্গে আর মহড়া করতে চাইছে না, বলেছে—”তোর চোখে এখন একটা অজানা রাত্রির আলো, যেটা আমি চিনতে পারি না।”
তবে অরিত্রর ভেতরে দ্বৈত অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে ক্রমশ—একটা আমি, যে দয়ালু, মানবিক; আরেকটা আমি, যে নাচের সময় ঘুঙুরের আওয়াজে হারিয়ে যায়, যাকে নিয়ন্ত্রণ করে এক অদৃশ্য তান্ত্রিক ছায়া। এই ছায়া প্রতিনিয়ত বলে—”আরও দাও, আরও প্রাণ, আরও নাচ!” অরিত্রর মনে পড়ে যায় সেই বৃদ্ধ তান্ত্রিকের কথা, যাকে সে পুরুলিয়ার একটি লোক-উৎসবে প্রথম দেখে। চোখে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, মুখে নীরবতা—সে বলেছিল, “এই ঘুঙুর শুধু তোমার নয়, এর ইতিহাসে রক্ত আছে।” তখন অরিত্র হেসেছিল, বলেছিল, “শিল্পে তো প্রাণ দিতে হয়ই!” এখন বুঝতে পারছে, এখানে ‘প্রাণ’ কথার মানে শুধুই কাব্যিক নয়, হয়তো খুব বাস্তব। ঘুমের মধ্যে অরিত্র দেখে, সে এক গুহায় নাচছে—চারপাশে মৃতদেহ, আর তান্ত্রিক দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার মতো। অরিত্র কাঁদতে চায়, কিন্তু তার পা চলতেই থাকে, আর ঘুঙুর বাজতেই থাকে। হঠাৎ একদিন, তার ঘরে আসে একজন বয়স্ক লোক—যিনি নিজেকে বলেন প্রাক্তন লোকশিল্প গবেষক। তিনি অরিত্রকে বলেন, এই ঘুঙুর এক সময় ‘তান্ত্রিক তান্ডব’ নামে পরিচিত এক নিষিদ্ধ নাচে ব্যবহৃত হত, যার মাধ্যমে আত্মা আহ্বান করা হতো।
এবার অরিত্রর সামনে একটা নতুন পথ খুলে যায়—সে খোঁজ শুরু করে সেই নিষিদ্ধ তান্ত্রিক নৃত্যশৈলী সম্পর্কে। সে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ঘুরতে থাকে, প্রাচীন মন্দিরের সামনে দাঁড়ায়, যেখানে নাকি এক সময় এই নাচ হত। সে খুঁজে পায় এক পুরনো শাল গাছ, যার গোড়ায় পাথরে খোদাই করা একটি নর্তকীর চিত্র—গলায় ছায়া, পায়ে ঘুঙুর। এক বৃদ্ধ পাণ্ডা বলে, “এই ঘুঙুর কেউ পরলে, সে আর স্বাভাবিক মানুষ থাকে না।” অরিত্র ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই ঘুঙুর শুধু নাচের উপকরণ নয়, বরং এক প্রবেশপথ, এক অদৃশ্যতায় যাওয়ার দরজা, যার ওপারে অপেক্ষা করে এক অদ্ভুত আত্মা—পুরোনো তান্ত্রিক, যে এখন নতুন শরীর খুঁজছে। অরিত্রর চোখে রক্ত এসে যায়, সে ভেতরে ভেতরে আর এক মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু তার শিল্পমন বাধা দেয়—সে নিজের ভেতরের অশুভ শক্তিকে হার মানাতে চায়, কিন্তু কিভাবে? পৃথা আবার আসে তার জীবনে, শেষবারের মত, তাকে বোঝাতে—”এই ঘুঙুর তুই না খুললে তুই হারিয়ে যাবি, শুধু নর্তকী নয়, মানুষ হিসেবেও। তুই তোর আত্মাকে বাঁচা শিখে দে।”
৯
রূপসীর গলায় মরা মানুষের আর্তনাদ যেন জমে আছে—এমনটাই বলছিলেন পুরনো মঞ্চের আলো-শিল্পী হরিশঙ্কর, যিনি রূপসীর সর্বশেষ পারফরম্যান্সটি দেখেছিলেন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে। তাঁর চোখে ভয়, কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় একরাশ বেদনা মিশে আছে। “ও নাচলেই কাঁপে ঘর, কিন্তু সেই কাঁপন যেন কারো মৃত্যুর হুঙ্কার,” বলেছিলেন তিনি অভিজিৎকে। অভিজিৎ তখন শান্ত হয়ে তাকিয়ে ছিল একটা ভাঙা আলমারির দিকে, যেখানে সেই রহস্যময় ঘুঙুর রাখা ছিল—তান্ত্রিক কৃষ্ণানাথের পুরোনো স্মারক। মরা মানুষদের আত্মা কীভাবে শিল্পীর শরীর দখল করে নেয়, তা কল্পনায় আনাও কঠিন ছিল। কিন্তু রূপসীর নাচের পরিণতি গোপনে এক মৃত্যুকে আহ্বান করত, এবং প্রতিটি মৃত্যু এক ধরনের নিগূঢ় চক্রপথে বাঁধা—এটা যেন এক অদৃশ্য যজ্ঞের অংশ, যেখানে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ছন্দ এক আত্মার মুক্তি নয়, বরং আরেক আত্মার শৃঙ্খল। অভিজিৎ বুঝে গিয়েছিল, যতক্ষণ ঘুঙুর থাকবে রূপসীর পায়ে, ততক্ষণ সে নিছক একজন শিল্পী নয়—সে একজন বাহক, মৃত্যুর বাহক।
তদন্তকারী ডিটেকটিভ অর্ণব এবার পুরোনো গ্রন্থাগারে গিয়ে খোঁজ পেল এক বিস্মৃত বই—“প্রেতনৃত্য ও পঞ্চভূতের সঙ্গীত”—যেখানে লেখা আছে তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে কীভাবে নৃত্যকে আত্মার আহ্বানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সেখানে উল্লেখ ছিল এক ‘শাস্ত্রীয় ঘুঙুর’, যার প্রতিটি ঘণ্টিতে লুকিয়ে আছে এক নিষিদ্ধ মন্ত্র—প্রতিটি শব্দ এক ‘আবাহন’। এই তথ্য জানার পর অর্ণব ও অভিজিৎ মিলে রূপসীর একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে। সেখানে দেখা যায়, রূপসীর চোখে নাচের সময় ঘোর লাগে, তার মুখাবয়বে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগে যে যে দর্শকরা রূপসীর নাচ উপভোগ করেছিল, তাদের অনেকের স্বপ্নে রূপসীর মতো মুখোশ-পরা এক নারী এসে দাঁড়াত, যার শরীর থেকে ঝরে পড়ত কালো ছাই। একজন দর্শক আতঙ্কে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এই সব দেখে অর্ণবের মনে সন্দেহ জাগে—এ কি নিছক কাকতালীয়, না কি এক গভীর তান্ত্রিক ছায়া? কৃষ্ণানাথের লেখা শেষ ডায়েরির পাতাগুলি বলছে, নাচ আর আত্মাহুতি একসাথে মিলে যায় এক অদ্ভুত যজ্ঞে, যেখানে নৃত্যশিল্পী শুধুমাত্র এক চ্যানেল, এক মাধ্যম।
এই চক্রপথ থামাতে গেলে ঘুঙুরকে সরাতে হবে, কিন্তু রূপসী তা মানতে রাজি নয়। সে বলে, “এই ঘুঙুর আমার আত্মা, এটা ছাড়া আমি কিছুই না।” অভিজিৎ তার হাত ধরে বুঝিয়ে বলে, “তুমি এখন যে রূপসী, সেটা এই ঘুঙুর নয়—তোমার প্রতিভা।” কিন্তু রূপসীর চোখে তখন অন্য চেতনা কাজ করছে। সে বলে, “তুমি জানো না, প্রতিটি নাচের শেষে আমি গভীর ঘুমে ডুবে যাই, আর সেখানে দেখি এক শ্মশান, যেখানে আমি নাচছি, আর আশেপাশে ছায়ারা হাততালি দিচ্ছে। তারা চায় আমি আরও নাচি, তারা আমার নাচ খায়।” এই কথা শুনে অভিজিৎ চমকে ওঠে। সে এবার আর দ্বিধা করে না—সে সিদ্ধান্ত নেয় ঘুঙুরটিকে এক তান্ত্রিক বিশারদ ডঃ সৌম্যজ্যোতির কাছে নিয়ে যাবে, যিনি ওঝা ও সংস্কৃত তন্ত্রবিষয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু তখনই ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত ঘটনা—রূপসী একা এক মঞ্চে গিয়ে ‘অগ্নিনৃত্য’ শুরু করে দেয়, যেটি কৃষ্ণানাথের ডায়েরিতে উল্লেখিত সর্বশেষ নাচ, যাকে বলা হয় ‘প্রায়শ্চিত্ত নৃত্য’। এই নাচের শেষে আত্মা নয়, দেহ-ই নশ্বর হয়। চারপাশে আগুনের আলো, দর্শক নেই, শুধু রূপসী আর তার নাচ। অভিজিৎ ছুটে গেলে দেখে, মঞ্চের মাঝখানে পড়ে আছে সেই ঘুঙুর—ভাঙা, কিন্তু একরাশ ধোঁয়ার ভিতরে কাঁপছে যেন কেউ সেটা পরে আছে। আর রূপসী নেই।
১০
নতুন দিনের আলো এখনও পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি, শহর তখনও ঘুমের আবরণে ঢাকা, আর সেই নীরবতা ছিঁড়ে হঠাৎ এক উচ্চস্বরে বাজতে শুরু করে একটি পায়ের ঘুঙুর। না, এটি মঞ্চের নয়, কোনও প্রথাগত উপস্থাপনাও নয়। এটি যেন মৃত্যুর আহ্বান—যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রুতির জীবনের শেষ অধ্যায়। কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার মুহূর্তে শ্রুতি বুঝতে পারে যে আজ সে একটি চূড়ান্ত যাত্রার সম্মুখীন হতে চলেছে। পায়ে বাঁধা ঘুঙুরটি তখন যেন নিজেই পথ দেখাতে থাকে, এবং শ্রুতি অনুভব করে যে তার শরীর, মন, আত্মা সবকিছু এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ওই তান্ত্রিক বস্তুটি। শ্বেতপাথরের মেঝেতে নাচতে নাচতে তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে—নয়নে অগ্নিস্নান, দেহে কামনার বিস্ফোরণ, মনে আতঙ্ক আর তীব্র আনন্দের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। মন্দিরের পুরোহিতেরা তখন একে একে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে, কেউ বা পিছু হটে যাচ্ছে, কারণ সেই নাচে ঈশ্বরের ছায়া নেই, আছে কেবল এক পুরোনো অভিশাপের মুখোমুখি হবার ক্রন্দন। ঘুঙুরের প্রতিটি ঝংকার যেন এক-একটি শোকগাথা গাইতে থাকে, আর মাটিতে যেন ধীরে ধীরে পড়ে যেতে থাকে এক অদৃশ্য মৃত্যুর রেখা।
ঠিক তখনই প্রবেশ করে অভিজিৎ ও অর্ণব, দুজনেই গা-জ্বালানো ধুলো-মাটিতে কাদা হয়ে গেছে, হাতে তান্ত্রিক কবচ, চোখে চূড়ান্ত ভয় ও দায়িত্বের মিশ্র চাহনি। তারা জানে—এই নাচ থামানো মানেই এক আত্মার শুদ্ধি, এক মৃত্যু রোধ, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এক অন্ধকার ইতিহাসের যবনিকা। শ্রুতির চোখ তখন লাল—কোনও অনুভূতির চিহ্ন নেই, সে যেন অন্য জগতের কেউ। অভিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগিয়ে যায়, কবচ উঁচু করে ধরে। ঘুঙুরের আওয়াজ কমতে শুরু করে, আর একটি মুহূর্তের মধ্যে শ্রুতি হঠাৎ থেমে যায়। নিঃশব্দে পড়ে যায় মেঝেতে, তার পায়ের সমস্ত ঘুঙুর খুলে পড়ে যায়, আর এক মুহূর্তের মধ্যে সেই ঘুঙুরের মেটালের মধ্যে থেকে নির্গত হয় এক অদ্ভুত ধোঁয়া—যা সরাসরি চলে যায় অর্ণবের দিকে। অর্ণব চিৎকার করে ওঠে, তার শরীর কাঁপে, চোখ দুটো শূন্য হয়ে যায়, আর সে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারায়। তখনই পুরোনো সেই তান্ত্রিকের ছায়ামূর্তি উঁকি দেয় মন্দিরের প্রাচীরে, মুখে এক ব্যঙ্গাত্মক হাসি।
শ্রুতি তখন ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পায়, কিন্তু তার মনে কিছু নেই—কে সে, কী করেছে—সব শূন্য। অভিজিৎ কাঁদে, ধরে রাখে শ্রুতিকে, এবং বুঝতে পারে, এই ঘুঙুর কেবল নাচের বাহন নয়, এক যুগান্তকারী অভিশাপ, যা তার প্রিয় মানুষকে শেষমেশ কেড়ে নেয়ই। ঘুঙুর এখন নিস্তব্ধ, তার ধাতব রং বিবর্ণ, যেন তার মধ্যে কোনও প্রাণ নেই। অর্ণব তখনও নিঃসাড়, তার চোখ দুটো খোলা, কিন্তু কোনও দৃষ্টি নেই—সে যেন এক জীবন্ত পাথর। পুলিশ এসে যায়, মন্দির ঘিরে ফেলে, কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই, কেবল পাওয়া যায় এক জোড়া প্রাচীন তামার ঘুঙুর, আর এক নিঃশব্দ আত্মা—যার নাম আজও উচ্চারিত হয় নাচের মহলে, ‘তান্ত্রিকের ঘুঙুর’।
[সমাপ্ত]