অসিত চক্রবর্তী
১
সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে যখন ঘরে ঢুকল, তখন ঘুম ভাঙল রিমা দাশের। মাথাটা ভার লাগছিল, ঠিক যেন সারারাত ঘুম হয়নি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা বলছে সে ন’ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আচমকা সে বুঝতে পারল—কিছু একটা নেই। কিছু একটা অদৃশ্য, অথচ খুব জরুরি। সেই অনুভূতিটা একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেল। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে তাকাল—চোখের নিচে হালকা কালো ছাপ, ঠোঁট শুকনো, কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা ভাবাচ্ছিল তা হলো এক রকম ভেতরের খালি জায়গা। তার মাথার ভিতর একটা চিত্রকল্প বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল—কোনো পুরনো কথা, কারও মুখ, অথবা একটা হাসি—যা এখন আর সে ধরতে পারছে না। দরজার কাছে রাখা তার পুরনো চামড়ার ডায়েরি খুলল সে, যেখানে প্রায়ই সে তার স্মৃতিগুলো লিখে রাখত। ১৯ তারিখের পাতায় লেখা আছে—”কাল কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল। আমি নিশ্চিত, কেউ আমার পিছনে লেগেছে। স্মৃতির ভেতরেও অন্ধকার ঢুকছে।” এর পরেই দুটো পৃষ্ঠা ছেঁড়া, এরপরের লেখাগুলো অসংলগ্ন, কেবল অস্পষ্ট নাম—”ঈ…শান?”, “B-Z-014”, এবং “সায়েন্সম্যান”। বুকের ভিতরটা ধকধক করে উঠল রিমার। এসব নাম সে চেনে না, অথচ ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। সে বুঝল, তার মস্তিষ্কে কিছু একটা ভয়ঙ্কর হচ্ছে, এবং সে একা নয়—এই শহরের আরও কেউ কেউ এর শিকার হতে পারে।
রিমা মুম্বাইয়ে বায়োটেকনোলজির উপর পিএইচডি করে কলকাতায় ফিরেছিল। তবে গত ছয় মাস তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। কিছু একটা যেন প্রতিদিন একটু একটু করে তার ভেতর থেকে কেড়ে নিচ্ছে তাকে। সে এক ধরনের সাইকোজেনিক স্মৃতি লস-এর কথা শুনেছিল, কিন্তু তা সাধারণত ঘটে গভীর মানসিক ট্রমার ফলে। রিমার জীবন স্থির ছিল, তবে স্মৃতির ভেতরে তৈরি হচ্ছিল ফাঁক। সে ঠিক করল এইবার সে নিজের গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকেই বুঝবে। তার নিজের তৈরি এক স্মৃতিঅনুসন্ধানকারী অ্যাপ্লিকেশন ছিল, যেখানে সে প্রতিদিনকার ‘মেমরি প্যাটার্ন’ রেকর্ড করত—আজকের ডেটা দেখে সে আঁতকে উঠল। গত ৭২ ঘণ্টায় তার ব্রেন-ম্যাপে চারটি জায়গায় ব্ল্যাক স্পট! এর মানে, কিছু সময় তার মনে নেই। এই ফাঁকগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় সময়টা ছিল ৪৮ মিনিট, যেখানে রেকর্ড নেই, অথচ মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছে সে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। কিন্তু সে তো ওইদিন বাড়িতেই ছিল! মাথা ধরে এলো। রিমা সিদ্ধান্ত নিল, সে যাবে ভিক্টোরিয়ায়—নিজের স্মৃতির পিছনে ছুটবে। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি। ছাতা হাতে নিয়ে, হুডি চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। কিন্তু জানত না, এই যাত্রা কেবল তার স্মৃতির জন্য নয়—এক ভয়াবহ চক্রান্তের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতিও।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে পৌঁছে রিমা হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার মনে পড়ল—সে এখানে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু একা নয়। একজন লোক ছিল তার সঙ্গে। গায়ের চামড়া ফর্সা, চোখে সানগ্লাস, গলায় নীল স্কার্ফ। তারা একসঙ্গে বসেছিল পুকুরের ধারে, এবং সেই লোক তার হাতে একটা ছোট ক্যাপসুল ধরিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল, “এইটা শরীরে গেলে তুমি যা ভুলতে চাও, তা মুছে যাবে। কিন্তু যে এটা তোমার ওপর প্রয়োগ করবে, সে তোমার ভিতরের গোপনটাও জেনে যাবে।” এটাই সে ভুলে গিয়েছিল—সে ভুলে গিয়েছিল যে সে নিজেই নিজের ওপর সেই ক্যাপসুল ব্যবহার করেছিল। বুকটা দপদপ করে উঠল। তাহলে সে-ই কি ছিল পরীক্ষামূলক সাবজেক্ট? তার নিজের হাতে তৈরি কোনো স্মৃতি-চোর জীবাণু? নাকি কেউ তার আবিষ্কার চুরি করে তার উপরেই ব্যবহার করেছে? আচমকা এক গাড়ির জানালার কাঁচ নামল পাশেই, এবং ভিতর থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল, “রিমা, ফিরে এসো। এবার বেশি এগোলে মস্তিষ্ক তোমার সঙ্গে থাকবে না।” তাকাতে গিয়েও দেখতে পেল না সে কে বলল। গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছিল তার চোখ দিয়ে, যেন বোঝা যাচ্ছিল না কাঁদছে কিনা। সে বুঝল, তার লড়াই শুরু হয়ে গেছে—এইবার তাকে তার স্মৃতির স্তর ভেদ করে নামতে হবে এক অন্ধকার জগতে, যেখানে অপেক্ষা করে আছে সেই মুখোশধারী ‘সায়েন্সম্যান’, যার অস্তিত্ব কেবল গল্পে ছিল, কিন্তু আজ বাস্তব হয়ে উঠছে।
২
কলকাতা শহরের ভেতরে যেন একটা অদৃশ্য ঘূর্ণিঝড় বইছে—রিমা দাশ তা প্রতিনিয়ত অনুভব করছিল। শহরের হাসপাতালগুলোর নিউরো বিভাগে রোগীর ভিড় হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। অধিকাংশ রোগী স্মৃতিভ্রষ্টতা, বিভ্রম কিংবা অনিয়ন্ত্রিত আচরণে আক্রান্ত। ডাক্তাররা বলছেন এটা নতুন এক ধরণের ভাইরাল নিউরোলজিকাল সিম্পটম, কিন্তু কেউই নিশ্চিত নন আসলে সমস্যার উৎস কী। ঠিক তখনই রিমার ইনবক্সে আসে একটি এনক্রিপ্টেড মেইল, প্রেরক: B-Z-014, বিষয়: “তোমার আবিষ্কার ফিরেছে, রিমা।” সঙ্গে একটি GPS লোকেশন ও সংযুক্ত PDF। রাত তখন ১টা। সে সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যকে ফোন করে ডাকে, কারণ এই ধরণের মেইল একা হ্যান্ডেল করার সাহস তার নেই। আদিত্য মুখার্জি—তার পুরোনো সহপাঠী, এখন সাইবার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। সে দ্রুত আসে ল্যাপটপ ও এনক্রিপশন সফটওয়্যার নিয়ে। ফাইল খুলে দেখে তারা: একটি পুরনো গবেষণাগারের নীলনকশা, যার নাম “NeoGen Lab – BactroVault Unit”—এই ল্যাবটি একসময় ভারত সরকারের অধীনে বিশেষ জীবাণু গবেষণায় ব্যবহৃত হত, পরে রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এবং, একটি নাম: ড. ঈশান সেন—এই নাম আগেও রিমা শুনেছে, কিন্তু ঠিক কোথায় মনে করতে পারছে না। মেইলে বলা হয়েছে, এই ল্যাবেই তৈরি হয়েছিল সেই স্মৃতিচোর জীবাণু, যার প্রোটোটাইপ ফর্ম ছিল BZ-Virus, আর এখন তার উন্নত রূপ BZ-X, যা শরীরে প্রবেশ করেই ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলকে অবশ করে ফেলে, স্মৃতির কোষগুলো শুষে নিয়ে যায়—যেন একটি সুক্ষ্ম, জীবন্ত হ্যাকার।
রিমা ও আদিত্য ঠিক করলেন তারা ওই GPS লোকেশন যাচাই করবেন। জিপিএস লোকেশনটি তাদের নিয়ে যায় উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের এক পুরনো, অর্ধভাঙা কারখানার ভেতর। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করে তারা দেখে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি—অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু কয়েকটি কম্পিউটার টার্মিনাল এখনও চালু। রিমা সেখানে আবিষ্কার করে একটি অটো-রান প্রোগ্রাম—একবার ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে পরপর ফুটেজ: কিছু পরীক্ষামূলক ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে মানুষের উপর জীবাণুর ব্যবহার। প্রথমে একটা তরুণী, যার নাম অঞ্জলি ঘোষ—ক্যামেরার সামনে বসে আছে, তারপর ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে—পরের দৃশ্যে সে নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছে। ভয়ানক ঠাণ্ডা লাগল রিমার শরীরে। এই সমস্ত ভিডিওর নীচে লেখা: Project SPECTRAL BETA: Control by Memory Reboot. এবং এক জায়গায় স্পষ্টভাবে লেখা—“Field Test Location: South Kolkata, Phase 1: 21 Targets”। তারা বুঝতে পারল শহরে ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। আর যে বা যারা এটা চালাচ্ছে, তারা শুধুমাত্র স্মৃতি চুরি করছে না—তারা এই ভাইরাসকে একটি অস্ত্র বানাচ্ছে। হয়তো মানুষের চিন্তা ও চেতনা নিয়ন্ত্রণের জন্যই।
ওই ল্যাবে তারা আরও খুঁজে পেল একটি ছেঁড়া রিপোর্ট, যেখানে হাতের লেখা স্পষ্ট রিমার নিজের—“Virus strain BZ-X shows rapid hippocampal degeneration within 43 minutes post-injection. Test on subject #014 proved unstable.” রিমার চোখ ছলছল করে উঠল। তবে কি সে-ই এই ভাইরাস তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিল? সে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না—তার স্মৃতির খাঁচাগুলো যেন ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। ঠিক তখনই আদিত্য খেয়াল করল, দেওয়ালে আঁকা একটা প্রতীক: দুটি চোখের মাঝখানে ডিএনএর স্ট্র্যান্ড আঁকা, তার নিচে লেখা ‘সায়েন্সম্যান’। এই নাম আগেও উঠেছিল—কিন্তু কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না সে কে। এখন পরিষ্কার, এই সায়েন্সম্যান-ই হয়তো পুরো খেলাটার মাস্টারমাইন্ড। আদিত্য বলল, “তুমি জানো, এটা কেবল স্মৃতিচুরি নয়। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক দখলদারি। যেই স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটা নিউ জেনারেশন ওয়েপন।” রিমা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর কেমন যেন এক অচেনা ভয় জমাট বাঁধতে লাগল। সে জানে, এই গবেষণার শেষপ্রান্তে তাকে নিজের অতীতকেও প্রশ্ন করতে হবে, কারণ হয়তো তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বিপদ।
৩
কলকাতার বুকে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পুরনো রাস্তাগুলোয় হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ে এক ধরণের রহস্যময়তা নিয়ে আসে—ঠিক যেমনটা রিমা দাশ অনুভব করছিল নিজের মনে। শ্যামবাজারের সেই ভগ্নপ্রায় গবেষণাগার থেকে ফেরার পর, সে একপ্রকার নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ে। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটা নাম—ড. ঈশান সেন। তার স্মৃতিতে স্পষ্ট কিছু নেই, কিন্তু মনে হয় অনেক পুরোনো কোনও সম্পর্ক ছিল এই মানুষটির সঙ্গে—হয়তো সহকর্মী, বা তার চেয়েও বেশি কিছু। সে পুরনো ল্যাপটপ খুলল, সেখানে রাখা একটি এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার খুঁজে বের করল, যার নাম “NeuroArchive_ES”। সেই ফোল্ডার খোলার জন্য দরকার ছিল একটি পাসওয়ার্ড—কয়েকবার চেষ্টা করে শেষমেশ সে ব্যর্থ হল। হঠাৎ করেই মাথায় এল একটি নাম—”ঈশান”। সে টাইপ করল নামটা এবং ফোল্ডার খুলে গেল। ভিতরে একাধিক ভিডিও ফাইল, গবেষণাপত্র, টেস্ট রিপোর্ট ও একটির নাম দেখে বুকটা কেঁপে উঠল: “Final Transmission – Confession by ES”। ভিডিও চালু করতেই দেখা গেল গাঢ় আলোর নিচে একজন ক্লান্ত, বিবর্ণ মুখ—ড. ঈশান সেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, “যদি তুমি এটা দেখছো, রিমা, তাহলে জানবে আমি এখন মৃত বা বন্দি। আমরা যা তৈরি করেছিলাম, সেটা অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তোমার স্মৃতি থেকে সব কিছু মুছে ফেলা হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবেই—প্রকল্পের সুরক্ষার জন্য। কিন্তু সে তোমাকে খুঁজে পাবে। ‘সে’—সায়েন্সম্যান—আমাদেরই দলে ছিল। কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। স্মৃতিচুরি এখন শুধু অস্ত্র নয়, সে মানুষের পরিচয় পাল্টে দিতে পারছে। আর তুমি, রিমা, এই সমস্তের কেন্দ্রে।”
ভিডিও চলতে থাকল। ড. সেন বললেন, “BZ-X জীবাণুর আপডেটেড ভার্সন এখন আত্মসচেতন হয়ে উঠছে। এটা কেবল ব্রেনের কোষে স্মৃতি মুছে দেয় না, এক ধরণের ‘জৈব কৃত্রিম স্মৃতি’ সঞ্চার করতে পারে। আমি জানি, তুমি এই লাইনে কাজ শুরু করেছিলে স্নায়বিক ট্রমা কমানোর জন্য, কিন্তু এখন ওরা এটা ব্যবহার করছে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষের মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি ঘটাতে।” রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই সত্যি একসাথে হজম করা অসম্ভব। তার মনে পড়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট কিছু মুহূর্ত—সাদা অ্যাপ্রন পরা ঈশান, রাতের ল্যাবে একসাথে পরীক্ষা চালানো, কোনো জৈবকণা দেখিয়ে বলছেন, “এটা হলে মানুষ নিজেকেই চিনতে পারবে না।” আর আজ, এত বছর পর, তার সেই নিজেকে চেনার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে গেছে। ভিডিওর শেষে ঈশান বললেন, “তুমি যদি সত্যি সব জানতে চাও, তবে খুঁজে বার করো ‘শূন্য নোড’। সেখানেই লুকিয়ে আছে পুরো নেটওয়ার্কের কেন্দ্র।” রিমা চমকে উঠল—শূন্য নোড? এটা কী? কোথায়?
পরদিন ভোরে আদিত্য এসে হাজির হয় রিমার ফ্ল্যাটে, চোখেমুখে উত্তেজনা। সে রাতে ঘুমায়নি। হাতে একটা প্রিন্টআউট, যেখানে লেখা একটি মেটাডেটা: “00_NODE_XL: Central Memory Hub”। সে জানায়, সে সরকারি ডেটাবেইসে একাধিক ‘স্মৃতির পুনঃস্থাপন কেন্দ্র’-এর নাম পেয়েছে, কিন্তু এই “শূন্য নোড” কোনো পাবলিক রেকর্ডে নেই। তার মতে, এটা হতে পারে সেই স্থানের কোডনাম, যেখান থেকে BZ ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। রিমা তখন ঈশানের শেষ কথা মনে করে বলল, “তুমি কি মনে করো ওটা কোনও ফিজিক্যাল লোকেশন নাকি ভার্চুয়াল সার্ভার?” আদিত্য একটু চিন্তা করে বলল, “দুটোই হতে পারে। কিন্তু তুমি যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছো, তাতে একটা সম্ভাবনা স্পষ্ট—তোমার স্মৃতি এখনও ওদের হাতে আছে। মানে, তোমার মস্তিষ্ক থেকে নেওয়া স্মৃতি কোথাও আপলোড করা হয়েছে।” রিমার দম বন্ধ হয়ে এলো। তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব যদি এখন আর তার নিজের না হয়—তাহলে সে কে? আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল, “তুমি ভেঙে পড়ো না। আমরা যদি শূন্য নোডে পৌঁছাতে পারি, তাহলে সব ফাইল ডিলিট করা যাবে। কিন্তু যতক্ষণ না পৌঁছাচ্ছি, তুমি পুরোপুরি নিরাপদ নও।” রিমা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, সকালের সূর্য উদিত হচ্ছে, অথচ তার মনে হচ্ছে, চারদিক অন্ধকার। এবার সময় এসেছে ছায়াকে খুঁজে বের করার, কারণ সেই ছায়াই হয়তো তার নিজের মুখোশ পরে আছে।
৪
সন্ধ্যার ঠিক আগে, রিমা দাশ যখন তার ল্যাবের নোট整理 করছিল, তখন ইন্টারকম বেজে উঠল। কেউ গেটের সামনে এসেছে—নাম বলে না, শুধু বলে, “ডেলিভারি।” রিমা অবাক হয়ে দরজা খুলতেই দেখে, একটা কালো খামে মোড়া প্যাকেট পড়ে আছে মেঝেতে, আর দূরে একটা বাইকের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। প্যাকেটটি হাতে নিয়েই অনুভব করল, ভিতরে কিছু শক্ত বস্তু আছে। খুলে দেখে চোখ কপালে ওঠে—একটা ছোট্ট পেনড্রাইভ, একটা অচেনা রিমোট, আর একটা চিঠি। চিঠির উপর লেখা: “Play Me Alone”। রিমা চমকে উঠল—চিঠির লেখার স্টাইল যেন কোথাও আগে দেখেছে। পেনড্রাইভে ঢুকিয়েই স্ক্রিনে ফুটে উঠল এক মুখোশধারী মানুষের ভিডিও। কালো পোশাক, মুখে সিলভার রঙের হাফ মাস্ক, ব্যাকগ্রাউন্ডে অন্ধকারে ঘেরা পরীক্ষাগার। তারপর সেই কণ্ঠস্বর—ভরাট, ধীর, যেন কোনও যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বেরোচ্ছে, বলল:
“হ্যালো রিমা, অথবা বলি, ডক্টর রিমা দাশ। কত দিন পর দেখা, তাই না? ভাবছো, আমি কে? আমি সেই ছায়া—তোমার বিজ্ঞানী-স্বপ্নের উল্টো দিক। তুমি ভুলে গেছো, আমি ভুলিনি। তুমি যে ভাইরাস তৈরি করেছিলে মানবতা রক্ষার জন্য, আমি সেটাকেই করেছি অস্ত্র। কারণ মানবতা বলে কিছু নেই—আছে শুধু নিয়ন্ত্রণ। আর নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, স্মৃতি চাই। যাদের তুমি ভুলতে চাও, আমি তাদের মনে জাগিয়ে তুলছি। আমি শুধু তোমার স্মৃতি না, তোমার নির্মাতা পরিচয়ও চুরি করেছি। এবার কি চিনলে, বিজ্ঞানী?”
রিমার রক্ত হিম হয়ে গেল। ভিডিওতে তখন মুখোশধারী আরও বলছে, “তুমি হয়তো ভাবছো, তোমার মস্তিষ্ক থেকে যা চুরি করেছি, সেটা কোথায় রেখেছি। আমি বলছি না, তবে ইঙ্গিত দিচ্ছি—তুমি যদি শূন্য নোডের কাছে আসো, তোমার শরীরের কোষ কোষ জেনে যাবে, কে তুমি। কিন্তু সাবধান, খুব বেশি কাছে আসলে হয়তো আর ফিরে আসতে পারবে না। কারণ, এই খেলা আর তথ্যের নয়—এটা এখন স্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির যুদ্ধ।” ভিডিও বন্ধ হয়ে যায়, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি অদ্ভুত প্রতীক—দুটি চোখ এবং মাঝখানে এক ডিএনএ স্ট্র্যান্ড, যার নীচে লেখা ‘S.M.’।
রিমা থমকে যায়। এই প্রতীক, এই মাস্ক, এই কণ্ঠস্বর—সব যেন অতীতের ঘোলাটে ফ্রেম থেকে উঠে এসেছে। সে চোখ বন্ধ করল, এবং মনে পড়ল সেই পুরনো দিনগুলোর কথা—যখন ড. ঈশান সেনের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। তখনও তার জেদ ছিল, মস্তিষ্কের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, মানসিক রোগীদের নতুন জীবন দেয়া যাবে। তারা দুজনে মিলে তৈরি করেছিল এক পরীক্ষা—নাম ছিল SPECTRAL। কিন্তু সেই প্রজেক্ট শেষ হতে পারেনি। কোনো এক রাতে, একটি বিস্ফোরণের পরে সব তথ্য মুছে যায়, এবং ঈশান তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে—সেই প্রথম স্মৃতি হারায় রিমা। এখন মনে হচ্ছে, সেই রাতেই জন্ম নিয়েছিল এই ছায়ামানব। কিন্তু সে কে? ঈশানের সহকারী রাহুল? না কি কোনো বাহিরের কেউ? তার মাথায় তখন ঘুরছিল কেবল একটাই প্রশ্ন—এই মুখোশের আড়ালে মুখটা কার?
রাত গভীর হলে রিমা ও আদিত্য নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় শূন্য নোড খুঁজে বের করতে হলে, প্রথমে দেখতে হবে কোথায় কোথায় এই ভাইরাস ব্যবহৃত হচ্ছে। আদিত্য তার সাইবার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে এমন কিছু লোকেশন ট্র্যাক করে যেখানে কয়েক মাসে হঠাৎ করে নিউরোলজিক্যাল সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার বেহালা, টালিগঞ্জ ও যাদবপুর এলাকায় কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গেছে—একই রাস্তায় রাতে কিছু মানুষ হেঁটে বেড়ায়, পরের দিন তারা নিজেদের নাম ভুলে যায়। রিমা সেই এলাকায় গিয়ে সরাসরি কথা বলল আক্রান্ত কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা, কথা বলার সময় ভাঙা স্মৃতির টুকরো—”আমি ছিলাম… স্কুলে যেতাম… তারপরে… কে যেন এল… আমাকে… একটা আলো দেখাল…”—এই আলো সম্ভবত সেই ইনজেকশনের প্রি-হ্যালুসিনেশন রেসপন্স।
তারা বুঝল, ভাইরাস শুধু স্মৃতি মুছে দিচ্ছে না—একটি নতুন স্মৃতি প্রতিস্থাপন করছে, যেন আক্রান্তরা ‘সায়েন্সম্যান’–এর নির্দেশে চলতে থাকে। এইভাবে সে আসলে নিজের নিয়ন্ত্রিত নাগরিক তৈরি করছে—স্মৃতিহীন, প্রশ্নহীন, কেবল নির্দেশ পালনকারী মানুষ। শহর আস্তে আস্তে এক পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। এই জৈব অস্ত্রের বিরুদ্ধে রিমার হাতে তখন একটাই রাস্তা—নিজের পুরোনো গবেষণার ফাঁক খুঁজে বের করে তার প্রতিষেধক বানানো। কিন্তু প্রতিষেধক তৈরির জন্য চাই তার হারানো স্মৃতির সমস্ত উপাদান। আর সেটি আছে কোথায়? শূন্য নোডে। রিমা ঠিক করল, সে আর অপেক্ষা করবে না। সে এবার ছায়ার মুখোমুখি হবে—হয় নিজের মুখ ফিরে পাবে, নয়তো হারিয়ে যাবে এক অন্ধকার মহাকোষে।
৫
রিমা ধীরে ধীরে ঢুকছিলো পুরনো ওয়্যারহাউসের মতো একখানা গুদামে—যার অন্দরে গোপনে কাজ করত ‘রেসন্যান্ট মেমোরি’ প্রজেক্ট। ঘন অন্ধকার, কেবল দূরের এক কায়েমি আলোর রেখা তার পথ দেখাচ্ছিল। তার হাতে শক্ত করে ধরা পিস্তল—যদিও সে জানে, এ লড়াই অস্ত্র দিয়ে জেতা যাবে না। মাথায় ভর করেছিল হাজারো প্রশ্ন। কেন তার স্মৃতি চুরি হয়েছিল? কে করেছিল? আর তার পেছনে উদ্দেশ্যই বা কী? গুদামের ভেতর কাঠের টেবিল ছড়ানো, তার উপরে ছড়িয়ে থাকা পুরনো রিপোর্ট, ডিএনএ ম্যাপিং, আর…অদ্ভুত কিছু ছবির নথি। রিমা দেখে, ছবিগুলোর একটাতে সেই আছে—তবে অন্যদের সঙ্গে, যাদের সে মনে করতে পারে না! এই প্রথমবার সে বুঝল, তার জীবনের একটা বড় সময় যেন কেউ ছেঁটে ফেলেছে, এক ব্লেড দিয়ে স্মৃতির পাতাগুলি কেটে নিয়েছে। তার ঘাড়ে ঠান্ডা ঘাম জমে উঠছিল। হঠাৎ তার কানে আসে ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। সে পেছনে ফিরে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই। আলো নিভে আসে। কেবল একটা যন্ত্র চলতে থাকে গুমরে গুমরে—যা মনে করিয়ে দেয় এই ল্যাবরেটরির কিছু এখনও সচল, কিছু এখনও জেগে আছে।
এমন সময় সামনে থেকে বেরিয়ে আসে একজন। লম্বা, পাতলা গড়নের এক মধ্যবয়স্ক মানুষ, চোখে গোল চশমা, পরনে ধুলো-মাখা ল্যাব কোট। সে নিজেকে পরিচয় দেয়: ড. অয়ন নাগ—এই প্রকল্পের প্রধান গবেষক। তার কণ্ঠে অনুতাপ মেশানো। “আমরা যা শুরু করেছিলাম, তা ছিল মহৎ উদ্দেশ্যে,” সে বলে, “অ্যালঝাইমার্স বা স্মৃতিভ্রংশ রোধ করার জন্য একটি সংরক্ষণশীল জীবাণু তৈরি করছিলাম, যেটা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে নির্দিষ্ট স্মৃতি ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু সেই প্রযুক্তি চুরি হয়ে যায়। একজন ব্যবহার করে সেটাকে ‘স্মৃতি চুরি’র অস্ত্রে পরিণত করে।” রিমার মুখ কুঁচকে যায়। “কে?” ড. নাগ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তোমারই প্রাক্তন সহযোগী। নাম—রাকেশ ধর। ও এখন এক নতুন পরিচয়ে, ‘জীবাণুবাজ’ নামে কুখ্যাত অপরাধী। সে-ই তোমার স্মৃতি মুছে দিয়েছে। তুমি যখন সত্যি জানতেও পারো—ও চেয়েছিল তুমি কিছু মনে না রাখো।” রিমার বুক কাঁপে। রাকেশ—যার সঙ্গে সে বহুদিন আগে একসাথে কাজ করত!
কিন্তু কথা এখানেই থেমে থাকে না। ড. নাগ জানায়, রাকেশ এখন এমন এক জীবাণু তৈরি করছে, যেটা শুধু স্মৃতি নয়—মানুষের নৈতিকবোধ ও আত্মপরিচয়কেও মুছে ফেলতে পারে। সেই জীবাণুর নাম “অ্যামনিথিন-২”। “একবার যদি ওটা শহরের জল বা বাতাসে ছড়ানো হয়,” বলে নাগ, “তবে মানুষ ধ্বংস হবে না, কিন্তু তারা কে—তা মনে রাখতে পারবে না। গোটা সমাজটাই হয়ে উঠবে শূন্য।” এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রিমার মাথায় একটাই শব্দ ঘোরে: বিপর্যয়। সে জানে, এখন আর শুধু নিজের হারানো স্মৃতি নয়, বাঁচাতে হবে হাজারো স্মৃতি—যাতে মানুষ নিজেদের ভুলে না যায়। নাগ তাকে একটি হার্ডড্রাইভ দেয়—যেখানে প্রথম ‘রেসন্যান্ট মেমোরি’ প্রোটোটাইপের সব রেকর্ড, কোড, এবং প্রতিরোধমূলক সিকোয়েন্স রাখা আছে। রিমা সেটা নিয়ে দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে রাত ঘনিয়েছে। তার সামনে এখন একটাই লক্ষ্য: রাকেশকে খুঁজে বের করে থামানো। কিন্তু কে জানে, রাকেশের ‘পরবর্তী টার্গেট’ হয়ত ইতিমধ্যেই নির্ধারিত!
৬
জীবাণুবাজ–এই এক শব্দই যেন রিমার কানে বাজতে থাকে সারাদিন ধরে। ক্যাম্পবেল ল্যাবের সেই গোপন ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া নথিগুলো পরীক্ষা করে রিমা নিশ্চিত হয়েছিল, “Cognivirus-BX” নামের একটি অদৃশ্য মাইক্রোবিয়াল জীবাণু দিয়েই স্মৃতি চুরি করা হচ্ছে। তার ধারণা ভুল ছিল না—স্মৃতিচুরি এখন আর সায়েন্স ফিকশনের বিষয় নয়, বরং ভয়ংকর বাস্তব। তবে কিভাবে এটি কাজ করে, কীভাবে একজন অপরাধী স্মৃতি নিয়ে অপরাধ করে যাচ্ছে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও অধরা। সেই সময়েই মুম্বই পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বিশেষ তথ্য আসে: এক ব্যবসায়ী হঠাৎ করেই নিজের সমস্ত পারিবারিক ও পেশাগত স্মৃতি ভুলে গিয়েছেন। সেই ব্যক্তি নাকি কয়েকদিন আগে এক গোপন সম্মেলনে গিয়েছিলেন যেখানে গবেষণাগারটির সাবেক বিজ্ঞানী ডঃ সঞ্জয় বর্মাও উপস্থিত ছিলেন। এই তথ্য পেয়ে রিমা ও তার টেক অ্যাসিস্ট্যান্ট আলফিয়া এক নতুন ছকের ভিত খুঁজে পায়।
রিমা এবার গোটা কেসকে একে একে গুছিয়ে দেখতে শুরু করে। ডঃ সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই ঘটে বিপর্যয়—তার চোখের সামনেই সঞ্জয় আচমকা অজ্ঞান হয়ে যান এবং জ্ঞান ফিরে পেলে আর কিছুই মনে করতে পারেন না। একেবারে যেন একখণ্ড সাদা কাগজ হয়ে উঠেছে তার স্মৃতি। রিমা বোঝে, কেউ আগে থেকেই এখানে ছিল এবং Cognivirus-BX ব্যবহার করে সঞ্জয়ের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিয়েছে, বিশেষ করে গবেষণাগার ও জীবাণুর তৈরির সূত্র। তন্নতন্ন করে গোটা জায়গা তল্লাশি চালালেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না, শুধু একটিই জিনিস পাওয়া যায়—একটি স্পর্শকাতর সেন্সর-চালিত পেনড্রাইভ, যার ভেতরে একটি অস্পষ্ট মেসেজ লুকিয়ে ছিল: “What you forgot, I remember.” আলফিয়া ডেটা রিকভার করতে গিয়ে একটি রহস্যময় অডিও সংকেত খুঁজে পায়, যেখানে এক বিকৃত কণ্ঠে বলা হচ্ছে: “স্মৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সত্য। তুমি যতই খোঁজো, আমি সব জানি।” এইবার রিমা নিশ্চিত হয়—তার নিজের স্মৃতি হারানো এবং এই অপরাধীর কার্যকলাপ একই সূত্রে গাঁথা।
এইসব অডিও সংকেত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রিমা আবিষ্কার করে, প্রতিটি শব্দচয়ন, শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দ এবং শব্দতরঙ্গের কম্পন যেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়েছে। এমনকি টোন অ্যানালাইসিসও ব্যর্থ হয় সঠিক কণ্ঠ শনাক্ত করতে। কিন্তু আলফিয়া একটি আশ্চর্য তথ্য দেয়—অডিওতে এক ধরনের “biometric resonance” আছে, যা শুধু বিশেষ এক ধরনের প্রাণীদেহে প্রভাব ফেলে। তার মানে, জীবাণুটি শুধু স্মৃতি মুছে দেয় না, বরং সেই স্মৃতির তরঙ্গধ্বনি কোনো একভাবে ধারণ করে রাখে! রিমার কানে বারবার বাজতে থাকে সেই অচেনা কণ্ঠস্বর—”আমি জানি তুমি কে, রিমা দাশ। তুমি নিজেই সেই প্রোটোটাইপ!”—এই তথ্য যেন পৃথিবীটা রিমার পায়ের নিচ থেকে টেনে নেয়। সে কি সত্যিই নিজের স্মৃতি খুইয়ে ফেলেছে, নাকি তার শৈশব থেকেই কোনো পরীক্ষার অংশ ছিল? রিমা বুঝতে পারে, সামনে যা আসছে তা আর শুধু তদন্ত নয়—এ এক ব্যক্তিগত যুদ্ধ, স্মৃতির ভেতরে ঢুকে নিজের সত্যিকারের পরিচয় উদ্ধার করার লড়াই।
৭
রিমা দাশ বুঝতে পারছিলেন, স্মৃতিচুরির পিছনে রয়েছে এমন এক প্রযুক্তি যা কেবল বায়োটেকনোলজির নয়, মানব আচরণবিজ্ঞানেরও গভীর অপপ্রয়োগ। ল্যাবের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া কোডেড নোটবুকটি নিয়ে সে যখন NIAB-এর (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড বায়োসায়েন্স) পুরনো বিজ্ঞানী প্রফেসর অনুপম লাহিড়ীর সঙ্গে বসে, তখন বহুদিনের দগদগে এক ক্ষত যেন নতুন করে ফুটে উঠল। প্রফেসর বললেন, “এই প্রযুক্তি তো আমরা এক দশক আগে বাতিল করে দিয়েছিলাম, কারণ এটি মানুষের ‘হিপোক্যাম্পাস’ অঞ্চলকে জৈবভাবে ম্যানিপুলেট করে। এই প্রযুক্তি এখন যদি কেউ ব্যবহার করছে, তাহলে তার ‘চিকিৎসাবিজ্ঞান’ নয়, ‘অপরাধবিজ্ঞান’ দিয়ে ব্যাখ্যা দরকার।” রিমার মনে পড়ে গেল নিজের হসপিটালের সেই হঠাৎ স্মৃতিভ্রষ্টতার দিন, আর মনে হচ্ছিল—এই প্রযুক্তিই কি তবে তার জীবনটাকে এমন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল?
রিমা সেই রাতেই ফিরে গেল শহরের এক প্রান্তে, সেই পুরনো হাসপাতাল যেখানে সে এক সময় কাজ করত এবং স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিল। ফাইলরুমে ঢুকে, জীর্ণ ফাইলের স্তূপ ঘেঁটে সে খুঁজে পেল সেই দিনের মেডিক্যাল রিপোর্ট—কিন্তু রিপোর্টে তার নামের জায়গায় লেখা “Subject: R03-M”. বুকটা যেন হিম হয়ে গেল। তাহলে কি সে কোনোভাবে এই প্রকল্পের অংশ ছিল? হয়তো তার স্মৃতি চুরি হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। তখন হঠাৎ মাথার পেছনে এক তীব্র যন্ত্রণা—কেউ বা কিছু তাকে লক্ষ্য করেছিল সেই হাসপাতালেও। চোখের সামনেই সে দেখতে পেল একজন PPE-কিট পরা অজানা ব্যক্তি ছুটে পালাচ্ছে পাশের করিডোর দিয়ে। রিমা তাড়া করলেও তাকে ধরতে পারল না, তবে তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া একটি ইনজেকশন পেয়েছিল। সেটি ছিল ‘M-Type’ সিরামের—একধরনের নিউরো-স্ন্যাপ সিরাম, যা ব্যবহারে স্মৃতি কয়েক ঘন্টার জন্য রিসেট হয়ে যায়।
পরদিন সকালে রিমা সেই ইনজেকশন সহ হাজির হয় ফরেনসিক বিশ্লেষক দিব্যজ্যোতির কাছে। তিনি জানালেন, এই সিরাম বাজারে নেই, কেবল একটি গোপন গবেষণাগারে তৈরি হয়েছিল, যেটি আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এক রহস্যজনক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। কিন্তু বিস্ফোরণের দিন সেখানে উপস্থিত ছিল একজন গবেষক, নাম—ডঃ শ্রেয়স মুখার্জী। সেই নামটা শুনেই যেন রিমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। এই নামটা তার স্মৃতির ফাঁকে কোথাও দোল খাচ্ছিল বহুদিন ধরেই। অতীত থেকে কেউ যেন তার কান ফুঁড়ে বলল—”শ্রেয়স তোমার অতীত, আর সেই অতীতেই আছে তোমার সত্যির চাবিকাঠি।” এবার রিমা নিশ্চিত—তার জীবনের সব রহস্য ঘিরে আছে শ্রেয়স, আর তার নির্মিত সেই ভয়ঙ্কর জীবাণু, যা কেবল স্মৃতি চুরি করে না, তার পেছনে লুকিয়ে রাখে এক অন্তর্লীন ঘৃণা।
৮
গভীর রাতে শহরের উপকণ্ঠে একটি পরিত্যক্ত পানীয় কারখানা। চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক, পাতা ঝরা শব্দ আর দূরের মহাসড়কের ক্ষীণ গর্জন। রিমা দাশ এই কারখানার একটি নিচতলার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার হাতে একটি মাইক্রো-সেন্সর যন্ত্র, যা স্মৃতি চুরি করা জীবাণুদের তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। যতবার এই যন্ত্র বেজেছে, ততবারই কেউ না কেউ তার স্মৃতির এক টুকরো চুরি করে নিয়েছে। কিন্তু আজ রাতে, সে প্রতিচ্ছবির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এসেছে।
গত কয়েকদিনে রিমা নিজের স্মৃতি খণ্ডাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে—তার ছোটবেলার একটি গোপন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, মায়ের আকস্মিক মৃত্যু, আর এক রহস্যময় মুখ—ড. অর্ণব সেন। সে বুঝেছে, প্রতিচ্ছবি কেবল একটি ব্যক্তি নয়, একটি সংগঠন, যারা মানুষের স্মৃতি চুরি করে তথ্য পাচার, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি হত্যাও করে। স্মৃতিই শক্তি, আর সেই শক্তির দখল পেতে তারাই তৈরি করেছে এই স্মৃতিখেকো জীবাণু। কিন্তু আজ, প্রতিচ্ছবির মূল ঘাঁটিতে ঢুকে রিমা বুঝে গেছে যে, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ে কয়েকটা স্টিলের ভ্যাট, যেগুলোর ভেতরে গোলাপি-নীল তরল ফেনা তৈরি করছে। পেছন থেকে একটি কণ্ঠ—অভিজিৎ, তার সহকারী। সে জানায়, এই তরলের মাধ্যমেই জীবাণুগুলো সংরক্ষণ করা হয় এবং ডিভাইসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্মৃতিচক্রে। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ। কারখানার অপর প্রান্তে আগুন লেগেছে। তড়িঘড়ি করে রিমা ও অভিজিৎ ছুটে যায়, কিন্তু তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যায় একজন মুখোশধারী। তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। মুখোশ খুলে পড়ে যায়। সে কেউ নয়, ড. অর্ণব সেন। তার চোখে ক্রুরতা, ঠোঁটে হালকা বিদ্রুপের হাসি। রিমা চিৎকার করে বলে—“তুমি আমার স্মৃতি চুরি করেছো, আমার মা-কে শেষ করেছো!” ড. সেন বলে, “স্মৃতি হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র, রিমা। তুমি জানো না, তোমার মায়ের মৃত্যুর পেছনেও তোমার স্মৃতি লুকিয়ে আছে।”
সব কিছু যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। রিমার মনে পড়ে যায়, তার মা-ও একসময় জীবাণু গবেষক ছিলেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন স্মৃতিকে প্রভাবিত করা কোষ-পরিবর্তনকারী এক অণুজীব, যা পরে প্রতিচ্ছবি সংগঠনের হাতে পড়ে যায়। ড. সেন চেয়েছিল রিমার মায়ের সমস্ত গবেষণা দখল করতে। ব্যর্থ হলে সে তাকে হত্যা করে, এবং রিমার স্মৃতি থেকে সেই স্মৃতি মুছে দেয়। কিন্তু আজ, সব পুণরুদ্ধার হয়েছে। রিমা যন্ত্রটি চালু করে, এবং জীবাণুদের প্রতিক্রিয়া বদলে দেয়—এবার তারা স্মৃতি চুরি না করে স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই ড. সেন ধস্তাধস্তিতে মাটিতে পড়ে, তার নিজের স্মৃতি ফিরে আসে—তার অপরাধ, তার লোভ, তার পাপ। অরণব উন্মাদ হয়ে চিৎকার করতে থাকে, আর রিমা ধীরে ধীরে পেছনে হাঁটে, অগ্নিকাণ্ডে গ্রাসিত হতে থাকা কারখানাটিকে ছেড়ে দেয়। বাইরে এসে দেখে, পুলিশ এসে গেছে, অভিজিৎ সব তথ্য পাঠিয়েছে।
রিমা ধীরে ধীরে রাতের আকাশের দিকে তাকায়। তার নিজের স্মৃতিগুলো এখন ধীরে ধীরে ঠিক জায়গায় বসছে। কিন্তু সে জানে, প্রতিচ্ছবি শুধু এই একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। স্মৃতি যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই যুদ্ধে একটি পর্যায় শেষ, কিন্তু যুদ্ধটা এখনও বাকি। তার চোখে দৃঢ়তা, ঠোঁটে এক অনড় প্রতিজ্ঞা—এই যুদ্ধে সে পিছিয়ে যাবে না।
—