অভিষেক মুখার্জী
গ্রামের প্রান্তে, যেখানে সবুজ ধানক্ষেত আর খয়েরি মাটির রাস্তার মাঝেই ছায়া মেলে কয়েকটি পুরনো ঘর, সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটিকে ভাঙতে শুরু করল কয়েকজন শ্রমিক। ধুলোর স্তূপের মাঝে, কাঠের পুরোনো চালের ঢাকনা খুলতে গিয়ে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল মাটির নিচে পুঁতে রাখা এক জোড়া খড়ম। প্রথম দেখায় খড়ম দুটি অদ্ভুত সাধারণ মনে হলেও, যখন শ্রমিকেরা তাদের হাতে তুলে নিল, তখন তারা অবাক হল—এগুলি অতি ভারী, কিন্তু কাঠে কোনো ক্ষয় বা পচন নেই। খড়মের লম্বা দণ্ড এবং সূক্ষ্ম কুঁচকানো অংশ যেন কোনো অদ্ভুত নিপুণতার নিদর্শন বহন করছিল। গ্রামের লোকেরা সকালবেলায় এগুলো দেখল এবং সাধারণ বস্তু হিসেবে উপেক্ষা করল। কেউ কেউ হেসে বলল, “পুরনো খেলনা বা কৃষিজাত কোনো যন্ত্র হতে পারে।” কিন্তু হরিদাস, বাড়ির বর্তমান মালিক, হঠাৎ অনুভব করল, যেন খড়মের ভেতর কিছু শক্তি সঞ্চিত আছে, কিছু যা বহু বছর ধরে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। তিনি এগুলো ধরে দেখল, এবং প্রতিটি রেখা ও খোঁচা যেন কোনো অচেনা অঙ্কের মতো চোখে পড়ল।
রাত নামতেই সবকিছু বদলে গেল। হরিদাস যখন ঘরে শুতে গেল, তখন তার চোখে ঘুম আসছিল না। হঠাৎ সে দেখল, ঘুমের মধ্যেই একটি কালো পর্দার মতো দিগন্তের মধ্যে হঠাৎ একজন তান্ত্রিক উপস্থিত হল। তান্ত্রিকের চোখ জ্বলে উঠছিল, মুখে অদ্ভুত এক ভাব, আর চারপাশে অদৃশ্য শক্তির দোলে ঘুরছিল যেন বাতাস itself বিদ্যুৎ হয়ে খেলছে। সে হরিদাসকে বলল, “আমার শক্তি ফিরিয়ে দাও।” হরিদাসর ঘুম তখন ভেঙে গেল, ঘরটা যেন হঠাৎ অন্ধকার ও নীরবতায় ভরে গেল। তান্ত্রিকটি হরিদাসের দিকে হাত বাড়াল, আর হরিদাস অনুভব করল, যেন খড়মের প্রতি তার মনোযোগ আকৃষ্ট হচ্ছে—এটি কোনো সাধারণ কাঠ নয়। খড়মের ভেতর অদৃশ্যভাবে কোনো শক্তি, কোনো জাদু, যেন নিজেকে প্রকাশ করতে চাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই হরিদাস অনুভব করল, গ্রামের জীবনের সাধারণতা আর এই জিনিসের মধ্যে একটি রহস্যময় শক্তির মিলন ঘটেছে।
পরের সকালে, হরিদাস খড়ম দুটি নিয়ে গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনা করল। গ্রামের বৃদ্ধেরা, যারা তান্ত্রিক ও পুরনো জাদুর কাহিনী জানে, তারা অবাক হয়ে দেখল এই খড়ম কেবল কাঠ নয়, বরং কোনো প্রাচীন তান্ত্রিকের শক্তি ধারণের বাহন। এক বৃদ্ধ বলল, “এগুলি প্রাচীন যুগে তান্ত্রিকেরা ব্যবহার করতেন তাদের শক্তি সংরক্ষণের জন্য। যারা এই খড়ম ব্যবহার করতে জানে, তার ক্ষমতা সীমাহীন হতে পারে।” হরিদাস তখন বুঝতে পারল, এই আবিষ্কার শুধু একটি পুরনো বস্তু নয়, বরং একটি বিপজ্জনক শক্তির উৎস, যা ভুল হাতে পড়লে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। গ্রামের মানুষরা সতর্ক হয়ে উঠল, কেউ কেউ ভয়ে পিছু হঠল। কিন্তু হরিদাসর মনে এক অদ্ভুত আগ্রহ জন্ম নিল—এটি কি সত্যিই কেবল একটি খড়ম, নাকি এর ভেতর লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা বহু বছর ধরে অচেনা শক্তিকে নিঃশব্দে ধারণ করে রেখেছে? সেই রাতের স্বপ্ন আর তান্ত্রিকের নির্দেশ যেন হরিদাসকে তাড়িত করছিল, এবং সে নিজেই অনুভব করল যে, এই খড়মের রহস্য উন্মোচনের পথ এখন তার হাতেই।
***
হরিদাস খড়মটি নিজের ঘরে রাখার পর প্রথম রাতেই অদ্ভুত সব ঘটনা শুরু হল। ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লক্ষ্য করলেন, বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে, এমনকি ঘরের সাধারণ আলোও যেন কম্পমান হয়ে উঠল। ধূপ-ধুনোর গন্ধ ধীরে ধীরে ঘরটি ভরে দিল, অথচ কোনো মানুষ বা আগুন জ্বালানোর চিহ্ন নেই। হরিদাস প্রথমে ভাবলেন, হয়তো ধূপের গন্ধ তার কল্পনার ফল। কিন্তু ঘরটি শূন্য থাকার পরও ছায়ার মতো কিছু জড়িয়ে ঘুরছে। বাতাসে কাঁপন, কোণার দিকে অদৃশ্য কোনো শক্তির উপস্থিতি, সবকিছু মিলিয়ে একটি অদ্ভুত আতঙ্ক সৃষ্টি করল। হরিদাস মনেই করলেন, খড়মটি কেবল কাঠ নয়, এটি যেন একটি জীবন্ত শক্তির বাহন, যা তার ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঘরে থাকা পরিবারের সবাই একটু একটু করে অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল, কিন্তু তারা কেউ স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারছিল না।
ঘরের কোণে ধীরে ধীরে ছায়ার মতো চলাফেরার চিহ্ন দেখা গেল। হরিদাসের ছোট ছেলে, রাহুল, প্রথমে কেবল চুপচাপ তাকিয়ে ছিল, কিন্তু খুব শিগগিরই সে ভয়ে কেঁপে উঠল। রাতে ঘুমের মধ্যে তার তাপমাত্রা বেড়ে গেল, জ্বরগ্রস্ত হয়ে সে কাঁপতে শুরু করল। হরিদাস ও তার স্ত্রী দ্রুত তাকে কোলে নিলেন, কিন্তু ঘরের কোণে অদৃশ্য ছায়া যেন আরও কাছে চলে আসছে। রাহুল ভয়ে কান্না করতে লাগল, আর হরিদাস বুঝতে পারলেন, খড়মটি শুধুমাত্র অদ্ভুত শক্তি বহন করছে না, এটি তার সন্তানকেও স্পর্শ করতে পারে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও রাত জাগার সময় লক্ষ্য করল, ঘরের বাতাসে হঠাৎ একটি ঠাণ্ডা ঝাপটা এসে ধাক্কা দিচ্ছে, যেন কেউ বা কিছু তাদের দিকে নিঃশব্দে ঘুরছে। হরিদাস একদিকে ভয়ে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, অন্যদিকে কৌতূহল তার মনের ভিতরে জেগে উঠল—এই খড়মের শক্তি কি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে, নাকি এটি শুধুই একটি প্রাচীন তান্ত্রিকের অস্তিত্বের নিদর্শন?
পরের দিন গ্রামে এই ঘটনা নিয়ে গুজব ছড়াতে লাগল। গ্রামের লোকেরা একে অশুভ বলে মনে করতে লাগল। কেউ বলল, “এই খড়মে যে শক্তি আছে, তা কেবল কল্পনার সৃষ্টি নয়, প্রকৃতই কোনো প্রাচীন তান্ত্রিকের আত্মা এতে বন্দী রয়েছে।” কেউ আবার মনে করল, “যে ঘরে খড়ম রাখা আছে, সেই ঘর রাতের অন্ধকারে মানুষের অদৃশ্য দৃষ্টি ধরে রাখে।” হরিদাস এবং তার পরিবারে আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হল। গ্রামের প্রবীণরা হরিদাসকে সতর্ক করলেন, এটি শুধুমাত্র বস্তু নয়, বরং এক বিপজ্জনক শক্তির বাহন, যা যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয়, তবে পরিবার এবং ঘরবাড়ি উভয়ের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। হরিদাসর মনে জিজ্ঞাসা জন্ম নিল—এই খড়ম কি শুধুমাত্র তার ঘরে প্রবেশ করলেই সক্রিয় হয়, নাকি এর শক্তি আরও গভীর কিছু লক্ষ্যপূর্বক অনুসন্ধান চায়? তিনি বুঝতে পারলেন, এই খড়মের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু বস্তুগত নয়, বরং এটি তাকে একটি অদৃশ্য রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যা হয়তো তার এবং পুরো গ্রামের জীবনকে চিরস্থায়ীভাবে পরিবর্তন করতে পারে।
***
গ্রামের প্রতিটি কোণে ধীরে ধীরে অদ্ভুততা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রাত নামলেই মানুষরা শোনা শুরু করল শ্মশানের দিক থেকে দূর থেকে আসা বাঁশির সুর, যদিও সেখানে কোনো বাঁশি বাজানো হয়নি। বাতাসে যেন অদ্ভুত সুর ভেসে আসে, যা মানুষকে অস্থির করে, মনে করিয়ে দেয় কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তাদের চারপাশে। একই সময়ে গ্রামের পশুপালকরা লক্ষ্য করল, হঠাৎ করে তাদের গরু, ছাগল বা অন্যান্য পশু নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, যেটি আগে কখনও ঘটেনি। কিছু লোক আবার রাতে ঘুমের মধ্যে দেখল, ঘরের জিনিসপত্র নিজে থেকেই নড়ে যাচ্ছে—টেবিলের কাপ, চেয়ার, এমনকি ছোট ছোট বাক্সও যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে স্থান পরিবর্তন করছে। গ্রামের মানুষ একদিকে আতঙ্কিত হয়ে উঠল, অন্যদিকে তারা বুঝতে পারল, এই সব ঘটনার সঙ্গে খড়মটির সরাসরি যোগ রয়েছে। যাদের চোখ এই খড়মকে দেখেছে, তারা অনুভব করেছে, এটি যেন এক অদৃশ্য শক্তির কেন্দ্রবিন্দু, যা ধীরে ধীরে গ্রামে প্রভাব বিস্তার করছে।
হরিদাসর পরিবারও এই অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে যাত্রা করছিল। ছোট ছেলে রাহুলের জ্বর, ঘরের কোণে চলাফেরা করা ছায়া, এবং ধূপ-ধুনোর গন্ধ—সব মিলিয়ে পরিবারে আতঙ্কের পরিমাণ বেড়ে গেল। হরিদাস রাতে বসে ভাবলেন, এই খড়মের শক্তি কোথা থেকে এসেছে এবং কেন এটি হঠাৎ সক্রিয় হল। তিনি মনে করলেন, হয়তো এটি কোনো প্রাচীন তান্ত্রিকের জীবনের অবশিষ্ট শক্তি, যা বহু বছর ধরে নিঃশব্দে মাটির গভীরে পুঁতে রাখা ছিল। গ্রামের প্রবীণরা বললেন, “এই খড়মটি সেই তান্ত্রিকের, যিনি বহু বছর আগে পূর্ণিমার রাতে রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার শক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে, তা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরও বস্তুতে বন্দী হয়ে থেকে গেছে। যারা এই খড়মের সংস্পর্শে আসে, তারা তার শক্তির প্রভাবে অচেনা আতঙ্কের মুখোমুখি হয়।” হরিদাসর মনে হল, এই তথ্য সত্যিই ভয়ঙ্কর, কারণ গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং পশুপাখি, এমনকি তার নিজস্ব পরিবারও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
দিনে গ্রামে গুজব আরও ছড়িয়ে পড়ল। কেউ বলল, “যে খড়মের সংস্পর্শে এসেছে, সে রাতে অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে মুখোমুখি হয়। কেউ কেউ দেখেছে, জিনিসপত্র নিজের ইচ্ছায় নড়ছে, আবার কেউ শুনেছে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর যা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না।” হরিদাস নিজেই বুঝতে পারছিলেন, খড়মটি কেবল একটি বস্তু নয়, এটি একটি অশুভ শক্তির বাহক, যা মানুষের মনের ভেতর ভয় এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। তিনি গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, এবং তারা তাকে সতর্ক করলেন, খড়মটি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, তবে এটি শুধু তার পরিবার নয়, পুরো গ্রামকে বিপদে ফেলতে পারে। হরিদাসর মনে জিজ্ঞাসা জন্ম নিল—এই খড়ম কি নিজেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে, নাকি এটি কোনো অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্ররোচিত, যা তার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগের অপেক্ষায়? এই প্রশ্ন তার ঘুম ভেঙে দিয়ে দিনের আলোতেও তাকে চিন্তায় নিমজ্জিত করছিল, এবং সে বুঝতে পারল, খড়মের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল একটি বস্তুগত সংস্পর্শ নয়, বরং এটি এক অশুভ রহস্যের প্রবেশদ্বার, যা এখন ধীরে ধীরে গ্রামে প্রভাব বিস্তার করছে।
***
গ্রামের বাতাসে ধীরে ধীরে অশান্তি ছড়াতে লাগল, আর হরিদাস এই অদ্ভুত শক্তির উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি গ্রামের প্রবীণ ও পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, এবং তাদের কাছে জানতে পারলেন একটি প্রাচীন গ্রন্থে তান্ত্রিকের বর্ণনা রয়েছে। সেই গ্রন্থে লেখা ছিল, তান্ত্রিক মৃত্যুর আগে এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন—যে কেউ তার খড়ম ঘরে আনবে, তার জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। হরিদাস প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভাবলেন, এটি কেবল গল্প, যা বহু বছর ধরে গ্রামে প্রচলিত। কিন্তু ঘরের কোণে অদৃশ্য ছায়া, রাতের বাঁশির সুর, এবং পশুপাখির অদ্ভুত আচরণ সব মিলিয়ে তাকে বোঝাচ্ছিল, গল্পের মধ্যে সত্যের ছায়া আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, খড়মটি কোনো সাধারণ বস্তু নয়, এটি সেই তান্ত্রিকের আত্মার বাহন, যার মধ্যে তার জীবদ্দশায় সঞ্চিত শক্তি এখনও সক্রিয়।
পুরোহিত আরও জানান, তান্ত্রিক জীবিত অবস্থায় খড়মে তার শক্তি সঞ্চার করেছিলেন, যেন মৃত্যুর পরও সে এই বস্তুটির মাধ্যমে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ চালাতে পারে। তিনি বলেন, “এই খড়মে শুধু শক্তি নয়, একটি জাদুকরী শক্তির ফাঁদ আছে। যিনি এটি ব্যবহার করেন, তার ইচ্ছার সঙ্গে না মিললে খড়ম তার জীবন, পরিবার ও সম্পদ সবকিছুতে প্রভাব ফেলতে পারে।” হরিদাস শোনার সঙ্গে সঙ্গে অবাক ও আতঙ্কিত হলেন। তিনি ভাবলেন, তার পরিবারের উপর যে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে—রাহুলের জ্বর, জিনিসপত্রের অদ্ভুত নড়াচড়া, ঘরের বাতাসে অদৃশ্য কাঁপন—সবই কেবল খড়মের কারণে। হরিদাসর মনে জিজ্ঞাসা জন্ম নিল, এই শক্তি কি কেবল তান্ত্রিকের আত্মার প্রভাবে সক্রিয়, নাকি খড়মটি তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন ঘটাচ্ছে?
দিনের আলোয় হরিদাস গ্রন্থটি আরও গভীরভাবে পড়তে লাগলেন। গ্রন্থে আরও লেখা আছে, তান্ত্রিকের মৃত্যু এবং খড়মের উপস্থিতি একটি চক্র তৈরি করে—যেখানে খড়মের শক্তি ধীরে ধীরে ঘরের এবং ব্যবহারকারীর জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামে অনেকে জানতেন না এই সত্য, তাই তারা খড়মের অশুভ শক্তিকে সহজেই অনুধাবন করতে পারছিল না। হরিদাস বুঝতে পারলেন, এটি কেবল একটি বস্তুগত বিপদ নয়, বরং একটি মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিপদ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, খড়মের রহস্য উন্মোচন না করা পর্যন্ত তিনি এটিকে নিরাপদে রাখতে হবে, এবং পরিবারের সকলকে সতর্ক রাখতে হবে। কিন্তু হরিদাস জানতেন, যত বেশি সময় যেত, ততই খড়মের প্রভাব বৃদ্ধি পেত, এবং একদিন এই শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এই উপলব্ধি তাকে গভীর উদ্বেগে নিমজ্জিত করল, এবং তিনি বোঝতে লাগলেন, খড়মের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধুমাত্র অবজেক্টিভ নয়, বরং এটি তার জীবনের ওপর একটি প্রাচীন, অশুভ কাহিনির প্রভাবের প্রতিফলন।
***
হরিদাসের পরিবার এখন প্রতিদিনই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যেত, ধূলোমাখা বাতাসে অদৃশ্য কোনো শক্তির উপস্থিতি স্পষ্টতই অনুভূত হত। খড়মটি ঘরের এক কোণে স্থাপন থাকলেও, তার চারপাশে অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করত। পরিবারের সদস্যরা রাতের অন্ধকারে শোনা অদ্ভুত শব্দে কেঁপে উঠত—যেন কেউ ঘরে নিঃশব্দে হাঁটছে, বা কোণার ছায়ার মতো কোনো অদৃশ্য হাত জিনিসপত্র সরাচ্ছে। কখনও কখনও খড়ম থেকে হঠাৎ অগ্নিশিখার মতো আলো ঝলসে ওঠত, যা ঘরকে এক মুহূর্তের জন্য প্রলাপময় জগতে পরিণত করত। এই আলো কখনও অল্প ক্ষণ ধরে থাকত, আবার কখনও তীব্রভাবে জ্বলে উঠত, যেন ঘরের সবকিছু পোড়ানোর হুমকি দিচ্ছে। হরিদাস এবং তার পরিবার বুঝতে পারছিল, এই সব ঘটনার সঙ্গে খড়মের সরাসরি যোগ রয়েছে, এবং এটি শুধু তাদের দৃষ্টি বা কল্পনার ফল নয়।
একদিন হরিদাস নিজেই ঘরে বসে খড়মের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, হঠাৎ তার মাথার মধ্যে একটি অজানা দুর্বলতা এবং অসহায়তার অনুভূতি প্রবাহিত হল। সে ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সে যখন হঠাৎ শ্বাস নিতে শুরু করল, তখন তার মুখ থেকে কণ্ঠনাদ বের হল, “খড়ম ফিরিয়ে দাও… না হলে সব শেষ।” এই শব্দগুলো শুনে তার পরিবার একেবারে আতঙ্কিত হয়ে গেল। তারা হরিদাসকে ধরে রাখতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখ যেন অদৃশ্য কোনো জগতে তাকিয়ে আছে। গ্রামের লোকেরা যখন এই ঘটনা জানল, তারা ভাবল হরিদাস পাগল হয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছিল না যে, হরিদাসের এই অবস্থা কেবল মানসিক নয়, বরং এটি খড়মের অশুভ শক্তির সরাসরি প্রভাব। পরিবারটি ক্রমশ আরও বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হতে লাগল, এবং ঘরের প্রতিটি কোণ যেন অদৃশ্য ভয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল।
দিনে গ্রামের মানুষরা হরিদাসের পরিবারের পরিস্থিতি দেখল এবং আতঙ্কে দৃষ্টিপাত করল। তারা ভেবেছিল, হয়তো খড়মটি একেবারেই সাধারণ বস্তু, এবং হরিদাস ও তার পরিবার কল্পনায় বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু রাতের অন্ধকার এবং অদ্ভুত ঘটনাগুলো এ ধারণাকে ভেঙে দিল। ঘরে অগ্নিশিখার মতো আলো, অদৃশ্য ছায়া, জিনিসপত্রের অজানা নড়াচড়া—সব মিলিয়ে পরিবারটি ক্রমশ সঙ্কটময় অবস্থায় পৌঁছল। হরিদাস বুঝতে পারল, এটি কেবল একটি প্রাচীন তান্ত্রিকের অবশিষ্ট শক্তি নয়, বরং একটি প্রাণবন্ত অশুভ শক্তি, যা মানুষের মন ও শরীরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এই উপলব্ধি তাকে গভীর আতঙ্কে নিমজ্জিত করল, এবং হরিদাস জানল, যতক্ষণ না খড়মের রহস্যের সঠিক সমাধান হবে, ততক্ষণ তার পরিবার কখনও নিরাপদ থাকবে না। তারা যেন এক অদৃশ্য বিভ্রমের জালে বন্দী হয়ে গেছে, যেখানে বাস্তব ও অতিপ্রাকৃত শক্তির মধ্যে পার্থক্য ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
***
গ্রামের মানুষরা হরিদাস এবং তার পরিবারের ক্রমশ বেড়ে চলা ভয়কে দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা সিদ্ধান্ত নিল, খড়মটির অশুভ শক্তি নষ্ট করতে হবে, আর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো। গ্রামের মধ্যবয়সী লোকেরা, কিছু যুবক, এমনকি হরিদাস নিজেও একত্রিত হয়ে রাতের অন্ধকারে খড়মটি নিয়ে শ্মশানের দিকে যাত্রা শুরু করল। পথে বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, বাতাসে অদ্ভুত ঠান্ডা ও কাঁপনের অনুভূতি ভেসে আসে। তারা যখন শ্মশানের ওপরে পৌঁছল, তখন আগুন জ্বালানোর জন্য খড়মটিকে রাখতেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আগুন ধরালেও খড়মের কাঠ কোনোভাবে পুড়তে পারল না। আগুনের শিখা খড়মের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ঝাপসা হয়ে গেল, আর হঠাৎ চারপাশে ঝড় উঠল, বাতাসে এমন তীব্র শক্তি অনুভূত হল যে গ্রামের মানুষরা ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। সেই ঝড়ে মাটি কেঁপে উঠল, বাতাসে গর্জন, এবং দূরে দিকদর্শনীয় মেঘের মত অদ্ভুত রূপান্তর দেখা গেল। খড়ম যেন নিজের শক্তিকে প্রকাশ করছে, এবং কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে, গ্রামের প্রবীণরা এক আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্ত নিলেন—তান্ত্রিক-বিদ্যার জানাশোনা কোনো সন্ন্যাসীকে খুঁজে আনা। এক সন্ন্যাসী, যিনি বহু বছর ধরে তান্ত্রিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক যজ্ঞের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, গ্রামে আসলেন। তিনি খড়মটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝলেন, এটি কোনো সাধারণ বস্তু নয়, বরং প্রাচীন তান্ত্রিকের আত্মার বাহন, যা মৃত্যুর পরও জীবিত মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। সন্ন্যাসী বললেন, “যে খড়মকে আপনি আগুনে পুড়াতে চাইছেন, তা সম্ভব নয়। এটি কেবল শক্তির বাহন, যার মাধ্যমে প্রাচীন তান্ত্রিকের আত্মা এখনো এই জগতের সঙ্গে সংযুক্ত। খড়মটি ধ্বংস করলে তার শক্তি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। মুক্তি দিতে হবে এক বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে, যেখানে আধ্যাত্মিক শক্তি, তন্ত্রমন্ত্র এবং নিখুঁত মনোযোগ একত্রিত হবে।” হরিদাস এবং গ্রামের মানুষরা এই বক্তব্য শুনে প্রথমে বিস্মিত হলেন। তারা ভাবলেন, এত বড় রহস্যের মোকাবিলা করার জন্য কি তারা সক্ষম হবেন? কিন্তু আতঙ্ক এবং ভয় তাদের তাড়িত করছিল, তাই তারা সন্ন্যাসীর নির্দেশ অনুসরণ করতে রাজি হল।
সন্ন্যাসী শুরু করলেন খড়মের চারপাশে একটি আধ্যাত্মিক বৃত্ত গঠন করা এবং প্রয়োজনীয় যজ্ঞের প্রস্তুতি নেওয়া। গ্রামবাসীরা সাহায্য করল, আর হরিদাসের পরিবার এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিল। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই খড়মের চারপাশে শক্তির উপস্থিতি আরও দৃঢ় মনে হচ্ছিল। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ, অগ্নিশিখার মতো আলোর ঝলক, এবং অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়ে ঘরটি এক অশুভ জগতে পরিণত হলো। সন্ন্যাসী সমস্ত যজ্ঞ সম্পন্ন করতে লাগলেন, তন্ত্রমন্ত্র পড়া শুরু করলেন, আর খড়মের শক্তি ক্রমশ স্থির হতে লাগল। গ্রামের মানুষরা, যারা আগে ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়েছিল, ধীরে ধীরে যজ্ঞের শক্তির মাধ্যমে আশ্বস্ত হতে লাগল। হরিদাসও বুঝতে পারলেন, খড়মের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল আতঙ্কের নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রার অংশ, যা তাকে ও তার পরিবারকে মুক্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখাচ্ছে। এই উপলব্ধি তার মনে শক্তি জোগালো—যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর, খড়মের শক্তি সত্যিই স্থির হবে এবং গ্রামের মানুষরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।
***
পূর্ণিমার রাতে গ্রাম পুরোপুরি অদ্ভুত এক আলো এবং ছায়ার খেলায় মগ্ন ছিল। চাঁদের আলো যেন মাটির ওপর একটি সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, আর বাতাসে এমন এক শান্তি বিরাজ করছিল যা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। এই রাতে হরিদাস এবং গ্রামের মানুষরা সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করল। মাটিতে বিশেষ ধরনের চক্র আঁকা হল, চারপাশে অগ্নি জ্বালানো হল, এবং প্রয়োজনীয় ধূপ ও তন্ত্রমন্ত্রের বস্তু সাজানো হল। যজ্ঞের শুরুতেই হরিদাস এবং তার পরিবার অনুভব করল, খড়মটি অস্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে উঠেছে, যেন এটি নিজের শক্তিকে অনুভব করছে। সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন, শব্দগুলো বাতাসে যেন কম্পন সৃষ্টি করছিল। প্রথমে ঘর এবং শ্মশানের চারপাশে সবকিছু শান্ত থাকলেও, ধীরে ধীরে অদ্ভুত নড়াচড়া দেখা দিল। খড়ম নিজে থেকে নড়ে উঠল, চারপাশে অগ্নি জ্বলে ওঠল, এবং বাতাসে এক ভয়ানক, অদৃশ্য হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে এলো—যেমন শতাব্দীর পুরনো আঘাতের প্রতিশোধ নিতে এসেছে কোনো অদৃশ্য শক্তি। গ্রামের মানুষরা প্রথমে স্থির হয়ে গেল, তাদের চোখে আতঙ্কের ছায়া ভেসে উঠল, কিন্তু সন্ন্যাসী ক্রমশ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
যজ্ঞের মধ্যেই খড়ম থেকে ধীরে ধীরে এক কালো ছায়া বের হতে শুরু করল। সেই ছায়া ছিল অতি শক্তিশালী, এবং তান্ত্রিকের আত্মার প্রতিচ্ছবি। ছায়ার আকৃতি একটি মানুষের মতো হলেও, তার চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়ার মতো অনুভূতি হল, আর শক্তি অনুভূত হল যা মানুষের সাধারণ বোধের বাইরে। ছায়াটি মুক্ত হতে চাচ্ছিল, নিজের প্রাচীন শক্তি ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সে ঘুরে ঘুরে বাতাসে স্থিতিশীলভাবে ভেসে চলল, কখনও স্থির হয়ে গেল, আবার কখনও তীব্র গতিতে নড়ল। হরিদাস এবং গ্রামের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, কিন্তু সন্ন্যাসী তাদের আশ্বস্ত করলেন, বললেন, “ধৈর্য ধরুন। আমাদের যজ্ঞের শক্তিই এখন তার উপর প্রভাব ফেলবে। তাকে শক্তিশালী হলেও আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখব।” সন্ন্যাসী আরও ধৈর্য ধরে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে গেলেন, এবং প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ যেন কালো ছায়াটির প্রতি একটি বীজ শক্তি প্রয়োগ করছিল।
যজ্ঞের চূড়ান্ত মুহূর্তে কালো ছায়া তীব্রভাবে আন্দোলিত হল, সে মুক্ত হতে চাইল, আকাশে গর্জন, বাতাসে কাঁপন, এবং অগ্নিশিখার মতো আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সন্ন্যাসী মন্ত্রে তাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করলেন, আর হরিদাসের পরিবার ঘিরে দাঁড়িয়ে ধ্যান এবং শক্তি সমন্বয়ের মাধ্যমে সাহায্য করল। প্রতিটি মন্ত্রের সঙ্গে ছায়ার প্রতিক্রিয়া আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল—কেউ হালকা কাঁপন অনুভব করল, কেউ আবার গলা আটকে যাওয়ার মতো চাপ অনুভব করল। ছায়াটি বুঝতে পারছিল, এটি নিজের প্রাচীন শক্তি হারাচ্ছে, কিন্তু তা ছাড়তে চাচ্ছিল না। তার অদ্ভুত চিৎকার বাতাসে ভেসে গেল, যেন শতাব্দীর পুরনো ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। ক্রমশ, সন্ন্যাসীর মন্ত্রের প্রভাবে ছায়ার শক্তি কমতে লাগল, তার আন্দোলন ধীর হয়ে গেল, এবং তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে নীরব হয়ে এলো। হরিদাস এবং গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারল, তান্ত্রিকের আত্মা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এবং খড়মের শক্তি স্থির হয়েছে—যজ্ঞ সফল হয়েছে, তবে সেই রাতের প্রতিটি ঘটনা তাদের মনে চিরদিনের জন্য ভয় এবং বিস্ময়ের ছাপ রেখেছে।
***
পূর্ণিমার রাতে গ্রাম পুরোপুরি অদ্ভুত এক আলো এবং ছায়ার খেলায় মগ্ন ছিল। চাঁদের আলো যেন মাটির ওপর একটি সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, আর বাতাসে এমন এক শান্তি বিরাজ করছিল যা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। এই রাতে হরিদাস এবং গ্রামের মানুষরা সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করল। মাটিতে বিশেষ ধরনের চক্র আঁকা হল, চারপাশে অগ্নি জ্বালানো হল, এবং প্রয়োজনীয় ধূপ ও তন্ত্রমন্ত্রের বস্তু সাজানো হল। যজ্ঞের শুরুতেই হরিদাস এবং তার পরিবার অনুভব করল, খড়মটি অস্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে উঠেছে, যেন এটি নিজের শক্তিকে অনুভব করছে। সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন, শব্দগুলো বাতাসে যেন কম্পন সৃষ্টি করছিল। প্রথমে ঘর এবং শ্মশানের চারপাশে সবকিছু শান্ত থাকলেও, ধীরে ধীরে অদ্ভুত নড়াচড়া দেখা দিল। খড়ম নিজে থেকে নড়ে উঠল, চারপাশে অগ্নি জ্বলে ওঠল, এবং বাতাসে এক ভয়ানক, অদৃশ্য হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে এলো—যেমন শতাব্দীর পুরনো আঘাতের প্রতিশোধ নিতে এসেছে কোনো অদৃশ্য শক্তি। গ্রামের মানুষরা প্রথমে স্থির হয়ে গেল, তাদের চোখে আতঙ্কের ছায়া ভেসে উঠল, কিন্তু সন্ন্যাসী ক্রমশ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
যজ্ঞের মধ্যেই খড়ম থেকে ধীরে ধীরে এক কালো ছায়া বের হতে শুরু করল। সেই ছায়া ছিল অতি শক্তিশালী, এবং তান্ত্রিকের আত্মার প্রতিচ্ছবি। ছায়ার আকৃতি একটি মানুষের মতো হলেও, তার চোখ থেকে আগুন ঝরে পড়ার মতো অনুভূতি হল, আর শক্তি অনুভূত হল যা মানুষের সাধারণ বোধের বাইরে। ছায়াটি মুক্ত হতে চাচ্ছিল, নিজের প্রাচীন শক্তি ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সে ঘুরে ঘুরে বাতাসে স্থিতিশীলভাবে ভেসে চলল, কখনও স্থির হয়ে গেল, আবার কখনও তীব্র গতিতে নড়ল। হরিদাস এবং গ্রামের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, কিন্তু সন্ন্যাসী তাদের আশ্বস্ত করলেন, বললেন, “ধৈর্য ধরুন। আমাদের যজ্ঞের শক্তিই এখন তার উপর প্রভাব ফেলবে। তাকে শক্তিশালী হলেও আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখব।” সন্ন্যাসী আরও ধৈর্য ধরে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে গেলেন, এবং প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ যেন কালো ছায়াটির প্রতি একটি বীজ শক্তি প্রয়োগ করছিল।
যজ্ঞের চূড়ান্ত মুহূর্তে কালো ছায়া তীব্রভাবে আন্দোলিত হল, সে মুক্ত হতে চাইল, আকাশে গর্জন, বাতাসে কাঁপন, এবং অগ্নিশিখার মতো আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সন্ন্যাসী মন্ত্রে তাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করলেন, আর হরিদাসের পরিবার ঘিরে দাঁড়িয়ে ধ্যান এবং শক্তি সমন্বয়ের মাধ্যমে সাহায্য করল। প্রতিটি মন্ত্রের সঙ্গে ছায়ার প্রতিক্রিয়া আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল—কেউ হালকা কাঁপন অনুভব করল, কেউ আবার গলা আটকে যাওয়ার মতো চাপ অনুভব করল। ছায়াটি বুঝতে পারছিল, এটি নিজের প্রাচীন শক্তি হারাচ্ছে, কিন্তু তা ছাড়তে চাচ্ছিল না। তার অদ্ভুত চিৎকার বাতাসে ভেসে গেল, যেন শতাব্দীর পুরনো ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। ক্রমশ, সন্ন্যাসীর মন্ত্রের প্রভাবে ছায়ার শক্তি কমতে লাগল, তার আন্দোলন ধীর হয়ে গেল, এবং তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে নীরব হয়ে এলো। হরিদাস এবং গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারল, তান্ত্রিকের আত্মা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এবং খড়মের শক্তি স্থির হয়েছে—যজ্ঞ সফল হয়েছে, তবে সেই রাতের প্রতিটি ঘটনা তাদের মনে চিরদিনের জন্য ভয় এবং বিস্ময়ের ছাপ রেখেছে।
***
যজ্ঞের শেষ মুহূর্তে সন্ন্যাসী ধীর ও গভীরভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। প্রতিটি শব্দ যেন বাতাসে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল, আর খড়মের চারপাশে অদ্ভুত শক্তির কম্পন অনুভূত হল। হরিদাস এবং গ্রামের লোকেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের চোখে আতঙ্ক ও কৌতূহল একসাথে। ক্রমশ খড়মের মধ্যে জমা প্রাচীন শক্তি মুক্তি পেতে শুরু করল, আর খড়ম ফেটে গিয়ে এক বিশাল অগ্নিশিখায় মিলিয়ে গেল। বাতাসে আগুনের গন্ধ এবং ধোঁয়ার সুর মিলেমিশে এক অদ্ভুত শান্তি তৈরি করল। গ্রামের মানুষরা মনে মনে ভাবল, অবশেষে তান্ত্রিকের আত্মা মুক্তি পেল, অভিশাপ চিরতরে শেষ হয়ে গেল। তারা একে একে ধীরে ধীরে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল, মনে করলেন—সব ভয়, সব অদ্ভুত ঘটনা এখন অতীত। হরিদাসও মনে মনে স্বস্তি পেলেন, এবং তিনি ভাবলেন, তার পরিবার আর গ্রাম শান্তির মধ্যে ফিরে এসেছে।
তবে, সেই রাতের শান্তি যেন খুব অস্থায়ী ছিল। পরদিন সকালে গ্রামে সকালের আলো ফুটতেই গ্রামবাসীরা এক অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করল। শ্মশানের প্রান্ত বা গ্রামের একান্ত কোণে যেখানে খড়ম ফেটে গিয়েছিল, সেখানে তার এক টুকরো অদ্ভুতভাবে অক্ষত অবস্থায় আবারও উপস্থিত হল। কাঠটি আগের মতোই ভারী, শক্ত এবং নিখুঁত—যেমন ফেটে যাওয়ার পরও তা নিজেই পুনরায় নিজেকে গঠন করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষরা অবাক ও আতঙ্কিত হয়ে গেল। কেউ বলল, “এ কি সম্ভব? খড়ম কি নিজেই পুনর্জীবিত হয়ে উঠল?” অন্য কেউ বলল, “হয়তো এটি কেবল তান্ত্রিকের আত্মার অংশ, যা এখনো মুক্তি পায়নি।” হরিদাসর মনে অদ্ভুত কল্পনা ও ভয় জাগল—যদি খড়মের এই টুকরো সত্যিই তার শক্তি ধারণ করে থাকে, তবে আগের অভিশাপের শক্তি কি সত্যিই শেষ হয়েছে, নাকি এটি কেবল নতুন অভিশাপের সূচনা?
গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ল, কেউ কেউ হরিদাসের পরিবারকে দূরে সরিয়ে রাখল, আবার কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিল, খড়মটিকে আরও গোপন স্থানে রাখা উচিত। হরিদাসও বুঝতে পারলেন, যজ্ঞে প্রাচীন শক্তি কিছুটা শান্ত হলেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তারা সবাই অনুভব করল, যে শক্তি ফেটে যাওয়া খড়মের টুকরোতে সঞ্চিত, তা এখনও মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। রাতের অন্ধকারে হরিদাস ঘরে বসে ভাবলেন, এই অভিশাপ কি সত্যিই শেষ হয়েছে, নাকি এটি কেবল নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে? গ্রামের মানুষদের মনে ভয়, কৌতূহল এবং অজানা ভবিষ্যতের প্রশ্নের মিশ্রণ তৈরি হল—খড়মের সঙ্গে জড়িত এই রহস্য কি কখনো শেষ হবে, নাকি এটি একটি চিরস্থায়ী ভয় এবং অশুভতার প্রতীক হয়ে থাকবে? এই উপলব্ধি সকলকে চুপচাপ করে দিল, আর গ্রামের প্রতিটি মানুষ আজও সেই ভাঙা খড়মের টুকরোকে নীরবভাবে অনুসরণ করছে, যেন তান্ত্রিকের আত্মা সত্যিই তাদের চারপাশে বিরাজ করছে।
****