সুদীপ্তা মিত্র
অধ্যায় ১
বৃষ্টি আসবে কি না, সেটি নিয়ে আকাশ যেন নিজেই দ্বিধায়। পাড়ার মাথায় পুরোনো অশ্বত্থ গাছটার পাতায় কুয়াশার মতো শিশির জমে আছে, রোদ এখনও মুখ খুলে উঠতে পারেনি। সকাল ঠিক দশটা। এই সময়েই প্রতিবারের মতো ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালেন অনুরাধা মিত্র—মনে হলো যেন প্রতিটি পা-ই কোনও অদৃশ্য প্রতিশ্রুতির ভার বইছে। তাঁর শাড়িটা একরঙা হালকা ধুসর, মাথায় সাদা খোঁপা, কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মুখে একরকম ধীর, নরম বিষণ্ণতা—যেটা বয়সের চিহ্ন নয়, বরং সময়ের সঙ্গে লড়াই করে রয়ে যাওয়া অভ্যেস। তিনি বোথের ভেতর ঢুকলেন, দরজাটা নিজে থেকেই খট করে বন্ধ হল, আর পাশের চায়ের দোকানে বসা সোমনাথ ঠোঁটে চায়ের কাপ ঠেকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। যে কোনও রবিবারের মতোই—এই দিনটা শুধু তাঁর, বুথের, এবং সেই অজানা নম্বরটার।
টেলিফোন বুথটা প্রায় বিলুপ্তির পথে—মাঝে মাঝে হঠাৎ বন্ধ, কখনও টোন আসে না, আবার চলেও ওঠে। তবু অনুরাধার ঠিক সময়মতো আসা যেন এই বুথেরই নিঃশব্দ প্রাণ। তিনি পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করেন, তাতে একটি নম্বর লেখা থাকে—প্রতিবার একই নম্বর। বোতামগুলোতে আঙুলের কাঁপুনি নিয়ে ডায়াল করেন তিনি, তারপর কানে রিসিভার তুলে বলেন, “হ্যালো, আমি… আমি আজও ঠিক সময়েই ফোন করেছি।” তাঁর গলা এতটাই নিচু, বাইরে থেকে কিছুই শোনা যায় না। সোমনাথ জানে না, ফোনের ওপারে কেউ থাকে কিনা—তবে সে দেখে, ফোন রাখার সময় অনুরাধার চোখে জল জমে থাকে। ফোন রেখে তিনি একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন কাকে কিছু বলতে চেয়েও বলছেন না। তারপর মৃদু হেসে দরজা ঠেলে বাইরে আসেন, এবং আবারও সেই শান্ত, ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন।
এই দৃশ্য সোমনাথ ছয় বছর ধরে দেখছে। প্রথমদিকে সে কৌতূহলী ছিল, এখন যেন একধরনের নিরব অভ্যেসে পরিণত হয়েছে এই পর্যবেক্ষণ। অন্য দোকানদারেরা হয়তো ব্যঙ্গ করে বলেন, “বুড়ি নিশ্চয়ই পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলে”, কেউ বলে, “মন খারাপ হলে মানুষ এমনই করে”, কিন্তু সোমনাথ কিছু বলে না। সে শুধু দেখে, রবিবার এলেই বুথের সামনে যেন একটা নীরব নাটক মঞ্চস্থ হয়—অভিনেত্রী একজনই, অনুরাধা মিত্র। একটা বুথ, একটা নম্বর, একটা সময়, আর সেই অপেক্ষা—যার প্রতিধ্বনি কেবল অনুরাধার চোখে ধরা পড়ে, বাকিদের শোনার মতো নয়। আজ সে ভাবল—এতদিন শুধু দেখেই গেছে, এবার কি একবার জানতে চায় না, কে এই ফোনের ওপারে? নাকি, সত্যি কথা জানার চেয়ে এই রহস্যটাই বেশি সুন্দর?
অধ্যায় ২
সকালটা ছিল একটু অন্যরকম। হালকা রোদে বুথের কাচের গায়ে লেগে ছিল শিশিরের রেখা, আর তার আড়ালে অনুরাধা মিত্রের ছায়ামূর্তি। সোমনাথ চায়ের ভাঁড়ে জল ঢালতে ঢালতে চমকে গেল, আজ বুথ থেকে বেরোনোর সময় তিনি হাতে একটা সাদা খাম ধরে আছেন—এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। খামটা মৃদুভাবে ভাঁজ করা, কিন্তু তাতে একটা লাল কালি দিয়ে ছাপানো বিদেশি ঠিকানা স্পষ্ট: “Mr. A. Mitra, 52, King’s Cross Road, London.” সোমনাথের কৌতূহল চরমে ওঠে, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। বৃদ্ধা চোখ তুলে তাকান, সেই পুরোনো বিষণ্ণ দৃষ্টি—যেন অনেকটা পথ হেঁটে এসে আবার একই শূন্যতায় ফিরে আসছেন। তিনি কোনও কথা না বলে হাঁটা শুরু করেন। খামের কোণায় কালো বলপেনে ছোট করে লেখা থাকে: “পৌঁছলে ফোন করো”—এই লেখাটা কিছুক্ষণ পর সোমনাথের চোখে পড়ে, এবং কেমন একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে যায় তার ভিতরে। ফোন করার জন্য কাউকে চিঠি দেওয়া—এটা কি শুধুই যোগাযোগের চেষ্টা, নাকি সময়ের কাছে হেরে যাওয়া এক নীরব অনুরোধ?
চা দোকানের ভেতরে বসে থাকা নন্দিনী নামের মেয়েটি আজও এসেছিল তার গবেষণার ফিল্ডওয়ার্কে। সে চোখের কোণে অনুরাধাকে অনুসরণ করে, তারপর সরাসরি সোমনাথের পাশে এসে দাঁড়ায়। “ওই খামটা কি আপনি আগে দেখেছেন?” প্রশ্নটা যেন হাওয়ার মতো ভেসে আসে। সোমনাথ ধাক্কা খায়—এই মেয়েটা প্রতিদিন না হোক, প্রায় দিনই আসে, চুপচাপ দেখে, কিন্তু আজই প্রথম এমন প্রশ্ন করল। নন্দিনী বলল, “আমি সামাজিক একাকীত্ব নিয়ে কাজ করছি—কিন্তু এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আমার গবেষণার থেকে অনেক বেশি কৌতূহল জন্মেছে।” সোমনাথ একটু ইতস্তত করে বলল, “আপনি হয়তো কিছু খুঁজে পাবেন, হয়তো কিছুই না। তবে উনি ফোনে যা বলেন, আমি কখনও শুনিনি। শুধু জানি, প্রতি সপ্তাহে তিনি কাউকে ডেকে চলেছেন—যিনি হয়তো আর ফেরেন না।” কথাটা বলেই সে থেমে যায়। নন্দিনী সেই ঠিকানাটা খাতায় টুকে নেয়, বলে, “আমি চেষ্টার মধ্যে থাকব। আমাদের সমাজে কিছু সম্পর্ক বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়।”
অনুরাধার বাড়িটা রীতিমতো নিঃশব্দ। লোহার গেটের ভেতর একটুকরো আঙিনা, যেখানে শুকনো তুলসী গাছটা শুধু সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। নন্দিনী সাহস করে দরজায় টোকা দেয়। অনুরাধা নিজে দরজা খুলে দাঁড়ান, একটু অবাক, একটু দ্বিধাগ্রস্ত। “আমাকে চায়ের দোকান থেকে পাঠানো হয়নি,”—নন্দিনী নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, “আমি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়ি। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?” অনুরাধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “তুমি যদি শোনার মতো মন নিয়ে এসো, তাহলে বসো।” ঘরটা যেন সময় আটকে রেখেছে—সেই পুরোনো কাঠের তাক, ধূলিধুসর বই, আর কোণার টেবিলটায় রাখা এক টুকরো খোলা চিঠি—যার শেষ লাইন লেখা: “মা, তুমি এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করো?” নন্দিনীর গলা শুকিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, এই চিঠি কোনো উত্তর নয়, বরং অনুরাধার মনে কল্পিত একটি প্রত্যুত্তর, যা তিনি নিজেই নিজের কাছে পাঠিয়ে রাখেন প্রতি সপ্তাহে।
অধ্যায় ৩
ঘরটা নিঃশব্দ ছিল, তবু সেই নিঃশব্দতায় যেন অসংখ্য শব্দের আনাগোনা—টিকটিক শব্দ করা পুরোনো দেওয়াল ঘড়ি, মৃদু বাতাসে জানালার কপাটের কেঁপে ওঠা, আর অনুরাধার নিঃশ্বাসে জমে থাকা এক ধরনের না-বলা অভিমান। নন্দিনী ধীরে ধীরে চারপাশ দেখে—দেয়ালে টাঙানো সাদাকালো ছবির ফ্রেম, তাতে এক যুবক—চোখে স্পষ্ট এক আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটে হালকা হাসি। ছবির নিচে ছোট করে লেখা, “অভিজিৎ – ১৯৮৭”। নামটা দেখে নন্দিনীর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, কারণ এটা সেই নাম, যা চায়ের দোকানের গল্পে বহুবার এসেছে। “এঁই কি আপনার ছেলে?”—সে প্রশ্ন করে। অনুরাধা মাথা হেঁট করে বলেন, “হ্যাঁ… অভিজিৎ… ও তো হারিয়ে গেছে। কোথাও চলে গেছে, আর কোনোদিন ফিরেও আসেনি।” নন্দিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আপনি তো প্রতি রবিবার ফোন করেন?” অনুরাধা মৃদু হেসে বলেন, “হ্যাঁ, করি… যাতে ভুলে না যায় আমি আছি। আমি জানি, ও ফোন তোলে না… তবু জানিয়ে যাই, আমি এখনও অপেক্ষা করছি।” তাঁর চোখে কোনও অশ্রু নেই, কিন্তু কণ্ঠস্বরের ভারে বোঝা যায়, ভেতরে সেই কান্না এখনও থেমে নেই।
নন্দিনী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে গভীর এক স্তব্ধতা নিয়ে। তার গবেষণার খাতায় ‘একাকীত্ব’ শব্দটা অনেকবার লেখা হয়েছিল, কিন্তু অনুরাধা মিত্রের গল্প যেন সেই একাকীত্বের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে দেয়। সে ভাবে—কত মানুষের জীবনে “যোগাযোগ” আসলে নিছক এক অভ্যাস হয়ে থাকে, যার আর কোনো বাস্তবতা নেই! চায়ের দোকানে ফিরে সে সোমনাথকে দেখে। সোমনাথ তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে না, শুধু বলে, “ছবিটা দেখলে?” নন্দিনী মাথা নাড়ে। “জানো, আমি এখন বিশ্বাস করি—এই শহরে সবচেয়ে সাহসী মানুষ অনুরাধা মিত্র। কারণ সে ভাঙা ফোনের ওপারে কাউকে ডাকে, জানে কেউ সাড়া দেবে না, তবু থামে না।” সোমনাথ হাসে না, মাথা ঝাঁকায়, বলে, “তুমি ঠিক বলছো। কিন্তু আমি ভাবি, হয়তো কখনও কেউ ফোন তুলবেই। হয়তো একদিন সে নিজেই ফিরে আসবে।” তারপর সে চুপ করে থাকে, যেমন প্রতি রবিবার সকালে বুথের কাঁচজানালার ওপারে অনুরাধার ছায়ার মতোই—নীরব অথচ উপস্থিত।
সন্ধে ঘনায়। শহরের আলো জ্বলে ওঠে। অন্য এক ঘরে, অন্য এক দেশে—লন্ডনের কোনো ফ্ল্যাটে হয়তো কেউ একটি চিঠি হাতে পায়, যার ওপরে লেখা—”মা এখনও ফোন করে…”। পাঠকের জানা নেই, পাঠানো সেই সাদা খাম সত্যিই পৌঁছেছে কিনা। শুধু এটুকু বোঝা যায়—নন্দিনীর আগমনে যেন অনুরাধার একলা জগতে ঢুকে পড়েছে আরেকটি আত্মা, যে বুঝতে পারে, কিছু সংযোগ হয়তো টেলিফোনের তার দিয়ে নয়, হৃদয়ের নিঃশব্দ অপেক্ষায় তৈরি হয়।
অধ্যায় ৪
পুজোর আগের সেই উত্তাল দুপুরে নন্দিনী আবার অনুরাধার বাড়িতে যায়। এবার তাঁর সঙ্গে বসে থাকে অনেকটা সময়—না কোনও প্রশ্ন করে, না কোনও গবেষণার খাতা খুলে। শুধু চুপ করে বসে থাকে, যেন তার উপস্থিতি এক প্রকার শ্রদ্ধা ও শ্রবণের। অনুরাধা নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, “আমার ছেলে অভিজিৎ খুব ভালো কথা বলত, খুব হাসত, আর খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠেছিল। ওর বাবার মতো নয়—ওর ভেতরে আলাদা একটা উন্মাদনা ছিল।” নন্দিনী টেবিলের ওপর রাখা অ্যালবামের পাতা উলটে উলটে দেখে—ছোটবেলার জন্মদিন, স্কুলের ছবি, কলেজের ফেয়ারওয়েল। তবে এরপরেই পাতাগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। যেন জীবনের ধারাবাহিকতা হঠাৎ থেমে গেছে। “এরপর আর কিছু নেই?” নন্দিনী জিজ্ঞেস করে। অনুরাধা মৃদু হেসে বলেন, “এরপর শুধু অপেক্ষা। অভিজিৎ আমাকে না বলে দেশ ছেড়েছিল। এক বিদেশি স্কলারশিপ পেয়েছিল—আমি বলেছিলাম যেতে, ও বলেছিল, ফিরে আসবে। তারপর আর আসেনি।” তাঁর গলায় কোনও রাগ নেই, শুধু একরাশ নিরবতা। যেন একধরনের আত্মসমর্পণ, যা বুঝে নিয়েছে, প্রত্যাবর্তন সবসময় হয় না।
নন্দিনী এবার সিদ্ধান্ত নেয়, সে খুঁজবে। শুধু গবেষণার জন্য নয়, বরং নিজের মধ্যেকার এক শূন্যতাকে পূর্ণ করার প্রয়াসে। কারণ তার নিজের জীবনেও রয়েছে একটি ‘না-ফেরার-চিঠি’—এক প্রাক্তন প্রেমিক, যে বার্তা ছাড়াই হঠাৎ অন্তর্ধান ঘটিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা তার ভেতরে রেখে দিয়েছে একরকম চাপা ক্ষত। সে ভাবে—অনুরাধার গল্প তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়; বরং সেই অপেক্ষা তার নিজের অপেক্ষাকেই প্রশ্ন করে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে যায়, পুরোনো রেজিস্ট্রির খোঁজ করে, এমনকি ব্রিটিশ কনসুলেটেও ই-মেইল করে অভিজিৎ মিত্র নামে কোনো ছাত্রের খোঁজে। শুরু হয় এক অনুসন্ধান, যেখানে প্রমাণের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় বিশ্বাস। একদিন সে জানতে পারে—১৯৯০ সালের অক্টোবরে “Abhijit Mitra” নামে একজন যাত্রা করেছিল কলকাতা থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তার পরে আর সরকারি খাতায় কোনও প্রবেশ বা ফিরে আসার রেকর্ড নেই।
সন্ধ্যেয়, অনুরাধা চা বানিয়ে এনে দেন নন্দিনীর জন্য। দু’জনে বারান্দায় বসে থাকেন। দূরের রাস্তায় ছোট ছোট প্যান্ডেল উঠছে, আলো ঝলমল করছে, কিন্তু এই বাড়িতে আলো অনেকটা ম্লান। নন্দিনী অনুরাধাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কখনও ভেবেছেন যে সে ফোনটা তোলে?” অনুরাধা উত্তর দেন না। শুধু বলেন, “ভেবেছি। ভাবতে পারাটাই তো আমার বেঁচে থাকা।” তারপর একটু থেমে আবার বলেন, “তুমি জানো, একটা সময় ছিল যখন বুথে গিয়ে নম্বর ডায়াল করার সাহস আমার হত না। হাত কাঁপত। ভয় করত, যদি কেউ সত্যিই ফোন তোলে?” সেই ভয় আর সেই আশার মাঝের ভারসাম্যই তো অনুরাধার জীবন। আর এখন নন্দিনীর চোখে এক নতুন বোঝাপড়া জমতে থাকে—একজন মানুষ যদি বছর ধরে নিঃশব্দে কল্পনা করে ফোন করে যেতে পারে, তবে তার অপেক্ষার প্রকৃতি কতটা গভীর হতে পারে!
অধ্যায় ৫
রবিবার সকালটা ছিল অন্যবারের চেয়ে একটু বেশি ঠান্ডা। বাতাসে একটা শুকনো পাতা উড়ছিল, যেন কেউ হারিয়ে যাওয়া চিঠির খোঁজে ছুটছে। অনুরাধা যথারীতি সেই পুরোনো সবুজ শাল গায়ে চাপিয়ে বেরোলেন। নন্দিনী তখন তাঁর সামান্য পেছনে, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। সোমনাথও জানে আজ কিছু ঘটবে—অন্তত আজ সে শুনবে, দেখবে, বুঝবে কিছু। বুথে ঢুকে অনুরাধা আজ একটু বেশি সময় নিলেন নম্বরটা ডায়াল করতে। তাঁর হাতের কাঁপুনি নন্দিনীর চোখ এড়াল না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সোমনাথ আর নন্দিনী একবার চোখাচোখি করে। বুথের ভিতর থেকে অনুরাধার কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে ভেসে এলো—“আমি জানি তুমি শুনতে পাও না, কিন্তু আমি কথা বলতেই থাকি… জানো কেন? যাতে আমি নিজেকে ভুলে না যাই।” এই বাক্যটা যেন সময়ের দেয়ালে ঠেক দিয়ে একটা দরজা খুলে দেয়।
সেই মুহূর্তে, বুথের উপরকার বাতিটি হঠাৎ নিভে যায়। লাইন কেটে যায়। অনুরাধা খানিকক্ষণ ফোনটা কানে ধরে রাখেন, যেন শেষ কথাটা আরেকবার শোনার চেষ্টা করছেন। তারপর আস্তে আস্তে ফোন রাখেন, বুথের দরজা ঠেলে বাইরে আসেন। নন্দিনী এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, “লাইনটা কি কেটে গিয়েছিল?” অনুরাধা তাকান, হালকা হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আজ সংযোগ হয়নি। কিন্তু সেটা তো নতুন কিছু নয়।” সোমনাথ এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না—সে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, ওপারে কেউ আছে?” অনুরাধা চুপ থাকেন, তারপর বলেন, “তোমরা জানো, অনেক সময় মানুষ ফোনে কথা বলে না শোনার জন্য, বলে শুধু বলার জন্য। কেউ শুনুক বা না শুনুক, কিছু শব্দ জমে গেলে বলতেই হয়। এই বুথটা যেন আমার গলির একমাত্র শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” এই কথাগুলো যেন শুধু তাঁদের জন্য নয়, বরং সেই সব নিঃসঙ্গ হৃদয়ের জন্য, যারা প্রতিদিন নিজের মনেই কিছু বলে যায়।
সেই সন্ধ্যায়, নন্দিনী বসে তার রিসার্চ নোট খুলে লেখে—“কখনো কখনো সংযোগের প্রমাণ থাকে না, কেবল অনুভব থাকে। এবং কখনো তা-ই সবচেয়ে বেশি সত্য।” সে ভাবতে থাকে, যদি কেউ বছরের পর বছর এমনভাবে একই নম্বর ডায়াল করে যায়, তবে কি এটা একরকম আত্মপ্রতিকৃতি নয়? বুথটি হয়ে উঠেছে অনুরাধার মানসিক আয়না—যেখানে সে নিজেরই প্রতিধ্বনি শুনে যায়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সে খুঁজে বের করবে সেই নম্বরের প্রকৃত উৎস—এই নম্বরটি কোথায় যায়, আদৌ কোথাও পৌঁছায় কিনা। হোক সেটি বন্ধ, অকেজো, কিংবা শুধুই একটা ছায়া—কিন্তু সে খুঁজবে। কারণ সে বুঝে গেছে, এই ‘ফোন’ আসলে একটি জীবনচক্র, যার ভেতরে ঢুকে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
অধ্যায় ৬
নন্দিনী দিনগুলো গুনছে। সকাল বেলা অনুরাধার জন্য এক কাপ দুধ নিয়ে গেলে তিনি বলেন, “তুমি তো এখন আমার মেয়ের মতো হয়ে উঠেছো… কেবল আমার গর্ভে আসোনি, তবে মনের ভিতরে ঠিক জাগা করে নিয়েছো।” সেই কথায় এক অদ্ভুত কোমলতা ছিল। কিন্তু নন্দিনীর মনের ভিতর তখন চলছিল এক নিঃশব্দ বিপ্লব—সে খুঁজছে, খুঁজতেই থাকবে। সোমনাথ তার পাশে এসে বলে, “আমি পুরোনো ফোন অফিসে এক বন্ধু আছে, দেখতে পারি কিছু খোঁজ পাওয়া যায় কি না?” নন্দিনী মাথা নাড়ে, বলে, “আমার মনে হয়, আমাদের খুব বেশি সময় নেই। অনুরাধা দিদির শরীর আর আগের মতো থাকছে না। আমাদের দ্রুত জানতে হবে—এই নম্বরটা কোথায় যায়।” তারা ঠিক করে, আগামীকালই পুরোনো টেলিকম আর্কাইভে যাবে। সেই সন্ধ্যায় অনুরাধা মন্ত্রের মতো বলেন, “আমার ফোন যদি একদিন সত্যি করে কেউ তোলে, তাহলে বলবে না যে আমি এখনও অপেক্ষা করছি?” নন্দিনী তাঁর হাত চেপে ধরে, মৃদু গলায় বলে, “আমি নিজে বলব।”
পরদিন তাঁরা যায় কসবা অঞ্চলের পুরোনো টেলিকম ভবনে, যেখানে এখন রেকর্ড রাখা হয় সরকারি খাতায়। অনেক অনুরোধের পর, এক বয়স্ক কর্মচারী তাঁদের পুরোনো ফোন লগবই থেকে কিছু পৃষ্ঠা খুঁজে বের করেন। নন্দিনী চোখ রাখে এক পুরোনো এনালগ ফাইলের পৃষ্ঠায়—অনুরাধার কলগুলোর সময় লেখা আছে, কিন্তু ‘ডেস্টিনেশন নম্বর’ হিসাবে যেটি লেখা, তা প্রতিবারই আসে “Null” বা ‘Invalid Number’। তার মানে ফোন করা হয়েছে, কিন্তু সংযোগ কোনও প্রান্তে স্থাপিত হয়নি। সোমনাথ ফিসফিস করে বলে, “তাহলে সে এতদিন কেবল বাতাসে কথা বলছে?” নন্দিনীর কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। কিন্তু ঠিক তখনই পুরোনো কাগজপত্রের ভাঁজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের কাটা টুকরো—তার উপর হেডলাইন: “Young Indian Scholar Missing in London — 1990”।
খবরের ভিতরে লেখা আছে, “Abhijit Mitra, 26, Indian researcher at University College London, last seen at King’s Cross station, suspected mental health episode, declared missing.” নিচে আছে তাঁর পাসপোর্ট ছবির কপি—যে ছবিটি নন্দিনী আগেই অনুরাধার অ্যালবামে দেখেছে। সে পড়ে যেতে বসে—প্রচণ্ড একটা ধাক্কা এসে লাগে তার বুকের ভিতর। এতদিন ধরে যে মুখকে ঘিরে এই গল্প বোনা হচ্ছিল, তিনি নিখোঁজ! অর্থাৎ ফোন তো তোলা তো দূর, সে হয়তো কোথাও বেঁচে নেই। সোমনাথ বলে ওঠে, “তুমি অনুরাধা দিদিকে এটা বলবে?” নন্দিনী চুপ করে থাকে। বলবে কি বলবে না, তা ঠিক করে উঠতে পারে না। হয়তো সত্যি এই বার্তাটা অনুরাধার জন্য নয়—এই সত্য নিজেই এত ভারী যে একাকীত্বের ওপর চাপিয়ে দিলে সব ভেঙে পড়ে। সে জানে, কিছু কিছু সংযোগ শুধু সংযোগহীন থাকলেই বেঁচে থাকে। হয়তো জানাই সব নয়, বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
অধ্যায় ৭
সন্ধ্যার সময় বাড়ির ছোট্ট ভাঙাচোরা ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছিলেন অনুরাধা। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা তাঁর অভ্যাস, যেন তিনি আকাশেই খুঁজছেন সেই মুখ, সেই কণ্ঠস্বর, যার জন্য তিনি এতগুলো বছর ধরে প্রতিটা রবিবার এই পৃথিবীতে টিকে রয়েছেন। নন্দিনী আজ একটু বেশি নির্ভার দেখালেও ভেতরে সে একটা পাহাড় বইছে—সে জানে, অভিজিৎ আর নেই। অন্তত বাস্তবের হিসাবে। কিন্তু সে এটাও জানে, এই খবর অনুরাধাকে দেওয়া মানেই সেই কাঁচের জীবনটা এক ঝটকায় চূর্ণ হয়ে যাওয়া। তাই সে আরেকটা পথ নেয়। “দিদি,” সে ধীরে ধীরে বলে, “আপনার লেখা চিঠিগুলোর কথা কখনও বলেছিলেন না… আপনি কি সব জমিয়ে রেখেছেন?” অনুরাধা চুপ করে থাকেন, তারপর দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর চলে যান। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি এক ধুলোপড়া লোহার ট্রাঙ্ক এনে রাখেন বিছানার ওপর। “দেখো,” তিনি বলেন, “প্রতিবার ফোন করার পর যা বলিনি, তাই লিখেছি। এই চিঠিগুলো আমার কথা, আমার কান্না, আমার আদর—সবই এখানে জমা।”
নন্দিনী চমকে যায়। ট্রাঙ্ক খুলতেই একরাশ কাগজ তার চোখে পড়ে—সবচেয়ে উপরেরটায় লেখা: “৩১শে জানুয়ারি, ১৯৯4 — আজ তোমার জন্মদিন। তুমি জানো না আমি আজও প্রতি বছর এই দিনটার জন্য আলাদা করে বসে থাকি…” প্রতিটি চিঠি এক একটি রবিবারের স্মৃতিচিহ্ন—কারণ অনুরাধা শুধু ফোন করেননি, ফোনের পরে সেই অনুভবগুলো লিখে রেখেছেন। কিছু চিঠি ছেঁড়া কাগজে, কিছু চায়ের প্যাকেটের উল্টো দিকে, কিছু আবার রীতিমতো সাদা খামে মুড়ে রাখা। কোনওটিতে অভিমান, কোনওটিতে দুঃখ, আবার কোনওটিতে শুধুই “আজ খুব ভালো একটা পেঁয়াজের ডালনা হয়েছিল, যদি থাকতে তুমি…” এইসব চিঠি যেন অনুরাধার আত্মার আয়না—যেখানে তাঁর ভালোবাসা, ক্ষোভ, অভিমান, আশা সব একসাথে লিপিবদ্ধ। নন্দিনীর চোখে জল এসে যায়, সে ভাবে—এ এক জীবন্ত আর্কাইভ, যেটা সমাজ কখনও গণ্য করে না, অথচ যেটা সবচেয়ে বড় ইতিহাস হতে পারে।
“তুমি এসব রাখো,” অনুরাধা বলেন, “তোমার গবেষণায় যদি কোনওদিন কাজে লাগে… আমি তো আর বেশি দিন নেই।” নন্দিনী কেঁপে ওঠে, বলে, “দিদি, প্লিজ, এমন কথা বলবেন না।” কিন্তু অনুরাধা হেসে বলেন, “ওকে আরেকটা চিঠি লিখেছি আজ। তবে সেটা আমি আর রাখিনি… আমি ভাবছি এবার সত্যিই পাঠিয়ে দেব। এতদিন তো শুধু নিজের কাছেই লিখে গেছি। এবার যদি ওর ঠিকানায় পৌঁছয়, ভালোই হয়।” তিনি শাড়ির আঁচল থেকে একটা সাদা খাম বার করেন। তাতে ঠিকানাটা আবার সেই পুরোনো—“Mr. A. Mitra, 52, King’s Cross Road, London.” নন্দিনী এবার আর কিছু বলে না। সে সেই খাম হাতে নেয়, ভাবে—হয়তো পাঠানোই উচিত। কারণ উত্তর আসুক বা না আসুক, কিছু চিঠি পাঠানো মানে নিজের কাছ থেকে মুক্ত হওয়া। সে জানে না, এই খামটা সত্যি কোনো গন্তব্যে পৌঁছাবে কিনা, কিন্তু পাঠানোর মধ্যেই অনুরাধার জীবনের শেষ স্পন্দনটা লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৮
সকালটা ছিল বিষণ্ণ রোদের মতো—কাঠফাটা নয়, কিন্তু রোদ থাকলেও তাতে কোনও উষ্ণতা ছিল না। নন্দিনী গলায় সেই চিঠিওয়ালা খাম ঝুলিয়ে শহরের অন্য প্রান্তে যায়—পূর্ব কলকাতার একটি পুরোনো দপ্তরে, যেখানে ফোন কল রেকর্ড ও আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জ লগগুলি এখনও কোনও কোনও পুরোনো ফরম্যাটে সংরক্ষিত থাকে। কিছুটা চেষ্টার পরে সে দেখা করে মিস্টার ঘোষাল নামের একজন প্রবীণ টেলিকম অফিসার-এর সঙ্গে, যিনি ৮০-র দশকে আন্তর্জাতিক কল রুটিং-এর কাজ করতেন। তাঁর হাতে থাকা পুরোনো লগ বইয়ের পাতায়, নন্দিনী সেই নম্বর খুঁজে পায়—যেটা অনুরাধা এত বছর ধরে ডায়াল করতেন। ঘোষাল চশমা চোখে দিয়ে পাতা উলটে বলেন, “এই নম্বর… এই তো… ০৪৪-৯৯৭৮১০… হুম, এটা একটা dead loop… মানে বোকার মতো কথা বলার মতোই একটা লাইন, যেটা আদতে পৃথিবীর কোথাও যায় না। কোনও রিসিভার এ থাকে না, শুধু একটা রিং দেয়, যেন সংযোগ হচ্ছে… কিন্তু আসলে কিছুই হয় না।”
নন্দিনীর শরীরের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। এতদিন ধরে, এই বুথের ভেতর দাঁড়িয়ে অনুরাধা প্রতিবার যাঁকে ফোন করেছেন, তা একরকম নিঃসঙ্গ বাতাসে কথা বলার মতোই—একটা প্রহসন। সে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু এটা তো বোঝা যায় না? ফোনের ভিতর টোন তো আসে!” ঘোষাল মৃদু হেসে বলেন, “এইরকম ফাঁকা নম্বর সিস্টেমে কখনও কখনও এমনটা হয়। হয়তো ৯০-র দশকে একবার কেউ ওই নম্বর দিয়েছিল, কিন্তু পরে সেটি অকেজো হয়ে গেছে, অথচ সিগন্যালটি থেকে গেছে।” নন্দিনী শুধু মাথা ঝাঁকায়। এ যেন এমন এক মায়া, যা বিশ্বাস দিয়ে তৈরি, কিন্তু বাস্তবতায় যার কোনও অস্তিত্ব নেই। সে ভাবে, তাহলে অনুরাধা ৩০ বছর ধরে কেবল নিজেকেই শোনাচ্ছেন?
সেই রাতে, সে বাড়ি ফিরে চুপচাপ বসে থাকে অনুরাধার পাশে। চিঠিটা সে পোস্ট করেছে, কিন্তু কিছু জানায়নি। অনুরাধা তখন একটা পুরোনো রেডিও চালু করেছেন, যা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে—“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদলে…” তাঁর মুখে হালকা হাসি, যেন ভেতরের কিছু একটা খুলে গেছে। হঠাৎ তিনি বলেন, “তুমি জানো, আমি কখনও জানতে চাইনি, ফোনটা কোথায় যায়। আমি শুধু চাই, কেউ একজন শুনছে ভাবতে।” নন্দিনীর গলা শুকিয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, কিছু কিছু বিশ্বাস মিথ্যে হলেও তাকে ভাঙা যায় না। সত্য যত কঠিন হোক না কেন, কিছু ভুয়ো সংযোগই আমাদের আত্মা ধরে রাখে। তিনি যদি বিশ্বাস করেন, ফোনের ওপারে কেউ আছে—তবে সত্যিই তো সে সংযোগের মূল্য আছে। সত্য এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, বরং ভালোবাসা নিজেই প্রমাণ।
সেই রাতেই সোমনাথ তার দোকানের কোণে বসে চা বানায়, আর নন্দিনী সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “আমরা অনেক সময় সত্য খুঁজি, কিন্তু মনে হয়, অনুরাধা দিদির এই মিথ্যেটাই অনেক বেশি সুন্দর।” সোমনাথ চুপচাপ চা বাড়িয়ে দেয়। বুথের কাঁচে আলো পড়ে, ভিতরে কিছু নেই—শুধু প্রতিফলিত হয় এক নারীর অপেক্ষার ছায়া, যা হয়তো আজও রিং বাজার পর বলেনি ‘হ্যালো’, কিন্তু শোনার ভান করে গেছে বহু বছর ধরে।
অধ্যায় ৯
রবিবারের সকালটা ছিল আশ্চর্য নিরব। অনুরাধা মিত্র সেই প্রথম বার সময়মতো বেরোলেন না। চায়ের দোকানের সোমনাথ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বুথের দরজার দিকে, তারপর বারবার ঘড়ি দেখেও নিশ্চয়তা পেল—আজ তিনি আসছেন না। কিছুক্ষণ পর, নন্দিনী চায়ের কাপটা ফেলে রেখে ছুটে গেল অনুরাধার বাড়ির দিকে। গেটটা খোলা ছিল, সদর দরজার ছিটকিনিও। ঘরে ঢুকেই সে দেখতে পেল, অনুরাধা বিছানায় শুয়ে আছেন, কিন্তু চোখ খোলা। নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরের পেঁপে গাছটার দিকে। চোখদুটো ভারী ক্লান্ত, ঠোঁট ফাঁক করা, কিন্তু মুখে কোনও ব্যথা নেই। যেন দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার ক্লান্তি জমে আজ শরীরটা হালকা হয়ে এসেছে। ডাকলে তিনি সাড়া দেন, কণ্ঠে মৃদু ফিসফিসানি—“আজ আর ফোনটা করিনি… হঠাৎ মনে হল, এবার আমি চিঠি পাঠাব। একটা শেষ চিঠি…” তাঁর হাতে তখনও ভাঁজ করে রাখা খাম—যেটি আগেরটিই, কিন্তু এবার তার ভিতরে ছোট করে লেখা আছে মাত্র কয়েকটি লাইন: “আমি অপেক্ষা করছি না আর, আমি রওনা হলাম।”
নন্দিনীর চোখে জল চলে আসে, কিন্তু সে নিজেকে ধরে রাখে। “আমি এটা নিজে পোস্ট করব, দিদি,” সে বলে। অনুরাধা একটা মৃদু হাসি দেন, যেটি যেন সব অভিমান ধুয়ে ফেলেছে। “তুমি জানো, এই কথাগুলো ওকে বলতে পারলাম বলে আমি হালকা বোধ করছি। একদিন যদি সে ফিরে আসে… যদি চিঠিটা পায়… তখন অন্তত জানবে, আমি সবটা জানিয়ে দিয়েছি।” সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস ভারী, কিন্তু শান্ত। নন্দিনী আর কিছু বলে না—সে শুধু বসে থাকে অনুরাধার পাশে। কেবল বুঝতে পারে, তাঁর ভেতরের সেই বিশাল একাকীত্ব আজ ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে। সেই রাতে অনুরাধার শরীরটা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, চিকিৎসকেরা বলেন—শরীরিকভাবে তাঁর কিছু নেই, কিন্তু মন হয়তো ছাড়ছে ধীরে ধীরে।
সোমনাথ পরদিন সকালবেলায় নন্দিনীর সঙ্গে পোস্ট অফিসে গিয়ে খামটা নিজ হাতে পোস্ট করে। তারা দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকে লাল রঙের সেই পোস্টবক্সের সামনে—যার পেটে ঢুকে গেল ৩০ বছরের শোক, অপেক্ষা আর একটা অস্ফুট বিদায়বাণী। পোস্টমাস্টার জিজ্ঞেস করেন, “জরুরি চিঠি?” নন্দিনী বলেন, “খুবই জরুরি, যদিও তাতে ঠিকানার চেয়ে বেশি লেখা আছে অপেক্ষার ছাপ।” চিঠি পাঠানোর পর, তারা দু’জনেই বুথটার দিকে ফিরে তাকায়—একটা অচল যন্ত্র, তবু কত কথার, কান্নার, ভালোবাসার আধার হয়ে উঠেছিল সে। এখন তাতে ধুলো জমেছে, কিন্তু তাতে জমে আছে ইতিহাসও।
সন্ধ্যেবেলায় অনুরাধা চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েন। কোনো ডাক্তার, ওষুধ, পঞ্জিকা তাঁকে আর স্পর্শ করতে পারে না। তিনি কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না—কিন্তু নন্দিনী জানে, তিনি আর অপেক্ষা করছেন না। তাঁর অপেক্ষা একটা চিঠির ভিতর ঢুকে পড়েছে, একটা খামের দিকে তাকিয়ে এখনও হাওয়ার কাঁধে উড়ে চলেছে। এই শহরের প্রতিটা ফোন বুথ, প্রতিটা নিষ্প্রাণ রিসিভার যেন আজ আরও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে—কারণ অনুরাধার মতো কেউ না কেউ এখনও বিশ্বাস করে, ফোনের ওপারে কেউ না কেউ শুনছে, হয়তো বলছে না, তবু শুনছে নিঃশব্দে।
অধ্যায় ১০
সময় পেরিয়ে গেছে কয়েক মাস। শহরের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো ফোন বুথটিতে এখন ধুলো জমে, কাঁচে জং ধরা রেখা। চায়ের দোকানে সোমনাথ এখনও চা বিক্রি করে, নন্দিনী মাঝে মাঝে আসে, কখনও চা খায়, কখনও একটা পুরোনো খাতা খুলে বসে থাকে। আজও সেই রবিবার। ঘড়ির কাঁটা ঠিক দশটার ঘরে আসে, এবং হঠাৎ যেন দুজনেই চুপ করে যায়। কেউ আসে না। বুথ ফাঁকা। কিন্তু হাওয়ায় একটা অদ্ভুত গন্ধ ভাসে—পুরোনো বইয়ের গন্ধ, চিঠির ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসা অনুভূতির মতো। নন্দিনী ধীরে ধীরে তার খাতাটা খুলে লেখে—“একজন মানুষ, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলেন যে কেউ ফোনের ওপারে শুনছে—তিনি আসলে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতীক। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, সংযোগের জন্য সবসময় আরেকজনের প্রয়োজন হয় না—প্রয়োজন হয় নিজের সত্যকে ধরে রাখার ক্ষমতা।”
চিঠি পৌঁছেছিল। কয়েক সপ্তাহ পর, ব্রিটেনের একটি অবসরপ্রাপ্ত ছাত্রাবাসের ঠিকানায় সেই চিঠির খাম হাতে পেয়েছিলেন একজন কর্মচারী। তিনি অবাক হয়ে দেখেছিলেন ঠিকানার নাম—“A. Mitra”—কারণ সেই ছাত্রাবাসে এমন কেউ কোনওদিন বাস করেনি। তবে আশেপাশের এলাকার পুরোনো নথি ঘেঁটে পাওয়া যায়, একজন ভারতীয় ছাত্র সত্যিই ১৯৯০ সালে নিখোঁজ হয়েছিল ঠিক এই এলাকা থেকেই। সংবাদটি একটি স্থানীয় পত্রিকায় ছোট করে ছাপা হয়—“An Indian mother’s letter reaches a thirty-year-old ghost address.” এই ছোট্ট খবরটুকু সোমনাথ একদিন অনলাইনে দেখে, এবং চুপচাপ প্রিন্ট করে এনে দেয় নন্দিনীর হাতে। নন্দিনী পড়ে আর কিছু বলে না—শুধু সেই চিঠি আর খবরের কাটিং একসঙ্গে একটি খামে ভরে অনুরাধার ঘরে সাজিয়ে রাখা একমাত্র ফটোফ্রেমের পেছনে রেখে আসে। অভিজিৎ মিত্রের ছবির নিচে তখনও লেখা আছে: “বাড়ি ফিরে এসো…”
সেই বুথটিকে এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। কিন্তু সোমনাথ তাকে নষ্ট হতে দেয়নি। সে মাঝে মাঝে কাঁচ মুছে দেয়, ভিতরের বোতামগুলোয় হালকা ধুলো ঝাড়ে। কেউ ফোন করে না, তবু বুথটা যেন কথা বলে—সেইসব মানুষের হয়ে, যারা কথা বলার জন্য শুধু একজন শ্রোতার ভান চায়। অনুরাধা মিত্র আর নেই, তবু তাঁর গল্প থেকে গেছে—চিঠির মধ্যে, বুথের ভিতরে, আর সেই নিরব সময়ে, যখন কেউ একজন প্রতিবার নিজের কাছেই ফিরে আসার চেষ্টা করত।
নন্দিনী গবেষণার কাজ শেষ করে এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে না। সে এখন শহরের এক ছোট্ট লাইব্রেরি চালায়, যার নাম দিয়েছে—”The Silent Line”। সেখানে আছে একটি কোণাঘর, যেখানে রাখা আছে সেই ট্রাঙ্কভর্তি চিঠি, বুথের ছবি, এবং একটি ছোট্ট নোট, যাতে লেখা—“তুমি ফোন না তুললেও, আমি জানি, তুমি একদিন শুনবে।”
___




