অর্ঘ্য মজুমদার
পর্ব ১: চায়ের দোকানটা অদ্ভুত ছিল
শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডের ঠিক এক কোণায় একটা ছোট্ট চায়ের দোকান আছে, নাম—”ডার্ক চা”। দোকানটা যতটা ছোট, ততটাই অদ্ভুত। এখানে চা বানানো হয় একটা পুরনো কেতলিতে, যার মুখে লাল রঙের একটা পাথর বসানো। দোকানের মালিক একটা তরুণী—নির্মা, বছর সাতাশের মতন বয়স। লম্বা কালো চুল, সিঁথিতে লাল সুতো, চোখে অদ্ভুত ঠান্ডা দৃষ্টি। তার চা খেলে কেউ না কেউ কিছু একটা ভুলে যায়—পুরনো প্রেমিকের নাম, নিজের মোবাইলের পাসওয়ার্ড, বা একটা দুঃস্বপ্ন। শহরের কিছু মানুষ হাসতে হাসতে বলেন, “ও চা না, ডাকিনির পান!” কিন্তু কেউই অদ্ভুতভাবে দূরে থাকে না। বরং সন্ধে হতেই দোকানটা জমে ওঠে—কলেজ পড়ুয়া থেকে প্রাইভেট কোম্পানির ছেলেপেলে, এমনকি এক-আধজন পুলিশের গোয়েন্দাও।
নতুন এসেছিল অনিক, কলকাতা থেকে বদলি হয়ে। পুলিশ ইনটেলিজেন্সে কাজ করে, ভেতরের তদন্ত, মানুষের মনের খুঁটিনাটি বোঝা, এসবই তার কাজ। প্রথম দিনই সহকর্মী জ্যোতির্ময় তাকে নিয়ে যায় ডার্ক চা-তে। “ওই মেয়েটার চা খাও, বুঝবি,”—বলতে বলতে ঢুকে পড়েছিল তারা দুজন। নির্মা একবার তাকিয়েছিল অনিকের চোখের দিকে, একটা হালকা হাসি ফুটেছিল তার ঠোঁটে, যেন চিনে ফেলেছে ছেলেটাকে।
“চা কোনটা খেতে চাই?” নির্মা জিজ্ঞেস করল।
“যেটা আপনি সাজেস্ট করবেন,” অনিক বলেছিল স্বাভাবিক গলায়।
নির্মা কোনো উত্তর না দিয়ে পেছনে ঘুরে গেল। সে যখন ফিরে এলো, হাতে কেতলি, কাপ ভর্তি ধোঁয়া ওঠা কালচে লিকার।
“এটা খেলে কাল রাতের খারাপ স্বপ্নটা মনে থাকবে না,” নির্মা বলল নিঃশব্দে।
অনিক চমকে উঠেছিল, কিন্তু সেটা সে চাপা দিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নেয়।
চা ছিল আশ্চর্যরকম তিক্ত, কিন্তু শেষে যেন মিষ্টির একটা দাগ ছিল। সে চুমুক দিল, আর চমকে উঠল—তার মাথায় হঠাৎ ভেসে উঠল এক সাদা পাড়ের লাল শাড়ি পরা মেয়ের মুখ। মুখটা ঝাপসা, কিন্তু চোখ জোড়া ঠিক নির্মার মতোই শীতল। সে চোখ বন্ধ করল, আর মুহূর্তেই দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল। চা শেষ করে সে কাপটা নামিয়ে রাখল, কণ্ঠে কাঁপন নিয়ে বলল, “আপনি কী করেন ওই কেতলিতে?”
নির্মা শুধু বলল, “অনিক, আপনাকে কেউ পাঠিয়েছে, তাই না?”
অনিক থমকে গেল।
“তুমি কীভাবে জানো আমার নাম?”
“তোমার গন্ধে,” নির্মা বলল শান্তভাবে।
“মানে?”
“তুমি যা বিশ্বাস করো, তা নিয়ে এসেছো তোমার গায়ে। আমি সেই বিশ্বাসের গন্ধ পাই। তুমি এসেছো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে?”
অনিকের গলা শুকিয়ে গেল।
“তুমি কি সত্যিই… একজন ডাইনি?”
নির্মা তার চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার ঠাকুমা ছিলেন, তার ঠাকুমাও। আমি শুধু উত্তরাধিকার। আমার কোনো জাদু নেই—শুধু কিছু কথা, কিছু মন্ত্র, আর মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা ভয় বোঝার ক্ষমতা। তাতে যদি আমাকে ডাইনি ভাবো, ভাবো।”
চায়ের দোকানের বাইরে বৃষ্টি নামছিল হালকা। ভিতরে অনিক বসেছিল গম্ভীর মুখে। সে জানত, এই মেয়েটাকে অবলীলায় অবিশ্বাস করা যাবে না। তার ফাইলেও কিছু লেখা ছিল—ক্লাস ১২-তে পড়ার সময় এক সহপাঠী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল নির্মার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনজন ছাত্রী স্বপ্নে ‘একই রকম নারীর মুখ’ দেখেছিল বলে আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। এবং ঠিক পাঁচ মাস আগে, শিলিগুড়ির এক রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুর আগের রাতেও তিনি নাকি ডার্ক চা-তে চা খেয়েছিলেন।
অনিক উঠে দাঁড়াল, “আবার আসব,”—বলে চলে গেল। পেছন থেকে নির্মা বলল, “তুমি যত আসবে, ততই হারাবে। আমি শুধু দিয়ে যাই, নিতে জানি না।”
বাইরে গড়িয়ে চলা রেললাইনের ধারে হঠাৎ একটা চিত্কার ভেসে এলো—একটা কালো বিড়াল রাস্তা পেরোতে গিয়ে ট্রাকের নিচে পড়ে গেছে। হঠাৎ ছাদে বসে থাকা আরেকটা কাক ‘কা কা’ করে ডেকে উঠল, আর নির্মা ধীরে ধীরে দোকানের কেতলির মুখে লাল পাথরটা ঘষে বলল, “আজ রাত শুরু হল।”
পর্ব ২: স্মৃতির খাতা খুলল যেদিন
শিলিগুড়ির সেই বর্ষাস্নাত সন্ধ্যা যেন থমকে ছিল। হিলকার্ট রোডের গলিপথে কুয়াশা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে, আর তার ফাঁকে দাঁড়িয়ে ছিল অনিক, হাতে তার অফিস ফোল্ডার আর মাথায় হাজার প্রশ্ন। সে জানত—নির্মা নামের এই মেয়েটা কোনও সাধারণ চাওয়ালিকে মতো নয়। ওর চা-এ কিছু আছে। ওর চোখে এক রকম ধৈর্য আছে, যা মানুষ এক জীবনে ধারণ করতে পারে না।
পরদিন সকালে, অফিসে বসে সে নির্মার পুরনো রেকর্ড খুলে বসেছিল। নাম: নির্মা সাহা। জন্ম: নিউ জলপাইগুড়ি রোড, ১৯৯৮ সালের নভেম্বর। বাবা অজয় সাহা, মৃত। মা অনিমা সাহা, মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য ২০১১ সাল থেকে দার্জিলিংয়ের একটি আশ্রমে। একটা অস্বাভাবিক তথ্য সে আবিষ্কার করল—নির্মা প্রতি বছর অমাবস্যার রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য গায়েব হয়ে যায়, কোনো মোবাইল ট্র্যাকিং বা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে না। অথচ সেই রাতে শহরে কোনো না কোনো এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—কারো প্রেমে ছ্যাঁকা, কেউ পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টাও করে।
দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে অনিক আবার ফিরে গেল ‘ডার্ক চা’-তে। দোকান তখন খালি, শুধু নির্মা একটা পুরনো বইয়ে চোখ গুঁজে বসে আছে। অনিক ঢুকতেই সে মুখ তুলে তাকাল না, বলল, “আজকে তো কিছু ভুলতে আসোনি, তাই না?”
“আজ কিছু জানতে এসেছি,” অনিক শান্ত গলায় বলল।
নির্মা মাথা তুলল। “যা জানতে চাও, সব জানতে গেলে মানুষ বাঁচে না। অল্প জেনে থাকাই শান্তি।”
“তুমি গায়েব হয়ে যাও প্রতি অমাবস্যায়। কোথায় যাও?” অনিক সোজাসুজি প্রশ্ন করল।
নির্মা এবার একটু হেসে ফেলল। তার হাসিটা ছিল অতল গভীর, যেন শিলিগুড়ির গাঢ় সবুজ রেইন ফরেস্টের মতোই রহস্যময়।
“গাইড লাইন দিয়ে বলতে গেলে, আমি থাকি। শুধু এই শরীরটা এখানে থাকে না। তুমি কি জানো, চা-পাতার প্রতিটা গন্ধ আলাদা? যেমন আছে স্মৃতির চা, যেমন আছে স্বপ্নের চা। আমি তৈরি করি ওগুলো।”
“তুমি বলছো তুমি জাদুকরী?”
“আমি বলছি না কিছুই। তুমি নিজে বিশ্বাস করতে চাইলে করো। তুমি তো বিশ্বাস নিয়ে কাজ করো, তাই না? মানুষ কীভাবে ভাবে, কীভাবে ঠকে, সেইসব। আমি শুধু চিনে ফেলি। আমি কারও মাথায় হাত রাখি না, শুধু একটু ঠোঁট ছুঁইয়ে দিই কেতলিতে। বাকিটা চা জানে।”
অনিক থমকে গেল। নিজের মনের মধ্যে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ঢুকে পড়ল—ও যদি সত্যিই ডাইনি হয়, তবে কেন এত সাহস করে দোকান চালায়? কেন পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থাকে না? নাকি তার ভয়টাই অন্য?
“তোমার মা এখন কোথায়?” অনিক জিজ্ঞেস করল।
নির্মা এবার চুপ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল চায়ের কেতলির দিকে, তারপর বলল, “আমার মা আর আমি একই ডায়েরির দুটো পাতার মতো। একটাতে লেখা শুরু হয়েছিল, আর একটাতে শেষ হবে। তিনি এখন কথা বলেন না। শুধু মাঝে মাঝে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলেন—‘আগুনে সব পুড়িয়ে দে। যেসব চোখ চা খায় না, ওদের পুড়িয়ে দে।’ তুমি যদি ওর চোখে তাকাও, দেখবে তুমি নিজেকে ভুলে যাবে। আমি তাই সেখানে যাই না।”
সন্ধে হয়ে আসছিল। দোকানে ঢুকতে শুরু করল একে একে পরিচিত মুখ—সায়ন্তন, লোকাল রিপোর্টার, যে পাগলের মতো নির্মার চায়ের প্রেমে; জয়ন্ত, পুরনো কলেজ প্রেমিক, যে এখন স্ত্রী নিয়ে শহরে থাকলেও প্রতি সপ্তাহে একদিন ঠিক আসে; আর আসে কাকাবাবু—একজন বৃদ্ধ, যিনি বলেন তিনি বারো বছর আগে মারা গিয়েছেন, কিন্তু এখনও প্রতি অমাবস্যায় নির্মার হাতে চা খান।
অনিক সেই চা-কাপগুলোর ভেতরে চোখ রাখল। প্রতিটা কাপেই যেন একটা করে গল্প লুকিয়ে আছে, আর প্রতিটা গল্পের শেষে এসে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—নামহীন, অন্ধকার, কিন্তু গভীর।
হঠাৎ দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি নজরে পড়ল অনিকের। কালো ফ্রেমের ভেতরে পুরনো একটা স্কেচ, এক নারীর ছবি, যার চোখ নির্মার চোখের মতোই। নিচে লেখা—‘অগ্নিদেবী, ১৮৯১’।
“কে উনি?” অনিক জিজ্ঞেস করল।
“আমার পূর্বপুরুষ। যাকে ব্রিটিশরা ডাইনি বলে পুড়িয়ে দিয়েছিল চায়ের খেতের এক কোণে। ও বলেছিল—আমি আবার ফিরব, ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে, মানুষের ভুলে যাওয়ার ইচ্ছায়। তখনও জানত না, তার রক্ত আমার শরীর বেয়ে বইবে।”
অনিক এবার একটু ভয় পেল। কাঁপা গলায় বলল, “তুমি চাও কী?”
নির্মা চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “একটা জায়গা। এক কোণ। শহরের একটা সীমানা, যেখানে মানুষ ভুলে যেতে আসে। আমি কাউকে খাই না, শুধু তাদের ভুলে যেতে সাহায্য করি। এটা কি অপরাধ?”
অনিক জানে না এর উত্তর। সে জানে শুধু একটাই কথা—এই মেয়েটা তার ফাইলে লেখা একাধিক রহস্যজনক ঘটনার মূল সূত্র। অথচ তার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা চোখ দিয়ে ধরা যায় না, কিন্তু চা দিয়ে বোঝা যায়।
তিন নম্বর চুমুকের পর সে হঠাৎ নিজের ছেলেবেলার একটা ছবি মনে করতে পারল না—তার বড় মামার বাড়ির উঠোনে একটা আমগাছ ছিল, সে গাছের নিচে বসে সে খেলত। এখন জায়গাটা মনে আছে, গাছটাও মনে আছে, কিন্তু সেই উঠোনের আম গন্ধ—সে আর মনে করতে পারল না।
সে তাকাল নির্মার দিকে। নির্মা হাসছিল।
“তুমি চাইলে আমার খাতা দেখতে পারো,” সে বলল।
“কোন খাতা?”
“যেখানে সব ভুলে যাওয়া মানুষদের নাম লেখা আছে। কেউ কেউ ফিরে পায়, কেউ পায় না।”
আরো এক চুমুক, আর অনিকের কানে বাজল নির্মার ফিসফিস—“তুমি আসলে এখানে কেন এসেছো, সেটা ভুলে যেতেই তো না?”
পর্ব ৩: ভুলে যাওয়ার মন্ত্র
শিলিগুড়ির বিকেল তখন গাঢ় ধোঁয়ায় মোড়া, শহরের পুরনো রাস্তাগুলো যেন পুরনো পাণ্ডুলিপির পাতায় লেখা গোপন ইতিহাসের মতো দেখতে। হিলকার্ট রোডের কোল ঘেঁষে থাকা ‘ডার্ক চা’ দোকানটার ভেতরে আলো ম্লান, কিন্তু গন্ধে ভরপুর। সেই চায়ের কেতলি থেকে উঠে আসা ধোঁয়া যেন কেবল জলীয় বাষ্প নয়, একেকটা অতীতের অলিখিত নোট।
অনিক আজ আর অফিসে যায়নি। বসের কাছে বলে দিয়েছে সে বিশেষ তদন্তে আছে। তার ডেস্কের ওপর খোলা আছে নির্মার ‘মনিটরিং ফাইল’—যেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা: “সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেটর, হাই রিস্ক। অবজারভেশন রিকোয়ার্ড।” তবে সেই রেকর্ড যতই সে পড়ে, ততই যেন নির্মাকে সে বুঝতে ব্যর্থ হয়। সে একাধারে অতীত, একাধারে আগুন, আর তৃতীয় কোনও রকম অস্তিত্ব—যাকে ভাষায় ধরা যায় না।
সন্ধে ছ’টার সময় আবার দোকানে পৌঁছল অনিক। নির্মা তখন একা বসে, সামনের টেবিলে ছড়িয়ে রাখা এক খাতা, তার ভেতর কালো কালিতে লেখা কয়েকটা নাম:
রূপক দত্ত – ভুলে গিয়েছিল বাবার মুখ
কাবেরী ঘোষ – ভুলে গিয়েছিল কাকে বিয়ে করেছিল
শ্রেয়সী দে – ভুলে গিয়েছিল নিজের গান
অনিক জিজ্ঞেস করল, “এই নামগুলো কাদের?”
নির্মা বলল, “যারা আমার চা খেয়ে কিছু না কিছু ভুলে গেছে। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ না জেনেই।”
“তুমি কি জেনে-শুনে মানুষকে ভুলিয়ে দাও?”
“আমি শুধু পথ দেখাই। মানুষ ভুলে যেতে চায়—যার সঙ্গে তার রাত জাগা কেটেছে, যার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েও শেষমেশ কিছু পায়নি। আমি কেবল একটা মাত্র চুমুকের রাস্তা তৈরি করে দিই।”
অনিক এবার চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, “আমিও ভুলতে চাই।”
নির্মা থমকে গেল।
“কি ভুলতে চাও?”
“আমার ভাইয়ের মৃত্যু।” অনিকের গলায় হঠাৎ এক অপার ব্যথা নেমে এলো।
“বছর তিনেক আগে, আমার ছোট ভাই অনিরুদ্ধ আমাদের ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। আমরা কেউ ধরতে পারিনি। পরে জানা গেল, সে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিল। আমি ব্যস্ত ছিলাম অফিস, প্রেমিকা, বিয়ের প্যান্ডেল—কিছুই শুনিনি ওর। শুধু যখন ও ঝাঁপ দিল, তখন আমি ছিলাম ফোনে… আর এখন প্রতিটা দিন আমি ওর মুখ দেখি, আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। আমি ভুলতে চাই, নির্মা। শুধু একটিবারের জন্য।”
নির্মা চুপ করে গেল কিছুক্ষণ। তারপর হালকা গলায় বলল, “তুমি জানো, কিছু কিছু দুঃখ থাকে যা ভুলে গেলে মানুষও বদলে যায়? তুমি এখন যে অনিক, সে তখন থাকবে না। তুমি হয়তো একেবারে অন্য একজন হয়ে যাবে।”
“হোক। অন্তত আমি রাতে ঘুমোতে পারব।”
নির্মা তখন কেতলি হাতে নিল, ধীরে ধীরে চা ঢালল কাপে। এবার সে তার আঙুল দিয়ে কেতলির লাল পাথরটা ছুঁয়ে বলল, “এই চায়ের নাম—অগ্নিচুম্বন। এটা একবার চুমুক দিলেই, তোমার মন তার সবচেয়ে পোড়া স্মৃতিটা ছেড়ে দেবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে—তুমি আর সেই জায়গায় ফিরতে পারবে না। যেখানে ওই স্মৃতি ছিল।”
অনিক চা হাতে নিল, থরথর করে উঠল হাত। ধোঁয়া কুয়াশার মতো ঘুরছে চারপাশে। নির্মা সামনে এসে দাঁড়াল।
“তুমি নিশ্চিত?”
অনিক এক চুমুক দিল।
প্রথমে একটা উষ্ণতা বুক জুড়ে ছড়িয়ে গেল। তারপর হঠাৎ এক শূন্যতা—যেন কিছু একটা ছিল মাথার মধ্যে, হঠাৎ নেই হয়ে গেল। সে আবার চুমুক দিল। এবার যেন পেছনের দোকান, আলোর ঝিলিক, নির্মার মুখ—সব কিছু হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করল।
একটা ফাঁকা ছাদ। একটা গাছতলায় পড়ে থাকা ছায়া। একটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কল হিস্টরি—“মিসড কল: অনিরুদ্ধ (৫)”
সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ ভার হালকা হয়ে গেল।
সে চোখ খুলল।
“আমি… আমি কি ভুলেছি?”
নির্মা কিছু বলল না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে হাসল।
“তুমি কে?” অনিক প্রশ্ন করল।
নির্মা চুপ করে থাকল।
“মানে… আমি কোথায় আছি?”
“তুমি সেই চায়ের দোকানে, যেখানে মানুষ ভুলে যেতে আসে,” নির্মা বলল।
“আমার ভাই… আমি তো ভাইয়ের কথা মনে করতে পারছি না! ওর নাম… ওর মুখ… সব কিছু ঝাপসা!”
নির্মা এবার চুপ করে বলল, “এইটুকুই চেয়েছিলে তো?”
অনিক উঠে দাঁড়াল। তার মনে হচ্ছে কিছু একটা সে ফেলে এসেছে, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছে না। তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল, গ্যালারিতে একটা ফোল্ডার—নামের জায়গায় লেখা: “ভাই…”—সে খুলল, কিন্তু ভিতরটা ফাঁকা।
তারপর সে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।
কিন্তু তখনও নির্মা পেছনে তাকিয়ে বলল, “একদিন ফিরবে তুমি। একদিন মনে পড়বে, তুমি কী চেয়েছিলে ভুলে যেতে, আর কী হারিয়ে ফেললে।”
আর সেই রাতে, নির্মা তার খাতা খুলে নতুন একটা নাম লিখল:
অনিক সরকার – ভুলে গিয়েছিল নিজের গ্লানি, হারিয়ে ফেলেছিল ভাই।
পর্ব ৪: লাল চিঠির জবাব
অনিক দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রাতটা নেমে এলো শিলিগুড়ির উপরে এক ধরনের অস্পষ্ট আলো আর অচেনা নীরবতা নিয়ে। শহরের চা-বাগানের কুয়াশা যেন হিলকার্ট রোড ধরে এসে জমে উঠল ‘ডার্ক চা’-র সামনে। নির্মা একা বসে ছিল টেবিলের ওপাশে, কেতলির নিচে থাকা আগুনটা ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। গন্ধটা একসময় ঘরে ঢুকে থাকা কিছুকে জাগিয়ে তুলল।
পেছনের আলমারি থেকে সে টেনে বের করল একটা ছোটো কাঠের বাক্স। ভেতরে ছিল চামড়ার মোড়া একটা খাতা, যার গায়ে একটা সোনালী চিহ্ন—আগুনের মতো ঘূর্ণি। খাতাটা সে খুলল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল:
“এ আমার উত্তরাধিকার। আমার আগে যারা ভুলিয়ে দিয়েছে, তারা সব এখানে আছে। আজ থেকে আমার নামে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হল। নির্মা সাহা, চতুর্থ স্তরের বাহক।”
নিচে লিপিবদ্ধ নামগুলোর পাশে ছিল তারিখ আর কী ভুলেছিল তারা। অনিকের নাম এখন সদ্য যোগ হয়েছে। কিন্তু তার নীচেই হঠাৎ একটি পুরনো নাম চোখে পড়ল—সায়ন্তন চক্রবর্তী – ভুলে গিয়েছিল নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সাক্ষাৎকারের দিন।
নির্মা থমকে গেল।
সায়ন্তন?
সে যে প্রতিদিনই আসে চায়ের দোকানে। যে প্রায় প্রতিবারই নতুন গল্পের খোঁজে আসে, তার ক্যামেরায় দোকান, চায়ের ধোঁয়া, পেছনের আলপনা—সব কিছু ফ্রেমবন্দি করে। নির্মা হঠাৎ বুঝল, সে সেই সায়ন্তনের সঙ্গে আজ পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি যা তার ভেতরের কথা ছুঁয়ে গেছে। সে ছিল একজন খদ্দের, একজন নিয়মিত প্রেমিক, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল না কোনো অতীতের কথা।
সেদিন রাতে, হঠাৎ দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সায়ন্তন। হাতে তার ক্যামেরা, চোখে সারারাত না ঘুমোনোর ক্লান্তি।
“আজ একটা ছবি তুলতে পারি তোমার?”
নির্মা তাকাল।
“আমার ছবি তুললে ভুলে যাবে নিজেকে।”
“তাই তো চাই। তোমার ভেতরে একটা ধোঁয়া আছে, নির্মা। সেটা চায়ের নয়, সেটা মানুষের হাড়ে জমে থাকা অতৃপ্তি থেকে উঠে আসে। আমি চাই সেটা ধরে ফেলতে।”
নির্মা এবার উঠে দাঁড়াল, ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে থাকল।
“তুলে ফেলো।”
ক্লিক।
কিন্তু ক্যামেরার স্ক্রিনে ফুটে উঠল এক কালো ফ্রেম। নির্মা নেই। চায়ের দোকান ঠিকঠাক আছে, ধোঁয়া ঘুরছে, কিন্তু নির্মা অনুপস্থিত। সায়ন্তন চোখ কুঁচকে তাকাল।
“তুমি… ফ্রেমে আসছো না!”
নির্মা হেসে ফেলল।
“আমি অনেক আগেই ফ্রেম ছেড়েছি, সায়ন্তন। তুমি শুধু আমাকে খুঁজে চলেছ।”
সায়ন্তন এবার বলল, “তুমি কি মনে করো আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম সেই সাক্ষাৎকারটা? না, আমি তোমার চা খেয়ে মনে রেখেছিলাম, কিন্তু ভান করেছিলাম যেন কিছু ভুলেছি। আমি দেখেছিলাম কীভাবে তুমি মানুষদের থেকে তাদের নিজেরই স্মৃতি চুরি করো। তাই তো আমি আসি প্রতিদিন—দেখতে, শিখতে। তুমি একা নও, নির্মা। তোমার মতো আরেকজনকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম কুচবিহারে। তার নাম ছিল মীরা। সে গান গাইত, আর গানের মাঝখানে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলত।”
নির্মার চোখে কিছু একটার শিহরণ খেলে গেল।
“তুমি মীরাকে চেনো?”
“চিনি না, শুধু তার শেষ গান শুনেছিলাম। সে আমাকে বলেছিল—‘যারা ভুলিয়ে দেয়, তারা নিজেরাও একসময় ভুলে যায় নিজের শরীরকে।’ এখন বুঝি, সে ঠিক বলেছিল।”
সায়ন্তন এবার একটা ছোট্ট লাল খাম বার করল।
“এই চিঠিটা পেয়েছিলাম মীরার কাছ থেকে, ঠিক তার মৃত্যুর আগে। সেখানে লেখা ছিল—‘যদি নির্মাকে পাও, এই চিঠিটা তাকে দিও।’”
নির্মা হাত কাঁপতে কাঁপতে খামটা নিল।
ভেতরে কালি-ছাপা অদ্ভুত অক্ষরে লেখা:
“তুমি আগুন বহন করো, আমি করেছিলাম জল। কিন্তু একদিন সব শক্তি মিশে যাবে—এমন একজন আসবে যে ভুলে যাবে ভুলতেও। আর সে-ই আমাদের মিথ্যে করবে।”
নির্মার চোখ ঠান্ডা হয়ে গেল।
“কে আসবে?”
সে ফিসফিস করে নিজেকেই জিজ্ঞেস করল।
“যে ভুলে যাবে ভুলে যাওয়ার অর্থ। যাকে তুমি চা দেবে, কিন্তু সে ভুলবে না কিছুই। বরং সে বুঝে যাবে—তুমি চুরি করো, দিয়ে দাও না।”
সায়ন্তন এবার কৌতূহল নিয়ে বলল, “তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”
নির্মা ধীরে ধীরে বলল, “ভয় নয়। আমি প্রস্তুত হচ্ছি।”
সেই রাতেই, নির্মা তার খাতা বন্ধ করল। প্রথমবার, সে তার দোকানের দেয়াল থেকে আগুনের প্রতীক খসে নামাতে লাগল। তার ঠাকুরমার দেওয়া পাথরের কেতলিটা তুলল দু’হাতে। বাইরে কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি—মুখ দেখা যায় না, শুধু তার গলায় একটা নীল ঝোলানো ব্যাগ।
ছায়াটি বলল, “তুমি প্রস্তুত?”
নির্মা বলল, “আর কত জনের স্মৃতি নেব আমি? আর কতজন আসবে আমার দোকানে? আমি তো আর চিনি না তাদের চোখ।”
ছায়া বলল, “তোমার পথ এবার বদলাবে। অমাবস্যার রাতের আগেই সে আসবে, যে কিছুই ভুলবে না।”
“আর যদি আমি হারিয়ে ফেলি নিজেকে?”
“তবে মনে রাখবে, নির্মা—তুমি একা নও।”
পর্ব ৫: যে কিছুই ভুলতে আসেনি
শিলিগুড়ির আকাশ যেন সকালবেলায়ও গাঢ় রঙে আঁকা থাকে—হলদে মেঘ আর কুয়াশার লেপ। ‘ডার্ক চা’ দোকানটা ছিল অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি নিঃস্তব্ধ। কেতলি নিঃশব্দে বসে ছিল আগুনের ওপর, গ্যাস বার্নারের শব্দটাও যেন আজ ঢিলে। নির্মা জানে, সময় ঘনিয়ে এসেছে। ছায়া যেমন বলেছিল, অমাবস্যার আগেই আসবে সেই ব্যক্তি—যে কিছুই ভুলবে না।
তিন দিন পেরিয়ে গেল।
নির্মা অপেক্ষা করছিল। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা তার চা তৈরির ছন্দে ছেদ ফেলছিল। একেকটা কাপ বানানোর সময় সে নিজের আঙুল থামিয়ে দিচ্ছিল, যেন কিছু ফেলে যাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কী। দোকানের জানলার কাঁচে এখন ছায়া পড়ে সন্ধ্যেবেলায়, তবু সেই আগুনের মতো মুখ এখনও আসেনি, যার দিকে তাকিয়ে নির্মা বুঝবে—এবার পাল্টে যাবে তার ভূমিকা।
চতুর্থ দিন সকালে, ঠিক সকাল ১১টা নাগাদ, একটি যুবক দোকানে ঢুকল। ধুলো রঙের ট্রেঞ্চকোট, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, আর হাতে একটা নীল কাপড় মোড়া নোটবুক। সে চুপচাপ চেয়ারে বসে বলল,
“আমি চা খেতে এসেছি। কিন্তু ভুলতে নয়। বরং কিছু মনে রাখতে।”
নির্মার হাত থেমে গেল।
“এখানে সবাই কিছু না কিছু ভুলে যেতে আসে।”
“তাই তো আমি আলাদা। আমি আসছি মনে রাখার জন্য।”
ছেলেটার গলার স্বর এতটাই স্থির, যেন তার বুকের মধ্যে ঢেউ ওঠে না কখনও। নির্মা তাকিয়ে দেখল—সে একটুও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। সে সরাসরি তাকিয়ে আছে নির্মার চোখে, যেন কিছু খুঁজে নিচ্ছে সেখান থেকে।
“তোমার নাম কী?”
“অরণ্য সেন। আমি পেশায় নোটবুক মেরামত করি।”
নির্মা হাসল। “সে আবার কী?”
“যারা হারিয়ে ফেলা খাতা খুঁজে পায়, কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না—তাদের খাতা আমি পড়ে দিই। মনে করিয়ে দিই—তারা কী লিখেছিল, আর কেন ভুলে গিয়েছিল।”
“তাহলে তুমি তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বী!”
“না। আমি এক ধরণের আয়না। তুমি যারা ভুলিয়ে দাও, আমি তাদের মুখ দেখাই—তারা কী ভুলেছে আর কেন।”
নির্মা এবার চুপ করে গেল। অরণ্য এবার ব্যাগ থেকে বের করল একটা পাতলা খাতা। খুলে দেখাল—ভেতরে একটাও শব্দ নেই, কিন্তু পাতাগুলোতে হালকা চা পাতার দাগ, আর মাঝেমধ্যে সোনালি রঙে আঁকা ঘূর্ণি চিহ্ন।
নির্মার চোখ বড় হয়ে গেল।
“এটা কোথায় পেলেন?”
“দার্জিলিঙে, একটা পোড়া চায়ের দোকানের ধ্বংসাবশেষে। দোকানটার নাম ছিল ‘স্মৃতির পাতায়’। কেউ বলেছিল, ওটা এক ডাকিনির দোকান ছিল। মেয়েটার নাম ছিল মীরা।”
নির্মা ফিসফিস করে বলল, “মীরা আমার দূর আত্মীয়া। আমরা সবাই এক গাছের ডালপালা।”
“তাহলে তোমারও সময় এসেছে, নির্মা। সময় এসেছে ভুলে যাওয়ার বদলে মনে রাখানোর। মানুষ এখন আর ভুলতে চায় না, তারা মুখোমুখি হতে চায় নিজেদের ছায়ার সঙ্গে।”
নির্মা এবার ধীরে ধীরে এক কাপ চা বানাল। কিন্তু সেই চায়ের রং আগের মতো গাঢ় লাল নয়, বরং হালকা ধূসর।
“এই চা খেলে কিছুই ভুলবে না?”
“না। বরং যা যা এড়িয়ে গিয়েছো, সব সামনে এসে দাঁড়াবে।”
অরণ্য ধীরে ধীরে কাপ হাতে নিল। প্রথম চুমুকের পরই তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল।
“তুমি কী দেখছো?” নির্মা জিজ্ঞেস করল।
অরণ্য চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি দেখছি আমার বাবার মুখ। আমি যখন সাত বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে পালিয়ে যাই, তখন বাবার সেই মুখটা দেখিনি। আজ দেখছি। আমি দেখছি আমার প্রথম প্রেমিকাকে, যে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছি, সে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিল, শুধু বলার সুযোগ পায়নি।”
নির্মার শরীর কেঁপে উঠল। তার মনে হল, যেন আজ বহুদিন পর কারও চোখে সে তার নিজস্ব কষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সেই মুহূর্তে তার মনে হল—তিনিও একজন মানুষ, যে সারাজীবন অন্যদের ভুলে যেতে শিখিয়েছে, অথচ নিজের স্মৃতিগুলো পাথরের নিচে চাপা দিয়েছিল।
অরণ্য এবার বলল,
“তুমি ভয় পাচ্ছো?”
“হ্যাঁ,” নির্মা স্বীকার করল।
“তাহলে এবার তুমি ভুলে যেতে চাও?”
“না। আমি মনে রাখতে চাই।”
অরণ্য তার দিকে একটা ছোট্ট আয়না এগিয়ে দিল। “তবে নিজেকে দেখো।”
নির্মা আয়নায় তাকাল। সেখানে যে মুখ দেখা গেল, তা তার নিজের নয়। সেটা ছিল এক ছোটো মেয়ের মুখ, বয়স হয়ত আট বা নয়, চোখে ভয়, ঠোঁটে দাগ, আর হাত ধরে আছে এক পুরনো কেতলি। পেছনে আগুন। পেছনে মায়ের গলা চিৎকার—“তুমি আগুনের পথ নেবে না! ভুলিয়ে দেবে না! মনে রাখলে তবেই সত্য আসবে!”
নির্মা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। আয়নাটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। কিন্তু অরণ্য শান্ত।
“এই সেই দিন, যেদিন তুমি প্রথম চায়ের কেতলি ধরেছিলে, আর তোমার মা পুড়ে গিয়েছিল নিজের জাদু দিয়ে তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে।”
নির্মার চোখে তখন জল। সে হাঁপাচ্ছিল।
“আমি তো শুধু চেয়েছিলাম কাউকে কষ্ট না দিতে…”
“তুমি দিতে না চাইলেও, তারা ভুলে গিয়ে নিজেদের ভুলে ফেলেছে। এবার সময় এসেছে—তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার। মনে করিয়ে দেওয়ার।”
অরণ্য ধীরে ধীরে তার খাতাটা বন্ধ করল।
“আমি আবার আসব,” সে বলল।
নির্মা চুপ করে তাকিয়ে রইল।
আর তার খাতার প্রথম পাতার ওপরের লেখা নিজে থেকেই বদলে গেল—
ডার্ক চা: ভুলিয়ে দেওয়ার দোকান নয়, মনে রাখার পথ।
পর্ব ৬: স্মৃতির বিপ্লব
অরণ্য চলে যাওয়ার পর দোকানটায় যেন নেমে এলো এক নতুন রকমের নীরবতা। আর সেটা কোনও সন্ধ্যার নিঃশব্দতা নয়—বরং এক ধরনের আত্মজিজ্ঞাসার গুমগুম ধ্বনি। নির্মা বসে ছিল, চায়ের কেটলি ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, আগুন নিভে গেছে, আর তার মুখে একটা অনিশ্চিত দৃষ্টির ছায়া। এত বছর ধরে সে জানত—সে ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে রক্ষা করছে, তাদের অতীতের জঞ্জাল পরিষ্কার করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। কিন্তু আজ, এক অচেনা লোক এসে যেন পুরো দুনিয়া উল্টে দিল।
তিন দিনের মাথায় সে প্রথমবার খাতাটা খুলে দেখল না। বরং সে তাকিয়ে রইল দোকানের দেয়ালে ঝুলে থাকা আয়নাটার দিকে, যার সামনে বসে অনেকে একদিন নিজেকে দেখত, তারপর নিজের অতীতটা ফেলে রেখে বেরিয়ে যেত। কিন্তু আজ আয়নাটা ফাঁকা, যেন আয়নার ভেতরে আর কোনও মুখ ধরা পড়ে না, শুধুই ধোঁয়া।
সন্ধ্যায় দোকানে এল সায়ন্তন। চুপচাপ বসে বলল, “তুমি আজ চা দিচ্ছো না?”
নির্মা মাথা নাড়ল, “আজ আর আগের মত চা বানাতে পারছি না।”
“তুমি কি তাহলে সব ছেড়ে দিচ্ছো?”
“না, আমি নতুন কিছু শুরু করতে চাই। তুমি জানো, আমি এতদিন ধরে যা করেছি, সেটা একপেশে ছিল। মানুষ ভুলে গিয়ে শান্তি পেয়েছে, কিন্তু নিজের ভুল বুঝে ওঠার সুযোগ পায়নি। আমি চা বানাবো, কিন্তু এবার সেটা তাদের মনে করিয়ে দেবে তারা কী ছিল, কী হতে পারত।”
সায়ন্তন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে তুমি একজন সত্যিকারের ডাকিনি!”
নির্মা মাথা নিচু করে হাসল। “না, আমি একসময় ডাকিনি ছিলাম। এখন আমি স্মৃতির বাহক হতে চাই।”
পরদিন শহরে একটা কানাঘুষো ছড়িয়ে পড়ল—‘ডার্ক চা’-র চা খেলে নাকি এখন মানুষ পুরনো কথা মনে করতে শুরু করছে। কেউ নিজের ফেলে আসা কবিতার লাইন ফিরে পাচ্ছে, কেউ ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া আঁকা ছবি, কেউ বা প্রেমপত্রের গন্ধ।
প্রথম এল জয়ন্ত—নির্মার পুরনো প্রেমিক। হাতে একটা সাদা চিঠি।
“আমি বুঝে গেছি, তুমি আমার জীবন থেকে কেন চলে গিয়েছিলে। আমি তখন ভাবতাম তুমি আমাকে ছেড়ে গেছো কারণ তুমি ক্লান্ত, বিরক্ত। এখন বুঝি, তুমি আমায় ভুলে যেতে চেয়েছিলে, যেন আমিও নিজেকে ভুলে যাই। কিন্তু আমি পারিনি।”
নির্মা বলল, “তুমি পারোনি বলেই এখন এসেছো। এবার চা খাও—যা ভুলেছো, তা মনে থাকবে, আর যা মনে রাখতে চাওনি, তাও সামনে আসবে।”
জয়ন্ত চা খেয়ে চোখ বন্ধ করল। তার মনে ভেসে উঠল একটা বর্ষার বিকেল, দুজনের প্রথম চুমু, একতলার বারান্দায় লেগে থাকা চায়ের কাপের ছোপ। সে হেসে ফেলল, চোখে জল।
“আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি আমায় কীভাবে তাকিয়ে দেখেছিলে সেই প্রথম সন্ধ্যেতে। আমি এবার মনে রাখব।”
এরপর একে একে আসতে লাগল মানুষ। কেউ তার ছোটবেলার ভয়কে ফিরিয়ে আনল, কেউ তার প্রথম গান, কেউ তার মায়ের কাঁধে মাথা রাখা মুহূর্ত।
অনিক আবার এল, কিন্তু তার মুখে আজ কোনও বিস্ময় নেই।
“আমি এখন বুঝতে পারি, আমি কি হারিয়েছি। ভাইয়ের মুখ মনে নেই, কিন্তু মনে আছে তার জন্য আমার অনুতাপ। সেটা নিয়ে আমি বাঁচতে পারি।”
নির্মা তাকিয়ে রইল। সে যেন ধীরে ধীরে নতুন জন্ম নিচ্ছে। চায়ের ধোঁয়ার মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক নতুন দর্শন—ভুলে না গিয়ে, স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচা।
রাতে, দোকান বন্ধ করার ঠিক আগমুহূর্তে, নির্মা টেবিলের ওপর খাতাটা রাখল। এবার সেই খাতায় লেখা হচ্ছে নতুন নাম—
জয়ন্ত বিশ্বাস – মনে পড়েছে ভালোবাসা ফেলে যাওয়া ভুল নয়
মৃণালিনী দে – মনে পড়েছে তার প্রথম আঁকা ছবি মায়ের কোলে
সায়ন্তন চক্রবর্তী – মনে পড়েছে কেন সে গল্প লেখা শুরু করেছিল
এই তালিকাটা দেখতে দেখতে নির্মা হঠাৎ যেন বুঝে গেল—চা কেবল শরীরের নয়, এটা আত্মার পানীয়।
সে এক নতুন কেতলি খুলল—পুরনো পাথরখচিত নয়, বরং একটানা পিতলের তৈরি, মসৃণ। আগুন জ্বালাল নতুন ছন্দে, কেতলিতে চা আর স্মৃতি একসঙ্গে ফুটে উঠল।
ঠিক তখনই দরজার সামনে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক বলল, “তুমি তৈরি?”
নির্মা মাথা নেড়ে বলল, “আমি আমার পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত।”
লোকটা বলল, “তবে এবার সময় এসেছে উত্তরাধিকার বদলানোর।”
সে নির্মার দিকে এগিয়ে দিল একটা সাদা কাগজ—একটা পত্রিকা প্রকাশনার অফার, নাম: স্মৃতির চা।
চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছিল ধীরে ধীরে, আর নির্মার চোখে জ্বলছিল সেই আলো, যা একটা ডাকিনির চোখে নয়—একজন চৈতন্যমান, ক্ষমাশীল, স্মৃতিধারী নারীর চোখে।
পর্ব ৭: এক কাপ চা, একখণ্ড ভবিষ্যৎ
নির্মা পত্রিকার সেই সাদা কাগজটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল অনেকক্ষণ। ‘স্মৃতির চা’—শুধু একটাই শব্দ নয়, যেন তার সবকিছু। সেই চা, যা ভুলিয়ে দিত, আজ তা-ই মনে রাখার যন্ত্র হয়ে উঠছে। কিন্তু ঠিক এই সময়, তার ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল—একটা ডাকিনি কি সত্যিই তার বংশানুক্রমিক ধর্ম থেকে সরে এসে স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে?
বাইরে রাত গভীর। শহরের আলোগুলো রাস্তায় ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে, আর হিলকার্ট রোডের চা দোকানটা যেন বাতাসে ভাসছে। হঠাৎ করে নির্মার মনে হল, দোকানের দেয়ালের আয়নাটা যেন কাঁপছে। সে উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। কিন্তু নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না। বরং সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠাকুরমা—অগ্নিদেবী, সেই নারী যাকে ব্রিটিশরা ডাইনি বলেছিল।
“তুমি কি বংশভিত্তিক শপথ ভাঙছো, নির্মা?”—আয়নার ভেতর থেকে ঠাকুরমার গলা ভেসে এল।
নির্মা থমকে গেল, কিন্তু ভয় পেল না। সে শুধু বলল, “আমি শপথ ভাঙছি না, আমি তাকে নতুন করে লিখছি। ভুলিয়ে দেওয়া একদিন দরকার ছিল, কিন্তু এখন মানুষ ভয়কে ভুলে নয়, মোকাবিলা করে জিততে চায়। আমি তাদের অস্ত্র দেব, ভোলার সুযোগ নয়।”
আয়নার ভেতর ঠাকুরমার মুখ হেসে উঠল। “তোমাকে দেখলে গর্ব হয়। আমি ভুলিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু তুমি… তুমি ফিরিয়ে দিতে চাও।”
আয়না নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল। নির্মা ফিরে এসে খাতার পাতা খুলল, এবার লিখল নতুন কিছু:
“স্মৃতি ভুলে গেলে জীবন থেমে যায় না, তবে চলার দিশা বদলে যায়। এবার সময় হয়েছে মানুষকে ভুলের মধ্যেই সত্য খুঁজে নেওয়ার সাহস শেখানোর। ডার্ক চা শুধু আর চায়ের দোকান নয়, এ এক আত্ম-অনুসন্ধানের পথ।”
এরপর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ‘ডার্ক চা’-র নাম ছড়িয়ে পড়ল শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, এমনকি সিকিম পর্যন্ত। লোকেরা আসতে লাগল দূরদূরান্ত থেকে—নিজেদের হারানো গান, কাঁটা পড়া সম্পর্ক, এমনকি ছেঁড়া ডায়েরির পাতা নিয়ে। কেউ জানতে চায়, তাদের কেন মনে নেই মায়ের শেষ কথা, কেউ জানতে চায় পুরনো ছবি আঁকার অভ্যেস কেন হারিয়ে গেছে।
তারা আসত, এক কাপ চা খেত, আর নির্মার সামনে বসে চোখ বন্ধ করত। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে হয়তো হঠাৎ কেঁদে ফেলত, বা চুপচাপ একটা চিঠি বের করে দিত যেটা কখনো পোস্ট করা হয়নি, অথবা ছেঁড়া পুরনো একটা অডিও টেপ।
একদিন এক বয়স্ক ভদ্রলোক এল—চোখে ঘোলাটে চশমা, কানে হালকা যন্ত্র বসানো, হাতে একটা লাল কাপড়ে মোড়া বই।
“আমি চাইলেও ভুলতে পারিনি,” বললেন তিনি।
“তাহলে কী মনে রাখতে চান?” নির্মা জিজ্ঞেস করল।
ভদ্রলোক বললেন, “যে মেয়েটি আমাকে একদিন ভালোবেসেছিল, আমি তার কথা কখনো ভুলিনি। কিন্তু আমি ভুলে গেছি, আমি তাকে কখন ভালোবেসেছিলাম। শুধু জানি, একসময় করতাম। সেই অনুভবটা হারিয়ে গেছে। আমি সেই ভালোবাসা অনুভব করতে চাই, আবার।”
নির্মা এবার নতুন চা বানাল। এই চা ছিল গোলাপ পাতার সঙ্গে শুকনো তুলসী, হালকা দারুচিনি আর শেষ চুমুকে মধু। এই চা ছিল স্মৃতির প্রতিকৃতি, আর অনুভবের সেতু।
ভদ্রলোক চা খেয়ে চোখ বন্ধ করলেন, আর তার ঠোঁট কাঁপল—“মাধুরী… তুই সেদিন বলেছিলিস, ভালোবাসা গন্ধে টেকে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম গন্ধ কেমন ছিল…”
তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু, কিন্তু তাতে দুঃখ ছিল না, ছিল আশ্চর্য শান্তি।
এই রকম শতশত মুখ, শতশত গল্প প্রতিদিন জমে উঠতে লাগল ‘ডার্ক চা’-তে। আর নির্মা বুঝতে পারছিল—তার কাজ আর কেবল চা দেওয়া নয়। সে এখন একজন শ্রোতা, একজন চাক্ষুষ সাক্ষী, একজন পথপ্রদর্শক।
ঠিক এমন সময়, অরণ্য আবার ফিরে এল। এবার তার হাতে ক্যামেরা।
“তুমি জানো, তোমার দোকানটা এখন একটা আর্কাইভ হয়ে উঠেছে,” বলল সে।
“তাহলে তুমি ছবিগুলো নেবে?”
“না,” অরণ্য বলল, “আমি গল্পগুলো রেকর্ড করতে চাই। তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে এখানে একটা রেকর্ডিং সেটআপ করতে?”
নির্মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “শর্ত একটাই—কোনও মুখ দেখানো যাবে না, শুধু কণ্ঠস্বর, আর কেতলি ফুটতে থাকা শব্দ।”
অরণ্য মাথা নোয়াল। সেই থেকে ‘ডার্ক চা’ দোকানে প্রতি সন্ধ্যায় শুরু হল ‘স্মৃতির রেকর্ডিং’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকেরা এসে এক কাপ চা খেয়ে বলত, “আমি ভুলে গেছি কীভাবে হাসতাম। আবার মনে পড়ল।” আর সেই গল্প রেকর্ড হত—কেবল কণ্ঠে, কেবল ধোঁয়ায়।
নির্মা একবার করে আয়নায় তাকাত। নিজের মুখে সে দেখত আগুন নয়, বরং শান্ত কুয়াশা। সেই কুয়াশা যা ভুলিয়ে দেয় না, বরং আড়াল সরিয়ে দিয়ে সামনে আনে।
সে জানত, এবার সে ডাকিনি নয়।
সে এখন এক চায়ের মেয়ের নাম,
যে এক কাপ চা দিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে
ভুলে যাওয়া ভবিষ্যৎ।
পর্ব ৮: আগুনের শেষ চুমুক
শিলিগুড়ির ভোর তখনও আলোর স্পর্শ পায়নি। শহরের গলিপথগুলো ঢেকে আছে পাতলা কুয়াশায়, আর তার ভিতর দিয়ে যেন শব্দহীন সুর বয়ে যাচ্ছে হিলকার্ট রোড বরাবর। ‘ডার্ক চা’ দোকানটা সেই সুরের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে—একটা ছায়া, একটা গন্ধ, একটা অতীতের রেকর্ড।
সেই দিনটা ছিল অমাবস্যা।
যে দিনটাতে নির্মা আগে গায়েব হয়ে যেত, কোথায় যেত জানত না কেউ, এমনকি নিজেও হয়তো পুরোটা জানত না। আগুনের বাহক হওয়া মানে নিজের সত্তাকে অন্য সত্তায় সঁপে দেওয়া। কিন্তু এ বছর সব বদলে গেছে। এ বছর সে গায়েব হবে না। সে থাকবে—চা ফুটবে, গল্প রেকর্ড হবে, আর তার ভেতরে জমে থাকা আগুন এবার জল হয়ে নামবে।
সকাল হতেই অরণ্য এসে হাজির। মুখে তার অদ্ভুত একটা উত্তেজনা।
“আজ রেকর্ডিংয়ের বিশেষ আয়োজন রেখেছি। স্মৃতির উৎসব। আমি চাই, তুমি নিজে আজ একটা গল্প বলো।”
নির্মা চমকে গেল।
“আমি? আমি তো শুধু শুনি।”
“তোমার গল্প কেউ শোনেনি। কিন্তু তুমি তো সেই প্রথম ডাকিনি, যে নিজের ভিতর তাকাতে ভয় পায় না। আজ বলো।”
দোকানের মধ্যে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। কেবল কেতলির নিচে জ্বলছে ক্ষীণ একটা অগ্নিশিখা, আর তার গায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে নির্মার মুখ। অরণ্য মাইক অন করল।
“এই বিশেষ পর্বে, আপনাদের শোনাবো ‘ডার্ক চা’-র নির্মার নিজের গল্প—স্মৃতির, ক্ষমার, আর আগুনের।”
নির্মা শুরু করল—
“আমি যখন ছোট, আমার মা বলতেন, মানুষের ভেতরে একটা করে ছায়া থাকে। সেই ছায়া যদি বড় হয়ে যায়, তাহলে মানুষ নিজেকে ভুলে যায়। আমার মায়ের ছায়া খুব বড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি কখনও আদর করতে পারতেন না, হাসতেও কম, কিন্তু চোখে তার এক ধরনের আলো ছিল—যেটা ভয় পেতে শেখাত।
একবার, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—‘তুমি কি ডাইনি?’
তিনি চুপ করে থেকে বলেছিলেন—‘আমি কিছুই না। আমি শুধু সেই পাথরের কেতলির এক ফোঁটা।’
আমার ঠাকুমা, যিনি আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, তার মুখ কখনো দেখিনি। শুধু মা বলতেন, তিনি আগুনকে ভালোবাসতেন এতটাই, যে নিজেই তাতে মিশে গিয়েছিলেন।
আমি যখন প্রথম চা বানালাম, সেটা শুধু গন্ধ নয়, একটা অনুভব। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমি মানুষের ভয় চিনতে পারি। শুধু সেই ভয়টা চায়ের মধ্যে ঢেলে দিতাম। মানুষ খেত, ভুলে যেত, হালকা হয়ে যেত।
তখন আমার মনে হতো, আমি কিছু একটা ভালো কাজ করছি। কিন্তু একদিন, এক ছেলেকে আমি তার মা ভুলিয়ে দিয়েছিলাম। সে চেয়েছিল ভুলতে, কারণ সে অভিমান করেছিল, কিন্তু চা খাওয়ার পর সে কেঁদে বলেছিল—‘মা’র মুখটা আর মনে করতে পারছি না, ঠিক যেন মুখটা মুছে গেছে।’
সেদিন রাতে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। আর তখন প্রথম আমার ঠাকুরমা আমার সঙ্গে কথা বলেন। বলেন—‘ভুলিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ জাদু। ফিরিয়ে দেওয়া সবচেয়ে কঠিন। তুই কোন পথ নেবি?’
আমি পথ বদলাই। মানুষ এখন এসে চা খেয়ে বলে—‘আমি আজ নতুন কিছু মনে করতে পেরেছি।’ আর আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারা আবার তাদের পুরনো হাসি ফিরিয়ে আনছে।
এই আমার গল্প। ভুলিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু মনে রাখতে শেখানোই আমার সত্য।”
অরণ্য চুপ করে বসে ছিল। চোখে তার এক অদ্ভুত আলো। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল,
“তুমি জানো, আমি কেন এসেছিলাম?”
নির্মা তাকাল।
“তুমি তো বলেছিলে তুমি স্মৃতি ফেরাও।”
অরণ্য ম্লান হাসল।
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি এসেছিলাম একটা সত্য জানার জন্য—তুমি কি সত্যিই মানুষ? নাকি তুমি কেবল একটা কেতলির ধোঁয়ার ছায়া?”
নির্মা এবার উঠে দাঁড়াল।
“আজ বলি। আমি মানুষই। কিন্তু আমি এমন একজন, যার ভেতরে সময় জমা পড়ে। আমার শরীরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে মানুষের দুঃখ। আমি খাই না, ঘুমাই না, প্রেমও করি না। কিন্তু আমি ভালোবাসি—মানুষের স্মৃতি ভালোবাসি, তাদের চেষ্টা ভালোবাসি, ভুল ভালোবাসি।”
ঠিক তখন বাইরে শুরু হল প্রবল ঝড়।
আকাশ কাঁপছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
দোকানের আলো নিভে গেল।
কেতলি ফুটতে ফুটতে হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো শব্দ করল।
নির্মা কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল কেতলির দিকে। আগুন যেন উঠে আসছে কেতলির গা বেয়ে—যেন কেউ ফিরেছে।
দেয়ালের আয়নায় ফুটে উঠল সেই মুখ—অগ্নিদেবী।
“তুই আগুন ছেড়ে জলকে বেছে নিয়েছিস। তবে এখনই শেষ নয়। সময় এসেছে শেষ চুমুকের। আজ তুই চা খাস।”
নির্মা থমকে গেল। এতদিন অন্যদের খাইয়ে গেছে, আজ নিজের জন্য এক কাপ।
সে বানাল এক কাপ চা—তুলসী, শুকনো গোলাপ, চন্দন আর একটু আগুনের ধুলো। সে চুমুক দিল।
হঠাৎ তার চোখ ভিজে উঠল।
মায়ের মুখ মনে পড়ল,
ভুলে যাওয়া প্রেমিকের চোখ মনে পড়ল,
নিজের প্রথম কবিতা মনে পড়ল—
“আমি ডাইনি নই, আমি আলো।”
তারপর সে চোখ বন্ধ করল।
ঝড় থেমে গেল।
দোকান আবার আলোকিত হল।
কেতলি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কিন্তু এবার সেটা সোজা উঠে গিয়ে ঘরের ছাদে মিলিয়ে যাচ্ছে।
অরণ্য তাকিয়ে দেখল, নির্মা দাঁড়িয়ে আছে শান্ত মুখে।
তার চোখে আগুন নেই, ভয় নেই—শুধু একটা শান্তি।
সে বলল, “আজ থেকে এই দোকান সবার জন্য। যারা ভুলে যেতে চায়, তারা আসবে। যারা মনে রাখতে চায়, তারাও। আমি শুধু পথ দেখাবো। বাকি পথ, তাদের।”
সেই রাতেই, অরণ্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছাপাল—
“ডার্ক চা: ভুলের নয়, স্মৃতির দোকান”
প্রকাশনায়: স্মৃতির চা
বিশেষ সাক্ষাৎকার: নির্মা সাহা – এক ডাকিনির আত্মকথা
আর হিলকার্ট রোডের কোণায় আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই ছোট্ট দোকান।
একটা কেতলি ফুটছে ধীরে ধীরে।
আর তুমি জানো—তুমি যা হারিয়েছো, এক কাপ চা-এ হয়তো আবার ফিরে আসবে।
[শেষ]