Bangla - ভূতের গল্প

ডাকিনী কুন্ড

Spread the love

সুপ্ৰকাশ মুখার্জী


অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অলিগলিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধের প্রার্থনা শেষ হলে কাকাদের আড্ডা থেমে যায়, খুদেরা দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে মায়েদের আঁচলের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একমাত্র যিনি তখনও সক্রিয়, তিনি রাধিকা কাকিমা। বয়স আশির কাছাকাছি, মুখভর্তি কুঁচকানো ভাঁজ, মাথার চুল প্রায় সাদা, তবুও তার চোখদুটি এখনো অদ্ভুত উজ্জ্বল। গ্রামের বাচ্চারা যখন চারদিকে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সন্ধেবেলায় তার উঠোনে জড়ো হয়। উঠোনের মাঝখানে রাখা মাটির প্রদীপটিতে হলদেটে আলো জ্বলে ওঠে, আর কাকিমার গলায় ভেসে আসে সেই পুরোনো দিনের গল্প। আজও তিনি বসে আছেন শালপাতার পাখা হাতে, যেন সেই আলো আর বাতাসকে গল্পের তালে তালে নাচাচ্ছেন। তার কণ্ঠে আজকের গল্প—ডাকিনী কুন্ডের কিংবদন্তি। তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন, “শুনিস তো, এ জঙ্গলের ভেতরেই আছে একটা কুন্ড, যতটা গভীর তার জল, তার থেকেও গভীর তার রহস্য। বহু বছর আগে, সেই কুন্ডের ধারে এক নারী সাধিকা সাধনা শুরু করেছিল। লোকেরা বলে, সে ছিল এক ডাকিনী—অসাধারণ শক্তির অধিকারিণী। সে চেয়েছিল মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমর হতে। দিনরাত কুন্ডের ধারে বসে সে মন্ত্রোচ্চারণ করত, হাড়গোড়ের মালা গলায় ঝুলিয়ে, চোখ বন্ধ করে, যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য জগতের সঙ্গে কথা বলছে। গ্রামের লোকজন দূর থেকে তাকিয়ে থাকত, কাছে যাওয়ার সাহস করত না কেউ।”

বাচ্চারা গোল হয়ে বসে শিউরে ওঠে, কারণ কাকিমার কণ্ঠের সঙ্গে সঙ্গে রাতের হাওয়ায় হঠাৎ একরকম শীতলতা নেমে আসে। তিনি আরও বলেন, “কিন্তু হায়, তার সাধনা পূর্ণ হয়নি। শেষরাতে, পূর্ণিমার আলোয়, যখন সে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে শেষ মন্ত্রপাঠ করতে বসেছে, তখন হঠাৎ প্রবল ঝড় ওঠে। আকাশে বজ্রপাত, চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। সেই ঝড়ে তার দেহ পড়ে যায় কুন্ডের ভেতর। মানুষজন ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, কেউ সাহস করে আর তাকে বাঁচাতে যায়নি। বলে, সেই রাতে তার প্রাণ কুন্ডেই বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু আত্মা নয়। অসমাপ্ত সাধনা তাকে শিকল বেঁধে রেখেছে। মৃত্যুর পরও সে মুক্তি পায়নি। আজও পূর্ণিমার রাতে, বা গভীর অন্ধকারে, কুন্ডের জল থেকে শোনা যায় তার কণ্ঠস্বর। মৃদু সুরে, নারীকণ্ঠে ভেসে আসে মন্ত্র—‘ওঁ… হ্রীঁ… ক্রীঁ…’। যারা শুনতে পায়, তাদের হৃদয় ধড়ফড় করে ওঠে, মাথা ঘুরে যায়। অনেকের নাকি কানে রক্ত বেরিয়েছে, অনেকে পাগল হয়ে গেছে।” কথাগুলো বলে কাকিমা যখন গলাটা আরও নিচু করে ফেলেন, তখন বাচ্চারা একে অপরের হাত চেপে ধরে বসে থাকে। গ্রামের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধেবেলায় সেই গল্প যেন বাস্তব হয়ে ওঠে।

রাধিকা কাকিমা থেমে এক চুমুক জল খেয়ে আবার শুরু করেন, “তোরাও শুনেছিস নিশ্চয়ই, গ্রামের বাইরে সেই জঙ্গলে আজও কেউ যায় না। শিকারিরা এড়িয়ে চলে, কাঠুরেরা ওই অংশে ঢোকে না। বড়রা বলে, ওই কুন্ড অভিশপ্ত। কারও কারও মতে, ডাকিনী এখনও সেখানে বসে সাধনা করছে—তবে এখন শরীর নেই, শুধু ছায়া। যারা অত কৌতূহলী হয়ে কুন্ড দেখতে গেছে, তারা আর স্বাভাবিক ফিরে আসেনি। কেউ কেউ নিখোঁজ হয়েছে, আর যাদের পাওয়া গেছে তারা সারাদিন চুপ করে বসে থেকেছে, চোখ স্থির, মুখ ফ্যাকাসে। যেন তারা আর এই পৃথিবীর নয়।” কথাগুলো শেষ করে তিনি বাচ্চাদের দিকে তাকান—চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে প্রদীপের আলোয়। হাওয়া বইছে ধীরে ধীরে, তালপাতার ঘরের ফাঁক দিয়ে রাতের পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। বাচ্চারা স্তব্ধ হয়ে থাকে, মনে হয় যেন দূরে জঙ্গলের দিক থেকে আসলেই কোনো অচেনা সুর ভেসে আসছে। সেই মুহূর্তে কিংবদন্তি আর গল্পের ভেদরেখা যেন মিলিয়ে যায়—সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে, জঙ্গলের গভীরে সত্যিই আছে এক রহস্যময় কুন্ড, যেখানে অসমাপ্ত ডাকিনীর সাধনার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায়।

গ্রামের প্রাচীন কিংবদন্তি শোনার পর থেকেই তরুণ অরিন্দমের কৌতূহল অদ্ভুতভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। তার চোখে কুন্ড যেন এক অদৃশ্য টান, যা প্রতিনিয়ত তাকে ডেকে নিয়ে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় খেলার মাঠে বসে বন্ধুরা যখন আড্ডা দেয়, তখন একসময় গল্পের কেন্দ্রে চলে আসে সেই কুন্ডের প্রসঙ্গ। অরিন্দমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুমন আর বিকাশ হাসতে হাসতে বলে, “ওসব বুড়ি কাকিমার বানানো ভয় দেখানোর গল্প। এসব কিছু নেই।” কিন্তু কথা শেষ হতেই ওদের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে, কারণ প্রত্যেকেই অন্তরে জানে, গ্রামের বহু মানুষ সেই কুন্ডের ভয়াবহতা নিয়ে একদিন না একদিন মুখ খুলেছে। একবারের জন্য হলেও তাদের সকলের মনে হয়েছে যে অন্ধকার জঙ্গলের গভীরে সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে। আর অরিন্দমের মন, যা সবসময় রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট, সে আর থেমে থাকতে পারে না। রাতে বিছানায় শুয়ে তার কানে বারবার বাজে কাকিমার বলা সেই নারীকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ, যেন অজান্তেই কুন্ড থেকে ভেসে আসছে।

কৌতূহল চরমে পৌঁছোয় যখন একদিন হাটে গিয়ে অরিন্দম আর তার বন্ধুরা এক বৃদ্ধ কাঠুরের গল্প শোনে। লোকটি বলেছিল, বহু বছর আগে তার ভাই এক পূর্ণিমার রাতে কাঠ কেটে ফেরার সময় ভুল করে কুন্ডের ধারে গিয়ে পড়ে। পরদিন তাকে পাওয়া যায় জঙ্গলের ভেতর বসে, চোখ দুটো স্থির, ঠোঁটে আধখানা হাসি, আর মুখে অস্পষ্টভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। তারপর থেকে লোকটি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। গল্প শুনে অরিন্দমের শরীরে কাঁপুনি দিলেও তার ভেতরে যেন এক অদ্ভুত আগুন জ্বলে ওঠে। সে ভাবে, “সবাই যদি ভয় পায়, তবে সত্যিটা কখনোই জানা যাবে না। হয়তো কুন্ডের ভেতরে আসলেই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, যা কাউকে আবিষ্কার করতে হবে।” বিকাশ ও সুমন প্রথমে আপত্তি তোলে, কিন্তু অরিন্দমের জেদী মনোভাব দেখে তারাও কিছুটা নরম হয়। সেদিন রাতে আড্ডার শেষে অরিন্দম ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “চল না, একদিন গিয়ে দেখি আসল ব্যাপারটা। দূর থেকে হলেও।” সুমন ভয়ে পিছিয়ে গেলেও বিকাশ হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। তাদের চোখেমুখে ভয় মেশানো উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তাদের পরিকল্পনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামের পুরোহিত অমৃতানন্দজী খবর পেয়ে অরিন্দমদের বাড়িতে চলে আসেন। গম্ভীর চেহারা, কপালে সাদা চন্দনের টিপ, হাতে জপমালা—তিনি খুব সহজে কাউকে ভয় পান না। কিন্তু ডাকিনী কুন্ডের প্রসঙ্গে তার মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে ওঠে। অরিন্দম ও তার বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কঠোর কণ্ঠে বলেন, “তোরা বুঝিস না! ও জায়গাটা নিষিদ্ধ। ওখানে শুধু ভূতের ছায়া নয়, এক অসমাপ্ত সাধনার শক্তি বন্দি আছে। মানুষ যদি ভয় বা কৌতূহলবশত সেখানে যায়, সে শক্তি তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। বহু বছর ধরে কতজনকে হারিয়েছি আমরা, কেউ আর ফিরে আসেনি। আমি শপথ করিয়ে বলছি, কুন্ডের ধারে যাবে না।” তার চোখদুটো লাল হয়ে ওঠে যেন রাগে আর উদ্বেগে মিশে গেছে। কিন্তু অরিন্দম চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকলেও ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে—সে যেভাবেই হোক, একদিন সেই কুন্ডের কাছে যাবে। পুরোহিতের সতর্কবাণী তার ভয়ের চেয়ে কৌতূহলকেই আরও উস্কে দেয়। যেন নিষিদ্ধ পথের আকর্ষণ তাকে আরও গভীরভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিন রাতে আকাশে যখন মেঘ জমে, বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, অরিন্দম বিছানায় শুয়ে নিজের বুকের ধড়ফড়ানি অনুভব করে, মনে হয়—ডাকিনী কুন্ড তাকে ডাকছে, আর সেই ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে সে নিজেকে রুখতে পারবে না।

চাঁদহীন এক রাত ছিল সেদিন, গ্রামে চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে নেমে এসেছে। বাতাসে এক অদ্ভুত স্থবিরতা, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। সবার অজান্তে, অরিন্দম সেই রাতে একা বেরিয়ে পড়ল। মনের মধ্যে ভয় আর কৌতূহল সমানতালে লড়াই করছিল, কিন্তু কৌতূহলই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল। গ্রামের সরু কাঁচা পথ ধরে সে ধীরে ধীরে হাঁটছিল, হাতে কেবল একটি কেরোসিনের টর্চ, যার আলো আঁধারিকে কাটতে কাটতে সামনে এগোচ্ছিল। জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছেই তার বুকের ভেতর হঠাৎ করে ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়, গা শিউরে ওঠে, তবুও পা থামে না। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে বুনো কুকুরের হুক্কাহুয়া, আর গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। কিন্তু অরিন্দম মনে মনে নিজেকে বোঝালো, “এখন না গেলে কখনোই জানা যাবে না আসল সত্যটা।” গাছের পাতার আড়াল ভেদ করে, সে আস্তে আস্তে জঙ্গলের গভীরে পা বাড়াল।

কিছুটা পথ এগোনোর পরেই অরিন্দম বুঝতে পারল, এই অন্ধকারে আলো কতটা অপ্রতুল। কেরোসিন টর্চের ক্ষীণ শিখা চারপাশের ঘন অন্ধকারে প্রায় গিলে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে অজানা কারও চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই বাতাসে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—মৃদু, টানা এক নারীকণ্ঠ। অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। প্রথমে সে ভাবল, হয়তো তার ভ্রম, বা হাওয়ার খেলা। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কণ্ঠস্বরটি ছিল ভয়ঙ্করভাবে করুণ, যেন কেউ কাঁদতে কাঁদতে মন্ত্র উচ্চারণ করছে—“ওঁ… হ্রীঁ… ক্রীঁ…”। শব্দটা একবার শোনা মাত্রই তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। অরিন্দম টর্চটা শক্ত করে ধরল, কিন্তু টর্চের আলো হঠাৎ করে টিমটিম করে নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। অন্ধকারে সে অনুভব করল, কুন্ড যেন খুব কাছে। কণ্ঠস্বর যেন সরাসরি তার কানে বাজছে, আর প্রতিটি মন্ত্র তার বুকের ভেতর ঢুকে গিয়ে রক্ত হিম করে দিচ্ছে। অরিন্দম থমকে দাঁড়াল, মনে হলো পা আর এগোচ্ছে না। ঠিক সেই সময় তার কানে আবার শোনা গেল এক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ, যেন কোনো নারী ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ঘেমে উঠল সে, আর পেছন ফিরে তাকাতেই কেবল গভীর অন্ধকার—কিছুই নেই।

ভয়ের তীব্র চাপে অরিন্দম হঠাৎ ছুটে পালাল। তার টর্চের আলো দপদপ করতে করতে নিভে গেল, তবুও সে অন্ধকারে দিকভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল। গাছের ডাল তার গায়ে আঁচড় কেটে দিচ্ছিল, মাটির শেকড়ে হোঁচট খাচ্ছিল, তবুও সে থামেনি। বুক ধড়ফড় করছিল এত জোরে যে মনে হচ্ছিল গা থেকে বেরিয়ে যাবে। অনেকটা দৌড়ে এসে যখন অবশেষে গ্রামের দিকের আলোর আভাস দেখতে পেল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় লুটিয়ে পড়ল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সে বিছানায় পড়ে গেল, কিন্তু তার কান থেকে সেই নারীকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ সরল না। মনে হচ্ছিল, শব্দটা এখনো ভেসে আসছে—টানা, করুণ, অথচ ভয়ঙ্কর। গভীর রাতে, চোখ বন্ধ করার পরেও অরিন্দম শুনতে পেল সেই প্রতিধ্বনি, যেন ডাকিনী নিজেই তার মনের ভেতরে ঢুকে গেছে। ভয়ে তার শরীর কাঁপতে লাগল, কিন্তু এক অদ্ভুত আসক্তিও তৈরি হলো। সে বুঝল, যতই পালাক, কুন্ডের রহস্য তাকে ছেড়ে যাবে না। বরং তার কানে, তার স্বপ্নে, তার ভেতরে সেই ডাক চিরকাল বাজতে থাকবে।

অরিন্দমের জীবনে সেই রাতের পর সবকিছু যেন বদলে গেল। প্রথম ক’দিন সে চেষ্টা করেছিল নিজেকে বোঝাতে যে যা শুনেছে, তা কেবল ভ্রম—রাতের নিস্তব্ধতা আর ভয়ের প্রভাবে তার কানে অদ্ভুত শব্দ ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু যতই সে তা অস্বীকার করার চেষ্টা করল, ততই মনের মধ্যে সেই নারীকণ্ঠ ঘুরে ফিরে বাজতে লাগল। কখনো দুপুরে পড়াশোনা করতে বসলে হঠাৎ মনে হতো কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, কখনো রাতে ঘুমাতে গেলে মনে হতো অন্ধকারে অদৃশ্য এক ছায়া তার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকবার গভীর রাতে ঘুম ভেঙে সে স্পষ্টভাবে শুনেছে জানালার বাইরে শুকনো পাতার ওপর কারও পায়ের চাপ পড়ছে। জানালা খুলে তাকালে চারপাশে শুধু অন্ধকার আর গাছের ছায়া, কিন্তু তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠত এক অদ্ভুত আশঙ্কা। সে বুঝতে পারল, কুন্ডের অভিশাপ তাকে ছেড়ে আসতে দেয়নি—বরং অদৃশ্য শক্তি তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার চোখের তলায় কালি জমতে শুরু করল, ঘুম ভেঙে বারবার আতঙ্কে চমকে উঠত, আর চারপাশে যেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে এমন অনুভূতি সর্বদা তাড়া করে বেড়াত।

অরিন্দমের মা লক্ষ্মী দেবী প্রথমে ছেলেটির এই পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেননি। তিনি ভেবেছিলেন, পড়াশোনার চাপ আর রাত জেগে পড়ার কারণেই ছেলের চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বুঝলেন, ব্যাপারটা অন্যরকম। অরিন্দম চুপচাপ হয়ে গেছে, সারাদিন কারও সঙ্গে কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়াও আগের মতো করে না। রাতে তাকে বারবার ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করতে শোনা যায়—অস্পষ্ট শব্দ, যেন কোনো মন্ত্রপাঠ করছে। এক রাতে লক্ষ্মী দেবী হঠাৎ জেগে উঠে দেখলেন, অরিন্দম বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখ অদ্ভুত শূন্য, ঠোঁট নড়ছে ধীরে ধীরে। মা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে চমকে উঠল, যেন ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এ দৃশ্য দেখে লক্ষ্মী দেবীর মনে আতঙ্ক জন্ম নিল। তিনি ভাবলেন, হয়তো ছেলেটি সত্যিই কোনো অশুভ প্রভাবের মধ্যে পড়ে গেছে। পরদিন সকালে তিনি প্রতিবেশী এক মহিলাকে এই কথা বলতেই, মহিলা গম্ভীর মুখে বললেন, “ছেলেকে তাড়াতাড়ি পুরোহিত অমৃতানন্দজীর কাছে নিয়ে যান। ওর চোখে যে ছায়া দেখছি, সেটা ভালো নয়।”

অরিন্দম নিজেও অনুভব করছিল নিজের মধ্যে পরিবর্তন। আগে যে বিষয়গুলো তাকে আনন্দ দিত—বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মাঠে খেলা, কিংবা বই পড়া—এসবের প্রতি তার আগ্রহ হারিয়ে গেছে। বরং এক অদ্ভুত টান বারবার তাকে জঙ্গলের দিকেই ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই তার মনে হতো, কুন্ডের ধারে ফিরে যেতে হবে, কারণ সেই কণ্ঠস্বর তার কাছে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু প্রতিবারই মায়ের মুখ মনে পড়লে সে দ্বিধায় ভুগত। তার বুকের মধ্যে এক তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে ভয়ঙ্কর অজানা শক্তির প্রভাব, অন্যদিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষা। রাতে ঘুম ভাঙলে সে স্পষ্ট শুনত জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে। একবার সাহস করে জানালা খুলতেই কেবল শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগল, কিন্তু তার মনে হলো দূরে অন্ধকারে সাদা কাপড় পরা কারও অবয়ব ঝলক দিয়ে মিলিয়ে গেল। এই অভিজ্ঞতা তাকে আরও ভেঙে দিল। সে বুঝল, কুন্ডের ছায়া তার জীবন জড়িয়ে ধরেছে, আর সেই ছায়া থেকে মুক্তি পাওয়া এত সহজ হবে না। মায়ের চোখে ছেলের পরিবর্তন ধরা পড়লেও, অরিন্দমের নিজের ভেতরেই ছিল আরও গভীর আতঙ্ক—সে আশঙ্কা করছিল, এই ছায়া তাকে ধীরে ধীরে কুন্ডের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, যেখানে থেকে হয়তো আর কখনোই ফেরা হবে না।

নীলাদ্রি ছিল গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভীক ছেলে। ছোটবেলা থেকেই তাকে সবাই চিনত দুষ্টুমি আর দুঃসাহসের জন্য। অরিন্দমের মতো কুন্ড থেকে ফিরে এসে আচরণ বদলে যাওয়া নয়, বরং তার বিপরীত—নীলাদ্রি বিশ্বাস করত এসব ভূতের কাহিনি, ডাকিনী আর মন্ত্রোচ্চারণ সবই বাজে কথা, বৃদ্ধাদের তৈরি করা গল্প। কিন্তু অন্তরের গভীরে একটা কৌতূহলও ছিল—যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে? যদি সেই কুন্ডে সত্যিই কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকে? সেই কৌতূহল তাকে বারবার প্রলুব্ধ করছিল। সে গ্রামে সবার সামনে হেসে বলেছিল, “ওসব ভুতের গল্পে তোমরা ভয় পেয়ো, আমি না। কাল রাতে গিয়ে দেখে আসব, কুন্ডে আদৌ কী আছে।” তার চোখের দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে সেই চ্যালেঞ্জের হাসি সবার মনে ভয় ধরিয়েছিল। অরিন্দম চুপ করে ছিল, কিন্তু তার অন্তরে একটা অদ্ভুত শঙ্কা জন্ম নিয়েছিল। সে নিজে যে শব্দ শুনেছিল, সেই করুণ অথচ ভয়ঙ্কর নারীকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ, তা এখনও প্রতিদিন রাতে তার কানে বাজে। সে নীলাদ্রিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল—“যেও না, আমি গিয়েছিলাম, ভয়ঙ্কর কিছু আছে।” কিন্তু নীলাদ্রি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, “তুই ভয় পেয়েছিস বলেই তাই মনে হচ্ছে।”

সেই রাতেই, অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে, নীলাদ্রি একা বেরিয়ে গেল। গ্রামের পথের শেষ প্রান্তে যেখানে জঙ্গল শুরু হয়, সেখানে তার ছায়া হারিয়ে গেল কুয়াশার ভেতরে। কারও সাহস হলো না তাকে থামানোর। গ্রামের কুকুরগুলো হঠাৎ করেই চিৎকার করতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য আতঙ্ক তাদের কাঁপিয়ে তুলেছে। বাতাসে তখন এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এসেছিল, যেন প্রকৃতিই সতর্কবার্তা দিচ্ছে। সারা রাত গ্রাম নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। কেউ জানত না, নীলাদ্রির সাহসী পদক্ষেপ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। পরদিন সকালে, গ্রামের কিছু লোক মাঠের ধারে গিয়ে দেখতে পেল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বড় বড় গাছের পাশে পড়ে আছে নীলাদ্রির দেহ। তার চোখ দুটি বড় বড় করে খোলা, যেন শেষ মুহূর্তে এমন কিছু দেখেছিল যা মানুষকে পাথর করে দেয়। মুখের কোণে জমাট বাঁধা আতঙ্কের ছাপ, আর কান দিয়ে বেরিয়ে আসছে লাল রক্তের ফোঁটা, শুকিয়ে গিয়ে মাটিতে লেগে গেছে। এই দৃশ্য দেখে গ্রামের সবাই শিউরে উঠল। বৃদ্ধা রাধিকা কাকিমা চিৎকার করে উঠলেন, “আমি বলেছিলাম, ও কুন্ডে কেউ যেও না। সেই ডাকিনী এখনও ডাকে, আর যে সাড়া দেয়, সে আর ফেরে না।”

খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। গোটা গ্রাম যেন ভয়ের অন্ধকারে ঢেকে গেল। কেউ কেউ বলল, নীলাদ্রি কুন্ডের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর সেখান থেকেই সে অদৃশ্য কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিল। কেউ আবার বলল, সে নাকি কুন্ডের জলে তাকিয়েছিল—সেই জলে এখনও ডাকিনীর ছায়া বন্দি আছে, আর যে তাকায়, তার চোখে ভেসে ওঠে মৃত্যু। পুরোহিত এসে মৃতদেহ দেখে কড়া কণ্ঠে বললেন, “এটা শুধু মৃত্যু নয়, এটা অভিশাপ। ও কুন্ডের টানে কেউ গেলে সে বাঁচে না। আমরা যদি গ্রামকে রক্ষা করতে চাই, তবে ওই জঙ্গল পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।” গ্রামের মানুষজন মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, কিন্তু তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক ছিল স্পষ্ট। রাত নামার আগেই সবাই ঘরে ঢুকে পড়ল, দরজা জানালা বন্ধ করল, আর বাইরে কুয়াশার ভেতরে সেই ভয়ঙ্কর কুন্ড যেন আরও কাছে চলে এল। অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠছিল—সে জানত, এ মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং অদৃশ্যের ডাকে সাড়া দেওয়ার ফল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—নীলাদ্রিকে কে ডাকল? সেই নারীকণ্ঠ, না কি কুন্ডের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো অশরীরী শক্তি? আর ভয়ঙ্করভাবে মনে হচ্ছিল—এই ডাক কি একদিন তাকে-ও ডেকে নিয়ে যাবে?

নীলাদ্রির মৃত্যুর পর গ্রামে যেন আতঙ্কের ছায়া স্থায়ী হয়ে গেল। ছোট ছোট বাচ্চারা রাতে কাঁদতে শুরু করত, গৃহিণীরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কেঁপে উঠত, আর পুরুষেরা দিনের আলো ফোটার আগে জঙ্গলের ধারে পা বাড়াত না। ঠিক এই সময়ে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক শম্ভুদা উদ্যোগ নিলেন কুন্ডের আসল ইতিহাস জানার। তিনি ছিলেন বিদ্বান ও যুক্তিবাদী মানুষ, অযথা গুজবে কান দিতেন না। কিন্তু টানা কয়েকটি মৃত্যুর পর তিনিও বুঝলেন, এই ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনো প্রাচীন কাহিনি জড়িত। এক সন্ধ্যায় তিনি গ্রামের লাইব্রেরির ভেতরে জমে থাকা ধুলো ঝেড়ে কিছু পুরনো পুঁথি বের করলেন। সেই পুঁথিগুলো বহু প্রজন্ম ধরে অযত্নে পড়ে ছিল, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার গন্ধে যেন ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে। শম্ভুদা টেবিলে রাখা প্রদীপের আলোয় পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন এক অজানা কাহিনি—এই গ্রামেরই কোনো এক নারীর জীবনের সাথে কুন্ডের অভিশাপের সূত্রপাত। তিনি গ্রামের লোকদের ডাকলেন, স্কুলের উঠোনে সবাই জড়ো হলো। সন্ধ্যার লাল আলো গাছের ফাঁক গলে পড়ছিল, আর ভয়ে কাঁপতে থাকা মানুষদের সামনে শম্ভুদা কাহিনি বলা শুরু করলেন।

“প্রায় একশো বছর আগে,” তিনি বললেন, “এই গ্রামে বাস করত এক নারী তান্ত্রিকী—নাম তার কেউ আজ মনে রাখেনি, তবে পুঁথিতে লেখা আছে, তিনি ছিলেন অসামান্য শক্তিশালী সাধিকা। সমাজ তাকে ভয় পেত, কেউ কাছে আসত না, কারণ বলা হতো তিনি অশুভ শক্তির সঙ্গে সংসর্গ করেন। একদিন তিনি ঘোষণা করলেন, তিনি অমরত্ব লাভের সাধনা করবেন। সেই সময়েই তিনি জঙ্গলের গভীরে এই কুন্ড খুঁজে পান। কুন্ডটি প্রাকৃতিক ছিল না, বরং বহু পুরনো কোনো আচারবিধির অংশ বলে ধারণা করা হয়। সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ সাধনা শুরু করেন। পুঁথিতে লেখা আছে, রাতের পর রাত তিনি মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, ভয়ঙ্কর শব্দে কাঁপত চারপাশের গাছপালা, এমনকি পশুপাখিরাও দূরে সরে যেত। মানুষ তখনও বলত, ‘ওই জঙ্গলে এক ডাকিনী বাস করে।’ তিনি প্রায় সিদ্ধিলাভের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু সময়ের আগে মৃত্যু এসে তার সাধনা ভঙ্গ করে। পুঁথির ভাষায়—‘অমরত্ব অসম্পূর্ণ রইল, সাধিকা মৃত্যুর সীমা ছাড়ালেও মুক্তি পেল না।’” শম্ভুদা নিঃশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকালেন। গ্রামবাসীরা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই কাহিনি নিছক গল্প নয়, বরং তাদের চারপাশে ঘটতে থাকা অশুভ ঘটনার শিকড়।

শম্ভুদা বললেন, “সেই সাধিকার আত্মা আজও এই কুন্ডের ধারে বন্দি। মৃত্যুর পরও সে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ অসম্পূর্ণ সাধনা তাকে মুক্তি দেয়নি। তাই রাতের বেলায় আমরা শুনি নারীকণ্ঠে সেই করুণ, অথচ ভয়ঙ্কর মন্ত্রপাঠ। যে কেউ সেই কণ্ঠে সাড়া দেয়, বা কুন্ডের জলে চোখ রাখে, সে আর ফেরে না—তার দেহ এখানে থাকে, কিন্তু আত্মা কে জানে কোথায় হারিয়ে যায়।” গ্রামের লোকেরা আতঙ্কে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, তারা ছোটবেলা থেকে এই কাহিনি শুনে এসেছেন, কিন্তু কখনও এত বিস্তারিতভাবে শোনেননি। এখন তারা বুঝতে পারছিলেন, কেন কুন্ডটা এত ভয়ঙ্কর, কেন সেখানে গিয়ে মানুষ আর বাঁচে না। অরিন্দম নীরবে বসে ছিল, তার গা দিয়ে শীতল ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল। সে জানত, সেই রাতের শব্দ ছিল সত্যি—মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা এক নারীর অমরত্বের ব্যর্থ আর্তনাদ। তার মনে হচ্ছিল, যেন অদৃশ্যভাবে সেই ডাক এখনও তাকে টানছে। আর গ্রামজুড়ে ভয়ের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত এক প্রশ্ন—যদি এই আত্মা মুক্তি না পায়, তবে কি কুন্ডের অভিশাপ চিরকাল এভাবেই চলবে? আর কে, বা কী, সেই অভিশপ্ত সাধনাকে শেষ করতে পারবে?

অরিন্দমের ভয় দিন দিন বেড়ে চলছিল। নীলাদ্রির মৃত্যুর পর থেকেই তার মন অস্থির হয়ে উঠেছিল, কিন্তু শম্ভুদার বলা ইতিহাস শোনার পর ভয় যেন অদ্ভুত এক বাস্তব রূপ নিল। রাতগুলো তার কাছে যন্ত্রণা হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি রাতে সে চেষ্টা করত গভীর ঘুমে ঢলে পড়তে, কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের সেই শব্দ কানে বাজতে থাকত। এক রাতে, হঠাৎ করেই সে নিজেকে দেখতে পেল এক অপরিচিত দৃশ্যে। চারপাশে ঘন অন্ধকার, কেবল চাঁদের আলোয় ভেজা এক কুন্ডের পাড়। জলের ওপরে কুয়াশার পর্দা, আর তার মাঝখান থেকে ভেসে উঠল এক সাদা শাড়ি পরা নারী। তার দীর্ঘ চুল ভিজে কপালের উপর লেগে আছে, চোখ দুটো যেন আগুনের মতো জ্বলছে। নারীটির ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ আসছে না। অরিন্দম স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ সে দেখল, ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে যেন এক অদৃশ্য মন্ত্র বেরোচ্ছে, যা বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই নারীটি তার দিকে হাত বাড়াল। অরিন্দম অনুভব করল, সে নড়তে পারছে না, তার দুই পা যেন জমে গেছে মাটিতে। নারীটির ঠোঁট এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল, সে বলছে—“আমার সাধনা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, তুমি সাহায্য না করলে আমি মুক্তি পাব না। যদি সাহায্য না করো, তবে তোমাকেই নিতে হবে।”

অরিন্দম হঠাৎ ঠান্ডা ঘামে ভিজে চমকে উঠে বসে পড়ল। তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত, বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছিল যেন ঢাকের মতো। ঘর অন্ধকার, শুধু জানালা দিয়ে ঢুকে আসা চাঁদের ফিকে আলো। তার মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন নয়, সত্যি সে কথা শুনেছে। তার কানে যেন এখনও বাজছে সেই করুণ, অথচ ভয়ঙ্কর আহ্বান। সে চুপচাপ বসে থাকল অনেকক্ষণ, জানালার বাইরে তাকিয়ে। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে, অদৃশ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘুম আর আসছিল না। সকালে মায়ের ডাকেই সে একটু স্বাভাবিক হল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, ডাকিনী তাকে বেছে নিয়েছে। গ্রামের অন্য কেউ নয়, বরং তাকেই ডেকেছে। কেন? এই প্রশ্ন তার মনে তোলপাড় করতে লাগল। হয়তো কারণ সে কুন্ডের কাছে গিয়েছিল প্রথমবার, আর সেই নারীকণ্ঠ শোনার সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু এবার আর সেটা শুধুই শব্দ নয়, স্বপ্নে রূপ নিয়েছে, যেন ডাকিনী তার আত্মার গভীরে হাত রেখে ডাক দিচ্ছে।

এরপর থেকে অরিন্দমের প্রতিটি দিন ভয়ে মোড়া হয়ে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে বসলেও সে প্রায়ই চুপচাপ থেকে যেত, চোখের সামনে যেন কুন্ডের ছবি ভেসে উঠত। রাতে শোবার সময় বুক ধড়ফড় করত, ঘুম আসত দেরি করে। আর আসলেও সে একই দৃশ্য দেখতে পেত—সাদা শাড়ি পরা নারী কুন্ড থেকে বেরিয়ে এসে তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। এবার নারীটির চোখে কান্না দেখা যাচ্ছিল, যেন মুক্তির জন্য আকুল আর্তনাদ। এক রাতে সে আবার স্পষ্ট শুনল—“অরিন্দম, তোমাকে চাই। তুমি না এলে আমি শান্তি পাব না।” অরিন্দম জানত, সে চাইলেও পালাতে পারবে না। এই ডাক তার অন্তরে ঢুকে গেছে, মন্ত্রের মতো শক্তি তাকে বেঁধে রেখেছে। ভোরে ঘুম ভাঙলে সে জানত, ডাকিনী শুধু স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও তাকে বেছে নিয়েছে। আর সে সাহায্য করুক বা না করুক, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। এই অদৃশ্য শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নেই। অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, আসন্ন দিনগুলো তাকে এমন এক পথে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না।

অরিন্দম অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল যে পালিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। দিনের পর দিন দুঃস্বপ্ন আর সেই অদৃশ্য ডাক তার মনের ভেতর ভয় জমিয়ে রেখেছিল, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল, এই রহস্য থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে মুখোমুখি হতে হবে। এক রাতে, যখন গ্রাম নিস্তব্ধ, চারপাশে কেবল পোকামাকড়ের শব্দ, তখন সে একটি ছোট ব্যাগে কিছু জিনিস গুছিয়ে নিল। ব্যাগে রাখল মোমবাতি, দেশলাই, আর পুরোনো একটি মন্ত্র বই—যা সে শম্ভুদার কাছ থেকে ধার নিয়েছিল। বইটি ছিল সংস্কৃত আর বাংলার মিশ্রণে লেখা, যার পাতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়া, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে ছিল কিছু প্রাচীন রক্ষাকবচ মন্ত্র। বুকের ভেতর ভয় জমলেও অরিন্দম অনুভব করছিল, তার ওপর যেন এক অদৃশ্য দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। সেই দায়িত্ব এড়ানো মানে কেবল নিজের নয়, পুরো গ্রামের সর্বনাশ ডেকে আনা। ধীর পায়ে সে বেরোল ঘর থেকে, মায়ের ঘুম ভাঙল না। বাইরে চাঁদের আলোয় পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু অরিন্দমের মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছায়ার ভেতর কেউ লুকিয়ে আছে। জঙ্গলের দিকে যতই এগোচ্ছিল, ততই বাতাস ঠান্ডা হয়ে উঠছিল, যেন কুন্ড তাকে ডাকছে। অবশেষে ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছাল সেই অভিশপ্ত জায়গায়।

কুন্ডের ধারে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের শরীর কেঁপে উঠল। রাতের নিস্তব্ধতায় জলের উপর থেকে হঠাৎই ভেসে এলো মন্ত্রোচ্চারণের করুণ ধ্বনি। শব্দটা এত স্পষ্ট ছিল যে মনে হচ্ছিল, যেন কারও নিঃশ্বাস তার কানের পাশে গিয়ে লাগছে। অরিন্দম কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করে জ্বালাল। চারদিকে অন্ধকারে সেই ক্ষীণ আলো এক টুকরো নিরাপত্তার মতো মনে হলেও আসলে আলোয় আরও ভয়ানক দেখাচ্ছিল চারপাশের গাছপালা। সে ধীরে ধীরে মন্ত্র বই খুলে রাখল হাঁটুর ওপর। বইয়ের অক্ষরগুলো কেঁপে উঠছে বলে মনে হচ্ছিল, যেন শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে গেছে। ঠিক তখনই কুন্ডের জলে ভয়ঙ্কর এক আলোড়ন দেখা দিল। শান্ত জলের ওপর ঢেউয়ের মতো কুয়াশা ভেসে উঠল, আর তার মাঝখান থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হতে লাগল এক মুখ। প্রথমে সেটা অস্পষ্ট, কেবল নারীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। তারপর মুখটি স্পষ্ট হলো—অর্ধেক ছিল অপূর্ব সুন্দরী, যেন কোনো দেবীর মূর্তি, চোখে শান্তি আর আলো। কিন্তু অন্য অর্ধেক বিকৃত, ভয়াবহ, যেন পোড়া মাংস আর বিকলাঙ্গ রূপ। এই দ্বিমুখী সৌন্দর্য আর ভয়াবহতা মিলেমিশে অরিন্দমকে অভিভূত করল। সে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল, শরীর অবশ, কিন্তু চোখ সরাতে পারল না।

“অরিন্দম…” সেই নারীকণ্ঠ আবার ডেকে উঠল। এবার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত মায়া আর শীতলতা। মুখের সুন্দর অর্ধেক থেকে বেরোচ্ছে মৃদু হাসি, আর বিকৃত অর্ধেক থেকে বেরোচ্ছে আর্তনাদ। “আমার সাধনা শেষ করতে হবে… না হলে আমি মুক্তি পাব না… তুমি না এলে তোমাকেই নিতে হবে।” অরিন্দমের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সে বইয়ের পাতার দিকে তাকাল, যেখানে রক্ষাকবচ মন্ত্র লেখা ছিল, কিন্তু শব্দগুলো যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তার ঠোঁট কাঁপছিল, অথচ শব্দ বেরোচ্ছিল না। কুন্ডের জল তখন তীব্রভাবে আলোড়িত হতে লাগল, যেন ভেতর থেকে কেউ উঠে আসতে চাইছে। অরিন্দম মরিয়া হয়ে বইয়ের একটি মন্ত্র আওড়াতে শুরু করল, যদিও শব্দগুলো কেঁপে যাচ্ছিল। মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতির শিখা হঠাৎ বেড়ে উঠল, আর সেই মুহূর্তে নারীর মুখ বিকৃতভাবে চেঁচিয়ে উঠল। জঙ্গলের ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে বাজল সেই আর্তনাদ। কিন্তু মন্ত্র থামতেই আবার কণ্ঠটা নরম হলো, যেন সে অনুনয় করছে—“আমাকে মুক্তি দাও, অরিন্দম… আমার সাধনা শেষ করতে সাহায্য করো…” অরিন্দম বুঝতে পারল, এই রাত তার জীবন বদলে দেবে। সে আর স্রেফ গ্রামের এক সাধারণ ছেলে নয়, বরং এক অভিশপ্ত সাধিকার অসম্পূর্ণ যজ্ঞের অংশ হয়ে গেছে। তার ভেতরে ভয় আর দায়িত্ব মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করল, আর কুন্ডের জল ততক্ষণে ভয়ঙ্করভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিল, যেন পরবর্তী পদক্ষেপ তার হাতেই নির্ভর করছে।

অরিন্দম সেই রাতের ভয়াবহ দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে মোমবাতির ক্ষীণ আলো আর কাঁপতে থাকা মন্ত্র বই। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল কুন্ডের উপর ভেসে উঠছে এক অদ্ভুত কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। বুকের ভেতর কাঁপন সত্ত্বেও সে ধীরে ধীরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। প্রথমে শব্দগুলো অস্পষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন তার ঠোঁটের শব্দ আর কুন্ডের ভেতর থেকে ভেসে আসা মন্ত্র একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, গাছের পাতা কেঁপে উঠল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রাতের জঙ্গলে পাখিদের যে ডাক সর্বদা শোনা যায় তা হঠাৎ থেমে গেল। সম্পূর্ণ নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। এই নীরবতার মধ্যে অরিন্দম বুঝতে পারল, সে আর স্রেফ একজন মানুষ নয়, বরং এক সীমারেখার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে জীবিত আর মৃত, আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। কুন্ডের জল হঠাৎ তীব্রভাবে আলোড়িত হতে লাগল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ভেতর থেকে ছুটে আসছে। অরিন্দম চমকে দেখল, জলের ফেনার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে সেই নারীর ছায়া।

প্রথমে ছায়াটা কেবল জলের তরঙ্গে অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব ছিল। কিন্তু যত সে মন্ত্র জোরে উচ্চারণ করছিল, ততই ছায়াটি আকার নিতে লাগল। ধীরে ধীরে জল থেকে উঠে দাঁড়াল এক নারী-মূর্তি—অর্ধেক দেহ যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্যে পূর্ণ, চোখে করুণার আভা, মুখে নিস্তব্ধ শান্তি। কিন্তু অন্য অর্ধেক বিকৃত, ভয়ঙ্কর—মাংসের অংশ যেন ছিঁড়ে গেছে, চোখ ফাঁকা কোটরে পরিণত, ঠোঁট ছেঁড়া, দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে পচা গন্ধ। এই দ্বৈত রূপ দেখে অরিন্দমের শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। নারীটি ধীরে ধীরে হাত বাড়াল তার দিকে, কণ্ঠে ভেসে এলো আর্তনাদ—“আমাকে মুক্তি দাও… শতবর্ষ ধরে আমি আটকে আছি। আমার সাধনা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তুমি যদি সম্পূর্ণ না কর, তবে আমি নতুন শরীর চাইব। তোমার শরীর… অথবা অন্য কারও।” এই বাক্য শুনেই অরিন্দমের শরীর অবশ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না, এই আর্তনাদ আসলেই মুক্তির ডাক, নাকি ভয়ঙ্কর প্রতারণা। নারীর চোখের একপাশে জল ঝরছে, অন্যপাশে আগুনের মতো দাউ দাউ করছে।

কুন্ড তখন উথলে উঠছিল প্রবল শক্তিতে, যেন জলে কোনো অদৃশ্য দানব নড়ছে। অরিন্দম মরিয়া হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে যেতে লাগল, কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু শব্দ থামাচ্ছিল না। হঠাৎ এক ঝলক বাতাস বইতে লাগল, মোমবাতির শিখা নিভে গেল, চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল। এই অন্ধকারের মধ্যে নারীর ছায়া আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন অন্ধকারই তার আসল আশ্রয়। সে ধীরে ধীরে অরিন্দমের কাছে এগিয়ে এলো। অরিন্দম অনুভব করল, তার পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠছে, গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে চারপাশে। তার কানে ভেসে এলো নারীর করুণ ফিসফিসানি—“তুমি কি আমাকে মুক্তি দেবে, নাকি আমি তোমার দেহ নিয়ে নেব?” এই প্রশ্নের উত্তর অরিন্দমের হাতে, কিন্তু সে জানত না কোনটা সত্যি, কোনটা ভ্রান্তি। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি ঘূর্ণায়মান হচ্ছিল, যেন সে এক সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে—জীবিত আর মৃতের সীমানা। আর যদি একবার ভুল পা ফেলে, তবে হয়তো তার আত্মাও কুন্ডের ভেতরে চিরকালের জন্য বন্দি হয়ে যাবে।

১০

সেই রাতের অন্ধকারে গ্রামের লোকেরা আচমকা ঘুম ভেঙে ভয়ঙ্কর শব্দে কেঁপে ওঠে। কুন্ডের দিক থেকে যেন বজ্রপাতের মতো বিস্ফোরণ হলো, সঙ্গে কেঁপে উঠল জমিন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল আগুনে পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ। অনেকেই ভয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে কাঁপতে থাকে, কেউ কেউ সাহস করে উঠোনে বেরিয়েও কিছু দূর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখে যে আকাশ লালচে আলোয় দপদপ করছে, যেন কুন্ডের ভেতর থেকে আগুন ফেটে বেরোচ্ছে। নারী-পুরুষ, বুড়ো-বাচ্চা, সবাই প্রার্থনা করতে থাকে—“ঠাকুর, রক্ষা করো।” কারও কারও মনে হলো, যেন মানুষের হাহাকার মিশে আছে সেই বিস্ফোরণের শব্দে। রাত ভোর হয় দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের মতো, কারও ঘুম ফেরে না আর। ভোরের আলো ফুটতেই সাহসী কয়েকজন মিলে ছুটে যায় কুন্ডের দিকে। তারা দেখে, চারপাশে গাছের পাতা পুড়ে ঝলসে গেছে, মাটিতে ছাইয়ের দাগ, আর পানির গায়ে ফেনা জমে আছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো—অরিন্দমের কোনো চিহ্ন নেই। কেবল ভেজা ঘাসের ওপর পড়ে আছে তার মন্ত্রবই, যার কিছু পৃষ্ঠা জ্বলে কালো হয়ে গেছে, আর বাকিগুলো কাদা ও রক্তে ভিজে গেছে। বইয়ের পাতায় লালচে আঙুলের দাগ যেন কারও শেষ স্পর্শের কথা বলছে।

গ্রামে ফিরে খবর ছড়িয়ে পড়তেই তোলপাড় শুরু হলো। কেউ বলল, অরিন্দম হয়তো ডাকিনীকে মুক্তি দিয়েছে, তার অসম্পূর্ণ সাধনা সম্পূর্ণ করেছে, তাই বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে সে মুক্তির আলোয় বিলীন হয়েছে। আবার অন্যরা বলল, তা নয়—অরিন্দমই আসলে তার শিকার হয়েছে। যে ডাকিনী মৃত্যুর পরও মুক্তি পায়নি, সে হয়তো অরিন্দমকে নিজের ছায়া বানিয়ে নিয়েছে, তার আত্মা বন্দী করেছে কুন্ডের অন্ধকারে। প্রবীণেরা দাওয়ায় বসে গুরুগম্ভীরভাবে বলতে লাগল, “এই কুন্ড অভিশপ্ত। যতদিন এ থাকবে, শান্তি আসবে না।” কেউ ভয়ে বাড়ি বদলানোর কথা ভাবল, আবার কেউ কুন্ড ভরাট করার প্রস্তাব দিল। কিন্তু যতই বিতর্ক চলুক, গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মা-বাবারা সন্তানদের কড়া করে নিষেধ করল কুন্ডের ধারে যেতে। আর যুবকেরা অরিন্দমের ভাগ্যকে অভিশাপ মনে করে নিজেদের কৌতূহল চেপে রাখল। তবু গভীর রাতে যখন বাতাসে পাতার মর্মর শোনা যায়, অনেকে বলে তারা ভেসে আসে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ—কখনও ক্ষীণ, কখনও ভয়ঙ্কর জোরে। যেন অরিন্দম কিংবা সেই তান্ত্রিকীর আত্মা এখনও সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে।

সময় গড়াল, দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর। কিন্তু কুন্ডের রহস্য মুছে গেল না। অরিন্দমকে কেউ আর খুঁজে পেল না, তার নাম গ্রামে ভয় আর কৌতূহলের সঙ্গে উচ্চারিত হতে লাগল। কেউ তাকে শহিদ বলল, কেউ পাগল, কেউ আবার অভিশপ্ত। মন্ত্রবইটা গ্রামোৎসবে একবার প্রদর্শন করা হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন সেটাও অদৃশ্য হয়ে যায়, আর কেউ তা খুঁজে পায়নি। যেন কুন্ড নিজের সব প্রমাণ টেনে নেয় ভেতরে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভয়ে গল্প শোনে, আবার সাহসীরা রাতে গিয়ে শোনে মন্ত্রের সুর। তাদের চোখে পড়ে কুন্ডের পানির ওপর কখনও সাদা শাড়ির ছায়া, কখনও লালচে আলো। আর তখন তারা ছুটে পালিয়ে আসে আতঙ্কে। গ্রাম আজও বিশ্বাস করে, অরিন্দম হয়তো ডাকিনীকে মুক্তি দিয়েছে, কিংবা নিজেই তার ছায়া হয়ে গেছে। সত্যিটা কেউ জানে না। শুধু জানে, কুন্ড আজও আছে, আর রাত যত গভীর হয়, ততই অন্ধকারে ভেসে ওঠে সেই ভয়াল মন্ত্রোচ্চারণ—যেন মুক্তি আর অভিশাপের সীমারেখা মুছে গিয়ে অদৃশ্য এক ছায়াজগৎ টেনে আনছে গ্রামের জীবনকে।

শেষ

 

1000064470.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *