রণজিৎ চক্রবর্তী
পর্ব ১: শেষ ধানের দানা
পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। বর্ষার শেষ দিক। চারপাশে কাদামাটি, শুকনো খাল, ফাটল ধরা জমি। যেদিকে তাকানো যায়, মানুষ হাহাকার করছে একফোঁটা শস্যের জন্য। কারণ পৃথিবীর আর কোথাও প্রকৃত ধানের চারা নেই—সবটাই কর্পোরেট কোম্পানির হাতে। তাদের বিশাল “জিন-ব্যাংক” থেকে কিনতে হয় বিশেষ বীজ, যা একবার চাষ হলে আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায় না।
কৃষক নীলমাধব দত্ত প্রতিদিন নিজের খালি গোলাঘরে বসে থাকেন। তাঁর বাবা-ঠাকুর্দার আমলের গাদা ধানের খড় শুকিয়ে মাটির গন্ধ ছড়াচ্ছে, কিন্তু একটাও বীজ বাকি নেই। গ্রামের মানুষ রেশন কুপনের লাইনে দাঁড়ায়, শহর থেকে আসা ট্রাকে যে-টুকু বীজ আসে, তা কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দাম এত বেশি যে ছোট কৃষকরা কিনতে পারে না। ফলে জমি পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে একে একে।
নীলমাধবের স্ত্রী শশী প্রতিদিন কান্না চাপতে চাপতে ছেলেকে অর্ধেক ভাত খাওয়ান। ছেলেটির নাম অর্জুন, বয়স মাত্র বারো। তার চোখে ভেসে ওঠে শহরের বিলবোর্ড, যেখানে ঝকঝকে স্যুট-পরা কর্পোরেট বিজ্ঞানীরা বলে— “খাওয়াবো আমরা, বাঁচাবো আমরা। আমাদের বীজ ছাড়া বাঁচা অসম্ভব।”
কিন্তু এক রাতে, গোলাঘরের কোণে পুরোনো কাঠের বাক্স খুলতে গিয়ে নীলমাধব হঠাৎ এক অচেনা পুঁটলি খুঁজে পান। ভেতরে শুকনো, হলুদাভ দানার মতো কিছু রাখা। তিনি হতবাক হয়ে যান—এটা তাঁর দাদার রেখে যাওয়া “দেশি ধানের” বীজ। বহু বছর আগেই যেটা হারিয়ে গেছে ভেবে সবাই ভুলে গিয়েছিল।
হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় নীলমাধবের। যদি এগুলো এখনও জেগে থাকে, তবে গ্রামে নতুন আশা জাগতে পারে। কিন্তু বিপদও কম নয়—কারণ কর্পোরেট আইনে ঘোষণা আছে: “অননুমোদিত বীজ ব্যবহার অপরাধ। ধরা পড়লে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।”
নীলমাধব চুপচাপ পুঁটলিটা লুকিয়ে রাখেন। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। তিনি জানেন, আগামী প্রভাতেই হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে—জমি, বীজ আর ভবিষ্যতের জন্য।
পর্ব ২: মাটির নিচে গোপন বিদ্রোহ
ভোরবেলা নীলমাধব উঠেই আঙিনায় দাঁড়ালেন। রাত্রির বৃষ্টি মাটিকে ভিজিয়ে দিয়েছে, জমি থেকে উঠে আসছে এক ধরনের কাঁচা গন্ধ। তাঁর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কম্পন—কেমন যেন মনে হচ্ছে এই গন্ধের সঙ্গেই মিশে আছে বাঁচার প্রতিশ্রুতি।
তিনি চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন পুকুরপাড়ের দিকে। সবার চোখ এড়িয়ে কয়েকটা খুপরি গর্ত খুঁড়ে সেই পুরোনো ধানের বীজ মাটিতে পুঁতে দিলেন। শশী জানতেও দিলেন না। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করলেন—“হে মাটি, এ দানা বাঁচিয়ে দাও।”
কিন্তু গোপন রাখা সহজ নয়। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী—মৃণাল সরকার—গোপনে সব দেখছিল। সে কর্পোরেট কোম্পানির এজেন্টদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করে। গ্রামে যেই কোনো নিষিদ্ধ কাজ হয়, মৃণালই খবর পাঠায় শহরে। বদলে কিছু টাকা আর প্যাকেটজাত চাল পায়। সেই রাতেই সে সিগন্যাল পাঠাল ড্রোনে।
দু’দিন পরে গ্রামে এলো কর্পোরেট “অ্যাগ্রি-ফোর্স”—কালো ইউনিফর্ম পরা লোকজন, চোখে সেন্সর-চশমা। তারা গ্রামের মাটি স্ক্যান করতে লাগল। লোকেরা ভয়ে কাঁপছে। ঘোষণা হলো:
—“যে কেউ অবৈধ বীজ ব্যবহার করবে, তার জমি বাজেয়াপ্ত হবে। আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেওয়া হবে।”
গ্রাম উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। সবাই নীলমাধবকে সন্দেহ করছে, কারণ ওর জমিই একমাত্র টিকে আছে। কিন্তু কেউ প্রমাণ দিতে পারছে না।
সেই রাতেই নীলমাধবের ছেলে অর্জুন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল—
—“বাবা, ভয় পেয়ো না। মাটির সঙ্গে যুদ্ধ করলে জিততে হবে। আমি স্কুলের বইয়ে পড়েছি, আমাদের পূর্বপুরুষরা মাটির শক্তিতে বেঁচে থাকত। কর্পোরেটরা তো শুধু আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।”
অর্জুনের চোখে এক ধরনের আগুন। তার মনে হচ্ছে, এ বীজ শুধু ধান ফলাবে না—এ গ্রামকে ফিরিয়ে দেবে তার আত্মসম্মানও।
নীলমাধব প্রথমবার বুঝলেন, এই লড়াই তিনি একা করছেন না। তাঁর ছেলে, তাঁর মাটি, এমনকি গ্রামও হয়তো ধীরে ধীরে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু অচিরেই এক নতুন বিপদ আসছে—কারণ কর্পোরেট ফোর্স ঠিক করেছে, আগামী সপ্তাহেই ড্রোনের মাধ্যমে গোটা গ্রাম স্ক্যান করবে। যদি বীজ গজিয়ে ওঠে, তখন আর লুকোনো যাবে না।
পর্ব ৩: গ্রামের গোপন কৌশল
নীলমাধব জানেন—ক্রিকেট খেলার মতো ছায়া ফিলিং করে বসে থাকা যাবে না। কর্পোরেট ড্রোন আর স্ক্যানারদের কাছে গ্রামের মৌলিক অস্তিত্বের রক্ষা হবে কৌশলে। তাই তিনি রাতে সকলে ডেকে আনলেন—শশী, অর্জুন, মৃণালর চোখ ফাঁকি দেওয়ার কথা কেউ বলল না—আর গ্রামের কয়েকজন পুরনো কৃষক: গুরুপদ, চাঁদনাথ, আর বাঁশু মিয়া। তারা সবাই জানে গোপন রাখার মানে শুধু বীজ লুকানো নয়; সেটা চিন্তা, রুটিন, রাস্তাঘাট, কথা-বার্তাও পাল্টাতে হবে।
প্রথম সিদ্ধান্তটা ছিল সরল—“ডিকয় প্লট” বানানো। নীলমাধব ও গুরুপদ এক ছুটে পুরোনো মাঠটাতে যায়, যেখানে পাত্তাই নেই। লম্বা ঘাস কেটে সেখানে পলিথিন আর মাটির কিছু কুশলতা করে, যাতে ড্রোন দেখলে মনে হবে সেখান কিছুই চাষ হয়নি বা কর্পোরেট বীজ ছাড়া চাষ হয়েছে। অন্যদিকে, আসল বীজগুলোকে তারা টুকরো টুকরো করে রেখে দিলেন পুকুরধারের গর্তগুলোতে, লেবুর বাগানের নীচে, কচুরিপানার আঁচলে—একেবারে অপ্রত্যাশিত জায়গায়।
অর্জুনের মাথায় এক কৌতুক—স্কুলে রোবট ক্লাব থেকে শেখা কিছু জিনিস কাজে লাগানো যায়। ছোটখাটো বাঁশফুল দিয়ে তারা এমন এক ধরনের “রিফ্লেক্টর” বানালো—শাড়ির রং-চকচকে কাপড়গুলো টুকরো করে মাটিতে বিছিয়ে দিলো; ড্রোনের ক্যামেরা থেকে প্রতিফলিত আলো তৈরি করে তারা ড্রোনকে বিভ্রান্ত করবে। রাতে তারা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া তেল দিয়ে এমনভাবে ঘুরিয়ে দিল যাতে বারোমাসি চাষের মতো দেখে না কোনও রকম হট স্পট।
মৃণাল তো প্রথমে সহায়ক বলে ভেবেছিল। কিন্তু সে ছিল নীরবে সন্দেহের বীজ বপন করে—দিনে দিন সে যে কর্পোরেটের পকেটে ঢুকছে, সে বোঝায় না। সে শহরের এজেন্টদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চায়, অথচ নীলমাধব বুঝে ছিলেন, গ্রামে আভাস ধরলে মৃণালের কণ্ঠস্বর কর্পোরেটের কাছে পৌঁছাবে। তাই লুকোচুরির খেলায় মৃণালকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে “ব্যস্ত” রাখা হলো—তাকে নিয়মিত বাজারে কাঁচা চাল দিতে বলা হলো, যাতে সন্দেহের ভাষা বাঁধে আর সে অনেক কথা বলার সময় না পায়।
এক রাত তারা পরীক্ষা করলেন—ড্রোন আসবে এমন এক সময় চাহিদা তৈরি করে, তারা প্রতিরক্ষামূলকভাবে মাঠে কাজ করবে। অর্জুন আর বাঁশু মিয়া মাটিতে ভিটেমাটি করছিল, হাতে সারস, মুখে গামছা বেঁধে। ড্রোন এল—একটা সাদা আলোর চোখ আকাশে। সবাই নিঃশ্বাস থুড়ে ধরে। ক্যামেরার আওয়াজ যেন গলা ব্যাথা। তখন গুরুপদ ঢেকে দিলেন মাঠে ঢালাও শেড—প্লাস্টিকের টুকরো, অ্যান্টি-রিফ্লেক্টিভ কাপড় মূল জায়গার ওপর বিছিয়ে দিলেন। ড্রোন ওঠা-নামার মাঝে ক্যামেরা মনে করল, এখানে কিছুই নেই। স্ক্যানিং রিপোর্টে কয়েক মিনিটের ভুল ইনফরমেশন পাঠাল। গ্রামে আওয়াজ উঠল—সবাই চাপা আনন্দে হেসে উঠল।
কিন্তু বিজয়ের মাঝে একটা খামতি রয়ে গেল—মৃণালের ভেতরে এখনও দ্বিধা। সে কর্পোরেটের কাছে গিয়ে বলেছিল—“শুধু একটা প্লটেই স্পাইক আছে।” শহর থেকে সে এজেন্টকে বলেছিল যেভাবে, তাদের লোকেরা গ্রামে দিনে দু’বার ঘুড়তে শুরু করল—একটু খাদ্যবস্তুর পরিদর্শন বলে, একটু “সেফটি রিভিউ” বলে। নীলমাধব জানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঁটা বাড়বে; কর্পোরেটরা হার মেনে যাবে না।
তিরিক্ত এক জিনিস নীলমাধবের মনে ধোঁয়া তুলল—যদি বীজ গজায়, তাহলে কি শুধু নিজেদের গ্রামেই সীমাবদ্ধ থাকা যাবে? কি করে তারা এই বীজের জাগরণ ছড়িয়ে দেবে? গুরুপদ বলে উঠল, “আমরা যদি দেখাই—বীজের ফলন খারাপ নয়, যে উপায়টা আমরা নেব, সেটা অন্য গ্রামের কৃষকেও জানাতে হবে। কিন্তু কর্পোরেট যদি ধরা দেয়, তারা আইনি কোর্টে যাবে।”
তখন শশী, নীরবভাবে, একটি কাগজ বের করে আনল—তার বন্ধুর যাঁর গ্রামের ডাক্তারের এক ছাত্র আছে কলকাতায়; সে জেনেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছে। শশী বলল, “আমরা যদি ইচ্ছায় একটা রিপোর্ট বানাতে পারি—প্রমাণ দেখাবো বীজ আধ্যাত্মিকভাবে নয়, এটা আমাদেরই বংশগত—তাহলে কোর্ট সম্ভবত আমাদের হাছলেও দেখবে।”
নীলমাধব জানতেন—এটা আর কোনো সাদা-কালো লড়াই নয়। এটা আইনি, সামাজিক, আর প্রযুক্তিগত সব মিলিয়ে যুদ্ধ। গ্রামের বুকে এখন ছোট ছোট সংঘঠিত হৃৎকম্প আছে—রাতের ছক কষা, দিনের ছায়া ফাঁকি দেয়া। কিন্তু এসবই ছিল শুরুর প্রস্তুতি। কর্পোরেটের চোখে তারা এখন শুধু একটি “ট্যাগেট”। আর সেই ট্যাগেট ধরা দিলে পুরো গ্রামের আত্মবিশ্বাস হারাবে।
পর্ব শেষ হওয়ার ঠিক আগেই অর্জুন বারবার নিজের ছোট কঁচি হাতে মাটি মুঠো করল—তার মাটিতে কড়া ভালোবাসা, তার মাটির জন্য অবিচল প্রত্যয়। সে বুঝে গেল—এ লড়াই কেবল নীলমাধবের নয়; এটা এখন আর্থিক, নৈতিক, আর ঐতিহাসিক—একটি নতুন সময়ের সূচনা।
আগামীদিনে কর্পোরেট নতুন তরিকা আনতে পারে—আইন, সিআইএস প্রক্সি, কিংবা আরও তীব্র নজরদারি। কিন্তু গ্রামটাও বদলাতে শুরু করেছে—একে একে মানুষের মনে দানা বোনা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের নতুন বীজ।
পর্ব ৪: নজরদারির ছায়া
গ্রামের আকাশে এখন প্রতিদিনই গুনগুন করে উড়ে বেড়াচ্ছে কর্পোরেট ড্রোন। কেউ জানে না কোনটার ক্যামেরা চলছে, আর কোনটা শুধু ভয় দেখানোর জন্য। শিশুরা খেলা করতে বেরোলেই মায়েরা তাড়িয়ে নিয়ে যায়—“ওসব আলোয় মুখ দেখিও না, সব রেকর্ড হয়ে যাবে।” মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখন ভয়ে গুটিয়ে গেছে।
নীলমাধব বুঝলেন, শুধু গোপনে বীজ বপন করলেই হবে না। তাদের শত্রু হল তথ্য—কর্পোরেটরা গ্রাম থেকে প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি শব্দ সংগ্রহ করছে। তাই তিনি উদ্যোগ নিলেন গোপন বৈঠকের। এক রাতে পুকুরপাড়ে তেলের প্রদীপ জ্বেলে কয়েকজন বিশ্বস্ত মানুষকে নিয়ে বসালেন।
গুরুপদ বলল, “আমাদের চলাফেরাই যদি ধরা পড়ে, সব শেষ। কৌশল চাই।”
অর্জুন মাথা খাটিয়ে বলল, “ড্রোনকে ফাঁকি দিতে হবে। আমি স্কুলের সায়েন্স ক্লাবে ছোট্ট একটা যন্ত্র বানিয়েছিলাম। লোহার টুকরো আর চুম্বকের ঘূর্ণন দিয়ে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল গুলিয়ে ফেলা যায়। আমরা চাইলে মাঠের পাশে সেটা বসিয়ে রাখতে পারি—ড্রোনের ক্যামেরা ক’সেকেন্ড অন্ধ হয়ে যাবে।”
সবার চোখ জ্বলে উঠল। গুরুপদ হাসতে হাসতে বলল, “ছেলের মাথায় আগুন জ্বলছে, ওকেই নেতা মানতে হবে।” নীলমাধব চুপ করে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।
কিন্তু সেই রাতেই নতুন বিপদ। কর্পোরেট ফোর্সের গাড়ি এসে থামল মৃণালের আঙিনায়। কালো পোশাকের অফিসাররা তাকে আলাদা ডেকে নিল। পরদিন ভোরে গুজব ছড়িয়ে গেল—মৃণাল নাকি শহরে গিয়েছিল রিপোর্ট জমা দিতে। কেউ কেউ বলল, সে গ্রামের বিশ্বাসঘাতক। আবার কেউ বলল, কর্পোরেট তাকে টাকার লোভ দেখিয়েছে।
শশী ফিসফিস করে স্বামীকে বলল, “মৃণালকে ছাড়তে নেই। ও যদি খোলাখুলি বলে দেয়, তবে তোমার সেই বীজটুকুও বাঁচবে না।”
নীলমাধব দোটানায় পড়ে গেলেন। প্রতিবেশীকে সরাসরি শত্রু বানানো ভয়ংকর। কিন্তু নীরব বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া আরও ভয়ঙ্কর।
এদিকে গোপনে বপন করা ধান গজাতে শুরু করেছে। অল্প অল্প সবুজ চারাগাছ মাথা তুলছে ভেজা মাটির বুক থেকে। দৃশ্যটা দেখে নীলমাধবের চোখে জল এসে গেল—এ যেন শুধু গাছ নয়, বেঁচে থাকার অঙ্গীকার।
কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হলো না। ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশে লাল আলো জ্বলে উঠল—কর্পোরেট ড্রোন নিচুতে নেমে আসছে। সবার বুক ধড়ফড় করে উঠল।
অর্জুন চুপচাপ তার হাতে বানানো যন্ত্রটা চালু করল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ড্রোনের ক্যামেরা কেঁপে উঠল, যেন ঝড়ের মধ্যে বাতি দুলছে। কিন্তু বেশি সময় টিকে রইল না। আলো আবার স্থির হয়ে গেল—আর ধানগাছের কচি সবুজ পাতায় লেন্সের চোখ আটকে গেল।
সবাই নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে রইল। খেলা এখন সত্যি শুরু হয়ে গেছে।
পর্ব ৫: কর্পোরেটের সভা
শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকার ৭৭ তলায় কর্পোরেট সদর দপ্তর। কাঁচের দেয়ালের ভেতর ঝকঝকে আলো, টেবিলের চারপাশে বসে আছে স্যুট-পরা কয়েকজন পরিচালক। বড় পর্দায় ভেসে উঠল সেই গ্রামের ছবি—ধানের কচি চারাগাছগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
অফিসার মীনা দেশাই ঠাণ্ডা গলায় বলল,
—“স্পষ্টতই এখানে অননুমোদিত বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে। আইন ভাঙা হয়েছে। আমাদের মডেল বলে, এগুলো যদি ছড়িয়ে পড়ে, তবে পুরো রাজ্যের বীজ-বাজার ভেঙে পড়বে।”
অন্যজন, ডিরেক্টর কাশ্যপ হাসল,
—“একটা গ্রামই তো! চাইলেই আমরা উড়িয়ে দিতে পারি। ড্রোনে আগুন ফেললেই শেষ।”
কিন্তু সিইও অরুণাভ সেন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন।
—“না, ওভাবে হবে না। ধ্বংস করলে মিডিয়া গন্ধ পেয়ে যাবে। এখন মানুষের ভেতরে ক্ষুধার জ্বালা তীব্র। যদি খবর ছড়ায় যে কোথাও প্রকৃত ধানের বীজ টিকে আছে, তখন আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হবে। আমাদের চাই প্রমাণ, আদালতের রায়, আর মানুষের বিশ্বাস করানো যে এসব বীজ বিপজ্জনক।”
তাই সিদ্ধান্ত হলো—পরের সপ্তাহে বিশেষ টিম যাবে গ্রামে। তারা বীজ বাজেয়াপ্ত করবে, এবং প্রমাণ বানাবে যে এই বীজে “রোগ ছড়ানোর” ঝুঁকি আছে। সরকারকেও হাতের মুঠোয় রাখা হবে।
—“অভিযানের নাম হবে অপারেশন স্টেরাইল,” মীনা ফাইল বন্ধ করে বলল।
গ্রামে এদিকে টানটান উত্তেজনা। সবাই জানে বড় কিছু ঘটতে চলেছে। নীলমাধব আর অর্জুন গোপনে চারাগাছের চারপাশে কাঁটা জালি বানাচ্ছে। গুরুপদ বলল,
—“ওরা যদি এসে গাছ তুলে নেয়, সব শেষ।”
শশী ফিসফিস করে বলল,
—“তাহলে আমাদের সত্যিটাই আগে ছড়িয়ে দিতে হবে। শহরে যারা বিজ্ঞান পড়ছে, সাংবাদিক আছে, তাদের কাছে খবর পাঠাতে হবে।”
অর্জুন হঠাৎ বলল,
—“আমি আমার স্কুলের বন্ধু সোহমকে মেসেজ দিতে পারি। ওর কাকা এক নিউজ চ্যানেলে কাজ করে। যদি ছবিগুলো পৌঁছয়, তবে সবাই জানবে।”
নীলমাধব ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে নীরব থাকলেন। ভয় আর আশা একসঙ্গে বুকে কাঁপছিল।
কিন্তু ঠিক তখনই মৃণাল হঠাৎ এসে হাজির। তার চোখে অদ্ভুত এক চাহনি। সে বলল,
—“শুনেছি শহর থেকে বিশেষ বাহিনী আসছে। তোমরা যদি এখনই বীজ হস্তান্তর না করো, পুরো গ্রাম শেষ হয়ে যাবে।”
সবার মুখ স্তব্ধ হয়ে গেল। কে বন্ধু, কে শত্রু—এখন আর বোঝা যাচ্ছে না।
আর দূরের আকাশে তখন কালো হেলিকপ্টারের ছায়া দেখা যাচ্ছে…
পর্ব ৬: অপারেশন স্টেরাইল শুরু হয়
কালো হেলিকপ্টারের ঘূর্ণি গ্রামজুড়ে গর্জন করে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো আকাশটাই তাদের পায়ের তলায় নামছে। কর্পোরেট টীমের ট্রাকেরা আসে—রঙে চকচকে, লোগো ঝকঝকে; কালো গ্লাভস, নীল মেডিক্যাল কোট আর থিক-লেন্স চশমা পরা মানুষজন নেমে পড়ে। তাদের মুখে কোনো দয়া নেই; কাঁধে বহন করা যন্ত্রগুলো—সেন্সর, বায়ো-স্যাম্পলিং কিট—সবকিছুই প্রস্তুত। গ্রামবাসী একেবারেই স্তব্ধ; বয়স্করা কাঁধ নেড়ে বলছে—“এত বড় বাহিনী কখনও দেখে নি আমরা।”
নীলমাধবের বুক কেঁপে উঠছে, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। তাঁর হাতে ছিল সেই পুরোনো পুঁটলির শেষ কয়েকটা দানা—মৃতপ্রায় বীজের মতো একটি আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। গুরুপদ, শশী, বাঁশু মিয়া—সবার চোখেই বিরামহীন সংকেত: লড়াই হবে, কিন্তু বুদ্ধি আর সাহস দুটোই দরকার। তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল—এক দল মাঠে কৃত্রিম ডিকয় রেখে ড্রোন-স্ক্যানারকে বিভ্রান্ত করবে; আর অন্য দল সরাসরি টীমের সামনে “শান্ত” আচরণ করে তথ্য টেনে আনবে—সময় কাড়বে, যাতে অর্জুনের পাঠানো ছবি আর সোহমের কাকাকে পৌঁছাতে পারে।
কর্পোরেট টীম নেতা, একটি নামফলক ধরে, ঘোষণা করল—“আমরা নিত্যনতুন প্রজাতির বীজ বিপদজনক হতে পারে; তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নমুনা সংগ্রহ করছি। যাহোক, কেউ প্রতিবাদ করলে আইন ব্যবহার করা হবে।” তিনি কণ্ঠে সেই একই কর্পোরেট ভদ্রতা, যাকে শুনলে মানুষ লজ্জায় নতমুখ হয়। মৃণাল ভির করে দাঁড়িয়ে থেকে টিমকে সকল জায়গার চাবি দিয়ে দিল—সে কাঁটা হয়ে দাঁড়াল যে-কেউ বললেই সে সব বলে দেবে। নীলমাধবের গলায় কাঁটা চেপে গেল।
অন্যদিকে, অর্জুন মোবাইলের সোশ্যাল অ্যাপ থেকে ছবি আপলোড করে দিল। সোহম ফোন ধরে মুহূর্তেই খবরটা চ্যানেলে পৌঁছল—“গ্রামে সন্দেহভাজন দেশি বীজের চাষ, কর্পোরেট অপারেশন শুরু”—হেডলাইন উঠল। শশীর মন হঠাৎ এক নতুন আশায় ফুঁসে উঠল; কিন্তু আনন্দ হওয়ার সময় খুব কম—কারণ কর্পোরেট লোকেরা কাজ শুরু করে দিল। তারা মাঠ কেটে, কচুরিপানার আঁচল থেকে মাটির নমুনা তোলার সময় একজন দলের বিজ্ঞানী বলে উঠল, “এখানে অননুমোদিত জিন নেই—তবু আমরা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা যাচাই করব।” তার কণ্ঠে সোঁদা আস্থা ছিল—নাহয় ফল পাবেই।
নীলমাধব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এক এক করে নিজের জমির ওপর দেখল—তার চোখে গাছগুলো কেঁদে উঠে বলে কিছুই নয়, কিন্তু মাটির গভীর থেকে যেন একটা নিঃশ্বাস উঠল—“বেঁচে আছি।” তিনি বুঝলেন, কখনোবা আইনি লড়াই, কখনোবা গণমাধ্যম, কখনোবা স্নেহভারি গ্রামবোলেই তারা জিতবে—কিন্তু সময় এখনও তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
আচমকাই ঘটল—কর্তৃপক্ষের একজন নিরীক্ষা অফিসার খামছুঁয়োর মতো সাদা জ্যাকেট খুলে কাঁচের বোতলে মাটির নমুনা ঢুকিয়ে নিলেন। মাঠের কাছে দাঁড়ানো কিছু তরুণ—বাঁশু মিয়া ও গুরুপদ—চালাকি করে আলাদা অংশে আলাদা নমুনা ঢুকিয়ে দিলেন; কারণ তারা জানত, যদি ল্যাব রিপোটে “জৈববৈচিত্র্য” পাওয়া যায়, তাহলে কর্পোরেটের হাতে আইনি প্রমাণ থাকবে। সেদিন সন্ধ্যায় টীম গ্রামের লোকদের বলল কাল আদালতের নোটিশ পাঠানো হবে, এবং বীজ হেফাজতে নিয়ে পরীক্ষার জন্য সরিয়ে নেওয়া হবে।
কিন্তু তখনই গ্রামের পুরোনো ঘরের ভিতর থেকে একটি মোবাইল কাঁপছে—সোহমের কাকাই লাইভ ব্রডকাস্ট শুরু করে দিলেন। চ্যানেলে কাজি-ফরহাদ—একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক—মাইকে বলতে লাগলেন, “আমরা এখন সরাসরি দেখতে পাচ্ছি—একটি ছোট গ্রাম, যেখানে দেশের ধানের ঐতিহ্যের কিছু নিঃশেষ বীজ ধারণ করা আছে। কর্পোরেট বাহিনী সেখানে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছে; প্রশ্ন হচ্ছে, কার মানে কী?” তাঁর কথায় ছিল আগ্রাসী কৌতূহল; এই ধরনের লাইভ মুহূর্ত ভক্তদের মনে নড়েচড়ে বসায়—লোকজন সোশ্যাল-ফিডে প্রশ্ন তুলছে, #SaveOurSeeds ট্রেন্ড করে উঠছে।
গ্রামের মধ্যে মুহূর্তে দুই ভাগে বিভক্তি আরও বাড়ল—এক দল চায় আইনি লড়াইয়ে নামবে, অন্য দল ভয়ে পিছনে সরে যেতে চায়। মৃণাল উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, “এরা আমাদেরকে নষ্ট করবে! এখন সরাই।” কিন্তু শশী বলল, “না—আমরা লড়ব। যদি কেউ না লড়ে, সকলেই হারাবে।” নীলমাধব কেবল তাদের দিকে তাকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস দিলেন—তার মাথায় একটাই চিন্তা, কিভাবে এই তীব্র সময়ে গ্রামের মানুষকে একত্র রাখা যায়।
পর্বের শেষদিকে, কর্পোরেট টীম একটি কাগজ তুলে ধরল—সরকারি অর্ডার, যাতে ল্যাব টেস্টের পর যদি বীজ অননুমোদিত ঘোষিত হয়, তাহলে দ্রুতই জমি বাজেয়াপ্তের ধারা আছে। সোজাসুজি তারা বলতে পারল—“আপনাদের অধিকার রক্ষা করা হবে—কিন্তু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।” গ্রামের গায়ে যেন গরম পাথর পড়ে—সবাই বুঝল, এখন সময় নীরবে শ্বাস রাখা নয়; সময় এসেছে স্বর তুলতে।
আর অর্জুন যে লাইভ দেখে আর সোশ্যাল মিডিয়ার সাপোর্ট বাড়ছে, তা নীলমাধব জানেনি—সে বুঝলো না যে শহরের মানুষদের চোখ এখন তাদের গ্রামে, আর এই নজর দেবে নতুন সাহস আর নতুন বিপদ দুইই।
পর্ব ৭: বিচার-মঞ্চে দাঁড়ানো
টিভি ক্যামেরার লেন্স গ্রামের মাটির ওপর ঝুঁকে ছিল—সকালে শুরু হওয়া লাইভ কভারেজের আলো গ্রামের ঘরে ঘরে আকাশ ফেলতে শুরু করেছে। কর্পোরেটের কাগজপত্র আর ইস্যু করা নোটিশের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল; মানুষের রায়ের সঙ্গে সাথে গ্রামটা রাতারাতি পত্রিকার পাতায় চলে এল।
নিলমাধবের বাড়িতে তখনও এক অদ্ভুত নীরবতা—ভয়ের সঙ্গে কৃতজ্ঞতা মিশে আছে। শশী সকালে বাজার সবার কাছে বলল, “এই যে, আমরা লড়ছি—আর আমাদের পাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছে।” অর্জুনের হাসি খাটে; সে জানে তার ছোট্ট সিদ্ধান্তটা—এক টা ছবি পাঠানো—গ্রামের ভাগ্য বদলাতে পারে।
একজন আইনজীবী শহর থেকে এল—নামের মধ্যেই ছিল গ麟িত ভোটে পরিচিতি, আইনজীবী শর্মিলা দত্ত। তিনি বললেন, “প্রথম কাজ—চেইন অফ কাস্টডি প্রতিষ্ঠা করা। ল্যাবে পাঠানো নমুনাগুলো কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কারা তা দেখেছে—সবকিছু রেকর্ড থাকতে হবে। আমরা যদি দেখাতে পারি নমুনা পাল্টে দেওয়া হয়েছে বা পরীক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম আছে, তাহলে আদালত আমাদের তরফে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।” তাঁর ওপর থেকে গ্রামবাসী যেন বাঁচার ভালোবাসা পাওয়ার মতো ভর করে ওঠে।
কিন্তু চেইন অফ কাস্টডি মানানো সহজ ছিল না—কারণ নমুনা তো এখন কর্পোরেট ল্যাবে। জেলা প্রশাসনের একজন অফিসার শান্তভাবে বলেন, “ল্যাব স্বাধীন, কিন্তু সরকারও আমাদের নীতিতে আছে। আপেলের মতো সরল বিষয় নয়—প্রমাণের চেয়ে বেশীর ভাগই নীরব কাগজে। ” গ্রামবাসীরা বুঝল, আদালতই তাদের শেষ ভরসা, কিন্তু সেখানে পৌঁছনো মানে কষ্ট আর সময়।
তারই মাঝে মৃণালের গলতি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। সে একরাশ নথি হাতে গ্রামে এল—বলছিল, “আমি শুধু আসলে বলেছি—তারা যদি চায় বীজ হাতে হস্তান্তর করুক।” গ্রামের কোনো কেউ আর বিশ্বাস করতে চাইলো না। মৃণাল কাঁপছে, চোখে লজ্জা, কিন্তু কর্পোরেটের টাকাপয়সা তার কাঁধে গভীর ছাপ ফেলেছে। গুরুপদ তাকে ঠেস দিয়ে বলল, “আজ তুমি কি সত্যি আমাদের পাশে থাকবে?” মৃণাল চুপ।
শহরের সাংবাদিকরা গ্রামে এসে প্যাকেট আর কাগজ ছড়িয়ে ধরে কথা বলল—কেউ কর্পোরেট-বিরোধী সমর্থন দিচ্ছে, কেউ বলছে গবেষণার স্বার্থে নমুনা জরুরি। কিন্তু একমত সবাই—এই লড়াই শুধু একটা গ্রামের নয়; এটি এখন সমগ্র ক্ষুদ্র কৃষকের প্রতিরোধের প্রতীক। #SaveOurSeeds ট্যাগে একঝাঁক পিশাচের মতো নতুন নতুন কাহিনী ঢুকে পড়ল—কেউ নিজের পুরোনো বীজের ছবিও দিল, কেউ লিখল তার গ্রামেও একই রকম হয়।
শর্মিলা জেলা কোর্টে জরুরি আবেদন করলেন—“অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, যাতে ল্যাব রিপোর্ট আসার আগে কোনো ধরণের বীজ ধ্বংস বা ফেরত না নেয়া হয়।” কোর্ট আদেশ দিল—ল্যাব রিপোর্ট আসা পর্যন্ত নমুনাগুলো নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে; অন্যদিকে, কর্পোরেটের পক্ষে প্রযোজ্য আইন মান্য করা হবে। আদালত বুঝল—এটা শুধুই বিজ্ঞান নয়, সামাজিক প্রসঙ্গও।
কিন্তু কর্পোরেটের প্রতিক্রিয়া কড়া। একই রাতেই তারা গ্রামে কয়েকজন আইনি পরামর্শক পাঠাল—একটা নরম হুমকি মিশিয়ে বাক্স—“আপনাদের রাজস্ব ও ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে চিন্তা করুন, আর না হলে প্রক্রিয়া দ্রুত এগোবে।” গ্রামের মধ্যে অশান্তি ছড়াল—কেউ বলল আইন মানলে ভালো, কেউ বলল কর্পোরেট তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।
সেদিন রাতে, যখন কোর্ট থেকে অদ্ভুত এক শান্তির বাতাস বইছিল, গ্রামের প্রান্তে ভেসে এলো একটি শব্দ—হংকারের মতো। কেউ বলল হয়তো হেলিকপ্টার, কেউ বলল সন্দেহজনক গাড়ি। নীলমাধব, গুরুপদ আর কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাইরে গেলেন—পাশেই দেখা গেল মৃণাল অট্টহাসি সহ শহরের এক প্রতিনিধি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে একটি কাগজ—তারাই বলে, “আপনি চাইলে আমরা আপনাদেরকে বাজারে এমন একটা নতুন চুক্তি দেব, যেখানে আপনি নিয়মিত টাকা পাবেন।” মৃণাল এক অদ্ভুত হাসি দিল।
নীলমাধবের চোখে তখন ফোটে কষ্ট আর অভিমান—সে জানে, আর্থিক প্রলোভন প্রতিটি দিন তাদের মাঝে বিস্তার করছে। কিন্তু সে আর পিছনে ফিরে তাকায় না; সে জানে যে পরেরদিন সকালে কোর্টে যাওয়া তাদের জন্য এক নতুন সংগ্রামের শুরু। প্রত্যেকের মনে আজ একটাই কথা—যদি তারা হারায়, তাদের ভবিষ্যৎ হারাবে; আর যদি জিততে পারে, তাহলে সম্ভবত পুরো রাজ্যের ক্ষুদ্র চাষিরাও বাঁচবে।
পর্বের শেষ দিকে, অর্জুন চুপচাপ তার বাবার হাত ধরল। তার চোখে অমরা প্রত্যয়—“বাবা, আমি তোমার পাশে আছি।” নীলমাধব হালকা হাসি দিলেন, কিন্তু ভিতরে দগ্ধ এক ভয় ছিল—অবাক ঘটনা হলো, মৃণালের কথাবার্তায় ভাঙচুরের চিহ্ন এখনও অদৃশ্য। কোথাও একটা সুঁইবিন্দু ছিল, যেটা সময়ের সঙ্গে বড় হৈচৈ তুলবে।
আগামী পর্বে আমরা দেখব—ল্যাব রিপোর্ট কেমন আসে, মিডিয়ার চাপ কেমন বদলে দেয়, আর কর্পোরেট কোন নতুন হদিশ এনেছে গ্রামে।
পর্ব ৮: ল্যাবের রিপোর্ট
সকালের প্রথম আলোতেই খবর এল—কর্পোরেট ল্যাব রিপোর্ট তৈরি করেছে। জেলা আদালতের কোর্ট রুমে সাংবাদিক, আইনজীবী আর গ্রাম থেকে আসা কিছু মানুষ ভিড় জমাল। শশী শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে বসেছিল, আর গুরুপদ একেবারে সামনের বেঞ্চে। অর্জুন তার ছোট্ট খাতাটা বুকে চেপে রেখেছে, যেন যুদ্ধের ঢাল।
বড় পর্দায় ভেসে উঠল রিপোর্টের সারাংশ—
“এই বীজে জেনেটিক অস্থিরতা আছে। এর ফলে মাটির ক্ষয়, রোগ বিস্তার, এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”
কর্পোরেট আইনজীবীরা হাততালি দিয়ে বলল—“এটাই প্রমাণ! অবৈধ বীজ, মানুষের শত্রু। আমাদের কোম্পানির সুরক্ষিত বীজ ছাড়া অন্য কিছু টিকতে পারে না।”
কোর্টরুমে ফিসফাস শুরু হলো। গ্রামের লোকজন ভয় পেয়ে একে অন্যের দিকে তাকাল। কিন্তু শর্মিলা দত্ত দাঁড়িয়ে রইলেন শান্ত গলায়। তিনি বললেন,
—“মাই লর্ড, আমি এই রিপোর্টের স্বচ্ছতা চ্যালেঞ্জ করছি। রিপোর্টে কোথাও উল্লেখ নেই নমুনার চেইন অফ কাস্টডি। কবে, কে, কোথা থেকে নিয়েছে—কোনো ডকুমেন্ট নেই। নমুনা পাল্টে দেওয়া হয়েছে কিনা, সেটা যাচাই করার উপায় নেই।”
তিনি কোর্টে একে একে ছবি দেখালেন—সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, যেখানে গ্রামবাসীরা ড্রোন ফাঁকি দিচ্ছে, যেখানে কর্পোরেট অফিসাররা গোপনে বোতল বদল করছে।
বিচারক কঠোর মুখে বললেন, “রিপোর্টটি পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ নয়। স্বাধীন সরকারি ল্যাবকে নতুন নমুনা পরীক্ষা করতে হবে।”
এই এক বাক্যে গ্রামবাসীদের মুখে আলো ফুটে উঠল। নীলমাধব চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। শশী তাঁর হাত চেপে ধরলেন—“মাটি এখনও আমাদের পাশে আছে।”
কিন্তু খেলা এখানেই শেষ হয়নি। কোর্ট থেকে বেরোবার সময় মীনা দেশাই সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করলেন—
—“এই গ্রাম রাষ্ট্রদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছে। তারা অবৈধ বীজ ছড়িয়ে আমাদের খাদ্য সুরক্ষাকে বিপদে ফেলছে। যদি এরা থামতে না চায়, আমরা সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলব।”
মিডিয়ার ফ্ল্যাশ জ্বলল। মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ল—কেউ বলল গ্রাম বীরত্ব দেখাচ্ছে, কেউ বলল এরা অজ্ঞতার কারণে বিপদ ডেকে আনছে।
রাতে গ্রামে ফিরে সবাই মশাল জ্বালিয়ে জমায়েত হলো। গুরুপদ গর্জে উঠল—
—“এখন আর পেছনে ফেরার রাস্তা নেই। আমাদের বীজ আমরা নিজেরাই রক্ষা করব।”
অর্জুন কণ্ঠ উঁচু করে বলল—
—“যদি সরকার বা কর্পোরেট আবার আসে, আমরা লুকোব না। সবার সামনে বলব—এটাই আমাদের ধানের দানা, আমাদের বাঁচার অধিকার।”
নীলমাধবের চোখে জল জমল। তাঁর মনে হলো, মাটির গন্ধ আবার ফিরছে গ্রামে—যা কোনো কর্পোরেট আইন ছুঁতে পারবে না।
কিন্তু আকাশের দিকে তাকাতেই দেখা গেল—নতুন ড্রোনের বহর লাল আলো জ্বালিয়ে ঘুরছে। তাদের চোখ আরও ধারালো, আরও নির্মম।
পর্ব ৯: আগুনের রাত
আকাশজুড়ে ড্রোনের লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো গ্রামটা যেন এক বিশাল নজরদারি কারাগার। সন্ধ্যা নামতেই কর্পোরেট আর সরকারি বাহিনী একসঙ্গে অভিযান শুরু করল। ট্রাক, সশস্ত্র রক্ষী আর কাঁধে ঝোলানো “বায়ো-ডিস্ট্রয়ার” যন্ত্র—সব মিলিয়ে গ্রামবাসীর বুক কেঁপে উঠল।
লাউডস্পিকারে ঘোষণা হলো—
“সরকারি নির্দেশে এ গ্রামে অবৈধ বীজ ধ্বংস করা হবে। সবাই ঘরে ফিরে যান। প্রতিরোধ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু এবার আর কেউ পিছু হটল না। মশাল হাতে পুরুষরা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে গেল, মহিলারা শাড়ির আঁচল শক্ত করে ছেলেমেয়েদের সামলাল। গুরুপদ বুক ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—
—“এই মাটি আমাদের। এই বীজ আমাদের রক্তে মিশে আছে। কেড়ে নিতে এলে প্রতিরোধ হবেই।”
শশী নারীদের নিয়ে গোল হয়ে বসে উঠল গান গাইতে—পুরোনো সাঁওতালি সুর, যা যুদ্ধের ডাকের মতো বেজে উঠল রাতের অন্ধকারে।
অর্জুন স্কুলের খাতায় আঁকা সার্কিট থেকে বানানো যন্ত্র চালু করল। লোহার টুকরো আর চুম্বকের ঘূর্ণনে ড্রোনের ক্যামেরা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল। কয়েকটা ড্রোন আকাশে ঘুরপাক খেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেল। গ্রামের ছেলেরা বাঁশের লাঠি দিয়ে আকাশে ঝাপটে পড়া আলোকে ভাঙার চেষ্টা করল।
প্রথম সংঘর্ষ হলো মাঠের কিনারায়। কর্পোরেটের লোকেরা বীজ জব্দ করতে এগোতেই গ্রামবাসীরা মানব প্রাচীর তৈরি করল। বাঁশু মিয়া দাঁত চেপে বলল—“মাটি ছুঁলেই রক্ত পড়বে।” উত্তেজনার মুহূর্তে একজন অফিসার ঠেলাঠেলি শুরু করল, আর হঠাৎ লাঠির বাড়ি পড়ে গেল তার কাঁধে। পুরো পরিস্থিতি আগুনের মতো জ্বলে উঠল।
বিস্ফোরক যন্ত্র থেকে ধোঁয়া ছড়ানো হলো—গ্রাম অন্ধকারে ঢেকে গেল। কাশির দমক, চিৎকার, কান্না—সব মিলিয়ে ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু গ্রামের মানুষ ছড়িয়ে না গিয়ে আরও গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ সাংবাদিক শর্মিলা দত্ত তার মোবাইল ক্যামেরা অন করলেন। তিনি সরাসরি লাইভ করে চিৎকার করে বললেন—
—“দেখুন, এখানে কর্পোরেট বাহিনী এক নিরস্ত্র গ্রামকে আক্রমণ করছে! এরা শুধু ধানের বীজ রক্ষা করছে।”
লাইভ সম্প্রচার ছড়িয়ে পড়ল শহরে। #SaveOurSeeds ট্রেন্ড নতুন ঢেউ তুলল। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের ক্ষোভ বাড়তে লাগল। সরকারের ওপর চাপ বাড়ল—কেন একটি গ্রামে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে?
কিন্তু মাঠে তখনও যুদ্ধ চলছে। নীলমাধব গলা উঁচু করে ছেলেকে বলল—
—“অর্জুন, আলো জ্বালাও!”
মুহূর্তে গ্রামজুড়ে মশাল, লণ্ঠন আর আগুনের ঢেউ উঠল। অন্ধকার ধোঁয়ার ভেতরেও সেই আলো ফুটে উঠল—প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে।
কর্পোরেট বাহিনী থমকে গেল। তারা জানে, লাইভ ক্যামেরার সামনে রক্ত ঝরালে শহর বিদ্রোহে ফেটে পড়বে।
কিন্তু এও সত্যি—তারা খালি হাতে ফিরে যাবে না।
আকাশে তখন দূর থেকে আসছে আরও বড় হেলিকপ্টারের শব্দ…
পর্ব ১০: বিজয়ের বীজ
হেলিকপ্টারের শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো নেমে এলো। আলো ঝলসে উঠল মাঠজুড়ে, আরেকদল সশস্ত্র বাহিনী নেমে পড়ল। গ্রামের মানুষ বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে গেল—কেউ মশাল হাতে, কেউ বাঁশের লাঠি, কেউবা কেবল খালি চোখে আগুনের শপথ নিয়ে।
লাউডস্পিকারে গর্জে উঠল কণ্ঠ—
“এটা শেষ সতর্কবার্তা। অবিলম্বে বীজ হস্তান্তর করুন, নইলে বলপ্রয়োগ করা হবে।”
কিন্তু এবার আর ভয় দেখানো চলল না। শশী মাটিতে বসে পড়লেন, মাথায় আঁচল টেনে নিলেন, আর বাকিদের সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন—
“এই মাটি আমাদের! এই বীজ আমাদের! আমরা ছাড়ব না।”
তার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও কণ্ঠ তুলল, পুরুষরা শ্লোগান দিল। অর্জুন মশালের আলো উঁচুতে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—
“আমাদের বীজ আমাদের জীবন!”
লাইভ সম্প্রচার সেই মুহূর্তটাকে শহরের কোটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিল। সংবাদমাধ্যমে ছবি ফুটে উঠল—একটা ছোট গ্রাম, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহুজাতিক কর্পোরেট শক্তির সামনে।
অভিযান দল থমকে গেল। তাদের ওপরও চাপ বাড়ছিল—উপরে সরকার থেকে ফোন আসছে, “কোনো রকম রক্তপাত যেন না হয়।” মিডিয়ার ঝড় এমন অবস্থায় ফেলল যে কর্পোরেট হেলিকপ্টারও উড়াল দিল ফিরে যাওয়ার জন্য।
গুরুপদ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা জিতলাম।”
কিন্তু নীলমাধব জানতেন—এটা লড়াইয়ের শেষ নয়, কেবল প্রথম অধ্যায়।
পরদিন সকালে সরকারী নোটিশ এলো—“দেশজ বীজের গবেষণা ও সংরক্ষণ শুরু হবে। কর্পোরেটের একচেটিয়া অধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত।” আদালত স্বাধীন কমিশন গঠন করল, যেখানে কৃষক প্রতিনিধি থাকবে।
গ্রাম আনন্দে ভেসে উঠল। নারীরা গাছের গোড়ায় জল ঢালল, শিশুরা মাটিতে খেলে বেড়াল। শশীর চোখে জল, সে বলল, “এই দানাগুলো শুধু গাছ নয়—এ আমাদের ভবিষ্যৎ।”
অর্জুন বুকে খাতাটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খাতার ভেতর আঁকা সার্কিট, মশালের ছবি, আর এক কোণে লেখা—
“যে বীজ বাঁচাতে জানে, সেই মানুষ বাঁচাতে জানে।”
মৃণাল লজ্জায় গ্রামে মুখ দেখাতে পারল না। কেউ আর তাকে শত্রু বলল না, কিন্তু কেউ আর তার কথা শুনলও না। ইতিহাস তাকে বাদ দিয়ে এগিয়ে গেল।
সন্ধ্যায় নীলমাধব গোলাঘরে ঢুকে পুরোনো বাক্স থেকে শেষ কয়েকটা দানা হাতে তুলে নিলেন। আঙুলে মাটি ঘষে বললেন,
“যুদ্ধ হয়তো শেষ হয়নি, কিন্তু এই বীজ এখন আমাদের রক্তে মিশে গেছে। কেউ আর এটাকে মুছে ফেলতে পারবে না।”
আকাশে তখন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছিল। মাটির বুক ভরে উঠছিল নতুন চারা গাছের সবুজে।
আর গ্রামের মানুষ বুঝল—এই ছোট্ট জয়ে তারা শুধু নিজের জমিই নয়, পুরো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষা করেছে।
শেষ — কিন্তু প্রকৃত লড়াই চলতেই থাকবে।