Bangla - রহস্য গল্প

টেরাকোটার চোখ

Spread the love

অর্ঘ্য সেন


বিষ্ণুপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। হালকা কুয়াশা, কাঁপা কাঁপা আলো, আর ছায়ার মতো লোকজন। অরণ্য সান্যাল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল। তার চোখে ঘুম নেই, মাথায় ঘুরছে কেবল একটি পুরনো নথির লাইন—“মল্ল রাজাদের শেষ টেরাকোটা মন্দির, যার প্রবেশদ্বারেই আছে ‘চোখ’—যা দেখে, কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।” কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে পাওয়া শতবর্ষ পুরনো এক জার্নালে সে এই লাইন পড়েছিল, তারপর থেকেই যেন এক টান অনুভব করছে, একটা ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণ।

টোটোয় বসে সে স্থানীয় হোমস্টের দিকে রওনা দেয়, সাথে তার সহকারী দেবাশীষ। ছেলেটা নতুন, কিন্তু উৎসাহে টগবগ করছে।

“স্যার, ওই চোখটা কি আসলেই আছে?”

অরণ্য মাথা নাড়ল। “খুব কম তথ্য আছে। কিন্তু যদি থাকে, তাহলে এটা শুধু প্রত্নতত্ত্বের বিষয় না, এটা এক ইতিহাসকে নতুন করে বোঝার চাবিকাঠি।”

দেবাশীষ জানালার বাইরে তাকিয়ে, রোদ উঠছে ধীরে ধীরে, লাল মাটির গ্রামগুলো একে একে পেছনে পড়ে যাচ্ছে।

দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছে যায় বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির এক পরিত্যক্ত অংশে। লোকমুখে বলা হয়, এই দিকটায় কেউ আসে না—কারণ এখানে সময় দাঁড়িয়ে থাকে। অরণ্য অবশ্য অতটা ভাবেনি। সে শুধু জানত, টেরাকোটার কাজে বিষ্ণুপুর অদ্বিতীয়, আর যদি এই চোখ সত্যি হয়, তাহলে সে এক অলৌকিক শিল্প-আবিষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ধুলো, গাছপালা, ভাঙা দরজা পেরিয়ে তারা প্রবেশ করে মন্দির প্রাঙ্গণে। ভিতরে ঢুকতেই অরণ্য থমকে যায়। সামনেই এক দালান—ছোট, গোল, ঘরবদ্ধ। দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় খসে পড়া টেরাকোটা। কিন্তু দক্ষিণ দিকের প্রাচীরে একটি মুখ ঠিকঠাক রয়েছে।

অরণ্য ধীরে ধীরে কাছে যায়।

মুখটা অদ্ভুত—একেবারে সাধারণ কিম্বা ঐতিহাসিক মনে হয় না। তার চোখদুটো যেন কাঁদছে, আবার হেসে উঠছে। চোখের মধ্যে কেমন এক গভীরতা—যেটা দেখে মনে হয়, কেউ যেন তাকিয়ে আছে।

“স্যার, ওটা কি… চোখ?”

অরণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। “হ্যাঁ, ওটাই।”

সে পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বের করে। চোখে আলো ফেলতেই মনে হয় যেন পাথরের মাঝে কিছু দুলে উঠল।

দেবাশীষ একটু ভয় পায়, পিছিয়ে যায়।

“ওটা দেখছে স্যার…”

“ছিঃ, পাথরের চোখ এসব করে না,” অরণ্য বললেও কণ্ঠে নিশ্চিততা নেই।

রাতে হোমস্টেতে ফিরে এসে অরণ্য আর ঘুমোতে পারে না। চোখদুটো বারবার মনে পড়ে। তারা কীভাবে যেন তার ভিতরের দিকটা খুঁড়ে ফেলছিল, যেন তাকিয়ে থাকলেই মনে হয় কেউ তাকে চিনে ফেলেছে—ভিতরের সবটুকু।

সে উঠে ডেস্কে বসে নোট লিখতে শুরু করে। সময় এগোয়, কিন্তু তার কলম থেমে যায় একটা বাক্যে—“আমি তাকাচ্ছি, অথচ দেখছি না—আমার দেখা হচ্ছিল।”

রাত তিনটে নাগাদ সে আবার টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে মন্দিরে ফিরে যায়। দেবাশীষ তখন ঘুমে অচেতন।

মন্দিরে ঢুকেই অরণ্য দেখে, সব চুপচাপ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, হাওয়ার মৃদু সোঁ সোঁ। সে টর্চ চালায়, আবার সেই মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়।

এইবার সে চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শিথিল করে। প্রায় ধ্যানের মতো। ধীরে ধীরে তার চোখে ভেসে ওঠে এক দৃশ্য—

এক সোনালী রঙের সিঁড়ি, রাজদরবার, মেঝেতে রক্ত, আর এক রাজকন্যা কাঁদছে। তার কণ্ঠে এক অজানা সুর, কিন্তু সেই সুর যেন টেরাকোটার গায়ে খোদাই হয়ে যাচ্ছে।

অরণ্য চমকে উঠে।

সে পিছিয়ে আসে, চোখে ভয়, আর বিস্ময়।

কিন্তু মুখটা এখন অন্য রকম। মনে হচ্ছে, একটু হাসছে। যেন বলছে, “তুমি এখন আমার গল্পের ভিতরে ঢুকে গেছ।”

অরণ্য ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করে। মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে সে আকাশের দিকে তাকায়।

তারা নেই।

চাঁদ নেই।

শুধু চোখ।

সকালবেলা দেবাশীষ যখন ঘুম ভেঙে উঠে দেখে স্যারের বিছানা খালি, তখন প্রথমে ভাবল উনি হয়তো বাইরে হাঁটতে গেছেন। কিন্তু ডেস্কে অরণ্যর খাতায় খসখসে অক্ষরে লেখা মাত্র একটা লাইন—“আজ আমি দেখেছি, কিন্তু কেউ আমায় দেখছিল।” সেটা দেখে ওর বুক কেঁপে ওঠে।
অরণ্য তখন মন্দিরের সামনে বসে, ঘাসের উপর। তার চোখে রাতজাগা ক্লান্তি, কিন্তু মনভরা এক আলো।
দেবাশীষ কাছে যেতেই অরণ্য বলে উঠল, “আমি তাকে দেখেছি, দেবু। এক রাজকন্যা। নাম বলেছিল রত্নাবতী। তার চুলে ছিল জবা ফুল গাঁথা, আর কপালে এক ফাঁকা তিলক। সে কাঁদছিল, কিন্তু সেই কান্নার ভেতরেও এমন এক দৃঢ়তা ছিল… যেন কোনো যুদ্ধ শুরু হওয়ার অপেক্ষায়।”
দেবাশীষ একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। “স্যার, আপনি স্বপ্ন দেখেছেন নাকি?”
“না। এই চোখ দেখিয়েছে। এই মুখটা, এই পাথরের চোখ—ও যেন একটা ক্যামেরা, না, একটা দরজা। অতীতের ভিতরে ঢোকার দরজা। আমি গত রাতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিক দশ মিনিট। কিন্তু আমার মাথায় সময় কেটেছে যেন এক ঘন্টা। আমি সবকিছু অনুভব করেছি—ধুলো, রক্ত, জ্বর, কান্না, আর সঙ্গীত।”
দেবাশীষ কাঁপা কণ্ঠে বলে, “আপনি এখনো একটু বিশ্রাম নেন, স্যার?”
অরণ্য চুপ করে থাকে। তার চোখ যেন অতীতেই আটকে আছে।
দুপুরে, ক্যামেরা আর নোটবুক হাতে, তারা আবার মন্দিরে যায়। এবার অরণ্য নিজেই ক্যামেরা সেট করে দেয়ালের মুখটার দিকে। এইবার সে চোখ বন্ধ করে বসে।
শুরু হয় আবার সেই দেখার যাত্রা।
এইবার অরণ্য দেখে—
এক ছোট্ট কক্ষ। কুপি জ্বলছে। রত্নাবতী একা বসে আছে, সামনে এক চর্মনাদ। তার আঙুলে গিঁট, কিন্তু সে গান গায়। গলায় সেই সুর, যেটা অরণ্য আগেও শুনেছিল—
“তুমি যদি আসো, আমি চোখ খুলব না
তুমি যদি ডাকো, আমি উত্তর দেব না
তবুও জানব, তুমি এসেছ
আমার নীরবতার ভিতর দিয়ে”
সে হঠাৎ বলে ওঠে, “আমার চোখ কেউ দেখছে।”
অরণ্য কেঁপে ওঠে। এইবার সে শুধুই পর্যবেক্ষক নয়, সে যেন দৃশ্যের অংশ।
রত্নাবতী চোখ তুলে তাকায়—সে সরাসরি তাকায় অরণ্যের দিকে। না, দেয়ালের দিকে নয়, একেবারে তার চোখে।
“তুমি কে?”
অরণ্য বলার চেষ্টা করে, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে যায়। শব্দ হয় না।
রত্নাবতী আবার বলে, “তুমি কি ইতিহাস, না ভবিষ্যৎ?”
হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ে। রত্নাবতী গান থামিয়ে বলে, “সে এসেছে।”
অরণ্যর দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই মুহূর্তে সব অন্ধকার।
সে হঠাৎই বাস্তবে ফিরে আসে—দেখে দেবাশীষ তাকে ঝাঁকাচ্ছে।
“স্যার, স্যার, আপনি দশ মিনিট ধরে শ্বাস নিচ্ছেন না প্রায়! আপনি ঠিক তো?”
অরণ্য ধীরে ধীরে ওঠে। গলার স্বর ভারি, চোখ লাল।
“সে আমাকে দেখতে পেয়েছে।”
“কে?”
“রত্নাবতী। এই মুখের ভেতর দিয়ে আমি শুধু অতীত দেখিনি, অতীতও আমায় দেখেছে।”
দেবাশীষ ভয় পায়, কিন্তু কিছু বলে না।
রাতে অরণ্য নিজেকে ঘরবন্দি রাখে। সে লিখতে থাকে সেই গান, সেই কণ্ঠস্বর, সেই দৃশ্য, যতটুকু মনে রাখতে পারে। সে বুঝে যায়, এটা শুধু শিল্প নয়। এটা এক আত্মা, যাকে কেউ বন্দি করে রেখেছে এই মুখের ভেতর।
রাত বাড়ে। হঠাৎ জানালার কাঁচে ছায়া।
অরণ্য উঠে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু জানালার কাঁচে ভিজে লেখা—“আগুন আসবে। প্রস্তুত হও।”
সে এবার প্রথমবার ভাবে—এই চোখ কি সত্যিই শুধু অতীত দেখায়? নাকি সামনে কী আসছে, তারও পূর্বাভাস দেয়?
ঘড়িতে রাত ৩:৪৭। বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। কিন্তু তার ভেতরে এক ভয়াবহ নীরবতা—যেটা বলে, গল্পটা এখন শুরু হচ্ছে।
আর সে, অরণ্য সান্যাল, এই গল্পের আর একটা চরিত্র হয়ে গেছে—সেই চোখের দৃষ্টি দিয়ে তৈরি।

অরণ্যর ঘুম ভেঙে যায় ভোর পাঁচটায়। অথচ সে জানে, আজ রাতে সে ঘুমায়নি। জানালার বাইরে অন্ধকার ম্লান হয়ে আসছে, পাখির ডাক শুরু হয়েছে, অথচ তার ভিতরটা অদ্ভুত ভারে ঠাসা। মনে হচ্ছে, তার মন নয়, যেন মগজে কেউ একটা লুকানো পাণ্ডুলিপি ঢুকিয়ে দিয়েছে—যেটা সে না চাইতেও পড়ে ফেলছে।
সে খাতাটা টেনে নেয়, যা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখার জন্য নিয়ে এসেছিল। লিখতে শুরু করে—
“রত্নাবতী আমায় বলেছিল, ‘আগুন আসবে।’ আমি জানি না এটা ভবিষ্যৎ, না অতীত। কিন্তু আজ সেই আগুনের গন্ধ যেন বাতাসে লেগে আছে।”
দেবাশীষ তখনো ঘুমোচ্ছে, বিছানার কোণে একটা অর্ধেক খাওয়া গুড়বাতি পড়ে আছে।
অরণ্য ধীরে ধীরে উঠে তৈরি হয়। আজ সে ফের মন্দিরে যাবে, কিন্তু এইবার সে শুধু চোখে তাকাতে নয়, দেয়ালের চারপাশটা ঘুরে দেখতে চায়।
দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছোয়। মন্দিরে ঢুকে অরণ্য সোজা মুখটার সামনে না গিয়ে বাঁদিকে ঘোরে।
তারা প্রথমবার খেয়াল করে, দেয়ালের অন্য পাশে কিছু খোদাইয়ের চিহ্ন আছে—একটি ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রাজপুত্র, আর এক মহিলার হাতে অগ্নিশিখা। ছবিগুলো খসে খসে পড়ছে, কিন্তু অরণ্য বুঝতে পারে, এই ফ্রেমটা সেই গল্পের সূচনা হতে পারে—যা রত্নাবতীর কণ্ঠে সে শুনেছিল।
হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়।
মাটিতে একটা পাথরের ফলক—ভাঙা, তবু স্পষ্ট তিনটি শব্দ:
“জ্ঞান নয়, আগুন”
সে ফিসফিস করে বলে, “আচ্ছা… রত্নাবতীর লড়াইটা কি জ্ঞানের বিরুদ্ধে ছিল?”
দেবাশীষ অবাক হয়ে বলে, “মানে?”
অরণ্য এবার মুখের সামনে গিয়ে বসে পড়ে। আবার তাকায় চোখে।
এইবার দৃশ্য শুরু হয় আরও তীব্রভাবে।
সে দেখে—
রাজদরবারে সভা বসেছে। সোনালি ছাউনির নিচে বসে আছেন রাজা মল্লবর্মণ। তার ডানদিকে সেনাপতি, বাঁদিকে প্রধান পুরোহিত। দরবারের এক কোণে বসে আছে রত্নাবতী, গায়ে মণিকাঞ্চন চাদর, কপালে রক্তচাপা তিলক।
সবার মধ্যে তীব্র বিতর্ক চলছে।
“রত্না দেবী, আপনি একজন রাজকন্যা, রাস্তায় নেমে শাস্ত্র বিতরণ করছেন? আপনার গলায় সঙ্গীত, হাতে প্রতিবাদ—এই ভাবে মল্ল রাজবংশ চলবে না!”
রত্নাবতী ধীরে বলে, “আমি কোনো রাজবংশ চালাতে আসিনি। আমি যা দেখি, তা বলি। আমি যা বুঝি, তা লিখি। সেটা কেউ ভয় পেলে, তার মানে তো সত্যে আঘাত লেগেছে।”
পুরোহিত চোখ তুলে বলে, “আপনার ভাষা রাজরক্তের উপযুক্ত নয়। নারী কখনো ইতিহাস লেখে না।”
রত্নাবতী উঠে দাঁড়ায়, তার চোখে সেই আগুন।
“আমার ভাষা আমার অস্ত্র। আর ইতিহাস? ওটা দেয়ালে খোদাই করা আছে। শুধু চোখ লাগলেই পড়ে যাবে। আমি হয়তো লিখে যাব না, কিন্তু একদিন কেউ এসে ঠিকই পড়ে ফেলবে।”
রাজা চুপ করে শোনেন। হঠাৎ তিনি বলেন, “রত্না, তুমি জানো না—এই রাজ্যের প্রাচীরেও কান আছে। এই মুখগুলো শুধু শিল্প নয়, এরা স্মৃতি রাখে। তুমি যদি বেশি আগুন ছড়াও, সেই আগুন তোমাকেই পোড়াবে।”
রত্নাবতী হাসে।
“তাহলে পুড়তে প্রস্তুত থাকি।”
এইবার অরণ্য দেখে—সেই মুখ, যেটার চোখে সে তাকিয়ে আছে—এই রাজদরবারের এক কোণে গাঁথা। সেটি সেই সময়েই ছিল।
তখনই কে যেন তার কানে বলে ওঠে, “তুমি আমার গল্প লিখবে?”
অরণ্য চমকে ওঠে। চারপাশে অন্ধকার। চোখের সংযোগ কেটে যায়। সে আবার মন্দিরের ধুলোয় পড়ে যায়।
দেবাশীষ তাকে ধরে ফেলে।
“স্যার, সব ঠিক?”
অরণ্য ধীরে ধীরে উঠে বসে। তার কপাল ঘামে ভিজে, চোখ লাল।
সে বলে, “এই রাজবাড়ির মধ্যে ষড়যন্ত্র ছিল। রত্নাবতী কেবল রাজকন্যা নয়, সে ছিল এক বিপ্লবী। আর এই মুখগুলো ছিল সেই বিপ্লবের প্রহরী। এখন বোঝা যাচ্ছে, কেন এই মুখকে কেউ নষ্ট করেনি—ওরা ভয় পায়। কারণ ও এখনো সব মনে রাখে।”
দেবাশীষ বিস্ময়ে বলে, “আপনার মানে, এই মুখ জীবন্ত?”
“জীবন্ত না হলেও সচেতন। এই চোখে যা দেখি, তা শুধু ইতিহাস নয়—তা এক যুদ্ধ। আগুনের যুদ্ধ।”
সেদিন রাতে হোমস্টেতে ফিরে এসে অরণ্য সিদ্ধান্ত নেয়, সে এখানেই থাকবে যতদিন না পুরো গল্প সে বুঝে ফেলে। রত্নাবতীর আত্মা, এই চোখের স্মৃতি, আর আগুন—সবকিছুর জট খুলতে হবে।
তার কানে এখনো বাজছে সেই কণ্ঠ—
“তুমি আমার গল্প লিখবে?”
এবং সে জানে, উত্তর হ্যাঁ।

অরণ্য এখন দিনের পর দিন মন্দিরে যাচ্ছে, অথচ তার শরীর এখানে আছে, মন কোথায় যেন অন্য এক কালের ভেতর ডুবে আছে। রাত্রি ও দিবসের পার্থক্য তার কাছে এখন কেবল একটি চোখের পলক ফেলার ব্যাপার। দেবাশীষ খেয়াল করে, স্যারের খাওয়া কমেছে, চোখের নিচে কালি জমেছে, আর মাঝে মাঝে সে একা একাই কথা বলে।
এক সন্ধ্যায় অরণ্য হঠাৎ বলে ওঠে, “রত্নাবতী আমার সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু কথাগুলো শব্দে নয়, ছবি হয়ে আসে—প্রাচীন শব্দ, পুরনো গন্ধ, রক্তের রং, আগুনের ঝলক। তুমি বলো দেবু, এগুলো কি স্মৃতি, না দর্শন?”
দেবাশীষ কিছু বলতে পারে না। তার ভয় হচ্ছে।
রাত তিনটের দিকে অরণ্য ফের একবার চোখের সামনে বসে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। এবার সে চোখ বন্ধ করেই অপেক্ষা করে।
হঠাৎ সে এক হালকা আলোর রেখা দেখে।
তাকে দেখা যায় রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে, যেখানে রত্নাবতী বসে আছে আয়নার সামনে। আয়নায় সে নিজেকে চায় না, বরং তাকিয়ে আছে এক শূন্যতায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন দাসী কেশ বেঁধে দিচ্ছে।
“কেমন করে চেনা যায় এমন একজনকে, যে এসেছে ইতিহাস থেকে?” রত্নাবতী জিজ্ঞেস করে।
দাসী চুপ করে থাকে।
রত্নাবতী আবার বলে, “সে আমায় দেখে, অথচ কথা বলতে পারে না। আমি জানি না সে আমার বন্ধু, না গুপ্তচর।”
এইবার রত্নাবতী আয়নার মধ্যে অরণ্যকে দেখতে পায়—স্পষ্ট, জ্যান্ত।
“তুমি কি আমার গল্পের লেখক, না পাঠক?”
অরণ্য কিছু বলার আগেই দৃশ্য কেটে যায়।
সে হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় মন্দিরের ধুলোয়। তার কাঁধে হাত—দেবাশীষ।
“স্যার, এবার অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। শরীর খারাপ করে ফেলবেন।”
অরণ্য ধীরে উঠে বসে, চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। সে আসলে এখন দুই দুনিয়ার মাঝখানে। একদিকে বিষ্ণুপুরের রাজদরবার, রত্নাবতীর অভ্যন্তর, অন্যদিকে তার কলকাতার জীবন—জলখাবার, মেইল, ক্লাস, সভা।
সে চুপচাপ বলে, “আমি আর ফিরে যেতে পারব না।”
দেবাশীষ ব্যাগ থেকে জল বের করে দেয়। “কোথা থেকে?”
“এই সময় থেকে।”
রাত বাড়তে থাকে। হোমস্টের ঘরটা আজ আরও অচেনা লাগে। দেয়ালের ছবি, জানালার কাঁচ, বিছানার চাদর—সব কেমন যেন পুরনো হয়ে গেছে। অরণ্য ঘরের কোনায় বসে খাতায় লিখতে শুরু করে—
“আমার মধ্যে দুটো সত্তা জন্ম নিচ্ছে। এক আমি, যে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী। আর এক আমি, যে এখন রোজ রাতে রত্নাবতীর সঙ্গে কথা বলে। যে তাকে দেখে চোখের ভিতর, তার কণ্ঠ শুনে হাওয়ার শব্দে। কে আমি? কোন সময়ের বাসিন্দা?”
হঠাৎ আলো বন্ধ হয়ে যায়।
ঘর অন্ধকার।
একটা ছায়া জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে।
অরণ্য এগিয়ে যায়, কিন্তু ততক্ষণে ছায়া মিলিয়ে গেছে।
কিন্তু জানালায় লেখা একটা লাইন, যেন নখ দিয়ে আঁচড়ে কেউ লিখেছে—
“তুমি ফিরে গেলে গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”
সকালে হোমস্টের মালিক এসে খবর দেয়, “স্যার, আপনাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোন এসেছে। আপনি গত এক সপ্তাহ ধরেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আপনার সহকর্মীরা চিন্তিত।”
অরণ্য কিছু বলে না। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা—সে ঠিক কতদিন এখানে আছে?
সে ক্যালেন্ডারে দেখে, আজ তার বিষ্ণুপুর আসার দশম দিন। অথচ তার মনে হচ্ছে, সে অন্তত এক মাস ধরে রত্নাবতীর সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে।
সে নোটবুকে লিখে, “সময়ের হিসেব যেন বদলে যাচ্ছে। আমি এখন দিন গুনছি চোখের ছায়া দিয়ে, আর রাত বুঝছি তার কণ্ঠের দোলায়।”
দেবাশীষ বলে, “স্যার, হয়তো কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে বাড়ি ফেরা দরকার।”
অরণ্য ধীরে মাথা নাড়ে।
“না। আমি এই গল্প শেষ না করে ফিরতে পারব না। আমি এখন কেবল দর্শক না—আমি এখন চরিত্র। আমি এখানে না থাকলে গল্পটা থেমে যাবে। আর জানো? হয়তো সেটাই ওরা চায়।”
“কারা?”
অরণ্য তাকিয়ে থাকে চোখের মুখটার দিকে।
“যারা এই চোখের ভিতর ইতিহাসকে বন্দি করে রেখেছে।”
সে বুঝে যায়, এই মন্দির শুধু এক গোপন প্রেমের গল্প নয়, এটি এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের দলিল। রত্নাবতী শুধু প্রেমিকা নয়, সে এক বিপ্লবের চাবিকাঠি—আর সেই বিপ্লবকে কেউ লুকিয়ে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আর এখন সেই স্মৃতি জাগছে, অরণ্যের চোখের ভিতর দিয়ে।
সে আর ফিরতে পারবে না। হয় সে এই গল্প শেষ করবে, নয়তো সেই মুখের ভেতরেই মিশে যাবে—আরও এক চরিত্র হয়ে, আরেকটি খোদাই।

বৃষ্টি পড়ছে সারারাত। অরণ্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, টিপটিপ শব্দ শুনছে—কিন্তু তার মন যেন সেই শব্দের গভীরে গলে যাচ্ছে। বিছানায় ছড়িয়ে আছে পুরনো দলিল, টেরাকোটার খোদাইয়ের স্কেচ, রত্নাবতীর কণ্ঠের লাইনগুলো যা সে গত কয়েক রাত ধরে মনে রাখছে, লিখে রাখছে, আবার কাটছাঁট করছে।
এইসব তথ্য, এইসব চিহ্ন—এসব কেমন যেন এক অদৃশ্য ছকের মতো মিলছে।
দেবাশীষ তখন ঘরের কোণে বসে টর্চ ঠিক করছে।
“স্যার, আপনি যখন চোখে তাকান, তখন ঠিক কী দেখেন?”
অরণ্য চুপ করে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলে, “কখনও আমি দেখি রত্নাবতীর চোখ, যেখানে প্রশ্ন আছে। কখনও দেখি রাজদরবার, যেখানে ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু গতকাল রাতে… আমি দেখেছিলাম আগুনের ভিতরে জেগে থাকা এক মূর্তি, যার গায়ে ছিল অশুদ্ধ টেরাকোটা, যার মুখ কাঁদছিল। আর কেউ বলছিল, ‘আমায় মুক্তি দাও।’”
“আপনি কী মনে করেন, ওটা রত্নাবতী?”
“না, দেবু। আমি এখন ভাবছি, এই চোখটা আসলে ওর নয়। এটা এক অভিশপ্ত কণ্ঠ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী আটকে আছে দেয়ালের ভিতর। আর রত্নাবতী সেই অভিশাপের গল্প জানত। হয়তো সে মুক্তি দিতে চেয়েছিল।”
সেইদিন বিকেলে অরণ্য আবার মন্দিরে যায়। এবার সে নিয়ে যায় লাল রঙের এক ক্রেয়ন। দেয়ালের খোদাইয়ের ফাঁকে সে ঘষে ঘষে বের করতে থাকে কিছু লুকানো চিহ্ন—
একটি প্রতীক উঠে আসে:
এক ত্রিভুজের ভিতর চোখ, তার নিচে আগুন, আর পাশে একটি ভাঙা কাঁকুড়ির মতো আকৃতি।
সে হঠাৎ চিনে ফেলে—এটা তো সেই গোপন প্রতীক যা রাজবংশের ‘ঋদ্ধগুপ্ত রক্ষক দল’ ব্যবহার করত। ইতিহাসে এই দলটির নাম শুধু একবার এসেছে—“যারা রাজ্যর গোপন সত্য পাহারা দেয়, না বলে, না লিখে, শুধু চোখে দেখে।”
অরণ্যর শ্বাস আটকে আসে।
তার মাথার মধ্যে দ্রুত মিলতে থাকে সব খণ্ডচিত্র—রত্নাবতীর প্রতিবাদ, রাজপ্রাসাদের নীরবতা, চোখের স্মৃতি, আর সেই বারবার ফিরে আসা আগুনের ঝলক।
সে মুখটার সামনে গিয়ে বসে।
“তুমি যদি সত্যিই কিছু বলতে চাও, আমি এখন শুনতে রাজি।”
এইবার সে চোখে তাকায়। দৃশ্য ফুটে ওঠে—
এক রাত্রি। মল্লবর্মণ রাজা শয়নকক্ষে বসে আছে। তার সামনে পুরোহিত, সেনাপতি, আর এক বৃদ্ধ যিনি আগুনের দিকে তাকিয়ে বলছেন,
“প্রতীক আজ জেগে উঠেছে। কেউ তার খোঁজ করছে। কেউ ইতিহাসে প্রবেশ করছে। অভিশাপ আর চাপা থাকবে না।”
রাজা মাথা নিচু করে বলেন, “সে কে?”
পুরোহিত বলে, “সে আমাদের রাজবংশের বাইরের কেউ। এক আগন্তুক, যার সঙ্গে রত্নাবতীর আত্মা সংযোগ তৈরি করেছে। যদি সে সব জেনে ফেলে, আমাদের তৈরি এই প্রতিমা, এই চোখ—সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।”
বৃদ্ধ বলে, “অভিশাপ রক্ষা করে যে দেওয়াল, সেটি ভেঙে যাচ্ছে। যদি চোখের মানুষ প্রশ্ন তোলে, আমরা আর লুকিয়ে থাকতে পারব না।”
এইবার দৃশ্য ফেটে যায়।
অরণ্য বুঝে যায়—এই চোখ কেবল স্মৃতি দেখায় না, এই চোখ নিজে একটা অস্তিত্ব, একটা পাহারাদার। রাজবংশের সেই গুপ্ত সংগঠন এই চোখ তৈরি করেছিল অভিশাপ ঢাকতে।
কিন্তু অভিশাপ কী? কে অভিশপ্ত?
রাত বাড়ে। অরণ্য আর ঘরে ফেরে না। মন্দিরের মধ্যেই এক কোণে বসে থাকে, গায়ে চাদর, চোখে স্বপ্নভরা ক্লান্তি।
হঠাৎ গাছের পাতার শব্দের মধ্যে সে এক কণ্ঠস্বর শুনতে পায়—
“আমি লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দেয়ালে আমায় গেঁথে রাখা হলো।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আগুন দিয়ে গলা পোড়ানো হলো।
আমি প্রেম করতে চেয়েছিলাম, অথচ আমায় বলল—তুই ইতিহাস।”
অরণ্য উঠে দাঁড়ায়। “রত্নাবতী?”
কোনো উত্তর আসে না।
কিন্তু মুখটা হঠাৎ আলো ফেলে। মনে হয় চোখটা একটু নড়ে উঠল।
দেওয়ালের পাশের মাটি খুঁড়ে সে খুঁজে পায় একটা ধাতব ছোট বাক্স।
ভেতরে এক ভাজ করে রাখা পাতলা পুঁথি—
তার ওপরে লেখা—
“এই চোখ যদি খোলে, তবে ইতিহাস ফিরবে। আর যে দেখবে, সে আর ফিরতে পারবে না। কারণ চোখ চায়—একজন নতুন পাহারাদার।”
অরণ্য পড়ে যায় মাটিতে বসে। তার মনে হয়, এই চোখ এখন তাকে দেখে না—সে নিজেই চোখ হয়ে গেছে।
সে জানে, সে আর স্রেফ গবেষক নেই। সে এখন অভিশাপের বাহক, উত্তরাধিকারী—যে মুক্তি দিতে পারবে, আবার বন্দিও করতে পারে।
দূরে বাজ পড়ে।
রত্নাবতীর কণ্ঠ ফের ভেসে আসে—
“তুমি কি আমার গল্প শেষ করতে পারবে? নাকি তুমি নিজেই চোখ হয়ে যাবে?”

রাত অনেকটা কেটে গেছে। অরণ্য মন্দির থেকে ফিরেও ঘুমোতে পারছে না। শরীরটা ক্লান্ত, কিন্তু মগজ যেন জেগে উঠেছে নতুন কোনো বোধে। বারবার তার মনে হচ্ছে—পেছনের দেয়ালে কেউ তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা আলোয় তার ছায়া পড়ে বিছানার পাশে, কিন্তু ছায়াটা যেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নড়ছে না—বরং আলাদা।
সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে। প্রথমে কিছু অস্বাভাবিক লাগে না, কিন্তু একটু পর সে খেয়াল করে—তার চোখ যেন পাল্টে গেছে। যেন ঘন, কালো—আরও গভীর। টেরাকোটার সেই চোখের সঙ্গে আশ্চর্য মিল।
সে পেছন ফিরে তাকায়। জানালার কাঁচে ঘাম জমে, আর তাতে লেখা কিছু অক্ষর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়—
“তুমি এখন আর শুধু দেখছো না, তুমিও দেখা হচ্ছো।”
হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। সে জানে, এই রাত আর সাধারণ নয়।
সে বিছানায় বসে, কিন্তু চোখ বন্ধ করতে ভয় হয়। তবুও অবশেষে ক্লান্ত শরীর চোখ নামিয়ে আনে। ঘুম আসে না, আসে একটা দুলে ওঠা অনুভূতি, যেন এক পাল্লা দরজা খুলছে মাথার ভেতরে।
ঘুমের মধ্যেই সে নিজেকে দেখে—এক অন্ধকার ঘরে, দেয়ালে একের পর এক চোখ খোদাই করা। প্রতিটি চোখ থেকে বেরোচ্ছে ফিসফিস করা কণ্ঠ:
“আমরা দেখেছি সব। তুমি আমাদের মতো হয়ে যাচ্ছো।”
হঠাৎ এক চোখ থেকে আলো পড়ে তার মুখে, আর সেই চোখে ভেসে ওঠে রত্নাবতীর মুখ। এবার সে কাঁদছে না, বরং এক গম্ভীর শান্ত চোখে তাকিয়ে বলছে—
“তুমি কেবল চোখ ব্যবহার করছিলে, এখন তুমি চোখ হয়ে গেছো। এখন যা তুমি দেখবে, তা তোমার মধ্যেই আটকে থাকবে। তুমি আর বলতে পারবে না।”
অরণ্য জেগে ওঠে। শ্বাস ভারী, কপালে ঘাম।
দেবাশীষ পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসে।
“স্যার, কিছু হয়েছে?”
অরণ্য ধীরে ধীরে বলে, “ঘুমের মধ্যে আমি জেগে ছিলাম। আমি দেখছিলাম, কিন্তু যেন আমার শরীর আলাদা ছিল। আমি এক দেয়াল হয়ে গেছি।”
দেবাশীষ ভয় পায়, “স্যার, চলুন আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”
অরণ্য মাথা নাড়ে।
“না, ডাক্তার নয়। এটা অসুস্থতা না। এটা সংক্রমণ। সেই চোখ… আমার ভিতরে ঢুকে পড়েছে।”
সেদিন সারাদিন অরণ্য কিছু খায় না। কথা কম বলে। সে কেবল দেখে—জিনিসপত্র, দেওয়াল, মানুষের মুখ, ছায়া—সব কিছুই এখন অন্যরকম লাগছে। যেন তাদের অন্তরের গভীরতা তাকিয়ে পড়ে তার চোখে। সে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এক বৃদ্ধাকে দেখে, আর হঠাৎ বুঝে যায়, বৃদ্ধার ছেলে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না।
সে এক বাচ্চার দিকে তাকায়, বুঝতে পারে, মেয়েটা মা-বাবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত হাসে।
দেবাশীষ জিজ্ঞেস করে, “আপনি ওদের চেনেন?”
“না,” অরণ্য বলে, “কিন্তু এখন বুঝি।”
সে থেমে থেমে বলে, “এই চোখ শুধু অতীত দেখায় না। এটা মানুষের ভিতরের গোপনতম কথাও প্রকাশ করে। এই চোখ এখন আমার ভিতরে।”
রাতে সে নিজেই লেখে—
“আমার মন এখন জানালার মতো, বাইরে তাকালেই মানুষের অগোচরে লুকিয়ে থাকা গল্প দেখি। আমি এখন বুঝি, ইতিহাস শুধু দেয়ালে থাকে না, মানুষের শরীরেও থাকে—হাঁটার ভঙ্গিতে, কণ্ঠের কাঁপুনিতে, নীরবতার ভিতরে।”
রাত বাড়ে। আবার ঘুম নামে তার চোখে।
এইবার সে নিজেকে দেখে এক পুরনো সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে। রত্নাবতী সেখানে নেই। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধ, যাকে আগেও রাজদরবারে দেখেছিল।
বৃদ্ধ ধীরে বলে, “তুমি কি জানো, চোখ কেন খোদাই হয়েছিল?”
অরণ্য মাথা নাড়ায়।
“যাতে সত্য দেখা যায়।”
“না,” বৃদ্ধ হেসে ওঠে। “চোখ তৈরি হয়েছিল, যাতে কিছু সত্য চিরকাল চুপ করে থাকে। দেখে, কিন্তু বলে না। মুখ খুললে চোখও অন্ধ হয়ে যায়। তাই তোমাকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তুমি কি শুধু দেখবে, না বলেও ফেলবে?”
অরণ্য স্তব্ধ।
তার ঘুম ভাঙে তীব্র ঠান্ডায়।
সে দেখে, তার নিজের ডান চোখ থেকে একটু লালাভ জল গড়িয়ে পড়ছে।
আয়নায় গিয়ে দেখে—চোখ একটুখানি ফেটে গেছে।
সে হালকা হেসে ফেলে।
“চোখও কি কাঁদে?”
অথচ সে জানে, এটা কাঁদা নয়—এটা একটা খোলা জানালার অশ্রু। কারণ ভিতরের ইতিহাস আর চুপ করে থাকতে পারছে না।
রত্নাবতীর কণ্ঠ ভেসে আসে শেষ রাতে—
“তুমি যেদিন বলবে, সেদিন অভিশাপ ভাঙবে। কিন্তু তার আগেই, কেউ তোমাকে থামাতে চাইবে।”

সকালের রোদ উঠে এসেছে, কিন্তু অরণ্যের ঘরে আলো ঢুকছে না। সে পর্দা টেনে রেখেছে, দরজা বন্ধ, খাতা খুলে বসে আছে একান্তে। আজ তার কলম থামে না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে চলেছে সে—একটি মেয়ে, তার গান, তার প্রতিবাদ, তার ভয় আর তার স্বপ্নের কথা। রত্নাবতীর গল্প সে শুধু দেখছে না, এখন সে লিখছে।
এটা যেন অরণ্যের নিজের গল্প হয়ে উঠছে। যেন রত্নাবতীর আত্মা তার ভিতরে ঢুকে তার হাত ধরে লিখছে।
দেবাশীষ বারবার দরজা ঠুকছে,
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?”
অরণ্য উত্তর দেয় না।
অবশেষে দুপুর নাগাদ দরজা খুলে যায়। অরণ্যের চোখ লাল, কিন্তু ঠোঁটে অদ্ভুত এক প্রশান্ত হাসি।
সে বলে, “আমি আজ রত্নাবতীর কথা লিখেছি। আর এখন আমি সেটা প্রকাশ করব।”
“কোথায়?”
“যেখানে সবাই দেখতে পায়—অনলাইন, সংবাদমাধ্যম, প্রকাশনা। আমার আর ভয় নেই। আমি শুধু গবেষক নই এখন, আমি এখন ইতিহাসের ঋণ শোধ করতে এসেছি।”
দেবাশীষ অস্থির হয়ে বলে, “কিন্তু স্যার, আপনি তো নিজেই বলেছিলেন, কেউ আপনাকে থামাতে চাইবে।”
অরণ্য হাসে। “হ্যাঁ। আর আমি জানি, সেটা আজই শুরু হবে।”
বিকেলে তারা আবার মন্দিরে যায়। অরণ্য এবার হাতে রাখে একটি ছোট কাগজ, যাতে লেখা—
“আমি বলছি। আমার দেখা এখন শব্দ হয়ে উঠছে।”
সে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, “তোমরা যারা চোখ বানিয়েছিলে, যারা ইতিহাসকে আটকে রেখেছিলে—আমি তোমাদের কথা আজ ভাঙছি। আমি এই কাহিনি সকলকে শোনাব। আমি অর্পণ করছি নিজেকে এই চোখের বিপক্ষে।”
হঠাৎই বাতাস বদলে যায়। গাছ কাঁপে, মন্দিরের ভিতরে যেন এক গর্জন উঠে আসে। দেয়ালের চোখ গাঢ় হয়ে ওঠে, মনে হয় যেন পাথরের গা দিয়ে ধোঁয়া উঠছে।
দেবাশীষ ভয় পেয়ে পেছনে সরে যায়।
অরণ্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
এইবার সে আবার চোখে তাকায়।
এইবার সে দেখে—
রাজপ্রাসাদের সেই অন্ধকার কক্ষ। রত্নাবতী পড়ে আছে মাটিতে, তার গলা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে সেনাপতি, আর পুরোহিত কাঁপা হাতে এক চামচ আগুন নিয়ে এগিয়ে আসছে।
“তুমি ভুল করেছ রত্নাবতী। তোমার কণ্ঠ আর কেউ শুনবে না।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই রত্নাবতী উঠে বসে। তার চোখে আগুন।
সে বলে, “আমার গলায় যদি আগুন ঢালো, আমি সেই আগুনেই কথা বলব। এই চোখ, যা তোমরা বানিয়েছ—এটাই হবে তোমাদের পতনের দরজা। কেউ একজন একদিন আসবে, সে শুধু দেখবে না, সে বলবেও। এবং সে আমাকে অর্পণ করবে এই দেয়াল থেকে। সেই দিনেই এই অভিশাপ ভাঙবে।”
অরণ্য হঠাৎ বুঝতে পারে—সেই কেউ একজন সে-ই।
এইবার দৃশ্য বদলায়।
সে দেখে—পুরোহিত কাঁদছে। চোখ তার গলে যাচ্ছে। সেনাপতি পালাচ্ছে আগুনে দগ্ধ হয়ে।
রত্নাবতী উঠে দাঁড়িয়ে মন্দিরের দিকে হাঁটছে, মুখে এক অজানা সুর।
অরণ্যর মাথা ঘুরে যায়। সে মাটিতে পড়ে যায়।
দেবাশীষ দৌড়ে এসে ধরে ফেলে।
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?”
অরণ্য নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, “আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি।”
“কে?”
“রত্নাবতী। আর নিজেকেও। এখন চোখ কাঁদবে না, কারণ সে কথা পেয়েছে। আমি বলেছি।”
সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে।
“আমি এই লেখা পাঠাব সবার কাছে। প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, গল্প—যে নামে ছাপানো যাক না কেন, ইতিহাস এবার বেরিয়ে আসবে।”
কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সবকিছু অদ্ভুত হয়ে ওঠে।
তার ফোন কাজ করে না। ইন্টারনেট নেই। ল্যাপটপ চালু হয় না।
দেয়ালের কড়ি খুলে পড়ে।
জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে এক অচেনা মানুষ, মুখ অন্ধকারে ঢাকা।
সে বলে, “তুমি যা বলেছ, সেটা কেউ শুনতে পারবে না। এই চোখ যতদিন থাকবে, সত্য শুধু দেখা যাবে, বলা যাবে না।”
অরণ্য তার দিকে তাকায়।
“তুমি কে?”
“আমি পাহারাদার। অভিশাপের মুখ।”
অরণ্য চোখ নামায় না। সে বলে, “তাহলে এসো। চোখ আর ভয় পাবে না। আমি এবার বলেই যাব।”
সে জানে, তার সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু সে এখন চুপ থাকবে না।
সে জানে, রত্নাবতী অপেক্ষা করেছিল একজনকে, যে তার গল্প নিজের বলে ভাববে, নিজের মতো করে বলবে।
অরণ্য সেই মানুষ।
এটাই তার অর্পণ।

রাত একটার পর হঠাৎ চারদিকের সব আলো নিভে গেল। অরণ্য জানত, এই অন্ধকার প্রকৃত নয়—এটা চোখের তৈরি ছায়া, যা এখন তার ঘর ঘিরে ফেলেছে। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটা আর সেখানে নেই, কিন্তু তার অস্তিত্ব যেন দেয়ালের গায়ে ছায়া হয়ে ঠেস দিয়ে আছে।
অরণ্য বসে। খাতাটা টেনে নেয় সামনে। আর একবার লিখতে শুরু করে—এইবার শেষ করার জন্য।
“আমি লিখছি, কারণ কেউ একদিন শুধু তাকিয়ে ছিল বলে আজ আমি দেখতে পাচ্ছি।
আমি লিখছি, কারণ কেউ একদিন কিছু বলেছিল না বলেই আজ আমার বলার দায়িত্ব।”
তার কলম থেমে যায় না।
হঠাৎ জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে।
দেয়ালের ছবিগুলো পড়ে যায়। বাতাসে ভেসে আসে ছাইয়ের গন্ধ।
দেবাশীষ চিৎকার করে উঠে আসে পাশের ঘর থেকে,
“স্যার, বাইরে কোথা থেকে যেন আগুনের আলো দেখা যাচ্ছে!”
অরণ্য ধীরে বলে, “সেই আগুন, যে আগুন রত্নাবতীর কণ্ঠ পোড়াতে চেয়েছিল, সে আগুন আজ কথা বলতে চাইছে।”
মন্দিরের দিক থেকে ধোঁয়া আসছে।
তারা দৌড়ে যায়।
দেখে—মন্দিরের ভিতরে আগুন লেগেছে না, বরং দেয়ালের মুখ গা থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। সেই চোখটা এখন টেরাকোটার নয়, যেন গলন্ত পাথর।
অরণ্য সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সে চিৎকার করে বলে, “আমি শেষ করেছি রত্নাবতীর গল্প। এখন তোমার কাজ শেষ। তুমি আর পাহারা দেবে না।”
তখনই চোখটা ধীরে ধীরে ফেটে পড়ে।
এক ঝলক আলো, এক বিস্ফোরণের শব্দ, আর তারপর সব নিঃশব্দ।
দেবাশীষ চোখে হাত দিয়ে বলে, “স্যার! আপনি ঠিক আছেন?”
কিন্তু কোথাও অরণ্য নেই।
শুধু মাটিতে পড়ে আছে তার খাতা।
দেওয়ালে চোখ নেই, মুখ নেই—শুধু ফাঁকা, ধূসর এক ছায়া।
দেবাশীষ খাতাটা তুলে নেয়। পড়ে—
শেষ পাতায় লেখা:
“আমি এখন চোখের বাইরে। আমি এখন সেই স্থানে, যেখানে দেখা আর বলা—দুইই এক।”
এরপর অরণ্যের খোঁজ কেউ পায়নি।
পুলিশ আসে, রিপোর্ট লেখে, তদন্ত চলে, কেউ বিশ্বাস করে না তার চোখে অদ্ভুত কিছু ছিল।
কিন্তু এক মাস পর, এক সন্ধ্যায়, হোমস্টের বারান্দায় বসে থাকা এক বৃদ্ধা বলেন,
“সেদিন রাতে আমি দেখেছিলাম মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে একজন ছেলেকে—সে আর অরণ্য ছিল না, সে যেন এক চোখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে হাসছিল, আর তার শরীর থেকে বের হচ্ছিল পাথরের গন্ধ।”
দেবাশীষ সেই খাতা নিয়ে ফিরে যায় কলকাতায়।
সে সিদ্ধান্ত নেয়—এই লেখা সে ছাপাবে। রত্নাবতীর নামে, অরণ্যের নামে, সেই চোখের নামে।
এক ছোট প্রকাশনায় বের হয় বই—“টেরাকোটার চোখ”
সবার কাছে এটা এক বিস্ময়কর ইতিহাস-গল্প, অথচ দেবাশীষ জানে—এই বই শুধু গল্প নয়, এটা এক মুক্তি।
বইয়ের শেষ পাতায় লেখা থাকে:
“যে দেখেছিল, সে আজ নেই।
যে বলেছিল, তার কণ্ঠ এখন পাঠকের কণ্ঠে।
আর চোখ?
চোখ এখন তোমার ভিতরেও বাস করে।”

-শেষ-

1000024335.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *