Bangla - তন্ত্র

ডামরু-সাধনা

Spread the love

তথাগত সান্যাল


অধ্যায় ১: ডামরুর প্রথম ধ্বনি
শিবরাত্রির রাত। হিমছোঁয়া বাতাসে ভেসে আসছে ধূপধুনোর গন্ধ, শালবনের ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটি ছুঁয়ে। উত্তর ত্রিপুরার অরণ্যঘেরা গুহামন্দিরে দাঁড়িয়ে ঋভু রায়চৌধুরী অনুভব করলেন—এ কেবল একটি সাধারন রাত্রি নয়। দিনদুয়েক আগেই কলকাতা থেকে আসার সময় লোকাল ড্রাইভার বলে দিয়েছিল, “এই মন্দিরে আজও কিছু ঘটে… বিশেষ করে শিবরাত্রির রাতে।” ঋভু প্রথমে হেসেছিলেন। তবে সেই হাসি চাপা পড়ে গেল, যখন তিনি ওই গুহার সামনে পৌঁছে এক ছায়াময় বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলেন—দাঁতহীন মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, গায়ে জটাধারী চেহারা, আর হাতে ছিল একটি পুরনো কাঠের বাক্স। বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে কেবল ইশারায় বাক্সটি ঋভুর দিকে এগিয়ে দেন। কৌতূহলে খুলতেই ভিতরে পাওয়া যায় একটি পুরনো ডামরু—কালচে বর্ণের কাঠ, তাতে জড়ানো রক্তিম সুতো, আর ডগায় খোদাই করা একটি করোটির প্রতিচ্ছবি। ঋভু সেটি হাতে তুলে নিতেই যেন অদৃশ্য এক শ্বাস তাঁর ঘাড় ছুঁয়ে গেল, আর মুহূর্তেই চারপাশের বাতাস থমকে দাঁড়াল। গুহার ভিতর থেকে এক অদ্ভুত ধ্বনি ভেসে এলো, যেটা কানে নয়, ঢুকে পড়ল বুকের গভীরে—জেগে উঠল এক ঘুমন্ত বিস্ময়।
রাতের শেষে কলকাতা ফেরার ট্রেন। ঋভু সেই ডামরু ব্যাগে রেখে ফিরে আসেন, কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন ঝিমধরা ভাব। সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে তিনি দেখলেন—এক আগুনজ্বলা শ্মশানে তিনি বসে আছেন, গলায় মালা, কপালে ছাই, সামনে ঘুরছে শত শত ছায়ামূর্তি। কেউ বাঁশি শুনছে, কেউ ডামরু বাজাচ্ছে, আর কেউ অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্র জপছে। স্বপ্নে তিনি নিজের হাতে সেই ডামরু বাজাতে শুরু করলেন, আর তখনই একটি বিকট ধ্বনি চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল, যেন মহাকাল নিজে হেঁকে উঠেছে। চমকে জেগে উঠে বুঝলেন, তাঁর শরীর ঘামে ভিজে গেছে, আর জানালার বাইরে কে যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে—আলোর ফাঁকে দেখা গেল, সেই বৃদ্ধ সাধু! পরদিন সকালে সে এই ঘটনা ভুলে যেতে চেষ্টা করেন, কিন্তু গানের ঘরে ঢুকে যখন বংশী মুখে তোলেন, তখনই বুঝতে পারেন—কিছু এক‌টা সত্যিই বদলে গেছে। তাঁর আঙুল যেন নিজে নিজে চলতে থাকে, সুরের মাঝে এক অদ্ভুত কম্পন, যেন বায়ুর স্তর কাঁপিয়ে তুলে। তিনি ঘোরে বাজাতে থাকেন, এবং হঠাৎ করেই পাশের রুম থেকে তাঁর ছাত্র সৌম্য ছুটে আসে—চোখে বিস্ময়, মুখে ভয়। “দাদা… আপনি কী বাজাচ্ছেন? আমি শুনে হাঁটতে পারছিলাম না… মাথা ঘুরছিল!”
ঋভু হেসে ফেলেন, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু তাঁর মনে তখন এক আশ্চর্য দ্বিধা—তিনি কী সুরের ওপর ক্ষমতা লাভ করলেন, না কি সেই সুরই তাঁকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে? এর মধ্যেই ফোন আসে দূরদূরান্ত থেকে—লোকজন বলছে, ইউটিউবে তাঁর নতুন রেওয়াজের রেকর্ড শুনে কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছে, কেউ নাকি রাতে ঘুমোতে পারছে না! একজন শ্রোতা ফোন করে জানায়—”আপনার বাজনার সময় আমার শরীর অবশ হয়ে যায়, আমি যেন কেবল ভেসে যাই…” ঋভু চুপ করে শোনেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বুঝে যান, এটা কেবল শুরু। তাঁর অনুশীলন কক্ষের দেয়ালে ক্রমে জমতে থাকে ছায়া, বায়ু ভারী হয়ে ওঠে, আর খোলা ব্যাগের ভিতরে রাখা ডামরুটি মাঝে মাঝেই নিজে থেকেই হালকা ঝংকার তোলে। এখন, আর তিনি একা নন—সেই ডামরুর মধ্যকার কোনও শক্তি ধীরে ধীরে তাঁর চেতনায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এবং সে শক্তি—নামহীন, ভয়াবহ, ও অতলান্ত অন্ধকার থেকে উঠে আসা—তাকে তৈরি করছে এক ভয়াবহ সাধনার জন্য।
অধ্যায় ২: সুরের পরশে ছায়া
ঋভু রায়চৌধুরীর জীবনের নিয়মিত ছন্দে যেন এক অদৃশ্য ফাটল ধরতে শুরু করেছে। সকালবেলা উঠে তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলেন, চোখের পাতার নিচে কালি, চাহনিতে অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল অচেনা এক সুর—যা মুখের ভাষা নয়, এক প্রাচীন মন্ত্রের সুরেলা উচ্চারণ। সেদিন সকালে রেওয়াজে বসে যখন তিনি বাঁশি হাতে তুলে নিলেন, তখন ঘরের বাতাস কেঁপে উঠল। বাঁশির সুর বেরিয়ে এল না—বরং গলার ভেতর থেকে নিঃশব্দে কেঁপে উঠল এক অলীক কম্পন। এরপর ডামরুটি হাতের কাছে নিয়ে বাজাতে শুরু করতেই কিছুকাল পর তাঁর চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। দরজার ফাঁক দিয়ে যেইমাত্র তাঁর ছাত্র সৌম্য দত্ত ঘরে ঢোকে, হঠাৎই দম বন্ধ করে দেওয়া অনুভূতি নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ঋভু থেমে যান, ছুটে এসে জল ছিটিয়ে সৌম্যকে জাগিয়ে তোলেন। কিছুক্ষণ পর সৌম্য ফিসফিস করে বলে—“দাদা… আপনার সেই বাজনার মধ্যে… আমি যেন একটা শ্মশানের গন্ধ পাচ্ছিলাম… একটা ধ্বনি আমার কানের মধ্যে ঘুরছিল, যেন কাঁধে কেউ হাত রাখছে…”
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই একটি বিশেষ কনসার্টের আয়োজন হয়—কলকাতার জাদুঘরের উন্মুক্ত মঞ্চে, যেখানে ঋভুর নাম ঘোষণা করা হয় “বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশেষ সুর-সাধক” হিসেবে। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ, অডিয়েন্সে বসে থাকে প্রায় তিনশো মানুষ—বিভিন্ন বয়সের, কেউ প্রথমবার শুনতে এসেছে, কেউ পুরনো শ্রোতা। ঋভু স্টেজে ওঠার আগে চোখ বন্ধ করে ডামরুটি বুকে চেপে ধরেন, এবং সেই পুরনো স্বপ্নের দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে আবার ফিরে আসে—আগুন, ছায়া, মন্ত্র, আর চেতনার মধ্যে নিঃশব্দে ডুব দেওয়া এক ভৈরব ছায়া। প্রথমে বাঁশির সুর দিয়ে শুরু করেন, দর্শকরা মুগ্ধ। এরপর হঠাৎই তিনি পকেট থেকে ডামরু বের করে বাজাতে শুরু করেন—অল্প কিছু সময়ের জন্য মাত্র। কিন্তু সেই ছোট্ট সময়ে ঘটে যায় অবিশ্বাস্য কিছু। সামনের সারির এক তরুণী হঠাৎ মুখে দুই হাত চেপে কাঁদতে শুরু করে, কেউ পাশের বন্ধুর কানে ফিসফিসিয়ে বলে—“আমার গা কাঁটা দিচ্ছে… আমি এখানে থাকতে পারছি না।” আর এক কোণে এক বৃদ্ধ দর্শক হঠাৎ চেয়ার থেকে পড়ে যান, চোখে স্থির দৃষ্টি, মুখে ফেনা! অডিটোরিয়ামের আলো তখনো নিভে নেই, মাইক্রোফোনে শ্রোতাদের চাপা কান্না, শ্বাসনালীর শব্দ, ও ডামরুর শেষ ঝংকার মিশে এক অভিশপ্ত চক্র তৈরি করে।
এই ঘটনার পরেই মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে—খবরে উঠে আসে “ঋভু রায়চৌধুরীর সঙ্গীত কি অলৌকিক?”, “বাঁশির সুরে মৃত্যু?”, “ভৈরব সাধনার ছায়া”—এই ধরনের শিরোনাম। ঋভু সকল প্রশ্নের মুখে চুপ থাকেন। তিনি আর আগের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না, কেবল ঘরে বসে ডামরুর ধ্বনি নিয়ে একা গবেষণা করেন। এবং তখনই অনুভব করেন, প্রতি রাতে ঘুমের আগে ডামরু তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘর অন্ধকার, কিন্তু তার ভিতর আলো জ্বলে ওঠে, যেন চামড়ার উপর আঁকা করোটির চোখ দুটি একেবারে তাঁর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। সৌম্য, এখনও তাঁর কাছেই আছে, কিন্তু সে এখন আরও চুপচাপ—একবার সে বলেছিল, “দাদা… আমি মাঝে মাঝে আপনার মুখে এক অদ্ভুত হাসি দেখি… যেন আপনি আর আপনি নেই।” এই সময়ই ফোন করে ডঃ পারমিতা সেন—ঋভুর পুরনো সহপাঠী, এখন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগীততত্ত্ববিদ। সে বলে, “ঋভু, আমি তোমার কনসার্টের ভিডিও দেখেছি… সেটা সঙ্গীত ছিল না, সেটা কিছু একটা… অনেক আগে আমি এই ধরনের এক যন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। আমি আসছি, অপেক্ষা করো।” ফোন রাখার পর ঋভু অনুভব করেন, ডামরুর সুর কেবল তাঁর কণ্ঠের ভিতর নয়—এখন যেন তাঁর রক্তেও ঢুকে গেছে। সময় কম, এবং ছায়া দীর্ঘ।
অধ্যায় ৩: পারমিতার পুনরাগমন
কলকাতার ঠান্ডা হাওয়ায় গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ডঃ পারমিতা সেন বহু বছর পর শহরটাকে যেন নতুনভাবে দেখছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীততত্ত্বে গবেষণা শেষে দেশে ফিরে এসেছেন, মূলত একটি বিশেষ কারণেই—ঋভু রায়চৌধুরীর কনসার্ট। প্রথমে ইউটিউবে ভিডিও দেখেন, পরে কয়েকজন সংগীত বিশারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হন—ঋভুর বাজনায় অলৌকিক উপাদান প্রবেশ করেছে। পারমিতা যখন ছাত্র ছিলেন, তখন হিমাচলে এক তিব্বতি শৈব মঠে গবেষণার সময় এক প্রাচীন পুঁথিতে পড়েছিলেন “ভৈরব তন্ত্রসুর” সম্পর্কে, যেখানে উল্লেখ ছিল এমন এক ডামরুর, যা শুধু শব্দ তৈরি করে না—চেতনার স্তরও বদলে দেয়। সেই পুঁথিতে লেখা ছিল, “যে বাজায়, সে আর বাজিয়ে থাকে না—তাকে বাজায় এক চেতনা, যে হাজার বছর ঘুমিয়ে আছে শ্মশানের ছায়ায়।” তখনকার বিশ্বাস ছিল, এ কেবল রূপকথা। কিন্তু আজ তা আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। পারমিতা রওনা দিলেন ঋভুর বাড়ির উদ্দেশ্যে—মনভরে প্রশ্ন, উত্তরের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিনি।
ঋভু তখন নিজের ঘরের অন্ধকার কোণে বসে আছেন, একটানা ডামরুর মাথায় আঙুল ঘষে চলেছেন, যেন তাকে জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। চোখে রক্তচোখা ক্লান্তি, শরীর কাঁপছে, কিন্তু মুখে এক আশ্চর্য শান্তি। হঠাৎ দরজায় বেল। দরজা খুলতেই পারমিতাকে দেখে তাঁর চোখের মণি একটু বড় হয়ে যায়, কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা আতঙ্ক। “পারমিতা?”—শব্দটা ফিসফিসে কণ্ঠে বেরোয়। পারমিতা ধীরে ভেতরে ঢোকে, চারপাশের পরিবেশ দেখে বুঝতে পারে, ঘর জুড়ে এক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কাজ করছে। দেয়ালে পুরনো তাম্রফলক, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধূপ, তন্ত্রসংক্রান্ত বইপত্র, এবং টেবিলের কোণে সেই ডামরু—যার রঙ যেন আর কাঠের নয়, যেন কারও চামড়া দিয়ে মোড়ানো। পারমিতা বলে, “ঋভু, তুই জানিস এটা কী?” ঋভু চুপ। পারমিতা ব্যাগ থেকে এক ভাঁজ করা পুঁথি বের করে বলে, “এটা সেই পুঁথি, যেখানে এই ডামরুর ইতিহাস লেখা আছে। এটার নাম ‘ভৈরব যন্ত্র’। একে তৈরি করা হয়েছিল তন্ত্রচক্রের সবচেয়ে নিষিদ্ধ সাধনায়। বাজনোর সময় এর সুর শরীর নয়, আত্মাকে নাড়া দেয়। যারা শুনে ফেলেছে, তারা চিরদিনের মতো ভিন্ন হয়ে যায়।”
ঋভু হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলেন, “তবে কি এটা আমার অনুপ্রেরণা নয়?” পারমিতা বলে, “না ঋভু, এটা এক ধরনের সংক্রামক চেতনা। এটা তোকে ব্যবহার করছে।” এই কথা শুনে ঋভুর চোখে খেলা করে এক অদ্ভুত আলো। সে শান্ত কণ্ঠে বলে, “তাহলে পারমিতা, যদি আমি এখন আর আমি না থাকি, তবে কে বাজাচ্ছে এই সুর?” ঘরে হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, বাইরের বাতি নিভে যায়, আর দরজার ফাঁক দিয়ে সৌম্য মুখ বের করে বলে, “দিদি… আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন। কিন্তু দাদা… তিনি এখন আর আগের মতো নন। রাতে ঘুমের মধ্যে উনি উচ্চারণ করেন কিছু শব্দ… আমি রেকর্ড করে রেখেছি।” পারমিতা রেকর্ড শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়—ঋভুর মুখ দিয়ে যে মন্ত্র বের হচ্ছে, তা অঘোর তন্ত্রের গভীর স্তরের শব্দ—যা সাধারণ মানুষের জানা থাকার কথা নয়। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যদি এই তন্ত্রচক্র থামাতে হয়, তাকে যেতে হবে শিকড়ে… শ্মশানের গোপন সাধনায়, যেখানে হয়ত উত্তর আছে, অথবা… আরও ভয়াল প্রশ্ন।
অধ্যায় ৪: আগুনে চোখ, পাথরে সুর
তিনদিন পেরিয়ে গেছে। অভিষেক আর অরিত্রর মধ্যে যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একসময় যারা রাতে একই মিউজিক হাউসে বসে বসে সুরের ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করত, আজ তাদের কথাবার্তায় কেবল চাপা উত্তেজনা। ঈশান সারাদিন একা একা প্র্যাকটিস করছেন, ডামরুর ছন্দে তাঁর বাঁশির সুর এখন যেন শাস্ত্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে অন্য কোথাও পৌঁছে গেছে। সেই সুর শুনলে শরীর কেঁপে ওঠে, কারও কারও চোখে অশ্রু জমে যায়, আবার কেউ কেউ ভয়ে পিছিয়ে যায়। অরিত্র এই পরিবর্তন লক্ষ্য করলেও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। অভিষেক একবার বলেছিল, “ঈশানের গলায় এখন যেন আগুন আছে, আর চোখে… চোখে পাথরের মতো স্থিরতা।” এমনকি সুরলোকের সিনিয়র শিক্ষকরাও যেন ঈশানের এই পরিবর্তন নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন, কিন্তু কেউ মুখ খুলছেন না। ঈশানের চোখে একধরনের অতিলৌকিক দীপ্তি ফুটে উঠেছে, যা ধীরে ধীরে চারপাশের লোকদের ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় অরিত্র সাহস করে ঈশানের সঙ্গে কথা বলতে যায়। সুরলোকের ঘরে ঢুকে দেখে, ঈশান পাখির খাঁচার মতো এক অদ্ভুত কাঠের স্ট্যান্ডে ডামরু ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাঁর সামনে আগুনের আলোয় একটি তামার পাত্রে রাখা কপালদুটি—একটা মানুষের, অন্যটা পশুর। অরিত্র চমকে উঠে বলে, “এইসব কী, ঈশান? তুমি তো এসব করো না!” ঈশান কিছু বলে না। তাঁর চোখ যেন লাল হয়ে জ্বলে উঠছে। হঠাৎ বাঁশি হাতে নিয়ে ডামরুর ছন্দে এক সুর বাজাতে শুরু করেন। মুহূর্তেই ঘর যেন দুলে ওঠে। অরিত্রের কানে বাজতে থাকে এক অদ্ভুত গুঞ্জন—মন্ত্র না কি অভিশাপ, বুঝতে পারে না। সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়, মনে হয় যেন কিছু তাকে বের করে দিচ্ছে ঘর থেকে। সেই রাতে সে জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, আর স্বপ্নে দেখতে থাকে এক পাহাড়ি গুহা, যেখানে এক নগ্ন সন্ন্যাসী চাঁদের আলোয় তাণ্ডব করছেন ডামরুর তালে।
পরদিন সকালে অভিষেক এসে অরিত্রর অসুস্থতা দেখে চিন্তিত হয়। সে জানায়, শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে “ভৈরব ডামরু” এক তান্ত্রিক সংগীতের অংশ—এই ধরণের বাদ্যযন্ত্র শুধু সিদ্ধপুরুষদেরই ব্যবহার করার অধিকার ছিল। সাধারণ মানুষ এটি বাজালে মানসিক ভারসাম্য হারানোর সম্ভাবনা থাকে। অভিষেক বলে, “ঈশান এখন এমন এক পথে হাঁটছে, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই।” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই পথটা কি ঈশান নিজে বেছে নিয়েছে, না কি কেউ বা কিছু তাকে চালিত করছে? আর সেই ‘কেউ’ যদি মানব না হয়? তাদের সামনে এখন শুধু সংগীত নয়, এক অলৌকিক শক্তির রহস্য উদঘাটনের চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে। একটা ভুল পদক্ষেপেই হয়তো বিপদ আসবে ঈশান নয়, পুরো শহরের ওপর।
অধ্যায় ৫: ভৈরবের রক্তচোখ
শিবানীকে হারানোর পর অভিষেক যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে। পেছনে ফেলে আসা বাঁশির দিনের চেনা পরিচিত আনন্দ আর গর্ব যেন নিঃশব্দে আত্মহত্যা করেছে। সে এখন নিয়মিত ভাবে ডামরু বাজায় — সূর্য ওঠার আগে, সূর্য অস্ত যাওয়ার পর। প্রতিবার সে বাজাতে শুরু করলে, কেবল সে নয়, তার চারপাশের পরিবেশও যেন রূপান্তরিত হয়। তার বাসার দেয়ালে ছায়ার মত কিছুরা দুলতে থাকে, মেঝেতে লালাভ ছোপ পড়ে, আর বাতাস ভারি হয়ে ওঠে ধূপ আর পোড়া হাড্ডির গন্ধে। লোকজন বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে ভয় পায়। একদিন রাতে, সে নিজের ঘরে বসে ডামরু বাজাতে বাজাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। স্বপ্নে তার সামনে হাজির হন একজন মুখহীন সন্ন্যাসী, যার চারপাশ জ্বলে উঠছে আগুনে, গলা থেকে ধ্বনিত হচ্ছে গম্ভীর, মন্ত্রোচ্চারণের মতো কোনো শব্দ — “তুমি পথ ধরেছো, এখন ফেরার নয়, অভিষেক।” ঘুম ভাঙতেই সে দেখে তার বিছানার পাশে ডামরুটা নিজেই ধীরে ধীরে ঘুরছে, আর মাটিতে পড়ে আছে তার হাতের রক্তের দাগ।
এই ঘটনার পর অভিষেক ধীরে ধীরে খুঁজতে শুরু করে ডামরু এবং ভৈরব সাধনার পেছনের প্রকৃত ইতিহাস। সে ছুটে যায় পুরনো শ্মশান, সন্ন্যাসীদের আখড়া, এবং পুরাকালের মন্দিরের গহ্বরে। হরিদ্বারের গঙ্গার ঘাটে এক বৃদ্ধ নাগাসাধুর কাছ থেকে সে জানতে পারে—ভৈরব সাধনা হলো শিবতন্ত্রের এক চরম স্তর, যেখানে ডামরু কেবল বাদ্যযন্ত্র নয়, তা এক যুদ্ধাস্ত্র। এই সাধনায় ডামরুর প্রতিটি শব্দ একেকটি ‘তাল’ নয়, বরং একেকটি ‘কায়িক ধ্বনি’, যা জড় জগতকে জাগ্রত করতে পারে। এই সাধনার মূল উদ্দেশ্য—জীবনের এবং মৃত্যুর মাঝের সূক্ষ্ম পর্দা ছিঁড়ে দিয়ে নীচের শক্তিগুলিকে মুক্ত করা। তবে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে এক ভয়ংকর শর্ত—এই পথে পা দিলে প্রিয়জন হারাবে, আত্মা পুড়বে, এবং একসময় শরীর ও চেতনা দুটোই অজানা কারও অধীনতায় চলে যাবে। অভিষেক কাঁপতে কাঁপতে জানে, এই যাত্রায় সে অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছে নিজেকে, আর ফিরবার পথ নেই।
ডামরুর শক্তি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। একদিন সকালে সে দেখে, তার গলায় এক অলৌকিক দাগ উঠেছে—ত্রিশূলের মতো তিনটি রেখা, যেন কেউ আগুনে পুড়িয়ে এঁকে দিয়েছে। সেদিন বিকেলে, সে বাঁশি নিয়ে রেওয়াজ করতে বসে, কিন্তু সুর উঠতেই চারদিক যেন কেঁপে ওঠে। তার বন্ধু অরিত্র, যে হঠাৎ তার খোঁজ নিতে এসেছে, সেই বাঁশির আওয়াজে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে—সে হেসে উঠতে থাকে অস্বাভাবিকভাবে, চোখ লাল হয়ে ওঠে, আর আচমকা মাটিতে পড়ে যায় অজ্ঞান হয়ে। অভিষেক তার পাশে বসে বোঝে, এই বাঁশি আর তার বাঁশি নয়, এটা এখন ভৈরবের কণ্ঠস্বর। সেদিন রাতে সে একা, নিঃশব্দে ডামরুর দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। “ভৈরব যদি সত্যি থেকে থাকেন, তবে তিনি কি আমার ভেতরেই প্রবেশ করেছেন?” তার প্রশ্নের জবাবে যেন বাতাস ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “তুমি এখন কেবল বাদ্যকার নও, তুমি এক সঞ্জীবক। এই সুর এখন মৃত্যুকেও জাগাতে পারে।” অভিষেকের চোখে এবার জ্বলজ্বল করে রক্তচোখ—ভৈরবের চোখ।
অধ্যায় ৬: মহাযাত্রার স্বরলিপি
শিবরাত্রির পর থেকে ঈশানের দেহে যেন অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে শুরু করল। ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আয়নায় দেখলে চোখের তলায় গভীর কালো ছায়া, কণ্ঠে গাম্ভীর্য আর সুরের টানে এক ধরণের আদিমতা লক্ষ্য করত সে। বাঁশি বাজাতে গেলেই ডামরুর আওয়াজ যেন অলৌকিকভাবে মিলেমিশে যেত সুরে—সেই সুরে যেন কোনো মন্দ্রলোকের ডাক ভেসে আসত। অভিষেক এসব কিছু দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেও ঈশান যেন দিন দিন আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছিল। আর একদিন রাতে হঠাৎ ঈশান দেখল, তার ঘরের চারদিকে যেন কুয়াশার আড়ালে এক ঝাঁক ছায়ামূর্তি ঘোরাঘুরি করছে। তারা কেউই সম্পূর্ণ মানুষ না, কেউ আধা পশু, কেউ হাড় জিরজিরে, কেউ আবার ত্রিনেত্রধারী—তবে সবার কণ্ঠেই একটিই আহ্বান, “ভৈরবের সঙ্গীত শেষ করো… সময় এসেছে…”
এই অস্বাভাবিক সব ঘটনার মধ্যেই ঈশান একদিন পৌঁছে গেল তার গ্রামের পাশের একটি ধ্বংসপ্রায় শিবমন্দিরে। সেখানেই তাকে দেখা দিল এক বয়স্ক তান্ত্রিক—ঝাঁকড়া চুল, কপালে তিনটি রক্তিম রেখা, আর হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। তিনি জানালেন, এই ডামরু শুধু এক বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি এক সাধনার সেতু, যার মাধ্যমে জীবনের সীমা ভেদ করে মোক্ষের প্রান্ত ছোঁয়া যায়। কিন্তু সেই সাধনা সহজ নয়—ঈশানকে পেরোতে হবে দশটি ধ্বনির স্তর, যাকে বলা হয় “নাদ বীজ”। প্রতিটি স্তর পেরোতে হবে একেকটি স্থানে, যেখানে আগেকার ভৈরবসাধকেরা সাধনা করতেন। প্রথম স্তর ‘ভূনাদ’—যেখানে শরীরের শক্তি সঞ্চালিত হয়। ঈশানকে যেতে হবে এক পুরনো শ্মশানে, যেখানে আজও রাতে শোনা যায় প্রেতসুর।
ঈশান সব শুনে হতবাক, কিন্তু সে যেন নিজের ইচ্ছার বাইরে কারও হাত ধরে হাঁটছে। অভিষেক তাকে আটকাতে চাইলেও বুঝতে পারল, বন্ধুকে আটকে রাখা যাবে না। পরদিন তারা দুজনে মিলে পৌঁছাল সেই পরিত্যক্ত শ্মশানে। রাত ঘনালেই, পূর্ণিমার আলোয় শ্মশান যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। ঈশান বাঁশিতে প্রথম ‘ভূনাদ’ ধ্বনি তুলতেই চারপাশ কেঁপে উঠল, যেন মৃত আত্মারা সাড়া দিচ্ছে সেই সুরে। ভয়ংকর অথচ সম্মোহিত করা সেই ধ্বনি অভিষেককে যেন স্থির করে রাখল—সে এক পা-ও এগোতে পারল না। ঈশান তখন চোখ বন্ধ করে, ডামরু হাতে, সেই সুরের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করল এক অলৌকিক ধ্যানজগতে, যেখানে প্রথম ‘নাদ বীজ’ ঈশানের আত্মায় প্রবেশ করল। তবে সেই ধ্বনির স্পন্দনে শ্মশানের এক গহীন আত্মা মুক্তি পেলেও, আরেকটি ঘুমন্ত শক্তি জেগে উঠল—যে চায় ঈশানকে থামাতে, যে চায় এই ভৈরব সাধনার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিতে…।
অধ্যায় ৭: ছায়ার সর্পদংশন
চন্দ্রবিন্দু আশ্রমের ঘন জঙ্গলে শীতের রাতে হিমশীতল হাওয়া হু হু করে বইছে। পূর্ণিমার আলোয় গাছের পাতাগুলো ছায়া ফেলে মাটির ওপর, যেন কেউ নিঃশব্দে চলাফেরা করছে। ঈশান এখন প্রায় নির্বাক—তার কথা খুব কমে গেছে, চোখে গভীরতা আর এক অদ্ভুত আভা। অবিনাশ ও অরিত্র বুঝতে পারছে, ডামরু এখন ঈশানকে শুধু নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং তার শরীর ও সত্তার অংশ হয়ে উঠছে। ডামরু বাজানোর সময় এখন আর সে নিজের মধ্যে থাকে না—তার চোখ ফাঁকা হয়ে যায়, নিঃশ্বাস ভারী হয়, আর চারপাশে যেন অদৃশ্য সাপেরা ফিসফিস করে। আশ্রমের পুরোনো তন্ত্রকক্ষটি ঈশানকে ডেকে নেয় প্রতিদিন। ওখানে বসেই সে একা একা ডামরু বাজায়। কিন্তু সেদিন রাতে, যখন অরিত্র আর অবিনাশ দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিল, তারা লক্ষ্য করল—ঈশানের সামনে মাটিতে ছায়া কাঁপছে। একটা বড় সাপের মতো ছায়া, কিন্তু আশেপাশে কোনো সাপ নেই। ডামরুর প্রতিটি শব্দে ছায়াটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে।
সেই ছায়াসাপটি ধীরে ধীরে ঈশানের চারপাশে পাক খেতে থাকে। অরিত্র সাহস করে এগিয়ে যায়, কিন্তু ঠিক তখনই এক অদ্ভুত শক্তি তাকে পেছনে ছিটকে ফেলে দেয়। অবিনাশ ছুটে এসে অরিত্রকে ধরে ফেলে। ঈশানের চোখ তখন বন্ধ, সে নিজের মধ্যেই বাজিয়ে চলেছে সেই ভয়াল সুর। তার মুখের ওপর ঘাম জমেছে, কিন্তু সে থামছে না। ঠিক সেই সময় ঈশানের গলায় হঠাৎ একটি গভীর কণ্ঠ বেরিয়ে আসে—যেটা ঈশানের নয়। সে বলছে, “ভৈরবের রক্ত চাই… অভিষেকের কণ্ঠ চাই…” এই নামটা শোনামাত্রই অরিত্র ও অবিনাশের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। অভিষেক, ঈশানের বাবা, যিনি একসময় নিষিদ্ধ তান্ত্রিক সুরের গবেষণা করতেন এবং নিখোঁজ হয়েছিলেন। কিন্তু কেউ জানত না তিনি ডামরু সাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঈশানের শরীর থেকে এক সময় ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বেরিয়ে আসে, আর ছায়াসাপটি তার শরীরে ঢুকে যায়। মুহূর্তেই ঈশান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অবিনাশ আর অরিত্র ছুটে গিয়ে তাকে তোলে, কিন্তু তার মুখে গভীর বিষণ্ণতা আর শরীর নিস্তেজ।
ঈশান যখন জ্ঞান ফেরে, তখন সে ধীরে ধীরে বলে, “সে আসছে… আমার মধ্য দিয়ে আসছে। আর হয়তো ফিরতে পারবো না।” অরিত্র তাকে ধরে বলে, “তুই ডামরু বাজানো বন্ধ কর, এটা তোর শরীর খেয়ে ফেলছে।” কিন্তু ঈশান কাঁপা গলায় বলে, “তুই কিছু বুঝছিস না, এটা আমি নই… এটা আমার বাবার অসম্পূর্ণ সাধনা, যেটা আমাকে শেষ করতেই হবে। না হলে… এই পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছায়াসাপেরা ঢুকে যাবে।” সেই রাতে আশ্রমের আকাশ কালো হয়ে ওঠে, যেন তারারাও আলো দিতে ভয় পাচ্ছে। দূরের বাঁশবন থেকে ভেসে আসে বাঁশি ও ডামরুর সম্মিলিত এক অলৌকিক ধ্বনি—যেটা মানুষের নয়, বরং কোনো অন্যলোকে জন্ম নেওয়া সুর। আর সেই সুরের দিকে চেয়ে থাকে তিনজন… কিন্তু ঈশান জানে, এবার সে একা। তার সাধনার শেষ পর্ব শুরু হয়ে গেছে—যেখানে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে নিজেই এক যন্ত্র, এক রক্তমাংসের ডামরু।
অধ্যায় ৮: শ্মশানের নৃত্য
ঘোর অমাবস্যার রাত। চারপাশের আকাশ যেন কালো কালি মেখে বসে আছে। ঝোড়ো হাওয়ায় বনভূমি কাঁপছে, আর সেই হাওয়ার রুদ্ধশ্বাস ছোঁয়ায় সঙ্গীত মিশে যাচ্ছে অদৃশ্য কোনো আর্তনাদে। অভিষেক এবার নিজের শরীরেই শব্দের খেলা অনুভব করছিল। তার ডামরু যেন নিজেই বাঁচতে চাইছে, ধ্বনির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করছে এক অলৌকিক সত্তাকে। ঈশান অনেক দূরে বসে, একাকী মন্ত্র জপে ব্যস্ত, কপালে ভস্ম, গলায় কপাল-ছোঁয়া রুদ্রাক্ষের মালা। এই গভীর অরণ্যের মধ্যস্থলে একটি পুরনো শ্মশান, যেখানে কেউ আর মৃতদেহ পোড়াতে আসে না, কারণ বহু বছর আগে নাকি এখানে এক তান্ত্রিক মৃত্যুর আগেও মৃতদেহ সঙ্গীত দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল। অভিষেক সেই শ্মশানে দাঁড়িয়ে ডামরু বাজাচ্ছে। প্রথম ধ্বনিতে শ্মশান যেন কেঁপে উঠল, দ্বিতীয় ধ্বনিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠল, আর তৃতীয় ধ্বনিতে আশেপাশে কুকুরের মতো কিছু অদ্ভুত অশরীরী আওয়াজ উঠল—“বোল হার! ভৈরব নাচে…”
এখানে সঙ্গীত আর মন্ত্র একসাথে মিশে এক ভয়ানক আবেশ তৈরি করল। অভিষেকের চোখ লাল হয়ে উঠছিল, তার দেহ দিয়ে যেন আগুনের রেখা উঠছে। শ্মশানের কুয়াশা সরিয়ে এক এক করে উঠে আসছে ছায়ামূর্তি—তারা কেউ জীবিত নয়, কেউ মৃতও নয়—তারা বোধহয় কোনো এক ‘সন্ধিক্ষণ’-এর বাসিন্দা। তাদের গায়ে ছাই মাখা, গলার স্বরে শূন্যতা। কিন্তু তারা সকলেই ডামরুর তালে তালে নাচছে, এক অন্ধ উন্মাদ নৃত্যে, যা তাদের মৃতস্মৃতি থেকে জাগিয়ে তুলছে। অভিষেক কিছু বলতে পারছে না—তার কণ্ঠ বন্ধ, কিন্তু তার ডামরুর প্রতিটি শব্দ যেন মহাকালের শঙ্খধ্বনি হয়ে উঠছে। ঈশান এবার ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে, মন্ত্র থেমে গেছে তার, কিন্তু চোখ দুটি যেন দীপ্তিতে জ্বলছে। সে বলে, “তুই এই শক্তিকে এখন কেবল বাজাচ্ছিস, কিন্তু তুই জানিস না, এই নাচ থামানো যাবে না… যদি তুই নাচতে না পারিস, তোর নিজের শরীর জ্বলে ছাই হয়ে যাবে।”
শব্দের আবেশ ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে এক গভীর ডোল বাজছে যেন মাটির নিচ থেকে। শ্মশানের মাটি ফেটে কিছু হাত উঠে আসছে, কেবল অভিষেকের ডামরু ছুঁতে। সেই স্পর্শে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, ডানহাতে বাজনা, বাঁহাতে ভীষণ কাঁপন। হঠাৎই অভিষেক নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারল না। সে মাটিতে বসে পড়ল। ছায়ামূর্তিগুলি এক মুহূর্তে থেমে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, আর তারপর সব মিলিয়ে গেল শ্মশানের কুয়াশার ভিতর। ঈশান দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “ভৈরব এখন তোর মধ্যে প্রবেশ করেছে। এবার থেকে তুই শুধু সুর সৃষ্টি করবি না, তুই নিজেই এক তান্ত্রিক অস্ত্র। কিন্তু সাবধান, এই সুরকে যেদিন অন্য কোনো মন কু-প্রয়োগে ব্যবহার করবি, সেদিন তোর শেষ আসবে। এখন চল, শ্মশানের প্রহর ফুরিয়ে এসেছে।” অভিষেক মাথা নিচু করে থাকল। ডামরুর চামড়ার গায়ে এক ফাটল দেখা গেছে, আর সেই ফাটলের মধ্যে দিয়ে যেন অনন্ত ঘোর অন্ধকার তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
অধ্যায় ৯: শ্মশানের নিনাদ
আকাশে তখন মেঘের খেলা। বিদ্যুতের আঁচড় আঁকা পড়ছে গঙ্গার পাড়ে। বেনারসের দক্ষিণ প্রান্তের এক পুরনো শ্মশানঘাট—মানুষজন এড়িয়ে চলে রাতের বেলায়। কিন্তু সেই রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে সেখানে পৌঁছে যায় অভিষেক ও ঈশান। হাতে তান্ত্রিক শাস্ত্রের দলিল, এবং ডামরু—যা ক্রমেই এক বিভীষিকার উৎস হয়ে উঠছে। ঈশান বারবার শুনছেন সেই অদ্ভুত ধ্বনি—“ভৈরব…ভৈরব…জাগো।” অভিষেকের মুখে ক্লান্তির ছাপ, অথচ চোখে জেদ। “এই শ্মশানেই সাধনা হয়েছে, ঈশান। এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে গেয়েছিল সেই গায়ক… যার গলায় ভৈরবের সুর নেমেছিল,” বলে সে চারদিক দেখতে থাকে। ঘন ছায়া, আগুনের পোড়া গন্ধ, আর একটানা শ্মশানের বাতাসে যেন কান্না ও রাগ মিলেমিশে থাকে। তারা দু’জনে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছায়—যেখানে পুরাণ মতে তন্ত্রসাধক মৃণাল গঙ্গোপাধ্যায় শেষ সাধনায় বসেছিলেন। ঈশান হঠাৎ ডামরু বাজাতে শুরু করেন—অভিষেক থমকে যায়। সেই বাজনার তালে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন শ্মশানচত্বরে সময় স্থির হয়ে গেছে।
হঠাৎই ডান দিকের এক ছায়ার মাঝে আগুনের মতো কিছু জ্বলে ওঠে। অভিষেক চিৎকার করে: “বন্ধ কর! এটা ভৈরবের রাগ, এটা নিয়ন্ত্রণহীন!” কিন্তু ঈশান যেন trance-এ চলে গেছেন। চোখ তাঁর উল্টো দিকে ঘুরে গেছে, সারা দেহ কাঁপছে। তাঁর বাঁশি আর ডামরুর তালে চারপাশের শ্মশান থেকে উঠে আসে অদৃশ্য ছায়ামূর্তি—কেউ কেউ অর্ধউলঙ্গ, কেউ পূর্ণ নগ্ন, কারো চোখ অন্ধকারের গহ্বরে ডুবে। তারা সবাই ঈশানের চারপাশে ঘুরছে, আর উচ্চারণ করছে সেই একই মন্ত্র—“ভৈরব সদা জাগ্রত।” অভিষেক বাঁচাতে যায়, কিন্তু পিছু হটে যায় হঠাৎ এক অদৃশ্য ধাক্কায়। সে দেখে ঈশান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, মাথার ওপর ডামরু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বজ্রের মতো আওয়াজ তুলছেন, যেন তিনি নিজেই এক ভৈরবের আধার। চারপাশের বাতাস এমনভাবে ঘূর্ণি হয়ে যায় যে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে, এবং তার মাঝে ঈশান দাঁড়িয়ে, চোখে নীল জ্যোতি, গলায় এক অজানা মন্ত্র।
এমন সময় ঘটে বিস্ফোরণ—একদম নিরবধি অন্ধকার আর আগুনের মাঝে যেন কিছু ফেটে যায়। ঈশান হঠাৎই পড়ে যান মাটিতে, আর সবকিছু থেমে যায়। বাতাস স্তব্ধ, আগুন নিভে যায়, ছায়ারা মিলিয়ে যায় ধোঁয়ায়। অভিষেক দৌড়ে যায় ঈশানের কাছে। তিনি নিঃসাড়। তবে তাঁর ডান হাতে তখনও ডামরু ধরা। অভিষেক ধীরে ধীরে তুলে নেন ডামরু, দেখে সেটার রঙ কালো থেকে লালচে হয়ে গেছে, যেন রক্ত মিশে গিয়েছে কাঠে। সে নিজেকে বলে, “এটা এখন শুধু বাদ্যযন্ত্র নয়, এটা অস্ত্র… এক অলৌকিক অস্ত্র।” কিন্তু ঈশান বেঁচে আছেন, নিঃশ্বাস চলছে ধীরে। অভিষেক জানে, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি—শুধু আরম্ভ হয়েছে। শ্মশানের এই অভিশপ্ত সাধনার রাতে ঈশান ভৈরবের সঙ্গে সংযোগ পেয়েছেন, কিন্তু সেই সংযোগ তার শরীর ও সত্তাকে কীভাবে বদলে দেবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি।
অধ্যায় ১০: “প্রলয়ের শেষ তান”
প্রলয়ের ঘূর্ণি যখন শহরের গায়ে নেমে এসেছিল, তখন রাত প্রায় আড়াইটা। কালো মেঘ, বজ্রের প্রতিধ্বনি আর তার মাঝে ঈশানের সেই ভয়ংকর ডামরু-সাধনার শেষ পর্যায় শুরু হয়েছিল। পুরনো গঙ্গার ঘাটে ভৈরব-ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ঈশান তাঁর কণ্ঠে এক আশ্চর্য তান তুলেছিলেন—যার সুরে গঙ্গার জল থরথর করে কেঁপে উঠছিল। অভিষেক ও অরিত্র দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কীভাবে শহরের দিক থেকে ভৌতিক ছায়াগুলো এই ঘাটের দিকে টেনে আনা হচ্ছে, যেন ঈশানের তানের ডাকে তারা বাধ্য। এই ছিল চূড়ান্ত সাধনা—ভৈরবকে জাগানোর সাধনা। হঠাৎ হাওয়ার তীব্রতায় ঈশানের চুল এলোমেলো হয়ে উঠল, চোখের মণি উল্টে গিয়ে গা ছমছমে এক অনুভূতি তৈরি করল। “ভৈরব,” ঈশান জপ করল, “প্রলয় তুমি আনো, কিন্তু আমি জানি—এই সুরেই আবার সৃষ্টি জন্ম নেয়।”
ভৈরব ডামরুর শব্দে বাতাস যেন গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র, ভগ্ন মন্দিরের দেহ, আর সাধকের আহ্বান মিলিয়ে এক অলৌকিক ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। হঠাৎই নদীর জলে দাঁড়ানো এক বিশাল ছায়ামূর্তি দেখা গেল—গাঢ় কালো, লাল চোখ, হাতে এক অদৃশ্য অস্ত্র। সে যেন পুরাণের এক রুদ্রস্বরূপ। অরিত্র ভয়ে পেছনে হাঁটতে থাকল, অভিষেক ঈশানকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ঈশান তখন সত্তার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে এগিয়ে এসে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুমি কি আমার ডামরু বাজানোর ক্ষমতা নিয়েছো?” ঈশান মাথা নেড়ে বলল, “আমি শুধু তোমার সুরের বাহক।” সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তি ডামরুর মধ্যে প্রবেশ করল, আর ঈশানের দেহ ভেঙে পড়ে গেল মাটিতে। ডামরুর শব্দ থেমে গেল—সমস্ত শহর নিঃশব্দ হয়ে গেল।
পরদিন সকাল। শহরের মানুষ বুঝতে পারল যে এক অদৃশ্য সংকট কেটে গেছে। ঈশানের দেহ পাওয়া যায়নি, শুধু গঙ্গার ঘাটে পড়ে ছিল সেই পুরনো ডামরুটা—নিশ্চুপ, শীতল, অথচ তার গায়ে অদ্ভুত নকশা—যেন সদ্য আঁকা। অভিষেক সেই ডামরুটা তুলে নিয়ে বলেছিল, “ওর সুরে আমাদের জীবন ছিল, এখন এটা নিঃশব্দ হলেও ঈশান আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে।” শহরে আর অস্বাভাবিক সুর শোনা যায়নি, পাগল হওয়া মানুষজন ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করল, আর ভৈরব-ঘাটে একটা নতুন গল্প শুরু হল—এক সাধক, এক সুর, আর এক প্রলয়ের যা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত শিবরাত্রির রাতে। সুর যে কেবল আনন্দ দেয় না, সে ধ্বংসও আনতে পারে—কিন্তু ঈশান প্রমাণ করে গেল, সেই ধ্বংসের মধ্যেই আবার জন্ম নেয় সৃষ্টি। ডামরু-সাধনার যবনিকা পতনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল এক অলৌকিক যুগের, কিন্তু কে জানে—সেই ডামরু আবার কবে কাকে ডাকে?
[সমাপ্ত]

1000043142.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *