Bangla - কল্পবিজ্ঞান - রহস্য গল্প

জিন-প্রজন্ম

Spread the love

জিনিয়া রায়


পর্ব ১

২০৭৫ সালের ‘নিউ কলকাতা’ রাত জেগে থাকে এলইডি আলো আর ড্রোনের গুঁজনের নিচে। এ শহরের আকাশে তারা নেই, আছে ডেটা-গ্রিড আর ক্লাউড রেডিয়েশন। আর এ শহরের শিশুদের কাঁদার আওয়াজ নেই, কারণ জন্মই হয় নিরবতায়, সিলিকনের স্যানিটাইজড ওয়ার্ডে, বেছে নেওয়া জিনের শংসাপত্র হাতে নিয়ে। কিন্তু সেদিন ভোররাতে, শহরের পূর্বাংশে পুরনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতালের নিচতলায় এক শিশুর কান্না শোনা গেল। তার নাম রাখা হলো—আরব। পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী এই জন্ম বেআইনি। আরবের মা নিসর্গা সেন একসময়কার জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রিসার্চার ছিলেন। কিন্তু যখন ‘G-Sculpt’ কোম্পানি পুরো মানবজাতির জিন বেছে নেওয়ার অধিকার জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়, নিসর্গা পালিয়ে যায়, নিজেকে আড়াল করে ফেলে, কারণ সে বিশ্বাস করত—প্রকৃত জন্ম মানেই প্রকৃত মানবতা। আরবের জন্মের দিনই সে বুঝেছিল, তার ছেলেটি আলাদা। আরবের চোখে ছিল তীব্র আলো, অথচ শহরের বাকি সব শিশুদের চোখ ছিল নিস্তেজ—যেমনটা হয় যন্ত্রের, ফরম্যাট করা স্মৃতির।

দুই দিন বয়সে আরব শব্দের প্রতিক্রিয়া জানায়, চারদিনে সে গানের সুরে মাথা দুলায়, সাতদিনে সে নিসর্গার মুখে হাত বুলিয়ে বলে—“মা।” নিসর্গা কেঁদে ফেলেছিল। কারণ এসব কিছুই আজকের শিশুদের মধ্যে থাকে না। কারণ শিশুদের জন্ম হয় “প্রি-ডিফাইনড ট্রেইট মডিউল” থেকে। মায়ের কোলে থাকা উষ্ণতা এখন একটি অ্যাপে পাওয়া যায়, আর শিশুর কান্না? সেটা নিষিদ্ধ—কারণ কান্না “ইমোশনাল ডিসরাপশন” তৈরি করে, বলে সরকারের ম্যানুয়াল। আরব বেড়ে উঠতে থাকে গোপনে। নিসর্গা এক বিধ্বস্ত সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নেয়, যার নিচে জলের ধ্বংস আর মাটির গহ্বরে এক পুরনো কলকাতা ঘুমিয়ে আছে। সেখানে কিছু “আন্ডারলিভিং” মানুষ বাস করে—যারা অস্বীকার করেছে জিন-মডিফিকেশন, প্রযুক্তির চরমতা, এবং সব রকমের শরীর-পরিচালিত বিধিনিষেধ। তারা সমাজ থেকে মুছে গেছে। তারা গানের সুরে কথা বলে, আগুন জ্বেলে রাত কাটায়, গল্প বলে শিশুদের।

আরব এসব শুনে বড় হতে থাকে। সে বোঝে, বাইরের দুনিয়ায় সে অবাঞ্ছিত। কারণ তার কোনও জিন কাস্টমাইজ করা হয়নি। সে এক প্রাকৃতিক শিশু—এই সমাজে যা একমাত্র “অপরাধ।” নিসর্গা মাঝে মাঝে তাকে আগুনের পাশে বসিয়ে বলে—“তুই আমার শেষ বিশ্বাস।” আরব কিছু বুঝত না তখন, কিন্তু তার ভিতরে একটা কাঁপন জমত, যেমন জমে আশ্চর্যের ভিতর ভয়। শহরের অন্যপাশে, G-Sculpt কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে, ড. শ্রেয়ন গুহ আরবের ডেটা খুঁজে চলেছেন। সেই জন্মঘটনার শব্দ, যা ড্রোন ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছিল, সেটা নিয়েই তারা পরীক্ষা করছেন। যেহেতু শহরে কোনও প্রাকৃতিক জন্ম হওয়ার কথা নয়, তার মানে—কেউ আইন ভেঙেছে। আর প্রাকৃতিক শিশুর অস্তিত্ব মানে বিপদ। কারণ প্রাকৃতিক শিশু চিন্তা করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে।

আর এই তিন জিনিসই আজকের সমাজে সবচেয়ে বড় অপরাধ। নিসর্গা জানে, একদিন ওরা খুঁজে বের করবে। আরবকে রক্ষা করার জন্য সে রোজ একেকটা প্ল্যান করে, পালানোর রুট কাগজে আঁকে, তার মুখ মনে রাখে যেন ডেটাবেসে কোনও ছবি না যায়। কিন্তু একদিন, রাতে, নিসর্গার চোখের সামনে আরব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে—“মা, আমি কী করে আলাদা?” প্রশ্নটা কাঁপিয়ে দেয় নিসর্গাকে। তার মনে পড়ে যায় নিজের সেই গবেষণাগার, সাদা কোট পরা শ্রেয়নের মুখ, আর সেই মুহূর্ত—যখন সে সিস্টেম থেকে নিজের শরীরের জন্য অনুমোদিত জিন সেট বাদ দিয়ে একটি নিরপেক্ষ কোড ব্যবহার করেছিল। সেই কোডেই জন্ম নিয়েছিল আরব।

“তুই আলাদা, কারণ তুই তৈরি হয়নি, তুই এসেছিস,” নিসর্গা ফিসফিস করে। আরব হেসে বলে—“আমি এসেছি দেখতে তারা কেমন।” তারা মানে সমাজ। কৃত্রিমতা। তার ঠোঁটের কোণে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপ ফুটে ওঠে—যা এই সময়ের কোনও শিশুর মধ্যে দেখা যায় না। আর ঠিক সেই সময়েই দূরে একটা ড্রোন উড়তে থাকে। নিসর্গা জানে, ওরা এসেছে।

পর্ব ২

আরব প্রথমবার স্বপ্ন দেখেছিল সেই রাতে, যখন ড্রোনের শব্দে নিসর্গা চমকে উঠেছিল। ছেলেটির স্বপ্নে ছিল জলভরা এক মাঠ, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ধোঁয়াচ্ছন্ন এক পাথরের মূর্তি—মুখ নেই, গলা নেই, শুধু বুক থেকে বেরিয়ে আসছে গাছের ডাল। সেই ডালের মাথায় বসে আছে এক সাদা পাখি, তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। পাখিটা হঠাৎ ডাকে—”আরব!” আর সেই শব্দেই ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটির। নিসর্গা তখন ব্যাগ গোছাচ্ছে, তার মুখে চেপে আছে উৎকণ্ঠার ছাপ। ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, “আমাকে কেউ ডাকছিল।” নিসর্গা তাকিয়ে থাকল ছেলের চোখে, যেটা সে আগেও লক্ষ করেছে—আলোয় ভরা, ভেতর থেকে জ্বলছে।

“ডাকছিল মানে?”
“স্বপ্নে, মা। কেউ বলছিল আমার নাম।”
“এই শহরে নাম বলে কেউ ডাকে না আর। তাই তুই শুনতে পারিস।”

নিসর্গার চোখে তখন শুধু আতঙ্ক নয়, ছিল ঈর্ষাও। কারণ সে জানত না স্বপ্ন কেমন। তার ছোটবেলাতেই তাকে দেওয়া হয়েছিল ‘Emotion Suppression Serum,’ যাতে কল্পনা বা আবেগ না জন্মায়। তার স্বপ্ন দেখতে শেখার বয়সেই রাষ্ট্র তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তার ছেলে? তার রক্তমাংসে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সেই তো ভোররাতে, ৪টা ৩৬ মিনিটে, ছয়টা ড্রোন ঘিরে ফেলে সাবওয়ে শেল্টার। প্রথমে আসে শব্দ—বাঁশির মতো একটা দীর্ঘ টান, যেটা শোনামাত্র পুরনো মানুষেরা জানে, পালাতে হবে। তারপর আসে আলো, সাদা, চোখ ধাঁধানো, ডেটা-ক্যাপচারিং লাইট। নিসর্গা আর মুহূর্ত না নষ্ট করে আরবের হাত ধরে দৌড়ায়। তার ব্যাকপ্যাকে আছে কিছু কাগজ, একজোড়া ট্রান্সজেনারেটেড মেমোরি চিপ, আর এক পুরনো কম্পাস—যেটা সে একসময় শ্রেয়নের টেবিল থেকে চুরি করেছিল।

তারা দৌড়াতে থাকে ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের ভাঙা পাথরের মধ্য দিয়ে, অন্ধকারে, অথচ নিসর্গার পায়ের ছন্দে ছিল এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা। সে যেন জানে কোনটা বাঁক, কোনটা ফাঁদ। আরব বলল, “ওরা কারা?” নিসর্গা বলল, “ওরা মানুষ না, ওরা কৃত্রিম চেতনার বাহক—G-Guard বাহিনী। ওরা চিনতে পারে গন্ধ, উষ্ণতা, এবং ভয়। আর তোর শরীরে তিনটেই আছে।”

একটা বাঁক পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছায় একটা ঘূর্ণিপথের নিচে। ওখানে এক সময় ট্রেন চলত, এখন শুধু বৃষ্টির জল জমে থাকে। সেখানেই বসে নিসর্গা গভীর শ্বাস নেয়। আরব জিজ্ঞেস করে, “তুমি কেন আমার মতো একটা সন্তান চেয়েছিলে, মা?”

নিসর্গা চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “আমি যখন গবেষণাগারে ছিলাম, তখন একদিন একটা শিশু দেখা এসেছিল, চার বছরের। তাকে তার মা ত্যাগ করেছে, কারণ তার ’empathy gene’ সঠিকভাবে কাজ করছিল না। শিশুটি কাঁদত, জোরে কথা বলত, গল্প বানাত। অথচ সেই সমাজে এগুলো রোগ। তখনই আমি বুঝেছিলাম—আমরা একটা জাতিকে কল্পনাহীন করে দিচ্ছি। আমি জানতাম, আমি যদি মা হই, তাহলে এমন এক সন্তান চাই যে কাঁদবে, হাসবে, গান গাইবে, আর স্বপ্ন দেখবে।”

আরব বলল, “আমি সেই সন্তান।”
“তুই শুধু আমার সন্তান না আরব,” নিসর্গা চোখে জল নিয়ে বলে, “তুই হয়তো গোটা ভবিষ্যতের প্রতীক।”

সেই সময় ড্রোনদের দ্বিতীয় হানা আসে। এইবার সিলিং থেকে ফেলে দেওয়া হয় একটা ন্যানো-ডাস্ট, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে যায় এবং জিন সিগনেচার পড়ে ফেলে। নিসর্গা চেঁচিয়ে ওঠে, “চোখ বন্ধ কর! শ্বাস বন্ধ রাখ!”

কিন্তু আরবের চোখ খুলে থাকে। সে বলে, “ওরা তো শুধু ডেটা খোঁজে। আমি যদি নিজেকে একেবারে শূন্য করি, তাহলে ওরা কিছু খুঁজবে না।”

“কী বলছিস তুই?”

“আমার ভিতর যদি কিছু না থাকে, মা? আমি যদি নিজেই হই এক শূন্যতা?”

এই প্রথম নিসর্গা দেখে, ছেলের শরীর জ্বলে উঠেছে এক অদ্ভুত দীপ্তিতে, যেন তার চামড়ার নিচে অদৃশ্য কোনো রশ্মি প্রবাহিত হচ্ছে। ড্রোনরা কিছুক্ষণ ঘুরে চলে যায়, কিছু না পেয়ে। নিসর্গা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আরব বলে, “আমি চাইলে আমার নিজস্ব তরঙ্গ লুকাতে পারি। আমার ভিতরে আছে কিছু, যেটা এই পৃথিবী বোঝে না।”

তারপর নিসর্গা ব্যাগ থেকে বের করে সেই পুরনো কম্পাসটা। বলল, “তোর বাবার শেষ উপহার। কোথাও একটা আছে এমন একটা জায়গা, যেখানে এখনো প্রকৃত মানুষেরা লুকিয়ে আছে। তোকে ওখানে পৌঁছাতে হবে।”

“তুমি আসবে না?”

“আমার কাজ শেষ, আরব। আমাকে থেকে যেতে হবে এই শহরে, যাতে ওরা বোঝে আমি এখনো তোকে লুকিয়ে রেখেছি। তুই পালা।”

আরব কাঁপছিল। কিন্তু সে মাথা নাড়ে। এরপর সে একা উঠে দাঁড়ায়, চারদিকে ভাঙা সিমেন্ট, অন্ধকার জল, এবং বিদ্যুতের কাঁপুনি। তারপর সে হাঁটতে থাকে সেই কম্পাসের দিকে তাকিয়ে, যার কাঁটা বারবার কাঁপতে কাঁপতে একদিকে তাকিয়ে থাকে—উত্তরে।

আরব জানে না সে কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু জানে—সে যাচ্ছেই।

পর্ব ৩

আরব হাঁটছিল। ভূগর্ভস্থ ট্রানজিট করিডর, কোথাও আলো নেই, কেবল কম্পাসের কাঁটা যেন অদৃশ্যভাবে তাকে টেনে নিচ্ছিল এক অজানা গন্তব্যে। পেছনে পড়ে থাকল তার মা নিসর্গা, পড়ে রইল শিশুকালের গল্প, আগুনের পাশে বসে থাকা গান, কাগজের নৌকা বানিয়ে জলের মধ্যে ভাসানো মুহূর্তগুলো। এখন আরব একা। তার সামনে কেবল ছায়া, গন্ধ, আর ভবিষ্যতের এক রহস্যময় রাস্তা। তার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ধাপে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ—চাকচাক করে যেন ধাতব কিছু ঘষা খাচ্ছে পাথরের সঙ্গে। সে থেমে দাঁড়ায়। মাটির নিচে এই করিডরে কোনো মানুষ থাকার কথা না। সে পাথরের আড়ালে দাঁড়ায়, নিঃশ্বাস আটকে রাখে। আর তখনই সামনে থেকে এগিয়ে আসে একজন, পরনে লম্বা ছেঁড়া চাদর, চোখদুটো ঢাকা একটা কালো পট্টিতে, হাতে একটা ছোট্ট বাতির মতো বস্তু।

“তুই পালিয়ে যাচ্ছিস?”
কণ্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা, কিন্তু তাতে ছিল এক ধরনের অভিজ্ঞতা, যেন হাজার বছর বাঁচা এক আত্মা কথা বলছে।
আরব কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
“ভয় নেই। আমি তোকে চিনি,” মহিলা বলে।

“আপনি কে?”
“আমি… এক সময়কার বিজ্ঞানী ছিলাম, আমার নাম মুছে গেছে ডেটাবেস থেকে। এখন কেউ আমায় ডাকে ‘ছায়ামা’ নামে।”

আরব চমকে যায়। এই নাম সে শুনেছে তার মায়ের কাছে—একবার নিসর্গা বলেছিল, “ছায়ামা ছিল এক সময়ের বিদ্রোহী, যে জিন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তারপর হারিয়ে গিয়েছিল।”

“তুমি জানো না, আরব, এই শহরের নিচে লুকিয়ে আছে আরেকটা পৃথিবী। যেখানে আমরা—ভুলে যাওয়া মানুষরা—বেঁচে আছি। আমরা স্বপ্ন দেখি, ভুল করি, আর বিশ্বাস করি।”

আরব ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। ছায়ামা তার হাত ধরে। “তুই একমাত্র না, আরব,” সে বলে, “এমন আরও একজন আছে।”

“আরও একজন?”
“হ্যাঁ। তোর মতোই, প্রাকৃতিক জন্ম। কিন্তু মেয়েটি অনেক ছোট ছিল যখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন সে কোথায় আছে, কেউ জানে না।”

“তার নাম?”

ছায়ামা একটু থেমে বলে, “সে নিজেকে ডাকে—ইরা।”

এই প্রথম আরব অনুভব করে, সে একা নয়। তার মতোই আরেকটা মন, আরেকটা শরীর এই কৃত্রিম শহরের কোথাও বেঁচে আছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অথবা হয়তো বন্দি হয়ে আছে।

ছায়ামা তাকে নিয়ে চলে এক গোপন শরণার্থী ঘরে। সেখানে আছে কিছু শিশু, যারা ট্রান্সজেনিক হলেও ভুল করে জন্মেছে—তাদের মধ্যে কেউ হাসে বেশি, কেউ প্রশ্ন করে বেশি, কেউ একা থাকতে ভালোবাসে। সমাজ যাদের বলে “ডেভিয়েন্ট,” ছায়ামা তাদের বলে “বেঁচে থাকা মানুষ।”

ছোট একটা মেয়ে এসে আরবকে দেখে বলে, “তোমার চোখে আলো আছে।”
আরব হেসে বলে, “তোমারও তো।”
ছায়ামা পাশে বসে বলে, “আলো থাকবে। কারণ তোর মধ্যে আছে সেই জিন, যেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি—ইচ্ছের জিন। তোরা যা চাইবি, সেটা হতে পারবি। আমরা তো সেটা ভুলে গেছি। এখন সবই পরিকল্পনা আর নিয়ন্ত্রণ।”

রাত গভীর হলে ছায়ামা আরবকে নিয়ে একটা পুরনো সার্ভার রুমে যায়। সেখানে আছে এক পুরনো ল্যাপটপ, যার মধ্যে নাকি আছে “প্রোটোকল হিউম্যান-০” নামে এক গোপন ফাইল—যা প্রমাণ করে, প্রাকৃতিক মানুষেরাই মানবতার শেষ আশা।

ছায়ামা বলে, “এই ফাইলটা যদি G-Sculpt-এর মেইনফ্রেমে আপলোড করা যায়, তাহলে হাজার হাজার কৃত্রিম মানুষ আবার ফিরে পেতে পারে নিজেদের ভাবনার অধিকার।”

“কিন্তু ওটা তো অসম্ভব,” আরব বলে।
“অসম্ভব বলেই তো তুই সম্ভব।”

ছায়ামা তাকে দেয় এক ছোট ডিভাইস, যেটা দিয়ে সার্ভারে হ্যাক করা যায়।
“তুই যেতে পারবি G-Tower-এর ৯৯তম তলায়?”
আরব মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।

তারপর সে বলে, “আমি যাব। কিন্তু ইরাকে খুঁজে পেলে আগে তাকে বাঁচাব।”

ছায়ামা চোখ বুজে হাসে।
“তুই সত্যিই মানুষ। যারা ভালোবাসা দিয়েই বিপ্লব শুরু করে।”

সে আরবকে জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধে চেপে বসে শতাব্দীর ক্লান্তি। তারপর সে বলে, “তোর গন্তব্য এখন রক্তের পথ। কিন্তু তুই যে প্রথম সূর্য দেখবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”

আরব বিদায় নেয়। তার সামনে অন্ধকার শহরের ছায়া, পিছনে পড়ে থাকে গান আর গল্পের মানুষরা।

পর্ব ৪

নিউ কলকাতার হৃদপিণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কালো টাওয়ারটার নাম G-Tower। বিশাল, চকচকে কাচে মোড়া এক শীতল দানব। এর ৯৯ তলায় রয়েছে G-Sculpt কোম্পানির মূল মেইনফ্রেম, যেখানে বিশ্বের সব জিন-ডিজাইন সংরক্ষিত থাকে—প্রতিটি শিশুর জন্মের আগেই, কেমন হবে সে, কী চিন্তা করবে, কত বছর বাঁচবে—সব নির্ধারণ করা থাকে এই ভবনের কোডে। আরব সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল, গায়ে ছেঁড়া শার্ট, কোমরে বেঁধে রাখা ছায়ামার দেওয়া হ্যাক-ডিভাইস। মাথায় গুগল-স্ক্যানার লাগানো, যাতে ড্রোন নজরদারি থেকে চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়।

টাওয়ারের নিচে পা রাখতেই সে অনুভব করল কেমন ঠান্ডা একটা শ্বাস বইছে যেন সারা শহরের মেরুদণ্ড বেয়ে। তার মনে পড়ল ছায়ামার কথা—“জানিস আরব, এই ভবনের একেবারে উপরের ফ্লোরে, দেয়ালে একটা শব্দ খোদাই করা আছে: ‘Perfection is Peace’। ওরা ভাবে তোর মতো ভুলরাই অশান্তি।”

আরব বুঝে গিয়েছিল, এখানেই তার যাত্রার মূল লড়াই শুরু হবে। সে সিকিউরিটি স্ক্যানার এড়িয়ে, সার্ভিস লিফট ধরে উঠতে থাকে। একেকটা ফ্লোর পেরোতেই চোখে পড়ে কাচের ভিতর আটকে রাখা শিশুরা—তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, যেন কোনো প্ল্যান্টের বীজ, সময় হলেই যেন রোবট হয়ে ফুটবে।

লিফট থামে ৯৯ তলায়। দরজা খুলতেই আরব দেখে—এক শূন্য করিডর, যার দুপাশে প্রজেক্টেড প্যানেল ঘুরছে। হঠাৎ সামনে আবির্ভূত হয় এক মুখ—যা সে জীবনে বহুবার ছবি দেখে চিনেছে।

ড. শ্রেয়ন গুহ।
কাচের মতো ঠান্ডা চোখ, মুখে হাসি, পেছনে জিন-মডেলিং স্ক্রিনে ঘুরছে মানুষের স্পাইরাল ডিএনএ।

“স্বাগতম, আরব,” বলে গুহ, “তুই এসেছিস ঠিক সময়েই।”
আরব হতচকিত। সে কোনও শব্দ করেনি।
“আমার ধারণা ঠিক ছিল। তুই ওর ছেলে।”

“কার ছেলে?”

“নিসর্গা সেনের। আমার প্রাক্তন সহকর্মী, প্রাক্তন প্রেমিকা, আর প্রাক্তন বিশ্বাসঘাতক।”

আরব পিছু হটে, হাত স্পর্শ করে কোমরের ডিভাইসে। গুহ বলে, “শান্ত হ, আমি তোকে মারতে আসিনি। বরং, আমি চাই তুই বুঝে নে, তুই আসলে কে।”

“আমি জানি আমি কে। আমি একজন প্রকৃত মানুষ।”

“না,” গুহ বলে, “তুই শুধু মানুষ না। তুই আমার পরিকল্পনার ফাঁদ।”

আরব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়।

“তোর মা ভেবেছিল, সে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম, ও একদিন মা হতে চাইবে। আমি সেটাই চেয়েছিলাম। কারণ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, প্রকৃত জন্মে তৈরি হওয়া শিশুদের জেনেটিক রেসপন্স কেমন হয়। তুই এক্সপেরিমেন্ট নম্বর ১২১—আমার গবেষণার আসল বিষয়।”

আরবের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। “তাহলে আমার জন্মও পরিকল্পনার অংশ?”

“না,” গুহ মুচকি হেসে বলে, “তোর বিকাশ ছিল আশ্চর্যের। কারণ তোকে আমরা কোনো কোডে বাঁধতে পারিনি। তুই নিজের কোড নিজে লিখিস।”

আরব বলল, “আর এখন আমাকে ব্যবহার করে আবার কন্ট্রোল করতে চাও?”

গুহ চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকায়, শহরের আলোয় ঢেকে যাওয়া আকাশ দেখে। “আমি চাই, তুই আপলোড কর সেই ফাইলটা—যেটা তোর কাছে আছে। আমি জানি ছায়ামা তোকে দিয়েছে। ফাইলটা আপলোড হোক, আমি দেখতে চাই যদি এই ডেটা মানুষের ‘ভাবনার স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়, তাহলে কী ঘটে। কিন্তু মনে রাখ—এই ভাবনা মানুষের পক্ষে সহনীয় হবে না। ভয়, ব্যথা, প্রেম, হতাশা—এসব সামলাতে তারা শেখেনি।”

আরব দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। সে জানে, এই মুহূর্তে একটা ক্লিকেই বদলে যেতে পারে সব কিছু। সে ডিভাইসটা বার করে কনসোলে বসায়। গুহ তার দিক থেকে পিছিয়ে আসে, নিঃশব্দে বলে, “আমারও ইচ্ছা ছিল এমন একটি সন্তান হোক, যে নিজের পথ নিজে বেছে নেবে। তুই সেই সন্তান।”

আরব থমকে যায়। “তুমি বলতে চাইছো…?”

গুহ চোখ বন্ধ করে বলে, “হ্যাঁ, আমি তোর জৈবিক পিতা।”

ঘরের বাতাস থেমে যায় যেন। এক মুহূর্তে আরব অনুভব করে—তার রক্তে চলছে এক বিজ্ঞানীর নিষ্ঠুরতা, তার মাংসে আছে এক বিদ্রোহীর বিশ্বাস।

সে ডিভাইসটা সক্রিয় করে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ফাইল ট্রান্সফারের বার্তা: “Uploading: Protocol Human-0…”

গুহ ধীরে ধীরে কাঁচের জানালার দিকে হাঁটে। বলে, “তুই এখন যা করবি, তার ফল তোকে বইতে হবে। আমি না থাকলেও।”

আরব মাথা নিচু করে বলে, “আমি শুধু চাই… যারা বেঁচে আছে, তারা যেন সত্যিকারের বেঁচে থাকে।”

“তাহলে কর। ক্লিক কর।”

আরব ক্লিক করে। পর্দায় ভেসে ওঠে:
Upload Successful. Broadcasting to Central Genome Grid…

টাওয়ার কেঁপে ওঠে। নিচে হাজার হাজার ট্রান্সজেনিক শিশু কেঁদে ওঠে একসাথে, প্রথমবারের মতো তাদের চোখে অশ্রু নামে।

আরব জানে, পৃথিবী বদলে গেছে।

পর্ব ৫

G-Tower থেকে বেরিয়ে এসে আরব দেখে শহরটা আর আগের মতো নেই। বাতাসে একধরনের অজানা কম্পন, চোখে পড়ে কাচের দেয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো—যাদের মুখ আগে ছিল নিঃসাড়, এখন সেখানে উদ্বেগ, বিস্ময়, এমনকি হালকা হাসির রেখাও দেখা যাচ্ছে। এক বৃদ্ধা রাস্তায় বসে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে—যেটা এক সময় এলইডি স্ক্রিনে ভরা ছিল, এখন সেই স্ক্রিনে শুধুই ত্রুটি দেখাচ্ছে। একজন তরুণ হাঁটু গেড়ে বসে, তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদছে। এই শহরে আর কেউ কাঁদত না।

আরব জানে, এ হলো চেতনার জ্বর—এক ধরনের মানসিক ভূমিকম্প, যা শুরু হয়েছে ‘প্রোটোকল হিউম্যান-০’ আপলোড হবার পর। বহু বছর ধরে যে মানুষগুলো অনুভব করত না, এখন তাদের ভিতরে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে সব আবেগ, সব স্বপ্ন, সব ভয়। G-Sculpt কোম্পানির সমস্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। জেনেটিক কনসোলের নির্দেশ আর কাজ করছে না। আরব রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায়, কিছু মানুষ হঠাৎ গান গাইছে, কেউ কেউ আঁকছে, কেউ অজানা ভাষায় কথা বলছে—একটি বিস্ফোরিত মনের ভাষা।

কিন্তু সে থামে না। কারণ তার এখন একটিই লক্ষ্য—ইরাকে খুঁজে পাওয়া।

ছায়ামা বলেছিল, ইরা ছিল আরবের মতোই প্রাকৃতিক শিশু। কিন্তু তাকে বহু আগেই ধরে নিয়ে যায় ‘Re-Assimilation Program’-এর জন্য। এই প্রোগ্রাম এমন শিশুদের ব্রেন রিসেট করে আবার নতুন ডিজাইনে রূপান্তরিত করত। আরব জানে, ইরা যদি এখনো বেঁচে থাকে, তাহলে হয়তো তার স্মৃতি আর নিজের থাকবে না। হয়তো সে এখন এক অন্য মানুষ।

আরব তার পকেট থেকে বের করে একটা ছোট ম্যাপ, যেটা ছায়ামা দিয়েছিল—মারাত্মক সুরক্ষিত একটি ডেটা-হাবের অবস্থান দেখিয়ে। সেখানেই হয়তো বন্দি রাখা হয়েছে সেই শিশুদের, যাদের স্মৃতিগুলি ফরম্যাট করা হয়েছিল।

তিন ঘন্টা হেঁটে সে পৌঁছায় এক বিরাট ধাতব গম্বুজের কাছে—ভিতরে ঢোকার কোনো দরজা নেই, কেবল বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং-এ প্রবেশাধিকার। কিন্তু এখন যখন প্রোটোকল আপলোড হয়ে গেছে, সমস্ত সিকিউরিটি ফাংশন বিঘ্নিত।

আরব দেয়ালে হাত রাখতেই ধাতব প্যানেল কাঁপে, এবং একটা সরু ফাঁক খুলে যায়। ভিতরে প্রবেশ করে সে দেখে এক অস্পষ্ট আলোয় ভেসে থাকা চেম্বার—যেখানে শিশুরা ঘুমিয়ে আছে, অ্যানিমেশন ফ্লুইডে ভাসমান, শরীরে নানা সেন্সর লাগানো। প্রতিটি শিশুর মাথার উপর ভেসে আছে নামের বদলে একটি সংখ্যা।

হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটাতে লেখা—”Subject: I-09″।

সে কাছে এগিয়ে যায়। গ্লাসের ভিতরে মুখ, এত শান্ত, এত নরম, যেন একটা নদী ঘুমিয়ে আছে। চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখদুটি বন্ধ, কিন্তু ঠোঁটে একটুকরো বিদ্রুপ লেগে আছে—যা তাকে বলে, সে এখনো পুরোপুরি রিসেট হয়নি।

“ইরা,” ফিসফিস করে ডাকে আরব।

তারপর সে ব্যাগ থেকে ডিভাইসটা বের করে, যা দিয়ে মস্তিষ্কের ফ্রিকোয়েন্সি রিস্টোর করা যায়। ছায়ামা তাকে বলেছিল, যদি ডেটা পুরোপুরি ডিলিট না হয়, তাহলে এই যন্ত্রের মাধ্যমে স্মৃতি ফেরানো সম্ভব।

আরব ইরার গ্লাস চেম্বারে যন্ত্রটি সংযুক্ত করে। ফ্লুইডে থাকা ডেটা ধীরে ধীরে প্রসেস হয়। স্ক্রিনে আসে—“Partial memory fragments detected…”

আর তখনই ইরার চোখ ধীরে ধীরে খোলে।

প্রথমে যেন কিছুই বোঝে না সে। তারপর তার ঠোঁট নড়ে। খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করে, “আ…রব?”

আরব স্তব্ধ হয়ে যায়।
“তুমি আমাকে চিনতে পারো?”

“আমি জানি না… কিন্তু এই নাম আমি স্বপ্নে শুনেছি…”

এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ইরার চোখ থেকে। আর তখনই ঘরে বেজে ওঠে অ্যালার্ম—ডেটা হাবের সেন্ট্রাল সিস্টেম এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়নি।

আরব ইরার চেম্বার খুলে ফেলে। ভেতর থেকে সে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে। শরীর দুর্বল, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলছে।

“তুমি কে?”

“আমি তোমার মতো,” আরব বলে, “আমরা দুইটা ভুল, যাদের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের মতো হবার জন্য।”

“ভুল বলছ না,” ইরা বলে, “আমরা হলাম সেই দু’জন, যাদের আর বাকি কেউ বোঝে না।”

তারা একে অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে তখন শুরু হয়েছে “মনের বৃষ্টি”—লোকেরা কাঁদছে, হাসছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে, ভুল করছে, মাফ চাইছে।

আরব জানে, এই শহরকে এখন আর কেউ ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
মানুষ এখন আবার মানুষ হয়ে উঠছে।

আর সে ও ইরা?
তারা এখন খুঁজবে—একটা এমন জায়গা, যেখানে আর কোনও কোড নয়, শুধু নিজেদের মতো করে বাঁচা যাবে।

তাদের চোখে ছিল এক অদ্ভুত স্থিরতা—যা হয়তো সভ্যতার সমস্ত ভুলের ভিতর জন্ম নেয়।

পর্ব ৬

নিউ কলকাতা শহরের সীমান্ত ছাড়িয়ে যখন আরব আর ইরা একটা পুরনো বগিভাঙা ট্রেনে চড়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন আকাশটা ছিল সাদা কুয়াশায় ঢাকা। তারা জানে না কোথায় যাচ্ছে, জানে না সামনে কে আছে—তাদের জানা আছে শুধু একটা সত্য: এই শহরের কোড ভেঙে গেছে। এখন বাকি বিশ্বে কি চলছে, কেউ জানে না। তাদের লক্ষ্য ছিল “নিও-মেঘবন”—একটি গোপন বনাঞ্চল, যা একসময় শহরের জেনেটিক পরীক্ষার জায়গা ছিল, এখন সরকারি ম্যাপে নিষিদ্ধ অঞ্চল।

এই বন ছিল প্রকৃতির শেষ ভাঁজ, যেখানে কোনো জিন মডিফিকেশন নেই, কোনো ডেটা সার্ভার নেই, কেবল গাছপালা, বন্যতা, আর ভুলে যাওয়া পৃথিবীর শব্দ। ট্রেন থেমে যায় এক লোহার ব্রিজের ধারে, তারপর শুরু হয় হেঁটে চলা।

ইরার শরীর এখনো দুর্বল, কিন্তু তার চোখ ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হচ্ছে। মাঝে মাঝে সে থেমে কিছু গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখে, যেন চেনা চেনা লাগে।

“তুমি এখানে এসেছ আগে?” আরব জিজ্ঞেস করে।

“স্বপ্নে,” ইরা বলে। “একটা পাথরের ওপর আমি বসে থাকতাম, একটা ডালপালার নিচে, আর পাখিরা গান গাইত।”

“তুমি স্বপ্নে শুনতে?”

“আমরা সবাই শুনি, আরব। শুধু কেউ মনে রাখে, কেউ ভুলে যায়।”

তারা হেঁটে হেঁটে পৌঁছায় এক জায়গায়, যেখানে গাছগুলো অসম্ভব উঁচু, মাটি যেন দম নেয়, আর আকাশের ফাঁক দিয়ে সূর্য ছিটকে পড়ে। আর ঠিক সেই জায়গায় হঠাৎ চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে লোক।

গায়ে ছাল পেঁচানো পোশাক, হাতে স্পিয়ার-জাতীয় অস্ত্র, মুখ ঢাকা মাটি-মাখানো কাপড়ে।

“তোমরা কে?” ইরা চিৎকার করে।

একজন সামনে আসে, গলা মোটা, চোখে অবিশ্বাস—
“মানুষ? না কোড?”

আরব বলে, “আমরা প্রকৃত মানুষ। প্রাকৃতিক জন্ম। কোডে তৈরি না।”

লোকটা তাকায়, যেন যাচাই করছে। তারপর বলে, “তোমরা ঢুকতে পারো। কিন্তু প্রশ্ন জবাব শেষ না হলে তোমাদের থাকতে দেওয়া হবে না।”

তারা নিয়ে যায় আরব ও ইরাকে একটি কুড়েঘরের মতো জায়গায়—যেখানে আগুন জ্বলছে, কিছু মানুষ বসে আছে, তাদের চোখে ক্লান্তি, গলায় গান।

এক বৃদ্ধা সামনে এসে বসে, বলে, “আমি রাশ্মি। এই বনভূমির রক্ষক।”

আরব সব খুলে বলে—G-Tower, প্রোটোকল আপলোড, শহরের পরিবর্তন, ইরার পুনর্জাগরণ। রাশ্মির মুখে একটুও বিস্ময় নেই।

“আমরা জানতাম, একদিন কোনো এক ছেলে বা মেয়ে আসবে, যার মধ্যে থাকবে মানুষের সবটুকু। তোমাদের দেখা পেয়ে মনে হচ্ছে—সেই সময় এসেছে।”

কিন্তু বনের ভিতর সবাই এমন নয়। কিছু তরুণ আছে যারা পরিবর্তন চায় না। তারা বলে, “এই ছেলেমেয়েরা শহরের। ওরা আসল বিপদ। ওদের জন্যই আগুন আসবে।”

তারা চায় আরব ও ইরাকে বন থেকে বের করে দেওয়া হোক। তারা ভয় পায়, এই দুজনের কারণে শহরের ড্রোন বা সৈন্যরা বন পর্যন্ত এসে যাবে।

আরব বুঝতে পারে, যেখানে সে মুক্তি খুঁজে এসেছে, সেখানেও ভয় আছে।

এক রাতে সে আর ইরা বসে ছিল বনভূমির এক পাহাড়ি ধাপে। নীচে আগুন জ্বলছে, পাখি ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে।

ইরা বলে, “তুমি জানো, আমরা বাঁচতে এসেছি, কিন্তু মানুষ কেবল বাঁচে না। মানুষ স্বপ্ন দেখে, ভুল করে, ক্ষমা চায়, লড়াই করে।”

আরব বলে, “তাহলে আমরা কী করব?”

“আমরা গল্প বলব।”

“গল্প?”

“হ্যাঁ। যা মানুষের ভেতরকে জাগায়। তাদের মনে করিয়ে দেয় তারাও একদিন ভালোবাসত, কাঁদত, মরে যেতে ভয় পেত। গল্পই বাঁচিয়ে রাখে সভ্যতা।”

আর তখনই দূর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ আসে। বনভূমির একদিকে আগুন। কেউ একটা আগুন ধরিয়েছে, যাতে বনের লোকেরা ভয় পেয়ে আরব ও ইরাকে বের করে দেয়।

রাশ্মি দৌড়ে আসে। বলে, “কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। তোমাদের এখনই পালাতে হবে।”

“না,” আরব বলে। “আমরা পালাব না। এই আগুন আমরা নেভাব। কারণ এটাই প্রমাণ করবে—আমরা মানুষ।”

আরব আর ইরা এগিয়ে যায় আগুনের দিকে, হাতে জল, ভেজা কাপড়, আর গলায় গান।

গান?

ইরা শুরু করে গুনগুন করতে—একটা ছড়া, তার ছোটবেলার, যেটা হয়তো তার স্মৃতির বাইরে ছিল, এখন ফিরে এসেছে।

আর গানের মধ্যে লোকেরা এগিয়ে আসে। তারা জল ছিটিয়ে দেয়, গাছ বাঁচায়।

এক কিশোর ছুটে এসে বলে, “তোমরা সত্যিই মানুষ।”

সেই রাতে আগুন নেভে। বাঁচে বন, বাঁচে ভরসা।

আরব বুঝে যায়—মানুষের ইতিহাস শুধু প্রযুক্তি নয়, ক্ষমতা নয়, বরং গল্প, গান, স্বপ্ন, আর সাহস।

পর্ব ৭

নিও-মেঘবনের আগুন নিভে গেছে, কিন্তু বাতাসে এখনো জ্বলন্ত পাতার গন্ধ। আগুন শুধু পুড়িয়ে দেয়নি গাছ; পুড়িয়ে দিয়েছে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব, আর বহুদিনের জমে থাকা ভয়। আরব আর ইরা সেই রাতে অনেকটা সময় বসে ছিল গাছতলায়, জোছনার নিচে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু দু’জনেই জানত—কিছু একটা বদলে গেছে।

পরদিন সকালে, রাশ্মি ডাকে তাদের। চুলে ছাই লেগে আছে এখনো, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু কণ্ঠে যেন নতুন শক্তি।

“আমরা সভা ডেকেছি,” সে বলে। “তোমরা সেখানে আসবে। এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

আরব আর ইরা চুপচাপ হেঁটে যায় বনভূমির মাঝে ছোট্ট এক গোল দালানের ভেতরে—পুরোনো সময়ের সভাঘর, যেখানে কোনো মাইক নেই, স্ক্রিন নেই, কেবল মুখোমুখি চোখ, আর কণ্ঠস্বরের কম্পন।

প্রথমে উঠে দাঁড়ায় এক তরুণ, চোখে আগুন—সে আগুন লাগানোর মূল চক্রান্তকারী ছিল।

“আমি ভয় পেয়েছিলাম,” সে বলে। “আমার মনে হয়েছিল, ওরা আমাদের ধ্বংস করবে। কিন্তু এখন বুঝছি, ওরা আসলে আমাদের মনে করিয়ে দিতে এসেছে আমরা কে।”

তারপর একজন বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ায়—“আমরা গাছের সঙ্গে কথা বলি, নদীর সঙ্গে কথা বলি। আজ অনেকদিন পর মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। এই ছেলেমেয়েরা যেন সেই নদী, যা আমাদের শুকনো শরীরকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।”

রাশ্মি একটানা তাকিয়ে থাকে আরবের দিকে, তারপর বলে, “আমরা বেঁচে থাকব। কিন্তু শুধু নিজের মতো থাকলে চলবে না। এখন গোটা মানবজাতি প্রশ্ন করছে—আমরা কারা? আর সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে তোদের ফিরতে হবে শহরে।”

“ফিরে যেতে?” ইরা ফিসফিস করে।

“হ্যাঁ,” রাশ্মি বলে, “তুই আর আরবই এখন সেই দুই আলো, যা মানুষকে দেখাবে কিভাবে আবার মানুষ হওয়া যায়।”

আরব মাথা নিচু করে থাকে। সে জানে, শহর তাকে এখন দেবতার মতো দেখছে—কিন্তু দেবতা মানেই মানুষ নয়।

রাশ্মি একটা ছোট থলে এগিয়ে দেয়।
“এটা একটা বীজ। আমাদের পুরনো বৃক্ষের শেষ বংশধর। এটা নিয়ে যা, শহরের ভিতর পুঁতে দিস।”

“কিন্তু শহরে তো মাটি নেই,” আরব বলে।

“তোর মতোই,” রাশ্মি হেসে বলে। “তুইও তো মাটি ছাড়া জন্মেছিস। কিন্তু এখন তুইই তো শেকড়।”

ইরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে বলে, “তাহলে আমরা যাচ্ছি। কিন্তু শুধু বার্তা নিয়ে নয়, গান নিয়ে।”

গোল সভা ঘরে সেই প্রথম গান শোনা যায়—ইরার গলায় এক পুরনো আদিবাসী সুর, যেটা হয়তো তার পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্কের কোষে কোথাও লুকিয়ে ছিল। মানুষ চোখ বুজে শোনে। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে।

তারপর শুরু হয় যাত্রা। আরব ও ইরা আবার পথে নামে, সঙ্গে রাশ্মির দেওয়া বীজ, আর ইরার গলায় সেই সুর।

নিউ কলকাতা শহরে তারা যখন ফিরে আসে, সময় পেরিয়েছে মাত্র কুড়ি দিন। কিন্তু শহরের মুখটা পাল্টে গেছে।

G-Tower এখনো দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার কাচ ভাঙা, ভেতরের ল্যাবগুলোতে কেউ নেই। রাস্তায় লোকজন বসে—কেউ গান গাইছে, কেউ একে অপরের চোখে তাকিয়ে কথা বলছে।

তারা বুঝতে পারে, মানবতা বাঁচতে চায়, কিন্তু দিশাহীন।

আর তখনই আরব ও ইরা দাঁড়িয়ে যায় শহরের মাঝখানে, সেই পুরোনো চত্বরে, যেখানে একসময় “পারফেকশন ইজ পিস” লেখা ছিল।

আরব ব্যাগ থেকে বের করে রাশ্মির দেওয়া বীজটা। পাথরের ওপর একটা ফাটল খুঁজে নেয়। মাটি তো নেই, কিন্তু সে নিজের হাতে জল ঢালে, চারপাশ থেকে শহরের মানুষ এসে দাঁড়িয়ে দেখে।

ইরা বলে, “এই বীজের নাম হবে বিশ্বাস।”

একজন বলে, “এতে তো কিছুই জন্মাবে না!”

আরব হেসে বলে, “মানুষও তো মাটিতে জন্মায় না, তবু সে প্রেম করে।”

চারদিক থেকে মানুষ হাততালি দেয় না। তারা দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। কিন্তু সেই নিঃশব্দে থাকে ইতিহাস।

সেই রাতে শহরের লোকেরা একে একে নিজের পুরোনো নামগুলো বলে—যেটা তাদের ডেটা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল।

“আমি অর্ণব, একদিন ছবি আঁকতাম।”
“আমি রেহানা, আমি বাবার হাত ধরে ঈদের মেলায় যেতাম।”
“আমি যীশু, আমি দাদুর মুখের গল্প শুনে কেঁদেছিলাম।”

এভাবেই শুরু হয় মানুষের পুনর্জন্ম।

আরব ও ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তারা জানে না এরপর কী হবে।
শুধু জানে—তারা ফিরে এসেছে, কিন্তু এইবার কেউ তাদের ফিরিয়ে দেবে না।

তারা মাটি নয়, তারা বীজ।
মানুষ নয়, মানুষের শুরু।

পর্ব ৮

পাথরের ফাটলে সেই বীজ পোঁতা হয়েছিল নির্জনে, অথচ তার ঘূর্ণি ছিল মহাজাগতিক। কয়েকটা দিন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কেবল একটা সামান্য ফাটল, একটু জল, আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক-যুবতী—যারা নিজেদের জন্মেই সন্দিহান ছিল একদিন। শহরের লোকেরা প্রতিদিন আসে, কেউ ছবি তোলে, কেউ মোমবাতি রাখে, কেউ বসে গান গায়। কেউ কেউ বলে, “এটা প্রতীক, কিছুই হবে না।” আবার কারও কণ্ঠে শোনা যায়—“তবে আমরা দেখতে চাই।”

সপ্তম দিন ভোরবেলা, প্রথম পাতাটা জন্ম নেয়। ছোট্ট সবুজ, নিঃশব্দে মাথা তোলে শহরের কংক্রিট বুক চিরে। কেউ দেখে না সেটা জন্মের মুহূর্তে, শুধু সকালের বাতাসে ভেসে আসে অন্যরকম একটা গন্ধ—মাটির, শিশিরের, আর সম্ভবত ইতিহাসের।

ইরা প্রথম দেখে পাতাটা। সে কিছু বলে না, শুধু ধীরে ধীরে মাটি ছুঁয়ে মাথা নোয়ায়। আরব তখনো ঘুমিয়ে, পাশের ফুটপাথে। ইরা তাকে ডাকে না। কিছু মুহূর্ত হয় কেবল দেখার, ভাগ করে নেওয়ার নয়।

সকাল বাড়তেই শহরে ছড়িয়ে পড়ে খবর—“গাছ গজিয়েছে পাথরে!”
প্রথমে আসে একদল শিশু, তারপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তারপর সেই মধ্যবিত্ত মানুষগুলো যারা এক সময় নাম ভুলে গিয়েছিল। সবাই এসে দাঁড়ায় এক অদ্ভুত নীরবতায়।
তারা চিৎকার করে না, জয়ধ্বনি দেয় না, কারণ বোঝে—এটা শুধু এক পাতার জন্ম নয়, এটা এক হারিয়ে যাওয়া আত্মার ফিরে আসা।

G-Tower-এর এক প্রাক্তন জিন-ডিজাইনার এসে বলে, “আমি এত বছর ধরে কোড লিখেছি, কিন্তু এই পাতা যে কোডে লেখা তা আমি জানি না।”
এক প্রাক্তন সেনা এসে বলে, “আমরা একসময় শরীর রক্ষা করতাম, এখন দেখি মাটি রক্ষা করছে আমাদের।”
এক তরুণী বলে, “আমি ছোটবেলায় একটা গাছ আঁকতাম, যেটা কোনোদিন দেখিনি। আজ বুঝছি, আমি সেই গাছেরই অপেক্ষায় ছিলাম।”

শহরে একধরনের উৎসব শুরু হয়। কেউ কেউ বলে, “এইদিনটাকেই বলি না কেন নবমানবতা দিবস?”
কেউ গান গায়, কেউ ছড়া লেখে, কেউ দেয়াল লিখনে লেখে—“আমরা ভুল ছিলাম। কিন্তু ভুল থেকেই জন্ম নেয় সত্য।”

আরব ও ইরাকে বলা হয়, “তোমরা বক্তৃতা দাও।”
তারা দাঁড়িয়ে যায় পাথরের পাশে, ছোট্ট পাতাটার সামনে, যেন সেই পাতাই মঞ্চ।

আরব বলে, “আমি তোমাদের মতোই, একসময় বুঝতাম না আমি কে। আমার জন্ম হয়েছিল এক পালানো বিজ্ঞানীর শরীরে, আর এক নিষ্ঠুর বিজ্ঞানীর ইচ্ছেতে। কিন্তু আমি মানুষ হয়েছি, কারণ আমি ভয় পেয়েছি, কেঁদেছি, ভালোবেসেছি।”

ইরা বলে, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি কে। কিন্তু এক নাম—‘আরব’—আমার ভেতর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল স্মৃতি। আজ এই গাছ আমাদের কথা বলছে। যদি তার কোনও ভাষা থাকে, তবে তা আমাদের মতো—ভুল, অস্থির, কিন্তু জীবন্ত।”

তাদের কথা শেষ হতেই জনতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই নীরবতাই সম্মতি, এই নীরবতাই ভবিষ্যৎ।

রাতের শহর আলোকিত হয়ে ওঠে কোনও বিদ্যুৎ দিয়ে নয়, মানুষের চোখের জ্যোতিতে। মোমবাতি জ্বলে, বাচ্চারা চক দিয়ে রাস্তা আঁকে, যেখানে গাছের চারপাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ, পশু, আর পাখি।

আরব ও ইরা ফিরে যায় সেই জায়গায়, যেখানে একসময় বসত G-Sculpt-এর কমান্ড সেন্টার। এখন সেটার ধ্বংসস্তূপের ভেতর তারা খুঁজে বের করে কিছু পুরনো জিন-মডিউল, ভাঙা স্ক্রিন, আর ফেলে রাখা নোট।
আরব একটা ভাঙা চিপ তুলে নেয়, বলে, “আমরা এগুলো দিয়ে কী করব?”

ইরা হেসে বলে, “আমরা এগুলো দিয়ে খেলব। যে যেমন খুশি সাজাবে। কোনও প্ল্যান নেই, কোনও আদর্শ নেই। শুধু খেলা।”
তারা মাটি খুঁড়ে এসব বসিয়ে দেয় ছোট ছোট ফর্মে—শিশুদের খেলার স্টেশন বানায়, যেখানে তারা নিজের মতো করে ভাবতে পারবে।

এভাবেই গড়ে ওঠে “স্মৃতি বাগান”—একটা পার্ক যেখানে বসে কেউ নিজেকে খুঁজে পেতে পারে।
একটা দেয়ালে লেখা থাকে—“নিজেকে বানাও, কিন্তু ভালোবেসে।”

সময়ের হিসাব চলে না তখন আর। দিন গড়িয়ে যায়, গাছ বড় হয়, আরব ও ইরা কখনো সামনে, কখনো আড়ালে—তারা নেতা নয়, মূর্তি নয়, কেবল দুটো হৃদয় যারা সাহস করেছিল ভুল হতে।

শেষ দৃশ্যটায়, এক শিশুকে দেখা যায়, সে বসে আছে সেই পাতার নিচে। তার হাতে একটা পুরনো বই, নামহীন। সে বলে, “এই পাতার নাম কী?”

পাশে বসা বৃদ্ধ বলে, “এই পাতার নাম তুইই রাখিস। তোর ইচ্ছেমতো।”

শিশু ভাবে, তারপর বলে, “এই পাতার নাম রাখি… মানুষ।”

শহরজুড়ে বাতাস বয়ে যায়। আর কোথাও লেখা থাকে না—“Perfection is Peace”।
সেখানে এখন লেখা—“Imagination is Survival.”

শেষ

 

1000025006.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *