শ্রাবণী দাস
১
ভোর তখন পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কিন্তু নদীয়ার ছোট্ট তাঁতশিল্পের গ্রাম বর্ণনাদহ যেন দিনের প্রথম নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। গ্রামের মাটির গন্ধ, ধোঁয়া ওঠা চুল্লির কাশফুলের মতো পাতলা ধোঁয়া, আর তাঁতের খটখট আওয়াজ—সব মিলে এক অবাক মায়ার ভোর। সেই মায়ার মধ্যেই উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলা পাল, এক হাতে ধরা সুতোর গোছা আর অন্য হাতে তার বাবার পুরোনো নকশার খাতা। চুলে গাঁথা ছিল লাল জবা, চোখে ছিল দূরের স্বপ্নের আলো। মেয়েটির বয়স বেশি না—এই বাইশ, তবুও তার চিন্তা যেন এক শিল্পী আর বিপ্লবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। সে জানে, এই গাঁয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই তাকে জড়িয়ে ধরেছে সমাজের রক্ষণশীলতা, কিন্তু একইসাথে তার চোখে বাঁধা আছে এমন এক ভবিষ্যৎ যেখানে তাঁতের শাড়ি আবার চলবে প্যারিসের র্যাম্পে, লন্ডনের প্রদর্শনীতে আর নিউ ইয়র্কের সংগ্রহশালায়। কিন্তু সবই স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নের পথ পেরোনো মানে কাঁটার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। বাবা রঘু পাল—এক অভিজ্ঞ, নীরব তাঁতশিল্পী। তাঁর হাতের সুতোয় একসময় বোনা হত নদীয়ার গরদ, ফুলিয়া, ধনেখালি শাড়ির খ্যাতি। কিন্তু সময় বদলেছে, আজ সেই শাড়িগুলো পড়ে থাকে আড়তের এক কোণে, যখন সস্তা সিন্থেটিক কাপড় শহর দখল করেছে। অথচ মেঘলা জানে—এই অবহেলিত শিল্পে এখনো প্রাণ আছে, প্রয়োজন শুধু নতুন রঙ আর দৃষ্টিভঙ্গি। সেই কারণে কলেজে সে ফ্যাশন ডিজাইন না পড়ে নিজেই শিখে ফেলেছে সফটওয়্যার, ডিজাইন থিয়োরি, ইউরোপের হস্তশিল্প বাজার সম্পর্কে, আর রোজ রাত্তিরে সে বসে তার নকশার খাতার সামনে। পুরোনো নকশাকে সে রূপ দেয় আধুনিক আঙ্গিকে—কখনো তাতে ঢুকে পড়ে এক জ্যামিতিক ছন্দ, কখনোবা ঠাকুরমার গল্প থেকে টেনে আনা কোন লৌকিক রূপকথার ছায়া। কিন্তু শুধু ডিজাইন করলেই তো হয় না। একদিন সে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “বাবা, আমি চাই তোমার তাঁতের কাজ আবার ফিরুক, নতুনভাবে। আমি ডিজাইন করব, তুমি তাঁতে তুলো—আমরা একসাথে কাজ করব।” রঘু পাল প্রথমে চমকে ওঠে। সে জানে, এই মেয়ে তার বাবার চেয়ে অনেক দূরে পৌঁছে যেতে চাইছে, কিন্তু তার চোখের সাহসটা অচেনা নয়—এই সাহস তার মায়েরও ছিল একদিন। “তুই জানিস তো, এসব কাজ করতে গেলে লোকে কেমন বলে?” — জিজ্ঞেস করে রঘু। মেঘলা হেসে উত্তর দেয়, “জানি। লোকে বলবে, মেয়ে হয়ে এত বড় স্বপ্ন? আমি বলি, মেয়ে বলেই বড় স্বপ্ন দেখি।” তারপর শুরু হয় এক নিঃশব্দ যুদ্ধ—জ্যামিতিক ডিজাইনের সঙ্গে রঙের মিতালি, বিদেশি বায়ারের সঙ্গে ইমেইলের বিনিময়, অনলাইন পোর্টালে ছবি আপলোড, ভিডিও বানানো, আর স্থানীয়দের কটাক্ষ সয়ে নেওয়া। বন্ধু রুবেল, একজন প্রযুক্তি-প্রিয় ছেলে, মেঘলাকে সাহায্য করে ফেসবুক পেজ খুলতে, হ্যান্ডলুম প্রোমোশন ভিডিও বানাতে, এমনকি পেমেন্ট গেটওয়ের সেটিং-ও করে দেয়। সে বলে, “তুই যা করছিস, এটা শুধু ব্যবসা নয় রে, একটা আন্দোলন।”
তবে এই পথে সবটাই ছিল না রোদের মতো ঝকঝকে। বিপত্তি আসে স্থানীয় সরকারি প্রকল্প সংস্থা থেকে—মনোরঞ্জন দত্ত নামের এক প্রতিনিধি মেঘলার ডিজাইনগুলো দেখে মুগ্ধ হয়, প্রশংসাও করে, কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায় সে সেই ডিজাইন নিজের নামে ব্যবহার করে শহরে প্রদর্শনীর জন্য জমা দিয়েছে। মেঘলা প্রথমে হতবাক হয়, তার পর ফুঁসে ওঠে। সে জানে, প্রতিবাদ না করলে এই লড়াইয়ের মানে থাকবে না। মা চন্দনা তাকে বোঝায়, “এইসব দুনিয়ার কৌশল তুই জানিস না, সাবধানে চল।” কিন্তু মেঘলা কারো কথায় থামে না। সে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ভিডিও দেয়, যেখানে সে বলে—”এই নকশা আমি এঁকেছি, এই তাঁতের সুতো আমার হাতে বোনা নয়, কিন্তু আমার স্বপ্ন দিয়ে গাঁথা। আমি মেয়ে, আমি জন্মাই শুধু রাঁধা-বুনার জন্য না—আমি জন্মাই গড়ে তোলার জন্য।” ভিডিও ভাইরাল হয়। এক বিদেশি শিল্প সংগ্রাহক, শ্রীমতী ঘোষ, ভিডিও দেখে যোগাযোগ করেন। বলেন, “You must come to London with your works.” সেই প্রথম মেঘলা তার শাড়ির গায়ে ট্যাগ লাগায়—“Handwoven by Dreams – Meghla Pal”। গ্রামের লোকেরা প্রথমে অবজ্ঞা করেছিল, এখন গর্ব করে বলে—“ও তো আমাদের মেয়ে, তাঁতের মেয়ে!” বাবা রঘু পাল মেয়েকে দেখে চুপ করে থাকেন, তারপর একদিন তার হাতে এক পুরনো তাঁতের টুকরো তুলে দিয়ে বলেন, “এটা তোর ঠাকুমার সময়ের নকশা। যদি পারিস, ওটাকেও ফিরিয়ে আন।” মা রান্নাঘর থেকে ডেকে বলে, “খিদে পায় না তোর? সারাদিন সুতো আর ফ্যাশন নিয়ে বুঁদ?” মেঘলা তখন আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে—“আমি শুধু তাঁতের মেয়ে না, আমি স্বপ্ন বোনার কারিগর। আর সেই স্বপ্ন একদিন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বেই।” তার চোখে তখন একটা আগুন, একটা নির্ভরতা, আর এক অদ্ভুত শান্তি—যেন সে জানে, আজ নয়, কাল নয়, কিন্তু একদিন পৃথিবী তাকে চিনবেই।
২
শীতের হালকা কুয়াশায় ঢাকা সেই সকালটা যেন অন্যরকম ছিল—রঘু পাল চোখ খুলে দেখলেন উঠোনে মেয়ের তৈরি এক নতুন নকশার শাড়ি ছড়ানো, তার উপরে রোদ পড়েছে ঠিক যেমন বাগানের লেবুপাতায় পড়ে শিশির ঝরে পড়ে। চারিদিকে ঘুরছিল খবর—কলকাতার হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে ‘Handwoven by Dreams’ নামে একটি স্টল রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মেঘলার তৈরি ডিজাইন, যার নাম সে রেখেছে ‘নির্বন্ধ’, যেখানে সুতোয় গাঁথা ছিল চারপাশের নারীদের মুখচ্ছবি—খোলা চুলে হাঁটছে কেউ, কেউবা ছেঁড়া শাড়ির পাড়ে বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে; কারো কপালে তিলক, কারো কপালে ঘাম, কিন্তু সবার চোখে এক আলো। প্রথমে যাদের চোখ কুঁচকে গিয়েছিল সেই সাহসী নকশার প্রতি, তারাই এখন বলছে, “ও তো একেবারে অন্যরকম শিল্প।” বিদেশি বায়ার শ্রীমতী ঘোষ তার সংগ্রহে রাখার জন্য শাড়িগুলি অর্ডার করলেন এক ডজন করে, আর অনলাইন ফ্যাশন ম্যাগাজিন “Loom & Soul” তাদের প্রচ্ছদে ছাপাল মেঘলার নাম। রুবেল তাকে ফোনে বলল, “তুই এখন শুধু গ্রাম না, পুরো বাংলা জুড়ে আলোচনার মেয়ে।” অথচ, এই প্রশংসা সত্ত্বেও গ্রামের মন্দিরের পাশের বারান্দায় বসে চার-পাঁচজন বৃদ্ধ বলাবলি করছিল, “ওই মেয়েটা নাকি নারী স্বাধীনতা, বিদ্রোহ, এসব আঁকছে? শাড়ি তো নারীকে ঢেকে রাখার জন্য, এসব আবার কি?” এক মাতব্বর তো সোজা বলে দিল, “গ্রামের নাম খারাপ করছে মেয়েটা!” মেঘলা চুপ করে শুনল, কিন্তু ফিরিয়ে বলল না কিছু, বরং সে কেবল নকশা আঁকার ক্যানভাসে এক নতুন মুখ এঁকে ফেলল—এক নারী, যার চোখে বিদ্রোহ, যার কপালে তারা। সেই নকশার নাম দিল “প্রতিবাদ”, আর তার নিচে লিখল: “যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারাও তো কোনো না কোনো গল্পের চরিত্র।”
দিন যত গড়াতে লাগল, মেঘলার ডিজাইন ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেশের বাইরেও—দিল্লির এক ডিজাইন হাউস তার কাজ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করল, জাপানের এক ফ্যাব্রিক কালেক্টর তার তাঁতের ভিডিও চাইল। অথচ এই উড়ানের মধ্যেই এক দিন সকালবেলায় সে দেখতে পেল উঠোনে ছড়িয়ে আছে কিছু ছেঁড়া শাড়ির টুকরো, আর পাশে পড়ে আছে একটি হাতে লেখা চিঠি—“নারীর মুখ আঁকো না, এসব বাজে স্বাধীনতা আমরা চাই না।” মা চন্দনা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এই পথই বেছে নিয়েছিস তো, এখন আর ভয় পেলে চলবে না মা।” বাবা রঘু এবার আর চুপ করে থাকেননি। তিনি সেই শাড়ির টুকরো হাতে নিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে বললেন, “আমার মেয়ে যা আঁকে, তা শুধু সুতো নয়—সময়ের চিহ্ন। তোমরা কেউ তার কাজ বন্ধ করতে পারবে না।” সেই প্রথম রঘু পাল প্রকাশ্যে মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। এবং সেদিনই গ্রামের স্কুলের দুই মেয়েও মেঘলার কাছে এসে বলল, “দিদি, আমরাও শিখতে চাই আঁকা, ডিজাইন, তাঁত।” মেঘলা তখন জানত, এটাই আসল জয়। শুধু বিদেশে শাড়ি বিক্রি নয়, এ লড়াই যেন এখন এক ‘অন্য নকশার গল্প’—যেখানে সুতো দিয়ে সমাজের চোখে প্রতিচ্ছবি আঁকা যায়, যেখানে মেয়ে মানে কেবলই ঘর নয়, সে একজন ভাষ্যকার, শিল্পী, বিপ্লবী। এবং এই গল্পের শুরু মেঘলার হাতেই, কিন্তু শেষ? সে এখনও লেখা হয়নি—কারণ এই শাড়ির তাঁতে এখনো অনেক রঙ বাকি।
৩
পৌষের কুয়াশা তখন কেবল হালকা হয়ে উঠছে, ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘলা পালের চোখে পড়ে গ্রামের মাঠঘাটে নতুন এক আলো—না, সেটা রোদ নয়, সেই আলো কিছু সাহসী কণ্ঠের, যারা মেয়েদের কাজ, তাদের শিল্প, তাদের নকশাকে অসম্মানের মুখে ফেলে এক ধরনের নিষিদ্ধতার মোড়কে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। গত কয়েক সপ্তাহে মেঘলার আঁকা সেই ‘প্রতিবাদ’ শাড়িটি, যেখানে এক নারীর মুখ আঁকা ছিল স্বাধীন চোখে, ঠোঁটে স্পষ্ট অভিমান, এবং চোখে যেন দাবির আগুন, তা নিয়েই প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। পাড়ার ক্লাবঘরে একদল পুরুষ চেঁচিয়ে বলেছে, “এটা কি শিল্প? না কি সমাজকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা?” গ্রামের মন্দিরের পুরোহিতও পঞ্চায়েতে অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, “এ সব বিদেশি ভাবনা মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে অপসংস্কৃতি!” এমনকি স্থানীয় মেলায় যেই স্টলে মেঘলার শাড়ি রাখা হয়েছিল, সেখানে এক রাতে আগুন লেগে যায়—কেউ বলেন দুর্ঘটনা, কেউ বলেন ইচ্ছাকৃত। কিন্তু মেঘলা চুপ করে থাকে না। সে যায় সোজা পঞ্চায়েত ভবনে, হাতে সেই ছেঁড়া শাড়ির অংশ আর মুখে আগুনের মতো কথা: “তাঁত মানে কেবল কাপড় নয়, এই সুতোয় বোনা থাকে সময়, চোখের জল, ঘাম, আর সাহস। যদি আমার নকশায় কেউ অপমান খোঁজে, তাহলে সে শিল্পকে বোঝেনি, সে ভয় পায়। আর ভয় পেয়েই প্রতিবাদ পোড়ায়।” তার কণ্ঠে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যে অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলতে পারেনি। পঞ্চায়েতের প্রধান, যিনি প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ থাকতে চাইছিলেন, এবার বললেন, “আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। যারা বিরোধিতা করছেন, তারা কালকে ইতিহাসে অপরাধী হিসেবেই লেখা থাকবে।” আর সেই প্রথম, গ্রামের দু-একজন পুরুষ, যাদের মেয়েরা এখন মেঘলার শেখানো ডিজাইন শিখছে, তারাও এসে পাশে দাঁড়াল। কেউ বলল, “মেয়ে যদি ঘরে থাকেই, তাহলে ঘর তো আমরাও বাঁধি না!” এই ভাষ্য সমাজে শোনা গিয়েছিল বহু বছর পর, এক মেয়ে শিল্পীকে ঘিরে।
এইসব ঘটনার মাঝেই কলকাতা থেকে একটি নিমন্ত্রণ আসে—”তাঁতের ভবিষ্যৎ: এক নারীর দৃষ্টিতে” নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মেঘলাকে বক্তব্য দিতে বলা হয়। সেই দিন তার পরনে ছিল সেই পোড়া শাড়ির বাকি অংশ দিয়ে বানানো একটা নতুন কুর্তা, যার গায়ে বড় অক্ষরে লেখা ছিল—“I Weave Fire”। মঞ্চে উঠে সে বলে, “তাঁতের সুতো কখনোই একরঙা নয়, তাতে থাকে স্ত্রীর ঘাম, কন্যার স্বপ্ন, মায়ের যন্ত্রণা—আর সেই ছেঁড়া সুতো দিয়েই গড়ে তোলা যায় এক নতুন প্রতিরোধ।” তার বক্তব্যের পর উপস্থিত বিদেশি প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, আর ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রামের ক্লাস থ্রি-র বাচ্চা মেয়েগুলো একটা ছোট ভিডিও পাঠায়, যেখানে তারা বলছে, “আমরাও আঁকব, আমরাও গড়ব, কারণ আমরাও মেয়ে।” মেঘলার চোখে জল আসে না, বরং সে হাসে—কারণ সে জানে এই লড়াই কাঁটার হলেও, তার সুতো এখন ছেঁড়ার নয়—এই সুতোয় বাঁধা আছে শত শত মেয়ের আত্মবিশ্বাস। এবং একদিন, যখন সবাই ভাববে শিল্প কেবল চার দেয়ালের সৌন্দর্য, তখন সে আবার বলে উঠবে—“এই নকশা শুধুই শাড়ি নয়, এই নকশা একটা প্রতিবাদের ভাষা।” এভাবেই ‘তাঁতের মেয়ে’ হয়ে ওঠে এক ভাষ্যকার, এক পথ দেখানো আলোর মতো, যাকে পুড়িয়ে ফেললেও সে ছাই থেকে ফিনিক্সের মতো উড়ে যেতে জানে।
৪
হলদে কুয়াশা আর পাখির ডাক যখন গ্রামকে মোহময় করে তোলে, তখন মেঘলা পালের হাতে আসে একটা ই-মেইল—“Dear Meghla, you are invited to present your work in the International Handloom Revival Conference, Milan.” চিঠিটি তার হৃদয়ে যেন হাজার সুতোয় বোনা এক প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। কখনো যে কাঁধে শাড়ির পাড় গুঁজে পায়ে মাটির ধুলো মেখে সে নকশা আঁকত, সেই কাঁধেই এবার উঠবে পাসপোর্ট আর ঝুলবে বিদেশি আমন্ত্রণ। রঘু পাল প্রথমে চুপ করে থাকেন, তারপর ধীরে বলেন, “তুই বিদেশ যাবি? শাড়ি নিয়ে?” মেঘলা মাথা হেঁট করে বলে, “তোমার তাঁতের গাঁথা নিয়ে যাব, আমার ছোঁয়া দিয়ে, দু’জনের কাহিনি একসাথে।” গ্রামের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়—“মেয়ে কি আর দেশে থাকবে না?” “ওর মতো হলে তো সবাই উড়ে যাবে!” এমন কথার ভিতর দিয়েই মেঘলা একদিন ভোরে কলকাতা রওনা দেয়, সেখান থেকে দিল্লি, আর সেখান থেকে মিলান। প্লেনের জানালা দিয়ে মেঘলা দেখতে পায় নিচের শহরের আলো, তার পাশে অন্ধকার পাহাড়, আর সে ভাবে—“এই আলো-আঁধারির মধ্যেই তো আমি নিজেকে বুনেছি।” মিলানের কনফারেন্সে তার গলায় থাকে এক স্বর, যা অনেক ভাষা জানে না, কিন্তু জানে কিভাবে আঁচলের গল্প বলতে হয়। সে বলে, “আমার দাদি বলতেন, শাড়ির প্রতিটি পাড়ে একটা করে কাহিনি লেখা থাকে, আমি কেবল সেই ভাষা তুলে এনেছি।” অনুষ্ঠানে বসে থাকা কেতাদুরস্ত বিদেশিরাও তখন বোঝে, সুতো শুধু গায়ে জড়ানোর বস্তু নয়—এ এক আত্মার শিল্প।
তবে বিদেশ মানেই কেবল সম্মান আর আলো নয়। মিলানের কনফারেন্স শেষে এক ফ্যাশন হাউস মেঘলাকে প্রস্তাব দেয়, “We will buy your designs, but under our brand. Your name can be in footnote.” মেঘলা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর প্রশ্ন করে, “If I sell my name, who will carry my grandmother’s stories?” তাদের উত্তর হয়, “Stories don’t sell, styles do.” সেই রাতে হোটেলের জানালায় দাঁড়িয়ে মেঘলা ভাবে—এই বিদেশি শহর তার কাপড়কে চায়, কিন্তু গল্প চায় না। অথচ সে তো এসেছে গল্প নিয়েই। ঠিক সেই সময় রুবেল তাকে ভিডিও কলে গ্রাম থেকে দেখায়, কিভাবে স্কুলের বাচ্চারা তার ডিজাইন কপি করে শাড়িতে আঁকছে। সেই দৃশ্য দেখে মেঘলা চোখ বন্ধ করে ভাবে—যে কাজ একসময় পোড়ানো হয়েছিল, আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে নিজের দেশেই। সে বুঝে যায়, বিদেশে নাম না থাকলেও তার শেকড় শক্ত—কারণ সে এসেছে মাটির কাছ থেকে, মায়ের গল্প থেকে, আর বাবার তাঁতের শব্দ থেকে। পরদিন সে চূড়ান্তভাবে ফ্যাশন হাউসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়, আর নিজের ডিজাইনের ছোট প্রদর্শনী করে স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসে। সেখানে সে শাড়ির পাশে একটা কাগজে লিখে রাখে—“This is not just handloom. This is a handwrit story of a girl who dared to weave fire.” বিদেশে সেই লেখা পড়ে অনেকেই মাথা ঝুকিয়ে বলে, “Your work is not just art, it’s heritage.” এবং সেদিন মেঘলা প্রথমবার বুঝতে পারে—আন্তর্জাতিক হওয়া মানেই শুধু শহরের আলো নয়, নিজের রং ধরে রেখে আলোতে দাঁড়ানো।
৫
ফ্লাইট নামার মুহূর্তে মেঘলার চোখে শুধু দেশের আকাশ নয়, ভেসে উঠছিল শত রঙের সুতো—যা সে নিজে বুনেছে, ভালোবেসে জড়িয়েছে, আবার হারিয়েও ফেলেছে কিছু অংশ। মিলানের প্রদর্শনী শেষ করে যখন সে কলকাতার মাটি ছোঁয়, তখন তার মনে হচ্ছিল—সে যেন নিজের জন্মভূমিতে নয়, বরং নিজেকে নতুন করে চিনে ফেরা এক মাটির দিকে ফিরছে। গাড়ির জানালায় বসে থাকা অবস্থায় সে জানালা দিয়ে দেখে চেনা দৃশ্য—গাছের পাতায় জং ধরে গেছে, হকারের গলায় আগের মতো চিৎকার নেই, তবু সবকিছু যেন আগের মতোই আছে। কিন্তু তার চোখে এবার যা ধরা পড়ছে তা ভিন্ন—সে খুঁজছে নিজেকে, নিজের ফেলে আসা সেই ছোট গ্রামটিকে, যেখানে সব শুরু হয়েছিল। গ্রামে পা রাখতেই তাকে ঘিরে ধরে অনেক চেনা মুখ, যারা আগে তাকে তুচ্ছ বলেছিল, তার শিল্পকে অপমান করেছিল, আজ তারা কেউ জড়িয়ে ধরে, কেউ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘলা বুঝতে পারে—মানুষ বদলায়, আর বদলায় সময়। সে হাঁটে সেই পুরোনো তাঁতের ঘরের দিকে, যেটা তার বাবা এখন আর আগের মতো ব্যবহার করেন না। রঘু পাল এখন অধিকাংশ সময় স্কুলে ছেলেমেয়েদের তাঁতের ক্লাস করান। ঘরে ঢুকে সে দেখে একটি পুরোনো কাঠের তক্তায় রাখা আছে তার ছোটবেলার আঁকা একটা রঙিন তাঁতের নকশা, পাশে লেখা: “মেয়ে হয়ে বোনা স্বপ্ন।” চোখে জল এসে যায়। চন্দনা রান্নাঘর থেকে হাসতে হাসতে বলে, “তোর বিদেশ ঘুরে এসে কেমন লাগছে রে? আমাদের ভাত-মাছ খেয়ে তোর গার্লিক ব্রেড মনে পড়ে?” মেঘলা হেসে বলে, “ওটা ছিল মুখের স্বাদ, এটা প্রাণের।” তখনই রুবেল এসে জানায়—“দিদি, ওরা পাড়ার মাঠে একটা তাঁত মেলা করতে চাইছে, যেখানে তুই উদ্বোধন করবি। এই গ্রাম এখন তোকে দেখে শেখে।” মেঘলা মৃদু হাসে, কিন্তু তার ভিতরে জমে থাকে নতুন ভয়, নতুন টানাপোড়েন। কারণ বিদেশের চোখে সে যত বড় হোক, নিজের মাটিতে ফিরে সে আবার সেই লড়াইয়ের মেয়েটিই।
তবে এই ফিরে আসায় এক নতুন বিপদ ঘাপটি মেরে বসে ছিল। মেলা শুরুর আগের রাতে মেঘলা জানতে পারে—স্থানীয় এক প্রভাবশালী কাপড়ের আড়তদার তার ডিজাইন নকল করে চীন থেকে একই রকম ডিজাইন প্রিন্ট করিয়ে এনে বিক্রি করছে ‘তাঁতের নাম করে’। এই ঘটনা শুধু প্রতারণা নয়, একেবারে তার কাজ ও পরিচয়ের ওপর আঘাত। সে জানে, যেসব বায়ারদের সাথে সে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, তারা যদি বুঝতে পারে নকল পণ্য বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাহলে তার শিল্পের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়—এইবার মুখ বন্ধ না রেখে আইনি ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রামে অনেকেই ঐ আড়তদারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলে, অনেকের জীবন চালানো তার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবাদ করলে আবার তাকে দোষারোপ করা হবে, বলবে, “এই মেয়েটা গ্রামের চালচিত্র বদলে দিচ্ছে, বাঁচিয়ে রাখছে না।” চন্দনা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুই যদি চুপ করিস, একদিন তোর মেয়ে, বা তারও মেয়ে বলবে—আমাদের শাড়ির নকশা আমরা বানাইনি, কিনেছি।” এই কথা যেন বাজ পড়ে মেঘলার ভেতরে। সে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠায়—“তাঁত মানে হাতের বুনন, আত্মার স্বাক্ষর। যার পেছনে নেই স্রষ্টা, সে শুধু ছাপা কাপড়।” সেই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। শাসকের ছায়ায় থাকা আড়তদার পিছু হটে, এবং প্রশাসন শেষ পর্যন্ত মেঘলার পক্ষ নেয়। মেলা হয়—আর সেখানে প্রথমবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেঘলা বলে, “আমি ফিরে এসেছি শুধু শাড়ি নিয়ে নয়, ফিরে এসেছি ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে।” সেই মেলায়, এক কোণে এক কিশোরী বসে নতুন ডিজাইনের উপর আঁকছে শাড়ির নকশা, আর মেঘলা হাসতে হাসতে বলে—“এই মেয়েটি হয়তো একদিন আমার থেকেও বড় হবে, কারণ সে এখনই জানে, সুতো শুধু কাপড় হয় না, সুতো দিয়ে বোনা যায় ইতিহাস, পরিচয় আর প্রতিবাদ।” মেঘলার এই ফিরে দেখা তার পুরনো ঘরকে নতুন আলোয় দেখায়—এক সুতোয়, যা আগেও ছিল, এখনও আছে, কিন্তু এবার সে বুনছে ভবিষ্যৎ।
৬
সেদিন আকাশটা যেন রঙ তুলিতে আঁকা ছিল—গাঢ় নীলের মধ্যে লালচে সূর্যের ঢেউ, আর তার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলা পাল, তার নতুন পরিকল্পনার নকশা হাতে। শীতের সকালের সেই আলোয় উঠোনে বসে মেঘলা বুঝছিল—তাঁতের শিল্পকে রক্ষা করতে গেলে শুধু শাড়ি বানালে হবে না, দরকার এমন একটা মানচিত্র, যেখানে থাকবে প্রত্যেক গ্রামের, প্রত্যেক তাঁতির আলাদা গল্প, আলাদা শৈলী, তাদের আঙুলের ভাষা, তাদের গায়ের ঘামের ছাপ, আর সেই শিল্পকে ঘিরে থাকা মেয়েদের হাজার বছরের চুপচাপ জীবন। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার থেকে শুধু নিজের ডিজাইন নয়, সে তৈরি করবে একটা “তাঁত মানচিত্র”—একটা আঞ্চলিক রূপরেখা, যেটা বোঝাবে কোন অঞ্চলে কী ধরণের তাঁত, কোন রঙ, কোন প্যাটার্ন, কোন গাঁয়ের মেয়ে কী বুনে আসছে এতদিন, আর কেন তারা হারিয়ে যাচ্ছে। সে ডাকে গ্রামের সব তাঁতির মেয়েদের—ঝর্ণা, বিথি, পিয়ালী, লক্ষ্মী—যারা এতদিন কেবল কাজ করত, নিজের নাম জানাত না কারও কাছে। মেঘলা বলে, “তোমাদের কাজ এবার তোমাদের নামে পরিচিত হবে। আমরা তৈরি করব এক ‘আঁচলের মানচিত্র’—তাতে থাকবে বাংলার তাঁতের আত্মা।” মা চন্দনা প্রথমে অবাক হয়ে যায়, তারপর একদিন রাতে মেয়ের আঁকা মানচিত্রের খসড়ায় নিজের হাত রাখে, বলে, “আমি তো ভাবতাম আঁচল কেবল কান্না ঢাকার জন্য, আজ দেখি এতে ইতিহাস লেখা যায়।” এভাবেই গড়ে ওঠে এক সংগ্রহ—পুরনো নকশা, নতুন ডিজাইন, অঞ্চলভিত্তিক রঙের ধরন, এবং তাঁদের কাহিনি যারা এসব বুনেছেন—সেই সমস্ত মেয়ে, যাদের কখনো নাম হয় না, তারা প্রথমবার লিখছে তাদের পরিচয় নিজেই।
এই কাজের মাঝেই আসে নতুন ধাক্কা—সরকারি শিল্প উন্নয়ন পর্ষদ থেকে এক কর্মকর্তা এসে জানায়, “আপনার এই তন্তুমেলা, নকশা মানচিত্র সবই ঠিক আছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানে উন্নত ব্র্যান্ডিং চাই।” মেঘলা প্রশ্ন করে, “তবে কি আমাদের মেয়েদের নাম আর গল্প থাকবে না?” তিনি বলেন, “ব্যবসায় আবেগ চলে না, ম্যাম।” এই কথাটা তার গায়ে লেগে যায় ঠিক আগুনের মতো, কিন্তু সে বুঝে যায়, ব্যবসার কাঠামো না জানলে শিল্প কেবলই একটি শখ থেকে যাবে। সে রুবেলের সঙ্গে মিলে তৈরি করে “Meyeli Sutra Exports”—একটা নারীকেন্দ্রিক রপ্তানি সংস্থা, যার প্রতিটি পণ্যের গায়ে থাকবে ডিজাইনার মেয়ের ছবি, তার এলাকা, এবং হাতে লেখা ছোট্ট গল্প। বিদেশি ক্রেতারা প্রথমে অবাক হয়, পরে মুগ্ধ হয়, কারণ তারা দেখে এক শাড়ির ভিতর শুধু রঙ নয়, আছে মানুষ, আছে ইতিহাস, আর আছে বেঁচে থাকার লড়াই। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষক এসে মেঘলার কাজ দেখে বলেন, “তুমি যা করছ, তা শুধু শিল্প নয়, এটা ভবিষ্যতের সামাজিক নথিপত্র।” মেঘলা বুঝে যায়, তার আঁচল এখন শুধু সে নিজে গায়ে দেয় না—এই আঁচলের গায়ে ছাপ পড়ে যাচ্ছে একটা জাতির, একটা নারীশ্রমিকের, একটা অদৃশ্য হাতের মানচিত্র। সম্মেলনে দাঁড়িয়ে সে বলে, “আজকাল দেশ চেনে সীমান্ত দিয়ে, আমি চাই দেশ চেনা হোক আঁচলের ডিজাইন দিয়ে।” এবং সেই কথা শুনে এক বিদেশি প্রতিনিধি বলেন, “We need to print this on the global map.” তখন মেঘলা হেসে বলে, “Already printed. In thread and soul.” এবং সেই দিন থেকে “তাঁতের মেয়ে” হয়ে ওঠে কেবল একজন শিল্পী নয়, হয়ে ওঠে এক আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক—যার আঁচলে বোনা থাকে গোটা এক মানচিত্র, যার রেখায় লেখা থাকে মাটি, মানুষের, মেয়ের গল্প।
৭
পশ্চিমবঙ্গের সেই ছোট্ট গ্রাম বর্ণনাদহ থেকে যে শাড়ির আঁচল বয়ে এসেছিল সুদূর ইউরোপের প্রদর্শনীর দেয়াল অবধি, সেই আঁচলেই এবার ছড়িয়ে পড়ে বিতর্কের আগুন। লন্ডনের এক গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটাইল ফেস্টিভ্যালে মেঘলার তৈরি ‘মুক্তির রেখা’ নামের শাড়িটি, যাতে তিনি এক নারীকে আঁকেন মাটির ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে, চোখ তুলে আকাশের দিকে চেয়ে—আর সেই আকাশে ফুটে ওঠে প্রাচীন এক মানচিত্রের ছায়া—তা দেখে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি বলেন, “This is too political.” কেউ কেউ বলেন, “You are trying to impose your history on textile.” অথচ মেঘলার চোখে এই নকশা ছিল শুধুই এক আত্মজৈবনিক ভাষা, যেখানে একজন নারী তার ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তার শরীরে যে কাপড় জড়ানো, তা কেবল শালীনতার না, তা তার ভূগোল, তার মানচিত্র, তার অস্তিত্ব। বিতর্ক যত বাড়তে থাকে, ততই সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় দর্শক ও সমালোচকরা। কেউ বলে, “নারী শিল্পে নিজের ভূখণ্ড কেন জুড়বে?” কেউ বলে, “এই তো মেয়েদের স্বাধীনতার নামে অন্য মত চাপানো।” মেঘলা সব দেখে, শোনে, চুপ করে একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয় তার পুরোনো নকশার খাতার পাশে বসে। বাবা রঘু পাশে এসে বসে বলেন, “তুই যা আঁকিস, তাতে যা কিছু থাকে, তা তোর সত্যি। লোকে যেটা দেখে, সেটা তাদের ভয়।” মা চন্দনা বলে, “তুই তো আমার মুখের কাহিনি এঁকেছিস, এখন যদি তার জন্য দোষারে, তাতে ভয় কী?” সেই রাতেই মেঘলা বসে নতুন ডিজাইন আঁকে, যেখানে এক নারী পিঠে আঁচল গুঁজে রেখে হাঁটছে, আর তার পায়ের নিচে রঙিন সুতোয় বোনা মানচিত্র—তাতে নদী, গাছ, ঘর, মাঠ—সবকিছু। সেই ডিজাইন নিয়ে সে একটি ভিডিও বানায়, যেখানে সে বলে, “If my land, my sky, my mother and my language are political, then so be it—my loom will carry them all.” ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প জগতে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে প্রশ্ন: “Is textile just fabric, or can it be a storyteller?” সেই প্রশ্নের উত্তরে মেঘলা নিজের শাড়ি নিয়ে একটি মিনি-ডকুমেন্টারি তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি নকশার পেছনের কাহিনি সে বলে নিজেই—একটাতে দাদির হারানো হাতঘর, একটাতে বিথির মা যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, আরেকটাতে তার নিজের প্রথম প্রতিবাদ। সেই ভিডিও দেখে এক ফরাসি সাংবাদিক লেখেন, “This girl from Bengal is not weaving silk. She is weaving revolutions.” দেশে ফেরার পরে তাকে আমন্ত্রণ জানায় এক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তাকে বলা হয়, “We want you to talk about cloth as resistance.” মেঘলা তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, “শরীর তো সবার থাকে, কিন্তু তাতে কোন কাপড় পড়বে, কোন গল্প জড়াবে, সেই স্বাধীনতা মেয়েদের না দিলে, তারা শুধু দেখা যাবে, শোনা যাবে না।” সে জানে, আজ সে শুধুই এক তাঁতের কন্যা নয়, সে একটি শুদ্ধ কণ্ঠ, যা কাপড়ের ছেঁড়া প্রান্ত দিয়েও বর্ণনা করতে পারে ইতিহাস। আর তখনই গ্রামের মেলায় ছোট মেয়েরা নতুন করে গাইতে শেখে এক গান—“আমার আঁচল, আমার মানচিত্র, আমার চুপ হয়ে থাকা ইতিহাসের মুখ।” এই অধ্যায়ে মেঘলা বুঝে যায়—কোনও কাপড় কেবল শালীনতা নয়, তা হয়ে উঠতে পারে এক জীবন্ত দলিল। এবং যে হাত তা বোনে, সে হয়ে ওঠে কেবল শিল্পী নয়, ইতিহাসের এক ভাষ্যকার।
৮
তাঁতের গুঞ্জনে যখন গ্রাম ঘুম ভাঙাচ্ছে আর পাখির ডাকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তাঁতির মাদুলি বেজে ওঠা শব্দ, তখনই মেঘলার রপ্তানি সংস্থার সদর দফতরে ঢোকে এক চকচকে গাড়ি, ভিতর থেকে নামে বিদেশি এক প্রতিনিধি—মিস্টার ম্যাথিউ কোলম্যান, এক বিশাল বহুজাতিক টেক্সটাইল ব্র্যান্ডের প্রধান প্রতিনিধি। তার চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, হাতে ল্যাপটপ, মুখে আন্তর্জাতিক ভব্যতার ছাপ। “We have seen your brand, Meghla,” সে বলে, “Meyeli Sutra is not just a product line—it’s a story people are ready to wear.” মেঘলা তাকে চুপচাপ শোনে, মনে পড়ে যায় গ্রামের বিথির কথা, যে এখন তার আঁকা প্যাটার্নে রঙ ভরছে, আর পিয়ালীর—যে প্রথম নিজের নামে একটা শাড়ি ডিজাইন করেছে। কোলম্যান জানায়, তারা মেঘলার সংস্থাকে কিনে নিতে চায়—সম্পূর্ণ হস্তান্তর হবে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও থাকবে তাদের হাতে। মেঘলা জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আমার গ্রামের মেয়েরা?” কোলম্যান উত্তর দেয়, “We will keep a few of them as design consultants. But branding will be global, not local.” মেঘলার বুক কেঁপে ওঠে—সে ভাবে, এই ব্র্যান্ড সে গড়েছে প্রতিটি কুঁচকে যাওয়া শাড়ির ভাঁজ থেকে, শত প্রতিকূলতা বুনে, হাতের ঘামের গন্ধ রেখে। আজ কেউ সেই মাটি-মিশ্রিত স্বপ্নকে কিনে নিতে চায় চকচকে মুনাফায়? বাবা রঘু একদিন রাতে তাকে বলে, “তোকে মানুষ চেনে যে আঁচলে মাটি লেগে থাকে, সেই আঁচল তুলে নিয়ে যদি সিল্কের খোপে রাখিস, তাহলে তো তুই আর তুই থাকবি না।” মা চুপ করে থাকে, কিন্তু ভোরবেলা উঠোনে গিয়ে তাঁত চালিয়ে বলে ওঠে, “মাটি ছাড়া সুতো শুধু দড়ি, আর দড়ি দিয়ে কেউ ইতিহাস বাঁধে না।”
মেঘলা এরপর একটি সর্বসম্মত সভা ডাকেন—গ্রামের সব নারী কর্মী, তার সহকর্মী, পাড়ার মেয়ে, এমনকি কয়েকজন বৃদ্ধ তাঁতীও আসেন। সে তাদের সামনে কোলম্যানের প্রস্তাব পড়ে শোনায়, তারপর বলে, “এটা আমার একার সিদ্ধান্ত না। এই সংস্থা আপনাদের স্বপ্নের সুতো দিয়ে বোনা। যদি বিক্রি হয়, তবে তোমাদের গল্প কেউ আর পড়বে না—তখন তা শুধু ‘পণ্য’ হবে।” সকলে একযোগে বলে ওঠে, “না, দিদি, আমরা গল্প বিক্রি করব না।” পরদিন সকালে মেঘলা অফিসে বসে কোলম্যানকে চিঠি লেখে—“Thank you for your generous offer, but we believe some threads are not for sale.” সে চিঠির নিচে সই করে—“Meghla Pal, Founder & Weaver.” কোলম্যান হতবাক হয়ে যায়, কিন্তু কিছু বলে না। আর সেই সন্ধ্যায় মেঘলা নিজের হাতে আঁকে এক নতুন শাড়ির নকশা—যেখানে শাড়ির পাড়ে থাকে মাঠ, আকাশ, নদী, কাঁথা, হাড়িভাঙা আমের পাতার ছায়া, আর সেই চেনা একটি উঠোন। তার নাম দেয়—“জায়গা”—A Place Called We.” সেই শাড়িটি হয়ে ওঠে পরবর্তী প্রদর্শনীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন সবাই ব্যবসার গল্প বলে, তখন মেঘলার গল্প হয়ে ওঠে এক প্রতিবাদী মাটি—যেখানে তাঁর বুননের মধ্যে লেখা থাকে, “আমরা বেচি না, আমরা বলি।” এভাবেই মেঘলা নিজের শিল্প ও সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখে বাজারের লোভ থেকে, আর প্রমাণ করে, চোখে যদি তাঁতের স্বপ্ন থাকে, আর বুকের ভেতর যদি থাকে নিজের মাটির স্পর্শ, তাহলে কোনো বহুজাতিকও সেই ঘ্রাণ কিনে নিতে পারে না।
৯
একদিন সকালের চিঠির বোঝা নিয়ে যখন ডাকপিয়ন গ্রামের পুকুরপাড় দিয়ে হাঁটছিল, তখন তার ব্যাগে ছিল একটি চমকপ্রদ আমন্ত্রণপত্র—ভারত সরকারের জাতীয় হস্তশিল্প পুরস্কারের জন্য মেঘলা পালের নাম মনোনীত হয়েছে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই বর্ণনাদহ যেন উৎসবের পাড়ায় পরিণত হয়। পাড়ার পুকুরঘাটে গাঁয়ের মেয়েরা ঢাকের মতো পাড়ে হাত ঠুকিয়ে বলে ওঠে, “আমাদের দিদি দেশকে দেখালো!” রুবেল এসে বলে, “তুই তো এখন খবরের শিরোনাম!” অথচ, এই আনন্দের ঢেউয়ের মাঝেই, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় একটি চিঠি—এক স্বঘোষিত নকশাকার দাবি করেন, “মেঘলা পালের ডিজাইনগুলোর মধ্যে একটি, ‘নির্বন্ধ’, আসলে পুরোনো শিলাইদহ নকশার ছায়া মাত্র। এতে মৌলিকতা নেই।” সমাজমাধ্যমে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়—“সে কি চুরি করেছে?” “পুরস্কার পাওয়ার লোভে কি ইতিহাস বিকৃত?” মেঘলা প্রথমে নির্বাক থাকে, মাথার ভিতর যেন গুনগুন করে বাজতে থাকে তাঁতের একঘেয়ে শব্দ। সেই মুহূর্তে সে নিজেকে দেখে একটি লম্বা আয়নায়, যেটা দু’ভাগে ভাঙা—একদিকে তার স্বীকৃতি, আরেকদিকে প্রশ্নচিহ্ন। মা চন্দনা বলে, “তুই যা বুনিস, তা কারো থেকে নিলি না। তুই তো নিজের দৃষ্টিতে দেখিস।” কিন্তু বিতর্ক যেন থামে না।
মেঘলা এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়—সে চুপ করে থাকবে না। সে নিজের ডিজাইন খাতা, রঙিন পেনসিল, পুরোনো ছবি, এবং দাদির লেখা চিঠিগুলি নিয়ে যায় কলকাতার প্রেস কনফারেন্সে। সেখানে উপস্থিত হয় শতাধিক শিল্পী, সাংবাদিক, নকশাকার, এবং হস্তশিল্প সংস্থার প্রতিনিধিরা। মেঘলা মঞ্চে উঠে বলে, “আমি কারও নকশা চুরি করিনি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করেছি, নতুন আলোয় দেখিয়েছি। যেমন আমার মা শাড়ির আঁচলে দাদির পছন্দের পাড় রাখতেন—এটা উত্তরাধিকার, অনুকরণ নয়। তাঁত কখনো একা হয় না—তার প্রতিটি সুতো পেছনের শত শত হাতের ঋণ নিয়ে চলে।” তারপর সে নিজের ডিজাইন খাতার পাতাগুলো খুলে দেখায়—প্রতিটি স্কেচের পাশে লেখা রয়েছে তার ভাবনা, সময়, আর উৎস। উপস্থিত সকলে স্তব্ধ। পুরস্কার কমিটির প্রধান তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “মেঘলা পাল শুধু একজন ডিজাইনার নন—তিনি একজন আর্কাইভার, যিনি সুতো দিয়ে ইতিহাস লেখেন।” অভিযোগকারী শিল্পী পরে তার ভুল স্বীকার করে নেন। আর জাতীয় হস্তশিল্প পুরস্কারের দিন, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সম্মান গ্রহণের মুহূর্তে মেঘলা গলায় পরে সেই শাড়ি—‘নির্বন্ধ’। তার চোখে জল নেই, শুধু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি—কারণ সে জানে, তার নাম আজ কাগজে ছাপা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসল নাম সে বহু আগে লিখেছিল—তাঁতের সুতো দিয়ে, ধীরে ধীরে, এক একটি স্পর্শ দিয়ে, এক একটি মুখ আঁকা দিয়ে। এবং সেই নাম কেউ মুছতে পারবে না—কারণ সে নাম শুধু তার নয়, সে নাম সেই সমস্ত মেয়ের, যারা নিজের গল্প নিজেই বুনে নিয়েছে।
১০
শরতের সেই হালকা কুয়াশা আর কাশফুলের মাঝে মেঘলা দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো আমগাছটার নিচে, যেখানে একদিন সে প্রথমবার রঙতুলি দিয়ে আঁচল আঁকতে চেয়েছিল। আজ সেখানে ছোট একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে—তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ “আঁচলের মানচিত্র” প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। মঞ্চের পাশে রাখা একটি টেবিলে শাড়ির মতো প্যাঁচানো সেই বইয়ের পাতা খুলে পড়ছে গ্রামের কিশোরীরা, যেখানে শুধু ছবি আর ডিজাইন নয়, আছে গল্প, মুখ, সময়, প্রতিবাদ আর সাহস। বইয়ের মুখবন্ধে লেখা: “এই পৃষ্ঠাগুলো সুতো দিয়ে লেখা, যারা পড়বে তাদের আঙুলে মাটি লাগবে।” শহরের সাহিত্যিক, সমাজতাত্ত্বিক, ডিজাইনার, এমনকি আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। সবাই বলে, “এই বই শুধু পড়ার নয়, অনুভব করার। এই বই পড়লে বোঝা যায়, এক মেয়ের আঁচল দিয়ে গোটা একটা সভ্যতা ঢাকা যায়।” ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘলার হাতে তুলে দেওয়া হয় এক আন্তর্জাতিক সম্মান—“Textile Memory Maker” পুরস্কার, প্যারিসের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর পক্ষ থেকে। কিন্তু এই সব সাফল্যের মাঝেও, মেঘলা সবচেয়ে বেশি গর্ব করে যখন দেখায়, স্কুলের ছোট মেয়েরা তার ডিজাইন ধরে তুলে বলছে—“এইটা আমি এঁকেছি!” সে তাদের শেখায়, “তোমাদের আঁচলেও আছে ইতিহাস, কেবল আঁকো, ভয় পেয়ো না।” মেঘলা জানে, শিল্পের শেষ নেই, যেমন শেষ নেই এক মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের। তার জীবন আজ আর একার নয়—তা হয়ে উঠেছে শত শত মেয়ের রঙিন গল্পের জমি।
সেই রাতেই মেঘলা একা বসে তার পুরোনো নকশার খাতা খুলে দেখে—প্রথম পৃষ্ঠায় সেই কাঁচা আঁকা মুখ, যেটা একদিন সবাই বলেছিল “ভুল”, আজ তা পরিণত হয়েছে পরিচয়ে। সে জানে, তাঁত মানে কেবল কাপড় না, তাঁত মানে চলমান সময়, যেখানে প্রতিটি নকশা একটা করে অধ্যায়। সে ভাবে, এই যাত্রা যদি থেমে যায়, তাহলে থেমে যাবে কত শত মুখের গল্প, যারা এখনো কথা বলতে শেখেনি। তাই সে স্থির করে—এবার সে গড়বে এক আর্কাইভ—বাংলার প্রতিটি অঞ্চলভিত্তিক মেয়েদের নিজস্ব তাঁতের রেকর্ড, ডিজাইন, গল্প ও জীবনচিত্র নিয়ে। এই আর্কাইভ থাকবে অনলাইন ও অফলাইন, যাতে একদিন কেউ যদি জানতে চায়, “তাঁতের মেয়েরা কেমন ছিল?”, তাহলে মেঘলার বই, তার নকশা, তার শাড়ি, তার গলার স্বর আর সেই আঙুলের ছাপ থেকেই উঠে আসবে উত্তর। গল্প এখানেই শেষ নয়, কারণ সুতো কখনোই থামে না। সে একদিন মেয়েদের হাতে কেবল কাপড় বোনার না, বরং নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতা তুলে দেয়। শেষ পৃষ্ঠায় মেঘলা লেখে—“আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি এত বড় করে ভাবো কেন? আমি বলি, আমি মেয়ে বলেই বড় ভাবি। কারণ ছোট করে ভাবার দিন শেষ। এখন মেয়েরা বুনে ভবিষ্যৎ। আঁচলে নয়, মনের ভিতর।”
-সমাপ্ত-




