Bangla - তন্ত্র

ডাকিনীবৃত্তান্ত

Spread the love

অমৃতা রায় চৌধুরী


অধ্যায় ১:

কলকাতার উত্তরপ্রান্তের এক মফস্বলি ফ্ল্যাটের বারান্দা ধরে ছড়িয়ে পড়া সকালের আলোয় বসে ছিল অর্ণা সেনগুপ্ত, হাতে ছিল এক কাপ লিকার চা আর চোখ ছিল ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকে থাকা। তার চোখে লালচে রেখা, সারারাত ঘুম হয়নি ঠিকঠাক—নিউজরুমের মধ্যরাতের মিটিং, তার পরে হঠাৎ করে সিনিয়র এডিটরের একটি নির্দেশ—“ঝাড়খণ্ডে একটা মেয়ের মৃত্যুর খবর এসেছে, গ্রামবাসীরা বলছে ডাইনি, কিন্তু তুই গিয়ে দেখে আয়। কিন্তু এবার শুধু নিউজ রিপোর্ট নয়, আমি চাই এক্সপোজে—তুই পারবি।” অর্ণা পারবে না? অর্ণা জানে, এই সমাজ কিভাবে নারীর অস্বাভাবিকতা বা স্বাধীনতা দেখলেই তাকে ‘ডাইনি’, ‘অশুভ’, বা ‘অতিমাত্রায় শক্তিশালী’ বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু সাংবাদিকতা মানে কি কেবলই রিপোর্টিং? নাকি অন্যায় আর অন্ধবিশ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো? তার ভিতর এক অদ্ভুত আলোড়ন ছিল—গেলো দুই বছরে বহু প্রতিবেদন করেছে সে ধর্ষণ, নিপীড়ন আর প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কিন্তু এইটা ছিল অন্যরকম। কোথায় যেন অজানা এক টান অনুভব করছিল সে—ঝাড়খণ্ডের ওই অজ পাড়াগাঁ, নাম কুন্দরি, যার নাম সে আগে শোনেইনি, যেন তাকে ডেকে নিচ্ছে। রওনা হওয়ার আগে সে গুগল ঘেঁটে দেখেছিল—বিস্তীর্ণ জঙ্গল, মাটি লাল, সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল, এবং সেখানে এক স্কুলছাত্রী গৌরী হাঁসদার মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটা প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন, কিন্তু কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক দাবি করেছেন—তার শরীরে ছিল অদ্ভুত কাটা দাগ, আর মুখে ছিল ভয়ের ছাপ। পত্রিকার পোর্টালে সেই খবর তিন লাইনের বেশি হয়নি, কিন্তু অর্ণা বুঝেছিল—ওই তিন লাইনের পেছনে অনেক গভীর কিছু লুকিয়ে আছে।

ট্রেনের জানালার পাশে বসে অর্ণা নিজের নোটবুকের পাতা উল্টে যাচ্ছিল। তার সঙ্গে ছিল চিত্রগ্রাহক সঞ্জয় দে, সদ্য বিবাহিত, হালকা রসবোধসম্পন্ন, কিন্তু অতিপ্রাকৃত বিষয়ে সম্পূর্ণ অনাগ্রহী। সে ঠাট্টা করে বলছিল, “ডাইনি নেই, কিন্তু রাজনৈতিক ডোনেশন দিয়েই ওখানে মেয়েগুলো মারা যায়, বুঝলি? তুই শেষমেশ ডাইনী খুঁজতে গিয়ে একটা হরর সিনেমার কাহিনি বানিয়ে আনবি না তো?” অর্ণা হাসে না, সে জানে ভয় কোন রকমের হতে পারে—কখনো চোখে দেখা, কখনো সমাজে গেঁথে থাকা, কখনো নিজের মনেই লুকিয়ে থাকা। ট্রেন এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে পুরুলিয়া পেরিয়ে, রাঁচির দিকে, তারপর সেখান থেকে গাড়িতে করে আরও দু’ঘণ্টা পথ পেরিয়ে যাবে তাদের গন্তব্য কুন্দরি। দূরদূরান্তে লাল মাটি, সাদাটে ধুলোর স্তর, এবং হালকা ঝাপসা বনাঞ্চল চোখে পড়ে জানালা দিয়ে। সঞ্জয় বসে বসে ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছে ক্যামেরায়, অর্ণা মাথা নিচু করে তার পুরনো প্রতিবেদনগুলো পড়ছিল—কিভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে এক বিধবার ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসী, কিভাবে বিষ্ণুপুরে এক আদিবাসী নারীকে গাছে বেঁধে পেটানো হয়েছিল ‘জাদুবিদ্যা’র অভিযোগে। এসব ঘটনার মধ্যে একটা মিল রয়েছে—নারী, ক্ষমতা, ভয়, এবং কুসংস্কার।

ঝাড়খণ্ডের গ্রাম পথে পৌঁছতেই অর্ণা টের পেল, কুন্দরি অন্যরকম। গ্রামে ঢোকার মুখে যে প্রাচীন কুঁড়েঘরগুলো চোখে পড়ল, তাতে ছিল অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকা—লাল রঙে আঁকা বৃত্ত, ত্রিভুজ, কচ্ছপ, আর একধরনের মুখছবি, যা দৃষ্টি আটকে দেয়। গ্রামের মানুষজন তাদের দিকে তাকায় একটু হালকা আতঙ্ক আর কৌতূহল নিয়ে। একজন বৃদ্ধা মুখ নিচু করে চলে গেল অর্ণার পাশ দিয়ে, যেন তার উপস্থিতি অশুভ। স্থানীয় থানার ওসি কথা বলতে চাইলেন না—তিনি বললেন, “আপনারা রিপোর্ট করুন, তবে বেশি প্রশ্ন করবেন না। এখানে মানুষের বিশ্বাস আলাদা।” স্কুলে গিয়েও খুব বেশি কথা পাওয়া গেল না। একমাত্র মেয়েটির এক বান্ধবী ফিসফিস করে বলল, “গৌরী মৃত্যুর আগে খুব অদ্ভুত আচরণ করছিল, সে বলত, কেউ তাকে ডাকছে রাতে… সে ঘুমাতে পারত না।” আরেকজন বলল, “ও নাকি শ্মশানের কাছে যেত একা একা…” অর্ণা এসব শুনে মনে মনে প্রশ্ন তোলে—একটা কিশোরী কেন এইরকম আচরণ করছিল? সেই রাতে, তারা যে সরকারি গেস্ট হাউজে উঠেছিল, সেখানে হালকা হাওয়ার শব্দের ফাঁকে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল যেন দূর থেকে কেউ গলা নামিয়ে কিছু জপছে। অর্ণা জানে না এগুলো তার কল্পনা, না বাস্তব। কিন্তু রাতে ঘুমানোর আগে সে অনুভব করে, তার ঘরের জানালায় যেন এক মুহূর্তের জন্য কারও ছায়া পড়েছিল। সে উঠে জানালার কাছে যায়, বাইরে তাকায়, কিছু নেই—শুধু গাঢ় অন্ধকার আর বনের সুর। এই কুন্দরি কেবল একটি রহস্যময় মৃত্যু নয়, যেন আরও কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছে তাকে গ্রাস করার জন্য। এক অদ্ভুত বাতাসে যেন শোনা যায়—“তুইও আসবি, মা… তোর মধ্যেও আছে, আমাদের রক্ত…”

অধ্যায় ২:

সকালের আলো গ্রামের ওপর ধীরে ধীরে নামছিল, কিন্তু কুন্দরি যেন আলোকে ছুঁতেই চায় না। চারপাশে একধরনের স্যাঁতসেঁতে কুয়াশা, ঘরের চালা থেকে ঝুলে থাকা পুরনো বটগাছের শিকড়ের মতো, বাতাসে জমে থাকা আতঙ্কের গন্ধ। অর্ণা ও সঞ্জয় গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে স্থানীয় স্কুলের পথে রওনা দেয়, যেখানে গৌরী হাঁসদা শেষবার দেখা গিয়েছিল। রাস্তা কাদা আর শুকনো ধুলোর মিশেলে বেখাপ্পা, আর চারপাশে বাড়ির গায়ে আঁকা থাকে মাটি দিয়ে তৈরি লালচে আলপনা—কিন্তু এগুলো সাধারণ উৎসবের চিহ্ন নয়, বরং অদ্ভুত সব চক্রাকৃতি, কিছু ত্রিকোণ, কিছু দৃষ্টিশূন্য মুখ। এগুলো অর্ণাকে যেন টেনে নিচ্ছিল; সে থেমে দাঁড়িয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় সঞ্জয় বলে ওঠে, “এই যে, অর্ণা! ভয় পাচ্ছিস নাকি?” অর্ণা মুখে কিছু না বলে এগিয়ে চলে, কিন্তু তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে—এগুলো কেবল অলঙ্করণ নয়, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও প্রাচীন ভাষা বা চিহ্ন লুকিয়ে আছে। স্কুলে পৌঁছে তারা কথা বলে প্রধান শিক্ষক শৈলেশ হেমব্রম-এর সঙ্গে, যিনি স্বাভাবিকভাবে বন্ধুভাবাপন্ন, কিন্তু অর্ণার প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করেন। “গৌরী খুব ভালো ছাত্রী ছিল। কিন্তু শেষের দিকে অনেকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু বলত—‘ওরা আসছে’, ‘আমি ওদের দেখতে পাই।’ আমরা ভেবেছিলাম মানসিক সমস্যা হচ্ছে। ওর মা ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর…” তিনি আর কিছু বলেন না।

অর্ণা গৌরীর বাড়িতে যায়। কুঁড়েঘর, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। দরজার বাইরে একটা তালা ঝুলছে। একজন প্রতিবেশী জানায়, “ওর মা গিয়েছেন বোনের বাড়ি। এখানে থাকা যাচ্ছে না। লোকজন বলে, ওর আত্মা ঘুরে বেড়ায়।” অর্ণা সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা চাপা কাঁপুনি অনুভব করে। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে—“তুমি শহর থেকে এসেছো? ওদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছো?” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, এক বৃদ্ধা মহিলা—রুক্ষ চুল, কুঁচকে যাওয়া গাল, চোখে যেন প্রাচীন সময়ের ছায়া। তিনি নিজের পরিচয় দেন, “আমার নাম চুনী। সবাই বলে পাগলী চুনী। কিন্তু আমি সব জানি। ওরা ফিরে এসেছে।” অর্ণা জানতে চায়, “ওরা মানে?” মহিলা উত্তর না দিয়ে বলে, “আজ রাতটা দেখতে থেকো। আজ অমাবস্যা। ওরা জাগে আজ।” বলেই ঘুরে চলে যান। অর্ণা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। তার মধ্যে এক অদ্ভুত টান কাজ করে, যেন কেউ ধীরে ধীরে তার মনের মধ্যে ঢুকে বলছে—“তুমি আসবে। তুমি জানবে।” সঞ্জয় তার কাঁধে হাত রাখে—“এই গ্রামের সবাই হ্যালুসিনেশনে ভোগে, পুরোটাই মনস্তত্ত্ব।” অর্ণা কিছু বলে না। তার ভেতর যুক্তি-তর্কের জায়গায় এক অদৃশ্য শূন্যতা জন্ম নিচ্ছে, যা ভাষায় ধরা যায় না।

সন্ধ্যাবেলা গেস্ট হাউসে ফিরে এসে সঞ্জয় ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখতে বসে। দুপুরে তারা গ্রামের শ্মশানের দিকে গিয়েছিল, যেখান থেকে গৌরীর দেহ উদ্ধার হয়েছিল—কিন্তু জায়গাটা ঘন ঝোপঝাড়ে ঢেকে, কেউ কিছু বলতে চায়নি। ফুটেজে দেখা যায়, এক বটগাছের নিচে পোড়া ছাই, চারপাশে পাথরের টুকরো দিয়ে ঘিরে রাখা। হঠাৎ অর্ণা বলে ওঠে—“একটু জুম করতো।” সঞ্জয় জুম করে, আর তখন দেখা যায় ছাইয়ের পাশে একটি কাঠের চাকতির ওপর আঁকা তান্ত্রিক চিহ্ন—তিনটি বৃত্ত, একটি উল্টো ত্রিকোণ এবং এক নারীর মুখ। অর্ণার বুকের মধ্যে যেন হিমশীতল কিছু নেমে আসে। “এই চিহ্নটা আমি দুপুরে এক বাড়ির গায়ে দেখেছিলাম,” সে বলে। সঞ্জয় আবার ঠাট্টা করে বলে—“তুই আবার ভূতে বিশ্বাস করছিস নাকি?” ঠিক সেইসময় হঠাৎ ভিডিও ফুটেজে ক্যামেরার পেছনে এক মুহূর্তের জন্য কুয়াশার মধ্যে ছায়া দেখা যায়—একজন নারী, দাঁড়িয়ে, চুল খোলা, তার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন ক্যামেরা কাঁপে। সঞ্জয় বলে—“এটা হয়তো টেকনিক্যাল গ্লিচ।” অর্ণা জানে, এটা গ্লিচ নয়। তার নিজের মন বলছে, কেউ আছে। রাত বাড়ে, বাতাস ভারী হয়, জানালার বাইরে ঝোপের পাতার ফাঁকে শোনা যায় একটা মিহি গান—“রাত ডাকে মা, আগুন জ্বালো মা…”। অর্ণা উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জঙ্গলের ভেতর দেখা যায় একরাশ ধোঁয়া, যেন কেউ আগুন জ্বালিয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা ছায়ামূর্তি নড়ে ওঠে। সে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ পেছনে সঞ্জয়ের গলা—“তুই ঠিক আছিস?” অর্ণা চোখ মেলে তাকায়, জানালার বাইরে এখন কিছুই নেই—শুধু অন্ধকার, আর তার মধ্য দিয়ে ভেসে আসে সেই একই গলা—“তুইও আসবি… তুইও…”

অধ্যায় ৩:

সকালে ঘুম ভাঙতেই অর্ণা অনুভব করল তার শরীর যেন ঠান্ডা ও জড়ানো কুয়াশার মধ্যে ডুবে আছে। ঘরের মধ্যে বাতাসে এক ধরনের থমথমে ভাব, যেন রাতের সমস্ত রহস্য এখনও মেঝেতে পড়ে আছে। সঞ্জয় তখনো ঘুমিয়ে, তার পাশেই রাখা ক্যামেরার লেন্স আবছা, যেন কেউ ওর ওপরে নিঃশ্বাস ফেলেছে। অর্ণা চুপচাপ উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরের আলো এখনও ধোঁয়াটে, কিন্তু জঙ্গলের দিক থেকে আসা হাওয়াতে ভেসে আসছে কিছু অদ্ভুত শব্দ, যেন কেউ মাটির নিচ থেকে ফিসফিস করে বলছে—”জানিস না তুই, আমরা কতকাল ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করছি?”। সেই মুহূর্তে দরজায় হালকা ঠক ঠক শব্দ হয়। অর্ণা দ্রুত দরজা খুলে দেখে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধা—চুনী মাহাতো। তার চোখে আজ আর আগের দিনের পাগলামি নেই, বরং তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টি যা যেন অনেক কিছু জেনে বসে আছে। মুখে ফিসফিস করে বলল, “চল, তোকে কিছু দেখাতে হবে।” অর্ণা দ্বিধায় পড়ে যায়, কিন্তু কৌতূহল তার যুক্তিকে চুপ করায়। পেছনে ক্যামেরা তুলে নেয়, আর নীরবে অনুসরণ করে চুনীকে।

চুনী তাকে গ্রামের শেষ প্রান্তে এক পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের ভেতর নিয়ে যায়। ভিতরে ঢুকেই একটা ঝাঁঝালো ধূপের গন্ধ নাকে আসে। অন্ধকার ঘরের এক কোণে রাখা আছে কাঠের ছোট আলমারি, মাটির প্রদীপ, কিছু শুকনো নিমপাতা, আর চুনী আলমারির নিচ থেকে বের করে এক মোটা ধুলিধরা বই—মলাট ছেঁড়া, পাতাগুলো কুয়াশার মতো নরম, ছাপা অক্ষর ঝাপসা। বইটার নাম ‘ডাকিনী বিদ্যা: তান্ত্রিক চর্চার গুহ্যজ্ঞান’। অর্ণার গায়ে হিম স্রোত বয়ে যায়। চুনী ধীরে ধীরে বলে, “এই বই আমি পেয়েছিলাম আমার গুরু তামসী দেবীর কাছ থেকে। আমি ছিলাম ডাকিনীদের সমাজের একজন—তখন আমার নাম ছিল ‘রূপামালা’। আমি সাধনা করেছিলাম ছায়াশক্তির, অন্ধকারের, মৃত্যুর… কিন্তু আমি পালিয়ে এসেছিলাম।” অর্ণা শুনতে শুনতে পাতা উল্টায়—বইয়ের মধ্যে আঁকা রয়েছে নারীদেহের বিভিন্ন শক্তি-চক্র, রক্তবলিদান এবং ‘অমর শক্তির আহ্বান’ এর নিয়মাবলি। কিছু কিছু স্থানে লেখা ভাষা তার কাছে অপরিচিত—সম্ভবত প্রাচীন সাঁওতালি ও সংস্কৃতের মিশ্র রূপ। পাতাগুলোর ফাঁকে পাওয়া যায় এক কিশোরীর রেখাচিত্র—চোখবন্ধ, গলায় লাল সুতো বাঁধা—অর্ণা চমকে ওঠে। এই মুখ, এই দৃষ্টিভঙ্গি… ঠিক গৌরীর মতো। “ওই মেয়েটা ছিল বলিদানের জন্য নির্বাচিত। প্রতি চল্লিশ বছরে একবার, অমাবস্যার রাতে, একটি পবিত্র আত্মা উৎসর্গ করতে হয়। এবার ছিল গৌরীর পালা,” চুনী বলে। “তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে ‘দেবীডি’-কে, আমাদের প্রধান ডাকিনীকে। এখন তারা খুঁজছে পরবর্তী বাহককে। তাদের প্রথা অনুযায়ী পরবর্তী নারীকে ‘দীক্ষা’ দেওয়া হবে—সেই হবে পরবর্তী রূপান্তর। এবং আমার বিশ্বাস, তারা তোকে খুঁজছে, অর্ণা।”

চুনীর কথা শুনে অর্ণার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। “তারা আমাকে কেন?”—তার প্রশ্ন। চুনী উত্তর দেয়, “তোর মধ্যে আছে পুরনো শক্তির ছায়া। তোর পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন ছিলেন এক নিষিদ্ধ তান্ত্রিক, যার নাম ছিল গিরিশানন্দ। তিনি ছিলেন ডাকিনী বিদ্যার এক গোপন চর্চাকারী। হয়তো তুই জানিস না, কিন্তু তোর রক্তে সেই টান রয়ে গেছে। তুই সাহসী, স্বাধীন, বদ্ধ সমাজের বাইরে, একা হাঁটতে জানিস—তোর মতো মেয়েরাই সবচেয়ে বড় শিকার ও বাহক।” অর্ণা হঠাৎই শ্বাস নিতে কষ্ট পায়। “আমি সাংবাদিকতা করতে এসেছি, তন্ত্র সাধনা নয়!” চুনী তাকে শান্ত করে বলে, “তুই যা করছিস, সেটাই তন্ত্র। সত্যকে উন্মোচন করাই একধরনের সাধনা। তবে সাবধান—ওরা তোকে ডাকবে, মনের ভিতর কথা বলবে, স্বপ্নে আসবে। যখন তুই নিজেকে হারাতে শুরু করবি, বুঝবি—তুই ওদের মাঝেই ঢুকে পড়েছিস।” অর্ণা বইটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে, বুকের ভেতর গুঞ্জন করে চলেছে অজানা শব্দ—জানে, সে যা খুঁজতে এসেছে, সেটা এখন তাকে খুঁজে নিচ্ছে।

অধ্যায় ৪:

বইটা হাতে নিয়ে অর্ণা যেন এক অজানা ভার বহন করছিল। কাঠের পাতার মতো পাতাগুলো গন্ধ ছড়াচ্ছিল ধূপ, আগুন, আর শ্মশানভস্মের, আর তার মগজে বয়ে চলেছিল অদ্ভুত কিছু শব্দ—পুরনো মন্ত্র, সাঁওতালি গান, নারীকণ্ঠের গম্ভীর ফিসফাস। গেস্ট হাউসে ফিরে এসে সে বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে, সঞ্জয় যেন না দেখে। সঞ্জয় তখনও ব্যস্ত তার ড্রোন ক্যামেরার চিপ নিয়ে, কাল রাতের ভিডিও বিশ্লেষণ করছিল। “দেখেছিস অর্ণা? কাল রাতের আগুনটা ছিল উত্তর-পূর্ব দিকে। অথচ কেউ আগুন জ্বালায়নি,” সঞ্জয় বলে। অর্ণা মনোযোগ দিতে পারে না। সে তখন ভাবছে—গৌরী কি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল তার কপালে কী আছে? চুনীর কথামতো, ওকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। কিন্তু কেন সে? গ্রামের আরও অনেক মেয়ে তো ছিল। অর্ণা ঠিক করে, গৌরীর জীবন আরও গভীরভাবে বুঝতে হবে। সে স্কুলে ফিরে যায়, আবার খোঁজ নেয় গৌরীর বান্ধবী জুমা হাঁসদা-র কাছ থেকে। জুমা প্রথমে ভয় পায়, তারপর ধীরে ধীরে মুখ খোলে—“গৌরী আমাদের বলত, রাতে তার ঘরের জানালার বাইরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ দেখা যায় না, শুধু সাদা চুল, আর এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। ও বলত, সে কথা বলে… বলে ‘তুই আমাদের’। আমরা হাসতাম, ভাবতাম গৌরী গল্প বানাচ্ছে। একদিন সে একটা কাগজে কিছু লিখে স্কুলে এনেছিল। কিন্তু মাস্টারমশাই দেখে কাগজটা কেড়ে নেন। তারপর থেকেই গৌরী আরও চুপ হয়ে গিয়েছিল।”

অর্ণা স্কুলে ফিরে গিয়ে খোঁজ নেয় সেই কাগজের। শিক্ষক শৈলেশ প্রথমে অস্বীকার করেন, পরে অর্ণার অনুরোধে তিনি একটা পুরোনো খাতা থেকে একটা ছেঁড়া পৃষ্ঠা বের করেন—সেখানে আঁকা এক বৃত্ত, তার মধ্যে তিনটি চোখ, নিচে লেখা কিছু সাঁওতালি শব্দ—“Ickchak Da’ran Maahi”। অর্ণা শব্দগুলোর অর্থ বোঝে না, কিন্তু তার মনে পড়ে, চুনীর দেওয়া বইয়ের এক পাতায় ওই একই শব্দ লেখা ছিল। সে বই খুলে দেখে—সেখানে অনুবাদ লেখা রয়েছে: “রক্তের উৎস হতে হবে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে, চেতনা ভেঙে গেলে পথ খুলবে দীক্ষার।” অর্ণা শিউরে ওঠে। গৌরী কি তবে স্বপ্নে সেই নারীকণ্ঠ শুনেছিল? ডাকিনী কি স্বপ্নের ভেতর দিয়েই প্রভাব ফেলে? তার স্মৃতিতে হঠাৎ ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য—তিন রাত আগে সে এক স্বপ্ন দেখেছিল, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের ভেতরে, গাঢ় কালো পুকুরের পাশে, আর একজন নারী—লম্বা, সাদা কাপড় পরা, তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। তখন ভেবেছিল এটা কল্পনা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেটাও হয়তো কোনো সংকেত ছিল। অর্ণার মধ্যে ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র অনুভব জন্ম নেয়।

সন্ধ্যাবেলা অর্ণা আবার যায় সেই শ্মশানের পাশে, যেখানে গৌরীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল। জায়গাটা ভেঙে পড়া একটা বটগাছের নিচে, চারপাশে ছোট ছোট পাথর দিয়ে ঘেরা। সেখানে এখন একধরনের নির্জনতা নেমে এসেছে, অথচ সেই নীরবতা মাঝে মাঝে যেন চিৎকার করে ওঠে। গাছের গুঁড়ির ওপর সে দেখতে পায় লাল রঙে আঁকা এক নারীমুখ—চোখ খোলা, ঠোঁট নেই, কপালে তিনটি তিল। হঠাৎ সে অনুভব করে, কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে। ঘুরে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু তার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়, কারণ ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে আসে সেই শব্দ, সেই গান—“রাত ডাকে মা… আগুন জ্বালো মা…”। গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে একটা পাথর—জলপাথরের মতো মসৃণ, কিন্তু তাতে খোদাই করা এক নারীমূর্তি, যার দুই হাত প্রসারিত, আর মাথার পেছনে আঁকা অগ্নিচক্র। অর্ণা তা হাতে নেয়, আর মুহূর্তেই তার মাথার ভেতর এক বিকট শব্দ ফেটে পড়ে—হাজারো নারীকণ্ঠ একসাথে চিৎকার করে উঠছে, কাঁদছে, হাসছে। সে ছিটকে পড়ে যায়। উঠে দেখে, সঞ্জয় দৌড়ে এসেছে ক্যামেরা হাতে, “তুই এখানে কী করছিস? মুখটা সাদা হয়ে গেছে!” অর্ণা কিছু বলতে পারে না। তার চোখে তখনও দেখা যাচ্ছে এক মেয়েকে—সে হেঁটে যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতরে, পেছন ফিরে তাকায় না। তার হাতে বাঁধা লাল সুতো, আর পায়ের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আগুনের ফুল।

অধ্যায় ৫:

রাতে ফিরে এসে সঞ্জয় প্রথমেই ল্যাপটপ খুলে বসে ক্যামেরার ফুটেজ ট্রান্সফার করতে। গৌরীর মৃত্যুর স্থান থেকে সে কয়েকটা ক্লিপ নিয়েছিল, আর অর্ণা যতই ভেতরে ভেতরে টান অনুভব করুক, সঞ্জয়ের কাজ এখনও যুক্তি আর ছবির মধ্যেই আবদ্ধ। তবে আজ সে নিজেও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। “আজ বিকেলে তুই পড়ে গেলি কেন? মাথা ঘুরেছিল, না কিছু দেখতে পেয়েছিলি?”—তার প্রশ্নে অর্ণা চুপ থাকে। সেও ঠিক জানে না, যে মেয়েটিকে সে দেখেছিল—সে কি শুধুই তার কল্পনা? নাকি আসলেই তার চোখে ভেসে উঠেছে সেই বলিদানকৃত আত্মার ছায়া? অর্ণা মনে মনে ভাবে, যদি এই অনুভূতি কাউকে বোঝানো যেত—এই যন্ত্রণা, এই অশরীরী আকর্ষণ, যেন নিজের ভেতরেই কেউ বসে আছে এবং তাকে নির্দেশ দিচ্ছে। “তুই শুনেছিস কখনো… নিজের মনের গলার সঙ্গে যুদ্ধ?”—অর্ণা হঠাৎ বলে ওঠে। সঞ্জয় বলে, “হ্যাঁ, অনেক সময়… তবে সেটা সাধারণত কাফি খেতে খেতে হয়।” হালকা রসিকতা করলেও তার গলায় টেনশন লুকোনো নেই। এই গ্রামের মানুষ, এই অদ্ভুত নিঃশব্দতা, আর গৌরীর ছবি—সব কিছু যেন ধীরে ধীরে তার ক্যামেরার মধ্যেই বন্দি হয়ে উঠছে, কিন্তু প্রতিটা ফ্রেমের ফাঁকে যেন কিছু লুকিয়ে থেকেও ধরা দিচ্ছে না।

সঞ্জয় ড্রোন ক্যামেরার ক্লিপ খুলে দেখে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে—জঙ্গলের মাঝে একটা খোলা জায়গা, যেখানে বেশ কিছু মহিলার ছায়া দেখা যায়। তারা সবাই হাঁটু গেড়ে বসে, মুখ নিচু করে, পরনে সাদা শাড়ি—কিন্তু কোনও রঙ নেই, যেন রঙ কেটে নেওয়া হয়েছে ছবির ভেতর থেকে। একটা সময় দেখা যায়—একসাথে সবাই মুখ তোলে। ক্যামেরা অনেক উপরে থাকলেও সেই মুখগুলো যেন ঠিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তখনই ক্যামেরা কেঁপে ওঠে। অর্ণা নিজের চোখে দেখে—ফ্রেমে একটা মুখ বড় হয়ে উঠে আসে, যেন ড্রোনের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। সেই মুখে চোখ ছিল না—শুধু গহ্বর, অথচ তাতে অর্ণা অনুভব করে এক দৃষ্টির জোর। ঠিক তারপর, ড্রোন হঠাৎ নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে যায়, ভিডিও কেটে যায়। সঞ্জয় উঠে দাঁড়ায়, কাঁধে চাপ দেয় অর্ণার। “এইটা কী ছিল, অর্ণা? এটা তো র‍্যান্ডম মুভমেন্ট নয়। কেউ যেন ক্যামেরাকে টেনে নামাল।” অর্ণা ঠোঁট শুকিয়ে ফেলে, মাথা নেড়ে বলে, “ওরা শুধু দেখতে দেয়, যেটুকু চায়। তুই যে দেখতে পেয়েছিস, সেটাও অনুমতি ছিল।” সঞ্জয়ের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। “ওরা?”—তার প্রশ্ন। অর্ণা বলে না। তার মনের ভেতর এখনও ঘুরছে সেই নারীকণ্ঠ—“চোখের পেছনে যা আছে, দেখার সাহস তোর আছে কি?”

রাত গভীর হলে অর্ণা একা বারান্দায় গিয়ে বসে। কুন্দরির বাতাসে একধরনের ঘনত্ব, যেন বাতাসও গোপন কিছু বহন করে। তার হাতের আঙুলে এখনও ধরা গৌরীর লাল সুতো, যা সে বিকেলে গাছের পেছন থেকে কুড়িয়ে এনেছিল। হঠাৎ জানালার কাচে সে দেখতে পায়—পেছনে এক ছায়া। অর্ণা ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। কেউ নেই। কিন্তু ঘরের বাতাস ভারি হয়ে যায়, ধূপের মতো একটা গন্ধ ভেসে আসে। সে বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে, আর তখনই সে দেখতে পায় এক স্বপ্ন—জঙ্গলের ভেতর আগুনের গোলচক্র, মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নারী, তার চুল ছড়িয়ে, চোখ সাদা, এবং গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক অজানা ভাষা। সেই নারী এগিয়ে আসে, তার কপালে হাত রাখে, আর বলে—“তোকে দরকার আমাদের। তোকে ছাড়া পথ খুলবে না।” অর্ণা ঘেমে ওঠে, চিৎকার করে উঠে বসে। ঘরে আলো নিভে গিয়েছে। সঞ্জয় পাশে নেই। শুধু দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কেউ—একজন নারী, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে গলে যেতে থাকে অন্ধকারে। আর তার পেছনে, দেওয়ালে ছায়া পড়ে একটি চিহ্ন—একটি উল্টো ত্রিকোণ, তার মধ্যে চোখ। অর্ণা বুঝে যায়—এবার শুরু হয়েছে তার অভিষেক। ডাকিনীরা শুধু ডাকে না, তারা ঢুকে পড়ে শরীরের গভীরে।

অধ্যায় ৬:

অর্ণার মনে হচ্ছিল সে হাঁটছে, অথচ পা নড়ে না। গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে ঘন ছায়া, পেছন থেকে ভেসে আসছে অগণিত নারীকণ্ঠ—কেউ হাসছে, কেউ বিলাপ করছে, কেউ যেন অজানা ভাষায় ডাকছে। সে বুঝতে পারে না এটা স্বপ্ন, না জেগে থাকা দুঃস্বপ্ন। তার চারপাশে ছায়া জমে উঠছে, আর এক সময় সে পৌঁছয় এক বৃত্তাকারে সাজানো পাথরের চৌকাঠে, যেখানে মাঝখানে জ্বলছে আগুন। আগুনের চারদিকে বসে আছে একদল নারী—শুধু মুখগুলো অস্পষ্ট, চুল খোলা, সাদা বসন, চোখে অনিকেত দৃষ্টি। হঠাৎ একটি নারী উঠে দাঁড়ায়। বাকিরা একসঙ্গে মাথা নত করে। দাঁড়ানো নারীর মুখে অদ্ভুত দীপ্তি—সে সুন্দরী, অথচ তার চোখের গভীরে কিছু নেই, শুধু এক শূন্যতা। সে বলে, “আমার নাম দেবীডি। আমি প্রজন্মের ডাকিনী। তুই আমাদের উত্তরাধিকার।” অর্ণা বলতে চায়, “আমি এখানে কিভাবে এলাম?” কিন্তু কণ্ঠ আটকে যায়। দেবীডি তার দিকে এগিয়ে এসে কপালে আঙুল ছোঁয়ায়—এক মুহূর্তেই অর্ণার চোখের সামনে ভেসে ওঠে শত শত দৃশ্য—নারীদের দগ্ধ দেহ, চিৎকার, বৃষ্টিভেজা শ্মশান, আর মাঝখানে এক দেবীমূর্তি যার চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে।

হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে, অর্ণা আবিষ্কার করে সে মাটির ঘরের মধ্যে, হাত-পা বাঁধা, মুখের পাশেই একটি পুরনো তামার প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে এক রহস্যময় অক্ষরমালা, একদিকে পড়ে আছে পাথরের চক্র, আর তার মাঝখানে সেই একই মুখ—চোখহীন নারীছবি। অর্ণা কাঁধ নাড়ার চেষ্টা করে, তখনই সে টের পায়, তার শরীরে খোদাই করা হয়েছে কিছু রেখা—হালকা কাটাছেঁড়ার দাগ, এবং তার বুকের উপর লাল রঙে আঁকা ত্রিকোণ ও বৃত্ত। তার মনে পড়ে যায় চুনীর কথা—“ওরা দীক্ষা দেয় শরীরের মাধ্যমে। শরীরই হল সত্তার দ্বার।” হঠাৎ দরজা খোলে, ভিতরে ঢোকে দেবীডি। সে বসে, শান্তস্বরে বলে, “তুই শুধু সাংবাদিক নোস, তুই বাহক। তোর মধ্যেই জাগবে নতুন শক্তি। আগে যে ছিল—গৌরী—সে ছিল অর্ধেক। কিন্তু তুই সম্পূর্ণ। তোকে দেখে আমরা চিনেছি।” অর্ণা বলে, “আমি কাউকে দেবে না কিছু! আমি এসেছি সত্য জানতে, তোমাদের খণ্ডন করতে।” দেবীডি হেসে ওঠে, “আমাদের খণ্ডন? আমরা খণ্ডিতই তো, রক্তে, ইতিহাসে, শ্মশানে। আমরা তোদের মা, তোদের পূর্বপুরুষের উপাস্য। তোর রক্তে সেই সুর আছে।” সে বলে, “আজ রাত পূর্ণ দীক্ষা। তুই শুধু দেখবি না, তুই হবে।”

অর্ণার চেতনা টলমল করে। হঠাৎ কেউ তার মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। সে চোখ খুলে দেখে, পাশেই বসে আছে চুনী মাহাতো। ফিসফিস করে বলে, “চুপ কর, আমি তোকে নিয়ে যাচ্ছি।” চুনীর মুখ কঠিন, সোজা, দৃঢ়। অর্ণাকে মুক্ত করে সে হাতে ধরে টানে, অন্ধকার পথে। তারা পালায় সেই তাম্রঘর থেকে, হেঁটে যায় গহীন জঙ্গলের মধ্যে। পিছনে শোনা যায় আগুনের শব্দ, নারীকণ্ঠের চিৎকার, দেবীডির ডাকে ছায়াদের উন্মাদনা। অবশেষে তারা পৌঁছায় পাহাড়ঘেরা এক গুহায়। সেখানে চুনী প্রদীপ জ্বালে, আর বলে, “এই ছিল তামসীর গুহা—আমার গুরু। এখানেই আমি প্রথম বুঝেছিলাম, ডাকিনী মানে শুধু শক্তি নয়—মানবতারও সীমানা আছে। দেবীডি সেই সীমা পেরিয়ে গেছে।” অর্ণা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে। চুনী তার কপালে হাত রাখে—“তুই এখনও আমাদের মাঝে, তুই বাঁচতে পারিস। কিন্তু তোর ভিতরে যেটা জেগে উঠেছে, সেটা তোকে শেষ করবে—নইলে তোকে দিয়ে ওরা আর কাউকে শেষ করাবে।” অর্ণা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আগুনের দিকে, আর অনুভব করে, তার চেতনার গভীরে যে ছায়া জন্ম নিচ্ছে, তার নাম—দেবীডি নয়, বরং তারই নিজস্ব এক রূপ, যাকে আজ থেকে আর অস্বীকার করা যাবে না।

অধ্যায় ৭:

গুহার ভেতরে আগুনের আলো কাঁপছিল চুপচাপ, আর তার পাশে বসে অর্ণা অনুভব করছিল এমন এক উত্তাপ, যা শরীরকে নয়, গলিয়ে দিচ্ছে চেতনা। চুনী ধীরে ধীরে বলছিল—“তোর যা জেগে উঠেছে, সেটা তোর শত্রু নয়। তবে ওকে এখনই মুক্তি দিলে তুই আর তুই থাকবি না।” অর্ণা বলে, “আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না কে আমি… আমার ভিতর থেকে কে যেন কথা বলছে… স্বপ্নে একরকম মুখ দেখি, চোখ দেখি, আর জেগে ওঠার পরও সেই গন্ধ, সেই গান কানে বাজে।” চুনী তাকিয়ে থাকে তার দিকে—“ওটা তোর পূর্বস্মৃতি। আগে যারা ছিল, যারা বলি হয়েছিল, যারা জেগেছিল, তাদের স্মৃতি তোর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ডাকিনী বিদ্যা রক্তের মাধ্যমে টিকে থাকে। সব মেয়ের মধ্যে নয়, শুধু যারা দেখে, যারা শোনে, যারা প্রশ্ন করে। তুই সেই জাত।” অর্ণা চুপ করে যায়। সে বুঝতে পারে, গৌরী ছিল প্রথম সিঁড়ি, আর তাকে দিয়ে শুরু হয়েছে এক নতুন চক্র। সে আর শুধু একজন সাংবাদিক নয়, সে হয়ে উঠেছে কাহিনিরই এক অনিবার্য চরিত্র।

হঠাৎ গুহার বাইরে শব্দ হয়—ঝোপ নড়ে ওঠে, শোনা যায় নারীকণ্ঠের গান—“আয় মা, আয় রে, তোর আগুনে পুরে যাক মন…” চুনী কাঁপা গলায় বলে, “ওরা খুঁজে পেয়েছে।” অর্ণা উঠে দাঁড়ায়, বলে, “তারা আমায় চাইছে? আমি যাবো।” চুনী বাধা দিতে চায়, কিন্তু অর্ণার চোখে তখন আর দ্বিধা নেই। তার শরীর আগুনের ছায়ায় ঝলসানো, পায়ের নিচে জমাট মাটি, হাতে সে তুলে নেয় গুহার একপাশে রাখা পুরনো ধাতব বেল্ট, তাতে খোদাই করা ছিল সেই পুরনো চিহ্ন—ত্রিকোণ ও চোখ। চুনী বোঝে, অর্ণা চলে গিয়েছে এক এমন স্তরে, যেখান থেকে তাকে ফেরানো যায় না। অর্ণা গুহা থেকে বেরিয়ে আসে, মুখে আর ভয় নেই, বরং আশ্চর্য এক শীতলতা। বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তারা—ডজনখানেক নারীছায়া, মুখ ঢাকা, চোখ ঝলসে ওঠা আগুনে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দেবীডি, তার সাদা চুল বাতাসে উড়ছে, কপালে তিলক, ঠোঁটে এক হাসি। সে এগিয়ে আসে অর্ণার দিকে, হাতে একটি রক্তমাখা চূর্ণমালা। “এবার,” সে বলে, “তুই আমাদের হবে। আগুনে হাঁটবি, রক্তের নিচে নামবি, এবং পুনর্জন্ম নেবে। এরপর তুই দীক্ষা দিবি, তুইই পথ দেখাবি।”

অর্ণা চোখ বন্ধ করে। মনে পড়ে মায়ের কথা, তার সাংবাদিকতার প্রথম প্রতিবেদন, প্রথম পুরস্কার, কলকাতার ব্যস্ত ট্র্যাফিক, লেকের ধারে সিগারেট, আর হঠাৎ করেই সব সরে গিয়ে চোখের সামনে শুধু আগুন। সে হাঁটে—আগুনের দিকে। ছায়ারা গান ধরে, হাত তোলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের তারা নিভে যায়। অর্ণা যখন পাথরের বেদির সামনে দাঁড়ায়, তখন তার ভেতরের ভয় মুছে গিয়েছে। দেবীডি তার কপালে তেল ছোঁয়ায়। হঠাৎ এক তীব্র ঝড় উঠেই থেমে যায়, আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে শোনা যায় এক কণ্ঠস্বর—না দেবীডির, না চুনীর, বরং অর্ণার নিজের—“আমি কারো নই, আমি আমার। আমি রক্তের মধ্যে আগুন, আগুনের মধ্যে প্রশ্ন।” সেই মুহূর্তেই চারপাশের আগুন যেন উল্টো ঘুরে যায়, ছায়ারা থেমে যায়, এবং দেবীডির চোখে প্রথমবার আতঙ্ক। অর্ণা বেদির ওপর দাঁড়িয়ে হাত তোলে, আর বেদির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ছাইভরা ধোঁয়া—কিন্তু এবার সে ধোঁয়া নয়, প্রতিজ্ঞা।

অধ্যায় ৮:

আগুনের বৃত্ত থেমে গেছে, কিন্তু বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। সেই নিঃশব্দতা, যা মৃতদের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর, গিলে ফেলছে অর্ণার চারপাশ। দেবীডি পেছনে এক পা সরিয়ে যায়। এই প্রথমবার তার চোখে অচেনা কিছু—ভয়, সংশয়, এবং সেই দুর্বলতা যা একজন ‘ঈশ্বরী’র সাজানো মুখোশে থাকা চলবে না। ছায়ারা স্তব্ধ, তারা চেয়ে আছে অর্ণার দিকে, যেন এখন থেকে তিনিই নিয়ম তৈরি করবেন। অর্ণা বেদির ওপর দাঁড়িয়ে, তার কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে নিচের চূর্ণমালার ওপর, কিন্তু তাতে এখন আর দীক্ষা জন্মায় না—জন্ম নেয় ঘৃণা। “তোমরা আমাকে বাহক ভাবছিলে,” সে বলে ওঠে, “কিন্তু আমি আছি তোমাদের ভেতরকার প্রতিচ্ছবির বিরুদ্ধে। আমি বলিদান নয়, আমি বিচার। আমার দেহে তোমাদের নাম নেই, আছে স্মৃতির প্রতিশোধ।” তার গলা গমগম করে ওঠে, বাতাসে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। হঠাৎ সেই মুহূর্তে ঝড় ওঠে, জঙ্গল নড়ে ওঠে, আর বেদির পেছনে ছায়াময়ী একটি কণ্ঠ ভেসে আসে—একটি মেয়ে, সে যে এখনো মুক্তি পায়নি। সে গৌরী।

চক্রের মাঝখানে ধোঁয়া জমে এক আকৃতি গড়ে তোলে। সে নারীমূর্তি, কিন্তু ক্লান্ত, বিবর্ণ, পুড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর নিয়ে সে বলে, “তুই এসেছিস… দেরি করেছিস… কিন্তু এবার শেষ কর… ওদের নাম ধরে জ্বালিয়ে দে…” অর্ণা কাঁপে, কিন্তু পেছনে সরে না। সে গৌরীর দিকে এগিয়ে যায়, হাত বাড়িয়ে দেয়—“তুই মুক্ত হ, আমি তোর শরীর নই, আমি তোর প্রতিবাদ।” চারপাশে নারীর মুখগুলো বদলে যেতে থাকে—তারা আর এখন দেবীডির দাসী নয়, বরং সেই সকল আত্মা যারা বলিদান হয়েছিল। দেবীডি বুঝে যায়, নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই। সে উচ্চারণ করতে থাকে পুরনো মন্ত্র—“আহম দেবী, আহম সর্বজ্ঞা, তিস্রো শক্তি বিভাজিতা”—কিন্তু এবার সেই মন্ত্র কাজ করে না। ছায়ারা এগিয়ে আসে তার দিকে। অর্ণা বলে, “তুমি দেবী হতে চেয়েছিলে, কিন্তু তুমি ছিলে একখণ্ড ভয়। আমি ভয় নই, আমি আলোর নাম।” এই বলে সে পায়ের নিচের আগুনের বৃত্ত ভেঙে ফেলে। মুহূর্তেই চারপাশে বিস্ফোরণ ঘটে, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে, ছায়ারা একে একে অদৃশ্য হতে শুরু করে। দেবীডির চোখ বড় বড় হয়ে যায়, সে গর্জন করে ওঠে—কিন্তু সেই গর্জন আর জাদু নয়, বরং এক ব্যর্থ নারীর চিৎকার।

চুনী দৌড়ে আসে, তার হাতে পুরনো তামার ঘণ্টা, সে তা ঝাঁকায় এক নিঃশেষিত মন্ত্রের তালে—“যাহা জন্ম, যাহা বলি, যাহা ভয়—যাক ফিরে কালের গর্ভে।” সেই শব্দে নারীর মুখগুলো শান্ত হতে থাকে, মুখ তুলে তারা বলে, “আমরা যাচ্ছি… কিন্তু ও যেন মনে রাখে, আলো কখনও পূর্ণ হয় না, ছায়া ছায়াতেই থাকে।” দেবীডির শরীর কাঁপে, তার মুখ ফেটে যায় এক নিঃশব্দ চিৎকারে, আর সে ধীরে ধীরে গলে মাটির নিচে নেমে যায়। অর্ণা হাঁটু গেড়ে বসে, ক্লান্ত, ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে, কিন্তু তার চোখে তখনও জ্বলছে সেই আগুন, যেটা বলিদানের নয়—প্রতিশোধের নয়—বরং পুনর্জন্মের।

অধ্যায় ৯:

ভোরের আলো যখন কুন্দরির আকাশে প্রথম ধোঁয়াশা সরিয়ে রক্তজবা রঙ মেখে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন অর্ণা বসে আছে সেই পুরনো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের পাশে। আগের রাতে যা ঘটেছে—যা দেখা, যা সহ্য, যা পরিবর্তন—সবই যেন এক গোপন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। চুনী চুপ করে তার পাশে বসে থাকে, চোখে ক্লান্তি, মুখে একধরনের তৃপ্তি। “দেবীডি চলে গেছে,” চুনী বলে, “তোর ভেতর যা ছিল, তা জেগে উঠেছিল ঠিক সময়ে। আর আমি জানতাম, একদিন কেউ আসবে, যে কেবল প্রত্যক্ষ করবে না—প্রতিরোধও করবে।” অর্ণা বলে না কিছু, তার মন এখনো জটলার মধ্যে। গৌরীর মুখটা, ছায়াদের হাহাকার, দেবীডির গলে যাওয়া রূপ—সবকিছু বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু এবার সেই ভয় তাকে দুর্বল করে না, বরং একরকম শক্তি দেয়। সঞ্জয় সেই মুহূর্তে এসে দাঁড়ায়, ক্যামেরা গলায় ঝোলানো, মুখে তীব্র বিস্ময়। “অর্ণা, আমরা এখানে একটা ডকুমেন্টারি করতে এসেছিলাম। কিন্তু যা পেলাম, তা কোনো স্ক্রিপ্টে ছিল না। তুই জানিস, ড্রোনের শেষ ফুটেজে তুই জ্বলন্ত আগুনের বৃত্তে দাঁড়িয়ে আছিস—কিন্তু আগুন তোকে ছুঁতে পারছে না। এটা কোনো সিজিআই নয়।” অর্ণা তার দিকে তাকায়, হেসে বলে, “আমি আগুন নই, আমি ছায়ার শেষ গান।”

গ্রামজুড়ে একটা পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চারা খেলছে মাঠে, যেখানে এতদিন ভয় ছিল; বৃদ্ধেরা কথা বলছে মুখোমুখি বসে, যেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখত আগে। কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু সবাই বুঝেছে—কিছু একটা শেষ হয়েছে, এবং নতুন কিছু শুরু হয়েছে। গৌরীর বাড়িতে গিয়ে অর্ণা তার মা-কে খুঁজে বের করে। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে অর্ণার পা জড়িয়ে ধরে, বলে, “আমার মেয়েকে ফেরাতে পারলি না, কিন্তু তাকে শান্তি দিলি মা, ওর আত্মা এখন মাটির ওপারে। ও রাতে স্বপ্নে এসেছিল—সাদামাটা মুখ, কিন্তু শান্ত।” অর্ণা নিশ্চুপে মাথা নেড়ে। চুনী ফিরে গেছে তার ঘরে, কিন্তু ঘরটিকে সে এখন তামসীর সাধনপীঠ হিসেবে সাজাচ্ছে না। বরং সে জানালার পাশে ধূপ রেখে বলে, “আলো জ্বালতে হয় রোজ। ছায়া শুধু একদিনে যায় না।” অর্ণা জিজ্ঞেস করে, “তুই এখন কী করবি?” চুনী হাসে, “এই পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটব, নতুন অর্ণাদের জন্য রাস্তা রেখে যাব। যাতে কেউ আর গৌরী না হয়।”

শেষ বিকেলে সঞ্জয় ও অর্ণা জিপে ওঠে ফিরে যাওয়ার জন্য। পেছনে পড়ে থাকে সেই কুন্দরি, পাহাড়, নদী, আগুনের ছায়া, গোপন তান্ত্রিক চক্রের স্মৃতি। অর্ণা জানে, এই সফর ছিল শুধু অনুসন্ধান নয়, আত্মোপলব্ধিরও। সে কলকাতায় ফিরবে, এই কাহিনি লিখবে, জানাবে দেশকে, এক নতুন ধারায়। কিন্তু কিছু অংশ সে নিজের মধ্যেই রেখে দেবে—কারণ এই অভিজ্ঞতা শুধু খবরের কাগজে যায় না, তা গেঁথে যায় আত্মার ভেতর। সঞ্জয় চুপচাপ গাড়ি চালায়, হঠাৎ বলে, “তুই যদি লেখ, আমি ছবি তুলব।” অর্ণা তাকায়, হেসে বলে, “তবে এটা শুধু খবর হবে না—এ হবে প্রমাণ যে অন্ধকারকে জয় করা যায়, যদি কেউ নিজের ছায়াকেও দেখতে শেখে।” আর পেছনে, পাহাড়ের আড়াল থেকে যেন এক মুহূর্তের জন্য আবার ভেসে আসে সেই পুরনো সুর—“আয় মা… আয়…”—কিন্তু এবার তা আর ডাক নয়, বরং এক বিদায়।

অধ্যায় ১০:

কলকাতার newsroom-এ বসে অর্ণা কম্পিউটারে টাইপ করছে—আঙুলের গতি দ্রুত, চোখে গভীর মনোযোগ। বাইরে শহরের ট্রাফিক, পাঁশে চায়ের কাপে ঠান্ডা চা, কিন্তু অর্ণার দৃষ্টি আটকে আছে পর্দার প্রতিটি লাইনে। সে লিখছে কুন্দরির ঘটনাগুলিকে ঘিরে এমন একটি প্রতিবেদন, যা শুধু ‘investigative journalism’ নয়, বরং এক আত্মসাক্ষাৎকার। শিরোনাম—“দেবীডির ছায়া: ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ে নারীকেন্দ্রিক গোপন তান্ত্রিক সমাজের ভেতর থেকে”। রিপোর্টে সে তুলে ধরেছে গৌরীর মৃত্যু, ডাইনী অপবাদে ভীত মানুষের কথা, সেই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, চুনীর স্বীকারোক্তি, এবং সেই অদৃশ্য ডাইনীবৃত্তান্তের প্রতীক—ত্রিকোণ আর চোখ। সে বলেছে: “আমি যা দেখেছি, তা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু অস্বীকারও করা যায় না। আমাদের সমাজে নারীশক্তি যতটা পূজিত, ততটাই পরিত্যক্ত। এই কাহিনি তারই একটা প্রতিচ্ছবি, যা পাহাড়ের ছায়ার নিচে ধিকিধিকি করে জ্বলছিল।” সঞ্জয় তার ডেস্কে এসে দাঁড়ায়, হাতে পেনড্রাইভ, তাতে সেই রাতের শেষ ড্রোন ফুটেজ। “এইটা রিপোর্টে যোগ করবি? তুই জানিস, ওটা এখনো ন্যাশনাল মিডিয়ার প্রথম পেজে জায়গা করে নেবে,”—সে বলে। অর্ণা একটু চিন্তা করে, তারপর বলে, “তবে শুধু ওইটা নয়, এর পাশে থাকবে গৌরীর মুখ। যেন সবাই জানে, সে শুধু উৎসর্গ ছিল না—সে ছিল প্রতিরোধের শুরু।”

রিপোর্ট জমা দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তা ভাইরাল হয়। সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়—কিছু লোক মেনে নেয়, কিছু নস্যাৎ করে দেয়। কেউ বলে—“অলৌকিকতা বিশ্বাসযোগ্য নয়,” আবার কেউ টুইটে লেখে, “এই কাহিনির ভেতর লুকিয়ে আছে ভারতীয় নারীবাদী চেতনার অন্ধকার দিক।” অর্ণা নিজের লেখালিখির চেয়ে বেশি মন দেয় মানুষদের প্রতিক্রিয়ায়। চুনী তাকে একবার ফোন করে, বলে, “তুই আলো এনেছিস। এখন কেউ আর ডাইনী বলে না আমাকে। তারা চায়ের দোকানে বসিয়ে কথা বলে। হয়তো শেষমেশ… আমি ‘রূপামালা’ থেকে আবার ‘চুনী’ হতে পারলাম।” এইসব শুনে অর্ণা বুঝতে পারে, সে কেবল গল্প বলেনি—সে সমাজের কোনো এক মৃত কোণকে আলো দেখিয়েছে। তবু রাতে যখন সে একা থাকে, জানালার পাশ দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে সেই পুরনো সুর, সেই ফিসফাস—“আয় মা… আয়…”—যা তাকে মনে করিয়ে দেয়, এই কাহিনির শেষ মানেই নতুন কিছুর শুরু। অর্ণা ধীরে ধীরে নতুন আর্টিকেল শুরু করে—শিরোনাম: “যারা অন্ধকারে আলো খোঁজে: আধুনিক তন্ত্র ও নারীচেতনার অস্পষ্ট রেখা”।

কিন্তু শেষরাতের এক মুহূর্তে, যখন সে ডেস্কের ল্যাম্প নিভিয়ে উঠতে যাচ্ছে, হঠাৎ তার চোখ পড়ে ডেস্কের ওপর রাখা সেই পুরনো বইটির কপি—“ডাকিনী বিদ্যা: তান্ত্রিক চর্চার গুহ্যজ্ঞান”—যা সে কুন্দরি থেকে নিয়ে এসেছিল, আর কখনও না ছুঁয়েছিল। বইটা নিজের থেকে খোলা, যেন হাওয়ায় পাতাগুলো উল্টে গিয়ে খুলে গেছে সেই পৃষ্ঠা, যেখানে আঁকা এক অচেনা নারীমুখ—কিন্তু এবার অর্ণার বুক ধক করে ওঠে, কারণ সেই মুখটা অবিকল তার নিজের মতো। আর নিচে লিপি—“পরবর্তী বাহক: অ…” বাকিটা ছেঁড়া, অর্ধেক অক্ষর, কিন্তু তবু স্পষ্ট ইঙ্গিত। অর্ণা ধীরে বইটা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে জানালার দিকে তাকায়। দূরের ছায়ায় তখনও জ্বলছে আগুনের মতো একটা দৃষ্টি—যেটা সে জানে, একদিন আবার ডাকবে।

সমাপ্ত

1000039033.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *