Bangla - প্রেমের গল্প

ট্রামের জানালায় ভালোবাসা

Spread the love

সুব্রত রায়


এক

১৯৮০ সালের কলকাতা শহরের সকালগুলো ছিল নিরালায় মোড়া, পাখির কিচিরমিচিরে ভরা এবং শহরের গায়ে তখনও আধুনিকতার খোলস পুরোপুরি চেপে বসেনি। শ্যামবাজার থেকে ট্রাম ছাড়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা ১০ মিনিটে, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে ধর্মতলার দিকে। ঠিক এই ট্রামেই প্রতিদিন ওঠে অনিমেষ মুখার্জী, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পুরনো কাপড় বাঁধানো একটা খাতা, যাতে সে নিজের মতো করে কবিতা লেখে আর অলস দুপুরে গুটিগুটি অক্ষরে নিজের মনোভাবের ছায়া ফেলে রাখে। সরকারি কলেজের লাইব্রেরিতে চাকরি করে ছেলেটি, স্নাতকোত্তর শেষ করে যেই চাকরি জুটেছে, তাতেই পরিতৃপ্ত। তার জীবনে রোমাঞ্চের জায়গা নেই, কিংবা সে তা নিজেই হতে দেয়নি—বাবার অবর্তমানে সংসারের দায়িত্ব আর বইয়ের গন্ধ মিশিয়ে জীবনটাকে সাজিয়েছে স্থিরভাবে। ট্রামের জানালার ধারে প্রতিদিন বসে থেকে সে দেখে শহরটাকে—রাস্তায় বসে থাকা ফুলবিক্রেতা, উল্টোদিকের চায়ের দোকানে ভিড় করা মানুষ, কিংবা সেই দুধে রঙা ছেলেটা যে ময়দানে লাল বেলুন বিক্রি করে গুনগুন করতে করতে। কিন্তু একটা সময় থেকেই সে শুধু শহর দেখে না, খুঁজে ফেরে একটা পরিচিত মুখ, যা হঠাৎ করেই একদিন তার নীরব জীবনে ঝড় তুলেছিল।

সেই মুখটার নাম সে তখনও জানে না। প্রথম যেদিন মেয়েটিকে দেখেছিল, সেদিন ছিল অক্টোবরের শুরুর দিক, পুজোর পরপর, শহরের গায়ে তখনও মেঘের ছায়া রয়ে গেছে। ভবানীপুর থেকে ট্রামে উঠেছিল মেয়েটি, মেঝের ওপরে মৃদু শব্দ তুলে হেঁটে এসে বসেছিল অনিমেষের বিপরীত দিকের জানালার ধারে। তার হাতে ছিল এক ছোট্ট স্কেচবুক, আর কাঁধে একটা জামদানি ব্যাগ—চোখে ছিল বিস্ময়ের আলো, আর ঠোঁটে একধরনের শান্ত হাসি, যেন সে শহরকে আঁকছে নিজের চোখে, নিজের ছোঁয়ায়। অনিমেষ প্রথমে তাকিয়ে ছিল, তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু মনের ভিতরে কোথাও একটা ঢেউ লেগেছিল—যার ব্যাখ্যা সে তখন খুঁজে পায়নি। প্রতিদিন মেয়েটি ট্রামে ওঠে, কখনো সিঁথিতে দোপাট্টা উড়ে এসে গালে লাগে, কখনো ট্রামের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে অনিচ্ছাকৃত ভাবে কাঁধ ছুঁয়ে যায় অনিমেষের। সে কিছু বলে না, শুধু চুপচাপ স্কেচবুকে এঁকে চলে রাস্তাঘাট, ট্রামের কন্ডাক্টরের বাঁশি, আর জানালার বাইরে ছুটে চলা হরিধ্বজাবাহী প্যান্ডেল। আর অনিমেষ? সে তার কবিতার খাতায় লিখে চলে অদেখা শব্দের বিন্যাস—যা কেবল সেই মেয়েটার জন্যই জন্ম নিচ্ছে, একান্তভাবে, নিঃশব্দে।

দিন যেতে থাকে, শহরের ছন্দ বদলায় না, কিন্তু অনিমেষের প্রতিদিনের সকাল এক নতুন অপেক্ষার নাম হয়ে ওঠে। সে এখন আগের রাতেই খাতা গুছিয়ে রাখে, জামা ইস্ত্রি করে, ট্রামের একেবারে নির্দিষ্ট জানালার সিটে বসে থাকে, যেন কোনও এক অলিখিত শর্ত মেনে সেই মেয়েটিও এসে বসবে ঠিক তার বিপরীত পাশে। শব্দহীন ভাষায় তারা একে অপরকে চেনে, অথচ কোনো নাম ধরে ডাকে না, কোনো কথা বলে না। দু’জনে আলাদা জগতে বাস করে—একজন শব্দে, একজন রেখায়, কিন্তু এই ট্রামটাই যেন তাদের একমাত্র মিলনস্থল। একদিন হঠাৎ মেয়েটি অনিমেষের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ফেলে, “আপনি কি কবিতা লেখেন?”—অনিমেষ ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলতেও পারে না, শুধু মাথা নাড়ায়, তারপর মেয়েটি নিজের স্কেচবুকের পেছনের পাতায় আঁকা একটা ছোট ছবি ছিঁড়ে তাকে দেয়। ছবিতে ছিল জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলেকে, যার চোখ ট্রামের ভেতরের দিকে। নীচে লেখা: “ভেতরের জানালায় একটা মন—যে জানে অপেক্ষা কাকে বলে।” অনিমেষ চমকে যায়, হাসে, কিছু বলতে চায়, পারে না। পরদিন থেকে তাদের চিঠি চালাচালি শুরু হয়—কাগজে লেখা শব্দ, অঙ্কনের রঙ, আর অস্পষ্ট এক প্রেমের গল্প—যেটা তখনও কেউ মুখ ফুটে বলে না, তবুও একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

দুই

ভোরবেলা কলকাতার আকাশে তখনও আলোর রঙ মিশে ওঠেনি, পাখিরা ডাল পাল্টাচ্ছে, আর শহরটা যেন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে ঘুমচোখ মুছে। শ্যামবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে অনিমেষ ভাবছিল—আজ শিখা কি আসবে? নামটা এখন সে জানে—শেষ চিঠিতে মেয়েটি তার নাম লিখেছিল, সাদা কাগজের কোণে মৃদু হস্তাক্ষরে: “শিখা লাহা, ভবানীপুর।” এর আগেও বহুবার সে কল্পনায় ভেবেছে, সেই মেয়েটির নাম কী হতে পারে—মালবিকা? সঞ্চিতা? অন্বেষা? কিন্তু ‘শিখা’ নামটা যেন এক অদ্ভুতভাবে তার নিজের কল্পনার থেকেও অনেক বেশি মানানসই লাগলো। আগুনের নিঃশব্দ শিখার মতো, যা বাইরে হাওয়ার শব্দে দুলে ওঠে, কিন্তু নিভে যায় না। শিখা প্রতিদিন ট্রামে উঠে নিজের জায়গায় বসে, স্কেচবুক খুলে, একবার কটাক্ষে দেখে অনিমেষের দিকে—তারপর আবার ডুবে যায় নিজের আঁকায়। আর অনিমেষ? সে আজকাল বই পড়া ভুলে গিয়েছে ট্রামে। শুধু জানালার বাইরের ফাঁক দিয়ে শিখার মুখের ওপর পড়া আলোটা দেখে, আর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, আজ তার মনটা কেমন আছে।

একদিন ট্রামের জানালায় বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ অনিমেষ লক্ষ্য করল—শিখা কিছুটা বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে, চোখের নিচে হালকা ছায়া, ঠোঁট কাঁপছে অল্পস্বরে, কিন্তু সে কিছু বলছে না, না হাসছে, না আঁকছে। ট্রাম থেমে গেলে শিখা নেমে গেল—কোনও দৃষ্টি বিনিময় ছাড়াই। সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় অনিমেষ তার ডায়েরিতে লেখে: “তোমার আজকের নীরবতা আমায় অস্থির করেছে, শিখা। ট্রাম যেন আজ শুধুই ট্রাম ছিল, আমাদের নয়।” পরদিন সে শিখার জন্য একটা ছোট চিঠি লেখে, লেখে: “যদি কোনওদিন বলো, আমি শুনতে জানি। আর যদি কিছু না বলো, তাও আমি পাশে আছি—চুপচাপ।” চিঠিটা সে ভাঁজ করে একটা পুরনো কাগজের মোড়কে রাখে, আর শিখার দিকে বাড়িয়ে দেয়। শিখা তা নিয়ে চুপচাপ রাখে ব্যাগে, চোখে জল, মুখে কিছুই বলে না। কিন্তু তার পরের দিন থেকে শিখা আবার হাসে, চোখের কোণে একটা মায়া ফুটে ওঠে, আর অনিমেষ যেন বুঝে যায়—প্রেম কখনও শুধু ‘ভালোবাসি’ বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কিছু চুপ করে পাশে থাকার নামও প্রেম।

শহরের প্রতিদিনের চেনা গলিগুলোর মধ্যে, পিচঢালা রাস্তায়, ট্রামলাইনের ছন্দে—অনিমেষ আর শিখার সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। একদিন বিকেলবেলা, কলেজ থেকে ফেরার পথে অনিমেষ দেখে, শিখা ট্রামে নিজের খাতায় একটা স্কেচ এঁকে রেখেছে—একটা জানালার পাশে দাঁড়ানো দুই মানুষ, একজন নিচে তাকিয়ে, একজন উঁচু করে তাকিয়ে আছে। ছবির নিচে লেখা, “চোখে চোখে কথা হয়, বাক্য তো শুধু তার অনুবাদ।” অনিমেষ সে কাগজটা হাতে নিয়ে আবারও বোঝে—এই নীরব ট্রামের ভেতরেই দুজন মানুষ একে অপরকে চিনে ফেলেছে, স্পর্শের বাইরে থেকেও একান্তভাবে কাছাকাছি এসেছে। শহরটা চলেছে নিজের গতিতে, তবু দু’জনের ভেতরে শুরু হয়েছে অন্য এক পথচলা—যেখানে স্টপেজ নেই, গন্তব্য নেই, আছে শুধু জানালার ধারে বসা সেই ভালোবাসা, যা চোখে চোখে বলে যায়, ‘তুমি আছো, তাই আমি আছি।’

তিন

শীতের সকালে কলকাতা যেন একটু বেশি নিরব, ট্রামের ঘণ্টার ধ্বনি দূর থেকে ভেসে আসে কুয়াশার ভিতর দিয়ে। জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশির ফোঁটায় আঙুল ঘষে অনিমেষ লিখে রাখে শিখার নাম, আর মুছে ফেলে দ্রুত, যেন নামটা প্রকাশ পেলেই সেটা কোথাও হারিয়ে যাবে। সেই দিন থেকেই তারা শুরু করে চিঠির বিনিময়—একটা ছোট কাগজে, হয় কবিতা, নয়তো কিছু স্কেচ, কখনো বা নিছক দু’লাইনের নীরব মনখারাপ। কেউ কাউকে ডাকেও না, কেউ কারও ঠিকানাও জানে না ঠিকভাবে, শুধু জানে প্রতিদিন সকাল আটটা দশে ট্রামে দু’জনে একসঙ্গে থাকবে কিছু সময়—এটাই তাদের প্রেমের পরিধি, এটাই তাদের স্বপ্নের সীমারেখা। প্রথম চিঠিটা শিখা দিয়েছিল—ছোট্ট একটা নীল কাগজে লেখা ছিল, “আজ আপনার চোখটা কেমন যেন বিষণ্ণ লাগছে, কিছু হয়েছে?” অনিমেষ প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, তারপর রাতভর লেখে উত্তর—“চোখগুলো আজ কিছু খুঁজছে… হয়ত সেইটুকুই যা আপনি ধরে ফেলেছেন।”

ধীরে ধীরে প্রতিদিনের ট্রাম ভ্রমণ হয়ে ওঠে চিঠির প্রতীক্ষার একটি পর্ব। শিখা কখনো লিখে দেয়, “আজ কলেজে মডেল ড্রইং-এর পরীক্ষা, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।” অনিমেষ প্রতিউত্তরে একখানা ছোট কবিতা লিখে দেয়—“তোমার তুলির টানে যদি ক্লান্তি ধরা দেয়, তবে চোখ দুটো একটু বন্ধ করো, আমি সেখানে রঙ ছড়িয়ে দেবো।” এইভাবে গড়ে ওঠে এক আশ্চর্য কথোপকথন, যার না আছে আওয়াজ, না আছে চোখের সম্মতি, শুধু বিশ্বাস আর অদৃশ্য সেতু। অনিমেষ আজকাল অফিসে গিয়েও ভাবতে থাকে পরের দিন সে কী লিখবে, কেমন করে বলবে, “তোমার আজকের চুলে একটু জবা ফুলের গন্ধ লেগে ছিল, জানো?” কিংবা “তুমি যখন স্কেচ করো, তখন আমি যেন সময় থেমে যেতে দেখি।” এই অনুরণন যেন তাদের দুজনকেই রক্ষা করছে বাস্তব পৃথিবীর জটিলতা থেকে—এই ট্রামই তাদের গল্পের ক্যানভাস।

একদিন হঠাৎ করে শিখা অনিমেষকে একটা খাম দিয়ে দেয়। তাতে তার আঁকা একটি পেন-স্কেচ—অনিমেষের মুখ, চশমার ফ্রেম, জানালার ধারে বসে থাকা নিঃশব্দ একটি ছায়া। নিচে লেখা, “তোমাকে চিনে ফেলেছি আমি, প্রতিদিন একটু করে।” অনিমেষ সেই রাতেই ডায়েরির পেছনে লিখে রাখে তার নিজের কবিতা, “তুমি না বলেও বলো, আমি না ছুঁয়েও ছুঁয়ে ফেলি।” কিন্তু তখনও কেউ কাউকে বলে না—”ভালোবাসি”। কারণ হয়তো তারা জানে—এই সম্পর্ক শব্দের চেয়ে অনেক বেশি কিছু, আর যদি উচ্চারণে ফেলা হয়, তাহলে সেই যাদু হয়তো ভেঙে যাবে। কাগজের পাতায় তারা লিখে চলে এমন এক ভালোবাসার ইতিহাস, যার অস্তিত্ব ছিল কেবল জানালার ধারে বসে থাকা সেই প্রতিদিনকার যাত্রায়।

চার

কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার ধুলো, কলেজ স্কোয়ারের পুকুরের পাশে বসে থাকা কয়েকজন ছাত্র, আর এক কোণে রোদ পোহাচ্ছে কিছু ভবঘুরে কুকুর—এই দৃশ্যগুলো শিখা প্রতিদিন আঁকে, পেন্সিলের টানে ফুটিয়ে তোলে শহরের কোলাহল, আবার তার ভিতরেই খুঁজে ফেরে এক ধরনের একাকীত্ব, যা আজকাল তাকে অনিমেষের কথা ভাবতে শেখায়। সে বুঝে গেছে, এই ছেলেটি শুধুই তার ট্রামের সহযাত্রী নয়—সে এক আত্মিক বন্ধু, যার সঙ্গে কথা না বলেই কথা হয়ে যায়, চোখে চোখ রেখেই হয় ভাগ করে নেওয়া ব্যথা। একদিন সে কলেজ ছুটির পর ভিড় ঠেলে পৌঁছে যায় কলেজ স্ট্রিটের ‘বিশ্বভারতী’ বইয়ের দোকানে। দরকার ছিল চারকোল পেন্সিল, কিনতে গিয়েও শিখা দেখে—সেই দোকানের সামনে অনিমেষ দাঁড়িয়ে, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে একটি কবিতার বই। চোখাচোখি হতেই দু’জনেই যেন কিছুটা থমকে যায়। অনিমেষ হালকা হাসে, কিন্তু কিছু বলে না। শিখাও নয়। শুধু পেছনে সরে এসে পেনসিল নিয়ে চলে যায়, কিন্তু মনে মনে সে বুঝে ফেলে—এই শহরে শুধু ট্রাম নয়, বইয়ের পাতাগুলোতেও জমে উঠেছে তাদের ভালোবাসার রেখা।

তারপর থেকে শিখা প্রতিটি চিঠির সঙ্গে একটি করে ছোট স্কেচ দিতে শুরু করে—কখনো নিউ মার্কেটের ভিড়, কখনো গঙ্গার ধারে বসে থাকা একটি কাপল, কখনো বা ভিক্টোরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি একলা ছায়া। অনিমেষ চিঠির জবাবে লেখে, “তুমি প্রতিদিন যে শহরটা আঁকো, আমি সেই শহরের ভেতরেই তোমাকে খুঁজি।” একবার একটি স্কেচে শিখা এঁকে দেয় একটি জানালার পাশের ছায়া, যেখানে দু’জন মানুষ দাঁড়িয়ে, একজনের হাতে পেন্সিল, আরেকজনের হাতে খাতা। নিচে লেখা: “একসাথে কিছু না বলেও, আমরা যেন কিছু গড়ে চলেছি।” অনিমেষের মন কেঁপে ওঠে। সে বুঝে যায়, তারা আস্তে আস্তে নিজেদের অজান্তেই এক গল্প লিখে ফেলছে, যা মোবাইল, ফোন, কিংবা একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার গল্প নয়—এ গল্প নিঃশব্দ দেখা হওয়ার, জানালার ধারে বসে একে অপরের অস্তিত্ব অনুভব করার।

তাদের এই সম্পর্ককে আজও কেউ স্পষ্টভাবে ভালোবাসা বলবে না, কিন্তু শহরের আকাশ যেন প্রতিদিন সেই ট্রামের জানালার কাচে আঙুল টেনে দিয়ে বলে—“তোমরা আছো, আমি জানি।” একদিন, যখন ট্রাম শ্যামবাজার ক্রস করে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকছে, শিখা অনিমেষকে হাতে তুলে দেয় তার সবচেয়ে প্রিয় স্কেচটি—একটা ট্রাম ভিতরে শুধু দু’জন মানুষ, একদিকে কবিতা, অন্যদিকে আঁকিবুঁকি। নিচে ছোট করে লেখা: “এই ট্রামটাই আমাদের পৃথিবী।” অনিমেষ সেই মুহূর্তে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, প্রথমবার সে শিখার চোখে চোখ রেখে বলে, “তুমি ছাড়া আমি আজকাল কিছুই লিখতে পারি না।” শিখা চমকে ওঠে, তারপর ধীরে হেসে মাথা নিচু করে বলে, “তুমি ছাড়া আজকাল আমি কিছু আঁকতেই পারি না।” আর শহরের ওপরে মেঘের ছায়া নামতে থাকে ধীরে ধীরে, যেন কলকাতা নিজেই সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায় এক নিষ্কলঙ্ক ভালোবাসার, যা জন্ম নিয়েছে ট্রামের জানালায়, কাগজের পাতায়, আর এক নীরব চাহনিতে।

পাঁচ

শীত ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে, শহরের গায়ে তখন বসন্তের হালকা রোদ, আর গন্ধে গন্ধে যেন অচেনা আগুন। অনিমেষের সকালগুলো ঠিক যেমনভাবে শুরু হতো, সেদিনও ঠিক তেমনই শুরু হয়েছিল—এক কাপ লাল চা, ছাপানো পত্রিকার ভাঁজে জড়িয়ে থাকা পুরনো খবর, আর ব্যাগে গুছিয়ে রাখা ছোট খাতা, যাতে আগের রাতের লেখার শেষে লেখা ছিল: “কাল সকালে তোমার চোখে বসন্ত দেখব।” সে ঠিক সময়মতো পৌঁছেছিল শ্যামবাজার ট্রামস্টপে, জানালার ধারের সেই নির্দিষ্ট আসন দখল করেছিল, আর চোখ রেখেছিল স্টপেজে, ঠিক যেখানে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে শিখা ওঠে। মিনিট কেটে যায়, তারপর আরও কিছুক্ষণ—ট্রাম ছেড়ে দেয়, কিন্তু শিখা ওঠে না। প্রথমদিন সে ভেবেছিল হয়তো অসুস্থ, হয়তো দেরি হয়ে গেছে, হয়তো অন্য কোনও কাজ এসে পড়েছে। কিন্তু পরের দিনও… আর তার পরের দিনও—সেই জানালা খালি পড়ে থাকে। শিখা নেই। ট্রামের ভিতর যেন শব্দ কমে যায়, শহর নিঃশব্দে থেমে থাকে অনিমেষের জন্য।

প্রথম ক’দিন অনিমেষ নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে, হয়তো সে অন্য রুটে যাচ্ছে, হয়তো কলেজে কাজ বেড়েছে। তারপর একদিন সে সাহস করে পৌঁছে যায় গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের সামনে—সেই লালরঙা বিল্ডিং, যেটা শিখার আঁকার মতোই নরম। কিন্তু কলেজে শিখার কোনও খোঁজ পায় না। এক অধ্যাপক জানান, “শিখা লাহা কিছুদিন আগেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছে—বাবা গুরুতর অসুস্থ, তাকে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে।” গ্রামের নাম জানা যায় না, ঠিকানাও নয়। শিখার দেওয়া শেষ চিঠিগুলো ঘেঁটে অনিমেষ কিছু সূত্র খোঁজে—কোনও স্কেচে কি লুকোনো ইঙ্গিত ছিল? কোনও শব্দে কি গ্রাম, পথ, নদীর নাম ছিল? কিন্তু না—শুধু অনুভব, আর নির্জনতা। সে সেই রুটের প্রতিটি ট্রাম ধরে, প্রতিটি জানালার পাশে বসে, যেন আবার হঠাৎ একদিন শিখা এসে দাঁড়াবে, একটা হাওয়ায় উড়ে আসা দোপাট্টা নিয়ে, আর সে বলবে, “আবার আঁকি?” কিন্তু না, জানালায় এখন কেবল পর্দার মতো ছায়া, আর শহরের কোলাহলের ভিতর থেকেও অনিমেষ শুনতে পায় নিজের হৃদপিণ্ডের একঘেয়ে নিঃসঙ্গতা।

তবু একদিন, ঠিক সেই জানালার পাশে বসে, অনিমেষ নিজের খাতা থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে লেখে, “তোমার না থাকার দিনগুলো আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে—ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয়, ভালোবাসা মানে কখনও কখনও অপেক্ষা করাও। আমি অপেক্ষা করছি, জানালার ধারে।” সে কাগজটা ভাঁজ করে একটা খামে রাখে, এবং পরদিন আর্ট কলেজের গেটে ছেড়ে আসে, পুরনো সেই সিকিউরিটির হাতে দিয়ে বলে, “একজন ছাত্রী ছিল এখানে—শিখা লাহা, যদি কোনওদিন ফেরে…” আর বাকিটা সে বলে না। শিকড় ছেঁড়া ভালোবাসা শহরের কোলাজে তখন আঁকা হয়ে গেছে—একটা জানালার পাশে বসে থাকা কবি আর এক অনুপস্থিত শিল্পীর নিঃশব্দ গল্প হয়ে।

ছয়

ফাল্গুন মাসের কলকাতা তখন আলোতে ভরা, কিন্তু অনিমেষের মনে কুয়াশা। জানালার ধারে বসে থাকা তার প্রতিদিনের ট্রাম এখন শুধুই এক চলন্ত কাঠামো, যার প্রতিটি কম্পনে সে খোঁজে শিখার অনুপস্থিতি। ট্রামের জানালার পাশ দিয়ে যতই ছুটে চলে কলেজ স্ট্রিটের ধুলো, হাতিবাগানের হকারদের হাঁকডাক, নিউ মার্কেটের গন্ধমাখা ভিড়—তার ভেতরে যেন সব কিছু থেকে ছিঁটকে গিয়েছে অনিমেষের হৃদয়। শিখা নেই, তার আঁকা নেই, চিঠি নেই, শুধুই ফেলে যাওয়া অপেক্ষা। ক’দিন তো ঠিক ছিল সব! সে লিখেছিল কবিতা, শিখা দিয়েছিল স্কেচ, জানালার ধারে বসে তারা গড়ে তুলেছিল এক নীরব জগৎ। আর এখন—শুধুই শুন্যতা। তাই একদিন, সকালবেলা ট্রামের বদলে সে হাঁটা দেয় ভবানীপুরের দিকে, শিখার আঁকা সেই পুরনো জানালাটা মনে রেখে।

শুরু হয় খোঁজ—প্রথমে আর্ট কলেজ, তারপর পাড়ার নাম, অলিগলি। সে যায় “লাহা বস্ত্রালয়”-এর দোকানে, যেখানে এক বৃদ্ধ বললেন, “ও শিখা? হ্যাঁ, ভবানীপুরেই ছিল, কিন্তু মাস দুয়েক হল বাবার শরীর খুব খারাপ, মেয়েটা উত্তর ২৪ পরগনার কোথাও ফিরে গেছে। ঠিকানা জানা নেই।” অনিমেষ বুঝে যায়, এত সহজে সে পৌঁছাতে পারবে না, তবু তার মন বাধ মানে না। সে পুরনো চিঠিগুলো ঘেঁটে খুঁজতে থাকে কোনো গ্রামের ইঙ্গিত—একবার মনে পড়ে, শিখা একবার লিখেছিল: “ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পেছনে সরু একটা খাল ছিল, যেখানে পদ্মফুল ফুটত। আমি সেখানেই প্রথম আঁকতে শিখেছিলাম।” অনিমেষ তারই সূত্র ধরে খোঁজ করে—নানান পরিচিতকে জিজ্ঞাসা করে—অবশেষে জানতে পারে একটি নাম—পানিহাটি। খাল, পদ্মফুল, পুরনো পুকুর, আর লাহা পদবির কিছু পরিবার।

সপ্তাহখানেকের মধ্যে এক সকালে সে পৌঁছে যায় পানিহাটি। সেখানকার সরু রাস্তায়, খড়ের গন্ধমাখা বাতাসে, সে খোঁজে শিখার শৈশব। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এক কাঁচা বাড়ির কথা—এক বৃদ্ধ লোক বহুদিন শয্যাশায়ী, তার মেয়ে মাঝে মাঝে শহর থেকে আসে। অনিমেষ পৌঁছে যায় সেই বাড়ির সামনে—ঘাসে ঢাকা উঠোন, পেছনে সত্যিকারের একটা খাল, আর জানালার পাশে শুকাতে দেওয়া কিছু ক্যানভাস কাপড়। দরজা খোলা, ভিতর থেকে ভেসে আসছে পুরনো হারমোনিয়ামের শব্দ। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ঠিক সেই সময় দরজার পাশে এসে দাঁড়ায় এক চেনা মুখ—শিখা, ছেঁড়া সাদা সালোয়ারে, মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে সেই পুরনো আলো। তাকিয়ে থাকে অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “তুমি এতদূর এসেছো?” অনিমেষ বলে না, কিন্তু চোখে জানিয়ে দেয়—এই খোঁজটাই ছিল তার বেঁচে থাকা। শিখা ধীরে এসে বলে, “বাবা… ভালো নেই। সব ফেলে চলে এসেছিলাম। ট্রামটা ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু জানালার ধারে বসে থাকা তুমি, আমার আঁকা তুমি… রেখে যেতে পারিনি।” আর অনিমেষ বুঝে যায়, এই ভালোবাসা শুধু শহরের রুটিন নয়, এটা হারিয়ে গেলেও আবার খুঁজে পাওয়ার নাম।

সাত

টানা তিন সপ্তাহ কেটে গেছে শিখাকে ছাড়া। প্রতিটি সন্ধ্যায় অনিমেষ এখনও শিয়ালদহ স্টেশনের সেই পুরোনো ট্রামস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে একদিন দু’জন একসঙ্গে ট্রামের জানালায় ভেসে যাওয়া আলোয় নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিল। হঠাৎ হঠাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামে, আর তাতে ভিজে যায় তার খাতা—যেখানে সে এখনও লিখে রাখে শিখার জন্য চিঠি, ঠিক সেই পুরোনো কালি কলমে। তার চোখ আজকাল আর ট্রাম নয়, খোঁজে শুধু সেই ছায়া—সাদা ওড়নায় আবৃত, চোখে বিনীত নীরবতা, আর ম্লান হেসে যাওয়া মুখ, যেন কলকাতার ট্রামের জানালার বাইরে এক চিরন্তন অপেক্ষা। বন্ধু সায়ন্তন চেপে বসেছে—“এই পাগলামি থামা দরকার তো! যদি কোনোদিন ফেরেই না আসে?” কিন্তু অনিমেষ জানে, কিছু মানুষ ফেরে না ঠিকই, কিন্তু ফেলে যাওয়া শব্দেরা ফেরে, ট্রামের ধাতব ঘর্ঘর শব্দে, কন্ডাক্টরের চিৎকারে, অথবা বিকেলের শেষ আলোয় ট্রামের জানালায় পড়ে থাকা একজোড়া চোখের মায়ায়।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায়, হঠাৎ করে সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠল স্টেশন চত্বর। নীলচে কুয়াশার মাঝে ট্রাম থামল, আর নামল এক মেয়ে, ম্লান-সাদা শাড়ি, হাতে একটি বই—‘কবিতা সংগ্রহ – জীবনানন্দ’। অনিমেষ তাকাল, আর আবার তাকাল। মেয়েটি হাঁটছিল ধীরে, যেন চেনা পথ ধরে, অথচ চোখে ছিল এক অচেনা ধাঁধা। অনিমেষ ছুটে গেল, বুকের মধ্যে ঢেউ ওঠে, গলা শুকিয়ে যায়, কিন্তু গিয়ে দেখে—সে শিখা নয়। বুকের ভিতর সেই পুরোনো ঢেউ থেমে যায়, যেমন থেমে যায় রাতের শেষ ট্রাম। সে বইয়ের নাম দেখে হতবাক—এই বইটি তো সেই, যা শিখা একদিন পড়ছিল, ট্রামের জানালায় ঝুঁকে। শিখা কি তবে এখানে এসেছিল? বইটি তারই হতে পারে? সে ছুটে যায় মেয়েটির পিছু, জিজ্ঞাসা করে—“এই বইটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?” মেয়েটি বলে, “ওটা আমি নিউ মার্কেটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনেছি, গত সপ্তাহে। এর ভেতরে একটা চিঠি ছিল…” চিঠি! অনিমেষের চোখে আলো জ্বলে ওঠে।

চিঠিটা খুলে মেয়েটি তুলে দেয় অনিমেষের হাতে। কাগজটা পীতাভ হয়ে গেছে, কালি হালকা, কিন্তু শব্দগুলো এখনও স্পষ্ট—“তুমি যদি কোনোদিন না পাও, জানবে আমি সেই জানালার পাশে এখনো বসে আছি, প্রতিদিন। তুমি যেদিন ছেড়ে গেলে, আমি সেদিন বুঝলাম ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয়—ভালোবাসা মানে অপেক্ষা।” অনিমেষ বুঝে যায়—শিখা ফিরেছিল, কোনোভাবে, কোনোভাবে সে জানত যে অনিমেষ অপেক্ষা করছে। সেই ট্রামের জানালা, সেই কলকাতার সন্ধ্যে, সেই হারানো শব্দেরা—সব যেন একসঙ্গে ফিরে আসে। অথচ শিখা কোথায় গেছে, কেন গিয়েছিল—তা জানা হয় না। কেবল এই চিঠি, এই অপেক্ষা, আর জানালায় আটকে থাকা অতীতের ভালোবাসা—এই দিয়েই আবার শুরু হয় নতুন সন্ধ্যা, নতুন ট্রাম, আর নতুন করে চোখে দেখা কলকাতা।

আট

টানা তিন মাস হয়ে গেল—শিখার কোনো খোঁজ নেই। সেই সকালবেলার ট্রামগুলো, মোহরকুঞ্জের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নির্দিষ্ট সিট, আরেকজন ভ্রমণকারী যাত্রীর মতো হয়ে গেছে—নীরব, অনুপস্থিত, অনুপলব্ধ। অনিমেষ এখন আর ঠিকমতো ঘুমোতে পারে না। পত্রিকায় চোখ রাখে না, রেডিও ছাড়ে না, এমনকি ডালহাউসি অফিসের কাজের মাঝে সে বারবার ছাদে উঠে আসছে, যেন কোথাও থেকে কেউ ডাক দেবে। মেসে ফিরে আর কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে না—সবাই বুঝতে পারে, ছেলেটা যেন ট্রামের জানালায় কাউকে রেখে এসেছে। এক দুপুরে সে হঠাৎ ঠিক করল—যতদিন না সে শিখাকে খুঁজে পাচ্ছে, ততদিন অবসরের সময় সে একের পর এক ট্রামে উঠবে, একের পর এক পথ ধরবে, এমনকি ট্রামলাইন ছেড়ে গলিপথেও হাঁটবে, যদি কোনো সন্ধান পাওয়া যায়। এই পাগলামির মধ্যে একদিন কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার চোখে পড়ল একটা খাম—পুরনো টাইপ করা ঠিকানার পাশে ছোট্ট করে তার নাম লেখা: “অনিমেষ দত্ত, কেয়ার অব ত্রিপুরা লজ, কলেজ স্ট্রিট।” বুকের ভিতরটা কেমন থমকে গেল। হাতে নিয়ে সে দেখল—চিঠিটা যেন বহুদিন আগেই রাখা হয়েছে, তার কাগজ হলুদ, কালি কিছুটা ঝাপসা। কোনো প্রেরকের নাম নেই। চিঠি খুলে পড়তেই সে থমকে গেল।

চিঠির কাগজে ছিল শিখার লেখা—চেনা, নরম হস্তাক্ষর। “অনিমেষ, জানি হঠাৎ হারিয়ে গেছি। তোমার অপেক্ষার কাছে আমি অপরাধী। কিন্তু তোমার চোখের সেই এক মুহূর্তের চাহনি, যে কথা কখনো ভাষায় বলিনি, সেটাই আমার কাছে একটা প্রতিশ্রুতি হয়ে উঠেছিল। আমি জেনেছিলাম, তুমিই হয়তো একমাত্র, যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু সেই সময় আমার জীবনে কিছু এমন দায়িত্ব এসেছিল যা আমি অস্বীকার করতে পারিনি। মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর আমার বোন—যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেটা ভেঙে গেল। আমাদের সংসারটা যেন ভেঙে পড়েছিল আমার কাঁধে। ট্রাম ধরার সময়টাই তখন কাটত হসপিটাল আর বাজারের দৌড়ে। জানি, এ কোনো কৈফিয়ত নয়। কিন্তু সেই ট্রামের জানালায় তোমার মুখ, সেই নীরবতার ভালোবাসা, আমি ভুলতে পারিনি। বহুদিন ধরেই তোমাকে লিখতে চেয়েছি। এই চিঠি, যদি কোনোভাবে তোমার হাতে পৌঁছয়, যদি সময় তোমার মনকে নরম রাখে, তাহলে তুমি যদি একদিন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে, সেই পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়াও—আমিও সেখানে থাকব। ১২ই আগস্ট, বিকেল চারটে। যদি তুমি আসো… আমি বুঝব, তুমি এখনো বিশ্বাস করো ট্রামের জানালার সেই ভালোবাসায়।” অনিমেষ আর অপেক্ষা করল না—সরাসরি সেই দিন, সেই সময়, সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। দোকানের কাঁচে প্রতিফলিত নিজের মুখ দেখল—কয়েকটা দিন যেন তাকে বুড়িয়ে দিয়েছে। চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আর তখনই সে দেখল—দোকানের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শিখা। একদম সেই রকমই, শুধু চোখে একটু ক্লান্তি, একটুখানি কাঁচের চশমা, কিন্তু সেই চাহনি—যেটা শুধুই অনিমেষকে খোঁজে। শিখা এগিয়ে এল, ধীরে ধীরে, যেন পেছনের সমস্ত দিনগুলো তাদের মধ্যে একটা নীরব সেতু গড়ে দিচ্ছে। “তুমি এসেছ,” বলে শিখা থেমে গেল। অনিমেষ শুধু বলল, “তোমার চিঠিটা পেয়েছি। একটু দেরি করে। কিন্তু ভালোবাসা কি কখনও দেরি মানে?” তারা দুজন হাঁটতে লাগল—এই কলকাতার গলিপথ ধরে, ট্রামের ঘণ্টাধ্বনির নিচে, যেন আবার একবার শুরু হচ্ছে সেই পুরনো প্রেম—মোবাইলবিহীন, শব্দবিহীন, কেবল হৃদয় দিয়ে লেখা, ট্রামের জানালায় দেখা সেই ভালোবাসা।

শেষ

1000043320.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *