Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

টিফিনবক্স

Spread the love

চৈতালি মুখার্জী


ভোর সাড়ে চারটে। দমদমের একটি পুরোনো একতলা বাড়ির উঁচু-নীচু ইটের মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা সরে আসে পায়ের পাতায়। মীরা কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। উনুনে কেরোসিন ঢালার শব্দ, দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে আগুন জ্বালায় সে—শব্দ হয় ফিসফিসে, অথচ বুকের ভিতর এই মুহূর্তেই যেন এক ধরণের আগুন জ্বলে ওঠে। চাল ধোয়া জল হাতে করে হাঁড়িতে ফেলে সে, পেঁয়াজ কুচো করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে—তাড়াহুড়োতে আঙুল কেটে গেলে পাত্তা দেয় না। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে সে মাঝে মাঝে—আজ তিনটি নতুন অর্ডার এসেছে, তার মানে ১৩টা টিফিন বানাতে হবে, একটাও যেন কম তেল না হয়, বেশ ঝাল না হয়, আরেকটায় যেন কড়ি পছন্দমতো নরম হয়। রান্নার ফাঁকে চোখ চলে যায় কোণের বিছানায়, যেখানে রবিন হুইলচেয়ারে বসে চুপ করে বাইরের জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে, এককালে যে লোকটা কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বলত, “তোর হাতের মাছটার তুলনা হয় না রে”, সে এখন আর কোনো মন্তব্য করে না। তাদের এই ঘরটার প্রতিটি কোণ, প্রতিটি জিনিস যেন স্মৃতি হয়ে গেছে—এককালে রান্নাঘর ছিল আলাদা, এখন একটা স্টিলের আলমারির পেছনে রান্না চলে, বাসনপত্র আর শ্বেতশুভ্র কাচা চালের গন্ধে ঘর ভরে যায়।

মীরার মেয়ে সঞ্চি ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে গিয়ে আধো ঘুমে বলে ওঠে, “মা, আজ টিফিনটা আমি বেঁধে দিচ্ছি”—মেয়েটা এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট ছোট হাত, কিন্তু অভ্যস্ত মায়ের পায়ের ছায়া হয়ে উঠতে। সে গোটানো টিফিন কৌটো গুলো খুঁটিয়ে দেখে—এইটাতে অমিতবাবুর আলুভাজা আছে তো? ওইটায় শান্তা ম্যাডামের ডিমকারি? নাকি ভুল করে পাল্টে গেল? মীরা ধমক দেয় না, ওর মধ্যে যে দায়িত্ব জন্ম নিচ্ছে সেটা দেখলে গর্ব হয়, কিন্তু সেই গর্ব ঢাকতে হয় ঠোঁটের কোণে এক কাপ চা তুলে। ভোরবেলার শহরের আওয়াজ তখনও জাগেনি, দূরে প্ল্যাটফর্মের ঘণ্টা বাজে ধীরে—লোকাল ট্রেনের ঘোষণা, গা ছমছমে নীরবতা, মীরার বুকের ভিতর একটা চিনচিনে উত্তেজনা—আজ যেন অনেকটাই ভরসার দিন, কারণ টিফিন বিক্রি ভাল হলে সঞ্চির স্কুলের টিউশন ফি মিটিয়ে দেওয়া যাবে। পাশের বাড়ির কাকিমা এসে একঝলক বলে যান—“আজকে জল একটু কম পড়বে, সকালবেলা মাটি শুকোবে না।” এসব কথা শুনেও মাথা গুঁজে কাজ করে যায় মীরা—তার চোখে এখন একটাই ছবি, লোকাল ট্রেনের কামরার ভিড়ে দাঁড়িয়ে টিফিন বেচা, আর যাত্রীরা মুখে তুলে বলছে—”খুব ভাল খাইয়েছো টিফিনদি”।

ট্রেনে ওঠার সময় গায়ের ঘাম পিঠে নেমে আসে। দমদম স্টেশনে হুড়োহুড়ির মধ্যে কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছোয় সে। একদিকে চা-ওয়ালারা হাঁকছে, অন্যদিকে ছাতা হাতে ধাওয়া করা মানুষজন—মীরা এই ভিড়ের মধ্যেও নিজের স্পেস খুঁজে নেয়। তার জায়গাটা প্রথম কামরার দরজার ধারে, জানালা খুললে হাওয়া খেলে যায় আর গায়ে ভিজে আসে নরম রোদ। হঠাৎ এক লোক বলে—”আজ একটু বেশি ঝাল হয়েছে কিনা?” মীরা মাথা নিচু করে বলে—”কাল রাতে লঙ্কা শুকিয়েছিল, ভাবিনি এমন হবে দাদা, আজ একটু কম দিয়েছি”—লোকটা তখন হাসে, মীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। প্রতিদিনকার এই ভিড়, কথা, দৃষ্টি—সবই তার চেনা, কিন্তু প্রতিদিনই সেটা নতুন লড়াই। গন্তব্য শিয়ালদহ বা ব্যারাকপুর হলেও তার প্রতিটি যাত্রা যেন নিজেরই জীবনের ট্র্যাকে চলার আরেক গল্প। যখন ট্রেন ছুটে চলে, তখন তার টিফিনবক্সগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে নিজের স্বপ্ন ছুঁতে চায়—একদিন সে নিজের দোকান খুলবে, “মীরার টিফিনঘর”, আর মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবে—এই ভোরবেলা রান্নার গন্ধে আর ট্রেনের হুঙ্কারে যেন জীবনের শব্দ মিশে যায়, অদৃশ্য রেললাইনে।

ট্রেনের গায়ে বেজে ওঠা ধাতব শব্দ, হঠাৎ টান দিয়ে থেমে যাওয়া, আর কামরার জানালা দিয়ে হু-হু করে ঢুকে পড়া হাওয়া — এই সবই মীরার দৈনন্দিন কর্মস্থলের একেকটি মুখ। দমদম স্টেশন থেকে শিয়ালদহগামী ৬:২০ লোকাল ট্রেনের প্রথম কামরার এক কোণেই দাঁড়িয়ে থাকে সে, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, তার ভেতর টিফিন কৌটো — প্লাস্টিকের ঢাকনা বাঁধা, চট দিয়ে মোড়া যেন খাবারের ভিতর তার মমতা লুকোনো থাকে। কামরায় উঠেই সে শুরু করে হাঁকডাক — “টিফিন, গরম খাবার, ডিমভাজা-ডালভাত-আলুর দম” — এইসব শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে ট্রেনের চলন্ত ছন্দে যেন তার গলার আওয়াজটাও তাল মেলে যায়। যাত্রীরা কেউ কেউ জানে তাকে, কেউ নতুন। একজন অফিসগামী যুবক প্রশ্ন করে — “আজ পাঁঠার মাংস আছে?” মীরা মাথা নাড়ায় — “সোমবার মাংস নয় বাবু, তেলের খরচেই হিমসিম”— তবু সে তার হাসি গোপন রাখে না, কারণ সেই হাসি দিয়ে দিনের শুরু হয়। একটা আসন খালি পেলে সে সেখানেই কিছুক্ষণ বসে পড়ে, একেকজন যাত্রী তাকে ডাকেন “টিফিনদি”, কেউ “মীরাদি”, কেউ “ও দিদি”—আর এই ডাকগুলোই যেন মীরার নিজস্ব দোকানের সাইনবোর্ড হয়ে দাঁড়ায়।

মীরার পাকা হাতের রান্নার গন্ধ কামরায় ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন খেয়ে বলেন, “তোমার রান্নায় মায়ের হাতের ছোঁয়া আছে”, কেউ আবার মজা করে বলেন, “আজ তো রান্নাটা ঝাল হইছে, বৌয়ের থেকে ভাল!” মীরা হাসে, বলে — “বৌয়ের কাছে বলবেন না দাদা, আজকাল মেয়েরা রাগ করলে ফ্রিজে রাখা ডাল খাওয়ায়।” এই ছোট ছোট কথোপকথনের ভেতর দিয়েই সে মানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় — শুধু খাবার নয়, এক চুমুক মানবিকতা সে পরিবেশন করে প্রতিদিনের কামরায়। ট্রেন যখন বরাহনগর ছাড়িয়ে বেলঘরিয়া পেরোয়, তখন মীরা জানে, তার হাতে আর মাত্র কয়েক মিনিট — টিফিনগুলো পৌঁছে দিতে হবে ঠিক লোকের হাতে। প্রতিটি যাত্রীই তার কাছে আলাদা — কারো ডায়াবেটিস, কারো গ্যাসের সমস্যা, কারো পেঁয়াজ খাওয়া মানা — সে সব মনে রাখে, ঠিকঠাক খাবার প্যাক করে, যেন এই চলমান রেলপথটাই তার রাঁধুনি জীবনের রুটম্যাপ। স্টেশনের আলো আর ছায়া, কামরার ভিড় আর গন্ধ, এই সবের মাঝেই সে গড়ে তুলেছে এক ক্ষুদ্র অথচ গর্বের স্বপ্ন — নিজের ব্যবসার ছায়া।

শিয়ালদহ এসে যখন ট্রেন থামে, তখন কামরার ঝাঁকুনিতে টিফিন বাক্সগুলো কেঁপে ওঠে একবার, মীরার কাঁধের ভারও নড়ে ওঠে—কিন্তু তাতে তার অভ্যেসের ব্যাঘাত ঘটে না। যাত্রীদের ভিড়ে কেউ ঠেলে যায়, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে বলে — “আস্তে চলুন দিদি, ব্যাগটা ভারী নিশ্চয়”, তখন সে এক দৃষ্টিতে তাকায়, ভাবে, “এই ভারই তো আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।” এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে ছাতার মতো টিফিন কভার ধরা — শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে বিলাস কাকুর দোকানে এসে দাঁড়ায় সে। কাকু বলে — “আজ কি মিষ্টি কিছু এনেছো? গরম খেয়ে মুখ মিষ্টি করতে ইচ্ছে করছে।” মীরা তখন টিফিনের ফাঁকে রাখা দুটো নারকেল নাড়ু বার করে দেয়। কাকু হাঁসতে হাঁসতে বলে — “তুই না আসলে প্ল্যাটফর্মটা ফাঁকা লাগে রে।” এইসব কথার পেছনে যে নির্ভরতা আছে, সেটা মীরা বোঝে, কিন্তু কখনও দেখায় না। বরং সে গুছিয়ে রাখে খালি কৌটোগুলো, স্টেশনের ধারে এক কোণে বসে নিজেরও একটুখানি খাবার খায় — ঠান্ডা ডালভাত, দুটো ভাজা লঙ্কা। এটাই তার “বিরতি”। আবার ট্রেন ধরতে হবে — এবার ব্যারাকপুরগামী। একটা কামরা, কিছু টিফিন, কিছু কথা, আর অনেকখানি স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিনের মতো সে এগিয়ে চলে — ট্রেনের কামরাতেই গড়ে ওঠে তার ছোট্ট দোকান, রেললাইনের পাশে জীবন চলে যায় শঙ্খনাদে গুঞ্জরিত এক লড়াইয়ের দিকে।

রবিবার দুপুর। শিয়ালদহ স্টেশন ফাঁকা, মীরার রান্নাঘরে আজ হালকা কাজ। সঞ্চিতা জানালার ধারে বসে অঙ্ক কষছে, আর মীরা বসে আলু কুঁচোচ্ছে মনোযোগহীনভাবে। হঠাৎ রবিনের গলায় ভেসে এল — “স্মরণ আছে, ঠিক আজকের দিনেই ছিল আমাদের দুর্ঘটনা?” কথাটা শুনে মীরার হাত থেমে গেল। মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই নভেম্বর মাসের এক রোদেলা সকাল, যখন রবিন বেলঘরিয়ার ছোট্ট লোহার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে বিশাল এক চাকার নিচে পা হারিয়েছিল। সকালবেলা ও বলেছিল, “আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরব”, অথচ বিকেলেই ফোন আসে—“আপনার স্বামীর দুর্ঘটনা হয়েছে, মেডিকেল কলেজে ভর্তি।” ওই ফোনটা বদলে দিয়েছিল তাদের পুরো জীবন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা রবিন, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ আর তার পাশে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা — কিছু ভুলে গেলেও সেই চিত্র তার মনে গেঁথে আছে স্থায়ীভাবে। অস্ত্রোপচারের পর এক পা বাদ গেল, কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে দায় মেটাল। মীরা তখন বুঝে গিয়েছিল—এই যুদ্ধটা তাকে একাই লড়তে হবে।

দুর্ঘটনার পরের কয়েক মাস ছিল দুঃস্বপ্ন। একটা ছোট্ট ঘরে বন্দী হয়ে পড়েছিল জীবন। রবিন হুইলচেয়ারে বসে থাকত, চোখে অপরাধবোধের ছায়া, কাঁধে অবসরের বোঝা। প্রথম দিকে মীরা সাহায্য চেয়েছিল আত্মীয়দের কাছে, কেউ কেউ একবেলা খাবার দিলেও কেউ দীর্ঘমেয়াদে পাশে থাকেনি। প্রতিবেশীরা কিছুদিন সহানুভূতি দেখিয়েছিল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। একদিন বারান্দায় বসে থাকা অবস্থায় সঞ্চির জন্য দুধ কেনার পয়সা পর্যন্ত ছিল না। সেই মুহূর্তেই মীরা নিজেকে প্রতিজ্ঞা করে—”আর কারো দিকে চাইব না।” রান্না সে জানে, আর কিছু জানে না। তখনই পাশের বাড়ির কাকিমা বলেছিলেন—“তুই টিফিনের কাজ শুরু কর, আমার অফিসে দুজন খাবে।” সেইদিন থেকে শুরু। প্রথমে দুইটা, তারপর পাঁচটা, এরপর সাতটা টিফিন। সকালবেলা উঠে রান্না, তারপর বাসে করে গিয়ে পৌঁছে দেওয়া। কিছুদিন পর ট্রেনে ওঠার কথা ভাবল—কারণ বাসের খরচ আর সময়, দুটোই বেশি যাচ্ছিল। ট্রেনে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়ানো মীরার সাহস জন্ম নেয় স্টেশনের ধারে গড়ে ওঠা সেই সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের ভিড়েই।

রবিন মাঝে মাঝে বলে — “তুই না থাকলে হয়তো আমি বেঁচেই থাকতাম না।” কথাটা শুনে মীরা কিছু বলে না, শুধু ব্যস্ততার আড়ালে হাসে। ও জানে, মীরার অভিমান জমে আছে, কিন্তু সে বোঝে—রবিন ইচ্ছা করে এমনটা করেনি। সেই মানুষটিই এখন মেয়ের পড়াশোনার খেয়াল রাখে, বই থেকে পড়ে শোনায়, ক্লাসের প্রশ্নপত্র তৈরি করে দেয়। মীরা একবার বলেছিল — “তুই এখনো সংসারের চালক।” রবিন হেসেছিল — “চালক হলেও তো পা নেই!”— আর তারপরে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেছিল। মীরা জানে, এই সমাজে পঙ্গু পুরুষকে দেখে করুণা করে, আর স্বনির্ভর নারীর সাফল্যে সন্দেহ করে। কিন্তু এই চার বছরের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে — নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে অনেক কথাকে শুনেও না শোনার ভান করতে হয়। তাই আজ যখন সে লোকালে টিফিন বিক্রি করে, তার চোখে শুধুই একটা ছবি ভাসে—সেই মুহূর্তের, যখন রবিনের পায়ের জায়গায় হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরত আর চারপাশের শব্দগুলো হয়ে উঠেছিল নিঃশব্দ — আর সেই নিঃশব্দতার মাঝেই জন্ম নিয়েছিল এক নারীর ঘামভেজা প্রতিজ্ঞা।

শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচটা দিনে যতটা ব্যস্ত, ভোরবেলা ততটাই নিঃসঙ্গ। প্ল্যাটফর্মের এক কোনে টিনের চালের নিচে পাতা একটি ছোট দোকান — একদিকে ঝুলছে সিগারেটের প্যাকেট, অন্যদিকে পাউরুটি আর চিপসের প্যাকেট ঝাঁকাচ্ছে হাওয়ায়। দোকানের নাম নেই, কিন্তু দোকানদারটা সবার পরিচিত — বিলাস কাকু। বছর আটান্নর মতো বয়স, মাথায় টাক, চোখে মোটা চশমা, গলায় একটা লাল গামছা ঝোলানো থাকে সবসময়। কাকুর মুখে সর্বক্ষণ হাসি লেগে থাকে, আর চোখে থাকে একটা মায়া — ঠিক যেন কোনও বৃদ্ধ ঠাকুর্দা নাতির অপেক্ষায় দোকানে বসে আছেন। মীরা প্রথম দিন কাকুর দোকানের পাশে বসেছিল একটু বিশ্রামের জন্য। হাতে তিনটা খালি টিফিন কৌটো, কপালে ঘাম, পায়ের পাতায় ব্যথা। কাকু তখন বলেছিলেন — “দিদি, বসো বসো, রোদ উঠেছে, একটু চা খাও না?” মীরা লজ্জায় না করেছিল, কিন্তু কাকু কথা শুনতেন না। নিজের হাতে এককাপ পাতলা দুধ চা এগিয়ে দিয়েছিলেন, আর তারপরেই শুরু হয়েছিল কথোপকথন। মীরা নিজের গল্প বলেছিল ধীরে ধীরে — পঙ্গু স্বামী, মেয়ের পড়াশোনা, টিফিন বেচা — আর কাকু শুধু মাথা নেড়ে বলেছিলেন — “এই শহর যতটা বড়ো, তার চেয়ে বেশি কঠিন, কিন্তু একটা কথা মনে রাখো—নিজের নাম থাকলে লড়াইটা সহজ হয়।”

সেদিন থেকেই প্ল্যাটফর্ম পাঁচে মীরার একটি কোণা নির্দিষ্ট হয়ে গেল। প্রতিদিন সকাল আটটা নাগাদ ট্রেন থেকে নেমে সে কাকুর দোকানের সামনে এসে বসে। টিফিনগুলো গুছিয়ে রাখে, খালি কৌটো ফেলে না দিয়ে মুছে ব্যাগে ভরে, তারপর এক কাপ চায়ে চুমুক দেয় আর দু’চার কথা বলে কাকুর সঙ্গে। বিলাস কাকু শুধু দোকান চালাতেন না — তিনি যেন এক জীবন্ত খবরের কাগজ। কে কোন ট্রেনে ওঠে, কার অফিস কোথায়, কে কবে দেরি করে — সব কিছু তার জানা। মীরা প্রথমে অবাক হয়েছিল, পরে বুঝেছিল — এই লোকটা শুধু ব্যবসা করেন না, স্টেশনের প্রতিটা মানুষকে ভালোবাসেন। একদিন কাকু বললেন — “তোর ব্যাগে টিফিন কৌটোগুলোতে যদি তোর নাম লেখা থাকত, বা তোর রান্নার পরিচয় থাকত, তাহলে মানুষ তোকে চিনত। কী ভাবিস, একটা নাম রাখ—‘টিফিনবক্স’।” মীরা প্রথমে অবাক হয়েছিল। নাম রাখার কথা কখনও ভাবেনি। তার কাছে টিফিন মানেই পেট চালানো, স্বপ্ন চালানো। কিন্তু কাকুর কথায় একটা দৃঢ়তা ছিল। সেইদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কাগজের পুরোনো খাম কেটে ছোট একটা ট্যাগ বানিয়েছিল মীরা—লাল কালিতে লেখা “টিফিনবক্স — মীরার রান্না।” পরদিন সেটা সে সেলাই করে দিয়েছিল নিজের ব্যাগে। কাকু সেটা দেখে বলেছিলেন — “এইবার তুই দোকানদার।”

নাম পাওয়ার পর, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও যেন বদলে যেতে লাগল। যাত্রীরা এখন তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল — “টিফিনবক্স দিদি, ডিমভাজা আছে?” কেউ বলত, “আজকেরটা দারুণ হয়েছিল, মশলা একটু বাড়ালে আরও ভালো হতো।” এইসব কথার মাঝেই সে বুঝতে পারল—মানুষ শুধু খিদে মেটাতে টিফিন নেয় না, তারা একটুকু নির্ভরতা, এক চুমুক ঘরোয়া স্বাদ খুঁজে পায় তার রান্নায়। বিলাস কাকু মাঝেমধ্যে সাহায্য করতেন—নতুন ক্রেতা দেখলে বলতেন, “একবার খেয়ে দেখো, মা-মেয়ের ভালোবাসা দিয়ে রাঁধে।” এমন বন্ধুত্ব মীরা কল্পনাও করেনি। স্টেশনের হাজারো ব্যস্ত মানুষের মধ্যে এই এক ব্যক্তিই যেন নির্ভরতার মতো পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সেই নির্ভরতাই ধীরে ধীরে মীরার ভরসায় রূপ নেয়। সে বুঝে যায় — এই প্ল্যাটফর্ম শুধু ট্রেন ধরার জায়গা নয়, এখানেই গড়ে উঠছে তার আত্মপরিচয়ের বীজ। “টিফিনবক্স” নামটা শুধু তার ব্যাগে লেখা নয়, ওটা যেন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় — আর সেই অধ্যায়ের প্রথম শব্দ ছিল ‘বন্ধুত্ব’।

দুপুরের ব্যারাকপুর স্টেশন। সূর্য মাথার উপর, রেললাইনের ধারে জমে থাকা গ্রীষ্মের উত্তাপ যেন কুড়িয়ে আনছে শহরের প্রতিটি হতাশা, ক্লান্তি আর সংগ্রাম। ঝরঝরে ঘামে ভেজা শাড়িতে, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে টিফিনবক্সের বাক্স নিয়ে চেনা ছায়ার মতো প্ল্যাটফর্মের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি। এই সময়ের ট্রেনটা একটু ফাঁকা হয় — যাত্রীরা টিফিনের খোঁজে ততটা থাকে না, কিন্তু শিউলি জানে, এই সময়েই আসে দুই তিনজন নির্ভরযোগ্য কাস্টমার — ব্যারাকপুর কোর্টের এক ক্লার্ক, আর একটা স্থানীয় কোল্ডস্টোরের সুপারভাইজার, যারা রোজ দুপুরে তার কাছ থেকে মাংস-ভাত, বা লাউ-চিংড়ি কিনে নেন। এই সময়টায় কিছুটা আরাম হয় বটে, তবুও দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, কারণ রেলের অনিশ্চয়তা সবসময়ই পেছনে তাড়া করে। শিউলি চোখ বুলিয়ে নেয় স্টেশনের ওপারে — ভীড়ের ভেতর মুখ খুঁজে পায় তার পরিচিত কাস্টমারদের। সেদিন একটা বিশেষ কথা বলার ছিল তার — একটা নতুন আইটেমের কথা। ভেবেছে পরশু থেকে চিকেন কষা বানাবে শুক্র-শনিবারের জন্য, দামটা একটু বেশি হলেও অনেকেই খাবে। তবু মনে ভীষণ দোটানা — যদি না বিকোয়? যদি এক বেলার বাজার খরচই উঠে না আসে?

হঠাৎই প্ল্যাটফর্মে একটা ছোট্ট গোলমাল হয় — কেউ একজন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়েছে। লোকজন ছুটে যায়, শিউলিও একটু এগিয়ে দেখে। একটা অল্পবয়সী ছেলে, হয়ত কলেজে পড়ে, গরমে কাহিল হয়ে পড়ে গেছে। তার ব্যাগ খুলে কেউ পানির বোতল বের করে মুখে জল ছিটোচ্ছে। শিউলির বুকের মধ্যে কেমন ধুকধুক করে ওঠে — ওর নিজের মেয়ে পায়েল যদি এরকম একা রাস্তায় পড়ে যেত! কলেজে যায় মেয়েটা, বাড়ি থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কত রকম বিপদ হতে পারে, ভেবে ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়। শিউলি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে, এক কাপ লেবুর জল বার করে এগিয়ে দেয়। লোকজন দেখে, কেউ বলে “বোন, বড় মন আছে তোমার।” কিন্তু শিউলি এসব শুনে না। তার চোখে তখন নিজের মেয়ের মুখ। ও জানে, এই প্ল্যাটফর্ম, এই শহর কাউকে ক্ষমা করে না — কেবল যারা দাঁতে দাঁত চেপে বাঁচে, লড়াই করে, তারাই রোজকার গল্পের অংশ হয়। ছেলেটা একটু সুস্থ হলে ট্রেন আসে। সেই ট্রেনে উঠে যায় সেই কোর্টের ক্লার্ক সাহেব — আজ মাংস ভাত নেননি, বললেন “আজ মন খারাপ দিদি, খিদে নেই।” শিউলি জোর করেন না, শুধু ঠোঁটে হালকা একটা হাসি ঝুলিয়ে দেন, ঠিক যেমন শহরের মানুষ শেখে — নিজের কষ্ট ঢেকে একটা ‘সব ঠিক আছে’ মুখের ওপর আঁকা।

দিনের শেষে শিউলি বাড়ি ফেরে। ব্যারাকপুর থেকে সোদপুর হয়ে দমদমে নামেন তিনি। বাজার থেকে কিছু তরকারি কেনেন — সস্তা পালং, কচু শাক, আর হাফ কিলো ছোট ইলিশ — আজ একটু স্পেশাল রান্না হবে, কারণ পায়েলের কলেজে একটা ছোট পরীক্ষা ছিল, আর সেই সুযোগে শিউলি মনে মনে ঠিক করেছে মেয়েটাকে একটু ভালো কিছু খাওয়াবে। পেছন থেকে হুইলচেয়ারে বসে থাকা তার স্বামী হিমাংশু প্রশ্ন করে, “সব বেচতে পেরেছিলি তো?” শিউলি মাথা নেড়ে বলে, “একটা বাক্স ফেরত এনেছি, কিন্তু চিন্তা কোর না, কাল সকালে অফিসপাড়ায় দিয়ে দেব।” হিমাংশু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে — তার শরীর আজকাল বেশিরভাগ সময় অবশ হয়ে থাকে। শিউলি জানে, সে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পায়, অসহায় লাগে। কিন্তু সে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, হেসে বলে — “চিকেন কষার জন্য কাল একটু বেশি কাঁচা লঙ্কা আনতে হবে। লোকজন চাইছে। বুঝলি তো?” এই বলেই শিউলি জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় — দূরের ব্যারাকপুর স্টেশনটার প্ল্যাটফর্মটা কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে — ঠিক যেমন ভেসে ওঠে তার স্বপ্ন। রান্নার গন্ধে, লোহার চাকার শব্দে আর যাত্রীদের ভিড়ে সে খুঁজে পায় নিজের অস্তিত্ব। নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দেয় — সে একজন মা, একজন স্ত্রী, আর এক সংগ্রামী — যে নিজের শহরটাকেই টিফিনবক্সের ভেতর গুছিয়ে বয়ে নিয়ে চলে প্রতিদিন।

সকাল সাতটা কুয়াশায় ঢাকা দমদম স্টেশনের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল রাধা। গায়ে শাল জড়ানো, হাতে দুটি টিফিনের থলে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু চোখে ছিল একরাশ উষ্ণতা। আজ নতুন এক যাত্রা শুরু করার কথা। ব্যারাকপুর পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা, শিয়ালদহ থেকে ব্যারাকপুর লাইনে নতুন কিছু যাত্রী পাওয়া গেলে রোজগারটা বাড়বে—এই ছিল আশ্বাস। কিন্তু কোনো নিশ্চিততা নেই, শুধু নিজের রান্না, সাহস আর ছোট্ট মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর তৃষ্ণা। প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে থাকা এক বয়স্ক লোক তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “আজ একটু দেরি, ট্রেন সাড়ে সাতটায়…” রাধাও মাথা নেড়ে সম্মত হলো, ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল ট্রেনের দিকেই।

ব্যারাকপুরের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা ট্রেনটা ঠিক সময়েই এলো। রাধা উঠল, ভিড় একটু কম থাকায় বসার সুযোগও পেল। সামনে বসে থাকা কয়েকজন কলেজছাত্র তার হাতে টিফিনের ব্যাগ দেখে আগ্রহ দেখাল। একজন বলল, “দিদি, কি আছে আজকে?” রাধা মুচকি হেসে থলের মুখ খুলে বলল, “ঘি দিয়ে করা লুচি, সঙ্গে চটপটা ছোলার ডাল আর একটু সুজি হালুয়া।” ছেলেগুলো খুশিতে একে একে টিফিন কিনল। রাধার মুখে ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ল—এই প্রথম ব্যারাকপুর লাইনে তার বিক্রি শুরু হলো। পাশের এক ভদ্রমহিলা তাকিয়ে বলল, “তোমার রান্নার গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে—মায়ের হাতের স্বাদ।” রাধা মাথা নিচু করে বলল, “আমার মেয়ে আছে, ওর জন্যই তো এই সব করি।” তখনই সেই মহিলা একটি কার্ড এগিয়ে দিলেন, “আমি একটা ছোট অফিস চালাই, টিফিন সার্ভিস লাগবে। চাইলে কথা বলতে পারো।” রাধা বিস্ময়ে কার্ডটা হাতে নিল, মনে মনে বলল, “নতুন দরজা খুলছে নাকি?” ট্রেন তখন বাঁক নিচ্ছে, জানালার বাইরে আলো ঝলমল শহর পেছনে ছুটে চলেছে।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যখন সে খবরগুলো স্বামী সন্তুকে বলল, সন্তুর চোখে জল এসে গেল। সে বিছানায় আধ শোয়া হয়ে হাতটা বাড়িয়ে রাধার হাত ধরল, “তুই পারবি রাধা, তুই একাই আমাদের দু’জনের লড়াই লড়ছিস।” ছোট্ট পায়েল বইয়ের ব্যাগ নামিয়ে মায়ের কোলে বসে বলল, “মা, আমি বড় হয়ে তোমার মতো শক্ত হবো?” রাধা ওকে জড়িয়ে ধরল, কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তুই আরও শক্ত হবি, তোর স্বপ্নে যেন কোনোদিন অভাবের ছায়া না পড়ে।” বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি, কাঁচের বাইরে ঝাপসা আলো—রাধার মনেও কিন্তু আজ একরাশ আলো ফুটেছে। বাস্তবের কঠিন রেললাইন বেয়ে এগোচ্ছে তার জীবনের টিফিনবক্স—তাতে শুধু খাবার নয়, ভরে আছে সংগ্রাম, আশা আর স্বপ্নের উষ্ণতা।

সকাল তখন ঠিক ছয়টা। দমদম স্টেশনের চারপাশে গুঁড়ি গুঁড়ি কুয়াশা নেমে আছে। ট্রেন এখনও আসেনি, কিন্তু রেললাইনের ধারে বসে থাকা লতিদির চোখে ঘুম নেই। এক হাতে গামছায় টিফিনবক্স ঢেকে রেখেছেন, আর অন্য হাতে পুরোনো মেলা ব্যাগটা শক্ত করে ধরে আছেন, যেন এই ব্যাগেই তার সংসার, তার স্বপ্ন, তার আশ্রয়। আজ নতুন একজন “অর্ডার পার্টি” বলেছে—ব্যারাকপুরের দিকে অফিস যাওয়ার পথে তিনটে টিফিন চাই। মাছ ভাজা, ডাল আর বেগুন ভাজা—এই মেনুতে তার পাকা হাত। কিন্তু সকাল থেকে মেয়ে রুমকির জ্বর, ভাত উঠছে না মুখে, কিছু বলতেও পারছে না। দুশ্চিন্তা আর দায়িত্ব—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে কাটা পড়েছে লতির মন। তবু সারা মুখে একরকম অনমনীয় শান্তি টেনে, তিনি প্রস্তুত।

ট্রেন যখন এল, লতির শরীরটা কেমন এক ঝাঁকুনি খেল। ক্যানভাস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি ট্রেনের দরজায় দাঁড়ালেন, যেন এক সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে নামছে। প্রথমে কল্যাণী পর্যন্ত যাবেন, তারপর ফিরে আসবেন শিয়ালদহের দিক থেকে। প্রতিদিন এক রুটিন, এক রকম মুখ, কিন্তু প্রতিদিনই নতুন লড়াই। এই লড়াইয়ে হার জেতা নেই—আছে টিকে থাকার চেষ্টায় অদম্য এক মন। ট্রেনের কামরায় টিফিনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—“টিফিন, হট টিফিন!”—লতির গলা যেন স্টেশনের মাইকে ভেসে বেড়ায়। কেউ একজন পেঁয়াজ চচ্চড়ি বেশি চাইছে, কেউ আবার চিতল কাবাবের জন্য মুচকি হেসে বলছে—“বৌদি, কাল যেটা দিলেন, আবার বানাবেন তো?”—এই ছোট ছোট কথাগুলোই লতির দিনের উপার্জনের উৎস।

তবে আজ একটু আলাদা। আজকে কল্যাণীতে একজন বৃদ্ধ যাত্রী বললেন, “তোমার রান্নায় মা-র হাতের ছোঁয়া আছে।” লতি কিছু বললেন না, শুধু মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। বাবার কথা মনে পড়ল তার—যিনি একসময় হোটেলের বাবুর্চি ছিলেন, পরে এক দুর্ঘটনায় হাত হারান। সেই বাবার কাছে শেখা রান্না আজ লতির অস্ত্র। টিফিন বিক্রি শেষ করে যখন লতি স্টেশনের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখনই মোবাইল বেজে উঠল। রুমকি ফোন করেছে—জ্বর অনেকটাই কমেছে। বুকের ভিতর জমে থাকা আশঙ্কা একটু আলগা হলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে যখন সকালের আলো গায়ে পড়ে, তখন লতির চোখে ভেসে ওঠে আগামীকাল। এই সংগ্রামে সে একা নয়, তার সঙ্গে আছে রান্না করা মশলার ঘ্রাণ, ব্যাগভর্তি টিফিনবক্স, আর কিছু নিষ্পাপ হাসি—যারা জানে, একজন মা কেমন করে শহরের কোলাহলের মধ্যেও স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন।

ভোরের আলো ঠিক মতো নামেনি এখনও, কিন্তু চারপাশে রোদ আসার আগে থেকেই সুনীতা রাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। আজ নতুন মেনু—পটল-আলু পোস্ত, ডিমের কারি আর লুচি। মেয়েটা, রিমি, পাশে বসে বই খুলে পড়ছে—আগামী সপ্তাহে মাধ্যমিক শুরু। বাড়ির মধ্যে সেই পুরোনো কাঠের ফ্রেমে টাঙানো প্রণবের হাস্যোজ্জ্বল ছবি তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে, যেন এখনও কিছু হারায়নি। আগুনের তাপে হাঁসফাঁস করতে করতে সুনীতা ভাবে—“এই মেয়ের স্বপ্নটা আমি ছাড়তে পারি না। যতক্ষণ গ্যাস জ্বলবে, হাত চলবে, ততক্ষণ লড়াই থামবে না।” একটা সময় ছিল যখন সুনীতা শুধু সংসার চালাতে হিমশিম খেত, এখন সে জানে তার রান্না ঘামের গন্ধের চেয়েও বেশি কিছু বহন করে—তার প্রতিটি টিফিনে স্বপ্নের স্বাদ মেশানো থাকে।

ট্রেনে ওঠার সময় আজ একটু দেরি হয়েছিল। প্ল্যাটফর্মে ঠেলাঠেলি, তারপর কামরার দরজায় চড়চড় করে লাফ দিয়ে ওঠা—সবই যেন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ এক ভদ্রলোক, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সুনীতাকে দেখে বলে উঠলেন, “আপনার টিফিন আমি আগেও খেয়েছি, খুব ভালো। আমি এক ম্যাগাজিনে কাজ করি, আপনার ওপর একটা লেখা লিখতে চাই।” মুহূর্তে সুনীতা থমকে গেল। জীবনে এমন প্রশংসা বা পরিসরে কেউ কোনোদিন কিছু বলেনি। তার চোখে জল এসে গেল, যদিও সে তা আড়াল করল। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যায় শহর ছুটে চলেছে, কিন্তু সুনীতার মনে হচ্ছে সে আজ একটু এগিয়ে গেল—শুধু একজন মা বা একজন রাঁধুনি নয়, সে এখন নিজেই একটা অনুপ্রেরণার গল্প।

সন্ধ্যার পর আজ বাড়িতে লোকজন। প্রতিবেশী মালতীদি, রিমির শিক্ষক অরুণ স্যার, আর কয়েকজন সাংবাদিক এসে বসেছেন। সুনীতা লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে—“আমি তো কিছুই করি না, শুধু রান্না করি আর ট্রেনে বিক্রি করি।” অরুণ স্যার মৃদু হেসে বলেন, “আপনি যা করেন, সেটা লাখ লাখ নারীর অনুপ্রেরণা হতে পারে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মেয়েকে স্কুলে রাখেন, স্বামীর দেখভাল করেন, এবং একটা ইজ্জতদার পেশাকে সম্মান দিয়ে এগিয়ে যান।” সেই রাতে, প্রণব হুইলচেয়ারে বসে সুনীতার দিকে তাকিয়ে বলে—“তুই আমার চেয়ে অনেক বড় মানুষ রে সুনীতা। আমি শুধু চাকরি করতাম, তুই একটা সমাজ পাল্টে দিচ্ছিস।” সুনীতার চোখে জল আসে, কিন্তু সে জল চাপা দিয়ে বলে—“আমি শুধু রান্না করি, আর স্বপ্ন বেঁধে রাখি একটা টিফিনবক্সে।”

নতুন বছরের প্রথম সকালে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে মিশে ছিল একরাশ নতুন সম্ভাবনার ঘ্রাণ। নীলিমা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন—টিনের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছিল। মেয়েটা—ঋতাভা—এখন ক্লাস টেন, আর পাড়ার হেডস্যার বলেছিলেন, “ম্যাডাম, আপনার মেয়েটা কলেজে পড়ার মতোই মেধাবী।” এই বাক্যটাই নীলিমার রাতজাগা চোখে জ্যোতি এনেছিল। সাত বছর আগের শোক, অন্ধকার, অনিশ্চয়তা, সব পেরিয়ে এখন একটা কাঠামো তৈরি হয়েছে—যেখানে রান্না, ট্রেন, যাত্রী, পয়সা আর স্বপ্ন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আজকাল টিফিনের চাহিদা এত বেড়েছে যে তাঁকে দু’জন মহিলা হেল্পার রাখতে হয়েছে—তারা একজন ভোরে এসে মন্ডা কাটে, আরেকজন রুটি বেলে দেন। একবার ভাবলেন, ব্যারাকপুর থেকে দমদম অবধি স্টলে স্টলে কিছু ‘ফিক্সড’ কাস্টমার তৈরি করলে কেমন হয়! তাতে তিনি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে না বিক্রি করেও রোজগার চালাতে পারবেন। মাথায় এইসব হিসেব ঘুরছিল যখন ছোট্ট ঋতাভা পাশ থেকে এসে বলল, “মা, তুমি যদি একদিন অফিস করো আর আমি যদি একদিন ডাক্তার হই, তাহলে আমরা আর টিফিন নিয়ে ট্রেনে উঠব না, তাই না?”

মেয়ের সেই কথায় বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল। এটা কি কষ্ট? না কি গর্ব? সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ঋতাভার জন্যই তো এত লড়াই—সেই ছোট্টবেলা থেকে যখন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে দমদম স্টেশনে প্রথমবার একটিমাত্র টিফিন বিক্রি করেছিলেন, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে একদিন তিনটে কামরায় তার “নীলিমা রান্নাঘর” নামক একটা পরিচিত ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে। শিয়ালদহে উঠেই লোকজন চেনে, ডাকে—“দিদি, আজ ডিম না ভেটকি?” এমনকি কিছু সরকারি কর্মচারী তাঁর থেকে আগেভাগে অর্ডার দিয়ে রাখে—কোন কামরায়, কোন সিটে। ব্যবসার এই বিস্তারে একটা কথা নীলিমা অনেকবার উপলব্ধি করেছেন—যতটা পরিশ্রম, ততটাই আত্মবিশ্বাস লাগে, আর যতটা স্বপ্ন, ততটাই সাহস। বৃষ্টি, ধর্মঘট, দাঙ্গা—কত কিছুর মধ্য দিয়ে গেলেন, কিন্তু প্রতিদিন ঠিক ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরের ধোঁয়া আর লবঙ্গ-এলাচের ঘ্রাণ নিয়ে তিনি তৈরি হয়ে গেছেন, কারণ তাঁর কাছে এটি শুধুই রুটি-রুজি নয়, বরং একটি জয়যাত্রা।

দিনের শেষে স্বামী প্রশান্ত এখন কিছুটা হাঁটতে পারেন—ডান পায়ে লোহার ব্রেস লাগানো, তবু সন্ধেবেলা মেয়েকে পড়াতে বসেন। সেই দৃশ্য নীলিমার চোখে জল আনে, কিন্তু মুখে থাকে হাসি। আজ প্রশান্তই বলেছে, “নীলু, এতদিন তুমি একা সামলে নিয়েছো, এখন একটু বিশ্রাম নাও। ঋতাভা বড় হয়েছে, আমি একটু অফিসিয়াল ট্রেনিং-এর জন্য অনলাইনে চেষ্টা করবো।” নীলিমার মনে হল, একটা চক্র সম্পূর্ণ হল যেন। হতাশার দিনগুলোর চূর্ণ হওয়া টুকরোয় উঠে এল আত্মবিশ্বাসের ইট। জীবনের সেই রেললাইন, যা একসময় থেমে গেছিল, এখন আবার চলেছে—নিয়মিত, আত্মমর্যাদায় ভরা। তিনি জানেন, সংগ্রাম শেষ হয় না, তবে এইটুকু তো বলা যায়—একটা নতুন সকালের সূর্য ওঠে, আর সেই রোদে জ্বলে ওঠে এক নারীর টিফিনবক্স।

১০

ভোর তখন ঠিক চারটে। রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে ভাঙছে, আর পাখিরা কিচিরমিচিরে স্বাগত জানাচ্ছে নতুন সকালকে। তমাল এখনও ঘুমিয়ে, পায়ের উপর চাদরটা আধখানা পড়ে আছে। মঞ্জু একেবারে নিঃশব্দে উঠলেন, যেন তমালের ঘুম না ভাঙে। এই শেষ দিন। না, তার রান্না করার শেষ দিন নয়, বরং এই টিফিনবক্স নিয়ে দৌড়ের শেষ দিন। আজ তিনি স্নেহার কলেজে প্রথম দিনের ভর্তি ফর্ম জমা দেবেন। গত সাতটা বছর ধরে যেই সংগ্রাম, সেই টানাপোড়েন, ঘামে ভেজা ট্রেনের কামরা, ভাত-ডাল-আলুপোস্তর গন্ধে জারিত সকালগুলো, সব যেন আজ একটি পরিণতির মুখে দাঁড়িয়ে।

খুপরি ঘরে কেরোসিনের চুলা জ্বলে উঠল। মঞ্জুর চোখে এখন আর কোনো ক্লান্তি নেই, এক আশ্চর্য রকমের স্থিরতা। প্রথম টিফিনটা বাঁধছেন নিজের হাতে, আজ একটু ভিন্ন মেনু — খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। সে জানেন, রবি কাকু বলেছিলেন আজই শেষবারের মতো তিনি অফিসে যাবেন; এরপর অবসর। তাই আজ তাঁর টিফিনটা একটু বেশি যত্ন করে বানানো। ছোট ছোট লোহার কৌটোয় খাবার ভরে একের পর এক প্লাস্টিক ব্যাগে রাখলেন, বাইরের দিকে সাবধানে নাম লিখে দিলেন সাদা সেলোটেপে। নামগুলো শুধু নাম নয়, সাত বছরের পথচলার বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছে: রবি, সুরজিৎ, লিপিকা, শর্মিষ্ঠা, জগন্নাথদা, এমন আরও অনেক, যাঁদের মুখ মঞ্জু দেখেননি, কিন্তু যাঁদের পেট তাঁর হাতের রান্নায় ভরেছে।

শিয়ালদহ স্টেশনের ট্রেনটা আজ একটু দেরি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া খাচ্ছেন মঞ্জু। তাঁর কাঁধে এখনও টিফিন ব্যাগ, হাতে ছাতা। ভিড় কিছুটা কম, কারণ আজ শনিবার। ট্রেন ছাড়ল ব্যারাকপুরের দিকে, আর মঞ্জুর মনে হল তিনি যেন নিজের জীবন থেকে এক এক করে পুরনো পাতাগুলো উল্টে ফেলছেন। রবি কাকুকে আজ টিফিন দেওয়ার পর মঞ্জু একটুখানি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর পাশে। রবি হেসে বলেছিলেন, “তুই স্নেহার অ্যাডমিশন ফর্মটা ভরেছিস তো? আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি, একদিন তোকে স্নেহার গ্র্যাজুয়েশন পার্টিতে ডাকব।” সে হাসি মঞ্জুর চোখ ভিজিয়ে দিল, কারণ রবি কাকুর মতো লোকেরা মঞ্জুর জীবনকে মানবিকতার আলোয় আলোকিত করেছেন। বাড়ি ফিরে এসে, রান্নাঘরে বসে থাকা তমালের পাশে চুপচাপ বসলেন মঞ্জু। তমাল বললেন, “আজ তো আর টিফিন নেই?” মঞ্জু শুধু বললেন, “না, আজ শুধু খিচুড়ি রান্না করেছিলাম স্নেহার পছন্দের। আজ আমাদের নতুন শুরু।”

স্নেহা, নতুন কলেজের ব্যাগ হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, আজ থেকে তুমিও আমার মতো একটু স্বপ্ন দেখো।” মঞ্জু চোখ মুছে বললেন, “স্বপ্ন তো তোর মধ্যেই বেঁচে আছে মা।” বাইরে সূর্য তখন একেবারে মাথার উপর। কলকাতা শহরের হাজার চাহিদা আর সংঘাতের মাঝে, একজন মহিলা, তার রান্নাঘর থেকে উঠে ট্রেনের কামরায়, সেখান থেকে মেয়ের কলেজ ফর্ম জমা দিতে গেছেন — এই ছিল তাঁর নিজের ছোট্ট যুদ্ধ। টিফিনবক্স বন্ধ হয়ে গেল আজ, কিন্তু তা যেন একটি পথের সমাপ্তি নয়, বরং নতুন পথে যাত্রার সূচনা। যতদিন শহর থাকবে, যতদিন মানুষের গল্প থাকবে, ততদিন মঞ্জুর মতো নারীরা শহরটাকে গড়ে তুলবে — ছায়ার মতো, অথচ সবচেয়ে দৃঢ়।

—-

1000043298.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *