নীলাদ্রী সেনগুপ্ত
১
রুদ্র বসুর চোখে নদিয়ার এই ছোট্ট গ্রামটা ছিল শুধু আরেকটা বিনিয়োগের জায়গা, অথচ আজ যখন সে ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে পুরনো তাঁতকলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার বুকের ভেতর যেন কিছু একটা গুমরে ওঠে। শহরের কোলাহল, ব্যস্ত কর্পোরেট দুনিয়া আর অবিরাম ডেডলাইনের জীবন থেকে বেরিয়ে রুদ্র এবার নিজের মতো করে কিছু শুরু করতে চায়—নিজের তৈরি কিছু, নিজের সিদ্ধান্তে। তাই তো সে কিনে নিয়েছে এই বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে থাকা, ধুলো-জমা এক তাঁতকল, যেটার ইটের গায়ে এখনও পুরোনো মসৃণতা আর গুমোট ঘামের গন্ধ লেগে আছে। কলের কেয়ারটেকার, বৃদ্ধ মদন, তাকে চাবি তুলে দেয় এক কথাও না বলে—শুধু একবার চোখে চোখ রাখে, যেন বলতে চায়, “খেয়াল রেখো, ছেলেমানুষি কোরো না।” সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, যে কথাটা মুখে বলা হয়নি, সেটাই যেন চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। রুদ্র অবশ্য হেসে এড়িয়ে যায়, পুরনো গ্রামের ভয়ভীতি, অপপ্রচারে তার বিশ্বাস নেই। সে চাবি হাতে নেয়, দরজা খোলে, আর নিজের চোখে দেখতে পায়—এক সময়ের গর্জন করা তাঁতের ঘর এখন মৃত, কেবল একটা ঘন নিঃশ্বাসের মতো স্তব্ধতা সেখানে জমে আছে।
ঘরের ভেতরে পা রাখা মাত্র তার মনে হয় যেন কেউ একটু আগেই উঠে গেছে এখান থেকে—তাঁতের চাকার পাশে পড়ে থাকা কাঠের ফ্রেমে ধুলো জমলেও কোথাও কোথাও সেটা যেন ঘষা লেগে কমে গেছে। জানালা গুলো খোলা, তবে বাতাস নেই, কেবল নিঃস্পন্দ নির্জনতা। রুদ্র ধীরে ধীরে ঘর পরিদর্শন করে, কলের ইঞ্জিনের জায়গায় একটা ছোটো ঘর দেখে যেখানে নানান ধরনের পুরনো তাঁত-ফ্রেম, সুতোয় বাঁধা লতানো কাঠামো, আর এক কোণে জীর্ণ একটা চেয়ার পড়ে আছে। এমন সময় তার চোখ পড়ে দেয়ালে টাঙানো একটি সাদা কাপড়ের ওপর ছাপানো হাতের ছাপের মতো লালচে দাগের ওপর, যেন কেউ একসময় রক্তমাখা হাতে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সে নিজেকে যুক্তিবাদী ভেবে চোখ সরিয়ে নেয়, ভাবে, “আবেগ নয়, কাজে মন দাও।” সন্ধে গড়াতে গড়াতে সে পুরো জায়গা পরিষ্কার করার পরিকল্পনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, মদনের কাছ থেকে কিছু লোকজন জোগাড় করতে বলে, আর গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে সে খেয়াল করে, চারপাশে কিছু অদ্ভুত চোখে তাকানো মানুষ। যেন তারা চায় কিছু বলতে, আবার চায় না—তাদের চোখে হাওয়া ও ইতিহাস মিশে এক অদ্ভুত সংকেত দিয়ে যায়।
রাত ৯টা নাগাদ সে ফিরে আসে তাঁতঘরে, ক্লান্ত শরীরে জল খেয়ে বিশ্রাম নেয় এক কোণার ছোটো কাঠের খাটে। চারপাশে নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজও অচেনা ঠেকে। বিদ্যুৎ নেই, তাই সে একটা পুরনো হারিকেন জ্বালায়। রাত বাড়তে থাকে, ঘুম ধরা চোখের পাতায় ভর দেয়। হঠাৎ, রাত তিনটার একটু পরেই, ঘরের নিস্তব্ধতায় কেঁপে ওঠে এক অদ্ভুত শব্দ—ক্লিক, ক্লাক, ঘড়ঘড়… যেন কোথাও কোনও পুরনো যন্ত্র আবার চালু হয়েছে। রুদ্র চমকে ওঠে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে—ঠিক ৩:০৩। সে উঠে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন হাতে ঘরের ভেতর হাঁটে, আর তার কানে আসে—তাঁতের চাকার ঘূর্ণনের টানা শব্দ, একঘেয়ে, মন্ত্রমুগ্ধ করার মতো। অথচ ঘরে কেউ নেই, কোন লোক নেই, কোন বাতাস নেই—কিন্তু চাকা চলছে। সে তাকিয়ে দেখে, এক কোণে সেই পুরনো তাঁতের কাঠামো একটু একটু করে নড়ে উঠছে, যেন অদৃশ্য কোনও হাত চালাচ্ছে তাকে। মুহূর্তেই চাকা থেমে যায়, সব শব্দ বন্ধ। কিন্তু রুদ্র জানে—ওটা সে কল্পনা করেনি। কারণ তার হাত তখনও কাঁপছে, আর কানের ভেতর চাকার শব্দটা ঘুরছে। কিছু একটা ঠিক নেই এই তাঁতের ঘরে, এবং সে অনুভব করে—এই বিনিয়োগ শুধু টাকা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কিছু যা অঙ্কে ধরা যায় না। সেই রাতে রুদ্র প্রথমবার ভাবে—এই চাবির সঙ্গে সে শুধু একটি ঘরের দায়িত্ব নেয়নি, নিয়েছে এক গোপন অভিশাপের দোরগোড়ায় পা রাখার সাহসও।
২
রুদ্র সারারাত ঘুমোতে পারেনি। চোখ বুজলেই তাঁতের চাকা ঘোরার শব্দ তার কানে ঘুরে ফিরে আসে, মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে বাজতে থাকে। ভোরবেলায় বাইরে গিয়ে চা বানাতে গিয়ে দেখে, চারপাশে গাঢ় কুয়াশা নেমে এসেছে। গ্রামের দিকে চোখ গেলে দেখতে পায়—একটা ধুতি পরা বৃদ্ধ কুঁকড়ে যাওয়া মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটা খেজুর গাছের পাশ থেকে। রুদ্র কিছু বলতে যাবার আগেই সে উল্টোদিকে চলে যায়, যেন দেখা হয়ে যাওয়া এক অমঙ্গলের মতো তাকে এড়িয়ে গেল। সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, “পুরোনো জায়গা, পুরোনো মানুষ, অদ্ভুত ভাবনা”—কিন্তু মনের ভিতর ভয় নয়, বরং কৌতূহল বাড়তে থাকে। সে ঠিক করে, আজই সে কলের ইতিহাস জানবে, গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলবে। তাই দুপুরের দিকে সে বাজারের রাস্তায় হেঁটে যায়, আর এক চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় যেখানে কয়েকজন স্থানীয় মানুষ চুপচাপ বসে আছে। তাদের মধ্যে একজনকে সে চিনে ফেলে—বিষ্ণুপদ পাল, যিনি আগে এই তাঁতঘরেই কাজ করতেন বলে মদন তাকে জানিয়েছিল।
রুদ্র সামনে গিয়ে কথা বলতেই বিষ্ণুপদ যেন একটু চমকে ওঠে। সে কথা ঘুরিয়ে দেয়, বলে, “তিনে বাজে হাওয়া তো কত জায়গাতেই চলে, কি আর এমন?” কিন্তু রুদ্র যখন চেপে ধরে—“আপনি তো জানেন এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক হয়”—তখন বিষ্ণুপদ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ওইসব কথা ভুলে যান বাবু, কাজের কথা ভাবুন।” এরপর আর কেউ কিছু বলে না। ফিরে আসার পথে রুদ্র হঠাৎ এক জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধাকে দেখে—সে চোখেমুখে রহস্যময় অভিব্যক্তি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকায়। এগিয়ে গিয়ে রুদ্র জানতে চায়, “আপনি কি জানেন, ওই ঘর নিয়ে কিছু?” বৃদ্ধা মুখে হাত দিয়ে বলে, “তুই ওই ঘরে রাতে থাকিস, তোর সাহস আছে, তাই বলি—ওখানে কারা ছিল, সেটা জানিস না। যারা জানত, তারা চুপ করে আছে। তোদের শহরের ছেলেরা বিশ্বাস করবে না, তাই মুখ বন্ধ।” রুদ্র আশ্চর্য হয়, “আপনি কে?” উত্তর আসে, “গৌরী—গৌরী মা বলে ডাকত সবাই। এই ঘরের অনেক ইতিহাস জানি আমি। কিন্তু সব একদিনে বোঝা যায় না।” তারপর সে নেমে যায় তার পেছনের দাওয়ায়, দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
রুদ্র সন্ধ্যাবেলায় আবার তাঁতের ঘরে ফিরে আসে, সঙ্গে একটা ছোট রেকর্ডার ও তার মোবাইল ক্যামেরা সেট করে দেয় ঘরের এক কোণে। সে ঠিক করে আজ আবার শব্দ এলে সে প্রমাণ রাখবে। সে হারিকেন জ্বালিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। চারদিক স্তব্ধ, যেন পুরো ঘর নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে। সময় এগোয়—একটা, দুটো… তারপর ঠিক তিনটা বেজে যায়, এবং কিছুক্ষণ পরে সেই পরিচিত শব্দ আবার ভেসে আসে—ঘড়ঘড়, ক্লিক, ক্লাক। চাকা আবার ঘুরতে শুরু করে, এবার যেন একটু জোরে। রুদ্র উঠে বসে, ধীরে ধীরে উঠে ক্যামেরার দিকে তাকায়—এবার সে নিজের চোখে দেখে, আলোছায়ার মাঝে চাকার সামনে দিয়ে হঠাৎ এক নারীমূর্তি হেঁটে যায়, ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট, কিন্তু রক্তলাল শাড়ির আঁচল তার পেছনে টেনে নিয়ে যায় চাকার দিকে। রুদ্র মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে, আর ঘরের তাপমাত্রা যেন আচমকাই নেমে যায়। চাকা ঘুরে আবার থেমে যায়, আর চারপাশে নেমে আসে ভীষণ নিস্তব্ধতা। সে তখন আর ভয় পায় না—সে জানে, ভয়কে দমিয়ে রাখতে হবে, কারণ কিছু একটা নিশ্চিতভাবে লুকিয়ে আছে এই তাঁতের ঘরের ভেতরে। পরদিন সকালেই সে ক্যামেরা ও রেকর্ডার নিয়ে বসে, এবং বুঝতে পারে—এই রহস্যকে খোলা ছাড়া তার পক্ষে শান্ত থাকা সম্ভব নয়। এইবার সে খুঁজবে অতীত, খুঁজবে ভ্রমর নামের সেই নারীর ইতিহাস, যার ছায়া আজও ঘোরে রাত তিনটায় তাঁতের চাকার চারপাশে।
৩
রুদ্রর ভেতরে এখন আর শুধু কৌতূহল নেই, এক ধরনের দায়িত্ববোধ জন্ম নিয়েছে। সে জানে, রাত তিনটার সেই অদৃশ্য তাঁতচালক শুধু অতীতের কোনো ক্ষত নয়, সেটা এখনো জীবিত—প্রেতস্মৃতি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার নতুন ক্রয়কৃত ঘরের প্রত্যেকটা ইঁট, কাঠ, আর সুতোয়। সেইদিন সকালে সে ক্যামেরার ফুটেজ বারবার দেখে, ফ্রেম-বাই-ফ্রেম। এক জায়গায় লাল শাড়ির পেছনে একটা মুখ উঠে আসে—অস্পষ্ট, তবুও চোখদুটো যেন তাকে সোজাসুজি চেয়ে দেখছে, যেন জানে সে কে। রুদ্র একসময় দাঁড়িয়ে পড়ে আয়নার সামনে, নিজের চোখে তাকিয়ে বলে, “তুই কি ভয় পাচ্ছিস? নাকি সত্যিটাকে জানার সাহস জন্মাচ্ছে?” দুপুরে সে মদনের কাছে যায়, জিজ্ঞেস করে, “ভ্রমর দাসী নামটা শুনেছেন?” মদনের মুখ থমকে যায়, সে চুপ করে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “শোনেছি, তুই শুনে কী করবি বাবু? যারা বেশি জানে, তারা বেশি পুড়ে যায়।” কিন্তু এবার রুদ্র থামার লোক নয়। সে গৌরী মার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়—দরজা খোলাই ছিল, যেন সে অপেক্ষা করছিল।
গৌরী মা এক কাপ জল এগিয়ে দিয়ে বলে, “ভ্রমর ছিল এই গ্রামের মেয়ে, তার স্বামী ছিল এক নম্বর তাঁত মিস্ত্রি। কিন্তু তার কপাল ভালো ছিল না, রে। লোকটা খুব পরিশ্রম করত, কিন্তু একদিন মারা গেল হঠাৎ করে ওই তাঁতের ঘরেই—কারেন্ট লেগে বলেছিল সবাই, কিন্তু আমি জানতাম সে খুন হয়েছিল। আর সেই রাত থেকেই ভ্রমরের চোখ বদলে গেল, সে কারো সঙ্গে কথা বলত না, ছাদে বসে চাঁদ দেখতে দেখতে মন্ত্র জপত। এক সময় মানুষ বলতে লাগল, ও ডাইনী। তারপর একদিন ওর ঘরেই আগুন লেগে গেল। ওর শরীরের ছাই খুঁজে পাওয়া যায়নি রে, শুধু একটা ছাইমাখা শাড়ির টুকরো মেলে।” রুদ্র বিস্ময়ে শোনে, ধীরে ধীরে যেন সে পা রাখছে এক অতীতের অভিশপ্ত ধুলোয় মোড়া পথের দিকে। সে জানতে চায়, “কিন্তু তাঁর আত্মা কেন এখনও আছে?” গৌরী মা ধীরে মাথা নাড়ে, “কারণ তার অভিশাপ সম্পূর্ণ হয়নি। সে বলেছিল—‘আমি ফিরবো, যেদিন আবার কেউ এই তাঁতের ঘরে আগুন জ্বালাবে।’ তুই কি জানিস, তোর হারিকেনের আলোতেই সে ফিরেছে?”
রুদ্র সেই রাতে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ফেরে—ক্যামেরার সঙ্গে এবার সাউন্ড সেন্সর, ইনফ্রারেড সেন্সরও লাগায়। সে ঘরের এক কোণায় একটা পুরনো আয়না পায়, পেছনটা কিছুটা পঁচে গেছে, কিন্তু ফ্রেমে আঁকা কিছু দাগ তার চোখে পড়ে—চক্রাকার এক তান্ত্রিক চিহ্ন, যেটা সে গুগলে খুঁজে পায়—‘শমন বৃত্ত’। এই চিহ্ন মূলত আত্মাকে বন্ধ করে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। সে বুঝে যায়, এই ঘর শুধু তাঁতের কল ছিল না, ছিল এক তন্ত্রকক্ষ। রাত তিনটার জন্য সে বসে থাকে ঘরের মাঝখানে। আর ঠিক সময়মতো চাকা চলতে শুরু করে, এবার আরও স্পষ্ট—তাঁতের শব্দের সঙ্গে একটা স্ত্রীর গলার মৃদু গান মিশে যায়, যেন কোনও নারী আপন মনে কাজ করতে করতে গাইছে। রুদ্র বোঝে, সে কেবল ছায়া নয়, উপস্থিত এক প্রাচীন আত্মার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর তখনই আয়নার ফ্রেমটা হঠাৎ নিজে নিজে কেঁপে ওঠে, এবং সেই আয়নায় দেখা যায়—রুদ্রর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই লাল শাড়ি পরা নারী, চোখে গভীর কষ্ট আর রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রুদ্র চমকে পেছনে তাকায়—কেউ নেই। কিন্তু সে জানে—সে ফিরে এসেছে। সেই ভ্রমর দাসী, যাকে সময় ও সমাজ একসাথে পুড়িয়ে ফেলেছিল, সে এখন তাঁতের শব্দে, সুতোয়, আয়নায়—আর রুদ্রর নিঃশ্বাসের ভিতর বেঁচে আছে।
৪
পরদিন সকালবেলায় ঘুম ভাঙতেই রুদ্রর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে—তার কাঁধের ওপর সেদিন রাতে অনুভব করা ঠান্ডা স্পর্শটা কি কেবল ভয় ছিল, নাকি সত্যিই কেউ ছিল পেছনে? সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে তাকায়, আর আগের রাতে আয়নায় দেখা নারীর সেই মুখ মনে পড়ে—রাগে, কষ্টে ও অভিমানে মিশে থাকা এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সে সেদিন এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়েছিল, কিন্তু এখন সেই ভয়টা রূপ নিচ্ছে অন্য কিছুর—এক ধরনের টান, এক অজানা দায়িত্বের দিকে। সে একখানা খাতা খুলে লেখে, “ভ্রমর দাসী—তাঁতের ঘর—রাত তিনটে—আত্মা কি শুধুই ভয়, না তা অভিমান?” সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সে গ্রামের পুরনো রেকর্ড খোঁজে, পঞ্চায়েত অফিসে যায়, এমনকি গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের পাশে থাকা নথির ঘরেও যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক পুরনো খাতায় পায় একটা তালিকা—১৯৮৪ সালে মৃত্যুবরণকারী কিছু ব্যক্তির নাম লেখা আছে, তাদের মধ্যে একটি নাম আলাদা করে দাগানো—ভ্রমর দাসী (বয়স ৪৩), মৃত্যু কারণ: দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিদগ্ধ। কিন্তু পাশে ছোট অক্ষরে লেখা—“দেহ উদ্ধার হয়নি, মৃত ঘোষিত সামাজিক সহিংসতার কারণে।” রুদ্রর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায়। সে বুঝে নেয়, এ মৃত্যু শুধু মৃত্যু নয়, এটা ছিল এক রকমের নিষ্ঠুরতার বিচারহীন সমাপ্তি।
ফিরে এসে রুদ্র চা খেতে বসে আবার বিষ্ণুপদর দোকানে যায়। এবার বিষ্ণুপদর মুখে চাপা অসহায়তা দেখা যায়, সে আর কথা ঘোরাতে পারে না। চাপ দিয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে মুখ খোলে, “ভ্রমর দাসী এক সময় এই গ্রামের নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, স্বামী মারা যাওয়ার পরে সে একা থাকত, কিন্তু সে সহজে ভাঙার মেয়ে ছিল না। কেমন করে যেন সে কিছু তান্ত্রিক চর্চা শিখে নেয়, রাতবিরেতে ঘরের ছাদে ধূপ ধোয়া উঠত, লোকজন ভয় পেতে শুরু করে। সেই সময় কিছু লোক… মানে… আমরাও কিছু বলেছিলাম পেছনে, সমাজে মুখ রক্ষার কথা বলে… ওর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল কেউ, তবে কেউ ধরা পড়ে নি।” বিষ্ণুপদর কণ্ঠ তখন থেমে গেছে, কাঁপছে। সে নিচু গলায় বলে, “আমি তখন কিছু বলিনি, বাবু। কিছু করিনি, শুধু দেখেছিলাম। আজও ঘুম আসে না।” রুদ্র তাকিয়ে থাকে বিষ্ণুপদের দিকে, বোঝে, এই আত্মাটা শুধু প্রতিশোধ নিতে নয়, নিজের অপমান, অস্বীকৃত ব্যথা আর বিচারের অভাবে আটকে আছে। সে উঠে দাঁড়ায়, মনে মনে ঠিক করে—এই প্রেতার জন্য, এই ভুলে যাওয়া নারীর জন্য সে এক শেষ সুযোগ তৈরি করবে, যাতে কেউ অন্তত বলে—“ভ্রমর, তোমার গল্পটা আমরা শুনেছি।”
রাত্রি নেমে আসে ধীরে ধীরে। এবার রুদ্র ঘরে ফিরে আসে এক নতুন মনোভাব নিয়ে। সে একটি সুতোয় লাল কাপড় বেঁধে ঘরের মাঝখানে টাঙিয়ে রাখে—একটা আহ্বানের প্রতীক হিসেবে। আয়নার সামনে সে বসে, হাতের কাছে রেকর্ডার, ক্যামেরা আর একটি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেয়। ঘড়িতে যখন ৩:০০ বাজে, তখন আবার সেই শব্দ ওঠে, কিন্তু এবার তার সঙ্গে শোনা যায় পায়ের চলার ধ্বনি, যেন কেউ ধীরে ধীরে তাঁতের ফ্রেম ছুঁয়ে হাঁটছে। হঠাৎ করেই রুদ্র দেখে, টাঙানো লাল কাপড়টা নিজে নিজেই দুলে উঠছে—না, বাতাসের কারণে নয়, সেটা এমনভাবে ওঠানামা করছে যেন কেউ সেটা আলতো করে ছুঁয়ে দেখছে। রুদ্র চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি যদি কিছু বলতে চাও, বলো, আমি শুনছি।” এরপর কিছু সময় স্তব্ধতা, তারপর খুব মৃদু নারীকণ্ঠে ভেসে আসে—“তাঁত চালানোর শব্দটাই তো আমার পরিচয়, তাও তোমরা আমায় পুড়িয়ে দিলে।” রুদ্র চমকে ওঠে, কিন্তু সে জানে, সে পালাবে না। এই আত্মা তার প্রতিকারের আশায় ফিরে এসেছে, ভয় দেখাতে নয়। সে ধীরে ধীরে বলে, “তুমি চাইলে আমি তোমার নাম ফিরিয়ে আনবো, তোমার সত্যি জানাবো সকলকে।” তার কণ্ঠে নির্ভরতা জাগে, ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়, আর ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। কিন্তু ঠিক যাওয়ার আগমুহূর্তে আয়নায় একটা চিহ্ন পড়ে—আঙুল দিয়ে আঁকা, যেন কেউ লিখে গেছে ‘এখনও কেউ বাকি’। রুদ্র বুঝে যায়, শুধু সত্যি জানানো নয়, কাউকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে—যে এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু নিজের অতীতের ছায়া এড়িয়ে যাচ্ছে। তার সামনে এবার নতুন লক্ষ্য—ভ্রমরের মৃত্যুর দিন কারা ছিল, আর কারা নীরব থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিল। এখন সেই নীরবতাকেই ভাঙতে হবে।
৫
রাত গভীর হতেই ঋত্বিক আবার সেই তাঁতের ঘরে ফিরে এল, lantern-এর আলোকছায়ায় তার চোখে পড়ল তাঁতের চাকার ছায়া—নড়ছে, যেন কাউকে অপেক্ষা করছিল। সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘরের মাঝখানে, দরজার পাশের প্রাচীন কাঠের খাঁজে হাত রেখে অপেক্ষা করতে থাকল। হঠাৎ ঘরের কোণে একটা চেনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—চন্দনের সঙ্গে কিছু পুড়ে যাওয়া তুলোর ধোঁয়া। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, তাঁতের চাকার পেছনে এক ঝলক দেখে ফেলল ঋত্বিক—লাল শাড়ি পরা এক নারী, মুখ আড়ালে, চুল খোলা, যিনি ধীরে ধীরে তাঁতের সুতোয় আঙুল বুলিয়ে চলেছেন। ঋত্বিকের শরীর জমে গেল। ভয় আর কৌতূহলের এই দ্বৈত টানাপোড়েনে সে কেবল দেখেই যাচ্ছিল, কথা বলতে পারছিল না। তান্ত্রিকীর চোখ তার চোখের দিকে ঘুরে এলো, কিন্তু যেন কুয়াশার আড়াল থেকে—একটা চোরা টান অনুভব করল সে, বুকের গভীর থেকে একটা গলা বলে উঠল, “তুমি আমার তাঁতের ঘর কেন নিয়েছ?” তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো সে শুধু বলল, “আমি কিছু জানতাম না… কে তুমি?” তান্ত্রিকীর কণ্ঠে রুদ্ধ শ্বাস, “আমি গায়ত্রী… এই তাঁতের অভিশাপ আমার রক্ত দিয়ে বাঁধা… তুমি যদি খুলে ফেলো, তোমারও দেহ খুঁজে পাবে না কেউ।”
পরদিন সকালে, ঋত্বিক জেগে উঠল চাদর পেছানো অবস্থায়, ঠিক তাঁতের চাকার পাশে। রাত্রে যা দেখেছিল তা স্বপ্ন না বাস্তব, বোঝার উপায় নেই, কিন্তু তার ডান হাতের কাঁধে স্পষ্ট আগুনে পুড়েছে এমন দাগ। নীলিমা ওর ক্ষত দেখে আঁতকে উঠল, বলল, “এভাবে গেলে তুই মরবি একদিন… চল পুরুতের কাছে নিয়ে যাই।” কিন্তু ঋত্বিক চাইল না—সে এবার নিজেই ঠিক করল নদিয়ার প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহশালায় যাবে। সেখানকার লাইব্রেরির এক কোনায় dusty পুরোনো দলিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সন্ধে নামল, কিন্তু সে পেয়ে গেল একটা চিঠির মতো দলিল, যেখানে লেখা—“গায়ত্রী বসু, নদিয়ার গোপালপুরের একজন তান্ত্রিকী তাঁতশিল্পী, যাকে সমাজ বশীকরণ ও মৃত্যুকৌশলে পারদর্শী হিসেবে ভয় পেত। ১৮৮৬ সালে তিনি নিজেই তাঁতের ঘরে আত্মাহুতি দেন, বলেন—যদি কেউ তাঁতের কাজে হস্তক্ষেপ করে, তার জীবন তাঁতের সুতোয় গাঁথা হবে…” ঋত্বিক দলিলটা পড়ে কেঁপে উঠল। গায়ত্রী তার তাঁতের ঘর ছাড়বে না—এখন এটা স্পষ্ট।
রাত নামতেই ঋত্বিক আবার ঘরে ফিরে এসে গায়ত্রীকে ডাকল—“আমি তোর তাঁতের কাজে কিছু করিনি… আমি শুধু কাজ চালাচ্ছিলাম।” কুয়াশার মতো সেই একই লাল শাড়ির ঝলক দেখা গেল, এবার একটু দূর থেকে। তান্ত্রিকী গায়ত্রী ধীরে ধীরে সামনে এল, এবং তার চোখে এবার আর রাগ নেই—ছিল বিস্ময় আর কষ্ট। “তুই যদি তাঁতের ঘর চালাস, তবে আমার নিয়মে চলতে হবে… রক্ত ছাড়া সুতো চলবে না… প্রতি পূর্ণিমায় কেউ না কেউ তাঁতের কাছে আত্মাহুতি দেবে।” ঋত্বিক হতবাক, তার মুখ শুকিয়ে এল—সে বলল, “আমি কি এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারি না?” গায়ত্রী মাথা নাড়ল, “তুই যদি জানতে পারিস আমার মৃত্যুর আসল কারণ… তবে হয়তো…” আর কিছু না বলে তান্ত্রিকী মিলিয়ে গেল আবার সেই ধোঁয়ার ছায়ায়। ঋত্বিক বুঝে গেল, তাঁতের ঘর শুধুই ব্যবসার জায়গা নয়, এটা একটা মৃত অতীতের জীবন্ত রক্তমাখা দিনলিপি—আর সে এখন তারই একটি পাতা।
৬
অমাবস্যার রাত যেন নদিয়ার তাঁতশিল্পগ্রামে গা ছমছমে একটা কুয়াশা নামিয়ে এনেছে। সেই রাতে দেবজ্যোতি আবার তাঁতের ঘরের দিকে এগোয়, সঙ্গে থাকে কেবল একটা টর্চ। সারা গ্রাম নিঃশব্দ, কেবল তার পায়ের আওয়াজ আর মাঝেমধ্যে দূর থেকে আসা শিয়ালের ডাক। ঘরের দরজাটা খোলা, ভেতরে ঢুকেই টর্চের আলো ফেলতেই সে দেখতে পায়—তাঁতের চাকার কাছে মাটিতে বসে এক মহিলা, তার মাথায় লাল শাড়ির আঁচল, হাতে তান্ত্রিকের চিহ্ন আঁকা একটা তাবিজ আর সামনে ছড়ানো কিছু পুরনো কাঠের পুতুল। প্রথমে সে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু সাহস করে এগিয়ে যায় আর বলে—“আপনি কে?”—কোনো উত্তর নেই, হঠাৎই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায় সেই অবয়ব। মাটিতে শুধু থেকে যায় একটা পুরনো চিঠি, যাতে লেখা, “আমি রঞ্জবতী, এই ঘরের চাকা আমি চালাতাম যখন আমি বেঁচে ছিলাম… আমার কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।”
পরদিন সকালে দেবজ্যোতি সেই চিঠি আর তাবিজ নিয়ে যায় গ্রামের পুরনো ওঝা রামপ্রসাদ ঠাকুরের কাছে। রামপ্রসাদ চিঠিটা পড়ে মুখে একগাল হালকা হাসি ফুটিয়ে বলে, “রঞ্জবতী ছিলেন এই গ্রামের শ্রেষ্ঠ তাঁতিন। কিন্তু তিনি শুধু কাপড় বুনতেন না—তিনি মন্ত্র জপ করে, তাঁতের সুতোয় শক্তি প্রবাহিত করতেন। তাঁর কাপড় নাকি কারো গায়ে পরলেই তার শরীর আর মন উজ্জ্বল হয়ে উঠত। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ বলত, তিনি বনবাস নিয়েছেন, কেউ বলত, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।” রামপ্রসাদ দেবজ্যোতিকে বলে, “তুই যদি সত্যিই জানতে চাস কী ঘটেছিল, তবে আজ রাতে তাঁতের ঘরে দাঁড়িয়ে রঞ্জবতীর নাম ধরে ডাকিস। যদি সে চায়, সে ফিরে আসবে।” দেবজ্যোতির ভেতর এক অদ্ভুত কৌতূহল কাজ করে, আর সে ঠিক করে, এই রাতে সে রঞ্জবতীকে ডাকবে।
রাত তিনটে বাজে। আকাশে চাঁদ নেই, কুয়াশা জমে উঠেছে জানলার কাচে। দেবজ্যোতি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “রঞ্জবতী… আমি সত্য জানতে চাই। তুমি এসো।” প্রথমে কিছুই ঘটে না। তারপর হঠাৎ তাঁতের চাকা নিজে থেকেই ঘুরতে শুরু করে, আর বাতাসের মাঝে এক হালকা সুর ভেসে ওঠে, যেন কেউ গুনগুন করে গান গাইছে। ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণ থেকে ধোঁয়ার মতো একটা রক্তচাপার অবয়ব তৈরি হয়। সেই অবয়ব এক মহিলা, তার চোখে করুণ বিষাদ, মুখে এক অপূর্ণ গল্পের ছায়া। “তুমি কি জানতে চাও কেন আমি আজও এই ঘরে ঘুরি?”—তার কণ্ঠ যেন বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দেবজ্যোতি বলে, “হ্যাঁ, বলো, আমি জানতে চাই।” রঞ্জবতী এগিয়ে আসে, একদম চাকার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “আমার কাজ ছিল শেষ কাপড়টা বোনা—যেখানে আমি বাঁধতে চেয়েছিলাম এক মন্ত্র—যাতে এই গ্রামের তাঁতের গৌরব চিরকাল অটুট থাকে। কিন্তু সে কাজ আমি শেষ করতে পারিনি—কারণ আমি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলাম।” শব্দগুলো দেবজ্যোতির বুক কাঁপিয়ে তোলে, কারণ সে বুঝতে পারে—এই তাঁতের চাকার পেছনে আছে এক অভিশপ্ত ইতিহাস, যার জাল ছিন্ন না হলে রঞ্জবতী কখনও মুক্তি পাবে না।
৭
আকাশের রঙটা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল প্রতিদিন রাতে, আর অর্ণবের চোখে এখন আর নিছক ভয়ের ছায়া নেই—ছিল জেদ, ছিল একরকম মিশ্র মোহ আর আশঙ্কা। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এই তাঁতের ঘরের রহস্য শুধুমাত্র এক অলৌকিক কান্ডে সীমাবদ্ধ নয়—এ যেন এক প্রাচীন অভিশাপ, এক নারীর ক্ষোভ, এক অপ্রাপ্ত প্রেমের দীর্ঘশ্বাস যা তাঁতের সুতোয় আজও লেগে আছে। সেই রাতেও, নির্ধারিত সময়, ৩টা বাজতেই তাঁতের ঘর আবার জেগে উঠল। অর্ণব, আগেভাগেই প্রস্তুত, কাঁধে ফ্যাকাশে সবুজ শাল চাপিয়ে, হাতে সেই পুরনো তামার তাবিজ আর শিকল—ঘরে ঢুকল নিঃশব্দে। কিন্তু এবার পরিবেশটা অন্যরকম; এবার মাটিতে ফুলের গন্ধ, বুনো চন্দনের মতো গন্ধ আর ঘরের মাঝখানে উল্কির মতো আলো। আর সেই আলোতে দাঁড়িয়ে এক নারী—দীর্ঘ ঘন কালো চুল, তামাটে গায়ের রং, চোখে অগ্নি আর বিষাদের মিলন।
নারী বলল না কিছু, তবে তার চোখের ভাষা যেন হাজার কথার চেয়েও গভীর। অর্ণব চুপ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে, আর হঠাৎই চারপাশের তাঁতের চাকা ঘুরতে ঘুরতে যেন এক কোরাস সুরে বাজতে লাগল—তা কোনও প্রাচীন শ্লোক, না পুরনো নিঃশব্দ আহ্বান—বোঝা যাচ্ছিল না। নারীর ঠোঁটে তখন এক হালকা হাসি, যেন সে দীর্ঘদিন পরে কাউকে পেয়ে অবাক নয়, কেবল স্বস্তি পেয়েছে। সে এক পা এগিয়ে এসে অর্ণবের হাতে ছুঁয়ে দিল—তার স্পর্শে যেন তীব্র শীত আর অতল গ্রীষ্ম মিশে ছিল, অর্ণব কেঁপে উঠল, আর তারপর নারী বলল তার নাম—‘ঈশানা’। এই প্রথম, নামটা উচ্চারণ হতেই ঘরের দেয়ালগুলো যেন সাড়া দিয়ে উঠল, তাঁতের সুতো কাঁপতে লাগল, আর এক টুকরো হাওয়া ভেতর থেকে বাইরে ছুটে গেল। ঈশানা জানাল, সে এক সময় এই ঘরেরই কারিগর ছিল, কিন্তু সমাজ তাকে মেনে নেয়নি তার সাধনার জন্য।
তিনি ছিলেন তন্ত্রসাধিকা, ভালবাসতেন তাঁতের নকশায় প্রাচীন মুদ্রা আর মন্ত্র জুড়ে দিতে, যার ফলে কাপড়ে তৈরি হতো এক ধরণের প্রতিরক্ষা, এক আশীর্বাদ। কিন্তু লোভী জমিদাররা একে কালো বিদ্যা বলে সমাজ থেকে একঘরে করে দেয় তাকে, পুড়িয়ে দেয় তার তাঁত, বন্ধ করে দেয় তার ঘর। ঈশানা অভিশাপ দিয়ে অদৃশ্য হয়, আর এই ঘর হয়ে ওঠে তার সত্তার শেষ অবশিষ্ট আশ্রয়। কিন্তু অর্ণবের আগমন যেন সেই অভিশপ্ত সুতোয় নতুন বাতাস এনেছে। ঈশানা বলল, “যদি তুমি সত্যি বিশ্বাস কর, তবে আমার তাঁতের শেষ নকশা সম্পূর্ণ করো—তা হলেই আমি মুক্তি পাব।” অর্ণবের হাতে একটি আধা-তৈরি নকশার কাপড় তুলে দিল সে, যেটা স্পর্শ করতেই অর্ণবের চোখের সামনে এক মুহূর্তে ভেসে উঠল শত বছর পুরনো ঈশানার জীবন, তার প্রতিটি কষ্ট, প্রতিটি স্বপ্ন, আর সেই অসমাপ্ত তাঁতের ছন্দ।
৮
রাত তিনটে বাজে। বাইরে নদিয়ার আকাশে অচেনা ঝাপসা জ্যোৎস্না, আর ভিতরে ঘন অন্ধকারে দীপ্তিমান সেই তাঁতের ঘর, যেন আলো নিজের ইচ্ছেতে ঠিক ওই সময়েই জ্বলে ওঠে। অনির্বাণ এবার আগেই ঘরে ঢুকে এক কোনায় লুকিয়ে ছিল, কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যামেরা আর তামার তাবিজ আঁকড়ে। হঠাৎই আবার সেই আওয়াজ—চাকা ঘোরার, সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার, কাঠের কড়চড় শব্দ—সবকিছু যেন সময়ের নিয়মে চলতে থাকে। অনির্বাণ ঘামতে ঘামতে ঘরের দিকে তাকায়, আর তখনই দেখল সেই নারীকে—তাঁতের সামনে বসে, লাল জরির শাড়ি গায়ে, চুল এলোমেলো, হাতের নখ লম্বা ও কালো, কিন্তু চোখ দুটি আশ্চর্যরকম দুঃখে পূর্ণ। এবার সে শুধু তাঁত চালাচ্ছে না, যেন কাঁদছে, চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে। অনির্বাণ প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝে যায়, ওই নারী কারো ক্ষতি করতে নয়, বরং কিছুর অপেক্ষায় রয়েছে—হয়তো মুক্তির। সাহস করে অনির্বাণ তাঁকে ডাকে, ‘আপনি কে? কী চাচ্ছেন?’ ঘর হঠাৎ নীরব হয়ে যায়, সময় যেন থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। নারী ধীরে ধীরে তার দিকে তাকায়, ঠোঁট না নেড়ে বলে, “তুই তাকে দেখতে পাস… তুইই পারবি আমাকে মুক্তি দিতে…” সেই কণ্ঠস্বর বাতাসের মধ্যেই, কিন্তু অনির্বাণ স্পষ্ট শুনতে পায়। সে আরও এগিয়ে যায়, তাঁতের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, আর তখনই সে দেখতে পায় একটি পুরনো কাগজের পুঁটলি, যেটি মেঝেতে পড়ে আছে—ভিতরে একটি চিঠি, কিছু চুল, এবং এক প্রাচীন ছবি। নারী ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু ঘরে রেখে যায় সেই পুঁটলিটি—মুক্তির সূত্র হতে পারে এমন কিছু।
সকালে অনির্বাণ সেই পুঁটলি নিয়ে যায় রাধারানী দেবীর কাছে—স্থানীয় একজন তান্ত্রিকা যিনি পুরনো ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কাজ করেন। রাধারানী পুঁটলি খুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন, “এ চিঠি আর চুল ওই নারীটারই… নাম ছিল শান্তিলতা। বহু বছর আগে এই তাঁতঘরে কাজ করত। গোপনে একজন জমিদারের প্রেমে পড়েছিল সে, কিন্তু সেই প্রেম পরিণত হয়নি। একদিন রাতে সে জানলায় বসে তাঁত বুনছিল, ঠিক তিনটেয়, তখনই জমিদারের বউয়ের চক্রান্তে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর আত্মা এখনও এই ঘরেই রয়ে গেছে—সে চায় তার মৃত্যুর সত্য উদঘাটিত হোক।” অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যিই তো, সে প্রথমবার ঘরে ঢোকার সময়ই জানালার পাশে একটা পুড়েছে এমন কাঠের দাগ দেখেছিল, যেটা তখন গুরুত্ব দেয়নি। রাধারানী বলেন, “তাকে মুক্তি দিতে হলে তাঁর মৃত্যুর সত্যটা প্রকাশ করতে হবে—তার নাম, তার ভালোবাসা, এবং তাকে যেভাবে মারা হয়েছিল, সেটা যেন জানে সবাই।” অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নেয় সে সত্যি সামনে আনবেই, এই অভিশপ্ত তাঁতঘরের ইতিহাস লিখে প্রকাশ করবে—যে ইতিহাস কখনও কেউ জানেনি।
অনির্বাণ সেই রাতেই ফের তাঁতঘরে ফিরে আসে, ক্যামেরা আর কলম নিয়ে। সে শান্তিলতার স্মৃতি, তার প্রেম, এবং তার মৃত্যুর যন্ত্রণার প্রতিটি অংশ লিখে ফেলে ঘরের দেওয়ালে, লাল কালি দিয়ে। ঠিক তিনটে বাজে, আরেকবার সেই আওয়াজ—কিন্তু এবার শান্ত, যেন কোনো ব্যথাহীন রেওয়াজ। সে আবার তাকে দেখতে পায়—এইবার নারী দাঁড়িয়ে, চোখে শান্তি, ঠোঁটে এক হালকা হাসি। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে, “ধন্যবাদ… আমার কথা কেউ শোনেনি, তুই শুনলি… আমি চলি…” এই বলে সে এক ঝলকে মিলিয়ে যায়, এবং সেই মুহূর্তে ঘর অন্ধকার হয়ে আসে, কিন্তু এবার ভয় নেই, বরং এক ধরনের শান্তি। অনির্বাণ জানে, অভিশাপ কেটে গেছে, ইতিহাস তার আলোয় ফিরে এসেছে। সেই তাঁতের চাকা আর চলে না তিনটেয়, কিন্তু ঘরের দেওয়ালে লেখা আছে এক নারীর কাহিনি—তাঁতের ঘরের তান্ত্রিকা।
৯
চাঁদের আলোয় ভিজে থাকা তাঁতের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে জয়ন্তর মনে হচ্ছিল সময় থমকে আছে, ঘড়ির কাঁটা যেন আর এগোচ্ছে না। রাত ঠিক তিনটেয়, আবার সেই শব্দ—চাকা ঘোরার, সুতো কাটা, যেন কারও ব্যস্ত হাতে রাতের অন্ধকারে তৈরি হচ্ছে অদৃশ্য কাপড়। সে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, লণ্ঠনটা এবার বন্ধ রাখল, কারণ আলো জ্বালালে চক্র বন্ধ হয়ে যায়—এটা সে আগেই বুঝেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই দেখে সেই তান্ত্রিকী নারী আবার এসেছে, তাঁর গায়ের লাল শাড়িটা যেন আগুনের আঁচড়, চোখ দুটো পাথরের মত স্থির, আর ঠোঁটে অদ্ভুত মৃদু হাসি। সে চুপচাপ বসে তাঁত বুনছে, কিন্তু এবার জয়ন্ত খেয়াল করে তাঁতটা যেন বদলে গেছে—সুতোয় জড়ানো আছে মানুষের চুল, আর সেই চুলের মাথায় লেগে আছে রক্তের দাগ। সে আতঙ্কে সরে যেতে গিয়েও থমকে গেল, তার মনে হল, এই নারীকে যদি সে এই রাতেই মুখোমুখি না হয়, তবে আর কোনোদিনও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না।
তাঁতের ঘরে ঢুকে জয়ন্ত সরাসরি নারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার গলা শুকিয়ে এলেও সে বলল, “তুমি কে? কেন এই ঘরে রাতের অন্ধকারে ফিরে ফিরে আসো?” নারী তাকাল না, শুধু বলল, “তোমরা কাপড় বোনো শরীর ঢাকার জন্য, আমি বুনি আত্মার জন্য। এই তাঁত ঘরে রক্ত লেগে আছে, অভিশাপ লেগে আছে, তবু তা কেউ দেখতে পায় না, কেউ বিশ্বাস করে না।” জয়ন্ত বলে উঠল, “আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু বিশ্বাস করলেই কি অভিশাপ উঠে যায়?” নারী এবার থেমে তাকাল, তার চোখে দগদগে শূন্যতা, সে বলল, “আমার কথা শেষ হয়নি। আমি ছিলাম এই গ্রামেরই এক তাঁতিনির মেয়ে। রোজ তাঁতের ঘরে বসে কাপড় বুনতাম। একদিন এক ঠগের দল এসে আমাকে বলল, আমার বোনা কাপড় নাকি দেবতাদের উৎসর্গ করার জন্য চাই। আমি আনন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু তারা আমায় ঠকাল। সেই কাপড় দিয়ে তারা রক্তমাখা তান্ত্রিক সাধনা চালাত। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে জীবন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিল এই ঘরেই। আমার আত্মা এখানেই থেকে গেছে, আমি প্রতিটি রাতে তাঁতের চাকা ঘুরিয়ে তাদের ভ্রান্তির রক্ত বুনি।”
জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে শুনছিল, সে বুঝতে পারল, এই অভিশপ্ত নারীর অভিমান আর বেদনার গায়ে যে আগুন, তা নিভিয়ে না দিলে এই তাঁতের ঘর আর শান্ত হবে না। সে বলল, “আমি কি তোমায় মুক্তি দিতে পারি?” নারী হালকা হেসে বলল, “যদি সত্যিই দিতে চাও, তবে আগুন দিয়েই দাও, যেমন তারা আমায় দিয়েছিল। কিন্তু এই আগুন পবিত্র হোক, প্রতিশোধের জন্য নয়, ক্ষমার জন্য।” জয়ন্ত চোখ বুজে মাথা নোয়াল। সে জানত, আগামী রাতে তাঁতের ঘর পুড়বে। কিন্তু সেই পুড়ে যাওয়া কাঠ-সুতো-ছাইয়ের ভিতর থেকেই জন্ম নেবে এক নতুন বোনা—যেখানে অভিশাপ থাকবে না, শুধু থাকবে মানুষের বিশ্বাস আর নারীর আস্থা।
১০
অরিন্দমের বুকের ভেতর ঝড় ওঠে যখন সে শেষ রাতে তাঁতের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিক নিস্তব্ধ, যেন গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে তবু সেই একটানা চাকার শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে—টিক টিক টিক—এক অশরীরী ছন্দে। সে ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভিতরে পা রাখে। কুয়াশার মত এক নীলচে আলো ভাসছিল ঘরের মধ্যে, যেন বাতাসের মধ্যেই একটি অতীন্দ্রিয় উপস্থিতি। সেই আলোয় তাঁতের চাকা আপনমনে ঘুরছে, অথচ ঘরের মধ্যে কেউ নেই। কিন্তু দরজার ওপারে পিছন ঘোরার সময় সে এক ঝলকে দেখে, এক লালপাড় শাড়ি পরা নারী, যার চুল ছড়ানো, যার চোখে পুড়ে যাওয়া ক্রোধ—এক অভিশপ্ত আত্মার ঝলক। অরিন্দম বিস্ময়ে পেছন ফিরে তাকায় কিন্তু সেখানে আর কেউ নেই, কেবল চাকার কাঁপুনি, আর পুরনো কাঠের হালকা গন্ধ। সে নিজেকে স্থির করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়—এই রহস্যের শেষ দেখতে সে পিছপা হবে না। পরদিন সকালে সে গ্রামের বৃদ্ধ পাটিকর ধনঞ্জয়কে খুঁজে পায়, যিনি এক সময় এই তাঁতের ঘরে কাজ করতেন। ধনঞ্জয় একথা শুনে ভয়ে সিঁটকে যান, চোখে পড়ে যায় সেই আতঙ্ক যা কেবল অতীতের অদৃশ্য ঘায়ের কথা মনে পড়লে আসে। ধনঞ্জয় ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলেন—“ওই ঘর তান্ত্রিকী দুর্গার অভিশাপে ছেয়ে গেছে। ও ছিল এক অদ্ভুত মেয়ে, বামাচারী। নিজের সাধনায় লিপ্ত ছিল যখন মালিক তার তাঁতের ঘর ছিনিয়ে নেয়, সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে। কিন্তু তার সাধনা সম্পূর্ণ না হওয়ায় তার আত্মা বাঁধা পড়ে গেছে এই ঘরে। রাত তিনটায়, তান্ত্রিক সাধনার সময়, তার আত্মা জেগে উঠে চাকা চালায়। সে অপেক্ষা করছে সেই মানুষটির জন্য, যে তাকে শেষত সাধনায় মুক্তি দিতে পারবে।” অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে যায়, বুঝে ওঠে—এ এক আত্মার কান্না, না-পাওয়ার কষ্ট, যা এই চাকার শব্দে ধরা দেয় প্রতিরাতে।
তারপরের কয়েক রাত অরিন্দম গভীর মনোযোগে তাঁতের ঘরে বসে থাকে। সে টের পায় সেই নির্দিষ্ট সময়ে শীতল হাওয়া ঘরে ঢোকে, বাতি নিভে যায়, চাকা ঘুরতে থাকে। সে ধীরে ধীরে দুর্গার আত্মার সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করে, চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় সেই মুখ, সেই দৃষ্টি, যা এতকাল ধরে অপেক্ষায় থেকেছে। সে তাঁতের সূতোয় দুর্গার অতীত বুনতে থাকে, একেকটি শাড়িতে ফুটে ওঠে তার দুঃখ, তার সাধনা, তার ক্রোধ। এক রাতে দুর্গা তার কাছে ধরা দেয় সম্পূর্ণ রূপে—সে জানায় যে তার সাধনার কিছু পদক্ষেপ অসমাপ্ত থেকে গেছে এবং তার আত্মা মুক্তি পাবে যদি কেউ তার হয়ে সেই শেষ আচার সম্পন্ন করে। অরিন্দম প্রস্তুতি নেয়—ধনঞ্জয় তাকে শেখায় বামতন্ত্রের কিছু পুরনো নিয়ম, একটি বিশেষ ধূপ, একটি নীল জবা ফুল, এবং তাঁতের এক প্রাচীন শাড়ি যার মধ্যে দুর্গার স্পর্শ ছিল। সেই রাত তিনটায়, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়, অরিন্দম সেই আচার শুরু করে। ঘরজুড়ে ভেসে ওঠে দুর্গার আত্মা, তার চোখে ছিল ক্লান্তি, শান্তি পাওয়ার আকুতি। অরিন্দম তার দিকে এগিয়ে যায়, শাড়ির মধ্য দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে সেই বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে। তখনই ঘরের ভিতর ঘূর্ণি ওঠে, চাকা প্রবল বেগে ঘুরতে থাকে, বাতাস কেঁপে উঠে, আর সেই সঙ্গে এক দীর্ঘ কান্না—যা ছিল মুক্তির কান্না।
পরদিন সকালে ঘরে সব কিছু থেমে যায়। তাঁতের চাকা নিঃশব্দ, ঘর ঠান্ডা, কিন্তু শান্ত। অরিন্দম জানে, সেই আত্মা আজ আর নেই। দুর্গা মুক্তি পেয়েছে, চিরতরে। গ্রামের মানুষ বুঝতে পারে কিছু বদলেছে—ঘর যেন আলো ছড়াচ্ছে, বাতাসে আর ভয়ের গন্ধ নেই। অরিন্দম সেই তাঁতের ঘরে আবার কাজ শুরু করে, দুর্গার স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। সে ‘দুর্গাশ্রী’ নামে একটি তাঁতের ব্র্যান্ড চালু করে, যার প্রতিটি শাড়ি গাঁথা হয় সেই অতৃপ্ত আত্মার গল্প দিয়ে। শহর থেকে লোক আসে, কেনে সেই শাড়ি, কেউ কেউ বলে—এই শাড়ির মাঝে এক আশ্চর্য উষ্ণতা থাকে, যেন কোনও আত্মা আশীর্বাদ জানিয়ে রাখে। অরিন্দম জানে, সে শুধু একটি তাঁতকল নয়, একটি আত্মার যন্ত্রণার শেষ অধ্যায় সম্পূর্ণ করেছে। আর তার জীবনেও যুক্ত হয়েছে এক এমন গল্প, যা রাত তিনটায় চাকা চালায়, এবং চুপিচুপি বলে যায়—মুক্তি তখনই আসে, যখন কেউ অজানা ব্যথা বুঝে তাকে পরিত্রাণ দেয়।
_____