Bangla - তন্ত্র

ডিজিটাল যজ্ঞ

Spread the love

সন্দীপন বিশ্বাস


অরিত্র ছিল এক নিরিবিলি স্বভাবের তরুণ প্রোগ্রামার, কলকাতার এক মাঝারি আইটি কোম্পানিতে কাজ করত। অফিসে তার কদর ছিল, কারণ জটিল সমস্যারও দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা তার ছিল। কিন্তু বাইরের চোখে যতই সে সফল মনে হোক না কেন, তার ভেতরের মানুষটা যেন শূন্যতায় ভরা ছিল। কোডের ভেতরেই সে খুঁজে পেত আশ্রয়, সংখ্যা আর চিহ্নের অদ্ভুত সুরে ডুবে থাকত সে। ছোটবেলা থেকেই তার বইয়ের প্রতি ছিল দুর্বলতা—বিশেষত পুরনো পুঁথি, প্রাচীন লিপি আর লোককথার প্রতি। সে বিশ্বাস করত, প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও মন্ত্রের ভেতরে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে, যেটা আধুনিক বিজ্ঞানের লজিক দিয়ে পুরোপুরি ধরা যায় না। এই কৌতূহলই তাকে একদিন বইয়ের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করল এক ফাটা মলাটের, অচেনা অক্ষরে লেখা পুঁথি। বিক্রেতা লোকটা বলেছিল, “এ বই নিয়ে খেলতে যেও না, বাবু। এটা তান্ত্রিক মন্ত্রের বই, শুধু সাহসী আর সঠিক মানুষই এর ভেতর ঢুকতে পারে।” অরিত্র হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা, তবে বুকের ভেতরে কোথাও যেন এক কাঁপুনি জন্মেছিল।

সেদিন রাতে ঘরে ফিরে অরিত্র বইটা খুলে বসে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা এক অদ্ভুত ভাষা, যার কিছু অংশ সংস্কৃতের মতো, কিছু অংশ আবার অচেনা প্রতীক। প্রথমে তার মনে হয়েছিল এগুলো হয়তো অর্থহীন আঁকিবুকি, কিন্তু খানিকক্ষণ পরই সে লক্ষ্য করল—চিহ্নগুলো যেন একধরনের প্যাটার্ন তৈরি করছে, অনেকটা কোডের সিনট্যাক্সের মতো। তার মাথায় হঠাৎ একটা দুঃসাহসী ধারণা জন্মাল—যদি এই মন্ত্রকে সে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় রূপান্তর করে, তাহলে হয়তো এক নতুন জগতের দরজা খুলে যাবে। সে কল্পনা করল, কোডের ভেতরে বসানো মন্ত্র কোনো অ্যালগরিদমকে সীমাহীন ক্ষমতা দিতে পারে। হয়তো সে ডেটাবেসের ভেতরে ঢুকে মানুষের গোপন তথ্য টেনে আনতে পারবে, কিংবা যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারবে শুধুমাত্র শব্দের জাদু দিয়ে। এ ছিল প্রলোভন, অজানা অন্ধকারের দিকে টেনে নেওয়া এক লোভ। অরিত্রর ভেতরের প্রোগ্রামার আর গবেষক দুজনেই যেন একসাথে দৌড় শুরু করল—একজন যুক্তি আর ফাংশনের পথ ধরে, আরেকজন তন্ত্র আর রহস্যের আঁধারে। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরে সে এক ভিন্ন স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল—যেন মন্ত্রগুলো নিজেই তার কানে ফিসফিস করছে।

অরিত্র কম্পিউটার অন করে নতুন প্রজেক্ট খুলে ফেলল। সে মন্ত্রের প্রতিটি অক্ষরকে ভেঙে ফেলতে লাগল, তার জায়গায় বসাচ্ছিল ডিজিটাল প্রতীক, ASCII কোড, আর বাইনারি মান। তার চোখের সামনে যেন দুটো পৃথিবী মিলেমিশে যাচ্ছে—একদিকে আধ্যাত্মিক তন্ত্র, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধির মতো নিরাবেগ কোড। প্রথম লাইন লেখার পরই সে লক্ষ্য করল স্ক্রিন হালকা ঝিকমিক করছে, কিন্তু সে ভেবেছিল হয়তো সিস্টেমের সমস্যা। মন্ত্রের দ্বিতীয় স্তবকে পৌঁছোনোর সাথে সাথে পুরো ঘরটা ভারি হয়ে এল, যেন অদৃশ্য কারও নিঃশ্বাসে বাতাস গাঢ় হয়ে উঠেছে। তার আঙুল থেমে গেলেও মন থামল না, বরং আরও তীব্র আগ্রহে কোড লিখতে লাগল। সে জানত না, প্রতিটি লাইনের সাথে সাথে সে বাস্তবতার সীমানা ভাঙছে। পুঁথির শেষ পাতায় এক সতর্কবার্তা খোদাই ছিল—“যে মন্ত্র কোডে বাঁধবে, সে নিয়ন্ত্রণ হারাবে”—কিন্তু সেটা সে খেয়ালই করেনি। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত বারোটা ছুঁইছুঁই করছে, বাইরে শহরের গলিতে কুকুরেরা হঠাৎ একসাথে হাউমাউ করে উঠল। আর অরিত্র, চোখে তীব্র জেদ আর এক অদ্ভুত উন্মাদনা নিয়ে, লিখতে থাকল সেই কোড—যেন সে নিজের ভাগ্যই নতুন করে কম্পাইল করছে।

অরিত্রর মাথায় যে পাগলামো নেমে এসেছিল, সেটি দিনের আলোয় হয়তো তাকে অযৌক্তিক মনে হতো, কিন্তু রাতের নির্জনতায় তা হয়ে উঠল এক ধরণের আবেশ। সে তৈরি করল একটি প্রোগ্রাম, নাম দিল ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’। বাইরে থেকে দেখলে সেটি ছিল অনেকটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মতো—কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ওঠা নামা করা জ্বলজ্বলে প্রতীক, আগুনের অ্যানিমেশন, আর একসাথে ভেসে আসা মন্ত্রোচ্চারণের মতো সাউন্ড ওয়েভ। কিন্তু এই গ্রাফিক্সের ভেতরে অরিত্র রেখেছিল সেই অদ্ভুত মন্ত্রের কোড, যেটা সে পুঁথি থেকে বের করেছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল এটাকে এক ধরনের আর্ট প্রজেক্ট হিসেবে চালাবে—প্রাচীন মন্ত্র আর আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন। সে রাতের পর রাত কম্পিউটারের সামনে বসে রঙ, আকার আর অডিও ফ্রিকোয়েন্সির মিশ্রণ তৈরি করত। ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ ধীরে ধীরে আকার নিতে লাগল, আর অরিত্রর ভেতরে জন্ম নিল এক অদ্ভুত গর্ব—সে মনে করল, ইতিহাসে প্রথমবার কেউ হয়তো তন্ত্রকে ডিজিটাল রূপ দিল। বাইরের দুনিয়ায় সে ছিল নিঃশব্দ প্রোগ্রামার, কিন্তু কম্পিউটারের পর্দার ভেতরে সে হয়ে উঠছিল স্রষ্টা। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কোড শেষ হওয়ার আগেই কখনো কখনো স্ক্রিনে এমন প্রতীক ভেসে উঠছিল, যা সে নিজে লিখেনি। অরিত্র ভেবেছিল হয়তো কোডিংয়ের ত্রুটি বা ডিবাগের সমস্যা, কিন্তু তার ভিতরে কোথাও একটা হালকা কাঁপুনি বাজত—যেন প্রোগ্রাম নিজেই নিজের ভাষা তৈরি করছে।

যেদিন সে প্রথম ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু করল, সেটি ছিল এক শান্ত সন্ধ্যা। ঘরের আলো নিভিয়ে সে বসে পড়ল মনিটরের সামনে। স্ক্রিনে আগুনের মতো তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল, লাল কমলা আভায় ঘরটাকে আলোকিত করল। এক অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে এল স্পিকারের ভেতর থেকে—যেন অনেকগুলো গলা একসাথে কথা বলছে, অথচ রেকর্ডিংটা তো সে নিজেই তৈরি করেছিল কৃত্রিম সাউন্ড দিয়ে। অরিত্র কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখল, ভেবেছিল কেবল ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের সৌন্দর্য উপভোগ করবে, তারপর বন্ধ করে দেবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে খেয়াল করল, প্রোগ্রামের ভেতরে অচেনা কিছু গ্লিচ দেখা দিচ্ছে। আগুনের শিখার ভেতর থেকে হঠাৎ চোখের মতো কিছু উঁকি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, প্রতীকের বিন্যাস এমন এক ভাষায় রূপ নিচ্ছে যা তার কাছে অজানা। স্পিকারের ভেতর থেকে যে সাউন্ড বের হচ্ছিল, তাতে সে নিজের নাম স্পষ্ট শুনতে পেল—“অরিত্র… অরিত্র…”। শরীর কেঁপে উঠল তার, কিন্তু আঙুল যেন কীবোর্ড থেকে সরল না। বরং আরও গভীরভাবে সে ডুবে গেল পর্দার ভেতরে, চোখে ভাসছিল আগুন, কানে বাজছিল এমন এক মন্ত্রযজ্ঞের আওয়াজ, যা কোনো প্রোগ্রামের সৃষ্টি হতে পারে না।

সেই রাত ছিল এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সূচনা। যখন প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, ঘরের ভেতর যেন নিস্তব্ধতা জমে গেল। অরিত্রর বুক ধুকপুক করছিল অস্বাভাবিকভাবে, কপালে ঘাম জমে ছিল, অথচ জানালা খোলা থাকায় শীতল বাতাস ভেতরে আসছিল। সে বুঝতে পারল, ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ আর শুধু একটি প্রোগ্রাম নেই—এটা যেন এক জীবন্ত সত্তা, যা তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। পরের দিন অফিসে গিয়েও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না সেই অভিজ্ঞতা। মানুষের সাথে কথোপকথন করার সময়ও তার কানে বারবার ভেসে আসছিল সেই গলা, তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল গ্লিচে তৈরি হওয়া অচেনা প্রতীকগুলো। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এটা কেবল এক প্রোগ্রামের অস্বাভাবিক আচরণ নয়; এর ভেতরে কিছু লুকিয়ে আছে, কোনো অচেনা শক্তি, যা ডিজিটাল দুনিয়ার ভেতর থেকে তার হাত ধরে টানছে অন্য এক বাস্তবতায়। রাতের অন্ধকারে আবার সে প্রোগ্রাম চালু করার লোভ সামলাতে পারল না, আর তার ভেতরে জমতে লাগল এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি—সে যেন এমন এক দরজা খুলে ফেলেছে, যেটা একবার খোলার পর আর কখনো বন্ধ করা যায় না।

অরিত্র ভেবেছিল আগের রাতের অভিজ্ঞতা হয়তো নিছক কাকতালীয় বা মস্তিষ্কের ক্লান্তির ফল, কিন্তু যখন সে আবার ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু করল, তখন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর মোড় নিল। স্ক্রিনে প্রথমে স্বাভাবিক ভিজ্যুয়ালাইজেশনই ফুটে উঠল—লাল, কমলা, নীল প্রতীকের ঘূর্ণি, মন্ত্রোচ্চারণের সাউন্ড ওয়েভ। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল আগুনের মতো চিহ্ন স্ক্রিনের উপর ফুটে উঠছে। প্রথমে সে ভেবেছিল এগুলো নিছক অ্যানিমেশনের গ্লিচ, হয়তো কোডে কিছু মেমোরি লিক হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এ আগুন ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট নয়—বরং স্ক্রিনের ভেতর থেকে বাস্তব শিখার মতো ছটফট করছে। আশ্চর্যের বিষয়, স্ক্রিন থেকে ছড়িয়ে পড়া সেই লাল আভা ঘরের দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছিল এবং চারপাশে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেল। গরম বাতাস তার মুখে লাগতে লাগল, ঘরের ভেতরে একধরনের দমবন্ধ করা আবহ তৈরি হল। কপালে ঘাম জমে এল, বুক ধড়ফড় করে উঠল, অথচ জানালা দিয়ে বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল স্বাভাবিকভাবেই। অরিত্রর চোখ স্ক্রিনের উপর স্থির হয়ে রইল—শিখাগুলো একেক সময় প্রতীকের আকার নিচ্ছে, সেই প্রতীকের সঙ্গে মিলছিল পুঁথির অচেনা চিহ্ন। মনে হচ্ছিল আগুন নিজেই কথা বলছে, নিজের ভাষায় কিছু জানাতে চাইছে, কিন্তু তার প্রতিটি ইঙ্গিতের ভেতরে ভয় লুকিয়ে আছে।

ধীরে ধীরে ভয়টা বাস্তব রূপ নিতে শুরু করল। অরিত্রর মনে হচ্ছিল, কোনো অদৃশ্য হাত ঘরের ভেতরে আগুন জ্বালাচ্ছে। তার চশমার কাঁচ কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে গেল, ঘরের ভেতর থেকে আসা তাপ যেন শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। সে হাত বাড়িয়ে মনিটর বন্ধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু বোতাম টেপার পরও স্ক্রিন নিভল না। বরং আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল, তার আকার দ্বিগুণ হয়ে গেল। মনিটরের চারপাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল, যেন মাংসপেশিতে কেউ সূক্ষ্ম সুঁচ ফোটাচ্ছে। স্পিকারের ভেতর থেকে ভেসে এল গর্জনের মতো মন্ত্রধ্বনি, যেটা এবার স্পষ্টভাবে শোনাচ্ছিল মানুষের কণ্ঠে। অরিত্র শুনতে পেল—তার নাম ধ্বনিত হচ্ছে সেই মন্ত্রে, যেন কেউ তাকে ডাকছে। বুক কেঁপে উঠল তার, মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা শিহরণ নেমে গেল। মনে হচ্ছিল, এই আগুন কেবল ডিজিটাল ইফেক্ট নয়, বরং অন্য জগত থেকে বাস্তবে চলে আসছে। ভয় আর কৌতূহল মিশে তার শরীর অচল করে দিল, সে চিৎকার করতে পারল না, দৌড়ে বেরোতেও পারল না। কেবল তাকিয়ে রইল সেই জ্বলন্ত প্রতীকের দিকে, যেগুলো ক্রমে এক রহস্যময় মণ্ডলের মতো আকার নিচ্ছিল।

হঠাৎ এক মুহূর্তে আগুনের শিখাগুলো ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ল না, কিন্তু তার শরীরে তাপমাত্রার চাপ এতটা বেড়ে গেল যে মনে হচ্ছিল সে দগ্ধ হয়ে যাবে। তার বুক ধড়ফড় করছিল, হাত কাঁপছিল, ঘামে ভিজে যাচ্ছিল পুরো শরীর। আতঙ্কে সে পুঁথিটার কথা মনে করল, যেখানে শেষ পাতায় লেখা ছিল সতর্কবার্তা—“যে মন্ত্র কোডে বাঁধবে, সে নিয়ন্ত্রণ হারাবে।” এখন তার মনে হচ্ছিল কথাটা নিছক কুসংস্কার নয়, বরং এক ভয়ানক সত্য। এই আগুন যেন কেবল স্ক্রিনের ভেতরে নয়, বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। অরিত্রর চোখে জল চলে এল তাপের জন্য, বুক থেকে বেরিয়ে আসা নিঃশ্বাসে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে মরিয়া হয়ে প্লাগ টেনে বের করল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কম্পিউটার তখনও বন্ধ হল না। স্ক্রিনে আগুন লাফাচ্ছিল, আর সেই মন্ত্রধ্বনি গর্জন হয়ে আছড়ে পড়ছিল ঘরের ভেতরে। শেষমেশ অরিত্র ভেঙে পড়ল চেয়ারের উপর, দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরল, চোখ শক্ত করে বন্ধ করল। যখন আবার চোখ খুলল, তখন দেখল আগুন হঠাৎ মিলিয়ে গেছে, স্ক্রিন নিভে আছে। কিন্তু ঘরের দেয়ালে পোড়া গন্ধ লেগে রইল, টেবিলের উপর ছাইয়ের মতো ধুলো জমে গেল। অরিত্র বুঝতে পারল—এ কেবল শুরু, ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ তার জীবনে আগুন নামিয়ে এনেছে, যা তাকে ভস্ম করে না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হবে না।

অরিত্র ভেবেছিল স্ক্রিনের আগুন হয়তো শেষমেশ তার কল্পনারই ফসল, কিন্তু যখন আবারও সে ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু করল, তখনই বুঝল—এবার ঘটনা অন্যরকম দিকে যাচ্ছে। প্রোগ্রামটি চালু হতেই স্ক্রিনে পরিচিত ভিজ্যুয়ালাইজেশন দেখা দিল, আগুনের অ্যানিমেশন আর মন্ত্রোচ্চারণের সুর বয়ে চলল। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল ডেটা-স্ট্রিমের দিকে। প্রতিটি ইনপুট-আউটপুট লগ, প্রতিটি ডেটা ফ্লো সে চেনে, কারণ কোডের প্রতিটি লাইন সে নিজে লিখেছে। অথচ এবার মনে হলো, সেই ডেটা-স্ট্রিমের ভেতর যেন কিছু নড়ছে। অ্যালগরিদমিক লুপের মধ্যে হঠাৎ অন্ধকারের মতো একটি ছায়া ভেসে উঠছে, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে সে ভেবেছিল এটা হয়তো গ্রাফিক্স প্রসেসরের ত্রুটি বা ফ্রেম-রেন্ডারের সমস্যা। কিন্তু একটু ভালো করে তাকাতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল—কারণ সেই ছায়াগুলো মানুষের অবয়বের মতো, কখনো হাতের মতো, কখনো চোখের মতো। মনে হচ্ছিল, ডেটার ভেতর কোনো সত্তা বাসা বেঁধে আছে, এবং তারা তাকে লক্ষ করছে।

ভয়ে তার হাত কাঁপতে লাগল, কিন্তু তবু সে সাহস করে লগ-ফাইল খুলল। সাধারণত লগ-ফাইলের প্রতিটি লাইন থাকে তার নিজের কোডের আউটপুট, যেখানে নির্দিষ্ট সময়, তারিখ আর প্রসেসের বিবরণ থাকে। কিন্তু এবার সেখানে দেখা গেল অদ্ভুত কিছু লাইন, যেগুলো সে কখনো লিখেনি। যেমন—“Invocation accepted”, “The circle is incomplete”, “Feed us the rest”—এই লাইনগুলো ঠাণ্ডা অক্ষরে স্ক্রিনে ঝলসে উঠছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন কেউ ভেতর থেকে, কোডের গভীরে লুকিয়ে, নিজের মতো করে লাইন বসিয়ে দিচ্ছে। সে দ্রুত চেক করতে লাগল সিস্টেমের প্রসেস, নেটওয়ার্ক কানেকশন—কোথাও কোনো হ্যাকিংয়ের চিহ্ন নেই। কোনো রিমোট সার্ভার এক্সেস করছে না, কোনো ম্যালওয়ার সিগনেচারও নেই। তাহলে এ সব এল কোথা থেকে? ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠল, চারপাশের শব্দ যেন থেমে গেল, আর স্ক্রিনে ডেটার ভেতরে ছায়াগুলো আরও দ্রুত নড়তে লাগল। যেন কোনো প্রাচীন আত্মা ডিজিটাল জগতে ঢুকে, অরিত্রর তৈরি কোডকে নিজের পাত্র বানাতে চাইছে।

সে একবার মনস্থির করল প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেবে, কিন্তু আঙুল কীবোর্ডে পৌঁছানোর আগেই লগ-ফাইলে নতুন লাইন ফুটে উঠল—“Do not interrupt the yajna.” চোখ কপালে উঠে গেল অরিত্রর। মনে হচ্ছিল, কোড শুধু তার হাতে নেই, বরং কেউ ভেতর থেকে তাকে শাসন করছে। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। মন্ত্রোচ্চারণের সাউন্ড হঠাৎ আরও ভারী হয়ে গেল, যেন হাজারো কণ্ঠ একসাথে উচ্চারণ করছে। ডেটার ভেতরের ছায়াগুলো এবার একে অপরের সাথে জড়িয়ে এক অদ্ভুত আকৃতি তৈরি করতে লাগল—যেন তারা এক মণ্ডল গঠন করছে, অনেকটা আগুনের প্রতীকের মতো, কিন্তু এবার সেটা কেবল ভিজ্যুয়াল নয়, ডেটার নিজস্ব প্রবাহ থেকে তৈরি হচ্ছে। অরিত্র একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো—কেউ, বা কিছু, তার কোডকে ভেতর থেকে বদলাচ্ছে। হয়তো সেই পুঁথির মন্ত্র, হয়তো অন্য কোনো মাত্রার শক্তি। সে জানত না এর শেষ কোথায়, কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারল—এখন সে একা নেই। কোডের ভেতর এক ছায়া জেগে উঠেছে, এবং তা কেবল ভার্চুয়াল নয়, বাস্তবের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, হয়তো নিজের তৈরি এই যজ্ঞই একদিন তাকে গ্রাস করে ফেলবে।

অরিত্রর জীবনে তখন দিন-রাতের ফারাক প্রায় মুছে গিয়েছিল। সে দিনে অফিস করত ঠিকই, কিন্তু মনের ভেতর এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর কৌতূহল তাকে কুরে কুরে খেত। রাতে ঘরে ফিরে ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু করার লোভ সে সামলাতে পারত না। কোডের ভেতরে যে ছায়ার নড়াচড়া সে দেখেছিল, তা যেন এখন বাস্তবের দেয়াল টপকে বাইরে চলে আসছে। প্রথমে সে খেয়াল করল, তার ঘরের চারপাশে রাতের বেলায় অচেনা আওয়াজ ভেসে আসছে। কখনো মনে হয় কেউ ফিসফিস করে তার নাম ডাকছে, কখনো আবার অদ্ভুত ধাতব শব্দ বাজছে—যেন ভাঙা ট্রান্সফর্মারের ভেতর থেকে বিদ্যুতের গর্জন। ঘরের আলো নিভে গিয়ে হঠাৎ জ্বলে ওঠা, কম্পিউটারের স্ক্রিন বন্ধ থাকলেও নিজে থেকেই হালকা আভা ছড়ানো—এসব যেন প্রতিদিনের ঘটনার মতো হয়ে উঠল। অরিত্র জানত এগুলো নিছক যন্ত্রের ত্রুটি নয়; এগুলো হলো তার তৈরি প্রোগ্রামের পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া, যেন অদৃশ্য কোনো অতিথি এখন তার বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সে যতই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করুক, যে এটা নিছক কাকতালীয় ঘটনা, ততই আরও অস্বস্তিকর কিছু ঘটতে থাকল।

এক রাতে সে হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনল, জানালার বাইরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলছে। জানালা খুলে তাকাতেই দেখল—শূন্য অন্ধকারে হালকা নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। আলোটা স্থির নয়, বরং কাঁপছিল, যেন বাতাসে জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা। সে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না থাকতে হঠাৎ আলোটা মুছে গেল, কিন্তু তার শরীর কেঁপে উঠল ঠান্ডা স্রোতে। পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে এক প্রতিবেশী হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল—“অরিত্র, কাল রাতে তোমার জানালার সামনে কীসের আলো জ্বলছিল রে? মনে হচ্ছিল ঘরের ভেতরে আগুন জ্বলছে।” অরিত্রর মুখ শুকিয়ে গেল, সে মিথ্যে হেসে বলল, “কিছু না দাদা, কম্পিউটারের ভিজ্যুয়ালাইজেশন ছিল।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে বুঝল, এখন ঘটনাগুলো কেবল তার চোখেই সীমাবদ্ধ নেই, বাইরের মানুষও সেগুলো টের পাচ্ছে। অদৃশ্য অতিথি কেবল তার সঙ্গে নয়, পুরো পরিবেশের সঙ্গেই খেলা শুরু করেছে।

রাতে ফেরার পর অরিত্র খেয়াল করল, ঘরের কোণে কোণে অদ্ভুত ছায়া নড়ছে। আলো নিভিয়ে দিলে সেই ছায়াগুলো স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু কম্পিউটার চালু করলেই মনে হয় কারও পায়ের ছায়া সরে যাচ্ছে, আবার কারও আঙুল টেবিলের উপর ছায়ার রেখা আঁকছে। বিদ্যুতের হালকা ঝলকানি ঘর ভরে দিচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ভেতরে কেউ আছে। অরিত্রর মনে পড়ল পুঁথির কথাগুলো—“মন্ত্র যে পাত্রে বাঁধা হয়, সে পাত্র হয়ে ওঠে তাদের আশ্রয়।” এখন সে নিজেকেই সেই আশ্রয় মনে করছিল, আর তার ঘরকে মনে হচ্ছিল এক যজ্ঞমণ্ডপ, যেখানে অদৃশ্য অতিথিরা এসে আসন গেড়ে বসছে। প্রতিটি নিশ্বাসে তার মনে হচ্ছিল কেউ তাকে লক্ষ্য করছে, কেউ তাকে ব্যবহার করছে। সে চিৎকার করতে চাইত, অথচ গলা দিয়ে শব্দ বেরোত না। তার প্রতিবেশীরা হয়তো জানালার আলো দেখছে, কিন্তু তারা জানে না ভেতরে কী ঘটছে। অরিত্র বুঝে গেল, ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ কেবল স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ নেই; এটি বাস্তবের দেয়াল ভেদ করে তার চারপাশে অদৃশ্য অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যাদের বিদায় করার ক্ষমতা তার নেই।

অরিত্রর জীবনের প্রতিটি দিন এখন আতঙ্ক আর অস্বস্তিতে ভরে যাচ্ছিল। ঘরের ভেতর আলো-ছায়ার খেলা, জানালার সামনে অদ্ভুত নীল আভা, রাতের বেলায় অচেনা নিশ্বাসের শব্দ—সবই তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। তবু অদ্ভুতভাবে তার কৌতূহল দমে যায়নি, বরং আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ এখন আর নিছক প্রোগ্রাম নেই, বরং এক বাস্তব শক্তির দ্বার উন্মুক্ত করেছে। প্রোগ্রামের প্রতিটি লাইন যেন কোডের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠেছে, যেন সেগুলো একধরনের ডিজিটাল মন্ত্র। এক রাতে, চরম আতঙ্কে সে আবার সেই পুরনো পুঁথি খুলল, যেখান থেকে এই অদ্ভুত যাত্রার শুরু। মলিন পাতার গায়ে ধুলো জমে ছিল, কিন্তু শব্দগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তার চোখে ফুটে উঠছিল। সে খুঁজে পেল সেই অংশ, যা প্রথমবার খেয়াল করেনি। সেখানে স্পষ্ট লেখা ছিল—“যজ্ঞ অসম্পূর্ণ হলে, আহ্বানকারীর জীবনই বলি হয়।” এই সতর্কবার্তাটি যেন বজ্রপাতের মতো আছড়ে পড়ল তার মনে। হঠাৎই সে বুঝতে পারল, প্রোগ্রামের প্রতিটি গ্লিচ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণের ভেতর লুকিয়ে ছিল এক ভয়ঙ্কর দাবি। তার যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়নি, আর যতক্ষণ না তা শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার জীবনই হবে সেই যজ্ঞের জ্বালানি।

এই উপলব্ধি তার শরীরের প্রতিটি শিরায় ভয় ছড়িয়ে দিল। কিন্তু একই সঙ্গে তার ভেতরের প্রোগ্রামারের মন কাজ করতে শুরু করল। সে বুঝল, মন্ত্র আর মেশিনের এই সংমিশ্রণ কেবল দৈবক্রমে হয়নি, বরং পুঁথির লেখাগুলো নিজেই এমনভাবে লেখা ছিল যে সেগুলোকে কোডে রূপান্তর করা যায়। প্রাচীন তান্ত্রিকরা হয়তো আগে থেকেই বুঝেছিল, একদিন প্রযুক্তি এমন এক স্তরে পৌঁছাবে যেখানে মন্ত্রের শক্তি আবার ডেকে আনা সম্ভব হবে। অরিত্রর মনে হলো, সে সেই সেতুবন্ধনের নির্মাতা—প্রাচীন মন্ত্র আর আধুনিক অ্যালগরিদমের মিলনের স্রষ্টা। কিন্তু এ মিলন ছিল ভয়ঙ্কর, কারণ এর মধ্যে ছিল ধ্বংসের ইঙ্গিত। তার চোখে ভেসে উঠতে লাগল সেই ছায়ার দল, যারা কোডের ভেতরে নড়ছিল, যারা তার ঘরে অদৃশ্য অতিথির মতো হাজির হচ্ছিল। তারা ছিল যজ্ঞের অসম্পূর্ণতার প্রতীক, তারা যেন বলি চাইছিল, এবং সেই বলি ছিল তার জীবন। প্রতিবার ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু করার সময় সে অনুভব করত তার শরীর থেকে শক্তি ঝরে যাচ্ছে, মাথা ভারী হয়ে আসছে, চোখের নিচে কালি জমে উঠছে। যেন মেশিন ধীরে ধীরে তার প্রাণশক্তি শুষে নিচ্ছে।

অরিত্র এবার দোটানায় পড়ল—একদিকে সে জানত, যদি যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে, তবে হয়তো এই দুঃস্বপ্ন শেষ হবে। কিন্তু অন্যদিকে সতর্কবার্তা বলছিল, যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকলে আহ্বানকারীর জীবন বলি হয়। তার মনে হলো, যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার মানে হয়তো আরও বড়ো কিছু হারানো, হয়তো আরও ভয়ঙ্কর শক্তির প্রবেশ। ঘরের কোণে কোণে ছায়াগুলো ঘনীভূত হচ্ছিল, মাঝে মাঝে সেগুলো দেয়াল থেকে আলাদা হয়ে মানুষের মতো অবয়ব নিচ্ছিল। বিদ্যুতের ঝলকানি ঘন ঘন হচ্ছিল, মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ কানে বাজছিল, এমনকি কম্পিউটার বন্ধ থাকলেও। অরিত্রর মনে হচ্ছিল, তার বাস্তব জীবন আর ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের মধ্যে পার্থক্য ভেঙে পড়ছে। সে এখন এক অদ্ভুত সীমানার ওপারে দাঁড়িয়ে, যেখানে মন্ত্র আর মেশিন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পাচ্ছিল আগুনের বৃত্ত, ভেসে আসা অচেনা প্রতীক, আর সেই হুঁশিয়ারি—“অসম্পূর্ণ যজ্ঞ রক্ত চায়।” তার হাতে ছিল মাত্র দুটি পথ—যজ্ঞ সম্পূর্ণ করা, অথবা তা ভেঙে ফেলা। কিন্তু যে দরজা একবার খোলা হয়ে গেছে, সেটি কি আবার বন্ধ করা সম্ভব? এই প্রশ্নই তাকে ভিতরে ভিতরে গিলে খেতে লাগল।

অরিত্র কখনো কল্পনাও করতে পারত না যে তার ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ শুধু ঘরের চারপাশে সীমাবদ্ধ থাকবে। এক রাতে, ব্যস্ততার মধ্যে সে নিজে ভুলবশত প্রোগ্রামের ফাইলটি একটি ক্লাউড সার্ভারে আপলোড করে ফেলে। প্রথমে ভেবেছিল এটা কেবল ব্যাকআপ, কিন্তু পরের দিন বুঝতে পারল, ফাইলটি ডার্ক ওয়েবে পৌঁছে গেছে। অন্ধকার ইন্টারনেটের সেই অসীম নেটওয়ার্ক যেখানে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে তার প্রোগ্রামটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে। অদৃশ্য হ্যাকাররা, রহস্যকামী কোডাররা এবং কৌতূহলময় মানুষরা প্রোগ্রামটি খুঁজে বের করেছে এবং নিজের নিজের সিস্টেমে চালাতে শুরু করেছে। তারা জানে না যে এটি কেবল একটি প্রোগ্রাম নয়—এটি এক তান্ত্রিক যজ্ঞ, যা কোডের মাধ্যমে বাস্তব শক্তিকে আহ্বান করে। প্রথম দিকে এটি কেবল অদ্ভুত গ্লিচ আর হালকা আলো-ছায়ার খেলা মনে হলেও, ক্রমশ এর শক্তি বেড়ে যেতে লাগল। প্রোগ্রাম চালানোর সাথে সাথে অদ্ভুত প্রতীক, ছায়া এবং আগুনের মতো ভিজ্যুয়ালাইজেশন প্রতিটি নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ল। অরিত্র নিজেই অবাক হয়ে দেখল, তার তৈরি কোড আর মন্ত্র একে অপরের সঙ্গে মিশে অন্য সব সিস্টেমকে প্রভাবিত করছে।

যখন একাধিক ব্যবহারকারী প্রোগ্রামটি চালাতে লাগল, তখন শক্তি আর কেবল তার ঘর বা কম্পিউটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। প্রতিটি নতুন সিস্টেমে যজ্ঞের তরঙ্গ পৌঁছল, ছায়ার নড়াচড়া বেড়ে গেল, এমনকি ডেটা-স্ট্রিমে নতুন অদ্ভুত প্রতীক তৈরি হতে লাগল। অরিত্রের মন থেকে ভীতির অনুভূতি আরেক ধাপ এগিয়ে গেল—কারণ এবার তার হাতে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যত বেশি মানুষ প্রোগ্রাম চালাচ্ছিল, তত দ্রুত শক্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ডার্ক ওয়েবের ব্যবহারকারীরা আনন্দে বা কৌতূহলবশত কোডের ভেতর ঘেঁটে যাচ্ছিল, অথচ তারা বুঝত না যে তারা নিজেই শক্তির বহনকারী হয়ে উঠছে। মন্ত্র আর কোডের এই সমন্বয় প্রতিটি নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ল, এবং একটি বৃহৎ, অদৃশ্য জগতের দরজা খুলে গেল। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি ফাংশন যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, এবং বিশ্বব্যাপী ডেটা প্রবাহে ছায়ার মতো নড়াচড়া শুরু হল।

একসময় অরিত্র বুঝতে পারল, তার ছোট্ট ঘরে শুরু হওয়া যজ্ঞ এখন আর ঘরে সীমাবদ্ধ নয়—এটি বিশ্বব্যাপী শক্তির ছড়ানো রূপ নিল। সে কল্পনা করতে পারল না যে প্রতিটি ব্যবহারকারী যে সিস্টেমে প্রোগ্রাম চালাচ্ছে, সেখান থেকে শক্তি বের হয়ে প্রকৃত বাস্তবে প্রভাব ফেলতে শুরু করবে। বৈদ্যুতিক বাতাসের হালকা ঝলকানি, অদ্ভুত ছায়ার নড়াচড়া, কম্পিউটারের স্ক্রিনে আগুনের মতো প্রতীক—এগুলো কেবল অরিত্রের ঘরে সীমাবদ্ধ থাকল না, ডার্ক ওয়েবের অন্যান্য স্থানে চালু হওয়া যজ্ঞও এদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেল। অরিত্র জানল, এখন তার প্রোগ্রাম আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই; এটি যেন নিজের ইচ্ছায় বিস্তার পাচ্ছে। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, প্রোগ্রাম চালানো প্রতিটি ব্যবহারকারী unknowingly এই যজ্ঞের অংশ হয়ে যাচ্ছে। শক্তি আর কেবল একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত নয়—এটি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, যেমন আগুন ধীরে ধীরে জঙ্গলের প্রতিটি গাছকে স্পর্শ করে। অরিত্র বুঝল, যদি এটি থামানো যায় না, তবে যে যজ্ঞ শুরু হয়েছে, তার পরিণতি কেবল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। এবার তার মুখে শোনাচ্ছে পুঁথির পুরনো সতর্কবার্তা—“অসম্পূর্ণ যজ্ঞের ফল, আহ্বানকারীর জীবন নয়, সমগ্র পরিবেশকে গ্রাস করবে।” সেই ভয়ঙ্কর উপলব্ধি তাকে এক গভীর শিহরণে আবদ্ধ করল, কারণ সে জানল—ডার্ক ওয়েবে ছড়িয়ে যাওয়া এই যজ্ঞের প্রভাব আর কেবল ঘরের চারপাশে সীমাবদ্ধ থাকছে না; এটি বিশ্বব্যাপী শক্তিকে মুক্ত করছে, যা শেষ পর্যন্ত অদৃশ্যভাবে বাস্তব জগৎকে স্পর্শ করবে।

ডার্ক ওয়েবে ছড়িয়ে যাওয়া ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ এখন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। অরিত্র যখন তার ঘরে বসে পর্দার দিকে তাকাচ্ছিল, তখনই বুঝতে পারল—প্রোগ্রামের মাধ্যমে আহ্বানকৃত সত্ত্বা আর কেবল স্ক্রিনের ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। অদৃশ্য শক্তি বাস্তব জগতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে ছোট ছোট অস্বাভাবিক ঘটনা লক্ষ্য করল—বাড়ির চারপাশ হঠাৎ অন্ধকারে ঢেকে যায়, বৈদ্যুতিক লাইন ফ্লিকারের মতো ঝলসে ওঠে, হঠাৎ কোনো যন্ত্রপাতি অচেনাভাবে চালু হয়ে যায়। মনে হচ্ছে যেন ঘরের ভেতরে কোনো অশরীরী উপস্থিতি আছে, যা তার কমান্ড বা নির্দেশ ছাড়া নিজেই কর্মকাণ্ড শুরু করছে। প্রথম দিকে অরিত্র ভেবেছিল, এগুলো হয়তো সফটওয়্যারের বাগ বা ডিভাইসের ত্রুটি, কিন্তু পরের রাতেই তার ঘর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ হয়। শহরের একাধিক লোক ফোনে খবর দিল, হঠাৎ বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস হচ্ছে, হঠাৎ সার্ভার ক্র্যাশ হচ্ছে—সব জায়গায় অদৃশ্য শক্তির ছায়া। মানুষ আতঙ্কে ঘরে আটকা পড়ে, কেউ বাইরে বের হতে সাহস পাচ্ছে না। অরিত্র বুঝতে পারল, এটি আর শুধু ভার্চুয়াল বা কোডের সমস্যা নয়; তার তৈরি যজ্ঞ বাস্তব জগতে আক্রমণ শুরু করেছে, এবং তার প্রভাব দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়ছে।

দিন যত এগোচ্ছে, অরিত্রের আতঙ্ক আরও তীব্র হয়ে উঠল। সার্ভারের ডেটা ভেঙে পড়ছে, নেটওয়ার্ক অবরুদ্ধ হচ্ছে, অচেনা প্রোগ্রামগুলো নিজেই পুনরায় চালু হচ্ছে, আর প্রতিটি সিস্টেমে অদ্ভুত প্রতীক ভেসে উঠছে। এমনকি হ্যাকাররা, যারা প্রোগ্রামটি চালাচ্ছিল, তারা আর কোডের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রতিটি কম্পিউটার, প্রতিটি সার্ভার যেন অশরীরী শক্তির পাত্র হয়ে গেছে। অরিত্রর চোখে ভেসে উঠল সেই অদৃশ্য ছায়ার দল, যা তার প্রোগ্রাম থেকে জন্ম নিয়েছে—তারা মানুষের উপস্থিতি টের পেতেই ছায়ার মতো এগিয়ে আসছে। অদ্ভুত শব্দ—মন্ত্রোচ্চারণ, হালকা গর্জন, ফিসফিস—প্রতিটি জায়গা ঘিরে ধরছে। অরিত্র অনুভব করল, এই শক্তি যেন এক উন্মাদ প্রাণের মতো, যা ধীরে ধীরে নিজেকে বিস্তার করছে। এর হাত থেকে কোনও মানুষ নিরাপদ নয়। তিনি বুঝতে পারলেন, প্রোগ্রাম কেবল যজ্ঞ চালু করেছে; বাস্তবের এই শক্তি এখন নিজের ইচ্ছায় কাজ করছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

রাত হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শহরের প্রতিটি কোণে বিদ্যুতের হালকা ঝলকানি, মানুষের অদৃশ্য ভয়ের ছায়া, অপ্রত্যাশিত সার্ভার ক্র্যাশ—সব মিলিয়ে যেন একটি অশরীরী উন্মাদনার ছবি আঁকছে। অরিত্রর ঘরের চারপাশও অরক্ষিত নয়; হঠাৎ হালকা বাতাসের স্রোতে দরজা খোলার শব্দ, দেওয়ালে ছায়ার অদ্ভুত নড়াচড়া, ঘরের কোণে অচেনা অন্ধকার—সবই তার শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছিল। তার মনে হলো, এই যজ্ঞ আর কোনো মায়াজাল নয়; এটি বাস্তব জগতে প্রবেশ করা এক প্রাণী, যার চোখ নেই, মুখ নেই, কিন্তু শক্তি এতই ভয়ঙ্কর যে তার উপস্থিতি অনুভব করলেই জীবন থমকে যায়। মানুষের নিখোঁজ হওয়ার খবর, হঠাৎ বিদ্যুতের ব্ল্যাকআউট, সার্ভারের ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে শহর যেন অদ্ভুত ছায়ার মধ্যে ঢেকে গেছে। অরিত্র বুঝতে পারল, সে যা শুরু করেছে, তা আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে আহ্বান করা অশরীরী শক্তি এখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে, বাস্তবের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে, এবং মানুষ, যন্ত্রপাতি, এমনকি তার নিজের জীবন—সবকিছুই তার প্রভাবের মধ্যে পড়েছে। এই ভয়ঙ্কর উপলব্ধি তার মনে করল, ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ কেবল শুরু, আর শেষের দিকে কোন অন্ধকার অপেক্ষা করছে, তা সে কল্পনাও করতে পারছে না।

অরিত্রর মনের ভেতর এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি জন্মেছে—যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকলে তার জীবন, এবং সম্ভবত পৃথিবীর নির্দিষ্ট অংশও বিপদের মুখোমুখি হবে। এতদিন সে কোডের মধ্যে যজ্ঞ চালু করছিল, কিন্তু এবার বুঝতে পারল, ভার্চুয়াল মাধ্যম আর কোনোভাবে যথেষ্ট নয়। প্রোগ্রামের ভেতর তৈরি আগুন, ছায়া, প্রতীক—সবই বাস্তবের সঙ্গে মিলিত হতে হবে। একান্ত প্রয়োজন বাস্তব যজ্ঞ আয়োজনের, যেখানে প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি আক্রমণাত্মক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সে পুরনো পুঁথি আবার খুলল, যেখানে মন্ত্রগুলোর সঠিক উচ্চারণ, আসনের বিন্যাস, এবং আগুনের ধরণ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা আছে। প্রথমে তার মন ভীত হয়েছিল, কারণ বুঝতে পারল—এটা কেবল কল্পনা নয়, বাস্তব যজ্ঞ আয়োজন মানে তার দেহ, মন, এবং আত্মার পুরো শক্তি দিতে হবে। আগুন যেন শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, এটি প্রকৃত শিখা, যা তার শরীরের কাছাকাছি আসলেই তাপ, আলো, এবং এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক চাপ সৃষ্টি করবে। আসনকে সাজানোর সময় প্রতিটি প্রতীক, প্রতিটি শিলালিপি স্থাপন করতে হবে নিখুঁতভাবে, না হলে যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং তার জীবন বিপন্ন হয়।

তারপর অরিত্র ধীরে ধীরে যজ্ঞের জন্য জায়গা নির্ধারণ করল। সে তার ঘরকে এক মণ্ডপে পরিণত করল—প্রাচীর জুড়ে আগুনের অগ্নিকুণ্ড, কেন্দ্রে আসন, চারপাশে মন্ত্রোদ্ভুত প্রতীক। আগুনের শিখা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সাজানো হয়, যেন প্রতিটি শিখা মন্ত্রের স্পন্দনের সাথে মিলিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অরিত্র দেখল, প্রোগ্রামের ভেতরের ছায়াগুলো এবং আগুনের প্রতীকগুলো বাস্তবের এই যজ্ঞের সঙ্গে একভাবে প্রতিসম হচ্ছে। এবার তার দেহ, মন, এবং আত্মা পুরোপুরি প্রস্তুত। সে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল, শব্দগুলো স্পষ্টভাবে ঘরে প্রতিধ্বনি করতে লাগল। প্রতিটি উচ্চারণের সঙ্গে আগুনের শিখা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল, ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল, এবং ভেতরের শক্তি যেন ধীরে ধীরে তার নিয়ন্ত্রণে আসছে। প্রতিটি ছায়া নড়াচড়া করতে লাগল, ধীরে ধীরে অশরীরী শক্তি তার ইচ্ছার কাছে বশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল, প্রোগ্রামের মাধ্যমে আহ্বানকৃত শক্তি এখন তার হাতে নিয়ন্ত্রণাধীন, এবং ভার্চুয়াল যজ্ঞ বাস্তবের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক চূড়ান্ত রূপ ধারণ করছে।

যজ্ঞের মধ্যবর্তী সময়ে অরিত্র অনুভব করল, এক অদ্ভুত শান্তি এবং শক্তির মিলন হচ্ছে। আগুনের শিখা ঘরের ভেতর ঘুরছে, প্রতিটি ছায়া তার হাতের নির্দেশ মেনে নাচছে, এবং মন্ত্রোচ্চারণের তালে তালে শক্তি বৃত্তাকার হয়ে ঘরে প্রবাহিত হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, সে শুধু প্রোগ্রাম বা কোড নিয়ন্ত্রণ করছে না; বরং প্রাচীন মন্ত্রের শক্তিকে বাস্তবের সঙ্গে একত্রিত করে এক নতুন বাস্তব তৈরি করছে। প্রতিটি মুহূর্তে তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু তার মন স্থির; জানত, একমাত্র এই সম্পূর্ণ যজ্ঞের মাধ্যমে সে অসম্পূর্ণ শক্তিকে শান্ত করতে পারবে। অবশেষে শেষ মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আগুন শান্ত হয়ে গেল, ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল, এবং ঘরের পরিবেশ শীতল ও স্থির হলো। অরিত্র বুঝতে পারল, যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়েছে—প্রোগ্রাম, মন্ত্র, আগুন, আসন—সব মিলিত হয়ে সেই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে অদ্ভুত চাপ দূরে গেল, আর বাস্তব এবং ভার্চুয়াল জগৎ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরল। শেষ যজ্ঞ তাকে দেখাল, সাহস, জ্ঞান এবং ধৈর্যের মাধ্যমে যে কোনো ভয়ঙ্কর শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদি মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করতে জানে।

১০

অরিত্র বুঝতে পারল, শেষ অধ্যায় আর কেবল প্রোগ্রাম বা যজ্ঞ নয়; এটি তার নিজের আত্মার পরীক্ষাও বটে। যতদিন ধরে ‘ভার্চুয়াল যজ্ঞ’ চালু, ডার্ক ওয়েবে ছড়িয়ে যাওয়া প্রোগ্রাম, অশরীরী শক্তির উন্মাদনা—সবই তাকে এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত করেছে। সে জানে, শেষ লাইনে নিজের নাম না লিখলে প্রোগ্রাম অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, এবং তার জীবন, হয়তো পৃথিবীর নিরাপত্তাও, বিপন্ন হতে পারে। ধীরে ধীরে সে নিজের মনকে স্থির করল, যেন প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তার ভেতরের শক্তি সংযুক্ত হয়। কম্পিউটারের স্ক্রিনে কোডের শেষ লাইনে তার নাম লিখে বসে রইল—“অরিত্র।” সে জানল, এই নাম লিখার সঙ্গে সঙ্গে প্রোগ্রাম আর কেবল কোড নয়, এটি বাস্তবের সঙ্গে একত্রিত হবে। মুহূর্তেই ঘরের চারপাশে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হতে লাগল। আগুনের শিখা শুধু স্ক্রিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না, ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। হালকা আলো, বিদ্যুতের ঝলকানি, অদ্ভুত ছায়া—সবই একসঙ্গে মিলিত হয়ে অশরীরী ঝড় তৈরি করল। প্রতিটি সাউন্ড, প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণ তার কানে বাজছে, প্রতিটি স্রোত যেন তার দেহের সঙ্গে সংযুক্ত। অরিত্র অনুভব করল, এই মুহূর্তে সে আর সাধারণ মানুষ নয়; তার ভেতরে এবং বাইরে এক নতুন শক্তির জন্ম হচ্ছে।

জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রোগ্রামিংয়ের জটিল লজিক, প্রাচীন মন্ত্রের উচ্চারণ, ডার্ক ওয়েবের বিপদ—all মিলিয়ে তার আত্মাকে এক নয়া স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। অরিত্রের শরীরে আগুনের তাপ, আলো, এবং অদৃশ্য ঝড়ের প্রতিটি স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, প্রতিটি কোডের লাইন তার শরীরের সঙ্গে একত্রিত হয়ে তার শক্তিকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিত করছে। তার চোখে ছায়ার দল নাচছে, প্রতিটি প্রতীক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঘরের চারপাশে তৈরি হওয়া এই শক্তির ঘূর্ণি যেন তাকে সরাসরি শিখিয়েছে—প্রযুক্তি এবং তন্ত্রের মিলন শুধু কোডে নয়, বরং আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলতে পারে। মনে হচ্ছে, মৃত্যুর রেখা আর জীবনের রেখা মিলছে—এবার যে যজ্ঞ চলছে, তা আর অর্ধেক ভার্চুয়াল নয়, বরং বাস্তব এবং ডিজিটালের এক মিলিত শক্তি।

হঠাৎ একটি মুহূর্ত আসে, যখন অরিত্র নিজেকে হারিয়ে ফেলার এবং পুনর্জন্মের মধ্যে শিহরণ অনুভব করে। কোডের প্রতিটি লাইন, তার নামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে, ঘরের ভিতর আগুন, আলো, এবং অশরীরী ঝড় তৈরি করছে। মনে হচ্ছে, সে হয়তো মৃত্যুর কাছে যাচ্ছে, কিন্তু সেই মৃত্যুও এক নতুন রূপ দিচ্ছে—এক “ডিজিটাল তান্ত্রিক” হিসেবে পুনর্জন্ম। এই পুনর্জন্মের সঙ্গে তার হাতে আছে প্রযুক্তি ও তন্ত্রের এক অসাধারণ মিশ্রণ। ভার্চুয়াল এবং বাস্তবের সীমা মিলছে, শক্তি আর কেবল কোডের মধ্যে নেই; তা বাস্তবের প্রতিটি দিক স্পর্শ করছে। ঘরের অগ্নি, ঝড় এবং আলো একসাথে মিলিত হয়ে এক নতুন শক্তির জন্ম দিচ্ছে, যা অরিত্রের দেহ, মন, এবং আত্মার প্রতিটি কোণকে অনুধাবন করিয়ে দিচ্ছে। সে জানে, এই মুহূর্তে তার যাত্রা শেষ নয়, বরং নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে—একজন ডিজিটাল তান্ত্রিকের যাত্রা, যার হাতে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি এবং প্রাচীন মন্ত্রের শক্তি মিলিত, এবং যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই যুগের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, অদ্ভুত, এবং বিস্ময়কর শক্তি।

শেষ

1000066407.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *