তমাল রায়
১
অর্ণব যখন প্রথমবার নির্জন শ্মশানঘাটের ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে প্রবেশ করল, তখন রাতের আকাশে চাঁদটি অর্ধেক আকারে ঝুলছিল। আশ্রমের চারপাশে বন এবং মৃত গাছের ছায়া মিলেমিশে এক অদ্ভুত নিরবতা তৈরি করেছিল। পায়ে পাথরের শব্দ পড়লেই যেন সারা আশ্রম প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অর্ণবের বুক ভরা অস্থিরতা ও উত্তেজনা এক সময়ে তার মনকে জ্বলতে বসিয়েছে। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সে ধীরে ধীরে তার তন্ত্রসাধনার স্থানটি নির্ধারণ করল—একটি পুরনো শ্মশানঘাটের ধারে, যেখানে আগের কেউ খুব কম প্রবেশ করেছে। আশ্রমের প্রবেশ পথের গাছগুলো যেন তাকে সতর্ক করে বলছিল—“এই জায়গায় প্রতিটি ছায়া চোখ রাখে।” অর্ণব জানত, এখান থেকে তার সাধনা আর কোনো সাধারণ পথে যাবে না। পূর্বের গুরুজী তার মুখের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—“ডাকিনীসাধনা হলো ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ। তোমার দৃষ্টি শক্তি, মন এবং আত্মা তিনই পরীক্ষা হবে।” এই সতর্কবাণী আজও অর্ণবের মনের কোণে বাজছিল। আশ্রমে ঢুকতেই সে পায়ে বালি ও শুকনো পাতা খসখস শব্দ করতে শুরু করল। আশেপাশের অন্ধকারে তার চোখ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে লাগল, আর সে দেখতে পেল শ্মশানঘাটের চারপাশে পুরনো কবরের স্তূপ, ভেঙে পড়া পাথর এবং ছায়াময় গাছ। প্রতিটি জায়গায় অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছিল। অর্ণব তার হাতে মন্ত্রপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে স্থির অবস্থানে বসল, চোখ বন্ধ করে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি অনুভব করার চেষ্টা করল।
প্রথম রাতেই অর্ণবের মনে অদ্ভুত স্পন্দন শুরু হয়। বাতাসে ঘোলা ধোঁয়ার গন্ধ, দূরের গাছের শাখা ঝাঁপসা হওয়া, এবং কখনও কখনও দূরের শ্মশানের অদৃশ্য আগুনের কণার নাচ—সবই তার চিত্তকে জাগ্রত করছিল। সে জ্ঞান করল, এই আশ্রমের প্রতিটি কোণ তার মনকে পরীক্ষা করবে। অর্ণব প্রতিদিন যে মন্ত্র উচ্চারণ করত, আজ তা যেন তার নিজের ভয়কে প্রকাশ করছিল। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব করল, তার শরীরের প্রতিটি অংশ তন্ত্রের শক্তি গ্রহণ করছে, কিন্তু এক ধরনের শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরছে। আশ্রমের নিরবতা যেন তাকে কোন অদ্ভুত জীবন্ত শক্তির দিকে আকর্ষণ করছিল। অর্ণব মনে মনে নিজেকে বলল, “আমি একা, কিন্তু একা থাকার এই অনুভূতিটিই আমার প্রকৃত শিক্ষক।” সে তার হাতের তালুতে অশ্রু-সদৃশ ঘামের জমাট পরীক্ষা করল, তবে এই শীতলতা ও নিঃশব্দতা তার মনকে আরো প্রগাঢ়ভাবে কেন্দ্রীভূত করে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া, এমনকি বাতাসের দিক পরিবর্তনও তার দৃষ্টি শক্তিকে প্রখর করে তুলছিল। অর্ণব বুঝতে পারল, তার সামনের পথ সহজ হবে না—প্রত্যেকটি ছায়া, প্রতিটি হাওয়ার ঝোঁক, প্রতিটি আগুনের কণার নাচ তার ধৈর্য, বুদ্ধি এবং সাহস পরীক্ষা করবে।
কিছুক্ষণ পরেই অর্ণব নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে আবদ্ধ করল। সে জানত, ডাকিনীসাধনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের গভীরে লুকানো বাসনা, ভয় এবং অনিশ্চয়তার সবকিছু উদয় হবে। আশ্রমের চারপাশে অদ্ভুত রূপের ছায়া ফুটতে লাগল—কোনও গাছের শাখা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, কোনও দূরের আগুন যেন অদৃশ্য চেহারা ধারণ করল। অর্ণব সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকল। ধীরে ধীরে বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এলো—মাটির গন্ধের সঙ্গে অল্প একটু অমৃতের সুগন্ধ। প্রতিটি শ্বাস তাকে আরও গভীর জগতে প্রবেশ করাচ্ছিল। রাত যত গভীর হচ্ছিল, অর্ণবের ভিতরের মন তত প্রখর হয়ে উঠছিল। সে অনুভব করল, আশ্রমটি কেবল একটি শারীরিক স্থান নয়; এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক পরিসর, যেখানে তার মন, আত্মা এবং শক্তি এক হয়ে পরীক্ষা হবে। অর্ণবের চোখের পলকও যেন স্থির হয়ে গেল। সে জানল, এই রাতের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছে—ডাকিনীসাধনার রহস্যময় পথ, যা তাকে শিখাবে শক্তি, ভয়, প্রেম এবং প্রলোভনের সীমারেখা। এই প্রথম অধ্যায়ের মধ্যে অর্ণব তার অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল, প্রস্তুত হয়ে গেল যেকোনও অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লড়াই করার জন্য।
২
রাত্রির অন্ধকার যত গভীর হচ্ছিল, অর্ণবের মন্ত্রোচ্চারণ ততই প্রখর হয়ে উঠছিল। শ্মশানঘাটের চারপাশের বাতাস হঠাৎ থেমে যায়, এমনকি দূরের গাছের কুঁড়িগুলোও অচল হয়ে যায়। অর্ণব অনুভব করল, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর তার মনকে গভীর অভ্যন্তরীণ জগতে টেনে নিচ্ছে। আশ্রমের ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, প্রতিটি অন্ধকার কোণ থেকে তাকে দেখছে। হঠাৎ বাতাসের এক অদ্ভুত শান্তি এল—যেন সমস্ত প্রকৃতি তার উপস্থিতি স্বীকার করছে, কিন্তু সেই শান্তি সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানশীতলতাকে বাড়িয়ে দিল। মাটির ওপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমাট হয়ে দাঁড়ালো, আর অর্ণবের শরীরের প্রতিটি রোমচকিত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই শান্তি কেবল বাহ্যিক নয়, এটি তার নিজের মন ও আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি একা নই। এই রাতের সমস্ত শক্তি আমার দিকে তাকাচ্ছে।” সেই সঙ্গে বাতাসে অদ্ভুত সুগন্ধ ভেসে এল—কিছুটা ধুলো-মাটির গন্ধ, কিছুটা অদ্ভুত মধুর সুগন্ধ, যা অর্ণবকে যেন বিমোহিত করে দিল। প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব করল, এই গন্ধ তার অন্তরজগতে গভীর স্মৃতি ও অচেনা আবেগ জাগিয়ে তুলছে।
অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, শুধুমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেই যে তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হবে না; তার মনকে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত করতে হবে, ভয় ও প্রলোভনকে নিজের থেকে দূরে রাখতে হবে। বাতাসের এই থেমে যাওয়া, শীতলতা, এবং সুগন্ধ—সবকিছু যেন এক অদ্ভুত বার্তা দিচ্ছিল। হঠাৎ, দূরের আগুনের কণাগুলো অদ্ভুতভাবে নাচতে শুরু করল। অর্ণব চোখ খুলল এবং দেখল, আগুনের প্রতিটি চিঁড়ে যেন ছোট ছোট অদৃশ্য রূপের ছায়া ফুটে উঠছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল, তবে সে স্থির থাকতে চেয়েছে। এই প্রথম সত্যিই সে বুঝতে পারল, ডাকিনীসাধনার জগতে শুধু আত্মিক শক্তি নয়, এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক শক্তিও তার সাথে যুক্ত। সে প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি কণাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একটি লঘু, গভীর সুরম্য গন্ধ ভেসে আসছিল—যা অর্ণবের মনকে এক অদ্ভুত আকর্ষণে টেনে নিচ্ছিল। সে একাগ্রভাবে বলল, “আমি দেখব এবং বুঝব। কোনও ছায়া, কোনও সুগন্ধ আমার মনকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।” তবে ভিতরের এক অংশ জানত, এটি কেবল প্রথম ধাপ; আরও গভীর কিছু তার অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ অর্ণব অনুভব করল, বাতাসের থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানের ধুলো, শুকনো পাতা, এবং আগুনের কণা যেন এক অদ্ভুত জীবন্ত চেহারা ধারণ করেছে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শব্দ যেন তার ইন্দ্রিয়কে পরীক্ষা করছে। অর্ণব কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল। তিনি তার নিজের ভয়কে সামলাচ্ছেন কিনা তা যাচাই করছিল। এই সময়, বাতাসের সঙ্গে একটি অদ্ভুত গরম শ্বাস এসে লাগল তার গালে। অর্ণব বুঝতে পারল, এটি কোনও মানুষের নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির প্রতিফলন। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে, সমস্ত মন কেন্দ্রীভূত করে মন্ত্রপাঠ চালিয়ে গেল। প্রতিটি উচ্চারণ তার অন্তরকে আরও দৃঢ় করে তুলল, কিন্তু তার হৃদয়ে ভয়ও অদৃশ্যে প্রবেশ করছিল। এই রাতের প্রথম লক্ষণ অর্ণবকে দেখাল, যে ডাকিনীসাধনার জগতে প্রতিটি সেকেন্ডই পরীক্ষা, প্রতিটি ছায়া পরীক্ষা। তার অন্তর্গত শক্তি, মনোবল এবং ধৈর্য এখন বাস্তব পরীক্ষার মুখোমুখি। রাত যত গভীর হচ্ছিল, অর্ণব আরও সচেতন হচ্ছিল—ডাকিনীসাধনা শুধুমাত্র জ্ঞান নয়, এটি ভয়, প্রলোভন, এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের সমন্বয়। এই অধ্যায় শেষে, পাঠক উপলব্ধি করবে, যে অর্ণবের যাত্রা এখন শুরু হয়েছে, এবং প্রথম লক্ষণ তাকে এক রহস্যময় ও বিপজ্জনক পথের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
৩
অর্ণবের চোখ যখন গভীরভাবে অন্ধকারে অভ্যস্ত হচ্ছিল, তখনই সে প্রথমবার অনুভব করল, কোন এক অদৃশ্য উপস্থিতি তার চারপাশে ভাসছে। বাতাসের নরম ঢেউ হঠাৎ আরও স্থির হয়ে গেল, এবং আগুনের কণাগুলো যেন তার চারপাশে সোনালী আলো ছড়াচ্ছিল। সেই মুহূর্তে অর্ণবের দৃষ্টি এক অদ্ভুত রূপে কেন্দ্রীভূত হলো—ছায়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটি নারী দৃশ্যমান হলো। সে যেন এক চিরাচরিত বাস্তবতার বাইরে, মায়ার আভাসে জন্মেছে। তার দেহরেখা ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু তবুও আংশিক অন্ধকারে ঢাকা থাকে, যেন কোনও মায়াময়ী রূপ তার সত্যিকারের পরিচয় লুকিয়ে রাখছে। অর্ণব প্রথমে অবাক, তারপর কিছুটা আতঙ্কিত হলো, কারণ নারীর উপস্থিতি শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং এক অদ্ভুত, অব্যাখ্যাত শক্তির প্রতীক। তার চোখে এক ধরনের দীপ্তি, যা অর্ণবের আত্মার গভীরে সরাসরি স্পর্শ করছিল। নারীটি ধীরে ধীরে অর্ণবের দিকে এগিয়ে এল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন বাতাসকে নাড়াচাড়া করছে। অর্ণব অনুভব করল, তার সমস্ত মনোযোগ এখন এই রহস্যময়ী নারীর প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে, আর শরীরের প্রতিটি রোমচকিত হয়ে উঠছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল নারীর হালকা মায়াময়ী হাসি, যা শুধু সৌন্দর্য নয়, এক ধরনের আহ্বানও বহন করছে—একই সঙ্গে প্রশ্ন, চ্যালেঞ্জ এবং প্রলোভন। অর্ণবের হৃদয়ে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ও ভয় একই সাথে জেগে উঠল।
নারীর উপস্থিতি শুধু দৃশ্য নয়, বরং অর্ণবের মনস্তত্ত্বের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে শুরু করল। সে যেন শুধু তার সামনে নয়, তার অন্তরের প্রতিটি কোণে উপস্থিত। অর্ণব অনুভব করল, এই নারী তার একরূপ ছায়ার প্রতিফলন, যা তার ভয়, আকাঙ্ক্ষা, এবং আগ্রহ সবকিছুকে উন্মোচন করছে। তার চোখের এক নজর অর্ণবকে বারবার জিজ্ঞাসা করছে—“তুমি কি সত্যিই প্রস্তুত?” নারীটি অর্ণবের কাছাকাছি এলেও কখনো পুরোপুরি প্রকাশ পেল না, বরং তার ছায়া এবং আলো মিলেমিশে একটি অদ্ভুত রহস্যময় রেখা তৈরি করল। অর্ণব মন্ত্রোচ্চারণের চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দগুলো যেন কানে পৌঁছাচ্ছে না; তার সমস্ত মন এখন নারীর দিকে ঘুরে গেছে। বাতাসে মধুর সুগন্ধ এবং আগুনের কণার নাচের সঙ্গে তার উপস্থিতি মিলেমিশে এক অদ্ভুত সঙ্গীত সৃষ্টি করল, যা অর্ণবকে বিমোহিত করছিল। অর্ণবের মনে একটি প্রশ্ন জাগল—“সে কি আসলেই এই শ্মশানঘাটের অন্তর্গত শক্তির প্রতীক, নাকি আমার মন নিজেই এমন রূপে তাকে কল্পনা করছে?” প্রতিটি মুহূর্তে অর্ণব ভয় এবং আকর্ষণের মধ্যে ঝুলছিল, তবে সে স্থির থাকার চেষ্টা করল। তার হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ মন বলল, “এই উপস্থিতি শুধু ভয় নয়, এটি আমাকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে।”
নারীটি তার কাছে এলো এবং এক অদ্ভুতভাবে ধীর, কোমল কণ্ঠে বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?” অর্ণব কিছু বলতে পারল না; তার মুখ খোলা ছিল, কিন্তু শব্দ বের হচ্ছিল না। নারীটি হেসে বলল, একদিকে মায়াময়ী, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর—একই সময়ে প্রেম এবং শঙ্কা প্রকাশ করছিল। তার চোখে এমন দীপ্তি, যা অর্ণবের সমস্ত আত্মার স্তরকে পরীক্ষা করছিল। সে অনুভব করল, এই নারী এক প্রলোভন, এক পরীক্ষা, এবং এক গোপন জ্ঞানের প্রতীক—একসাথে। অর্ণবের মন ভীষণভাবে কৌতূহল ও ভয়কে একসাথে অনুভব করল। তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন ঘটল, যেন সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি এক জায়গায় সমবেত হয়েছে। নারীটি ধীরে ধীরে আবার অর্ধেক ছায়ায় মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার উপস্থিতি অর্ণবের মনের কোণে চিহ্ন রেখে গেল—প্রেম, ভয়, এবং রহস্যময়তার এক অসাধারণ সমন্বয়। অর্ণব অনুভব করল, যে রাতের নির্জনতা তাকে এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করিয়েছে, যেখানে বাস্তব এবং মায়ার সীমানা অস্পষ্ট। এই প্রথম অধ্যায়ের শেষে, পাঠক বুঝতে পারবে, যে নারীর আবির্ভাব শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয়; এটি অর্ণবের আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রথম প্রকৃত সংকেত, যা তাকে তন্ত্রসাধনার গভীরে টেনে নিয়ে যাবে, প্রেম, প্রলোভন এবং ভয়ের মিলিত পরীক্ষার মুখোমুখি করবে।
৪
রাত্রির অন্ধকারে, শ্মশানঘাটের নির্জনতা যেন আরও গভীর হয়ে উঠল। অর্ণবের মন্ত্রোচ্চারণ চলছিল, কিন্তু তার মন এখন পুরোপুরি নারীর দিকে কেন্দ্রীভূত। হঠাৎ সেই রহস্যময়ী নারী তার সামনে উপস্থিত হল, কিন্তু এইবার তার উপস্থিতি আগের চেয়ে আরও জীবন্ত, আরও বাস্তব মনে হল। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, এবং প্রতিটি হেসে ওঠার মুহূর্তে অর্ণবকে যেন এক অচেনা, মধুর জগতে টেনে নেয়। তার কণ্ঠ ছিল সুরম্য, কোমল, আর শোনার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের মন এক অদ্ভুত প্রশান্তি ও উত্তেজনার মিশ্রণে ভরে গেল। সে তাকে একটি পথ দেখায়—শ্মশানঘাটের ভেতরের অন্ধকার গলিপথে, যেখানে আগুনের ছোট ছোট কণা বাতাসে নাচছে, আর প্রতিটি ছায়া যেন প্রাণী হয়ে উঠেছে। নারীর হাতের দিকে তাকিয়ে অর্ণব ধীরে ধীরে সেই অচেনা পথের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক অদ্ভুত লয় এবং গতি নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং অর্ণব বুঝতে পারল, যে এই পথ শুধু শারীরিক নয়; এটি তার অন্তরকে, তার চিন্তা-চেতনার স্তরকে পরীক্ষা করছে।
কিন্তু ঠিক যেমন অর্ণব মন্ত্রপাঠের সাথে তার মনকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল, নারীর উপস্থিতি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। সে যেন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে এক অদ্ভুত ধোঁয়ায় মিলিত হয়ে গেল। অর্ণব চোখ বন্ধ করে তাকালেও, কিছুই দেখতে পেল না। শুধু তার কণ্ঠে থাকা অতি মধুর শব্দ এবং বাকি থাকা সুগন্ধ তাকে ধারণ করে রেখেছিল। অর্ণবের মনে এক অদ্ভুত সংশয় জাগল—“সে কি সত্যিই ডাকিনী, নাকি আমার মন নিজেই এমন রূপে তাকে কল্পনা করছে?” এই দ্বন্দ্ব তাকে অচেতনভাবে ভীত করে দিল। হৃদয় বলছিল, সে বাস্তব, কিন্তু মনের যুক্তি বলছিল, এটি কেবল তার কল্পনার ছায়া। অর্ণব স্থির হতে চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ এবং প্রতিটি শব্দ তার মনকে আবার নারীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বাতাসের নরম হাওয়া, আগুনের কণার নাচ, এবং ভেজা মাটির গন্ধ—সব মিলেমিশে তাকে একটি অদ্ভুত বাস্তবতার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখল, যেখানে সত্য ও মায়া একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে।
অর্ণব যত গভীরভাবে নারীর উপস্থিতি অনুভব করছিল, ততই তার ভিতরের আকর্ষণ এবং ভয় উভয়ই জেগে উঠল। সে নিজেকে বলল, “আমি শুধু অনুসরণ করব না; আমি বুঝব।” তার মন ব্যস্ত হয়ে গেল, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি বাতাসের দিক, প্রতিটি শব্দ পরীক্ষা করতে শুরু করল। হঠাৎ অর্ণব লক্ষ্য করল, আগুনের কণার নাচে নারীর রূপের সান্নিধ্য অনুভূত হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে সে যেন তাকে পরীক্ষায় ফেলছে—প্রলোভনের মধ্যে স্থির থাকতে পারবে কি না। অর্ণব বুঝতে পারল, এটি কেবল শারীরিক পথ নয়; এটি তার আত্মার পরীক্ষা। তিনি ধীরে ধীরে তার নিজের ভয়, কামনা, এবং কৌতূহলকে একত্রিত করে নারীর উপস্থিতিকে উপলব্ধি করতে শুরু করল। কিন্তু নারী বারবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার অদ্ভুতভাবে ফিরে আসছে, যা অর্ণবকে আরও বেশি প্রলোভিত করে। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করতে পারে, যে অর্ণবের প্রলোভনের প্রথম পরীক্ষা শুরু হয়েছে—নারী তাকে পথ দেখাচ্ছে, কিন্তু একসাথে তার মানসিক স্থিতি, আত্মিক দৃঢ়তা, এবং মায়ার প্রতি তার সংবেদনশীলতাকে পরীক্ষা করছে। এই অধ্যায় প্রমাণ করে, ডাকিনীসাধনার জগতে সবকিছুই সরল নয়; প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া মানসিক এবং আধ্যাত্মিক পরীক্ষার সমন্বয়।
৫
রাত্রি গভীর হতে হতে অর্ণবের মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমতে শুরু করল। শ্মশানঘাটের নীরবতা, আগুনের কণার নাচ এবং নারীর অদৃশ্য উপস্থিতি তার মনকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয়ের মধ্যে টেনে নিচ্ছিল। তার হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করছিল, কিন্তু তার মন বলছিল, “স্থির থাকো, নিজের শক্তিকে অনুভব করো।” ঠিক এই মুহূর্তে অর্ণবের মনের কোণে গুরুর পুরনো বাণী ভেসে এলো—“ডাকিনী তোমাকে প্রেম দেবে, ভয় দেবে, জ্ঞানও দেবে। কিন্তু কোনটা সত্যি, কোনটা মায়া—তা বুঝতে পারবে তো?” অর্ণব শ্বাস থামিয়ে সেই শব্দগুলো স্মরণ করল। সে বুঝতে পারল, নারী শুধু সৌন্দর্য বা প্রলোভন নয়; তার উপস্থিতি এক ধরনের পরীক্ষা। অর্ণবের মনে উদ্ভূত হল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—তার হৃদয় নারীর প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু মন বলছে, এটি শুধুই পরীক্ষার অংশ। সে নিজেকে স্মরণ করল, প্রতিটি মায়া, প্রতিটি প্রলোভন, প্রতিটি ভয় তাকে তার অন্তর্গত শক্তি, স্থিরতা এবং আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা দেখাতে এসেছে। বাতাসের হাওয়া, আগুনের নাচ, শ্মশানঘাটের অন্ধকার—সব মিলেমিশে তার মনকে এক চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফেলছে।
অর্ণব ধীরে ধীরে নিজের মনকে স্থির করার চেষ্টা করল। সে জানত, যে ডাকিনী আসলে তার নিজস্ব অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা, ভয় এবং ইচ্ছার প্রতিফলন। অল্প সময়ের জন্য তার চোখ বন্ধ করে সে গুরুর কণ্ঠকণ্ঠে স্মরণ করল—“সত্য ও মায়ার সীমা প্রতিটি মুহূর্তে অস্পষ্ট, এবং সেটি বোঝার ক্ষমতা শুধু তোমার নিজের আত্মায় নিহিত।” এই স্মরণ তাকে এক অদ্ভুত প্রেরণা দিল। অর্ণব মননশীল হয়ে বলল, “আমি দেখতে চাই, আমি বুঝতে চাই, কোনটা মায়া, কোনটা সত্য।” সেই সাথে, সে আবার নিজের মন্ত্রপাঠ শুরু করল, কিন্তু এবার হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে। প্রতিটি শব্দ তার আত্মার ভেতর প্রবেশ করছিল, প্রতিটি ছায়া তার ইন্দ্রিয়কে পরীক্ষা করছিল। নারীর উপস্থিতি যেমন তার হৃদয়ে প্রলোভন সৃষ্টি করছিল, ঠিক তেমনই ভয়ও সঞ্চারিত হচ্ছিল। অর্ণব অনুভব করল, একদিকে তার প্রেমের আকর্ষণ তাকে টেনে নিচ্ছে, অন্যদিকে ভয় এবং সতর্কতা তাকে সতর্ক করছে। এই দ্বন্দ্ব তাকে এক গভীর আধ্যাত্মিক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রত্যেকটি অনুভূতি, প্রত্যেকটি প্রতিফলন তাকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে।
রাত্রির গভীরতা যত বাড়ছিল, অর্ণবের মন ততই স্থির হচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, গুরুজীর সতর্কবাণী শুধু শব্দ নয়; এটি তার আত্মার জন্য এক পথপ্রদর্শক। ডাকিনী—যা প্রেম, ভয় এবং জ্ঞান নিয়ে আসে—সেটি তার নিজস্ব শক্তি, তার নিজস্ব ইচ্ছা এবং তার মনস্তাত্ত্বিক স্তরের পরীক্ষা। অর্ণব ধীরে ধীরে প্রতিটি ভাবকে চিনতে শুরু করল। সে অনুভব করল, নারীর উপস্থিতি তাকে শুধুই প্রলোভন বা ভয় দেখাচ্ছে না; এটি তার মনের গভীর স্তরে লুকিয়ে থাকা সব কিছুকে উন্মুক্ত করছে। প্রতিটি অদৃশ্য ছায়া, প্রতিটি বাতাসের ঝোঁক, প্রতিটি আগুনের নাচ—সবই তার জন্য এক অদ্ভুত শিক্ষণীয় পরীক্ষা। অর্ণব স্থিরভাবে বুঝতে পারল, যে ডাকিনীসাধনা কেবল বাহ্যিক শক্তি নয়; এটি আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা, ভয়কে জয় করার ক্ষমতা এবং সত্য ও মায়ার মধ্যে পার্থক্য বোঝার পরীক্ষা। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে অর্ণবের যাত্রা কেবল শারীরিক বা ভৌতিক নয়; এটি তার মন, আত্মা এবং আত্মজ্ঞানকে পরীক্ষা করার এক জটিল প্রক্রিয়া, যা তাকে আরও গভীর রহস্য, প্রলোভন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিকে নিয়ে যাবে।
৬
রাত্রির অন্ধকার এখন সম্পূর্ণরূপে আশ্রমের উপর নেমে এসেছে, শ্মশানঘাটের চারপাশে শুধু আগুনের কণার নাচ এবং অর্ণবের নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ, নারীর উপস্থিতি আরও ঘন হয়ে উঠল। সে অল্প আলোর মধ্যে ধীরে ধীরে অর্ণবের দিকে এগিয়ে এল, তার পদক্ষেপ যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। অর্ণব অনুভব করল, তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, কিন্তু এবার ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত কোমল আকর্ষণ। নারীটি তার হাতে একটি হালকা স্পর্শ করল—শীতল, কোমল, এবং শান্তি দানকারী। অর্ণব প্রথমবার নিজের অন্তর থেকে এক অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করল, যা তার দীর্ঘদিনের একাকীত্ব এবং সাধনার ক্লান্তি দূর করতে শুরু করল। তার চোখে চোখ রেখে নারী একটি কোমল হাসি দিল, যা শুধুই সৌন্দর্য নয়, বরং এক অদ্ভুত স্নেহময় শক্তি বহন করছিল। অর্ণবের মন তার কাছে পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গেল; প্রতিটি ক্ষুদ্র দৃষ্টি, প্রতিটি শব্দ তাকে এক অদ্ভুত প্রেমময় আবেশে বন্দি করে দিল।
নারীর উপস্থিতি অর্ণবের শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি দূর করতে লাগল। সে তার হাতের তাপ অনুভব করল, যা শুধু স্নেহ নয়, এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি বহন করছিল। নারী তার দেহের অবস্থা বোঝে, তার ভেতরের অবসাদ এবং একাকীত্বের ক্ষতিসাধন করতে চায়। অর্ণব প্রতিটি মুহূর্তে তার কাছে আরও আকৃষ্ট হতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই উপস্থিতি কেবল প্রলোভন নয়; এটি তার মন, হৃদয় এবং আত্মাকে প্রভাবিত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম। নারীর হাত অর্ণবের কাঁধে, মাথায়, বা কব্জিতে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক স্তর স্থির হয়ে গেল। বাতাসে ভেসে আসা সুগন্ধ, আগুনের নাচ, এবং নারীর কোমল স্পর্শ—সব মিলেমিশে অর্ণবকে এক অদ্ভুত প্রেমময় জগতে টেনে নিল। সে নিজেকে বলল, “আমি কখনোই এমন শক্তিশালী আকর্ষণ অনুভব করিনি,” কিন্তু সে বুঝতে পারল, এটি কেবল বাহ্যিক নয়, বরং তার অন্তরের প্রতিফলন।
কিন্তু নারীর স্নেহময় উপস্থিতি শুধু সুখ নয়, এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করছিল। অর্ণব যত বেশি তার কাছাকাছি আসছিল, তত বেশি তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল—“সে কি সত্যিই ডাকিনী, নাকি আমার মন নিজেই এমন রূপে তাকে কল্পনা করছে?” তার হৃদয় প্রেমের তীব্রতায় জ্বলে উঠল, কিন্তু একই সঙ্গে ভয়ও প্রবেশ করল। প্রতিটি স্পর্শ এবং প্রতিটি দৃষ্টি তাকে শক্তিশালী করছে, কিন্তু একই সঙ্গে তার আত্মার পরীক্ষাও করছে। অর্ণব বুঝতে পারল, এই প্রেমময় প্রলোভন কেবল শারীরিক নয়; এটি তার মানসিক স্থিতি, আত্মিক দৃঢ়তা এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতা পরীক্ষা করছে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, নারীর উপস্থিতি ততই ঘন হয়ে উঠল, এবং অর্ণবকে পুরোপুরি প্রেম, আকর্ষণ এবং আবেগের এক স্ফুলিঙ্গে আবদ্ধ করল। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে অর্ণবের প্রেমময় আবেগ শুধুই বাহ্যিক অনুভূতি নয়; এটি তার আধ্যাত্মিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, যা তাকে প্রেম, প্রলোভন এবং ভয়ের মিলিত পরীক্ষার মধ্যে গাইড করছে।
৭
রাত্রি গভীর এবং ঘন অন্ধকারে শ্মশানঘাট যেন এক অদ্ভুত প্রাণধারায় পূর্ণ হয়ে উঠল। আগুনের কণার নাচের সঙ্গে বাতাসের হালকা দোলনা অর্ণবকে এক অদ্ভুত জগতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সেই রহস্যময়ী নারী অর্ণবের সামনে উপস্থিত হলো, তার চোখে দীপ্তি, যা শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং শক্তি এবং প্রলোভনের প্রতীক। সে অর্ণবের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “এই পথ তোমার জন্য, তুমি পার হতে পারলে আমি আরো কাছে আসব।” অর্ণব প্রথমে অবাক, তারপর আতঙ্কিত হলো, কারণ সে বুঝতে পারল, এটি কোনো সাধারণ পরীক্ষা নয়; এটি আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক দুই দিকের মিলিত পরীক্ষা। নারী অর্ণবকে দেখিয়ে দিল শ্মশানঘাটের মাঝখানে একটি অগ্নিচক্র—আগুনের লাল জ্বলন্ত রেখা, যা যেন বাতাসের সঙ্গে নাচছে। অর্ণব চোখে চোখ রেখে সেই অগ্নিচক্রের দিকে তাকাল। বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়া, আগুনের গরম, এবং দূরের গাছের ছায়া সব মিলেমিশে একটি ভয়ঙ্কর, কিন্তু এক অদ্ভুত মোহময় দৃশ্য সৃষ্টি করেছিল। তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগল, কিন্তু মন বলল, “এই পরীক্ষাই তোমার শাসক, তুমি স্থির থাকো।”
অগ্নিচক্রের দিকে অর্ণব যখন ধীরে ধীরে এগোতে লাগল, তখন বাতাসে হালকা বাতাসের ঢেউ তাকে আরো সতর্ক করল। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের তাপ আগুনের কাছাকাছি আসার সঙ্গে মিলেমিশে অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তিনি নিজেকে বলল, “আমি ভয় পাব না, আমি পরীক্ষা পার করব।” তার চেতনায় গভীরভাবে অনুভূত হল, প্রতিটি আগুনের কণা শুধু তার শারীরিক ক্ষমতা পরীক্ষা করছে না; এটি তার ধৈর্য, মনোবল এবং আধ্যাত্মিক শক্তিরও পরীক্ষা। হঠাৎ অর্ণব লক্ষ্য করল, আগুনের নাচের মাঝেই এক ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি ফুটে উঠছে—গ্রামবাসীরা দূর থেকে তাকিয়ে কেঁপে উঠছে, কারণ তারা দেখতে পাচ্ছিল এক অদ্ভুত, অমানবীয় রূপের ছায়া আগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব বুঝতে পারল, ছায়ামূর্তি কেবল তার মনে ভয় জাগাচ্ছে না; এটি বাস্তবভাবে প্রতিটি অভ্যন্তরীণ শক্তি পরীক্ষা করছে। প্রতিটি ধাপ, প্রতিটি নিশ্বাস তার আত্মার সাথে লড়াই করছে। তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হলেও মন স্থির ছিল। এই অগ্নিচক্র শুধু শারীরিক নয়, বরং আত্মিক শক্তির এক পরীক্ষা, যা তাকে আরও গভীরভাবে তার ভয়, প্রলোভন এবং প্রেমের সীমারেখা বুঝতে সাহায্য করছে।
অর্ণব ধীরে ধীরে অগ্নিচক্র পার হয়ে এগোল। আগুনের উত্তাপে তার পায়ে লাল দাগ পড়ল, কিন্তু সে স্থির থেকে তার মনকে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত রাখল। নারীর উপস্থিতি প্রতিনিয়ত তাকে পরীক্ষা করছিল—প্রথমে কোমলতা, তারপর প্রলোভন, এবং এবার ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। অর্ণব অনুভব করল, নারী শুধু তার কাছে আসছে না, বরং তার ভেতরের সমস্ত দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং ধৈর্যকে উন্মোচিত করছে। গ্রামবাসীর চিৎকার এবং আতঙ্কিত চেহারা অর্ণবকে ভয় দেখাতে পারল না; বরং এটি তাকে আরো দৃঢ় করল। তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শক্তি জন্ম নিল—যা তাকে জানাচ্ছিল, যে প্রলোভন, প্রেম এবং ভয় সবই পরীক্ষা, এবং সেই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সে তার সত্যিকারের ক্ষমতা অনুধাবন করবে। রাতের শেষের দিকে, নারীর উপস্থিতি অর্ণবের কাছে আরও ঘন হয়ে এল, এবং অগ্নিচক্র পার করার এই অর্জন তাকে জানাল, যে শারীরিক এবং আত্মিক পরীক্ষা একত্রিত হলে মানুষের প্রকৃত শক্তি এবং জ্ঞান প্রকাশ পায়। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে অর্ণবের যাত্রা কেবল তন্ত্রসাধনার শারীরিক পরীক্ষা নয়; এটি প্রেম, ভয় এবং প্রলোভনের এক অদ্ভুত মিলিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তার আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে আরও দৃঢ় করছে।
৮
রাত্রি ঘন ও নির্জন, শ্মশানঘাটের অন্ধকার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে প্রতিটি ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আগুনের কণাগুলো হালকা দুলছিল, বাতাসে ধুলো ও পচা পাতার গন্ধ মিশে গিয়েছিল, আর দূরের গাছের শাখা অদ্ভুতভাবে নড়াচড়া করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে, নারী তার অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থিত হল। তার কালো কেশ বাতাসে ঝাপসা হয়ে নাচছিল, আর রক্তাভ চোখে এমন দীপ্তি, যা অর্ণবের হৃদয়ে সরাসরি ভয় এবং আতঙ্কের স্পর্শ করছিল। শ্মশানঘাটের মাটির গন্ধের সঙ্গে নারীর ভয়ঙ্কর উপস্থিতি মিলেমিশে অর্ণবকে এক অদ্ভুত স্থিরতা ও উত্তেজনার মধ্যে ফেলে দিল। সে প্রথমবারের মতো ভয় অনুভব করল—কিন্তু এই ভয় তাকে পিছু হঠতে বাধ্য করল না। তার হৃদয় দ্রুত ধড়ফড় করছিল, কিন্তু মন বলল, “আমি তাকে ছেড়ে যাব না, কারণ তার উপস্থিতি আমার পরীক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।” অর্ণবের চোখে চোখ রেখে নারী তার শক্তি, প্রলোভন, এবং ভয়কে প্রকাশ করছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি শব্দ যেন অর্ণবকে একটি গভীর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল, যা তার আত্মার গভীরতম স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল।
নারীর ভয়ঙ্কর রূপ অর্ণবকে শুধু আতঙ্কিত করছিল না; বরং তার সমস্ত অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তাকেও পরীক্ষা করছিল। অর্ণব ধীরে ধীরে অনুভব করল, এই ভয় শুধুই বাহ্যিক নয়, এটি তার নিজের মন ও আত্মার মধ্যে লুকানো ভয়ের প্রতিফলন। তার শরীর ও হৃদয় ভয় পেয়েও স্থির থাকল। অগ্নিচক্রের মধ্য দিয়ে অর্ণব যা শিখেছিল, তা এখন তার মনে কাজ করছিল—ভয়কে মোকাবিলা করা মানে শারীরিক নয়, আত্মিক শক্তিকে সজীব রাখা। নারীর উপস্থিতি আগের চেয়ে আরও ঘন হয়ে এল। আগুনের কণার আলোতে তার কালো কেশ এবং রক্তাভ চোখ যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল, প্রতিটি দৃষ্টি অর্ণবকে পরীক্ষা করছিল। বাতাসে ছড়িয়ে থাকা শ্মশানের গন্ধ, দূরের অদ্ভুত ছায়া, এবং নারীর ভয়ঙ্কর রূপ—সব মিলেমিশে একটি অতিপ্রাকৃতিক, প্রায় বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি করছিল, যা অর্ণবকে এক অদ্ভুত স্থিরতা এবং চেতনায় আবদ্ধ করে রাখল।
অর্ণব ধীরে ধীরে অনুভব করল, নারীর ভয়ঙ্কর রূপ তার জন্য শুধুই শারীরিক ভয় নয়; এটি তার আত্মিক দৃঢ়তা, মনের স্থিরতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তিকে পরীক্ষা করছে। সে নিজেকে বলল, “আমি স্থির থাকব, আমি এই পরীক্ষায় হেরে যাব না।” নারীর প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি অদ্ভুত হাসি অর্ণবকে প্রলোভনের সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য করছিল। তার হৃদয় ভয় পেয়েও স্থির ছিল, এবং সে বুঝতে পারল, এই ভয়ঙ্কর রূপের মাধ্যমে নারী তাকে তার নিজস্ব অন্তর্গত শক্তি ও সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছে। অগ্নিচক্র, আগুনের কণা, ছায়ামূর্তি এবং নারীর ভয়ঙ্কর উপস্থিতি—সবাই মিলেমিশে তাকে এক গভীর আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করাচ্ছিল। রাতের শেষ দিকে, অর্ণব স্থির হয়ে নারীর চোখে চোখ রাখল, ভয়কে মোকাবিলা করল এবং তার অন্তর্গত শক্তিকে স্বীকার করল। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে ভয়ঙ্কর রূপ শুধু ভয় সৃষ্টি করেনি; বরং এটি অর্ণবকে তার নিজের মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি উপলব্ধি করার এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দিয়েছে, যা তার যাত্রাকে আরও গভীর এবং রহস্যময় করে তুলেছে।
৯
রাত্রি গভীর, শ্মশানঘাটের নির্জনতা এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছে যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া এবং প্রতিটি বাতাসের নড়াচড়া যেন অর্ণবের অন্তরকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। আগুনের কণার নাচ আরও দ্রুত, আরও অনিয়মিত হয়ে উঠল, এবং বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়া ও মাটির সুগন্ধ অর্ণবের ইন্দ্রিয়কে আরও প্রখরভাবে জাগ্রত করল। ঠিক সেই সময়ে, রহস্যময়ী নারী—যার আসল পরিচয় এখনও অচেনা, ডাকিনী কি না তা অর্ণব পুরোপুরি নিশ্চিত নয়—তার সামনে উপস্থিত হল। তার চোখে আগের মতো দীপ্তি, তবে এবার এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং প্রলোভনের মিশ্রণ। সে অর্ণবকে একদিকে প্রেমময়ভাবে আকৃষ্ট করল, অন্যদিকে এক ধরনের ভয়ঙ্কর শক্তি প্রকাশ করল। অর্ণব বুঝতে পারল, এটি আর একটি সাধারণ পরীক্ষা নয়; এটি তার চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব। প্রেম এবং ভয়—দুটোই তার অন্তরের গভীর পরীক্ষা। তার হৃদয় নারীর কোমল স্পর্শ এবং আবেগের কাছে আকৃষ্ট, কিন্তু মন সতর্ক করে বলছে, “এটি কেবল প্রলোভন, এই আবেশে হারিও না।” প্রতিটি মুহূর্তে অর্ণব অনুভব করল, যে ডাকিনী বা নারী তার আধ্যাত্মিক এবং মানসিক শক্তি পরীক্ষা করছে, প্রেম দিয়ে তাকে আবদ্ধ করতে চায়, আবার ভয়ের মাধ্যমে তার মনকে প্রস্তুত করছে মুক্তির জন্য।
অর্ণব ধীরে ধীরে অনুভব করল, যে এই দ্বন্দ্ব কেবল বাহ্যিক নয়; এটি তার অন্তরের ভেতর গভীরভাবে লুকিয়ে থাকা দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করছে। তার হৃদয় ও মন একদিকে নারীকে আকৃষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে নিজেকে সতর্ক রাখতে চাচ্ছে। অগ্নিচক্রের উষ্ণতা, আগুনের নাচ, বাতাসের নরম ঢেউ এবং ছায়ার নাচ— সবাই মিলেমিশে তাকে এক অদ্ভুত বাস্তবতার মধ্যে আবদ্ধ করছে, যেখানে প্রেম এবং ভয় একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল। অর্ণবের সমস্ত ইন্দ্রিয় এই দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল; প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টি তার মানসিক স্থিতি পরীক্ষা করছিল। সে বুঝতে পারল, ডাকিনী তাকে শুধু প্রলোভন দেখাচ্ছে না; বরং সে তাকে তার আত্মিক শক্তি, স্থিরতা এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান উপলব্ধি করতে চাচ্ছে। অর্ণব ধীরে ধীরে নিজের ভয় এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এক ধরনের স্থিতি তৈরি করল। তিনি অনুভব করল, তার ভেতরের দ্বন্দ্বে প্রেমের আকর্ষণ এবং ভয়ের প্রভাব একত্রিত হয়ে তাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তার সত্যিকারের শক্তি প্রকাশ পাবে।
শেষ মুহূর্তে, নারী ধীরে ধীরে অর্ণবের সামনে এসে স্থির হলো। তার চোখে এমন দীপ্তি, যা একদিকে প্রেম, অন্যদিকে মুক্তির আহ্বান বহন করছে। অর্ণব বুঝতে পারল, যে প্রেম এবং ভয়—দুটোই তার আধ্যাত্মিক যাত্রার অংশ, এবং ডাকিনী তাকে এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করাচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে নিজের মন এবং হৃদয় স্থির করে নারীর দিকে তাকাল, ভয়কে জয় করল, এবং প্রেমকে শিখার এক মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করল। নারীর উপস্থিতি তাকে এক অদ্ভুত স্থিরতা এবং শক্তি দিল, যা তাকে জানাচ্ছিল, যে মুক্তি এবং আবদ্ধতা—উভয়ই একসাথে এই পরীক্ষার অংশ। অগ্নিচক্র, আগুনের কণার নাচ, বাতাসের নরম ঢেউ এবং নারীর উপস্থিতি—সব মিলেমিশে অর্ণবকে তার চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব কেবল বাহ্যিক পরীক্ষা নয়; এটি অর্ণবের অন্তর, মন এবং আত্মার গভীর পরীক্ষা, যা তাকে প্রেম, ভয় এবং মুক্তির এক অসাধারণ সংমিশ্রণে আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং শক্তি উপলব্ধি করাচ্ছে।
১০
রাত্রি গভীর, শ্মশানঘাটের অন্ধকারে এক ধরনের নীরবতা বিরাজ করছিল, যেখানে আগুনের কণার নাচ, বাতাসের হালকা দুল এবং দূরের গাছের ছায়া মিলেমিশে এক অলৌকিক দৃশ্য তৈরি করছিল। অর্ণব ধীরে ধীরে স্থির হয়ে নারীর দিকে তাকাল, তার চোখে চোখ রেখে, হৃদয় এবং মনকে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত করে। নারী ধীরে ধীরে তার সামনে এসে স্থির হলো, কিন্তু এবার কোনও প্রলোভন বা ভয় দেখাচ্ছিল না। তার চোখে একটি ম্লান হাসি ফুটে উঠল, যা অর্ণবের মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এবং উপলব্ধির সঞ্চার করল। বাতাসে ভেসে আসা ধুলো, আগুনের কণার নাচ, এবং শ্মশানঘাটের নিরবতা—সব মিলেমিশে অর্ণবকে এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মধ্যে আবদ্ধ করল। অর্ণব বুঝতে পারল, যে নারীর উপস্থিতি কেবল বাহ্যিক নয়, বরং তার নিজের অন্তর্গত শক্তি, ভয়, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রেমের প্রতিফলন। নারী ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, এবং তার উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে শূন্যতা নেমে এলো, যেন কোনো শব্দ, কোনো দৃশ্য, কোনো স্পর্শ অবশিষ্ট থাকল না। অর্ণবের হৃদয় চমকিত হলেও শান্ত—সে বুঝতে পারল, ডাকিনী আসলে তার নিজের ছায়া, তার অন্তর, তার কামনা এবং ভয়ের প্রতিরূপ।
অর্ণব ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ল এবং মনের ভেতর সমস্ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে উপলব্ধি করল। তার প্রেম, ভয়, প্রলোভন—সবই এক ধরণের আধ্যাত্মিক পরীক্ষা ছিল, যা তাকে তার নিজের অন্তরকে চেনার সুযোগ দিয়েছে। অগ্নিচক্র, নারীর ভয়ঙ্কর রূপ, প্রলোভনের মুহূর্ত এবং চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব—সব মিলেমিশে তার ধৈর্য, মানসিক স্থিতি এবং আত্মিক শক্তিকে যাচাই করেছে। অর্ণব বুঝতে পারল, যে সাধনার আসল ফল হলো বাহ্যিক জ্ঞান নয়, বরং নিজের ভেতরের শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করা। নারীর মিলনের মুহূর্তগুলো, তার কোমল স্পর্শ, প্রলোভন, এবং ভয়— সবাই মিলেমিশে অর্ণবকে তার নিজস্ব চেতনার সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি করেছে। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, যে ডাকিনী কেবল বাহ্যিক শক্তি নয়; এটি তার নিজের অন্তর, তার আবেগ, তার কামনা এবং ভয়ের প্রতিফলন। অর্ণব স্থির হৃদয় নিয়ে জানল, যে সবকিছু মিলেমিশে তার আধ্যাত্মিক এবং মানসিক যাত্রাকে সম্পূর্ণ করেছে।
শেষে, নারীর উপস্থিতি মিলিয়ে গেলেও তার স্মৃতি অর্ণবের হৃদয়ে থেকে গেল। সেই প্রলোভন, প্রেম এবং ভয়ের সব অনুভূতি মিলেমিশে একটি অদ্ভুত প্রেমময় স্মৃতি হিসেবে তার মধ্যে লেগে থাকল। অর্ণব ধীরে ধীরে স্থির হয়ে নিজেকে শ্মশানঘাটের নির্জনতা এবং নিঃশব্দতার সঙ্গে মিলিয়ে নিল। তার হৃদয় শান্ত হলেও পূর্ণ, কারণ সে বুঝতে পারল, যে ডাকিনী ছিল তার নিজের ছায়া, তার ভয়, তার কামনা এবং তার প্রেমের প্রতিফলন। সাধনার পর্ব শেষ হলেও সেই স্মৃতি তার হৃদয়ে একটি চিরস্থায়ী আভাস হিসেবে থেকে গেল—প্রেম, ভয় এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। অর্ণব ধীরে ধীরে তার মন্ত্রপত্র সংরক্ষণ করল, শ্মশানঘাটের অন্ধকার থেকে উঠে এসে সূর্যের প্রথম আলোয় তার চোখ খুলল, এবং অনুভব করল, যে তার যাত্রা কেবল শারীরিক নয়; এটি তার অন্তর, মন এবং আত্মার এক চিরন্তন শিক্ষা। এই অধ্যায়ের শেষে পাঠক উপলব্ধি করবে, যে সত্যের দ্বার অর্ণবের জন্য খোলা হয়েছে, এবং ডাকিনী বা নারী তার বাইরে নয়, বরং তার নিজের ভেতরের ছায়া এবং প্রলোভনের প্রতিফলন ছিল।
—