Bangla - তন্ত্র

তন্ত্রের আঁধারে

Spread the love

সব্যসাচী হাজরা


পর্ব ১: রহস্যময় পুস্তক

শীতের রাত। চারপাশে একটা গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। কলকাতার শহরতলির প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো দোতলা বাড়িটা যেন রাতের আঁধারে আরও বেশি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। সেখানেই থাকত আকাশ সেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক। তার পড়াশোনার বিষয় ছিল “ভারতের লোকবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক ইতিহাস”, বিশেষ করে তন্ত্রবিদ্যার ওপর সে গভীর আগ্রহী ছিল। তবে তার এই আগ্রহ ছিল শুধু বইপত্র পড়া ও গবেষণার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ—অন্তত সে তাই ভাবত।

এক সন্ধ্যায়, কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুকেছিল আকাশ। দোকানটা ছিল অদ্ভুত রকমের নিঃসঙ্গ, যেন কেউ ঢোকে না কখনও। ধুলো জমা তাকের মধ্যে হঠাৎ তার নজর পড়ল একটা মোটা চামড়া বাঁধানো বইয়ে। বইটির নাম ছিল না, লেখকের নামও লেখা ছিল না। শুধু বাঁধাইয়ের ওপর একটা সাদা তাম্রচিহ্ন খোদাই করা—একটা অর্ধচন্দ্র, তার ভেতরে চোখের মতো একটা প্রতীক।

আকাশের মনে হল বইটা যেন তাকে ডাকছে। সে হাত বাড়িয়ে বইটা তুলতেই একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল চারপাশে, অথচ দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। বুকটা ধড়ফড় করছিল, কিন্তু সে বইটা কিনে ফেলল। দোকানদার শুধু বলল, “খুলে দেখার আগে দু’বার ভাবো। সব জ্ঞান আশীর্বাদ হয় না।”

আকাশ হেসে বলল, “আমি শুধু গবেষণার জন্য নিচ্ছি।”

বাড়ি ফিরে সে বইটা খুলে বসল নিজের পড়ার ঘরে। বাইরের জানালায় তখনো হালকা কুয়াশা জমেছে, আর রাস্তায় একটা কুকুরের ডাকে চারদিক কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। বইটার প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা ছিল প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা, তবে পাশে বাংলায় অনুবাদ করা ছিল। বিষয়বস্তু ছিল তন্ত্র সাধনার প্রাচীন পদ্ধতি—কিন্তু এর বর্ণনা ছিল এমনভাবে, যেন লেখক নিজে তন্ত্র সাধনার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এবং অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।

তৃতীয় অধ্যায়ে এসে আকাশ থমকে গেল। পৃষ্ঠার মাঝখানে একটা মন্ত্র লেখা ছিল, আর তার নিচে সাবধানবাণী—”এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে জীবনের দ্বার খুলে যাবে, কিন্তু কোন জীবন? এই প্রশ্ন করার সুযোগ নাও পাবে।”

মন্ত্রটি ছিল—

“ক্লীং কলিকা চণ্ডিকা যক্ষিণী ত্রিনয়নী,

দেখাও আমাকে অন্ধকারের জ্যোতি।

বদ্ধ দ্বার খুলুক আজ, প্রাণে আসুক আগুনের সুর।”

আকাশ মন্ত্রটা পড়তে পড়তে বুঝতেও পারল না কখন যেন তার ঘরের বাতি নিভে গেল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ঘরের দেয়াল যেন সরে আসছে। সে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই পড়ে গেল—মেঝেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে বরফের মতো। হঠাৎ, দরজার বাইরে থেকে ভেসে এল এক নারীর হাসি—একটা কাঁপানো, ঠান্ডা, ধ্বংসাত্মক হাসি।

আকাশ জানত, সে এক ভুল করে ফেলেছে। সে যেটা গবেষণার বস্তু বলে ভেবেছিল, সেটা কেবলই এক বাস্তব শক্তির দরজা ছিল, যে শক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে কেবল গল্পে, পুরাণে বা স্বপ্নে।

হঠাৎ করে বাতিটা জ্বলে উঠল আবার। ঘরের সবকিছু ঠিক আছে যেন। কিন্তু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটা কে?

একটা ছায়ামূর্তি। উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট, মাথায় চুল এলোমেলো, মুখ দেখা যায় না। তার দিকে তাকিয়েই আকাশ বোঝে—সে আর একা নেই।

সেই ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় দেয়ালের ভেতর, যেন কোনও অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু তার পরে, বইটার শেষ পৃষ্ঠায় হঠাৎ এক নতুন লাইন যোগ হয়—

“প্রথম দৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় দণ্ডে তুমি প্রবেশ করছ। প্রস্তুত হও ত্যাগের জন্য।”

আকাশের হাত কাঁপছিল, বুক ধড়ফড় করছিল, তবু সে পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতেই থাকল। আর প্রতিটা শব্দের সঙ্গে মনে হচ্ছিল, তার নিজের ভিতরের একটা স্তর খুলছে—আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক অচেনা, অশুভ কিছু।

এই ছিল শুরু—একটা পুস্তক, এক উচ্চারিত মন্ত্র, আর এক ছায়াময় আগমন। কিন্তু এটা কেবল শুরু। কেননা একবার তন্ত্রের আঁধারে প্রবেশ করলে, আলোয় ফিরে আসা হয় না আর সহজে।

পর্ব ২: দ্বিতীয় সম্বন্ধ

আগামী কয়েকদিন আকাশের ঘুম হয় না ঠিকমতো। প্রতিদিন রাতেই ঘরের এক কোণে যেন একটা ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে সরাসরি না দেখলেও অনুভব করে সে—ছায়াটা তাকিয়ে আছে, কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিবার আলো জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে ছায়াটা মিলিয়ে যায়। কিন্তু সেই পুস্তকটির শেষ পাতায় প্রতিদিন নতুন কিছু লেখা দেখতে পায় আকাশ।

প্রথমে সে ভেবেছিল ওসব হ্যালুসিনেশন, কিন্তু এবার আর ভুল করার সুযোগ ছিল না। আজ সকালেই সে লক্ষ্য করেছে, তার বাম হাতে একটি কালচে দাগ উঠে এসেছে। বৃত্তাকার দাগ, ঠিক সেই চিহ্নের মতো যা বইটার গায়ে খোদাই করা ছিল—অর্ধচন্দ্রের মধ্যে চোখের প্রতীক।

ভয় আর কৌতূহলের মাঝখানে দোল খেতে খেতে সে ঠিক করল, তার একমাত্র বন্ধু রাহুলের সঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নেবে। রাহুলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের, আর রাহুল নিজেও প্রাচীন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও লোকবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করছিল। তবে রাহুল ছিল আকাশের চেয়ে একটু বেশি বাস্তববাদী, কিছুটা নির্লিপ্ত এবং ঠান্ডা মস্তিষ্কের।

বিকেলে আকাশ রাহুলের বাড়িতে গিয়ে বইটি খুলে তাকে দেখাল। রাহুল প্রথমে একটু হাসলেও, বইয়ের পাতাগুলো দেখে সে গম্ভীর হয়ে উঠল। সে পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বইটা আমি চিনি। আমার ঠাকুরদার সংগ্রহে এর মতো আরেকটা কপি ছিল। কিন্তু সেই বইটা কেউ একবার খোলার পর উধাও হয়ে যায়। ওঁরা বলতেন, এটা ‘উজ্জ্বল অন্ধকার’ থেকে এসেছে। কেউ এই মন্ত্র ব্যবহার করলে, সে তন্ত্রচক্রে প্রবেশ করে—ফিরে আসাটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে।”

আকাশ কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এখন আমি কী করব?”

রাহুল উত্তর দিল, “তুই শুরু করেছিস, এখন শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু একা নয়। আমি আছি। কিন্তু তোকে সতর্ক থাকতে হবে—তন্ত্র সাধনা কেবল মন্ত্র পড়ে শেষ হয় না। এটা আত্মার বিনিময় চায়।”

দু’জনে মিলে ঠিক করল, তারা একটা প্রাথমিক তন্ত্র ক্রিয়া করবে, যাকে বলে ‘দ্বিতীয় সম্বন্ধ’। এই সাধনার মাধ্যমে বোঝা যায়, কে ডাক পাঠিয়েছে, কেন পাঠিয়েছে, এবং সেই শক্তি কেমন প্রবৃত্তির। তবে এই ক্রিয়া চালাতে হবে নির্জনে—প্রকৃতির কাছাকাছি, যেখানকার পরিবেশে তন্ত্র শক্তি সহজে প্রবাহিত হয়।

তারা বেছে নিল গড়িয়ার পাশে থাকা পুরনো গোরস্থানটির পেছনের বনভূমি। সে জায়গাটাকে লোকেরা এড়িয়ে চলে, কারণ শোনা যায় রাতের বেলায় নাকি ওখানে কান্নার শব্দ শোনা যায়, বাতাসেও নাকি ধূপ-ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে নিজে থেকেই।

রাত দশটায় দুজনেই পৌঁছে গেল নির্ধারিত জায়গায়। আকাশ পুস্তকটি হাতে নিয়েই দাঁড়াল বৃত্তের মাঝখানে, রাহুল চারপাশে লাল সিঁদুর দিয়ে মাটি চিহ্নিত করল। পাঁচটি দিক ঠিক করে মাটিতে পাঁচটি প্রদীপ জ্বালানো হল। বায়ু থমকে গিয়েছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই চুপ করে দেখছে কী হয়।

রাহুল মন্ত্র শুরু করল—

“অগ্নিমুখী কালিকা, দিগ্বলয় ছিন্ন করো,

প্রেতলোকের দ্বার খুলে, আসো তুমি, শক্তির রূপে!”

আকাশ তার হাতে থাকা পুস্তক থেকে উচ্চারণ করল সেই আগের মন্ত্র। মুহূর্তেই চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে এল, প্রদীপের আলো যেন নিভে যেতে চাইছে, কিন্তু নিভল না। আকাশের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। তার মনে হল বুকের ভেতর কেউ চাপ দিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করতেই সে দেখল এক বিশাল দরজা, কালো পাথরের তৈরি। দরজার দুই পাশে দুটি চোখ—তন্দ্রাচ্ছন্ন, কিন্তু জানে সে এসেছে।

রাহুল তখন বলল, “প্রথম সাড়া পাওয়া গেছে। এখন তোর ভেতরের শক্তির প্রতিচ্ছবি দেখা দেবে।”

আকাশ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মুখ—রক্তাক্ত, পুড়ে যাওয়া, চোখদুটো শুধু সাদা সাদা গোলক। সেই মুখটা বলল, “তুই ডাকছিস আমাকে? আমি তো অনেক আগেই তোর ভেতরে বাস করছি।”

তাড়াতাড়ি রাহুল মন্ত্র থামিয়ে দেয়। সব আলো নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে।

আকাশ পড়ে গিয়েছিল, নিঃশ্বাস নিচ্ছিল হাপরের মতো। সে ধীরে ধীরে উঠে বলল, “আমি তাকেই দেখেছি, যাকে ছোটবেলায় স্বপ্নে দেখতাম—যে আমাকে ডাকত, বলত আমি নাকি তার উত্তরসূরি। আমি জানতাম না এটা বাস্তব!”

রাহুল চোখ নামিয়ে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না, তোকে কেন এই বইটা পেয়েছে। তোকে ডাকা হয়েছে কারণ তুই একটা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে আসা আত্মার উত্তরসূরি। এখন এটা কেবল তোর হাতেই নয়—তোর রক্তের মধ্যে শুরু হয়েছে পরিবর্তন।”

আকাশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, সে আর ফিরে যেতে পারবে না। বইটা তাকে বেছে নিয়েছে।

পর্ব ৩: অশুভ শক্তির আগমন

আকাশ ঘর ফিরে এসে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন তার জীবনের সমস্ত কিছু পালটে গেছে—তার সত্ত্বা, তার পৃথিবী, সব কিছু। তন্ত্রের পথ বেছে নেওয়ার পর থেকে তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এক অদৃশ্য শক্তি তার ওপর শাসন করছে, এবং তার প্রভাব দিনকে দিন আরও দৃঢ় হচ্ছে।

প্রথমে সে বুঝতে পারেনি, কিন্তু কিছু দিন পরেই তাকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেই শক্তি শুধুমাত্র একমাত্র তন্ত্র সাধনা থেকে আসছে। তার শখের বইগুলো, পুরনো গবেষণাগুলি—সব কিছু যেন দুর্বল হয়ে গেছে তার কাছে। তার মনোযোগ কেবল সেই অদ্ভুত বইয়ের দিকে চলে গিয়েছে, যা রাহুলের সঙ্গে শুরু হওয়া তন্ত্র সাধনার পর থেকে তাকে অস্থির করে তুলেছিল।

অবশেষে, এক রাতে, আকাশ এক নতুন অভিজ্ঞতা পেল। সে তখন একটি গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিল। হঠাৎ, তার শরীরের ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়, যেন কোনও অদৃশ্য শব্দ তার মাথায় ঢুকছে। তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেল, আর তার চোখের সামনে অন্ধকারের মাঝে এক উজ্জ্বল আলো ফুটে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এটা কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়—এটা তন্ত্র শক্তির সরাসরি প্রভাব।

তার ঘরের বাতি ছাড়া আর কোনো আলো ছিল না, তবে এক অদ্ভুত আলো তার সারা ঘরকে আলোকিত করে ফেলেছিল। সেই আলোর মধ্যে ভেসে উঠেছিল এক নারীর ছবি—রক্তিম, মরমী এক চেহারা, যার চোখ গম্ভীর এবং হাহাকার ভরা। আকাশ চেষ্টা করেছিল তার চোখ মেলে তাকানোর, কিন্তু তার শরীর একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছিল।

ওই নারীর মুখ থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো: “তুমি আমাকে ডাকছ, আকাশ। আমি তোমার ভেতরে আছি। তোমার রক্তে আমি প্রবাহিত হচ্ছি। আমার পেছনে যেতে চেয়েছিলে, তাই তুমি এখানকার বাসিন্দা হয়ে উঠেছ।”

আকাশ হঠাৎ নিজেকে অদ্ভুতভাবে শক্তিহীন মনে করতে থাকে। এই শক্তি তাকে যে দিকেই নিয়ে যেতে চায়, সে নিজেই তা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু একটাই বিষয় নিশ্চিত ছিল—সে আর কোনো সাধারণ মানুষ নেই। তন্ত্রের শক্তির মধ্যে সে নিজে এক নতুন রূপ ধারণ করেছে।

এক সপ্তাহ পর, রাহুল আবার তার কাছে আসে। আকাশের মনের অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠেছিল। তার ভেতর এক অজানা শক্তি উথালপাথাল হচ্ছিল। তবে রাহুল একেবারে চিন্তিত মনে আকাশের কাছে আসার পর বলল, “আকাশ, তুই কী জানিস, তন্ত্র সাধনা যদি শুরু করিস, তবে তুই শেষ পর্যন্ত সেটা গ্রহণ করতেই হবে। তন্ত্র শক্তি ছাড়া জীবনের কোনো মানে থাকে না, কিন্তু একই সঙ্গে তা তোর আত্মাকে গ্রাসও করতে পারে।”

রাহুলের কথাগুলি আকাশের মনে গভীর চিন্তা সৃষ্টি করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, আর কোনো পথ নেই। সে যে শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল, সেটি কিছু একটা চেয়েছিল—এটা শুধুমাত্র তন্ত্র শক্তির দিকে আরও গভীর প্রবেশের ফল ছিল।

একদিন রাহুল তাকে বলল, “আকাশ, তুই জানিস কি, আমাদের গ্রামে এক পুরানো কিংবদন্তি ছিল। বহু বছর আগে, এখানে এক তন্ত্র সাধক এসেছিল, যার নাম ছিল কালীপ্রসাদ। লোকেরা বলত, সে মৃত্যুকে ছাড়িয়ে জীবনের চিরন্তন রহস্যের সন্ধান করেছিল। কিন্তু সে ফিরে আসেনি। তার মন্ত্র এবং সাধনার ফলাফল, আমরা জানি না।”

আকাশ রাহুলের কথায় শুনে কিছু সময় চুপ ছিল, তারপর বলল, “এটা তো অনেক পুরনো কাহিনী। তবে কিছু একটা অনুভব করছি—যে শক্তি আমায় ডাকছে, সেটা সেই কালীপ্রসাদের শক্তি তো নয়?”

রাহুল মাথা নেড়ে বলল, “তুই ভাবতে পারিস, কিন্তু তন্ত্র সাধনার পথ ভীষণ বিপজ্জনক। তুই যদি গভীরভাবে সেই শক্তির মধ্যে প্রবেশ করিস, তোকে সেই শক্তির অধিকারী হতে হবে। কিন্তু তার পরিণতি কী হবে, তা কেউ জানে না।”

আকাশের মন অস্থির হয়ে উঠল। তন্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ বাড়ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা অজানা ভয়ও তার ভেতর গ্রাস করছিল। একদিকে সেই অতীত তন্ত্র সাধকের কথা মনে পড়ছিল, অন্যদিকে তার ভেতরকার অশুভ শক্তির আওয়াজ আরও জোরালো হচ্ছিল।

রাহুল তাকে পরামর্শ দিল, “যতটা সম্ভব সাবধান থাক। তন্ত্রের পথে তোমার শরীর এবং মনকে উন্মুক্ত করতে হবে, কিন্তু তা যদি বেশি হয়ে যায়, তবে তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না।”

একদিন, যখন আকাশ একাই বসে ছিল তার ঘরের মধ্যে, হঠাৎ ঘরের বাতি নিভে গেল। এক অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া চলতে লাগল। আকাশ শোকার্ত হয়ে চোখ খুলল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই নারীর ছায়া—রক্তিম চোখ, সাদা মুখ। এবার সে স্পষ্টভাবে শুনতে পেল সেই আওয়াজ, “তুমি ফিরে আসবে না, আকাশ। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।”

আকাশের হৃদয়ে এক গভীর ভয় জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারে, সে কোনো সাধারণ তন্ত্র সাধক নয়। সে কিছু ভয়ংকর শক্তির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

পর্ব ৪: মরণের পূর্বসূচনা

রাতের পর রাত, আকাশের ঘুম আসছিল না। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পেত আগুনের লেলিহান শিখা, রক্তস্নাত মাটির ওপর শুয়ে থাকা পুরনো তান্ত্রিকদের কঙ্কাল, আর এক নারীর মুখ—চোখে দাহ জ্বলে, ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি।

তাকে ঘিরে একটা অনুজ্ঞা ছিল যেন—একটা চাপ, একটা অব্যক্ত দাবি। এবং সেই দাবি দিনের পর দিন আরও গভীর, আরও অদৃশ্যভাবে তার উপর আধিপত্য বিস্তার করছিল। সে জানত, এটা নিছক মানসিক বিভ্রম নয়—এটা এমন কিছু, যা তার রক্তের ভেতর থেকে উৎসারিত হচ্ছে।

এক দুপুরে আকাশ কলকাতার নিকটে এক নির্জন গ্রামে পৌঁছাল, যেখানে রাহুলের ঠাকুরদার পুরনো বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে বহুদিন আগে এক সাধক আশ্রয় নিয়েছিলেন, যাকে গ্রামবাসীরা ডাকত “কালো গুরু” নামে। তাঁকে নিয়েই বহু লোককথা ছড়িয়ে ছিল—নাকি তিনি মৃত্যুরও ওপারে পৌঁছেছিলেন। আকাশ জানত, সেখানে গেলে সে আরও কিছু পাবে—নিজেকে নিয়ে, তার পূর্বজদের নিয়ে।

বাড়িটা ছিল একেবারে ধ্বংসপ্রায়। ভাঙা দেওয়াল, শুকিয়ে যাওয়া পুকুর, আর এক চিলতে শ্যাওলা-ঢাকা উঠোন। রাহুল তখনো পৌঁছয়নি। আকাশ একাই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে একটা ঘরের মেঝেতে গুটি কয়েক পুরনো প্রতীক আঁকা—যেগুলো ঠিক তন্ত্রচক্রের মতো, কিন্তু একটু আলাদা, যেন কিছুর বিকৃত রূপ।

হঠাৎ বাতাসে একটা গন্ধ পেল সে—ধূপ, রক্ত আর মাটি মেশানো কিছুর। ঘরের এক কোণে একটা কাঠের বাক্স পেল সে। খুলতেই তার গায়ে কাঁটা দিল। বাক্সের ভেতরে একটা মৃত পাখির কঙ্কাল, তেলের বোতল, আর একটা সোনালি পাতায় লেখা মন্ত্র। পাতার এক প্রান্তে লেখা ছিল

“এই পত্র যার হাতে পৌঁছায়, সে যদি পূর্বস্মৃতিধারী হয়, তবে সে পূর্ণ সাধক হবার পথে।”

আকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার মনের মধ্যে তখন চলছিল এক যুদ্ধ—একদিকে যুক্তি আর বিজ্ঞান, অন্যদিকে আবেগ, ইতিহাস আর অশরীরী টান। শেষ পর্যন্ত সে পাতাটা নিল হাতে, আর পড়তে শুরু করল মন্ত্র

“অগ্নিবীজে হোক সূচনা,

অশরীর দেহে আসুক জ্বালা,

যে ছিল মৃত, সে জাগুক আজ,

তন্ত্রপথে ফিরে পাক কল্পসাধনা।”

মাত্রই সে মন্ত্র শেষ করেছে, হঠাৎ ঘরের দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশে একগুঁয়ে অন্ধকার। তারপর শুরু হল এক অদ্ভুত শব্দ—দম বন্ধ করা, কাঁপানো গুঞ্জন। ঘরের দেয়ালে ছায়ারা নড়ে উঠল, আর মেঝের প্রতীকে যেন রক্ত ফোঁটা পড়তে লাগল অদৃশ্য উৎস থেকে।

আকাশ ঘরের এক কোনায় গিয়ে সেঁধিয়ে পড়ল। তার শ্বাস আটকে আসছিল। ঠিক তখন, দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেল রাহুলের গলা, “আকাশ! তুই ঠিক আছিস?”

দরজা খুলে গেল হঠাৎ। আলো ফিরে এল।

আকাশ দেখল, রাহুল দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তার মুখে একটা অদ্ভুত শীতলতা। সে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে পড়ল।

“আমি জানি তুই এটা পড়বি, আকাশ,” রাহুল বলল। “কারণ তুই জানিস না, আমি সেই বংশের উত্তরসূরি যাদের কাজ ছিল এই শক্তিকে পাহারা দেওয়া। তুই যে বইটা পেয়েছিস, সেটা তোকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল—কারণ তুইই সেই পুনর্জন্মপ্রাপ্ত আত্মা, যার ভেতর আবার সেই কালো গুরুর শক্তি জন্ম নিচ্ছে।”

আকাশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। রাহুল বলল, “তুই ভাবিস আমি তোকে সাহায্য করছি। আসলে আমি তোকে চালনা করছি, যতক্ষণ না তুই পুরোপুরি খুলে ফেলিস সেই দরজা—যার ওপারে আছে সীমাহীন শক্তি, এবং সীমাহীন মৃত্যু।”

আকাশ ধীরে ধীরে বুঝল, সে শুধু একজন পাঠক নয়, একজন গবেষক নয়—সে এক পুরনো, ভয়ংকর উত্তরাধিকার বহন করছে। তার জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অন্ধকার ইতিহাস, যার প্রতিফলন এখন শুরু হয়েছে।

তার রক্ত এখন আর একা তার নয়। সেখানে বয়ে চলেছে এক মৃত তান্ত্রিকের কামনা, প্রতিশোধ, আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

পর্ব ৫: জন্মপূর্ব পাপ

রাহুলের মুখে ওই কথা শোনার পর আকাশ যেন জমে গেল। তার চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল—কোনও বাস্তব পৃথিবী নয়, বরং এক তপ্ত দুঃস্বপ্ন। সে চিৎকার করে বলতে চাইল, “তুই কি বলছিস?” কিন্তু শব্দটা গলা থেকে বেরোল না। তার মগজ যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠেছিল।

রাহুল ধীরে ধীরে বলল, “শোন আকাশ, সময় এসেছে তোকে সব বলার। এই যে বইটা তোর হাতে এল, এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। তোর জন্মের অনেক আগেই এই অভিশাপ লেখা হয়েছিল তোর রক্তে। তুই হচ্ছিস কালীপ্রসাদ তান্ত্রিকের রক্তধারার উত্তরসূরি—সে তান্ত্রিক যে মৃত্যুর আগমুহূর্তে এক শপথ নিয়ে গিয়েছিল: ‘আমার শক্তি মৃত হবে না, আমি ফিরে আসব, নতুন দেহে, নতুন রূপে।’”

আকাশ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল রাহুলের দিকে।

রাহুল আরও বলল, “আমার পূর্বপুরুষরা ছিল এই শক্তির রক্ষক। তারা চেয়েছিল এই অভিশপ্ত শক্তিকে পৃথিবী থেকে দূরে রাখতে, কিন্তু সে শক্তি নিজেই তোকে খুঁজে বের করেছে। তুই জন্মের আগেই নির্ধারিত ছিলি। তোর মা যখন গর্ভে তোকে ধারণ করেছিলেন, তখনই মন্দিরে এক অশরীরী কণ্ঠ বলেছিল—‘যে আসবে, সে দ্বার খুলবে।’”

আকাশ এবার ফিসফিস করে বলল, “তাহলে আমার জন্মই কি অভিশপ্ত?”

রাহুল চোখ নামিয়ে বলল, “তুই অভিশপ্ত নস, তুই নির্বাচিত। কিন্তু যাকে নির্বাচিত করা হয়, তার ওপরই সবচেয়ে বড় দায় পড়ে।”

আকাশ সেই পুরনো কাঠের ঘরের এক কোণায় গিয়ে বসে পড়ল। বুক ধড়ফড় করছিল। তবুও সে মনস্থির করে ফেলল—এবার আর পেছন ফেরার নয়।

“তাহলে আমাকে বল, কী করতে হবে আমাকে?”

রাহুল কণ্ঠে অদ্ভুত এক গম্ভীরতা এনে বলল, “তোর প্রথম কাজ হবে ‘স্মৃতিফলক’ খুঁজে বের করা। কালীপ্রসাদ তার মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার সমস্ত শক্তি এক শিলার মধ্যে সঞ্চার করেছিল। সেটাই তার ‘স্মৃতিফলক’। যেখানে সেটি আছে, সেখানে আছে তার মৃত্যুর রাতের সমস্ত ঘটনার চিহ্ন। ওই শিলার উপর তোর হাত রাখলেই তুই দেখতে পাবি, কে ছিলি তুই… কী ঘটেছিল সেদিন।”

আকাশ বলল, “তুই জানিস কোথায় আছে সেটা?”

রাহুল বলল, “হ্যাঁ। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এক জঙ্গলে, ‘ভেররা পাহাড়’ নামে এক জায়গা আছে। জনশ্রুতি আছে, সেখানে নাকি রাত হলেই শোনা যায় ঢাক-ঢোলের শব্দ, দেখা যায় ছায়া-পূজারীদের উত্সব। কেউ ওখানে রাত কাটালে আর ফিরে আসে না।”

পরের দিন তারা রওনা দিল পুরুলিয়ার পথে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে, ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আকাশ অনুভব করল, তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উত্তাপ জেগে উঠছে। মনে হচ্ছিল, তার শরীর নিজে নিজেই পথ চিনে নিচ্ছে।

তারা পৌঁছাল ভেররা পাহাড়ের পাদদেশে। সূর্য ডুবছিল, চারদিকে এক রহস্যময় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। গাছে পাখির ডাক থেমে গেছে, বাতাস থমথমে। রাহুল বলল, “চল, এখনই চলতে হবে। রাত নামলেই শুরু হবে আসল পরীক্ষা।”

জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করে তারা দেখল, গাছের গায়ে লাল সিঁদুরের দাগ, কিছু পুরনো হাঁড়ির ভাঙা টুকরো, আর মাটির নিচে আধা পোঁতা কাঠামো। হঠাৎই একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল—কাঁপিয়ে দিল আকাশের শরীর।

রাহুল বলল, “ওই দেখ, ওটাই স্মৃতিফলক।”

একটা কালো পাথরের চাতাল, যার উপর খোদাই করা আছে এক চক্রের চিহ্ন, আর মাঝখানে অর্ধচন্দ্র। আকাশ এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে দিল পাথরের দিকে। তার আঙুল ছোঁয়া মাত্র চারপাশের জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে গেল, যেন সময় থেমে গেল।

তারপর—

আকাশের চোখের সামনে অন্ধকার ভেদ করে ভেসে উঠল এক পুরনো রাত। চারপাশে আগুন, শত শত লোক কালো আলখাল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর পুরুষ—কালো গায়ের রঙ, গলায় মৃত মানুষের খুলি, চোখে আগুন। সে হাত তুলছে, মন্ত্র পড়ছে—

“আমার শক্তি থাকিবে… মরণও যাহা নাশ করিতে পারে না… আমি ফিরিবো…”

আকাশ চমকে উঠল—সে নিজের মুখে সেই মন্ত্র বলছে!

“আমি… আমি তো কালীপ্রসাদ নিজেই?”

তার বুকের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।

পর্ব ৬: দ্বিখণ্ডিত আত্মা

আকাশ মাটিতে পড়ে গেল। ঘোর কেটে যাওয়ার পর সে অনুভব করল তার সমস্ত শরীর ঘামতে লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ খুলতেই দেখল, রাহুল তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার মুখটা স্তব্ধ, তবে চোখে বিস্ময়।

আকাশ ফিসফিস করে বলল, “আমি… আমি ও… আমি কালীপ্রসাদ?”

রাহুল মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ আকাশ। তুই ওরই পুনর্জন্ম। তবে সবটা এখনো বোঝা বাকি। কারণ সত্যিটা আরও গভীরে লুকিয়ে আছে।”

আকাশ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার বুকের ভেতর তুমুল ঝড় বইছে। এখন সে স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে—তার মনের ভেতরে দুটো সত্তা বসবাস করছে। একদিকে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক আকাশ, অন্যদিকে হাজার বছর পুরোনো কালীপ্রসাদ তান্ত্রিক—যে মৃত্যু জয় করার শপথ নিয়েছিল।

“আমার মনে হচ্ছে…” আকাশ থেমে গেল, “আমার ভিতরে কেউ আরেকজন কথা বলছে, যেন সে চায় আমি তার পথেই হাঁটি।”

রাহুল বলল, “কারণ তোর আত্মা পূর্ণ নয়, আকাশ। কালীপ্রসাদের আত্মা যখন মৃত্যুর পর দেহ ছেড়েছিল, তখন সে নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করেছিল—একটা অংশ শুদ্ধ, আরেকটা কলুষ। শুদ্ধ অংশ তুই। আর কলুষ অংশ… এখনও বেঁচে আছে।”

আকাশের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “বেঁচে আছে মানে?”

রাহুল বলল, “অন্য কারও শরীরে, অন্য কোথাও। তুই যদি পূর্ণ হতে চাস, তোকে সেই অর্ধেক আত্মাকে খুঁজে পেতে হবে—আর হয় তাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে, নয়তো ধ্বংস করতে হবে।”

আকাশ হাঁ করে তাকিয়ে রইল, “কে সে? কোথায় থাকে?”

রাহুল একটু থেমে বলল, “আমরা নিশ্চিত না, তবে একটা নাম উঠে আসছে বারবার… ‘তামসা’। এটা একটা সন্ন্যাসিনী আশ্রম, কিন্তু সেখানে যা ঘটে, সেটা কোনও সাধনার নয়—তা এক নিঃশব্দ কালো তন্ত্রের অভয়ারণ্য। সেখানেই আছে ‘তন্ত্রকন্যা’, যার নাম অদ্বিতি। সে নাকি মানুষ নয়, বরং সেই তান্ত্রিক শক্তিরই রূপ। আমরা বিশ্বাস করি, ওর দেহেই আছে কালীপ্রসাদের সেই অন্ধকার অংশ।”

আকাশ ধীরে ধীরে বলে উঠল, “তাহলে আমি নিজেরই অন্য রূপের মুখোমুখি হতে চলেছি?”

রাহুল চুপ করে রইল।

সেদিন রাতে আকাশ আর রাহুল একটি পুরনো বাইকে চেপে রওনা দিল পূর্ব বর্ধমানের দিকের দিকে—সেখানে কোথাও আছে সেই তামসা আশ্রম। পথ যেন নিজেই দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল। GPS কাজ করছিল না, মোবাইলে নেটওয়ার্কও ভ্যানিশ।

এক সময় তারা পৌঁছল একটা গাছ-ঢাকা, শান্ত, কিন্তু অদ্ভুত নীরবতায় মোড়া একটা এলাকার সামনে। একটা পুরনো নামফলকে লেখা ছিল ‘তামসা আশ্রম – প্রবেশ নিষেধ’।

দু’জনেই সামনের লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

আশ্রমটা ছিল যেন এক পুরনো মঠের মতো—নিমগ্ন নীরবতায় ডুবে। হঠাৎ হাওয়া বইল, আর তাদের চোখে পড়ল সাদা শাড়ি পরা কিছু মহিলা, যাদের মুখ ঢাকা, চোখ স্থির, হাসি নেই। যেন তারা মানুষ নয়, বরং কোনও প্রাচীন অভিশাপের বাহক।

আকাশের গা শিউরে উঠল। এক অদ্ভুত টান অনুভব করল সে, যেন আশ্রমের কেন্দ্র থেকে কেউ তাকে টানছে—এক অলিখিত আহ্বান। ধীরে ধীরে সে সেই কেন্দ্রীয় চত্বরের দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে ছিল একটা বিশাল কালো পাথরের মঞ্চ।

আর সেখানেই দেখা গেল অদ্বিতি—কালো শাড়িতে মোড়া, চুল খোলা, চোখে তীব্র বিদ্যুৎ। তার চোখে তাকাতেই আকাশ হঠাৎ এক চরম ধাক্কা অনুভব করল। তার শরীর কেঁপে উঠল।

অদ্বিতি হেসে বলল, “তুই এলি শেষ পর্যন্ত। জানতাম আসবি।”

আকাশ থতমত খেয়ে বলল, “তুই কে?”

অদ্বিতি শান্ত গলায় বলল, “তুই জানিস না? তুই আর আমি এক… আমি তোর অর্ধেক। আমি কালীপ্রসাদের সেই দিক, যা মৃত্যুকে ভয় পায় না… যা ক্ষমতা চায়, যা শাস্তি দিতে চায়।”

আকাশ থেমে গেল। তার ভেতরে কিছু যেন জেগে উঠল। মস্তিষ্কে প্রচণ্ড ধাক্কা—হঠাৎই সে দেখতে পেল অদ্বিতির ভেতর দিয়ে এক কালো আগুনের ধারা উঠে আসছে। সে বুঝতে পারল—এই নারী নিছক নারী নয়, বরং সেই অন্ধকারের অবয়ব, যে তার আত্মার অর্ধেক দাবী করে।

অদ্বিতি এবার বলল, “তুই চাইলে আবার এক হতে পারি। দুই অর্ধ এক হলে যা হবে, তা কোনো ঈশ্বরও আটকাতে পারবে না। শু

ধু বল—তুই কি আমাকে গ্রহণ করবি, না আমাকে ধ্বংস করবি?”

আকাশ চুপ।

তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার অতীত… আর হাতে আছে ভবিষ্যৎ।

পর্ব ৭: আগুনে আত্মসংঘাত
আকাশ এক পা পিছিয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্বিতির চোখে কোনও ভয় ছিল না—ছিল শুধুই প্রত্যয়। এমন আত্মবিশ্বাস, যা হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কোনও শক্তির প্রতিনিধি ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
“তুই কি ভয় পাচ্ছিস?” অদ্বিতি জিজ্ঞেস করল। “নাকি তোর ভিতরে সেই আধা মানুষ আধা তান্ত্রিক সত্তাটা এখনও ঘুমিয়ে আছে?”
আকাশ গলা শক্ত করে বলল, “আমি জানি না তুই কে। কিন্তু আমি জানি, আমি কে হতে চাই। আমি কালীপ্রসাদের মত হতে চাই না—যে নিজের ক্ষমতার জন্য মৃত্যু, রক্ত, আর অভিশাপকে স্বাভাবিক করে তুলেছিল। আমি মানুষ হতে চাই।”
অদ্বিতির ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি খেলে গেল।
“তুই ভাবছিস, আমি খারাপ? কালীপ্রসাদ শুধু রক্তের তৃষ্ণায় তান্ত্রিক হয়নি, ও হয়েছিল কারণ দেবতারা ওকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। সমাজ তাকে অবিশ্বাস করেছিল। আমিই ওর সেই দিক—যে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে চায়, যে চায় সব নিয়ম পুড়িয়ে দিতে। আর তুই… আমারই আরেক রূপ। আমাকে অস্বীকার করলি, মানে নিজেকেই অস্বীকার করলি।”
আকাশ ফুঁসে উঠল, “তুই আমার অন্ধকার দিক হতে পারিস, কিন্তু আমি সেই অন্ধকারকে গ্রহণ করব না। আমি আলো চাই।”
অদ্বিতির চোখ তখন আগুনের মতো জ্বলছিল। “তাহলে যুদ্ধ ছাড়া আর উপায় নেই, আকাশ। যদি এক হতে না চাস, তবে এই দেহভাগ একজনেরই থাকবে। আমার, না তোর।”
কঠিন শ্বাস নিয়ে আকাশ বলল, “তবে এস। দেখা যাক, কে নিজেকে জিতিয়ে নিতে পারে।”
হঠাৎ আকাশের বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হল। সে পড়ে গেল মাটিতে। তার শরীরের ভিতর দিয়ে কিছু যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। অদ্বিতি চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়া শুরু করল—
“অন্ধকার যেখান থেকে শুরু,
সেখানেই হোক সংহার।
আলো না চাই, শূন্যতা দাও,
যেখানে আমি একমাত্র প্রভু।”
চারপাশে বাতাস দুলে উঠল। আশ্রমের ঘন্টা আপনিই বাজতে লাগল, আর আকাশের দেহ চারদিকে ছায়ার রেখায় ঘিরে পড়ল। অদ্বিতির হাত উপরে উঠল, যেন সে আকাশের আত্মা টেনে বার করে নিতে চাইছে।
কিন্তু তখনই আকাশ নিজের ভিতরের শক্তির মধ্যে ডুব দিল। সে মনস্থির করল—কোনও তান্ত্রিক মন্ত্র নয়, কোনও অশরীর নয়—সে নিজের বিশ্বাসেই রুখে দাঁড়াবে।
সে মনে মনে বলল—
“আমি যা ছিলাম না, আমি তাই হব না।
আমি মানুষ, আমি আলো,
আমি জন্মাই পাপ থেকে,
কিন্তু ফিরব মুক্তির পথে।”
হঠাৎই চারপাশে ঝড় ওঠে। অদ্বিতি পিছিয়ে যায়। আকাশের শরীর থেকে আলো বের হতে থাকে—সেই আলো কোনও মন্ত্রজাল নয়, বরং সাহসের, মানবতার, নিজের বেছে নেওয়া পথের।
অদ্বিতি চিৎকার করে ওঠে, “তুই পারবি না! আমি তোরই অংশ! আমাকে মেরে তুই নিজেকেই মেরে ফেলছিস!”
আকাশ দাঁত চেপে বলে, “তুই আমার নয়, তুই আমার অভিশাপ। আজ সেই অভিশাপ পুড়বে!”
সে সামনে হাত বাড়ায়। তার হাত থেকে বেরিয়ে আসে এক বৃত্তাকার আলোকরেখা। সেই আলো ছুঁয়ে যায় অদ্বিতিকে। সে ছিটকে পড়ে মাটিতে। তার দেহ ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে ছায়ার মধ্যে।
শেষ মুহূর্তে অদ্বিতি ফিসফিস করে বলে, “তুই জিতলি… কিন্তু মনে রাখিস, তোর ভিতরের অন্ধকারকে একবার দমন করলি মানে এই নয়, সে আর আসবে না…”
আর তারপরই সে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
চারপাশে ঘূর্ণিঝড় থেমে যায়। আশ্রমের আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। আশ্রমের ভেতরের সেই মুখহীন নারীরা অদৃশ্য হয়ে যায়। রাহুল দৌড়ে এসে আকাশকে জড়িয়ে ধরে।
“তুই ঠিক আছিস?”
আকাশ মাথা নেড়ে বলল, “আমি বেঁচে আছি। শুধু বেঁচে না… আমি এখন জানি, আমি কে। আমি কার পুনর্জন্ম, সেটা বড় কথা নয়। আমি আজ নিজেকে বেছে নিয়েছি।”
রাহুল চুপ করে তার বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে। তাদের পেছনে তামসা আশ্রম ধ্বসে পড়ে, যেন অন্ধকারের এক অধ্যায় চিরতরে শেষ হল।
পর্ব ৮: মুক্তির ছায়া
তামসা আশ্রম ধ্বসে পড়ার পর চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আকাশ আর রাহুল অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তারা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এল।
সেই রাতে তারা এক নির্জন গ্রাম্য হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিল। আকাশের শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন অদ্ভুতভাবে শান্ত। যেন শতাব্দীর পুরোনো এক লড়াই শেষ হয়েছে, এবং সে বিজয়ী।
রাহুল তাকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিল। “তুই একে শেষ করলি, আকাশ। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
আকাশ ধীরে মাথা নাড়ল। “শেষ নয় রাহুল, এটা শুরু।”
রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “শুরু?”
আকাশ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “যে শক্তিকে আমি দমন করেছি, সে নিঃশেষ হয়নি। ওর অস্তিত্ব আমার রক্তে, আমার অতীতে। আমি তাকে হারিয়েছি, কিন্তু মেরেও ফেলিনি। কারণ সে আমি ছিলাম একসময়। আমি কেবল তাকে গ্রহণ করিনি।”
রাহুল বসে পড়ল। “তাহলে এখন কী করবি?”
আকাশ চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি চাই না আর কেউ এই অভিশপ্ত পথ বেছে নিক। আমি সেই বইটা, সেই চিহ্ন, সেই মন্ত্র—সবকিছু ধ্বংস করতে চাই। যাতে কারও আর এই দিকটায় হাত দেওয়ার সাহস না হয়।”
রাহুল বলল, “তাহলে তোকে আবার ফিরতে হবে ‘ছায়ালিপি’ বইটার কাছে। ওটা এখনও তোর ব্যাগে আছে।”
আকাশ ব্যাগ খুলে সেই পুরনো কালো মলাটের বইটা বের করল। বইটা খুলতেই কালি ছড়ানো পাতাগুলোর ভেতর থেকে একটা পাতলা বাতাস বেরিয়ে এল—মনে হল, তাতে অদ্বিতির নিঃশেষিত শ্বাস এখনো গুঁজে আছে।
সে বইটা নিয়ে চলল নদীর পাড়ে। সেই নদী যেখানে নাকি একসময় কালীপ্রসাদ নিজেকে শুদ্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারে নি।
আকাশ কাঁপা গলায় বলল, “এই বইয়ে আছে মৃত্যু, আছে ক্ষমতার লোভ, আর আছে এমন কিছু সত্য, যা মানুষ জানলে পাগল হয়ে যাবে। আমি এসব আর কারও জানার সুযোগ দেব না।”
সে বইটা নদীর মধ্যে ছুঁড়ে দিল। বইটা কিছুক্ষণ ভাসল, তারপর ধীরে ধীরে ডুবে গেল।
হঠাৎ আকাশ অনুভব করল—একটা ভার যেন তার বুক থেকে নেমে গেল। তার মাথার মধ্যে এক নিঃশব্দ প্রশান্তি, বহুদিন পর।
রাহুল পাশে এসে বলল, “এখন তুই মুক্ত।”
আকাশ মাথা নেড়ে বলল, “না রাহুল, এখন আমি সজাগ। কারণ অন্ধকার কখনো মরে না। সে শুধু ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙার সময় এলেই সে আবার নতুন মুখ, নতুন রূপে ফিরে আসে।”
“তুই ভয় পাচ্ছিস?”
“না। আমি প্রস্তুত।”
তারপর আকাশ আর রাহুল ফিরে এল শহরে। আকাশ আবার তার পুরনো জীবন শুরু করল। ক্লাসে পড়ানো, ছাত্রদের প্রশ্ন, ব্যস্ত রাস্তার শব্দ—সব যেন আগের মতো। কিন্তু আকাশ জানে, সে আর আগের মানুষ নেই।
এক রাতে, ক্লাস শেষে সে নিজের ডেস্কে বসে ছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করল, টেবিলের উপর একটা চিরকুট রাখা—
“আলোকে যতই ভালোবাসো, ছায়া ততই গভীর হয়।
ফিরে আসব। খুব শীঘ্র।
— অ.”
আকাশ চুপচাপ চিরকুটটা হাতে নিল। চিঠিতে কোনও ঠিকানা নেই, কালি একেবারে টাটকা। সে জানে, অদ্বিতি শেষ হয়নি। তার শক্তি কোথাও আবার জমা হচ্ছে। সময় এলেই সে আবার ফিরবে।
কিন্তু এবার আকাশ একা নয়।
সে নিজের ভিতরের আলো চিনেছে, নিজের অন্ধকারকে মোকাবিলা করতে শিখেছে।
আকাশ জানে, আবার যদি ছায়া নামে—তবে সে প্রস্তুত।
শেষ

Lipighor_1749582112581.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *