তনুশ্রী রায়
এক
রোজকার মতো সকালটা শুরু হয় একঘেয়ে নিয়মে—চা, শাড়ির আঁচল গুঁজে নেওয়া, আর বাড়ির সদর দরজাটা হালকা শব্দে টেনে বন্ধ করা। শহরের কিনারে পুরোনো একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষপ্রাচীন ডাকঘরটি যেন সময়কে আটকে রেখেছে নিজের দেওয়ালে। দুলালী ঘোষ, যাকে শহরের সকলে ‘দিদি’ বলে জানে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় এসে সেই সাদা-লাল রঙের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দেওয়ালে ঝোলানো পিতলের ঘড়িটা তার আগমনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চুপচাপ টিক টিক করে। খোলা জানালার ফাঁকে মৃদু আলো ঢোকে, আর তাতে ধুলোর কণাগুলি বাতাসে ভাসে যেন স্মৃতির মতো। দুলালী টেবিলে রাখা তার কাঠের বক্স খোলে, যেখানে সারি সারি চিঠি, স্ট্যাম্প আর রেজিস্টার রাখা—যেন এগুলোই তার নিজের সন্তানের মতো। তার চোখে চিঠি মানে শুধু খবর নয়, মানে সময়, অপেক্ষা, কিছু না বলা কথা। প্রতিদিন সকালে সে প্রথমেই সব চিঠিগুলিকে সাজায়—পোস্ট কোড অনুযায়ী, হাতে লেখা আর টাইপ করা চিঠির আলাদা ভাগ করে। সে চিঠিগুলোকে হাত বুলিয়ে পড়ে, যেন খামের পেছনে লেখা না-থাকা কথাগুলিও সে পড়তে পারে।
ডাকঘরটা খুব বড় নয়—তবে সেখানে রয়েছে অনেক চরিত্র। শুভঙ্কর, পোস্ট অফিসের পিয়ন, সকালে এসে দুলালীকে চা এনে দেয় ছোট্ট একটা কাপ-এ। বাইসাইকেলে চিঠি বিলি করার আগে সে একটু বসে, খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নেয়। তার চোখে দুলালী একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, যার কাছে সে মাঝেমধ্যে নিজের কবিতা পড়ে শোনায়, যদিও দুলালী কখনো বিশেষ কিছু বলেনা, শুধু মৃদু হাসে। আর আছেন মৃণাল সেনগুপ্ত—অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, যিনি প্রতিদিন এসে এক কাপ চা খেয়ে নিজের পুরোনো বন্ধুদের চিঠি লেখেন এবং দুলালীর কাছে বসে গল্প বলেন—কখনো নিজের ছেলেবেলা, কখনো স্বাধীনতার আগের দিনগুলো। আর সাম্প্রতিক যুক্ত হয়েছেন রূপসা ব্যানার্জী, নতুন পোস্টমাস্টার—প্রশাসনের তরফ থেকে এসেছেন, আধুনিকীকরণের দায়িত্ব নিয়ে। তার চোখে পুরোনো পদ্ধতিগুলো অপ্রয়োজনীয়, আর দুলালীর মতো আবেগপ্রবণ কর্মীদের জন্য তার ধৈর্য খুব সীমিত। তবে দুলালী এসবের তোয়াক্কা করে না। তার কাছে ডাকঘর একটা মন্দিরের মতো—যেখানে প্রতিটি চিঠি যেন কোনো পুজোর অর্ঘ্য।
সেইদিন সকালটা একটু আলাদা ছিল। স্ট্যাম্প সাজাতে সাজাতে হঠাৎ খামগুলোর মাঝে একটি অচেনা খাম চোখে পড়ে দুলালীর। সেটি ছিল সাধারণ অফ-হোয়াইট খামে, কোনো অফিসিয়াল ছাপ নেই। তবে অবাক করা বিষয়—উপরের নামটা তার নিজের। ‘দুলালী ঘোষ’—স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে লেখা, কিন্তু প্রেরকের জায়গাটি ফাঁকা। কোনো পোস্ট মার্ক নেই, মানে কেউ সম্ভবত হাতে এসে রেখে গেছে পোস্ট বক্সে। তার বুকের ভিতর কেমন যেন ধড়ফড় করতে থাকে। খামটা হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ বসে থাকে, চোখে হাজার প্রশ্ন। এই চিঠিটা কে দিল? কেন? সে কি ভুল করে এল? নাকি কেউ ইচ্ছে করে দিল, কিন্তু নাম লিখল না? ধীরে ধীরে খামটা খুলে এক টুকরো কাগজ বের করে সে। লেখাগুলো তার চেনা, অথচ অচেনা মনে হয়—“তুমি চিঠি সাজাও, জানি। কিন্তু জানো কি, কোনো এক চিঠি তোমার নিজের জন্যই ছিল, যা তুমি কোনোদিন খোলোনি।” চোখ কেঁপে ওঠে দুলালীর। তার মনে পড়ে যায় কলেজের সেই বছরগুলো—যখন সে এক কবিকে ভালোবেসে নিজের লেখা কবিতা এক খামে পুরে দিয়েছিল, কিন্তু কোনোদিন জবাব আসেনি। তবে কি এত বছর পরে সেই চিঠিরই প্রতিধ্বনি ফিরল? না কি এই শব্দগুলো কোনো নতুন গল্পের শুরু? সে কিছুই জানে না, কিন্তু বুঝতে পারে—এই চিঠি যেন তার নিজের জীবনের দরজায় টোকা দিচ্ছে, যাকে সে এতদিন ধরে বন্ধ করে রেখেছিল।
দুই
সেই অচেনা চিঠিটা পরের কয়েকদিন ধরে দুলালীর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। পোস্ট অফিসে রোজকার কাজ যেমন চলছিল, তেমনই তার অভ্যস্ত হাসিটাও মুখে ছিল—কিন্তু চোখের গভীরে জন্ম নিয়েছিল এক নতুন আলোড়ন। রূপসা ব্যস্ত ছিল ডিজিটাল সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনায়, শুভঙ্কর ব্যস্ত ছিল বাইসাইকেল চালিয়ে নতুন নতুন ফ্ল্যাটের চিঠি বিলিতে, আর মৃণালবাবু কাঁপা হাতে চিঠি লিখে যাচ্ছিলেন তাঁর পুরোনো সহপাঠী মীনাদেবীকে—কিন্তু দুলালী ছিল নিজের এক নিঃশব্দ অনুসন্ধানে। যে কাগজটায় চিঠিটা লেখা, তার কাগজের গন্ধ অন্যরকম—পুরোনো, যেন কোনো পুরাতন ডায়েরি থেকে ছেঁড়া। অক্ষরগুলো সুন্দর, ছন্দে ভরা, অথচ সংক্ষিপ্ত। সে বুঝে ওঠে, চিঠির লেখক তার মনের কথা জানে—কিন্তু এটা কি কেবল কাকতালীয়? না কি কেউ ইচ্ছে করে তাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে, যে ভালোবাসা হয়তো কেবল প্রাপ্তি নয়, স্মৃতিও হতে পারে?
একদিন চিঠিটা ব্যাগে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দুলালী সদর রোডের পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ে—যেখানে কলেজ জীবনে তার যাওয়া ছিল প্রায় রোজকার। দোকানটা এখন ধুলোমাখা, বেচাকেনাও খুব কম। তবে দেয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের তাকগুলো যেন এখনো সেই পুরোনো দিনগুলোর নিঃশ্বাস ধরে রেখেছে। সে একখানা পুরোনো খাতা কেনে, যেখানে সে ঠিক করে এই চিঠির শব্দগুলো লিখে রাখবে, এবং খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে কার লেখা এটা হতে পারে। বাড়ি ফিরে সে তার পুরোনো চিঠিপত্র, কবিতা, এমনকি কলেজে পাওয়া গ্রুপ ফটো খুলে বসে। তার স্মৃতিতে এক নাম ভেসে ওঠে—অরিন্দম। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, কবিতা লিখত, চুপচাপ থাকত, এবং সে একবার দুলালীর কবিতার একটি লাইন পড়ে বলেছিল, “তুমি কাগজে কাগজে হৃদয়ের শব্দ রাখো।” সে কি চিঠির প্রেরক? না কি এই সবকিছুই শুধু তার কল্পনার তৈরি এক দীর্ঘ ছায়া?
পোস্ট অফিসে পরদিন সকালটা ছিল অন্যরকম। শুভঙ্কর যেন কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। অবশেষে সে দুলালীর টেবিলে একখানা কাগজ রাখে—একটা কবিতা, হাতে লেখা। “চিঠি তুমি, পাঠানো হয়নি কোনোদিন / খামের গায়ে নামও লেখা হয়নি…”—এই লাইন দেখে দুলালীর মনে হয়, হয়তো শুভঙ্করই সেই প্রেরক। সে একবার চোখ তুলে শুভঙ্করের দিকে তাকায়—ছেলেটা কিছুটা অস্বস্তিতে হাসে, আর বলে, “এই কবিতাটা কাল রাতে লিখেছিলাম, আপনাকে পড়ে শোনাব ভেবেছিলাম।” দুলালী তখন নিশ্চিন্ত হয়—এই চিঠি শুভঙ্করের নয়। সে বুঝে, এই খেলা জটিল, এই খোঁজ তার একার, আর এই চিঠির উত্তর হয়তো সে সহজে পাবে না। কিন্তু সে এখন চায় খুঁজতে—কারণ এ খোঁজ যেন তার নিজের মধ্যে ফিরে যাওয়ার এক রাস্তা, যেখানে সে আবার সেই মেয়েটিকে খুঁজে পায়, যে অপেক্ষা করত, ভালোবাসতে জানত, আর যে একদিন চিঠির বদলে চুপ করে যাওয়া শিখেছিল।
তিন
রাতে একা ঘরের নির্জনতায় বসে দুলালী আবার খুলে দেখে সেই নামহীন চিঠিটা। আলো নিভিয়ে সে বারান্দায় বসে থাকে, জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে কাগজের প্রতিটি অক্ষর। “তুমি চিঠি সাজাও, জানি। কিন্তু জানো কি, কোনো এক চিঠি তোমার নিজের জন্যই ছিল, যা তুমি কোনোদিন খোলোনি।” — এই লাইনটা যেন একশোবার পড়েও নতুন লাগে। এইবার সে চোখ বন্ধ করে কল্পনায় ফিরে যায় কলেজের শেষ বর্ষে, সেই দুপুরবেলার ক্লাসগুলোর ফাঁকে লেখা তার নিজের কবিতা, যার প্রতিটি পঙ্ক্তি সে একদিন কোনো অচেনা অনুভবে লিখেছিল। সেই সময়কার খাতাগুলো সে বারান্দার আলমারি থেকে খুঁজে বের করে, খুলে দেখে পাতার পর পাতা অজস্র কবিতা—অপ্রকাশিত, অসমাপ্ত। তার নিজের হাতে লেখা, অথচ সেই হাতের ভাষা আজ অনেক দূরের মনে হয়। একটা পাতায় লেখা ছিল—“যদি কোনোদিন আমার চিঠি কেউ পড়ে, যেন সে শুধু শব্দ না, নিঃশ্বাস পড়ে।” তার মনে হয়, হয়তো সেই পাতাই কোনোভাবে কখনো কোথাও পৌঁছেছিল, কাউকে ছুঁয়েছিল, যিনি আজ এতদিন পর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই নিঃশ্বাসে লেখা চিঠি।
পরদিন সকালে ডাকঘরে আসতে আসতে রাস্তার ধারে সেই ছোট্ট মন্দিরটায় ঢুকে পড়ে সে, যেখানে প্রতিদিন পায়রারা ঘোরে, আর দোকানের পাশের চা-ওয়ালা হরিপদ তাকে দেখে বলে, “দিদি, আজ একটু বেশি চুপচাপ না?” সে হেসে বলে, “কখনো কখনো চুপ করাটাও একটা চিঠির মতো, হরিপদ।” ডাকঘরে এসে দেখে, শুভঙ্কর নেই। বদলে, রূপসা বসে বসে নতুন কম্পিউটার প্রোগ্রাম দেখছে, চোখে বিরক্তি। দুলালী চুপচাপ নিজের ডেস্কে গিয়ে চিঠিগুলো সাজাতে বসে, কিন্তু মন পড়ে থাকে তার খাতার মধ্যে। তখন হঠাৎ একটা চিঠি চোখে পড়ে—পুরোনো, ১৯৯৮ সালের তারিখ, কিন্তু প্রাপক নাম নেই। শুধু একটাই লাইন লেখা—“যে চিঠি কোনোদিন পৌঁছায় না, সেই চিঠিই কখনো কখনো হৃদয়ের ঠিকানায় পড়ে থাকে।” খামের গায়ে নেই কোনো স্ট্যাম্প। দুলালীর বুক ধক করে ওঠে—এই লেখাটা তার নিজের, একবার কলেজের দিনগুলিতে সে সত্যিই এমন একটা খাম লিখে রেখে দিয়েছিল লাল পোস্ট বক্সের পাশে, পাঠায়নি কাউকে।
বিকেলে সে সেই পুরোনো রেকর্ড রুমে ঢুকে, যা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। ধুলোমাখা তাক, মাকড়সার জাল, আর বিবর্ণ ফাইলের মধ্যেও যেন সময় গেঁথে আছে। একেকটা ফাইলে পুরোনো চিঠি, যেগুলো প্রাপক না থাকায় জমে রয়েছে বছরের পর বছর। সে হাতড়ে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজে পায় একটি খাম—যেখানে লেখা, “প্রিয় জনের জন্য”—কোনো নাম নেই। খামটা খুলতেই তার নিজের হাতে লেখা কবিতার কাগজ বের হয়—সেই কবিতা, যেটা সে একদিন পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু সাহস পায়নি। কাঁপা হাতে খামটা বুকে চেপে ধরে সে জানে—এই চিঠি কেউ পাঠায়নি, কিন্তু সময়ই একে ফিরিয়ে দিয়েছে তার কাছে। এই ফিরে আসা কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এক গভীর নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি—যেখানে দুলালী নিজেই নিজের প্রেরক, নিজের প্রাপক, আর নিজের ইতিহাস।
চার
ডাকঘরের রেকর্ড রুমে নিজের পুরোনো কবিতা খুঁজে পাওয়ার পর দুলালীর ভেতরে যেন এক ঝড় বয়ে যায়। সময় যেন নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে। সেই কাগজে লেখা অক্ষরগুলো তার নিজের, অথচ বিস্মৃত। এতদিন ধরে অন্যের চিঠি সাজাতে সাজাতে সে ভুলেই গিয়েছিল—কোনোদিন সে নিজেও লিখত, অপেক্ষা করত, কাউকে চুপিচুপি ভালোবাসত। কিন্তু সেই ভালোবাসা কোনোদিন নাম জানেনি, পথ পায়নি। তার চেয়ে আশ্চর্য আর কিছু ছিল না, যখন পরদিন সকালে ডাকঘরে এসে সে দেখে শুভঙ্কর তার ডেস্কে বসে কিছু লিখছে। সাধারণত সে সকালে বাইকে চিঠি নিয়ে বেরিয়ে যায়, কিন্তু আজ সে থেমে আছে। দুলালী চুপচাপ তার ডেস্কে বসে, কিন্তু চোখ পড়ে শুভঙ্করের হাতে থাকা কাগজে। তাতে লেখা কবিতার প্রথম লাইন: “তুমি চিঠির মতো / বাইরে সাদা, ভেতরে অনেক কথা…”
দুলালী মনে মনে চমকে ওঠে। শুভঙ্কর কি জানে কিছু? সে কি দেখেছে সেই চিঠি? না কি সেও দুলালীর জীবনের কোনো অনুচ্চারিত অধ্যায় হয়ে উঠছে? কিছুক্ষণ বাদে শুভঙ্কর খাতা বন্ধ করে বলে, “দিদি, একটা কবিতা লিখেছি। যদি পড়ে শোনাই…” দুলালী হেসে মাথা নাড়ে। শুভঙ্কর পড়ে, কবিতাটা বিষণ্ণ অথচ কোমল। তাতে রয়েছে নিঃশব্দ প্রেমের ভাষা, যেটা প্রকাশ পায় না চিঠির খামে, শুধু পড়ে থাকে বাতিল চিঠির স্তূপে। “আমি প্রতিদিন নাম লেখা খামে / অন্য কারো ঠিকানা লিখি / কিন্তু এক খাম বাঁচিয়ে রাখি / যেখানে কোনো ঠিকানাই লেখা নেই…” — এই পংক্তিতে দুলালীর বুক ধড়ফড় করতে থাকে। এই কবিতা কি তার উদ্দেশ্যে? সে কিছু বলে না, শুধু ধীরে বলে, “ভালো লিখেছো, শুভঙ্কর। লিখে যাও।” কিন্তু তার মনে হয়, শুভঙ্কর হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছু। হয়তো সে চোখে চোখে রেখেছিল দুলালীকে, তার নিঃশব্দ অভ্যেসগুলোকে।
দুলালী সেদিন রাতে নিজের খাতায় লিখে রাখে, “ভালোবাসা যদি নামহীন হয়, তা কি চিঠি হয়ে ওঠে না?” পরদিন মৃণালবাবু এসে তাকে বলেন, “তুমি জানো, দিদি, তোমার ডাকঘরটা শুধু চিঠি না, অনেক অসমাপ্ত কথার ঠিকানা।” দুলালী হাসে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সে জানে—চিঠির খামে যেমন শব্দ থাকে, তেমনি থাকে না বলা হাওয়ার মতো অনুভব, যেগুলো শুধু সময় বুঝতে পারে। শুভঙ্করের কবিতা তার হৃদয়ে কোনো নতুন কাঁপন তোলে, কিন্তু সে জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় প্রেম নয়—কখনো কখনো সেটা নীরব শ্রদ্ধা, অথবা এক বিনীত বোঝাপড়া। যেটা নামহীন, অথচ চিরকালীন।
পাঁচ
সেই সপ্তাহটা যেন অদ্ভুত এক নিঃশব্দ উত্তেজনায় কেটে গেল। দুলালীর মনে প্রতিনিয়ত এক দ্বন্দ্ব—চিঠির প্রেরক কি সে নিজেই, না কি কেউ তাকে চেনার, ছুঁয়ে যাওয়ার সাহস করেছিল নীরবে? শুভঙ্করের কবিতা তাকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু তার অনুভবে প্রেমের চেয়ে বেশি ছিল এক স্নেহের ছোঁয়া, এক আত্মিক সম্মান। সেইমধ্যে হঠাৎ এক বিকেলে ডাকঘরের ছোট্ট কাঠের জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছিল, আর মৃণাল সেনগুপ্ত ধীরে ধীরে হেঁটে এসে বসেন দুলালীর ডেস্কের ঠিক উল্টোদিকে। হাতে একটা খাম। চোখে একটু জলচাপা ক্লান্তি। দুলালী তখন রেজিস্টার লিখছিল, কিন্তু মৃণালের চাহনি টের পেয়ে মাথা তোলে। “দিদি,” মৃণালবাবু বলেন, “একটা কথা বহুদিন বলিনি, আজ বলি—তুমি জানো, তুমিও এক চিঠি ছিলে কোনো একসময় আমার জীবনে।”
দুলালী হতভম্ব হয়ে তাকায়। মৃণালবাবুর মুখে কোনো ছলনা নেই, নেই কোনো শারীরিক ভাষা। শুধু কণ্ঠে একটা ক্লান্ত সত্য। তিনি বলেন, “অনেক বছর আগে, তোমার বয়স যখন কুড়ি, আর আমার তিরিশ। তুমি তখন কলেজে, আর আমি স্কুলের নতুন শিক্ষক। আমি প্রতিদিন লাইব্রেরির জানালা দিয়ে দেখতাম—একটা মেয়ে বসে থাকে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে, মাঝে মাঝে খাতায় কিছু লেখে। আমি জানতাম না, তুমি কে। শুধু চুপচাপ ভালো লাগতো। একদিন সাহস করে একটা চিঠি লিখে ফেলি—কিন্তু পাঠাতে পারিনি। তাতে লেখা ছিল, ‘যদি কোনোদিন দেখা হয়, শুধু বলো তুমি ভালো আছো কি না।’ সেই চিঠিটা কোনোদিন খামে ভরিনি, কিন্তু আজ এত বছর পর, সেই অনুভবটা আবার ফিরে এলো—যখন দেখলাম তুমি প্রতিদিন এই পোস্ট অফিসে চিঠির পাহারাদার হয়ে বসে থাকো। তোমাকে বলা হয়নি কোনোদিন, দিদি, কিন্তু তুমি আমার জীবনের প্রথম না-পাওয়া চিঠি।”
দুলালীর মুখে কোনো শব্দ আসে না। সে শুধু চোখ নামিয়ে রাখে, যেন এক অন্য পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন ধরে যাকে সে শুধু এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভেবেছিল, তার হৃদয়ে সে নিজে কখনো একজন ‘অপ্রকাশিত চিঠি’ হয়ে ছিল, সে সত্য তাকে আলোড়িত করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—তাতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়নি। বরং মনে হলো—একটা বোঝা হালকা হলো। সেই না-পাওয়ার গল্পটাও যেন তার নিজের মতই—এক নিঃশব্দ ভালোবাসা, যা উচ্চারিত না হলেও থেকে যায় কারো মনে। সে ধীরে বলে, “আপনি যদি সেই চিঠি কখনো পাঠাতেন, আমি হয়তো… হয়তো পড়তাম। কিন্তু হয়তো উত্তর দিতে পারতাম না।” মৃণালবাবু হালকা হেসে বলেন, “তাই তো পাঠাইনি, দিদি। ভালোবাসা সবসময় উত্তর পায় না, পায় এক নিঃশব্দ সম্মতি।” সে উঠে চলে যায় ধীরে ধীরে, তার চলার ছন্দে মিশে যায় একটা অস্ফুট স্বস্তি। দুলালী জানে, এই ডাকঘর শুধু মানুষের বার্তা বহন করে না—এটা স্মৃতির আধার, যেখানে সময় ফেলে যাওয়া শব্দগুলো একদিন ঠিক ফিরে আসে, হয়তো অন্য নামে, অন্য মুখে, কিন্তু হৃদয়ের ভাষা বদলায় না।
ছয়
ডাকঘরের সেই নির্জন দুপুরে, যখন জানালার কাঁচের ওপারে রোদটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে, দুলালী আজ এক অন্য রকম চিন্তায় ডুবে থাকে। অচেনা চিঠিখনির মায়াজালে আটকে গিয়েছে যেন সে। গত কয়েকদিনে আরও দু’টি চিঠি এসেছে—কোনোটিতেই প্রেরকের নাম নেই, শুধু এক একটি সূক্ষ্ম অনুভব, যেন কেউ অতীতের পাতায় লেখা এক নৈঃশব্দ্যের গল্প পাঠাচ্ছে তার ঠিকানায়। আজকের চিঠিতে লেখা—“তোমার মুখে চিঠি গুছিয়ে রাখার সেই অভ্যেসটা, আজও চোখে ভাসে। তুমি জানো না, কতটা প্রশ্রয় পেতাম তোমার এই ছোট ছোট অভ্যাসে।” লাইনটা পড়ে দুলালীর গা শিউরে ওঠে। কে লিখছে এ কথা? কে এতটা নিবিড় ভাবে জানত তাকে? বুকের মধ্যে যেন হাওয়ার ঢেউ উঠে যায়, আর সেই ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে মনে পড়ে যায় ডাকঘরের পেছনের সেই গাঁথা, সেই সময়ের কথা—যখন সে নতুন জয়েন করেছিল এই অফিসে। তখনও কলকাতার অনেকটা গা ছুঁয়ে থাকা চিঠির যুগ, তখনও মানুষ লিখত মনের কথা খামে ভরে। তখনকার এক সহকর্মী ছিল—সুব্রত। হাসিখুশি, কিন্তু গভীর চোখের ছায়ায় কিছুটা বিষাদ ছিল। সে-ই কি?
তদন্তে নেমে পড়ে দুলালী—নয়, গোয়েন্দার মতন নয়, বরং এক আশাহীন হৃদয়ের মতো, যে নিজের অতীতকে নতুন চোখে দেখতে চায়। পুরোনো অফিস রেজিস্টার, আগের বছরগুলির চিঠিপত্রের লগ, ছেঁড়া খামে মোড়ানো অসমাপ্ত কিছু আবেদন—সব ঘাঁটতে থাকে সে, যেন কোথাও পাওয়া যাবে কোনো প্রমাণ, কোনো ধোঁয়ার রেখা, যা পৌঁছে দেবে সেই অদৃশ্য লেখকের কাছে। আজকাল সে বাড়ি ফিরতে দেরি করে; রাতের ভাত ঠান্ডা হয়ে যায়, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ডাকঘরের কাঠের তাকের তলায়, কোন পুরোনো নথির স্তুপে। একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায়, অশোকবাবু তাকে বলে—“দিদি, তোমার ডেস্কে একটা খাম রাখা ছিল, আমি টুলের নিচে পেয়েছি।” চমকে ওঠে দুলালী। সেই খামে লেখা ছিল—“শেষবার তোমার ছায়ার পেছনে হেঁটে গিয়েছিলাম পোস্ট অফিসের গেট অবধি, জানো?” দুলালীর চোখে জল চলে আসে। এত গভীর চিন্তা, এত সুক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা… এ কি সত্যিই সুব্রতের লেখা হতে পারে?
এর পরদিন অফিস ছুটির পরে, দুলালী সোজা চলে যায় সুব্রতের পুরোনো ঠিকানায়—যা সে খুঁজে পেয়েছিল পুরাতন রেকর্ড বইতে। তালা ঝুলছে ঘরের দরজায়। পাশের বাড়ির মেনকা কাকিমা জানায়, অনেক বছর আগেই সুব্রত হঠাৎ করে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যায়; কেউ বলে গিয়ে ছিল পাহাড়ে, কেউ বলে চিঠি লেখার কাজ নিয়ে বাইরে চলে যায়। কিন্তু আর ফেরেনি। সেই সন্ধ্যাবেলাটা, যখন দুলালী পোস্ট অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে চিঠিটা আবার পড়ে, তখন যেন তার হৃদয়ে এক নিঃশব্দ বৃষ্টির শব্দ বাজে। হ্যাঁ, সে আজ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—চিঠিগুলো ঠিক তারই জন্য, ঠিক তার অতীতেরই কেউ লিখছে। কে জানে, হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না। কিন্তু এ চিঠির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য এখন তার জীবনের অংশ। দুলালী জানে, সে আর আগের মতো সাধারণ এক পোস্টমাস্টার দিদি নয়—সে এখন একজন গল্পের চরিত্র, যার চিঠিতে নিজেই লেখা হয়ে চলেছে নিঃশব্দ প্রেম, হারানো সময় আর না বলা কথার এক অনুপম ইতিহাস।
সাত
সন্ধ্যার পর বাতাসে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘুরে বেড়াত, যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু ভাষা খুঁজে পায় না। দুলালী চুপচাপ বসে ছিল টেবিলের পাশে, চায়ের কাপের ধোঁয়া আর চিঠির উপর হাত রাখা তার প্রিয় অভ্যাস হয়ে উঠেছে ইদানীং। ময়ূরবরণ খামে লেখা সেই অচেনা হাতের লেখা আজ আবার এল—তৃতীয়বারের মতো। এবারেও প্রেরকের নাম নেই, ঠিকানাও শুধু ছাপার অক্ষরে ‘তুমি’। কিন্তু এবার শব্দগুলো যেন একটু বেশি ঘন, একটু বেশি ব্যক্তিগত। “তুমি যে জানো না, তোমার প্রতিদিনের হাঁটাচলা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, অথবা ছেঁড়া গলায় আধভাঙা সুর গুনগুন করে ওঠা—সবটা আজও আমার চোখে বাঁধা আছে। আমি থাকি না, কিন্তু থাকিও… তোমার আশেপাশে।”
চিঠির এই কয়েকটি লাইন যেন দুলালীর ভিতরের ঝাঁপ বন্ধ জানালাটাকে খুলে দেয়। তার মন চলে যায় ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে, যখন নদীয়ার কাছাকাছি এক পাড়াগাঁয়ে সে পোস্টিং পেয়েছিল। সেইখানেই পরিচয় হয়েছিল অরিন্দম নামের একজন চিত্রশিল্পীর সঙ্গে—যে এসেছিল গ্রাম আঁকতে, কিন্তু রং-তুলি ফেলে রেখে শেষপর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় পোস্ট অফিসে বসে থাকত, দুলালীর সঙ্গে কাকভোর থেকে খোলা চিঠিগুলোর কথা শুনতে শুনতে। অরিন্দম কখনও কিছু বলেনি, কখনও প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি। কেবল তার খাতা ভর্তি ছিল দুলালীর মুখের একের পর এক রেখাচিত্রে। হঠাৎ একদিন সে চলে গিয়েছিল কলকাতা ফিরে যাওয়ার নাম করে, তারপর আর কোনো খবরই আসেনি।
চিঠির ভাষা, সেই দিনের আঁচ, আর অরিন্দমের মুখের আবছা স্মৃতি সব মিলিয়ে দুলালীর ভিতরে কিছু যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে চিঠিটা আবার পড়ে, চা ঠান্ডা হয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়, কিন্তু তার চোখ আটকে থাকে ঐ ‘তুমি’-র কাছে। এ কি সেই অরিন্দমের চিঠি? এতদিন পর? এত আড়ালে? তার বুকের ভিতর যেন ছোট এক কাঁপুনি বাজে—ভয় নয়, উত্তেজনা নয়, বরং এক প্রাচীন প্রতীক্ষার নতুন শব্দ।
আট
সন্ধ্যার সোনালি আলোয় দুলালীর ডাকঘর যেন এক রহস্যময় উপাখ্যানের অন্তিম অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ভগ্নপ্রায় দেওয়াল, কাঠের তাক, অক্ষয়চিত্রের মতো পুরনো পোস্টকার্ড আর সেগুলোর মাঝখানে বসে আছে দুলালী—একটি চিঠি হাতে, জীবনের শেষ পৃষ্ঠার সামনে দাঁড়িয়ে। এই চিঠি তার কাছে আগত বহু অচেনা শব্দের মতো নয়, এ চিঠি যেন তার আত্মার ভাষা। লেখাগুলি খুব পরিচিত, অনেকটা রুদ্রর মতো, কিন্তু আবার ঠিক তার নয়। প্রেরকের নাম নেই, ঠিকানাও নয়—শুধু এক আভাস, এক অনুভূতির টানে বাঁধা কিছু বাক্য। “যদি চিঠির শব্দে ভালোবাসা জন্মায়, তাহলে তুমি জানবে—তুমি একা নও, কোনোদিনও ছিলে না।”
সেই দিন ডাকঘরে হঠাৎ হাজির হয়েছিল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কপালে সাদা চুল, চোখে পাতলা ধোঁয়া—কিন্তু চাওয়ার মাঝে এক আশ্চর্য শান্তি। দুলালীকে দেখে বলেছিল, “আপনার চিঠিগুলোকে আমি বহু বছর ধরে দেখছি, কিন্তু এবার একটা ফিরিয়ে দিতে এসেছি।” তার হাতের খামে ঠিক সেই লেখার ছায়া। দুলালীর মুখে কোনো কথা আসে না। লোকটি শান্তভাবে বলে, “অনেক বছর আগে কেউ আপনাকে একটি চিঠি পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। আজ সেই কথাগুলি সময়ের পাহাড় ডিঙিয়ে আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি শুধু বাহক।” দুলালীর চোখ ভিজে ওঠে। সেই বৃদ্ধ আর কোনো কথা না বলে চলে যায়, আর তার পদধ্বনি যেন এক নতুন যাত্রার সূচনা করে। চিঠির লাইন পড়তে পড়তে দুলালীর মনে পড়ে যায় প্রথম ভালোবাসার সেই দিনগুলি, হারিয়ে যাওয়া অক্ষরগুলি, ও সেই হৃদয়—যা কোনো ঠিকানা ছাড়াই আজও অপেক্ষা করে।
চিঠির শেষ লাইন ছিল—“ভালো থেকো, দিদি। যদি কোনোদিন আবার জন্ম হয়, আমি যেন আবার তোমার চিঠির দুলালীর নামেই লিখি।” দুলালী খামটা বুকের কাছে চেপে ধরে। বাহ্যিক দুনিয়ার কোলাহল পেরিয়ে সে যেন পৌঁছে যায় সেই আবেগের ঠিকানায়, যেখানে সময় থেমে থাকে না, ভালোবাসা হারায় না—শুধু নতুন রূপে ফিরে আসে, নতুন বার্তায়। ডাকঘরের সেই জানালা দিয়ে সুর্যাস্তের আলো এসে পড়ে তার মুখে, ঠিক যেন চিঠির শব্দে লেখা এক বিদায়, এক আশ্বাস—”তুমি কখনোই একা নও।”
***