Bangla - ভূতের গল্প

ডাকঘরের প্রেতাত্মা

Spread the love

অধ্যায় ১ : পুরনো ডাকঘর

অরিন্দম চক্রবর্তী শহুরে মানুষ। কলকাতার ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর বহু বছর চাকরি করে হঠাৎই একদিন ট্রান্সফারের চিঠি এসে যায় তার হাতে—পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছে নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল, কেননা শহরের আরাম, বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা হল বা বইয়ের দোকান সব কিছুই ছেড়ে আসতে হবে। তবু ভেতরে ভেতরে কৌতূহলও ছিল, গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নেওয়া যাবে, আর নতুন জায়গার নতুন অভিজ্ঞতাও তো একরকম রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের ছবিটা তার চোখে ধরা দেয়—চওড়া কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে ধানক্ষেত, হাওয়ায় ভেসে আসা খড়ের গন্ধ, আর দূরে সাদা মন্দিরের শিখর। এমন সরল অথচ শান্ত পরিবেশে বসবাস করার সুযোগ সে কোনোদিন পায়নি। পোস্ট অফিসে পৌঁছনোর পর কিছু গ্রামের মানুষ তাকে ঘিরে ধরে। সবাই হাসিমুখে, কেউ ফুল দেয়, কেউ বলি দেয় গরম চা খাবার জন্য। তবে তাঁদের অভ্যর্থনা যতটা আন্তরিক ছিল, তার মাঝেই এক অদ্ভুত গম্ভীরতা মিশে ছিল। মাঝেমধ্যেই কারও দৃষ্টি অরিন্দমকে দেখে অন্যদিকে সরে যাচ্ছিল, যেন তারা কিছু বলতে চাইছে অথচ স্পষ্ট করে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে নিজের দায়িত্বে গর্বিত হলেও অরিন্দম বুঝতে পারছিল, এই ডাকঘরটিকে ঘিরে গ্রামের মানুষের মনে কোনো এক গভীর ভীতি বা অস্বস্তি আছে।

পোস্ট অফিসটা ছিল একেবারে পুরনো ধাঁচের। লাল ইটের দেওয়ালে পলেস্তারা উঠে গেছে, জানালার কাঁচগুলো কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে আছে, আর ভেতরে ঢুকলেই ধুলো আর পুরনো কাগজের গন্ধে শ্বাস আটকে আসে। বড় কাঠের টেবিল, চিঠি রাখার আলমারি আর এক কোণে শিকল দিয়ে আটকানো লোহার সিন্দুক—সব কিছুতেই একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল। যেন ঘরটার প্রতিটি ইট, প্রতিটি আসবাবপত্র দীর্ঘদিন ধরে অচল, অথচ নিঃশব্দে কোনো গল্প বলতে চাইছে। অরিন্দম এসব ভেবে হেসে উঠল—‘শহরে তো এসবকে নস্টালজিয়া বলা হয়, এখানে হয়তো ভৌতিক বলে কুসংস্কার ছড়ায়।’ হঠাৎ গ্রামের এক প্রবীণ লোক, শশধর মল্লিক, এসে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “বাবু, রাত হলে একা একা এ ঘরে বসবেন না। অনেকে চেষ্টা করেছে, টিকতে পারেনি।” কথাগুলো শুনে অরিন্দম হেসে জবাব দিল, “আরে এসব গুজব! ভূত বলে কিছু হয় নাকি? আমি দেখব সব।” কিন্তু শশধরের চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছিল, যা সহজে মুছে যায় না। চারপাশের মানুষজনও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তারা আর কিছু বলল না। নতুন জায়গায় এসে অরিন্দমকে তারা অভ্যর্থনা জানালেও, সেই উষ্ণতার আড়ালে একটা অচেনা ভয় ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

সন্ধ্যা নামতেই ডাকঘরের ভেতরে একা দাঁড়িয়ে অরিন্দম জানালার বাইরে তাকাল। আকাশে হালকা মেঘ, দূরে ধানক্ষেতের ওপরে কুয়াশার আস্তরণ নামছে। ডাকঘরের সামনে দিয়ে কয়েকজন গ্রামবাসী যাচ্ছিল, তারা অরিন্দমকে দেখে একটু থেমে তাকাল, তারপর দ্রুত হেঁটে চলে গেল। যেন তাদের দৃষ্টি বলছে—‘তুমি জানো না তুমি কোথায় পা রেখেছ।’ অথচ অরিন্দম এসব উপেক্ষা করল। সে মনের মধ্যে স্থির করল, এই ডাকঘর আর গ্রামকে সে নিজের দায়িত্ববোধ আর যুক্তির জোরে নতুন প্রাণ দেবে। কোনো ভৌতিক কাহিনি বা গুজব তাকে টলাতে পারবে না। তার চোখে এসব শুধুই অশিক্ষা আর অন্ধবিশ্বাসের ছায়া। কিন্তু তবু, ডাকঘরের ভেতরের সেই অদ্ভুত গন্ধ, দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা সোঁদা হাওয়া আর নিস্তব্ধতায় ভেসে বেড়ানো এক চাপা অস্বস্তি—এসব যেন বারবার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এ জায়গা হয়তো সাধারণ নয়। রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, ঘরের ভেতরে সেই চাপা রহস্য যেন আরো ঘনীভূত হচ্ছিল। অরিন্দম নিজের মনে হাসলেও অজান্তেই সে হঠাৎ কেঁপে উঠল, বুঝতে পারল না কেন তার হাতের কাগজগুলো অকারণে কাঁপছে। এভাবেই, পুরনো ডাকঘরের সঙ্গে তার প্রথম রাতের আলাপ অচেনা এক অন্ধকারের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হলো।

অধ্যায় ২ : রাত্রির প্রথম সতর্কতা

প্রথম রাতের নিস্তব্ধতা যেন অরিন্দমকে এক অচেনা আবহের ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সারা দিন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আলাপ, পোস্ট অফিসের পুরনো কাগজপত্র গোছানো, আর নিজের থাকার ঘর মেপে নেওয়া—সব মিলিয়ে ক্লান্ত হলেও তার মনে একরকম উত্তেজনা ছিল। নতুন কর্মস্থল, নতুন দায়িত্ব, আর সঙ্গে গ্রামবাসীর ফিসফিস করা ভৌতিক কাহিনি—এসবের মধ্যে ভরসন্ধ্যায় কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে টেবিলে বসেছিল সে। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, মাঝে মাঝে কুকুরের দূরবর্তী ঘেউ ঘেউ, আর জানালার ওপারে ঝিরঝিরে হাওয়া—সব মিলে পরিবেশটা রহস্যময় হয়ে উঠছিল। বিনোদ মাঝি, ডাকঘরের রাত্রি প্রহরী, ঘরের এক কোণে হেলান দিয়ে বসে কুঁজো ভঙ্গিতে বিড়ি টানছিল। তার চোখেমুখে এক ধরণের অনিচ্ছা, যেন সে চাইছে এই রাতটা দ্রুত শেষ হোক। হঠাৎই অরিন্দম খেয়াল করল, টেবিলের ওপর রাখা চিঠির খামগুলো একে একে নড়ছে, যেন হালকা বাতাস লাগছে। সে মাথা তুলে চারপাশে তাকাল—জানালা বন্ধ, দরজার ফাঁক নেই, বাতাসের কোনো চিহ্নই নেই। অথচ খামগুলো কাঁপছে, টেবিলের প্রান্ত থেকে একটা খাম ধীরে ধীরে পিছলে মেঝেতে পড়ল। অরিন্দম প্রথমে ভেবেছিল হয়তো ভুল দেখছে, কিন্তু বিনোদ মাঝির চোখেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে সে বুঝল, ব্যাপারটা সাধারণ নয়। বিনোদ বিড়ি ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে তোতলানো গলায় বলল—“বাবু, আমি… আমি থাকব না। আমি যাচ্ছি।”

অরিন্দম তাকে থামাতে চেষ্টা করল। বলল—“আরে বিনোদ, ভয় কিসের? হয়তো ইঁদুর লাফালাফি করছে কোথাও, কিংবা টেবিলটা হেলে আছে।” কিন্তু তার নিজের গলাতেও দৃঢ়তার সঙ্গে সঙ্গে এক অদৃশ্য অনিশ্চয়তা জড়িয়ে যাচ্ছিল। বিনোদ দরজার দিকে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিল—“না বাবু, আমি এইসব দেখেছি বহুবার। রাতে এই খামগুলো নড়ে, কারও পায়ের শব্দ শোনা যায়, যেন কেউ ডাক বয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে চেষ্টা করেছে এখানে রাত কাটাতে, কিন্তু কেউ টিকতে পারেনি। আমার মায়ের কসম, আমি আর থাকব না।” কথাগুলো বলে সে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হতেই ঘরটা আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কেবল কেরোসিন ল্যাম্পের আলো দুলে উঠছিল। অরিন্দম একা বসে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। খামগুলো আর নড়ছিল না, তবে মেঝেতে পড়ে থাকা খামটা যেন তার দৃষ্টি আটকে দিল। সে খামটা হাতে তুলে নিল, অদ্ভুত ভারী লাগছিল যেন, কাগজের ওজনের থেকেও বেশি কিছু বহন করছে। খামটা ঘুরিয়ে উল্টে দেখল—প্রেরকের নাম নেই, শুধু মলিন কালিতে লেখা আছে একটি ঠিকানা, যেটি সে চেনে না। অরিন্দমের বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল, তবে সে নিজের যুক্তিবাদী মনকে দৃঢ় করল। ভেবে নিল, ‘অবশ্যই কোনো স্বাভাবিক কারণ আছে, আর যদি রহস্য থেকেও থাকে, আমি সেটাই খুঁজে বের করব।’

রাত যত গাঢ় হচ্ছিল, ডাকঘরের পরিবেশ ততই ভারি হয়ে উঠছিল। টেবিলে বসে অরিন্দম নিজেকে কাজের ভান করাতে লাগল—পুরনো চিঠি গুছিয়ে রাখছে, খাতা টুকটাক উল্টে দেখছে। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেও কারও দেখা পেল না, তবুও বাতাসের ভেতরে অদৃশ্য উপস্থিতি যেন ধরা পড়ছিল। একসময় ল্যাম্পের আলো হঠাৎ কেঁপে উঠল, তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে অরিন্দম স্পষ্ট শুনতে পেল, দূর থেকে ভারী পায়ের চাপা শব্দ এগিয়ে আসছে—টুক টুক টুক—মনে হচ্ছিল ডাকঘরের ভেতরেই কেউ হাঁটছে। তার শরীরের রক্ত যেন জমে গেল, হাত থেকে খামটি প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে দাঁত চেপে স্থির হয়ে বসে রইল। মনের মধ্যে সাহস জোগাল—‘আমি ভয় পাব না, আমি এখানে সত্যিই কী হচ্ছে তা খুঁজে বের করব।’ পদশব্দ হঠাৎ থেমে গেল, আর ঘরটায় আবার নীরবতা নেমে এল। অরিন্দম ধীরে ধীরে নিশ্বাস ছাড়ল, বুকের ভেতর ধুকপুকানি থামানোর চেষ্টা করল। তখনই তার মনে হলো, ডাকঘরটা যেন কেবল একটি দপ্তর নয়, বরং কোনো অসমাপ্ত কাহিনির ভার বহন করছে। গ্রামবাসীর কথিত ভৌতিক গল্প হয়তো নিছক কুসংস্কার নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো সত্য। প্রথম রাতেই এমন সতর্কতার সম্মুখীন হয়ে অরিন্দম বুঝতে পারল—এই ডাকঘরে তার আগামীর প্রতিটি রাত সাধারণ হতে চলেছে না, বরং এক অজানা রহস্যের ভেতর তাকে টেনে নিয়ে যাবে।

অধ্যায় ৩ : রামলোচনের গল্প

পরদিন সকালে ডাকঘরের সামনে কুয়াশা গড়িয়ে আসছিল, আর দূরে পাখিদের কিচিরমিচির ভেদ করে গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ছিল। অরিন্দম সারারাত জেগে থেকেও দৃঢ় ছিল, যদিও চোখে ক্লান্তি আর মুখে চাপা অস্বস্তি ছিল স্পষ্ট। চায়ের কাপ হাতে বসেছিল সে ডাকঘরের সামনের সিঁড়িতে। তখনই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসেন গ্রামের প্রবীণ মানুষ শশধর মল্লিক। মাথায় সাদা গামছা, ধুতি আর কপালে বয়সের ভাঁজ, হাতে লাঠি—তাঁর হাঁটার ভঙ্গিতেই এক ধরনের স্থিরতা। তিনি চুপ করে অরিন্দমের পাশে বসে একটুখানি নিশ্বাস নিলেন, যেন মনে সাহস সঞ্চয় করছেন। অরিন্দম হালকা হেসে বলল, “আপনারা সবাই ভয় পান, অথচ আমি তো কোনো ভয়ঙ্কর কিছু পাইনি।” শশধর তীব্র দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন, যেন বলছেন—তুমি এখনো কিছুই জানো না। একটু পরে তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, “বাবু, আপনি নতুন মানুষ, তাই ভাবছেন এসব গুজব। কিন্তু এ ডাকঘরের ইতিহাস জানলে আপনি হাসতে পারবেন না। স্বাধীনতার আগে এখানে ছিলেন এক ডাকপিয়ন—রামলোচন। অদ্ভুত সৎ, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন তিনি। গ্রাম থেকে গ্রামে, মাইলের পর মাইল হেঁটে চিঠি পৌঁছে দিতেন। কেউ খিদে পেয়ে তাঁকে ভাত খেতে ডাকলে তিনি বলতেন, ‘প্রথমে দেশের দায়িত্ব, তারপর নিজের খিদে।’ এমন মানুষ আর কোথাও জন্মায়নি।” অরিন্দম প্রথমে অবিশ্বাসের ভান করলেও শশধরের গলার দৃঢ়তা তাকে নিঃশব্দে শুনতে বাধ্য করল।

শশধরের চোখের ভেতর যেন পুরনো দিনের চিত্র ভেসে উঠছিল। তিনি বললেন, “সে সময় স্বাধীনতার আন্দোলন তুঙ্গে। গ্রামে গ্রামে বিপ্লবীরা গোপনে খবর আদানপ্রদান করত, আর রামলোচন তাঁদের গোপন ভরসা হয়ে উঠেছিল। তিনি চিঠির খামে লুকিয়ে বার্তা পৌঁছে দিতেন, ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু এক রাতে, হঠাৎই তাঁর মৃত্যু হয় এই ডাকঘরের ভেতরেই। কেউ বলে, হৃদরোগে মারা যান; কেউ বলে, ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তাঁকে মেরে ফেলে। কিন্তু সত্যিটা আজও কেউ জানে না। যেদিন সকালে লোকেরা তাঁর দেহ পায়, চারপাশে ছড়িয়ে ছিল অনেক অদ্ভুত চিঠি—কোনোটার ঠিকানা নেই, কোথাও নাম নেই, কেবল রক্তের দাগ লেগে আছে। সেই থেকে ডাকঘরটা যেন বদলে গেল। মাঝরাতে খামগুলো নড়তে থাকে, পদশব্দ শোনা যায়, দরজার বাইরে ছায়া ঘোরাফেরা করে। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে, রামলোচন মারা গিয়েও নিজের দায়িত্ব শেষ করতে পারেনি। তাই তাঁর আত্মা এখনো এ ঘরে ঘুরে বেড়ায়, অদৃশ্য হাতে চিঠি বয়ে বেড়ায়। আপনি যা দেখেছেন গতরাতে, এ গ্রামের বহু মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে বছরের পর বছর।” শশধরের কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু তাঁর চোখে ভয়ের সঙ্গে একটা শ্রদ্ধাও ছিল। যেন তিনি কোনো ভৌতিক শক্তিকে নয়, বরং এক অসমাপ্ত দায়িত্বপালনকারী মানুষকে স্মরণ করছেন।

অরিন্দম চুপচাপ শুনছিল। মনের ভেতর যুক্তি আর আবেগের লড়াই শুরু হয়ে গেল। সে ভাবছিল—‘কতটা সত্যি এসব? ভূত বলে কিছু নেই, কিন্তু মানুষের স্মৃতি আর অপরাধবোধ কি জায়গাটিকে ভর করে রাখতে পারে না?’ হঠাৎ খেয়াল করল, ডাকঘরের ভেতর ঢুকতেই আবার সেই পুরনো কাগজের গন্ধ, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা এক চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ যেন শোনা যাচ্ছে। শশধর উঠে দাঁড়িয়ে লাঠি ঠুকে বললেন, “বাবু, আমরা এ সত্যি মেনে নিয়েছি। আপনি চাইলে হেসে উড়িয়ে দিন, কিন্তু সাবধানে থাকবেন। কারণ এ ঘরের ভেতর রামলোচনের আত্মা এখনো তার শেষ চিঠি খুঁজছে।” অরিন্দম হেসে বলল, “আমি ভূতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আপনার গল্পটা সত্যিই চমকপ্রদ। হয়তো এ রহস্যের ভেতর অন্য কোনো কারণ আছে। আমি চেষ্টা করব সেটি খুঁজে বের করতে।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে নিজেও অনুভব করছিল, রাতের সেই খাম নড়ার ঘটনা নিছক কাকতালীয় নয়। ইতিহাস, ষড়যন্ত্র আর অসমাপ্ত দায়িত্বের এক ছায়া ডাকঘরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর হয়তো সেই ছায়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ সত্য, যেটির সামনে দাঁড়াতে হলে কেবল যুক্তি নয়, সাহস আর ধৈর্যও চাই।

অধ্যায় ৪ : মিতালীর সতর্কবাণী

অরিন্দম তখন ডাকঘরের কাঠের টেবিলে বসে দিনের হিসাব মেলাচ্ছিল। বাইরে বিকেলের আলো ঢলতে শুরু করেছে, জানলার ফাঁক দিয়ে লালচে রোদ ঢুকে কাঠের মেঝেতে ছোপ ছোপ ছায়া ফেলছে। হঠাৎ করেই দরজার আড়াল থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো—“আপনি নতুন পোস্টমাস্টার, তাই না?” অরিন্দম চমকে তাকিয়ে দেখল, বয়সে পঁচিশ-ছাব্বিশের এক তরুণী, পরনে সাদা-লাল শাড়ি, কাঁধে একটি কাপড়ের ব্যাগ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মিতালী সেন। অরিন্দম হাসিমুখে তাকে ভেতরে আসতে বলল। কিন্তু মিতালীর চোখে এক অদ্ভুত সতর্কতা—কথা শুরু করতেই তার গলায় কাঁপুনি শোনা গেল। সে সরাসরি বলল, “আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। এই ডাকঘর নিয়ে গ্রামের মানুষের ভয়টা নিছক গুজব নয়। এখানে অনেকেই সত্য খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, কেউ আবার পাগলও হয়েছে। আপনি অকারণে ঝুঁকি নেবেন না।” অরিন্দম প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিল, বলল—“মিস সেন, আমি এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই, সবই মানুষের ভ্রম।” কিন্তু মিতালীর গলার দৃঢ়তা তাকে থামতে বাধ্য করল। সে জানাল, শশধর মল্লিকের বলা রামলোচনের গল্প শুধু শোনাই নয়, তার প্রমাণও আছে। অনেক রাতে স্কুল থেকে ফেরার পথে সে নিজে কান দিয়ে শুনেছে—ডাকঘরের ভেতর থেকে খামের খসখস শব্দ, কাগজ সরানোর আওয়াজ। অথচ তখন ভেতরে কেউ ছিল না। সে থেমে থেমে বলল, “যদি আপনি জেদের বশে এগোন, তবে সেই অদৃশ্য শক্তিকে বিরক্ত করবেন। সে শক্তি সহজে কাউকে ক্ষমা করে না।”

অরিন্দম চুপচাপ শুনছিল। তার মনে দোটানা শুরু হলো। একদিকে তার যুক্তিবাদী মন—সে শহরে বড় হয়েছে, শিক্ষিত, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। ভূতপ্রেতের গল্প তার কাছে হাস্যকর। অন্যদিকে মিতালীর চোখের ভীত-সতর্ক দৃষ্টি তাকে নড়বড়ে করে তুলল। সে বুঝতে পারছিল, মেয়েটি মিথ্যে বলছে না, অন্তত নিজের অভিজ্ঞতাই শেয়ার করছে। ডাকঘরের বাতাস যেন হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠল। ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টা ছুঁই ছুঁই করছে, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। মিতালী আরও কাছে এসে বলল, “আপনি শহুরে মানুষ, জানি এসব মানতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই গ্রাম অন্যরকম। এখানে প্রতিটি পুরনো দেওয়াল, প্রতিটি গাছ যেন ইতিহাস আর গোপন কথা বয়ে বেড়ায়। গ্রামের বয়স্করা বলেন, রামলোচনের আত্মা আজও অসমাপ্ত দায়িত্বে ঘুরে বেড়ায়। আপনি যদি তাকে চ্যালেঞ্জ করতে যান, হয়তো এমন কিছু ঘটবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।” অরিন্দম একটু হেসে উঠল, যদিও তার হাসিতে অদ্ভুত এক সঙ্কোচ ফুটে উঠল। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি ভয় পাই না, মিস সেন। আমার কাজের জায়গায় আমি দায়িত্ব পালন করব, গুজবের কাছে মাথা নত করব না। বরং প্রমাণ করব, এগুলো সব অযৌক্তিক কাহিনি।” মিতালী নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তার চোখে যেন অদ্ভুত এক বেদনা—যেন সে জানে, সামনে এক অজানা বিপদ দাঁড়িয়ে আছে, আর সে চাইলেও অরিন্দমকে আটকাতে পারছে না।

সন্ধ্যার পর যখন মিতালী বেরিয়ে গেল, ডাকঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। অরিন্দম কাগজপত্র গুছিয়ে টেবিলে রাখল, কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল মিতালীর সতর্কবাণী। কানে বাজছিল তার কথাগুলো—“সে শক্তি সহজে কাউকে ক্ষমা করে না।” অরিন্দম জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, চারদিকের অন্ধকারে গ্রামের মানুষজন নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়েছে, মাঠে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। যেন গ্রামটা নিঃশ্বাস ফেলে বিশ্রাম নিচ্ছে। অথচ ডাকঘরের ভেতর তার বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ বেড়ে চলেছে। সে নিজের মনে ভাবল, “না, আমি ভয় পাব না। এসব বাজে গল্প।” তবুও তার হাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও খামের স্তুপের উপর ছুঁয়ে গেল, মনে হলো অদ্ভুত এক শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে। রাত ঘনিয়ে এল, বাতাস থেমে গেল, কেরোসিন ল্যাম্পের আলো দপদপ করতে লাগল। আর অরিন্দমের চোখে ভেসে উঠল মিতালীর চোখের সতর্ক দৃষ্টি—যেন সেই দৃষ্টি তাকে শেষবারের মতো সাবধান করছে। অথচ সে একরোখা। নিজের মনে শুধু একটাই দৃঢ় বিশ্বাস—সে প্রমাণ করবে, কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। কিন্তু রাত যত গভীর হতে লাগল, ততই মনে হচ্ছিল, এই ডাকঘরের অদৃশ্য দেয়ালগুলো যেন তাকে নীরব কোনো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

অধ্যায় ৫ : রাতের সাক্ষাৎ

রাত তখন গভীর, ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। ডাকঘরের চারদিকে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এসেছে। অরিন্দম সেদিনও কাজের অজুহাতে থেকে গিয়েছিল, কিন্তু আসল কারণ সে নিজেই জানত—সে এই গুজবের পেছনের সত্যটা খুঁজে বের করতে চায়। কেরোসিন ল্যাম্পের মৃদু আলোয় তার চোখ দুটো ঝিমোচ্ছিল, কিন্তু বুকের ভেতর কৌতূহল তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ, নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট এক শব্দ ভেসে এলো—মেঝেতে কারও পদশব্দ। অরিন্দম কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে গেলেও সে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল। আর তখনই তার চোখ আটকে গেল ডাকঘরের ভিতরের অন্ধকার কোণে। যেন ছায়ার ভেতর থেকে কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আলোর আবছায়ায় দেখা গেল মানুষের মতো এক অবয়ব, কালো ছায়া, হাতে যেন চিঠির খামগুলো তুলে নিচ্ছে। অরিন্দমের বুক ধুকপুক করে উঠল—কেউ কি সত্যিই ভেতরে ঢুকেছে? নাকি এ তার চোখের ভ্রম? সে তাকিয়ে রইল, দেখল খামগুলো যেন নিজে থেকেই একের পর এক সরছে, উল্টেপাল্টে কেউ যেন সেগুলো পড়ছে। ল্যাম্পের আলোয় মুহূর্তে অদ্ভুত এক শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল ঘরের ভেতর।

অরিন্দম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মনে হচ্ছিল যেন হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন ঘরের নীরবতার মধ্যে গর্জন করছে। একে একে তার সব যুক্তি, সব আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ছিল এই দৃশ্যের সামনে। কিন্তু একরোখা স্বভাব তাকে পিছিয়ে আসতে দিল না। সে ধীরে ধীরে কয়েক পা এগোল, চেষ্টা করল সেই ছায়াটিকে স্পষ্টভাবে দেখতে। তখনই সে কানে পেল পদশব্দ—কেউ যেন ঘরের ভেতর হাঁটছে, মেঝের কাঠ চাপা শব্দ করছে স্পষ্টভাবে। অরিন্দম থেমে গেল, তার চোখে ঘাম জমল, গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও সে এগোল, ফিসফিস করে বলল, “কে ওখানে?” কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। কেবল খামের খসখস শব্দ চলতে লাগল, আর পদশব্দ যেন ক্রমশ কাছে আসছে। অরিন্দম মনে করল, হয়তো কেউ ঢুকেছে ডাকঘরে, গ্রামের কোনো দুষ্ট ছেলে বা চোর। সে সাহস জোগাড় করে টেবিলের পাশে রাখা লাঠি তুলে নিল, আর আলোর দিকে পা বাড়াল। কিন্তু আলো স্পষ্ট হওয়ার আগেই সেই ছায়ামূর্তি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সবকিছু—খামের শব্দ, পদশব্দ, সব থেমে গেল এক নিমিষে। টেবিলের উপর খামগুলো তবুও ছড়ানো অবস্থায় রইল, যেন সত্যিই কেউ সেগুলো হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিল।

অরিন্দম দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। তার বুক ধড়ফড় করছে, কপালে ঠাণ্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সে বুঝতে পারছিল না, কী দেখল সে এইমাত্র। চোখের ভুল? নাকি সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি তার চোখের সামনে খামগুলো নেড়ে দিল? বাতাস থেমে আছে, চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা, অথচ তার মনে হচ্ছিল ঘরের কোণায় এখনো কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেরোসিন ল্যাম্পের শিখা দপদপ করে উঠল, আর সেই সঙ্গে অরিন্দম অনুভব করল—তার যুক্তিবাদী মন আর অদৃশ্য রহস্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সে ধীরে ধীরে লাঠিটা নামাল, গলা শুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এটা হতে পারে না… ভূত বলে কিছু নেই।” কিন্তু মনের গভীরে সে জানত—যা চোখে দেখল, তা অস্বীকার করা সহজ নয়। রাত গড়িয়ে যেতে লাগল, তবুও অরিন্দম সেই অদৃশ্য ছায়ার স্মৃতি ভুলতে পারল না। মনে হচ্ছিল, রামলোচনের অসমাপ্ত দায়িত্ব যেন আজও ঘরের প্রতিটি ইটে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর সেই দায়িত্বের অশান্ত আত্মা হয়তো সত্যিই তার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে কিছুক্ষণ আগে।

অধ্যায় ৬ : লুকানো ডায়েরি

সকালের আলোয় ডাকঘরের কাঠের দেওয়ালে এক অদ্ভুত শূন্যতা ছায়া ফেলেছিল। গত রাতের ঘটনার পর অরিন্দমের চোখে ঘুম আসেনি। তার মাথায় বারবার ভেসে উঠছিল ছায়ামূর্তির ছবি, সেই খামের খসখস শব্দ আর পদশব্দ। সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে জানালার বাইরে তাকিয়ে সে স্থির করল—এ রহস্যের মূলে পৌঁছোতে হবে। “যদি সত্যিই কোনো ইতিহাস থেকে থাকে, তবে তার প্রমাণও কোথাও লুকিয়ে থাকবে,” সে নিজেকে বলল। সেই ভেবেই সেদিন সে ডাকঘরের পুরনো কাঠের আলমারির তালা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। আলমারিটা অনেক বছর ধরে খোলা হয়নি, তালায় মরচে ধরেছে, আর দরজার কাঠে পোকায় খাওয়া চিহ্ন। সে কষ্ট করে তালাটা ভাঙল, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে পুরনো কাগজপত্র, ধুলো আর সেঁতসেঁতে গন্ধ বেরিয়ে এল। ফাইলের নিচে চাপা দেওয়া ছিল একটি কালো চামড়ার বাঁধাই খাতা। অরিন্দম সেটি হাতে তুলতেই তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। খাতার মলাটে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা—“রামলোচন দত্ত।” এটি যে ডাকপিয়ন রামলোচনের ডায়েরি, তাতে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

অরিন্দম প্রথম কয়েকটা পাতা উল্টে পড়তে শুরু করল। লেখা ছিল সাধারণ দিনের খুঁটিনাটি দিয়ে শুরু—ডাকপিয়নের জীবন, চিঠি বয়ে নিয়ে যাওয়া, মানুষের খবর পৌঁছে দেওয়ার আনন্দ। কিন্তু কয়েক পাতা পর হঠাৎই ডায়েরির ভাষা বদলে গেল। সেখানে লেখা ছিল—“দেশ যখন অগ্নিগর্ভ, তখন ডাকও হয়ে উঠেছে লড়াইয়ের হাতিয়ার। আমি ঠিক করেছি, আমার হাতে দেওয়া চিঠিগুলো কেবল ভালোবাসার খবর নয়, স্বাধীনতার বার্তাও বহন করবে।” অরিন্দমের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। সে আরও পড়ল—“কিছু খামের ভেতর আমি নেতাদের গোপন বার্তা গুঁজে দিই। এগুলো ব্রিটিশ পুলিশ যেন না পায়, তাই প্রতিদিন ভয় নিয়ে কাজ করি। জানি, ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য।” পাতার পর পাতা জুড়ে রামলোচনের নিজের ভয়, সাহস আর দায়িত্বের কথা লেখা। এক জায়গায় লেখা ছিল—“আমার মৃত্যু যদি হয়, তবুও আমার আত্মা থামবে না। আমি যে বার্তা বহন করি, তা আমার শরীরের চেয়ে বড়।” অরিন্দম পড়তে পড়তে থেমে গেল। কাগজে কালি মুছে যাওয়া, কখনও রক্তের দাগের মতো দাগ দেখা যাচ্ছিল। যেন এই ডায়েরি এক নিঃশব্দ সাক্ষী, স্বাধীনতার আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের।

ডায়েরির শেষের দিকের পাতাগুলো আরও শিহরণ জাগানো। সেখানে রামলোচন লিখেছিল—“আজকাল টের পাচ্ছি কেউ আমাকে নজর রাখছে। ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচররা হয়তো জেনে ফেলেছে আমি কী করছি। কাল যদি ফিরতে না পারি, তবে বুঝবে সত্যিই তারা আমায় শেষ করে দিয়েছে।” শেষ পাতায় কেবল কয়েকটি শব্দ লেখা—“চিঠির খামে লুকোনো বার্তা পৌঁছোতে হবে। যদি আমি না পারি, তবে হয়তো আমার আত্মা নিজেই তা বহন করবে।” অরিন্দমের শরীর কেঁপে উঠল। সে গত কয়েক রাতের ঘটনা মনে করল—চিঠির খাম নড়ছে, পদশব্দ ভেসে আসছে, ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকছে। এগুলো কি নিছক অলৌকিক খেলা? নাকি সত্যিই রামলোচনের আত্মা তার অসমাপ্ত দায়িত্ব পালন করতে ফিরে এসেছে? আলমারির ভেতর থেকে ডায়েরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অরিন্দমের বুকের ভেতর যেন এক ভয়ানক টান তৈরি হলো। সে বুঝল, এখন আর কেবল গুজব নয়, সত্যিই ইতিহাসের এক গোপন অধ্যায়ের মুখোমুখি সে দাঁড়িয়ে গেছে। ডাকঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা পুরনো ঘড়ি তখন টিকটিক করে বাজছিল, যেন প্রতিটি সেকেন্ডে রামলোচনের অসমাপ্ত যাত্রার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। অরিন্দম ধীরে ধীরে ডায়েরি বুকের কাছে চেপে ধরল, আর মনে মনে বলল—“আমি সত্যটা খুঁজে বের করব, যেভাবেই হোক।”

অধ্যায় ৭ : ষড়যন্ত্রের ছায়া

ডায়েরির পাতাগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, যেন সে হঠাৎই ইতিহাসের এক অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করেছে। যতই পড়ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল—রামলোচনের মৃত্যু কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়। সেদিন রাতে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল, তার পেছনে ছিল এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ডায়েরির শেষ কয়েকটি পাতায় রামলোচন লিখেছিল—“কিছু খাম ঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি। কারো হাতেই এগুলো আটকে গেছে।” এই কথাটাই অরিন্দমকে ভীষণ নাড়া দিল। সে বুঝল, এমন কেউ ছিল, যে কেবল ব্রিটিশদের পক্ষেই নয়, গ্রাম ও ডাকঘরের ভেতর থেকেও রামলোচনের কাজকে বাধা দিচ্ছিল। হয়তো সেই বিশ্বাসঘাতকের হাতেই শেষমেশ রামলোচনের মৃত্যু হয়েছিল। অরিন্দম এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সব কল্পনা করল—এক তরুণ ডাকপিয়ন, বুকের ভেতর স্বাধীনতার আগুন, প্রতিদিন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে খামের ভেতরে গোপন বার্তা বহন করছে। আর হঠাৎই তার পাশে থাকা কেউ, যে হয়তো বন্ধু সেজেছিল, তার জীবনটা ছিনিয়ে নিলো। অরিন্দমের মনে প্রশ্ন জাগল—কে সেই বিশ্বাসঘাতক? ডায়েরিতে নাম লেখা নেই, কিন্তু অস্পষ্ট কিছু চিহ্ন আছে—কোনো নামের আদ্যক্ষর, কিংবা কিছু ভাঙা বাক্য। সেই সূত্রগুলো একরকম ধাঁধার মতো ছড়িয়ে আছে পাতার ভাঁজে।

রাত গভীর হতে লাগল, আর অরিন্দমের মন যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল রামলোচনের ছায়া—যেন কোনো অদৃশ্য কণ্ঠ ফিসফিস করে বলছে, “আমার মৃত্যু বৃথা যায়নি, সত্যটা খুঁজে বের করো।” অরিন্দম খেয়াল করল, ডায়েরির অনেক জায়গায় হঠাৎ করে লেখা থেমে গেছে। কলমের কালি মাখামাখি, আঁকাবাঁকা দাগ টানা, যেন আতঙ্কের মুহূর্তে লেখা। এক জায়গায় স্পষ্ট দেখা গেল—“আজ বুঝলাম, মৃত্যুই আমার অপেক্ষায় আছে। কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। আমি চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছি… যদি পৌঁছোতে না পারে…” এখানেই লেখা থেমে গেছে। অরিন্দম ডায়েরির পাতার গন্ধ শুঁকলো, মনে হলো কাগজে এখনো রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে। তার শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত বইল। তাহলে কি সেই অদৃশ্য শক্তি—যা প্রতি রাতে ডাকঘরে খামগুলো নেড়ে দেয়—আসলে রামলোচনের আত্মা, যে তার অসমাপ্ত কাজের ভার বইছে? আর যে খামগুলো পৌঁছোয়নি, সেগুলোর ভেতরে কি এমন কোনো বার্তা ছিল, যা দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারত? এই প্রশ্নগুলো একের পর এক তার মনের ভেতর ঝড় তুলতে লাগল।

অরিন্দম জানত, এখন আর ফিরে আসার উপায় নেই। একবার এই রহস্যে পা রাখলে তাকে শেষ পর্যন্ত যেতেই হবে। মিতালীর সতর্কবাণী, শশধরের গল্প, আর গ্রামের ভয়ভীতি—সব এখন তার কাছে যুক্ত হয়ে গেল এক সত্য অনুসন্ধানের বাঁকে। সে টেবিলে বসে ডায়েরির ভাঁজকরা পাতাগুলো সমান করতে লাগল, প্রতিটি অক্ষর মনোযোগ দিয়ে পড়ল। সেখানে একটি লাইনে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল—“বি… ম…”। বাকিটা কলম থেমে গেছে। অরিন্দম বারবার শব্দটা পড়তে লাগল, মনে মনে নাম খুঁজতে লাগল—এ কার প্রতি ইঙ্গিত? কে সেই ষড়যন্ত্রকারী, যার হাতে থেমে গিয়েছিল স্বাধীনতার এক অজানা অধ্যায়? হঠাৎ বাইরে ঝড়ো হাওয়া উঠল, জানলার পাল্লা ঠকঠক করে বাজতে লাগল। ল্যাম্পের শিখা দপদপ করে নিভে যেতে চাইল। আর সেই অন্ধকারের ভেতর অরিন্দমের মনে হলো, যেন কেউ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল—“সত্য এখনো লুকিয়ে আছে খামের ভেতর…”। তার বুক কেঁপে উঠল, কপালে ঠাণ্ডা ঘাম জমল। তবুও চোখে এক অদম্য জেদ ঝলসে উঠল। সে দাঁত চেপে বলল, “আমি খুঁজে বের করব কে তোমাকে মেরেছিল, রামলোচন। সত্য লুকোনো যাবে না।” আর সেই মুহূর্তে অরিন্দম বুঝল—সে কেবল ইতিহাসের পাঠ পড়ছে না, সে জড়িয়ে পড়েছে এক অসমাপ্ত লড়াইয়ে, যেখানে অতীতের রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র আজও ছায়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে ডাকঘরের প্রতিটি দেওয়ালে।

অধ্যায় ৮ : অশরীরীর দাবি

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। ডাকঘরের ভেতর তখন নিস্তব্ধতা জমে উঠেছে কুয়াশার মতো। অরিন্দম একা বসেছিল পুরোনো কাঠের টেবিলে, কেরোসিনের আলো মিটমিট করছিল। বাইরের হাওয়া জানালার কাঁচে অদ্ভুত শব্দ তুলছিল, যেন কে আঁচড়ে যাচ্ছে। হঠাৎই সেই শব্দের ফাঁক গলে তার কানে ভেসে এলো এক ক্ষীণ, কিন্তু গভীর অনুরোধমাখা কণ্ঠ—“আমার শেষ চিঠি পৌঁছে দাও।” প্রথমে অরিন্দম ভেবেছিল, হয়তো বাইরে কোনো মাতাল বা ভিখিরি চিৎকার করছে। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা এত কাছে, এত স্পষ্ট ছিল যে মনে হলো যেন ঘরের ভেতরেই কারো অদৃশ্য ঠোঁট নড়ছে। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল, হাত কাঁপতে শুরু করল। চারদিকে তাকিয়ে সে কোনো মানুষকে দেখতে পেল না, কেবল টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য চিঠি আর খামগুলো। ঠিক তখনই এক ঝটকা হাওয়ায় খামগুলো মেঝেতে উড়ে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হলো যেন কোনো অদৃশ্য হাত ইচ্ছে করেই সেগুলো ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ অরিন্দমের চোখে পড়ল—একটা খামের কিনারা অন্যগুলোর থেকে আলাদা, যেন অন্ধকারের মধ্যেও নিজে থেকে একটু ঝিলমিল করছে। গলার স্বর আবার ভেসে এলো, আরও চাপা, আরও মরিয়া—“আমার শেষ চিঠি পৌঁছে দাও।” অরিন্দমের গলা শুকিয়ে গেল, তবুও বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শক্তি তাকে ঠেলে দিল সামনে। ভয় যতই পাক খাচ্ছিল, তার ডাকপিয়নের দায়িত্ববোধ আরও দৃঢ় হচ্ছিল। সে ঝুঁকে মেঝে থেকে খামগুলো একে একে তুলতে শুরু করল, কিন্তু সেই বিশেষ খামটা যেন লুকিয়ে পড়েছে, অন্যদের মধ্যে নিজেকে আড়াল করেছে। প্রতিটি খাম হাতে নিয়ে অরিন্দম চেষ্টা করছিল অক্ষরগুলো পড়তে, কিন্তু আলোর অভাবে বেশিরভাগই অস্পষ্ট। এদিকে ভেতরে এক অচেনা ঠান্ডা হাওয়া ঘুরছিল, যেন অশরীরী উপস্থিতি প্রতিটি শ্বাসে মিলেমিশে গেছে।

অরিন্দমের কপাল দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, অথচ বাইরের শীতল রাতের হাওয়ায় শরীর কাঁপছিল না, বরং হাড় পর্যন্ত ঠান্ডা পৌঁছে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কেউ যেন ঠিক তার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে, আবার ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মেঝেতে ছড়ানো খামগুলো একে একে হাতের মুঠোয় তোলার সময় হঠাৎ একটার স্পর্শে তার শরীর বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল। সেই খামের ওপর নাম লেখা—“শচীন পাল”। হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যেন কেউ কানে ফিসফিস করে বলছে—“ঠিক এটাকেই খুঁজছিলাম।” কণ্ঠস্বরটা এত কাছে, এত ঠান্ডা যে অরিন্দম তাড়াহুড়ো করে পিছন ফিরে তাকাল, অথচ ঘরে কেউ নেই। তবু তার বুকের ভেতর যেন এক অদৃশ্য দৃষ্টি গেঁথে আছে। খামটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অরিন্দম টেবিলে বসল। চিঠিটা কাকে লেখা আর কোথায় পৌঁছতে হবে, সেটা পড়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু খামের ওপর ঠিকানাটা আধখাওয়া, কালি ফিকে হয়ে গেছে, শুধু নামটাই স্পষ্ট—একজন বিধবা মহিলার কাছে পাঠানো বলে মনে হলো। প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল তার মাথায়—কে এই শচীন পাল? কেন এত মরিয়া হয়ে কেউ এই চিঠি পৌঁছে দিতে চাইছে? চিঠিটার ভেতরে কী এমন আছে, যা এক মৃত মানুষের আত্মাকেও শান্তি দেয়নি? হঠাৎ কেরোসিনের আলো দপদপ করে নিভে গেল। পুরো ঘর ডুবে গেল অন্ধকারে। অরিন্দমের বুকের ভেতর তখন বেজে উঠছে সেই একই কণ্ঠস্বর, এবার আরও শীতল, আরও স্পষ্ট—“আমাকে মুক্তি দাও, চিঠিটা পৌঁছে দাও।” মনে হলো শব্দগুলো টেবিলের কাঠ ফুঁড়ে উঠছে, মেঝের ধুলো নড়ে উঠছে, আর অরিন্দমকে ঘিরে অদৃশ্য কোনো বলয় তৈরি করছে।

 

কিন্তু অরিন্দম এবার আর ভয়কে প্রশ্রয় দিল না। ডাকপিয়নের জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা সে সামলেছে—জলপ্লাবিত রাস্তা, ডাকাতি, এমনকি মড়ার গন্ধ লেগে থাকা জনপদেও চিঠি পৌঁছে দিয়েছে। আজকের ভয়টা অন্য রকম হলেও ভেতরে যেন তার কর্তব্যের আগুন জ্বলে উঠল। সে খামটাকে বুকের পকেটে রাখল, ঠিক করল সকাল হতেই যেই হোক না কেন, গন্তব্য খুঁজে বের করে শেষ চিঠি পৌঁছে দেবে। তখনই চারপাশে ভৌতিক পরিবেশে যেন সামান্য বদল এলো—আলো না থাকলেও অন্ধকার আর গুমোট লাগছিল না, কণ্ঠস্বরও মিলিয়ে গেল হঠাৎ, কেবল বাইরে দূরে কুকুরের হাউহাউ শোনা যাচ্ছিল। তবু ভেতরে রয়ে গেল একটা চাপা ভয়—যদি ঠিকানা খুঁজে না পাওয়া যায়? যদি এই কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়? তবে কি অশরীরীর দাবি আরও বেড়ে উঠবে? এই প্রশ্নগুলো তাকে একদিকে শিউরে তুলল, অন্যদিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা দিল। জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম হাওয়া ঢুকছিল, মনে হচ্ছিল রাতের অশরীরী উপস্থিতি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু অরিন্দম জানত—এই রহস্য এখনো শেষ হয়নি। খামটা যেন তার হাতে নয়, বরং তার ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক গুরুতর দায়। ডাকঘরের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট ধরাল, ধোঁয়া পাক খেয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। তার মনে হলো—আজ থেকে তার যাত্রা আর শুধু সাধারণ ডাকপিয়নের নয়, বরং এক অশরীরীর শান্তির সন্ধানে বেরোনো এক অদ্ভুত যাত্রা। ভয়, কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ মিশে গিয়ে তাকে নতুন এক দিশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর সে জানে, যেভাবেই হোক, সেই শেষ চিঠি পৌঁছানোই হবে তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

অধ্যায় ৯ : সত্যের উদ্ঘাটন

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই অরিন্দম বুঝতে পারল যে সে একা এই রহস্য মেটাতে পারবে না। তাই সে ছুটে গেল মিতালীর কাছে—যে শুধু তার সহকর্মী নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে তার সবচেয়ে ভরসার জায়গা। মিতালী ডাকঘরের পুরোনো খাতাপত্রে হাত পাকানো, প্রতিটি নাম, প্রতিটি তারিখ, প্রতিটি ভুলে যাওয়া খামের খুঁটিনাটি সে মনে রাখতে পারে। অরিন্দম যখন ভেজা চোখে আর ক্লান্ত গলায় তাকে সব শোনাল, মিতালী কোনো বিস্ময় প্রকাশ করল না। বরং গম্ভীরভাবে বলল, “চলো, আর্কাইভ ঘরে খুঁজে দেখি। অনেক সময় এমন খাম কোথাও আটকে পড়ে যায়।” তারা মিলে ধুলোমাখা আলমারি টেনে বের করল, পুরোনো কাগজের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। প্রতিটি খাম উল্টেপাল্টে দেখা হলো, প্রতিটি ফাইল খোলা হলো, আর ঠিক তখনই মিতালীর সূক্ষ্ম চোখ খুঁজে পেল এক অদ্ভুত চিহ্ন—একটি সাদামাটা খামের ভাঁজে লাল কালি দিয়ে আঁকা এক ক্ষুদ্র চিহ্ন, যা অন্যদের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে আলাদা। অরিন্দম যখন সেটি হাতে নিল, বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, যেন খামের মধ্যে নিদ্রিত ইতিহাস তার মুঠোয় ধরা পড়েছে। খামের ওপরে লেখা নাম ছিল ঠিক সেই—“শচীন পাল।” মিতালী বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “এ নাম তো আমাদের এলাকায় নেই। তবে কি কোনো ছদ্মনাম?” অরিন্দম মাথা নাড়ল, বলল, “না, এটা অন্য কিছু। খামের ভেতরে হয়তো সব উত্তর লুকিয়ে আছে।”

তারা সাবধানে খাম খুলল, ভিতরে পাওয়া গেল হলুদ হয়ে যাওয়া এক চিঠি। প্রথম দৃষ্টিতে চিঠিটা ছিল সাধারণ, কয়েকটি পারিবারিক খোঁজখবরের বাক্য। কিন্তু মিতালী বলল, “দেখো, অক্ষরগুলোর মধ্যে কিছু অদ্ভুত ছাঁদ আছে।” চিঠিটা আলোর দিকে ধরতেই ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো এক গোপন বার্তা—প্রতিটি দ্বিতীয় শব্দের প্রথম অক্ষর জোড়া লাগালে তৈরি হচ্ছিল এক সাংকেতিক বাক্য। মিতালী শব্দগুলো পড়তে শুরু করল, আর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো যে এটি আসলে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর গোপন বার্তা, যেখানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গুপ্ত বিদ্রোহের পরিকল্পনার দিশা দেওয়া হয়েছিল। চিঠির শেষে স্পষ্ট লেখা ছিল—“যদি আমি না বাঁচি, এ বার্তা পৌঁছে দিও আমার দেশের ভাইদের কাছে।” অরিন্দম আর মিতালী দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। এখন বোঝা গেল কেন এই খাম এতদিন ধরে অশরীরীর দাবি হয়ে ঘুরছিল, কেন রামলোচনের মৃত্যু ঘটেছিল। রামলোচন, যে সৎভাবে চিঠি পৌঁছে দিতে চাইছিল, সে আসলে এই গোপন বার্তার ফাঁদে পড়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা হয়তো ইংরেজদের দালাল, যারা এই বার্তা কখনো পৌঁছতে দিতে চায়নি। তাই তারা রামলোচনকে আটকেছিল, এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। অরিন্দমের মাথার ভেতর সেই রাতের ভৌতিক কণ্ঠ আবার প্রতিধ্বনিত হলো—“আমার শেষ চিঠি পৌঁছে দাও।” এখন সে জানে, এটি কেবল অশরীরীর আর্তি নয়, বরং এক ইতিহাসের অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি, এক শহিদের অসমাপ্ত দায়িত্ব।

 

অরিন্দম খামটা বুকের কাছে চেপে ধরল, চোখে জল এসে গেল। মনে হলো, সে শুধু একটি চিঠি হাতে নেয়নি, বরং এক বিস্মৃত ইতিহাসের সাক্ষ্য ধরে রেখেছে। মিতালীও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমাদের এখনো দেরি করা চলবে না। যারা রামলোচনকে হত্যা করেছিল, তারা নিশ্চয়ই এখনও সক্রিয়। এই সত্য ফাঁস হলে তাদের মুখোশ খুলে যাবে।” দু’জনেই ঠিক করল, তারা প্রমাণসহ কমিশনারের কাছে যাবে। কিন্তু তার আগে অরিন্দম মনে মনে শপথ নিল—চিঠিটা যাদের কাছে পৌঁছনোর কথা, সেখানে একবার হলেও পৌঁছে দেবে। ডাকপিয়নের জীবনে যত দায়িত্বই আসুক, এ দায়িত্ব তার কাছে সবচেয়ে পবিত্র। বাইরে তখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেই আলোয় যেন লুকিয়ে আছে অন্ধকারের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি। অরিন্দম অনুভব করল—এই মুহূর্ত থেকে সে শুধু ডাকপিয়ন নয়, ইতিহাসের এক সাক্ষী, যে একজন অশরীরীর দাবিকে পূর্ণতা দিতে চলেছে। আর মিতালীর চোখে ভাসছিল দৃঢ়তা, যেন সে বুঝে গেছে তাদের দু’জনের পথ এখন আর আলাদা নয়। ডাকঘরের নীরব ঘরে, কাগজের গন্ধে আর ইতিহাসের ভারে তারা দু’জনেই প্রতিজ্ঞা করল—সত্যকে প্রকাশ করবেই, যেভাবেই হোক। সত্যিই, “অশরীরীর দাবি” এখন আর শুধু ভূতের ফিসফিস নয়, বরং এক জাতির রক্তমাখা ইতিহাসের প্রতিধ্বনি।

অধ্যায় ১০ : আত্মার মুক্তি

সকালবেলা গ্রামের রাস্তাটা যেন অস্বাভাবিক নীরবতায় মোড়া ছিল। অরিন্দম চিঠিটা সযত্নে সাদা কাপড়ে মুড়ে বুকের কাছে ধরে হাঁটছিল। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক অদৃশ্য দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে—এক ভরসা, এক প্রত্যাশা। মিতালী তার পাশে ছিল, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তারা দু’জনে সেই বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, যেটা গ্রামের সীমানার বাইরে, এক পুরনো সংগ্রাহক পরিবারের শেষ ঠিকানা। অনেকেই ভেবেছিল সেই পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামের প্রবীণদের মুখে শোনা গিয়েছিল যে তাদের বংশধরেরা এখনও বেঁচে আছে। বাড়িটার দরজা ধাক্কা দিতে মুহূর্তের জন্য অরিন্দমের হাত কেঁপে উঠল, কিন্তু ভিতর থেকে ভেজা চোখে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দিলেন। তার চোখে অবাক দৃষ্টি, যেন সে আগেই বুঝে গিয়েছিল কেউ একদিন এ বার্তা নিয়ে আসবে। অরিন্দম চুপচাপ খামটা তার হাতে দিল। বৃদ্ধার হাত কাঁপছিল, ঠোঁট কাঁপছিল, সে বিড়বিড় করে বলল, “এটাই সেই চিঠি… যেটার অপেক্ষায় আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেটেছি।” মুহূর্তেই বাড়ির ভেতর যেন এক চাপা কান্নার ধ্বনি ভেসে এল। মনে হলো, অরিন্দম শুধু একটি পরিবারের কাছে চিঠি পৌঁছে দিল না, সে যেন সময়ের বুক চিরে ইতিহাসের অসম্পূর্ণ দায় শোধ করল।

চিঠি হাতে নিয়ে বৃদ্ধা ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে অরিন্দম আর মিতালী এক অদ্ভুত আবহ অনুভব করল। আকাশ মেঘলা হয়ে গেল, বাতাসে হঠাৎ ঠাণ্ডা শীতলতা নেমে এল। গ্রামের মানুষ, যারা দূর থেকে কৌতূহল নিয়ে সব দেখছিল, তারাও বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। হঠাৎই ডাকঘরের দিক থেকে এক অদ্ভুত আলো আকাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অরিন্দম ঘুরে দেখল, ডাকঘরের জানালা দিয়ে ভেসে উঠছে উজ্জ্বল সোনালি আভা, যেন ভেতরে আগুন জ্বলছে অথচ তাতে কোনো ভয় নেই। গ্রামের শিশুরা ভয় পেয়ে মায়েদের আঁকড়ে ধরল, আর বয়স্করা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা শুরু করল। সেই আলোর ভেতরে যেন দেখা গেল এক ক্ষীণ ছায়া—ডাকপিয়ন রামলোচনের রূপ, হাতে চিঠির ঝোলা, মুখে প্রশান্তির হাসি। তার চোখে আর যন্ত্রণা নেই, বরং এক অনন্ত শান্তির ছাপ। ধীরে ধীরে সেই ছায়া মিলিয়ে গেল, আর আলো আস্তে আস্তে নিভে গিয়ে পুরো গ্রাম আবার স্বাভাবিক আলোয় ঢেকে গেল। ডাকঘরের দেয়াল, যেগুলো এতদিন ভয় আর কুসংস্কারের প্রতীক ছিল, হঠাৎ করেই যেন প্রাণ ফিরে পেল। আর কোনো খামের নড়াচড়া নেই, আর কোনো রাতের পায়ের শব্দ নেই—শুধু নীরব শান্তি। অরিন্দম বুঝল, দায়িত্ব শেষ হয়েছে। রামলোচন অবশেষে মুক্তি পেয়েছে, তার আত্মা আর আটকে নেই অসম্পূর্ণতার শৃঙ্খলে।

পরদিন ভোরে ডাকঘর খুলতেই গ্রামবাসী অবাক হয়ে দেখল—সবকিছু কতটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগের মতো খামগুলো গুছিয়ে রাখা, বাতাসে আর কোনো অদ্ভুত শব্দ নেই। মনে হলো যেন ডাকঘর নতুন প্রাণ পেয়েছে। গ্রামের মানুষ একে একে এসে অরিন্দমকে ধন্যবাদ জানাতে লাগল। কেউ বলল, “আপনি শুধু ডাকঘরকে নয়, আমাদের মনকেও মুক্তি দিয়েছেন।” আবার কেউ কেউ অশ্রুসিক্ত চোখে ফিসফিস করে বলল, “রামলোচন এবার শান্তিতে ঘুমোবে।” অরিন্দম কিছু বলল না, শুধু দূরের আকাশের দিকে তাকাল, যেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে নীরব কথা বলছে। মিতালী পাশে এসে ধীরে বলল, “তুমি প্রমাণ করেছ, সাহস আর সততা সবসময়ই অন্ধকারের ওপর জয়লাভ করে।” অরিন্দম হেসে উত্তর দিল, “এটা আমার কাজ নয়, এটা ছিল রামলোচনের কাজ—আমি শুধু তার শেষ দায়িত্বটা শেষ করেছি।” সেই মুহূর্তে ডাকঘর আর ভূতের কাহিনি নয়, বরং ত্যাগ আর দায়িত্ববোধের প্রতীক হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষ আর কখনো কুসংস্কারে ভয় পাবে না, কারণ তারা দেখেছে—সত্যের আলো অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে। আর অরিন্দম? তার চোখে ভেসে উঠল নতুন দৃঢ়তা—সে জানত, যতদিন বাঁচবে, ডাকপিয়নের মতো দায়িত্বকে অটল বিশ্বাসের সঙ্গে পালন করে যাবে। ইতিহাসের এক অসমাপ্ত অধ্যায় অবশেষে শেষ হলো, আর ডাকঘরের গায়ে খোদাই হয়ে রইল এক বার্তা—“সত্যই মুক্তি দেয়, আর দায়িত্বই আত্মাকে শান্তি দেয়।”

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *