Bangla - ভূতের গল্প

ঝড়ের রাতে

Spread the love

আকাশে হঠাৎ করেই যেন অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা দিল। বিকেলের শেষ আলোটুকু ম্লান হয়ে যেতেই গ্রামের আকাশ ভরে উঠল কালো মেঘে। দূর থেকে আসা বজ্রপাতের গর্জন যেন ঘুমন্ত প্রকৃতিকে এক এক করে জাগিয়ে তুলছিল। চারপাশের গাছপালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক এসে পুরো আকাশকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আলোকিত করে তুলছিল। গ্রাম্য জনজীবন এতদিন ছিল শান্ত ও ধীর—যেখানে সন্ধ্যা মানেই ধূপকাঠির গন্ধ, দূরে কুঁড়েঘরে আলোর ক্ষীণ দীপশিখা আর গৃহস্থালির ছোটখাটো ব্যস্ততা। কিন্তু এই দিনটি যেন ভিন্ন কিছু ঘোষণা করছিল। বাতাসে অদ্ভুত শিরশিরানি, শীতলতা আর অস্থিরতা জমে উঠতে লাগল। ঝড়ের আগমনী সঙ্কেতকে কেউই সাধারণ চোখে নিতে পারল না। বর্ষার দিনে ঝড়-বৃষ্টি নতুন কিছু নয়, কিন্তু আজকের রাতটিতে যেন লুকিয়ে ছিল আরও গভীর কোনো অশনি সংকেত। গ্রামের মাঝখানে দাঁড়ানো সেই পুরোনো বাড়িটিই সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগল। মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠল তার জানালা, কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে শোঁ শোঁ করে ঢুকে পড়ল বাতাস, আর ভেতরে জমা হলো এক অস্বস্তিকর ভয়াবহ নীরবতা।

সেই বাড়িটিতে ছিল হরিদাসের পরিবার। হরিদাস ছিলেন গৃহকর্তা, সত্তরের কোঠায় পড়লেও এখনও দেহে বল কমেনি। সেদিন ঝড়ের হাওয়া লাগতেই তিনি তাড়াহুড়ো করে জানালার খিল বন্ধ করতে গিয়ে যেন থমকে গেলেন—আকাশের বিদ্যুৎ ঝলকানিতে মুহূর্তের জন্য মনে হলো কারও ছায়া যেন উঠোনে নড়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই অন্ধকার গ্রাস করল চারদিক। তাঁর মনে আতঙ্ক জন্মালেও তিনি তা চেপে রাখলেন, কারণ পরিবারকে নিরাপদে রাখতে তাঁরই দায়িত্ব। ভেতরে তখন তাঁর স্ত্রী সরলা চিৎকার করে সন্তান-নাতিদের ডাকছেন। কাঠের চৌকাঠ নড়ে উঠছিল, কপাটের কড়া ভাঙার শব্দ হচ্ছিল। সবাই তড়িঘড়ি করে বসার ঘরে এসে একত্র হলো। বাতাসে তখন কেবল পচা পাতা আর ভিজে মাটির গন্ধ, যা সঙ্গে এনেছিল এক অজানা আশঙ্কা। মেয়েরা প্রদীপ জ্বালালেও হাওয়ায় বারবার তা নিভে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য বজ্রপাত আকাশকে ফালি করে ছিঁড়ে ফেলল, আর তার আলোয় পুরোনো বাড়ির দেওয়ালে অদ্ভুত এক ছায়া দেখা গেল। কেউই সাহস করে কিছু বলতে পারল না, কিন্তু সবার বুকের ভেতরে জমে উঠল অব্যক্ত ভয়।

পরিবারের সবাই একসাথে বসে গেলেও ঘরটি যেন ক্রমশ আরও অন্ধকার ও শূন্য হয়ে উঠছিল। ঝড়ের আওয়াজে বাইরে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, অথচ সেই আওয়াজের মধ্যেই মাঝে মাঝে যেন অচেনা কোনো নিঃশ্বাস বা কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। সরলা আঁচল দিয়ে নাতনির মুখ ঢেকে তাকে কাছে টেনে নিলেন। ছোট মেয়ে মিঠি তখনও নির্বিকারভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন ঝড়ের সাথে আসা সেই অশুভ উপস্থিতিকে অনুভব করতে চাইছে। তার চোখে ভয় ছিল না, বরং ছিল কৌতূহল। অথচ বাকিদের মনে কেবল একটাই চিন্তা—আজকের ঝড়টি সাধারণ ঝড় নয়। পুরোনো বাড়িটি, যার দেওয়ালে বহু স্মৃতি, বহু মৃত্যু আর বহু অপ্রকাশিত রহস্য জমে আছে, তা আজ আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে। বজ্রপাতের ঝলকানি আর দরজার কাঁপুনি যেন জানিয়ে দিচ্ছিল—আসন্ন রাত শুধু ঝড় নয়, নিয়ে আসছে অতীতের অশরীরী ছায়াদেরও। আর সেই পূর্বাভাসকে উপেক্ষা করার মতো শক্তি আর সাহস কারও ছিল না।

ঘরজুড়ে তখন অদ্ভুত এক আলো-আঁধারি পরিবেশ। বাইরে ঝড়ের হাহাকার থামেনি, জানালার কপাট নড়ে উঠছে অবিরত, আর ঘরের ভেতর প্রদীপের আলোও কাঁপছে কাঁপছে করে নিভে যাওয়ার মতো। সবাই বসে আছে নিস্তব্ধ হয়ে, যেন প্রত্যেকেই কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে, অথচ মুখে উচ্চারণ করার মতো সাহস পাচ্ছে না। এই সময় সরলা, গৃহকর্ত্রী, নিজের ভয়ের ভার আর সামলাতে না পেরে যেন নিজের মনের ভেতরে জমে থাকা পুরোনো স্মৃতিকে টেনে আনলেন। তাঁর চোখ যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে অতীতে ফিরে গেল। গলায় এক অদ্ভুত কাঁপন নিয়ে তিনি বললেন, “তোমরা মনে রেখেছো তো, কাকিমার মৃত্যুর রাতটা ঠিক এরকমই ছিল। এই বজ্রপাত, এই বৃষ্টি, এই অন্ধকার।” কথাটা শুনেই ঘরে এক শীতল হাওয়া বইয়ে গেল, কারণ পরিবারের সকলেই জানত, দশ বছর আগে এই বাড়িতেই ঘটে গিয়েছিল সেই বিভীষিকাময় মৃত্যু। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ যেন সরলার স্মৃতিকে আরও জোরে জাগিয়ে দিল। তাঁর মনে ভেসে উঠল কাকিমার শেষ মুহূর্ত—পুকুরপাড়ে ভিজে শাড়িতে দাঁড়ানো, আকাশ থেকে বজ্রপাত নেমে আসা, আর এক ঝলক আলোর সঙ্গে তাঁর নিথর শরীর পড়ে যাওয়া। এই দৃশ্যের স্মৃতি আজও সরলার ঘুম কেড়ে নেয়।

ঘরের সবাই যেন সরলার কথার স্রোতে টেনে নেওয়া হলো অতীতের সেই রাতে। হরিদাসের মাথা নত হয়ে এল। তিনি স্মরণ করলেন, সেদিন তিনি বাইরে ছিলেন, শহরে কোনো প্রয়োজনীয় কাজে। ফিরে এসে দেখেছিলেন, বাড়ি ভর্তি কান্নার শব্দ আর আতঙ্কিত মুখ। কাকিমা ছিলেন পরিবারের প্রাণকেন্দ্র, স্নেহে আর সাহসিকতায় তিনি সবাইকে আগলে রাখতেন। তাঁর মৃত্যু যেন শুধু এক প্রিয়জনের হারিয়ে যাওয়া ছিল না, বরং এই বাড়ির ভরসার স্তম্ভটিকে ভেঙে দেওয়া ছিল। বজ্রপাতে মৃত্যুকে সবাই এক ধরণের অদ্ভুত ভাগ্য বলে মানলেও মনে মনে প্রত্যেকে বুঝত, সেই মৃত্যু কেমন যেন অসম্পূর্ণ ছিল, যেন কোনো অপ্রকাশিত অভিযোগ বা আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল তাঁর। সরলার কথায় ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই শিউরে উঠল, কারণ ঠিক এই মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি, বিদ্যুৎ আর মেঘের শব্দ যেন এক নিখুঁত পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছিল সেই রাতের। মনে হচ্ছিল, যেন দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর কাহিনি আবার ফিরে আসছে, আবার এই বাড়িকে ঘিরে ধরছে।

এই স্মৃতি সবাইকে অস্থির করে তুললেও সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলল ছোট মেয়ে মিঠির মনে। সে তো কখনো কাকিমাকে দেখেইনি, শুধু গল্প শুনেছে, ছবি দেখেছে, আর মাঝে মাঝে বড়দের ফিসফিসানি শুনেছে। আজ সরলার মুখ থেকে সরাসরি শোনার পর তার মনে জন্মাল এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে কাকিমাকে দেখতে চায়, বুঝতে চায় কেন তাঁর মৃত্যুর স্মৃতি এখনও এত ভারী হয়ে আছে পরিবারের ওপর। মিঠির চোখে এই কাহিনি কেবল ভয়ের নয়, বরং এক রহস্যের আবরণ, যার ভেতরে হয়তো লুকিয়ে আছে অনেক অজানা সত্য। সে যখন জানালার বাইরে ঝড়ের দিকে তাকাল, তখন তার মনে হলো, কাকিমা সত্যিই হয়তো এখনও এই বাড়ির সঙ্গে কোথাও বাঁধা আছেন। পরিবারের বাকিদের মতো সে ভয় পায়নি, বরং আরও গভীরভাবে শোনার জন্য কাছে গিয়ে সরলার কোলে মাথা রাখল। সরলার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এত বছর চেপে রাখা স্মৃতিকে আবার বলা মানে সেই অশরীরী ছায়াকে আরও কাছে ডেকে আনা। ঘরজুড়ে তখন কেবল বজ্রপাতের আলো, অন্ধকারের ছায়া আর এক অমোঘ অনুভূতি—যেন কাকিমার মৃত্যু শুধুই একটি অতীত নয়, বরং আজকের রাতের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে।

ঝড় তখন প্রায় পূর্ণরূপে গ্রামটিকে গ্রাস করে নিয়েছে। বাইরে বাতাস এমনভাবে বইছে, যেন পুরোনো গাছগুলো গোড়া থেকে উপড়ে যাবে। বজ্রপাতের আলো এক ঝলকে চারপাশকে আলোকিত করছে, তারপরই আবার ঘন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে সব। হরিদাসের পুরোনো বাড়িটি যেন এই প্রলয়ের ভেতর দাঁড়িয়েও টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ঘরের ভেতরে সবাই চুপচাপ বসে আছে, সরলার গলা শুকিয়ে গেছে, আর মিঠি জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ সেই গভীর নীরবতা ভেঙে উঠল এক অদ্ভুত শব্দে—কড়া নাড়ার আওয়াজ। দরজার কপাট কেঁপে উঠল যেন কারও শক্ত হাত তা আঘাত করছে। প্রথমে সবাই ভাবল হয়তো কোনো পথিক, ঝড়ে আটকে পড়ে আশ্রয় চাইছে। এই বাড়ি তো গ্রামের মাঝখানে, এমন রাতে যদি কেউ আশ্রয়ের খোঁজে আসে, তবে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তবুও আওয়াজের ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা, যেন সে কড়া নাড়ার মধ্যে কোনো অজানা তাড়াহুড়ো বা আক্রোশ লুকিয়ে আছে।

হরিদাস উঠে দাঁড়ালেন, হাতে একটি লণ্ঠন নিলেন, আর দরজার দিকে এগোলেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে বাড়ির মেঝে যেন কেঁপে উঠছিল। সরলা ভয়ে চিৎকার করে বলল, “ওই দরজা খুলো না, এমন রাতে কে আসবে!” কিন্তু হরিদাস নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তাঁর মনে হল, হয়তো সত্যিই কোনো অচেনা পথিক। ঝড়ের রাতে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া পাপ হবে। তিনি ধীরে ধীরে দরজার কাছে পৌঁছালেন, কপাটে হাত রাখলেন। ঠিক তখনই আবার বজ্রপাতের গর্জন, এক ঝলকে পুরো উঠোন আলোকিত হলো। হরিদাস বুঝতে পারলেন, বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ নেই—অন্তত চোখে পড়ল না। কিন্তু দরজার কপাটে আঘাতের মতো শব্দ স্পষ্ট ছিল, যেন ঠিক তাঁর সামনে কেউ অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুক ধকধক করতে লাগল, তবুও সাহস জোগাড় করে দরজা খুলে দিলেন তিনি। আর সেই মুহূর্তে পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাতাসের শব্দ, ঝড়ের গর্জন, এমনকি বজ্রপাতের আওয়াজও যেন থেমে গেল এক নিমেষে। যেন সময় নিজেই স্থির হয়ে গেছে।

দরজা খোলার পর যে দৃশ্য দেখা দিল, তা কারও কল্পনার মধ্যেও ছিল না। উঠোন ভিজে কাদায় ডুবে আছে, চারপাশে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা শূন্যতা। কারও পায়ের শব্দ নেই, কিন্তু ভিজে মেঝেতে পানির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগে ভিজে কাপড় পরা কেউ এসে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। হরিদাসের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, লণ্ঠনের আলোয় তিনি দেখলেন পানির ফোঁটা একে একে ভেতরের দিকে গড়িয়ে আসছে। সরলা চিৎকার করে বলল, “ও তো কাকিমা…!” বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল, কিন্তু সবাই একসাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো, কাকিমার সেই পুরোনো ভিজে শাড়ির ছায়া যেন আবার ফিরেছে। পরিবার ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ল, শুধু মিঠি বিস্ময়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল, তার চোখে ভয় নয়, বরং এক গভীর কৌতূহল। ঘরের ভেতরে আলো-আঁধারি, বাইরে ঝড় থেমে আসছে, আর সেই মুহূর্তে মনে হলো, বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি দরজা-জানালা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে—প্রত্যাশা করছে, অতীতের কোনো অসমাপ্ত গল্প আবার নতুন করে শুরু হবে।

দরজার ফাঁক দিয়ে বজ্রপাতের আলো ভেতরে এসে পড়তেই হঠাৎ করেই সবাই যেন শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। সেখানে, দরজার দোরগোড়ায়, দাঁড়িয়ে আছে সেই রূপ—যাকে তারা কেবল স্মৃতিতে দেখেছে, শোকের মধ্যে অনুভব করেছে, অথচ বাস্তবে আর দেখার কথা ছিল না। কাকিমা। দশ বছর আগে বজ্রপাতে মারা যাওয়া সেই প্রিয় মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন যেন এখনও সেই শেষ রাতের মতোই। গায়ে ভিজে শাড়ি লেপ্টে আছে, আঁচল থেকে ঝরে পড়ছে পানি, মুখের রেখাগুলো ধূসর আলোতে যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। তাঁর চোখে কোনো দৃষ্টি নেই—না অভিযোগ, না স্নেহ, না কোনো রাগ—বরং এক শূন্যতা, যা জীবিত মানুষকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে। ঘরের ভেতরে উপস্থিত প্রত্যেকের বুকের ভেতর থেকে যেন হৃদস্পন্দনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সরলা ভয়ে হাতজোড় করে বসে পড়লেন, মনে মনে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। হরিদাস স্তম্ভিত হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর ভেতরের অপরাধবোধ মুহূর্তেই আরও ভারী হয়ে উঠল। বাচ্চারা কেঁদে উঠল, কিন্তু মিঠি এক অদ্ভুত কৌতূহলে তাকিয়ে থাকল, যেন সে এই ভয়ঙ্কর উপস্থিতির ভেতরে কোনো গোপন সত্য দেখতে চাইছে।

কাকিমার রূপ ঘরে প্রবেশ করল না, কেবল দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে ঝড় এখনও বয়ে চলেছে, কিন্তু সেই ঝড় যেন তাঁকে ছুঁতে পারছে না। তাঁর ভিজে শরীর থেকে যে পানির ফোঁটা ঝরছে, তা যেন সময়ের স্রোতকে অস্বীকার করছে—দশ বছর আগের সেই রাতের জল আজও বয়ে আনছে তিনি। পরিবার একে অপরের কাছে সরে এল, কিন্তু কেউই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে সাহস পেল না। শুধু মিঠি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দোরগোড়ার কাছাকাছি দাঁড়াল। সে দেখল, কাকিমার ঠোঁট সামান্য নড়ছে, যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। নিস্তব্ধতার ভেতর সেই নীরব উচ্চারণই যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সরলা চিৎকার করে বলল, “ওকে শান্তি দিতে হবে, ওর জন্য পূজা করতে হবে।” কিন্তু হরিদাস একেবারেই শব্দহীন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, কাকিমা যেন শুধুই এক আত্মা নয়, বরং অসমাপ্ত কোনো আক্ষেপের প্রতীক। সেই আক্ষেপই তাঁকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।

ঘরজুড়ে বাতাসের ভার যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। প্রদীপের আলো কেঁপে উঠল, লণ্ঠনের শিখা হঠাৎ দীর্ঘ হয়ে গেল, আর সবাই অনুভব করল এক অচেনা ঠাণ্ডা স্পর্শ। কাকিমার চোখে তখনও সেই শূন্যতা, কিন্তু তাতে যেন এক অমোঘ টান ছিল। মিঠির মনে হলো, কাকিমা তাকে ডাকছেন, যদিও কোনো শব্দ নেই। অন্যদিকে বয়স্করা বুঝতে পারছিলেন, এই উপস্থিতি সাধারণ নয়। এমনকি গ্রামবাসীরা বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছিল, কিন্তু ভেতরে সাহস করে কেউ আসছিল না। মনে হচ্ছিল, পুরো বাড়িটিই যেন এক অদৃশ্য আবরণের ভেতরে ঢেকে গেছে, যেখানে জীবিত আর মৃতের সীমারেখা মুছে গেছে। আর সেই মুহূর্তে সবাই উপলব্ধি করল—এই রাত কেবল ঝড়ের নয়, এই রাত এক দশক ধরে জমে থাকা মৃত্যুর ছায়াকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। কাকিমা দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সেই সত্যই সবাইকে অনুভব করিয়ে দিলেন, আর ঘরের ভেতর উপস্থিত প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারল, তাদের জীবনের পথ আর আগের মতো সহজ আর শান্ত থাকছে না।

দরজায় দাঁড়ানো কাকিমার সেই রূপ দেখে ঘরের ভেতর সবাই আতঙ্কে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেও হরিদাসের ভেতরে ভিন্ন এক ঝড় শুরু হলো। তাঁর চোখের সামনে যেন হঠাৎ করেই খুলে গেল দশ বছরের পুরোনো স্মৃতির অন্ধকার দরজা। তিনি তখন শহরে ছিলেন, কোনো প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দেওয়ার কাজে, আর সেই সময়েই বজ্রপাতে কাকিমার মৃত্যু ঘটে। যতবার এই ঘটনার কথা ভেবেছেন, ততবারই বুকের ভেতর এক অপরাধবোধ কুরে কুরে খেয়েছে তাঁকে—যদি তিনি সেই রাতে বাড়িতে থাকতেন, হয়তো কাকিমাকে পুকুরপাড়ে যেতে দিতেন না, হয়তো তাঁর মৃত্যু এড়ানো যেত। আজ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এই ভিজে ছায়া যেন তাঁকে সেই ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। হরিদাসের মনে হলো, কাকিমার শূন্য দৃষ্টি যেন সোজাসুজি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন কোনো কথা না বলেও তাঁকে দোষারোপ করছে। বাইরে ঝড়ের হাওয়া দরজার কপাট কাঁপাচ্ছিল, কিন্তু হরিদাসের ভেতরের ঝড় তার থেকেও বেশি প্রবল ছিল। তাঁর হৃদপিণ্ডের প্রতিটি ধাক্কা মনে করিয়ে দিচ্ছিল—তিনি শুধু একজন দর্শক নন, বরং এই অশান্ত আত্মার প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

হরিদাসের চোখে ভেসে উঠতে লাগল কাকিমার জীবনের স্মৃতিগুলো। তিনি ছিলেন এক প্রাণবন্ত মানুষী, যিনি বাড়ির প্রতিটি কোণকে আপন করে নিতেন। তাঁর হাসি, তাঁর যত্ন, তাঁর স্নেহে ভরা চোখ—সবকিছু এখনও হরিদাসকে তাড়া করে বেড়াত। আর এখন সেই একই মুখ শূন্য চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। হরিদাস অনুভব করলেন, এই শূন্যতা কেবল মৃত্যুর নয়, বরং এক গভীর অভিমান, এক অমোঘ আক্ষেপের প্রতিচ্ছবি। তাঁর মনে হলো, হয়তো মৃত্যুর মুহূর্তে কাকিমা শেষবারের মতো সাহায্যের জন্য ডাক দিয়েছিলেন, আর সেই ডাক শুনতে পাননি তিনি। এই চিন্তা তাঁকে ভিতরে ভিতরে ভেঙে দিল। ঘরে সরলা তখন প্রার্থনা করছিলেন, শিশুরা কাঁপছিল ভয়ে, কিন্তু হরিদাস যেন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটা কেবল তাঁর জন্যই ফিরে এসেছে। আজ যদি তিনি কিছু না করেন, তবে হয়তো কাকিমার আত্মা কোনোদিনই শান্তি পাবে না।

কিন্তু দ্বন্দ্ব এখানেই শেষ নয়। হরিদাস জানতেন, তিনি যদি সত্যিই এগিয়ে গিয়ে কাকিমাকে উদ্দেশ করে কিছু বলেন, তবে পুরো পরিবার আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। আবার চুপ থাকলেও কাকিমার অদৃশ্য দৃষ্টি তাঁর অন্তরকে পুড়িয়ে মারবে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই আত্মা কেবল ভয় দেখাতে আসেনি, বরং তাঁর কাছ থেকে কোনো উত্তর চাইছে—হয়তো ক্ষমা, হয়তো স্বীকৃতি, হয়তো অসমাপ্ত কোনো প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা। হরিদাসের কপালে ঘাম জমল, হাত কাঁপতে লাগল। তাঁর মনের ভেতরে দুটো কণ্ঠ লড়াই করছিল—একটি বলছিল, ভয় পেয়ে চুপ করে থাকো, অন্যটি চিৎকার করে উঠছিল, মুখোমুখি হও অতীতের, স্বীকার কর নিজের অপরাধবোধ। এই দ্বন্দ্বের ভেতর দাঁড়িয়ে হরিদাস অনুভব করলেন, আজকের রাত তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাত। তাঁর সিদ্ধান্তই হয়তো ঠিক করবে, কাকিমার আত্মা মুক্তি পাবে নাকি এই পুরোনো বাড়ির দেয়ালেই বন্দি থেকে যাবে আরও দশক ধরে। আর তিনিও মুক্তি পাবেন কি না, সেই উত্তর লুকিয়ে আছে তাঁর নিজের সাহসের ভেতরেই।

ঘরজুড়ে যখন ভয় আর শীতলতার ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সরলার ভেতরে জমা হলো এক ভিন্ন ধরণের আতঙ্ক। তিনি বহুবার পুরোনো লোককথা শুনেছেন—যে আত্মা মৃত্যুর পরে শান্তি পায় না, সে বারবার ফিরে আসে, পরিবারকে অশান্ত করে তোলে, আর কখনও কখনও সর্বনাশ ডেকে আনে। দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়ানো কাকিমার ভিজে ছায়াকে দেখে তাঁর মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। এটি কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি এক অশান্ত আত্মার প্রত্যাবর্তন। সরলার হাত কাঁপতে লাগল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল। তিনি মনে করলেন, হয়তো মৃত্যুর সময় কাকিমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি, তাই আজও তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাইরে ঝড় যতই গর্জে উঠুক না কেন, সরলার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল এই বাড়ির ভেতরের দৃশ্য। ভয় তাঁর ভেতর এমনভাবে বাড়তে লাগল যে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না, বুক ভরে কান্না বেরিয়ে এল, গলায় কাঁপা কাঁপা স্বর—“এ বাড়ি সর্বনাশ হয়ে যাবে যদি আমরা ওকে শান্ত না করি।” তাঁর চোখে তখন শুধু ভয় আর ভক্তির মিলন।

সরলা হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। আঁচল মাথায় টেনে নিয়ে ভক্তিভরে হাত জোড় করলেন, যেন কাকিমার সামনে প্রণাম করছেন। তাঁর বিশ্বাস, এভাবে ভক্তি প্রদর্শন করলে হয়তো আত্মা শান্ত হবে, হয়তো অমঙ্গল সরে যাবে। তিনি প্রার্থনার মতো করে বলতে লাগলেন, “মা, আমাদের ক্ষমা করো… আমরা পূজা দেব, তোমায় শান্তি দেব।” তাঁর চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছিল। বাচ্চারা মায়ের এই রূপ দেখে আরও ভয় পেতে লাগল, তারা কেঁদে মায়ের গায়ে লেপটে ধরল। কিন্তু সরলার কণ্ঠ থামল না। তাঁর মধ্যে একধরনের উন্মাদনা চলে এল। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, যদি এই মুহূর্তে ভক্তিভরে কাকিমার আত্মাকে ডাকেন, তবে হয়তো সেই আত্মা দয়ার দৃষ্টি দেবে। ঝড়ের শব্দ আর বজ্রপাতের আলোয় সরলার প্রার্থনা যেন আরও শিহরণ জাগানো হয়ে উঠল। তাঁর কণ্ঠে ভয় ছিল, তবুও সেই ভয়ের মধ্যে ছিল গভীর বিশ্বাস—শুধুমাত্র ধর্মীয় আচারই এই অশান্ত আত্মাকে শান্ত করতে পারে।

কিন্তু তাঁর এই আচরণে ঘরের ভেতর দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হলো। হরিদাস ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে পুড়ছিলেন, মিঠি কৌতূহলে এগিয়ে আসছিল, আর সরলা পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করছিলেন ভয় আর ভক্তির কাছে। তাঁর মনে হচ্ছিল, যদি এখনই কিছু না করা হয় তবে কাকিমা হয়তো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবেন, হয়তো সর্বনাশ ডেকে আনবেন। সরলার চোখ লাল হয়ে উঠছিল কান্নায়, কণ্ঠ কাঁপছিল প্রার্থনায়, অথচ সেই দরজায় দাঁড়ানো রূপ একটুও নড়ছিল না। কাকিমার চোখের শূন্যতা যেন আরও গভীর হচ্ছিল, আর সরলার বিশ্বাস শক্তিশালী হচ্ছিল—এ এক অভিশাপ, এক অসমাপ্ত আত্মার তৃষ্ণা। তিনি কেঁপে কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কাল সকালেই পূজা হবে, ওকে শান্তি না দিলে এ বাড়ি শেষ হয়ে যাবে।” তাঁর গলায় সেই মুহূর্তে আর্তি আর দৃঢ়তা মিলেমিশে একাকার। এভাবে সরলার আতঙ্ক শুধু তাঁকে নয়, পুরো পরিবারকেই ঘিরে ধরল, কারণ তাঁর মুখের প্রতিটি শব্দ যেন ভবিষ্যতের অমঙ্গলের ঘণ্টাধ্বনি হয়ে উঠল।

ঘরজুড়ে তখন আতঙ্কের বাতাস। সরলা প্রার্থনায় লীন, ছোটরা ভয়ে কেঁদে কেঁপে উঠছে, হরিদাস নিজের অপরাধবোধে ভেঙে পড়ছে—সবাই ভয়ের অন্ধকারে ডুবে গেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে কিশোরী মিঠি এক ভিন্ন চোখে দৃশ্যটিকে দেখছিল। তার বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু তার ভেতরের কৌতূহল আর সাহস অন্যদের থেকে আলাদা। দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়ানো কাকিমার ভিজে রূপটিকে সে চোখ মেলে দেখছিল। অন্যরা যেখানে অশুভ, অমঙ্গল আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেখছে, মিঠি সেখানে খুঁজে পাচ্ছিল এক অদ্ভুত আহ্বান। সে হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠল—“ওঁর চোখে ভয়ের ছায়া নেই, আছে যেন ডাক!” মুহূর্তেই ঘরের সবাই থমকে গেল। সরলা কেঁদে চুপ হয়ে গেলেন, হরিদাসও তাকালেন বিস্মিত দৃষ্টিতে। ঝড়ের মধ্যে মিঠির এই স্বর যেন এক টুকরো বজ্রপাতের মতো কেটে গেল ভয়ঙ্কর নীরবতাকে। তার কণ্ঠে ভয় ছিল না, বরং ছিল দৃঢ়তা, ছিল সেই অদ্ভুত সাহস যা অন্ধকারকে প্রশ্ন করতে শেখায়।

মিঠির চোখে ভেসে উঠছিল কাকিমার পুরোনো রূপ—যে কাকিমা একসময় তাকে গল্প শোনাতেন, আঁচলে টেনে কাছে নিতেন, পুকুরের ধারে নিয়ে খেলাতেন। সে জানে, যে চোখে এত স্নেহ জমা থাকত, তা কোনোদিনও হঠাৎ অশুভ হয়ে উঠতে পারে না। হয়তো এই ফিরে আসা এক ভয়ঙ্কর রহস্যের আচ্ছাদন, কিন্তু মিঠির মনে হলো কাকিমা কিছু বলতে চাইছেন, কিছু বোঝাতে চাইছেন। তাই সে এগিয়ে গেল এক কদম। ঘরের সবাই তার দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে থাকলেও মিঠির মনে হচ্ছিল, ভয়ের দেয়াল ভেঙে না দিলে সত্যিটা জানা যাবে না। তার মনের কৌতূহল যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠল। সে নরম স্বরে ফিসফিস করে বলল, “কাকিমা, আপনি কি কিছু বলতে চান?” ঘরে তখন ঝড়ের গর্জন, বজ্রের আলোয় কাকিমার ভিজে রূপ ঝলসে উঠছে, আর সেই মুহূর্তে মিঠির চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল সাহসের দীপ্তি। সরলা ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “না, কাছে যাস না!” কিন্তু মিঠি থামল না, কারণ তার ভেতরের কণ্ঠ বলছিল—ভয়ের ওপারে লুকিয়ে আছে এক অন্য আলো।

এই ছোট্ট কিশোরীর সাহসই গল্পটিতে নতুন দিক খুলে দিল। পরিবার যেখানে কেবল অমঙ্গল আর অভিশাপের ছায়া খুঁজছিল, মিঠি সেখানে অনুভব করল এক আহ্বান, এক অজানা রহস্যের দরজা। তার দৃষ্টিতে কাকিমার শূন্য চোখ আর ফাঁকা মুখ কোনো ভয়াবহতা নয়, বরং ব্যথা, আকুলতা আর অপূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। মিঠি বুঝল, এ ফিরে আসা কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়; বরং কাকিমার অসমাপ্ত গল্প শোনানোর জন্য। এই উপলব্ধি তাকে আরও সাহসী করে তুলল। সে যেন এক আলো জ্বালিয়ে দিল, যা পরিবারের ভয়কে কিছুটা হলেও নরম করল। হরিদাস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর মনে হলো হয়তো মেয়েটির কথার মধ্যে সত্য লুকিয়ে আছে। আর সরলা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও নীরব হলেন। মিঠির সাহস পরিবারকে শিখিয়ে দিল—যে চোখে শুধু ভয় থাকে, সে অন্ধকারেই ডুবে যায়; কিন্তু যে চোখে কৌতূহল আর বিশ্বাস থাকে, সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় মুক্তির পথ। আর সেদিন রাতে মিঠিই হয়ে উঠল সেই পরিবারের ভয়ের অন্ধকারে একমাত্র আলোকশিখা।

ঝড় থামতে না থামতেই গ্রামের চারদিক থেকে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হলো। বজ্রপাতের ভয় পেরিয়ে লোকেরা হাতে লণ্ঠন, মশাল নিয়ে ছুটে এল পুরোনো বাড়িটার সামনে। কে যেন খবর ছড়িয়ে দিয়েছিল—বজ্রবিদ্যুতের রাতে মৃত সরলা কাকিমাকে নাকি আবার দেখা গেছে। মুহূর্তেই আশেপাশের মানুষজন ভিড় জমাল বাড়ির উঠোনে। কেউ বলল, এটা ভূত, অশান্ত আত্মা ফিরে এসেছে। কেউ বলল, এটা দেবীর আবির্ভাব—বৃষ্টি, বজ্র আর ঝড়ের সঙ্গে তিনি এসেছেন গ্রামের পাপ দূর করতে। আবার কেউ গলা ফাটিয়ে বলল, “না না, এসব কিছুই নয়, পুরোনো বাড়ির ভেতর আলো-ছায়ার খেলা। আমাদের চোখই ভুল দেখছে।” এই ভিন্ন ভিন্ন মত একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে এক বিভ্রান্তির পরিবেশ তৈরি করল। মানুষের কৌতূহল, ভয় আর বিশ্বাস মিলে পুরো উঠোন যেন এক অস্থির অরণ্যে পরিণত হলো। হাওয়ায় এখনও ভেজা কাদা আর ঝড়ের গন্ধ মিশে ছিল, তার ওপর গ্রামের লোকের ফিসফাস, কানাঘুষো সেই অন্ধকার রাতটাকে আরও ভারী করে তুলল।

গ্রামবাসীর ভিড়ে বাড়ির ভেতরের আতঙ্ক যেন নতুন রূপ নিল। মহিলারা আঁচল মুখে দিয়ে চুপিচুপি নাম জপতে লাগল, পুরুষেরা চোখ বড় বড় করে কাকিমার উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করল। “আমি দেখেছি, দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল,” বলে উঠল একজন। আরেকজন প্রতিবাদ করল, “না, আমি কিছুই দেখিনি, এসব গাঁয়ের গুজব।” কিন্তু প্রত্যেকের গলায় ভয়ের সঙ্গে লুকোনো একধরনের উত্তেজনা ছিল—যেন ভূতের গল্প তারা নিজের চোখে দেখতে পেয়ে গেছে। ছোটো ছেলেরা সাহস দেখাতে চাইছিল, বারবার বলছিল—“চলো ভেতরে গিয়ে দেখি।” অথচ তাদের চোখে কৌতূহলের আড়ালে ভয় স্পষ্ট। ভিড় বাড়তে থাকায় একসময় মনে হলো বাড়িটা যেন চাপা পড়ে যাবে মানুষের গুঞ্জনে। সরলা ভেতর থেকে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ওঁকে শান্তি না দিলে সর্বনাশ হবে।” এই কথা শুনেই আরও হৈচৈ বেড়ে গেল। কেউ বলল পূজা দিতে হবে, কেউ বলল ওঝার কাছে নিয়ে যেতে হবে, আর কেউ আবার বলল, এসব নিছক নাটক। ভিড়ের চাপে যেন আতঙ্ক আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল।

হরিদাস তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। তাঁর অপরাধবোধ আর মিঠির সাহসের বিপরীতে গ্রামবাসীর এই বিভ্রান্তি তাঁকে আরও অস্থির করে তুলল। তিনি বুঝলেন, একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছে ঘটনাটাকে—কেউ ধর্ম দিয়ে, কেউ ভয় দিয়ে, কেউ যুক্তি দিয়ে। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে সত্যটা আরও আড়াল হয়ে যাচ্ছে। মিঠি ভিড়ের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল, মানুষের চোখে ভয় যতটা, তার চেয়েও বেশি উত্তেজনা। যেন সবাই চায় গল্পটা আরও রহস্যময় হোক। এই বিভ্রান্তি শুধু পরিবারকে নয়, পুরো গ্রামকে এক উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঝড় থেমে গেলেও মানুষের মনে ভয়ের ঝড় থামল না। বরং প্রতিটি ফিসফাস, প্রতিটি কণ্ঠস্বর সেই বাড়ির রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলল। আর সেদিন রাতে গ্রামবাসীর এই ভিড়ই বুঝিয়ে দিল—একজন অশান্ত আত্মার উপস্থিতি কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো গ্রামের মানসিকতাকেই নাড়া দিতে পারে।

রাত তখন গভীর, ঝড় থেমে গেলেও আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের রেখা খেলে যাচ্ছিল। সেই আলোয় বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো কাকিমার ছায়া। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তিনি একটিও শব্দ উচ্চারণ করলেন না। শুধু স্থির চোখে পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন সেই অন্ধকার জলে লুকিয়ে আছে তাঁর মৃত্যুর রহস্য, অথবা এমন কিছু যা কেউ জানে না। ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা প্রত্যেকে কাঁপছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে যেতে সাহস পেল না। মনে হচ্ছিল, তাঁর ঠোঁট নড়ছে না অথচ সেই নীরবতাই সবচেয়ে ভারী ভাষার মতো বাজছে প্রত্যেকের অন্তরে। হরিদাস, সরলা, মিঠি—প্রত্যেকেই অনুভব করছিলেন, এই ফিরে আসার পেছনে আছে কোনো অসমাপ্ত কথা, কোনো অপূর্ণ আক্ষেপ, যা কেবল পুকুরপাড়ই জানে।

সরলা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রার্থনা করতে করতে ফিসফিস করে বললেন, “ওর কিছু চাই, হয়তো পূজা বা প্রসাদ…” কিন্তু মিঠি মাথা নেড়ে বলল, “না মা, ও কারও দিকে তাকাচ্ছে না, শুধু পুকুরের দিকে।” সত্যিই তাই—কাকিমার চোখে সেই দিকে এক গভীর আকর্ষণ, যেন মৃত্যুর মুহূর্তের কোনো দৃশ্য সেখানে চিরদিনের মতো খোদাই হয়ে আছে। বজ্রের আলোয় তাঁর চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল যন্ত্রণা আর আকুলতা। মিঠির মনে হলো, কাকিমার আত্মা কোনো ভয় ছড়াতে আসেনি, বরং কাউকে কিছু জানাতে চাইছে। হয়তো মৃত্যুর কারণ নিয়ে অজানা কোনো সত্য, হয়তো তাঁর অন্তরের শেষ ইচ্ছা। কিন্তু সেই রহস্য তিনি ভাষায় প্রকাশ করছেন না, রেখে যাচ্ছেন শুধু নিঃশব্দ দৃষ্টি আর ঠান্ডা শীতল উপস্থিতি। এই নীরবতাই যেন পুরো পরিবারকে ধীরে ধীরে পাগল করে দিচ্ছিল।

গ্রামবাসীর ভিড় তখনো উঠোনে, তারা নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছিল—কেউ বলল অভিশাপ, কেউ বলল দেবতার ইঙ্গিত। কিন্তু ঘরের ভেতরের মানুষ বুঝতে পারছিল, এই দৃশ্যের আসল মানে তাদের কারও জানা নেই। কাকিমার পা দরজার চৌকাঠ ছাড়ায়নি, তাঁর দৃষ্টি একটুও ভাঙেনি—শুধু পুকুরপাড়, আর পুকুরপাড়। এই পুনরাবৃত্ত দৃশ্য যেন বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে এক অদৃশ্য ছাপ রেখে যাচ্ছিল। হরিদাসের বুকের ভেতর ভয় আর অপরাধবোধ আরও ভারী হয়ে উঠল। তিনি মনে করলেন, হয়তো কাকিমার মৃত্যুর আসল কারণ এখনও কেউ জানে না। তাঁর নীরব ফিরে আসা সেই অজানা সত্যের দরজা খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত। আর মিঠির চোখে সেই নীরবতা পরিণত হলো এক রহস্যের ছাপে—যা ভয়ঙ্কর অথচ অনিবার্য, যা তাদেরকে পুকুরপাড়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সত্য জানার জন্য। সেই মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারল, ঝড়ের রাতের আসল ভয় ঘরে নয়, বরং সেই পুকুরপাড়েই লুকিয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *