Bangla - সামাজিক গল্প

তবু আমি থাকি

Spread the love

শুভাশিস রায়


পর্ব ১: ঘর, সমাজ আর আমি

স্নিগ্ধা যখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, শহরের কোলাহল তার গায়ে কখনও লাগত না। একসময় যে শহরে সে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, সেই শহরই এখন যেন প্রতিদিন তাকে প্রশ্ন করে—”তুমি এখনো আছো কেন?”

তিন বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা যায় তার স্বামী অভিরূপ। দাম্পত্য ছিল শান্ত, যদিও প্রেমে রঙের চেয়ে দায়িত্বের ছায়া ছিল বেশি। একমাত্র ছেলে রুদ্র তখন মাত্র আট বছরে পা রেখেছে। অভিরূপের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছেলেটার চোখে কোনো প্রশ্ন ছিল না, শুধু একটা স্থির তাকিয়ে থাকা। সেই চাহনি আজও স্নিগ্ধার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে আছে।

দেখতে গেলে সমাজ তাকে দয়া করে রেখেছে। “বিধবা মেয়েদের তো থাকতে হয় সিধে হয়ে। বাচ্চাটা আছে না, সেটাই এখন সব।”—এমন বাক্য বানে প্রতিদিন ঝড় উঠে। অথচ সে কাঁদে না, তর্কও করে না। শুধু কাজ করে যায়—সকাল আটটায় স্কুল, দুপুরে বাজার, বিকেলে পড়ানো, রাতে রুদ্রর পাশে গল্প বলে ঘুম পাড়ানো।

কিন্তু সমাজের বিচার কি এত সরল?

যখন স্কুলে নতুন শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করে রিনা মেম, স্নিগ্ধার জীবনে আরেক গল্প শুরু হয়। রিনা ছিল ঢাকঢোল পিটিয়ে আধুনিক—চুলে হালকা গোলাপি হাইলাইট, মেকআপ করা মুখ, Insta-র পোস্টে বাঁচে। অথচ মেয়েটা সরল, প্রাণোচ্ছল। প্রথম দিনেই স্নিগ্ধাকে বলেছিল, “আপনাকে দেখেই বুঝি আপনি বাঁচতে জানেন না, শুধু টিকে আছেন।”

স্নিগ্ধা হেসেছিল—অন্তত মুখে।

বাড়িতে ফিরে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে বলেছিল, “আমি কি সত্যিই বাঁচছি না?”

তারপর একদিন, পাড়ার বউ-সমিতির এক কাকিমা বললেন, “তোমার বয়স তো বেশি না। আবার বিয়ে করলে দোষ কী?”

স্নিগ্ধা কোনো উত্তর দেয়নি। মুখ ফিরিয়ে শুধু ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল সে কার্টুনে ব্যস্ত। তার মনে হয়েছিল, “বিয়ে করা মানেই কি আরেকবার সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া?”

রাত্রি গভীর হলে, যখন চারপাশ নিঃস্তব্ধ, তখন স্নিগ্ধা নিজের বুকের ভিতরে শুনতে পায় একরাশ প্রশ্ন।

“আমি কার জন্য থাকি? নিজের জন্য, না ছেলের জন্য? না, সমাজের একটা বাক্য মেনে চলার জন্য?”

অফিসে আবার একজন সহকর্মী সম্প্রতি তার প্রতি একটু বেশিই সদয় হচ্ছে। শুভাশীষ নামের সেই মানুষটা নরম গলায় বলে, “আপনার ছেলেকে আমি একদিন নিয়ে যেতে চাই বইমেলাতে।”

স্নিগ্ধা এক মুহূর্তের জন্য চমকে ওঠে।

“এতটা কাছের হয়ে ওঠার অনুমতি কি আমি দিতে পারি?”

তার হৃদয় বলেছিল, “তুমি মানুষ, শুধু মা বা বিধবা নও।”

তবু চারপাশের চোখ যেন বলে, “দাঁড়াও, তুমি কে? তুমি আমাদের নিয়মে চলবে না?”

এইসব ভাবনা আর চুপচাপ কাটানো রাতগুলোতে স্নিগ্ধার ভেতর গড়ে উঠছিল এক নতুন সত্তা—যে না চাইলেও ভাবতে বাধ্য হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে।

তবু সে থাকে—এই শহরে, এই ঘরে, এই সমাজে।

নিজেকে প্রতিদিন একটু একটু করে খুঁজে পেতে পেতে সে বুঝে যাচ্ছে, টিকে থাকা মানেই মরে যাওয়া নয়।

পর্ব ২: চোখের পেছনে কথা

স্নিগ্ধা আজ একটু দেরিতে স্কুলে ঢুকল। দরজায় দাঁড়াতেই সহকারী প্রধান শিক্ষিকা একরাশ ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সব ঠিক তো, স্নিগ্ধা? এমন তো হয় না তোমার সঙ্গে।”

সে হেসে মাথা নাড়ল, “রুদ্রর জ্বর ছিল রাতে, একটু ঝামেলা হয়েছে।”

মিথ্যা।

রুদ্র সুস্থই ছিল।

সত্যি কথা ছিল, স্নিগ্ধা সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিনিট কুড়ি চুপ করে থেকেছিল। নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল আর ভাবছিল, শুভাশীষর বলা কথাটা।

“বইমেলায় একদিন ছেলেকে নিয়ে যাবো…”

এটা কি একটুখানি ভালোবাসার ইঙ্গিত? না কি শুধুই সৌজন্য?

ক্লাসের ফাঁকে রিনা এসে পাশে বসল। “এই যে, তুমিও তো একটু হাসো। তুমি জানো, তোমার হাসি খুব নরম।”

স্নিগ্ধা অবাক।

অনেক দিন কেউ তার হাসি নিয়ে কথা বলেনি। হাসি যেন তার মুখে থাকে না এখন, কেবল দায়িত্বের ছায়া খেলা করে।

চতুর্থ পিরিয়ডে ক্লাস সেভেনের এক ছাত্র হঠাৎ বলে উঠল, “ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প বলবো?”

সে বলল, “বলো।”

ছেলেটা বলে, “একটা মানুষ ছিল। সে পাখির খাঁচা খুলে দিয়েছিল, কিন্তু পাখিটা উড়ল না। সবাই বলল পাখিটা বোকা, কিন্তু কেউ বুঝল না, তার ডানা ভাঙা ছিল।”

স্নিগ্ধার বুকের ভিতর কেঁপে উঠল।

ছেলেটা বোঝেনি, সে স্নিগ্ধার নিজের গল্প বলে ফেলেছে।

বাড়ি ফিরে সে খাটে বসে ছিল একা। রুদ্র পড়তে বসেছে, পাশের ঘরে টেবিল ল্যাম্পের নিচে তার মুখ গম্ভীর।

সে জানে, ছেলেটা বড় হয়ে গেছে সময়ের চেয়ে আগেই।

স্নিগ্ধা তখন হঠাৎ পুরনো একটা খাতা টেনে বের করল। তার কলেজের দিনের ডায়েরি। পাতাগুলো ঝাপসা হয়ে আছে, কিন্তু স্মৃতিগুলো উজ্জ্বল।

একটা পাতায় চোখ আটকে গেল—

“স্নিগ্ধা, যদি একদিন তোমার পাশে থেকে গল্প বলা না যায়, জানবে—আমি গল্পের ভিতর থেকেই তোমায় ভালোবাসি।”

লেখাটা ছিল তার কলেজের বন্ধু দীপ্তর। যে কখনও প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি, কিন্তু চিঠি লিখে বলেছিল—তার ভালোবাসা নীরব হবে, ঠিক তার মতো।

স্নিগ্ধা জানে না দীপ্ত এখন কোথায়।

তবে এতদিন পরেও সেই লেখা তার বুকের মধ্যে কাঁপুনি তোলে।

তাহলে কি কারও নীরব ভালোবাসা তাকে আজও ছুঁয়ে যায়?

সন্ধ্যায় হঠাৎ কলিং বেল বাজল। দরজা খুলতেই শুভাশীষ দাঁড়িয়ে। হাতে একটা মোটা বই—’মায়ের কাছে শেখা প্রথম গল্প’।

সে বলে, “আপনার ছেলেকে দিলাম। আমি ছোটবেলায় এই বইটা অনেকবার পড়েছি। রুদ্ররও ভালো লাগবে।”

স্নিগ্ধা বইটা হাতে নিয়ে থমকে থাকে।

এই ছোট ছোট স্পর্শগুলো কি কোথাও নিয়ে যাচ্ছে তাকে?

রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে ডায়েরির এক খালি পাতায় লিখল—

“চোখের পেছনে কিছু কথা থাকে, যারা মুখে আসে না। তবে বুঝি, সেই নীরবতা কারও কারও কাছে ভাষা হয়ে ওঠে।”

সে জানে, তার বেঁচে থাকাটা নিছক অভ্যেস নয়।

দিনের পর দিন, কেউ না কেউ তাকে জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

পর্ব ৩: একটা চিঠি

রাত তখন অনেকটা গড়িয়ে গেছে।

রুদ্র ঘুমিয়ে পড়েছে, পড়ার টেবিলের পাশে ছড়ানো বই, পেন্সিল, একটা আধাখোলা চকোলেট বার।

স্নিগ্ধা ধীরে দরজা বন্ধ করে তার নিজের ঘরে এসে বসে। জানলার কাচে আজ বৃষ্টির ছোঁয়া। গাঢ় মেঘ ঢাকা আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্ন নেই।

ডায়েরির পাতাটা খুলেই ছিল তখনও। দীপ্তর সেই এক লাইন:

“আমি গল্পের ভিতর থেকেই তোমায় ভালোবাসি।”

স্নিগ্ধা কখনও এই অনুভবকে প্রেম বলত না।

ওটা ছিল একরকম আশ্রয়।

যে সময় তার জীবনে কেউ ছিল না, দীপ্ত তার পাশে ছিল—অদৃশ্য ছায়ার মতো, বন্ধু হয়ে।

কিন্তু ভালোবাসা কি সবসময় প্রকাশ পায়?

নাকি অনেক সময় চিঠির মধ্যে, না-কাটা কথার মাঝে জমে থাকে?

স্নিগ্ধা আবার ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে লাগল। হঠাৎই পড়ে গেল একটা ভাঁজ করা হলুদ চিঠি।

অবাক হয়ে সে চিঠিটা খুলল। তারিখ—২০০৮ সালের ১২ই জুন।

চিঠির ওপরে লেখা ছিল:

“যদি এটা একদিন তুমি পাও, জানবে আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি, আমি কেবল অপেক্ষা করতে পারিনি…”

স্নিগ্ধার গলা শুকিয়ে এল।

চিঠিটা শুরু হয়েছিল দীপ্তর হাতে লেখা সেই চেনা অক্ষর

“স্নিগ্ধা,

আমি জানি তুমি কখনও কারও বোঝা হতে চাও না। তোমার ভেতরের যে অব্যক্ত লড়াই, তা আমি দেখেছি। তবু তোমার মুখে কখনও ক্লান্তি দেখিনি, দেখেছি আলো—আদরের, দায়িত্বের, আর এক অদ্ভুত নীরব সাহসের।

আমি জানতাম, আমি তোমার জীবনের অংশ হব না, কারণ তুমি খুব বেশি স্বাধীন। তোমার চারপাশের মানুষ তোমার দায়িত্বকে ভালোবাসা ভাববে, কিন্তু আমি জানি—তুমি আসলে একটু ছায়া খুঁজো, যেখানে তুমি নিজের মতো করে বসে থাকতে পারো।

আমি শুধু এটুকু বলতে চেয়েছিলাম—তুমি যেদিন ক্লান্ত হবে, একদিন যদি ভুল করে এই চিঠি খোলো, জানবে—আমি বলেছিলাম, ‘তুমি একা নও।’

– দীপ্ত”

স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে চিঠিটা ভাঁজ করল। চোখে পানি নেই, কিন্তু বুক ভার হয়ে আছে।

সে জানে দীপ্ত তার জীবনে নেই। হয়ত এখন অন্য শহরে, অন্য জীবনে, অন্য কারো সঙ্গে।

তবু এই একটা চিঠি তাকে অনেকখানি আলগা করে দিল।

বাইরে বৃষ্টি জোরে পড়ছে।

স্নিগ্ধা জানালার পাশে বসে থাকে অনেকক্ষণ।

তার মনে হলো, এই শহরটা বৃষ্টি হলে যেন নরম হয়ে যায়। তার বুকের মতো।

রাত্রি শেষ হওয়ার আগেই সে একটা খাতা বের করল। নতুন।

প্রথম পাতায় লিখল—

“সব গল্প চিরকাল মুখে বলা যায় না। কিছু গল্প চিঠি হয়ে থাকে।”

আরও নিচে লিখল—

“তবু আমি থাকি—নিজের মতো করে, হারিয়ে যাওয়া কিছু চিঠির পাশে।”

পর্ব ৪: জল জমা চোখ

সকালটা ছিল একটু অন্যরকম।

রুদ্র ঘুম থেকে উঠে বলল, “মা, আজ না স্কুলে ‘প্যারেন্টস স্পিচ’ আছে। ক্লাস ফাইভের একটা প্রজেক্ট—আমার টিচার বলেছে, কেউ একজন এলেই হবে।”

স্নিগ্ধা চমকে উঠেছিল।

সে জানত, স্কুলে রুদ্রর মা ছাড়া আর কেউ নেই। অথচ এমন অনুষ্ঠানগুলোতে বাবা-মায়ের যুগল উপস্থিতিই নর্ম।

“আমাকে আসতেই হবে?”

“হ্যাঁ মা, আমি চাই তুমি বলো, কীভাবে তুমি কাজ করো, ক্লাস নাও, আর আমাকে সময় দাও।”

স্নিগ্ধার বুক ধকধক করতে লাগল।

এই প্রথম, ছেলে নিজেই তার জীবনটাকে গর্বের চোখে দেখছে।

স্কুলের ছোট অডিটোরিয়ামটা সাজানো।

রঙিন ফেস্টুন, পেছনে লেখা—“Parent Talks: My Hero at Home”.

রুদ্রর নাম ডাকা হলে সে এগিয়ে যায়। তার চোখে একরাশ আলো।

মাইক হাতে নিয়ে বলে,

“আমার মা স্নিগ্ধা সেন। উনি একজন শিক্ষিকা। আমার বাবার মৃত্যুর পর উনিই আমার সবকিছু হয়েছেন। ওনার ঘুম নেই, ছুটি নেই, কিন্তু আমি জানি, ওনার হাসিটা আমায় দেখে আসে।”

স্নিগ্ধা প্রথমবার অনুভব করল, তার জীবনটা এতটা দৃঢ়, এতটা সাহসী হয়ে উঠেছে ছেলের চোখে।

তারপর স্নিগ্ধাকে ডাকা হলো মঞ্চে।

সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে মাইক ধরেছিল। তারপর বলল—

“আমি শুধু একজন মা নই, আমি একজন মানুষও। আমার ছেলের চোখে আমি ‘নায়ক’, অথচ আমার চোখে প্রতিদিনের দায়িত্বই যুদ্ধ। আমার স্বামী নেই, আমার পাশে রাত জাগার কেউ নেই, তবু আমি আছি—কারণ ভালোবাসা আমাকে শক্তি দেয়। আমার ছেলে আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ওর জন্য আমি প্রতিদিন একটু একটু করে বাঁচতে শিখি।”

হলঘর এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গিয়েছিল।

তারপর করতালি।

স্নিগ্ধার চোখে জল জমেছিল—চোখের কিনারায় টলমল।

বাড়ি ফেরার পথে রিনা হেসে বলল, “তোমার মতো করে কথা বলতে আমি পারতাম না। তুমি তো সত্যি মা নয়, একটা বই। খুললেই গল্প।”

স্নিগ্ধা প্রথমবার রিনাকে জড়িয়ে ধরল।

সেই আলিঙ্গনে ছিল বন্ধুত্ব, কৃতজ্ঞতা, আর একটু সাহস।

বাড়ি ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

চুলে নতুন করে খোঁপা বাঁধল, মুখে হালকা কাজল দিল।

নিজেকে বলল—“তুই কেবল বেঁচে নেই, তুই আসলে জীবনকে আগলে রাখিস।”

তবে রাতের এক প্রান্তে, যখন ঘুম তার চোখে আসে না, স্নিগ্ধা আবার খাতাটা খোলে।

সেখানে লিখে রাখে—

“জল জমে চোখে নয়, অভিজ্ঞতায়। আমি কাঁদি না, কারণ কান্না নয়, শক্তিই আমার অস্তিত্ব।”

পর্ব ৫: সীমানার রেখা

পাড়ার এই গলিটা অনেক ছোট, কিন্তু কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।

একদিন সকালে স্নিগ্ধা যখন রুদ্রকে নিয়ে বাজার যাচ্ছিল, পিছন থেকে চাপা গলায় কাকিমার মন্তব্যটা কানে এল—

“বউয়ের মতো বউ নয়, বিধবা হয়ে এখন সাজগোজ করে ঘোরে।”

স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে গেল।

রুদ্রর হাত শক্ত করে ধরল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

তবে তার চোখ দুটো থেমে গেল সেই মহিলার দিকে।

একটা চোখ, যেখানে শুধু বিষ, আর একটা সমাজের ভ্রুকুটি।

তবে এবার সে চুপ করে থাকেনি।

বিকেলে, নিজের বাসার নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে পাড়ার কিছু মহিলার সামনে গলা মেলাল।

“আমার একটা প্রশ্ন আছে,” সে বলল, “একজন স্বামীহারা মেয়ের কি হাসতে নেই? সাজতে নেই? বই পড়া, গান শোনা, শাড়ি পরা—এই সব কি শুধু বিবাহিতদের জন্য?”

চারপাশে থমথমে হয়ে যায়।

রিনাও পাশে দাঁড়িয়ে। শুভাশীষ একটু দূর থেকে দেখছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না।

স্নিগ্ধা আবার বলল—

“যে সমাজ বলে ‘নারী মানে আত্মত্যাগ’, সে কি কখনও নারীর নিজের ইচ্ছেগুলোর খবর রাখে?”

একজন প্রবীণ কাকিমা তখন ধীরে বললেন, “মেয়েটা ঠিক বলছে… আমি আমার সময় এগুলো বলতে পারিনি, ও বলছে। ভালই করছে।”

সেদিনের পর প্রথমবার পাড়ার কয়েকজন স্নিগ্ধার দরজায় এসে চা খেতে চাইল।

কেউ বলল, “আপনার হাতের চায়ের গন্ধে আলাদা কিছু আছে।”

কেউ বলল, “আপনার মতো করে কথা বলতে পারলে আমার মেয়েটা হয়তো ডিপ্রেশনে যেত না।”

স্নিগ্ধা বুঝল, ভাঙা নিয়মগুলো শুধু আওয়াজে ভাঙে না—ভাঙে সাহসে।

আর সাহস চুপচাপ তৈরি হয় দিনের পর দিন, একলা থাকার ভিতর দিয়ে।

সে রাতে শুভাশীষ একটা মেসেজ করল—

“আজ তোমায় দেখে মনে হচ্ছিল, তুমি শুধু রুদ্রর মা নও, তুমি অনুপ্রেরণা।”

স্নিগ্ধা একটা ছোট্ট রিপ্লাই দিল—

“আমি এখন আর ছায়া নই, আমি নিজের আলো।”

খাতার পাতায় লিখল—

“যে সীমানা সমাজ টানে, তার ওপারে হেঁটে যাওয়াটাও একরকম স্বাধীনতা।”

পর্ব ৬: আমি, একা নই

বছর ঘুরে গেছে।

শহরের গাছে নতুন কচিপাতা এসেছে।

স্নিগ্ধার জীবনেও যেন এক নতুন পাতা খুলছে।

আজ স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠান। রুদ্র ক্লাস ফাইভ শেষ করে সিক্সে উঠছে।

সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলল—

“আমার মা শুধু মা নন, উনি আমার পৃথিবী। ওনার কাছ থেকে আমি শিখেছি—কখনো হেরে যেও না, যতই অন্ধকার হোক, আলো খুঁজে নিও।”

হলঘরে তখন কান্না আর করতালির সংমিশ্রণ।

অনেক অভিভাবক দাঁড়িয়ে তালি দিচ্ছেন।

স্নিগ্ধার চোখে জল জমে, কিন্তু এবার আর তা লুকিয়ে রাখে না।

সে উঠে দাঁড়িয়ে একবার চারপাশ দেখে—

সমাজ, স্কুল, ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, এমনকি ক’জন কাকিমাও আজ চোখে-মুখে সম্মান নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

অনুষ্ঠান শেষে শুভাশীষ এগিয়ে এসে বলল,

“তুমি এবার নিজের গল্পটা লিখে ফেলো, স্নিগ্ধা। তোমার মতো গল্প আরও মেয়েকে পথ দেখাবে।”

স্নিগ্ধা হেসে বলল,

“লিখছি তো… প্রতিদিন… নিজের বাঁচা দিয়ে।”

সন্ধ্যাবেলায় রিনা এসে তার হাতে একটা খাম দিল।

ভিতরে একটা আমন্ত্রণপত্র—

“শহরের নারীজীবন বিষয়ক সেমিনারে আপনি স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রিত।”

স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

তারপর আস্তে করে বলল,

“ভালোবাসার জায়গা পেলে, মেয়েরাও ফের দাঁড়াতে শেখে।”

রাত্রে রুদ্র ঘুমিয়ে পড়লে সে নিজের নতুন খাতা খুলল।

প্রথম পাতায় বড় করে লিখল—

“তবু আমি থাকি”—

একটা মেয়ের একা থাকার গল্প নয়,

একটা মেয়ের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার খুঁজে পাওয়ার গল্প।

আমি একা নই। আমার মতো অনেকেই আছেন। আমরা কেউ কারো ছায়া নই, আমরা আলো হয়ে উঠতে চাই।

তারপর খাতাটা বন্ধ করে স্নিগ্ধা জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

রাতের আকাশে ছোট একটা তারা উঁকি দিচ্ছে মেঘের ফাঁকে।

সে মনে মনে বলল,

“আজ আমি থাকি, কারণ আমি চাই।

তবু আমি থাকি… নিজের মতো।”

সমাপ্ত

Lipighor_1750329126010.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *