Bangla - তন্ত্র

তন্ত্রপীঠের অগ্নিপরীক্ষা

Spread the love

প্রাচীন কাল থেকে গ্রামটির নাম শিউলিবাড়ি, তবে এই নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে বহু গোপন কাহিনি। গ্রামের উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ প্রাচীন তন্ত্রপীঠ মন্দির, যার কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কানে কানে পৌঁছেছে। লাল ইটের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটল ধরা প্রাচীর থেকে গাছের শিকড় নেমে এসেছে যেন সময়ের আঁচড়। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দির একসময় এক তান্ত্রিক রাজা নির্মাণ করেছিলেন, যিনি দেবীর কৃপা পাওয়ার জন্য নরবলি পর্যন্ত দিতেন। গ্রামের বয়স্করা বলেন, মন্দিরের অন্তঃকক্ষে এক গোপন দরজা আছে, যার ওপারে বন্দি রয়েছে এক অদ্ভুত অলৌকিক শক্তি—শক্তি, যা একবার মুক্তি পেলে সমগ্র অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। দিনের বেলাতেও মন্দিরের ভেতরে গা ছমছমে অন্ধকার, আর সন্ধ্যা নামলেই শোনা যায় অজানা শব্দ, যেন মৃদু মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে দেয়ালের ভেতর থেকে। ভয় ও ভক্তি মিশে এই মন্দির গ্রামবাসীর জীবনে এক অদ্ভুত মর্যাদা পেয়েছে—কেউ দেবীর পূজা না করে নতুন কাজ শুরু করে না, আবার কেউ সাহস করে রাতের বেলা মন্দিরের দিকে মুখও করে না।

এই রহস্যময় মন্দিরের কথা বহুদিন ধরে শহরের প্রত্নতত্ত্ববিদদের কানে পৌঁছাচ্ছিল, কিন্তু অধিকাংশই একে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তবে অদিতি সেন আলাদা। কলকাতার বাসিন্দা এই তরুণী প্রত্নতত্ত্ববিদ ভারতের প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য ও গুপ্তকক্ষের নকশা নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করছেন। তিনি জানেন, কুসংস্কারের আড়ালে অনেক সময়ে হারিয়ে যায় মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রমাণ। তাই যখন শিউলিবাড়ির তন্ত্রপীঠ মন্দিরের কথা শোনেন, তখনই নোটবুকে লিখে রাখেন এবং নিজেই সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অদিতি একদম একা রওনা হন, সঙ্গে থাকে কেবল একটি ব্যাকপ্যাক—যার ভেতরে থাকে নোটবুক, ক্যামেরা, মাপজোখের যন্ত্র, আর একটি ছোট্ট টর্চ। মন্দিরে পৌঁছে তিনি প্রথমেই অবাক হয়ে যান—পুরো স্থাপত্যে অদ্ভুত এক নকশা, খোদাই করা পাথরের ভাস্কর্য, আর প্রতিটি স্তম্ভে যেন একেকটি গল্প লুকিয়ে আছে। ঘোরাঘুরির সময় হঠাৎই তিনি মন্দিরের দক্ষিণ প্রাচীরে এক অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পান—ত্রিভুজের মধ্যে অর্ধচন্দ্র আর তার ওপরে একটি চোখ। চিহ্নটি পাথরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে সাধারণ চোখে ধরা পড়বে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন—চিহ্নের পাশে একটি ফাঁপা অংশ আছে, যা চাপ দিতেই ভেতর থেকে শোনা যায় ‘ক্লিক’ শব্দ। পাথরের গায়ে ধুলো ঝরতে থাকে, আর ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এক গোপন ফাঁক—যেন কোনো লুকানো প্রবেশপথ।

অদিতি জানতেন, এই আবিষ্কার গ্রামবাসীর কাছে সহজে প্রকাশ করা ঠিক হবে না, কারণ এখানে কুসংস্কার ও ভয়ের প্রভাব প্রবল। তবুও তিনি গ্রামপ্রধান প্রচেষ্টা মুখোপাধ্যায়কে খবর দেন, কারণ মন্দির সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত তার অনুমতি ছাড়া নেওয়া যায় না। প্রচেষ্টা প্রথমে বিরক্ত হলেও অদিতির বর্ণনা শোনার পর মুখে এক ধরনের অস্থিরতা আসে। তিনি জানেন, এই গোপন দরজার কিংবদন্তি সত্যি হলে এর ভেতরে যা আছে তা খোলা বিপজ্জনক। নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে তিনি অদিতিকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। তবে একা সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পান না। তার মনে পড়ে যায় একমাত্র মানুষটির কথা, যিনি এই মন্দির ও এর গুপ্তশক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন—তরুণ তান্ত্রিক অগ্নিভ রায়। গ্রামের ভেতরে তান্ত্রিক বিদ্যা নিয়ে কাজ করা মানুষের সংখ্যা কমে গেলেও অগ্নিভ তার গুরু শিবনাথ আচার্যের কাছে বহু বছর ধরে তন্ত্রসাধনা শিখেছেন। প্রচেষ্টা তৎক্ষণাৎ একজন দূত পাঠিয়ে অগ্নিভকে খবর দেন, যাতে তিনি শীঘ্রই মন্দিরে এসে পরিস্থিতি দেখেন।

এদিকে বিকেলের আলো ক্রমশ সোনালি থেকে লাল হয়ে আসছে, আর মন্দিরের চারপাশে যেন অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এসেছে। গ্রামের শিশুরা খেলাধুলা থামিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে, বৃদ্ধরা উঠোনের ধারে বসে নামগান গাইছেন, আর মন্দিরের কালো দরজার ফাঁক দিয়ে যেন ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছে। অদিতি একা দাঁড়িয়ে আছেন সেই গোপন ফাঁকের সামনে, যার পেছনে লুকিয়ে আছে অজানা ইতিহাস কিংবা অকল্পনীয় ভয়। দূরে কোথাও পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়, কিন্তু তার ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি—যেন এই মন্দির তাকে ডাকছে। সেই ডাক কেবল গবেষকের কৌতূহল নয়, বরং এক গভীর, প্রাচীন শক্তির আমন্ত্রণ, যা একবার গ্রহণ করলে আর ফেরার পথ থাকে না। আর ঠিক সেই সময়েই, কাঁচা রাস্তা ধরে ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে আসতে থাকে এক লম্বা গড়নের মানুষ—অগ্নিভ রায়, যার চোখে-মুখে যেন গোপন সংকল্পের ছায়া, আর সঙ্গে রয়েছে এমন এক দায়িত্ব, যা হয়তো তাঁর জীবনও পাল্টে দিতে চলেছে।

শিউলিবাড়ির প্রান্তে, শাল-সেগুন গাছের ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো আশ্রম। এ আশ্রমেই থাকেন তান্ত্রিক গুরু শিবনাথ আচার্য—যার নাম শুধু এই গ্রামে নয়, আশেপাশের জেলাতেও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়। অগ্নিভ ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিষ্য। গুরু শিবনাথের ধবধবে সাদা দাড়ি, গেরুয়া পোশাক, কপালে বড় লাল তিলক—দেখলেই মনে হয় যেন প্রাচীন যুগের কোনো ঋষি। সেদিন বিকেলে অগ্নিভ তাড়াহুড়ো করে আশ্রমে পৌঁছাল, সঙ্গে গ্রামপ্রধানের পাঠানো বার্তা। গুরুদেব নদীর ধারে বসে দীপশিখার আলোয় মন্ত্রপাঠ করছিলেন, তাঁর চারপাশে ধূপের গন্ধে ভরে আছে বাতাস। অগ্নিভ প্রণাম করতেই গুরু মাথা তুলে তাকালেন—চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা। বার্তা শুনে তাঁর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল, যেন বহুদিন আগের কোনো স্মৃতি তাঁকে নাড়িয়ে দিল। তিনি ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন, লাঠি ভর দিয়ে অগ্নিভকে ইশারা করলেন ভিতরের ঘরে আসতে।

ঘরে ঢুকতেই অগ্নিভ দেখতে পেল দেওয়ালে টাঙানো প্রাচীন তন্ত্রপুঁথি, শুকনো গুল্ম আর নানা সাধনাসামগ্রী। গুরুদেব কাঠের আসনে বসে বললেন, “অগ্নিভ, তুই কি জানিস তন্ত্রপীঠের গোপন কক্ষের কাহিনি?” অগ্নিভ মাথা নাড়ল, কারণ সে কেবল গুজব শুনেছে, নিশ্চিত কিছু নয়। গুরু গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন—শত শত বছর আগে, এই তন্ত্রপীঠে রাজা বিজয়নাথের তান্ত্রিক যজ্ঞ চলছিল। সেই যজ্ঞে আহ্বান করা হয়েছিল এক শক্তিশালী অলৌকিক শক্তিকে, যা মানুষের মনকে বাঁকিয়ে দিতে পারে, লোভ ও ভয়ের প্রলোভনে ডুবিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মন্দিরের আচার্যরা এক বিশেষ তান্ত্রিক মন্ত্রপূজা করে তাকে ওই গোপন কক্ষে বন্দি করে দেন। সেই থেকে কক্ষটি বন্ধ—তাদের শপথ ছিল, কোনো অবস্থাতেই সেই দরজা খোলা যাবে না। গুরু শিবনাথের কণ্ঠ গাঢ় হয়ে উঠল, “যদি সেই শক্তি মুক্ত হয়, গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু গ্রাম নয়, আশেপাশের অনেক এলাকা বিপদের মুখে পড়বে।”

অগ্নিভ মন দিয়ে গুরুদেবের কথা শুনছিল, কিন্তু তার চোখে দৃঢ়তা। সে জানে গ্রামবাসীরা অজ্ঞতার কারণে ভয় পায়, কিন্তু যদি সত্যিই এই শক্তি বিপজ্জনক হয়, তবে তা আবার আবদ্ধ করা তার দায়িত্ব। গুরুদেব যেন তার মনের কথা বুঝে নিয়ে বললেন, “তুই আমার সবচেয়ে যোগ্য শিষ্য, কিন্তু মনে রাখিস—শক্তি ও জ্ঞান সবসময় আশীর্বাদ নয়, কখনও কখনও তা অভিশাপ। তুই যদি এই কাজে নামিস, তোর মনকে হতে হবে পাহাড়ের মতো দৃঢ়, কারণ এই শক্তি প্রথমে তোর মনেই প্রলোভন ঢালবে।” কথা বলতে বলতে গুরু কাঠের সিন্দুক খুলে একটি ছোট রূপার তাবিজ বের করলেন। তাবিজে খোদাই করা আছে অদ্ভুত মন্ত্রচিহ্ন, যা তান্ত্রিক পদ্ধতিতে পবিত্র করা। তিনি তা অগ্নিভের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোর সঙ্গে রাখবি। যতক্ষণ তুই শুদ্ধ থাকবি, এটা তোর সুরক্ষা দেবে, কিন্তু মনে রাখ—তোর ভিতরে যদি সন্দেহ বা লোভ জন্মায়, এই তাবিজও তোর বিপক্ষে যাবে।”

অগ্নিভ গুরুদেবকে প্রণাম করল, এবং তাঁর আশীর্বাদ নিল। বাইরে তখন সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে, দূরে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আশ্রমের গেট পেরিয়ে যখন অগ্নিভ মন্দিরের দিকে হাঁটতে লাগল, তার মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—গভীর ভয়, অজানা উত্তেজনা, আর অটল সংকল্প। সে জানে, সামনে যা আসছে তা কেবল শারীরিক লড়াই নয়, বরং এক অন্তরের যুদ্ধ, যেখানে তার বিশ্বাস, আত্মসংযম, আর তন্ত্রশিক্ষার প্রতিটি শিক্ষা পরীক্ষা হয়ে যাবে। আর এই পরীক্ষা ব্যর্থ হলে শুধু তার জীবন নয়, গোটা গ্রাম হয়তো আর কোনোদিন ভোর দেখতে পাবে না।

পরদিন সকাল থেকেই মন্দির চত্বরের বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত ভারী ভাব, যেন গাছের পাতাও নড়তে সাহস পাচ্ছে না। সূর্য উঠলেও আলো যেন ম্লান, আর গ্রামবাসীরা দূর থেকে কৌতূহলভরে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মন্দিরের দক্ষিণ প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আছেন অদিতি, অগ্নিভ আর প্রচেষ্টা মুখোপাধ্যায়। মাটিতে সাজানো রয়েছে লোহার সরঞ্জাম, মাপজোখের যন্ত্র, আর কিছু বিশেষ তান্ত্রিক সামগ্রী—গঙ্গাজল ভরা কলস, ধূপকাঠি, আর অগ্নিভের গুরু শিবনাথ আচার্যের দেওয়া রূপার তাবিজ। অদিতি হাতে নোটবুক ও ক্যামেরা, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত টান—সে জানে, আজ হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হতে চলেছে। প্রচেষ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কপালে ঘাম, কিন্তু মুখে যেন গুরুত্বের আড়ালে কিছু লুকানো ভাবনা। অগ্নিভ চুপচাপ মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, হাতের আঙুলে দ্রুত মুদ্রা বদলাচ্ছে, যেন বাতাসে অদৃশ্য বৃত্ত আঁকছেন। তারপর তিনি অদিতিকে ইশারা করলেন চিহ্নের পাশে থাকা পাথরের ফাঁপা অংশে চাপ দিতে।

একটি ভারী শব্দের সঙ্গে পাথরের ফাঁক ধীরে ধীরে সরতে লাগল, যেন শতাব্দীর ঘুম ভাঙছে। মুহূর্তেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক প্রবল ঠান্ডা হাওয়া—এমন ঠান্ডা, যা শীতের গভীর রাতেও মেলে না। বাতাসে ধূপের গন্ধ মিশে গেল এক অদ্ভুত কটু গন্ধে, যা নাকে পৌঁছেই মাথা ঘুরিয়ে দেয়। হাওয়ার সঙ্গে যেন এল ফিসফিসে শব্দ—মানুষের কণ্ঠ নয়, কিন্তু ভাষা যেন অজানা কোনো প্রাচীন মন্ত্রের। দরজার ভেতর অন্ধকার এত ঘন যে টর্চের আলোও যেন গিলে ফেলল। অগ্নিভ এক পা ভিতরে বাড়াতেই সেই অন্ধকারের মধ্যে নড়াচড়া হল—এবং হঠাৎই চোখের কোণ দিয়ে তারা দেখতে পেল এক ছায়ামূর্তি, লম্বা, বিকৃত আকারের, যার চোখে লাল জ্বলন্ত বিন্দুর মতো আলো। মুহূর্তেই সেই মূর্তি ধোঁয়ার মতো পিছিয়ে গেল, আর পরের সেকেন্ডে যেন বাতাসে মিশে আকাশের দিকে উড়ে গেল। চারপাশে আবার নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতা যেন আরও ভয়ঙ্কর।

গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই কয়েকজনের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ল, কেউবা হাঁপাতে লাগল, আর কারও মুখ দিয়ে অস্পষ্ট প্রলাপ বেরোতে লাগল—শব্দগুলো যেন মানুষের নয়, বরং সেই ফিসফিসে মন্ত্রেরই বিকৃত রূপ। অদিতি ভয় পেয়ে পেছিয়ে এল, কিন্তু অগ্নিভ দ্রুত গঙ্গাজল ছিটিয়ে অসুস্থদের দিকে মন্ত্রপাঠ করলেন। কয়েকজন ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পেল, তবে তাদের চোখে রইল অদ্ভুত এক শূন্যতা, যেন কিছু ভেতর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রচেষ্টা পরিস্থিতি সামলাতে লোকজনকে দূরে সরিয়ে দিতে লাগলেন, কিন্তু চোখে ভয় ও কৌতূহলের মিশ্র ঝিলিক স্পষ্ট। তিনি মনের গভীরে অনুভব করলেন—যে শক্তি তারা মুক্ত করল, তা কেবল কিংবদন্তি নয়, বরং সত্যিকারের বিপদ।

অগ্নিভ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ স্থির রইলেন। তাঁর মনে পড়ল গুরু শিবনাথের সতর্কবার্তা—“শক্তি প্রথমেই মন আক্রমণ করবে।” এই ঠান্ডা হাওয়া, ছায়ামূর্তির চোখ, আর গ্রামবাসীদের অসুস্থতা—সবই সেই আক্রমণের প্রথম ধাপ। তিনি জানতেন, এখন সময় খুব কম, কারণ মুক্ত শক্তি যতক্ষণ বাইরে থাকবে, ততই তার প্রভাব বাড়বে। অদিতি কাছে এসে ধীরে বলল, “আমরা কী করেছি, অগ্নিভ? এটা কি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব?” অগ্নিভ চোখ বন্ধ করল, হাতের তাবিজ শক্ত করে ধরল, আর ধীর স্বরে বলল, “সম্ভব… কিন্তু এর জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। এই খেলা এখন শুরু হল।” আর দূরে, বটগাছের ছায়ায়, যেন কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে—যার চোখে একই সঙ্গে তৃপ্তি আর অশুভ ইঙ্গিত।

রাত নেমে এসেছে গ্রামে, চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন কানের ভেতর ধ্বনিত হচ্ছে। আকাশে চাঁদের আলো ঝাপসা, মেঘের আড়ালে কেমন ভুতুড়ে রূপ নিচ্ছে। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ করেই হাওয়ায় এক ঠাণ্ডা স্রোত বইতে শুরু করল। গ্রামবাসীরা তখন ঘরে, কেউ ঘুমের প্রস্তুতিতে, কেউ আবার চুপচাপ অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে গল্প করছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে অদৃশ্য এক ছায়া ঢুকে পড়ল গ্রামের ভেতরে। কারো দৃষ্টিসীমায় ধরা না পড়লেও, সেই উপস্থিতি যেন বাতাসকে ভারী করে তুলল। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল, তারা একে একে দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল—স্বপ্নে তারা দেখতে পেল গভীর অন্ধকারে এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দৃষ্টিতে ভয় আর লোভ মিলেমিশে অদ্ভুত এক টান তৈরি করছে, যেন তাদের আত্মা ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চাইছে।

প্রথম আক্রমণ শুরু হয় হরিপদ মল্লিকের বাড়িতে। বৃদ্ধ হলেও হরিপদের মন সবসময় টাকার প্রতি দুর্বল। স্বপ্নের ভেতর সেই ছায়ামূর্তি তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে—”তুমি যদি আমার হয়ে যাও, আমি তোমাকে স্বর্ণের পাহাড় দেব।” লোভে মস্তিষ্ক ঝাপসা হয়ে যায় হরিপদের, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তি তার আত্মার এক অংশকে গ্রাস করে নেয়। পরের ঘরে, কিশোর রতনও ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে আটকে পড়েছে। সে দেখে তার প্রিয়জনেরা একে একে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, আর তাদের বাঁচাতে হলে তাকে অদৃশ্য সেই অন্ধকারের কাছে মাথা নত করতে হবে। ভোরের আগে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী এমন দুঃস্বপ্নের শিকার হয়ে জেগে ওঠে, কিন্তু তারা কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না—তাদের চোখে যেন এক অদ্ভুত কুয়াশা জমে আছে, মুখে নির্লিপ্ত, ভৌতিক হাসি।

অগ্নিভ তখন গ্রামের প্রান্তে পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই সে অনুভব করল বাতাসে এক শীতল, দমবন্ধ করা শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। সে বুঝল, এ আক্রমণ স্বপ্নে সীমাবদ্ধ নয়—ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে বাস্তব দুনিয়ায় নিজের অস্তিত্বকে গেঁথে নিচ্ছে। তখনই সে মন্ত্রপাঠ শুরু করল—তার ঠোঁট দ্রুত নড়ছে, শব্দগুলো বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে, আর কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। হাতে তাবিজ শক্ত করে ধরে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করল। মুহূর্তের জন্য গ্রামজুড়ে এক তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ল, যেন সেই আলো অন্ধকারকে চিরে ফেলে দিতে চায়। কিন্তু ছায়ামূর্তির হাসি শোনা গেল—এক হিমশীতল, উপহাসে ভরা হাসি। আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর অগ্নিভ অনুভব করল তার শক্তি যেন বালুর মতো হাতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

আক্রমণ থামল ঠিক ভোরের আগে। গ্রামজুড়ে তখন এক ভয়াবহ নীরবতা নেমে এসেছে। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা ঘরে চুপচাপ বসে, কারো চোখে শূন্য দৃষ্টি, কারো ঠোঁটে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হাসি। অগ্নিভ বুঝতে পারল, তার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই অন্ধকার কেবল শক্তি দিয়ে নয়, মনের গভীরে ঢুকে কাজ করছে—ভয় আর লোভের শিকড়ে আঘাত করছে। প্রচেষ্টা এবং অদিতি খবর পেয়ে তার কাছে এলো, আর অগ্নিভ তখনো মন্ত্রপাঠের ব্যর্থতা নিয়ে হতবুদ্ধি। সে জানত, আগামী আক্রমণ আরও তীব্র হবে, আর তখন হয়তো গ্রাম আর টিকতে পারবে না। তবুও তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ফুটে উঠল—যতই কঠিন হোক, এই অন্ধকারের শেকড় খুঁজে বের করতেই হবে।

অগ্নিভ গম্ভীর মুখে গুরু শিবনাথ আচার্যের সামনে বসে আছে। মন্দিরের ভিতরে তখন গভীর নীরবতা, বাইরে শুধু বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। আচার্যের হাতে একটি প্রাচীন তালপাতার পুঁথি—ধূলিমলিন, কিন্তু তাতে যেন এক অদ্ভুত দীপ্তি লেগে আছে। শিবনাথ ধীরে ধীরে পুঁথির পাতাগুলো উল্টে বললেন, “এটি আমাদের গুরুপরম্পরার গোপন ‘তন্ত্রপীঠের রহস্যপাঠ’। শতাব্দী আগে এই মন্ত্রশক্তি ব্যবহার করে এক ভয়ঙ্কর শক্তিকে আবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই শক্তি এখন মুক্ত। তাকে পুনরায় বেঁধে রাখা সহজ নয়, অগ্নিভ। তোমাকে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ পেরোতে হবে—এটি শুধু শারীরিক পরীক্ষা নয়, এটি তোমার মন, ইন্দ্রিয়, এবং আত্মার সীমা ছুঁয়ে যাবে।” অগ্নিভের কণ্ঠে দ্বিধা ছিল না, কিন্তু ভেতরে এক অজানা শঙ্কা ধীরে ধীরে শিকড় গাঁথতে লাগল। শিবনাথ আচার্য তাকে জানালেন, এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তার প্রাণহানিও হতে পারে, এমনকি তার আত্মাও হয়তো ছায়াশক্তির কবলে পড়ে যাবে।

পুঁথিতে বর্ণিত ছিল বহু বিরল মন্ত্র—যেগুলির উচ্চারণ সামান্য ভুল হলেও ভয়ঙ্কর ফল বয়ে আনতে পারে। অগ্নিভ প্রথমে শিখল ‘অগ্নিসূক্ত’—একটি মন্ত্র যা শত্রুর কালো শক্তিকে আগুনের আলোয় ভস্ম করতে পারে। এরপর এলো ‘দশদিক বেঁধন মন্ত্র’—যা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানের চারপাশে এক অদৃশ্য সীমানা তৈরি হয়, যাতে অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু এগুলো শিখতে শিখতে অগ্নিভ বুঝতে পারল, মন্ত্র শুধু মুখস্থ করলেই হয় না; প্রতিটি শব্দের সঠিক স্বর, প্রতিটি ধ্বনির গভীর অর্থ বুঝতে হয়। আচার্য তাকে ভোরের আগে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে স্নান করালেন, তারপর ভেজা শরীরে তিলক পরিয়ে যজ্ঞপীঠে বসালেন। অগ্নিভ চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপ শুরু করতেই তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত আলোড়ন জেগে উঠল—মনে হচ্ছিল যেন কারও চোখ তাকে ভেদ করে দেখছে, আর কোথাও থেকে হিমশীতল বাতাস এসে শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

দিন কেটে রাত এল, আর প্রতিটি রাত অগ্নিভের জন্য হয়ে উঠল নতুন পরীক্ষা। তাকে শিখতে হল ‘নবমুদি যজ্ঞপদ্ধতি’—যেখানে নয়টি ভিন্ন রঙের ধান, নয় রকম ফুল, এবং নয় প্রকার সুগন্ধি দিয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়। প্রতিটি উপাদান সংগ্রহের মধ্যেও ছিল চ্যালেঞ্জ—কিছু ফুল শুধু নির্দিষ্ট চাঁদের রাতে ফোটে, কিছু ধান শুধু অরণ্যের গোপন খেত থেকে পাওয়া যায়। অগ্নিভ নিজেই সব সংগ্রহ করল, কারণ গুরু বলেছিলেন, “যে নিজের হাতে উপাদান সংগ্রহ করে, তার শক্তি মন্ত্রে মিলিয়ে যায়।” এক রাতে, যখন সে গভীর অরণ্যে বিরল কালো তুলসী সংগ্রহ করছিল, তখন পেছন থেকে মৃদু হাসির শব্দ পেল—সেই ছায়ামূর্তির কণ্ঠ। অগ্নিভ ভয় পেল না, কিন্তু অনুভব করল, তার অগ্নিপরীক্ষা কেবল শুরু হয়েছে।

অবশেষে, পুঁথির শেষ পাতায় পৌঁছে অগ্নিভ পড়ল সেই নির্দেশ—যা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অগ্নিপরীক্ষার শেষ ধাপ সম্পন্ন করতে হলে তাকে যেতে হবে তন্ত্রপীঠের ‘রক্তচক্র’-এ—একটি প্রাচীন পাথরের বৃত্ত, যা শত বছর ধরে পরিত্যক্ত। বলা হয়, সেখানে সময়ের গতি অন্যরকম, আর সেখানে প্রবেশ করলে নিজের অন্তরের সবচেয়ে অন্ধকার রূপের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। শিবনাথ আচার্যের চোখে গভীর সতর্কতার ছায়া, কিন্তু ঠোঁটে এক গম্ভীর দৃঢ়তা—“অগ্নিভ, মনে রেখো, মন্ত্র ও যজ্ঞ শুধু বাহ্যিক শক্তি নয়। এর আসল উৎস তোমার অন্তরের শুদ্ধতা। যদি লোভ, ক্রোধ বা ভয় তোমাকে গ্রাস করে, তবে সেই শক্তিই তোমাকে ধ্বংস করবে।” অগ্নিভ পুঁথি বন্ধ করে গুরুদেবকে প্রণাম করল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যে শক্তি গ্রামকে গ্রাস করছে, তাকে সে যেকোনো মূল্যে বেঁধে রাখবেই। অগ্নিপরীক্ষার প্রস্তুতি শেষ, কিন্তু পথ এখনো শুরু হয়নি।

অদিতি সবসময়ই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী—সংখ্যা, সূত্র, পরীক্ষণ আর প্রমাণের জগতে তার জীবন কাটে। তার কাছে প্রতিটি ঘটনারই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকা উচিত, আর যে কোনো অলৌকিক বলে দাবি করা বিষয়কে সে প্রথমেই সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের এই ছোট্ট গ্রামটিতে এসে, অনিন্দ্যের মৃত্যুর পর থেকে, একের পর এক এমন ঘটনা তার সামনে ঘটতে লাগল যা কোনো সূত্রে মেলে না। প্রথমে সে ভেবেছিল, হয়তো মানসিক চাপ, ভয় কিংবা দুঃখ তাকে বিভ্রম দেখাচ্ছে। কিন্তু সেই রাতেই, যখন সে নিজের চোখে দেখল মন্দিরের ভিতরে নিভু আলোয় ভেসে বেড়াচ্ছে শঙ্খিনীর অর্ধস্বচ্ছ অবয়ব, আর তার ঠোঁট নড়ছে এক অচেনা ভাষায়, তখন সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বুকের ভেতরটা কাঁপছিল, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেনি। তার যুক্তিবাদী মন যেন সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর সে বুঝতে পারল—সবকিছু হয়তো বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে ধরা যায় না। এই উপলব্ধি তার ভিতরের অহংকারকে নাড়িয়ে দিল, তবুও সে নিজেকে বোঝাতে চাইছিল যে এরও কোনো না কোনো বাস্তব কারণ অবশ্যই আছে।

পরের দিন সকালে, অদিতি মন্দিরের আঙিনায় এসে দাঁড়াল। অগ্নিভ তখন গুরু শিবনাথ আচার্যের সঙ্গে প্রাচীন মন্ত্রপাঠ অনুশীলনে ব্যস্ত। আগুনের ধোঁয়া আর ধূপের গন্ধ মিলে বাতাস ভারী হয়ে আছে। অদিতি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সে লক্ষ্য করল, অগ্নিভের চোখে একাগ্রতা, কণ্ঠে দৃঢ়তা, আর ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত শান্তি—যা সে আগে কোনো মানুষে দেখেনি। হঠাৎ অগ্নিভ তার দিকে তাকাল, যেন তার মনের ভেতরের সংশয় পড়ে ফেলল। অদিতি নিজের অজান্তেই কিছুটা লজ্জা পেল। এতদিন যে মানুষটিকে সে শুধু এক রহস্যময় লোক হিসেবে দেখত, আজ তার মধ্যে এমন এক আভা খুঁজে পেল যা তাকে টেনে নিচ্ছে অদৃশ্য শক্তির মতো। অগ্নিভের সঙ্গে কথা বলার সময় তার ভেতরের দ্বিধা কিছুটা গলল, কিন্তু পুরোপুরি নয়। সে জানত, নিজের বিশ্বাসকে পুরোপুরি ভাঙতে হলে তাকে আরও অনেক কিছু দেখতে হবে।

তবে এই পরিবর্তনের শুরুটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করল সে রাতে। ঝড়ো হাওয়া বইছে, চারপাশে কাঁপতে থাকা আলোয় অদ্ভুত ছায়া নড়ছে। অদিতি বই পড়ছিল, তখন বাইরে থেকে খুব ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট একটি ডাক শোনা গেল—তার নাম। কণ্ঠস্বরটি মিষ্টি, কিন্তু তাতে এক শীতল স্রোত বইছে, যা গায়ে কাঁটা দেয়। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখল, দূরে মন্দিরের দিকে যেন একটা সাদা শাড়ি পরা ছায়ামূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে ধাক্কা মারল। যুক্তি বলছিল—হয়তো কোনো মানুষ, কিংবা ভ্রম। কিন্তু তার হৃদয় ফিসফিস করে বলছিল—এটা সাধারণ কিছু নয়। সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, আর দেখল অগ্নিভ ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। মাটির নিচে যেন কিছু কেঁপে উঠল, বাতাস থমকে গেল, আর সাদা অবয়বটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অদিতির মাথায় একটিমাত্র প্রশ্ন ঘুরছিল—যদি অগ্নিভ না থাকত, তবে কি সে ফিরে আসতে পারত?

এরপর থেকে অদিতির দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য নয়; কিছু রহস্য আছে যা এখনো মানুষের বোঝার বাইরে। ধীরে ধীরে অগ্নিভের প্রতি তার শ্রদ্ধা গভীর হতে লাগল। সে আর শুধু একজন যুক্তিবাদী গবেষক নয়, বরং এমন একজন যে অদৃশ্য জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করছে। অগ্নিভের আত্মবিশ্বাস, সাহস আর ত্যাগ তাকে মুগ্ধ করছিল। যদিও তার ভেতরের যুক্তিবাদী অংশ এখনো মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলে, কিন্তু সে জানে—এই পথেই হয়তো সত্যের সন্ধান আছে। আর সেই সত্যের পথে অগ্নিভই তার একমাত্র দিশারী। সেই রাত থেকে অদিতির চোখে অগ্নিভ কেবল রহস্যময় নয়, অপরিহার্যও হয়ে উঠল।

প্রচেষ্টা মুখোপাধ্যায়ের মানসিক দ্বন্দ্ব অনেকদিন ধরেই চলছিল, কিন্তু বাইরে থেকে তাকিয়ে কেউই তা বুঝতে পারত না। শান্ত, ভদ্র, আর কিছুটা আত্মবিশ্বাসী এই মানুষটির ভেতরে ধীরে ধীরে বাসা বেঁধেছিল এক গভীর লোভ—ক্ষমতা, খ্যাতি, এবং মৃত্যুকে পরাস্ত করার ইচ্ছা। অগ্নিভের গবেষণাগার আর পুরনো পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে সে অনেক কিছু শিখে ফেলেছিল, কিন্তু সেই জ্ঞানের একাংশ তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক ধূর্ত পরিকল্পনা। একরাতে, যখন পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, প্রচেষ্টা গোপনে বেরিয়ে পড়ল শান্তিনিকেতনের সীমানার দিকে, যেখানে বলা হয় ছায়ামূর্তির আবাস। কুয়াশায় ভরা সেই রাত, চারপাশে অদ্ভুত এক হিমেল বাতাস বইছে, আর দূরে কোথাও যেন কেউ শ্বাস নিচ্ছে ধীরে, গভীরভাবে। প্রচেষ্টা একটুও ভয় পায়নি—বরং বুকের ভেতর এক উত্তেজনার ঢেউ। সে জানত, এই চুক্তি একবার হয়ে গেলে, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। ছায়ামূর্তির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎটা ছিল শীতল ও অস্বস্তিকর—একটা কালো আকার, যা চোখে ধরা পড়ে না কিন্তু ছায়ার মতো গাঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন প্রতিটি শব্দ আর চিন্তা সে পড়ে ফেলছে। প্রচেষ্টা মাথা নোয়াল, আর বিনিময়ে প্রার্থনা করল অমরত্ব ও ক্ষমতার।

চুক্তির শর্ত ছিল সহজ, কিন্তু মারাত্মক—প্রচেষ্টা তার চারপাশের মানুষের ভয় ও বিশ্বাস ভেঙে দিতে হবে, এবং ধীরে ধীরে অগ্নিভের আস্থা নষ্ট করতে হবে। বিনিময়ে, ছায়ামূর্তি তাকে দেবে এমন এক শক্তি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। প্রচেষ্টা প্রথমে দ্বিধা করেছিল, কিন্তু লোভের কণ্ঠস্বর যুক্তি ও নৈতিকতার চেয়ে জোরে চিৎকার করছিল। সেই রাতে, একটি কালো কুয়াশার মতো কিছু প্রচেষ্টার চারপাশে পাক খেয়ে তার দেহে মিশে গেল—ঠান্ডা, ভারী, আর তীক্ষ্ণ শক্তির অনুভূতি। সে বুঝল, তার চোখের সামনে অদ্ভুতভাবে রং বদলাচ্ছে, কান দিয়ে যেন দূরের ক্ষীণ শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, এমনকি মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা ক্ষুদ্রতম দুর্বলতাও সে টের পাচ্ছে। সেই মুহূর্তে, প্রচেষ্টা জানত যে সে ফিরে যেতে পারবে না—এ চুক্তি তার অস্তিত্বকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এক অদ্ভুত ভয়ও ঢুকে পড়ল তার ভেতরে—ছায়ামূর্তি যেন শুধু তার সঙ্গী নয়, বরং তার প্রতিটি নিশ্বাসে নজরদার।

প্রথম কয়েকদিন, প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে অগ্নিভের পরিকল্পনায় সূক্ষ্ম ফাটল ধরাতে শুরু করল। কোনো কোনো তথ্য ভুলভাবে পৌঁছে দিচ্ছিল, কোনো কোনো প্রমাণ গোপন করছিল, আর কারো সামনে না থেকেও অগ্নিভের কথাবার্তা অন্যদের কাছে বিকৃত করে পৌঁছে দিচ্ছিল। তার চারপাশের সবাই অল্প অল্প করে একে অপরের ওপর সন্দেহ করতে শুরু করল, আর এই ভাঙনের মধ্যে প্রচেষ্টা যেন আনন্দ পাচ্ছিল। ছায়ামূর্তি মাঝে মাঝে তার কানে ফিসফিস করে দিত, কোন পথে গেলে সবার বিশ্বাস ধ্বংস হবে, কার দুর্বলতা কাজে লাগানো যাবে। তবে এই শক্তি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে প্রচেষ্টা বুঝতে লাগল, নিজের ভেতরেও কিছু বদলে যাচ্ছে—তার হৃদয় যেন আর স্পন্দিত হয় না, ঠান্ডা এক শূন্যতা তাকে গ্রাস করছে। রাতে ঘুম এলেও, স্বপ্নে সে দেখত অসীম এক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, আর দূরে থেকে ছায়ামূর্তির চোখ দুটি তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

কিন্তু বিপর্যয়ের সূচনা হলো তখনই, যখন প্রচেষ্টা বুঝতে পারল ছায়ামূর্তির আসল উদ্দেশ্য কেবল তাকে ক্ষমতা দেওয়া নয়—বরং তাকে ব্যবহার করে অগ্নিভের প্রতিরক্ষা ভেঙে দেওয়া, যাতে সেই শক্তি দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। একদিন গভীর রাতে, যখন প্রচেষ্টা একা, তার শরীর হঠাৎ অসহ্য ব্যথায় কাঁপতে লাগল, আর ছায়ামূর্তি তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে ঘুরতে লাগল। প্রচেষ্টা আতঙ্কে বুঝতে পারল, চুক্তি তাকে শুধু শক্তি দেয়নি—তাকে বাঁধনহীন এক পুতুলে পরিণত করেছে, যার উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছায়ামূর্তি হেসে উঠল, সেই হাসি শীতল আর অনন্ত—আর প্রচেষ্টা প্রথমবারের মতো অনুভব করল, সে আসলে এক গভীর ফাঁদে পা দিয়েছে, যেখানে মুক্তি বলে কিছু নেই। তার ক্ষমতা এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে, আর সেই অভিশাপের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে, শান্তিনিকেতন জুড়ে।

অগ্নিভ মন্দিরের অন্তঃকক্ষে প্রবেশ করল ভোরের আলো ফোটার আগেই। ঘন ধূপের গন্ধে বাতাস ভারী, আর চৌদ্দদিক থেকে শঙ্খধ্বনি ও মৃদু মন্ত্রপাঠের আওয়াজ এসে মিলিত হচ্ছে। শ্বেতপাথরের দেয়ালে খোদাই করা দেবমূর্তিগুলো যেন তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে। যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশে ইতিমধ্যেই সিঁদুর, গঙ্গাজল, অঞ্জলি ভরা ধান ও মঞ্জরি সাজানো। পুরোহিতদের একটি দল মন্ত্রোচ্চারণে ব্যস্ত, কিন্তু অগ্নিভ জানে—এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ তারই দায়িত্ব, আর তাকে একটানা ২৪ ঘণ্টা মন্ত্রপাঠ চালিয়ে যেতে হবে। ঘড়ির কাঁটা যখন শূন্যে ঠেকল, তখন থেকেই শুরু হলো তার “অগ্নিপরীক্ষা”—যেখানে কেবল শারীরিক সহনশীলতাই নয়, মানসিক দৃঢ়তাও সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সে বসে পড়ল পদ্মাসনে, চোখ অর্ধনিমীলিত, আর তার ঠোঁট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বেরোতে লাগল প্রাচীন সংস্কৃত মন্ত্র। প্রথম কয়েক ঘণ্টা সব ঠিকঠাকই চলল, কিন্তু সে জানত আসল পরীক্ষা এখনও শুরু হয়নি।

সময়ের সাথে সাথে মন্দিরের ভেতরে এক অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। প্রদীপের শিখাগুলো অস্বাভাবিকভাবে দুলে উঠল, আর মন্ত্রের মাঝপথে তার কানে ভেসে এল এক ফিসফিসানি—”থামো… তুমি পারবে না…”। প্রথমে সে ভেবেছিল, এটি কেবলই তার কল্পনা, কিন্তু ক্রমে সেই কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হতে লাগল, যেন কেউ ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে চোখ খোলেনি, কিন্তু ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। ছায়ামূর্তির প্রথম প্রলোভন ছিল এক অপরূপ দৃশ্য—তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই পরিবার, যাদের সে একসময় বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে অভিযোগ, দুঃখ, আর অভিশাপ মিশ্রিত। অগ্নিভের গলা শুকিয়ে এল, মনোযোগ বিচলিত হতে লাগল, কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে মন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল। বাইরে বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেল, আর আকাশে কালো মেঘের ভিড় জমে উঠল, যেন প্রাকৃতিক শক্তিও তাকে থামাতে চায়।

রাত গভীর হলে, প্রলোভন আরও তীব্র হলো। ছায়ামূর্তি এবার তার সামনে হাজির করল স্বর্ণমুদ্রা, রত্ন, আর এক মহাসিংহাসনের দৃশ্য—যেখানে অগ্নিভ নিজে এক অজেয় সম্রাট। “শুধু একটি মন্ত্র থামাও, আর বাকিটা আমি সামলে নেব”—ছায়ামূর্তির কণ্ঠ যেন রেশমের মতো কোমল, কিন্তু বিষে ভরা। অগ্নিভ অনুভব করল তার মন ধীরে ধীরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। স্বপ্নের মতো এক জগতে সে দেখতে পাচ্ছিল নিজেকে অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে, কিন্তু ঠিক তখনই তার চোখে ভেসে উঠল গুরুজির মুখ, যিনি তাকে একদিন বলেছিলেন—“প্রলোভন যতই মধুর হোক, তার মূলে সর্বনাশ লুকিয়ে থাকে।” অগ্নিভ গভীর শ্বাস নিয়ে পুনরায় মনোযোগ ফিরিয়ে আনল, আর আরও জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। প্রলোভনের দৃশ্য হঠাৎ ভেঙে গেল, মন্দির আবার ধূপগন্ধে ভরে উঠল, আর ছায়াগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

যজ্ঞের শেষ প্রহরে এসে ক্লান্তি, অনিদ্রা, আর শারীরিক যন্ত্রণায় অগ্নিভের শরীর প্রায় ভেঙে পড়ছিল। পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা, কপাল ঘামে ভিজে, আর চোখের পাতা ক্রমে ভারী হয়ে আসছিল। ছায়ামূর্তি শেষবারের মতো এক সর্বাত্মক আক্রমণ চালাল—চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল, মন্ত্রপাঠের শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল, আর সে অনুভব করল যেন তার চারপাশে শত শত হাত তাকে আঁকড়ে ধরছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে, অন্তরের গভীর থেকে উঠে এল এক শক্তি—যা ছিল না কেবল তার নিজের, বরং তার বিশ্বাস, তপস্যা, আর সকল শুভশক্তির সম্মিলিত রূপ। শেষ শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে যজ্ঞকুণ্ড থেকে শিখা আকাশচুম্বী হয়ে উঠল, আর অন্ধকার মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। অগ্নিভ ধীরে ধীরে চোখ খুলল—যজ্ঞ শেষ হয়েছে, প্রলোভন ও ভয়ের সব পরীক্ষা সে পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সে জানত, আসল যুদ্ধ এখনও বাকি।

মন্দিরের অন্তঃকক্ষ তখন মৃদু প্রদীপের আলোয় আবছা সোনালি ও লাল রঙে ভেসে যাচ্ছে। ধূপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, আর অগ্নিভ চোখ বন্ধ করে বসেছে যজ্ঞকুণ্ডের সামনে। চারপাশে এক অদৃশ্য উত্তাপ, যেন বাতাসের মধ্যে ঝনঝন শব্দ ভাসছে—অদ্ভুত, ভৌতিক। ছায়ামূর্তি তার মনস্তলে প্রথম আঘাত হানে, মনের গভীরে ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য ফুটে ওঠে—প্রিয়জনের মৃত্যু, নিজের অসহায়ত্ব, এবং অপমানের দীর্ঘ স্মৃতি। অগ্নিভ জানে, এগুলো সবই মায়া, তবু প্রতিটি ছবি তার বুকের ভেতর চেপে বসে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা কি বাস্তব, নাকি ছায়ামূর্তির আরেক প্রলোভন, বোঝা যাচ্ছে না। প্রচেষ্টা মুখোপাধ্যায় ছায়ার অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে আসছে—তার চোখে উন্মত্ততার ঝলক, হাতে কালো রক্তে ভেজা এক তাবিজ। সে অগ্নিভের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, “এই যজ্ঞ বৃথা… শক্তি তোকে বাঁচাবে না, আমি বাঁচাব!” কিন্তু তার গলায় এখন আর মানুষের সুর নেই, সেখানে মিশে আছে ছায়ামূর্তির শীতল প্রতিধ্বনি।

যজ্ঞের আগুনে ঘৃত ঢালতেই মন্ত্রপাঠের সুর ঘন হয়ে ওঠে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তি রূপ বদলে অগ্নিভের শৈশবের প্রিয় বন্ধুর মুখ ধারণ করে—হাসছে, ডাকছে, বলছে, “থাম… আমার কথা শুন।” অগ্নিভের হাত কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে আরও উচ্চস্বরে মন্ত্র জপতে থাকে। প্রচেষ্টা এদিকে যজ্ঞকুণ্ডের দিকে ধেয়ে এসে আগুন নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু অগ্নিভের সামনে যেন এক অদৃশ্য বলয় দাঁড়িয়ে গেছে, যা তাকে বারবার পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। ছায়ামূর্তি ক্রমে আকারে বিশাল হতে থাকে—তার ছায়া দেওয়াল বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে, ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ঘরের ভেতর বাতাস ভারী হয়ে আসে, ধূপের গন্ধ হঠাৎ করেই তীব্র, কটু, প্রায় শ্বাসরোধী হয়ে ওঠে। অগ্নিভ জানে, এই মুহূর্তটাই নির্ণায়ক—যদি মন এক মুহূর্তের জন্যও দুর্বল হয়, সব শেষ।

হঠাৎ প্রচেষ্টা চিৎকার করে ওঠে, “আমার সাথে এসো! আমরা দু’জনে মিলে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করব!” তার চোখে তখন অদ্ভুত দীপ্তি—আধেক পাগল, আধেক লোভী। কিন্তু ছায়ামূর্তির কালো স্পর্শ তার কাঁধে পড়তেই সে কেঁপে ওঠে, আর মুহূর্তের মধ্যে তার শরীর কাঁপুনি দিয়ে নুয়ে পড়ে। অগ্নিভ চোখ খুলে দেখে, প্রচেষ্টার দেহ কালো ধোঁয়ার মতো ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে—মুখে আতঙ্ক, তবুও মুক্তির কোনো লক্ষণ নেই। সেই ধোঁয়া ঘরের কোণে মিশে আবার ছায়ামূর্তির শরীরে গিয়ে জড়ো হয়, তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। মন্ত্রের সুর তখন প্রায় গর্জনের মতো উচ্চ, অগ্নিভ নিজের সমস্ত মনোযোগ কুণ্ডে কেন্দ্রীভূত করে, যেন শব্দই আলো হয়ে ছায়ামূর্তির অন্ধকারকে বিদীর্ণ করছে।

শেষ মুহূর্তে আগুনের শিখা যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে—মুহূর্তের জন্য অন্ধকার কেঁপে ওঠে, ছায়ামূর্তি চিৎকার করে ওঠে এক ভৌতিক, অমানবিক স্বরে। তার আকার টলমল করতে থাকে, ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। অগ্নিভ আরও একবার মন্ত্রের শেষ শব্দ উচ্চারণ করতেই ঘর ভরে যায় দীপ্তিময় আলোয়, যেন সূর্যের কিরণ আচমকা বন্দী অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে। ছায়ামূর্তির দেহ এক ঝলকে ভেঙে যায়, আর প্রচেষ্টার ভগ্ন আত্মা সেই আলোয় বিলীন হয়ে যায়, রেখে যায় কেবল শূন্যতা আর এক অদ্ভুত নীরবতা। যজ্ঞ শেষ হয়, কিন্তু অগ্নিভ জানে, এই জয় যতটা বাহ্যিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ভেতরের—কারণ এই যুদ্ধে সে জিতেছে নিজের ভয়, লোভ, আর ভঙ্গুরতার উপর। তবে ছায়ামূর্তির ফিসফিসানি যে চিরতরে মিলিয়ে গেছে, সেই নিশ্চয়তা এখনো তার নেই।

১০

অগ্নিভর কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ তখন আরও গভীর ও অনুরণিত হয়ে উঠেছিল। মন্দিরের প্রাচীন প্রাচীর যেন সেই ধ্বনির সাথে সুর মিলিয়ে কেঁপে উঠছিল। ধূপকাঠির ধোঁয়া ধীরে ধীরে চক্রাকারে উঠছিল, আর প্রদীপের শিখাগুলি অনিয়মিত ভাবে দুলছিল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি সেগুলোকে নাড়া দিচ্ছে। ছায়ামূর্তিটি শেষবারের মতো ক্রুদ্ধ গর্জন তুলল, তার অন্ধকার আকার দেয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো মাঝআকাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। অগ্নিভের হাতের ত্রিশূলদণ্ড তখন নীলাভ আভা ছড়াচ্ছিল, যা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। গুরু শিবনাথ আচার্য একাগ্রচিত্তে আশীর্বচন দিচ্ছিলেন, “শক্তি আবদ্ধ হউক, পথ রুদ্ধ হউক!” মন্ত্রের স্রোত ও ত্রিশূলের আভা মিলেমিশে যেন এক অদৃশ্য শিকল তৈরি করল, যা ছায়ামূর্তিকে ধীরে ধীরে চেপে ধরতে লাগল। হঠাৎ এক বিকট শব্দে অদৃশ্য দরজা যেন খুলে গেল, আর সেই কালো শক্তি তাতে টেনে নিয়ে যাওয়া হল, এক মুহূর্তে নিস্তব্ধতা নেমে এল।

যজ্ঞের ধোঁয়া ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল, আর মন্দিরের পরিবেশ যেন আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করল। অগ্নিভের কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, হাতে ত্রিশূলটি এখন নিঃশব্দ, কিন্তু সে জানত এর ভেতরে আবারও সেই শক্তি আবদ্ধ আছে। গুরু শিবনাথ আচার্য তার কাঁধে হাত রেখে ধীরস্বরে বললেন, “তুমি আজ যা করলে, তা শুধু এই গ্রাম নয়, আরও বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। কিন্তু মনে রেখো, এই শক্তি আবারও জাগতে পারে, যদি অশুভ লোভ তাকে আহ্বান জানায়।” অদিতি, যিনি পুরো ঘটনাটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছিলেন, এগিয়ে এসে অগ্নিভের চোখের দিকে তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা এবং গভীর ভয়ের ছায়া একসাথে মিশে ছিল। তিনি জানতেন, এই ঘটনার সমস্ত তথ্য তিনি লিখে রাখতে পারেন, তাতে এক নতুন ইতিহাস তৈরি হবে—কিন্তু সেই ইতিহাস হয়তো বিপজ্জনকও হতে পারে।

পরদিন ভোরে, তারা মন্দির থেকে নেমে এলেন। সূর্যের প্রথম আলো যখন গাছের পাতায় পড়ল, তখন অগ্নিভ বুঝতে পারল—গত রাতের অন্ধকার শুধু বাইরের ছিল না, তার মনেও কিছুটা জায়গা করে নিয়েছিল। তবুও সে গুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত আশীর্বাদ বুকে নিয়ে, শক্তি আবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে স্বস্তি অনুভব করছিল। অদিতি পথে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আমি আমার গবেষণার রিপোর্ট জমা দেব, কিন্তু এই অধ্যায়ের কোনো উল্লেখ করব না। মানুষকে কেবল জানানোই যথেষ্ট নয়, কখনও কখনও তাদের অজানা রাখাও বড় দায়িত্ব।” অগ্নিভ শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। গ্রামের লোকেরা মন্দিরের চারপাশে ভিড় করেছিল, কেউই জানত না গত রাতে ভেতরে কী ঘটেছে, আর হয়তো জানবেও না।

গ্রাম পেরিয়ে শহরের পথে যখন তারা বেরিয়ে পড়ল, তখন বাতাসে এক ধরনের হালকা স্বস্তি ভাসছিল। কিন্তু অগ্নিভের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—ছায়ামূর্তিটি এখন সত্যিই নিরাপদে আবদ্ধ তো? গাড়ি ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল, পেছনে রইল সেই প্রাচীন মন্দির, যার দেয়ালের ভেতর আবারও বন্দি হলো অদৃশ্য এক শক্তি। সূর্যের আলোয় মন্দিরটিকে শান্ত ও পবিত্র মনে হচ্ছিল, কিন্তু অগ্নিভ জানত, গভীরে এখনও অন্ধকার ঘুমিয়ে আছে—যতক্ষণ না আবার কেউ তাকে জাগিয়ে তুলতে আসে। আর সেই দিন এলে, হয়তো আবারও তাকে ফিরতে হবে এই মন্দিরে, আবারও এক যুদ্ধ শুরু হবে, যেখানে জিতবে না আলো বা অন্ধকার—জিতবে কেবল সেই, যার ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে দৃঢ়।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *