Bangla - ভ্রমণ - রহস্য গল্প

ডুয়ার্স ডায়রিজ

Spread the love

স্নেহা চৌধুরী


রেলগাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ সমুদ্রের মতো বিস্তৃত চা-বাগান আর দূরের বনভূমি দেখে পবিত্রর মনে হল যেন কারও আলতো হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়ের গোপনতম কোণ। পাহাড়ের কোলে ছড়িয়ে থাকা ডুয়ার্সের অপার সৌন্দর্য তাকে বহুবার ডেকেছে, কিন্তু এবার সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার রূপ একেবারেই ভিন্ন—সঙ্গে নতুন বউ অনুরাধা, আর তাদের প্রথম মধুচন্দ্রিমা। নিউ মাল জংশনে নামার সময় সকালটা ছিল কোমল কুয়াশায় মোড়া, আকাশে রোদের ঝলকানি আর বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। অনুরাধা ঘাড়ের ওপর শাড়ির আঁচল টেনে বলল, “এতটাই নির্জন জায়গা! একটু ভয় ভয় করছে জানো?” পবিত্র হেসে বলল, “তাই তো এখানে এসেছি। শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, শুধু তুমি আর আমি… আর প্রকৃতি।” তাদের হোমস্টে ছিল গরুমারা জাতীয় উদ্যানের একেবারে প্রান্তে, বাঁশগাছের ছায়ায় ঘেরা কাঠের কটেজ, যেখান থেকে রাতের বেলায় হাতির ডাক শোনা যায়। হোমস্টের মালিক বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি—দেবেন বর্মন—চোখ নরম করে বললেন, “ভালই করেছেন এসেছেন, বাবু-ম্যাডাম। তবে মনে রাখবেন, সন্ধ্যার পর বনের দিকে যাবেন না। এখানে অনেক পুরনো গল্প আছে… কিছু ভুলেও নয়।” পবিত্র হাসি চাপতে পারলেও অনুরাধা একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় তারা যখন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন কোথাও একটা বাঁশ ঝোপ নড়ে উঠেছিল যেন—কারও হালকা পায়ের শব্দ… অথবা হয়তো হাওয়া।

পরদিন সকালে তারা সাফারি বুক করে, গাইড হিসেবে এল এক কিশোর—শিবু। তার মুখে সারাক্ষণ ভয় মিশ্রিত কৌতূহল। সে বলল, “চিলাপাতায় গেলে না হয় একটা কথা বলি, বাবু। শুনেছেন ‘চামেলি বৌদির’ গল্প?” পবিত্র তখন ক্যামেরার ফ্রেম ঠিক করছিল, অনুরাধা বলল, “কে তিনি?” শিবু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “অনেক আগের কথা। এক বন অফিসারের বউ ছিলেন। খুব সুন্দরী। একদিন সকালবেলা বনে ঢুকে আর ফেরেননি। পরে লোকজন বলেন, কেউ কেউ নাকি তাকে আজও দেখে, শাড়ি পরে, মাথায় সিঁদুর, হেসে হেসে হাঁটেন গাছের ফাঁকে। কেউ তাকে দেখে ফেললে ফিরে আসেন না।” অনুরাধা ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল, “তুমি কি দেখেছো?” ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, কিন্তু আমার কাকা একদিন দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল।” পবিত্র ক্যামেরা নামিয়ে বলল, “গল্পটা রাখো, শিবু। ফিরে গিয়ে ডকুমেন্টারির জন্য তোমার একটা ইন্টারভিউ করব।” বনভ্রমণের পর দুপুরে তারা ফিরল হোমস্টেতে। বিকেলটা ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর—আকাশ কমলা, পাখির কিচিরমিচিরে ভরে আছে চারদিক, আর সামনে বন যেন নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। অনুরাধা কিছুটা চুপচাপ ছিল; পবিত্র জিজ্ঞেস করলে বলল, “কিছু নয়, মনে হচ্ছে কেউ যেন ডেকেছিল… জানি না ঠিক।” রাতে খাওয়া শেষ করে তারা যখন বারান্দায় বসেছিল, তখনই হঠাৎ ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এল এক চুড়ির মৃদু ঝংকার, যেন দূরে কোথাও কেউ হেসে উঠল। পবিত্র বলল, “হাওয়া বাজাচ্ছে।” অনুরাধা জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল—চোখে ভয়।

রাতের ঘুমটা অনুরাধার জন্য ভালো ছিল না। পবিত্র ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝরাতে হালকা শব্দে ঘুম ভাঙল তার। সে দেখল অনুরাধা নেই পাশে। উঠোন পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে একটা সাদা ছায়া এগিয়ে যাচ্ছে, আঁচলে লাল পাড়। সে দৌড়ে বাইরে ছুটল, ডাকল, “অনু! অনুরাধা!” কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। পায়ে গুঁড়ো বাঁশের পাতা মাড়িয়ে, কুয়াশায় ডুবে সে পৌঁছাল জঙ্গলের প্রান্তে—কিন্তু সেখানে কেবল গা-ছমছমে নীরবতা, আর একটা ধূপের গন্ধ। চারদিক ফাঁকা, অথচ পেছনে হঠাৎ একটা শব্দ—চুড়ির ঝংকার, অথবা কারও নিঃশ্বাস? সে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল—কেউ নেই। পবিত্র পুরো রাত ধরে খুঁজে বেড়াল, গাইডকে, হোমস্টের লোকজনকে জাগিয়ে তুলল, কিন্তু কেউ অনুরাধাকে খুঁজে পেল না। পুলিশের খবর দেওয়া হল। বনদপ্তরের লোক এসে বলল, “সাধারণত বাঘ বা হাতির আক্রমণ হলে দেহের চিহ্ন মেলে। এখানে এমন কিছু নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।” পবিত্র হাঁ করে বসে রইল। ঘরে ফিরে ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে গিয়ে দেখল শেষ রেকর্ডিংয়ে ধরা পড়েছে—অনুরাধার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি, আর এক মহিলার ছায়া তার পেছনে। লাল পাড় সাদা শাড়ি, মাথায় সিঁদুর। ছবি থেমে গেল সেই মুহূর্তেই, ক্যামেরার আলো নিভে গেল। পবিত্রর বুক ঠেলে উঠল একটা প্রশ্ন—এই বনে কে ঘুরে বেড়ায় এখনও?

চিলাপাতার জঙ্গলের দিকে গাড়ি ছুটে চলেছিল কাঁপা কাঁপা ধুলোর ধোঁয়া ফেলে রেখে, আর পবিত্রর চোখ যেন টান খেয়ে ছিল প্রতিটি ছায়া-আলো মাখা বাঁশঝাড়ের দিকে। অনুরাধা নিখোঁজ হওয়ার একদিন কেটে গেছে। পবিত্র একটা মুহূর্তও বিশ্রাম নেয়নি—পুলিশ, বনবিভাগ, স্থানীয় গাইড, এমনকি হোমস্টের দেবেনবাবুর বাড়ির রান্নাঘরের বুড়ো কর্মচারীকেও জিজ্ঞেস করে ফেলেছে—কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু পবিত্রর ভিতরের filmmaker-instinct যেন বলছিল, “এটা নিছক হারিয়ে যাওয়া নয়।” ওর ক্যামেরার শেষ রেকর্ডে অনুরাধার পেছনে দাঁড়ানো সেই অস্পষ্ট শাড়িপরা ছায়া—যার অস্তিত্ব কেউ মানতে রাজি নয়—তা চোখে লেগে আছে। শিবু গাইডটা চুপচাপ পাশে বসে ছিল, ডাকা হয়েছিল তারই গ্রামের এক বৃদ্ধাকে দেখাতে, যার নাম লক্ষ্মী রাভা। হোমস্টের আঙিনায় শুকনো তুলসীগাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ্মীর চোখদুটো ছিল যেন বহুদিন ধরে অরণ্যের গভীরে তাকিয়ে থাকা। পবিত্র তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি চামেলি বৌদির নাম শুনেছেন?” বৃদ্ধা একটু হেসে বলল, “শুধু শুনিনি বাবু, দেখেছি। এই দুই চোখে। আপনার বউমার মতই দেখতে ছিল। বড্ড হাসিমুখ ছিল তার… তখন বুঝিনি, সেই হাসিতে কতো শোক ছিল।” পবিত্রর গলা শুকিয়ে এল। লক্ষ্মী বলল, “একদিন গরুমারার রাস্তায় ধূপের গন্ধ পেয়ে আমি ফিরে তাকাই—একজন নারী হাঁটছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে হাওয়ায়, পায়ের শব্দ নেই, কেবল একটানা হাঁটছে… তারপর বাঁশঝাড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল। তারপর থেকেই এই বন বদলে গেছে। কেউ চুপ করে কাঁদে, কেউ নিখোঁজ হয়, আর কেউ শুধু ছায়া দেখে। চামেলি বৌদি আজও খুঁজে বেড়ায়—কাউকে—যে তার মতো। এই মেয়েটা… হয়তো তাকেই খুঁজে পেয়েছে।”

গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে থাকা চিলাপাতার জঙ্গল আর পবিত্রর ভিতরের উত্তাল সন্দেহ একসঙ্গে হাহাকার করতে শুরু করল। সে সিদ্ধান্ত নিল, যেখান থেকে মোবাইল ট্র্যাকিং-এ অনুরাধার শেষ লোকেশন পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে যেতে হবে। দীনেশ ওঁরাও—স্থানীয় বনরক্ষী—তাকে সঙ্গ দিতে রাজি হল। “যদি ও বনের ওই অংশে গিয়ে থাকে, তবে আপনাকে মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে, বাবু,” সে বলল। জিপচালক ও আরও একজন বনকর্মীসহ তারা প্রবেশ করল চিলাপাতার জঙ্গলের সেই পুরনো, পরিত্যক্ত ট্রেইলে। জিপের চাকা থেমে গেল যখন কাদায় আটকে পড়ল গাড়ি। বাকি পথ হাঁটতে হবে শুনে পবিত্রর গলা শুকিয়ে এলো, কিন্তু থামার উপায় নেই। আধাঘণ্টা হাঁটার পর তারা এক জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে লাল রঙের কিছু বস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দীনেশ বলল, “দেখুন, সিঁদুর।” পবিত্র নিচু হয়ে দেখতে পেল—গাছের গুঁড়িতে অদ্ভুত সিঁদুরের রেখা, আর একটা মাটির পাত্র, যার ভেতরে কিছু ধূপকাঠি এখনও জ্বলছিল। এই নির্জনতায় কেউ ধূপ জ্বালাল কবে? চারদিকে সুনসান, শুধু বাতাসে ভেসে আসা বুনো ফুলের গন্ধ—আর সেই পরিচিত কাঁপা কাঁপা চুড়ির আওয়াজ। পবিত্র ক্যামেরা অন করে খোঁজার চেষ্টা করল—কোনও দৃশ্য বা শব্দ ধরা পড়ে কি না। ক্যামেরা যেন হঠাৎ হালকা ঝাঁকি খেয়ে গেল—স্ক্রিনে ধরা পড়ল একটা ফ্রেম—এক নারী, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গি, তার চুলের বিনুনি, তার চোখের দিকের রেখা—এটা কি অনুরাধা?

আচমকা হাওয়ার দমকা ঝাপটা পবিত্রর মুখে এসে লাগল, ক্যামেরার স্ক্রিন নিভে গেল। দীনেশ এগিয়ে এল, “বাবু, আর ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, আর বনের এই অংশটা… ভালো নয়।” কিন্তু পবিত্র থামল না। সে হাঁটতে থাকল সেই দিকেই, যেখানে সেই নারী মিলিয়ে গিয়েছিল। কিছুদূর যেতেই সে দেখতে পেল একটা পরিত্যক্ত কাঠের কুঁড়ে—ঘরের ভিতরে রোদ পড়ে এক সোনালি রেখার মতো ছড়িয়ে আছে, আর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে পুরনো ছবি, কাগজ, ও এক সাদা-লাল শাড়ি। সে এগিয়ে গিয়ে একটি ছবি তুলে নিল—তাতে দেখা যাচ্ছে এক নবদম্পতি, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের পটভূমিতে। মেয়েটির মুখ হুবহু অনুরাধার মতো। নিচে লেখা তারিখ—“১৯৮৯, চামেলি ও দীপক।” পবিত্রর হাত কেঁপে উঠল, মেঝেতে রাখা সেই শাড়ির আঁচলে হাত দিতেই চারদিকে বাতাস থেমে গেল, গাছের পাতারা হঠাৎ থেমে গেল যেন। আর হঠাৎ মাটির নিচ থেকে উঠে এল এক কর্কশ গলা, যেন কেউ কেঁদে বলছে, “আমাকে নিয়ে যা… আমি একা… আর নয়…” পবিত্র ছিটকে উঠল, দৌঁড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। দীনেশ ও অন্য বনরক্ষীরা তাকে ধরে ফেলে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?” সে কিছু বলতে পারল না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল—একটা শাড়ির আঁচল বাতাসে ভেসে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে চিলাপাতার গহীন সবুজে।

জলপাইগুড়ির থানার ইনস্পেক্টর হেমন্ত রায় ফাইল বন্ধ করে মাথা তুলে বলল, “শুনুন মিস্টার ঘোষাল, আমরা প্রতিদিন অনেক নিখোঁজ কেস পাই। কিন্তু এখানে কোনও সংঘর্ষ, প্রাণীর আক্রমণ, কিংবা অপহরণের কোনো প্রমাণ নেই। হয়তো আপনার স্ত্রী নিজে থেকেই কোথাও চলে গেছেন।” কথাটা শুনে পবিত্রর কানে যেন বোমা ফাটল। “নিজে থেকে কোথাও চলে গেছেন? এই জঙ্গল, এই নির্জনতা—ও কী কারণে যাবে একা? কোথাও কেউ দেখেছে তাকে?” পবিত্রর গলা কাঁপছিল। ইনস্পেক্টর শীতল গলায় বলল, “স্থানীয় গাইডদের জিজ্ঞেস করেছি। কেউ বলেননি যে উনি একা কোথাও গেছেন। কিন্তু আপনি যা বলছেন—যে তিনি শাড়ি পরে, কারও ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে যান—এটা শুনলেই তো অলৌকিক কাহিনির মত শোনায়।” পবিত্র ক্যামেরার স্ক্রিন খুলে দেখাল শেষ ভিডিওটি—যেখানে অনুরাধার পাশে দেখা গিয়েছিল এক নারীসদৃশ ছায়া। ইনস্পেক্টর ভালো করে দেখে বলল, “হয়তো আলো-ছায়ার বিভ্রম। আর যেটা বললেন চামেলি বৌদির কথা—এসব লোককথা। আমাদের প্রমাণ চাই।” পবিত্র বুঝল, প্রশাসন এই খোঁজে তার পাশে থাকবে না। সে নিজেই বেরিয়ে পড়ল আরও গভীর অনুসন্ধানে। হোমস্টে ফিরে পবিত্র সেই বৃদ্ধ দেবেন বর্মনের কাছে গিয়ে বসে বলল, “আপনি কিছু জানেন। বলুন, চামেলি বৌদি কে ছিলেন? কোথা থেকে এই কাহিনি শুরু?” দেবেন ধীরে ধীরে চায়ের কাপ নামিয়ে বলল, “বাবু, ও ছিল এখানে বন বিভাগের এক কর্মকর্তার স্ত্রী। উনি ভীষণ ভালোবাসতেন চিলাপাতার বনের নিঃস্তব্ধতা। একদিন সকালে বলল সে জঙ্গলে একটু হাঁটবে—তিনদিন বাদে তার ক্ষতবিক্ষত শাড়ির একটা অংশ পাওয়া যায় এক খাদের ধারে। কারও দোষ প্রমাণ হয়নি। এরপর থেকেই এই এলাকায় এক অলক্ষ্মী ছায়া ছড়িয়ে পড়ে।”

পবিত্র নিজের নোটবুকে লিখতে শুরু করল—চামেলি, তার নাম, ছবি, লোককথা, নিখোঁজ হওয়ার সময়। সে বুঝতে পারছিল—এই রহস্য অনুরাধার নিখোঁজ হওয়ার চাবিকাঠি হয়ে উঠছে। সন্ধ্যায় যখন সে নিজে হাঁটতে বেরোয় গরুমারার ধার ধরে, তখন তার চোখে পড়ে এক বৃদ্ধা গাছের নীচে বসে ধূপ জ্বালাচ্ছেন। কাছে গেলে লক্ষ্মী রাভা মুখ তুলে বলল, “তুমি বোঝো না বাবু, চামেলি কাউকে খুঁজছে যে তার মতো—শরীর না থাকলেও আত্মার আকৃতি সে নিজেই গড়তে পারে। তোর বউমার মধ্যে ও নিজেকে দেখেছে।” পবিত্র কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু আমি তো এখনও জানি না, ও কোথায়!” বৃদ্ধা চুপ করে একটা বস্তার ভাঁজ খুলে দিল। ভেতরে ছিল একটি পুরনো আয়না, যার কিনারা ধাতব, আর মাঝখানে অস্পষ্ট এক মুখের ছায়া। “এই আয়নায় যাদের চামেলি দেখে, তারা হারিয়ে যায়। চামেলি নিজের মতো করে তাদের গড়ে নেয়। জঙ্গল আর ছায়ার মধ্যে ওদের খুঁজে পেতে গেলে শুধু চোখ নয়—মনেরও দরজা খুলতে হয়।” পবিত্র আয়নায় চোখ রাখল। হঠাৎ হাওয়া থেমে গেল, শব্দ মিলিয়ে গেল, আর আয়নায় দেখা গেল অনুরাধা—সে তাকিয়ে আছে তার দিকে, কিন্তু চোখ যেন শূন্যতায়। পবিত্র পিছিয়ে এল, ঘাম ঘাম মুখে বলে উঠল, “আমি যেভাবেই হোক, ওকে ফিরিয়ে আনব।”

রাতে হোমস্টের রুমে ফিরে এসে পবিত্র সিদ্ধান্ত নেয় চামেলির অস্তিত্বের ব্যাখ্যা খুঁজবে—যদি অলৌকিক হয়, তবে সে ছবি তুলে প্রমাণ রাখবে, আর যদি না হয়, তবে এই জটিল রহস্যের শেষ কড়িটা খুঁজে বের করবে। সে তার ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার, একটা পুরনো নোটবুক আর অনুরাধার ছবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গরুমারার গভীরে। দীনেশ ওঁরাও সঙ্গে থাকে, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন পথে যায়। পবিত্র ওই জায়গায় ফিরে যায়, যেখানে সে সিঁদুর ও ধূপ পেয়েছিল। সেখানে এবার সে দেখল নতুন কিছু—একটি ছোট পাথরের চাতালে রাখা একটা শাঁখ, আর তার পাশে খোলা একটা চিঠি—তাতে লেখা, “আমি ফিরতে চাই না। আমি এখন তার সঙ্গে, যে আমাকে সত্যি দেখে, সত্যি বোঝে। তুমি বুঝবে না।” লেখাটা অনুরাধার হাতের লেখা। পবিত্রর মাথা ঘুরে উঠল। সে বুঝতে পারছিল, অনুরাধা বেঁচে আছে। কিন্তু সে স্বেচ্ছায় কোথাও গেছে? নাকি তার ওপর প্রভাব ফেলেছে সেই ছায়া, যাকে এই জঙ্গল বুকে পুষে রেখেছে? হঠাৎ তার পেছনে একটা ঝোপ নড়ে উঠল। পবিত্র ক্যামেরা ঘুরিয়ে ধরল—একটা শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে, কিন্তু কেউ নেই। ক্যামেরায় সে ধরা পড়ল না, কিন্তু পবিত্রর মনে হল, হাওয়ার মাঝে একটা কণ্ঠ ভেসে এল—“তুমি কি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? যদি পারো, তবে একটা মূল্য চুকোতে হবে…” আর তখনই জঙ্গলের মাঝে শিয়ালের দীর্ঘ আর্তনাদ উঠল, আর দূরে কে যেন হেসে উঠল—খুব চেনা, খুব আপন, কিন্তু এখন আর একা নয়।

পবিত্রর মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল—অনুরাধা বেঁচে আছে, কিন্তু সে কি স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছে? না কি কেউ বা কিছু তাকে নিজের মায়াজালে টেনে নিয়েছে? চিঠিতে লেখা সেই বাক্য—“সে আমাকে সত্যি বোঝে”—এই ‘সে’ কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পবিত্র পৌঁছে গেল সেই পুরনো লাইব্রেরিতে, যেখানে স্থানীয় ইতিহাস ও বনবিভাগের পুরাতন রেকর্ড রাখা থাকে। মাকড়সার জালে ঢাকা কাঠের তাক ঘেঁটে সে বার করল ১৯৮৯ সালের এক পুরনো সংবাদপত্র, যার শেষ পাতায় লেখা—“নিখোঁজ বনকর্মীর স্ত্রী, আত্মহত্যা সন্দেহে তদন্ত জারি।” পাশে একটি অস্পষ্ট ছবি—চোখে রোদচশমা, সাদা শাড়ির ওপর লাল পাড়, ঠোঁটে ম্লান হাসি, আর চোখে এক গভীর শূন্যতা—নাম লেখা আছে: চামেলি রায়। পরের পাতায় একটি হ্যান্ডনোট সংযুক্ত ছিল, যেখানে লেখা: “চামেলি আত্মহত্যা করেনি, সে চলে যেতে চেয়েছিল… কিন্তু কারও সঙ্গে নয়।” রিপোর্টটি লিখেছিলেন এক সাংবাদিক—তাপস দে। সেই নাম পেয়ে পবিত্র সোজা চলে গেল মালবাজার শহরের দিকে, লোকমুখে জেনে সে পৌঁছে গেল তাপস দের ছেলেবেলার বাড়িতে। এখন বৃদ্ধ, স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত, তবু কিছু কিছু কথা বলছিলেন—“চামেলি বৌদি… অদ্ভুত মেয়ে ছিল… কথা বলত গাছের সঙ্গে, শুনত পাখির ভাষা… সে বলত, মানুষ তাকে বোঝে না, বনই তার ঘর।” পবিত্রের শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। “তাহলে… সে জঙ্গলেই থেকে গিয়েছিল?” বৃদ্ধ তাপস চাপা কণ্ঠে বলল, “একদিন বন অফিসারের বিরুদ্ধে গুজব রটে… চামেলি অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। লোকটা নাকি তাকে একা রেখে গভীর জঙ্গলে পাঠায়। আর ফিরে আসেনি। কে জানে, তাকে মেরে ফেলেছিল, নাকি সত্যিই চামেলি নিজেই বেছে নিয়েছিল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।”

সন্ধ্যার পর পবিত্র আবার ফিরে এল গরুমারায়। দেবেনবাবু ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন, হাতে ধোঁয়া ওঠা লাল চায়ের কাপ। পবিত্র সব কথা খুলে বলল—তাপস দে, খবরের কাগজ, সেই অভিযোগ, আর চামেলির ‘অপসারণ’। দেবেনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি চামেলিকে দেখেছি। ওর চোখে ছিল অদ্ভুত আলো। একটা সময় আমাদের হোমস্টের পাশে ঘর ভাড়া নিয়েছিল তারা। বনকর্মী দীপকবাবু সারাদিন বাইরে থাকতেন, চামেলি হাঁটতেন বনের ধারে, কথা বলতেন ফুলের সঙ্গে। আমি দেখেছি—ও রাতে জেগে থাকত, চাঁদের আলোয় ছায়ার সঙ্গে কথা বলত। অনেকে বলত, ও পাগল। কিন্তু আমি বলি, ও ছিল একা। একা, অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রাণ।” পবিত্র প্রশ্ন করল, “আপনি কী মনে করেন, ও আত্মহত্যা করেছিল?” দেবেনবাবু মাথা নাড়লেন, “না, বাবু। আমি বিশ্বাস করি, ও বেছে নিয়েছিল নিজেকে গড়ার নতুন পথ। কেউ যদি তার ডাকে সাড়া দেয়, তাকে সে নিজের সঙ্গে নিয়ে যায়—এই জঙ্গলের কোনো ছায়াময় স্তরে। আপনার বউমার হয়তো সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলার মত হৃদয় ছিল।” পবিত্রর হৃদয়ে ঢেউ খেলল এক অজানা বিষাদ, কিন্তু তার ইচ্ছেশক্তি ততটাই দৃঢ় হয়ে উঠল। অনুরাধাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। সে জানত, চামেলিকে বোঝার জন্য তার চিহ্নগুলো ধরতে হবে—কোথায় সে ঘুরে বেড়ায়, কখন সে প্রকাশ পায়, আর কীভাবে সে টানে কাউকে নিজের দিকে।

পরের দিন খুব ভোরে, হালকা কুয়াশা আর ডুয়ার্সের পাখিদের কণ্ঠে সুর মিশে থাকা সেই মুহূর্তে, পবিত্র পৌঁছাল সেই নির্জন জায়গায়—যেখানে সিঁদুর, ধূপ, আর শাঁখ পড়ে ছিল আগের দিন। সে এবার সঙ্গে করে এনেছে অনুরাধার প্রিয় কাগজের ডায়রি, যে ডায়রিতে সে কবিতা লিখত। পবিত্র পাতাগুলো খুলে বনভূমির মাঝে জোরে পড়তে লাগল—“তুমি যদি বাতাস হও, আমি হব গন্ধ… তুমি যদি জল, আমি হব ঢেউ… তুমি যদি হারিয়ে যাও, আমি হব খোঁজ।” কয়েক মিনিট কোনো প্রতিক্রিয়া এল না। এরপর হঠাৎ বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। বনভূমির মাঝখানে উঠল ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়ার মধ্যেই দেখা গেল এক নারী, মাথায় সিঁদুর, শাড়ির আঁচল লাল পাড়ের মতো উড়ছে—কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না। পবিত্র এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে বলল, “অনুরাধা?” নারীমূর্তি কিছু বলল না। পবিত্র চিৎকার করল, “তুমি ও নও। তুমি চামেলি। আমি জানি তুমি একা ছিলে, কষ্ট পেয়েছিলে। কিন্তু তুমি অনুরাধাকে নিজের মতো করে টেনে নিতে পারো না।” হাওয়ায় কাঁপা কাঁপা আওয়াজে ভেসে এল, “সে তো আমায় বুঝেছে… তুমি কি বুঝতে পেরেছো, কখনও?” পবিত্র কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি আজ বুঝতে শিখছি… আর আমি চাই না কেউ আর হারিয়ে যাক, যেমন তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে। অনুরাধা তোমার প্রতিচ্ছবি নয়—সে নিজের আলোয় আলাদা।” কথাগুলো যেন ধাক্কা দিলো সেই ছায়াকে। শাড়ির আঁচল ধীরে ধীরে পড়তে লাগল মাটিতে, আর ছায়া মিলিয়ে গেল পাতার ফাঁকে, কুয়াশার ভিতর। পবিত্র শুনতে পেল অনুরাধার নিঃশ্বাসের মত আওয়াজ—ক্লান্ত, কিন্তু জীবিত। তখনই দূরে থেকে কেউ চিৎকার করল, “ওই তো! ওই তো ও আছে!” পবিত্র ছুটে গেল। বাঁশঝাড়ের নীচে, অনুরাধা বসে আছে, চোখ বুঁজে, ঠোঁটে একটুকরো হাসি—যেন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে ছিল… জীবিত।

অনুরাধাকে জলপান করিয়ে, কোলে মাথা রেখে বসে ছিল পবিত্র—চোখদুটো ঘুমন্ত, নিঃশ্বাস ধীরে, কিন্তু শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। দীনেশ ওঁরাও আর শিবু পেছন থেকে ছুটে এসে বলল, “বাঁচানো গেছে… ঈশ্বরের কৃপায়।” কিন্তু পবিত্র জানত, ঈশ্বরের থেকেও বড় ভূমিকা রেখেছে তার বিশ্বাস, তার ভালোবাসা, আর এক নারীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প, যার ছায়া অনুরাধার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। অনুরাধা কিছুই মনে রাখতে পারছিল না—সে বলল, “আমার মনে হয় যেন আমি কারও সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু সে মানুষ নয়… সে যেন বাতাস, গন্ধ, কিংবা সময়। সে আমাকে দেখে বলেছিল, ‘তুই আমার মতো…’ আমি ভয় পাইনি, আমি শান্তি পেয়েছিলাম।” পবিত্র তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তুমি ফিরে এসেছো, এটাই যথেষ্ট।” কিন্তু তার মনে তখনই জন্ম নিল আরেকটি প্রশ্ন—এই ঘটনা কি শেষ? নাকি সবে শুরু? অনুরাধার চোখে কিছুক্ষণ পর কুয়াশা ভরা দৃষ্টি দেখা গেল—সে বলল, “একটা রাস্তা মনে আছে… একটা সিঁদুরে রঙের পথ… যেন গাছের গায়ে লাল দাগ ছিল, আর কেউ ডাকছিল আমাকে।” পবিত্রর গা শিউরে উঠল—সে আগেও সেই সিঁদুরের দাগ দেখেছে, গাছের গায়ে। সে বুঝল, এই জঙ্গল কিছু রেখে দিয়েছে তার জন্য—একটা বার্তা, একটা অসমাপ্ত গল্পের টুকরো। সেই রাতে অনুরাধাকে ঘুম পাড়িয়ে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। আকাশে পূর্ণিমা, আর গাছের ছায়ায় মাঝে মাঝে যেন শাড়ির আঁচল উড়ে যায়।

পরদিন সকালে পবিত্র একা বেরিয়ে পড়ে সেই লাল সিঁদুরের দাগ খুঁজতে। হোমস্টের পুরনো মানচিত্র দেখে সে বুঝে নেয়—যেখানে ধূপকাঠি আর শাঁখ ছিল, তার উত্তর-পূর্বদিকে এক পুরোনো কাঠের সেতু আছে, যার ওপারে আগে এক তপোবন ছিল। এখন সব ভেঙে পড়েছে, ঝোপে ঢেকে গেছে পথ। সে হাঁটতে থাকে, হাতে ক্যামেরা, পকেটে অনুরাধার সেই কবিতার ডায়েরি। বনের মাঝে, সিঁদুরের দাগ আবার দেখা যায়—গাছের গায়ে, মাটির চৌকাঠে, পাথরের ওপর। পবিত্র বুঝতে পারে, এ যেন এক অলৌকিক পথনির্দেশ, এক জঙ্গলের মধ্যেকার মানসচিত্র, যা কেবল অনুভবেই বোঝা যায়। একটু দূরে গিয়ে সে দেখে—একটা গাছের গোড়ায় বসে আছে এক ছায়ামূর্তি, মুখ ঢাকা, শুধু লাল শাড়ি, আর গলায় সাদা ফুলের মালা। পবিত্র ক্যামেরা তোলার চেষ্টা করতেই ছবিটা স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—অস্বাভাবিক ভাবে স্পষ্ট—ছবিতে দেখা যায় মুখটা অনুরাধার মতো, কিন্তু চোখদুটো অতল, গা-ছমছমে শূন্য। হঠাৎ মাটির তলা থেকে উঠে আসে শব্দ, যেন চুড়ির টুংটাং, আর একটা চাপা হাসি। পবিত্র এগিয়ে যায়, কিন্তু ততক্ষণে ছায়া মিলিয়ে গেছে। সে বুঝে নেয়, এটি চামেলির ইচ্ছাশক্তিরই রূপ, আর এই পথ, এই ‘সিঁদুরের পথ’, তার তৈরি করা এক স্মৃতি-ভূমি। পবিত্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলে, “আমি এসেছি, তোমার কথা শুনেছি, বুঝেছি। কিন্তু এবার আমাকে যেতে দাও। যে ভালোবাসে, সে বেঁধে রাখে না। অনুরাধা তোমার প্রতিচ্ছবি নয়—সে আমার স্বপ্নের দিকদর্শন।”

গভীর বনের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ বাতাসে ওঠে এক দীর্ঘশ্বাস। গাছের পাতা নড়ে না, কিন্তু যেন সময় থেমে যায়। একটা সাদা শাড়ির আঁচল ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে পাশের বাঁশঝাড়ে। পবিত্রর চোখে জল চলে আসে। সে বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে চামেলি মুক্ত হয়েছে—নিজেকে, তার আবেগকে, সেই আঘাত আর অপমানকে ছেড়ে দিয়েছে। অনুরাধার ওপর তার মায়া কাটল, এবং এই বন হয়তো নতুন করে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। পবিত্র ক্যামেরা বন্ধ করে ব্যাগে রাখে, সেই কবিতার ডায়েরিটা এক গাছের গুঁড়িতে রেখে আসে, যেন চামেলির নামে একটা অর্পণ। হোমস্টেতে ফিরে অনুরাধাকে দেখে যেন সে প্রথম প্রেমিকার চোখে তাকিয়ে আছে। অনুরাধা হালকা হাসে, “তুমি কেমন করে এত শান্ত হয়ে গেলে?” পবিত্র বলে, “কারণ এক আত্মা আজ মুক্তি পেল, আর আমি শিখলাম—ভয় নয়, ভালোবাসা একমাত্র সত্যি।” সেই রাত, অনেকদিন পরে, ছিল নির্ঝঞ্ঝাট—না ছিল চুড়ির শব্দ, না ধূপের গন্ধ, না অদ্ভুত ছায়া। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে অনুরাধা জানালার ধারে গিয়ে একটুকরো সাদা কাপড় কুড়িয়ে পেল—লাল পাড়, ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ। অনুরাধা চুপ করে সেটাকে কোলের উপর রাখল, পবিত্র কিছু বলল না—শুধু ওর কাঁধে হাত রেখে বাইরে তাকিয়ে রইল। জঙ্গল তখন আলতো বাতাসে দুলছিল—যেন বিদায় জানাচ্ছে চুপিসারে, এক চিরকালীন পথিকাকে।

গরুমারার জঙ্গলকে পেছনে রেখে যখন পবিত্র ও অনুরাধা জলদাপাড়ার দিকে রওনা হল, তখন আকাশ ছিল ধু ধু নীল, আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো যেন পথের কোল ঘেঁষে চলছিল। এক অদ্ভুত শান্তি ঘিরে ধরেছিল তাদের—কিন্তু সে শান্তি নিঃসঙ্গ নয়, বরং এক প্রজ্ঞা-বিজড়িত প্রাপ্তি যা ভয়কে ছুঁয়ে দেখেছে, ভালোবাসাকে মাপার পথ চিনেছে। অনুরাধা যেন নতুন করে পৃথিবীকে দেখছিল; গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল, “জঙ্গলটা এখন অনেক বেশি আপন মনে হচ্ছে, অথচ খুব অচেনাও।” পবিত্র হেসে বলল, “কারণ তুমি জেনেছ, সব হারিয়ে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। কারও স্মৃতিতে থাকা, কারও জন্য অপেক্ষা করাও একটা জীবন।” অনুরাধার চোখে জল চিকচিক করল। তাদের গন্তব্য ছিল জলদাপাড়ার এক গহীন বনসংলগ্ন বুনো কটেজ—পশ্চিম দিকের ধানতলার পাশে, একসময় যেখানে ভুটিয়াদের প্রাচীন শিকারি দল তাদের ছায়া রেখে গিয়েছিল। সেখানে এখন পর্যটক কম আসে, কিন্তু বনের আদিগন্ধ আরও গভীর। হোমস্টে মালিক—এক কুরুক্ষেত্রজয়ী গলা ও হাসি সম্বলিত পাহাড়ি ভদ্রলোক—তাদের দেখে বলল, “আপনারা সাহস করে এসেছেন। অনেকেই গরুমারার পর আর জলদাপাড়া আসে না।” পবিত্র জিজ্ঞেস করল, “কেন?” লোকটি এক গাল হেসে বলল, “এখানে নাকি এক পুরনো হাতি এখনও রাতভর হেঁটে বেড়ায়… কারও পায়ের ছাপ নেই, তবু শব্দ শোনা যায়। আর মাঝে মাঝে—একটা সাদা ময়ূর উড়ে যায় আকাশে, যার দেখা পাওয়া মানেই কিছু বদলে যাবে।”

সন্ধ্যার দিকে কটেজে বসে তারা বনরক্ষী শান্তিলাল দাসের মুখে শুনছিল পুরনো জলদাপাড়ার ইতিহাস—রাজবংশ, মোনপা উপজাতি, আর একটি প্রাচীন অলিখিত শপথের কথা। “এই বনে,” শান্তিলাল বলল, “একদা এক মেয়ে ছিল যার নাম ছিল তাশিমা। সে মানুষের ভাষা জানত না, কিন্তু পশুর চোখে কথা পড়তে পারত। একদিন সে এক ময়ূরের রূপ ধরে অরণ্যে বিলীন হয়। আর তারপর থেকেই এই জঙ্গলে রাতের বেলা কেউ সাদা কাপড় পরে হাঁটতে পারে না—মনে করা হয় তাশিমা সেটা সহ্য করতে পারে না।” অনুরাধা হালকা চমকে বলল, “মানে?” শান্তিলাল মাথা নাড়িয়ে বলল, “সাদা কাপড়—যেমন শাড়ি—রাতের জঙ্গলে অশুভ বলে মনে করা হয়। আপনি গরুমারার গল্প শুনে এসেছেন বুঝি?” পবিত্র ও অনুরাধা পরস্পরের দিকে তাকাল। চামেলির ছায়া যেন এখনও কোথাও গায়ে লেগে আছে। পবিত্র মৃদু গলায় বলল, “সেই অভিজ্ঞতা আমাদের বদলে দিয়েছে। এখন আমরা ভয় পাই না, শুধু শ্রদ্ধা করি।” শান্তিলাল বলল, “তবেই তো আপনি জলদাপাড়ার যোগ্য অতিথি।” রাত গভীর হলে তারা কটেজে ঢুকে দরজা বন্ধ করল, কিন্তু বাইরের পাতায়-পাতায় একটা হালকা শব্দ বেজে চলল—হাতির পায়ের ছাপ? না কি বাতাসের প্রতিধ্বনি? অনুরাধা পবিত্রর কাঁধে মাথা রেখে বলল, “তোমার পাশে থাকলে কোনো ছায়াও ভয় পায় না। আমি যেন নতুন জন্ম পেলাম।” পবিত্র চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল—দূরে যেন কিছু একটা সাদা উড়ে গেল… পাখি, না কি কেউ?

পরদিন খুব ভোরে তারা হাতির পিঠে চড়ে সাফারিতে বের হল—জঙ্গলের পথে, যেখানে বুনো মোরগ ডাকে, চিতা ঘাসে শুয়ে থাকে, আর বরফের মতো নীরবতা দখল করে থাকে বাতাস। অনুরাধার হাতে ছিল সেই ডায়েরি, যেখানে চামেলির গল্পের পাশে সে নতুন কবিতা লিখেছে—“যে হারিয়ে যায়, সে সবসময় ভুলে যায় না… সে ফিরে না এলেও থেকে যায়, পাতার শব্দে, আলো-ছায়ার খেলায়, কিংবা রাতের বাতাসে কারও শ্বাসের মতো।” পবিত্র সেই পাতাটা তুলে ক্যামেরায় ধারণ করল—এই ছিল তাদের ডুয়ার্স ডায়রিজের সবচেয়ে অমূল্য ছবি। সাফারির শেষে তারা যখন জিপে ফেরে, তখন গাইড বলল, “আপনারা ভাগ্যবান। এমন দিনের শেষে সাধারণত কেউ চুপ করে বসে থাকে, আপনাদের চোখে আমি আলো দেখছি।” পবিত্র হেসে বলল, “আমরা কিছু হারিয়েছি, কিছু পেয়েছি… আর এখন শিখেছি, প্রতিটি জঙ্গলের হৃদয়ে একটা গল্প বাস করে, যা কেবল ভালোবাসা দিয়ে ছুঁতে হয়।” তখন হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে এল, আর এক সাদা ময়ূর পাশের গাছ থেকে উড়ে গেল—আলো ছুঁয়ে, ছায়া ভেদ করে। অনুরাধা আর পবিত্র জানাল—এই যাত্রা শেষ নয়, এই যাত্রা সেই পথ যেখানে ফিরে আসা মানেই নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।

জলদাপাড়ায় কাটানো দিনগুলি যেন ধীরে ধীরে স্মৃতির কুয়াশায় মিশে যাচ্ছিল, কিন্তু পবিত্রর মনে একটা অস্থিরতা থেকে গিয়েছিল—একটা অদ্ভুত বোধ, যেন এইসব ছায়ারা কেবল অতীত নয়, বরং বর্তমানকে গঠন করে। অনুরাধা এখন অনেকটা ভালো, হাসে, কথা বলে, এমনকি গভীর জঙ্গলে ছবি তুলতে যায় পবিত্রর সঙ্গে, কিন্তু মাঝেমধ্যে তার চোখে এক অচেনা বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে—যা পবিত্রকে ভাবায়। এক রাতে, যখন দু’জনে কটেজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, হঠাৎ অনুরাধা নিচু গলায় বলল, “তুমি কি জানো, আমি মাঝে মাঝে মনে করি আমি একা হাঁটছি… আর কেউ যেন পেছনে-পেছনে হেঁটে চলেছে… আমি ঘুরে তাকালে কেউ নেই, কিন্তু আমার পায়ের ছায়ার পাশে আরেকটা ছায়া লেগে থাকে।” পবিত্রর চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে জানত, এই অভিজ্ঞতা একরকম মানসিক অনুরণন হতে পারে, আবার হতে পারে আরও গভীর কিছু—চামেলির বিদায় হয়তো সম্পূর্ণ ছিল না, বরং ছায়া রয়ে গেছে, অন্য রূপে। সে বুঝল, শুধু শরীর উদ্ধার করলেই সম্পর্ক শেষ হয় না—অনুভূতির স্তরে সম্পর্ক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা থাকে। পরদিন সকালে সে অনুরাধাকে না জানিয়ে গেল সেই শাঁখ রাখা জায়গায়—এবার আর কোনো ছায়া বা শব্দ ছিল না, কিন্তু পাতার ফাঁকে সে খুঁজে পেল একটি পাথরে খোদাই করা নাম—“চা”। অর্ধেক লেখা, যেন সময় ধরে ফেলেনি পুরোটা। সে এবার নিশ্চিত—এই জায়গায় চামেলির আত্মা কোনও ছাপ রেখে গেছে।

হঠাৎ করেই শান্তিলাল খবর আনল—জলদাপাড়ার উত্তরের দিকে, বক্সা পাহাড়ের ধারঘেঁষা এক এলাকায় এক তরুণী হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছে, যাকে স্থানীয়রা শেষবার দেখেছিল সাদা সালোয়ার-কামিজ পরে একা হেঁটে যেতে। তার ফোন পাওয়া যায় এক গাছের গায়ে ঝোলানো অবস্থায়, যার স্ক্রিনে ক্যামেরা অন ছিল। শান্তিলাল পবিত্রকে ফোনে ডেকে বলল, “আপনি এসব বিষয়ে জানেন… আপনি যদি একবার গিয়ে দেখে দেন।” পবিত্র দ্বিধায় পড়ে গেল। সে অনুরাধার দিকে তাকাল—সে তখন বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিল, রঙে ভরে তুলছিল সাদা ক্যানভাস। তার কি এই নতুন ঘটনার কথা জানানো উচিত? নাকি সে নিজেই নিঃশব্দে যাবে? সে কিছু না বলেই চলল, স্থানীয় বনকর্মী জয়দীপের সঙ্গে। বক্সা পাহাড়ের সেই এলাকা আরও নিঃসঙ্গ, আরও নির্জন। পাহাড়ের গায়ে হালকা ধোঁয়ার রেখা, আর মাঝেমাঝে বাতাসে পাখির চিৎকার। তারা যেই জায়গায় পৌঁছাল, সেখানে দেখা গেল একটা মোবাইল পড়ে আছে, স্ক্রিনে ফ্রেমজমা একটি ভিডিও—ক্যামেরা ধরা এক তরুণী, হঠাৎ থমকে দাঁড়াচ্ছে, ক্যামেরা কেঁপে উঠছে, আর দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে একটা মুখ—আংশিক দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পবিত্র চিনে ফেলল—চামেলির ছায়া! তার গায়ের রঙ ঝাপসা, চোখজোড়া গভীর, কিন্তু এই প্রথমবার এত স্পষ্ট। পবিত্রর শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তাহলে কি চামেলি এখন নতুন কাউকে টার্গেট করছে? না কি সে কোনো বার্তা দিতে চাইছে? নাকি এই ছায়া চামেলির নয়, বরং তার উত্তরসূরী?

ফিরে এসে পবিত্র সব ঘটনা খুলে বলল অনুরাধাকে। অনুরাধা স্তব্ধ হয়ে শুনল, তারপর ধীরে বলল, “হয়তো চামেলি এখন চাইছে কেউ তার কথা শুনুক… আবারও। আমি তো বুঝেছিলাম, ও চলে গেছে। কিন্তু হয়তো না… ও থেকে যেতে পারে। কারণ তার গল্পটা অপূর্ণ।” পবিত্র কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে কী করব আমরা?” অনুরাধা একটুখানি হাসল, সেই চিরচেনা শিল্পীর চোখে আত্মবিশ্বাস—“আমরা লিখে ফেলি তার গল্প। ছবির ভাষায়, শব্দের ভাষায়, যেন তাকে কেউ না ভুলে যায়।” পবিত্র বুঝে গেল—এই ‘ডুয়ার্স ডায়রিজ’ কেবল একটি মধুচন্দ্রিমার স্মারক নয়, এটি হয়ে উঠবে এক যাত্রার দলিল—ভয়, ভালোবাসা আর ছায়ার সংলাপের দলিল। এরপর দু’জনে মিলে শুরু করল সেই কাজ—ক্যামেরা হাতে তারা খুঁজে নিল সেই সমস্ত জায়গা, যেখানে চামেলি তার ছায়া রেখে গেছে, গাছের গায়ে আঁচড়, পাথরে আঁকা নাম, বাতাসে ঝুলে থাকা ধূপের গন্ধ। তারা লিখতে লাগল—চামেলির না বলা কথা, অনুরাধার দেখা স্বপ্ন, আর পবিত্রর উপলব্ধি। আর সেই লেখার মাঝে বারবার ভেসে উঠল এক সাদা আঁচল, এক শূন্যতা, যা এখনও ঠিক অতীত নয়।

বর্ষার প্রথম বৃষ্টির মত শব্দে এক সকাল ঘুম ভাঙল পবিত্রর। জানালার কাঁচে জমেছে বিন্দু বিন্দু জল, দূরের জঙ্গলে রামগাঙার ডাক—সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতি এক নতুন অধ্যায়ের পাতায় কলম ছুঁইয়ে দিয়েছে। অনুরাধা সেই সকালে উঠে বসেছিল একেবারে নিরিবিলি কোণটায়, আঁকছিল একটা মুখ—অর্ধেক আলোয়, অর্ধেক ছায়ায়। পবিত্র পাশে গিয়ে বসতেই সে মুখ তুলে বলল, “চামেলিকে আমি এখন বুঝতে পারি… হয়তো আমি নিজেই একসময় এমনই ছায়ায় হারিয়ে যেতে চাইতাম।” কথাটা বলার সময় অনুরাধার চোখে কোনও ভয় ছিল না, ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি—এক আত্মার গল্প, যার ছায়া থেকে জন্ম নেয় নিজের উপলব্ধি। পবিত্র চুপচাপ শুনছিল, যেন গাছের পাতায় জলের ঝরনা শুনছে। সে টেবিলের ডায়েরিটা খুলে দেখাল, যেখানে চামেলির সম্পর্কে তারা যা যা জেনেছে, সব লিখে ফেলেছে—একটা অদ্ভুত, অসম্পূর্ণ কাহিনি, যার কোনও সরল শেষ নেই। কিন্তু তারই ভেতর, সেই পাতার ফাঁকে, আজ সকালে একটা কাগজ পাওয়া গেছে—কেউ রেখে গেছে হয়তো, কিংবা হাওয়ায় এসে আটকে গেছে। অনুরাধা তা তুলে পড়ে শোনাল: “আমি ফিরে যাইনি, আমি আছি। আলোয় নয়, ছায়ায়। তুমি আমাকে খুঁজো না—তবে ভুলেও যেও না। আমি ছিলাম, কারণ আমি ভালোবেসেছিলাম।” হাতের লেখা অপরিচিত, তবু যেন খুব চেনা। দু’জনের চোখে কেবল একটাই কথা—চামেলির বিদায় নয়, চামেলির উপস্থিতি।

সেইদিন বিকেলে তারা আবার গিয়েছিল বক্সার ধারঘেঁষা পথটিতে—যেখানে সেই তরুণী হারিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র ক্যামেরা হাতে, অনুরাধা কবিতার খাতা হাতে। বনের নিঃশব্দতা একটু একটু করে শব্দে ভরছিল—পাতার খসখস, শালগাছের ফাঁকে বাতাসের ছোঁয়া, আর দূর থেকে আসা নদীর কলতান। তারা দেখল, ঝোপের ভেতর ছোট্ট একটি পাথরের চাতালে আবার একটি শাড়ির টুকরো রাখা, সঙ্গে একটি সাদা ময়ূরের পালক। যেন কেউ তাদের অপেক্ষায় ছিল—হয়তো স্বয়ং চামেলি, হয়তো তার ছায়া। অনুরাধা পাথরের পাশে বসে নিজের কবিতার খাতা খুলে পড়ে শোনাতে লাগল—“তুমি যদি ছায়া হও, তবে আমি হব সূর্য, যতবার তুমি ফিরে তাকাও, ততবার তোমার পিছনে আলো পড়ুক। যদি তুমি জঙ্গলে হারিয়ে যাও, আমি হব পাতার শব্দ, যে তোমাকে ঠিক পথ দেখায়।” পবিত্র সেই মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখল—কিন্তু পর্দায় তখন আর অনুরাধা একা নয়। তার পেছনে ছায়ার মধ্যে এক নারীচেহারা—নির্জন, মৃদু হাসিমাখা, যেন সম্মতির ছায়া। ক্যামেরা ধরা বন্ধ করার আগেই সেই ছায়া মিলিয়ে গেল বাতাসে। অনুরাধা পিছনে ঘুরে তাকাল, বলল, “সে এসেছিল, তাই তো?” পবিত্র শুধু মাথা নাড়ল—এবার আর ভয় নয়, বরং শ্রদ্ধা।

তাদের “ডুয়ার্স ডায়রিজ” নামের বই তখন প্রায় শেষের পথে। ক্যামেরার ছবি, শব্দের নোট, স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মানবিক নথি—যেখানে অলৌকিককে ছুঁয়ে যায় ভালোবাসা, আর হারিয়ে যাওয়া মানেই বিস্মৃত নয়, বরং রয়ে যাওয়া এক অন্য স্তরে। বইয়ের শেষ অধ্যায়ের নাম রাখল—“আলোয় ছায়ার চিঠি”—কারণ তারা বিশ্বাস করে, চামেলি বেঁচে নেই ঠিকই, কিন্তু সে অস্তিত্ব হারায়নি, বরং রয়ে গেছে প্রতিটি বাতাসে, গাছের ফাটলে, আর তাদের হৃদয়ের ভাঁজে। এক সন্ধ্যায়, যখন বইয়ের প্রথম কপি ছাপা হয়ে তাদের হাতে এল, তখন হোমস্টের জানালার পাশে অনুরাধা বসে ছিল, তার চোখে শান্তি, ঠোঁটে মৃদু হাসি। পবিত্র কাছে গিয়ে বলল, “চামেলির গল্প শেষ হল না, কিন্তু আমরা তাকে জায়গা দিতে পেরেছি।” অনুরাধা বলল, “গল্পের কাজ তো সেটাই—হারিয়ে যাওয়া কথাকে বাঁচিয়ে রাখা।” আর সেই মুহূর্তে বাতাসে আবার এক ঝলক ধূপের গন্ধ এল—না প্রলয়ঙ্কর, না রহস্যময়—বরং যেন কোনও আত্মার বিদায়ের নম্র নিঃশ্বাস।

বই প্রকাশের পর ডুয়ার্সের শান্ত পল্লী থেকে শুরু করে কলকাতার ক্যাফেগুলোতেও ‘ডুয়ার্স ডায়রিজ’ নিয়ে চর্চা শুরু হয়। কেউ বলছে এটা অলৌকিক অভিজ্ঞতার ডকুমেন্টেশন, কেউ বলছে একধরনের ‘থেরাপিউটিক ট্রাভেল মেমোয়ার’। কিন্তু পবিত্র জানত, বইটি এক আত্মার গোপন অভিমানের দলিল, এক নারীর না বলা বেদনার সাক্ষ্য। একদিন এক ইমেইল আসে—বিষয়: “আমি চামেলিকে চিনি”। লেখক নিজেকে পরিচয় দেয় বনকর্মী দীপক রায়ের নাতনি হিসেবে, আর লেখে যে তার দাদুর মৃত্যুর পর সে পেয়েছে কিছু নোট, যেখানে চামেলির নাম, বনের মানচিত্র, আর কিছু অসমাপ্ত লাইন ছিল—“ও চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি বুঝিনি… আমি ভয় পেয়েছিলাম।” ইমেইলের সঙ্গে ছিল একটি ছবি—এক হাতে আঁকা চিত্র, যেখানে এক নারী হাঁটছে বনপথে, পেছনে তার ছায়া একটু একটু করে ঝরে যাচ্ছে পাতার মতো। অনুরাধা সে চিত্র দেখে নির্বাক হয়ে যায়—ঠিক এমনই ছবি সে একবার নিজের ডায়েরিতে এঁকেছিল, কিন্তু সেটা কাউকে দেখায়নি। দু’জনে এবার স্থির করল—চামেলির পুরো জীবন নিয়ে একটি প্রদর্শনী করা হবে, নাম রাখা হবে “অরণ্যের অন্তর্বাণী”—একটি নীরব আত্মার চিৎকার, যা গাছেরা শুনেছিল, আর বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছিল।

প্রদর্শনীর জন্য তারা গেছিল চিলাপাতার প্রান্তবর্তী এক হোমস্টেতে, যেখানে একসময় চামেলি ও দীপক থাকতেন অস্থায়ী ভাবে—সেখানে এখনও একটি পুরনো কাঠের কুঠুরিতে পাওয়া গেল কিছু ধুলো মাখা চিঠি, যার কিছু পঁচে গেলেও কয়েকটি এখনো পড়ার উপযোগী। এক চিঠিতে চামেলি লিখেছিল, “তাকে বলো, আমি কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নই, আমি শুধু নিজের খাঁচা থেকে বেরোতে চেয়েছিলাম।” এই লাইন অনুরাধার চোখে জল এনে দিল। সে পবিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “চামেলি ছিল তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে, কিন্তু সময়ই তাকে ভুল বুঝেছিল।” প্রদর্শনীর দিন চিলাপাতার এক পুরনো চা-বাগানে মঞ্চ বানানো হল, পেছনে বড় পর্দায় চলছিল চামেলির ছবি ও পবিত্রর ক্যামেরায় ধরা সেই রহস্যময় ছায়া। অনুরাধা পড়ছিল তার লেখা কবিতা, আর চারপাশে বসা মানুষজন নিঃশব্দে শুনছিল। হঠাৎ এক বৃদ্ধা দর্শক উঠে এসে বললেন, “আমি চামেলিকে দেখেছি, অনেক বছর আগে… সে আমার কাছে এসে বলেছিল, ‘দিদি, যদি কেউ হারিয়ে যায়, তাকে খোঁজো না—সে যদি ভালোবাসে, সে নিজে ফিরে আসবে।’ আমি ভেবেছিলাম পাগল… কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, সে ছিল সবচেয়ে সত্যি মানুষ।”

প্রদর্শনীর পর রাতে, তারা দু’জনে হোমস্টের উঠানে বসে চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা গাছগুলো দেখছিল। বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ—না ভয়াবহ, না রহস্যময়, বরং শান্ত। অনুরাধা বলল, “আমরা কি এবার ফিরে যাব?” পবিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল, “চলে তো যাব, কিন্তু একটুকরো আমরাই এখানে রেখে যাব।” অনুরাধা তার হাতে হাত রেখে বলল, “চামেলি এখন শান্তিতে আছে, তাই আমরা ফিরছি শান্তি নিয়ে।” তখনই দূরে, গাছের ছায়ায়, যেন একটা আলো ফুটে উঠল—ছায়া আর আলো মিশে এক নারীমূর্তি গঠন করল, তারপর ধীরে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের পাতার ভাঁজে। পবিত্র ক্যামেরা তোলার কথা ভাবলেও এবার সে কিছুই করল না—কারণ সে জানত, এই মুহূর্ত ধারণযোগ্য নয়, বরং বোধযোগ্য। চামেলি এবার সত্যি চলে গেল—কোনও অপরাধ, আক্ষেপ, বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই। আর তারা—পবিত্র ও অনুরাধা—রয়ে গেল চিরকালীন সেই যাত্রার সাক্ষী হয়ে, যেখান থেকে কেউ হারিয়ে গেলেও তার ছায়া থেকে যায়, পেছনে রেখে যায় এক অন্তর্বাণী।

১০

ডুয়ার্সে কাটানো দিনগুলো যেন এখন এক কুয়াশাভেজা ফিল্মের মত মনে হচ্ছিল—ছায়া, আলো, শব্দ আর নিস্তব্ধতার মিশেল। ফিরে যাওয়ার আগের দিন সকালে পবিত্র আর অনুরাধা গিয়েছিল বক্সা পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা একটি ছোট গ্রামে—তাদের সফরের শেষ গন্তব্য, যেন পাহাড়ের বুক থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি। গ্রামের একপ্রান্তে ছিল একটি ছোট্ট বিহার, যেখানে এক বৃদ্ধ ভিক্ষু বসে ছিলেন পাথরের ধ্যানমূর্তি হয়ে। অনুরাধা তার কাছে গিয়ে চুপ করে বসে পড়ে, আর পবিত্র পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে নীল রঙ আর কুয়াশার পর্দা মিলে এক অপার্থিব দৃশ্য তৈরি করেছে। ভিক্ষু হঠাৎ মুখ খুললেন, “তোমাদের চোখে কিছু ক্লান্তি আছে, কিন্তু সেই ক্লান্তি ভয় নয়, বরং বোঝার চেষ্টা। সেই বোঝা নিয়েই পাহাড় থেকে নামতে হয়। পাহাড় কাউকে ধরে রাখে না।” অনুরাধা তার হাত জোড় করে বলল, “আমরা একটা আত্মাকে বিদায় জানিয়েছি, যার গল্প আজও বাতাসে বেঁচে আছে।” ভিক্ষু মৃদু হেসে বললেন, “তাহলে সেই আত্মাও নিশ্চয় তোমাদের ভিতরে কিছু রেখে গেছে—একটা আলো।” সেই আলো নিয়েই তারা শেষবারের মতো হাঁটল বনের ভেতর দিয়ে, একটানা সেই পথ যেখান দিয়ে একদিন চামেলি হেঁটে গিয়েছিল। এবার আর ভয় ছিল না—ছিল শুধুই স্বীকারোক্তির একরাশ নীরবতা।

ফেরার দিন সকালটা ছিল অপার্থিব। সূর্য উঠছিল ধীরে ধীরে, আর অনুরাধা প্যাকিংয়ের ফাঁকে পবিত্রকে একটা পেইন্টিং দেখাল—তাদের যাত্রার শেষ ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে একটি নারীছায়া জঙ্গলের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক জোড়া মানুষ হাত ধরাধরি করে তাকিয়ে আছে তার দিকে—না কান্নায়, না বিস্ময়ে, শুধু শ্রদ্ধায়। পবিত্র ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এটাকে কী নাম দিলে?” অনুরাধা হাসল, “বিদায় নয়… অনুমতি।” পবিত্র তখন জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল এক সাদা পালক উড়ে যাচ্ছে বাতাসে—শেষবারের মতো। গাড়ি ছুটে চলল বাগানের ধারে, যেখানে চা-পাতা এখনও জেগে, আর শিশির ভেজা মাটি থেকে উঠছে সেই চিরচেনা বনগন্ধ। অনুরাধা গাড়ির কাঁচে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল, আর বলল, “তুমি জানো, আমরা যদি না আসতাম, চামেলি হয়তো আজও কথা বলার কেউ পেত না। আমাদের শোনা, আমাদের বোঝা, সেটাই ছিল তার মুক্তি।” পবিত্র হাত ধরে বলল, “আর তোমার ফিরে আসাও ছিল আমার মুক্তি। আমরা শুধু পর্যটক ছিলাম না—আমরা ছিলাম সাক্ষী।” দূরে, পাহাড়ের ঢালে এক ঝাঁক বুনো হাতি চলছিল ধীরগতিতে—তাদেরও মনে হচ্ছিল যেন কেউ বলছে, “বিদায়… দেখা হবে, হয়তো অন্য এক ছায়ায়।”

স্টেশন যখন কাছে এল, তখন মনটা ভারী হয়ে উঠছিল, কিন্তু দুঃখ নয়—এক রকম শান্তি ঘিরে ছিল দু’জনকে। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে, পবিত্র ব্যাগ থেকে বের করল “ডুয়ার্স ডায়রিজ”-এর একটি স্বাক্ষরিত কপি। কভার পাতায় অনুরাধার আঁকা সেই ছায়াচিত্র, আর পেছনের পাতায় লেখা: “চামেলি রায়—এক নারীর গল্প, যে হারিয়ে গিয়ে আমাদের খুঁজে পেল।” পবিত্র বইটা তুলে রাখল সেই স্টেশনের অপেক্ষাকৃত পুরনো একটা বেঞ্চে—যেখানে হয়তো কেউ বসবে, হাতে তুলে নেবে, আর পড়ে যাবে সেই জঙ্গলের গল্পে, যেখানে ছায়ারা শুধু ভয় দেখায় না, তারা কথা বলে, ভালোবাসে, আর সময় হলে বিদায় জানায়। ট্রেন চলতে শুরু করল, অনুরাধা কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল—একটা ছোট্ট মেয়ে কৌতূহলী চোখে বইটা তুলে নিচ্ছে। আর পেছনে, গাছের ছায়ায়, কুয়াশার ঘোমটা সরিয়ে যেন কেউ একটুখানি হাসল—সেই হাসি কোনো আত্মার, না ভালোবাসার—সে ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু জানালার কাচে তখন দু’টি ছায়া স্পষ্ট—পবিত্র আর অনুরাধা, আর মাঝখানে একটুকরো শূন্যতা… যাকে ভরিয়ে দিল এক নিঃশব্দ বিদায়।

সমাপ্ত

1000041959.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *