অধ্যায় ১: চিঠির মতো নিঃশব্দ
পাহাড়ে ওঠার পথে হঠাৎ করে কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ট্রেকিং পাথ বেয়ে যে ঘোড়ামারা ডাকে ওঠা গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল অভিজিৎ সরকার, তার চারপাশে যেন হঠাৎই সময় থমকে গেল। বালির কাঁধে বয়ে আনা ছোট স্যুটকেস, একটা জলচৌকো ব্যাগ আর হাতে ধরা সরকারি ফাইলের খাম—সবই ভার হয়ে উঠল যেন হঠাৎ। এই ডাকঘরটা, পুরুলিয়ার এক পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তে অবস্থিত, বহু বছর আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে রেকর্ডে লেখা ছিল। কিন্তু হেড অফিস থেকে অদ্ভুত এক চিঠির সূত্র ধরে, তাকে বদলি করা হল এই ‘বন্ধ’ ডাকঘরে। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ফাইলের গরমিল, অথবা ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু বদলিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন ডি.জি. (Director General) নিজে, যাঁর নামটিও সে কখনো শোনেনি। খাড়া পাহাড়ি পথ, মেঘে ঢাকা আকাশ, আর একটি সম্পূর্ণ জনমানবহীন ডাকঘর—এই সব কিছু নিয়ে তার মনে উদ্ভব হল এক অদ্ভুত অনুভূতি। পাহাড়ের কোলে কাঠের খোপখোপ জানালার এক তেঁতো গন্ধমাখা ভবন, তার উপর লাগানো চুনের প্রলেপ উঠে গিয়ে ধূসর হয়েছে, তবে আশ্চর্যভাবে তালা খোলা। দরজায় এক জংধরা তক্তি—”ঘোড়ামারা ডাকঘর – স্থাপিত: ১৮৭২”। প্রথম পা রাখার মুহূর্তেই, চায়ের স্টলে না পাওয়া এক অব্যক্ত স্বাদের মতো, তার গায়ে ঠেকে গেল কোনও এক অদৃশ্য ইতিহাসের হাত।
ঘরের ভেতরে অন্ধকার, কিন্তু রোদের উঁকি গলে ঢুকে যায় জানালার ফাঁক দিয়ে। অভিজিৎ ধুলো মুছে চেয়ার বসায়, আলমারির তালা খোলে, কিছু পুরোনো রেজিস্টার খাতা খুঁজে পায়, যেগুলোর শেষ এন্ট্রি ১৯৮৯ সালের। টেবিলের উপর একটা ঘড়ি, যা বছর কুড়ি থেমে আছে ১০টা ৪৭ মিনিটে। অথচ ঠিক তখনই বাইরে ঘণ্টার মত শব্দ হয়—টাং করে একবার। সে তাকিয়ে দেখে, কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু হালকা দুলছে পুবের জানালার কাঁচ। সে ভাবল, পাহাড়ে এমন হয়—আবহাওয়ার দাপটে শব্দও ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু এরপর সে দেখতে পেল কিছুকিছু চিঠি, টেবিলের এক কোণে স্তুপাকারে পড়ে আছে। আশ্চর্যজনক ভাবে সব ক’টা চিঠির উপরেই তাজা সিল আছে—ডাক সিল। আর সেগুলোর কোনোটির তারিখ ১৯৪৭, কোনোটির ২০২৭, আবার একটি চিঠিতে লেখা ১৮৯১! সময় যেন এই ঘরের মধ্যে ঢুকে থেমে গেছে, এবং ধীরে ধীরে নিজের ছায়া ফেলছে প্রত্যেক কাগজে। চিঠিগুলোর কিছু নামপত্রহীন, কিছুতে লেখা “প্রাপক: পূর্বসূরি”। এমনকি একটি চিঠিতে প্রেরকের নাম ছিল—“ভবিষ্যতের তুমি”। ঘরের মাঝে টেবিলটিতে বসে থাকতে থাকতে অভিজিৎ নিজের পেছনে হঠাৎ একটা শীতল নিশ্বাসের শব্দ টের পেল, ফিরে তাকিয়েও কিছু দেখতে পেল না, শুধু চেয়ারে রাখা নিজের নাম লেখা আইডি কার্ডটা পড়েছিল মেঝেতে।
রাত বাড়তে থাকে। বাইরে পাহাড়ের কুয়াশা ঘন হয়ে এলেও ডাকঘরের ভিতর ঠিক যেন স্থির থাকে বাতাস, কেমন একটা নিঃশব্দ স্পন্দন বয়ে যায় দেয়ালজুড়ে। অভিজিৎ সেই চিঠিগুলোর মধ্যে নিজের বাবার নাম খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখতে পেল একটি খাম—হাতে লেখা তার বাবার পরিচিত অক্ষরে। তার বাবাও ছিলেন পোস্টমাস্টার, এবং আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, আচমকাই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক এই পাহাড়ি অঞ্চলেই কোনও সফরে এসে। সেই চিঠির ভিতরে লেখা ছিল—”যদি কখনো ঘোড়ামারায় পা রাখিস, জানবি সবকিছুর শুরু এই ঘরেই। কেউ একসময় এসে চিঠিগুলো পোস্ট করত, কিন্তু তা কেবল জীবিতদের জন্য নয়। তুই যদি পাস চিঠিগুলো, বুঝে নিস, এখনও সময় আছে থামানোর।”—তার হাত কাঁপতে থাকে। একই সঙ্গে বাইরে আবার সেই ঘণ্টার শব্দ—টাং! দরজা খোলে, আর সেখানে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি—দীর্ঘজীবী, ধুতি আর অলৌকিক মুখে রহস্যভরা দৃষ্টি। সেই ব্যক্তির গলায় লাল পাড়ের উত্তরীয়, হাতে ধরা একটি চিঠির প্যাকেট, আর ঠোঁটে এক অদ্ভুত, যেন পূর্বজন্ম থেকে উঠে আসা হাসি। “তুমি অবশেষে এসেছো,” সে বলল ধীরে, “চিঠিগুলো আবার বাঁচতে চাইছে।” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করতে চাইল—“আপনি কে?” কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, বাতাস থেমে যায়, আর ছায়ামূর্তিটি দরজার আড়ালে মিলিয়ে যায়। অভিজিৎ বুঝতে পারে, ডাকঘরের দরজার ভিতর সে যা পেয়েছে, তা কেবল চিঠি নয়—এ এক নিষিদ্ধ পাণ্ডুলিপি, যেখানে লেখা আছে সময়ের গোপন চুক্তি।
অধ্যায় ২: সময়ের বাইরে থেকে
পরদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল, অথচ তাতে কোনো উষ্ণতা ছিল না। পাহাড়ি হাওয়ার ঠাণ্ডা আর কুয়াশার কাঁপুনি জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকছিল, অথচ অভিজিৎ এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল সেই টেবিলের সামনে যেখানে আগের রাতের চিঠিগুলো রাখা ছিল। ঘড়িটা এখনও থেমে আছে ১০টা ৪৭ মিনিটে। কিন্তু আজ একটা নতুন জিনিস নজরে এলো—মেঝেতে রাখা পিঁপড়ে চলার সরু লাইন গিয়ে শেষ হয়েছে পোস্টবক্সের নিচে, এবং পোস্টবক্সের ফাঁক দিয়ে ঢোকানো হয়েছে একটি খাম। অবাক হয়ে খামটি হাতে তুলে দেখে, সেটিতে প্রেরকের নাম লেখা নেই, ঠিকানাও নেই—শুধু লেখা আছে “হয়তো কাল।” খামের ভেতরে বেরোল একটি পাণ্ডুলিপি সদৃশ পত্র—হাতে লেখা নয়, যেন প্রাচীন ছাপার অক্ষরে ছাপা—তাতে লেখা, “এই ডাকঘর সময়ের বাহিরে নির্মিত এক কেন্দ্রবিন্দু। এখানে শুধু প্রেরক বা প্রাপক নেই, আছে অনুরোধ ও প্রতিফলনের সম্পর্ক। যার যেটুকু লেখা বাকি, সে তার বাকি কথাগুলো এখানে পাঠিয়ে যায়।” নিচে একটি স্বাক্ষর—”রুদ্রপ্রতাপ, প্রেরণাধিকারিক।”
সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে হঠাৎ ছায়ার মতন এক দোলন দেখতে পেল অভিজিৎ। দ্রুত বাইরে বেরিয়ে দেখে যে দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি—লম্বা, কালো ধুতি ও কাঁধে উত্তরীয় পরা, তার চোখে যেন সময় জমাট বেঁধে আছে। সে এগিয়ে এসে বলে, “আমি এখানকার চিঠির মূল বাহক। নাম রুদ্রপ্রতাপ, তবে কালের সীমানা পেরিয়ে আমি নিজেকে শুধু ‘পাঠক’ বলি।” অভিজিৎ তাকে প্রশ্ন করে, “এখানে এসব চিঠি আসে কোথা থেকে?” রুদ্রপ্রতাপ জবাব দেয়, “যারা জীবনে কথা শেষ করতে পারেনি, যারা ভালোবাসা প্রকাশের আগেই মারা গেছে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থেকেও সন্তানকে জানাতে পারেনি নিজের ইচ্ছা—তাদের অনুরোধ এখানে চিঠি হয়ে ফিরে আসে।” সে জানায়, ডাকঘরের পুরোনো দেওয়ালে আঁকা যে যন্ত্রচক্র রয়েছে, সেটি আসলে এক তান্ত্রিক চক্র যার মাধ্যমে সময় ছিদ্র হয়ে যায়। অভিজিৎ বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ বলে, “তোমার বাবার চিঠি তুমি পেয়েছো, তাই না?”
আচমকা সবকিছু যেন নিঃশব্দে থেমে যায়। পাহাড়ের হাওয়ার শব্দ বন্ধ হয়ে যায়, দূরের ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে যায়, এমনকি নিজের দম নেওয়ার আওয়াজটাও অনুচ্চ হয়ে আসে। রুদ্রপ্রতাপ বলে, “তুমি যদি চাও, এই ডাকঘর আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। তবে সেই সঙ্গে জেগে উঠবে তাদের যন্ত্রণাও—যারা এখনও কথা বলতে চায়।” সে উঠে দাঁড়িয়ে পোস্টবক্সের পাশে রাখা একটি খাম বের করে দেয়—চিঠির উপর লেখা, “আগামীকাল, তোমার নামের শেষ চিঠি।” অভিজিৎ সে চিঠি হাতে নিয়ে দেখে, ভিতরে শুধু একটা লাইন: “যদি তুমি না ঠেকাও, সময় হয়ে যাবে পূর্বনির্ধারিত।” বাইরে মেঘ জমছে, কিন্তু সেই মেঘে যেন মানুষের মুখ—হাজার চিঠির ভাষাহীন চিৎকার ভেসে বেড়াচ্ছে। তখনও সে জানে না, সামনে কী অপেক্ষা করছে—শুধু অনুভব করে, পাহাড়ের নির্জনতায় ডাকঘরের দেওয়ালের ভিতর এক অদৃশ্য তন্ত্রচক্র শুরু হয়ে গেছে।
অধ্যায় ৩: তান্ত্রিকের প্রথম দর্শন
রাত তখন গভীর। বাইরে পাহাড়ি বাতাসে পাতা দুলছে কাঁপাকাঁপিভাবে, কিন্তু ডাকঘরের ভেতর যেন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। অভিজিৎ বসে আছে টেবিলের এক কোণে, চোখের সামনে রাখা রুদ্রপ্রতাপের দেওয়া সেই চিঠিটা—“তোমার নামের শেষ চিঠি।” তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে বাবার পুরনো কথা, সেই ১৯৮৯ সালে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা, আর এই রক্তমাখা ইতিহাসময় ডাকঘর। সে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়, পাহাড়ের নিচের দিকে তাকায়, যেন কিছু বা কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে। তখনই তার চোখ পড়ে, ডাকঘরের পিছন দিকের ছায়াঘন ঢালে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে রুদ্রপ্রতাপ—কিন্তু এবার একেবারে অন্যরকম ভাবে। তার চোখদুটি আগুনের মতো জ্বলছে, আর তার চারপাশে যেন বাতাসের চাপ তৈরি হচ্ছে। হাতে ধরা লাল রঙের পুঁতির মালা ঘোরাতে ঘোরাতে সে ডাকঘরের পেছনের ভাঙা প্রাচীরে কিছু দাগ কেটে তৈরি করছে এক বৃত্ত, আর সেই বৃত্তের মাঝে বসে পড়ছে পদ্মাসনে।
অভিজিৎ চুপচাপ দেখে, দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রুদ্রপ্রতাপ আসলে এক প্রাচীন তান্ত্রিক যিনি চিঠিকে শুধু সংবাদের বাহক নয়, আত্মার ধারক বলে মনে করেন। সেই বৃত্তের মাঝে বসে রুদ্রপ্রতাপ জপ করতে থাকে এক অজানা ভাষায়—তা সংস্কৃত নয়, বাংলা নয়, এমনকি কোনো জানা মর্তীয় ভাষাও নয়। জপের ছন্দে ছন্দে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, এবং আচমকা মেঘ জমতে শুরু করে ঠিক ডাকঘরের মাথার উপর। কয়েক মুহূর্ত পর, সেই বৃত্তের ভিতরে আগুনের মতো আলো জ্বলে ওঠে আর হাওয়ায় ভেসে আসে এক পুড়ে যাওয়া খাম—যার কালি আধা-পোড়া, যার অক্ষর অস্পষ্ট, কিন্তু তার গন্ধ যেন অভিজিৎ আগে কোথাও পেয়েছে—ঠিক তার বাবার টেবিলঘরে থাকা সেই পুরনো ডায়েরির পাতার মতো।
রুদ্রপ্রতাপ এবার উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে চায় অভিজিতের দিকে, বলে, “তুমি ভাবছ আমি পাগল, কিন্তু আমি যা করছি তা সময়ের রক্তমাংস থেকে সংগৃহীত। এ চিঠিগুলো আত্মার শেষ ভাষ্য। তুমি কি জানো, একটি অপ্রকাশিত অনুভব কত ভয়ানক অভিশাপ তৈরি করতে পারে? এই ডাকঘর আমি তৈরি করিনি, আমি শুধু এর সেবক। এই চক্র, এই প্রক্রিয়া, বহু আগে থেকেই চলেছে। তুমি এসেছো কারণ এই বৃত্ত এখন পূর্ণ হতে চলেছে।” অভিজিৎ বলল, “কিন্তু কেন আমাকে?” রুদ্রপ্রতাপ ধীরে হেঁটে এসে তার কাঁধে হাত রাখে, বলল, “কারণ তুমিই সেই চিঠির উত্তর—যা এখনও লেখা হয়নি, কিন্তু যেটার প্রাপক তুমি নিজেই।” অভিজিতের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, চারপাশের বাতাস স্থির হয়ে আসে, আর তার মনে হতে থাকে, সত্যিই কি সময় আর বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে—একজন পোস্টমাস্টার নয়, বরং এক অন্তর্দৃষ্টির প্রহরী?
অধ্যায় ৪: ভানুমতীর ছায়া
সকালের আলো পাহাড়ি গাছে গাছে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু ডাকঘরের জানালায় ঢোকে না সেই উজ্জ্বলতা। আজ অভিজিৎ আগেভাগেই উঠে বসে জানালা খুলতেই দেখে, নিচের ঢালে পাহাড়ি পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী। তার পরনে ময়লা ধুতি, কাঁধে পুঁতির মালা, মাথার চুল এলোমেলো। বয়স বড়জোর চৌদ্দ-পনেরো হবে। কিন্তু তার চোখ দুটো—ভালো করে তাকাতেই অভিজিৎ কেঁপে ওঠে—সেই চোখে কোনো হাওয়া নেই, যেন জলের নিচে আটকে থাকা চোখ, যেখান দিয়ে কেবল অতীতের রোদ পেরিয়ে আসে। মেয়েটা কিছু বলছে না, কেবল চেয়ে আছে অভিজিতের দিকে। সে জানালার ফাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি?” কোনো উত্তর আসে না। মেয়েটা নিঃশব্দে পেছন ঘুরে ঢুকে পড়ে কুয়াশার ভেতর।
অভিজিৎ বেরিয়ে আসে বাইরে, ডাকঘরের পেছনের দিকে যায়, কিন্তু কোথাও মেয়েটির ছায়াও নেই। মাটি শুকনো, তাতে কোনো পায়ের ছাপ নেই, কিন্তু ডাকঘরের দরজার পাশের কাঠে কেউ এক লাইন লিখে রেখে গেছে খয়েরি কালি দিয়ে—“আমার ভাই এখনও খাদের নিচে পড়ে আছে।” সে কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেখে সেই লেখা, মনে হয় রক্তে লেখা, কারণ কালি এখনও আঠালো। ঠিক তখনই সে দেখতে পায়, পোস্টবক্সের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে একটা চিঠি। চিঠিটা টেনে বার করে দেখে, প্রেরকহীন, কিন্তু হাতে লেখা অদ্ভুতভাবে পরিচিত। ভিতরে লেখা—“আমি বলিনি কিছু, কারণ বলার কেউ ছিল না। কিন্তু এখন যদি শুনতে পাও, জানিও আমি অপেক্ষা করি সেই পাহাড়ে, যেখান থেকে ভাইটা পড়ে গিয়েছিল।” নিচে লেখা নাম—ভানুমতী।
সে রাতে অভিজিৎ ঘুমোতে পারে না। ভানুমতীর নাম তার কাছে কেমন যেন পরিচিত লাগে। পুরোনো ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে খুঁজে পায় ১৯৫৬ সালের একটি দুর্ঘটনার কাগজ—এক কিশোরী ও তার ভাই পাহাড় থেকে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিল, নাম ভানুমতী ও উমেশ। কিন্তু তখনই চোখ আটকে যায় কাগজের এক বিবরণে—উদ্ধারের সময় জানা গিয়েছিল, কিশোরীটি আগেই মারা গিয়েছিল, কিন্তু ভাইটি ছিল আহত। তাকে কিছুদিন পর পাওয়া যায় স্থানীয় এক সাধুর আশ্রমে, কিন্তু সে আর কোনোদিন কথা বলেনি। অভিজিৎ বুঝতে পারে, সে যাকে দেখেছে, সে হতেই পারে না বর্তমানের কেউ। কিন্তু তবু তার চোখে-মুখে ছিল অনুরোধ, দুঃখ, আর এমন এক আশাভরা অপেক্ষা যা কেবল কোনো অসমাপ্ত আত্মার মধ্যেই থেকে যেতে পারে। ডাকঘরের অদ্ভুত জগতে এখন শুধু চিঠি নয়, চেয়ে আছে এক আত্মাও—ভানুমতী।
অধ্যায় ৫: ডাকঘরের দেয়ালের গায়ে সময়
সেইদিন রাত গভীর হতেই অভিজিৎ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে থাকে—ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে ঠিক ১০টা ৪৭-এ, ঠিক যেভাবে থেমে আছে তার আগমনের দিন থেকেই। কিন্তু আজ, হঠাৎ করেই ঘড়ির কাঁটা একবার কেঁপে উঠে আবার থেমে যায়। একই সঙ্গে ডাকঘরের পশ্চিম দেয়ালে ঝোলানো পুরোনো ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো নিজে থেকেই ওল্টাতে থাকে—টুকটুক শব্দে এক এক করে। ১৯৮৯, ১৯৪৭, ১৮৭২, আবার ২০২৯! যেন সময় নিজেই তার পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এই ঘরের ভেতরে। এক অদৃশ্য শক্তি যেন এই ঘরটিকে শুধু স্থানে নয়, সময়েও অস্থির করে তুলেছে।
আতঙ্ক আর কৌতূহলের মিশেলে অভিজিৎ দেয়ালের উপর আলতোভাবে হাত রাখে। আর তখনই ক্যালেন্ডারের পেছন থেকে খসে পড়ে একটি পাতলা কাগজ, যাতে হাতের লেখা অক্ষরে লেখা—”সময় রেখা নয়, সে এক বৃত্ত। এক জায়গা থেকে শুরু হয়ে, শেষ হয় না—তুমি এখন তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছো।” লেখা নিচে কোনো নাম নেই, কিন্তু কাগজের কালি একেবারে তাজা, যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই লেখা হয়েছে। সে বুঝে ওঠে না কে এই বার্তা রেখে গেছে।
ঠিক তখনই সিঁড়ির ধাপে শব্দ হয়। ডাকঘরের দরজা খোলে এক বৃদ্ধ—চামড়ায় ভাঁজ, চোখে ধূসর ঝাপসা দৃষ্টি, হাতে এক পুরোনো কাঠের লাঠি। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন—হরিহরণ দত্ত, এই ডাকঘরের প্রাক্তন কর্মী। অভিজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি এখনো এখানে থাকেন?” হরিহরণ হেসে বলেন, “আমি তো কখনো যাইনি, আমি এখানেই ছিলাম, সেই ১৯৫৭ সাল থেকে।” অভিজিৎ চমকে ওঠে, কারণ সরকারি নথি অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে হরিহরণের বয়স ছিল মাত্র ৬ মাস। বৃদ্ধ বলে, “এই ঘর মানুষকে সময় দেয় না, সময় কে আটকে রাখে। আমি এখানেই আছি, এক বয়সেই, বছরের পর বছর। যাদের কথা ছিল, কিন্তু বলা হয়নি—তাদের চিঠিগুলো জমতে জমতে একটা সময় তৈরি করে ফেলে। তুমি তা-ই দেখছ।”
অভিজিৎ তখন বুঝতে শুরু করে, ডাকঘরটি আসলে একটি বন্ধ দরজা নয়—বরং একটি মুক্ত ফাঁক, যেখানে অতীত এবং ভবিষ্যৎ কেবল পাশে বসে অপেক্ষা করে, ঠিক সেই চিঠির মতো—যা কখনো পৌঁছায় না, আবার কখনো ফিরেও আসে না। ডাকঘরের দেয়ালে কেবল ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার নয়, লেগে আছে সময়ের ব্যর্থতা, নিঃশব্দ প্রতীক্ষা, আর সেইসব মানুষের আত্মিক চিৎকার—যারা বলতে পারেনি ‘শেষ কথা’।
অধ্যায় ৬: ছায়ার ডাকপথ
ডাকঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন দলিলের স্তূপ থেকে উঠে এলো এক মিহি, তামাটে গন্ধ—যেন বহু যুগ পুরোনো শুষ্ক তামার পাতায় লেখা চিঠির গন্ধ। জয়ন্ত যখন সেই ভঙ্গুর কাগজে লেখা একটি অদ্ভুত চিঠির ভাষা বোঝার চেষ্টা করছিল, তখন বাইরে ঝিরঝিরিয়ে নেমে আসছিল পাহাড়ি সন্ধ্যা। চিঠিটি লেখা হয়েছিল সংস্কৃত, পালি ও বঙ্কিম বাংলার সংমিশ্রণে, যেখানে কথাগুলোর মধ্যে যেন গোপন এক মন্ত্র ছিল—কোনো মৃত আত্মার নিবেদন। “আমার ছায়াটিকে ফিরিয়ে দিন,” চিঠিটিতে লেখা ছিল। তার নিচে স্বাক্ষর—”অচিন্ত্য, প্রাক্তন অরণ্যচারী, মৃত: ১৮৯৩”। পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে জয়ন্ত বুঝলো এই ডাকঘরে কেবল আত্মাদের আকাঙ্ক্ষা নয়, তাদের ছায়াগুলোও আটকে আছে, আর এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে সেই তান্ত্রিক—আচার্য বীক্ষণানন্দ।
জয়ন্ত সেই রাতেই পাহাড়ি গুহার পথে রওনা দিল, যেখানে শুনেছিল তান্ত্রিক তার নৈর্ব্যক্তিক চেম্বার স্থাপন করেছে। পাহাড়ের ভেতরে সেই গুহাটি যেন ছিল এক চলমান, কাঁপতে থাকা অন্ধকার। ভিতরে ঢুকে জয়ন্ত দেখে—চৌদ্দ মুখো একটি কূপ, যার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য ছায়া, মানুষের মত অবয়ব নিয়ে। সেখানে বীক্ষণানন্দ এক বৃত্তে বসে, তার চারপাশে প্রজ্বলিত এক শতাধিক কাঁসার প্রদীপ, প্রতিটির শিখা ঠিক একটানা ডানদিকে ঘুরছে—এ এক অদ্ভুত, নিয়মিত ঘূর্ণন যেন সময়কেই বাঁকিয়ে দিচ্ছে। তান্ত্রিক তখন পাঠ করছিল এক “নির্ঘোষপত্র”—যা প্রতিটি আত্মার ছায়াকে ডেকে আনে এবং স্থিতি দেয় অচল কালে। জয়ন্ত হঠাৎ বলে ওঠে—“আপনার এই তন্ত্র, আপনার এই ছায়াগুলো, এগুলো তো আদতে বন্দিত্ব, মুক্তি নয়।” বীক্ষণানন্দ ধীরে চোখ তোলে, বলে—“বন্দিত্বই শেষ স্বাধীনতা, যদি তুমি কালকে আর বিস্মৃত না হতে চাও।”
তান্ত্রিক বীক্ষণানন্দ তার প্রস্তাব দেয়—“তুমি এই ডাকঘরের নতুন বাহক হও, নিয়মের নয়, কালের বাইরে ডাকের ধারক। তোমার কলম ছায়ার রক্তে চিঠি লিখবে, আর আমি তাদের গন্তব্যস্থল ঠিক করে দেব।” কিন্তু জয়ন্ত জানত, এই প্রস্তাব মানে এক শ্বাসরুদ্ধ চক্রে নিজেকে বন্ধক রাখা। সে ফিরে আসে ডাকঘরে, কিন্তু তখনই দেখে তার ছায়া আর তাকে অনুসরণ করছে না। এক পুরনো আয়নায় প্রতিফলিত হয়—তার ছায়া নিজেই চিঠি লিখছে, নিজের মত করে। ডাকঘরের টেবিলে, চিঠির ছায়াগুলো ছড়িয়ে পড়ছে একে একে, আর দূর পাহাড়ে একটি ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যায়—যা কেবল মৃতদের পায়ে বাঁধা থাকে। জয়ন্ত জানে, সে ঢুকেছে ছায়ার ডাকপথে—যেখানে সময় থেমে যায়, এবং প্রতিটি চিঠি এক অদৃশ্য ঠিকানায় পৌঁছয়, কিন্তু প্রাপকের অস্তিত্ব চিরকাল এক রহস্য হয়ে থাকে।
অধ্যায় ৭: মৃতদের অনুরোধপত্র
জ্যোতির্ময় এখন আর আগের মতো নিঃসঙ্গ নন। ডাকঘরের প্রতিটি ইট যেন তাঁর সঙ্গী হয়ে উঠেছে—কখনও মৌন, কখনও হঠাৎ বাষ্পময় দীর্ঘশ্বাসে ভরা। একরাশ অবিশ্বাস আর অভিমান নিয়ে তিনি যেদিন এসেছিলেন, আজ তার জায়গায় এসেছে উপলব্ধির চাপা কম্পন। রাত্রির গভীরে, ঘুমন্ত পাহাড়ি বাতাসে, মৃতদের কণ্ঠস্বর যেন জেগে ওঠে কালি মাখানো চিঠির পাতায়। এইসব চিঠি আসে—তন্দ্রাচ্ছন্ন সন্ন্যাসিনীর হাতে, বারান্দার ছায়ার দোলায়, কখনও বা তান্ত্রিকের শিষ্য ‘অঘোর’ অজানা ঠোঙা হাতে রেখে যায়। তারা কেউ আর বাঁচে না, কিন্তু চায় বাঁচার স্বপ্নটুকু পৌঁছে দিতে তাদের প্রিয়জনদের কাছে। চিঠিগুলোতে লেখা থাকে কোনো অপূর্ণ গান, কোনো অপরিচিত নাম, কোনও রক্তাক্ত মাফচাওয়া। জ্যোতির্ময় সব পড়েন, পড়ে ফেলে রাখেন এক ধূসর বাক্সে, যদিও জানেন, প্রতিটা চিঠি এক একটি প্রেতাত্মার ডাকে লেখা আর্তনাদ।
এমন এক রাতে, যখন চারদিক থমকে, মাটির নিচ থেকে উঠে আসে শীতল ধোঁয়া, জ্যোতির্ময় শুনলেন এক আওয়াজ—অপরিচিত অথচ পরিচিত, যেন ডাকছে নাম ধরে। ডাকঘরের ভেতর থেকে আলোর রেখা বেরোচ্ছে, অথচ তিনি কিছুই জ্বালাননি। ভিতরে ঢুকে দেখেন, পোস্টিং টেবিলের উপর রাখা আছে একটি কালো খামে মোড়ানো চিঠি। মুখবন্ধে লেখা ‘পোস্টমাস্টার জ্যোতির্ময় সরকারের জন্য’। হাতে নিয়েই বুঝলেন, এটি তান্ত্রিকের নিজস্ব লেখা—তাঁর কুচকুচে হরফ, যেন কালি নয়, কঙ্কালের রস। চিঠিতে লেখা ছিল এক আশ্চর্য আহ্বান: “সময়কে মুছে দাও, জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান ঘুচিয়ে দাও, এই ডাকঘর হয়ে উঠুক চিরন্তন—আমরা একসাথে থাকব, চিঠির ভেতরে, নামহীন ঠিকানায়।” সেই মুহূর্তে, খামটির ভেতর থেকে উঠে আসে এক অদ্ভুত ধূপের গন্ধ, চোখে অন্ধকার, আর মনে এক অব্যক্ত তৃষ্ণা। যেন কিছু টানছে, খুব কাছে, খুব ভিতর থেকে। জ্যোতির্ময় বুঝলেন, তিনি এক চূড়ান্ত পরীক্ষার মুখোমুখি।
জ্যোতির্ময় সিদ্ধান্ত নেন—তিনি সেই তান্ত্রিকের ডাক গ্রহণ করবেন না। কিন্তু সেটা মানে যুদ্ধ ঘোষণা। যুদ্ধ আত্মার বিরুদ্ধে, যুদ্ধ চিঠির মধ্যেকার সময়ের ছায়ার বিরুদ্ধে। তিনি পৌঁছন ‘কাঞ্চন ডোবা’—এক পরিত্যক্ত জলাশয়, যেখানে শোনা যায় প্রাচীন তান্ত্রিকরা চিঠি জ্বালিয়ে আত্মা মুক্ত করত। সেখানেই তাঁর দেখা হয় ‘প্রৌঢ়া’—এক বয়স্ক মহিলা, যিনি নাকি একসময় এই ডাকঘরের প্রথম পাঠক ছিলেন, যিনি নিজেই ছিলেন একজন মৃত। তিনি বলেন, “তুমি একা নও। অনেকেই লিখেছিল তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে। তাদের আত্মার ছায়া এখনো পাহাড় ঘিরে ঘোরে।” জ্যোতির্ময় তাঁর কাছ থেকে একটি পুরোনো চিঠি নেন—একটিমাত্র নামহীন অনুরোধপত্র, যার ভাষা ছিল—“মৃত্যু নয়, স্বপ্ন চাই।” সেই চিঠি হবে তাঁর অস্ত্র। এই চিঠিকে সামনে রেখে, তিনি ডাকঘরের প্রতিটি পোষ্টবক্সে রাখবেন একটি করে বাতি—সময় নয়, স্মৃতির আলো। সেই আলো যদি জ্বলে ওঠে, তবে প্রমাণ হবে—এই ডাকঘর তান্ত্রিকের নয়, এই ডাকঘর এখনো জীবনের শেষ শব্দ লিখতে জানে।
অধ্যায় ৮: পত্রমন্ত্র
নীলমণি রাত জেগে পড়ছিল এক অদ্ভুত চিঠি, যা দুপুরবেলায় ডাকঘরের পিছনের জানালার চৌকাঠে আটকে পাওয়া গেছে। কালি-কলমে লেখা নয়, লেখা যেন মুদ্রিত অদ্ভুত কোনো কাব্যময় ভাষায়, যা পাঠ করলেই পাঠকের স্মৃতির ভিতরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। তিনি বুঝলেন, এই চিঠিগুলি আর শুধুই মৃত আত্মাদের হাহাকার নয়—এগুলো এক বিশাল অন্তর্জগতের অনুবাদ। প্রতিটি শব্দ যেন একেকটা মন্ত্র। হঠাৎ করেই অদূরে পাহাড়ের দিকে চোখ চলে যায় তাঁর—তাঁর দৃষ্টির শেষ সীমানায়, সেই কালো কুয়াশার গহ্বরে যেন এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি জানতেন, ওই রূপটি তান্ত্রিক রক্তেশ্বরের। শেষ কয়েক রাত ধরে সে ডাকঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, চিঠিগুলোর গায়ে লাল সিঁদুর আর রক্তচিহ্ন রেখে যাচ্ছে, যেন সেগুলিকে একেকটি জীবন্ত যন্ত্রণা-শক্তিতে রূপান্তরিত করছে।
সেই রাতে, ডাকঘরের গায়ে প্রাচীন এক প্রতীক আঁকা হয়। এই প্রতীক অতীতের কোনো নিষিদ্ধ তন্ত্রসংহিতার অংশ, যা নীলমণি কেবলমাত্র তার বাবার পুরনো ডায়েরিতে পড়েছিলেন একবার। তিনি বুঝলেন, রক্তেশ্বর শুধু আত্মাদের নয়, সময়কেও বাঁকাতে চাইছে—অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে এক সঙ্গে এনে এই ডাকঘরকে একটি ‘কালসংকেত কেন্দ্রে’ পরিণত করার পরিকল্পনায় মত্ত সে। পরদিন সকালে গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ লোক এসে জানাল, তারা রাতে আবার চাঁদের আলোয় ডাকঘরের উপরে আগুন জ্বলে উঠতে দেখেছে, অথচ সেই আগুনের তাপ বা ধোঁয়া কিছুই ছড়ায়নি। এইসব ঘটনার মাঝে নীলমণি নিজের ভিতরে এক নতুন ক্ষমতা অনুভব করতে শুরু করেন—তিনি শুনতে পাচ্ছেন সেই চিঠিগুলির ভিতরের ‘পত্রমন্ত্র’, যা তাঁকে বলছে, কীভাবে এই ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
তিনি সেই চিঠিগুলি জড়ো করে এক নির্জন রাতে রক্তেশ্বরের তৈরি করা ‘তান্ত্রিক স্তম্ভে’ পৌঁছে যান। সেই স্তম্ভটি ছিল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা এক পাথরের টানেলে, যার মুখে শত শত মানুষের কান্নার ধ্বনি জমে থাকে বাতাসে। নীলমণি বুঝতে পারেন, এই স্তম্ভটাই একমাত্র জায়গা, যেখান থেকে রক্তেশ্বরের শক্তিকে খর্ব করা সম্ভব। চিঠিগুলি পাথরের গায়ে একে একে ছুঁইয়ে তিনি ‘পত্রমন্ত্র’ উচ্চারণ করেন—আর তখনই আকাশে নেমে আসে এক ঘূর্ণিবায়ুর বিস্ফোরণ, বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে স্তম্ভের চারদিক, আর সেই ধ্বনির মধ্যে শোনা যায় বহু আত্মার মিলে যাওয়ার জয়ধ্বনি। সে মুহূর্তে তিনি স্পষ্ট দেখেন রক্তেশ্বর, যার মুখে হাহাকার আর হতাশা—কারণ তার তৈরির ভিতেই ভেঙে যাচ্ছে তার নিজস্ব মন্ত্রতন্ত্রের ব্যূহ।
অধ্যায় ৯: সময়-ছাড়ার সন্ধিক্ষণে
প্রথম প্রহরের কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ি পথ ধরে ডাকঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল অর্ণব। তার কাঁধে বাঁধা ঝোলা ব্যাগ, চোখে কপট নিঃশব্দতা। গতরাতে সে বুঝেছিল—ডাকঘরের চতুর্দিকে কোনো সাধারণ বাস্তবতা আর নেই। সময় যেন বেঁকে গেছে, চিঠির কালি হয়ে গেছে রক্ত, আর শব্দগুলো পরিণত হয়েছে মন্ত্রে। তান্ত্রিকের তৈরি সেই রহস্যময় ‘কালপত্র’—যা কিনা মৃত আত্মাদের চিঠিকে সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে পৌঁছে দিতে সক্ষম—তা নিয়ে তান্ত্রিক তুষারকেতু আর এক ধরণের পিশাচিক খেলা খেলছে, যা শুধু এই পাহাড়কে নয়, গোটা বাস্তব জগতকে ভেঙে ফেলতে পারে। অর্ণব এবার সেই ডাকঘরেই ফিরে যাচ্ছে, একা নয়, সঙ্গে আছে পাণ্ডে, বৃদ্ধ হিমালয় গবেষক, যে বিশ্বাস করে, এই পাহাড়ের গুহার নিচে এখনও অবিকল রয়ে গেছে ‘ধ্বংস-চক্র’-এর কেন্দ্র—এক তান্ত্রিক বিন্দু, যেখানে দাঁড়িয়ে সময় আর স্থান দুটোই মুছে ফেলা যায়।
ডাকঘরের সামনে পৌঁছে তারা দেখল, দরজার উপর আঁকা চিহ্নগুলোর আকার বদলে গেছে—যেন তা প্রতিনিয়ত নিজেকে রচনা করছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই পাণ্ডে কাঁপতে কাঁপতে পাথরের মেঝেতে বসে পড়লেন, বললেন, “এই চক্রটা—এটাই তো! কালচক্র। আমি অনেক প্রাচীন তিব্বতি পাণ্ডুলিপিতে এর উল্লেখ পড়েছি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি, ওটা সত্যি।” ঘরের মাঝে একটি চিঠি রাখা, যার উপর রক্তের মতো কালিতে লেখা—”তুমিই শেষ প্রেরক।” অর্ণব সেটা পড়তেই চোখে ভেসে উঠল অতীত—মা’র মুখ, ছেলেবেলার ট্রাঙ্কবাক্সে রাখা পুরোনো চিঠি, আর সেই প্রথম দিন ডাকঘরের চাবি হাতে নেওয়ার মুহূর্ত। এই চিঠিটা যে তার নিজের জন্য—তা বুঝতে দেরি হয়নি। এ যেন তার নিজেরই কোনো ভবিষ্যৎ আত্মা লিখেছে। তাতে লেখা, “তুইই পারবি এই কেন্দ্রীয় সময়-রেখাকে ছিন্ন করতে। স্মরণে রাখ, শুধু ‘ভুলে যাওয়া’ নয়, ‘ক্ষমা করাও’ সময়ের চক্রভাঙার একমাত্র উপায়।”
ততক্ষণে, তুষারকেতু ডাকঘরের বুকে আবির্ভূত হয়েছে, তার শরীর জুড়ে গরল-ধোঁয়া, চোখে দপদপ করছে আগুন। সে বলল, “তুই এখানে এলেই তো জানতাম। এই চক্র তৈরি হয়েছে শতাব্দীর সাধনায়, আমি একে ভাঙতে দেব না।” অর্ণব এক পা এগিয়ে এসে বলে, “তুই যা বলিস, আমি তোর এই কাল-ডাকঘর আর এই আত্মার চিঠিদের মুক্ত করতে এসেছি। যাঁরা মৃত, তাঁরা যেন না থেকে যায় এভাবে আটকে, না পাঠাতে হয় চিঠি। তুই শুধু নিজের অস্তিত্বকে অমর করতে চাইছিস।” সেই মুহূর্তে ঘরে শুরু হয় সময়ের ঘূর্ণিবায়ু, দেয়ালে থাকা প্রতিটি চিঠি বাতাসে ভেসে উঠে ছিঁড়ে পড়তে থাকে। পাণ্ডে উচ্চারণ করে এক ব্রহ্মমন্ত্র, আর অর্ণব তার সেই শেষ চিঠিটা তুষারকেতুর দিকে ছুড়ে দেয়। মুহূর্তে তার শরীর জ্বলে উঠে রক্ত-রং ধরায়, আর তারপর নিঃশব্দে গিলে নেয় তাকে সেই সময়-চক্র। ডাকঘরের দেয়াল ধসে পড়ে, ঘূর্ণি থেমে যায়, আর এক বিশাল নিঃশ্বাসের মতো নিরবতা নামল পাহাড়ে।
অধ্যায় ১০: সমর্পণ
ভোরবেলা যখন মেঘভাঙা রোদ পাহাড়ের কাঁধ ছুঁয়ে মৃদুভাবে নামছিল ডাকঘরটির চূড়ায়, তখন ভিতরে দাঁড়িয়ে শ্রীপদ এক অজানা শান্তির অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে তাকিয়ে ছিল চারদিকে। যেন তার চারপাশের প্রতিটি শ্যাওলা, প্রতিটি পাথর, প্রতিটি বাতাস—সবই আজ একযোগে নিঃশব্দে কিছুর সাক্ষ্য দিচ্ছে। কাল রাতে যা ঘটেছে, তার কোনো ভাষাগত ব্যাখ্যা হয় না। তান্ত্রিক অনুশীলনমালার শেষ রাত্রিটি ছিল সর্বনাশা। অতীন্দ্রিয় সেই যজ্ঞমণ্ডপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কালাচক্রতন্ত্রের সংহারমন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন পুরাতন তান্ত্রিক রাজেন্দ্র নন্দী, আর তার বিপরীতে ছিল শ্রীপদ—এক সাধারণ পোস্টমাস্টার, যার অস্ত্র ছিল শুধুই মানুষের প্রার্থনা বোঝার ক্ষমতা এবং অন্তরের বিশ্বাস। শ্মশানাভাস ও মৃতচিঠিগুলির আবর্তে গড়ে ওঠা এই কুয়াশাময় লড়াইয়ে শ্রীপদ ব্যবহার করেছিল প্রেরিত আত্মাদের মনের ভাষা, যা কোনো তন্ত্র নয়, একপ্রকার মানবিক ক্ষমতা। সেই আত্মারা যাদের চিঠি কেউ কখনো পড়েনি, তাদের বেদনাই এক হয়ে শেষমুহূর্তে প্রতিহত করেছিল তান্ত্রিকের আত্মকেন্দ্রিক আয়োজনকে।
অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়ার পর, রাজেন্দ্র নন্দীর দেহ অদৃশ্য হয়ে যায় ধোঁয়ার ঘূর্ণিতে। তবে সে মারা যায়নি, বরং কোনো সময়বর্জিত স্তরে সে লীন হয়ে গেছে—যেখানে সে চেয়েছিল পৌঁছাতে। শুধু এতটাই ঘটেনি, যা সে চেয়েছিল—ডাকঘরটি পরিণত হয়নি তার বানানো কালচক্র কেন্দ্রে। বরং ডাকঘরের ঘড়ির কাঁটা আবার শুরু করেছে চলা, এবং সেই সাথে জীবিতদের জন্য চিঠি আসতে শুরু করেছে ফের। পাহাড়ি গ্রামের মানুষ যাঁরা এতদিন ডাকঘরটি এড়িয়ে চলতো, তারা আজ ভোরেই আসতে শুরু করেছে—কারও হাতে ছোট প্যাকেট, কারও হাতে কাগজে মোড়া পুরনো খাম। শ্রীপদ আজ ডাকঘরের দরজা খুলে দিয়েছে সবার জন্য—জীবিত আর মৃত উভয়ের।
দিনের শেষে, শ্রীপদ একটি চিঠি হাতে পেল—নিজের নামে। সেটি লেখা ছিল কোনো মানুষ নয়, এক প্রেতাত্মার হাতে, যার নামও সে জানত না। কিন্তু সেই চিঠিতে লেখা ছিল—“তুমি আমাদের পৌঁছে দিয়েছো ফিরে আলোয়। কৃতজ্ঞতা জানানো যায় না, শুধু ছায়া হয়ে পাশে থাকা যায়।” সেই মুহূর্তে সে বুঝেছিল, ডাকঘর আর কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ নয়, এটি একটি পথ—সময় ও আত্মার মাঝে এক সংযোগসেতু। তার চোখে জল এসে গেল, তবে সেই জল ছিল না বেদনার। সে জানত, এখন থেকে এই পাহাড়ি ডাকঘরে পোস্ট হবে শুধু খবর নয়, সময়ের ওপার থেকেও আসবে একেকটি বার্তা, যেখানে হৃদয় আর চেতনাই হবে আসল চালানপত্র। তখন সে শান্ত মনে আবার বসে পড়ল তার ডেস্কে, এক নতুন খামে লিখতে শুরু করল প্রথম চিঠি—জীবনের উদ্দেশ্যে।
****



