Bangla - ভূতের গল্প

জিজি পোলার ডাক

Spread the love

অমিতাভ ধর


 অধ্যায় : কুয়াশার পথ

রাত দশটা বাজে। রাহুল গাড়ির জানালার কাচ খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হিমেল হাওয়া গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। গাড়ি উঠছে পাহাড় বেয়ে—চুনাভাট্টি, দার্জিলিং-এর এক বিস্মৃত পাহাড়ি গ্রাম, যেটা এখনো পর্যটনের খাতে উঠে আসেনি।

পাশে বসা অর্ণব, হাত গুটিয়ে মোবাইলে পাহাড়ি মানচিত্র ঘাঁটছে।
— “এটা নিশ্চয়ই শেষ মোড়,” বলে নয়না, জানালার কুয়াশা মোছার চেষ্টা করতে করতে।
— “নিশ্চয়ই?” হেসে ওঠে ঋদ্ধি, “অবশ্যই না! এখনো এক ঘণ্টা বাকি।”
— “এই ট্রিপটা তুই কেন ঠিক করলি ঋদ্ধি?” প্রশ্ন করে রাহুল।
ঋদ্ধি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “ঠাকুমার ডায়েরিতে এই গ্রামের কথা ছিল। ছোটবেলায় অনেকবার শুনেছি… কিন্তু এবার দেখতে এলাম।”

গাড়ির ড্রাইভার—একজন চুপচাপ পাহাড়ি মানুষ—একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে,
— “আপনারা ওই ঘরে থাকবেন না তো?”
— “কোন ঘর?”
— “ওই… নিচে কাঠের সেতুর পাশে পুরনো স্কুলঘরটায়। যেখানে একসময় বাচ্চারা পড়ত। এখন ফাঁকা পড়ে আছে।”
— “ঠিক ওটাই তো বুক করেছি!” আনন্দে বলে নয়না।

ড্রাইভার তখন আর কিছু না বলে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চুপচাপ গাড়ি চালায়।

ঘরটা দেখতে সাদা রঙের, তিন দিকে কুয়াশায় ঘেরা। একপাশে বাঁশঝাড়, আর এক পাশে জঙ্গলের ঢাল। ঘরের পেছনে কাঠের সাঁকো পেরিয়ে একটা পুরনো জলধারা—ঝরনার রিনরিন শব্দ যেন কানে ভাসে।

ভেতরে ঢুকতেই ঠাণ্ডা গায়ে লাগে। ঘরের এক কোণে লাল রঙের কাঠের আলমারি, ধুলো জমে আছে। দেয়ালে একটা ফ্রেম—ছবিটা ঝাপসা, কিন্তু বোঝা যায়, এক বাচ্চা মেয়ের মুখ। চোখে মায়া, ঠোঁটে হাসি।

— “এত ভয়াবহ ছবি কে টাঙায় ঘরে?” হেসে বলে অর্ণব।
— “এটা জিজি…” ফিসফিস করে ঋদ্ধি।

— “জিজি কে?”
— “একটা গল্প আছে। ঠাকুমা বলত, এই এলাকায় এক মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল জিজি। খুব স্নেহপ্রবণ, পাহাড়ের ফুল পছন্দ করত, আর নিজের ছোট ভাইকে ‘পোলা’ বলে ডাকত। একদিন সে হারিয়ে যায় জঙ্গলে। তারপর তার গলা কাটা দেহ মেলে এখানেই, এই স্কুলঘরের কাছে।”

নয়না তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বলে—
— “তোমরা শুনলে? কেউ কি ডাকছিল?”
— “না তো…” বলে রাহুল, “কোনো জানোয়ারের আওয়াজ হবে।”
— “না, আমি শুনলাম… খুব আস্তে করে কেউ বলল, জিজি… পোলা জিজি…’

ঘরটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
অর্ণব বলে, “তুই হয়তো কল্পনা করছিস। পাহাড়ে এরকম হয়।”
কিন্তু নয়নার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক।

রাত বাড়ে। চারজনে নিজেদের স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ে। বাইরে ঝরনার শব্দ, মাঝে মাঝে রাতের পাখির ডাক। রাহুল জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখে—একটা সাদা ছায়ামূর্তি দূরের ঝোপ থেকে চলে গেল।

সে চোখ কচলাতে থাকে, নিজেকেই বোঝায়—ঘুম আসছে, হ্যালুসিনেশন।

কিন্তু তারপর?
জানালার পাশে কে যেন খুব ধীরে ধীরে বলে উঠল—
পোলা… জিজি পোলা…”

অধ্যায় : বাঁশবনের ফাঁকে

ভোরের আলো পুরোপুরি না ফোটায় বাইরের জঙ্গল কুয়াশায় ঢেকে আছে। রাহুল ঘুম ভেঙে উঠে দেখে জানালার পাশে নয়না নেই। ঘরের দরজাটা একটু খোলা, আর ঠাণ্ডা বাতাস ভেতরে ঢুকছে।

সে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে বেরোয়।

বাইরে এসে দেখে, নয়না বাঁশবনের দিকে হাঁটছে। সাদা কুয়াশার মধ্যে তাকে দেখা যাচ্ছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
— “নয়না! কোথায় যাচ্ছিস?” রাহুল চিৎকার করে ডাকে।

কোনো উত্তর নেই।

সে জুতো পরে দৌড়ে যায় বাঁশবনের দিকে।

বাঁশের পাতাগুলো থেকে শিশির পড়ে শব্দ করছে। জঙ্গলটা যেন গিলে নিচ্ছে সব শব্দ। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে রাহুল যখন পৌঁছোয়, দেখে নয়না একটা পাথরের ওপর বসে আছে। চোখ স্থির, গলায় গামছা জড়ানো।

— “তুই এখানে কেন?”

নয়না ধীরে ধীরে বলে,
— “সে আমাকে ডেকেছে।”

— “কে?”

— “একটা মেয়ে। খুব মায়াবী গলা। আমাকে বলল, পোলা কই? তুই কি পোলা? আমি কিছু বলতে পারিনি।”

— “তুই নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিস।”

নয়না মাথা নাড়ে।
— “না রাহুল। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম না। কেউ আমার হাত ছুঁয়ে ছিল। ঠাণ্ডা, বরফের মতো। আর তার মুখ দেখা যায়নি, শুধু একটা সাদা শাড়ি…”

অর্ণব আর ঋদ্ধিও এসে পৌঁছেছে। সবাই একসাথে ঘরে ফেরে। কিন্তু সকালটা আর স্বাভাবিক থাকে না।

বৃদ্ধা কামলা এসে হাজির হন। এক হাতে লাঠি, পরনে নীল কাঁথা। মুখে গাঢ় ভাঁজ। তিনি এসে প্রথমেই বলেন,
— “তোমরা জিজির স্কুলঘরে থেকেছো?”

— “হ্যাঁ… কিন্তু আপনি জানেন এই জিজি কে ছিল?”

বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করে বলেন,
— “জানি। আমার বয়স তখন আট। জিজি ছিল এক পাহাড়ি মেয়ে, কিন্তু ভয়ানক সুন্দরী। ওর ভাই ছিল ছোট, অন্ধ। ও তাকে পোলা বলেই ডাকত। একদিন জিজি হঠাৎ নিখোঁজ হয়। কয়েকদিন পর দেখা যায়, ওর কাটা গলা ঝুলছে ওই বাঁশবনের শেষ বটগাছে।”

— “কেন মেরেছিল কেউ?” ঋদ্ধির কণ্ঠ কেঁপে ওঠে।

— “লোকে বলে জমিদারের লোকেরা মেরে ফেলেছিল। কারণ জিজিকে তারা ভালোবাসত, কিন্তু সে রাজি হয়নি। তারা বিশ্বাস করত, ও ঝাড়ফুঁকের মেয়ে, পাহাড়ে আত্মা ডাকে।”

— “এবং এখন?”

বৃদ্ধা চুপচাপ কাঁদতে থাকেন।
— “জিজি ফিরে আসে। প্রতিটা শীতে, যখন হাওয়া জমে, কুয়াশা নামে পাহাড়ে, তখন সে কাউকে খুঁজতে থাকে। সে ভাবে তার ভাই এখনও বেঁচে আছে। ডাকতে থাকে—পোলা… জিজি পোলা…

দিনভর কেউ তেমন কিছু বলে না। সবাই যেন আলগোছে ভাবছে, সত্যিই কি এসব সম্ভব?

রাত আসে আবার ঠাণ্ডা হাওয়ার গায়ে ভর করে। কুয়াশা ঘন হয়, যেন আকাশ থেকে কেউ পাহাড়ে সাদা চাদর নামিয়ে দিয়েছে।

এই রাতে রাহুল আবার ওঠে। এবারে কেউ ডাকেনি। তবু তার ঘুম ভেঙে যায়।

দেয়ালের আলমারিটার সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায়। হঠাৎ খেয়াল করে, ছবিটা একটু বাঁকা হয়ে গেছে।

ঠিক করতে গিয়ে দেখতে পায়, ছবির পেছনে লেখা কিছু লাল কালিতে।
জিজি, তুই ফিরে আসিস না। পোলা তোকে ভুলে গেছে।”

ঘরের জানালার কাঁচে তখন হঠাৎ ঠক ঠক আওয়াজ।

রাহুল ঘুরে তাকায়।
সাদা শাড়ির একটা ছায়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে… হাত রাখছে কাঁচে… আর ঠোঁটে হাসি।
তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।

সে মুখ খুলে ধীরে ধীরে বলে—
তুই কি পোলা?”

অধ্যায় : কাঠের সাঁকোর নিচে

সকালবেলা রাহুল কিছু বলেনি কাউকে। রাতের ছায়া আর সেই কাঁচে ঠকঠক আওয়াজ—সবই যেন হ্যালুসিনেশন মনে হচ্ছিল। কিন্তু একটাই জিনিস ওকে চুপ করিয়ে রেখেছিল—ছবির পেছনের লাল লেখা।

ঋদ্ধি তখন বসে ডায়েরি পড়ছে। ঠাকুমার পুরনো লেখায় পাওয়া গেছে “জিজির ঘাট” নামের এক জায়গার উল্লেখ।
— “তুমি জানো এই সাঁকোর নিচেই নাকি জিজির শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল?” ঋদ্ধি বলল।
— “সাঁকোর নিচে?”
— “হ্যাঁ। ঠাকুমার লেখায় আছে—ঝরনার নিচে যে সাঁকোটা পচে গিয়েছে, ওখানেই গিয়েছিল জিজির শেষ নিশ্বাস।’

সকালের আলোয় চার বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে নামল সেই কাঠের সাঁকোর দিকে। এটা একটা পুরনো কাঠের ব্রিজ, অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছে। নিচে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝরনা। চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা, পাখির ডাক শোনা যায় না, কেবল ঝরনার নিরবচ্ছিন্ন গর্জন।

নয়না থেমে গেল মাঝপথে।
— “দেখছো? ওই জায়গাটায় একটা চিহ্ন?”

সাঁকোর কাঠে আঁকা একটা রক্তরঙের দাগ, যেন কারো আঙুলের ছাপ।
আর নিচের ঝরনার পাথরের উপর পড়া ছায়াগুলোর মধ্যে একটা যেন মানুষের অবয়ব।

— “কেউ কি এখনো এখানে আসে?” অর্ণব বলল।
— “গ্রামবাসীরা কেউই আসে না,” বলল ঋদ্ধি। “তারা ভাবে এটা অভিশপ্ত। তারা বলে, কেউ যদি রাতে এই সাঁকোর নিচে দাঁড়ায়, তবে তার ছায়া সে ফিরে পায় না।”

রাহুল তখন নিচে নেমে যায়, সাঁকোর ছায়ার দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ দেখে, নিজের ছায়া দু’দিকে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একটা ছায়া নড়ে, অন্যটা স্থির।

— “ঋদ্ধি… তুই দেখছিস?”
— “কি?”
— “আমার ছায়া…দুটো!”

ঋদ্ধি এগিয়ে আসতে না আসতেই হঠাৎ ঝরনার হাওয়া বেড়ে যায়। কুয়াশা ঘন হয়ে আসে। চারপাশ সাদা হয়ে যায়।

নয়নার কণ্ঠ ভেসে আসে,
— “কেউ… আমার নাম নিচ্ছে। নিচে থেকে। মেয়েটা। ও বলছে… পোলা…”

তখনই জোরে এক টান! নয়নার পা পিছলে যায় আর সে পড়ে যেতে বসে।

রাহুল দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে ফেলে। একটুর জন্য বেঁচে যায় নয়না।

আর তারপর, সাঁকোর নিচে ঝরনার কুয়াশার মধ্যে দেখা যায়—

একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে, পিঠের দিক ফিরে দাঁড়িয়ে। চুল খুলে রাখা, যেন জল ভেজানো। সে ধীরে ধীরে সাঁকোর নিচে ঝুঁকে একপাশে তাকায়।

তার ঠোঁট নাড়ছে।
তবুও কেউ কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না।

শুধু ঠোঁটের ভাঁজ থেকে বোঝা যায়—
তুই কি পোলা?”

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, সবাই নীরব। রাহুল আর নয়না কিছু না বলে সোজা ঘরে ফেরে।

ঋদ্ধি তখন ডায়েরির শেষ পাতাগুলো ঘাঁটছে। এক পৃষ্ঠায় খসখসে হাতে লেখা:

যদি কেউ পোলার নাম নেয়, তবে জিজি তাকে খুঁজে পায়। যদি কেউ তাকে ভালোবেসে ডাকে, তবে সে আর ফেলে আসে না। সে ছায়ার ভেতরে বন্দি করে রাখে।”

রাহুল আর একটা কথা না বলে নিজের ক্যামেরা নিয়ে বসে। আগের রাতের ছবি রিভিউ করতে গিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়।

একটা ছবিতে, ঘরের জানালার বাইরে, সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে—
স্পষ্ট মুখ দেখা যায় না।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ হলো… তার পাশে নয়নার মতো দেখতে আরেকটি মেয়ে।

আর ছবির নিচে অটো-ট্যাগ হয়েছে —
“two faces detected”

অধ্যায় : পুরনো মঠের নিচে

চুনাভাট্টি গ্রামের শেষ মাথায় একটা পুরনো বৌদ্ধ মঠ আছে—থমকা মঠ। ঝড়-বৃষ্টিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই মঠ এখন আর কেউ যায় না। কিন্তু ঋদ্ধি ঠিক করেছে, সে সেখানেই যাবে। কারণ ঠাকুমার ডায়েরিতে স্পষ্ট লেখা ছিল—

জিজির অন্তর্ধান মঠের নিচে কিছু লুকোনো সত্যের সঙ্গে যুক্ত। যদি কেউ সত্য জানতে চায়, তাকে ছায়ার নিচে নামতে হবে।”

সকালে যখন রাহুল, নয়না আর অর্ণব চা খেতে ব্যস্ত, ঋদ্ধি একা বেরিয়ে পড়ে। তার হাতে ঠাকুমার পুরনো নোটবুক, গলায় ঝোলানো একটা টর্চ আর পিঠে একটা ব্যাগ।

মঠে পৌঁছে সে দেখে, সবকিছু ভেঙে পড়েছে, একপাশে ছাদের অংশ নেই। তবু, মাঝে একটা পাথরের বেদি অক্ষত—তাতে খোদাই করা কয়েকটি অক্ষর:
জিজি-অং-পোলা-থুক”
সে বুঝতে পারে এটা স্থানীয় ভাষায় কিছু।

হঠাৎ সে খেয়াল করে, বেদির পাশে একটা সরু গর্ত। গর্তটা মেঝের নিচে চলে গেছে, আর বাতাসে একটা পুরনো গন্ধ—চুন আর পচা কাঠের।

ঝুঁকে দেখে টর্চ মারতেই দেখা যায়, নিচে সিঁড়ির মতো কিছু একটা।
সে নামা শুরু করে।

মঠের নিচে একটা ছোট চেম্বার। গায়ে আঁকা ছবি—সবটাই ফিকে।
কিন্তু দেয়ালের এক পাশে হালকা রঙে আঁকা:
একটা মেয়ে, সাদা শাড়ি পরে আছে, আর কোলে বসে আছে এক ছোট ছেলে।
ছেলের চোখে বন্ধ কাপড় বাঁধা।

আরেক পাশে দেখা যায়, কয়েকজন পুরুষ মশাল হাতে সেই মেয়েটিকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে।

— “জিজি…” ফিসফিস করে বলে ঋদ্ধি।

ঠিক তখনই তার কাঁধে যেন কারো ঠাণ্ডা স্পর্শ।
সে ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়—কেউ নেই।
কিন্তু বাতাস ভারি হয়ে গেছে। যেন ভূগর্ভে কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

দেয়ালের আরেকপ্রান্তে, ধুলোর নিচে লেখা:
আমার পোলা কাঁদে। আমি ফিরতে চাই।”

হঠাৎ, ঋদ্ধির ফোনের আলো নিভে যায়।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে টর্চটা বের করে চালু করে—ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে এক মেয়ের অবয়ব

সাদা কাপড়, ভেজা চুল।
চোখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ঠোঁট নাড়ছে।

— “তুই পোলা?”

ঋদ্ধি পেছনে হটতে গিয়ে একটা পাথরে হোঁচট খায়। মাটিতে পড়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে নোটবুকটা ছিটকে পড়ে।
জলভেজা বাতাসে সেই পাতাগুলো ওড়াউড়ি করতে থাকে।

মেয়েটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।

ঋদ্ধি কান্না জড়ানো গলায় বলে,
— “আমি পোলা না। আমি ঋদ্ধি। কিন্তু আমি জানি তোর কথা। আমি বিশ্বাস করি তুই অন্যায়ভাবে মরেছিস।”

এক মুহূর্ত যেন থেমে যায় বাতাস।

মেয়েটি আর এগোয় না। কুয়াশার মতো গলে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকারে।

ঋদ্ধি ফিরে আসে উপরে। ততক্ষণে বিকেল নেমেছে। সবাই ওকে খুঁজে ব্যস্ত। নয়না দেখে ঋদ্ধির চোখ লাল, মুখে ধুলো, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

— “তুই কি দেখলি?”
— “জিজিকে। ও… এখনো কারো অপেক্ষায় আছে। কেউ যদি তাকে তার ‘পোলা’ বলে স্বীকৃতি দেয়, তবে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু…”

— “কিন্তু কি?”

ঋদ্ধি চুপ করে। তারপর বলে—
— “তবে সে তার পোলাকে ছাড়বে না।”

রাহুল তখন ব্যাগ থেকে নিজের ক্যামেরা বের করে। ছবির মধ্যে আরও অদ্ভুত কিছু ধরা পড়েছে। এক ছবিতে দেখা যাচ্ছে নয়নার মুখ, কিন্তু আয়নায় তার প্রতিবিম্ব নেই।

আর একটা ছবিতে চার বন্ধুর একটি গ্রুপশট—কিন্তু সেখানে পাঁচটি অবয়ব

পঞ্চম মুখটা অস্পষ্ট, কিন্তু মেয়েলি। ঠোঁটে হালকা হাসি, চুল ভেজা, চোখ অদৃশ্য।

অধ্যায় : পোলার ছায়া

রাত দশটা পেরিয়েছে। বাতাস ঠান্ডা, জানালার কাঁচ জুড়ে জমে আছে শিশির। ঘরের ভেতর চারজন একসাথে বসে, কিন্তু কথা নেই কারো মুখে। কেবল রাহুলের ক্যামেরায় ধরা সেই অদ্ভুত মুখটা সবার মনে ভয়ের ছায়া ফেলেছে।

অর্ণব ধীরে ধীরে বলে,
— “ছবিটা এডিটেড নয়, নিশ্চিত? কিছু গ্লিচ?”
রাহুল মাথা নাড়ে, “না। আমি শপথ করে বলতে পারি, আমি পাঁচ নম্বর কাউকে সামনে পাইনি।”

ঋদ্ধি মুখ গম্ভীর করে বলে,
— “ও আমাদের সাথে হাঁটছে। কিন্তু একজনের শরীরের ভেতরে ঢুকেই।”

সবাই একসাথে নয়নার দিকে তাকায়।

নয়না তখন ঘরের একপাশে বসে, চুপচাপ। হাতে ধরা পুরনো একটা গজ কাপড়—যেটা সে সকালে পেয়েছিল বাঁশবনের পাশে একটা ঝোপের নিচে।

— “এটা কোথা থেকে পেয়েছিস?” রাহুল প্রশ্ন করে।
— “এটা আমার না,” নয়না ধীরে বলে। “কিন্তু আজকে বিকেলে ঘরের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কারণ… আয়নাতে আমি হাসছিলাম, অথচ আমি হাসিনি।”

ঋদ্ধির মুখ সাদা হয়ে যায়।

রাত গভীর হতে থাকে। হঠাৎ নয়নার মুখে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, আর এক আশ্চর্য মায়াবী গলায় সে বলে ওঠে—
তুই কি পোলা?”

রাহুল উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “নয়না! এটা কী করছিস?”
কিন্তু নয়নার চোখ দুটো এখন অদ্ভুতভাবে স্থির, ঠাণ্ডা।

— “তুই আমায় ভুলে গেলি রে? আমি তোকে পাহাড়ি কুয়াশায় বুকে করে রেখেছিলাম। তুই আমায় খুঁজলি না।”

অর্ণব পেছনে সরে গিয়ে কাঁপা গলায় বলে, “এটা নয়না না, এটা জিজি…”

ঋদ্ধি তখন নিজের ঠাকুমার ডায়েরি খুলে পড়ে।
যদি জিজি কারও দেহে আশ্রয় নেয়, তবে তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে ছায়ার উৎসে যেতে হবে। যেখানে সে প্রথম ‘পোলা’ বলে ডেকেছিল। যেদিন সে মরেছিল, ঠিক সেদিনের সেই রাতে।”

ঋদ্ধি বলে,
— “আজই সেই রাত। আজ থেকে অনেক বছর আগে এই রাতেই জিজিকে খুন করা হয়। আমাদের ফিরতে হবে সেই বটগাছটার কাছে। এখনই।”

রাহুল তখন নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
— “তুই নয়না না। আমি জানি। কিন্তু তুই যা খুঁজছিস, সেটা আমি দিতে পারব না। আমি তোর পোলা না।”

জিজির মুখে তখন একটা অদ্ভুত হাসি।
সে ধীরে ধীরে বলে,
— “তুই আমায় ফেরত দিবি না? তাহলে তুই আমার ছায়া হবি। চিরকাল আমার পাশে থাকবি।”

এক ঝলক বাতাস ঘরের কপাট খুলে দেয়।

জিজি—অর্থাৎ নয়নার শরীরে বসবাসকারী সেই আত্মা—হাঁটতে থাকে দরজার দিকে।

রাহুল, ঋদ্ধি, অর্ণব — তিনজনই পেছনে ছুটে যায়।

সবার গন্তব্য এখন সেই পুরনো বটগাছ, যেখানে জিজির কাটা শরীর একদিন শুয়ে ছিল।

ঘন কুয়াশার মধ্যে চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু ঝরনার গর্জন আর দূরে রাতজাগা ঝিঁঝিঁর ডাক।

বটগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেই নয়না হঠাৎ থেমে যায়।

সে চিৎকার করে বলে ওঠে—
আমি জিজি! আমি ফিরে এসেছি! আমার পোলা কই?”

তার চোখ থেকে কান্না পড়ছে, কিন্তু মুখে আগুনের মতো তীব্রতা।
রাহুল সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে,
— “তোর পোলা এই দুনিয়ায় নেই। তুই ভুল করিসনি জিজি। অন্যরা করেছিল। তুই শান্তি পেতে পারিস।”

ঋদ্ধি তখন ডায়েরির শেষ পাতাটি খুলে আগুনে ছুঁড়ে দেয়।
সেই পাতার আগুন আলো ফেলে বটগাছের গায়ে, আর সেখানে দেখা যায় জিজির নাম, রক্তে লেখা সেই দিন।

জিজি ধীরে ধীরে পেছন হটে, নয়নার শরীর থেকে যেন এক কুয়াশা বেরিয়ে আসে। বাতাসে ভেসে গিয়ে মিলিয়ে যায় পাহাড়ি রাতের অন্ধকারে।

নয়না পড়ে যায় মাটিতে।

সবাই ছুটে আসে।

— “নয়না!”

সে চোখ মেলে বলে,
— “আমি… আমি কোথায় ছিলাম এতক্ষণ?”

অধ্যায় : ছায়ার উৎস

পাহাড়ি সকাল। সূর্যের আলো কুয়াশার পর্দা ভেদ করে আস্তে আস্তে চুনাভাট্টি গ্রামে ঢুকছে। আগের রাতের ভয়াবহতা যেন সবাইকে নিঃশব্দ করে দিয়েছে।

নয়না এখনও দুর্বল। তার চোখে প্রশ্ন, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
রাহুল তার পাশে বসে বলে,
— “তুই ঠিক আছিস?”
— “মনে হচ্ছে অনেক দূর কোথাও ছিলাম… একটা সাদা ঘর, জানালা নেই, আলো নেই। শুধু একটা মেয়ে কাঁদছিল। বারবার বলছিল, ‘আমার পোলা কেন আসছে না?’”

ঋদ্ধি তখন ঠাকুমার ডায়েরির সবচেয়ে পুরনো পাতাগুলো পড়ে। হঠাৎ সে থমকে যায়।

— “দেখো এটা,” সে বলে।
পাতাটিতে একটা নাম লেখা — পোলার নামঃ অনন্ত লামা। জন্ম সাল ১৯৬৯।”
তার পাশে লেখা,
জিজির মৃত্যুর দু’বছর পর, চুনাভাট্টি ছেড়ে চলে যায়। এরপর আর কেউ তাকে দেখেনি।”

রাহুল বলে,
— “তাহলে সে বেঁচে ছিল?”
— “হ্যাঁ। এবং হয়তো এখনো বেঁচে আছে। যদি কোথাও থাকে… তবে তাকে খুঁজে পেতে হবে।”

ঋদ্ধি জানায়, ঠাকুমা লিখেছিলেন অনন্ত চলে গিয়েছিল তিনচুলে গ্রামে, যেখানে সে এক বৌদ্ধ আশ্রমে আশ্রয় নেয়।

চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নেয়—তারা আজই বেরিয়ে পড়বে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে, পায়ে হেঁটে পৌঁছোতে হবে তিনচুলে।

দুপুরের পরে

তিনচুলে পৌঁছে তারা খোঁজ করে করে পায় বিষ্ণু আশ্রম নামের এক পুরনো মঠ। এক বয়স্ক ভিক্ষু বলেন,
— “অনন্ত লামা? হ্যাঁ, ছিলেন একসময়। খুব চুপচাপ ছেলে ছিল। কিন্তু একদিন গভীর রাতে চলে যান। কোনো নোট রাখেননি। আমরা পরে জানতে পারি তিনি একা একা পাহাড়ি অরণ্যে ঘর বেঁধেছিলেন। এক জায়গায়, যেটা এখন ‘ছায়ার পাথর’ নামে পরিচিত।”

ঋদ্ধি ভাবে—ছায়ার পাথর? হয়তো এখানেই জিজি তার ভাইয়ের ছায়া দেখতে পেত।

ভিক্ষু তাদের পথ দেখিয়ে দেন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে, ঝোপঝাড় আর মাটির পথের শেষে, তারা পৌঁছোয় একটা সমতল পাথরের কাছে। চারপাশে বুনো গাছ আর পাখিদের কিচিরমিচির নেই—অস্বাভাবিক নীরবতা।

পাথরের পাশে একটা কুঁড়েঘর। সামনে ধূপকাঠি জ্বলছে।

তারা এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়।

একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দাঁড়ায়—চোখে পুরু চশমা, কপালে ভাঁজ, চুল সাদা।

ঋদ্ধি বলে,
— “আপনি অনন্ত লামা?”
লোকটি চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ।”

নয়না এগিয়ে গিয়ে বলে,
— “জিজি… আপনার দিদি… তিনি এখনো আপনাকে খোঁজেন।”

লোকটির চোখ জলে ভরে ওঠে।
— “আমি তার ডাকে ভয় পেতাম। আমি জানতাম না সে ফিরবে। আমি ছোট ছিলাম… দিদির মৃত্যুর পর আমি পালিয়ে যাই। ভেবেছিলাম ভুলে যাবো। কিন্তু পারিনি।”

রাহুল বলে,
— “এখনো সময় আছে। তাকে মুক্তি দিতে হবে। আজ রাতে আপনাকে ফিরতে হবে সেই বটগাছের নিচে।”

অনন্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
— “তাহলে চলো।”

রাত

পাহাড়ি বটগাছের নিচে পাঁচজন দাঁড়িয়ে। বাতাস নিস্তব্ধ।
অনন্ত মাটিতে বসে ধ্যান করে।

অন্ধকারে হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে। কুয়াশা ঘন হয়ে আসে।

ঝরনার শব্দের ভেতর থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর—
পোলা… তুই কি এলি?”

অনন্ত চোখ খুলে বলে,
— “হ্যাঁ, দিদি। আমি এলাম। তুই এখন মুক্ত হ। আমি তোর ভাই। আমি ভীত ছিলাম, কিন্তু তোর ভালোবাসা আমি ভুলিনি।”

একটা ছায়া ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ায়।
সাদা কাপড় পরা, মুখে শান্তির ছায়া। সে হাত বাড়িয়ে দেয়।

অনন্ত হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় সেই ছায়াকে।
আর পরক্ষণেই… হাওয়ার ভেতরে মিলিয়ে যায় সেই অবয়ব। বাতাস হালকা হয়। কুয়াশা সরে যায়।

আর ঘাসের ওপর লেখা থাকে, শিশিরে গড়া শেষ শব্দ—
তুই আমার পোলা। এখন আমি শান্ত।”

অধ্যায় : ফিরে দেখা

চুনাভাট্টি গ্রামের আকাশে আজ নতুন আলো। সকালের রোদে কুয়াশা নেই, যেন কেউ পর্দা সরিয়ে দিয়েছে পাহাড়ের মুখ থেকে।

ঘরের বারান্দায় চারজন বসে আছে—নয়না, রাহুল, ঋদ্ধি আর অর্ণব। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনন্ত লামা, শান্ত, স্থির, যেন কিছু একটা ছেড়ে এসেছেন বহুবছরের ভারের মতো।

নয়না প্রথম কথা বলে।
— “আমার এখনো মনে হচ্ছে কিছু একটা থেকে গেছে… যেন জিজি পুরোপুরি যায়নি।”

রাহুল হালকা হেসে বলে,
— “হয়তো কিছু ভালোবাসা থেকে যায়। একটা কান্না হয়তো নিঃশব্দেই রয়ে যায় আমাদের ভেতরে।”

ঋদ্ধি ডায়েরির শেষ পাতায় লিখছে। পাতাটা শিরোনামহীন।

— “কি লিখছিস?” জিজ্ঞেস করে অর্ণব।

— “এই সফরের কথা। কিন্তু শুধু ভূতের নয়—আমাদের ভেতরের ছায়াগুলোর কথাও। আমরা সবাই কিছু ভুল, কিছু ভয়, কিছু অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকি। আর মাঝে মাঝে… একটা ডাক শুনতে পাই।”

নয়না বলে,
— “আমি জানি, জিজি সত্যিই আমাকে ছুঁয়েছিল। কিন্তু এখন তার মুখটা মনে পড়লে ভয় নয়, মমতা লাগে। সে শুধু খুঁজছিল ভালোবাসা।”

অনন্ত হেঁটে আসে সামনে। তার হাতে একটা ছোট কাঠের পুতুল—একটা মেয়ে আর একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় খোদাই করা।

— “জিজি আমাকে ছোটবেলায় এটা দিয়েছিল। আমি রেখে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে এটা তার সবথেকে প্রিয় জিনিস ছিল।”

সে পুতুলটা নয়নার হাতে দিয়ে বলে,
— “তুমি যদি কখনো আবার শুনো… ‘পোলা’ বলে কেউ ডাকছে, বুঝে নিও ও একা নয়।”

বিকেলে তারা ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। গাড়িতে বসে পাহাড়ি রাস্তায় নামার সময় রাহুল বলে,
— “এই সফরটা জীবন পাল্টে দিল।”
— “হ্যাঁ,” উত্তর দেয় ঋদ্ধি, “কেবল ভূতের গল্প নয়, আত্মার গল্প হয়ে গেল এটা।”

পাহাড় পেছনে ফেলে শহরের দিকে ফিরতে ফিরতে নয়না জানালার পাশে বসে।

সে হঠাৎ হেসে বলে,
— “জানো, আমার কানে আবার সেই ডাকটা এসেছিল রওনা দেবার আগে। খুব আস্তে, কিন্তু এবার অন্যরকম… যেন বিদায় জানানো ডাক।”

— “কি বলছিল?”

নয়না চোখ বুজে ফিসফিস করে বলে,
থ্যাঙ্ক ইউ, পোলা।”

অধ্যায় : জিজির ঘর

এক বছর পর
আবারও বর্ষার শেষে পাহাড়ে ঠান্ডা নেমেছে। আকাশে সোনালি আলো ফোটে মাঝে মাঝে, আবার ঝেঁপে নামে ধোঁয়ামোড়া বৃষ্টি।
চুনাভাট্টির সেই পুরনো স্কুলঘরের সামনে এবার একজন নতুন মানুষ দাঁড়িয়ে।

তার নাম ইরা ঘোষ — কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্য গবেষক। পাহাড়ি আত্মকথা ও প্রেতকাহিনির সংকলন করতে এসেছে সে। এক বছর আগের সেই ঘটনার কথা বইয়ে পড়েছিল—”Jiji Polar Daak – The Mountain That Called Twice”।

পাণ্ডুলিপির লেখক: ঋদ্ধি সেন।

স্কুলঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ইরা। ঘরটা পরিষ্কার, কিন্তু পুরনো গন্ধটা আজও রয়ে গেছে। একটা কাঠের আলমারির ওপর রাখা একটি ছোট কাঠের পুতুল দেখে সে থেমে যায়। মেয়ে আর ছেলে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরা।

তার নীচে একটা কাগজ, যেখানে লেখা:
ভালোবাসা কভু অশরীর হয় না। শুধু রূপ বদলায়।”
নয়না রায়

ইরা বুঝতে পারে, এই জায়গা কেবল একটা প্রেতকাহিনির কেন্দ্র নয়, বরং একটা অসমাপ্ত সম্পর্কের পরিণতি।

ঘর থেকে বেরিয়ে ইরা হেঁটে যায় সেই পুরনো বটগাছের দিকে। কুয়াশা আজও আছে, ঝরনার শব্দও আছে, কিন্তু বাতাসে নেই সেই ভারী আতঙ্ক।

বরং বাতাসে যেন মিষ্টি একটা সুর ভেসে আসে।
কেউ যেন বুলিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের গায়ে।

ঠিক বটগাছের নিচে পৌঁছতেই ইরার চোখে পড়ে মাটিতে কিছু শিশির জমা শব্দ—
থ্যাঙ্ক ইউ, দিদি।”

সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে জল এসে যায়।
সে বুঝে যায়—প্রেম, দুঃখ আর প্রেতাত্মা সবকিছুই মিলে মিশে গেছে এই জায়গার মাটিতে।

তার পায়ের কাছে একটা সাদা ফুল।
সে ফুলটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
— “তোমার গল্প আমি বলব, জিজি। এবার আর তুমিই একা নও।”

পাহাড়ের ছায়া তখন ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে থাকে।
আকাশের কোণে যেন এক মেয়ের মুখ, শান্ত, হাসিমুখে পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে।

সেই দৃষ্টিতে ভয় নেই, আছে শুধু একটুকরো শান্তি।
আর পাহাড়ের বাতাসে ভেসে আসে শেষবারের মতো সেই গলা—

পোলা…”

সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-06-18-at-1.52.48-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *