সন্দীপ দে
অধ্যায় ১ —
নদিয়ার ছোট্ট গ্রাম চন্দ্রপুর, গঙ্গার শাখানদী ছোট ছোট খাল বেয়ে ছড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন জনপদ, যেখানে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির রাস্তা, কাঁচা বাড়ি, আর প্রায় ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আজও সেই গ্রামকে ঘিরে রেখেছে। গাঁয়ের লোকেরা সূর্যাস্তের পর আর বাইরে বেরোয় না। কারণ, চন্দ্রপুরের ঠিক প্রান্তে শুরু হয় শ্মশানঘাট, যার একপাশে প্রাচীন বটগাছ, আর অন্যপাশে সরু খালের কালো জলে প্রতিফলিত হয় জোছনার ভাঙা আলো। সেই শ্মশানের গায়েই ছোট্ট এক কুটিরে থাকে আজিজানন্দ তান্ত্রিক, নদিয়ার বিখ্যাত তান্ত্রিক ও সাধক। কুটিরের ভেতরে ধূপের গন্ধ আর পুঁথি-পত্র, জড়িবুটি, কঙ্কাল, রুদ্রাক্ষ, শঙ্খ—সব মিলিয়ে যেন অন্য জগতের বাতাস। আজিজানন্দ তান্ত্রিক একান্তে শিষ্য বিজয় নন্দীকে সাথে নিয়ে বহুদিন ধরে প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা করে চলেছে। বিজয় নন্দী, বছর ত্রিশের এক গম্ভীর চেহারার যুবক, লম্বা ছিপছিপে গড়ন, কপালে তিলক, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। সে আজিজানন্দের প্রতি সম্পূর্ণ ভক্তি আর শ্রদ্ধা রেখেই শিখছে তন্ত্রসাধনার গভীরতম রহস্য। কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অদম্য কৌতূহল, এক লালসা— এমন এক শক্তির অধিকারী হবার, যা তাকে সকলের উপরে বসিয়ে দেবে। শ্মশানঘাটের ধারে বসে থেকে রাতের পর রাত সে চেয়ে থাকে শ্মশানের দিকে, মনে মনে ভাবে, কবে সে এই মৃতদের আত্মাকে বশ করে নিজের শক্তি দেখাবে। একদিন গভীর রাতে, শ্মশানের বটগাছের নিচে বসে আজিজানন্দ বিজয়কে জানায় যে বহু বছর পরে সে এক আশ্চর্য পুঁথি পেয়েছে—এক মাটি খুঁড়ে পাওয়া পুঁথি, যেখানে লেখা রয়েছে নীল খঞ্জন মন্ত্র। সে মন্ত্রের শক্তি এত ভয়াবহ যে, জীবিত-মৃত সব আত্মা তার বশে আসতে বাধ্য। কিন্তু সেই মন্ত্র অভিশপ্ত; যে এর অপব্যবহার করবে, তার চরম সর্বনাশ অনিবার্য।
সেই রাতে ঝড় উঠেছিল। কালো আকাশে মেঘের গর্জন, শ্মশানঘাটের বটগাছের ডালপালা যেন শিকারের জন্য হাতড়াচ্ছিল। আজিজানন্দ তান্ত্রিক তার কুটিরের ভেতর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে ছিল, আর বিজয় নন্দী তার সামনে বসে নিঃশব্দে গুরুকে লক্ষ্য করছিল। আজিজানন্দের কণ্ঠস্বর গভীর আর ঘনিয়ে আসা রাতের অন্ধকারের মতো ভারী হয়ে উঠেছিল। সে বলেছিল, “বিজয়, এ মন্ত্রের সাধনা অতি বিপজ্জনক। যুগে যুগে যারা এ মন্ত্রের লোভ করেছে, তারা নিঃশেষ হয়েছে। তোর মধ্যে সাহস আছে, কিন্তু লোভ না দেখিয়ে, শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধির জন্যই এ মন্ত্রের দিকে তাকাবি।” বিজয়ের মুখ তখন অদ্ভুত উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছিল। তার হৃদয়জুড়ে এক অনন্ত ক্ষমতার স্বপ্ন জেগে উঠেছে, যে ক্ষমতা দিয়ে সে মৃতের আত্মা ডেকে আনতে পারবে, বেঁচে থাকা মানুষকে বশ করতে পারবে, এমনকি মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সে সেই রাতেই গোপনে শ্মশানঘাটে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করল। মৃদু বাতাসে শোনা যাচ্ছিল দূর গ্রামের শকুনের ডাক, আর বিজয়ের মনে হচ্ছিল, সেই ডাক তাকে আহ্বান করছে অজানা অন্ধকারের দিকে।
পরের দিন সকালেই শ্মশানের ধারে বটগাছের নিচে বসে আজিজানন্দ সেই পুঁথি বিজয়কে দেখায়। পোড়া কাগজের মত বাদামি রঙের পাতা, তাতে লাল কালি দিয়ে লেখা রহস্যময় অক্ষরগুলো বিজয়ের চোখে যেন এক আশ্চর্য নেশা ছড়িয়ে দিল। আজিজানন্দ বলল, “দেখ, এই পুঁথি তোর নয়। এটা তোর পরীক্ষার সময় হলে তোর হাতে দেব। তুই এখন শুধু দেখ, মনে রাখ, আর ভেবেই পা বাড়া।” কিন্তু বিজয়ের মনে তখন আর কৌতূহল থামছে না। রাতের অন্ধকারে সে লুকিয়ে শ্মশানঘাটে যাবে, সেই পুঁথি চুরি করবে—এমনই এক জেদ মাথায় চেপে বসেছে। সারাদিন বৃষ্টি হল, শীতল বাতাস শিরশিরে করে তুলল পুরো চন্দ্রপুরকে। বিজয়ের মনেও তেমনই শিরশিরে উত্তেজনা। সন্ধ্যা নামতেই সে কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে শ্মশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি ভেজা মাটিতে নিজের ছায়া দেখে সে নিজের ভেতরের অজানা অন্ধকারকে উপলব্ধি করে। সে জানে না, অদূরে কালভৈরবের ছায়া তাকে লক্ষ্য করছে, তার প্রতিটি চলাফেরা, তার চোখের লোভ, তার কাঁপা কাঁপা হাত—সব দেখে নিচ্ছে।
সেই রাতে, যখন শ্মশানঘাটে বিজয় পুঁথি নিয়ে বসে মন্ত্র পাঠ শুরু করল, আকাশে ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল। বাতাসে অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—কেউ যেন জ্বলন্ত ধূপ ছড়িয়ে দিচ্ছে শূন্যে। বিজয় তার চারপাশে বৃত্ত এঁকে বসে পড়ল, মুখে মন্ত্রের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করতেই শ্মশানের বাতাস যেন থেমে গেল। কুকুরের হুংকার থেমে গেল, শকুনের ডানার শব্দ মিলিয়ে গেল। কিন্তু অদূরে ঝোপের আড়াল থেকে কালভৈরব চুপিচুপি বিজয়কে লক্ষ্য করছিল। তার চোখে লাল আগুনের মত জ্বলে উঠছিল জ্যোতি। কালভৈরব—এক সময়ের শ্মশানচারী, এখন প্রায় অর্ধপ্রেতের মতো হয়ে গেছে। লোকমুখে ছড়িয়ে আছে তার গল্প, যে সে মৃত আত্মা বশ করে রাজ্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু অভিশপ্ত হয়ে শ্মশানের প্রেতেদের খপ্পরে পড়েছিল। আজ সেই কালভৈরব লালায়িত দৃষ্টিতে বিজয়ের পুঁথির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে এই পুঁথিই তার চরম শক্তির চাবিকাঠি। বিজয় তখনও অজানা, অদৃশ্য বিপদের গন্ধ পায়নি। তার কণ্ঠস্বর জোরে জোরে মন্ত্রপাঠে ব্যস্ত, আর রাতের অন্ধকার তাকে ক্রমশ গিলে নিচ্ছে।
অধ্যায় ২ —
শ্মশানঘাটের বটগাছের নিচে বসে বিজয় নন্দী সেদিন রাতের অন্ধকারকে এক নতুন চোখে দেখেছিল। চারদিকের নৈশব্দ্য, গঙ্গার শাখানদীর কালো জলরেখা আর মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসা পচা কাঠের গন্ধ তাকে অদ্ভুত এক নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হাতে ধরা সেই পোড়া কাগজের পুঁথি—যা সে গোপনে গুরুর কুটির থেকে চুরি করে এনেছে—তার হৃদস্পন্দনকে যেন দ্বিগুণ করে তুলেছিল। আকাশে চাঁদ ঢাকা পড়েছিল মেঘের চাদরে, শ্মশানের আলো-আঁধারি পরিবেশে বিজয় পুঁথি খুলে মন্ত্রপাঠ শুরু করে। প্রথমেই সে বৃত্ত এঁকে বসে, চারপাশে ধূপকাঠি গুঁজে দেয়। তার কণ্ঠস্বর অল্প কাঁপছিল, কিন্তু মন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস আর লোভ তাকে দৃঢ় করে তুলছিল। মন্ত্রের প্রথম ধাপ শেষ হতে না হতেই বাতাসে যেন এক শীতলতা নেমে এল, আর বিজয় টের পেল, তার চারপাশে অদৃশ্য কিছু উপস্থিতির স্পর্শ। সে জানে, এটা মন্ত্রের প্রভাবের প্রথম ইঙ্গিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে যে চোখ বুঁজে মন্ত্রে ডুবে আছে, সে বুঝতে পারল না, ঝোপের আড়াল থেকে কালভৈরব তার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কালভৈরবের হাত শক্ত করে পুঁথির লালচে পাতার দিকে টানছিল, কিন্তু সে জানে, এখনই হাত দিতে যাবে না; প্রথমে সে বিজয়ের মন্ত্রপাঠ শেষ হোক, শক্তি জাগুক, তারপরেই সে সেই শক্তিকে নিজের করে নেবে।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, শ্মশানের বাতাস তত ভারী হয়ে উঠছিল। বিজয়ের চারপাশে যেন অজস্র নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ দূর থেকে শোনা গেল শেয়ালের ডাক, আর তার পরেই শ্মশানজুড়ে নেমে এল ঘন নীরবতা। বিজয় মন্ত্রপাঠে মগ্ন, তার কণ্ঠস্বর আরও দৃপ্ত হয়ে উঠল। তখনই বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—যেন হাজার বছরের পুরনো শ্মশানের চিতা জ্বলে উঠেছে আবার। বিজয় চোখ মেলে তাকাল, আর যা দেখল তাতে তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। তার সামনে, ঠিক বৃত্তের ধারে, ধোঁয়ার মতো আবছা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ছায়ামূর্তি। বিজয় জানে, এটা কোনো সাধারণ প্রেত নয়—এ সেই আত্মা, যা মন্ত্রের ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছে। বিজয়ের ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল, কিন্তু সে মন্ত্রপাঠ থামায়নি। ঠিক তখনই কালভৈরব তার সুযোগ দেখে শ্মশানের অন্যপ্রান্ত থেকে নিঃশব্দে কাছে এগিয়ে এল। তার চোখে লোভ আর প্রতিহিংসার ঝলকানি, মনে মনে সে ভাবছে, ‘‘আজ এই মন্ত্রের শক্তি আমার হবে।’’ বিজয় তখনও অজানা অশুভের ছায়া টের পায়নি। মন্ত্রের শেষ ধাপের সময় সে দেখে ছায়ামূর্তিটি তার দিকে একপা এগিয়ে এসেছে, তার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে ফিসফিসে শব্দ, যেটা মানুষের নয়, যেন দূর অতীতের মৃত আত্মার আর্তনাদ।
মন্ত্র শেষ হতেই বিজয় হঠাৎ টের পেল, চারপাশের বাতাস থমকে আছে, এবং ছায়ামূর্তিটি মৃদু কম্পন করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। বিজয়ের চোখে তখন বিজয়ের আনন্দ—সে ভাবল, সে সফল। শ্মশান তাকে ভয় দেখাতে পারেনি। সে শক্তি পেয়েছে, সে আত্মাকে বশে আনতে পেরেছে। কিন্তু অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা কালভৈরব তখন ঠিক করল, সে আজ রাতেই পুঁথি চুরি করবে। বিজয় যখন ধূপ নিভিয়ে শ্মশান ছেড়ে কুটিরের দিকে হাঁটছে, কালভৈরব গিয়ে বৃত্তের মাঝে পড়ে থাকা সেই পুঁথি তুলে নিল। সে জানত, এখনই সময়। এই পুঁথি নিয়ে গিয়ে সে নিজের সাধনা শুরু করবে, আর নীল খঞ্জন মন্ত্রের সমস্ত শক্তি হবে তার। রাতের বাতাসে তখন আরেকটা গন্ধ ভেসে আসছিল—প্রাচীন বিপদের, যা বিজয় বুঝতে পারেনি, আর কালভৈরব যার দিকে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছিল। নদিয়ার গাঢ় রাত তখন অজানা আশঙ্কায় আরো কালো হয়ে উঠছিল, আর দূর বটগাছের ডালে এক শকুন ডানা ঝাপটিয়ে যেন জানিয়ে দিচ্ছিল, এই রাতে আরও কিছু ঘটতে চলেছে।
পরদিন ভোরে বিজয় ঘুম থেকে উঠে টের পেল, তার ভেতরে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে। মনে হচ্ছিল, সে আরও বেশি সাহসী, আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। গুরুর চোখের দিকে তাকিয়ে সে যেন বুঝতে পারছিল, আজিজানন্দ তার চোখের ভাষা পড়তে পারছে না। কিন্তু আজিজানন্দের মনে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল; সে অনুভব করছিল, বিজয়ের ভেতরে কোথাও যেন অজানা অন্ধকার ঢুকে পড়েছে। তখনও বিজয় জানত না যে পুঁথি আর তার সাধনার চিহ্ন রাতে চুরি হয়ে গেছে। সে ভাবছিল, শক্তি তার মুঠোয়, সে যখন ইচ্ছে করবে, তখন আত্মাকে ডাকতে পারবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই শোনা গেল, গ্রামের উত্তরপ্রান্তে গঙ্গার ধারে এক বৃদ্ধ নাওয়া মদন মল্লিক অদ্ভুতভাবে মারা গেছে। লোকে বলল, সে নাকি সারারাত নদীর পাড়ে বসে ছিল, আর ফিসফিস করে কারও সাথে কথা বলছিল। গ্রামের বয়স্করা বলল, এ নিশ্চয়ই শ্মশানের প্রেতদের খেলা। বিজয়ের মনে তখন কাঁপুনি ধরে গেল; সে বুঝতে পারল, মন্ত্রের শক্তি সে শুধু পায়নি, সেই শক্তি তার অজান্তেই জেগে উঠেছে, আর হয়তো তা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর ঠিক তখনই শোনা গেল গাঁয়ের প্রাচীন শ্মশানচারীদের কেউ কেউ বলছে, কাল রাতে নাকি তারা শ্মশানে কালভৈরবের ছায়া দেখেছে, আর সেই ছায়া নাকি শ্মশানের ভেতর থেকে কিছু একটা তুলে নিয়ে চলে গেছে।
অধ্যায় ৩ —
শ্মশানঘাটের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে সে রাতে অদ্ভুত এক গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। জ্বলা কাঠের ছাই মিশে থাকা সেই গন্ধ নদিয়ার সমস্ত প্রান্তর পেরিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল, আর গ্রামবাসীদের মনে জন্ম দিচ্ছিল অজানা আশঙ্কা। কেউ জানত না যে সেই রাতেই শ্মশানের কালো ছায়ায় এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। কালভৈরব, সেই রহস্যময় অর্ধপ্রেতসদৃশ শ্মশানচারী, শ্মশান থেকে চুরি করে এনেছে নীল খঞ্জন মন্ত্রের পুঁথি। বালিঘাটের ভাঙা শিবমন্দিরের পেছনে সে লুকিয়ে বসে পুঁথির পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে। তার চোখে তখন লালসা আর প্রতিহিংসার আগুন। এক সময়ের তান্ত্রিক কালভৈরব নিজের শক্তি হারিয়েছিল এক ভয়ানক তান্ত্রিক লড়াইয়ে, আর আজ এই পুঁথি তাকে ফিরিয়ে দেবে সেই শক্তি, ফিরিয়ে দেবে প্রতিশোধের ক্ষমতা। ঝড়ো বাতাসে পুঁথির পাতাগুলো কাঁপছিল, আর কালভৈরব তার কপালে ছাই মেখে, চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপ শুরু করল। আকাশে বিজলির ঝলকানি পড়ে শিবমন্দিরের ভাঙা চূড়োয়, আর সেই আলোয় তার চোখ দুটো ঝলসে উঠল, যেন আগুনের শিখা।
গ্রাম চন্দ্রপুর তখন গভীর ঘুমে। কিন্তু বিজয় নন্দীর ঘুম ভাঙে মাঝরাতে এক ভয়াবহ স্বপ্নে। স্বপ্নে সে দেখে, শ্মশানের ভেতর দিয়ে শত শত আত্মা মিছিল করে যাচ্ছে, আর তাদের চোখে আছে একরাশ ক্রোধ। সেই মিছিলের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কালভৈরব, যার হাতে ধরা পুঁথি থেকে বের হচ্ছে নীলচে ধোঁয়া। ঘামে ভিজে বিজয় বিছানা ছেড়ে উঠল। তার কানে তখনও স্বপ্নের সেই আত্মাদের আর্তনাদ বাজছে। বাইরে ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে শূন্যতা যেন ভারী হয়ে উঠেছে। বিজয় জানে না, ঠিক এই মুহূর্তে কালভৈরব শ্মশানঘাটের বটগাছের তলায় বসে নতুন করে সেই মন্ত্র জপ করতে শুরু করেছে। শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ করে উঠছে অদ্ভুত সব শব্দ—মনে হচ্ছে শেয়াল ডাকছে, আবার মনে হচ্ছে মানুষের মতো কেউ কাঁদছে। কালভৈরবের চারপাশে বাতাস স্থির, আর সে নিজের মন্ত্রপাঠের তেজে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তার সামনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে এক ছায়ামূর্তি, যার চোখে লাল রক্তিম আভা। সেই মূর্তি মাথা নোয়ায় কালভৈরবের প্রতি। কালভৈরব বিজয়ের মতো ভীত নয়, সে জানে, সে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত শক্তি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—সে গোটা চন্দ্রপুরকে দেখিয়ে দেবে শ্মশানের ক্ষমতা কাকে বলে।
পরদিন ভোর হতেই গ্রামের বাতাসে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রাতের শেষ প্রহরে গঙ্গার ঘাটের কাছে থাকা রাখাল বুড়ো বলছে, সে নাকি দেখেছে নদীর পাড়ে হেঁটে যাচ্ছে এক ছায়ামূর্তি, যার পা মাটিতে লাগে না। অন্যদিকে গাঁয়ের মোড়লের স্ত্রী জানিয়েছে, রাতের বেলায় তাদের উঠোনে অজানা ছায়া হেঁটে গেছে, আর ঘরের প্রদীপ অকারণে নিভে গেছে। আতঙ্কিত মানুষজন ভোরের আলো ফোটার আগেই মন্দিরে জড়ো হয়। কেউ শপথ করে বলছে, তারা শ্মশানের দিকে আর পা রাখবে না। বিজয় নন্দীর মন তখন অজানা দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। সে বুঝতে পারছে না, এই ভয়াবহতার পেছনে তার গোপন সাধনা দায়ী কি না। আজিজানন্দ তান্ত্রিক তখন ঘরে বসে ধূপ জ্বালিয়ে মনে মনে ভাবছে, রাতের আকাশে যে অশুভ লক্ষণ সে দেখেছে, তা কি বিজয়ের কৃতকর্মের ফল? সে শিষ্যকে ডেকে বলল, “বিজয়, তুই কোনো ভুল করিসনি তো? আমি ক’দিন ধরে শ্মশানের বাতাস ভারী মনে করছি। এই নীল খঞ্জন মন্ত্রের খেলা ভয়ঙ্কর।” বিজয় তখনো সত্যি কথা বলতে সাহস পায় না। তার চোখে তখন শুধুই আতঙ্কের ছায়া, আর মনে মনে সে অনুভব করতে থাকে সেই কালো অদৃশ্য চোখের দৃষ্টি—যা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
সন্ধ্যা নামার আগেই নদিয়ার আকাশ ঢেকে যায় কালো মেঘে। ঝড় ওঠে। বিজয়ের কানে শোনা যায় অজানা ফিসফিসে ডাক—যেন শ্মশানের বাতাস থেকে কেউ তাকে ডেকে আনছে। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরে যায়। সে জানে, সে যা শুরু করেছে, তা আর থামানো যাবে না। আর ঠিক তখনই দূর বটগাছের নিচে কালভৈরব তার পরবর্তী সাধনা শুরু করে দেয়। বাতাস স্তব্ধ, শ্মশানের শকুনেরা ডানা গুটিয়ে বসে থাকে। কালভৈরবের গলার মন্ত্রপাঠ আছড়ে পড়ে বাতাসে, আর শ্মশানের ভেতরে এক এক করে ভেসে ওঠে ছায়ামূর্তি। নদিয়ার গা-ছমছমে রাত আবার সাক্ষী থাকে সেই অশুভ জাগরণের, যার প্রভাব পরদিন সকাল থেকে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গরুর গোয়ালে অকারণ মৃত্যু, নদীর পাড়ে পচা গন্ধ, উঠোনে অদৃশ্য পায়ের ছাপ—সব মিলিয়ে চন্দ্রপুর যেন প্রেতাত্মাদের গ্রামে পরিণত হয়। আর বিজয় বুঝতে পারে, কালভৈরবের ছায়া কেবল শ্মশানেই থেমে নেই; সেই ছায়া ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তার চারপাশ, তার আত্মা, তার কল্পনা, আর তার জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস।
অধ্যায় ৪ —
রাতের অন্ধকারে কালভৈরবের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল নীল খঞ্জন মন্ত্রের বিকৃত ধ্বনি। শ্মশানের বাতাসে সেই মন্ত্র যেন কাঁপন তুলে দিচ্ছিল শূন্যের স্তব্ধতায়। চারপাশের বটগাছের ডালপালা যেন মন্ত্রের তেজে নড়ে উঠছিল। কালভৈরব বৃত্ত এঁকে বসে ছিল শ্মশানের ধূলোমাটিতে, তার চোখে লাল আগুনের মত দীপ্তি। পুঁথির পাতাগুলো সে খুলে রেখেছিল, আর সেই পাতার উপর ঝুঁকে পড়ে সে মন্ত্রপাঠে লিপ্ত ছিল। তার কণ্ঠস্বর কখনো গর্জে উঠছিল, কখনো নিম্নস্বরে ফিসফিস করছিল—যেন সে নিজেরই সঙ্গে যুদ্ধ করছে। শ্মশানের চারপাশে বাতাস থমকে গিয়েছিল, মৃতদের ছাইগন্ধ মিশে থাকা সেই বাতাসে ভেসে আসছিল অদৃশ্য আর্তনাদ। বটগাছের গুঁড়ির কাছে হঠাৎ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল এক অদ্ভুত ছায়া—মাটিতে পা ছোঁয়াচ্ছে না, ভেসে আছে। কালভৈরব সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে মন্ত্র জপের তেজ বাড়িয়ে দিল। সে জানত, এ সেই আত্মা, যা মন্ত্রের টানে এসেছে। আর সেই মুহূর্তে সে ঘোষণা করল, “আজ হতে তুই আমার অধীন, আমার শক্তি আমার ইচ্ছায় বাঁধা!” কিন্তু অন্ধকারের ভেতর থেকে সেই ছায়া হেসে উঠল, এক শীতল, হাড় কাঁপানো হাসি, যা শ্মশানজুড়ে প্রতিধ্বনিত হল, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরণের পচা গন্ধ, যেন হাজার বছরের পুরনো চিতার ছাই জেগে উঠেছে।
চন্দ্রপুর গ্রাম তখন ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু ঘরের ভেতর ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছিল অজানা কিছুর আতঙ্ক। কারো কারো উঠোনে ভোররাতের কুয়াশার মধ্যে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছিল—মানুষের নয়, যেন শূন্যের দিকে চলে যাওয়া অদৃশ্য কারো পা। গৃহস্থেরা ভোরের আলো ফোটার আগেই মন্দিরে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল। সবাই বলছিল, “কাল রাতের শ্মশান থেকে অশুভ কিছু বেরিয়ে এসেছে।” বিজয়ের ঘুম ভেঙেছিল গভীর রাতে। সে জানত না ঠিক কী কারণে বুক ধড়ফড় করছে। কুয়াশার ফাঁকে সে জানালা দিয়ে শ্মশানের দিকে তাকিয়ে রইল। দূরের আকাশে তখনও বিদ্যুতের হালকা ঝলকানি, আর বাতাসে ভেসে আসছিল শীতল ধোঁয়ার মত গন্ধ। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল পুঁথির কথা। কাঁপা কাঁপা হাতে সে লণ্ঠন জ্বালিয়ে কুটিরের কোণে রাখা বাক্স খুলল। কিন্তু পুঁথি আর নেই! আতঙ্কে তার হাত থরথর করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কালভৈরবের সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি, আর শ্মশানের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা সেই কণ্ঠস্বর, যা রাতের অন্ধকার চিরে বিজয়কে তাড়া করছিল। মন্ত্র চুরি গেছে, আর তার সাথে সাথে জেগে উঠেছে এক অজানা সর্বনাশ, যা গ্রামকে গ্রাস করতে আসছে।
সকালে গ্রামের মন্দিরের প্রাঙ্গণে মানুষের ভিড় জমেছিল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য সেখানে বসে ধূপ জ্বালিয়ে মন্ত্রপাঠ করছিলেন। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। গ্রামের মোড়ল থেকে শুরু করে চাষাভুষো মানুষ, সবাই ভীত কণ্ঠে বলছিল, “গতকাল রাত থেকে আমাদের ঘরবাড়িতে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। গরু মারা যাচ্ছে, বাড়ির দরজা আপনা আপনি খুলে যাচ্ছে, শয়তানের ছায়া দেখা যাচ্ছে উঠোনে।” বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য চোখ বুজে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন, এটা কোনো সাধারণ প্রেতবৃত্তি নয়। কারো অজ্ঞানতায় নাকি লোভে এমন মন্ত্র জাগানো হয়েছে, যার শিকল ছিঁড়ে গেছে। বিজয় ভেতরে ভেতরে নিজেকে অপরাধী ভাবছিল, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না। আজিজানন্দ তার চেহারা দেখে সব বুঝে যাচ্ছিল। সে বিজয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই যে ভুল করেছিস, তা বুঝে ফেলেছিস। কিন্তু এখন সময় কাজ করার। চল, পণ্ডিতমশায়ের কাছে গিয়ে সব খুলে বলি। নাহলে গ্রাম এই অশুভ শক্তির কবলে ধ্বংস হয়ে যাবে।” বিজয় হতবাক চোখে শ্মশানের দিকে তাকিয়ে দেখল, দুপুরের রোদ্দুরেও সেই দিকে ছায়া নেমে আছে। বাতাস নিস্তব্ধ, আর তার বুকের ভেতর শীতল স্রোত বইছে। সে জানত, কালভৈরবের হাত থেকে মন্ত্র ফেরত পাওয়া আর সহজ হবে না।
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামজুড়ে নেমে এল নিস্তব্ধ আতঙ্ক। শ্মশানদিকের আকাশে উঠল কালো মেঘ, বিদ্যুতের হালকা ঝলকানি আর শকুনের ডানার শব্দ শোনা গেল দূর থেকে। সেই অন্ধকারে, শ্মশানের বটগাছের নিচে কালভৈরব বসে নিজের জয়োৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার কণ্ঠে তখন এক বিকৃত হাসি, যা বাতাসে মিশে শ্মশানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। শ্মশানের ধুলোবালিতে সে আঁকল নতুন বৃত্ত, তার চারপাশে গুঁজল জড়িবুটি আর হাড়গোড়। তারপর শুরু হল তার সাধনার দ্বিতীয় অধ্যায়—যেখানে সে চেয়েছিল নীল খঞ্জন মন্ত্রের চূড়ান্ত শক্তি নিজের করে নিতে। বাতাস নিস্তব্ধ, চারদিকে অদ্ভুত শীতলতা। আর সেই সময় বিজয়, আজিজানন্দ আর পণ্ডিত ভট্টাচার্য মিলে শ্মশানের দিকে রওনা হল। পণ্ডিত বলল, “এখন আর থেমে থাকার সময় নেই। এই মন্ত্রকে সমাহিত করতে হবে। নাহলে কালভৈরব শুধু গ্রাম নয়, গোটো জনপদ ধ্বংস করবে।” আর বিজয়ের বুকের ভেতর কেবল বেজে চলল সেই শীতল অজানা কণ্ঠস্বর—যা যেন বলছে, “তোর হাতেই সর্বনাশের চাবি।”
অধ্যায় ৫ —
শ্মশানের দিক থেকে ভেসে আসা হাওয়ার শীতলতা যেন ঘিরে ধরছিল পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, বিজয় আর আজিজানন্দকে। তিনজনেই গ্রামের পুরনো শিবমন্দিরের সামনে বসে ছিল। মাথার ওপর বটবৃক্ষের পাতা থরথর করে কাঁপছিল, আর দূরের আকাশে বিদ্যুতের রেখা মাঝে মাঝে অন্ধকার ছিঁড়ে দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমরা যা করেছ, তা শুধু নিজের সর্বনাশ নয়, গোটা নদিয়ার সর্বনাশ ডেকে এনেছ।” তাঁর চোখের কোণে ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি মাটিতে আঁকতে আঁকতে বললেন, “শোনো, এই নীল খঞ্জন মন্ত্র শুধু এক মন্ত্র নয়। এটা এক অভিশপ্ত সাধনার নাম। প্রাচীন কালে এই মন্ত্র আবিষ্কার হয়েছিল কামরূপ কামাখ্যা পীঠে। তখন কিছু তান্ত্রিক সাধক মানুষের আত্মা বশ করার শক্তি চাইত, চেয়েছিল মৃত্যুকেও জয় করতে। সেই সময় এক সাধক এই মন্ত্র রচনা করেছিল, আর সেই মন্ত্রের ফলে সে মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখা মুছে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই সাধক শেষ পর্যন্ত আত্মাহীন হয়ে প্রেতরূপে বন্দী হয় চিরকাল। তার অভিশপ্ত আত্মা ছড়িয়ে পড়ে তন্ত্রপীঠ থেকে নদিয়া-অজমের শ্মশান পর্যন্ত। এই মন্ত্রের ভয়াল শক্তি তাই যুগ যুগ ধরে শ্মশানচারী, অশুভ শক্তি আর অভিশপ্ত আত্মাদের হাতে পড়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছে।”
পণ্ডিত বিষ্ণুপদ একবার থামলেন। বাতাসে ধূপের গন্ধ মিশে শীতল হয়ে উঠছিল। আজিজানন্দ মাথা নিচু করে বলল, “পণ্ডিতমশাই, আমরা কী করব এখন? কালভৈরবের হাতে মন্ত্র গেলে সে তো…” বিষ্ণুপদ হাত তুলে থামিয়ে বললেন, “সে তো শুধু নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে না, মৃতের আত্মা আর জীবিত মানুষের আত্মার মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক সীমানা ভেঙে ফেলবে। তখন সেই নীল খঞ্জন আত্মা জেগে উঠবে—যা সমস্ত আত্মাকে গ্রাস করবে, আর জীবিত মানুষের আত্মাও নিরাপদ থাকবে না। আর একবার সে জেগে উঠলে, তাকে আর মাটিতে পুঁতে রাখা যাবে না। কেবল এক উপায় আছে—মন্ত্র আর পুঁথি সমাধিস্থ করে পবিত্র অগ্নিতে উৎসর্গ করতে হবে। কিন্তু সেটা করার জন্য কালভৈরবকে হার মানাতে হবে।” কথাগুলো শোনার পর বিজয়ের মনে হল, শীতল বাতাস বুকের ভেতর নেমে যাচ্ছে। সে জানত, তার এক ভুলে গোটা গ্রাম বিপদের মুখে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ তখন তার চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি সাহসী ছেলে বিজয়, কিন্তু এই সাহসকে সঠিক পথে কাজে লাগাতে হবে। কাল রাতের চন্দ্রগ্রহণের আগে আমাদের কিছু করতে হবে, নাহলে সব শেষ।”
সেই রাতেই শ্মশানের দিকে তিনজন রওনা দিল। আকাশে মেঘ জমেছে, বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে ঝলকাচ্ছে। বাতাসে এক অদ্ভুত পচা গন্ধ, আর শ্মশান থেকে ভেসে আসছে হাড় কাঁপানো এক হাসির প্রতিধ্বনি। কালভৈরব তখন বটগাছের তলায় বসে নীল খঞ্জন মন্ত্রের জপে লিপ্ত। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাড়গোড়, লালচে ধোঁয়া উঠছে ধূপকাঠি থেকে। কালভৈরবের চোখে তখন আর মানুষিকতার ছায়া নেই; সে এক বিকৃত শক্তির দাস হয়ে গেছে। শ্মশানের শকুনেরা ডানা গুটিয়ে বসে আছে, বাতাসে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। বিজয় আর আজিজানন্দ দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখছিল, আর পণ্ডিত বিষ্ণুপদ মাটিতে পুঁথি সমাধিস্থ করার মন্ত্র জপ করতে শুরু করলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় কালভৈরব তাদের উপস্থিতি টের পেল। সে হঠাৎ গর্জে উঠল, তার কণ্ঠস্বর শ্মশান কাঁপিয়ে তুলল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই ভয়াল শক্তি—শ্মশান যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, আর কালভৈরব হাসতে হাসতে বলল, “তোরা আমাকে থামাতে পারবি না! এই মন্ত্র আমার শক্তি, এই শ্মশান এখন আমার রাজ্য!” তার চারপাশে ছায়ামূর্তিগুলো ধীরে ধীরে ঘন হতে শুরু করল, বাতাসে শোনা যেতে লাগল আত্মার কান্না আর অদ্ভুত ফিসফিসানি।
সেই মুহূর্তে বজ্রবিদ্যুৎ আছড়ে পড়ল শ্মশানের বটগাছের ডালে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ, আজিজানন্দ আর বিজয় মাটিতে শুয়ে পড়ল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ তখন আরও জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই মন্ত্রের শব্দ। কালভৈরব তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তার হাতে পুঁথি তুলে নিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল নীল খঞ্জন মন্ত্রের চূড়ান্ত ধাপ। হঠাৎ শ্মশানের অন্ধকারের ভেতর থেকে জেগে উঠল সেই ভয়ঙ্কর নীল খঞ্জন আত্মা। অর্ধপ্রেত, অর্ধমানব, লালচে চোখ আর কালো ছায়ামূর্তি নিয়ে সে ধীরে ধীরে কালভৈরবের দিকে এগিয়ে এলো। কালভৈরব প্রথমে হাসতে হাসতে বলছিল, “তুই আমার শক্তি!” কিন্তু এক মুহূর্তেই তার মুখে আতঙ্কের ছায়া। সে বুঝতে পারল, সে যে শক্তিকে ডেকেছে, তা তার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। বিজয় আর পণ্ডিত বিষ্ণুপদ সেই দৃশ্য দেখে কাঁপতে লাগল। এখন আর থেমে থাকার সময় নেই, এখনই মন্ত্র সমাহিত করতে হবে, নাহলে কালভৈরবের হাত ধরে গোটা জনপদ গ্রাস করবে সেই আত্মা। শ্মশানজুড়ে তখন বাতাসে গর্জন, মৃতের আত্মার আর্তনাদ আর পচা হাড়ের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত বিভীষিকাময় রাতের জন্ম দিয়েছিল।
অধ্যায় ৬ —
চন্দ্রপুর গ্রামের প্রান্তে গঙ্গার পাড়ের কাছে ছোট কুঁড়েঘরে বসে মাধবী চোখ বন্ধ করে জপছিল গায়ত্রী মন্ত্র। রাতের বাতাস থেমে গিয়েছিল, আর সেই নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে শ্মশানদিকের অদৃশ্য কোনো অশুভ শক্তির স্পর্শ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল তার দিকে। মাধবীর মন বারবার অস্থির হয়ে উঠছিল। চোখ খুলে সে দূরের আকাশের দিকে তাকাল। বিদ্যুতের ক্ষীণ রেখা আকাশে ফুঁড়ে যাচ্ছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল শ্মশানের পচা কাঠ আর ধূপের গন্ধ। সেই গন্ধের সাথেই মিশে ছিল অজানা এক আতঙ্ক, যা মাধবীর প্রাণের গভীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল। সে জানত, কিছু একটার অমঙ্গল অতি সন্নিকটে। তার স্বপ্নে বারবার ভেসে উঠছে কালভৈরবের ছায়া, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত নীলচে ধোঁয়ায় মোড়া ছায়ামূর্তি—যা কারো নয়, যেন অশুভ শক্তির প্রতীক। মাধবী ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই রাতেই কিছু ভয়াবহ ঘটতে চলেছে, যা গোটা চন্দ্রপুরের ভাগ্যকে অন্ধকারে তলিয়ে দেবে। সে লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে পড়ল বিজয়ের কুটিরের দিকে।
বিজয় তখন নিজের ঘরের কোণে বসে শ্মশানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতর অজানা শীতলতা বয়ে চলেছে। সে বুঝতে পারছিল, তার অজ্ঞানতায় জাগানো মন্ত্র আজ তার হাতের বাইরে চলে গেছে। তার মনের ভেতর দুই সত্তা যুদ্ধ করছিল—একদিকে সে চায় এই সর্বনাশ রোধ করতে, অন্যদিকে এক গভীর লোভ, এক শক্তির মোহ, যা সে অস্বীকার করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছিল, একবার যদি সেই নীল খঞ্জন আত্মাকে বশে আনা যায়, তাহলে সে হবে সর্বশক্তিমান। কিন্তু পরক্ষণেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল; মনে পড়ছিল কালভৈরবের বিকৃত হাসি, শ্মশানের বটগাছের তলায় লালচে চোখের সেই ছায়ামূর্তি। বিজয় জানত, সময় ফুরিয়ে আসছে। তখনই মাধবী এসে দরজায় কড়া নাড়ল। তার কণ্ঠে আতঙ্কের ছোঁয়া, “বিজয়দা, দরজা খোলো। অমঙ্গল আসছে, শীঘ্র কিছু করতে হবে।” বিজয় দরজা খুলে মাধবীর মুখে সেই শঙ্কার রেখা স্পষ্ট দেখতে পেল। দুজনেই বোঝে, রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অশুভ শক্তি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে চারপাশ।
শ্মশান তখন আর শুধু মৃতদের বিশ্রামের স্থান ছিল না। কালভৈরব বটগাছের নিচে বসে পুঁথির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তার চোখে তখন একপ্রকার উন্মাদনা। সে জানত, মন্ত্রের চূড়ান্ত শক্তি জাগাতে হলে তাকে নিজের রক্ত দান করতে হবে। সে বাম হাতের আঙুল কেটে রক্ত মাটিতে ঢেলে দিল। শ্মশানের বালি যেন সেই রক্ত চুষে নিল তৃষ্ণার্তের মত। বাতাস ঘনিয়ে এল, আর ছায়ামূর্তিরা আরও স্পষ্ট হতে লাগল। শ্মশানের বাতাসে ভেসে আসতে লাগল অদ্ভুত আর্তনাদ—যা কেবল মৃতের নয়, জীবিত আত্মারও। কালভৈরব তখন হঠাৎ আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠল, “এসো! এসো নীল খঞ্জন আত্মা! আমি তোমাকে ডাকি! আমার শক্তি হও!” দূরের গঙ্গার পাড়ের দিকে হাওয়া বইতে লাগল, আর সেই হাওয়ার সাথে কুয়াশার মতো ধোঁয়া ভেসে এসে জড়িয়ে ধরতে লাগল শ্মশানকে। সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে বড় হতে থাকল এক ছায়ার আকার—আধা মানব, আধা অদৃশ্য, লালচে আগুনের মত চোখ।
পণ্ডিত বিষ্ণুপদ, আজিজানন্দ, বিজয় আর মাধবী শ্মশানের কিনারায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ধূপ জ্বালিয়ে হাতে রাখল আর বলল, “আর সময় নেই। মন্ত্র সমাহিত করতে হবে এখনই। শ্মশানের শক্তি ভাঙতে হলে এই ধূপের পবিত্রতা আর মন্ত্রের শক্তি মিশিয়ে শঙ্খ ধ্বনি দিতে হবে।” বিজয় বুকের গভীর থেকে সাহস সঞ্চয় করল। মাধবী এক মুঠো গঙ্গাজল নিয়ে ছিটিয়ে দিল শ্মশানের বালির দিকে। শ্মশান যেন কেঁপে উঠল সেই গঙ্গাজলের স্পর্শে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক নতুন শক্তির গন্ধ। কিন্তু কালভৈরব হেসে উঠল। তার কণ্ঠস্বর শ্মশানজুড়ে প্রতিধ্বনিত হল, “তোরা কিছুই পারবি না। এই রাত আমার, এই মন্ত্র আমার। নীল খঞ্জন আত্মা আমার শক্তি হবে!” ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকালো, আর নীল খঞ্জন আত্মা ধীরে ধীরে কালভৈরবের দিকে এগিয়ে এলো—তার চোখে লাল আগুন, তার নিশ্বাসে মিশে মৃতের পচা মাংসের গন্ধ। বিজয় বুঝল, এ আর থামানো যাবে না যদি না তারা এখনই শঙ্খ ধ্বনি আর মন্ত্রপাঠ শুরু করে। শ্মশানজুড়ে তখন শুধু বাতাস, ধোঁয়া আর মৃত্যু-গন্ধে মিশে থাকা অশুভ শক্তির রাজত্ব।
অধ্যায় ৭ —
শ্মশানের নিস্তব্ধ বাতাস হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল শঙ্খের ধ্বনিতে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য হাতের ধূপ মাটিতে স্থাপন করে, শঙ্খটিকে উঁচু করে ধরে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ফুঁ দিলেন। শঙ্খের শব্দ যেন বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলল, শ্মশানের বালিতে অদৃশ্য কম্পন তুলল। সেই শঙ্খধ্বনি শ্মশান ঘিরে থাকা অশুভ শক্তিগুলোকে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিল। বাতাসে মিশে থাকা পচা গন্ধের স্রোত যেন থেমে গেল। কালভৈরবের মুখের বিকৃত হাসি এক লহমায় মুছে গেল। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল বিষ্ণুপদের দিকে। তার চোখে আগুনের মত লাল আভা। শ্মশানের বটগাছের ডালপালা শঙ্খের কম্পনে দুলছিল, আর পুঁথির ছেঁড়া পাতা বাতাসে ঘুরপাক খেতে খেতে জড়িয়ে যাচ্ছিল শঙ্খের ধ্বনির তরঙ্গে। বিজয় মাটিতে বসে মন্ত্রপাঠ শুরু করল, কাঁপা কণ্ঠে, কিন্তু দৃঢ় চিত্তে। মাধবী গঙ্গাজল ছিটিয়ে শ্মশানের চারপাশে বৃত্ত আঁকছিল, যেন সেই বৃত্তের ভেতরে অশুভ শক্তিকে বেঁধে রাখা যায়। শ্মশানের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু শঙ্খধ্বনি থেমে থেমে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শ্মশানজুড়ে, আর তার সঙ্গে মিশছিল মন্ত্রের ধ্বনি।
কালভৈরব ততক্ষণে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। সে হাতে থাকা পুঁথির ছেঁড়া পাতাগুলো আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল আর বলল, “তোরা চাইলেই কিছু হবে না! এই মন্ত্র এখন আমার রক্তের সঙ্গে মিশেছে। এই আত্মা আমার ইচ্ছার দাস!” কিন্তু নীল খঞ্জন আত্মা থেমে রইল না। কালচে ধোঁয়ার ভেতর থেকে সেই অর্ধপ্রেত অর্ধমানব আকৃতি ধীরে ধীরে কালভৈরবের দিকে এগিয়ে এল। তার চোখে রক্তিম আগুনের আভা, তার হাত যেন লম্বা হয়ে কালভৈরবের বুকে এসে পৌঁছতে চাইছে। কালভৈরব এক মুহূর্তের জন্য পিছিয়ে গেল, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, সে বুঝতে পারছিল যে এই আত্মা আর তার বশে নেই। বিজয় তখন উঠে দাঁড়াল, হাত তুলে মন্ত্রপাঠ জোরালো করে তুলল। তার কণ্ঠস্বর শ্মশানের বাতাসে মিশে এক তেজময় কম্পন তুলল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ আর মাধবীও একসঙ্গে মন্ত্রপাঠে লিপ্ত হল। শ্মশানের অন্ধকারে সেই শব্দ যেন আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।
শ্মশানের বালির ওপর বৃত্তের চারপাশে বাতাস ঘূর্ণি খেতে লাগল। ধোঁয়ার স্রোত সেই বৃত্তের ভেতরে আটকে পড়তে লাগল। নীল খঞ্জন আত্মা কেঁপে উঠল, তার লালচে চোখ যেন নিভে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু কালভৈরব হঠাৎ করে শ্মশানের মাটি থেকে এক মুঠো ছাই তুলে নিজের চোখে মুখে মেখে আবার বিকৃত হাসিতে ফেটে পড়ল। সে বলল, “তোমরা যা পারো করো, কিন্তু আমার রক্তের সঙ্গে যে মন্ত্র মিশেছে, তা আর কেউ থামাতে পারবে না!” সে নিজের বুক চিরে রক্ত বার করে সেই বালিতে ছড়িয়ে দিল। বালি রক্ত শুষে নিল, আর সেই রক্তের ছোঁয়ায় বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ আত্মা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। শ্মশানের বাতাস হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল। বিদ্যুৎ ঝলকে গাছের ছায়া যেন শ্মশানের চারপাশে নৃত্য করতে লাগল। আত্মার অর্ধমানব চেহারা ফেটে বেরিয়ে এল আরও বড় ছায়ায়, যেন সমস্ত শ্মশানকে ঢেকে নেবে। মাধবী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে গঙ্গাজল ছিটিয়ে গেল, পণ্ডিত বিষ্ণুপদ চোখ বুজে জপে ডুবে গেলেন। বিজয় জানত, এ এখন জীবন-মরণের লড়াই।
শেষে বিজয়, পণ্ডিত বিষ্ণুপদ আর মাধবী মিলে শেষ প্রচেষ্টা চালাল। বিজয় নিজের বুকের ভেতর থেকে ভয় দূর করে শঙ্খ হাতে নিল। সে জানত, এই শঙ্খধ্বনি, এই মন্ত্রপাঠই শেষ চেষ্টা। শঙ্খের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, সেই ধ্বনি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে শ্মশানের ভেতর ঢুকে পড়ল। নীল খঞ্জন আত্মা হাহাকার করে উঠল, তার লালচে চোখ নিভে যেতে লাগল। বাতাসে আবারও সেই শঙ্খ আর মন্ত্রের শক্তি প্রতিধ্বনিত হল। কালভৈরব হতভম্ব হয়ে পিছু হটল। শ্মশানের মাটিতে তখন পুঁথির ছেঁড়া পাতাগুলো মিশে যাচ্ছে বালির সাথে। বিদ্যুতের এক তীব্র ঝলকে বটগাছের ডাল ভেঙে পড়ল কালভৈরবের ওপর। শ্মশানজুড়ে এক ভয়াল নিস্তব্ধতা নেমে এল। বাতাস থেমে গেল। আর বিজয়, পণ্ডিত বিষ্ণুপদ আর মাধবী তখন জানত, তাদের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। রাতের অন্ধকারে শ্মশানের বুক থেকে হাওয়ায় মিশে থাকা আত্মার আর্তনাদ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই শক্তির কথা, যা অন্ধকারের গহীনে এখনও জেগে রয়েছে, নতুন কোনও সর্বনাশ ডেকে আনার অপেক্ষায়।
অধ্যায় ৮ —
শ্মশানের বটগাছের তলা তখন যেন এক মৃত্যুর মঞ্চ। কালভৈরব বিদ্যুতের ঝলকে ভাঙা ডালের নিচে পড়ে শ্বাসকষ্টে কাঁপছিল। তার মুখের বিকৃত হাসি মিলিয়ে গিয়ে এসেছে ভয়ের ছায়া। সে জানত, তার ডাকা শক্তি আর তার বশে নেই। সেই শীতল বাতাসে নীল খঞ্জন আত্মা ধীরে ধীরে চারপাশের অন্ধকারকে গিলে খাচ্ছিল। শ্মশানের বালিতে তার ছায়া পড়ে যেন শ্মশানজুড়ে অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠছিল। তার লালচে চোখ বিজয়ের দলের দিকে তাকিয়ে যেন হাহাকার করছিল, কিন্তু সেই হাহাকার করুণা পেত না, পেত এক প্রলয়ের ডাক। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ তখন নিজের শঙ্খ হাতে নিয়ে এক লহমায় শ্মশানের বালিতে পুঁথির ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে জড়ো করতে লাগলেন। বিজয় একমনে মন্ত্রপাঠে ডুবে গেল। মাধবী গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা নিয়ে শ্মশানের বৃত্তের চারপাশে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কালভৈরব শেষবারের মতো গর্জন করে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো! এই শক্তি আর আমার নয়!” কিন্তু সেই আর্তি অন্ধকারে ডুবে গেল নীল খঞ্জন আত্মার শীতল নিশ্বাসে।
শ্মশানজুড়ে তখন মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখা মুছে যাচ্ছিল। নীল খঞ্জন আত্মা তার লম্বা ছায়া বাড়িয়ে কালভৈরবের দেহ ছুঁয়ে দিল। কালভৈরবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তার চোখের লালিমা নিভে গেল, আর সে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল বালিতে। শ্মশানের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল প্রাচীন অভিশপ্ত আত্মার তৃপ্তির শীতলতা। কিন্তু বিজয় জানত, সব শেষ হয়নি। এখন এই শক্তিকে সমাধিস্থ করতে হবে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ শঙ্খধ্বনি তুললেন, সেই ধ্বনি শ্মশান কাঁপিয়ে তুলল। বালির ভেতর থেকে যেন মৃতদের আত্মার আর্তনাদ ভেসে এল, শ্মশানের বটগাছের ডালপালা থরথর করে কেঁপে উঠল। বিজয় ও মাধবী একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ জোরালো করে তুলল, তাদের কণ্ঠস্বর এক লয়ে মিশে গেল পবিত্র শঙ্খধ্বনির সাথে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সেই মন্ত্রের তেজ, যা নীল খঞ্জন আত্মাকে ধীরে ধীরে বালির ভেতর ঠেলে দিতে শুরু করল।
আকাশের অন্ধকারে বিদ্যুৎ ছিঁড়ে ফেলল মেঘের পর্দা, আর শ্মশানজুড়ে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টির ফোঁটা গঙ্গাজলের মতো পবিত্র মনে হচ্ছিল, যা শ্মশানের বালিকে ধুয়ে দিতে লাগল। নীল খঞ্জন আত্মা ক্রমশ ছোট হতে শুরু করল, তার লাল চোখ নিভে আসছিল। সে চিৎকার করে উঠল এক বিকৃত আর্তনাদে—যা শ্মশান আর গঙ্গার পাড় কাঁপিয়ে তুলল। বৃষ্টির জলে তার ছায়া গলে গিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ সেই সুযোগে পুঁথির ছেঁড়া পাতা একত্র করে অগ্নি জ্বালিয়ে তার ভেতর নিক্ষেপ করলেন। সেই অগ্নিশিখা শ্মশানের অন্ধকারকে ভেদ করে আলো ছড়িয়ে দিল। বিজয় শঙ্খের ধ্বনি আর মন্ত্রের তেজে শেষ চেষ্টায় বালির ভেতর নীল খঞ্জন আত্মাকে পুঁতে দেওয়ার প্রয়াস চালাল। বৃষ্টি, মন্ত্র আর শঙ্খের ধ্বনি মিলে যেন শ্মশানকে পবিত্র করে তুলল। কালভৈরবের নিথর দেহ তখন বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছিল, আর তার মুখে ফুটে উঠছিল এক গভীর অনুতাপের ছাপ।
শেষপর্যন্ত শ্মশানের বাতাস হালকা হয়ে এল। বৃষ্টি থেমে গেল, আকাশ ফিকে আলোয় ভরে উঠল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ধীরে ধীরে শ্মশানের বালিতে বসে পড়লেন। বিজয় আর মাধবী শ্বাসকষ্ট নিয়ে বসল বটগাছের তলায়। চারপাশে নেমে এল এক শূন্যতা, এক নিস্তব্ধ শান্তি, যা বহু বছর শ্মশান দেখেনি। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ বললেন, “আজ যে অভিশাপ ঘুচল, তা কেবল তোমাদের সাহস আর বিশ্বাসের জন্য। এই মন্ত্র আর কখনও মানুষ জাগানোর চেষ্টা করবে না, নাহলে ধ্বংস অনিবার্য।” বিজয় মাথা নত করে বলল, “আমার লোভই সর্বনাশের দ্বার খুলেছিল, পণ্ডিতমশাই। আজ আমি শিখলাম, শক্তি কখনও লোভের জন্য নয়, সেবার জন্য।” শ্মশানের বালির ভেতর তখন নিভে যাচ্ছিল সেই অশুভ ছায়ার শেষ চিহ্ন, আর বাতাসে ভেসে আসছিল গঙ্গার পবিত্র ধারার সুগন্ধ। কালভৈরবের দেহকে শ্মশানের মাটিতে সমাধি দেওয়া হল, আর পণ্ডিত বিষ্ণুপদ বললেন, “আত্মা শান্তি পাক, আর এই শ্মশান আবার হোক বিশ্রামের স্থান, ভয়ের নয়।” রাতের শেষ প্রহরে, দূরের আকাশে এক ফিকে চাঁদ উঁকি দিচ্ছিল, আর শ্মশানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল শান্তির নিঃশ্বাস।
অধ্যায় ৯ —
শ্মশানের রাত পেরিয়ে সকাল হলো। ভোরের প্রথম আলো গঙ্গার জলে পড়ে চিকচিক করছিল, আর সেই আলো শ্মশানের কালো ছায়াকে যেন ধুয়ে মুছে দিতে চাইছিল। গ্রামের মানুষজন একে একে মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হতে লাগল। কালরাত্রির ঘটনার কথা সবার মুখে মুখে ফিরছিল। মেয়েরা গঙ্গাজল নিয়ে ঘরের চৌকাঠে ছিটিয়ে দিচ্ছিল, পুরুষরা মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছিল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য শ্মশানের বালিতে বসে ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে শেষ শুদ্ধিকরণের মন্ত্রপাঠ করছিলেন। বিজয় শ্মশান থেকে ফিরে মন্দির চত্বরে এসে মাটিতে বসে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর অজস্র পাথরের ভার চেপে বসেছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কালভৈরবের মুখ—যে লোভের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ডেকে এনেছিল নিজের ওপর। বিজয় মাটিতে শুয়ে পড়ে বলল, “পণ্ডিতমশাই, এই সর্বনাশের জন্য আমি দায়ী। আমিই চেয়েছিলাম সেই শক্তি, যেটা মানুষকে নয়, অশুভ শক্তিকে ডেকে আনে।” তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যাচ্ছিল অনুতাপে।
গ্রামের মানুষ বিজয়ের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, “বিজয়, তোর সাহস ছাড়া কালরাত্রি পেরনো সম্ভব হত না।” আবার কেউ বলল, “ভুল করেছিলি ঠিক, কিন্তু তোরই চেষ্টায় সর্বনাশ ঠেকেছে।” পণ্ডিত বিষ্ণুপদ এগিয়ে এসে বিজয়কে উঠিয়ে ধরলেন। বললেন, “ভুল করলেই সর্বনাশ হয় না, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষই পারে অন্ধকার থেকে আলো খুঁজে পেতে। তুই যা করেছিস, তা সাহসের কাজ। মনে রাখিস, তন্ত্রের শক্তি লোভের জন্য নয়, কল্যাণের জন্য।” মাধবী দূর থেকে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল। তার চোখে তখন বিজয়ের জন্য এক অজানা স্নেহের ছায়া ফুটে উঠেছিল। সে জানত, বিজয় নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আর এ অনুতাপ তাকে নতুন মানুষ করবে। সেই ভোরের শান্ত বাতাসে গঙ্গার ধার থেকে আসা পবিত্র গন্ধ গ্রামের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ছিল, যা রাতের অশুভ শক্তির সমস্ত ছায়া দূর করে দিতে চাইছিল।
বিজয় মন্দিরের সিঁড়িতে বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিল। সূর্যের আলো গঙ্গাজলে লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। মাধবী পাশে এসে বসল। সে বলল, “সবাইকে ফিরিয়ে এনেছ বিজয়দা। কাল রাতের জন্য তুমি যে যুদ্ধে লড়েছ, তা অনেকেই পারত না।” বিজয় মৃদু কণ্ঠে বলল, “মাধবী, আমি শক্তি চেয়েছিলাম নিজের লোভের জন্য। আমি চেয়েছিলাম মানুষকে বশ করার শক্তি, অথচ শক্তি বশ করে আমাকেই গ্রাস করতে এসেছিল অশুভ আত্মা। আমি লজ্জিত।” মাধবী তার হাতের ওপর হাত রাখল, বলল, “যে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারে, সে সবচেয়ে বড় শক্তিমান। এখন তুমিই আমাদের আলোর পথ দেখাবে।” বিজয়ের চোখের কোণ ভিজে এল, কিন্তু বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শান্তি বয়ে গেল। দূরে শোনা যাচ্ছিল গ্রামের মানুষদের প্রার্থনার সুর, আর সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দের সাথে।
গ্রামে নতুন করে আশার সঞ্চার হলো। মন্দিরে প্রতিদিন সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলতে শুরু করল, গঙ্গার ঘাটে পুণ্যস্নান করে মানুষ আবার প্রার্থনা করতে লাগল। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ গ্রামের মাঝখানে পুঁথির ছেঁড়া পাতাগুলোর ছাই মিশিয়ে একটি পবিত্র বেদী তৈরি করলেন। তিনি বললেন, “এই বেদী আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে তন্ত্রের শক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য, লোভের জন্য নয়। আমরা সবাই মিলে শপথ নেব, আর কখনও অশুভ শক্তিকে ডাকার চেষ্টা করব না।” বিজয়, মাধবী, আজিজানন্দ সহ গ্রামের সকলেই সেই শপথ নিল। শ্মশান আবার হয়ে উঠল নীরব বিশ্রামের স্থান। আর গঙ্গার পবিত্র জলে ভেসে গেল রাতের অশুভতার শেষ ছায়া। চন্দ্রপুর গ্রাম আবার শান্তির শ্বাস ফেলল। আর বিজয় জানত, নতুন দিনের সূর্য কেবল আলোই আনবে, অন্ধকার নয়।
অধ্যায় ১০ —
ভোরের আলোতে চন্দ্রপুর গ্রাম নতুন প্রাণ ফিরে পেল। গঙ্গার পাড়ে পাখির কাকলি মিশে যাচ্ছিল ঢেউয়ের মৃদু শব্দে। রাতের বিভীষিকা যেন এক দুঃস্বপ্নের মতো মিলিয়ে গিয়েছিল, আর সেই জায়গা নিয়েছিল প্রশান্তির এক কোমল ছোঁয়া। গ্রামবাসীরা মন্দির চত্বর আর শ্মশান পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিল। গঙ্গাজল ছিটিয়ে মাটি পবিত্র করা হচ্ছিল, নতুন করে ধূপ-প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছিল মন্দিরে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ মন্ত্রপাঠ করে শ্মশানের চারপাশে গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, আর তার চোখে ছিল এক তৃপ্তির দীপ্তি—যে তন্ত্রের অমঙ্গলকে রাতের অন্ধকারে তারা রুখে দিতে পেরেছে। বিজয় মন্দিরের সিঁড়িতে বসে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত অন্ধকার ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ভেতরে এক নতুন আলোর শিখা জ্বলে উঠেছে—যে আলো তাকে নতুন পথে নিয়ে যাবে।
বিজয় ঠিক করল, এই গ্রামে থেকে সে আর তন্ত্রের শক্তিকে হাতিয়ার করবে না। সে এবার মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। পণ্ডিত বিষ্ণুপদের কাছে বসে সে তন্ত্রের কল্যাণমুখী দিকগুলি শিখতে শুরু করল। মাধবী তার পাশে এসে বসে বলল, “তুমি পারবে বিজয়দা। তুমি তো অন্ধকারের ভেতর থেকে আলোর পথ দেখেছ। এখন তোমার হাতেই গ্রামের কল্যাণ।” বিজয় মৃদু হেসে বলল, “মাধবী, এই গ্রাম আমাদের। আমরা সবাই মিলে নতুন দিন আনব।” গ্রামের মানুষজনও ধীরে ধীরে বিজয়ের দিকে ফিরে আসতে শুরু করল। তারা তাকে সেই মানুষ হিসেবেই দেখতে লাগল, যে রাতের অন্ধকার ভেদ করে গ্রামের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছে। মন্দিরে তার নামেই তৈরি হল একটি প্রদীপঘর, যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় আলো জ্বলবে, এই গ্রামের আলোর প্রতীক হিসেবে।
মাধবী আর বিজয়ের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে আরও গভীর হতে থাকল। মাধবীর চোখে বিজয় নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠল। প্রতিদিন বিকেলে তারা গঙ্গার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখত, আর গ্রাম আর মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলত। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ মাঝে মাঝে তাদের পাশে বসে বলতেন, “দেখো, তন্ত্রের শক্তি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলেই তন্ত্র পবিত্র থাকে। আর সেই শক্তি তখনই সত্যি হয়, যখন তাতে থাকে ভক্তি আর সততা।” বিজয় মন দিয়ে সেই কথা শুনত। তার মনে গভীরে গিয়ে গেঁথে যেত পণ্ডিতের সেই বাণী। সেই বিকেলগুলোয় গঙ্গার বাতাস বয়ে আনত নতুন জীবনের স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নে বিজয় আর মাধবী দুজনেই জড়িয়ে যেত এক অদৃশ্য বন্ধনে।
অবশেষে চন্দ্রপুর গ্রাম এক নতুন জীবন পেতে শুরু করল। শ্মশান আবার হয়ে উঠল শান্ত বিশ্রামের স্থান। মন্দিরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধূপপ্রদীপ জ্বলত, আর সেই আলো গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। বিজয় গ্রামের দরিদ্র শিশুদের তন্ত্রশাস্ত্রের কল্যাণমুখী শিক্ষা দিতে শুরু করল, যাতে তারা কখনও অশুভের পথে না যায়। মাধবী গ্রামের মেয়েদের নিয়ে গঙ্গার পাড়ে আশ্রম গড়ে তুলল, যেখানে তারা সেলাই, বুনন আর পুজোয় ব্যবহৃত পবিত্র জিনিস তৈরি করত। পণ্ডিত বিষ্ণুপদ একদিন বিজয়কে বললেন, “দেখেছিস, তোর অনুতাপ আর সাহস কেমন করে অমঙ্গলকে মুছে দিয়ে কল্যাণের পথ দেখিয়েছে।” বিজয় মাথা নিচু করে বলল, “পণ্ডিতমশাই, আপনিই শিখিয়েছেন শক্তির সত্যিকারের অর্থ। এখন শুধু চাই এই আলোর পথে এগিয়ে যেতে।” আর দূর আকাশে, গঙ্গার পাড়ে, সূর্য ঢলে পড়ছিল, আর সেই সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছিল চন্দ্রপুর গ্রামে, অমঙ্গল-জর্জরিত অতীতকে পেছনে ফেলে শান্তির নতুন দিনের বার্তা নিয়ে।
সমাপ্ত