Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

ট্রাফিক সিগন্যালের মেয়ে

Spread the love

সৌমিক হালদার


এক

কলকাতার শহরটা যেন প্রতিদিনই নিজের মতো এক নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ততা, রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, ফুটপাতের দোকানদারদের হাঁকডাক, হাওড়া-ব্রিজ থেকে পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত প্রতিটি রাস্তায় শহরের নিজস্ব ছন্দ ছড়িয়ে থাকে। এমনই এক ব্যস্ত মোড়, যেখানে চারপাশের গাড়ির ভিড়, ঠেলাগাড়ির ধাক্কাধাক্কি, ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির শব্দ আর মানুষের ভিড় একসাথে মিশে গিয়ে তৈরি করে এক অসহ্য কোলাহল। ট্যাক্সিচালক রাহুল প্রতিদিনই এই মোড় পেরোয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর—তার জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে এই মোড়। কিন্তু প্রতিদিনই সে লক্ষ্য করতে শুরু করে এক অদ্ভুত কিশোরী মেয়েকে। মেয়েটি কখনো ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো বা লাল সিগন্যাল জ্বাললেই হেসে ওঠে। রাহুলের কাছে প্রথমে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। হয়তো সাধারণ কোনো মেয়ে, হয়তো ফুল বিক্রেতা, যে জীবিকার টানে প্রতিদিন একই জায়গায় দাঁড়ায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তার চোখে ধরা পড়ে মেয়েটির মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি, এমন এক হাসি যা শহরের কোলাহলের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

সেই হাসির মধ্যে ছিল এক অচেনা ছোঁয়া, যেন শহরের এই অন্ধকারমাখা ব্যস্ততার মধ্যেও সে আলাদা। রাহুল যতবার ওই মোড় দিয়ে যেত, লাল আলো জ্বলে উঠলেই মেয়েটি হেসে উঠত, আর তার দৃষ্টি যেন ভেদ করে চলে যেত মানুষের অন্তরাল পর্যন্ত। আশেপাশের লোকেরা যদিও তাকে দেখে, তবু তার উপস্থিতি নিয়ে কেউ কোনো আলোচনা করত না, কেউ কৌতূহল প্রকাশ করত না। এটা রাহুলকে আরও বিস্মিত করত। যদি সে সত্যিই প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে অন্য কেউ তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না কেন? ফুটপাথের চায়ের দোকানদার, সিগারেটওয়ালা কিংবা হকার—কেউই যেন ওর উপস্থিতিকে আলাদা করে টের পাচ্ছে না। একদিন, লাল আলোতে আটকে থাকতে থাকতে রাহুলের চোখে পড়ে, মেয়েটি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ফুল বিক্রি করার কোনো তাড়া নেই। শহরের অন্য ফুলওয়ালিদের মতো গলা ফাটিয়ে ডাকছে না, কিংবা গ্রাহকের হাতে ফুল গুঁজে দিচ্ছে না। শুধু দাঁড়িয়ে আছে, আর হালকা ম্লান আলোয় তার মুখে ফুটে উঠছে সেই অদ্ভুত হাসি।

রাহুল প্রথমে নিজের মনে মনে উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। হয়তো সে কেবল কাকতালীয়ভাবে লক্ষ্য করছে, হয়তো তারই মনের ভুল। কিন্তু যতবার সে ট্রাফিক সিগন্যালের ওই মোড়ে দাঁড়াল, ততবারই মেয়েটিকে দেখতে পেল একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। একদিন আবারো রাহুলের চোখে ধরা পড়ল, মেয়েটির চোখ যেন সরাসরি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কোলাহলের মধ্যে যেন এক মুহূর্তে সবকিছু থেমে গেল, গাড়ির হর্ণ, মানুষের হাঁকডাক—সবকিছু যেন মিইয়ে গেল। রাহুলের মনে হলো, মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা আছে, যেন সেগুলো কোনো অজানা কাহিনির ভেতরে তাকে টেনে নিতে চাইছে। আর সেই দৃষ্টি থেকে পালানো সম্ভব নয়। অজান্তেই রাহুল শিউরে উঠল, তার আঙুলে হালকা কাঁপুনি খেলে গেল, অথচ মেয়েটির মুখে এখনো সেই একই হাসি খেলে যাচ্ছে। এক অচেনা প্রশ্ন রাহুলের মাথায় ভর করল—এই মেয়েটি কে? কীভাবে সে প্রতিদিন একইভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে?

কয়েকদিন পর রাহুল সিদ্ধান্ত নিল, আর চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। একদিন লাল আলো জ্বলতেই সে তার ট্যাক্সি সাইডে দাঁড় করাল এবং মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকাল। মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কিছু গাঁদা ফুল, মুখে সেই অদ্ভুত হাসি। হঠাৎ তার মনে হলো, এই হাসি কোনো সাধারণ মানুষের হাসি নয়—এতে যেন দুঃখ আর শান্তির অদ্ভুত এক মিশ্রণ লুকিয়ে আছে। রাহুল লক্ষ্য করল, মেয়েটির চারপাশে দাঁড়ানো মানুষজন কেউই তাকে খেয়াল করছে না। যেন তার অস্তিত্ব শুধুই রাহুলের দৃষ্টির ভেতর সীমাবদ্ধ। শহরের ব্যস্ততম মোড়ে, ভিড় আর কোলাহলের মধ্যে, রাহুল বুঝতে পারল—এই মেয়েটি সাধারণ কেউ নয়। তার উপস্থিতি যেন এক রহস্যময় আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই রাহুলের মনে হলো, এই গল্পটা তাকে টেনে নিয়ে যাবে এমন এক পথে, যেখানে আর ফিরে আসা সহজ হবে না।

দুই

কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিনই কত দৃশ্য চোখে পড়ে, কিন্তু সেদিন রাহুলের চোখে যে দৃশ্য ধরা দিল, তা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। বিকেলের ভিড়ভাট্টার সময়, চারদিক গাড়ির হর্ন আর মানুষের চিৎকারে ভরে গেছে, অথচ সেই বিশৃঙ্খলার মাঝেই মেয়েটিকে সে দেখে ফুল বিক্রি করতে। হাতে গাঁদা আর টগর ফুলের মালা, কাপড়ে সাদামাটা ময়লা লেগে থাকা শাড়ি, কিন্তু তার চেহারায় কোনো ভিক্ষুকসুলভ ভাব নেই। বরং তার ভঙ্গিমা ছিল শান্ত, নির্লিপ্ত—যেন সে অন্যদের মতো রোজগারের জন্য নয়, বরং কোনো অদৃশ্য কারণে দাঁড়িয়ে আছে। রাহুল দূর থেকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝল, মেয়েটি শুধু মাঝে মাঝে পথচারীদের হাতে ফুল তুলে দিচ্ছে, কিন্তু দাম চাইছে না। কেউ যদি পয়সা দেয়, সে নিচ্ছে, না দিলে কিছু যায় আসে না। আর সব সময় মুখে সেই অদ্ভুত হাসি—যেন পৃথিবীর কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এক রহস্যময় প্রশান্তি লুকিয়ে আছে তাতে। সেই হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিষাদের রেখা রাহুলকে আরও অস্থির করে তুলল। এটা কি শুধু তারই চোখে ধরা পড়ছে, নাকি আসলেই মেয়েটির অস্তিত্বের মধ্যে এমন অদ্ভুত দ্বৈততা আছে?

রাহুলের মনে কৌতূহল জন্মাল—এ মেয়ে কে? কেন এভাবে ফুল বিক্রি করছে? তার আচরণ কেন অন্যদের মতো নয়? কয়েক মুহূর্ত ভেবে রাহুল সিদ্ধান্ত নিল, আজ আর দূর থেকে তাকিয়ে থাকবে না। সিগন্যাল লাল হয়ে আসতেই সে গাড়ি সাইডে টেনে দাঁড়াল। মেয়েটি তখন ফুটপাথের এক কোণে দাঁড়িয়ে, হাতে গাঁদা ফুলের মালা। রাহুল ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ফুল কত করে দিচ্ছো?” মেয়েটি তাকাল তার দিকে, চোখের দৃষ্টি একেবারেই ভিন্নরকম। কোনো সাধারণ বেচাকেনার ইশারা নেই, বরং যেন দৃষ্টি ভেদ করে তার অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তারপর মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, “আপনি চাইলে নিন, না চাইলে থাক। ফুলের দাম কি আর সবসময় টাকা দিয়ে হয়?” সেই অদ্ভুত উত্তর শুনে রাহুল প্রথমে হতবাক হয়ে গেল। কলকাতার ফুটপাথের ব্যবসায়ীরা যেখানে প্রতিটি জিনিসের জন্য হাঁকডাক করে, দামাদামি করে, সেখানে এই মেয়ে যেন সেইসব নিয়মের বাইরে। তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, আর চোখে এমন এক গভীরতা, যেন সে অনেক দূরের কোনো গল্প বয়ে নিয়ে এসেছে।

রাহুল এবার সত্যিই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। “তুমি কি রোজ এখানে থাকো?” সে প্রশ্ন করল। মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, লাল আলো জ্বললেই তো আমি এখানে থাকি।” কথাটা শুনে রাহুলের বুকের ভেতর কেমন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এ কেমন উত্তর? এর মানে কী? সে কি শুধু সিগন্যাল লাল হলেই উপস্থিত হয়? নাকি কথাটা কোনো রূপক? রাহুল বুঝতে পারছিল না, তবে মেয়েটির মুখে সেই রহস্যময় শান্তি দেখে মনে হচ্ছিল, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো অজানা কাহিনি। সে লক্ষ্য করল, আশেপাশে দাঁড়ানো লোকজন কেউই তাদের কথোপকথনে কৌতূহল দেখাচ্ছে না। যেন অন্য কেউ মেয়েটিকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না, অথচ সে যে এখানে আছে, তা রাহুলের চোখে একেবারে স্পষ্ট। কিছুক্ষণ পর সিগন্যাল সবুজ হতেই মেয়েটি ধীরে ধীরে পেছনে সরে গেল। রাহুল গাড়ি চালিয়ে দিলেও তার মনে রয়ে গেল এক অজানা প্রশ্ন—মেয়েটির এই অদ্ভুত উপস্থিতি কেবল তার চোখেই ধরা দিচ্ছে, নাকি পুরো শহরেরই অলক্ষ্য কোনো রহস্য?

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে রাহুল অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগল। শহরের হাজারো মুখ সে প্রতিদিন দেখে, কিন্তু এমন একটা উপস্থিতি আগে কখনো তার নজরে পড়েনি। মেয়েটির হাসিতে যে অদ্ভুত বিষাদ লুকিয়ে ছিল, তা তার মনের গভীরে গেঁথে গেল। মনে হচ্ছিল, মেয়েটি কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করছে না। হয়তো তার হাসির আড়ালেই আছে এক অপূর্ণ ইতিহাস, হয়তো সে এমন এক জীবনের অংশ, যা মাঝপথেই থেমে গেছে। আর সেই থেমে যাওয়া গল্পের ভার যেন তার অস্তিত্বকে বেঁধে রেখেছে ওই সিগন্যালের ধারে। রাহুল অনুভব করল, এ রহস্যের ভেতরে পা রাখলে হয়তো তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। কিন্তু তবুও, সে আর থেমে থাকতে পারল না। একবার যার চোখে মেয়েটির সেই অদ্ভুত হাসি ধরা দিয়েছে, সে আর তা এড়িয়ে যেতে পারে না। সেই মুহূর্ত থেকে রাহুল জানল, এই মেয়েটির সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে—এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছে দু’জন। আর এই বাঁধন ভেঙে বেরোনো সহজ হবে না।

তিন

কলকাতার আকাশে সেদিন সন্ধ্যার রঙ ধীরে ধীরে গাঢ় হতে শুরু করেছে। রাস্তার আলো জ্বলে উঠছে, মোড়ের চারপাশে ভিড় জমেছে, আর সেই পুরোনো সিগন্যাল লাল হয়ে থেমে আছে। গাড়ির হর্ন, লোকজনের চেঁচামেচি, ফুচকার গন্ধ আর ভ্যাপসা গরমে যেন সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠেছে। রাহুল সেদিন অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব করছিল, মনে হচ্ছিল আজ কিছু একটা ঘটবেই। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে সে আবার মেয়েটিকে লক্ষ্য করল। মেয়েটি আগের মতোই ফুটপাথের কোণে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কিছু ফুলের মালা, আর ঠোঁটে সেই পরিচিত রহস্যময় হাসি। রাহুলের বুকের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত শিহরণ হলো। হঠাৎ মেয়েটির চোখ সরাসরি তার দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত টান। সিগন্যাল তখনও লাল, তাই সময় কাটাতে রাহুল জানলা নামিয়ে ডাক দিল, “চলো, বসো গাড়িতে। তোমায় যদি কোথাও নামিয়ে দিতে হয়।” আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যেই মাথা নাড়ল, আর পায়ের নরম শব্দে এসে গাড়ির দরজা খুলে বসল। ঠিক যেন সে অপেক্ষাই করছিল এই আমন্ত্রণের জন্য। রাহুল অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। তার মুখে আগের মতোই শান্ত হাসি, কিন্তু চোখে যেন এক গভীর শূন্যতা ভাসছে। “ধন্যবাদ,” মৃদু স্বরে বলল মেয়েটি।

মেয়েটির গাড়িতে ওঠার মুহূর্ত থেকেই রাহুলের মনে হলো, ট্যাক্সির ভেতরের পরিবেশ যেন হঠাৎ বদলে গেছে। এত ভিড় আর কোলাহলময় শহরের মাঝখানে থেকেও গাড়ির ভেতরে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। জানলার বাইরের গাড়ির হর্ন আর লোকজনের আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে, কেবল একটা ঠান্ডা বাতাসের মতো ছায়া ভাসছে ভেতরে। রাহুল হালকা গলাটা পরিষ্কার করে বলল, “তুমি কোথায় যাবে?” মেয়েটি একটু হাসল, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।” উত্তরে কোনো ঠিকানা নেই, কোনো গন্তব্য নেই—শুধু এক অস্পষ্ট বাক্য। রাহুল প্রথমে ভেবেছিল হয়তো সে মজা করছে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কোনো খুনসুটি বা খেলার ভাব নেই, বরং একেবারে গম্ভীর। গাড়ির ভেতরে সে একেবারেই স্পর্শযোগ্য মনে হচ্ছিল না—যেন তার শরীর আছে, অথচ নেই। রাহুল স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরল। হঠাৎ এক অদ্ভুত শীতলতা তার শরীর বেয়ে নেমে এলো, এমন শীত যা কোনো এসি চালিয়েও আসে না। সে অনুভব করল, এই মুহূর্তে তার যাত্রী যেন কোনো মাংস আর রক্তের মানুষ নয়, বরং অন্য এক স্তরের অস্তিত্ব।

গাড়ি চলতে শুরু করলে রাহুল বারবার রিয়ারভিউ মিররে তাকাতে লাগল। প্রতিবারই সে দেখল মেয়েটি বসে আছে, জানলার বাইরে তাকিয়ে। তার চোখে কোনো কৌতূহল নেই, কোনো ক্লান্তি নেই—শুধু শূন্য দৃষ্টি, যেন সময়ের স্রোতের বাইরে কোথাও ভেসে আছে। মাঝে মাঝে রাহুল মনে করল, সে যদি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে স্পর্শ করতে চায়, তবে হয়তো হাত কেবল শূন্যতাকেই ছুঁয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটির মুখে সেই মায়ামাখা হাসি ঠিকই রয়ে গেছে। হঠাৎ রাহুলের মনে হলো, গাড়ির ভেতরে গন্ধের পরিবর্তন হয়েছে—একটা পুরনো ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন অনেক দিন আগে শুকিয়ে যাওয়া মালার সুগন্ধ। সে নিজের অজান্তেই কাঁধ শক্ত করে নিল, কিন্তু কিছু বলল না। কয়েক মিনিট পর সাহস সঞ্চয় করে সে আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখানকারই? রোজ তোকে এই সিগন্যালেই দেখি।” মেয়েটি এবার ধীরে মুখ ফেরাল। তার চোখে কোনো উত্তর ছিল না, শুধু ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমি তো এখানেই থাকি… আলো জ্বলার অপেক্ষায়।” কথাটা শেষ করে সে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। রাহুলের বুক কেঁপে উঠল। আলো জ্বলার অপেক্ষা মানে কী? কোন আলো? ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলো? নাকি অন্য কোনো ভিন্ন আলো?

রাস্তা চলতে চলতে রাহুল অনুভব করল, গাড়ির কাঁচে শহরের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, কিন্তু মেয়েটির শরীর যেন তেমনভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এমনকি একবার মিররে তাকিয়ে সে মনে করল, মেয়েটির অবয়ব যেন আধা-স্বচ্ছ হয়ে গেছে, ঠিক যেন কুয়াশার মধ্যে বসে আছে। তার মনে হলো, সে এখন যাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে হয়তো মাটির জগতের নয়। গাঢ় ভয়ের স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে এলো, অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে চুপ করে থাকতে বাধ্য করল। সে জানে, এই যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সহজ নয়। ট্যাক্সি তখন এক সরু গলির দিকে মোড় নিল, বাইরের ভিড় কমতে শুরু করেছে। রাহুলের মনে হচ্ছিল গাড়ির ভেতরের সময় যেন থমকে আছে। মেয়েটি তখনও একই ভঙ্গিতে বসে, বাইরের দিকে তাকিয়ে, আর তার ঠোঁটে লেগে আছে সেই অদ্ভুত হাসি। ঠিক সেই মুহূর্তে রাহুল উপলব্ধি করল—এই লিফট শুধু এক সাধারণ যাত্রা নয়, বরং এক অজানা যাত্রার সূচনা, যেখানে মাটির মানুষ আর ছায়ার জগতের সীমারেখা মিলেমিশে গেছে।

চার

গাড়ির ভেতরের শূন্য নীরবতা ভাঙতে রাহুল সাহস করে ধীরে ধীরে কথোপকথন শুরু করল। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ট্যাক্সি চলছে, কিন্তু তার কানে কোনো হর্নের শব্দ ভেসে আসছিল না—শুধু পাশের সিটে বসে থাকা মেয়েটির নিঃশব্দ উপস্থিতি যেন পুরো পরিবেশ দখল করে নিয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় থাকো?” মেয়েটি উত্তর দিল না সঙ্গে সঙ্গে। কয়েক সেকেন্ড থেমে যেন অতীতের কোনো অদৃশ্য দিগন্তে তাকাল, তারপর মৃদু স্বরে বলল, “আমি তো এই শহরেই থাকি… রাস্তায়, আলো যেখানে থামে।” তার কণ্ঠে কোনো ব্যাখ্যা ছিল না, বরং এক অদ্ভুত মায়া আর বিষাদের মিশ্রণ। রাহুল একটু ভড়কে গেলেও আবার বলল, “তোমার বাড়ি নেই?” মেয়েটির চোখে হঠাৎ গভীর এক ছায়া নেমে এলো, তারপরও সে হাসল। সেই হাসি ছিল না মাটির মানুষের হাসি, বরং স্মৃতির গহ্বর থেকে উঠে আসা কোনো ভিন্ন জগতের অভিব্যক্তি। “বাড়ি…” সে পুনরাবৃত্তি করল, “ছিল… এখন নেই।” কথাটুকু শোনার পর রাহুলের ভেতর কেমন ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল। মনে হলো, তার প্রতিটি বাক্য আসলে কোনো পুরনো ঘটনার আভাস, যা এখনও শহরের বুকের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রাহুল তখন মেয়েটির দিক থেকে দৃষ্টি সরাতে পারল না। তার চোখে যে ঝিলিক, তা যেন একসঙ্গে দুটি দুনিয়ার দরজা খুলে রাখছে। একদিকে জীবিত মানুষের স্মৃতি, অন্যদিকে অদৃশ্য মৃত্যুর ইতিহাস। রাহুল বলল, “তুমি এখানে কতদিন ধরে আছ?” মেয়েটি ধীরে উত্তর দিল, “দিনগণনা কি আর আমার আছে? শুধু লাল আলো জ্বলে উঠলেই আমি আবার ফিরে আসি।” কথাটা শুনে রাহুলের বুক কেঁপে উঠল। সে কি বলতে চাইছে যে তার অস্তিত্ব কেবল সিগন্যালের আলো জ্বলার সঙ্গে বাঁধা? এর মানে কী হতে পারে? শহরের মানুষের কাছে প্রতিদিনের ব্যস্ততা, অথচ এই মেয়েটির কাছে প্রতিটি লাল সিগন্যাল যেন কোনো পুরনো ঘটনার দাগ। রাহুল একসময় খবরের কাগজে পড়া কিছু দুর্ঘটনার কথা মনে করার চেষ্টা করল—এই মোড়েই তো প্রায়শই ঘটে নানা ভয়াবহ দুর্ঘটনা। হয়তো কোনো একদিন, কোনো ভয়ঙ্কর সন্ধ্যায়, এই মেয়েটিও এমন কোনো ঘটনার শিকার হয়েছিল। তার শরীর এখন নেই, কিন্তু স্মৃতি আটকে আছে ঠিক এই মোড়েই। রাহুলের গলাটা শুকিয়ে এলো।

মেয়েটি হঠাৎ জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে কিছু দেখাল। রাস্তার ধারে দাঁড়ানো একটা পুরনো বৈদ্যুতিক খুঁটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “ওখানেই প্রথমবার আমি বুঝেছিলাম আলো কেমন নিষ্ঠুর হতে পারে।” রাহুল চমকে তাকাল। পুরনো খুঁটিটিতে কিছু রঙচটা পোস্টার সেঁটে আছে, আর এক পাশে শুকিয়ে যাওয়া মালার টুকরো আটকে রয়েছে। যেন কারও স্মৃতিতে শোক জানিয়ে রাখা হয়েছিল কোনো এক সময়। রাহুলের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেল—এ কি সেই জায়গা, যেখানে মেয়েটির জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল? সে বলতে পারল না, তবে মেয়েটির চোখে তখন এমন এক দৃঢ় দৃষ্টি, যা মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে। রাহুল মনে করতে লাগল, হয়তো সে কোনো এক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, যেখানে ট্রাফিক সিগন্যালের আলোই তার মৃত্যুর শেষ সাক্ষী ছিল। তার উপস্থিতি তাই মাটির মানুষের মতো নয়, বরং এক অসমাপ্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি হাসির ভেতরে সেই শেষ মুহূর্তের বিষাদ গোপন করে রেখেছে।

গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল, আর রাহুলের মনে হচ্ছিল এই কথোপকথনের প্রতিটি শব্দ যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতল গভীরতায়। মেয়েটি হঠাৎ বলল, “মানুষ ভাবে শহরটা শুধু ভিড় আর শব্দে ভরা। কিন্তু আমি জানি শহরের প্রতিটি মোড়ে কত গল্প লুকিয়ে আছে। কত আলো, কত মৃত্যু, কত অপেক্ষা।” তার কণ্ঠে এমন এক নিশ্চিততা ছিল যে, রাহুলের আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। সে শুধু অনুভব করল—মেয়েটির চোখে যে ভিন্ন দুনিয়ার আভাস, তা কেবল কোনো স্মৃতির নয়, বরং সেই স্মৃতির সঙ্গেই বাঁধা ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সাক্ষ্য। এই ট্যাক্সির যাত্রী যে শুধু মাংস-রক্তের মানুষ নয়, তা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। রাহুল জানত, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না—কারণ সে এমন এক স্মৃতির ছায়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে, যা এই শহরের বাতাসের মতোই চিরস্থায়ী।

পাঁচ

রাহুলের মনে সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। সেদিন রাতে ট্যাক্সি খালি ফেরার পরেও তার মস্তিষ্কে বারবার ঘুরছিল মেয়েটির কণ্ঠস্বর, সেই অদ্ভুত হাসি আর ফুটপাথের ধারে শুকনো ফুলের মালা। এক অজানা টান তাকে আবার সেই মোড়ের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ভোরের শহর তখনও ঘুমঘুম, রাস্তায় গুটিকতক মানুষ, ফুটপাথের ধারে চায়ের দোকান খোলার তোড়জোড় চলছে। রাহুল এক বৃদ্ধ চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, “এই মোড়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল আগে?” বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ বাবু, বছর খানেক আগে এক মেয়ের প্রাণ গিয়েছিল ঠিক এই সিগন্যালের সামনে। গরিব ঘরের মেয়ে ছিল, ফুল বিক্রি করত। হঠাৎ এক ট্রাক সিগন্যাল ভেঙে ঢুকে পড়ে, মেয়েটা বাঁচল না।” কথাগুলো যেন রাহুলের শরীরে বিদ্যুতের মতো আঘাত করল। তার কানে তখন ভেসে উঠছিল সেই পরিচিত গলা—“আমি তো এখানেই থাকি… আলো জ্বলার অপেক্ষায়।” এই উত্তর কি তবে মৃত্যুর পরও থেকে যাওয়া আত্মার ফিসফিসানি ছিল? তার চারপাশে সকালবেলার হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, অথচ রাহুলের মনে হচ্ছিল সে অন্ধকারের গভীরে ডুবে যাচ্ছে।

চা-ওয়ালার সঙ্গে কথা শেষ করে রাহুল আরেকটু দূরে গেল, যেখানে সেই পুরনো বৈদ্যুতিক খুঁটিতে মালার শুকনো টুকরো ঝুলছিল। কাছে গিয়ে সে লক্ষ্য করল খুঁটির গায়ে ফিকে হয়ে যাওয়া সাদা কাগজ আটকে আছে—একসময় হয়তো সেখানে কোনো পোস্টার টাঙানো হয়েছিল, দুর্ঘটনার খবর অথবা শোকবার্তা। হাত বুলিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে যেন রাহুলের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল এই শহরের অসংখ্য মানুষ হয়তো এই ঘটনার খবর পড়ে ভুলে গেছে, কিন্তু ওই মেয়েটির আত্মা তা ভুলতে পারেনি। প্রতিটি লাল আলো, প্রতিটি থেমে থাকা গাড়ি, প্রতিটি যাত্রীর মাঝে সে এখনও দাঁড়িয়ে থাকে, যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। রাহুলের বুকের ভেতর শূন্যতার সঙ্গে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা জমে উঠল। সে ভাবল, কেন তার সঙ্গেই মেয়েটির দেখা হলো? হয়তো সেও ছিল সেই মোড়ের প্রতিদিনের চালক, যে অজান্তে এক মৃত স্মৃতির সাক্ষী হয়ে গেছে।

রাহুলের মনে পড়ল, যখন সে মেয়েটিকে ট্যাক্সিতে তুলেছিল, তখন সে ঠিকানার বদলে বলেছিল, “তুমি যেখানে নিয়ে যাবে।” এখন তার মনে হলো, হয়তো মেয়েটির কোনো গন্তব্য ছিল না, কারণ তার জীবনের পথই থেমে গিয়েছিল বছরখানেক আগে। সে শুধু আলো জ্বলার অপেক্ষায় ফিরে আসে, নিজের অসমাপ্ত গল্পকে শহরের বুকের ভেতর ছড়িয়ে দেয়। রাহুল বারবার সেই দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল—একটি ছোট মেয়ে, ফুলের মালা হাতে সিগন্যালের ধারে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ দ্রুতগামী এক ট্রাকের ধাক্কা। চারপাশের ভিড়, চিৎকার, রক্তে ভেজা ফুলের গন্ধ। সেই ঘটনার রক্তাক্ত ছায়া হয়তো আজও মোড়ের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি বাতাসে লেগে আছে। মেয়েটি তাই প্রতিদিন ফিরে আসে, জীবিতদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের হারিয়ে যাওয়া উপস্থিতি জানান দেয়।

সেদিন সন্ধ্যায় আবার যখন রাহুল সেই মোড় দিয়ে যাচ্ছিল, তখন লাল আলো জ্বলতেই সে তাকাল ফুটপাথের দিকে। ভিড়ের মাঝে এক চেনা মুখ—সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে আবার কিছু ফুলের মালা, ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি। কিন্তু এবার রাহুলের মনে হলো, সে হাসি আসলে এক নিঃশব্দ কান্না, এক অমোঘ যন্ত্রণার ছদ্মবেশ। মানুষজন তখনও তাকে স্বাভাবিকভাবেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, যেন তারা তাকে একেবারেই দেখতে পাচ্ছে না। রাহুলের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল—তাহলে কি কেবল সে-ই দেখতে পাচ্ছে এই মেয়েটিকে? স্থানীয়রা যাকে বছরখানেক আগে মৃত বলে মেনে নিয়েছে, সে আজও বেঁচে আছে কেবল আলো আর ছায়ার মাঝখানে, এক অতীতের ছায়া হয়ে। রাহুল জানত, এখন থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। এই শহরের প্রতিটি সিগন্যাল, প্রতিটি আলো তাকে মনে করিয়ে দেবে সেই অদৃশ্য উপস্থিতিকে—যে উপস্থিতি মৃত্যুর পরও থেকে গেছে, মানুষের স্মৃতি আর অবহেলার মাঝখানে।

ছয়

সেদিন রাতটা রাহুলের কাছে একেবারেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। দিনের পর দিন মেয়েটির রহস্যময় উপস্থিতি তার মনকে আচ্ছন্ন করছিল, কিন্তু সে যেটা কল্পনাও করেনি, তা হলো মেয়েটি তার স্বপ্নেও প্রবেশ করবে। ঘুমের ভেতর সে দেখতে পেল—শহরের সেই ব্যস্ত মোড় একেবারে নিস্তব্ধ, গাড়ির শব্দ নেই, মানুষের হট্টগোল নেই, শুধু রাস্তার লাল আলো টিমটিম করছে। আলো জ্বলার মুহূর্তে মেয়েটি ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ফুলের ঝুড়ি। কিন্তু এবার তার হাসি অন্যরকম—শান্ত, কিন্তু তাতে গভীর সতর্কতা লুকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে রাস্তার মাঝখানে এগিয়ে গিয়ে হাত উঁচিয়ে এক নির্দিষ্ট জায়গার দিকে ইশারা করল। রাহুল সেই জায়গার দিকে তাকিয়ে দেখল—পিচঢালা রাস্তায় রক্তের মতো লাল ছোপ, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসতে লাগল কর্কশ ব্রেকের শব্দ, মানুষের চিৎকার আর ফুলের ঝুড়ি ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। ঘাম ভেজা শরীরে রাহুল আচমকা জেগে উঠল। তার বুক দপদপ করছে, শ্বাস দ্রুত। কিন্তু মনে হচ্ছিল এটা নিছক কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বরং একটা স্পষ্ট বার্তা, যা মেয়েটি তাকে দিতে চাইছে।

পরদিন সারাদিনই রাহুল অস্থিরভাবে কাটাল। সে যতবার সেই স্বপ্নের কথা মনে করছিল, ততবারই মেয়েটির হাতের ইশারা আর চোখের দৃষ্টি তার মনে গভীরভাবে গেঁথে যাচ্ছিল। যেন মেয়েটি চাচ্ছে রাহুল কিছু খুঁজে পাক, কোনো সত্যের মুখোমুখি হোক। কিন্তু কী সেই সত্য? কাজ করতে গিয়েও সে একাগ্রতা হারাচ্ছিল। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ মনে হচ্ছিল, তারা সবাই তার কাছে অচেনা হয়ে গেছে, যেন তাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো অদৃশ্য গোপন রহস্য। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল—আবার রাতে সেই মোড়ে যাবে। কারণ তার বিশ্বাস হচ্ছিল, মেয়েটি ইচ্ছে করেই স্বপ্নে এসেছে তাকে সতর্ক করতে। রাতের বেলায় কলকাতার ব্যস্ত মোড় অনেকটাই ফাঁকা হয়। রাহুল সেখানে দাঁড়িয়ে দেখল, বাতিগুলো ঝলমল করছে, কিন্তু বাতাসে যেন এক অদ্ভুত অশান্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। সিগন্যালের আলো লাল হতেই সে স্বপ্নের মতোই চোখ রাখল ঠিক মাঝের রাস্তায়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হলো, কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তাকে দেখছে, কোনো অসমাপ্ত গল্প তাকে জানান দিতে চাইছে।

মেয়েটির স্বপ্নে দেওয়া হাতের ইশারাটা মনে করে রাহুল সেই জায়গার দিকে গিয়ে দাঁড়াল। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেখানে রাস্তার কালচে রঙের মধ্যে এখনও হালকা লালচে দাগের মতো কিছু দেখা যাচ্ছিল—হয়তো কোনো পুরনো দাগ, হয়তো কেবল কল্পনার প্রতিফলন। কিন্তু রাহুল অনুভব করছিল এটা নিছকই সাধারণ কিছু নয়। মেয়েটির আত্মা যদি সত্যিই এখানে আটকে থাকে, তবে সেই দাগই তার চিহ্ন, তার অদৃশ্য উপস্থিতির প্রমাণ। হঠাৎ হাওয়ার দমকা ঝাপটা বইল, আশেপাশে কেউ না থাকলেও যেন রাহুলের কানে ভেসে এলো একটি মৃদু হাসি। সে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকল। মেয়েটির কণ্ঠস্বর মনে হলো যেন ফিসফিস করে বলছে, “সাবধানে থেকো… আবার ঘটতে পারে।” রাহুলের শরীর শিউরে উঠল। এ কি তবে কোনো সতর্কবার্তা? মেয়েটি কি তাকে আগত কোনো বিপদের কথা জানাতে চাইছে? শহরের এই মোড়ে কি আবার কোনো ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে?

সেই রাতের পর রাহুলের জীবন একেবারেই বদলে গেল। প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙছিল একই ধরনের স্বপ্নে—মেয়েটির হাসি, সেই মোড়, আর হাতের ইশারা। কখনো কখনো সে দেখতে পেত, মেয়েটির চোখ ভিজে যাচ্ছে, ঠোঁটে চাপা কান্না জমছে, কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। তার ইশারার ভেতরই যেন সমস্ত সত্য লুকিয়ে আছে। রাহুল ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, মেয়েটি কেবল মৃত আত্মা নয়, বরং এক দূত, যে তাকে সতর্ক করছে। হয়তো সে নিজের মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে, আর তার জন্যই রাহুলকে কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করবে সে? শহরের এই ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে-যায়, গাড়ি থামে, সিগন্যাল জ্বলে ওঠে। সেই ভিড়ের মধ্যে মেয়েটির গল্প এক অদৃশ্য ছায়া হয়ে আছে। রাহুল জানত, এখন তার আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মেয়েটি তাকে বেছে নিয়েছে তার গল্পের সাক্ষী এবং সতর্কবার্তার বাহক হিসেবে। তাই প্রতিটি লাল আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে রাহুল এখন নতুন করে ভয় এবং দায়িত্ব অনুভব করতে লাগল—যেন তার হাতে ধরা আছে ভবিষ্যতের কোনো অনিবার্য সত্য, যা সে এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।

সাত

রাহুলের অস্থিরতা সীমাহীন হয়ে উঠছিল। রাতের স্বপ্ন আর মোড়ের নিস্তব্ধতায় পাওয়া সেই অদ্ভুত সংকেত তাকে তাড়া করে ফিরছিল। কিন্তু এবার সে সিদ্ধান্ত নিল—অতীতের ছায়া থেকে সত্যকে টেনে আনতেই হবে। তাই একদিন সকালে সে আবার স্থানীয় চা-ওয়ালার কাছে গেল, যার কাছ থেকে সে আগেই দুর্ঘটনার কথা শুনেছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর, সে সাহস করে জানতে চাইল, “কেউ কি সেই দিনের কোনো ছবি বা ভিডিও তুলেছিল? দুর্ঘটনার সময় তো অনেক ভিড় হয়েছিল।” বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “লোকজন তো মোবাইলে ভিডিও তুলেছিল, পুলিশও তদন্তে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সেগুলো এখন হয়তো কারও কাছে আছে।” রাহুলের শরীর কেঁপে উঠল। মানে, মেয়েটির শেষ মুহূর্তের দৃশ্য ধরা আছে কোথাও! সে ঠিক করল, যেভাবেই হোক সেই ফুটেজ দেখতে হবে। তার অন্তরের অস্থির কণ্ঠ বলছিল, মেয়েটি যে তাকে স্বপ্নে ইশারা করছে, তার রহস্য হয়তো ওই ভিডিওতেই লুকিয়ে আছে।

রাহুল অনেক ঘুরে বেড়াল। স্থানীয় কয়েকজন দোকানদার, চায়ের আড্ডার স্থায়ী মুখগুলো, এমনকি মোড়ের পাশে চিরকাল দাঁড়ানো সংবাদপত্র বিক্রেতাকেও জিজ্ঞেস করল। সবাই একইভাবে বলল—ঘটনা হয়েছিল হঠাৎ, ভয়াবহ; তারপর পুলিশের হাতে গিয়েছিল ভিডিও আর ছবিগুলো। কিন্তু এক যুবক পথচারী, যাকে আগে রাহুল দেখেনি, চুপিসারে তাকে ডেকে নিয়ে বলল, “আমার মোবাইলে একটা ভিডিও আছে। আমি সেদিন ছিলাম এখানে।” রাহুলের বুক ধকধক করতে লাগল। যুবক ফোন বের করে তাকে ফুটেজ দেখাল। রাহুলের চোখের সামনে যেন এক দুঃসহ দৃশ্য ভেসে উঠল—গাড়ির ভিড়, লাল সিগন্যাল, মেয়েটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করছে। হঠাৎ একটি ট্রাক দৌড়ে এসে ভয়ঙ্কর শব্দে ধাক্কা মারে। চারদিকে হইচই শুরু হয়। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো—রাহুল স্পষ্ট দেখল, সেই ভয়াবহ মুহূর্তেও মেয়েটি সিগন্যালের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, ঝুড়ি হাতে, হাসিমুখে। ট্রাকের আঘাতে শরীর ছিটকে গেলেও পরের কয়েক সেকেন্ড ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির ছায়া এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যেন তাকে কেউ স্পর্শই করেনি।

রাহুল হতবাক হয়ে মোবাইলটা আঁকড়ে ধরে দেখছিল। যুবকও আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমি কতবার এই ভিডিও দেখেছি, কিন্তু প্রতিবারই অবাক হই। ট্রাকের ধাক্কায় সে পড়ে গেল, তবু ঠিক একই জায়গায় আবার দাঁড়িয়ে আছে। এটা কিভাবে সম্ভব?” রাহুল কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “পুলিশ কি এটা দেখেনি?” যুবক মাথা নাড়ল, “দেখেছিল বোধহয়, কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। সবার চোখ ছিল দুর্ঘটনা আর মৃতদেহের দিকে।” রাহুলের মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এই ভিডিও শুধু একটি প্রমাণ নয়, বরং জীবিতদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া এক অদ্ভুত সাক্ষ্য। মেয়েটির আত্মা হয়তো তখন থেকেই সেই মোড়ে আটকে গেছে। লাল সিগন্যাল জ্বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে উপস্থিত হয়, সেই চিরন্তন হাসি নিয়ে। রাহুল ভাবল, স্বপ্নে যে ইশারা মেয়েটি দিচ্ছিল, হয়তো সেটাই তাকে এই ভিডিও পর্যন্ত নিয়ে আসতে চেয়েছিল।

রাহুলের চোখে পানি এসে গেল। ভিডিওর পর্দায় মেয়েটির হাসি যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। শহরের প্রতিদিনের কোলাহলের ভেতর সে এক অদৃশ্য উপস্থিতি, যে মৃত্যুর পরও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কেন? সে কি প্রতিদিন একই দুর্ঘটনা আবারও পুনরায় বাঁচছে? নাকি কোনো অজানা রহস্যের বাঁধনে সে মুক্তি পাচ্ছে না? রাহুল বুঝতে পারছিল, এই ফুটেজ কেবল এক দৃশ্য নয়, বরং অদৃশ্য আর দৃশ্যমান জগতের মাঝের সেতু। মেয়েটি এখন শুধু এক স্মৃতি নয়, সে জীবিতদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিশপ্ত সাক্ষী। রাহুলের মনে হলো, মেয়েটি তাকে খুঁজে নিয়েছে কোনো উদ্দেশ্যে—শুধু দেখার জন্য নয়, বরং কিছু করার জন্য। ভিডিওর সেই ভৌতিক মুহূর্ত যেন তার আত্মাকে কাঁপিয়ে দিল। এখন সে নিশ্চিত জানল, মেয়েটি মারা গেছে, কিন্তু এখনও বেঁচে আছে আলো আর অন্ধকারের মাঝখানে, এক অদ্ভুত সাক্ষ্য হয়ে। রাহুলের জীবন আর আগের মতো রইল না, কারণ সে এক অসম্ভব সত্যের সম্মুখীন হয়েছে, যা যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

আট

রাহুল এখন প্রতিটি মুহূর্তে মেয়েটির উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল। ভিডিও ফুটেজে দেখা সেই অদ্ভুত ছায়া তার ভেতরে এক অচেনা কাঁপন জাগিয়ে তুলেছিল। সে ভাবছিল—একজন মানুষ যদি সত্যিই চলে যায়, তবে তার অস্তিত্ব কি এত জীবন্ত হয়ে ফিরে আসতে পারে? হয়তো মেয়েটির আত্মা মুক্তি পায়নি, হয়তো সে কারো অপেক্ষায় আছে। সেই দিন রাতে যখন রাহুল ঘরে শুয়ে ছিল, তখন জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে রাস্তার আলো ঢুকে আসছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, যেন পাশের চেয়ারে কেউ বসে আছে। সে ভয় পেয়ে তাকাল—চেয়ার ফাঁকা। কিন্তু বাতাসে এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, যেটা সে চিনতে পারল। ঠিক সেই ফুল, যা মেয়েটি প্রতিদিন বিক্রি করত। রাহুল বুঝতে পারল, মেয়েটি কোথাও নেই তবুও সে আছে—তার উপস্থিতি অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে। এ যেন দুই ভুবনের মাঝের এক মিশ্রণ, যেখানে সে আটকে আছে।

পরের দিন রাহুল আবার সেই মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। সকালবেলা রাস্তায় ভিড় কম থাকলেও বাতাসে অদ্ভুত একটা চাপা ভার ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, এক বৃদ্ধা ফুল বিক্রেতা মেয়েটির কথা বলছে—“ও মরে গিয়েও যায়নি, জানো তো? লাল আলো জ্বাললেই যেন সে হাসে, আমরা যারা এখানে প্রতিদিন থাকি, অনেকবার দেখেছি।” রাহুলের গা শিউরে উঠল। সে বুঝল, শুধু তার কল্পনা নয়, অন্যরাও মেয়েটির উপস্থিতি অনুভব করেছে। হয়তো মেয়েটি বেঁচে নেই, কিন্তু তার আত্মা এখনও এই পৃথিবীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। রাহুল মনে মনে প্রশ্ন করল, “কেন? তুমি কী চাও? তোমার উদ্দেশ্য কী?” মনে হলো যেন হাওয়ার ফিসফিস শব্দে উত্তর ভেসে আসছে—“ভুলো না, আমার অস্তিত্ব ভুলো না।” মেয়েটির মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং শহরের ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এক জীবনের প্রতীক, যাকে স্মরণ করা প্রয়োজন।

দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু রাহুলের জীবন প্রতিদিন নতুন রহস্যের মুখোমুখি হচ্ছিল। এক রাতে আবারও সে মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখল। এবার মেয়েটি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলল না, বরং চারপাশের ভিড় দেখিয়ে দিল। মানুষজন সিগন্যাল উপেক্ষা করছে, গাড়ি দ্রুত ছুটে যাচ্ছে, ট্রাফিক নিয়ম ভাঙছে। মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে, ঠোঁটে হালকা হাসি, কিন্তু চোখে গভীর যন্ত্রণা। রাহুল হঠাৎ বুঝতে পারল, মেয়েটি শুধু নিজের মৃত্যুর কথা নয়, বরং সকলের কাছে এক সতর্কবার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে। যেন তার মৃত্যু বৃথা না যায়, যেন শহরের মানুষ ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলে, যেন আর কোনো জীবন অকালে নিভে না যায়। অতীতের সেই মৃত্যু বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মেয়েটি তার আত্মাকে ব্যবহার করছে জীবিতদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার জন্য, যাতে তার গল্প ভুলে না যায়।

রাহুলের মন ভরে গেল এক অদ্ভুত দায়িত্ববোধে। সে আর মেয়েটিকে শুধু এক ভয়ঙ্কর আত্মা হিসেবে দেখছিল না; বরং এখন সে তাকে এক বার্তাবাহক হিসেবে ভাবছিল, যে অতীতের ক্ষত থেকে বর্তমানকে রক্ষা করতে চাইছে। তাই রাহুল সিদ্ধান্ত নিল, সে এই গল্প চাপা রাখবে না। সে স্থানীয়দের বোঝাবে, মেয়েটির মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং শহরের জন্য এক সতর্কবার্তা। হয়তো মেয়েটির আত্মা এভাবেই শান্তি পাবে, যদি তার মৃত্যুকে মানুষ মনে রাখে, শিক্ষা নেয়। অতীত আর বর্তমান এখানে মিলেমিশে গেছে—যেখানে এক মৃত মেয়ের হাসি প্রতিদিন লাল সিগন্যালের আলোয় ঝলমল করছে, জীবিতদের চোখে অদৃশ্য হলেও বাস্তবের চেয়েও সত্যি হয়ে। আর রাহুল জানত, এখন থেকে সে নিজেও এই গল্পের অংশ—মেয়েটির নিঃশব্দ কণ্ঠের সাক্ষী, যে তার অস্তিত্বকে শহরের কোলাহলের ভেতর টিকিয়ে রাখবে।

নয়

সেই রাতে রাহুলের ঘুম এক অদ্ভুত আলোড়নে ভেঙে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ঢুকে পড়ছিল। হঠাৎ যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল। তার বুকের ওপর এক ঠান্ডা স্পর্শ অনুভূত হলো, আর চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়েটির সেই পরিচিত হাসি। কিন্তু আজ তার মুখে এক গভীর বিষাদের ছায়া। সে আর কেবল ভৌতিক উপস্থিতি নয়, যেন এক অপরাধবোধে ভরা আত্মা। রাহুল তার ঠোঁট নড়তে দেখল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। তবুও অদ্ভুতভাবে রাহুল বুঝতে পারছিল তার বার্তা। মেয়েটি যেন ফিসফিস করে বলছে—“সিগন্যালের পাশে… ফুল… আর নোট…”। রাহুলের চোখে ভেসে উঠল সেই মোড়, লাল আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি, আর রাস্তার ধারে কোনো অজানা কিছু লুকিয়ে থাকা। এই নির্দেশ তার কাছে শেষ বার্তার মতো মনে হলো—মেয়েটি চাইছে, মৃত্যুর পরও তার অস্তিত্ব যেন কোনোভাবে পরিবার ও পৃথিবীর কাছে পৌঁছায়। রাহুল জানল, এটাই হয়তো তার মুক্তির পথ।

ভোরবেলা রাহুল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় তখনও ভিড় জমেনি, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল যেন শহরের প্রতিটি কোণ তাকে সেদিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে যখন সেই মোড়ে পৌঁছাল, সূর্যের আলো মৃদু সোনালি রঙে রাস্তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সিগন্যাল তখন সবুজ থেকে লালে পরিবর্তিত হলো, আর সেই মুহূর্তেই রাহুলের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে সে খুঁজতে লাগল, ঠিক কীসের দিকে মেয়েটি ইঙ্গিত করেছিল। রাস্তার পাশে কিছু শুকনো ফুলের গুচ্ছ দেখা গেল, যা বহুদিন ধরে কেউ স্পর্শই করেনি। কিন্তু সেই ফুলের নিচে মাটির ভেতরে অর্ধেক ডুবে থাকা এক ছোট্ট খাম তার চোখে পড়ল। রাহুল হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিল। খামটি পুরনো, ধুলোমাখা, কিন্তু ভেতরে যেন এখনো এক অক্ষয় উপস্থিতি লুকিয়ে আছে। তার বুক ধকধক করছিল, যেন সে কোনো অমূল্য জিনিস খুঁজে পেয়েছে। মনে হলো মেয়েটির আত্মাই তাকে এখানে টেনে এনেছে, এই ছোট্ট স্মৃতি ধরে রাখতে।

গাড়ির ভেতরে বসে রাহুল ধীরে ধীরে খামটা খুলল। ভেতরে ছিল একটি শুকনো লাল গোলাপ এবং ভাঁজ করা একটি কাগজ। কাগজে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—“মা, আমি প্রতিদিন এই মোড়ে তোমার অপেক্ষায় থাকি। একদিন ফুল বিক্রি করতে গিয়ে হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমি চাই তুমি জানো, আমি হারিয়ে যাইনি। আমি এখানেই আছি, আলো নিভে গেলেও তোমার ভালোবাসা নিয়ে।” রাহুলের চোখে জল এসে গেল। এতদিন ধরে মেয়েটির হাসি, তার উপস্থিতি, তার অদ্ভুত সংকেত—সবকিছুই এই নোটে এসে মিলল। সে তার পরিবারকে জানাতে চাইছিল, তার অস্তিত্ব শেষ হয়নি, সে এখনো বেঁচে আছে তাদের স্মৃতিতে। এই একটি ফুল আর নোটই তার ভালোবাসার সেতু, যা অতীত ও বর্তমানকে এক করে দিল। রাহুলের মনে হলো, মেয়েটি তাকে বেছে নিয়েছে শুধুমাত্র এই কারণেই—তার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

রাহুল আর দেরি করল না। স্থানীয়দের সাহায্যে মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে বের করল। তারা শহরের এক সরু গলিতে দারিদ্র্যের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিল। রাহুল যখন তাদের হাতে ফুল আর নোটটি তুলে দিল, মেয়েটির মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তার কাঁপা কণ্ঠে বেরিয়ে এলো, “আমার মেয়ে… আমার মিষ্টি মেয়ে এখনও আমাকে মনে রেখেছে।” সেই মুহূর্তে চারপাশে যেন বাতাসে অদ্ভুত প্রশান্তি ভেসে উঠল। রাহুল অনুভব করল, তার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি হাসছে—কিন্তু এবার সেই হাসি শান্তির, মুক্তির। লাল সিগন্যালের আলোয় যে হাসি এতদিন কেবল এক রহস্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তা এক মুক্ত আত্মার শেষ বিদায়ে পরিণত হলো। রাহুল জানত, মেয়েটির যন্ত্রণা শেষ হয়েছে। আর তার নিজের জীবনও বদলে গেল—কারণ সে শিখল, মৃতরা কখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায় না; তারা থেকে যায় স্মৃতিতে, ভালোবাসায়, আর অসমাপ্ত বার্তাগুলোতে, যেগুলো জীবিতরা পূর্ণ করে দেয়।

দশ

মেয়েটির পরিবারের হাতে সেই ফুল আর নোট পৌঁছে দেওয়ার পর থেকেই রাহুলের চারপাশের আবহাওয়ায় যেন এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে শুরু করল। যে মোড়টিকে এতদিন ভয়, রহস্য আর আতঙ্কের সঙ্গে চিনত, সেখানে এখন এক ধরনের প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি হলো। ট্রাফিক সিগন্যালের লাল আলো আর আগের মতো তাকে শিহরিত করে তুলছিল না, বরং মনে হচ্ছিল, সেই আলো এখন মুক্তির প্রতীক। রাহুল প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে এই মোড় পার হতো, আর মনে মনে মেয়েটিকে স্মরণ করত। কিন্তু সে আর সেই পরিচিত হাসি দেখতে পেত না, বাতাসে ভেসে আসা ফুলের ঘ্রাণও আর তেমন তীব্রভাবে অনুভব করত না। তবুও তার মন বলত, মেয়েটি এখনো আছে, তবে অন্য রূপে—শান্ত আত্মা হয়ে, যন্ত্রণামুক্ত হয়ে। সে যেন শহরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে, প্রতিটি লাল আলো, প্রতিটি ট্রাফিকের শব্দে তার অস্তিত্ব আর্তনাদ নয়, বরং এক নীরব আশীর্বাদ হিসেবে বেঁচে আছে।

স্থানীয়রাও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল। যারা প্রতিদিন রাস্তায় কাজ করত, দোকানদার, ফেরিওয়ালা কিংবা পথচলতি মানুষ, তাদের কণ্ঠে আর আতঙ্কের ছাপ ছিল না। বরং সবাই বলত, “মেয়েটা নিশ্চয়ই শান্তি পেয়েছে।” মোড়ের পাশে ছোটখাটো এক মন্দিরে কয়েকজন মানুষ মোমবাতি জ্বালাতে শুরু করল, কেউ কেউ ফুল রেখে প্রার্থনা করত। এটা যেন এক প্রথায় পরিণত হলো—যেখানে সবাই মৃত সেই ফুলওয়ালী মেয়েটিকে স্মরণ করত, কিন্তু ভয়ের চোখে নয়, বরং ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার চোখে। রাহুল প্রায়ই দেখত, ছোট্ট বাচ্চারা তাদের মায়ের হাত ধরে মোড়ে ফুল রেখে আসছে। সে জানত, এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে সেই শেষ বার্তা, সেই নোট আর ফুলের কারণে, যা মেয়েটি তার পরিবারকে দিতে চেয়েছিল। তার মৃত্যুর দুঃখ আজ এক শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে—মানুষ যেন আরও সাবধান হয়, যেন কারো জীবন এমন অকালে শেষ না হয়।

রাহুলের নিজের জীবনও পাল্টে গেল। একসময় এই ঘটনার রহস্য তাকে আতঙ্কিত করত, কিন্তু এখন সেই অভিজ্ঞতা তাকে আরও মানবিক করে তুলেছিল। সে বুঝতে শিখল, মানুষের অস্তিত্ব কেবল জীবিত অবস্থায় সীমাবদ্ধ নয়। স্মৃতি, ভালোবাসা আর অসমাপ্ত ইচ্ছেগুলো মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। রাহুল অনেক সময় ভাবত, যদি মেয়েটি তাকে বেছে না নিত, তবে হয়তো তার বার্তা কেউ কখনো জানতে পারত না। সে উপলব্ধি করল, জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো অন্যের কথা শোনা, যাদের কণ্ঠ হারিয়ে যায় ভিড়ের মধ্যে। এখন থেকে প্রতিবার সে যখন সিগন্যালের লাল আলো দেখত, তার মনে হতো—এটা শুধু থেমে যাওয়ার সংকেত নয়, বরং এক স্মৃতি, এক জীবনকে শ্রদ্ধা জানানোর মুহূর্ত। সে আর সিগন্যালকে কেবল যান্ত্রিক নিয়ম হিসেবে দেখত না; বরং এটাকে সে এক প্রহরী ভেবে নিত, যে শহরের মানুষকে সতর্ক করে, যেন আর কোনো ফুলওয়ালী মেয়ে অকালে হারিয়ে না যায়।

শেষবারের মতো এক সন্ধ্যায় রাহুল মোড়ের পাশে দাঁড়াল। আকাশে তখন গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ছে, সিগন্যাল লাল হলো, চারপাশে গাড়ির শব্দ, মানুষের হাঁকডাক। কিন্তু ভিড়ের ভেতর কোথাও আর সেই অদ্ভুত হাসি নেই। বাতাস শান্ত, শুধু রাস্তায় ধুলো উড়ছে। রাহুল চোখ বন্ধ করল, আর মনে মনে বলল, “তুমি এখন শান্তিতে আছো।” তার বুক হালকা হয়ে গেল, যেন কোনো দীর্ঘ দায়িত্ব শেষ হলো। সে জানত, মেয়েটির উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে—তার পরিবার জেনেছে সে এখনো আছে, তার স্মৃতি শহরের মানুষ বহন করছে। মোড় আর ভয়ের জায়গা নয়; এটা এখন স্মৃতির স্থান, যেখানে ভালোবাসা মৃত্যুকেও অতিক্রম করেছে। গাড়ির হর্ন বাজল, সিগন্যাল সবুজ হলো। রাহুল ধীরে ধীরে গাড়ি চালাল, আর তার মনে হলো, পেছন থেকে কেউ মৃদু কণ্ঠে বলছে—“ধন্যবাদ।” সে ঘুরে তাকাল না, কারণ জানত, বিদায় মানেই অনুপস্থিতি নয়; বরং নতুন এক রূপে বেঁচে থাকা। আর এই ব্যস্ত মোড়ে অবশেষে শান্তি নেমে এসেছে।

-শেষ-

1000055426.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *