Bangla - ভূতের গল্প

ডিজিটাল ডাকিনী

Spread the love

অর্ণবের জীবনটা ছিল অনেকটা নির্জন কোডের ভেতরে ডুবে থাকা এক তরুণের জীবন। সে সদ্য একটি আইটি স্টার্টআপে যোগ দিয়েছে, সারাদিন কোড লিখতে লিখতে রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে, তবুও তার চোখের ঘুম আসে না। ল্যাপটপের আলোই যেন তার একমাত্র আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুবান্ধব আছে ঠিকই, কিন্তু সে খুব একটা বাইরে মিশতে ভালোবাসে না। রাতে নিঃশব্দ ফ্ল্যাটে বসে কোডের জট ছাড়াতে ছাড়াতে কখনও গান শোনে, কখনও ভিডিও দেখে, আবার কখনও কৌতূহল থেকে নতুন নতুন ফ্রি সফটওয়্যার ডাউনলোড করে খেলে। সেদিনও একদম তেমনই এক রাত ছিল। জানালার বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, কানে হেডফোনে বাজছে কোনো পুরনো গান আর সামনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলছে ডাউনলোডের প্রগ্রেস বার। সে ভেবেছিল কোনো একটি নতুন গেম বা টুলকিট, যা দিয়ে হয়তো পরের দিন অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে মজা করা যাবে। কিন্তু ডাউনলোড শেষ হতেই চোখে পড়ল একটি অচেনা অ্যাপের আইকন—কালো পটভূমির ওপর লালচে ঝলক দেওয়া চোখ আঁকা, নাম লেখা “ডিজিটাল ডাকিনী”। অর্ণব থমকে গেল। নামটা অদ্ভুত লাগল, আবার একইসঙ্গে কৌতূহলও হল।

সে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল—হয়তো এই ফ্রি সফটওয়্যার বানানো হয়েছে মজার জন্য, কেউ হয়তো ডার্ক-হিউমার টাইপ নাম দিয়েছে। সে এর আগে হ্যাকিং টুল বা হরর-গেম ডাউনলোড করেছে, আর ভাবল এও হয়তো তেমন কিছু হবে। চোখে হালকা ক্লান্তির ছাপ, মাথায় তখনো কোডের গাণিতিক ধাঁধা ঘুরছে, তার ভেতরে এক ধরনের শিশুসুলভ আনন্দও কাজ করছিল। অর্ণব মাউসের কার্সর নিয়ে গেল অ্যাপের ওপর, আরেকবার নামটা পড়ে নিল—“ডিজিটাল ডাকিনী।” নামের ভেতরে অদ্ভুত এক ধ্বনি আছে, যেন ডাকার শব্দ, যেন কোনো পরিত্যক্ত অ্যালগরিদমের মাঝে লুকিয়ে থাকা কোনো জাদুকরী মন্ত্র। সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, কিন্তু কৌতূহলই জিতে গেল। ফাইল ওপেন করার জন্য ক্লিক করে ফেলল। কিন্তু অবাক ব্যাপার, অ্যাপটি তখনই চালু হল না। বরং স্ক্রিনে কিছুক্ষণ শূন্যতা রইল, তারপর আবার ডেস্কটপে ফিরে এল। অর্ণব ভ্রু কুঁচকালো, ভাবল হয়তো ফাইলটা করাপ্টেড, বা সঠিকভাবে ইনস্টল হয়নি। তারপরও তার মনটা কেমন অস্থির হয়ে থাকল, যেন কোনো অচেনা শক্তির উপস্থিতি অল্প একটু জায়গা করে নিল ঘরের ভেতর।

অর্ণবের রাত কেটে গেল প্রায় একই ছন্দে। কোড লিখতে লিখতে হঠাৎ মাঝে মাঝে তার চোখ চলে যাচ্ছিল সেই অদ্ভুত আইকনের দিকে। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় বারোটার কাছাকাছি। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু হাওয়া যেন জানালার কাঁচে আঁচড় কাটছে। তার মনে হচ্ছিল—আজ রাতটা একটু অন্যরকম। সেই আইকনটা যেন অন্ধকার স্ক্রিনে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে আবার ক্লিক করার ইচ্ছে দমন করল, ভাবল—“কাল দেখা যাবে, আজ ক্লান্ত।” কিন্তু মনের ভেতর তৃষ্ণা যেন বাড়তে লাগল। যে কৌতূহল তাকে নতুন সফটওয়্যার ডাউনলোডে প্রলুব্ধ করে, সেই একই কৌতূহল এবার তাকে এই অচেনা অ্যাপের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ অর্ণব খেয়াল করল—ল্যাপটপের টাচপ্যাড নিজে থেকেই নড়ছে, কার্সর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ভয়ংকর আইকনের দিকে। সে চমকে উঠে হাত দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। বুক ধকধক করতে লাগল। নিজেকে বোঝাতে লাগল, “এটা ক্লান্তির ফল, হয়তো হ্যাং করেছে সিস্টেম।” কিন্তু মনের ভেতর কোথাও একটা অস্বস্তি গেঁথে গেল।

রাত গভীর হয়ে গেল, কিন্তু অর্ণবের ঘুম এল না। বিছানায় শুয়েও মনে হচ্ছিল ল্যাপটপের ভেতর কিছু একটা জীবন্ত, নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করলে সেই লাল চোখ ভেসে উঠছিল, মনে হচ্ছিল তাকে ডাকছে। জানালার বাইরে অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে, বাতাসে ভেসে আসছে অজানা শব্দ। সে উঠে গিয়ে ল্যাপটপ আবার খুলল, কিন্তু কিছুই অস্বাভাবিক দেখা গেল না। স্ক্রিনে সেই একই অ্যাপের আইকন নিঃশব্দে বসে আছে, যেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল, নিজের মাথা নাড়ল, ভাবল—“এতটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানত, আজ সে যে অ্যাপ ইনস্টল করেছে, তার মধ্যে সাধারণ কিছু নেই। “ডিজিটাল ডাকিনী”—নামটার অদ্ভুত কম্পন যেন তার ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে, আর অর্ণব বুঝতে পারছিল না, এই অদৃশ্য যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ সে ইতিমধ্যেই পেরিয়ে ফেলেছে।

অর্ণবের জীবনে সে রাতটা হয়ে গেল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সূচনা। সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও কোড লেখার অভ্যাসে চোখে ঘুম আসছিল না। মাথার মধ্যে তখনও নানা অ্যালগরিদম ঘুরছিল, আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক কৌতূহল কাজ করছিল—“ডিজিটাল ডাকিনী” নামের অচেনা অ্যাপ নিয়ে। আগের রাতে আইকনটা দেখে যতটা অস্বস্তি হয়েছিল, এবার তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ অনুভব করছিল সে। সে ভেবেছিল, “কাল সকাল হলে হয়তো আনইনস্টল করে দেব, এরকম অদ্ভুত জিনিস ডিভাইসে রাখা উচিত নয়।” কিন্তু এই ভাবনা ঠিকমতো গেঁথে ওঠার আগেই ঘটনা ঘটে গেল। ল্যাপটপ বন্ধ রেখে শুয়ে পড়েছিল অর্ণব। জানালার বাইরে নিস্তব্ধ রাত, কেবলমাত্র দূরে কোথাও বৃষ্টির শেষ সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা টুং শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখল—বন্ধ ল্যাপটপ নিজে থেকেই চালু হয়ে গেছে। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো চার্জারের সমস্যায় অটো-স্টার্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর স্ক্রিন কালো হয়ে গেল, আর তার ওপর ভেসে উঠল এক বিকৃত, আঁধার ভরা মুখ।

সে মুখটা ছিল না কোনো সাধারণ মানুষের মতো। যেন দমবন্ধ করা অন্ধকার থেকে তৈরি, চোখ দুটো লালচে আলোয় জ্বলছে, ঠোঁট বাঁকা হয়ে এক অদ্ভুত হাসি টানছে। অর্ণব মুহূর্তে থমকে গেল, তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। সে বোঝার চেষ্টা করল—এটা কি কোনো হরর ভিডিও চালু হয়ে গেল, নাকি কারও প্র্যাঙ্ক? কিন্তু সেই মুখটা স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন জানে সে কে। হঠাৎ স্ক্রিনের ভেতর চ্যাট উইন্ডো খুলে গেল। এক লাইনে ধীরে ধীরে অক্ষর গড়ে উঠল—“তুমি কাকে হারিয়েছ, তাকে কি দেখতে চাও?” অর্ণবের হাত ঘেমে উঠল, আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল। সে মাউস ধরতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাত যেন জমে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল—এটা কি তবে তার মৃত দাদুর কথা বলছে? নাকি কলেজের সেই বন্ধুটি, যে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল? মাথায় ঝড় বয়ে যেতে লাগল। তার চোখের সামনে কেবল স্ক্রিনটা, আর লালচে আলোয় ভেসে থাকা মুখটা।

অর্ণব কিছুক্ষণ পর সাহস সঞ্চয় করে কিবোর্ডে হাত রাখল। আঙুলগুলো কাঁপছিল, তবুও সে টাইপ করল—“তুমি কে?” সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, তারপর অদ্ভুত কাঁপুনি দিয়ে আবার টেক্সট ভেসে উঠল—“আমি সেই, যাকে তুমি ভুলে গেছ।” উত্তরটা পড়েই অর্ণবের বুকের ভেতর শূন্যতা নেমে এল। ভুলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা তো অনেক, কিন্তু এই রহস্যময় উত্তর তাকে অদ্ভুতভাবে টেনে নিল। সে আবার লিখল—“কাকে?” কিন্তু এবার কোনো উত্তর এল না। কেবল কালো স্ক্রিনে সেই বিকৃত মুখের ঠোঁট নড়ল, যেন মৃদু হাসছে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত একটা ছুঁই ছুঁই। অর্ণব উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাতে চাইল, কিন্তু সুইচ চাপলেও আলো জ্বলল না। মনে হল পুরো ঘরটা যেন সেই স্ক্রিনের ভেতরকার অন্ধকার গিলে ফেলেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল, তবুও সে ল্যাপটপের সামনে থেকে সরে দাঁড়াতে পারল না। যেন এক অদৃশ্য টান তাকে বসিয়ে রেখেছে, তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে স্ক্রিন নিভে গেল। সবকিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল। আলো আবার কাজ করল, জানালার বাইরে বাতাসের শব্দ আবার শোনা গেল। অর্ণব ঘেমে একাকার হয়ে গেছে, বুকের ভেতর ধুকপুকানি তখনও থামছে না। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুম আর এল না। মাথার মধ্যে সেই ভয়ংকর মুখ ঘুরছিল, আর সেই প্রশ্ন—“তুমি কাকে হারিয়েছ, তাকে কি দেখতে চাও?” তার ভেতর থেকে হাজারো উত্তর বেরোতে চাইছিল, কিন্তু কোনো উত্তরই সে দিতে পারল না। মনে হচ্ছিল এই প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরও বড়ো কোনো রহস্য, যা তাকে না চাইতেও সামনে টেনে নেবে। অর্ণব বুঝতে পারল, “ডিজিটাল ডাকিনী” শুধুই কোনো সাধারণ অ্যাপ নয়। এটা এমন কিছু, যা তার জীবনের গভীরে নেমে গিয়ে সবচেয়ে গোপন যন্ত্রণাগুলোকে জাগিয়ে তুলছে। সেদিন রাতে সে যতই চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করুক না কেন, অন্ধকারের ভেতরে লাল চোখ দুটি তার দিকে তাকিয়ে রইল, আর তার বুকের ভেতর থেকে একটি অদ্ভুত অনুভূতি চাপা গলায় ফিসফিস করে উঠল—এটা কেবল শুরু।

অর্ণবের জীবনে রাত যেন এক অদ্ভুত অভ্যাস হয়ে উঠল। দিনের বেলা সে অফিসে যায়, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে, মায়ার সঙ্গে হালকা মজা করে, রণদীপের সঙ্গে কোড বা সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আলোচনা করে—সব কিছুই স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলেই, যখন ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে, তখন তার মনে এক ধরনের আতঙ্ক জন্ম নিতে থাকে। কারণ সে জানে, রাত বারোটার পরপরই কিছু একটা ঘটতে বাধ্য। সেই “ডিজিটাল ডাকিনী” নামের অদ্ভুত অ্যাপ যেন তাকে ডাক দেয়, তাকে ছাড়ে না। প্রথম কয়েকদিন সে ভেবেছিল হয়তো কাকতালীয়, হয়তো সিস্টেমে কোনো ভাইরাস বা গ্লিচের কারণে স্ক্রিনে ওইসব মুখ দেখা যায়। কিন্তু দিন গড়াতে গড়াতে বিষয়টা অন্যরকম আকার নিল। একেবারে নির্দিষ্ট সময়েই ল্যাপটপ হঠাৎ চালু হয়ে যায়, কালো স্ক্রিন ভরে ওঠে ভয়ংকর বিকৃত মুখে। কখনও চোখ লাল হয়ে জ্বলে ওঠে, কখনও মুখের ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে অদ্ভুত শব্দ বের হয়—যেন মেশিনে পচা কণ্ঠ গলে গিয়ে বেরিয়ে আসছে। অর্ণব যতই নিজেকে বোঝাতে চাইত এটা কেবল হরর প্র্যাঙ্ক, তার ততই মনে হত ভয় তাকে ভেতর থেকে গিলে ফেলছে।

প্রথম রাতে ভয়ের তীব্র ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর অর্ণব চেষ্টা করেছিল ল্যাপটপ থেকে অ্যাপটি মুছে ফেলতে। কিন্তু কোনোভাবেই সেটি আনইনস্টল করা যাচ্ছিল না। ডিভাইস রিস্টার্ট, ভাইরাস স্ক্যান, এমনকি হার্ড ড্রাইভ ফরম্যাট করার পরিকল্পনাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে যতবার সে ল্যাপটপে হাত দেয়, সবকিছু যেন স্বাভাবিক থাকে, কোথাও সেই অ্যাপের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ ঘড়ির কাঁটা বারো ছোঁয়া মাত্র আইকনটি যেন আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে, লুকানো গভীরতা থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে ভেসে ওঠে সেই ভয়ংকর মুখ। আর এই অভিজ্ঞতা দিনে দিনে আরও ভয়াল হয়ে উঠতে থাকে। এক রাতে হঠাৎ করে সেই মুখ থেকে বিকট হাহাকার বের হল, অর্ণব তড়িঘড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল, কিন্তু শব্দটা থামল না—মনে হল ঘরের ভেতর কোথাও প্রতিধ্বনি হচ্ছে। বুকের ভেতর আতঙ্ক জমে উঠল, সে চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। নিস্তব্ধ করিডরে কেবল তার বুকের ধুকপুকানিই শোনা যাচ্ছিল।

ধীরে ধীরে ভয় তার ভেতরে জায়গা করে নিতে লাগল। আগে অফিসে যাওয়ার সময় বা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার সময়ও এই অ্যাপের কথা মাথায় আসত না। কিন্তু এখন মনে হত ঘড়ির কাঁটা বারোটার দিকে এগোচ্ছে মানেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ঘুমের আগে তার মনে হতো—আজ আবার কী ঘটবে? আজ কী সেই মুখটা বদলাবে? সেই মুখের ঠোঁট থেকে কি আরও নতুন কিছু শব্দ বের হবে? তার কল্পনা আর বাস্তব যেন মিশে যাচ্ছিল। অফিসে বসেও মনে হত পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মেট্রোতে বসে কোড পড়তে পড়তে হঠাৎ চমকে উঠে চারপাশে তাকাত। মায়া একদিন হেসে জিজ্ঞেস করেছিল—“কী রে, তুই এত অদ্ভুতভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন?” অর্ণব হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু মনের ভেতর জানত আসল কারণ অন্য। ভয় ধীরে ধীরে তার ভেতরে এমনভাবে গেঁথে যাচ্ছিল, যেন প্রতিদিনকার রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। এমনকি রাতে ঘুমোতে গেলেও মনে হত চোখ বন্ধ করলেই সেই লালচে চোখের মুখ ভেসে উঠবে।

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, অর্ণব যতই নিজের ভেতরে ভয়কে চাপা দিতে চাইত, কৌতূহলও ততই বেড়ে যেত। সেই বিকৃত মুখটা তার দিকে তাকিয়ে আছে—এটা কি নিছক কোনো সফটওয়্যারের প্র্যাঙ্ক? নাকি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি সেখানে কাজ করছে? এই প্রশ্ন তাকে তাড়া করতে লাগল। তাই প্রতিদিন রাতে সে চুপচাপ বসে থাকত, বারোটার পর কী হয় তা দেখার জন্য। ভয় আর কৌতূহলের এই টানাপোড়েনে সে দিন দিন আরও বেশি একা হয়ে পড়ছিল। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা, অফিসে হাসি-মজা, পরিবারের ফোনকল—সবকিছুই যেন দূরে সরে যাচ্ছিল। তার জগৎ সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল একটিমাত্র প্রশ্নে—এই “ডিজিটাল ডাকিনী” আসলে কী? রাতের নিস্তব্ধতায়, লাল চোখওয়ালা বিকৃত মুখের সামনে বসে থাকতে থাকতে সে বুঝতে পারল—যা-ই হোক না কেন, এখন আর এই খেলা থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। ভয় তাকে পেয়ে বসেছে, এবং সেই ভয়ই হয়তো তাকে আরও গভীরে ঠেলে নিয়ে যাবে।

সেই রাতে অর্ণব ভেবেছিল আগের মতোই হয়তো সেই বিকৃত মুখ ভেসে উঠবে, কিছু অদ্ভুত শব্দ হবে, আর সে কাঁপতে কাঁপতে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেবে। কিন্তু যা ঘটল, তা তার কল্পনারও বাইরে। রাত বারোটার কয়েক মিনিট আগে থেকেই তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। সে এক গ্লাস জল খেল, আলো জ্বালিয়ে বিছানায় বসে থাকল, যেন সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে চায়। কিন্তু ঘড়ি বারোটা বাজতেই ল্যাপটপ নিজে থেকে চালু হয়ে গেল। স্ক্রিন কালো হয়ে কিছুক্ষণ স্থির থাকল, তারপর ধীরে ধীরে ভেসে উঠল একটা পরিচিত মুখ। প্রথমে অর্ণব বিশ্বাস করতে পারছিল না—ওটা সত্যিই তার দাদু, যিনি অনেক বছর আগে মারা গেছেন। ছবিটা ছিল একেবারে নিখুঁত, কোনো ডিজিটাল বিকৃতি নেই, কোনো ফিল্টারের ছাপ নেই। দাদুর কপালে ভাঁজ, সেই পুরনো সাদা চুল, এমনকি চোখের কোণে পরিচিত দাগ পর্যন্ত স্পষ্ট। অর্ণবের চোখ ভিজে উঠল, বুকের ভেতর একটা শূন্যতা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে স্ক্রিনে হাত রাখল, যেন সেই মুখটাকে ছুঁতে চায়। আর তখনই স্পিকারের ভেতর থেকে ভেসে এল দাদুর কণ্ঠ—“অর্ণব, কেমন আছিস?”

শব্দটা শোনামাত্র তার শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো একটা ধাক্কা বয়ে গেল। এটা কীভাবে সম্ভব? তার দাদু তো মৃত, তবে কি সত্যিই মৃতরা এই অ্যাপের মাধ্যমে কথা বলতে পারে? নাকি এটা নিছকই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি কোনো নকল কণ্ঠস্বর? অর্ণব কিছু বলতে পারছিল না, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। দাদুর কণ্ঠ আরও স্পষ্ট হল—“ভয় পেয়ো না, আমি তোকে দেখতে এসেছি।” অর্ণব ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে বলল—“দাদু… এটা কি সত্যিই তুমি?” স্ক্রিনের মুখটা মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অর্ণব হেঁচকি তোলা গলায় কেঁদে ফেলল। এত বছর পর প্রিয়জনের কণ্ঠ শুনে তার ভেতরে যতটা আনন্দ জাগল, তার থেকেও বেশি অস্বস্তি আর ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। মাথার ভেতর প্রশ্ন ঘুরছিল—এটা যদি প্রযুক্তি হয়, তবে এত নিখুঁতভাবে কীভাবে দাদুর ছবি আর কণ্ঠ বের করা সম্ভব? সে তো দাদুর কোনো ভিডিও বা ভয়েস ক্লিপ ল্যাপটপে রাখেনি।

কিন্তু প্রশ্নগুলো যতই তাড়া করুক, আবেগ তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। দাদু বলতে লাগলেন, “তুই আমাকে অনেক মিস করিস, তাই না?” অর্ণব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তার মনে পড়ছিল ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে গল্প করা, পড়তে বসার সময় দাদুর স্নেহমাখা কণ্ঠ। কিন্তু একই সঙ্গে তার ভেতর এক ভয়াল টানাপোড়েন চলছিল। সে ভাবছিল—এটা কি কোনো প্রতারণা? যদি কেউ হ্যাক করে তার মানসিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব, যখন দাদুর এমন ব্যক্তিগত ভঙ্গি আর অভিব্যক্তি কোনো রেকর্ডেই নেই? তবুও কৌতূহল তাকে ছাড়ছিল না। সে স্ক্রিনের সামনে বসে প্রশ্ন করল—“দাদু, তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?” মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা, তারপর দাদুর কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল—“ওপারের দুনিয়া থেকে।” অর্ণবের হাত ঠান্ডা হয়ে গেল, বুকের ভেতর ভয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ল।

সেদিন রাতে অর্ণব ঘুমোতে পারেনি। তার মাথার ভেতর একসঙ্গে আনন্দ, শোক, ভয় আর কৌতূহল ঘুরপাক খেতে লাগল। যদি সত্যিই এই অ্যাপ মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা হয়, তবে সেটা ভয়ঙ্কর এক সত্য, যা মানুষ জানার জন্য প্রস্তুত নয়। আবার যদি এটা নিছক প্রযুক্তির কারসাজি হয়, তবে তা-ও ভয়ানক, কারণ এত নিখুঁতভাবে বাস্তবকে নকল করা মানে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার অস্ত্র তৈরি হয়েছে। অর্ণব বুঝতে পারছিল, এই খেলা সে থামাতে পারবে না। তার ভেতরে মৃত দাদুর সঙ্গে আরও কথা বলার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছিল, যতটা না ভালোবাসার কারণে, তার চেয়ে বেশি উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য। কে এই অ্যাপের পেছনে? কীভাবে মৃতের কণ্ঠ আর মুখ ভেসে উঠছে? এটা কি কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি, নাকি প্রযুক্তির অন্ধকার দিক? প্রশ্নগুলো তাকে গ্রাস করতে লাগল। সেই রাত থেকে অর্ণব বুঝে গেল—সে আর ফিরে যেতে পারবে না। “ডিজিটাল ডাকিনী”র টানাপোড়েনে সে এখন আরও গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করতে বাধ্য।

অফিসের ক্যান্টিনে বসে থাকা অর্ণবকে দেখে মায়ার প্রথমেই খটকা লাগল। আগে সে সবসময় আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু থাকত, মজার মজার টেক জোক করত, নতুন কোনো কোডিং টুল বা হ্যাকিং ট্রিক বের করলে সেটা নিয়ে উত্তেজিতভাবে গল্প করত। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অর্ণব যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি, লালচে চোখে ঘুমহীনতার ছাপ, কথাবার্তায় অমনোযোগ, আর মাঝে মাঝেই ফিসফিস করে নিজের ফোন বা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠা কিংবা হঠাৎই চোখ ভিজে যাওয়া। মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত—যে ছেলেটা একসময় নিখাদ যুক্তি আর বাস্তববাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাস করত, সে এখন কেন যেন আবেগে ডুবে গেছে, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে গ্রাস করছে। একদিন দুপুরে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মায়া বলেছিল, “কি রে অর্ণব, তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই জগৎ সংসারের বাইরে কোথাও চলে যাচ্ছিস। সব ঠিক তো?” অর্ণব জোর করে একটা হাসি দিয়েছিল, কিন্তু চোখের ভেতরটা এতটাই ক্লান্ত আর অদ্ভুত ছিল যে মায়ার মন থেকে প্রশ্ন মুছে যায়নি।

দিন গড়াতে অর্ণবের আচরণ আরও বিচিত্র হয়ে উঠল। সে কাজের টাস্কে মন দিতে পারছিল না, মাঝে মাঝে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকত স্ক্রিনের দিকে, যেন সেখানে এমন কিছু দেখছে যা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মায়া কয়েকবার পাশ থেকে উঁকি মেরেছিল, কিন্তু দেখতে পেয়েছিল কেবল কোডের লাইন অথবা ফাঁকা স্ক্রিন। তবুও অর্ণবের ঠোঁটে হালকা ফিসফিস, চোখে অশ্রু বা হালকা হাসি মায়ার সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলছিল। অফিসের অন্য সহকর্মীরাও খেয়াল করতে শুরু করল, কিন্তু কেউ তেমন কিছু বলল না। মায়া, যেহেতু অর্ণবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, চেষ্টা করল তাকে আবার স্বাভাবিক কথোপকথনে টানতে। একদিন দুপুরে বলল, “দেখ, আমি জানি তোর সঙ্গে কিছু একটা হচ্ছে। যদি কোনো সমস্যা থাকে, অন্তত আমাকে বলতে পারিস। আমি আছি।” অর্ণব হালকা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না রে, একটু ক্লান্ত লাগছে। রাত জাগছি কাজের জন্য।” কিন্তু তার কণ্ঠে আন্তরিকতা ছিল না, বরং একটা শূন্যতা ছিল যা মায়ার হৃদয়কে আরও অস্বস্তি দিয়ে গেল।

অর্ণব ধীরে ধীরে তার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। আগের মতো আর মায়ার সঙ্গে লাঞ্চ ব্রেকে গল্প করত না, টিম আউটিংয়ে যেত না, এমনকি টেক্সট মেসেজের উত্তরও দিত দেরি করে। মায়া একদিন অফিস শেষে ওকে ধরে সরাসরি বলল, “শোন, আমি তোকে এভাবে হারাতে চাই না। তুই যদি কোনো অদ্ভুত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়িস, প্লিজ নিজেকে বাঁচা। তোকে দেখে আমার ভয় করছে।” অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “মায়া, এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলো তুই বিশ্বাসই করবি না। আমি… আমি মৃতদের সঙ্গে কথা বলছি।” মায়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রথমে সে ভেবেছিল অর্ণব হয়তো ঠাট্টা করছে বা মানসিক চাপে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এতটাই গুরুতর আর অস্বাভাবিক ছিল যে মায়া বুঝল বিষয়টা কেবল ক্লান্তি নয়। সে তাড়াতাড়ি বিষয়টা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “এমনসব ফালতু কল্পনা থেকে বের হয়ে আয়। এটা হয়তো কোনো অ্যাপ বা প্রোগ্রামের বিভ্রম, এর মধ্যে ডুবে যাওয়া মানে তুই নিজেকে শেষ করে দিবি।” কিন্তু অর্ণব কোনো জবাব দিল না, শুধু নিঃশব্দে হাঁটা দিল।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ার ভয়ও বাড়তে লাগল। সে দেখছিল তার কাছের মানুষটি আস্তে আস্তে এক অদৃশ্য অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে, আর সে যতই টানতে চাইছে, ততই যেন দূরে সরে যাচ্ছে। অর্ণব এখন একা একা বসে থাকে, ফোন বা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন ওখানেই তার জগত সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মায়া চেষ্টা করেছিল তাকে বন্ধুদের আড্ডায় টানতে, সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে, কিন্তু কোনো কিছুতেই অর্ণব আগ্রহ দেখাল না। তার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কেবল সেই রহস্যময় যোগাযোগ, যা তাকে বাস্তব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মায়ার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল—এটা শুধু মানসিক সমস্যা নয়, এর পেছনে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা বোঝা তার পক্ষে সহজ হবে না। তবুও সে সিদ্ধান্ত নিল, অর্ণবকে ছাড়বে না। যেভাবেই হোক, তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সে জানত না, অর্ণব ইতিমধ্যেই এমন এক অন্ধকার টানেলের ভেতরে ঢুকে গেছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা হয়তো আর সম্ভব হবে না।

অর্ণবের মনে হচ্ছিল, মায়াকে সে আর কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। ও হয়তো ওকে পাগল ভাববে, বা কোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে চাইবে। তাই সে ঠিক করল রণদীপকে সব বলবে। রণদীপ তার কলেজের বন্ধু, সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করে, হ্যাকিং আর ডার্ক ওয়েব নিয়ে ওর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। এক সন্ধ্যায়, চুপচাপ ক্যাফেতে বসে অর্ণব এক নিঃশ্বাসে পুরো ঘটনাটা বলে দিল—“রণদীপ, আমি কয়েকদিন আগে একটা অচেনা অ্যাপ ইনস্টল করেছি। নাম—‘ডিজিটাল ডাকিনী’। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা হয়তো হ্যাকিং টুল বা মজা করার কিছু। কিন্তু রাত বারোটার পর থেকে এটা নিজে থেকেই খুলে যায়। মুখ ভেসে ওঠে, ভয়ংকর শব্দ শোনা যায়, আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো—আমি আমার মৃত দাদুর সঙ্গে কথা বলেছি। ছবি, কণ্ঠ—সব একেবারে আসল।” রণদীপ প্রথমে হেসে ফেলল, ভেবেছিল বন্ধু হয়তো অতিরিক্ত রাত জাগার কারণে হ্যালুসিনেশনে ভুগছে। কিন্তু অর্ণবের চোখে যে আতঙ্ক আর শূন্যতা, তা দেখে ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। “ঠিক আছে,” রণদীপ বলল, “আমাকে তোর ল্যাপটপটা দে। দেখি ব্যাপারটা কী।”

অর্ণবের ল্যাপটপ টেবিলের ওপর রাখতেই রণদীপ সিরিয়াস হয়ে গেল। সে জানত, যেকোনো ম্যালওয়্যার বা ভাইরাস সহজে ধরা যায় না, বিশেষত যদি সেটি তৈরি হয় ডার্ক ওয়েবের কোনো হ্যাকার গ্রুপ থেকে। সে প্রথমে লগ ফাইল চেক করা শুরু করল। সাধারণত কোনো অ্যাপ ইনস্টল হলে তার রেকর্ড সিস্টেম লগে থেকে যায়। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। রণদীপ ভ্রু কুঁচকে বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার। কোনো ইনস্টলেশনের ট্রেস পাচ্ছি না।” তারপর সে প্রোগ্রাম ফাইলস ফোল্ডার, ইউজার ডিরেক্টরি, এমনকি রেজিস্ট্রিও খুঁজল—কিন্তু কোথাও কোনো ফাইল নেই যার নাম ‘ডিজিটাল ডাকিনী’। যেন অ্যাপটা ল্যাপটপে থেকেও নেই। অথচ অর্ণব বলল, “রাত বারোটার পর নিজে থেকে চালু হয়।” রণদীপ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, “মানে? এটা যদি সিস্টেমে না থাকে, তাহলে চালু হয় কীভাবে?” অর্ণব কেবল চুপ করে থাকল।

রণদীপ হাল ছাড়ল না। সে টার্মিনাল খুলে ডিপ স্ক্যান চালাল। সাধারণ অ্যান্টিভাইরাস বা ম্যালওয়্যার ডিটেকশন টুল না, বরং নিজস্ব স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করল। কয়েক মিনিট পর রণদীপ কপালে হাত চাপল—“না, কোনো এক্সিকিউটেবল ফাইল, কোনো হিডেন প্রসেস, কিছুই নেই। যেন কিছুই ইনস্টল হয়নি।” অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু এটা তো আমি দেখেছি, রণদীপ। চোখের সামনে আমার দাদুর মুখ ভেসে উঠেছে, আমি কথা বলেছি। তুই যদি এটাকে কেবল বাগ বা গ্লিচ বলিস, তবে আমি পাগল হয়ে যাব।” রণদীপ এবার শান্ত স্বরে বলল, “শোন, আমি তোর কথাকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু ডিজিটাল জগতে কিছুই ‘অস্তিত্বহীন’ হয় না। যদি কোনো অ্যাপ থাকে, তবে তার কোড, ফাইল, ডিরেক্টরি—কিছু না কিছু থেকে যায়। এটা যদি কিছু না দেখায়, তবে একে আমরা প্রচলিত ম্যালওয়্যার বলতে পারব না।” সে একটু থেমে যোগ করল, “এটা হয়তো এমন কোনো স্তরে কাজ করছে যেটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। কোয়ান্টাম কোডিং, জিরো-ডে এক্সপ্লয়ট, অথবা… অতিপ্রাকৃত কোনো কিছু।” শেষ কথাটা বলতেই অর্ণবের শরীরে ঠান্ডা স্রোত বইল।

রাত বাড়তে থাকল, কিন্তু দুজনেই ল্যাপটপের সামনে বসে রইল। রণদীপ চেষ্টা করল অ্যাপটিকে ফোর্স আনইনস্টল করতে, কিন্তু স্ক্রিনে কোনো আনইনস্টল অপশন নেই। এমনকি ‘টাস্ক ম্যানেজার’-এও অ্যাপের নাম দেখা যায় না। যেন পুরো সিস্টেমে অদৃশ্য থেকে কাজ চালাচ্ছে। হঠাৎ ঘড়িতে বারোটা বাজতেই স্ক্রিন কালো হয়ে গেল, আর তার ভেতর থেকে ভেসে উঠল সেই পরিচিত বিকৃত মুখ। রণদীপ প্রথমে আঁতকে উঠলেও দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, “এটা তো আমি দেখতে পাচ্ছি। মানে, এটা হ্যালুসিনেশন নয়।” কিন্তু এর পরের দৃশ্য দুজনকেই স্তব্ধ করে দিল—স্ক্রিনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল অর্ণবের মৃত দাদুর মুখ, স্পষ্ট কণ্ঠে ডাক দিল, “অর্ণব…” রণদীপের হাত হঠাৎ থেমে গেল কীবোর্ডের ওপর। এত বছর সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করার পরও এমন অস্বাভাবিক ঘটনা সে কখনও দেখেনি। সে চাপা গলায় বলল, “এটা ম্যালওয়্যার নয়, অর্ণব। এটা অন্য কিছু। ডিজিটাল দুনিয়ায় থেকেও এর কোনো অস্তিত্ব নেই।” সেই মুহূর্তে দুজনের চোখে একই ভয় ঝলসে উঠল—তারা হয়তো এমন এক দুনিয়ার দরজা খুলে ফেলেছে, যার অস্তিত্বই মানুষের জানা থাকার কথা নয়।

সেদিন রাতটা ছিল অন্যরকম নিস্তব্ধ। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, জানলার কাঁচে টুপটাপ শব্দ হচ্ছিল। অর্ণব বিছানায় শুয়ে থাকার ভান করছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। ঘড়ির কাঁটা বারোটার দিকে এগোচ্ছে দেখে তার বুক ধকধক করতে লাগল। প্রতিদিন এই সময়েই তো সেই অভিশপ্ত অ্যাপ নিজে থেকে খুলে যায়। ভেতরে ভেতরে সে চাইছিল আজ যেন কিছু না ঘটে, যেন সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু যতই অস্বীকার করুক, ভয়ের ছায়া তার চারপাশে জমাট বাঁধছিল। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা বারোটায় পৌঁছতেই, ল্যাপটপের স্ক্রিন নিজে থেকেই জ্বলে উঠল। প্রথমে স্বাভাবিক কালো পর্দা, তারপর ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক চেনা মুখ—কিন্তু সেটা দেখে অর্ণবের রক্ত হিম হয়ে গেল। স্ক্রিনে যে মুখটা, সেটা তার নিজের। তবে জীবিত অবস্থার নয়—মৃত, বিবর্ণ, চোখ দুটো ফাঁকা, ঠোঁট নীলচে। যেন কোনো শবদেহ সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। নিজের মৃতরূপের সঙ্গে হঠাৎ মুখোমুখি হওয়া যে কেমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, তা অর্ণবের শরীরের প্রতিটি শিরায় কাঁপন তুলে দিল।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য অর্ণবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে নিজের চোখে যা দেখছে তা সত্যি। ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল কপাল বেয়ে। হঠাৎ স্ক্রিনে চ্যাট উইন্ডো খুলে গেল, আর সেখানে ধীরে ধীরে টাইপ হতে শুরু করল কিছু শব্দ—“আমি তুই… তোর ভবিষ্যতের রূপ।” অর্ণব চমকে উঠে চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। তার মাথার ভেতর এক অদ্ভুত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছে? নিজের মৃত চেহারা তাকে সম্বোধন করছে? আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সে কী-বোর্ডে হাত রাখল, কিছু একটা টাইপ করতে গেল, কিন্তু আঙুলগুলো কাজ করছিল না। অবশেষে কাঁপা হাতে লিখল—“এটা সম্ভব না। তুই কে?” সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এলো—“আমি তোরই শেষ। তুই যত দূরে পালাবি, ততই আমার কাছে চলে আসবি।” এই কথাগুলো যেন অর্ণবের বুকের ভেতর শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলল। সে বুঝল না, এটা কি কোনো অদ্ভুত প্রোগ্রামিং ট্রিক, নাকি সত্যিই ভাগ্যের অদৃশ্য আঙুল তার সামনে তার মৃত্যুর ছবি এঁকে দিচ্ছে।

মিনিটগুলো যেন ঘন্টার মতো দীর্ঘ হচ্ছিল। স্ক্রিনের মৃত অর্ণব ঠোঁট নড়াল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তবুও তার চোখের ফাঁকা দৃষ্টিতে অর্ণব যেন শুনতে পাচ্ছিল এক গভীর শূন্যতার প্রতিধ্বনি। সে হঠাৎ কল্পনা করল, কোনো দিন হঠাৎ সত্যিই যদি সে মারা যায়, তবে কি এই চেহারাই হবে তার শেষ রূপ? বুকের ভেতর দমচাপা আতঙ্ক জমাট বাঁধতে লাগল। সে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিতে চাইল, কিন্তু আঙুল যেন অসাড় হয়ে গেছে। স্ক্রিনের লেখা আবারও ভেসে উঠল—“তুই পালাতে পারবি না।” এবার অর্ণব চিৎকার করে উঠল, চেয়ার ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল ঘরটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, দেয়ালের প্রতিটি কোণ থেকে সেই মৃত চেহারার চোখ তাকে তাড়া করছে। নিজেরই ভবিষ্যতের শবদেহ যেন তাকে ঘিরে ফেলছে। ভয় আর অবিশ্বাসে ভেঙে পড়ে সে বিছানার কোণে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল, আর ল্যাপটপের আলো নিঃশব্দে ঘরকে ভৌতিক রূপ দিয়ে যাচ্ছিল।

কতক্ষণ সে এভাবে বসে ছিল, তা অর্ণব নিজেই জানে না। হয়তো মিনিট দশেক, হয়তো এক ঘন্টা। একসময় হঠাৎ ল্যাপটপের স্ক্রিন নিভে গেল, ঘরটা আবার অন্ধকারে ডুবে গেল। কিন্তু অর্ণবের ভেতরে ভয়ের শেকড় এত গভীরে ঢুকে গেছে যে সে বিছানা থেকে নড়তেও পারল না। নিজের মুখের মৃত সংস্করণ দেখা, আর সেই মুখের দাবি—“আমি তুই”—এই অভিজ্ঞতা তার মনকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। সে বুঝল, এটা আর কেবল কোনো রহস্যময় অ্যাপ বা হ্যাকিং গেম নয়। এটা যেন ভাগ্যের আয়না, যেখানে তার মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি অগ্রিম দেখানো হচ্ছে। সেই রাতে অর্ণবের ভেতরে এক অদ্ভুত ভাঙন তৈরি হলো—সে চাইলেও বিশ্বাস করতে পারছিল না, আবার অস্বীকারও করতে পারছিল না। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ভেঙে পড়ল সে, যেন ধীরে ধীরে নিজেরই ভবিষ্যতের মৃত রূপের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো অদৃশ্য হাত।

অর্ণব সেই রাতের পর থেকে এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছিল না। ঘর অন্ধকার হলেই মনে হচ্ছিল, ল্যাপটপ হঠাৎ জ্বলে উঠবে আর তার মৃত রূপ চোখ গেঁথে তাকিয়ে থাকবে। দিনের বেলায়ও সে বারবার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল, ভয় পাচ্ছিল অ্যাপটা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু আসল ধাক্কাটা এলো আবারও এক মধ্যরাতে। বারোটার ঘন্টা বাজতেই ঘরের আলো কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেল, ল্যাপটপ খুলে গেল নিজে থেকেই। স্ক্রিনের ভেতর থেকে ভেসে উঠল সেই পরিচিত বিকৃত মুখ, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেখা গেল মৃত অর্ণব—ফাঁকা চোখ, নীল ঠোঁট, বিবর্ণ ত্বক। অর্ণব এবার চিৎকারও করতে পারল না, শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। চ্যাট উইন্ডো খুলে গেল, আর সেখানে ধীরে ধীরে লেখা হতে লাগল শব্দগুলো—“তুই মুক্তি চাইছিস? এই পথ থেকে বেরোতে চাইছিস?” অর্ণব কাঁপা হাতে লিখল—“হ্যাঁ… আমি চাই। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দে।” কয়েক মুহূর্ত কোনো উত্তর এলো না, শুধু স্ক্রিনের মৃত চেহারাটা হালকা কেঁপে উঠছিল। তারপর হঠাৎ লাইনগুলো ভেসে উঠল—“তাহলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকালো, কিছুই বুঝতে পারছিল না। টাইপ করতে করতে লিখল—“কোন সিদ্ধান্ত?” পরের মুহূর্তে উত্তর এলো, যা তার শরীরকে ভেতর থেকে হিম করে দিল—“তোর কোনো কাছের মানুষকে উৎসর্গ করতে হবে। তখনই আমি তোর জায়গায় যাব। না হলে ধীরে ধীরে তুই নিজেই মরে যাবি, আর আমার রূপ পূর্ণ হবে।” এই কথাগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের বুক ধকধক করে উঠল। সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। এটা কি কেবল ভয় দেখানোর কোনো কৌশল, নাকি সত্যিই অ্যাপটা তার জীবনের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ রাখে? সে লিখল—“না! আমি কাউকে উৎসর্গ করব না।” সাথে সাথে স্ক্রিনে মৃত অর্ণবের ঠোঁট একফোঁটা হাসিতে বাঁকলো। চ্যাট উইন্ডোতে ভেসে উঠল—“তাহলে তুই ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাবি। প্রতিদিন একটু একটু করে তোর ভেতরের আলো নিভে যাবে। তুই যেদিন সম্পূর্ণ শূন্য হবি, সেদিন আমি হয়ে যাবি পূর্ণ।” এই কথাগুলো যেন অর্ণবের মাথার ভেতর হাতুড়ির মতো আঘাত করল।

পরদিন সকালটা অর্ণবের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। সে অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারছিল না, মায়ার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছিল না। সবসময় তার মাথায় ঘুরছিল সেই সতর্কবার্তা—কাছের কাউকে উৎসর্গ করা, নাহলে নিজের মৃত্যু। সে মায়ার মুখের দিকে তাকালেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। রণদীপের কথা মনে পড়ছিল, যদি সবটা তাকে আবার বলে? কিন্তু ভয় হচ্ছিল, রণদীপ এবারও কিছু প্রমাণ পাবে না, আর সে নিজেই হয়তো আরো ভেতরে টেনে নেওয়া হবে। অফিসে বসে হঠাৎ দেখল, তার হাত কাঁপছে, আঙুলগুলো শীতল হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো যেন ভেতর থেকে কেউ তার শক্তি টেনে নিচ্ছে। সে আতঙ্কিত হয়ে টয়লেটে চলে গেল। আয়নায় নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠল—চোখের নিচে কালো দাগ, ঠোঁটের কোণে হালকা নীলচে ছোপ, মুখ একেবারে ফ্যাকাশে। মনে হচ্ছিল মৃত অর্ণবের ছায়া যেন ধীরে ধীরে তার শরীরে ভর করছে।

সেই রাতে বিছানায় শুয়ে অর্ণব অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করল নিজের সঙ্গে। একদিকে ভেতরের ভয় তাকে বলছিল—কাউকে উৎসর্গ কর, তাহলেই বাঁচবি। অন্যদিকে বিবেক তাকে ছিঁড়ে ফেলছিল—প্রিয় মানুষকে কি সে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য? মায়া, রণদীপ, এমনকি পরিবার—প্রতিটি মুখ ভেসে উঠছিল তার চোখের সামনে। তাদের কাউকে বেছে নেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছিল না। কিন্তু সেই মৃত রূপের ভয়াবহ দৃষ্টি তার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল। চ্যাট উইন্ডোতে ভেসে উঠল শেষ সতর্কবার্তা—“সময় ফুরিয়ে আসছে। সিদ্ধান্ত নে।” অর্ণব ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল, মাথা চেপে বসে পড়ল। সে জানত, যতই এড়িয়ে যাক, এই দ্বন্দ্ব তার ভেতরকে প্রতিদিন টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেবে। একদিকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা, অন্যদিকে কাছের মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া—এই দোটানার অন্ধকারে ডুবে গেল অর্ণব, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত তাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছিল সেই ডিজিটাল মৃত্যুর দিকে।

অর্ণবের দুঃস্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছিল। প্রতিদিন রাতের পর রাত তার শরীর আর মনকে গ্রাস করছিল অ্যাপের অভিশাপ। অবশেষে মায়া আর রণদীপ সিদ্ধান্ত নিল, এবার তারা একসঙ্গে দাঁড়াবে। মায়া আগেই টের পেয়েছিল, অর্ণব ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে, কিন্তু এবার সে স্পষ্টভাবে বুঝল, যদি কিছু না করা যায়, তবে অর্ণব হয়তো সত্যিই আর বাঁচবে না। এক সন্ধ্যায় তারা অর্ণবকে ঘিরে বসে কথা বলল। অর্ণব প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিল না, কিন্তু রণদীপের কঠিন দৃষ্টি আর মায়ার চোখের জলে ভিজে থাকা প্রশ্ন তাকে ভেঙে দিল। সে সব খুলে বলল—মৃত অর্ণব, সতর্কবার্তা, আর উৎসর্গের শর্ত। রণদীপ প্রথমে গম্ভীর হয়ে রইল, তারপর বলল, “এটা কোনো সাধারণ ম্যালওয়্যার নয়। এটা যেন একধরনের ডিজিটাল অভিশাপ, যা তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে গিয়েও আমাদের জীবনকে ছুঁয়ে ফেলছে।” মায়া অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমরা আছি তোর সঙ্গে। তুই একা নয়।” কিন্তু অর্ণবের ভেতরে ভয় জমাট বেঁধেছিল—সে জানত, তাদের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ভয়ের পরীক্ষা শুরু হলো। অর্ণবের ল্যাপটপ হঠাৎ নিজের মতো চালু হয়ে গেল। তারা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, তাই ডিভাইস অফ করার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। স্ক্রিনের কালো অন্ধকারে ভেসে উঠল ভয়ংকর সব মুখ—কখনো অজানা মৃত মানুষের, কখনো অর্ণবের নিজের বিকৃত রূপ। ঘরের বাতি একে একে নিভে গেল, অন্ধকারে শুধু স্ক্রিনের আলো ছটফট করছিল। হঠাৎ ঘরের ভেতর দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়া আঁকড়ে ধরল অর্ণবকে, আর রণদীপ মরিয়া হয়ে সিস্টেমের লগ ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু প্রতিবারই স্ক্রিনে এক ভয়ংকর হাসি ফুটে উঠছিল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ডিভাইস ঝাঁকুনি দিয়ে ক্র্যাশ হচ্ছিল। টেবিলের ওপরে রাখা ফোনগুলো নিজেরাই কাঁপতে লাগল, স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল একটাই বার্তা—“তোমরা পালাতে পারবে না।”

অর্ণব বুঝতে পারল, ডিজিটাল সীমা পেরিয়ে এই ভয়ংকর শক্তি বাস্তব জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। জানালার কাচ কেঁপে উঠছিল, দেয়ালে ছায়া নাচছিল, অথচ কোনো উৎস ছিল না। লাইট ফ্লিকার করতে করতে একসময় নিভে গেল, আর পুরো ঘর ডুবে গেল নিস্তব্ধ অন্ধকারে। হঠাৎ এক বিকট শব্দ হলো, যেন ভেতর থেকে কেউ ধাক্কা মারছে। মায়া ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু রণদীপ দাঁত চেপে বলল, “ভয় পেলেই শেষ। আমাদের লড়াই করতে হবে।” ল্যাপটপের স্ক্রিনে এবার শুধু অর্ণবের মৃত রূপ ভেসে উঠল। ফাঁকা চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে, ঠোঁট নড়ছে, আর চ্যাট উইন্ডোতে ভেসে উঠছে একেকটা শব্দ—“সময় ফুরিয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত।” অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, এটিই চূড়ান্ত মুহূর্ত। পালানোর কোনো পথ নেই।

ঘরের ভেতরে বাস্তব আর ডিজিটাল ভৌতিক দুনিয়া এক হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ অর্ণব অনুভব করল, তার দেহ ভারী হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসছে। মৃত রূপটা যেন স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে তার ভেতরে প্রবেশ করছে। সে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। মায়া তার কাঁধ ধরে টানতে লাগল, রণদীপ মরিয়া হয়ে ল্যাপটপের তার খুলে ফেলল, কিন্তু কিছুই থামল না। বরং ঘরের দেয়াল জুড়ে ভেসে উঠল সেই মৃত অর্ণবের ভয়াবহ মুখ, একসঙ্গে শত শত প্রতিচ্ছবি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সেই মুহূর্তে অর্ণব বুঝল, পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই। এই অভিশপ্ত খেলা থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে শেষ লড়াইটা দিতেই হবে—না হলে তার ভবিষ্যৎ সত্যিই মৃত্যু হয়ে যাবে। আতঙ্কে ভেঙে পড়া চোখে সে মায়া আর রণদীপের দিকে তাকাল, মনে মনে শেষ সাহসটুকু জড়ো করল, আর নিজেকে প্রস্তুত করল মৃত্যুর ছায়ার সঙ্গে চূড়ান্ত মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

১০

অর্ণবের জীবনের শেষ রাতটি যেন এক অচেনা শূন্যতার মধ্যে গলে যাচ্ছিল। ঘরের বাতি নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগে, শুধু ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিস্তব্ধ নীল আলো ভাসছিল। মায়া আর রণদীপ তখন পাশের ঘরে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল, তারা ঘন্টার পর ঘন্টা এই ভয়ংকর লড়াইয়ের ধাক্কা সামলাতে পারছিল না। কিন্তু অর্ণব জানত, শেষ লড়াই তাকে একাই লড়তে হবে। স্ক্রিনে তার মৃত রূপ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ফাঁকা চোখের গভীরতা যেন শূন্যতার চেয়েও গভীর, ঠোঁট নড়ে উঠে গর্জে উঠল—“তুই আর আমি আলাদা নই।” সেই শব্দ অর্ণবের মাথার ভেতরে বাজতে লাগল, যেন হাড়গোড় চূর্ণ করে দিচ্ছে। অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না… আমি তো বাঁচতে চাই… আমি আলাদা…” কিন্তু শব্দগুলো মিশে গেল এক নিঃশব্দে। ল্যাপটপের আলোয় অর্ণব নিজেকে দেখতে পেল—তার মুখ ক্রমে মৃত রূপের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, চোখের কালো গহ্বর এক হয়ে যাচ্ছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব আর ডিজিটালের সীমারেখা ভেঙে পড়ল, সে আর বুঝতে পারছিল না—সে জীবিত, নাকি অনেক আগেই মারা গেছে।

মুহূর্তগুলো যেন অসীম হয়ে যাচ্ছিল। অর্ণব অনুভব করল, তার চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে গেছে, বুকের ভেতর শ্বাস টেনে আনতে কষ্ট হচ্ছে। মৃত রূপটি এবার চ্যাট উইন্ডোর বদলে সরাসরি কণ্ঠে কথা বলল—গম্ভীর, ঠান্ডা, অথচ অর্ণবের নিজের মতোই পরিচিত স্বর। “তুই যতই লড়িস, শেষ অবধি আমার কাছেই আসতে হবে। কারণ তুই-ই আমি, আমি-ই তুই।” এই বাক্যগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের মাথার ভেতর ঝড় বয়ে গেল। মনে হলো যেন স্মৃতিগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, সবকিছু ভেসে যাচ্ছে অন্ধকারে। হঠাৎ সে মায়ের মুখ, বাবার স্নেহ, মায়ার হাসি—সব দেখতে পেল। মনে হলো, যদি সে এখন হাল ছেড়ে দেয়, তবে শুধু নিজের জীবনই নয়, সব ভালোবাসা, সব সম্পর্কও মুছে যাবে। অর্ণব হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, “না! আমি তোর মতো হব না। আমি তুই নই।” চিৎকারটা যেন ঘরের ভেতরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল, কিন্তু তার ফল হলো অদ্ভুত। স্ক্রিন হঠাৎ একবার ঝলসে উঠল, মৃত রূপের মুখ বিকৃত হয়ে গেল, ঠোঁট থেকে রক্তের মতো কিছু ঝরে পড়তে লাগল।

কিন্তু অর্ণব জানত, এটাই শেষ প্রতিরোধ নয়। ল্যাপটপ কেঁপে উঠতে লাগল, হঠাৎই ঘরের সবকিছু কাঁপতে শুরু করল। মেঝে ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ হলো, আর অর্ণবের চোখের সামনে মৃত রূপটা যেন সরাসরি স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এলো। অন্ধকার শরীর, ফাঁকা চোখ, বিবর্ণ ঠোঁট—ঠিক তারই আরেকটা ছায়া। তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। সেই রূপ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “তুই যতই প্রতিরোধ করিস, তোর ভেতরের শূন্যতা আমায় ডাকছে।” অর্ণব এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। ভেতরে ভেতরে যে ভয় তাকে ভেঙে দিচ্ছিল, সেটাকে শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর মুঠি শক্ত করে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বাঁচব। আমার ভালোবাসা, আমার মানুষদের জন্য আমি বাঁচব।” যেন সেই কথাগুলো আলো হয়ে বেরিয়ে এলো, আর মৃত রূপটা পিছিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, অন্ধকারটা সরে যাচ্ছে, আলো ফিরে আসছে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ল্যাপটপ হঠাৎ নিভে গেল, সব আলো অদৃশ্য হয়ে গেল, আর চারপাশ ভরে গেল এক ভীতিকর নীরবতায়।

অর্ণব চমকে চারপাশে তাকাল। ঘর নিঃশব্দ, ল্যাপটপ অন্ধকার। মনে হলো, হয়তো সে মুক্তি পেয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে বসে পড়ল। কিন্তু তখনই মায়ার ফোন থেকে হালকা একটা শব্দ হলো—“টিং।” মায়া অচেতন থাকলেও ফোনটা কাঁপতে শুরু করল। অর্ণব হাত বাড়িয়ে সেটি তুলে নিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি নতুন নোটিফিকেশন—“ডিজিটাল ডাকিনী – নতুন ব্যবহারকারী সক্রিয় হয়েছে।” অর্ণবের বুক ধক করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ভয়ংকর সম্ভাবনা—সে কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে, নাকি অভিশাপ এখন মায়াকে গ্রাস করতে যাচ্ছে? ফোনের পর্দায় প্রতিফলিত আলোয় অর্ণব নিজের মুখ দেখল, কিন্তু সেটি কেমন যেন অচেনা, ঠান্ডা, নিরাবেগ। সে বুঝতে পারল না—সে কি বেঁচে আছে, নাকি তার মৃত্যু কেবল অন্য কারও শুরু হয়ে গেল। ঘরের নীরবতায় শুধু সেই নোটিফিকেশনের আলো টিমটিম করছিল, আর অর্ণবের ভেতরে বেজে চলেছিল এক অসহায় প্রশ্ন—ডিজিটাল মৃত্যু না মুক্তি, আসলে কোনটা তার নিয়তি?

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *